গ্রন্থব্যবসায় এক ঐতিহাসিক অধ্যায়
ঠিক সাহিত্য নয়, গ্রন্থব্যবসার জগতে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় হয়ে রইল অবশ্যই হ্যারি পটার কাহিনি। লেখিকা শ্রীমতী রাউলিং মোট সাতখানা উপন্যাস লিখেছেন হ্যারি ও জাদুগল্প নিয়ে, তা নিয়ে ফিল্ম হয়েছে আটখানি। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ, পার্ট টু’ এই নামে অষ্টম ছবিটি শুরু হয়ে গেল এই জুলাই মাসের ১৫ তারিখে। শ্রীমতী রাউলিং ঘোষণাই করে দিয়েছেন যে তিনি হ্যারির সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আর কোনও বই লিখবেন না। অর্থাৎ, এ বিষয়ে আর কোনও উপন্যাস বেরুবে না, আর কোনও চলচ্চিত্রও প্রকাশিত হবে না। একটা অধ্যায়ের শেষ হল। অবশ্য, সেই বইগুলি ও চলচ্চিত্রক’টির জনপ্রিয়তা আরও কত দিন চলবে কে জানে!
আর জনপ্রিয়তা মানে, ব্যাখ্যাহীন, বিস্ময়কর ব্যাপার। সাতখানা বইয়ের প্রত্যেকটি সমান জনপ্রিয় আর প্রত্যেকটি চলচ্চিত্র ব্যবসায়িক দিক থেকে অসম্ভব সার্থক। এই যে ‘ডেথলি হ্যালোজ পার্ট টু’ ফিল্মটি, তার প্রথম সপ্তাহেই বিক্রির পরিমাণ দেখে প্রযোজক ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর চক্ষু চড়কগাছ। আশাতীত তো বটেই, সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিক্রির সর্বোচ্চ রেকর্ড। হলিউডেও এমন কখনও হয়নি আগে। কী এর জাদু?
বারো বছর আগেও শ্রীমতী রাউলিং ছিলেন এক বিবাহবিচ্ছিন্না ব্রিটিশ মহিলা, একটি সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসার, লেখিকা হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন, তার পর একটা পাণ্ডুলিপি, যাকে বলে, লেগে গেল। আমরা বাংলায় যাকে বলি গাঁজাখুরি গল্প, হ্যারি পটার নামে এক কিশোর ও জাদুবিদ্যা শেখাবার কলেজের গল্প। ঠিক তা-ই, তবু সেই অবান্তর, উদ্ভট কাহিনি নিয়েই কী করে বাচ্চা পাঠকদের মধ্যে এমন অসম্ভব উন্মাদনা সৃষ্টি করল, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে বটে, কিন্তু সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। এটা যেন সত্যিই ম্যাজিক। তবে দীর্ঘস্থায়ী। আর শ্রীমতী রাউলিং এখন পৃথিবীর যে-কোনও দেশের রানির চেয়েও ধনী।
কোন বই হঠাৎ অসংখ্য পাঠকের মন জয় করে নেবে, তাও যেন এক দুর্বোধ্য ম্যাজিক। হঠাৎ কোনও এক অজ্ঞাতকুলশীল লেখক বা লেখিকার বই বেস্টসেলার লিস্টের প্রথমে এসে যায়। তারপর তা নিয়ে কত রকম গল্প ও প্রচার চলে। আজকাল বইয়ের ক্রেতা ও পাঠক কমে যাচ্ছে, এ রকম শুনতে শুনতেও দেখতে পাই, মার্কিন দেশে বিশেষ কোনও বইয়ের প্রথম প্রকাশের দিনেই তিন লক্ষ বিক্রি। এখন তো আবার ইলেকট্রনিক বই বা ই-বুক এসে গেছে। বাংলায় অবশ্য এ সব এখনও কল্পনার অতীত। আমাদের যে বেস্টসেলার লিস্ট প্রকাশিত হয়, তাতে কোন বই সপ্তাহে কতগুলি বিক্রি হলে এই লিস্টে স্থান পাবার যোগ্যতা পায়, তা কখনও জানানো হয় না। আনন্দবাজারে যে বেস্টসেলার সাপ্তাহিক তালিকা বেরোয়, তাতে বছরের পর বছর শীর্ষস্থানে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং সত্যজিৎ রায়ের নাম স্থায়ী হয়ে আছে। অন্যান্য লেখকদের নাম মাঝে মাঝে বদলাবদলি হয়। এটা বাংলায় প্রয়াত লেখকের পক্ষে খুবই গৌরবের কথা, কিন্তু জীবিত লেখকদের পক্ষে তেমন সম্মানের নয়। তবে, শরৎচন্দ্রের নাম আর থাকে না বলে একটু খটকা লাগে। আর জন্মের দেড়শো বছর উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত রকম উৎসব-আয়োজন চলছে, তবু রবীন্দ্রনাথের বই কি তেমন বিক্রি হচ্ছে না? যদিও রবীন্দ্ররচনার প্রকাশের অধিকার এখন মুক্ত। তবে, দুই বাংলার লেখকদের সংযুক্ত তালিকা প্রকাশের রেওয়াজ আমাদের নেই, হয়তো ঠিক সংখ্যা জানারও অসুবিধে আছে। যদি থাকত, তা হলে নিশ্চিত বাংলাদেশের হুমায়ুন আহমেদের নাম শীর্ষ তালিকায় দেখা যেত মাসের পর মাস। আমি শুনেছি, হুমায়ুন আহমেদের এক-একটি উপন্যাস দু’মাসে পঁচিশ হাজার কপির সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। পশ্চিমবাংলায় তেমন কোনও লেখক আছেন কি?
বেস্টসেলার প্রসঙ্গে আর একটি প্রায় অবিশ্বাস্য কাহিনি শোনাতে চাই। স্টিগ লারসন নামটি আমাদের দেশে তেমন সুপরিচিত নয়। ইনি ছিলেন এক জন সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক প্রতিবাদী। কাজ করতেন সুইডেনের একটি সংবাদ সংস্থায়, তাও ডিজাইনার হিসেবে, আর এক্সপো নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন চালাতেন। সুইডেনে একটি নাতসিপন্থী উগ্র দল মাঝে মাঝে মাথা তোলে, লারসন তাদের বিরোধিতা করতেন সব সময়। লেখক হিসেবে কেউ তাঁকে কখনও তেমন গুরুত্ব দেয়নি। হঠাৎ কী খেয়াল হল, লারসেন রহস্য-কাহিনি লিখতে শুরু করলেন, লিখলেন পর পর তিনখানা। একখানাও ছাপার আগে তিনখানা উপন্যাস লেখা কিছুটা অভিনব তো বটেই, তার চেয়েও চমকপ্রদ ব্যাপার এই যে, প্রথম উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি প্রেসে জমা দেবার পর, সেটি পুস্তক অবস্থায় না দেখেই মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়েসে তিনি আচমকা মারা গেলেন। এবং সেই বই ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু’ প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গেল। সুইডেনে তো বটেই, বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদেও। মৃত্যুর সঙ্গে জনপ্রিয়তার কি কোনও সম্পর্ক আছে? অনেক সময় লেখকের মৃত্যুর কথা রটিয়ে দিলে তাঁর সম্পর্কে পাঠকদের আগ্রহ জাগতে পারে। যেমন একবার ঘটেছিল বাংলায়। বিনয় মুখোপাধ্যায় নামে একজন সাংবাদিক এক সময় যাযাবর ছদ্মনামে ‘দৃষ্টিপাত’ নামে একটি বই লেখেন এবং সে বইয়ের ভূমিকায় লেখা ছিল যে লেখক মৃত, যদিও তিনি বহাল তবিয়তে দিব্যি বেঁচে। পঞ্চাশের দশকে সে বই এমনই জনপ্রিয় হয় যে, লোকে দোকানের সামনে লম্বা লাইন দিয়ে সে বই কিনেছিল। পরে রহস্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, যাযাবর আরও বেশ কয়েকটা বই লিখেছেন, কিন্তু সে জনপ্রিয়তা আর পায়নি।
লারসন অবশ্য সত্যি সত্যি মৃত, বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০০৪ সালে। তারপর তাঁর উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা কোন তুঙ্গে পৌঁছেছে, তার একটা হিসেব দিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা। মূল রচনা ও অনুবাদ মিলিয়ে এই বই বিক্রি হয়েছে পঞ্চাশ মিলিয়ন কপি৷ পাঁচ কোটি বই? এবং এখনও সমান জনপ্রিয়তা।
‘দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু’ উপন্যাস আমি পড়ে দেখেছি। সুবিধে লাগেনি, কেন এত জনপ্রিয়তা, তাও বুঝতে পারিনি। খটোমটো সুইডিশ নাম ও জায়গা, ও দেশের ব্যাঙ্কিং অর্থনীতি, শেয়ার বাজার সম্পর্কে এত খুঁটিনাটি আছে যে রহস্য-কাহিনি হওয়া সত্ত্বেও আমি আগ্রহ ধরে রাখতে পারিনি। সে যা-ই হোক, আমার ভাল না লাগলেও লক্ষ লক্ষ পাঠকের তো লাগছে।
এই জনপ্রিয়তা নিয়েও এখন তৈরি হয়েছে এক জটিল সমস্যা। এত বই বিক্রির রয়ালটি তো অনেক টাকা। সে টাকা কে পাবে? লারসন বিয়ে করেননি, কিন্তু টানা বত্রিশ বছর ধরে তাঁর এক বান্ধবী ছিল, তাঁর নাম ইভা গেব্রিয়েলসন। এই ইভা তাঁর সহকর্মী, অনেক ব্যাপারে সাহায্য করেছেন, সহধর্মিণীই, শুধু বিবাহপ্রথায় বিশ্বাসী নন বলে রেজিষ্ট্রি করেননি। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন কোনও নারী ও পুরুষ, এক সঙ্গে অনেক দিন বাস করলে তাঁরা পরস্পরের সম্পত্তিরও অংশীদার হন। কিন্তু সুইডেনে সে রকম কোনও আইন নেই। তার ফলে লারসেনের বাবা ও ভাই এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য। ইভাকে বঞ্চিত করা নিশ্চিত অমানবিক হলেও আইন হচ্ছে আইন। মামলা চলছে, এর মধ্যে ইভাও একটা বই লিখে ফেলেছেন, সেটার নাম ‘স্টিগ লারসেন এবং আমার সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের জানাতে চাই।’ সে বইটিও বেস্টসেলার।
২৭. ৭. ২০১১
নবান্ন উৎসবের কথা, বহু দিন পরে
দাদা, আপনার কি মনে আছে, পোলটা পেরিয়ে একটুখানি গেলেই একটা বাজার ছিল। আমরা বলতাম, বাবুর বাজার।
হ্যাঁ, মনে আছে। খালের ওপর (আমরা মনে করতাম নদী) কাঠের ব্রিজ, তার ডান দিক বা বাঁ দিকে বাজার।
আপনি সেখানে কখনও বাজার করেছেন?
না রে, আমি তখন বেশ ছোট, বড়জোর ছ’সাত বছর বয়েস, তবে বাবার সঙ্গে গেছি কয়েকবার।
সেখানকার কোনও স্মৃতি আছে?
খুব সামান্য। এক দিন বাবা একটা লেপ কিনলেন, (ওখানে বলত ল্যাপ) তাঁর মায়ের জন্য। কাঁথা গায়ে তাঁর শীত করত। টুকটুকে লাল রঙের লেপ, সেটার কথা মনে থাকার কারণ, আমার ঠাকুমার পাশে শুয়ে আমিও সেই লেপ গায়ে দিয়েছি কিছু দিন।
আর কিছু?
এক দিন মাছের বাজারে ইলিশ মাছ কেনা। তোমরা শুনলে অবাক হবে, সে বাজারে কোনও মাছই ওজনদরে বিক্রি হত না। ছোট মাছ, যেমন পুঁটি, খলসে, বেলে, ট্যাংরা— এই সব বিক্রি হত ভাগা দিয়ে। দু’পয়সা চার পয়সা ভাগা; কই মাছ এক সঙ্গে চারটেকে বলা হত হালি, অথবা কুড়িটা এক সঙ্গে। মজার ব্যাপার, এটা আমি পরে শুনেছি, কোনও কোনও জেলায় মুখে বলা হত এক কুড়ি কিন্তু দিত বত্রিশটা৷ আর বড় মাছ, যেমন রুই বা ইলিশের দাম ঠিক করা হত তার আকৃতি দেখে। বাবা এক জোড়া ইলিশ কিনেছিলেন। কত দাম দিয়েছিলেন জানি না, যত দূর মনে হয়, দু’আনা বা তিন আনার বেশি নয়। তখন ষোলো আনায় এক টাকা।
আমরা অত শস্তা মাছ দেখি নাই, তবে এক টাকায় অনেক কিছু কেনা যেত।
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সেই বাজারেরই পিছন দিকে একটা পাঠশালা ছিল না?
আমরা পাঠশালা দেখি নাই, তবে একটা প্রাথমিক স্কুল আছিল। পরে সেইটা বড় স্কুলের সঙ্গে মিলে যায়।
এখন বোধহয় কোনও গ্রামেই পাঠশালা নেই, প্রাইমারি স্কুল দিয়ে শুরু। আমি কিন্তু পাঠশালায় পড়েছি। খড়ের চালের ঘর, মেঝেতে চট পেতে বসা, সঙ্গে শুধু স্লেট পেন্সিল। নামতা পড়া হত চেঁচিয়ে। সেই নামতা এখনও আমার মনে আছে। তাই সাত চোদ্দং আটানব্বই চট করে বলে দিতে পারি। আমি কলকাতার পাঠশালাতেও পড়েছি, দর্জিপাড়ায় ‘যদু পণ্ডিতের পাঠশালা’, সেটা বেশ বড় পাকা বাড়িতে। এখন নাম বদলে ফেলেছে কি না জানি না।
দাদা, ‘কালা রায়ের বাগ’ কিংবা রায় বাগানের কথা আপনার মনে পড়ে?
নাঃ।
ওটা ছিল এক বিশাল জঙ্গল, গভীর, দিনের বেলাতেও পাশ দিয়ে যেতে আমাদের গা ছমছম করত ছোটবেলায়। (আপনার ছোটবেলার অনেক পরে), মাঝে মাঝে সেখানে নাকি বাঘও (ওখানে বলত বড় শিয়াল) এসে পড়ত। চোর-ডাকাতের ভয়ও ছিল।
না ভাই, সে জঙ্গলের কথা আমার মনে নেই। তবে, সুন্দরবন থেকে বেশ দূরে হলেও মাঝে মাঝে ওই দিককার গ্রামে দু’একটা বাঘ ছিটকে চলে আসত, গল্প শুনেছি। আর এক রকম প্রাণী ছিল বাঘডাসা, আর গুলবাঘার কথাও শুনেছি, সেটা নাকি পুরোপুরি বাঘ নয়। আর শিয়াল আর সাপ ছিল অজস্র। তোমাদের গ্রামে এখনও কি তেমন গভীর জঙ্গল আছে?
তোমাদের গ্রাম কেন বলছেন? আপনারও গ্রাম নয়? আপনার জন্মস্থান—।
তা ঠিক, তা ঠিক।
দাদা, মাইজ পাড়ার কথা আপনার মাঝে মাঝে মনে পড়ে না?
ঠিক মাঝে মাঝে মাঝে না হলেও, বহু বছর তো হয়ে গেল, তবু হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। যখন মনে পড়ে, তখন স্মৃতি একেবারে জ্বলজ্বল করে। সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাই। সেখানে অত গাছপালা আছে এখনও?
না, না মানুষ বাড়ছে না? সব সাফ করে দিচ্ছে। যে সব গাছের এখন মালিকানা নাই… আপনাদের বাড়ির সামনের জম্ভুরা গাছটা (বাতাবি লেবু) কঙ্কালসার অবস্থা আমি দেখছি, তাও শেষ পর্যন্ত গেছে। যে-সব জঙ্গলে ছোট বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে পলাপলি খেলেছি, সে-সব আজ অদৃশ্য।
জম্বুরা গাছের আয়ু কত দিন হয়, জানি না, ষাট-সত্তর বছর আগের কথা। তবে বটগাছটা, ইস্কুল যাবার পথে, খুবই বিশাল ছিল, কত কোটর, কত ডালপালা, তার নীচে এক ধারে হিন্দুদের একটা ছোটখাটো শ্মশানও ছিল। তাই একটু ভয়ের ব্যপারও ছিল।
দুঃখের বিষয়, সে গাছটাও নাই, কেটে ফেলেছে। আমি দেখেছি ছোট বয়সে, সত্যি খুব বড় গাছ ছিল সেটা, তবে বট না, অশ্বত্থ।
ওই গাছে তক্ষক ছিল। ঠিক সাত বার ডাকত, আমরা গুনতাম, ভয়ও পেতাম।
সে ডাক আমরাও শুনেছি। আমরা ওটাকে তক্ষক বলতাম না, বলতাম ঠক্কর। আর জানতাম যে ওরা দূর থেকে মানুষের শরীরের রক্ত শুষে নেয়। তাই আগে থেকে বুকে ছ্যাপ (থুতু) ছিটিয়ে নিতাম।
আসলে তক্ষক সাপই নয়, বড় আকারের গিরগিটি, বিষ-টিষ নেই। মহাভারতে তক্ষক সাপ একটা বড় চরিত্র, তাই নাম শুনলেই ভয় জাগত।
দাদা, আপনি হয়তো ব্যস্ত ছিলেন, আপনাকে ফোনে বিরক্ত করলাম কি না জানি না। আজ সকালে ঘুম ভেঙেই দেখি, আমার জানলার বাইরের গাছটা সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে, ঝলমল করছে রোদ, সেখানে দুটো পাখি এসে বসেছে। অর্থাৎ, এ দেশে বসন্ত এসে গেল। কানাডার প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও পাখি দুটো বেঁচে ছিল কী করে তাই ভাবি। একটুক্ষণ ভাবতে ভাবতেই আমার দৃষ্টি ও মন চলে গেল বহু দূরে, পূর্ব গোলার্ধে, আমাদের গ্রামে। এখানে থাকি, প্রায়ই মন চলে যায় সেখানে। সেই মাটির পথ, বৃষ্টিভেজা গাছপালা, কত রকম পাখি, আমার খুব ইচ্ছে হল সেই গ্রামের স্মৃতির ছবি আপনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি।
রাজ্জাক, আমার জন্ম তো তোমারও আগে। দেশভাগের আগে আর পরে তো ওই সব গ্রামের ছবি অনেক বদলে যাবেই। জনগোষ্ঠীর প্যাটার্ন পাল্টে গেছে। আমি যে-সব বাড়িতে যে-সব মানুষ দেখেছি, সেখানে এখন অন্য মানুষ। এই তো যেটা জতু গাঙ্গুলির বাড়ি বলে পরিচিত ছিল, এখন সেটা হাওলাদার বাড়ি। এটাই স্বাভাবিক।
দাদা, হিন্দু-মুসলমান, ধোপা-নাপিত, বামুন-কায়েত, কামার-কুমোর, মুচি-ডোম-জেলে মিলে এক সময় মাইজপাড়া জমজম করত, আমি খুব ছোট বয়েসে অল্প অল্প দেখেছি সে-সব। তারপর কত মানুষ চলে গেল, আমার খেলার সঙ্গীরা, অনেক শূন্য বাড়ি হাহাকার করে, কেমন যেন নিরানন্দ ভাব।
তুমিও তো সে গ্রামে আর থাকে না।
থাকতে পারলাম না। ফিরে গেছি বার বার, আবার চলে আসতেও বাধ্য হয়েছি, তবু কেন বুক জুড়ে রয়েছে সেই গ্রাম। দাদা, একটা প্রশ্ন করি, আমার দেখা মতে, আপনাদের যেখানে বাড়ি ছিল, সেখানে ছিল তিনটি পরিবার। চৌধুরি, চ্যাটার্জি আর ব্যানার্জি, কেউ তো গাঙ্গুলিদের কথা বলেনি, কোনও বাড়িও দেখিনি। আমরা শুধু চৌধুরিদের দেখেছি, অন্য কোনও বাড়িতে কেউ ছিল না। সে বাড়ির এক জন আমাদের মতন বাচ্চাদের পড়াতেন। তাঁকে আমরা বলতাম ছদ্রি স্যার।
বললাম না, তোমার আর আমার স্মৃতির ছবি অন্য রকম হবেই। তুমি শুধু দেখেছ চৌধুরিদের, ওই পল্লিটি বামুনপাড়া বলে পরিচিত ছিল। একটা বড় চতুষ্কোণ প্রাঙ্গণের চার পাশে চারটি বাড়ি, প্রধান বাড়িটিই চৌধুরিদের, তাঁরা বেশ অবস্থাপন্ন। এর ঠিক উল্টো দিকেই নগেন চাটুজ্জ্যের মস্ত বড় পরিবার, সেই পরিবারের এক জনকে আমরা ডাকতাম চুনীকাকা, পঞ্চাশ সালে তিনি খুন হন, কলকাতায় বসে শুনেছি, তার পরেই পরিবারটি ছত্রভঙ্গ হয়ে দেশত্যাগী হয়। আর দু’দিকে ছিল দু’টি ব্যানার্জি ও চ্যাটার্জি বাড়ি, এঁদের সম্পর্কে আমার স্মৃতি অতি সামান্য। তোমরা গাঙ্গুলিবাড়ির নাম শোনোনি, তার কারণ বুঝতে পারছ, এই পরিবারগুলির মধ্যে গাঙ্গুলিরাই ছিল সবচেয়ে এলেবেলে, সবচেয়ে গরিব। তাদের সামনের দিকে স্থান হয়নি, পিছনের এক কোণে… আমার জ্যাঠামশাই থাকতেন, তিনি চলেও আসেন আগে।
বুঝেছি, ওইখানে একটা মস্ত পুকুর ছিল, এখন অনেকটাই মজে গেছে, পাট চাষ হয়।
অ্যাঁ? পুকুরটা আমার খুব প্রিয় ছিল। ওখানে আমি সাঁতার শিখেছি। প্রায়ই দুপুরে এসে বসে থাকতাম, জলের দিকে তাকিয়ে। কী যেন একটা দেখার আশায়।
অ্যাঁ? পুকুরটা আমার খুব প্রিয় ছিল। ওখানে আমি সাঁতার শিখেছি। প্রায়ই দুপুরে এসে বসে থাকতাম, জলের দিকে তাকিয়ে। কী যেন একটা দেখার আশায়।
চৌধুরিবাবু মারা যাবার পর তাঁর স্ত্রী দু’টি কন্যা নিয়ে আর থাকতে সাহস পেলেন না। তখন কিন্তু ‘বাংলাদেশ’-এর জন্ম হয়ে গেছে। উনি প্রতি বছর আমাদের নবান্ন খাওয়ার দাওয়াত (নেমন্তন্ন) দিতেন। সকালবেলা দৌড়ে গিয়ে চৌধুরি স্যারের স্ত্রীর গলা শোনা যেত, আয়, আয়, কাক, আয়, আয়, কো-কো-কো।
রাজ্জাক, তুমি আমাকে কত দিন পর নবান্নের কথা মনে করিয়ে দিলে। সেই কা কা ডাকা, সেই নতুন চালের গন্ধময় পায়েস।
টেলিফোনে অনেকক্ষণ ধরে এই সব কথা বলছে যে দু’জন, তাদের বিষয়, পৃথিবীর প্রায় উল্টো দিকে, সাড়ে চোদ্দো হাজার মাইল দূরের এক অতি সাধারণ গ্রাম। রাজ্জাক থাকে মনট্রিয়ল শহরে, আমি কার্য-কারণবশত কয়েক দিনের জন্য বোস্টন শহরে।
আমি তো কখনও কোথায়, কোন মাটিতে আমার জন্ম, তা নিয়ে তেমন গুরুত্ব দিইনি। তবু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কেন এই স্মৃতিচর্চা? আর রাজ্জাক হাওলাদার ছিল এক জন মুক্তিযোদ্ধা, তার ছ’ভাইয়ের মধ্যে পাঁচ ভাই-ই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। রাজ্জাকের স্বপ্ন পূরণ হয়নি, দূর বিদেশে বসে বাংলার মাটির জন্য বুকে ব্যথা হয় তার।
১০. ৮. ২০১১
ইলিশ, ইলিশ হায় রে ইলিশ!
আজ সকালে আমি গেলাম বাজারে। ইলিশের সন্ধানে। বুদ্ধদেব বসু, কবিতা লিখেছেন, ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ ইলিশ মাছ নিয়ে। বাংলা সাহিত্যে ইলিশের ছড়াছড়ি। সৈয়দ মুজতবা আলি বর্ণিত সেই গল্পটি নিশ্চয়ই অনেকেই জানেন। তবু সংক্ষেপে আবার বললে ক্ষতি নেই। এটি বিখ্যাত সম্রাট মুহম্মদ-বিন তুঘলক সম্পর্কে। ইতিহাসে যাঁকে পাগলা রাজাও বলা হয়। সেই তুঘলক গেছেন গুজরাটে বিদ্রোহীদের দমন করার উদ্দেশ্য নিয়ে। এমনকী জলাভূমিতে নৌকায় চেপে তাদের তাড়া করতেও সম্রাটের খুব উৎসাহ। তারই মধ্যে এক বিকেলে হঠাৎ একটা মাছ লাফিয়ে উঠে পড়ল নৌকার উপর। ঝকঝকে সাদা রং, তার গড়নটি চমৎকার। মাছটি দেখে সম্রাট খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়লেন। এটা কী মাছ, কেউ জানে না। তুঘলক বললেন, এটাকে এক্ষুনি কেটেকুটে রান্না করে দাও। আমি খেয়ে দেখব। তা শুনে মন্ত্রী ও পারিষদরা আঁতকে উঠলেন। তারা সম্রাটকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, এই মাছ বিষাক্ত কি না তা তাঁর জানা নেই, তা ছাড়া এখন রোজার মাস চলছে, সুতরাং এখন এই মাছ সম্রাটের মুখে ছোঁয়ানোই উচিত নয়। জেদি সম্রাট কারও উপদেশ গ্রাহ্য করলেন না। তাঁর আদেশে তিনি সেই মাছ রান্না করালেন এবং খেলেন। খুব সম্ভবত অনেকটাই খেয়ে ফেললেন। তার পর তাঁর পেট ছেড়ে দিল, এবং সেই কারণেই কি না কে জানে, কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু হল তার। এর পর মুজতবা আলির মন্তব্য এই: সেই অচেনা মাছটি ইলিশই ছিল। এবং ইলিশ খেয়ে যখন সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে, তখন নিশ্চিত তিনি বেহস্তে গেছেন।
এই কাহিনির ঐতিহাসিকতা নিয়ে আমায় কেউ প্রশ্ন করবেন না, প্লিজ। তবে গুজরাটে ইলিশ পাওয়া যায় ঠিকই। তার নাম পাল্লা। পৃথিবীর বহু দেশেই ইলিশ পাওয়া যায় বিভিন্ন নামে। ইলিশ সমুদ্রের মাছ। এক সময় নদীতে নদীতে ঝাঁক বেঁধে ঢোকে ডিম পাড়ার জন্য। স্যামন মাছেরও এই স্বভাব। তবু বাঙালিদের ধারণা, বাংলার নদীর ইলিশ রূপে, গুণে, স্বাদে, গন্ধে শ্রেষ্ঠ। আমেরিকার ইলিশের নাম শ্যাড।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর উপলক্ষে কত রকম নতুন নতুন গবেষণাপত্র বেরোচ্ছে। ‘রবীন্দ্রনাথ ও মাছ’ এই বিষয়ে কেউ কিছু প্রকাশ করেছেন কি না, তা আমার চোখে পড়েনি। রবীন্দ্রনাথের ইলিশ-প্রীতি সম্পর্কে কোনও তথ্য আমার জানা নেই। তবে পদ্মার ওপর বোটে অনেক দিন চেপেছেন, মাঝে মাঝে কি ইলিশ চেখে দেখেননি?
স্বামী বিবেকানন্দর ইলিশ-প্রীতি বিশ্ববিখ্যাত। স্বামীজির বুকের উপর আড়াআড়ি রাখা দু’হাত ও বীরত্বব্যঞ্জক চেহারা বহু পরিচিত হলেও তাঁর স্বাস্থ্য কিন্তু তেমন ভাল ছিল না। শেষের কয়েক বছর নানা রকম ব্যাধিতে ভুগেছেন। তিনি ছিলেন ভোজনরসিক। অনেক সময় চিকিৎসকদের নিষেধাজ্ঞা গ্রাহ্য করতেন না। একবার পূর্ববঙ্গে গিয়ে স্টিমারে ঘুরতে ঘুরতে ইলিশ মাছ ধরা দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। চোখের সামনে এত টাটকা ইলিশ! তিনি তাঁর সঙ্গী কানাইকে তক্ষুনি আদেশ দিলেন, গোটা কতক ইলিশ কিনে ফেলতে। ওঁদের দলে রয়েছেন মোট সাত জন। তাই কানাই তিনটি বা চারটি বেশ বড় ইলিশ কিনতে চাইলে স্বামীজি তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আমরা ক’জন মিলে খাব আর স্টিমারের খালাসি-মাঝিমল্লারা চেয়ে দেখবে?
কিনে ফেলা হল ষোলোটি ইলিশ। কত দামে? এক একটি চার পয়সা, তাই মোট এক টাকা! এটা গাল-গল্প নয়, বিবেকানন্দর প্রামাণ্য জীবনীতে এই দামের উল্লেখ আছে।
আর এক দিন, তখন স্বামীজির শরীর বেশ খারাপ। একটা যাই যাই রব উঠে গেছে। প্রায়ই তিনি বলেন, তাঁকে শিগগিরই চলে যেতে হবে। তিনি চল্লিশ বছরের বেশি বাঁচবেন না। একদিন তিনি উপোস করেছেন, পর দিন পরমহংসদেবের ঘরে বসে ধ্যান করলেন প্রায় তিন ঘণ্টা। তার পরই তাঁর খুব খিদে পেয়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন, আজ তিনি ভাত মাছ, তরকারি সব খাবেন। পুরোপুরি ঝাল ও মশলা দিয়ে। তখন গঙ্গায় ইলিশ মাছ ধরা হল, প্রেমানন্দ স্বামী সেই মাছ কিনছেন খবর পেয়ে বিবেকানন্দ সেখানে উপস্থিত হয়ে কিনলেন সেই টাটকা ইলিশ। সে দিন বেলুড় মঠে লোকজন বেশি নেই। তাই তিনি প্রেমানন্দকে বললেন, শুধু ঝোল নয়, গোটাকতক মাছ ভাজা করতে বলল, ভাজা ইলিশের স্বাদই অপূর্ব। আর একটু মাছের টক করতেও বলে দিও।
সে দিন তিনি খেলেন ইলিশ মাছের তেল দিয়ে ভাত, ডাল দিয়ে ভাজা মাছ, ঝোলে তেমন ঝাল হয়নি বলে কাঁচালঙ্কা ডলে নিলেন। শেষ পাতে মাছের অম্বল। সেই সব খেয়ে তাঁর শরীরে এমনই শক্তি এল যে, লাইব্রেরি ঘরে এসে কয়েকটি ছাত্রকে পড়াতে লাগলেন পাণিনির ব্যাকরণের মতো নিরস ও শক্ত বিষয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক দিন পর হাঁটতেও বেরোলেন। অনেক ব্যাপারেই তাঁর প্রবল উৎসাহ। অনেক গল্প করলেন অন্যদের সঙ্গে।
সেই রাত্রেই তাঁর মৃত্যু হল।
কোনও মৃত্যুর সঙ্গে ইলিশ ভক্ষণের নিশ্চয়ই কোনও সম্পর্ক নেই। আসল কথা হচ্ছে, খুব ভাল জিনিস একসঙ্গে বেশি আহার করতে নেই। বাঙালদের অভ্যাস আছে। তারা তবু অনেকটা খেয়ে নিতে পারে। বিবেকানন্দ বাঙাল ছিলেন না। তাই সহ্য করতে পারেননি। আবার ভক্তদের মতে, তিনি পুণ্যাত্মা মানুষ, ওই রাতেই তাঁর চলে যাওয়ার কথা ছিল, যাওয়ার আগে বেশ তৃপ্তি করে ইলিশের সব রকম স্বাদ নিয়ে গেলেন।
ইলিশ বিষয়ে আমার আরও অনেক কিছুই লেখার আছে, কিন্তু আজকাল অনেকেই আর পুরনো কথা শুনতে চায় না। আমি অনেক দিন বাজারে যাইনি, এ বছর শুনছি ইলিশের দাম নাকি ছ’শো সাতশো টাকা। অবিশ্বাস্য মনে হয়। নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখতে গেলাম।
এত দিন পরে বাজারে গেলেও তরকারিওয়ালি, ডিমওয়ালি, আলু-পেঁয়াজের দোকানদার অনেকেই আমাকে চিনতে পেরে, উঠে এসে আপনজনের মতো জিজ্ঞেস করে, দাদা অনেক দিন দেখিনি তোমায়, শরীর ভাল আছে তো? আজকাল আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেই বিশেষ দেখা হয় না। এঁদের গলায় সেই আত্মীয়তার স্পর্শ পেয়ে মনটা নরম হয়ে যায়।
মাছের বাজারে যাওয়ার আগে, তরি-তরকারির বাজার দেখে চমকে উঠি। এত বৃষ্টি ও বন্যার কারণে নিশ্চয়ই অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সাধারণ তরকারিরই আগুন দাম। গরিব মানুষরা মাছ-মাংস বেশি দাম দিয়ে কিনতে পারে না। এখন খাবেও না। কিন্তু তরকারি না পেলে কী খেয়ে বাঁচবে? বেগুন যাট টাকা, কচুর শাক কুড়ি টাকা।
মাছের বাজারেও জমজমাট ভাবটা নেই। সাপ্লাই কম, অনেক দোকান খালি। ইলিশ আছে বটে, সবই বাংলাদেশের। এককালে ডায়মন্ডহারবার, কোলাঘাট, বাগবাজার ঘাটের ইলিশের খুব সুনাম ছিল। সে সব নাম আর কেউ করে না। এখন পুরোপুরি বাংলাদেশের উপর নির্ভরতা। এই বাজারে যে সব ইলিশ রয়েছে, তা ছোট ছোট, বরফ দেওয়া, অনেকটা স্থল পথ পার হয়ে তারা এসেছে। বরফ তো দিতেই হবে।
আসল ইলিশের স্বাদ দেড় কিলো থেকে পৌনে দু’কিলোতে। আমরা বাল্যকাল থেকে ইলিশের সমঝদার। আমার মতন এমন মানুষ খুব কমই আছে, যে জ্যান্ত ইলিশকে লাফাতে দেখেছে। ছোট ইলিশ কখনও খেতাম না, আর বরফের ইলিশ তো ছুঁয়ে দেখারও প্রশ্ন ছিল না। কার্য-কারণবশত এ বছর এক দিনও ইলিশ খাইনি। একটুক্ষণ দোলাচলে রইলাম, দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনই খাঁটি ইলিশের স্বাদের সঙ্গে অন্য কিছুর সমঝোতা চলে না। বরং না খাওয়াই ভাল। আমি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে আমার পরিচিত মাছওয়ালাটি বলল, দাঁড়ান স্যার, আপনার জন্য আমি কাঁচা মাছ এনে দিচ্ছি।
কঁচা মাছ কাকে বলে তা আমি জানি। বরফ ছাড়া। টাটকা। কোনও কারণে এই মাছ এরা আড়ালে লুকিয়ে রাখে।
সে যে দু-তিনটে মাছ নিয়ে এল, তাদেরও ওজন এক একটি এক কিলো একশো মাত্র। তবে গড়ন ও গায়ের রং দেখে বোঝা যায়, ভাল জাতের। কাঁচা মাছের দাম বেশি। সাতশো টাকা কিলো। শুনে পিলে চমকে যাওয়ার কথাটা অনেক দিন পর মনে পড়ল।
ফেরার পথে আমার কিন্তু বেশি মন খারাপ হল। বেগুনের দাম ষাট টাকা শুনে। তবু মানুষ বেঁচে আছে। মানুষ বেঁচে থাকবে।
একটি বিস্মৃত কাহিনি
অনেক কাল আগে, স্বাধীনতা ও দেশ বিভাগের আগে, এক কলকাতার বাবু গিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গে বেড়াতে। একটি গ্রাম্য কিশোরের সঙ্গে ভাব জমাবার উদ্দেশ্যে তিনি জিজ্ঞেস করলেন খোকা, আজ কী দিয়ে ভাত খেলি রে দুপুরে?
ছেলেটি বলল, কলমি শাক আর দুইখান মাছ ভাজা দিয়া দুগ্গা (কিছু) ভাত খাইলাম। তার পর মাছের ঝোল দিয়া ভাত খাইলাম। তার পর পুঁটিমাছ আর তেঁতুলের চুকা (টক) অম্বল।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, সে কী রে, তোরা ডাল খাসনি?
ছেলেটি ততোধিক অবাক হয়ে বলল, কত্তা, আমরা কি বড়লোক যে ডাইল খাব?
২৪. ৮. ২০১১
দুই বিখ্যাত বন্ধুর বিচ্ছেদ কাহিনি
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল অনেক দিন। শেষের দিকে তা একেবারে বিষিয়ে যায়। এই বন্ধুবিচ্ছেদের কথা অনেকে জানে। কিন্তু প্রথম দিকের অনেক ঘটনা, যাতে দেখা যায় দু’জন বড় লেখকের মধ্যে গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনি, তা অনুধাবন করলে এই প্রশ্ন জাগবেই, কেন সে সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল, কেন এমন একটা অত্যন্ত কুরুচিকর কাণ্ড ঘটল? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর সম্ভবত আজও পাওয়া যায়নি।
এর কারণ কি শুধু ঈর্ষা? দু’জন সমসাময়িক লেখকের মধ্যে বন্ধুত্ব যেমন হয়, তেমনই ঈর্ষার সম্পর্কও স্থাপিত হতে পারে। সেটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। লেখকরা স্পর্শকাতর প্রাণী। যে কোনও শিল্পীই তাই। প্রায় একই বয়সী অন্য কোনও লেখকের সার্থকতা এবং খ্যাতি বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে আর একজন লেখকের মন ঈর্ষায় জ্বলে, কিন্তু তিনি সেই জ্বালা মনে মনেই চেপে রাখেন। এমনকী সেই ঈর্ষার জ্বালায় তার সৃষ্টি আরও বিকশিত হতে পারে কিন্তু প্রকাশ্যে সেই ঈর্ষার নগ্নরূপ দেখানো কি কোনও লেখককে মানায়?
আপাতদৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে ঈর্ষা করার কোনও কারণই নেই দ্বিজেন্দ্রলালের। তাঁর জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাননি। তাঁর সুনাম বাংলার বাইরে ছড়ায়নি। দু’জনেই কবি। দু’জনেই গান সৃষ্টি করেন। রবীন্দ্রনাথও নাটক লেখেন, কিন্তু নাট্যকার হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল অনেক বেশি জনপ্রিয়। দু’জনেই অভিজাত পরিবারের সন্তান।
রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে ঈর্ষা বা বিদ্বেষের সামান্যতম উপাদানও খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। সারা জীবনে রবীন্দ্রনাথ কখনও নিন্দুকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে যাননি। কোনও আক্রমণেরই তিনি প্রতি আক্রমণ-অস্ত্র শানাননি। তা বলে কি তিনি আঘাত পেতেন না? সামান্যতম আক্রমণেই তিনি আহত হতেন। তিনি লিখেছেন, কটাক্ষ যতই ক্ষুদ্র হউক, তাহারও বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু সেই সব আঘাতের কথা তিনি অতি সন্তর্পণে গোপন রেখেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল যখন থেকে রবীন্দ্র-বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন, তখনও একাধিক বার রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রশংসা করেছেন।
প্রথম জীবনে ঠাকুরবাড়ির অনেকের সঙ্গেই দ্বিজেন্দ্রলালের বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বিলেত থেকে ফিরে আসার পর দ্বিজেন্দ্রলাল (তখন তিনি পরিচিত ছিলেন দ্বিজুবাবু হিসাবে, যেমন রবিবাবু)। কিছু দিন আবগারি বিভাগের পরিদর্শকের কাজ করেছেন। সেই সুবাদে তাঁর একটি বজরা ছিল। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের বজরায় গিয়ে অনেক সময় কাটিয়েছেন। এ বজরাটি একেবারে কলকাতার গঙ্গায়। দ্বিজুবাবু প্রায়ই কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এই বজরায় সান্ধ্য বিহার করতেন। সেই আড্ডায় প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন রবিবাবু। দু’জনেই পর পর গান গাইতেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজে দ্বিজেন্দ্রলালের একাধিক গ্রন্থের সমালোচনা করেছেন। তার মধ্যে ‘মন্দ্র’ নামে কাব্যগ্রন্থটির এত প্রশংসা করেছেন, যাকে বলা যায় অতিশয়োক্তির চূড়ান্ত। দ্বিজেন্দ্রলালের কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের লেখা পাঠ্যপুস্তক শান্তিনিকেতনে পড়াবার জন্য সুপারিশ করেছেন। এ সবের উত্তরে দ্বিজেন্দ্রলাল শুরু করেছেন প্রকাশ্যে বিষোদগার।
একাধিক প্রবন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি যে দুটি অভিযোগ এনেছেন, তা হল দুর্বোধ্যতা এবং অশ্লীলতা। দ্বিজেন্দ্রলালের মতে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অস্পষ্ট এবং অস্বচ্ছ। তাই তার মধ্যে চিন্তার গভীরতা নেই। আর তাঁর কবিতার নীতিহীনতা দিয়ে তিনি কলুষিত করছেন এই সমাজকে। দুই কবির মধ্যে নীতিগত বিরুদ্ধ মত থাকতেই পারে। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের সেই প্রতিবাদের ভাষাই যে কুৎসিত। তাঁহার ‘তুমি যেও না এখনই’ ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ ইত্যাদি গান লম্পট বা অভিসারিকার গান।’ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝে মাঝে ছোট ভাইয়ের কবিতা আবৃত্তি করেন, সেটা নাকি তিনি ভাইয়ের কবিতা অ্যাডভার্টাইজ করার ভার নিয়েছেন বলে। ঠাকুরবাড়িতে যে নাটকের অভিনয় হয়, সেগুলোও নাকি আত্মবিজ্ঞাপন ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতার দ্বিজেন্দ্র-কৃত যে সমালোচনা তা বাংলা সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ হাউলারের মতন। এই কবিতা একেবারে অর্থশূন্য ও স্ববিরোধী তো বটেই, এটা যে কত অবাস্তব তার প্রমাণ ‘কৃষক আউস ধান কাটিতেছেন বর্ষাকালে, শ্রাবণ মাসে। বর্ষাকালে ধান কেহই কাটে না, বর্ষাকালে ধান্য রোপণ করে। ধান তিন প্রকার, ১) হৈমন্তিক, তাহাই কৃষকের আসল ধান্য— কাটে হেমন্তকালে, অগ্রহায়ণ মাসে; ২) আউস (নিজে খাইবার জন্যই প্রায় করে) কাটে শরৎকালে, ভাদ্র মাসে; ৩) বোরো (উড়িষ্যা অঞ্চলেই অধিক হয়) কাটে গ্রীষ্মকালে, বৈশাখ মাসে। …ক্ষেত্রখানি তবে একটি দ্বীপ। তবে এ চর জমি। এ রূপ জমিতে ধান করে না। এ সব জমি শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ডুবিয়া থাকে…।
এ সমালোচনায় দ্বিজেন্দ্রলালকে একজন কৃষি বিশেষক হিসাবে অবশ্যই গণ্য করা যায়। কাব্যবোদ্ধা হিসাবে বোধহয় ততটা যায় না।
মনুষ্য চরিত্রে এ রকম একটি দিক আছে যে, তোমাকে যদি কেউ অনবরত আঘাত করে, বিদ্রুপ ও গঞ্জনা দেয়, তুমি যদি তার প্রতিবাদ না কর, চুপ করে সব সহ্য করে যাও, তা হলে আঘাতকারীর রাগ ক্রমশ বাড়তে থাকে, সে একটা কিছু চরম আঘাত হানতে চায়। দ্বিজেন্দ্রলালের ক্ষেত্রেও তাই হল, তিনি তাঁর প্রাক্তন বন্ধুর বিরুদ্ধে আরও কুৎসিত ইঙ্গিত দিয়ে একটি নাটিকা লিখে ফেললেন এবং স্টার থিয়েটারে সেটি অভিনয়েরও ব্যবস্থা হল। ( ‘আনন্দ বিদায়’ নামে সেই প্রহসনটি আমি পড়িনি। পড়ে দেখার খুবই ইচ্ছে আছে। তবে এখন খুবই দুর্লভ।) সেটা ১৯১২ সালের নভেম্বর মাস, তখন রবীন্দ্রনাথের তুলনায় দ্বিজেন্দ্রলালের খ্যাতি, অর্থ-উপার্জন কিছুই কম ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তখন গড়ে উঠেছিল বেশ বড় একটি অনুরাগীমণ্ডলী। দ্বিজেন্দ্রলালের তেমন ভক্তমণ্ডলী ছিল না। এক একজন লেখককে ঘিরেই এ সব হয়। সব লেখকের ক্ষেত্রে হয় না। দ্বিজেন্দ্রলালের পক্ষেও কিছু মানুষ ছিলেন অবশ্যই, তবে তাঁরা যতটা রবীন্দ্রবিরোধী তার চেয়ে বেশি দ্বিজেন্দ্রভক্ত কি না তাতে সন্দেহ আছে।
‘আনন্দ বিদায়’-এর প্রথম রাত্রির অভিনয় তো বন্ধ করে দিতে হয়ই, নাট্যকারকে স্টার কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার খাতিরে পিছনের দরজা দিয়ে বার করে দিতে বাধ্য হন। সে নাটক আর দ্বিতীয় বার মঞ্চস্থ হয়নি।
দ্বিজেন্দ্রলালের সেই রুচিহীন কাজের জন্য তাঁর বেশ অপযশ হয়। এমনকী দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনীকারও এর জন্য তাঁকে নিন্দে করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের ছেলে দিলীপকুমার যাঁকে রবীন্দ্রনাথ খুবই স্নেহ করতেন, তিনিও বাবার এই কাজকে সমর্থন করতে পারেননি পরবর্তী কালে। দ্বিজেন্দ্রলাল যিনি এক এক সময় রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলে মেনে নিয়েছেন, আবার তাঁরই ওপর বার বার কেন এমন আঘাত হানতে উদ্যত হয়েছেন, তা যেন এক মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার মতন। ‘আনন্দ বিদায়’-এর পর দ্বিজেন্দ্রলাল সম্ভবত অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তিনি খুব বিমর্ষ হয়ে থাকতেন। যদিও লিখিত ভাবে কিছু জানাননি। মাত্র এক বছর পরেই এই শক্তিশালী নাট্যকার ও সঙ্গীতস্রষ্টার অকালপ্রয়াণ ঘটে। এখানে একটা অত্যন্ত কৌতূহলজনক ঘটনারও উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বিজেন্দ্রলালের মাথায় নাকি বাজ পড়েছিল একদিন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন যে, দ্বিজেন্দ্রলাল একদিন রবীন্দ্রনাথের প্রতি একটি চিঠি লেখায় ব্যস্ত ছিলেন, একটু পরেই তাঁর মাথায় বজ্রাঘাত হয়। স্ত্রীলোকেরা তাঁর মাথায় ঘড়া ঘড়া জল ঢালতে থাকেন, তাতে সব কাগজপত্র ভিজে যায়। একটি চিঠিতে শুধু রবীন্দ্রনাথের নামটি পড়া যাচ্ছিল। তাতেই অনুমান করা যায় যে, দ্বিজেন্দ্রলাল সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সব বিবাদ মিটিয়ে আবার পুনর্মিলনের আশাই ব্যক্ত করেছিলেন।
এত দিন পর আমরা এই সব ঘটনাকেই ইতিহাসের অন্তর্গত করে দিয়ে দু’জনেরই গুণমুগ্ধ হতে পারি। রবীন্দ্রনাথের এত বড় প্রতিভার পাশেও কী অনবদ্য গান সৃষ্টি করে গেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। তাতে তাঁর নিজস্বতা স্পষ্ট। তার ‘সাজাহান’ নাটক তো আজও অভিনীত হয়। আর দু’বছর পর তাঁরও জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হবে। তখন যেন সেই উপলক্ষটি আমরা সমারোহে উদ্যাপন করতে ভুলে না যাই।
যৌবন বয়সে যখন দু’জনের মধ্যে খুবই সৌহার্দ্য ছিল, তখন দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর কোনও পরিচিত ব্যক্তির জন্য চাকরির উমেদারি করে একটি কৌতুকপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন। তখনকার দিনে অনেক এ ধরনের চিঠি কবিতায় লেখা হত। চিঠিটি এ রকম:
শুনছি নাকি মশায়ের কাছে
অনেক চাকরি খালি আছে—
দশ-বিশ টাকা মাত্র মাইনে
দু’একটা কি আমরা পাইনে?
ইন্দ্রভূষণ সান্যাল নাম
আগ্ৰাকুন্তা গ্রাম ধাম
—চাপড়া গ্রামের অপর পাড়ে
এক্কেবারে নদীর ধারে।
নাইবা থাকুক টাকা কৌড়ি
—চেহারাটা লম্বা চৌড়ি
কুলীন ব্রাহ্মণ, মোটা পৈতে
ইংরাজিটাও পারে কৈতে…
তথ্যসূত্র: তাপস ভৌমিক সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিভিন্ন ভারতীয় ব্যক্তিত্ব’ নামে সংকলন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত স্মৃতিকণা চক্রবর্তী রচিত নিবন্ধ।
৭. ৯. ২০১১
ও দেবী তোর কেমন পা, ধুলা লাগে না
গল্পটা আমাকে বলেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা রবি ঘোষ। সেটা ষাটের দশকের কথা, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতাপ সারা দুনিয়ায় অপ্রতিহত, মস্কো থেকে নাটক ও চলচ্চিত্র জগতের দুই কেষ্ট-বিষ্টু পুডভকিন আর চেরকাশভ ভারত সফরে এসে পৌঁছেছেন কলকাতায়। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা এখানকার দু’একটি থিয়েটার দেখতে চাইবেন। তখন কলকাতার মঞ্চ একটা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে, উত্তর কলকাতার পেশাদারি থিয়েটারগুলি ভাঙনের মুখে, গ্রুপ থিয়েটারগুলির অভ্যুত্থান ঠিক মতন শুরু হয়নি। গিরিশ যুগের পরবর্তী মঞ্চসম্রাট শিশিরকুমারের তখন বেশ দৈন্য দশা, ভাঙা মঞ্চ, ছেঁড়া-খোঁড়া সেট নিয়ে তিনি তাঁর কয়েকটি শেষ অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং এক সন্ধ্যায় তাঁর একটি নাটক দেখতে নিয়ে যাওয়া হল ওই দুই প্রখ্যাত রাশিয়ানকে। যাবার পথে সরকারি অফিসাররা ওঁদের শিশিরকুমারের পূর্ব গৌরবের সব কাহিনি শোনাতে ছাড়লেন না। তারপর নাটক তো শুরু হল, এমন কিছু আহামরি তো নয়ই, বরং লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু দ্বিতীয় দৃশ্যে যে-ই শিশিরকুমার ঢুকলেন, তখন ওঁদের একজন পাশ ফিরে এক সরকারি অফিসারকে বললেন, তোমরা যে লেজেন্ডারি অভিনেতার কথা বলছিলে, ইনি তো তিনি, তাই না? সরকারি অফিসারটি বললেন, হ্যাঁ, ইনিই শিশিরকুমার, কিন্তু আপনি কী করে চিনলেন? চেরকাশভ বা পুডভকিন বললেন, সত্যিকারের বড় অভিনেতারা মঞ্চে পা দিলেই বোঝা যায়, যত ছোট ভূমিকাই হোক, তাঁরা মুহূর্তে মঞ্চ অধিকার করে নেন। তাঁর সারা শরীরেই থাকে অভিনয়।
এই গল্পের কথক রবি ঘোষ, যিনি নিজেই ছিলেন এ রকম একজন অভিনেতা। আমি তাঁর মঞ্চ অভিনয় বিশেষ দেখিনি। কত এলেবেলে সিনেমায় তিনি ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তবু তাঁকে দেখামাত্র বোঝা যেত, কত বড় অভিনেতা তিনি, আন্তর্জাতিক মানে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। এখন আফশোস হয়, রবি ঘোষকে তাঁর যোগ্যতার সঠিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, কোনও গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রে বড় কোনও ভূমিকাও পাননি। তবে সত্যজিৎ রায় তাঁকে খুব পছন্দ করতেন।
রবি ঘোষ কথিত এই কাহিনিটি আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মিনার্ভা রেপার্টারি থিয়েটারের দ্বিতীয় মঞ্চ উপস্থাপনা দেবী সর্পমস্তা দেখতে দেখতে। কথক আর লোকেন্দ্র এই দুই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, তাঁকে আমি চিনি না, আগে কোনও অভিনয়ও দেখিনি। তবু মনে হল, এই ছেলেটির মঞ্চ উপস্থিতিতেই খানিকটা জাদু আছে, এ এক জাত অভিনেতা। তা বলে তাকে আমি শিশির ভাদুড়ির তুল্য মোটেও বলতে চাইছি না, এমন কথা লিখলে সে নিজেই সম্ভবত লজ্জায় মরে যাবে। আমি এমন কিছু নাট্যবোদ্ধাও নই, তবে রবি ঘোষের কাহিনিটা অকস্মাৎ মনে পড়েছিল, এ কথাও ঠিক।
স্টার থিয়েটারের নব্য রূপ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানে তেমন কোনও নাট্য প্রযোজনার খবর শুনিনি। কিন্তু প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মিনার্ভা থিয়েটারের পুনর্জীবন পাওয়ার পর যে কাজ করছেন, তা সগৌরবে মঞ্চের ইতিহাসে স্থান পাবে। এর আগে সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিং লিয়ার দেখে যে মুগ্ধতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি, তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। এ বারে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় উপস্থাপিত করেছেন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের এক নাট্য প্রযোজনা, একেবারে দেশজ, গ্রামীণ সংস্কৃতির শিল্প রূপ।
অনেক বাঙালির মধ্যে এমন একটা হীনমন্যতার ভাব দেখি যেন, কলকাতা তথা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি জগতে ইদানীং নতুন কিছুই ঘটছে না। অন্যান্য ভারতীয়দের সামনে তাদের কাঁচুমাচু ভাব দেখে আমার আশ্চর্য লাগে। এখন বরং বাংলায় গর্ব করার মতন অনেক কিছু হচ্ছে। ফিরে এসেছে বাংলা সিনেমা। গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমুখ কয়েকজন প্রবীণ তো রীতিমতন সক্রিয় বটেই, তা ছাড়া এক ঝাঁক নতুন তরুণ-তরুণী অভিনব বিষয়বস্তু নিয়ে, নতুন আঙ্গিকে, কম খরচে চমৎকার সার্থক সব সিনেমা বানাচ্ছেন। এবং মুম্বই মার্কা ফিল্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলার দর্শক দেখতে আসছেন সেই সব ছবি। ‘ইচ্ছে’র মতন বিখ্যাত নায়ক-নায়িকা বর্জিত ফিল্ম চলছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ।
আর থিয়েটারে এখন সারা ভারতেই বাংলার জয়-জয়কার। এই শিল্পে এক সময় বাংলার প্রধান প্রতিযোগী ছিল মহারাষ্ট্রের থিয়েটার। এখন সেখানে চলছে কিছুটা ঝিমোনা ভাব। আর বাংলার মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটারের একটার পর একটা প্রযোজনা আন্তর্জাতিক স্তরের। রুদ্রপ্রসাদ আর স্বাতীলেখা আজও অক্লান্ত ও সৃষ্টিশীল। তার প্রমাণ অজ্ঞাতবাস আর মাধবী; বিভাস চক্রবর্তী নিজেকে বদলাচ্ছেন বার বার, সম্প্রতি তাঁর পরিচালনায় ‘হ্যামলেট’ পৃথিবীর বহু পরিচালকের কাছেই চ্যালেঞ্জস্বরূপ। বিভাসও সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেকসপিয়রের রচনাকে জীবন্ত ও তাৎপর্যময় করে তুলেছেন এবং নামভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই অভিনেতাটিকে যত দেখছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। (হ্যামলেটের বাংলা অনুবাদের ভাষায় ব্যঞ্জনার অভাব আর শুরুতে হিন্দি গান আর শেষ দৃশ্যে গোলাগুলি চালিয়ে হ্যামলেটকে যে ভাবে ‘কলকাতা হ্যামলেট’ করা হয়েছে, তা ব্যক্তিগত ভাবে আমি পছন্দ করতে পারিনি।)
ব্রাত্য বসুর কৃষ্ণ গহ্বর আর রুদ্ধসঙ্গীত আমাদের থিয়েটারের গৌরব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছু দিন আগে নাটুয়া নামে একটি দলের ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর মঞ্চরূপ দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি, এও কি সম্ভব? ‘ফুরুৎ’ নামের একটা নাটককেও স্মৃতিতে স্থায়ী স্থান দিয়ে রেখেছি। এ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি মঞ্চ-নাটক নতুন নতুন বিষয়বস্তুতে সফল। সব আমার দেখা হয়ে ওঠে না, তা আমারই ক্ষতি। নান্দীকার, পূর্ব-পশ্চিমের মতন দল আয়োজন করছে নাট্য উৎসব। মঞ্চ এখন জমজমাট।
মনোজ মিত্রের নাটক খানিকটা সিজিল মিছিল করে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত করেছেন দেবী সর্পমস্তা। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংখ্যা চব্বিশ, শুনলাম তাদের মধ্যে মাত্র চার জন সুমনের প্রযোজনায় অংশ নিয়েছেন, বাকি সবাই একেবারে নতুন। নানান জেলা থেকে আনা হয়েছে তাদের একেবারে আনকোরা অবস্থায়, তাদের শেখানো হয়েছে নাচ-গান এবং অবশ্যই অভিনয়, পাঁচ মাস ধরে টানা রিহার্সাল। তার ফল যে এমন চমকপ্রদ হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। নাটকের আঙ্গিক খানিকটা অপেরা-ধর্মী, কাহিনি এগিয়েছে নাচ ও গানে, অর্থাৎ মঞ্চে উপস্থিত সবাইকে নাচ শিখতে হয়েছে, মাঝে মাঝে বেশ উদ্দাম নৃত্য। অধিকাংশ গানই সমবেত, খুবই সাবলীল। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা, সব নতুন নতুন ছেলেমেয়ের অভিনয়ে অপূর্ব সৃষ্টি।
এই নাটকের কাহিনি বর্ণনা করার কোনও প্রয়োজন নেই। প্রায় দুশো বছর আগেকার পটভূমিকায় একটি উপকথার জীবন্ত রূপ। যেহেতু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনি না, তাই মনে হয় প্রত্যেকেই ওই সব সত্যিকারের চরিত্র। অবশ্য এর জন্য অনেকটা কৃতিত্ব পরিচালক দেবেশের। প্রধান ভূমিকায় অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে আমার মনে হল, চব্বিশ জনেরই নাম লেখা উচিত। কারণ এরা সবাই মিলেই তো প্রাণের ছন্দ আর টগবগে ভাব ফুটিয়ে তুলেছে।
নাটকটি দেখেছি বিভোর হয়ে। শেষ হওয়ার পর বেরুবার সময় আমি গুনগুন করছি, এর মূল গান, ‘ও দেবী তোর কেমন পা, ধুলা লাগে না।’ আমার সঙ্গে যে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন বাইরে এসে বললেন, এটা আবার দেখতে হবে। ঠিক কথা, নাচে-গানে মাতিয়ে দেওয়ার এমন নাটক বার বার দেখা যায়।
রক্ত গড়িয়ে ধানের খেতে
বারুইপুরের দিকে একটি সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু ছেলে-মেয়েকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যাদের রক্ত এইচ আই ভি পজিটিভ। বাচ্চা থেকে কিশোর-কিশোরী, বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই, তাদের মুখে চোখে রয়েছে কৈশোরের লাবণ্য, তারা একটা নাটক করতেও শিখেছে।
তাদের বাবা-মা এই বিষ দিয়েছে, ওরা কিছু জানেই না। এইচ আই ভি পজিটিভ মানেই কিন্তু এডস্ রোগাক্রান্ত নয়। এখন তাদের জীবন স্বাভাবিক, অন্য বাচ্চাদের মতনই, তবে তাদের ভবিষ্যতে ওই মারাত্মক রোগের সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
এই ছেলেমেয়েগুলিকে যখন এখানে আনা হয়েছিল, তখন স্থানীয় কিছু লোক আপত্তি জানিয়েছিল। তাদের বক্তব্য, এই ছেলেমেয়েরা যে জল ব্যবহার করবে, তার খানিকটা গড়িয়ে গড়িয়ে ধান খেতে গিয়ে পড়বে, তার ফলে সেই খেতের ফসলে এই রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে। এই হচ্ছে এডস্ রোগ সম্পর্কে আমজনতার জ্ঞানের নমুনা। কথাটা শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিল, জল নয়, যেন রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির নাম অফার। তার পরিচালক কল্লোল ঘোষ এমনিই আর পাঁচ জন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, উত্তর কলকাতায় বাড়ি, স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার পথে দেখত রেল লাইনে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ট্রেন থেকে কয়লা চুরির কাজ করে, অনেক সময় খুব ঝুঁকি নেয়, দু’একজন মারাও যায়। এ সব দৃশ্য তো আমরাও দেখি কিংবা এই সব কাহিনি শুনি, কিন্তু গা করি না। কিন্তু কল্লোলের মনে হয়েছিল, ওদের জন্য কিছু একটা করলে হয় না? দু’একজন বন্ধুর সাহায্য নিয়ে সে শুরু করল একটা ছোটখাটো স্কুল। তারপর সল্ট লেকে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেবা প্রতিষ্ঠান।
এখন কল্লোল এক জন মধ্যবয়সী, প্রাণবন্ত মানুষ। নিছক মনের জোরে তাঁর প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক বড় করে ফেলেছেন। বারুইপুরের কাছে নিজস্ব জমি-বাড়িতে আছে অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্য আবাস, শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা এবং ওই এইচ আই ভি পজিটিভ বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে নানা রকম ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গাটি, কল্লোলের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেকে। টাকাপয়সা তুলতে হয় নানান জায়গা থেকে, একটি ইতালিয়ান প্রতিষ্ঠানও সাহায্য করে। সেয়জু নামে এক বাংলা-প্রেমিক ইতালিয়ানকে চেনেন এই শহরের অনেকেই, এক সময় তিনি গৌতম ঘোষের সঙ্গে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় যুক্ত হয়েছিলেন, সেই সেয়জু মাঝে মাঝে কলকাতায় এসে এই প্রতিষ্ঠানে কিছু সময় কাটিয়ে যান। এখন কল্লোলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কানাডা-প্রবাসী দীপ্তেন্দু চক্রবর্তীও।
কোথাও কোনও বাচ্চা বিপদে পড়েছে শুনলে কল্লোল তাকে তুলে নিয়ে আসেন। মাত্র কয়েকদিন আগে, হাওড়ায় দুই মহিলা, সম্পূর্ণ উন্মাদ, তাদের বাচ্চাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এখন সেই শিশু দুটি আছে অফার-এর আশ্রয়ে। ওরা বেঁচে যাবে। দুই বাচ্চাকে এখানকার মহিলা কর্মীরা কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরছেন, বাচ্চা দুটির কী সুন্দর মুখ আর টলটলে চোখ, আমার এক একবার ইচ্ছে করে ওদের এক জনকে কোলে নিয়ে আদর করতে। কিন্তু নিই না, বরং দূরে সরে যাই। মায়ায় জড়িয়ে পড়তে আমার ভয় করে। ওরা বেঁচে থাক।
২১. ৯. ২০১১