যা দেখি, যা শুনি – ২৫

প্রথম বার প্রথম শোনা গানের রোমাঞ্চ স্মৃতি

একটা যোলো-সতেরো বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে একতলা আর দোতলার সিঁড়ির মাঝখানে। দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক পরিবার, একতলায় দু’ঘর ভাড়াটে। উত্তর কলকাতায়। ওপর তলায় রেডিয়ো আছে। ট্রানজিস্টর রেডিয়ো আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত রেডিয়ো ছিল বেশ দামি জিনিস, আর্থিক সচ্ছলতার চিহ্নই ছিল বাড়িতে রেডিয়ো ও টেলিফোন থাকা। রেডিয়োর জন্য ছাদে টাঙানো থাকত এরিয়াল, অর্থাৎ দূর থেকেই বোঝা যেত, কোন বাড়িতে আছে রেডিয়ো। তখন রেডিয়ো ছিল দু’রকম, একটিতে স্থানীয় অনুষ্ঠান শোনা যেত, আর একটি অল ওয়েভ, সেটি বেশ সুদৃশ্য একটা যন্ত্র, দেখলেই বেশ ভক্তিশ্রদ্ধা হয়, তাতে দেশবিদেশের অনুষ্ঠান ধরা যায়।

ওপর তলায় রেডিয়ো বাজছে, ভাড়াটেদের ছেলেটির যখন তখন সেখানে যাবার অধিকার নেই, তাই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, সদ্য সন্ধেবেলায় গান শুনছে। শুনছে মানে কি, প্রবল তৃষ্ণার্তের মতন সে সেই সংগীতসুধা পান করছে। সেই বয়েসে, এক-একটি রবীন্দ্রসংগীত প্রথম বার শোনার যে অভিজ্ঞতা, তার যে রোমাঞ্চ, তা অন্য কেউ বুঝবে না। গান গাইছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক তরুণী, ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালবাসায় ভোলাব’। বিশেষত প্রেমের গানে তাঁর সমস্ত মর্ম যেন নিবেদিত হয়। রেডিয়োর মালিকপক্ষের কেউ গানটার মাঝখানে পট করে বন্ধ করে দিল। ছেলেটির মনে হল, তার বুকে যেন কেউ হঠাৎ গুলি করেছে। সে সত্যি সত্যি এক আহত কিশোরের মতন সেই প্রায়ান্ধকার সিঁড়িতে বসে রইল কিছুক্ষণ।

বলাই বাহুল্য, সেই কিশোরটিই আমি। গানটা মাঝপথে বন্ধ করে দিয়ে বাড়িওয়ালারা আসলে আমার বেশ উপকারই করেছিলেন। গানটা আমার বুকের মধ্যে সারা জীবনের মতো একেবারে গেঁথে যায়, পরের তিন-চার দিন আমি সব সময় গানটির প্রথম কয়েকটি পঙ্‌ক্তি নিঃশব্দে গেয়েছি, আর ‘জানবে না কেউ কোন তুফানে’র পরের লাইনগুলি শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি।

তখন গান শোনার দুটি উপায়। রেডিয়ো অথবা গ্রামোফোন। রেকর্ড প্রথার কত বিবর্তন ঘটে গেল এর মধ্যে। আমাদের বাল্যকালে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে গ্রামোফোন ছিল এক আশ্চর্য বস্তু। তারা মনে করত, চোঙের মধ্য দিয়ে সত্যি সত্যি কেউ গান গায়। গ্রামে থাকার সময় শিশুকালে আমারও দু’এক বার এ রকম ধন্দ লেগেছিল। তখন রেকর্ড ছিল, আটাত্তর আর পি এম, তাতে এক পিঠে একখানা গান। তার পর পঁয়তাল্লিশ আর পি এম, তাতে গান দু’খানা। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এ সব রেকর্ডই শুনেছেন, তাঁর একটা গান আছে, ‘বান্ধবীকে গান শোনাতে ডাকতে হয় সতীশকে/হৃদয়খানা ঘুরে মরে গ্রামাফোনের ডিস্কে…’। আমাদের যৌবনকালেই বেরোল লং প্লেয়িং রেকর্ড, একসঙ্গে অনেক গান। তখন মনে হয়েছিল এ যেন উন্নতির পরাকাষ্ঠা। আমাদের বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল না, অন্য কোনও বাড়িতে ওই একখানা লং প্লেয়িং রেকর্ড হাতে নিলেই রোমাঞ্চ হত। এখন সেই সব রেকর্ড রাস্তায় ফেলে দিলেও নেওয়ার লোক নেই, কারণ বাজাবার যন্ত্র যদি বা কারও বাড়িতে থেকেও থাকে, কিন্তু পিন পাওয়া যায় না। কিছু দিন ওই রেকর্ড ভেঙে বাচ্চাদের খেলনা বানানো হয়েছে।

তার পর এল ক্যাসেট প্লেয়ার। তখনই গান শোনার সুযোগ এসে গেল আমজনতার কাছে। ওই যন্ত্র বা ক্যাসেটের দাম মধ্যবিত্তের সাধের মধ্যে। তখনই বাংলা গান অনেকের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। তার আগে রবীন্দ্রসংগীতের একটা সম্মানের জায়গা ছিল ঠিকই, উচ্চ বিদ্বজ্জন মহলে এ গান শোনা বা শেখার চল ছিল, কিন্তু মোটেই জনপ্রিয় ছিল না। বরং অনেকে বলত রবীন্দ্রসংগীত ন্যাকা-ন্যাকা গান, কোনও এক জন বিশিষ্ট গায়ক সম্পর্কে বলা হত, ওঁর গান শুনলেই ঘুম পেয়ে যায়, উনিও তো গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়েন!

ক্যাসেট প্লেয়ার প্রচলনের কিছু দিনের মধ্যেই এসে গেল একটা অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার, টু-ইন ওয়ান, অর্থাৎ একই যন্ত্রে ইচ্ছে মতন রেডিয়ো শোনা, অথবা ক্যাসেটে পছন্দ মতন গান। এই সময় আমার একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়। আমি আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে মেদিনীপুরের গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলাম। মেদিনীপুরের প্রায় কোনও বাড়িতেই বাথরুম বা টয়লেটের বালাই নেই, এমনকী মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারেও পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে ওই কর্মটি সারতে যায় মাঠে-ঘাটে নদীর ধারে। (আহা, এখন হয়তো অনেক বাড়িতে হয়েছে মেদিনীপুরেও, তখন ছিল না।)

মহিলারা যেতেন ভোর হওয়ার আগে বা সন্ধ্যায়, আর পুরুষরা যখন তখন ঝোপঝাড়ের আড়াল খুঁজে বসে পড়তেন, কাছাকাছি কোনও মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলে গলা খাঁকারি দিতেন। (শক্তি ও রকম গলা খাঁকারির আওয়াজ শুনে এক জনকে বলেছিল, কী গলায় আটকে গেল নাকি?) কয়েকটি গ্রামে দেখেছি এ ব্যবস্থার পরিবর্তন। কোনও ব্যক্তি উক্ত প্রয়োজনীয় কাজটি সারতে মাঠে যাওয়ার সময় এক হাতে নিতেন জলভর্তি গাডু, অন্য হাতে একটি ক্যাসেট প্লেয়ার বা টু-ইন ওয়ান! ঝোপের আড়ালে গান বাজলেই বোঝা যাবে যে ও দিকে যাওয়া চলবে না।

এখন ও-সব ক্যাসেট প্লেয়ারটেয়ারও বাতিল হয়ে গেছে। এসে গেছে সি ডি কিংবা ডি ভি ডি-র যুগ। (এদের পুরো নাম যে কী, তা আমি জানি না। ইদানীং অ্যাব্রিভিয়েশনের উৎপাত খুব বেড়েছে, এ বি সি ডি; আই জে কে এল; কিংবা ডব্লু এক্স ওয়াই জেড বলতে যে কী বোঝায়, তা মানুষ জানবে কী করে?) টি ভি এসে রেডিয়ো’কে কোণঠাসা করে দিয়েছে, ডি ভি ডি খুবই সস্তা, অনেক জায়গায় কোনও কিছুর সঙ্গে বিনা পয়সাতেও পাওয়া যায়। গান শুনতে চাইলে এখন আর সুযোগের অভাব নেই।

ধান ভানতে শিবের গীতের মতন আমার প্রথম একটি রবীন্দ্রসংগীত শোনার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে একটা ছোটখাটো ইতিহাস চলে এল। আমি মনে করছিলাম, আমার এক একটি রবীন্দ্রসংগীত শোনার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা। সেই গান পরে অনেক বার শুনেছি, কিন্তু প্রথম বারের স্মৃতি মনের মধ্যে অতি উজ্জ্বল ভাবে জাগরুক।

সুহৃদ রুদ্র আর পরিমল চন্দ নামে দুই ভদ্রলোক ষাটের দশকে শুরু করলেন নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসংগীত উৎসব (নামটা ঠিক মনে নেই), সেটা আমাদের শহরের সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এখন চতুর্দিকে গানবাজনার এত রমরমা, তাই সেই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব হয়তো ঠিক বোঝা যাবে না, সারা বছর আমরা সেই উৎসবের জন্য উৎসুক হয়ে থাকতাম। প্রথম দিকে এই অনুষ্ঠান হত মহাজাতি সদনে, আমরা তরুণ কবির দল গিয়ে ভিড় জমাতাম সেখানে। কত বড় বড় গায়িকা-গায়করা আসতেন, তার মধ্যেও এক বার একটি বারো-তেরো বছরের বাচ্চা মেয়ের গান আর সবাইকে ভুলিয়ে দিল। ‘হ্যাদে গো নন্দরাণী, আমাদের শ্যামকে ছেড়ে দাও’ গেয়েছিল ঋতু গুহঠাকুরতা, সেই দিনটিতে শোনা সেই গানটি আজও কানে বাজে। পরবর্তী কালে এই গায়িকার সঙ্গে বিখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব গুহ-র বিবাহ হওয়ার পর ঋতু শুধু তাঁর পদবিটি সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন।

দেবব্রত বিশ্বাস কাজ করতেন একটা ইনশিয়োরেন্স কোম্পানিতে। আমার বাবার প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার জন্য হিন্দুস্থান বিল্ডিংয়ের অফিসে গিয়ে তাঁকে অনেক বারই দেখেছি। বিভিন্ন কাউন্টারে ঘুরে ঘুরে রশিদে সই করতেন। আবার অন্য সময়ে তাঁকে দেখেছি মোটরবাইক চালিয়ে ঘুরতে, তখন তাঁকে বেশ বীরপুরুষ মনে হত। (মোটরসাইকেল আরোহী সবার মধ্যেই বেশ একটা হিরো-হিরো ভাব এসে যায়।) আবার, কোনও কোনও সকালে তাঁকে দেখা যেত একটা লুঙ্গি আর গেরুয়া ফতুয়া পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুখভর্তি পান, তাঁকে চেনার কোনও উপায়ই থাকত না। এক দিন সকালে এক জন যুবতী একা একা ওই অঞ্চলে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। এ রকম অনেকেই গাড়ি চালাতে শিখে নেয়, কিন্তু গাড়ির কলকব্জা বিষয়ে প্রায় কিছুই জানে না। হুডটা খুলে তিনি অসহায় ভাবে এ দিক ও দিক তাকাচ্ছেন, দেবব্রত বিশ্বাস কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হইসে? মহিলাটি খানিকটা অসহিষ্ণু ভাবে বলেন, যা-ই হোক না কেন, তুমি কি মেকানিক? দেবব্রত বললেন, দেখি চেষ্টা কইরা। তিনি একটুক্ষণ খুঁট-খুঁট করলেন, খুব সম্ভবত একটা প্লাগ খুলে গিয়েছিল, তিনি সেটা জুড়ে দিতেই ইঞ্জিন আবার প্রাণ ফিরে পেল। দেবব্রত বিশ্বাসের ওই তো সামান্য পোশাক, চেহারাও অনিন্দ্যকান্তি বলা যায় না, তাই মহিলাটি তাঁকে ধন্যবাদ জানাবার প্রয়োজন বোধ না করে একটি দশ টাকার নোট এগিয়ে দিলেন। আর তখনকার রবীন্দ্রসংগীতের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরুষ গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস সেই দশ টাকা নিয়ে বললেন, নমস্কার মা জননী! এর কয়েক সপ্তাহ পরে সেই মহিলা গেলেন দেবব্রত বিশ্বাসের গানের ইস্কুলে ভর্তি হতে। সেখানে সেই গেরুয়া ফতুয়া পরা মেকানিকটিকে দেখে তাঁর ‘ধরণী দ্বিধা হও’ অবস্থা।

দেবব্রত বিশ্বাসের গান শোনা সহজ ছিল। তিনি মাঠে ময়দানে বামপন্থীদের জনসভায় গান গাইতেন। তবে সে সব গান দেশাত্মবোধক কিংবা প্রতিবাদের গান। এক বার মনুমেন্টের পাদদেশে এক সভায় তিনি হঠাৎ গাইলেন, আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী। উদাত্ত গলায় সে কী অসাধারণ গান, প্রথম বার শুনেছি বলে আমার সারা গায়ে শিহরন হয়েছিল।

দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে সন্তোষকুমার ঘোষের মনোমালিন্যের কথা অনেকে জানে। এখনকার ‘রুদ্ধসংগীত’ নাটকেও সে প্রসঙ্গ এসেছে। রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার এবং ইচ্ছেমতন লয় কমানো-বাড়ানো নিয়ে সন্তোষকুমারের সঙ্গে মতভেদ হয়েছিল, ক্রমে তা তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছিল। কোনও গানের আসরে দেবব্রত বিশ্বাস ঘোষণা করতেন, এখানে কি সন্তোষকুমার ঘোষ মশাই আছেন নাকি? থাকলে আমি গান করুম না।

আমি তখন সন্তোষকুমার ঘোষের সাক্ষাৎ অধীনে আনন্দবাজারের কর্মী। তবু আমি সন্তোষকুমারের কোনও শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সমর্থন করতে পারিনি, আমাদের ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় সন্তোষকুমারের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। কিন্তু এত দিন পর আমার মনে হচ্ছে, লোকে ওই ঘটনার কথা জানে, কিন্তু সন্তোষকুমারের প্রকৃত পরিচয় বোধহয় জানে না বা ভুলে গেছে। সন্তোষকুমার ছিলেন এক বিচিত্র মানুষ। ছোটখাটো চেহারা, ছটফটে, অসাধারণ স্মৃতিশক্তিধর এবং মাঝে মাঝে বদমেজাজি। ‘কিনু গোয়ালার গলি’ কিংবা ‘শ্রীচরণেষু মা-কে’র মতন উপন্যাস এবং বেশ কিছু অসাধারণ ছোট গল্পের স্রষ্টা এই সন্তোষকুমার তাঁর লেখকসত্তা প্রায় বিসর্জন দিয়েছিলেন খবরের কাগজের জন্য। মাঝে মাঝেই সকাল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত তিনি থাকতেন আনন্দবাজার অফিসে, একই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রের (হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড) নিউজ এডিটর। ভূ-ভারতে এমন দৃষ্টান্ত বোধহয় আর নেই। অত পরিশ্রম ও মেধার বিনিময়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আনন্দবাজারের সর্বেসর্বা, প্রভূত ক্ষমতাবান। সে যা-ই হোক, সন্তোষকুমারের একটা অন্য পরিচয় অনেকের জানা নেই। গলায় একটুও সুর নেই, কিন্তু তীব্র ভাবে ভালবাসতেন গান, বিশেষত রবীন্দ্রসংগীত। অন্তত হাজার খানেক গান তার মুখস্থ। কেউ কোনও গান ভুল গাইলে তাঁর গায়ে যেন ফোসকা পড়ত। কেউ স্বরলিপি থেকে একটুও সরে গেলে তিনি ধরে ফেলতেন। রবীন্দ্রসংগীতের শব্দ-ব্যবহার নিয়ে তিনি আমাকে একটা বই লেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমি সে কাজ পারিনি। এমন ব্যস্ত এক জন মানুষ, তিনি দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে। দেবব্রত বিশ্বাসকে যিনি সমালোচনায় আক্রমণ করেছিলেন, সেই সন্তোষকুমার আনন্দবাজারের উচ্চ পদাধিকারী হিসেবে নন, রবীন্দ্রসংগীতের এক জন ভক্ত ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে। দু’জনে মতভেদ তো হতেই পারে। তবে, সন্তোষকুমার কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন তা-ও ঠিক।

দেবব্রত বিশ্বাসের এক ছাত্রীর নাম আমিনা বিবি। ওটা তার আসল নাম নয়। অতি লাজুক সে। ক্লাসের মধ্যে দেবব্রত তাঁকে একলা কোনও একটা গান গাইতে বললেই মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে বলত, আমি না, আমি না। তাই দেবব্রত তার ওই নাম দিয়েছিলেন। ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার সখ্য হয়। সেই কারণে তার গান শেখারও ক্ষতি হয়। সে যা-ই হোক, তখন একসঙ্গে দু’জনে ঘোরাঘুরি চলছে, এক সন্ধেবেলা আমার অনেক অনুরোধে সে একটা গান শোনাতে রাজি হল নিচু গলায়। আশ্চর্য ব্যাপার, রবীন্দ্রসংগীতের ছাত্রী, কিন্তু আমাকে সে শোনাল একটি অতুলপ্রসাদের গান; ‘শ্রাবণ ঝুলাতে বাদল রাতে/তোরা আয় গো কে দুলিবি আয়।’

তখন আমাদের দু’জনেরই শরীর ও মন ফুর্তিময়, তবু এই গানটায় কেমন একটা করুণ সুর আছে না? ওই গানটি সে দিনই আমার প্রথম শোনা। ওতে একটি লাইন আছে, ‘ওগো সুখী দুখী, দাঁড়া মুখোমুখি।’ আমাদের বিয়ের অত আগেই স্বাতী কি করে বুঝেছিল যে, সারা জীবনে আমাদের মাঝে মাঝেই সুখী-দুখী হয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে?

৫. ১০. ২০১১

‘আমাদের’ শব্দটির যে অর্থ অভিধানে নেই

সদ্য অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বইমেলায় অন্যান্যদের সঙ্গে এক জায়গায় বসে আছি। একজন কিছুটা মলিন পোশাকের মাঝবয়সের মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। সে আসলে কিছু বলতে চায় অথচ বলতে পারছে না বুঝে, আমি তার দিকে মুখ ফিরিয়ে ভুরু নাচালাম। সে প্রায় সারা শরীর মুচড়িয়ে অতি বিনীত ভাবে বলল, স্যর, যদি কিছু মনে না-করেন, আপনার সঙ্গে তো অনেকের চেনাশোনা, সিরাজগঞ্জ থেকে কেউ এসেছে কি না, আপনি দয়া করে জেনে দেবেন?

বাংলাদেশের এই বইমেলায় গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় সে দেশের বেশ কিছু প্রকাশক বইয়ের সম্ভার সাজিয়ে বসেছেন। সেখানে লেখক, প্রকাশক, ক্রেতা ও পাঠকদেরই সমাবেশ। দূতাবাসের কোনও অফিসারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব ভাবছি, যদি তিনি কোনও খোঁজ দিতে পারেন। তাঁর মধ্যেই লোকটি আবার বলল, স্যর, আমার নাম গোবিন্দচন্দ্র মণ্ডল। আমি আসছি উলুবেড়িয়া থেকে। আমাদের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের কাছেই বেলকুচি গ্রামে। ওখানে যমুনা নদী আছে জানেন তো? সেই নদীর ধারে। যদি কেউ আমাদের সেই গ্রামের কোনও খবর দিতে পারে—

এ বার আমি জিজ্ঞেস করলাম, গোবিন্দবাবু, আপনি বেলকুচি ছেড়ে এসেছেন কত বছর আগে?

তা সতেরো-আঠারো বছর আগে। সেখানে আমার অনেক বন্ধু ছিল।

এ একটা আশ্চর্য টান। যার ব্যাখ্যা পাওয়া খুব শক্ত। সতেরো আঠারো বছর আগে যে গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে গেছে, সেখানকার কোনও মানুষের দেখা পাওয়া কিংবা সেখানকার খবর জানার জন্য এমন আকুলিবিকুলি। গোবিন্দচন্দ্র উলুবেড়িয়া থেকে চলে এসেছেন, বই কেনার জন্য নয়, হয়তো তার তেমন সামর্থ্যও নেই। তবু এসেছেন বাংলাদেশের মানুষজনের মধ্যে পূর্ব স্মৃতি ঝালিয়ে নিতে।

প্রখ্যাত লেখক শাহরিয়ার কবির এসেছেন এই উপলক্ষে। আরও অনেক বিদগ্ধজন ভাষণ দিচ্ছেন, এখানকার অনেকের কথাতেই মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলির স্মৃতি। পবিত্র সরকার কিংবা পঙ্কজ সাহা তো সেই সময় ভাল ভাবেই যুক্ত ছিলেন। এমনকী সত্যম রায়চৌধুরী, তখন বয়স পাঁচ বছর। সেই শিশু-মনেও কী ভাবে দাগ কেটে গিয়েছিল সেই মুক্তিযুদ্ধ। তবে আমাকে বেশি আকর্ষণ করছে দু-এক জন চেনা-অচেনা মানুষের টুকটাক কথা।

মিন্টুকে আমি বহু দিন চিনি। অনেক কাল আগে বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। আমাকে সে মাঝে মাঝে শুঁটকি মাছ রান্না করে দিয়ে যায়। আমি ঝাল ভালবাসি বটে, শুঁটকি মাছ ঝাল না-হলে জমেও না। কিন্তু এক বার তাঁর বউ এমন ঝাল দিয়েছিল যে লাফিয়ে উঠে আমার মাথাটা ঘরের ছাদে ঠেকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেই মিন্টু এই বইমেলায় এক যুবককে সঙ্গে করে এনে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, দাদা, ইনি বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে নতুন এসেছেন। তার পরই সে ঝলমলে মুখে বলল, দাদা, ইনি আমাদের চিটাগাঙের মানুষ।

এই ‘আমাদের’ শব্দটিই কৌতূহল জাগায়। গোবিন্দচন্দ্রও বলল, আমাদের সেই গ্রাম। এই ‘আমাদের’ শব্দের মধ্যে কোনও অধিকারবোধ নেই। আছে এক ধরনের মায়া, কোনও অভিধানেই এর অর্থ পাওয়া যায় না।

কিছু কিছু সম্পর্কের মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই। দেশ ভাগ নেই। ইতিহাস নেই। আছে শুধু মানবিকতার স্পর্শ!

রাজ্জাক হাওলাদারের কথা আমি আগেই লিখেছি। কলকাতার নাগরিক হয়েও জন্মভূমির গ্রাম সর্বক্ষণ তাঁর মন জুড়ে আছে। সে গ্রামে বাচ্চা বয়সে সে হিন্দু বালকদের সঙ্গে খেলা করত। তারা সবাই কার্যকারণবশত চলে এসেছে ভারতে। রাজ্জাকের প্রিয় শখ কলকাতায় এসে সেই সব বন্ধুবান্ধবকে খুঁজে বের করা। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজ্জাক উত্তর কলকাতার কোথাও ছিল ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। তাই এই শহরটা সে মোটামুটি চেনে। একজনের সন্ধান পেলে তাঁর কাছ থেকে অন্য আর একজনের কথা জানা যায়। এ ভাবে খুঁজতে খুঁজতে সে যাদবপুরে পেয়ে গেল তার অতি ঘনিষ্ঠ এক বাল্যবন্ধুকে। মাইজপাড়া গ্রামে তাদের ছিল পাউরুটি বিস্কুটের কারখানা। মোটামুটি সচ্ছল অবস্থা। সে কারখানা তো ধ্বংস হয়ে গেছে। শরণার্থী হয়ে এখানে এসে বন্ধুটি বেশ দুর্দশায় পড়েছে। এক সময় নিজস্ব কারখানা ছিল। এখন যাদবপুরের একটি বিস্কুট কারখানায় সে ঠিকে শ্রমিকের কাজ করে। টিনের চালের যে বাড়িতে সে থাকে সপরিবার, তারও খুব ভগ্ন দশা। রাজ্জাক অন্য কাউকে কিছু না-জানিয়ে নিজে কিছু কিছু অর্থ দিয়ে সেই বাড়িটাকে বাসযোগ্য করে দিয়েছে।

মুসলমানদের জন্যই তো জন্মস্থানের বাড়িঘর ছেড়ে চলে এসেছিল এক হিন্দু। সেই গ্রামেরই এক মুসলমান এসে এখানে বানিয়ে দিল তার বাড়ি। দেশ বিভাগের ইতিহাসে লেখা থাকবে কি সেই সব কাহিনি? রাজ্জাক কিন্তু মোটেই তেমন ধনী ব্যক্তি নয়।

আর একটি মর্মস্পর্শী কাহিনি জেনেছি সম্প্রতি। কালা হাওলাদার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিশিষ্ট ভদ্র ও বিদগ্ধ মানুষ। তাঁর দিদির বয়স পঁচাত্তর। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়ে ভর্তি হন মেলবোর্ন হাসপাতালে। কোমায় চলে যান। সে অবস্থার পর আর কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু অত্যাশ্চর্য ভাবে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল এবং দিদি তাঁর ভাইকে বললেন, ছেলেবেলায় আমি সরস্বতীর সঙ্গে খেলতাম, তোরা তার খোঁজ দিতে পারবি? সরস্বতী নামে একটি বালিকা মাদারিপুর থেকে ভারতে চলে আসে ৬২ বছর আগে। কোথায় তাঁর খোঁজ পাওয়া যাবে? কিন্তু এত বছর পরেও কঠিন রোগশয্যায় এক প্রবীণার মনে পড়েছে তাঁর কথা। বড় বোনের এই ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে ভাইয়েরা নানা সূত্রে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। মাদারিপুরের বাদামতলা সিনেমা হলের মালিক এক সুধীরবাবুর নাতনি সৌমীর সঙ্গে কালা হাওলাদারের দেখা হয়েছিল নাইরোবিতে, সে যদি জানে কিছু। যাই হোক, অনেক অনুসন্ধানে জানা গেল, সেই মহিলা এখনও বেঁচে আছেন। থাকেন হাওড়ায়। কালা হাওলাদারের বড় বোনকে এ খবরটি দিতেই তাঁর চক্ষু সজল হয়ে উঠল।

দু’জনের কি আর দেখা হবে না? বয়সের ভার তো আছেই, তা ছাড়া দূরত্ব। কোথায় মেলবোর্ন, কোথায় হাওড়া। তবু এ যুগে অনেক কিছুই সম্ভব। হাওড়ায় সরস্বতীদেবীর কাছে একটি ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। তার পর স্কাইপে দুই বৃদ্ধা মুখোমুখি কথা বলতে লাগলেন। বাষট্টি বছর পর।

গভীর বন্ধুত্বের কাহিনি

আমি এক সময় এরিখ মারিয়া রেমার্ক-এর একটি স্মরণীয় মন্তব্য পড়েছিলাম। এ কালের এই জার্মান ঔপন্যাসিকের কয়েকটি উপন্যাস যেমন, ‘তিন বন্ধু’, ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘ফেরার পথ’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলি আমাদের খুবই প্রিয় ছিল। মধ্যজীবনে তিনি জার্মানি ছেড়ে হলিউডে এসে বসতি করেন।

এক বার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি কি ইহুদিদের পছন্দ করেন?

রেমার্ক বললেন, না।

আপনি কি জার্মানদের পছন্দ করেন?

না।

আপনি কি আমেরিকানদের পছন্দ করেন?

না।

তা হলে আপনি…

আমি পছন্দ করি আমার বন্ধুদের। যারা পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই আছে।

প্রসঙ্গত বলি, রেমার্কের ওই যে তিনটি উপন্যাসের নাম করলাম, প্রত্যেকটিরই বিষয়বস্তু গাঢ় বন্ধুত্ব। তিন বন্ধু-র অনবদ্য অনুবাদ করেছিলেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সে বই আমি একাধিক বার তো পড়েছি, যত বার পড়েছি, কান্না সংবরণ করতে পারিনি৷ অল কোয়ায়েট-এর সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছিলেন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। কিশোর বয়সে ওই বই যে পড়েনি, তাকে আমি দুর্ভাগা মনে করি। ‘দা রোডব্যাক’-এর বাংলা অনুবাদ আছে কি না আমার জানা নেই। তুলনামূলক ভাবে এই তিনটির মধ্যে সেটিই বোধহয় শ্রেষ্ঠ। এখন ওই বইগুলি পাওয়া যায় কি না কিংবা ওই সব বন্ধুত্বের কাহিনি এখনকার পাঠকদের পছন্দ হয় কি না, সে সম্পর্কেও আমি অবহিত নই।

জীবনের জয়ধ্বনি

কথাটা এই জন্য বলছি আরও—

যা জীবন, তাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

কী করে বাঁচাবে, যদি অতর্কিতে মৃত্যু দেয় হানা।

যা মৃত্যু, তা হলে তাকে মারো।

তা হলে নতুন করে জীবনের জয়ধ্বনি দাও

যা মারে মৃত্যুকে, সেই উদ্বোধনী সংগীত শোনাও।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

(এবার মৃত্যুকে মারো)

১৯. ১০. ২০১১

বাঙালিরা তখন গদ্যে কথা বলে, গদ্য লিখতে জানে না

ভদ্রলোক কাজ করতেন একটা জুতো তৈরির দোকানে। কিছু দিন পর বিয়ে করলেন মালিকের শ্যালিকাকে। আর কয়েক বছর পর সেই কোম্পানির মালিকের মৃত্যু হওয়ায় তিনিই হয়ে গেলেন মালিক। কয়েক বছরের মধ্যেই এই দম্পতির পর পর সাতটি ছেলেমেয়ে জন্মায়। সাতটি সন্তানের পিতা এই জুতো দোকানের মালিকটির ভবিষ্যৎ জীবন সাধারণ ভাবে এক নির্ধারিত পথেই যাওয়ার কথা। তা হয়নি, নাটকীয় ভাবে তাঁর জীবন মোড় নিয়েছে অন্য দিকে।

ভদ্রলোকের নাম উইলিয়াম কেরি। বংশানুক্রমে বসবাস ইংল্যান্ডের নর্দামটনশায়ারের একটি গ্রামে। আমাদের দেশের পণ্ডিত ও গবেষকদের মধ্যে এই নামটি বিশেষ পরিচিত। সাধারণ সাহিত্য পাঠকের কাছে নামটি শোনা শোনা, বিশেষ কিছু জানা নেই, আর আমজনতার কাছে একেবারেই অপরিচিত।

জুতো কোম্পানির এই মালিকটির ছিল ভাষা শেখার বিশেষ ক্ষমতা এবং ধর্ম আন্দোলনের দিকে দারুণ ঝোঁক। ব্যবসা চালাতে চালাতেই তিনি শিখে নিলেন হিব্রু, ইতালিয়ান, ডাচ, ফ্রেঞ্চ আর গ্রিক ভাষা। তাঁর এ রকম পাণ্ডিত্য কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে তাঁকে একটি স্কুলে পড়াবার জন্যও আহ্বান জানানো হল। তখন তাঁর বয়স চব্বিশ। এরই মধ্যে তিনি নিয়মিত গির্জায় গিয়ে ভাষণ দিতেন। কেরি ও তাঁর কিছু বন্ধুবান্ধবের ধারণা হল, সারা পৃথিবীর মানুষকেই খ্রিস্টধর্মের পবিত্র আলোকের মধ্যে নিয়ে এসে দীক্ষা দেওয়া উচিত। এবং তাদের বাইবেল পড়াতে হবে। এই নিয়ে তখন মিশনারিদের মধ্যে প্রায় একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বাইবেলে (ম্যাথিউ ২৮:১৮-২০) প্রভু যিশুর এ রকম একটা নির্দেশ আছে যে, সারা বিশ্বের মানুষই যাতে তাঁর অনুসরণ করে সে জন্য চেষ্টা করা উচিত।

ইউরোপে ওক গাছের কাঠ দিয়ে মজবুত জাহাজ বানানো যায়। সে সব জাহাজ সমুদ্রে ঝড়বৃষ্টিতে ডোবে না। সেই জাহাজ নিয়ে ষোলো সতেরো আঠারো শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক দেশের ভাগ্যান্বেষী, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, রাজপ্রতিনিধি এবং বোম্বেটের দল ছড়িয়ে পড়ল বিশেষত প্রাচ্য দেশগুলির দিকে। সে ইতিহাস অনেকেরই জানা। আঠারো শতকে ভারতে এক অদ্ভুত অবস্থা। পরাক্রান্ত মুঘল শক্তি তখন একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রাদেশিক নবাব ও রাজারা মাথাচাড়া দিলেও তাদের কোনও শৃঙ্খলাবদ্ধ, শক্তিশালী সেনাবাহিনী নেই। ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ বণিকরা কিছু দিন নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করল, তার পর প্রধান হয়ে উঠল ইংরেজরাই। আজও আমাদের লজ্জার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় যে, পলাশির যুদ্ধে সুবে বাংলার নবাব ইংল্যান্ডের রানির সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হননি, তিনি পরাজিত হয়েছিলেন নিতান্তই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ভাড়াটে সৈন্য ও তাদের সেনাপতি ক্লাইভের কূটবুদ্ধি ও রণকৌশলের কাছে।

তলোয়ার ও বন্দুকের সাহায্যে এক একটা রাজ্য জয়ের পরই আসেন ধর্মপ্রচারকরা। সব দেশেই এ রকম ঘটেছে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই প্রচুর ধর্মপ্রচারক ছড়িয়ে পড়েন পৃথিবীর নানান দেশে। আফ্রিকায় গিয়ে তো তাঁরা দেখলেন দারুণ সুযোগ। বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে কোনও সঙঘবদ্ধ ধর্ম নেই, তারা নানা রকম টোটেম ও ট্যাবুতে বিশ্বাসী। এদের খ্রিস্টধর্মের আওতায় আনা অনেক সহজ। পশ্চিম এশিয়ায় সে সুবিধা হল না। কারণ, ইসলাম একটা দৃঢ় সঙঘবদ্ধ শক্তি, সামরিক ভাবে তারা ইউরোপিয়ানদের কাছে হারতে শুরু করেছে বটে, কিন্তু ধর্মত্যাগ করতে একেবারেই রাজি নয়। ভারতে এসে তারা প্রথম দিকে একটা ধাঁধার সম্মুখীন হল। এত বড় দেশটার মানুষদের মধ্যে একতাবোধ নেই। অস্ত্রবল নেই। সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ম নেই। কিন্তু রয়েছে এক প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। বেশির ভাগ মানুষ অজ্ঞাতসারেই সেই ঐতিহ্যের অনুসরণ করে। এই ভারতের অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু। রাষ্ট্রশক্তি মুসলমানদের হাতে। এবং অধিকাংশ হিন্দুই জানে না, হিন্দু ধর্মটা আসলে কী? এই হিন্দু ধর্মের কোনও কেন্দ্রীয় শক্তি নেই, নীতিনির্ধারক নেই, বহু শতাব্দীর অবক্ষয়ে এই ধর্মের মধ্যে কতকগুলি কুৎসিত রীতিনীতি ঢুকে গেছে। যেমন, কঠোর জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা এবং অন্য ধর্মের কোনও মানুষকেই এই ধর্মে গ্রহণ না-করার অনমনীয় সংস্কার। জন্মগত ভাবে ছাড়া কেউ হিন্দু হতে পারে না। কিন্তু এই ধর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সব পথ খোলা। তথাকথিত উচ্চশ্রেণির অত্যাচারে বহু হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে। তা হলে তো তারা খ্রিস্টান হতেও পারে। এই ধারণা থেকেই দলে দলে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের এই দেশে আগমন।

উইলিয়াম কেরিও ঠিক করলেন, তিনি ছোট্ট গণ্ডি ছেড়ে বৃহত্তর জগতে এই ধর্ম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। তিনি ব্যাপটিস্ট আন্দোলনের অন্তর্গত ছিলেন। এবং এদের একটা ঘোষিত নীতিই হচ্ছে, ‘প্রোপাগেশন অব দ্য গসপেল অ্যামংস্ট দ্য হিদেন’। ভারতে অসংখ্য হিদেন, তাই জুতোর ব্যবসাট্যবসা সব গুটিয়ে কেরি সপরিবার আসতে চাইলেন ভারতে। তাঁর স্ত্রী কিছুতেই রাজি নন। তাঁর নাম ডরোথি। তিনি একেবারেই লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাননি (বিয়ের খাতায় টিপসই দিয়েছিলেন) এবং ভারত সম্পর্কে নানা রকম অলীক ভয়ের গল্প শুনেছেন। তা ছাড়া তিনি তখন গর্ভবতী। তাঁর স্বামী জাহাজের টিকিট কেটে ফেলেছেন। নানা কারণে সে জাহাজে আর যাওয়া গেল না। কয়েক মাস দেরি হয়ে গেল। এর মধ্যে এক পুত্রসন্তান প্রসব করলেন ডরোথি। সেই নবজাতক সমেত অন্য পুত্রকন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে কেরি সাগরে ভেসে পড়লেন এবং পৌঁছলেন কলকাতা বন্দরে।

এখানে এসে কেরি দেখলেন, এখানকার কোনও মানুষই, অর্থাৎ নেটিভরা, তাঁর কথা বুঝতে পারে না। অতি অল্পসংখ্যক মানুষের যৎসামান্য ইংরেজি জ্ঞান আছে। সুতরাং কেরি বাংলা শিখতে শুরু করলেন। কিছু একটা জীবিকাও তো চাই৷ তাই এক বন্ধুর অনুরোধে এক নীলের কারখানায় ম্যানেজার হয়ে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন মেদিনীপুর। সেখানে ছিলেন ছ’বছর। নীলকর সাহেবদের অনেক অত্যাচারের গল্প শোনা যায়। কেরি ম্যানেজার হিসেবে কী রকম ছিলেন আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, তার মধ্যে তিনি যথেষ্ট বাংলা শিখে নিউ টেস্টামেন্ট-এর অনুবাদ করে ফেলেছেন (অবশ্যই কোনও মুন্সির সাহায্য নিয়ে)। এর মধ্যে তাঁর একটি পুত্রসন্তানের মৃত্যু হয়। এবং তাঁর স্ত্রী ডরোথি বাকি জীবনের জন্য বন্ধ উন্মাদ হয়ে যান।

কলকাতায় দলে দলে মিশনারি এসে ভিড় করছে, তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পছন্দ হয়নি। তারা এ দেশে এসেছে ব্যবসা করতে। ধর্ম প্রচারের নামে কোনও হাঙ্গামা তারা চায় না। তাই ধর্মপ্রচারকরা অনেকেই চলে গেলেন শ্রীরামপুর শহরে। সেটা ডেনমার্ক সরকারের অধীনে। এবং তাদের রাজা এদের সাহায্য করতে উৎসাহী। উইলিয়াম কেরি এদের সঙ্গে শ্রীরামপুরে এসে যোগ দিলেন ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি।

সময়টার কথা মনে রাখা দরকার। বিদ্যাসাগর তখনও জন্মাননি। রামমোহন কেরির চেয়ে এগারো বছরের ছোট। তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু কাজ তখনও শুরু করেননি। বাঙালিরা তখন বাংলা ভাষায় কথা বলে বটে, কিন্তু, কিছু চিঠিপত্রের কথা বাদ দিলে, গদ্য ভাষা লিখতে জানে না। ছাপাখানা এসে গেছে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ছাপার মতো বিশেষ কিছু নেই, পুরনো কালের কবিতা ছাড়া। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক ভাষাতেই গদ্য ভাষা সংহত হয়ে রচিত হচ্ছে গল্প-উপন্যাস। বাংলায় তা লেখার মতো কেউ নেই। বাংলা সাহিত্যকে হাঁটি হাঁটি পা পা করাবার জন্য সাগরপার থেকে এক জন সাহেবকে আনতে হল।

শ্রীরামপুরে কেরি একটা ছোটখাটো প্রেস স্থাপন করেছিলেন এবং নানা ভাষায় বাইবেল ছাপিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে তিনি সংস্কৃত শিখছেন, ওড়িয়া ভাষা শিখছেন, সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য তিনি রামমোহনেরও আগে প্রকাশ্যে আবেদন জানাচ্ছেন। ছ’বছর বাদে তাঁর উন্মাদ স্ত্রীর মৃত্যু হলে তিনি বিয়ে করে ফেললেন আর এক বার। কিন্তু কেরির পুরো জীবনী রচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

কেরি এক সময় একটা বই রচনা করে ছাপালেন নিজেদের প্রেসে। বইটির নাম ‘ইতিহাসমালা’। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বইটি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত হয়নি। এর মধ্যে ধর্মের কোনও নামগন্ধ নেই। ‘ইতিহাসমালা’ কোনও ইতিহাসের বইও না। এতে আছে অনেকগুলি ছোট ছোট গল্প। অধিকাংশই লোককাহিনি। যা সাধারণত লোকের মুখে মুখে ছড়ায়। কেরি একজন ধর্মপ্রচারক তো বটেই, তবু তিনি নিছক এই গল্পের বই ছাপলেন কেন? বাংলা গদ্যের একটা স্পষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য? (তিনি নিশ্চিত তাঁর মুন্সি রামরাম বসুর যথেষ্ট সাহায্য নিয়েছিলেন, কিন্তু কেরিও এই বারো চোদ্দো বছরের মধ্যে অনেকখানি বাংলা শিখে ফেলেছেন, যার ফলে তিনি ইংরেজি-বাংলা অভিধানও রচনা করবেন আরও কিছু দিন পর)। ‘ইতিহাসমালা’ই বাংলা ভাষার অন্যতম প্রথম গদ্য গল্পের বই। কিন্তু বইটি ছাপা হওয়ার পরই একটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। বইটি প্রস্তুত হওয়ার পর বাইরে ছাড়বার আগেই আগুন লেগে প্রেস ও গুদামের অনেকখানি ধ্বংস হয়ে যায়। বিশেষ করে ইতিহাসমালার পুরো স্টক শেষ। কেউ কেউ অবশ্য ইঙ্গিত করেছেন যে, আগুন এমনি এমনি লাগেনি, এই বইয়ের কিছু কিছু গল্পে নীতিবাগীশদের আপত্তি ছিল, তাদের কারও নির্দেশে বইগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তার ফলে বাংলা সাহিত্যর গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে গণ্য হওয়ার মতো এই বইটির কথা কেউ জানতেই পারল না। লং সাহেবের বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থের তালিকায় এই বইয়ের নাম নেই। এমনকী কেরি সাহেবের রচনাবলিতেও এই বইয়ের নাম স্থান পায়নি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বই রচিত হল, তার পরই হারিয়ে গেল। এমনকী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যাঁরা রচনা করেছেন তারাও অনেকে এই বইয়ের নাম জানতেন না।

কিন্তু আগুনেও নাকি সব কিছু দগ্ধ হয় না। ইতিহাসমালার দু’চার কপি কোনও ক্রমে বেঁচে যায়। সেই রকম একটি কপি কোথা থেকে খুঁজে পেয়ে প্রথম মুদ্রণের একশো ষাট বছর পরে ফাদার দ্যতিয়েন এর একটি সটীক সংস্করণ প্রকাশ করেন। দ্যতিয়েন তো বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির অতি আপনজন। এবং এটা তাঁর একটা বিরাট কাজ। তবে কিছু দিনের মধ্যেই বইটি অপ্রাপ্তির অন্ধকারে চলে যায়। আবার প্রায় চার দশক বাদে এর একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে ‘গাঙচিল’। সম্প্রতি এই বই সম্পর্কে লিখেছেন ভাষাবিদ চিন্ময় গুহ এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অননুকরণীয় স্টাইলে বইটির ভাষা ও গল্পগুলির বিস্তৃত বয়ান রচনা করেছে। তার পর আমার আর নতুন কী লেখার থাকতে পারে?

তবু যে আমি এ সম্পর্কে লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছি, তার অন্য একটা কারণ আছে। উইলিয়াম কেরির জীবনীর কিছু উপাদান জানার জন্য আমি উইকিপিডিয়ার শরণ নিতে গিয়ে যেমন হতবাক, তেমনই বিষণ্ণ বোধ করেছি। কেরি তাঁর জীবনের চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর এই বাংলা মুলুকেই কাটিয়েছেন এবং এখানেই দেহ রেখেছেন। কিন্তু এই বহুভাষাবিদ পণ্ডিতটির খ্যাতি শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি বিশ্ববিখ্যাত। পৃথিবীর নানান দেশে তাঁর সম্মানে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর নাম যুক্ত। যেমন, উইলিয়াম কেরি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ইন পাসাডেনা, ক্যালিফোর্নিয়া, তেমনই ভ্যানকুভার, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, শ্রীলঙ্কার কলম্বো এমনকী বাংলাদেশের চট্টগ্রামে উইলিয়াম কেরি অ্যাকাডেমি। আর আমাদের কলকাতায়? কোনও অভিযোগ নয়, অতি লজ্জায় একা মাথা নত করে বসে থাকি।

বাধ্যতামূলক পাঠ

আমি খুব ভালই জানি, যাঁরা অনুগ্রহ করে আমার রচনাটি পড়বেন বা অলস ভাবে চোখ বুলোবেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় কেউই ইতিহাসমালা বইটি সংগ্রহ করে পড়ে দেখার আগ্রহ দেখাবেন না। এ রকম হতেই পারে, তাই আমি জোর করে ওই বইটির দু’তিন লাইন গদ্যের নমুনা তাঁদের পড়াবই পড়াব। ‘হাঁড়ি ভাঙ্গে, রাণী হাসে’, এটা একটা সাঙ্ঘাতিক গল্প। নীতিবাগীশদের এ রকম গল্পেই গায়ে কাঁটা দিতে পারে।

‘এক রাজা ছিলেন। তাঁহার রাণীর মন্ত্রির সঙ্গে অত্যন্তিকী প্রীতি ছিল। এক দিবস মন্ত্রী রাণীকে কহিল, “হে রাণি, আমারদের গোপনভাবে এ প্রীতি রাজা জ্ঞাত হইলে, প্রাণে বধিবেন। অতএব চল, এ স্থান হইতে দেশান্তরে যাই। অদ্য নিশাভাগে এই নগরের অন্তে পুষ্করিণীর তটে বৃক্ষের মূলে…: ইত্যাদি।

ছাপাখানার ভুলচুক

রাজ্জাক হাওলাদার সম্পর্কে ছাপা হয়েছে, ইনি ‘কলকাতার নাগরিক’। সে আবার হয় নাকি? উনি কানাডার নাগরিক। জন্ম বাংলাদেশে।

মাদারিপুরের বাদামতলার সিনেমা হলের মালিকের নাম সুধীরবাবু নয়, তিনি অতি সজ্জন সুনীলবাবু, সুনীলচন্দ্র ঘোষ।

পুডভকিন আর চেরকাশভের সঙ্গে শিশিরকুমার ভাদুড়ির দেখা হয়েছিল ঠিকই, ষাটের দশকের বদলে পঞ্চাশের দশকে।

২. ১১. ২০১১

লেখনী পুস্তিকা ভার্যা পরহস্তং গতা গতাঃ!

প্রথমে ভার্যার কথাই বলা যাক। আমার স্ত্রী যদি এক্ষণে অপর কোনও পুরুষের হাত ধরে, আমাকে টা টা বাই বাই বলে ড্যাং ড্যাং করে চলে যায়, তা হলে আমার তো বাধা দেওয়ার কোনও উপায় নেই। এটা নারীস্বাধীনতার যুগ। আমি নিজেও তো কট্টর নারীবাদী। এমতাবস্থায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে হাসি হাসি মুখে বলতে হবে, সুখে থেকো। ভাল থেকো!

এ রকম উদারতা দেখাতে গেলেও অনেক সময় উল্টো বিপত্তি হতে পারে। ওপরের এই চিত্রনাট্যটা যদি আমার স্ত্রীকে শোনাই, তা হলে তিনি নির্ঘাত চক্ষু গাঢ় করে বলবেন, ও তুমি বুঝি চাও, আমি অন্য কারওর সঙ্গে চলে যাই? তা হলে তুমি বাঁচো। আমাকে তোমার আর সহ্য হচ্ছে না, না? সে কথা আগে বললেই পারতে? ঠিক আছে, আমি কালই…

অগত্যা তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য আমাকে কালিম্পঙের টিকিট কাটতে হয়।

মোট কথা, নারীবাদী আন্দোলনের অগ্রগতির একটা দিক হচ্ছে, এক শ্রেণির পুরুষকে এখন বেশ ভয়ে ভয়েই থাকতে হয়, যাতে কোনও কথার একটুও ভুল ব্যাখ্যা না করা যায়।

উপরোক্ত অর্বাচীন সংস্কৃত শ্লোকটির মধ্যে এখন লেখনীর ব্যাপারটা অবান্তর হয়ে গেছে। কলম নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়, এখন কলম হয়ে গেছে অত্যন্ত সস্তা। হস্তান্তর হচ্ছে অনবরতই। পার্কার, শেফার্স এবং আরও সব দামি কলমের দিন গিয়েছে।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বাবা আমাকে একটা শেফার্স কলম উপহার দিয়েছিলেন। দিন সাতেকের মধ্যেই ট্রামে সেই কলমটা এক পকেটমার অদৃশ্য করে দেয়। ঘটনাটা আমার মনে আছে। আমার কলমটি মেরে দিয়েও খুশি না-হয়ে পকেটমারটি আবার হাত চালাচালি শুরু করে এবং ধরা পড়ে যায়। তখন তাকে ট্রাম থেকে নামিয়ে কিছু লোক, যাদের বলে পাবলিক, তারা পেটাতে শুরু করে। চোরাই কোনও জিনিস অবশ্য তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তা কোন জাদুবলে সে তার কোনও সঙ্গীর কাছে চালান করে দিয়েছে। তার মার খাওয়া দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব এবং সেই পাবলিকের কাছে ব্যর্থ অনুরোধ করেছিলাম, ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন। পকেটমারটি অবশ্য দিব্যি মার খেয়ে যাচ্ছিল। পরে শুনেছি ওরা মার খাওয়ার ট্রেনিং নেয়। নিশ্বাস বন্ধ করে কী সব যোগব্যায়ামের সাহায্যে ব্যথা-বেদনা সহ্য করে। তাই মার খেতে খেতে আধমরা হয়ে গেলেও একটু পরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনকার পাবলিক চড়চাপড় মেরে বড়জোর আধমরা করে দিত। একেবারে প্রাণে মারত না।

তার পর থেকে আমি আর কখনও দামি কলম ব্যবহার করিনি। এক টাকা, দু’টাকার ডটপেনই যথেষ্ট। পকেটমার বেচারাদের নিশ্চয়ই এখন খুব দুর্দিন। কারওর পকেটেই দামি কলম থাকে না, মানিব্যাগে টাকার বদলে প্লাস্টিক কার্ড, মেয়েদের গায়ে সোনার গয়নার বদলে প্লাস্টিক জুয়েলারি।

এই চুরি বা না-বলে নেওয়া কিংবা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও না-দেওয়া, এ সব বিষয়ে অনেক গল্প আছে। মার্ক টোয়েনের বাড়ির মেঝেতে একগাদা বই ছড়ানো দেখে এক বন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করলে মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, কী করব, যেভাবে এই বইগুলি এখানে এসেছে, সে ভাবে তো কোনও আলমারি আসতে পারে না।

সম্প্রতি বই চুরির ব্যাপারে আমার এমনই এক অভিনব অভিজ্ঞতা হল। যা সবাইকে জানাবার মতো।

গত সপ্তাহে আমি আফ্রিকার ঘানায় গিয়েছিলাম একটা বইমেলা উপলক্ষে। এক দুপুরে হোটেলের ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি, আমার বিছানার কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পুরোপুরি কৃষ্ণাঙ্গ। অল্পবয়সি যুবক। প্রথমে কোনও আততায়ীর কথাই মনে পড়ে এবং ভয়ে বুক তো কাঁপবেই।

ছেলেটি অবশ্য খুব বিনীত ভাবে বলল, (এখানে সবাই ইংরেজি বলে) স্যার, আমি আপনার ঘর পরিষ্কার করি। দু’দিন ধরে দেখছি আপনার বিছানার উপর একটা বই ওল্টানো রয়েছে। আমি একটু একটু পড়তে শুরু করি। বিষয়টি এমনই আকর্ষণীয় যে, ছাড়তেই পারছিলাম না। কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞেস না-করে তো নিতে পারি না। আপনি এই বইটা আমাকে দেবেন?

আমি বললাম, বইটা তোমাকে কী করে দিই বলো তো? আমার যে পড়া হয়নি।

সে বলল, বইটা কোথায় পাওয়া যায়? আপনি কোথা থেকে কিনেছেন?

আমি বললাম কোথায় পাওয়া যায়, তা তো আমি জানি না। কারণ, বইটি আমি কিনিনি। এ বইয়ের লেখক আমাকে উপহার দিয়েছেন।

সে বলল, কেন উপহার দিয়েছেন? তুমিও লেখক?

আমি বললাম, তা ছোটখাটো একজন লেখক আমাকে বলাই যায়।

সে বলল, একজন লেখক তোমাকে বই উপহার দিয়েছেন, তা হলে তোমার লেখা একটা বই আমাকে উপহার দাও।

আমি বললাম, তা দিতে পারি। কিন্তু তুমিও কি লেখক?

সে বলল, না। আমি এখনও কিছু লিখিনি। তবে ভবিষ্যতে লিখতে পারি।

এমন সরল আবেদন আমি কোনও গৃহ পরিচারকের কাছ থেকে আগে শুনিনি।

এ বার বইটি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলি। বইটির নাম ‘আমা’। এক কালে এখানে যে দাস ব্যবসা চলত, উপন্যাসের আকারে সেই ইতিহাস। এক হিসেবে এই উপন্যাসেও আছে নারীস্বাধীনতার বীজ, প্রধান চরিত্র একটি নারী। অসহ্য অত্যাচার, ধর্ষণ, হাত-পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থাতেও সে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, পালাবার চেষ্টা করেছে বার বার। বইটি পড়তে পড়তে একটা প্রশ্ন মনে আসে, যারা এই দাস ব্যবসায় জড়িত (শুধু শ্বেতাঙ্গ নয়, এদের মধ্যে কালো মানুষও আছে) তারা নিজের জাতের বাইরে অন্য মানুষদের মানুষ বলেই গণ্য করে না। যখন তখন চাবুক মারে। মেয়েদের প্রকাশ্যে বিবস্ত্র ও ধর্ষণ করতে পারে। আজ এরা তো স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দিব্যি সংসার করে। যে-সব ঘটনার কথা পড়ে আমরা শিউরে উঠি, তাতে এদের বিবেকে একটুও দাগ কাটবে না? তা হলে কি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটেছে, দয়া, মায়া, সহানুভূতি সব সে কালের ব্যাপার? একটু পরেই আমার মনে পড়ে, না তা তো নয়। প্রায় ছাব্বিশশো বছর আগে জন্মেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। তিনি করুণার প্রতিমূর্তি এবং তিনি একা নন, তাঁর শান্তি-নীতির অনুবর্তী হয়েছিলেন কোটি কোটি মানুষ। দু’হাজার বছর আগে যিশু খ্রিস্টও শুনিয়েছিলেন শান্তির বাণী। আবার তাঁর অনুগামীদের অনেকে লিপ্ত হয়েছিলেন দাস ব্যবসায়। ইতিহাসে দুটো ধারাই চলেছে পাশাপাশি। নিষ্ঠুরতা ও করুণা। চেঙ্গিস খান এক লক্ষ বন্দির মুণ্ডু কাটার হুকুম দিয়েছিলেন। হিটলার একটা জাতিকেই না নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পৃথিবীতে এখন দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ। কিন্তু এখনও কি বহু মানুষকে দাস বানাবার প্রক্রিয়া চলছে না?

দু’দিন বাদে আমি ছেলেটিকে ডেকে বললাম, বইটা আমার পড়া হয়ে গেছে। তুমি এখন নিতে পারো।

সে বলল, ধন্যবাদ স্যর। আমি এর মধ্যেই এক কপি কিনে নিয়েছি।

আর একটি বইয়ের কথা

শ্রীজয়ন্ত চক্রবর্তীকে আমি চিনি না। পরিচিতিতে জানলাম, তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন ফেলো৷ ডি ভি সি-তে কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলায় এম এ পাশ করেন। সংস্কৃত শিখেছেন। হিন্দিতেও কিছু গবেষণা করেছেন এবং তাঁর এক সময় শখ হয় ব্রাহ্মী লিপি পাঠ করার। সেই শখ থেকে গভীর চর্চা করে ব্রাহ্মী লিপি থেকে আরও নানা লিপির বিবর্তনে কী ভাবে বাংলা লিপির উদ্ভব হল, সেই বিষয়ে তিনি একটি চটি বইও লিখে ফেলেছেন। ‘ব্রাহ্মী থেকে বাংলা’। এর বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম কিংবা যাচাই করার মতো বিদ্যেবুদ্ধি আমার নেই। তবে শ্রীঅমলেন্দু দে-র মতো প্রখ্যাত পণ্ডিত এঁর কাজের প্রশংসা করেছেন।

বইটি খুবই দীন ভাবে ছাপা। ভেতরে যে সব হস্তলিপি, তা প্রায় পড়াই যায় না। কোনও বড় প্রকাশক এ রকম বই সম্পর্কে আগ্রহী নয়। এটা প্রকাশ করেছে, সঞ্চয়ন প্রকাশন। ১২১/এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট, কলকাতা-৯। বিজ্ঞান ও ভাষা সংস্কৃতিকে যাঁরা মেলাতে পারেন, তাঁরা আমাদের অবশ্যই শ্রদ্ধেয়।

১৬. ১১. ২০১১

দু’জন অবিস্মরণীয় মানুষের কথা

তখন আমি দিনের বেলা আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করি, আর সন্ধের সময় আমাদের নিজস্ব পত্রিকার দফতরে সম্পাদক সেজে বসি৷ তখন আমাদের পত্রিকাটি লিটল ম্যাগাজিনের অবয়ব ছেড়ে একটা পুরোদস্তুর মাসিক হওয়ার চেষ্টা করছে এবং প্রেসের মালিক গণেশচাঁদ দে’র সৌজন্যে বিনা পয়সায় একটা ঘর পেয়ে রীতিমতন দফতরও খোলা হয়েছে। একদিন দেখি, একটু দূরের একটা চেয়ারে একজন ব্যক্তি নিঃশব্দে বসে আছেন, অন্য লোকেরা আসছে যাচ্ছে, কাজ ও স্বার্থের কথা বলছে, তিনি আসলে কিছুই বলছেন না।

তাঁর বয়স আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। পুরোদস্তুর স্যুট পরা। মাথাটি কেশ-বিরল, তাঁর ঠোঁটের এক কোণে লেগে আছে একটুখানি সফিসটিকেটেড হাসি। এই সফিসটিকেটেড হাসি ব্যাপারটা বোঝানো শক্ত, সঞ্জীবচন্দ্র (বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা) যে প্রসন্নতাব্যঞ্জক ওষ্ঠের কথা বলেছেন, ঠিক তা নয়, বিদ্রুপ বা সবজান্তা ভাব মোটেই নয়, কারওর কারওর ওই হাসিটি থাকে কথা না-বলার সময়। অন্য কেউ চেষ্টা করলেও ওই হাসি ফোটাতে পারে না। সত্যজিৎ রায়ের ওই হাসিটি ছিল, আর দেখেছি কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও চিত্রপরিচালক তপন সিংহের ওষ্ঠে। এক সময় আমি ওই ভদ্রলোকের দিকে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কিছু বলবেন?

তিনি একটা হাত একটু তুলে মৃদু গলায় বললেন, না, না, আমি কিছু লিখি না, কিছু ছাপাতেও আসিনি। শুধু দেখতে এসেছি।

পত্রিকা অফিসে কেউ শুধু দেখতে আসে না। দেখার কী আছে? বরং এ রকম কারওর উপস্থিতিটাই অস্বস্তিকর।

আরও কিছু পরে যখন কাজকর্ম সেরে আমি উঠব উঠব করছি, তখন তিনি কাছে এসে বললেন, আমার নাম কল্যাণ চৌধুরী। অতি সাধারণ মানুষ। অন্য পরিচয় দেওয়ার মতো কিছুই নেই।

যাঁদের ঠোঁটে ওই রকম হাসি থাকে, তাঁরা কোনও ক্রমেই সাধারণ মানুষ হতে পারেন না। এঁর কথা শুনেও বোঝা গেল, তিনি রীতিমতো শিক্ষিত এবং বিদগ্ধ ব্যক্তি।।

তারপর তিনি বললেন, আমার একটাই অনুরোধ, আপনার তো কাজ শেষ। আপনি আমার সঙ্গে এক জায়গায় গিয়ে কিছু পানাহার করবেন?

অদ্ভুত প্রস্তাব। যাঁকে জীবনে প্রথম দেখছি, যাঁর সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, তাঁর সঙ্গে আমি পানাহার করতে যাব কেন?

আমি খানিক উদ্ধত ভাবেই বললাম, না, আমার অন্য কাজ আছে। এর দু’তিন বাদে তিনি আবার এলেন। এবং ওই একই প্রস্তাব। এবং আমার প্রত্যাখ্যান।

আমার চরিত্রের একটা প্রধান দোষ, আমি তিন বারের বেশি না বলতে পারি না। চতুর্থ বারে মনে হল, দেখাই যাক না, একবার চুকিয়ে ফেলা যাক। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন গ্লোব সিনেমার অন্দরে একটা রেস্তোরাঁয়। সেখানে একটা টেবিলে আগে থেকেই বসে আছেন দুই ব্যক্তি। বেশ বৃদ্ধই বলা যায়। একজন হাত তুলে ডাকলেন, এই কল্যাণ…

কল্যাণ চৌধুরী তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন। আমি শুনে বেশ বিস্মিতই হলাম যে, ওই দুই ব্যক্তিই আন্দামানে জেল খেটেছেন আঠাশ বছর। একবার অনশন করেছিলেন একচল্লিশ দিন। কথায় কথায় ওঁরা জানালেন যে, কল্যাণ চৌধুরী মাঝে মাঝেই ওঁদের ডেকে এনে খাওয়ান। আন্দামানের অন্য বন্দিদের মধ্যেও যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদেরও খুঁজে খুঁজে।

কয়েক দিন পর জানতে পারলাম যে, কল্যাণ চৌধুরীর এটাই বিচিত্র শখ। পরাধীন আমলে যাঁরা ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্ত্রী-পুত্রদের মধ্যে যাঁরা খুব অসহায় অবস্থায় আছেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনকে নিয়মিত অর্থ সাহায্যও করেন তিনি। রাষ্ট্র যাদের জন্য কোনও সাহায্যের ব্যবস্থা করেনি, ভগৎ সিংহের পরিবারের কয়েক জনকেও তিনি মানি অর্ডারে টাকা পাঠান। বছরে একবার ওদের সবাইকে তিনি কলকাতায় ট্রেন ভাড়া দিয়ে এনে একটা উৎসব করেন।

এর মধ্যে কল্যাণ চৌধুরী আমার কল্যাণদা। তিনি চায়েরপেটির ব্যবসা করেন এবং ইংরেজি সাহিত্য থেকে মাঝে মাঝেই লাগসই উদ্ধৃতি দেন। তিনি কোনও প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত নন, কোনও রকম প্রচার চান না, শুধু নিজের শখে এই সব কাণ্ড করেন। তিনি সব সময় কথা বলেন নিচু গলায়, মাঝে মাঝে কুটুস কুটুস করে এক একটা রসিকতা করেন। বেশ রসে-বশে মানুষ।

এর মধ্যে আমরা বুধসন্ধ্যা নামে একটা ক্লাবের পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু জায়গা পাওয়া যাবে কোথায়? কল্যাণদার থিয়েটার রোডের একটা বড় বাড়িতে একটা ফ্ল্যাট কিনে রাখা ছিল। মাঝে মাঝে তাঁর অতিথিরা এসে থাকেন সেখানে। কল্যাণদা সেই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিলেন আমাদের। ও রকম ফ্ল্যাটের ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। অন্তত বিদ্যুতের বিলটা আমরা দিতে চেয়েছিলাম। কল্যাণদা সেই মৃদু হাসি দিয়ে হাত নেড়েছিলেন। সেখানে আমাদের ‘মুক্তধারা’ নাটকের রিহার্সাল শুরু হল। কল্যাণদা অভিনয় করবেনই না, কোনও কমিটিতেও থাকবেন না। তবু রিহার্সালের সময় আমাদের জন্য নানা রকম খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসেন। এক সময় তিনি একজন গোয়ান কুককে ধরে এনে আমাদের এমন সব খাবার তৈরি করে খাওয়াতে লাগলেন, সে সবের আমরা নামও শুনিনি। আমি একদিন বলেছিলাম, কল্যাণদা করছেন কী? এইসব খাবার খাইয়ে আমাদের অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছেন। কিন্তু উত্তরে তাঁর মুখে সেই মৃদু হাসি।

বুধসন্ধ্যার গোড়ার দিকে নাটকের বিভিন্ন ভূমিকায় রিহার্সাল দিতেন সাগরময় ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সমরেশ বসু, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, প্রমুখ আরও অনেকে। সংগীত পরিচালক সুবিনয় রায়। খুব নক্ষত্র সমাবেশ। একদিন কল্যাণদা সাগরদার কাছে গিয়ে বললেন, আপনার স্ত্রীর নাম কি আরতি? মানিকতলায় থাকতেন? সাগরদা বললেন, হ্যাঁ তাই তো জানি, বিয়ের আগে মানিকতলায়। কল্যাণদা বললেন, আমিও তখন মানিকতলায় থাকতাম। সুন্দরী হিসেবে আরতিকে সবাই চিনত ওই অঞ্চলে। সাগরদা শেষ প্রৌঢ়ত্বের মুখে লাজুকতার দায় নিয়ে চুপ করে রইলেন। কল্যাণদা বললেন, আমার সঙ্গে আরতির ভালই পরিচয় ছিল। পাশাপাশি বাড়ি তো, ছাদেও গল্প হত মাঝে মাঝে।

সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আমার দিকে ফিরে নিচু গলায় বললেন, কী সুনীল, এতে কি একটা ছোট গল্প হতে পারে? না, উপন্যাস?

বুধসন্ধ্যার অনেক আগে আর একটা নাট্যদলের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। কয়েক বছরের জন্য এই ‘হরবোলা’ দলটি বেশ নাম করেছিল। জানি না, নাট্যদলের ইতিহাসে হরবোলার নাম থাকবে কি না।

নাট্য পরিচালক ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীকে রিহার্সালের আগে গলা সাধতে হবে। গান গাইতে পারুক বা না পারুক। সেই জন্য আসতেন সন্তোষ রায়, যিনি ফৈয়াজ খানের সাক্ষাৎ শিষ্য। আর অন্য গানের জন্য কবি ও গায়ক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, যিনি আই পি টি টি-র উদ্বোধনী গান ‘এসো মুক্ত করো মুক্ত করো’র স্রষ্টা। আমরা বাচ্চা ছেলের মতো সন্তোষ রায়ের সামনে বসে সরগম লিখতাম আর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র যাঁর ডাকনাম ছিল বটুকদা, তাঁর কাছে শিখতাম, ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দ, হে কবি’। আমরা ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ ও ‘মুক্তধারা’ এই দুটি নাটক মুখস্থ করেছিলাম। এক একটা নাটকের রিহার্সাল হত প্রায় এক বছর ধরে। আসল আকর্ষণ ছিল রিহার্সাল। সেই রিহার্সালই আমার জীবনে খুব বড় প্রভাব ফেলেছে। কিছুক্ষণ রিহার্সাল, তার পরেই আড্ডা, তুমুল আড্ডা। কমলকুমার ছিলেন গল্পের খনি আর তাঁর সঙ্গে টক্কর দিতেন বটুকদা। আর কখনও প্রসঙ্গ উঠলে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীদের জীবনের মজার মজার কাহিনি শোনাতেন সন্তোষদা। আর সাহিত্য বিষয়ে গালগল্প শুরু হলে সেখানে ঢুকে পড়তেন দিলীপকুমার গুপ্ত। যিনি ডি কে নামেই অনেকের কাছে পরিচিত।

আমাদের এই নাট্যদলটিল মেরুদণ্ড ছিলেন এই ডি কে। তিনি ডি জে কিমার নামে একটি বিলিতি প্রচার সংস্থার ম্যানেজার। সেখানে তিনি সত্যজিৎ রায়কে চাকরি দিয়েছিলেন। অন্য দিকে, তিনি তখনকার দিনের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা সিগনেট প্রেসের কর্ণধার। তিনি বাংলা প্রকাশন জগতে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন। মলাট, ছাপা, কাগজ নির্বাচন, বাঁধাই এমনকী পুস্তানি পর্যন্ত সব দিকে ছিল তাঁর তীক্ষ দৃষ্টি। জ্ঞানও ছিল নিশ্চয়ই, নইলে অন্যরা তাঁর কথা মেনে নেবেই বা কেন। আর প্রতি বছরই সর্বভারতীয় মুদ্রণ শিল্প প্রতিযোগিতায় সিগনেট প্রেস জিতে আনত অনেকগুলি পুরস্কার।

ডি কে ছিলেন খুবই ব্যস্ত মানুষ। ডি জে কিমার এবং সিগনেট প্রেস দুটিই তখন সাফল্যের তুঙ্গে। শুনেছি, এক একদিন তিনি রাত দুটো পর্যন্ত কাজ করে তাঁরপর স্নান করে খেতে বসতেন। অথচ প্রতি শনি রবিবার নাটকের রিহার্সালের সময় তিনি অন্য সব কাজ ভুলে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তিনি উচ্চশিক্ষিত মানুষ। শুনেছি তাঁর প্রাইভেট টিউটর ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। বিদেশি সাহিত্যেও তাঁর অগাধ জ্ঞান। ওই আড্ডাতেই আমি প্রথম ফ্রানৎস কাফকার নাম শুনি৷ ডি কে শুনিয়েছিলেন সম্পূর্ণ মেটামরফসিস গল্পটি।

সন্ধে ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলত এই রিহার্সাল ও আড্ডা। এর মধ্যে বারে বারে আসত সুদৃশ্য কাপে চা। প্রচুর নোনতা ও মিষ্টি খাদ্যদ্রব্য। ডি কে নিজে সারা কলকাতা ঘুরে ঘুরে এক একদিন একটি দোকান থেকে মিষ্টি কিনে আনতেন এবং তার গুণাগুণ বর্ণনা করতেন। এই আড্ডায় ধূমপান নিষিদ্ধ ছিল না। তখনকার দিনে পঞ্চাশটি গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের টিন পাওয়া যেত। সে রকম দু’তিনটে টিন ছড়ানো থাকত আসরের মাঝখানে। আমি তখনও ধূমপান শুরু করিনি। আমার বন্ধুরা কেউ কেউ একটার বদলে পাঁচ ছ’টা তুলে নিত। এই নাটকে ডি কে-র কোনও ভূমিকা নেই। কোথাও তাঁর নাম থাকবে না। তবু তাঁর প্রবল উৎসাহ। আড্ডার শেষে যাদের বাড়ি হাওড়ায় কিংবা দূরে তাদের প্রত্যেককে তিনি দিয়ে দিতেন ট্যাক্সিভাড়া। কমলকুমারও আমাদের কয়েক জনকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দিতেন শ্যামবাজার। মাঝে মাঝে তিনি সন্তোষদা, বটুকদা, কমলদার পকেটে গোপনে এক একটা খাম ভরে দিতেন। তাতে কী থাকত আমাদের জানার কথা নয়।

এলগিন রোডে, ওঁদের বাড়ির সামনে ছিল অনেকটা মাঠ, সেখানে এক ডেকরেটর মঞ্চ বেঁধে দিয়েছিলেন। শেষের দিকে প্রায় এক মাস আমরা সেই মঞ্চে রিহার্সাল দিয়েছি। তার পর চার দিন ধরে প্রচুর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে মঞ্চস্থ হয়েছিল নাটক। তখন বুঝিনি, এখন বুঝতে পারি, প্রচুর খরচ করেছিলেন ডি কে।

তিনি ছিলেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁরা নতুন কিছু উদ্ভাবনায় যতটা উৎসাহী, তার লাভক্ষতির দিকটা চিন্তাও করেন না। সিগনেট প্রেসের সাফল্য যখন তুঙ্গে, তখনই তার পতনও শুরু হয়ে যায়।

বাংলা কবিতাকে প্রকাশনা জগতে ডি কে-ই প্রথম সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শুধু জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথই তো নয়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও নরেশ গুহ-র মতো তরুণ কবির বইও প্রকাশ করতেন। তখন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ অতিশয় বেস্ট সেলার। যেমন সুন্দর ছাপা তেমন সুন্দর শ্বেতচন্দন মাখা প্রচ্ছদ। চার টাকা দাম। বিজ্ঞাপনে দেওয়া হল যে এক বছরে ছিয়ানব্বই হাজার কপি বিক্রি হয়েছে।

ডি কে-র শ্যালক বুড্ঢা যে হেতু আমার বিশেষ বন্ধু, তাই আমি ওদের কিছু কিছু ভেতরের কথা জানতাম। শুনেছিলাম, চার টাকা দামের ওই বইয়ের প্রোডাকশন কস্ট সাড়ে পাঁচ টাকা। অর্থাৎ যত বেশি বিক্রি হবে তত বেশি ক্ষতি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ সংগ্রহ পাঠকরা ছুঁতেও ভয় পায়।

এই দু’জন মানুষের কথা লিখতে ইচ্ছে হল একটাই কারণে। এঁরা কেউ কিন্তু জমিদার বা বড় ব্যবসায়ীর মতো ধনী ছিলেন না। উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যায়। ডি কে তো শেষ পর্যন্ত বিষয়সম্পত্তি কিছুই রেখে যাননি শুনেছি। এখনও তো বাঙালিদের মধ্যে ওঁদের তুলনায় কিছু ধনী ব্যক্তি আছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের কেউ কেউ কি নেহাত শখে কিংবা খেয়ালিপনায় অল্প বয়সি কবি শিল্পী, নাট্যদলের সঙ্গে মিশে অকাতরে অকারণে অর্থ ব্যয় করতে পারেন না? না কি যুগের হাওয়াই এখন অন্য রকম?

৩০. ১১. ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *