যা দেখি, যা শুনি – ১৫

আমাদের সেন্টু যদি সে রকম কিছু হয়, হতেও তো পারে, হোক না

আমাদের চেনা এক কবি তার গ্রাম থেকে একটি ছেলেকে এক দিন নিয়ে এল আমাদের বাড়িতে। শ্যামলা রং, বেশ রোগা ও ঢ্যাঙা মতন, মুখে এখনও লেগে আছে কৈশোরের লাবণ্য, লাজুক ভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কবিটি জানাল যে, ছেলেটি পিতৃহীন, থাকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। যদি তাকে আশ্রয় দিই, সে সবরকম কাজ করতে রাজি। ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা, জামাকাপড় কাচা, কুটনো কোটা। তবে রান্না জানে না, আর যে-কোনও কাজ।

আমার স্ত্রী একজন কাজের লোক খুঁজছিলেন, তাকে বেশ উৎসাহিত দেখালেও আমি প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেটির বয়েস কত? কেন না, যতই আমাদের প্রয়োজন থাক কিংবা সহানুভূতিসম্পন্ন হই না কেন, কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক বালককে আমি বাড়ির কাজে লাগাতে একেবারে রাজি নই। চাইল্ড লেবার-এর আমি ঘোর বিরোধী।

কবিটি জানাল যে, ওর বয়েস অন্তত উনিশ-কুড়ি তো হবেই। প্রমাণও আছে। বছর তিনেক আগে ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছে। কিছু দিন ও এক বাস কন্ডাক্টরের অ্যাসিস্টেন্টের কাজ করেছিল। ওই যে-সব ছোকরা বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে চ্যাঁচায়, বারাসত-বসিরহাট, মুহম্মদবাজার, বনগাঁ, চলে আসুন, চলে আসুন। খালি গাড়ি ইত্যাদি। ছেলে বড় মুখচোরা, ওই চাকরি তার পোষায়নি, তাই এখানে শুধু খাওয়া পরা চায়, এক্ষুনি কিছু মাইনে দেওয়ারও দরকার নেই…

মাধ্যমিক পাশ শুনেই খটকা লাগে। সে ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজার কাজ করবে, যাতে তার লেখাপড়া শেখাটার কোনও ভূমিকা থাকবে না। সেটা ভাবতে ভাল লাগে না মোটেই। তবে মাধ্যমিক পাশ করলে অন্য কী জীবিকাই বা হতে পারে? মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এ বারে দশ লক্ষও ছাড়িয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষার পথে যেতে পারে না। যে-বৃহৎ সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী পড়ে থাকে, তারা শেষ পর্যন্ত কী করে? কাগজে মাঝে মাঝে পড়ি, কোনও দিনমজুর কিংবা ভাগচাষির ছেলে কিংবা পরিচারিকার মেয়ে চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও অনমনীয় জেদে পড়াশুনো করে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করে। তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। আমি প্রায়ই ভেবেছি, তারা কি সত্যি আরও চার-পাঁচ বছর ওই অবস্থার মধ্যে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে? তাদের মধ্যে সত্যি সত্যি ক’জন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়? সে রকম কোনও পরিসংখ্যান দেখিনি। কোনও বস্তির ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, তা-ও এ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার।

ছেলেটি রয়ে গেল আমাদের বাড়িতে। ছেলেটি সত্যিই বড় লাজুক আর বিনীত। কথাই বলতে চায় না। তবে যে কোনও কাজের কথা বললে খুব মন দিয়ে করে। তার নাম সেন্টু। পুরো নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমাকে সেন্টু বলেই ডাকবেন। পুরো নাম বা পদবি থাকবে না এ কখনও হয়? মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটে তো নাম থাকবেই। কয়েক দিন পরই স্বাতীর মনে হল, এ ছেলেটি বোধহয় মুসলমান। তাকে সরাসরি এ কথা জিজ্ঞেস করায় সে অস্বীকার করতে পারল না। এই জন্যই তার এত কিন্তু কিন্তু ভাব? স্বাতী তাকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, আমাদের পরিবারে আমরা লালন ফকিরের ভাবশিষ্য, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। খাওয়াদাওয়ার আলাদা কোনও বাছবিচার নেই। সে যেন ও সব নিয়ে একটুও চিন্তা না করে। তার যদি নমাজ পড়ার অভ্যেস থাকে, তা-ও পড়তে পারে। তবু একটা কথা উহ্য রইল। এটা তো ফ্ল্যাটবাড়ি, অনেক কাজের লোক, তাদের কাছে সেন্টুর এই পরিচয়টা নিজে থেকে জাহির করার দরকার নেই। কে কী রকম ভাবে নেয়, কে জানে!

হিন্দুদের মধ্যে এখনও কতকগুলো অদ্ভুত সংস্কার আছে। এখন ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা শহর অঞ্চলে অনেকটা কমেছে ঠিকই। হিন্দু পরিবারে গাড়ির ড্রাইভার মুসলমান হতে পারে। ছেলেমেয়ের সহপাঠী কিংবা সহপাঠিনী মুসলমান হলেও সমান ভাবে আড্ডা দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু রান্নাঘরে কোনও মুসলমানের হস্তক্ষেপ আজও মানা হয় না। মুসলমান পরিবারেও হিন্দুদের সম্পর্কে এ রকম সংস্কার আছে কী? আমি বাংলাদেশে অবস্থাপন্ন পরিবারে হিন্দু ড্রাইভার দেখেছি, কাজের লোক বা কর্মচারীও হিন্দু দেখেছি। কিন্তু রান্নাঘর বিষয়ে কিছু জানি না। আসলে একেবারে গরিবদের মধ্যে কোনও জাতের বিচার থাকে না। খুব উচ্চশ্রেণির ধনীরাও এ সব তফাত অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। যত ঝামেলা মধ্যবিত্তদের নিয়ে। শুধু অবস্থায় নয়, মধ্যবিত্ত মানসিকতায়।

সেন্টু নামের এই ছেলেটি মুসলমান বলেই গ্রামে কোনও কাজ পায়নি, এই শস্তা সেন্টিমেন্টে আমি বিশ্বাস করি না। মুসলমানরা সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে কিছু কিছু অংশে পিছিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু ওর মতন আরও লক্ষ লক্ষ বর্ণহিন্দু বা নিম্নবর্গীয় হিন্দু ছেলেমেয়ে কিছুটা লেখাপড়া শিখেও যে কোনও কাজ পায় না, তা-ও তো নির্মম সত্য। জনসংখ্যা বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, সেই তুলনায় কাজ তো বাড়ছে না মোটেই। যাঁরা অবিলম্বে কয়েক লক্ষ বেকারকে চাকরির আশ্বাস দিচ্ছেন, সে সব তো মিথ্যে স্তোকবাক্য, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

এ প্রসঙ্গে আর একটা কথাও মনে আসে। যথেষ্ট কাজ তৈরি হয়নি তো বটে, শ্রমের মর্যাদাও তো তৈরি হয়নি। এক জন চাষির ছেলে, জেলের মেয়ে, তাঁতির সন্তান লেখাপড়া শিখেও সেই পারিবারিক পেশায় নিযুক্ত থাকতে পারবে না কেন? এখনও সমাজের অনেকেরই ধারণা, শিক্ষা পাওয়া মানেই বাবুশ্রেণির চাকরি অর্জনের অধিকার এক্তিয়ারে চলে আসা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে মেথর আছে, নাপিত আছে, ঘরবাড়ি ধোওয়া মোছার জন্যও লোক পাওয়া যায়, এবং তারা সবাই কিছুটা লেখাপড়া জানে। আমি এক বার বিদেশে এক সাহেব অধ্যাপকের বাড়িতে কিছু দিন ছিলাম। সকাল থেকে অধ্যাপক তাঁর নিজের ঘরে বসে লেখাপড়া করেন, আমিও অন্য একটি ঘরে নিজের কাজ করি। আর একজন কাঠের মিস্তিরি একটি বারান্দা সারাবার কাজে ব্যস্ত থাকেন। দুপুরে অধ্যাপক উঠে এসে সেই মিস্তিরিকে ডেকে বলেন, এসো জর্জ, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেয়ে নাও। মিস্ত্রিটি যন্ত্রপাতি রেখে আমাদের সঙ্গে খাওয়ার টেবিলে যোগ দেন। আমরা নিজেরাই স্যান্ডউইচ বানিয়ে বিয়ার সহযোগে তা খেতে খেতে নানা কথার মধ্যে পুলিৎজার প্রাইজের প্রসঙ্গ এসে যায়। মিস্তিরি মহাশয় জানান যে, সদ্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় লেখিকার বইটি তাঁর পড়া হয়ে গেছে। আর এক বার এক জন কলের মিস্তিরির সঙ্গে আলাপ করে জেনেছিলাম যে, তিনি আগে ছিলেন নিউক্লিয়ার্স ফিজিক্সের অধ্যাপক। সে চাকরি ছেড়ে এ পেশায় এসেছেন। কারণ, এতে উপার্জন বেশি। কোনও কাজই যে নিচু বা অসম্মানের নয়, এ উপলব্ধি আমাদের সমাজে কবে আসবে! মিস্তিরি কিংবা কাজের লোকের সঙ্গে আমরা খাওয়ার টেবিলে কবে একসঙ্গে বসতে শিখব? (একমাত্র শান্তিনিকেতনে ‘সুবর্ণরেখা’র ইন্দ্রনাথ মজুমদারের বাড়িতে এর ব্যতিক্রম দেখেছি। সেখানে কাজের মেয়ে, রান্নার মেয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে খায়)।

সেন্টু বেশ ভালই মানিয়ে নিয়েছিল আমাদের বাড়ির সঙ্গে। যে কোনও কাজের নির্দেশ দিলে সে ঠিকঠাক করে যায়। সে তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারে না। নিখুঁত হওয়ার দিকেই তার ঝোঁক। ফ্ল্যাটবাড়ির অন্য কারও সঙ্গে সে মেশে না। টিভি দেখারও আগ্রহ নেই তার। একটু সময় পেলেই সে এক কোণে বসে বই পড়ে। মা ষষ্ঠীর কৃপায় আমাদের বাড়িতে তো বইয়ের অভাব নেই। তা পডুক না সে। যত ইচ্ছে। এক বার তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেও তার কোনও রকম চিত্তচাঞ্চল্য বোঝা যায়নি।

আমাদের ফ্ল্যাটের মধ্যেই সে বিছানা পেতে রাত্তিরে শুয়ে থাকত। এক দিন সকালে দেখা গেল, বিছানাটা পাতাই আছে, সেন্টু নেই। এ রকম কখনও হয় না। আমরা জাগবার আগেই সে বিছানা গুটিয়ে রাখে। তারপর চোখে পড়ল, খাওয়ার টেবিলে নুনদানি চাপা দেওয়া একটা চিঠি। আমাকে ও স্বাতীকে সে মেসো ও মাসি সম্বোধন করে লিখছে যে, আমাদের কাছে সে খুবই ভাল ব্যবহার পেয়েছে, সে জন্য সে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখানে তার মন টিকছে না। সে গ্রামেই ফিরে যেতে চায়। তাই সে বিদায় নিচ্ছে।

গোটা গোটা হাতের লেখা, একটি মাত্র বানান ভুল। নিজের জামাপ্যান্টের পুঁটুলি ছাড়া সে আর কিছুই নিয়ে যায়নি। এমনকী ভাঙা মাসের কয়েক দিনের মাইনেও তো তার প্রাপ্য ছিল, তা-ও চায়নি। যদিও সে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে, তবু প্রথমেই মনে হয়, আমাদের কোনও ব্যবহারে সে আঘাত পায়নি তো? অনেক ভেবেও সে রকম কিছু মনে পড়ল না। এত বড় বাড়ির অন্য কেউ কি তাকে টিপ্পনি কেটে খোঁচা মেরেছে? সে রকম কিছুও জানা গেল না। অবশ্য এমন হতেই পারে, গ্রাম্য প্রকৃতির মধ্যে সে মানুষ। শহরের এই খাঁচার মতন ফ্ল্যাটবাড়ি তার সহ্য হয়নি। তবে, জীবিকার তাড়নাতেই তো গ্রামের ছেলেরা শহরে আসে। এখন কাজ ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেলে, তার যে সমস্যা ছিল, তা মিটবে কী করে? যদি সে আরও বিপদে পড়ে? বেশ কয়েক দিন সেই ছেলেটির লাজুক মুখটি বার বার মনে পড়ে।

প্রথম জীবনে অতি নগণ্য কাজ, যেমন চায়ের দোকানে বেয়ারা কিংবা গুদামে কুলির কাজ করে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ, হয়তো দশ লক্ষে এক জন, পরবর্তী জীবনে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। যেমন, গানের জগতের সম্রাট ভীমসেন জোশীও তো কিছু দিনের জন্য অভিনেতা পাহাড়ী সান্যালের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে ছিলেন। পরবর্তী জীবনে সে কথা স্বীকার করতেও তিনি লজ্জাবোধ করেননি। আমাদের এই সেন্টু যদি সে রকম কিছু হয়, হতেও তো পারে, হোক না।

বাচ্চাদের জন্য ধাঁধা

ছয় থেকে ন’বছরের কোনও বাচ্চা ছেলে বা মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে হবে, জুতোর কোম্পানি আছে, বাটা। সেই বাটা ইংরেজিতে বানান করো তো?

খুব সহজ, সে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে। বি এ টি এ।

তার পর জিজ্ঞেস করতে হবে, হয়ে গেছে?

সে বলবে, হ্যাঁ, হয়ে গেছে।

ও মা, তোমার বিয়ে-টিয়ে হয়ে গেছে? কবে হল?

১৮. ৫. ২০১১

আমার অতি সংক্ষিপ্ত চিন ভ্রমণ

প্রথম বার আমি চিন দেশে গিয়েছিলাম ঠিক একুশ বছর আগে। আমার সঙ্গী ছিলেন প্রসিদ্ধ হিন্দি লেখক কমলেশ্বর। সাংহাই শহরে পৌঁছে আমরা দ্বিতীয় দিনেই গিয়েছিলাম একটা কাঁচাবাজার দেখতে। যে-কোনও দেশে গেলেই আমার বাজার দেখার শখ হয়, কিছু কেনাকাটির জন্য নয়, বাজারের সম্ভার দেখলেই সে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য অনেকটা টের পাওয়া যায়। এর কিছু দিন আগে মস্কোর একটা বাজার দেখে খুব নিরাশ হয়েছিলাম। সেখানে কিছু বিট-গাজর আর আলু ছাড়া অন্যান্য শাক-তরিতরকারি কিছুই নেই। বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় গিয়ে দেখেছি, একটা মাংসের দোকানের সামনে বিরাট লম্বা লাইন। আমার পথপ্রদর্শক সখেদ বলেছিলেন, এর অর্ধেক লোকই শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে না, খালি হাতে ফিরে যাবে। অর্থাৎ, তখনই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির পতনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে।

সেই তুলনায় সাংহাইয়ের বাজার ছিল বেশ সমৃদ্ধ। তরিতরকারি ও নানা রকম মাছ-মাংসের অভাব নেই। ইঁদুরের মাংসও দেখেছি। আসল চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাজারের বাইরে। সেখানে রয়েছে খাঁচার পর খাঁচা ভর্তি ব্যাঙ। আর একটা জালের খাঁচায় জড়াজড়ি করে আছে গোটা পঞ্চাশেক সাপ। চিনেরা যে সাপ খায়, তা তো জানিই। আমিও দু’একবার খেয়েছি। সেই সাপ বিক্রির পদ্ধতিটা দেখার মতো। কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। সুন্দরী সুন্দরী মহিলারা এসেছে সাপ কিনতে। (আচ্ছা, পুরুষেরা কি আর বাজার করতে আসে না? কিন্তু আমার চোখ যে সুন্দরী মহিলাদের দিকেই আকৃষ্ট হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক)! এক মহিলা খাঁচার মধ্যে বিশেষ একটা সাপের দিকে আঙুল দেখাল, দোকানদার একটা চিমটে দিয়ে খোঁচা মারতেই সাপটা ফেঁস করে ফণা তুলতে লাগল। এ রকম দু’চারটে সাপের স্বাস্থ্য দেখার পর একটা তার পছন্দ হল, দোকানদার তখন একটা সাঁড়াশি দিয়ে সাপটার মুণ্ডু চেপে ধরে বাইরে টেনে এনে একটা বড় ছুরি দিয়ে ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলল মুণ্ডুটা। বাকিটা চামড়া ছাড়িয়ে কুচ কুচ করে টুকরো করে দেওয়া হল ব্যাগে। এখন তো সেটা মাছের মতন, বিষ থাকার কোনও প্রশ্নই নেই৷ সাপ খেতে অনেকটা বান মাছের মতনই মনে হয়েছে আমার।

যাই হোক হঠাৎ আমার চোখ পড়ল পাশের একটা খাঁচায়। তার মধ্যে রয়েছে বেশ স্বাস্থ্যবান, গাবলু-গুবলু চেহারার গোটা পাঁচেক বেড়াল। প্রথমটায় আমি বুঝতে পারিনি, তার পর খটকা লাগতেই আমি আমার সঙ্গিনী দোভাষিণীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কি বেড়ালও খাও নাকি? সে আমার দিকে ফিরে গভীর বিস্ময়-ভরা নয়নে বলেছিল, সে কি, তোমরা বেড়াল খাও না? বেড়াল তো ডেলিকেসি! আমার মনে হল, সর্বনাশ, তা হলে বোধহয় আমাকেও এর মধ্যে বেড়ালের মাংস খাইয়ে দিয়েছে। দোভাষীরাও ইংরিজি এত কম জানে যে রেস্তোরাঁর টেবিলে যখন অনেক রকম খাদ্য আসে, তখন বেশ কয়েকটার নাম ওরা বুঝিয়ে বলতে পারে না। আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমি শুধু কুকুর আর বাঁদর খাব না, কারণ কুকুর আমরা বাড়িতে পুষি, আর বাঁদর আমাদের পূর্বপুরুষের বংশ, এ ছাড়া আর সব কিছুই আমি স্বাদ নিয়ে দেখতে পারি। তখন অবশ্য বেড়ালের কথা আমার মনে পড়েনি।

সে বারে চিনের বিভিন্ন শহরের রাস্তাঘাটে কুকুর-বিড়াল, ষাঁড় কিংবা পাখি-টাকি কিছুই চোখে পড়েনি। কারণ, শুনেছি চিনেরা এ সবই খেয়ে ফেলে, পোকা-মাকড় পর্যন্ত। তবে আরশোলা খাওয়াটা বোধহয় নিছক গুজব।

এ বারে, এই মে মাসে, ২০১১ চিন সফরের সময় আমার অন্য সঙ্গী সাত জনের কেউই আগে এ দেশে আসেননি। দ্রষ্টব্য স্থানগুলি তাঁরা তো ঘুরে দেখছেনই। আমি ভাবলাম, অভিনব অভিজ্ঞতার জন্য ওঁদের সাংহাইয়ের সাপের বাজারটা দেখিয়ে আনি। এ যাত্রা আমাদের দোভাষী ও সঙ্গীর সংখ্যা তিনজন। তাদের ইংরিজি জ্ঞান আগের থেকে একটু ভাল। আমি তাদের ওই বাজারের কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন বলল, কোনও বাজারে তো সাপ বিক্রি হয় না! আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাজারে বিক্রি হয় না। তা হলে তোমরা খাওয়ার জন্য সাপ পাও কোথা থেকে? অল্পবয়সি একটি মেয়ে সাপ খাওয়ার কথা শুনে খুবই বিস্মিত। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক পুরুষটি বললেন, এক কালে খাওয়া হত, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আর ব্যাঙ? তা-ও খুব কম দোকানে পাওয়া যায়। পরিবেশ রক্ষার কারণে ও-সব খাদ্য নিষিদ্ধ। কথাবার্তায় যা বুঝলাম, সাপ-ব্যাঙ-কুকুর-বেড়াল-পোকামাকড় খাওয়ার অভ্যেস এরা ত্যাগ করেছে। আধুনিক চিনা নারী-পুরুষের পোশাক ও পোশাকের ফ্যাশন, হাবভাব (ইংরিজি ভাষা বাদ দিয়ে) পুরোপুরি পশ্চিমী দেশগুলির মতন, কিংবা তার চেয়েও বেশি। অর্থাৎ চিনেরা আর চিনে থাকছে না, সাহেব হয়ে যাচ্ছে। শিগ্‌গিরই তারা ইংরিজিও শিখে নেবে।

আমার বেশি অবাক লাগল এই ভেবে যে, একটা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হঠাৎ ওলটপালট হয়ে যেতে পারে, অর্থনৈতিক উন্নতিও হতে পারে ধাঁ-ধাঁ করে। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তন কি পনেরো-কুড়ি বছরে এতখানি হওয়া সম্ভব? আমরা যাদের দেখলাম, তারা খাদ্য-অভ্যেস একেবারে বদলে ফেলেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁয় যে-সব খাবার পাওয়া যায়, তা রান্নার পদ্ধতির জন্য অবশ্যই চাইনিজ ফুড, কিন্তু খাদ্যবস্তুগুলোর সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার খাদ্যের কোনও তফাত নেই। মাংস বলতে এখন শুয়োর-গরু-ভেড়া ও হাঁস-মুরগি, মাছ নানা রকম এবং চিংড়ি সুলভ। লোকের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। বিয়ার তো ছিলই। রেড ওয়াইনও অষ্ট্রেলিয়া-ফ্রান্স ব্রাজিলের মতন না হলেও বেশ ভাল। হুইস্কি-রাম বিশেষ কেউ খায় না। ওদের জাতীয় পানীয় মাওতাই। মদ্যপান বিষয়ে চিনে শুচিবাই আগেও ছিল না, এখনও নেই। চিনের বড় শহরগুলিতে চোখ ধাঁধানো হর্ম্যসারি দেখলে তাক লেগে যায়। এবং প্রশস্ত রাস্তা ও পরিচ্ছন্নতা… অনেকে বলতে শুরু করেছেন, আর দশ বছরের মধ্যে চিন ছাড়িয়ে যাবে আমেরিকাকে। একদলীয় সরকার এখনও কিছু কিছু অনুশাসন জারি রেখেছে। রাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করলে কারাদণ্ড হয়। এ বারের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক তো এখনও জেল খাটছেন। তবু কমিউনিজমের লাল রং অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে বোঝা যায়। লাল ঝান্ডা দেখাই যায় না। নিষিদ্ধ নগরীর সামনে ছাড়া আর কোথাও মাও জে দং কিংবা অন্য কোনও নেতার ছবি চোখে পড়ল না। দু’-একটা ছোট গল্পে লোকাল কমিটির দাদাগিরি নিয়ে বিদ্রুপ-মশকরাও পড়ে ফেললাম। যাই হোক, সবচেয়ে দর্শনীয়, চিনের রাস্তায় রাস্তায় ফুলের বাহার। সত্যি অপূর্ব। ফরাসি দেশেও এত ফুলের সজ্জা নেই। ভারতে বুঝি এত ফুল ফোটে না?

বেজিং-এ বঙ্গ ভাষা

সেই একুশ বছর আগে গোটা সফরে একজনও বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়নি। সে বারে ভ্রমণ ছিল অনেকটা ঘেরাটোপের মধ্যে। বাংলা শুনেছিলাম একবারই। বেজিং-এ, বেশ নাটকীয় ভাবে। এক সন্ধেবেলা বেজিং-এর সরকারি লেখক সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলাপচারিতার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি, কমলেশ্বর ছাড়া আর সবাই চিনে লেখক। এর আগে ভারত সরকারের রাষ্ট্রদূত আমাদের ডেকে অনুরোধ করেছিলেন যে, আমরা যেন তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ঘটনা নিয়ে কোনও প্রশ্ন না করি কোথাও। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই বেজিং-এর ওই বিশাল পার্কে ছাত্রবিদ্রোহ দমন করার জন্য সামরিক বাহিনী ট্যাঙ্ক এনে, গুলি চালিয়ে নৃশংস ভাবে সে বিদ্রোহ দমন করে। চিন সরকার সেই ভয়াবহ কাহিনি যাতে সারা বিশ্বে না ছড়ায়, তার জন্য বিশেষ তৎপর। সেই লেখক সংস্থার মিটিং-এ ওই প্রসঙ্গ একেবারে বাদ। আমরা শান্তি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিষয়ে মিষ্টি মিষ্টি কৃত্রিম কথা চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ ও দিক থেকে একটি চিনে মেয়ে উঠে এসে আমার কাছ ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে পরিষ্কার বাংলায় বলল, জানেন তো, তিয়েনানমেন স্কোয়ারে অন্তত তিন হাজার ছেলেমেয়ের মৃতদেহ পড়ে ছিল। আরও কত যে নিরুদ্দেশ। সরকার সব চেপে দিচ্ছে। কত যে মা-বাবা কাঁদছে…। মেয়েটি শান্তিনিকেতনে ছিল, ভাল বাংলা জানে, তার কথা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারছে না ঠিকই। তবু আমার মনে হয়েছিল, যদি ওর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে বোঝা যায় যে ও কোনও রাষ্ট্রবিরোধী কথা বলছে? তাই তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমি বলেছিলাম, চুপ, চুপ।

এ বারে শুনলাম অনেক বাংলা কথা। ভারতীয় দূতাবাসের সংস্কৃতি কেন্দ্রে একটি আলোচনাসভায় যত শ্রোতা উপস্থিত, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলাভাষী! ভারতীয় বাঙালিরা তো আছেনই, তা ছাড়াও ছিলেন অনেক বাংলাদেশি। আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দূতাবাসের কয়েকজন প্রতিনিধি। আমি বিদেশে যেখানেই যাই, বাংলাদেশিদের দেখে খুব আত্মীয়তা অনুভব করি। আমাদের কলকাতা অফিসে টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক সহকর্মী চিত্রলেখা বসুও এখন তো চিনের একটি ইংরেজি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তার দেখা পাওয়া মানে যাকে বলে প্লেজান্ট সারপ্রাইজ। টাইমস অব ইন্ডিয়ার স্থায়ী চিনা প্রতিনিধিও একজন বাঙালি। শৈবাল দাশগুপ্ত। সেই দম্পতির সঙ্গে আড্ডা হল এক সন্ধ্যায়। একটি হাস্যমুখী চিনা মেয়ে আমারই লেখা একটি বই সই করতে এনে বলল, লিখুন, আমার নাম সুস্মিতা। আমি হকচকিয়ে যেতেই সে বলল, না, তার বাবা-মা কেউই বাঙালি নয়। সে নিজেই এই নাম নিয়েছে। তার আসল নাম ইউকুই ইয়াঙ্গ। সে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ায়। (কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়না/ফরেন ল্যাঙ্গোয়েজ কলেজ/ডিপার্টমেন্ট অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান ল্যাঙ্গোয়েজেস)। আমি সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বাংলা পড়াও, তোমার ক্লাসে বাংলার ছাত্র-ছাত্রী হয়? সে বেশ ফুরফুরিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ, হয়। ভালই। আরও দু’জন চিনে মধ্যবয়সি ভদ্রলোক রাত্তিরে হোটেলে দেখা করতে এলেন আমার সঙ্গে। তাঁরা বেশ সহজ বাংলা বলেন। বাংলা পড়তেও পারেন। এবং কী আশ্চর্যের কথা, আমার মতন একজন সামান্য লেখকেরও কয়েকটা বই তাঁরা পড়ে ফেলেছেন। তারা কর্মসূত্রে বাংলাদেশে থেকেছেন অনেক দিন। বাংলা ভাষা শিখেছেন সেখানেই। সেই রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমার মনে হল, যদি একুশে ফেব্রুয়ারি, বাহান্ন সালে ঢাকায় গুলি চালনা না ঘটত, যদি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম না হত, তা হলে কি আমরা বাংলা ভাষার গৌরবের পতাকা উঁচুতে তুলে ধরতে পারতাম? পশ্চিমবাংলায় আমাদের হাত মাঝে মাঝে কম্পমান। বাংলাদেশিদেরই মুষ্টি অনেক দৃঢ়।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যিনি গবেষণা করছেন, যাঁকে গত বছর কলকাতায় বাংলা অ্যাকাডেমিতে সম্মান জানানো হয়েছিল, তিনি এখনও রবীন্দ্র রচনাবলি অনুবাদে ব্যাপৃত। আগের বারও দেখেছি, এ বারেও শুনলাম, সব লেখকই রবীন্দ্রনাথের কোনও না কোনও কবিতা পড়েছেন, একজন জানালেন যে, চিনের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই রবীন্দ্রনাথের নাম জানে। (চিনে শিক্ষিতের হার শতকরা আটানব্বই)। পশ্চিমী দেশগুলিতে রবীন্দ্রনাথের এমন পরিচিতি এখন আর নেই। অনেক আধুনিক লেখক রবীন্দ্রনাথের নামই জানে না। সেই তুলনায় চিনা সাহিত্যের কতটুকু আমরা জানি? চিনা ভাষায় আধুনিক সাহিত্যের পথিকৃৎ লু সুন-এর লেখা আমরা ক’জন পড়েছি? আমাদের সঙ্গে অন্য ভাষার যে ক’জন লেখক ছিলেন,তাদের মধ্যে অর্ধেক লু সুন-এর নামও শোনেনি। কনফুসিয়াস? তিনি কি লেখক না দার্শনিক না গুরু? দু-চারটে বাণী হয়তো কেউ কেউ দেখে থাকবেন। মাও জে দং-এর কবিতা এবং লাল বই এক সময় বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। এখনকার মাওবাদীরা তাও পড়েন কি না জানি না!

আমি কলকাতায় থাকি শুনে একজন চিনা লেখিকা বললেন, কলকাতা? সে তো বিশ্বের প্রধান দশটির মধ্যে একটি। তাই না? আমি জোর করে হেসে বললাম, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে তা ছিল ঠিকই, এখন আর তা নেই।

দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে বললাম, এখন তো কলকাতা প্রায় একটা মফস্সল শহর হয়ে গেছে।

একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ

মে মাসের ন’তারিখ। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে দিল্লির সমস্ত জাতীয় ইংরেজি সংবাদপত্রে একটি খবর বেরিয়েছে, সেটির অনুবাদ করে দিচ্ছি:

‘তিরুবনন্তপুরম: আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে কেরলের সমস্ত স্কুলের ছাত্রদের মালয়ালম ভাষা আবশ্যিক ভাবে শিক্ষা করতে হবে। নতুন রাজ্য সরকারের এই নির্দেশ। রাজ্যের এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে এই নির্দেশ জারি হয়েছে। একটি সরকারি প্রেস রিলিজে জানানো হয়েছে যে, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য ডি পি আই-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’

আর পশ্চিম বাংলায়?

১. ৬. ২০১১

শান্তিনিকেতনে নৌকাডুবি আর ঝড়ের রাত্রে বুলবুলি

শান্তিনিকেতনের বাড়িটির সামনের বারান্দাটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। যখনই আসি, এখানেই বেতের চেয়ারে বসে বেশির ভাগ সময় কাটাই। এমনকী এই চরম গরমেও। সামনে খানিকটা বাগান, ডান পাশে একটা পুকুর, সেটা নানা রকম গাছপালা, তার মধ্যে তিনটে বড় বড় তালগাছই প্রধান দ্রষ্টব্য। সামনের সরু রাস্তা দিয়ে সাইকেলই যায় বেশি, ইদানীং দু’-এক বছর দেখছি মোটর বাইকের সংখ্যা বেড়েছে, গাড়ি কদাচিৎ। অধিকাংশ সময় নিস্তব্ধতাই এখানকার রাজা। শব্দ শূন্যতায় কান জুড়োবার জন্যই তো প্রধানত এখানে আসা।

আজকাল প্রকৃতি দেখার প্রতিবন্ধক অনেক তার, নানা রকম তার। এ বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে একটা তার বেশ নিচু হয়ে চলে গেছে রাস্তার দিকে। ওটার নাম কেব্‌ল। প্রথম দিন এসে একটুক্ষণ বারান্দায় বসবার পরেই দেখি সেই তারের ওপর বসে আছে একটা বুলবুলি পাখি। কিন্তু এ পাখি তো মানুষের এত কাছাকাছি আসে না! শান্তিনিকেতনে কাক প্রায় নেই। শালিক আর চডুই মানুষের কাছাকাছি ঘুরঘুর করে, বুলবুলি আর ঘুঘুরা দূরত্ব বজায় রাখে। এই বুলবুলিটা এক-এক বার উড়ে যাচ্ছে, এক মিনিট দু’মিনিট বাদে আবার এসে বসছে, তাকিয়ে থাকছে আমার দিকে। ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্যের না? আমরা যেমন পাখি দেখি, এই পাখিটাও কি মানুষ দেখছে? মানুষদের ব্যবহার রকম-সকম স্টাডি করছে?

সকাল থেকে বিকেল হতে বুঝতে পারলাম পাখিটার ও-রকম ব্যবহারের আসল কারণ। বারান্দার বাঁ পাশে একটা লতানে গাছ উঠে গেছে ছাদ পর্যন্ত।  খুব হালকা নীল রঙের পাতলা পাপড়ির ফুল হয়। গাছটার নাম জানি না। স্থানীয় কেউ কেউ বলে পেঁয়াজ-রসুন গাছ। সত্যিই সেই ফুলে একটু একটু পেঁয়াজ-পেঁয়াজ গন্ধ। একতলা ছাড়িয়ে ওপরে ওঠার জায়গায় গাছটা বেশ ঝুপড়ি হয়ে গেছে, সেইখানে বাসা বেঁধেছে বুলবুলিটা। অর্থাৎ, ও যে প্রায় সর্বক্ষণ এখানে বসে থাকছে, তা আসলে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পাহারা দিচ্ছে ওর বাসা। মানুষের বাড়ির ঘুলঘুলিতে চডুই পাখিরাই সাধারণত বাসা বাঁধত, এ কালের বাড়িতে ঘুলঘুলি থাকেই না, চডুই সংখ্যা হু-হু করে কমে আসছে। শালিক পাখির বাসাও দেখেছি। কিন্তু দালান-কোঠায় বুলবুলির বাসা? এর একটাই কারণ থাকতে পারে, এ বাড়ি তো দিনের পর দিন ফাঁকা পড়ে থাকে, এ বারান্দায় কেউ বসে না। আমরাই তো এ বার এলাম দু’মাস বাদে। বুলবুলিটা সেই জন্যই এই নির্জন বারান্দার কোণটা নিরাপদ মনে করেছে। ছোট ছোট পাখিদের বাসার সমস্যা গরিব মানুষদের চেয়ে কম নয়। গোপন ঝোপ-ঝাড় খুঁজতে হয়, কারণ প্রকাশ্যে বড় গাছের ওপর বাসা বাঁধলে, বড় বড় পাখিরা অর্থাৎ কাক-চিল ওদের ডিম বা ছানা ঠুকরে খেয়ে ফেলে। মানুষকে তো আরও বেশি ভয়। পাখিটা বোধহয় ভাবছে, এরা আবার কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল।

বুলবুলিটা কি আমাকে চিনতে পেরেছে? এই পাখিটার আর কতই বা বয়েস। কিন্তু পূর্বপুরুষদের অনেক স্মৃতি জিন-বাহিত হয়ে নাকি চলে আসে, যাকে বলে রেস মেমরি। বহুকাল আগে আমি একটা বুলবুলি পাখির প্রতি অত্যন্ত নৃশংস অন্যায় করেছিলাম। তখন আমার বয়েস এগারো-বারো বছর, পূর্ব বাংলার এক গ্রামে ইজের পরে খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতাম মাঠে-ঘাটে। এক দুপুরে এক বেত গাছের ঝোপে হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলাম একটা বুলবুলির বাসা, তাতে দুটো ডিম। টপ করে তুলে নিয়েছিলাম ডিম দুটো। একটা বুলবুলি কোথা থেকে এসে আমার মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে উড়ছিল, আমি ধরার চেষ্টা করলাম সেটাকেও। ওই বয়েসের ছেলেরা সাধারণত নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়। তারা ফড়িং-এর পাখা ছিঁড়ে ফেলে, বেড়ালের ল্যাজে তারাবাজি বেঁধে দেয়, খেলার সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে খিমচে মারে। যৌন চেতনা, ঠিক মতো জাগার আগে মানুষের মনে স্নেহ, দয়া, মায়া আরও অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতিও জাগে না। মেয়েদের ওই চেতনা অনেকটা আগে-আগেই জাগে বলে ছেলেদের তুলনায় তারা অনেক নরম সরম হয়।

অর্ধেকটা শতাব্দী কেটে গেছে, এখনও সেই দু’টি বুলবুলির ডিম নষ্ট করার অপরাধবোধ স্পষ্ট আমার মনে দগদগ করে। জীবন আমাকে মাঝে মাঝে যে শাস্তি দিয়েছে, তা বোধহয় এই পাপেই। এখন আমি এই বুলবুলির বাসা রক্ষা করার জন্য বদ্ধপরিকর। কিন্তু আমি যে ওর বাসা পাহারা দেবার জন্যই বসে আছি, তা তো ও বুঝবে না। ও আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তারে বসে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসে। এই সময়কার বাতাস যেন মায়ের আদরের মতন। মায়ের আদর কেমন, তা কি এই বয়েসে আমার মনে আছে নাকি? এ হল কবি-প্রসিদ্ধি, উপমায় বেশ চলে। অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই জোনাকি উড়তে শুরু করে, এবং দু-একটা আমাকে জড় পদার্থ মনে করে গা বেয়েও উঠতে থাকে। এই একটা আশ্চর্য পতঙ্গ, প্রকৃতি একমাত্র একেই একটুখানি আলো দিয়েছে, কিন্তু তাতে ওর কী লাভ? আলোটা ওর পেছনে! তাতে অন্ধকারে ও তো কিছুই দেখতে পাবে না, বরং টিকটিকি বা অন্য পতঙ্গভুকরা ওকে খেয়ে ফেলতে পারবে। বেচারাদের আত্মরক্ষার কোনও উপায় দেওয়া হয়নি, এ কী ভুল প্রকৃতির! একটা গান মনে পড়ল, ‘কী সুখে ওই ডানা দু’টি মেলেছ, ও জোনাকি!’ যিনি এই গান লিখেছেন, তিনি নিশ্চয়ই জোনাকি দেখেননি। এর জীবন তো সুখের নয়ই, তা ছাড়া ওইটুকু প্রাণীর অতি ফিনফিনে দু’টি পাখনাকে ডানা বলা যায়? তারপরই মনে হল, আমি কি পাগল নাকি? এ গান তো রবীন্দ্রনাথের, তিনি জোনাকি দেখেননি। তার শান্তিনিকেতনে বসেই তো আমি দেখছি। অত বড় কবি, তিনি ইচ্ছে করলে মাটির মূর্তিতেও ডানা বসিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারেন। …বারো বছর বয়েস হলে আমি নিশ্চয়ই আমার গা-বেয়ে ওঠা জোনাকিটাকে টিপে ধরতাম। এখন আমি নিথর মূর্তির মতন বসে থাকি, যাতে ওর কোনও অসুবিধে না হয়।

সকালবেলা স্বাতী পাখিদের বিস্কুট খাওয়ায়। হাঁসেরাই দল বেঁধে এসে কাড়াকাড়ি করে সব খেয়ে নেয়, (হাঁসেরা নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করে বটে, কিন্তু কখনও মারামারি করে না) কয়েকটা শালিকও চতুর ভাবে পাশ থেকে দু-এক টুকরো সরিয়ে নেয়। কিন্তু তারের ওপর বসে থাকা বুলবুলিটির এ ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই। বাৎসল্যের টান সম্ভবত তার ক্ষুধা-তৃষ্ণাও ভুলিয়ে দিয়েছে।

দু’দিন ধরে গরম একেবারে সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। একটু বেলা বাড়লেই বাতাসের উষ্ণ হল্‌কা ঝাপটা মারে চোখে-মুখে। বারান্দায় আর বসা যায় না। স্বাতী বলল, একটা সিনেমা দেখতে গেলে হয় না? এখানে ‘নৌকাডুবি’ চলছে। প্রস্তাবটিতে প্রথমে উৎসাহ বোধ করি না, হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যেস আমার চলেই গেছে প্রায়, থিয়েটার দেখতে যাই, কারণ থিয়েটার বাড়িতে বসে দেখা যায় না, সিনেমা দেখা যেতে পারে। তা ছাড়া ‘নৌকাডুবি’… রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছরের উৎসব চলছে। এখন কোনও বেসুরো কথা বলা উচিত নয়, তবে এটুকু তো বলা যেতেই পারে যে ‘নৌকাডুবি’ রবীন্দ্রসাহিত্যে আমার প্রিয় রচনাগুলির অন্যতম নয়। তার পরেই মনে হল, সিনেমা হল তো বাতানুকুল, এই হাঁসফাঁস করা গরমে দু’ঘণ্টা তো অন্তত ঠান্ডা-ঠান্ডা জায়গায় কাটানো যাবে। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি একেবারে অখাদ্য হওয়ার কথা নয়। যদি তেমন হয়ও তা হলে চোখ বুজে ঘুমিয়ে কাটানো যেতে পারে আরামে।

ফিল্‌মটি শুরু হওয়ার পরই দারুণ চমক লাগল। এর শান্ত, গভীর রস মনকে এমন ভাবে স্পর্শ করল, তা দু’চক্ষু জুড়ে রইল আগ্রহ ও প্রত্যাশা। কাহিনি এগিয়ে আনা হয়েছে বেশ কিছু বছর। এ ছবিতে রবীন্দ্রনাথও একটি অপ্রত্যক্ষ চরিত্র, নায়িকা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। কাহিনির স্রষ্টাকে নিয়ে এ ধরনের খেলায় যে একটা স্নিগ্ধ কৌতুক থাকে, তা আমার খুব পছন্দ। ক্রমশ এর চিত্রভাষার সংযম আর গল্পের বুনন মুগ্ধ করে রাখে, কোথায় ঘুম আর কোথায় ঠান্ডার আরাম, সে সব মনেই পড়ল না। গানগুলি একটানা পরিবেশনের বদলে সিচুয়েশন অনুযায়ী কেটে-কেটে ব্যবহার করা সুপ্রযুক্ত হয়েছে। পিরিয়ড পিস রচনায় ঋতুপর্ণের কৃতিত্ব আগেও প্রমাণিত ‘চোখের বালি’তে। আমার মনে হল, ফিল্‌ম হিসেবে নৌকাডুবি অবশ্যই ঋতুপর্ণের শ্রেষ্ঠ দু-তিনটি ছবির অন্যতম। কাহিনিটি সম্পর্কে অনেকের অন্য মত থাকতে পারে, কিন্তু সেটা ফিল্‌মের বিচার নয়। ভাগ্যিস এই গরমে শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম, তাই বড় পর্দায় এমন একটি চমৎকার ছবি দেখার সৌভাগ্য হল।

ছবিটি সম্পর্কে একটি হালকা অভিযোগ, সকলেরই অভিনয় উচ্চাঙ্গের হলেও কয়েকটি চরিত্রের কথা বলার ভঙ্গি ঋতুপর্ণের মতন। একটা চরিত্রে তার কণ্ঠস্বর ডাব তা বোঝাই যায়। কিন্তু অন্য কেউ কেউ যেন ঋতুপর্ণ যেমন ভাবে শিখিয়েছে, সেই ভাবেই সংলাপগুলি বলেছে। ঋতুপর্ণ এর পর থেকে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা ভাবে নির্দেশ দাও। আর একটি কথাও মনে পড়ল, সেটা ব্যক্তিগত। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় এ ছবিতে নায়িকার বাবার ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেছে। অনেক দিন আগে, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র ফিল্‌মে সে ছিল এক রাগী, জেদি যুবক। এখন সে বৃদ্ধের ভূমিকায়, আর প্রতিদ্বন্দ্বী’র লেখকও এক সময় ছিল এক বাউন্ডুলে তরুণ, এখন সে এক-পা এক-পা করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে।

চিত্রনাট্যের বাঁধুনি যদি ঠিক থাকে, তা হলে প্রত্যেকের অভিনয়ই উঁচু তারে বাঁধা থাকে। এ ছবি দেখতে দেখতে সেটা আবার বোঝা গেল।

নৌকাডুবি উপন্যাসের প্রধান নায়ক হচ্ছে ঝড়। সিনেমা হল থেকে বাইরে বেরিয়েই দেখি ঝড় উঠেছে। ছবিটি দেখে ভাল লাগার রেশ কাটার আগেই এই ঝড় দেখে একটা আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে উঠল। এত গরমের পর ঝড় তো ভালই, তার পর বৃষ্টি হোক বা না-হোক, বাতাস বেশ কোমল হয় কিছুক্ষণ অন্তত। কিন্তু আমার মনে হল, নৌকাডুবির চরিত্র চারটির মতন যদি বুলবুলি পাখিটার সংসারও তছনছ হয়ে যায়? এর আগের একটি ঝড়ে ওই বাগানের দু’টি গাছ উপড়ে পড়েছে, কয়েকটা ফুলের চারা বিনষ্ট হয়েছে। গত কালই জোর হাওয়া ওঠার সময় বুলবুলিটাকে ছটফট করতে দেখেছি। কত রকম ঝাঞ্ঝাটের মধ্যে এদের সংসার চালাতে হয়! ঝড় ক্রমশই প্রবল হচ্ছে, ধুলোয়-ধুলোয় চতুর্দিক প্রায়ান্ধকার। আমার সত্যি ভয় হতে লাগল। বাড়ি ফেরার আগেই যদি ঝড়ের তাণ্ডবে নানান অঘটন ঘটে যায়।

ইচ্ছে হল প্রার্থনা জানাতে। দূর ছাই, কার কাছে প্রার্থনা জানাব? ভগবান-টগবান তো বিসর্জন দিয়ে ফেলেছি প্রথম যৌবনে। দেব-দেবীরাও সব সুন্দর পুতুল। তা হলে? প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা জানাব ঝড় থামাবার জন্য? আমি যদি প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা জানাতে শুরু করি, তা হলে প্রমাণ হয়ে যাবে যে আমার মগজও তরল হতে শুরু করেছে। আমি বুলবুলিটাকেই উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলতে লাগলাম, বেঁচে থাকো বুলবুলি, বেঁচে থাকো। বেঁচে থাকো, বেঁচে থাকো। তখনও সমস্ত আকাশ বিদ্যুৎ চমকে ফালা-ফালা করার পর কোথাও প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল।

জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড় এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না। আমরা বাড়ি পৌঁছোবার একটু আগেই বাতাস শান্ত হয়ে টিপি-টিপি বৃষ্টি নামল। না, ক্ষতি হয়নি, বারান্দার পাশে লতানে গাছের ঝোপে বুলবুলির বাসাটা ঠিকঠাক আছে। জায়গাটা নির্বাচনের কৃতিত্ব আছে পাখিটার। ওখানে ঝড়ের ঝাপ্টা বেশি লাগে না, তা ঠিক। তবু, আমারই প্রার্থনার জন্য ওর সংসার অক্ষুণ্ণ রইল, এই ভেবে আমি কি মনে মনে আত্মশ্লাঘা করতে পারি না?

রমণীর মন, সখা…

একটি বিরাট প্রশ্নের আজও উত্তর মেলেনি। আমি নিজে তিরিশ বছর ধরে নারীর অন্তরাত্মা নিয়ে গবেষণা করেও যার উত্তর খুঁজে পাইনি, সেটি হচ্ছে ‘একটি নারী কী চায়?’

—সিগমুন্ড ফ্রয়েড

১৫. ৬, ২০১১

এখনও ফর্সা, স্লিম, প্রকৃত সুন্দরী পাত্রী চাই!

খবরের কাগজের যে পৃষ্ঠা কিংবা পৃষ্ঠাগুলি আমি জীবনে কখনও পড়িনি কিংবা পড়ার দরকার হয়নি, তা হল পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের পাতা। খুদে খুদে অক্ষর, সাংকেতিক ভাষায় লেখা ওই সব বিজ্ঞাপনে কখনও চোখ পড়ে গেলেও চোখ সরিয়ে নিয়েছি। মাত্র কয়েক দিন আগে এক বর্ষার বিকেলে মুড়ি-তেলেভাজা খাওয়ার জন্য টেবিলের উপর খবরের কাগজ পাতা হয়েছে, ঢেলে দেওয়া হয়েছে মুড়ি, বেগুনি এখনও ভাজা শেষ হয়নি, আমি আবার কাঁচালঙ্কার অর্ডার দিয়েছি, চোখের সামনে ছাপা অক্ষর থাকলে তাতে অলস ভাবে চোখ বোলাতেই হয়। সেই ছড়ানো দু’পাতা ভর্তি সবই পাত্র-পাত্রী সংবাদ। কয়েকটি পড়ার পর আমার সমস্ত শরীরে যেন একটা ঝাঁকুনি লাগল। এ সব আমি কাদের কথা পড়ছি? এই দেশ সম্পর্কে আমি এতই অজ্ঞ? এই সমাজে যে এত অসংখ্য জাতপাত ভেদ আছে, সে সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।

আমরা সমাজে যে একটা ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে ঘোরাফেরা করি, সেখানে এখন প্রায় কেউ জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু তার বাইরের সমাজটা যে একেবারে শুদ্ধ হয়ে যায়নি, সে সম্পর্কেও ধারণা আছে। কিন্তু তা মোটা দাগের ধারণা। যেমন, বামুন, কায়েত, বৈদ্য-শূদ্র, আর ও-দিকে হিন্দু-মুসলমানের প্রভেদ। কিন্তু পূ: ব: কায়স্থ, সিংহ, সৌকালিন, দেবারি, কন্যারাশি, কলিস্থ দো: গহ, com. eng 31/5’4 পাত্রের জন্য স্বজাতীয় পাত্রী চাই। এর মানে কী? খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে অনেক পয়সা খরচ হয় আজকাল, তাই বক্তব্য যত দূর সংক্ষেপ করার জন্য নানা রকম সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করতে হয়। সেটা স্বাভাবিক। এ বিজ্ঞাপন যারা দেয় এবং যারা পড়ে তারা নিশ্চয়ই সংকেতগুলো বোঝে। আমাদের মতো অনধিকারীদের দুর্বোধ্য মনে হবে। যেমন উল্লিখিত বিজ্ঞাপনটির কলিস্থ দো গৃহ, অনেক চিন্তা করে এর অর্থ বের করলাম। খোদ কলকাতায় দোতলা বাড়ির মালিক। কেন? কিন্তু একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পাত্র এতই জাত মানে যে শুধুই কায়স্থ পাত্রী হলে হবে না। গোত্ৰটোত্র সব মেলাতে হবে! সৌকালিন একটা গোত্রের নাম আমি জানি, কন্যারাশিও শুনেছি, কিন্তু দেবারিটা কী ব্যাপার? অন্য কয়েকটা বিজ্ঞাপন পড়ে বুঝলাম, ‘গণ’ বলে একটা ব্যাপার আছে। নরগণ, দেবগণ ইত্যাদি। আমার এতখানি বয়স হল, সত্যি এই ব্যাপারটা এত দিন জানা ছিল না। তা হলে ‘দেবারি’ ব্যাপারটাও বোঝা গেল, দেবগণ নরগণ-এর মতো রাক্ষসগণও হয়। কিন্তু রাক্ষসটা দেখতে খারাপ লাগে, তাই দেবারি হয়ে গেল। কেউ কেউ সঠিক অর্থ না বুঝে বানান ভুল করে দেবারীও লিখেছে।

অন্তত শতকরা আশি ভাগ বিজ্ঞাপন পূ: ব: কিংবা প: ব: দিয়ে শুরু। দেশ ভাগ হয়ে গেছে চৌষট্টি বছর আগে, পূর্ববঙ্গ নামে এখন কোনও স্থানই নেই, এখনকার ছেলেমেয়েরা বাপ-ঠাকুর্দার সেই দেশ চর্মচক্ষে দেখেইনি। তবু বিজ্ঞাপনে এর উল্লেখের অর্থ হল, যে সব পরিবারের ইস্টবেঙ্গল অরিজিন, সে রকম পরিবারের সঙ্গেই বৈবাহিক সম্পর্ক পাতাতে চায় বিজ্ঞাপনদাতা। আর প: ব: থাকা মান বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে তারা খাঁটি পশ্চিমবঙ্গীয়, বাঙাল বাড়ির পাত্র বা পাত্রী চায় না। অর্থাৎ শুধু জাতের মিল থাকলেই হবে না। বাঙাল-ঘটির ভেদাভেদ এখনও রয়ে গেছে পুরোমাত্রায়। একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, পাত্রী শুধুমাত্র মেদিনীপুরের হওয়া আবশ্যক। কিছু কিছু শব্দের অর্থ আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝিনি। যেমন, ‘ফর্সা সুন্দরী, সু-উপায়ী মাঙ্গলিক সুপাত্র কাম্য’। মাঝখানে কমা টমা কিছু নেই। সুউপায়ী কে? পাত্র না পাত্রী? আর মাঙ্গলিক কোন অর্থবোধক? অন্য একটি বিজ্ঞাপনে ‘কায়স্থ, আলিম্বান গোত্র’ এ রকম গোত্র হয়? ছাপার ভুল? শুদ্ধ রূপটাই বা কী হতে পারে? ‘পূ: ব: ব্রাহ্মণ, নরগণ, মকর, O+’ কী ব্লাড গ্রুপ? মকর কী? প: ব: তন্তুবায় (gen) দেবারি ধনু’, gen-এর মানে বুঝলাম না, আর ধনু? আমি সরল ভাবে আমার অক্ষমতার কথা জানাচ্ছি, হয়তো অনেকেই এ সব বোঝে ও জানে।

কবি তারাপদ রায়ের প্রচুর সরস গল্পের স্টক ছিল। সে আমাদের বলত যে সে নিয়মিত পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়ে, নিজের জন্য নয় বা তার বউয়ের জন্যও নয়, কারণ সে মাঝে মাঝে এর মধ্যে অনেক মজার গল্পের সন্ধান পায়। যেমন, সে বলেছিল, একটি বিজ্ঞাপন, ‘গরিব বি এ প্লাকড, কোনও ভদ্র পরিবারে বিবাহ করিয়া ভাইয়ের মতো থাকিতে চাই।’ আর একটি ‘পাত্রী সুদর্শনা, বি এড, গৃহকর্মনিপুণা শুধু একটু গোঁফ আছে।’ এবং আর একটিতে পাত্রের যোগ্যতা, ‘গভ: ইঞ্জি: দৈনিক সাড়ে তিন যোগের বেসি না।’ এ সব সত্যি না তারাপদ রায় কল্পিত, তা আবশ্য জানি না। আমরা কোলের সামনে পৃষ্ঠাগুলিতে এ রকম কোনও মজার কাহিনি নেই। শুধু একজন পাত্র লিখেছেন, মাথায় টাক আছে। আর একটি বিজ্ঞাপনের করুন কাহিনির আভাস, ফর্সা, স্লিম, IT-তে কর্মরতা, নামমাত্র বিবাহে সাড়ে তিন মাসের ডিভোর্সি।’ এটুকু পড়লেই আহা রে বলতে ইচ্ছে করে ।

আমাদের গল্প উপন্যাসে প্রেমের ঘটনার ছড়াছড়ি। কিন্তু এখনও জনসাধারণের অধিকাংশই প্রেম-ট্রেম নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিংবা অল্প বয়সে ও সব একটু হলেও তার সঙ্গে বিয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। বিয়ে হয় বাবা-মা ,আত্মীয়স্বজনের উদ্যোগে অথবা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে। ওই সব প্রেম কিংবা ছেলেমেয়ের বিয়ের সিদ্বান্তে বিয়ে কিংবা বিয়ে ভাঙা একটা বিশেষ ক্ষুদ্র শ্রেণির ব্যাপার। জাত গোত্র মিলিয়ে বিয়ে এখনও পর্যন্ত নিরাপদ। বড় শহরে হয়তো কেউ ও নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না। কিন্তু দেশ মানে তো শুধু শহর নয়। অন্য জাতের ছেলেকে বা মেয়েকে বিয়ে করলে বাবা-মা নিজেদের হাতে ছেলে বা মেয়েকে কিংবা দু’জনকেই খুন করে। এমন তো প্রায়ই শোনা যায়। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান ছেলে মেয়ের বিয়ে হলে তাদের প্রাণের ভয়ে পালাতে হয়। এমনকী কলকাতা শহরেও তো কিছু কাল আগে রিজওয়ানুর নামে একটি সুদর্শন শিক্ষিত মুসলমান ছেলে প্রিয়ঙ্কা নামে মাড়োয়ারি কন্যাকে বিয়ে করার ফলে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ডই হল। এ ধরনের ঘটনা যখন খবরের কাগজে পড়ি, তখনই আমার মনে হয়, আমরা এখনও প্রকৃত সভ্য হইনি।

আমার ধারণা ছিল, পণপ্রথা যেমন বেআইনি হয়ে গেছে, সে রকম এই সব বিজ্ঞাপনে ফর্সা কালোর উল্লেখ করা নিষিদ্ধ। কী ভুল, কী ভুল সেই ধারণা। পণপ্রথাও যেমন আড়াল দিয়ে অনেকটাই চলে, তেমনই বিজ্ঞাপনে ফর্সা পাত্রী চাওয়া হয় নির্লজ্জভাবে।

আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের আমরা কত নিন্দে করেছি, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আফ্রিকার অন্য কয়েকটি রাজ্যে শ্বেতাঙ্গরা বহু কাল অত্যাচার করার পর এখন হার মেনে কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর ভারতে আমরা এখনও প্রকাশ্যে ফর্সা মেয়ে চাইছি। পাত্রী পক্ষের বিজ্ঞাপনে একটিও ফর্সা ছেলে চাওয়া হয়নি। বরং নিজেদের পরিচয়ে অনেক ক্ষেত্রে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে উ: শ্যা: অর্থাৎ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। পাত্রপক্ষের বিজ্ঞাপনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফর্সা, রঙের দাবি আবশ্যিক। একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, সদর্প ঘোষণা: ‘ফর্সা প্রকৃত সুন্দরী ছাড়া যোগাযোগের আবশ্যকতা নাই’। প্রকৃত সুন্দরী কাকে বলে? চল্লিশ শতাব্দী ধরে কবির দল তার সংজ্ঞা গুনে চলেছে আর বাংলার পাত্রপক্ষ তা জানে। মেয়েদের শরীরের গড়ন সম্পর্কে স্লিম কথাটি প্রায় সর্বত্র। অথচ বাংলায় ‘তন্বী’ একটা কী সুন্দর শব্দ আছে। বাংলা কাগজে কেউ কেউ ইংরেজি বিজ্ঞাপন দেয়। ‘E B Brahmin bride 27, fair, beautiful…’ আমার ধারণা ছিল ব্রাইড শব্দটার অর্থ বিবাহ-উৎসবের দিনে কোনও রমণী, বিয়ের আগে কিংবা পরে কী করতে ব্রাইড বলে? কনে শব্দটা যেমন বিয়ের রাতে তো শুধু কনেও এখন বোধহয় অর্থের ব্যাপ্তি ঘটেছে।

শতকরা আশিটি বিজ্ঞাপনেও জাতপাতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মিল খোঁজা হয়েছে। একটি বিজ্ঞাপনে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে পাত্রীকে হতে হবে নিরামিষভোজী। আর একটি বিজ্ঞাপনে খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে দাবি করা হয়েছে, মা-বাবা-ভাই-বোন থাকা আবশ্যিক। এই সব বিজ্ঞাপন থেকে সমাজচিত্রের কিছু কিছু পরিবর্তনও নিরীক্ষণ করা যেতে পারে। কিছু কিছু বিজ্ঞাপনদাতা প্রগতিশীল হচ্ছেন, জানিয়ে দিচ্ছেন অসবর্ণে আপত্তি নাই। কেউ কেউ বলছেন স/অ চলতে পারে। অর্থাৎ সবর্ণ বা অসবর্ণ। একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, ‘স/উ: অ’-এর মানে প্রথমে বুঝতে না পেরে অনেক গবেষণা করে বার করতে হল, সবর্ণ অথবা উচ্চ অসবর্ণে আপত্তি নাই। উচ্চ অসবর্ণ কী জিনিস, তা আমার বুদ্ধির অগম্য।

বস্তুতপক্ষে এই যে গোত্র, বর্ণ ইত্যাদি সবই আসলে ভাবের ঘরে চুরি। হাজার হাজার বছর ধরে এগুলি অবিকৃত বা শুদ্ধ আছে না ছাই। টাকা থাকলেও ইচ্ছে মতো জাত কেনা যায়। বিশ্বামিত্র নাকি তপস্যার জোরে ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন। এ যুগে তপস্যা-টপস্যা লাগে না। যদি অধ্যাবসায় থাকে, সৎ বা অসৎ পথে বহু অর্থ উপার্জন করা যায়, তা হলে যে কোনও জাতি ধর্মকে সে তুচ্ছ করে দিতে পারে।

কিছু কিছু মুসলমান পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনেও রয়েছে দেখলাম, ইসলামে এত জাতপাতের বিভেদ নেই। কিন্তু প্রতিটি বিজ্ঞাপনেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পাত্র বা পাত্রী সুন্নি মুসলিম এবং তারা সুন্নি পাত্র পাত্রীই চায়। আমাদের এ অঞ্চলে শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম নেই বললেই চলে। তবু এই সতর্কতা।

একটি প্রায় বিপ্লবী বিজ্ঞাপন উদ্ধৃত করে আপাতত শেষ করা যেতে পারে। ‘প: ব: ব্রাহ্মণ (নাস্তিক) ৩০/৫’7” চার্টার্ড অ্যাকা: ৭৫,০০০। একমাত্র সন্তান। কোনও দাবি নাই। শিক্ষিতা সুন্দরী ফর্সা ও কেবলমাত্র রেজিস্ট্রি বিবাহে আগ্রহী।’ নাস্তিক হলে কী করে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেওয়া যায়, জানি না। সে প্রশ্ন তুলছিও না। এই বিজ্ঞাপনকে প্রায় বিপ্লবী বলার কারণ, ফর্সা শব্দটি বাদ দিলেই ঠিক মানানসই হত। আমি নিজে ঝিরকুট্টি কালো। আমার বউ কালো ছাতা ব্যবহার করলে মিশে যাব বলে আমার পরিবারের সকলেই ঝড়ের আগে মেঘবর্ণ। তাই কালোদের প্রতি আমার দুর্বলতা তো থাকবেই!

তারাপদ রায় উবাচ

সম্রাট শের শাহ প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। তার আগে ঘোড়ারা বুঝি ডাকত না?

২৯. ৬. ২০১১

আমাদের শহরের পাশে প্রিয় নদীটি

এক সময় বরিশাল জেলা সম্পর্কে এই রসিকতাটি প্রচলিত ছিল। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বানান করে বাংলা শিখছে কয়ে হ্রস্বউ, কয়ে হ্রস্বউ, র=কুকুর, ম, হ-য়ে হ্রস্বই, মূর্ধন্য ষ=মহিষ, ব-য়ে হ্রস্বই, ড-এ শূন্য ড়’য় আকার, ল=ম্যাকুর! অর্থাৎ বরিশালে বিড়ালকে বলে মেকুর। বানান আর ছাপার অক্ষরে যা-ই থাক, ওরা মেকুর বলবেই। এটা হঠাৎ মনে পড়ল। তার কারণ কলকাতা শহরের পাশ দিয়ে যে নদীটি বয়ে চলেছে, তার নাম কী? সেই নদীটির নাম এক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাতও বটে। সব শিশুই যে নদীর নাম জানে, সে নদীর নাম দিয়ে কত কবিতা লেখা হয়, অনেক লোকে এখনও গঙ্গাস্নানে যায় পুণ্য অর্জনের জন্য। গঙ্গাসাগর সঙ্গমে প্রতি বছর বিরাট মেলা হয়। অথচ অনেক জায়গায় ছাপার অক্ষরে সে নদীর নাম হয়ে থাকে হুগলি নদী। মুখে কোনও লোকই হুগলি বলে না। অথচ ম্যাপে কেন গঙ্গার নাম থাকে না? এমনকী গঙ্গার উপর কোনও সেতু বানাতে গেলে তার দায়িত্ব নেয় ‘হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশন’।

কোথা থেকে এল এই হুগলি নাম? বলাই বাহুল্য, ইংরেজ আমলে গঙ্গা নামটি মুছে দিয়ে একটি মাত্র জেলার নামে এই নদীকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কেন এই অদ্ভুত কাজটি করা হয়েছিল, তা ইংরেজরাই জানে। কিংবা তারাও এখন ভুলে গেছে। মহাভারতে এই নদী সম্পর্কে চমৎকার একটি গল্প আছে। গঙ্গাদেবী সগর রাজার ছেলেদের (মাত্র ষাট হাজার) উদ্ধার করার জন্য নেমে এসেছিলেন স্বর্গ থেকে। তাঁর প্রবল বেগ সামলানোর ক্ষমতা ধরিত্রীর ছিল না। তাই স্বয়ং মহাদেব দু’পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই নদীকে মাথায় ধারণ করেছিলেন। ছোটবেলায় জগদীশচন্দ্র বসুর চমৎকার একটা লেখা পড়েছিলাম। যাতে এই প্রশ্ন, নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? কুলুকুলু ধ্বনিতে তার উত্তর পাওয়া যেত, মহাদেবের জটা হইতে। এই কাহিনির জন্যই বহু হিন্দু এখনও গঙ্গার জল অতি পবিত্র মনে করে।

শাসক ইংরেজরা এ দেশের অনেক নগর, নদী, পর্বতের নাম ইচ্ছে মতন বদল করেছে। উচ্চারণ বিকৃতিতেও ইংরেজরা ছিল ওস্তাদ। গঙ্গা শব্দটা উচ্চারণ করা কি খুব শক্ত? তবু ইংরেজরা বলত, গ্যাঞ্জেস। সারা ভারতেই এ নদীর নাম গঙ্গা হিসেবেই প্রসিদ্ধ, ভারতের বাইরেও গঙ্গা বা গ্যাঞ্জেস নামটি পরিচিত, শুধু বঙ্গ প্রদেশেই হয়ে গেল হুগলি। তা কি বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষের কারণে? নইলে এর যুক্তির মাথামুণ্ডু পাওয়া খুবই দুষ্কর। প্রাকৃতিক ভাবেও ভারতের অন্যতম এই প্রধান নদীটি বাংলার সীমান্তে এসে দু’ভাগ হয়ে গেছে, পূর্ববঙ্গে (অধুনা বাংলাদেশে) একটি ধারার নাম পদ্মা, এখনও সেই নামই আছে, অন্য ভাগটির একটি পৌরাণিক নাম (বেশি ব্যবহৃত নয়) ভাগীরথী, আর হুগলি নিছকই ইংরেজদের স্বকপোল কল্পিত? নাকি পাঠান-মোগল আমলে এই উটকো নাম দেওয়া হয়েছিল?

কিছুটা দেরি হলেও অনেক নগর, নদী, পর্বতের ইংরেজদের দেওয়া বিকৃত নামের পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতন ক্যালকাটার বদলে কলকাতা নামটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। কোনও মানচিত্রে, এমনকী স্বদেশি-বিদেশি বিমান সংস্থাগুলিতেও এখন ক্যালকাটার বদলে কলকাতা এসে গেছে স্বাভাবিক ভাবে। কলকাতা শহরের নানান পরিবর্তনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, এখন আমাদের প্রিয় নদীটির আসল নামটিকে কি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যায় না?

আমার গঙ্গা স্মৃতি

ছেলেবেলায় প্রায় আট-ন’মাস আমি ছিলাম কাশীতে। মা-ভাইবোনদের সঙ্গে (কিংবা আমার বোন বোধহয় তখনও জন্মায়নি), বাবা থাকতেন কলকাতায়। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ মধ্যগগনে। আমার সেই কাশীবাসের যে কয়েকটি স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ছোট্ট মাটির খুড়িতে মাত্র দু’পয়সায় বিশ্বনাথের গলিতে রাবড়ি কেনা। আর একটি হচ্ছে দশাশ্বমেধ ঘাটে প্রতি বিকেলে কথক ঠাকুরদের মুখে রামায়ণের গল্প শোনা। বিভিন্ন কথক ঠাকুর খানিকটা দূরে দূরে আলাদা আলাদা গল্প শোনাতেন। আমার মনে আছে রামায়ণের কথা। আমার একটি উপন্যাসে কাশীর সামাজিক ছবি ফুটিয়ে তুলতে আমার সেই বাল্যস্মৃতি অনেকটা কাজে লেগেছিল।

কথক ঠাকুরেরা যে সব পৌরাণিক কাহিনি শোনাতেন, তা কিন্তু ঠিক পাঠ নয়। কথক ঠাকুরেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কখনও নেচে নেচে রামায়ণ মহাভারতের গল্প খানিকটা অভিনয় করে মূল কাহিনির সঙ্গে নিজেরাও কিছু জুড়ে দিতেন। কোনও কোনও ঘটনার ব্যাখ্যাও করতেন। যেমন, সীতা হরণের সময় রাবণ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধরে সবলে সীতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন আকাশপথে। সেই দৃশ্য নাটকীয় ভাবে বর্ণনা করার পর কথক ঠাকুর বলতেন, হে রাবণ, তুমি যে সীতাকে হরণ করলে, তা এমন কিছু দোষের নয়, রাজারা তো এ রকম করেই থাকেন। নারী ও বসুন্ধরা বীরভোগ্যা। কিন্তু তুমি নিজের পৌরুষ প্রদর্শনের বদলে সন্ন্যাসী সাজলে কেন? এই যে কাণ্ডটি তুমি করলে, তার ফলে কী হল জানো, সেই থেকে লোকে সাধু সন্ন্যাসীদের অবিশ্বাস করতে লাগল। ছি ছি রাবণ রাজা!

আমার তখন ন’দশ বছর বয়স। পথের পাঁচালীর অপুও এই বয়সে কাশীতে ছিল। সেই নিজের চোখের চেয়েও বড় বড় চোখ মেলে সব কিছু দেখা, নতুন নতুন মানুষের কথা মনে গেঁথে রাখাই চলতে থাকে। আমার অন্য দুটি ভাই আরও ছোট। তাদের রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে তখনও আগ্রহী হওয়ার কথা নয়। তারা এ দিক ও দিক খেলে বেড়ায়। শেষ বিকেলে দশাশ্বমেধ ঘাট লোকে লোকারণ্য। কাছেই বাঙালিটোলা। তাই বাংলা কথাই শোনা যায় বেশি। মায়ের পাশে বসে আমি গোগ্রাসে রামায়ণ গিলতাম।

ডিসেম্বর মাস। কলকাতার বাঙালিদের কাছে কাশীর শীত খুব বেশিই মনে হয়। আমি অলেস্টারের উপর (কথাটা ঠিক কি না, তা আজও জানি না) চাদর জড়িয়ে নিতাম। এই সময় কাশীতে বেড়াতেও আসেন অনেকে। তাদের সঙ্গে নানা রকম শৌখিন শীতের পোশাক। এক দিন খুব মন দিয়ে রামায়ণের গল্প দ্বিতীয় বার শুনছি, হঠাৎ একটু দূরে হই হই রব উঠল। গঙ্গার সিঁড়ির শেষ ধাপে এক দল লোক জড়ো হয়েছে। আওয়াজ আসছে সেখান থেকে। পৌরাণিক গল্পের চেয়েও বাস্তব নাটকের প্রতি বেশি আগ্রহে ছুটে গেলাম সেই দিকে।

তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। সেখানে গিয়ে বোঝা গেল, লোকেদের চিৎকারের মর্ম, একটা বাচ্চা ছেলে হঠাৎ জলে পড়ে গেছে। কিন্তু তাকে বাঁচাবার জন্য কেউ জলে নামছে না। কারণ বোধহয় সকলেরই গায়ে অনেক পোশাক, পায়ে মোজা। সেই বয়সেই আমি নিজেকে খুব ভাল সাঁতারু মনে করতাম। এতগুলি লোকের সামনে আমার সাঁতার কৃতিত্ব দেখাবার লোভেই সম্ভবত আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম গঙ্গায়। প্রায় ডুবন্ত বাচ্চাটির দুটি মুঠি করা হাত দেখা যাচ্ছে দু’এক বার। আমি কোনও রকমে তার হাত ধরে ফেলে টেনে আনলাম ঘাটে। তখন দেখা গেল, সে আমারই ছোট ভাই বাচ্চু।

কথকতার আসরে আমার মা এই ঘটনা শুনেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য।

আরও একটু স্মৃতি

বাঙালিটোলায় একটা সরু গলির মধ্যে একটা বাড়ির তিনতলায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম আমরা। বাবা কলকাতায়, মা নিতান্তই এক যুবতী। সুতরাং পরিবারের কর্তা তখন আমিই। বাজার-টাজার করার ভার আমার ওপর। আমাদের এক পিসিমা ও পিসেমশাই থাকতেন ওই বাঙালিটোলায়। সেই সূত্রেই আমাদের কাশী যাওয়া। কিন্তু আত্মীয়তার সেই সম্পর্ক আমাদের পক্ষে তেমন ভরসার কিংবা সুখকর হয়নি।

এক দুপুরে ছাদে ঘুড়িটুড়ি উড়িয়ে ঘর্মাক্ত অবস্থায় নীচে নেমে দেখি, আমার মায়ের সামনে এক শীর্ণ চেহারার মহিলা বসে আছেন এবং কথা বলতে বলত আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। মা চোখের ইঙ্গিত করলেন, যাতে আমি সেখানে না থাকি।

পরে মায়ের কাছে ছেঁড়া ছেঁড়া বিবরণ শুনে এবং পারিপার্শ্বিক কিছু কিছু চরিত্র দেখে আমি ঘটনাটি জুড়েছি। নিছক ঘটনা নয়, এক টুকরো ইতিহাস।

পাড়াপ্রতিবেশীদের মুখে আমাদের এই নবাগত পরিবারটির পদবি শুনে তিনি আলাপ করতে এসেছেন। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল যে আমাদের মতো পূর্ববঙ্গের একই গ্রামের, একই পল্লি থেকে তিনিও এসেছেন এখানে। আটচল্লিশ বছর আগে। তাঁর বিয়ে হয়েছিল ন’বছর বয়সে। মাত্র দেড় বছর পরে বৈধব্য। তার এগারো মাস পরেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাশীতে। তারপর আর কোনও দিন বাংলায় ফিরে যাওয়া হয়নি। কিন্তু সালতারিখের খুঁটিনাটি সব তাঁর মুখস্থ আছে এখনও।

সে কালে বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের বালবিধবাদের বিড়াল পার করার মতো কাশী বা বৃন্দাবনে যে পাঠিয়ে দেওয়া হত, তা অনেক বইতে পড়েছি। তারই একটি জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত আমার নিজের চোখে দেখা। সে সময় বারাণসীর রাস্তায় কিংবা ঘাটে বিধবাদের প্রাচুর্য ছিল খুবই। তার তাৎপর্য সে সময় বুঝিনি। সেই মহিলাকে আমরা অন্নদামা বলতাম। তিনি মাঝে মাঝে আসতেন আমার মায়ের সঙ্গে গল্প করতে। তাঁর সঙ্গে লতায়পাতায় আমাদের কী একটা আত্মীয়তাও বেরিয়ে পড়ল।

এই বিধবাদের গ্রাম থেকে গোপনে বিদায় করে দিয়ে কিছু মাসোহারা পাঠানো হত, দশ টাকা বা পনেরো টাকা। পরিবার থেকে ওই টাকাটা আসত, তারপর জিনিসপত্রের দাম অনেক বাড়লেও মাসোহারা আর বাড়ত না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কয়েক বছর পর টাকা আসাই বন্ধ হয়ে যেত। কী করে বেঁচে থাকতেন এঁরা? শেষ পর্যন্ত এঁদের কেউ কেউ বাধ্য হয়ে যে পেশাটিকে গ্রহণ করতেন তাতে আমি কিছুতেই নৈতিকতার প্রশ্ন তুলতে রাজি নই।

হিসেব অনুযায়ী অন্নদামা’র বয়স ষাটের কাছাকাছি হওয়ার কথা। এই বয়সের কোনও রমণী এ যুগে সিনেমার নায়িকা হয়। কিন্তু অন্নদামাকে দেখাত অশীতিপর বৃদ্ধার মতো। হাঁটতেন একটু খুঁড়িয়ে। জীবনের কাছ থেকে তিনি অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই পাননি। তবু ভারী মধুর ছিল তাঁর ব্যবহার। আমাদের কাছ থেকে তিনি কোনও রকম সাহায্য নিতে চাইতেন না। বরং আটচল্লিশ বছর আগে ছেড়ে আসা তাঁর গ্রামের নতুন বউ আমার মা, তাঁকে আশীর্বাদস্বরূপ কিছু দিতে পারছেন না, সে জন্য তাঁর সে কী আফশোস।

আমি আজও স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু বহু বছর আগে দেখা অন্নদামাকে আমার মাঝে মাঝে মনে পড়ে। আর তখনই মনে হয়, এই সব নারীর জন্য একটা বিশেষ স্বর্গ অবশ্যই থাকা উচিত।

১৩. ৭. ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *