আমার সংক্ষিপ্ত কেরল দর্শন
এবারে আমার চতুর্থ বার কেরলে আসা। এক সময় প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছি, অরুণাচল ছাড়া সারা ভারতের কোনও রাজ্যই আমার অদেখা নয়। তবে, অনেক বছর অন্তর অন্তর এলে কিছু পরিবর্তন তো চোখে পড়বেই।
কোচি বা কোচিন শহরে এসেছিলাম প্রায় আঠারো বছর আগে। তখন কোচির বদলে এর্নাকুলম নামটাই বেশি পরিচিত ছিল, হাওড়া-কলকাতার মতন দুই সন্নিহিত জনপদ এখন বৃহত্তর কোচি, বিমানবন্দরের নামও তাই। সেখান থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে নগরের দিকে আসতে আসতে মনে হল, রাস্তার তো যথেষ্ট উন্নতি হয়েছেই, দু’দিকে আধুনিক কায়দার অনেক বাড়িঘর, সব মিলিয়ে বেশ একটা পরিচ্ছন্নতার ভাব, কলকাতা শহরে যে-ভাবটা আজও নেই। এখানে যেখানে সেখানে আবর্জনার স্তূপ চোখে পড়ে না, প্লাস্টিক-পলিথিনের থলি কোথাও ডাঁই করা নেই। একেবারে নেই তা নয়, দু’চারটি আছে এখানে সেখানে, তবে খুবই কম। ভারতের উত্তর বা পূর্ব অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণের দিকে পরিচ্ছন্নতা বোধ অনেক বেশি। তার কারণ, আর্যরা পরিচ্ছন্নতার তেমন ধার ধারে না, সেই তুলনায় অনার্য দ্রাবিড় জাতি অপরিচ্ছন্নতা সহ্য করে না। অমিশ্র আর্যদের উদাহরণ এখন কাবুলিওয়ালারা। তাদের আর যত গুণই থাক, পরিচ্ছন্নতার আদর্শ হিসেবে বোধহয় গণ্য করা যায় না। আমরা বাঙালিরা আর্য-অনার্যের দো-আঁশলা, আমাদের কোনও পরিচ্ছন্নতার আদর্শই নেই। এমনকী, এই বাংলাতেও সাঁওতাল ওরাওঁদের বাড়িঘর, সামান্য কুড়েঘর হলেও ঝকঝকে তকতকে। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি যাত্রায় গাড়ি লাফিয়ে উঠল না এক বারও, কোথাও খানাখন্দ নেই, পথের হাড়গোড় বেরিয়ে আসেনি। এর পরেও, কয়েক দিন ধরে অনেক গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাতেও ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে আমাকে, সব রাস্তাই হাইওয়ে নয়, তেমন চওড়াও নয়, কিন্তু গৰ্তমুক্ত, মসৃণ। আমাদের দিকেও প্রধান প্রধান রাজপথগুলির বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে, কলকাতা থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার পথ যেন বিলেত-আমেরিকার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, কিন্তু শাখাপথগুলি দিয়ে বাংলার অভ্যন্তরে ঢুকলেই বোঝা যায়, এই রাস্তায় যারা সাইকেল চালিয়ে যায়, তারা কত বীরপুরুষ। যে-সব রাস্তায় খানাখন্দ বুজিয়ে মেরামত করা হয়েছে, সেই সব রাস্তাও কিছুতেই মসৃণ হয় না। আমরা কি মসৃণতার কথা ভুলেই গিয়েছি?
এখানে এক-একটা মোড়ে লালবাতিতে গাড়ি থামলেই তো জানলায় জানলায় শিশু কোলে মা, কানা-খোঁড়া সাজা অভিনেতারা হানা দেয় না। ভিখিরিরা সব গেল কোথায়? এ রাজ্যের সব ভিখিরিকে কি দিল্লি-কলকাতায় চালান করে দেওয়া হয়েছে নাকি?
আমাকে আসতে হয়েছে একটি বিশেষ কাজ উপলক্ষে। ‘বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে’ গৃহিণীও তৈরি। পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, এমন কথা এ যুগে উচ্চারণ করাও বিপজ্জনক। যে-হেতু সতী শব্দটির কোনও পুংলিঙ্গ নেই, তাই স্ত্রীর সতীত্ব বিষয়ে সামান্য ইঙ্গিতও সংবিধানে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। (স্ত্রীলিঙ্গ, পুংলিঙ্গ এই শ্রুতিকটু শব্দ দু’টি ব্যাকরণ থেকে বাদ দিলে হয় না? স্ত্রীবাচক, পুরুষবাচক বললে ক্ষতি কী?)
স্বাতীও সঙ্গে আসছে জেনে আমার দু’জন প্রবাসী বন্ধু, যারা প্রতি বছরই আসে প্রাক্তন স্বদেশে, সেই অসীম রায় আর দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী বলল, তা হলে আমরাও কেরলে বেড়িয়ে আসি। এবং বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়, সদাব্যস্ত বিশিষ্ট আবৃত্তিকার ও থিয়েটার পাগল সৌমিত্র মিত্র এবং তস্য পত্নী মুনমুনও দু’দিন পর এসে উপস্থিত। অর্থাৎ, বেশ একটি পুরুষ্টু দল। তার ফলে হল কী, আমি যখন কোনও সেমিনার কক্ষে বসে রবীন্দ্রনাথের ইংরিজি রচনা বিষয়ে বক্তৃতা শুনতে শুনতে অতিকষ্টে চোখ ভোলা রাখার চেষ্টা করছি ও নিজের কোমরে নিজেই চিমটি কাটছি, তখন ওরা দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে সমুদ্রকিনারে কিংবা ঐতিহাসিক গন্তব্য স্থানগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধের পরের আড্ডায় ওরা সমস্বরে উচ্ছ্বসিত ভাবে জানায় যে, ভ্রমণের পক্ষে কেরল রাজ্যটি অতি উৎকৃষ্ট, যেমন দ্রষ্টব্য ও বিশ্রামের স্থান অনেক, তেমনই যাতায়াত ও থাকার জায়গার সুবন্দোবস্ত আছে, লোকজনের ব্যবহার ভাল, নানা দেশের পর্যটকদের ভিড় কিন্তু কোথাও বিশৃঙ্খলা নেই। তুলনামূলক ভাবে ওরা যখন পশ্চিমবাংলার সমালোচনা করতে থাকে, তখন আমার গোপন দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
আমাদের বাংলাতেও আছে সুন্দরবন ও দার্জিলিং-এর মতন দু’টি বিশ্ববিখ্যাত স্থান। এক কালে আমরাও তো দেখেছি, আমাদের বাংলায় কত হরেক রকমের সাহেব-মেম, আফ্রিকান ও আরবীয়, জার্মানিদের ঘুরে বেড়াতে। এরা প্রত্যেকেই এক-একটি জীবন্ত ফরেন এক্সচেঞ্জ। এখন আর তারা আসে না। হায় দার্জিলিং। কেন রে ভাই, তোরা দার্জিলিংকে আলাদা করার জন্য আত্মধ্বংসী আন্দোলন চালাচ্ছিস? যতই দাবিদাওয়া থাক, পশ্চিমবাংলাকে আবার টুকরো করার প্রস্তাব বাঙালিরা কি কিছুতেই মেনে নেবে? নাঃ। শিলিগুড়ির কাছে দেওয়াল তুলে দিলে গোর্খাল্যান্ডের মানুষ নীচে নামবে কী করে? শুধু পাহাড়ে থাকলে খাওয়া জুটবে?
কেরলের পথঘাটের বহির্দৃশ্যের সঙ্গে আমাদের বাংলার একটা তফাত অতি প্রকট। এখানেও তো নির্বাচন আসন্ন, কিন্তু কোথাও বড় বড় পোস্টার, নেতা-নেত্রীর অবয়বের কাট-আউট কিংবা মাইলের পর মাইল জুড়ে পতাকা লটকানো নেই। কাট-আউটের কালচারটা বোধহয় আমরা তামিলনাড়ু থেকে আমদানি করেছি। আমার কাছে এটা নির্লজ্জতা বলে মনে হয়। কোথাও কোনও মিছিলের জন্য পথ অবরোধের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়নি। খবরের কাগজেও কোনও দলীয় সংঘর্ষ, খুনোখুনির সংবাদও তো চোখে পড়ল না। এ আমারই চোখের দোষ নাকি? এ রাজ্যে হিন্দু ও মুসলমান ছাড়া খ্রিস্টধর্মীয়দের সংখ্যাও কুড়ি-বাইশ শতাংশ, মন্দির-মসজিদের তুলনায় সুদৃশ্য গির্জার সংখ্যাই বেশি। তবু ধর্মীয় হানাহানির কলঙ্ক এই রাজ্যে সবচেয়ে কম। ভোটের সময় সম্প্রদায় বিশেষের তোষামুদি ও টানাটানির মতন অগণতান্ত্রিক ব্যাপার এ রাজ্যেও চলে কি না, তা আমরা বাইরে থেকে এসে কী করেই বা বুঝব?
একটা ব্যাপারে পশ্চিমবাংলা এ রাজ্যের তুলনায় কিছুটা স্বস্তিজনক। খাবারদাবারের দাম এখানে যথেষ্ট বেশি। একটা ডাবের দাম কুড়ি টাকা, বাংলায় দশ টাকা। মাছ প্রচুর। কোচির মাছের বাজার বিখ্যাত, এত রকমের মাছ ও চিংড়ির বৃহৎ আকার খুবই দৃষ্টি-লোভন, কিন্তু দাম শুনলে বুক কেঁপে যায়। তবে, মুনমুন ও স্বাতীর মতে, শহরের বিশাল বিশাল দোকানে শাড়ির দাম কলকাতার তুলনায় অনেক সস্তা। এর সত্যতা, কিংবা শাড়ি বিষয়ে কোনও রকম মত দেওয়ার অধিকার অবশ্য পুরুষদের নেই।
এখানকার অনেক অংশের নামই বদলে গিয়ে আদিতে ফিরে এসেছে। যে অঞ্চলটিকে আমরা আলেপ্পি বলে জানতাম, এখন সেটি আলাপ্পুঝা, সেখানেও ব্যাকওয়াটারে বজরাভ্রমণ একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। বিশাল বিশাল সব বজরা, কিন্তু এখন যন্ত্রচালিত, ভেতরে আরামের সব রকম ব্যবস্থা, ঝকঝকে বাথরুম। সারা দিন চলন্ত জলপথ ও দু’পাশের গাছপালার দৃশ্য দেখে মনে পড়ে এক কালের পূর্ববঙ্গের স্বাস্থ্যবতী নদীগুলির কথা, সুন্দরবনের সঙ্গে বেশ মিল আছে। হায়, আমাদের সুন্দরবনে এমন ব্যবস্থা করা যায় না?
বজরার ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে চোখে পড়ে ছোট ছোট মাছ ধরার ডিঙিনৌকো, আমাদের দীপ্তেন্দু ও সৌমিত্র অতি মাত্রায় মৎস্যপ্রেমিক, জেলেদের ডেকে ডেকে কেমন মাছ কে ধরেছে, তার খোঁজখবর নেয়। এক জায়গায় সোনার খনি আবিষ্কারের মতন ওরা উল্লাসধ্বনি করে উঠল। একটা ডিঙিতে রয়েছে ছটফটে কই ও মাগুর মাছ। কই মাছ ভারতের অনেক রাজ্যে এবং অনেক অনেক দেশেই পাওয়া যায়, ভিয়েতনাম এবং চিনেও, কিন্তু বঙ্গদেশীয়রা মনে করে, ইলিশের মতন কই-ও বাঙালি-মাছ। হয়তো তার একটা কারণ এই যে, বাঙালিরা কই মাছ (এবং মাগুরও) জ্যান্ত না থাকলে ছোঁয় না, তাই তারাই এই মাছের প্রকৃত স্বাদ পায়, অন্য অনেক জায়গাতেই মৃত কই মাছ বাজারে বিক্রি হয়। এখানকার কইগুলি আকারে যথেষ্ট বড়, হৃষ্টপুষ্ট এবং ভুড়িদাস, অর্থাৎ ডিম ভরা, দাম অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা, দুশো টাকা কিলো। কলকাতার বাজারে পাঁচ-ছশো তো হবেই, মাগুরও সেই রকম। অত্যুৎসাহী যুবকদ্বয় অবিলম্বে মাছ কিনে স্থানীয় লোক ডেকে কাটাকুটি করে ফেলল। আমাদের বজরার পাচকরা পমফ্রেট বা সুরসাই ছাড়া অন্য মাছ রান্না করতে জানে না। সৌমিত্র রান্নাঘর দখল করে কই-ফুলকপির ঝোল ও মাগুর মাছের কালিয়া প্রস্তুত করে ফেলল। এ রকম পরিবেশে, পরিচিত লোভনীয় মাছের ঠিকঠাক রান্নায় যেন স্বাদ অনেক গুণ বেড়ে যায়।
আর একটি অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। ফোর্ট কোচি অঞ্চলে অনেক ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থান আছে, এবং রয়েছে গোটা দু-এক প্রাচীন হিন্দু মন্দির। শুধু হিন্দু ছাড়া কারও সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। এবং হিন্দুদেরও ড্রেস কোড আছে। পুরুষদের গায়ে জামা থাকবে না, এবং ধুতি পরতে হবে। আমরা আর ধুতি পাব কোথায়, আর বিগ্রহ দেখার জন্য তেমন কিছু দারুণ আগ্রহও নেই। মেয়েদের কোনও শর্ত নেই। স্বাতী চলে গেল ভেতরে। মন্দিরের দরজার পরেই দু’পাশে দুটি রোয়াক, তার পর প্রশস্ত চাতাল। তারও খানিক দূরে মূল গর্ভগৃহ। আমরা অনেকক্ষণ হেঁটেছি, আমি আর অসীম ভাবলাম, স্বাতীর অপেক্ষায় সেই রোয়াকে একটু বসি। দু’জনে রোয়াকে সবেমাত্র পশ্চাৎদেশ ঠেকিয়েছি, অমনি দূর থেকে এক তরুণ, বলবান পুরোহিত রে রে করে তেড়ে এসে বলতে লাগল, গেট আউট। গেট আউট। প্রায় গলাধাক্কা দিয়েই আমাদের বার করে দিল। এই বয়সেও কেউ হঠাৎ হঠাৎ এ রকম অপমান করলে মন্দ লাগে না। বেশ হাসিই পায়।
বিশিষ্ট শিল্পী ও আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ শ্ৰীমতী দীপালি ভট্টাচার্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের ছবি, চিঠিপত্র ও পাণ্ডুলিপির একটি প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। এক ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত কিছু ছবি এবং আর্ট কলেজের নিজস্ব সংগ্রহের কয়েকটি ছবি ও স্কেচ। এর মধ্যে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এর মধ্যে অনেক ছবি রবীন্দ্রনাথের নিজের আঁকা নয়, জাল। চমকে উঠেছি। এমন কথা আগে কখনও শুনিনি। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই, তবু কেউ কেন এ সব কুকর্ম করবেন, তা আমার বুদ্ধির অগোচর। আমি শিল্পবিশেষজ্ঞ নই, এ বিষয়ে একমাত্র মতামত দেওয়ারও অধিকার আমার নেই। যাঁরা পণ্ডিত, তারাই মীমাংসা করবেন। ছবিগুলি দেখতে দেখতে আমার রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য ছবির মতনই লাগছিল। এবং কয়েকটি রমণীর মুখ-আকৃতি দেখে অন্য একটা কথা মনে পড়ল। রবীন্দ্রনাথের আঁকা আরও যত নারীর মুখ দেখেছি, সবগুলির চোখ যেন একই রকম। সেই চোখ, কাদম্বরী দেবীর যে একটি ছবি পাওয়া যায়, তার চোখের যেন আশ্চর্য মিল। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয় রবীন্দ্রনাথের তেইশ বছর বয়সে। তার পঁয়তাল্লিশ বছর পরে ছবি আঁকতে বসে কবির সেই পরম প্রীতিময়ী নতুন বউঠানের চোখের কথাই মনে পড়েছে? রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদ্য-মুদ্রিত ‘লিখিনু যে লিপিখানি’ নামে বইটিতেও যেন এ রকমই ইঙ্গিত আছে।
এবং জাল বই
লেখকের বিনা অনুমতিতে, লেখককে সব রকম ভাবে বঞ্চিত করে জাল বই প্রকাশ করার প্রবণতা আছে আমাদের পাশের একটি রাষ্ট্রের। শুধু জাল বই নয়, তার চেয়েও মারাত্মক, এক লেখকের বই অন্য কোনও লেখকের নামে প্রকাশ করা। কিংবা কোনও অক্ষমের লেখা গ্রন্থে এক জন খ্যাতিমান সাহিত্যিকের নাম বসিয়ে দেওয়া। সমরেশ মজুমদার এই দুষ্কর্মের শিকার হয়েছেন। এই ব্যাধি এ বার পশ্চিমবাংলাতেও অনুপ্রবেশ করেছে। এ বারের বইমেলাতে একাধিক জাল বই আমরা অনেকেই চাক্ষুষ করেছি।
এই কুকার্যের একটি নবতম উদাহরণ এ বার টি ভি-র পর্দায়। ‘কেয়াপাতার নৌকো’ এবং ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, দুটিই বাংলা ভাষার বিখ্যাত উপন্যাস। দুটিরই মূল বিষয় দেশভাগজনিত পরিস্থিতি। যথাক্রমে প্রফুল্ল রায় ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, একটি উপন্যাসের কাহিনির মধ্যে অন্য উপন্যাসটির অনেক চরিত্র ও ঘটনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যথেচ্ছ ভাবে। উদাহরণগুলি এতই প্রকট যে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এ রকম ঘটনা প্রফুল্ল রায়ের কাছে যেমন লজ্জার, তেমনই অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মর্মাহত হওয়ার নিশ্চিত কারণ আছে। যাঁরা এই সব করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে শুধু বলতে পারি, ছি ছি ছি।
০৯. ৩. ২০১১
‘আমার হ্যাপি হোলি বলতেই ভাল লাগে’
হরিদাস কর, সে আবার কে হরিদাস পাল?
একটা বেশ বড় গানবাজনার দোকানে একটি যুবক ঢুকে এসে এক বিক্রয় কর্মীর সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনাদের কাছে কি বাই এনি চান্স হরিদাস করের কোনও সিডি আছে?
কর্মটি ভুরু কুঁচকে বলল, হরিদাস কর? কোনও দিন নাম শুনিনি তো!
সে তার পাশের অন্য এক সহকর্মীর দিকে তাকাতেই দ্বিতীয়জন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, নেভার হার্ড দ্যাট, নেই৷ কী করেন তিনি, সেতার-সরোদ বাজান, আবৃত্তি করেন নাকি?
যুবকটি বলল, তিনি একজন গায়ক ছিলেন। অনেক দিন আগেকার।
কর্মীটি বলল, নাঃ! ও রকম কোনও গায়কের নাম আমিও শুনিনি, আমার বাবাও শোনেননি।
যুবকটি কিছুটা হতাশ হয়ে ফিরে যেতে শুরু করল।
তখন এক বিক্রয়কর্মী তার সহকর্মীর দিকে ভুরু নাচিয়ে বলল, হরিদাস কর, সে আবার কোন হরিদাস পাল?
আমি পাশে দাঁড়িয়ে অন্য কিছু কেনা-কাটায় ব্যস্ত ছিলাম, এই মন্তব্যটি শুনে বেশ মজা লাগল। আমাদের ছাত্র বয়েসে বিদ্রুপাত্মক ‘কে হে তুমি হরিদাস পাল?’ এই কথাটা খুব চালু ছিল। এই উৎপ্রেক্ষাটির উৎস কী, তা আমি জানি না। হরিদাস পাল নামে কি কোনও জ্যান্ত লোক ছিলেন? ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ কিংবা ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’— এই ধরনের উপ-প্রবাদ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু হরিদাস পাল তা থেকে বঞ্চিত। আমার ধারণা ছিল, এখন আর হরিদাস পালের ব্যাপারটা চালু নেই, কিন্তু এই তো শুনতে পেলাম অনেক দিন পর।
এক দিকের কাউন্টারে বসে থাকেন এক বৃদ্ধ। তিনি এই দোকানটির মালিক কিংবা অতি প্রবীণ ম্যানেজার। তিনি বোধহয় ওই কথোপকথনের কিঞ্চিৎ শুনতে পেয়েছিলেন। প্রস্থানোদ্যত যুবকটিকে ডেকে বললেন, এই যে ভাই শোনো তো!
বাইরে অকালের বৃষ্টি পড়ছে বেশ ঝমঝমিয়ে, দোকানটি তাই এখন খুবই খদ্দের বিরল, আমার পক্ষেও এখন বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।
বৃদ্ধটি সেই তরুণকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার রেকর্ডের কথা জিজ্ঞেস করছিলে?
সে বলল, আজ্ঞে, হরিদাস কর। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এখন অনেকেই তাঁর নাম জানবে না। তিনি একজন গায়ক ছিলেন।
বৃদ্ধ প্রায় ধমকের সুরে বললেন, গায়ক ছিলেন মানে? অতি অপূর্ব গায়ক, মধুক্ষরা কণ্ঠস্বর যাকে বলে। গত পঁচিশ-তিরিশ বছরের মধ্যে কেউ তার রেকর্ডের কোনও খোঁজখবর করেনি। এক সময় জনপ্রিয় ছিলেন, বোধহয় একখানাই সেভেন্টি এইট কিংবা ফর্টি ফাইভ আর পি এমের রেকর্ড ছিল। তখন গ্রামাফোনের যুগ। রেডিয়োতে তাঁর গান প্রায়ই বাজত। তোমারও তো অল্প বয়েস। তুমি তাঁর নাম জানলে কী করে?
যুবকটি বলল, হরিদাস কর মশাই আমার ঠাকুরদার বন্ধু ছিলেন। আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন। আমার অবশ্য সে কথা মনে নেই। দাদু মাঝে মাঝে তাঁর গান গুনগুন করেন। দাদুর বয়েস এখন ঊননব্বই। ক’দিন ধরেই আমাকে বলছেন, হরিদাসের গান শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। যা না, ওর একখানা রেকর্ড কিনে নিয়ে আয়। আমি জানতাম, পাওয়া শক্ত হবে, তবু ওঁর শেষ বয়সের শখ।
বৃদ্ধ বললেন, পাবে না। ও-সব রেকর্ড আর ছাপা হয় না। হরিদাস কর ইজ ফরগটন ফর এভার। উনি কী গান গাইতেন জানো? পদাবলি কীর্তন। তুমি হাতে যে মোবাইল ফোনটা ধরে আছে, তাতে কয়েক মিনিট রেকর্ড করা যায়? আমি ওঁর গান কয়েক লাইন গেয়ে দিচ্ছি, তুমি তোমার দাদুকে শুনিয়ো।
যে-গানের রেকর্ড পাওয়া যায় না, সেই গান দোকানের মালিক নিজে গেয়ে শুনিয়ে দিচ্ছেন, এমন দৃষ্টান্ত ভূ-ভারতে আর কোথাও আছে কি না জানি না। আমি অন্তত তেমন কিছু জানি না।
তিনি গাইলেন—
ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না/ছুঁয়ো না হে কানাই ছুঁয়ো না/ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না নিলাজ কানাই/ আমরা পরের নারী/তুমি কথায় কথায় ছুঁয়ো না হে…
বৃদ্ধের গলা বেশ তৈরি। টপ্পার কাজও ভাল খোলে। দোকানদার না হয়ে তিনি নিজে গায়ক হলেন না কেন, কে জানে। আমার কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
গানটা হঠাৎ থামিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনেছ?
ছেলেটি বলল, অবশ্যই শুনেছি। আমাদের বাড়িতে গান-বাজনার চর্চা আছে।
বৃদ্ধ বললেন, নাম শুনেছ। তাঁর কোনও গান জানো? অমন পদাবলি কীর্তন, আহা একেবারে দেবদত্ত কণ্ঠস্বর। যেমন সুরেলা, তেমন তেজালো, তেমনই মধুর। বয়েসকালে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের গলা তোমাদের ওই সুচিত্রা মিত্তির আর কণিকা বাড়ুজ্যের চেয়েও মানে, আমি শুনে একেবারে মোহিত হয়ে যেতাম। এমন এক জন গায়িকা, অথচ কত জন আর তাঁকে মনে রেখেছে? কীর্তনের যুগই আর নেই, বুঝলে।
বাঙালির একেবারে নিজস্ব গান বলতে যদি কিছু বোঝায়, তা হচ্ছে এই কীর্তন। অন্য কোনও ভাষায় এমন কীর্তন আর নেই। কীর্তন আর ভজন কিন্তু এক নয়! কোথায় গেলেন রথীন ঘোষ! আর ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়কেই যদি লোকে ভুলে যায়, তা হলে রাধারাণী দেবী, আরও অনেকে… আর ভাবো তো কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কথা, কত বড় গায়ক, শিশির ভাদুড়ীর ‘সীতা’ প্লে-তে গান গেয়ে ফাটিয়েছেন, চোখে ভাল দেখতেন না বলে লোকে আড়ালে নাম দিয়েছিল কানা কেষ্ট। কত গান গেয়েছেন! তার মধ্যে কীর্তনও। ওঁর একটা ভাইপো ওই মান্না দে, খুব নাম করেছে। বেশ ভাল কথা। কিন্তু লোকে কৃষ্ণচন্দ্র দে’কে ভুলে যাবে? ভাবতেই আমার গা রাগে কষ-কষ করে। বাঙালির কত বড় সম্পদ এই কীর্তন, তা বাঙালিরাই অবহেলায় হারাতে বসেছে। সাধে কি বলে, বাঙালি ওই কী যেন, কী যেন, এক আত্মবিস্মৃত জাতি, তাই না?
বৃষ্টি থেমে গেছে, তাই এই আলোচনা যতই চিত্তাকর্ষক হোক, এ বার আমরা কর্তব্যের আহ্বানে চঞ্চল হয়ে উঠি।
বাইরে বেরিয়ে আমি একটুক্ষণ কীর্তনের কথা ভাবলাম। এখনও কেউ কেউ কীর্তন গায় বটে, কিন্তু এই গান সম্পর্কে এ কালের শ্রোতাদের আগ্রহ স্তিমিত হয়ে গেছে, তাও ঠিক। যদি সে গানের ধারা শুকিয়ে যায়, তা কি আর জোর করে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? রবীন্দ্রনাথই তো লিখেছেন, ‘যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর।’ এ কালে বাঙালির নিজস্ব গান বলতে কী বোঝায়? অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রগীতি এমনকী আলাদা ধরনের নজরুলগীতি সত্ত্বেও এবং হালফিলের ব্যান্ডের গান, ফিল্মের গান যতই সাময়িক বুদবুদ তুলুক, বাঙালির সর্বসময়ের, সব ঋতুর, সব উৎসবের আর সবরকম মানসিক অবস্থার, সমস্ত আনন্দ ও দুঃখের প্রতিফলন আছে রবীন্দ্রসংগীতেই। এ এক অবধারিত সত্য। এবং রবীন্দ্রসংগীত নিশ্চিত ভাবে বাঙালিরই নিজস্ব গান। কারণ, যে ব্যক্তি বাংলা ভাষা ভাল জানে না, তার পক্ষে এই গানের সম্পূর্ণ রস গ্রহণও সম্ভব নয়।
সুনামি শব্দটি এসেছে জাপান থেকেই। সেই সুনামিরই বিপুল আঘাতে জাপান এ বার মর্মান্তিক ভাবে বিপর্যস্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এত উন্নত হয়েও প্রকৃতির রোষের কাছে পরাজিত হতে হল জাপানকে।
সেই দেশের মানুষের দু’টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দু’টি অ্যাটম বোমার আঘাত খেয়ে এবং অত্যন্ত আপমানজনক শর্তে আত্মসমর্পণ করার পর জাপানের অধিকাংশ অঞ্চলই বিধ্বস্ত। এ দেশ কি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই অনেকের মনে এসেছিল।
মৃতের স্তূপের পাশে, অবশিষ্ট জনগণের উদ্দেশে দেশের সম্রাট বেতার ভাষণে আবেদন জানিয়ে বললেন, দেশটাকে তো আবার গড়ে তুলতে হবে, তাই আপনাদের সকলের কাছে সাহায্য চাই। আপনারা যার যা জীবিকা, সে কাজে তো লেগে পড়বেন বটেই, তার বাইরেও প্রতিদিন দু’ঘণ্টা কল-কারখানা ও রাস্তাঘাট গড়ায় সাহায্য করার জন্য বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দান করুন। এই আমার অনুরোধ।
এ কালেও জাপানিরা সম্রাটকে দেবতার মতন ভক্তি করে। পর দিন থেকেই সব মানুষ যে-যার অফিস কাছারি, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সেরে আরও দু’ঘণ্টা শ্রম দান করতে লাগলেন। এর পর কেটে গেল দু’বছর। সম্রাট আবার এক বেতার ভাষণে দেশবাসীকে জানালেন, আপনাদের সাহায্যে সব কিছুই আবার অনেকটা গড়ে তোলা গেছে। কাল থেকে আর বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দান করতে হবে না। সকলকে ধন্যবাদ।
তা শুনে হাজার হাজার মানুষ পথে নেমে এসে জানাতে লাগল, না, না, আমরা এখনও দু’ঘণ্টা শ্রমদান চালিয়ে যেতে চাই। ওটা আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে।
আর একবার, জাপানে বৌদ্ধ, সিস্টো, ক্রিশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পৃথক ভাবে কোন সংখ্যা কত, তার একটা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। তার ফলাফল হিসেব করতে গিয়ে দেখা গেল, এই সব ধর্মবিশ্বাসীদের যা যোগফল, তা জাপানের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি! এটা কী করে সম্ভব? আসলে, অনেক মানুষই জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছেন, আমি বৌদ্ধও বটে, সিস্টোও বটে, কিংবা আমি ক্রিশ্চান এবং বৌদ্ধ দুই-ই। অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে তাঁদের খুঁতখুঁতুনি কিংবা বিভেদ নেই।
হায়, আমরাও যদি লালন ফকিরের মতন বলতে পারতাম, আমরা হিন্দু এবং মুসলমান দুই-ই, কিংবা কোনওটাই নয়!
নতুন ভাষা
দুর্গাপুজোর ভাসানের সময় আমরা হইহই পার্টির মুখে কত বার শুনেছি, দুর্গা মাঈকি জয়! অর্থাৎ এই উল্লাসধ্বনিটি বাংলার বদলে হিন্দিতে বললেই যেন বেশি জোরালো হয়। সেই রকমই কালী মাঈকি জয়। অত্যুৎসাহীরা বলেও ফেলেছে, কার্তিক মাঈকি জয়!
বসন্ত-উৎসবকে বাঙালিরা বলে দোল, হিন্দিতে বলে হোলি। তবু দোলের দিন সকালবেলা রাস্তায় বাঙালি ছেলেরাও চেঁচাত, হোলি হ্যায়, হোলি হ্যায়! এ বারে দোলের দিনে শুনতে পেলাম, বাঙালি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পারস্পরিক সম্ভাষণ, হ্যাপি হোলি! বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বাংলা চ্যানেলগুলিতে হ্যাপি হোলির ছড়াছড়ি। শান্তিনিকেতনে এক প্রবীণ ব্যক্তির পায়ে আবির দিয়ে একটি দশ বারো বছরের ছেলে বলল, হ্যাপি হোলি। প্রবীণ ব্যক্তিটি বললেন, খোকা, হ্যাপি হোলির বদলে, শুভ দোল কি শুনতে ভাল নয়? ছেলেটি নির্বিকার ভাবে বলল, দুটো তো একই। আমার হ্যাপি হোলি বলতেই ভাল লাগে। ছেলেটির পাশে দাঁড়ানো তার বাবা-মায়ের গর্বে উদ্ভাসিত মুখও নজরে পড়ার মতন।
ভাই রাশিয়া, আমেরিকার বৈজ্ঞানিক ভাইরা আমার…
নিতান্ত বিরক্ত হলে আণবিক মারামারি না হয়ে বরং
জেট প্লেনে তিন টন কাব্য ফেলা হোক পরস্পরের মাটিতে,
তার পর দেখা যাবে কে কাকে হারায়?
(সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত রচিত ‘রাত আড়াইটা থেকে নিজের সঙ্গে কথাবার্তা’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত।)
২৩. ৩. ২০১১
হায় চিঠি, তোমার দিন গিয়াছে!
একখানা চিঠির খাম খুলতে গিয়ে আমার একটা আঙুল ছড়ে গেল। বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরিয়ে আসছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘হায় লাঠি, তোমার দিন গিয়াছে’র সঙ্গে গলা মিলিয়ে এখন অনায়াসে বলা যেতে পারে, হায় চিঠি, তোমার দিন গিয়াছে। আদালতের হুকুমনামা, ইনকাম ট্যাক্সের ঠান্ডা নির্দেশ কিংবা ক্লাব কমিটির নোটিস ইত্যাদি এখনও চিঠির আকারে ডাকবাক্সে আসে বটে, কিন্তু সে সবই ইংরেজিতে, যন্ত্র মুদ্রিত। কিন্তু হাতে-লেখা ব্যক্তিগত চিঠি উধাও হতে হতে এখন প্রায় ইতিহাসের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। তা হলে চিঠিরও তো একটা ইতিহাস লেখা দরকার।
আগেকার দিনে তো আর সাধারণ লোকে চিঠিফিটি লিখত না, চিঠি লিখতেন শুধু রাজা-বাদশাহরা তাঁদের প্রতিপক্ষদের, দূত সেই চিঠি বহন করে নিয়ে যেত। পোস্ট অফিস স্থাপনের আগে চিঠি যাতায়াতে অন্য কোনও উপায় ছিল না। আমরা ক্লাস সিক্সের ইতিহাস বইতে পড়েছি, সম্রাট হুমায়ূনকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন যে শের শাহ, তিনি অনেক রাস্তা বানিয়েছিলেন এবং তিনিই প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। (এ বিষয়ে তারাপদ রায়ের রসিকতা, শের শাহের আগে কি ঘোড়ারা ডাকত না?) যত দূর জানি, ইংরেজরাই বড় বড় শহরে, এমনকী অনেক গ্রামেও পোস্ট অফিস বসায়। গ্রামের একটা ছোট্ট পোস্ট অফিস নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা চমৎকার গল্প আছে, ‘পোস্টমাস্টার’। সেই তরুণ পোস্টমাস্টারবাবুটিকে নাকি রবীন্দ্রনাথ স্বচক্ষে দেখেছিলেন। সেই গল্প যাঁরা পড়েননি, তাঁরাও দেখেছেন সত্যজিৎ রায়ের হিরের টুকরোর মতন ফিল্মটি। এক গ্রাম থেকে দূর দূর গ্রামে চিঠি যেত কী করে? গাড়ি-টাড়ি তো ছিলই না, গাড়ি চলার মতো রাস্তাও ছিল না, ঘোড়াও সহজলভ্য নয়, চিঠি ও সেই সঙ্গে মানি অর্ডার ইত্যাদি বস্তায় বেঁধে ঘাড়ে করে দৌড়ে দৌড়ে নিয়ে যেত যে মানুষটি, তাদের নাম ডাকহরকরা, ইংরেজিতে রানার। তেমন একজন রানারকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। আর সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই গান বাংলার শ্রেষ্ঠ গানগুলির অন্যতম। ইতিহাস লিখতে গেলে সমসাময়িক কবিতা, সাহিত্য গল্পের উল্লেখ করাই এ কাজের রীতি। চিঠি এলেও গ্রামে অনেককে অসুবিধেয় পড়তে হত। আজ থেকে একশো বছর আগেও অধিকাংশ গ্রামেই তো সবাই নিরক্ষর। সুতরাং খুঁজে পেতে অন্য গ্রামের কোনও স্কুলের শিক্ষক কিংবা স্বয়ং পোস্টমাস্টারকে দিয়ে সে চিঠি পড়িয়ে নিতে হত। প্রবাসী স্বামী তাঁর স্ত্রীকে চিঠি লিখলেও তাতে গোপনীয়তা রক্ষার কোনও প্রশ্নই ছিল না। নিখিল সরকার (শ্রীপান্থ) একটা গ্রামের কথা লিখেছিলেন, যে গ্রামে মাত্র একজনেরই একটা চশমা ছিল। অন্য যে বয়স্ক লোকরা মোটামুটি পড়তে জানতেন তাঁরা কোনও চিঠি পেলে উক্ত ব্যক্তির কাছেই ছুটে আসতেন চশমা ধার করার জন্য।
যাই হোক, চিঠির ইতিহাস রচনা করা আমার সাধ্যাতীত। সে কাজ অন্য কেউ করবেন। আমার মনে আসছে কিছু আশকথা পাশকথা। কবি ব্যোদলেয়ার তাঁর মাকে এক দিনে ছ’লাখ চিঠি লিখেছিলেন। আমাদের লর্ড কার্জন নাকি তাঁর স্ত্রীকে একদিনে একটি একশো পাতার চিঠি লিখেছিলেন। আমেরিকার এক কবি পল এঙ্গেল বছরে চার হাজার চিঠি লিখতেন। তাঁর বিপরীত স্বভাবের কবি অ্যালেন গিনসবার্গও চিঠি লেখায় কম যেতেন না। চিঠি লেখায় গদ্য লেখকদের চেয়ে কবিদের প্রাধান্যর কথা জানা যায়।
অন্য অনেক কিছুর মতন আমাদের বাংলায় চিঠি লেখার সম্রাট অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। কত হাজার চিঠি যে তিনি লিখেছেন! এখনও নিশ্চয়ই আরও অনেক চিঠি অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। সে সবই তো পত্র-সাহিত্য। খুব সম্ভবত তিনি এক সময়ে সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর তরুণী ভাইঝি, উচ্চশিক্ষিতা ইন্দিরাকে। বাংলা সাহিত্যে সে সব চিঠির স্থান চিরকালীন। কোনও রহস্যময় কারণে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় সেই সব পত্রগুচ্ছের অনেক অংশই কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই জন্যই বইটির নাম ছিন্নপত্র। রবীন্দ্রনাথের রচনায় কাঁচি চালানোর সাহস হয়েছিল কার? সেই জন্যই সমালোচক অজিত চক্রবর্তী মন্তব্য করেছিলেন, ছিন্নপত্র গ্রন্থটির সর্বাঙ্গ হইতে রক্ত ঝরিতেছে!
সব পত্রের সার প্রেমপত্র। এখনকার ছেলেমেয়েরা কল্পনাও করতে পারবে না, মাত্র পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও প্রেমিকার কাছে কোনও প্রেমিকের চিঠি পাঠানো কত শক্ত ছিল। ডাকে পাঠানো ছিল বেশ বিপজ্জনক। অধিকাংশ বাড়িতেই মেয়েদের নামে কোনও চিঠি এলে দাদা এবং কাকাস্থানীয় তার আগেই সেটা খুলে ফেলতেন, কোনও অনাত্মীয় পুরুষের লেখা এবং তাতে বিন্দুমাত্র আবেগের বাষ্প থাকলেই সারা বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে যেত। অনেক সময় মেয়েটিকেও বেশ লাঞ্ছনাও সহ্য করতে হত। একটি মেয়ে ডাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল তার প্রেমিক অর্থাৎ এখনকার ভাষায় বয়ফ্রেন্ডকে। সে চিঠি ছেলেটির হাতে পৌঁছল না। কিন্তু তার পর থেকে সে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেলে সাড়া পায় না। রাস্তায় দৈবাৎ তার মুখোমুখি (দৈবাৎ কিংবা ওঁৎ পেতে পথের মোড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর) হলে মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ছেলেটির হতবুদ্ধি অবস্থা। আসলে হয়েছে কী, মেয়েটির চিঠি ছেলেটির বাবা-মা খুলে পড়েছে। তার পর ছেলেকে ঘুণাক্ষরেও কিছু না জানিয়ে বাবা নিজেই একটা চিঠি লিখেছেন এই মর্মে, ‘মা, তোমার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, তুমি আমার ছেলেকে ছাড়িয়া দাও। এই বয়সে এমন মেলামেশা করিলে পড়াশোনায় মতি থাকে না। ইদানীং দেখিতেছি, আমাদের পুত্রও ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠিক মতো খাওয়াদাওয়াতেও মন নাই। তোমার প্রতি আমি আমাদের পুত্রকে ভিক্ষা চাহিতেছি,’ ইত্যাদি।
তা বলে কি প্রেমিক প্রেমিকার চিটি লেখালেখি থেমে থাকত? তারা নানা কৌশল বার করত, তার মধ্যে একটি হচ্ছে, কোথাও দেখা হলে, কোনও কথাবার্তা না বলে চট করে হাতে হাতে চিঠি বদলাবদলি করত। ছেলেটি চিঠিপত্র তক্ষুনি লুকিয়ে ফেলত পকেটে। আর মেয়েটি? তাদের পোশাকে তো পকেট থাকে না, আর কল্পনা করতে এখনও রোমাঞ্চ হয়, সে চিঠিটি কয়েক ভাঁজ করে রেখে দিত তার ব্লাউজের মধ্যে। দুই কোমল বুকের মাঝখানে। স্তন শব্দটির একটি অর্থ, যা শব্দ করে যৌবনের আগমনবার্তা জানায় সেই স্থানটি এক সদ্যযুবার দুরুদুরু বক্ষে লেখা চিঠিরই তো যোগ্যতম স্থান।
এক প্রবীণ লেখক একদিন গোপন কথার ছলে আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর প্রথম যৌবনে তিনি এক সদ্য পঞ্চদশী থেকে পূর্ণিমায় পৌছনো মেয়েকে ওই রকম চকিত কৌশলে রাশি রাশি চিঠি লিখেছেন। প্রায় পাঁচশো তো হবেই। উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবেগের আতিশয্যে চিঠির পর চিঠি লিখে যাওয়া। এই পরিণত বয়সে পৌঁছে তাঁর মনে হয়, সেগুলি কি সত্যি সত্যি প্রেমপত্র ছিল? নাকি সেই বয়সে গদ্য লেখায় হাত পাকাবার প্রয়াস?
শুনে আমি কোনও মন্তব্য করিনি। আমার মনে হয়েছিল, লেখকদের জীবনের প্রস্তুতিপর্বের সব কথা বোধহয় অন্যদের না জানানোই ভাল। সম্ভবত, ওই লেখকের সেই সময়কার জীবনে নারীর প্রতি ও গদ্য রচনার প্রতি মোহ একসঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল।
প্রেমপত্র সম্পর্কে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। এখন তো তার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে মাঝে মাঝে আমি নানা ধরনের চিঠি পাই। তার কিছু তো এখনকার ভাষায় এস এম এস। অধিকাংশই কাজের কথা, ইংরেজিতে। আর কিছু রোমান অক্ষরে বাংলা ভাষায়। হ্যাঁ, বাংলা ভাষাই বটে, কিন্তু দু’বার তিন বার না পড়লে মানে বোঝা যায় না।
আর ডাকেও কিছু চিঠি আসে এখনও। তা সবই কার্ড কিংবা ছাপানো বিজ্ঞপ্তি কিংবা সভা-সমিতির খবর। কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে এখন আঠা কিংবা গঁদের ব্যবহার উঠেই গেছে। সে সব চিঠিই স্টেপল করা থাকে। এমনকী সরকারি চিঠি পর্যন্ত। তা খুলতে গেলে আঙুল তো ছড়ে যেতেই পারে। যেমন, আজ সকালেই আমার আঙুলে রক্তের ফোঁটা। এখন আমাকে ডেটল বা কিছু অ্যান্টিসেপটিক লোশন খুঁজতে হবে। এই হল এ যুগে পত্রপ্রাপ্তির পুরস্কার।
লেখক ও চিকিৎসক
এক মধ্যবয়সী লেখকের হৃদপিণ্ডে কিছুটা খোঁচা লেগেছে, গেলেন এক নামকরা ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারটি সব পরীক্ষা-টরিক্ষা করে দেখার পর গম্ভীর মুখে বললেন, হয়েছে কিছু, তবে এখনও ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সাবধানে চললে… ওষুধপত্র লিখে দিচ্ছি, খাদ্য-অখাদ্যের একটা চার্ট, আর মৃদু ব্যায়াম…। তার পর তিনি রোগীর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, দেখুন, আপনাদের মতন লেখক লেখিকাদের তো আমি চিনি। দু’পেগ, বুঝলেন, এখন থেকে দু’পেগের বেশি ড্রিঙ্ক করা চলবে না, মনে থাকে যেন—
লেখকটি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, দেখুন, জীবনে আমি এক ফোঁটাও ড্রিঙ্ক করিনি। তবে কি এখন থেকে রোজ দু’পেগ ড্রিঙ্ক করার অভ্যাস করতে হবে?
প্রতিটি ঝগড়ার পর
প্রতিটি ঝগড়ার পর বাথরুম তোকে মনে পড়ে
প্রতিটি সঙ্গম শেষে বাথরুম তোকে মনে পড়ে
লাল সাদা বাথরুমে ঝরে পড়ে জলের শুশ্রুষা
ওগো জল, শান্তি আনো রোদে পোড়া শরীরে আমার…
প্রতিটি নির্জন শোকে বাথরুম তোকে মনে পড়ে
প্রতিটি নিস্ফলা ক্রোধে বাথরুম তোকে মনে পড়ে
এইখানে ঋতুস্রাব, এইখানে ঋতুরঙ্গ নাচ
অঙ্গে অঙ্গে কী হিল্লোল, গ্রীষ্ম বর্ষা শীত ও শরৎ…
প্রতিটি গোপন পাপে বাথরুম তোকে মনে পড়ে
প্রতিদিন অপমানে বাথরুম তোকে মনে পড়ে…
(‘বাথরুম’, আংশিক, মল্লিকা সেনগুপ্ত)
৬. ৪. ২০১১
আমাদের মা-বাবার প্রতি একটি ‘প্রণাম’
ছেলেটির ডাক নাম ডন। তার দুরন্তপনা ছিল আমাদের পাড়ায় অতি বিখ্যাত। চারতলা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে সে সচরাচর নামত না। পাশের রেলিংয়ে চড়ে ঘোড়সওয়ারের মতোই সড়াৎ করে নেমে যেত এক এক তলা। একবার সে ঘুড়ি ধরার জন্য ছাদের প্যাপেটে নেমে হাঁটছিল, রাস্তায় লোক থেমে গিয়ে আতঙ্কিত হয়ে দেখছিল তাকে। সে বারে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি বটে, কিন্তু বেশ কয়েক বার এখানে সেখানে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছিল। ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে সেলাই করতে হয়েছে। এক বার সাতটা সেলাই। হাতে ধরে কালিপটকা ফাটাতে গিয়ে হাত ঝলসে গেল। আর একটি অসাধারণ কাণ্ড সে করেছিল, এক বার এক জন বেদে সাপখেলা দেখাতে এসেছিল আমাদের বাড়ির সামনে একটা রাস্তায়। হঠাৎ ডন তার ঝাঁপি থেকে একটা সাপ তুলে নিয়ে দে দৌড়। দর্শকরা ভয়ে ছিটকে সরে গিয়েছিল। সাপুড়েটি হা হা করে বলে উঠেছিল, ওই সাপটির নাকি বিষদাঁত ভাঙা হয়নি।
অনেক ছেলেই বাচ্চা বয়সে দুষ্ট থাকে। ডন ছিল দুষ্টুদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন। নিত্যনতুন গল্প শোনা যেত তার দুরন্তপনার। ইস্কুলেও সে প্রায়ই ডুব মারত। বাবা-মায়ের বেশি বয়সের একমাত্র সন্তান। তাই বোধহয় বেশি আদর ও প্রশ্রয়ে তার মাথা খাওয়া হচ্ছিল।
এই ধরনের ছেলে প্রাপ্তবয়সে কী হতে পারে? ঠিক মতন লেখাপড়া না শিখে মাস্তান কিংবা গুন্ডাজাতীয় কিছু হওয়াই স্বাভাবিক। অথবা সে একজন অসাধারণ মানুষও হয়ে উঠতে পারে। ডনের যখন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স, তখন তার বাবা রমেনবাবু চাকরিতে বদলি হয়ে সপরিবার দিল্লি চলে যান। তখনই আমরা ভেবেছিলাম, এ ছেলে দিল্লির পাড়া প্রতিবেশীদের জ্বালিয়ে খাবে।
তার পর আর ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রইল না। কিন্তু ডন সম্পর্কে আমার কৌতূহল রয়েই গেল। অমন একটা চরিত্রের ছেলেকে, বিশেষত তার ওই সাপ চুরি করার ঘটনার জন্য, ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
সাত-আট বছর পর রমেনবাবুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা এক মেট্রো স্টেশনে। আমি প্রথমে তাঁকে চিনতে পারিনি। তিনিই আমাকে ডাকলেন। ট্রেনে উঠে পাশাপাশি বসে যাওয়ার সময় অনেক গল্প হল। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর তিনি কলকাতায় ফিরে এসেছেন। ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন যোধপুর পার্কে। কথায় কথায় তাঁর ছেলের প্রসঙ্গ এসে গেল। চাপা গর্বের সঙ্গে তিনি জানালেন যে, দিল্লিতে গিয়ে ডনের চরিত্রে একটা দারুণ পরিবর্তন এসেছিল। পড়াশোনায় সে দারুণ মনোযোগী হয়ে উঠে আই সি এস ই-তে ভাল রেজাল্ট করে এবং সহজেই দিল্লির আই আই টি-তে চান্স পেয়ে যায়। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সে সেকেন্ড হয়েছে। এখন সে কোথায়? উত্তর তো অবধারিত, অবশ্যই আমেরিকায়। টেক্সাসের অস্টিন শহরে সে এর মধ্যে কম্পিউটার সায়েন্স করে ভাল চাকরি করছে। সে একটা হিরের টুকরো ছেলে। প্রত্যেক উইক-এন্ডে টেলিফোনে বাবা- মায়ের খবরাখবর নেয়। এর মধ্যে তার মায়ের এক বার হাঁটুর অপারেশন হয়েছে। তার সব খরচ ছেলে পাঠিয়েছে। ডন নামে সেই সাঙ্ঘাতিক দুষ্টু ছেলেটির এ হেন রূপান্তর খানিকটা চমকপ্রদ তো বটেই। তবে অসাধারণ কিছু নয়।
এরও বছর তিনেক পর এক দিন রমেনবাবু এলেন আমাদের বাড়িতে। তাঁর ছেলের বিয়ে। তাই পুরনো পাড়ার কিছু মানুষকে নেমন্তন্ন করতে চান। সন্তানের সাফল্য-কাহিনি অন্যদের জানাতে পারাটাই তো আসল সুখ। আমি সাধারণত বিয়ের নেমন্তন্ন এড়িয়ে যাই। রমেনবাবু পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। প্রাপ্তবয়স্ক ডনকেও এক বার চোখের দেখার ইচ্ছেও আমার ছিল।
খুব ছোটবেলায় যারা শান্তশিষ্ট থাকে, বড় হয়ে তারা খ্যাপা ষাঁড়ের মতন হয়ে যেতে পারে। আর বাচ্চাবয়সে যারা খুব দস্যিপনা করে, পরিণত বয়সে তারা হয় সভ্য ভদ্র। আমাদের ডন সেই থিয়োরির এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। কোথায় সেই দুঃসাহসী, কারও কথা-না-মানা কিশোর, সে এখন সুঠাম যুবক, অত্যন্ত বিনীত ও নম্র। অনেক দিন কলকাতা-ছাড়া বলে তার মুখের ভাষা বেশি পরিমাণে ইংরেজি মিশ্রিত। তার মনোনীত পাত্রীটি এক গুজরাতি কন্যা। সে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে এল। ডন তার বাবা-মায়ের মুখ এক উজ্জ্বল আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে।
রমেনবাবুর সঙ্গে আমার মাঝে মধ্যে আরও দেখা হয়েছে। খবর শুনেছি, ডন ইতিমধ্যে দুটি সন্তানের জনক। দু’বছর অন্তর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। তবে আগের বারে সে কলকাতায় চার দিনের বেশি কাটাতে পারেনি। কারণ, আমদাবাদে তার শ্বশুরবাড়িতে শ্যালিকার বিয়ের উৎসব ছিল।
কয়েক দিন আগে খবরের কাগজে দেখলাম রমেনবাবুর নাম। তিনি মাঝারি ধরনের সরকারি অফিসার ছিলেন। এই ধরনের মানুষের সংবাদপত্রে নাম ওঠার যোগ্যতা থাকে না, যদি না খুন হন কিংবা অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়। রমেনবাবুর মৃতদেহ তার প্রতিবেশীরা দু’দিন বাদে দরজা ভেঙে দেখতে পান। মেঝেতে হামাগুড়ির ভঙ্গিতে। খুব সম্ভবত তিনি মৃত্যুযন্ত্রণায় খাট থেকে নেমে দরজা খুলতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ইনি আমার সেই চেনা রমেনবাবু ঠিকই, সর্বাধিকারী, পদবি মিলে গেছে, যোধপুর পার্কের ঠিকানা। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল এক বছর আট মাস আগে। তখন বিদেশ থেকে তাদের পুত্র এসে শ্রাদ্ধ-শান্তি করে গিয়েছিল। সেই থেকে তিনি একেবারে একা। তার পর এই কাহিনিতে নতুনত্ব কিছু নেই। ডনের মতন আরও হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যদি মেধাবী হয়, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ভাল রেজাল্ট করে, তা হলেই নানান বিদেশ তাদের হাতছানি দেয়। সেখানকার বাতাস তাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। এক দিন বিমানে চেপে তারা পশ্চিমের আকাশে একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়। বুকভরা কত রকম প্রত্যাশা নিয়ে দেশে থেকে যান তাদের বাবা-মা। প্রথম প্রথম ওই প্রবাসী সন্তানেরা দেশে ফিরে আসতে চায়। স্বদেশে উপযুক্ত সুযোগের অভাব কিংবা নানান কার্যকারণে সেই সব সংকল্প ক্রমশ পিছিয়ে যায়। ও দেশে তাদের ছেলেমেয়ে জন্মে গেলে সে সম্ভাবনা ক্রমশ সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ জোর করে ফিরেও আসে৷
এই সন্তানেরা অধিকাংশই কিন্তু অকৃতজ্ঞ বা বাবা-মায়ের সম্পর্কে উদাসীন নয়। তারা টেলিফোনে নিয়মিত খোঁজখবর নেয়। মাঝে মাঝে দেশে আসে, প্রয়োজনে টাকা পাঠায়। শুধু একটা জিনিস তারা দিতে পারে না, বৃদ্ধবয়সে যা খুবই প্রয়োজনীয়, নিকট জনের সঙ্গ। নিঃসঙ্গতা অনেক কঠিন রোগের চেয়েও মারাত্মক। শুদু দু’জন বুড়োবুড়ি থাকলেও তাদের মধ্যে নিত্য খটাখটি হয়। যদি এক জন আগে চলে যায়, তা হলে অন্য জন সেই খটাখটি করতে পারে না বলেই আরও কষ্ট পায়।
একটি পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সারা ভারতে প্রবীণ-প্রবীণা, যাঁদের বলা হয় সিনিয়র সিটিজেন, তাদের সংখ্যা ৮১ লক্ষ। এঁদের মধ্যে আবার শতকরা ৩০ জনই সম্পূর্ণ একা। সম্ভবত শহর ও শহরতলিতেই এই পরিসংখ্যান গ্রহণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে খোঁজ নিলে এঁদের সংখ্যা নিশ্চিত আরও বেশি হবে। কলকাতা শহরেও এঁদের সংখ্যা প্রচুর। তবে কলকাতা শহরে এমন একটা কিছু আছে, যা অন্য শহরে নেই। ‘দ্য বেঙ্গল’ নামে একটি সংস্থা কলকাতা পুলিশের সহযোগিতায় এই প্রবীণ-প্রবীণাদের জন্য গড়ে তুলেছে একটি সাহায্য কেন্দ্র। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রণাম। কলকাতা পুলিশের নামে কিছু কিছু অভিযোগ আছে ঠিকই, কিন্তু তারা কয়েকটি সেবামূলক সামাজিক কাজও করে। যেমন, তারা পথশিশুদের জন্য অন্তত চোদ্দোটি ইস্কুল নিয়মিত চালায়। এই প্রণাম-এর ব্যাপারেও কলকাতা পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতা বেশ আন্তরিক।
বালিগঞ্জ থানার প্রাঙ্গণে একটা জায়গা দেওয়া হয়েছে, সেখানে গড়ে উঠেছে প্রণাম-এর সহযোগিতা কেন্দ্র। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মী। অর্থাৎ দিন বা রাতের যে কোনও সময়ে কোনও প্রবীণ-প্রবীণা আর্ত বা বিপন্ন হয়ে পড়লে ওই কেন্দ্রে ফোন করলেই সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য পাবেন। কেন্দ্রের কর্মী টেলিফোনে বিপদের কারণটি জেনে নিয়ে স্থানীয় শাখায় খবর দেবেন। সেখান থেকে পুলিশ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে সেই বাড়িতে। গুরুতর অসুস্থতার ব্যাপার হলে পাঠানো হবে অ্যাম্বুল্যান্স। প্রণাম-এর নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স তো আছেই, অন্য বেশ কয়েকটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও ব্যবস্থা করা আছে।
কলকাতার ৪৮টি থানার মধ্যে ওই পরিষেবা পরিব্যাপ্ত। প্রত্যেক থানাতেই এক জন সহকারী সাব ইন্সপেক্টর ও দু’জন হোমগার্ডকে এই ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিরিশটি হাসপাতালের সঙ্গে প্রণামের ব্যবস্থাপনা আছে। এঁরা কোনও অসুস্থ মানুষকে পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে করা হবে চিকিৎসার ব্যবস্থা। চিকিৎসা ছাড়াও বাড়ি বা সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলাতেও পড়তে হয় কখনও কখনও। সম্পত্তির লোভে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের উৎপীড়ন করার তো লোকের অভাব হয় না। সে রকম সঙ্কটে বিশিষ্ট আইনজীবীরা বিনা খরচে ব্যবস্থা দিতে পারেন।
কিংবা কোনও সমস্যাই নেই তেমন, তবু গভীর রাতে হঠাৎ ভয় পেয়ে অথবা বিষণ্ণ হয়ে পড়তে পারেন, তখন কথা বলার একজন সঙ্গীর জন্য মন আঁকুপাঁকু করে। সে রকম সময়েও সহায়তা কেন্দ্রের মহিলা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন ফোনে।
প্রণাম-এর সমস্ত পরিষেবাই বিনামূল্যে। সরাসরি কাউকে অর্থ সাহায্য করা হয় না। যাঁরা সেবা পাচ্ছেন, তাঁদের কারও বাড়ি থেকে কোনও দানও গ্রহণ করা হয় না। প্রত্যেক থানা থেকে প্রবীণ-প্রবীণাদের সদস্য করার জন্য ফর্ম পূরণ করার ব্যবস্থা আছে। এই উদ্যোগ যখন শুরু হয়, তখন যে দু’জন ফর্ম পূরণ করে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন সুচিত্রা সেন, অন্যজন জ্যোতি বসু। এখন সদস্য সংখ্যা ৩৩১৩ জন। সদস্যরা হাসপাতালে বিশেষ ডিসকাউন্ড পেতে পারেন। কয়েকটি ওষুধের দোকানেও কম দামে ওষুধ। বেশ কিছু শিল্পী লেখক, গায়ক, অভিনয় জগতের মানুষ এবং পুলিশ কমিশনার ও কয়েকজন কর্তাব্যক্তি প্রণামের সঙ্গে জড়িত।
শুধু রোগভোগ আর সমস্যা নিয়েই তো জীবন নয়। এই প্রবীণ-প্রবীণার পারস্পরিক মেলামেশারও ব্যবস্থা আছে। যেমন, মাঝে মাঝেই হয় পিকনিক, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্রিকেটের ওয়ার্ল্ড কাপের সময় সাহায্য কেন্দ্রের পাশে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখারও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সকলকেই জন্মদিনে পাঠানো হয় শুভেচ্ছা কার্ড। বিজয়া দশমী বা পয়লা বৈশাখে পাঠানো হয় মিষ্টি। সেই মিষ্টি এই বয়স্ক-বয়স্করা খেয়ে নেন বটে, তারপরই মৃদু অভিযোগের সুরে বলেন, এই বয়সে মিষ্টি… নোনতা পাঠালেই ভাল হত!
প্রণাম-এর ফোন নং
(০৩৩-)২৪১৯০৭৪০
ই মেল আই ডি -mail@ pranam.in
দুই বুদ্ধ
লাফিং বুদ্ধ, এই মূর্তির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এর ঠিক বিপরীতে কী হতে পারে? গৌতম গম্ভীর!
২০. ৪, ২০১১
যুধিষ্ঠির ক’টা মিথ্যে বলেছিলেন?
অনেকেরই ধারণা যুধিষ্ঠির সারা জীবনে মাত্র আধখানা মিথ্যে কথা বলেছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবরা বিপক্ষে তাদের অস্ত্রগুরু দ্রোণের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলেন না। যুদ্ধ শুরুর আগে যুধিষ্ঠির অন্যান্য গুরুজনের কাছে এবং দ্রোণের কাছেও গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার সঙ্গে যুদ্ধে কী করে জয়ী হব? দ্রোণ বলেছিলেন, মানুষ অর্থের দাস। কৌরবরা আমাকে এত দিন অর্থ দিয়ে খাইয়ে-পরিয়ে রেখেছে তাই আমি তাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করছি। আমি যতক্ষণ রথারূঢ় হয়ে ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধ করি, তখন আমাকে বধ করতে পারে, এমন লোক তো দেখি না। তবে হঠাৎ যদি কোনও দুঃসংবাদ পেয়ে আমি অস্ত্র ত্যাগ করি, তা হলে…
যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে দ্রোণের প্রবল প্রতাপে প্রচুর সৈন্যক্ষয় হচ্ছে দেখে যুধিষ্ঠিররা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কৃষ্ণ তখন বললেন, ধনুর্বাণ হাতে থাকলে এ ব্রাহ্মণকে তো দেবতারাও জয় করতে পারবেন না। সুতরাং ধর্মের পথে যুদ্ধ না-করে অন্য পথ ভাবো। দ্রোণ পুত্রস্নেহে অন্ধ। (দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামার স্বভাবচরিত্র মোটেই ভাল ছিল না)। সেই পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনলে ওঁর আর যুদ্ধে মতি হবে না। সুতরাং কেউ ওঁর কাছে গিয়ে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে দিক। কৃষ্ণের এই অসৎ প্রস্তাব একমাত্র অর্জুন পছন্দ করেননি। যুধিষ্ঠির মোটামুটি নিমরাজি হয়ে গেলেন।
তখন ভীম বিরুদ্ধ পক্ষের এক রাজার অশ্বত্থামা নামে একটা হাতি ছিল, গদার আঘাতে সেটাকে মেরে ফেলে দ্রোণের কাছাকাছি গিয়ে লজ্জিত ভাবে বললেন, অশ্বত্থামা হত। তা শুনে দ্রোণ এক বার কেঁপে উঠেও ভাবলেন, ওই ভীমটাকে মোটেই বিশ্বাস করা যায় না। অশ্বত্থামাকে তিনি অনেক সাংঘাতিক অস্ত্র ব্যবহার শিখিয়েছেন, তাকে হারানো মোটেই সহজ নয়। তবু পিতৃহৃদয় সন্তানের অমঙ্গলের আশঙ্কায় অস্থির হবে তো বটেই। খবরটার সত্যতা যাচাই করার জন্য তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আসল খবরটা কী বলো তো। সবাই জানত, ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের লোভেও যুধিষ্ঠির কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু কৃষ্ণ এবং অন্যান্যদের প্ররোচনায় যুধিষ্ঠির যুদ্ধ জয়ের আশায় চেঁচিয়ে বললেন, ‘অশ্বত্থামা হতঃ’। তার পর খুব নিচু গলায় ‘ইতি কুঞ্জরঃ অর্থাৎ ওই নামের হাতি। কথাটা মিথ্যে নয়, কিন্তু ওই যে পরের অংশটা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ফিসফিসিয়ে বলা, যাতে দ্রোণ শুনতে না পান, তাতেই যুধিষ্ঠিরের জীবনে মিথ্যা বলার পাপ স্পর্শ হল। তার পর ধৃষ্টদ্যুম্ন কী নৃশংস ভাবে অস্ত্রহীন দ্রোণের গলা কেটে ফেললেন, সে প্রসঙ্গ আর টানার দরকার নেই।
কিন্তু যুধিষ্ঠির তো আরও অনেক মিথ্যে বলেছেন, তা আমরা খেয়াল করি না। কেন, দ্বাদশ বৎসর অরণ্যবাসের পর একবৎসর অজ্ঞাতবাসের সময় কী হয়েছিল? পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদী ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন মৎস্যদেশে। বিরাট রাজার অধীনে। সেখানে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, তিনি ব্রাহ্মণ। তাঁর নাম কঙ্ক। তিনি পাশাখেলায় খুব দক্ষ। সেই পরিচয়ে তিনি রাজার কাছে চাকরি চান। কঙ্ক সেজে এক বছর তো তাঁকে ঝুরি ঝুরি মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে। এর আগেও, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় যুধিষ্ঠির নিজেদের পরিচয় দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ হিসেবে। রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্র মিথ্যে কথা বলেননি? (তাঁকে অনেকেই বিষ্ণুর অবতার হিসেবে পুজো করে। বাল্মীকির মূল রচনায় অবশ্য সে পরিচয় নেই, সেখানে তিনি দোষগুণে ভরা এক মানবিক চরিত্রের রাজা।) শ্রীরামচন্দ্রের সবচেয়ে নিষ্ঠুর মিথ্যেটির উল্লেখ করা যেতে পারে এখানে।
যুদ্ধবিগ্রহ শেষ হয়ে গেছে। দেশে ফিরে এসে রামচন্দ্র ভরতের কাছ থেকে রাজ্যভার নিয়ে নিয়েছেন, এর পর সুখে প্রমোদেই থাকার কথা। সীতার গর্ভলক্ষণও দেখা গেছে। এরই মধ্যে রাম এক দিন তাঁর সভাসদদের কাছে শুনলেন যে, রাজ্যের কিছু প্রজা সীতার চরিত্র নিয়ে আবার গুজুর গুজুর ফুসুর ফাসুর শুরু করেছে। সব দেশেই এমন কিছু মানুষ তো থাকেই যারা নানা রকম কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে। রাম এ রকম তুচ্ছ ব্যাপার সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারতেন কিংবা সীতা যে এক বার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন, সে কথা ভাল ভাবে জানিয়ে দিতে পারতেন, তার বদলে রাম নিজেই ফুঁসে উঠলেন। (সম্ভবত রামের নিজেরই মনের মধ্যে ছিল সন্দেহের কীট।) এর ঠিক আগের দিনই সীতা আব্দার করে বলেছিলেন, অনেক দিন অরণ্য-প্রকৃতি দেখা হয়নি, এক দিন একটু বেড়াতে গেলে হয় না? সেই কথার সূত্রে রাম সীতাকে লক্ষ্মণের সঙ্গে অরণ্যে ও গঙ্গাতীরের ঋষিদের আশ্রম দেখতে পাঠালেন। সীতা তো ভ্রমণের আনন্দে বেশ উচ্ছল। প্রথম রাত্রি কাটল এক ঋষির আশ্রমে। দ্বিতীয় দিনে গঙ্গায় স্নান করার কথা। সেখানে পৌঁছে লক্ষ্মণ হঠাৎ হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকলেন। খুবই অবাক হয়ে সীতা সরল ভাবে প্রশ্ন করলেন, তুমি কাঁদছ কেন? ‘দাদাকে দু’দিন দেখিনি তাই কষ্ট হচ্ছে।’ আমারও মন তাঁর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এই তো এই রাতটা কাটলেই আমরা অযোধ্যা ফিরে যাব।
অতিকষ্টে কান্না থামিয়ে লক্ষ্মণ সীতার পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেবী, এ কথা জানাতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। রাম আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেননি। আপনাকে এই বনেই রেখে যেতে বলেছেন।
মানুষ প্রধানত মিথ্যে কথা বলে কেন? ১) নিজের ছোট কিংবা বড় রকম স্বার্থের কারণে, ২) অপরের ক্ষতি করার জন্য, ৩) নিছক কৌতুকে। এর মধ্যে তৃতীয়টাই অনেকটা নির্দোষ এবং উপভোগ্য। সাহিত্যিক-শিল্পীরাও অনেক সময় মিথ্যার আশ্রয় নেন, সেই মিথ্যার অন্য নাম কল্পনা। এই কল্পনার বিস্তার না থাকলে কোনও শিল্পই সার্থক হয় না।
বনবাসের সময় শূর্পণখা এসে রামচন্দ্রের সঙ্গে প্রেম করার বায়না ধরেছিল। রাম বলেছিলেন, দেখো, আমি বিবাহিত, আমার স্ত্রীও সঙ্গে রয়েছেন। আমি আর তোমার সঙ্গে কী করে প্রেম করি বলো? বরং ওই যে আমার ছোটভাই, সে এখনও অবিবাহিত, তুমি ওর সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করে দেখো। লক্ষ্মণের যে ঊর্মিলা নামে একটি সুন্দরী স্ত্রী দেশে রয়ে গেছে, তা আমরা সবাই জানি। রামের এই মিথ্যেটা কৌতুকের। তবে কৌতুকেরও একটা সীমারেখা টানা দরকার। সেই সীমা লঙ্ঘন করলে অনেক সময় প্রচুর অনভিপ্রেত, সাংঘাতিক ঘটনাও ঘটতে পারে। সে রকম উদাহরণও অজস্র। শ্রীকৃষ্ণের সাঙ্গোপাঙ্গরা এক বার এক ঋষির সঙ্গে কৌতুক করতে গিয়ে সেই ঋষির অভিশাপে যদুবংশের ধ্বংস ডেকে এনেছিল।
কথায় বলে, প্রেম ও রণে মিথ্যে কথা বলায় দোষ নেই। প্রেম তো নিভৃত ব্যাপার। সে সব মিথ্যে অন্যদের জানবার কথা নয়। যুদ্ধের সময় যে অজস্র মিথ্যের ফুলঝুরি ছড়ায় তা কে না জানে। আমাদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধ দেখার বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই। তবে ভোটযুদ্ধ দেখেছি অনেক বার। তাতে যে কত রকম উদ্ভট মিথ্যে শুনতে পাওয়া যায়। এই যুদ্ধে প্রথম দুটি কারণেই মিথ্যে ছোড়াছুড়ি হয়। কৌতুকের কোনও স্থান থাকে না। একেবারে যে থাকে না, তা-ও বলা যায় না। যেমন কেউ যদি বলেন, যে রামবাবুকে তিনি রাতারতি শ্যামবাবু বানিয়ে দেবেন, তবে সেটা কৌতুক ছাড়া আর কী! কেউ কেউ আবার এটাকে সত্যি বলে বিশ্বাসও করে ফেলে!
একটি চমৎকার মিথ্যে
বাট্রান্ড রাসেলের আত্মজীবনীতে এই চমৎকার মিথ্যেটির কথা আছে। রাসেলের এক বন্ধু নাকি কখনও মিথ্যে কথা বলতেন না। তাঁকে এক দিন জিজ্ঞাসা করা হল, আচ্ছা টম, (অন্য নামও হতে পারে, আমার হাতের কাছে বইটি নেই) তুমি কোনও অবস্থাতেই, কোনও কারণে মিথ্যে কথা বলো না, এ কথাটা কি সত্যি?
টম মাথা নেড়ে বলেছিলেন, না।
এটাই সারা জীবনে টমের একমাত্র মিথ্যে কথা।
একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা
অভিষেক বসুকে আমি চিনতাম না। তাঁকে জানা এবং তার কাজ দেখার পর আমার মনে হল, এ রকম অভিজ্ঞতায় জীবন ধন্য হয়।
সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘টোড়াই চরিত মানস’ নামে উপন্যাসটি আমার খুবই প্রিয়। বিশ্বসাহিত্যেই এ উপন্যাসের তুলনা খুব কম। উইলিয়াম ফকনারের মতন লেখকও এমন আঞ্চলিক ভাষার উপন্যাস লিখতে পারলে নিশ্চিত গর্ব বোধ করতেন। এমন একটি উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়া এবং মঞ্চস্থ করা সম্ভব, তা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। কারণ, উপন্যাসটি পূর্ণিয়া জেলার তাৎমাটুলি ও ধাঙড় বস্তির প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে। তাদের মধ্যে ঢোঁড়াই নামে এক পিতৃপরিত্যক্ত বালকের বেড়ে ওঠার কাহিনি। লেখক খানিকটা ঠেট হিন্দির সঙ্গে বাংলা মিশিয়ে, অনেক ফুটনোট দিয়ে সে কাহিনি লিখেছেন। কতখানি পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে এ কাজ করা যায় তা ধারণা করাই শক্ত। বাংলা নাটককে ভালবাসা আর বাংলা নাটকের সমৃদ্ধির জন্যই এই উদ্যোগ সার্থক।
যে হেতু আমি নোটঙ্কি নামের এই দলটির আগে কোনও অভিনয় দেখিনি, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনি না, তাই আমার মনে হচ্ছিল, এরা সবাই ‘টোড়াই চরিত মানস’-এর একেবারে জীবন্ত সব চরিত্র। এতই বিশ্বাসযোগ্য। সম্প্রতি গিরিশ মঞ্চে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এই নাট্যানুষ্ঠান দেখেছি।
নাটকটির মাঝে মাঝে লেখকের চরিত্র এনে কাহিনির সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটা উপযুক্তই হয়েছে। কিন্তু লেখকের মুখের সংলাপ সম্পর্কে আর একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সতীনাথ যে ধরনের মানুষ, তিনি নিজের রচনা সম্পর্কে কোনও রকম অতিশয়োক্তি সহ্য করতেন না বোধহয়। গান গেয়েছেন কৌশলকিশোর বর্মা, সিপাহি মাহাতো মুন্না সাহু আর সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের এবং প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীকে, বিশেষ করে ঢোঁড়াইয়ের নতুন বউয়ের ভূমিকায় মেয়েটি, এবং মূক সাধু, সকলকে আমার অভিনন্দন। যারা এই নাটকটি এখনও দেখেনি, তাদের সম্পর্কে আমার দুঃখ হয়।
৪, ৫, ২০১১