যা দেখি, যা শুনি – ১

আগামী বছরে দুর্গোৎসব হবে ডিসেম্বর মাসে

তা হলে এটাই ঠিক হল যে আগামী বছরে দুর্গাপুজো আর উৎসব হবে ডিসেম্বর মাসে।

আমাদের আকাশ তো জানিয়েই দিয়েছে যে সেপ্টেম্বর আর অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কোনও উৎসব সম্ভব নয়। পর পর পাঁচ বছর দুর্গাপুজোর সময় বৃষ্টি হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চাদের আনন্দ মাটি, পুজোর উদ্যোক্তাদের অসুবিধের একশেষ। তার চেয়ে ডিসেম্বর মাসে বাতাস অতি মনোরম, পরীক্ষাটরীক্ষা শেষ, ফসলও তোলা হয়ে যায়, সেই তো উৎসবের উপযুক্ত সময়। আবহাওয়াবিদদেরও মত এই যে, বর্ষাকাল ক্রমশ বিলম্বিত হচ্ছে। তবে সেই বর্ষা আর যাই হোক, ডিসেম্বর মাসকে ছুঁতে পারবে না।

শারদীয় দুর্গোৎসবকে বলা হয় অকালবোধন। এর সঙ্গে রামায়ণের কাহিনি জড়িত। এ সম্পর্কে ভুল ধারণাও অনেক। একটি বেশ বড় গোছের পুজো কমিটির কর্তাব্যক্তিকে বলতে শুনেছি, সমুদ্রের বুকে সেতুবন্ধনের সময় রাম দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, তিনি রামায়ণ পড়েননি। এ জন্য তাঁকে বিশেষ দোষও দেওয়া যায় না। অনেকেই তো এখন রামায়ণ পড়েন না। টি ভি সিরিয়াল দেখেন। কোনও সিরিয়ালে এ সব আছে কি না জানি না। বাল্মীকির রামায়ণে এ রকম কিছু নেই। সে মহাকাব্যের রাম সমুদ্রকে শাসন করার জন্য জগৎ কম্পিত করে বজ্রনাদে শর মোচন করেছিলেন, যাতে মহার্ণব একেবারে শুষ্ক হয়ে যায়। তখন স্বয়ং সমুদ্র এসে কৃতাঞ্জলি হয়ে রামকে সেতুবন্ধনের পরামর্শ দেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও প্রসঙ্গটি প্রায় একই রকম।

বাল্মীকির সঙ্গে কৃত্তিবাসের প্রধান প্রভেদ রাবণ বধের বৃত্তান্তে। মূল রামায়ণেও যোদ্ধা হিসাবে রাবণের প্রতি খানিকটা অবিচার করা হয়েছে। রামকে সাহায্য করতে এসেছেন অনেক দেবতা ও মহর্ষি। ইন্দ্র পাঠিয়েছিলেন বহু অস্ত্রশস্ত্র সমেত রথ ও সারথি মাতলিকে আর অগস্ত্য মুনি এসে শিখিয়েছিলেন আদিত্যহৃদয় নামে এমনই স্তোত্র, যাতে যুদ্ধে জয় হবেই। রাম স্নান-টান করে শুচি হয়ে সূর্যের উদ্দেশে তিন বার সেই স্তোত্র পাঠ করলেন। রামের পুজো বলতে এইটুকুই। তার পর আর রাবণ বধে বেশি দেরি হয়নি।

কৃত্তিবাস রাবণ বধ পালাটি অনেকখানি বিস্তারিত করেছেন। রাম-রাবণের ঘোর যুদ্ধের সময় রাবণ অম্বিকার স্তব করে পেলেন তাঁর দয়া ও অভয়। আর রাবণের রথে সেই দেবীকে দেখে রাম চরম হতাশ হয়ে ধনুর্বাণ ফেলে দিলেন। এখন উপায়? বাঙালির মতন এখানে রাম খুব কান্নাকাটি করেছেন। তার পর ব্রহ্মার পরামর্শে রাম ‘অকালে শরতে কৈল দেবীর বোধন’। এখানেই সেই একশো আটটি নীল পদ্ম উৎসর্গের কাহিনিও আছে। রাম এখানে মৃন্ময়ী মূর্তি গড়িয়েও পুজো করলেন। (মহাকবি কৃত্তিবাস সম্ভবত জানতেন না যে, রামায়ণ মহাভারতের আমলে মূর্তি পুজোর কোনও রীতি বা বিধিই ছিল না।)

যাই হোক, সেই দৃষ্টান্তেই প্রতি বছর শরৎকালে মহিষমর্দিনী দেবী দুর্গার মূর্তি পূজোর প্রবর্তন। এখানে একটা সামান্য প্রশ্ন আছে। শাস্ত্র মতে, শরৎকালে সূর্যের দক্ষিণায়ন, তখন দেবতাদের ঘুমের সময়। রাবণ বধের জন্য রাম বাধ্য হয়ে অসময়ে দেবীর আরাধনা করতে বাধ্য হন। আমরা এখন যে দেবী দুর্গার পুজো করি, তাঁর সঙ্গে তো রাবণ বধের কোনও সম্পর্ক নেই, এই দেবী মহিষাসুরকে বধ করতে উদ্যত এবং তিনি চিরজাগ্রত। সুতরাং এখন তো তাঁর পুজো যে কোনও সময়েই হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায়, ঋতুও বদলায়, আর উৎসবের সময় বদলাতে পারে না? বাংলার আর একটি বড় উৎসব ঈদ পালিত হয় চান্দ্রমাস অনুযায়ী, সেই উৎসবের তারিখও প্রতি বছরই বদলে যায়।

অনেকের মুখেই এ রকম দাবি শোনা যায়। আগেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। এই তো কিছু দিন আগে পত্রান্তরে নন্দদুলাল রায়চৌধুরী নামে এক জন লেখক বিস্তৃত ভাবে লিখেছেন।

পঞ্জিকাকার, বিশিষ্ট পুরোহিতগণ কিংবা বারোয়ারি পুজোর উদ্যোক্তাবৃন্দ কারা এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেবেন, তা অবশ্য আমি জানি না।

পুলিশ কেন আসে না?

সকাল এগারোটা। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ছুটছে গাড়ি। ছায়া ছায়া দিন, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। এই মসৃণ রাজপথটি অতি সুগম, শান্তিনিকেতন পৌঁছে যাওয়া যায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে। আমাদের দেশে একশো দশ কুড়ি কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলবে, এ কথা কয়েক বছর আগে আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি।

হঠাৎ গাড়ির গতি কমে এল। তার পর নিশ্চল। সামনে ও শেষে আছে গোটা পঞ্চাশেক। উল্টো দিকটা ফাঁকা। অর্থাৎ দু’দিকের পথই বন্ধ। ক্রমশ শোনা গেল, সামনে এক জায়গায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। খুবই মর্মান্তিক। একটি মোটর সাইকেলের ধাক্কায় একজন পথচারী প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ বলল বটে যে ঠিক নিহত নয়, আহত, তার সত্যি-মিথ্যে বোঝা দুষ্কর, কারণ, অকুস্থলটি বেশ দূরে। শোনা গেল, কিছু কিছু গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে সেখানে।

যাদের স্বজন হারিয়েছে, তাদের শোক-দুঃখ থেকে ক্রোধের উদয় হওয়া অতি স্বাভাবিক। বেছে বেছে যে শুধু মোটর সাইকেলই ভাঙা হবে তার কোনও মানে নেই। যাদের গাড়ি নেই, গাড়িওয়ালা লোকদের সম্পর্কে তাদের রাগ বা কিছু একটা থাকতেই পারে। দলে দলে গ্রাম থেকে ছুটে আসছে মানুষ। এ-দিককার কিছু গাড়ির চালক বা যাত্রীও কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। এর পর কী হবে, পুলিশ এসে নিশ্চয়ই পরিষ্কার করে দেবে এই ব্যস্ত রাস্তাটি! হঠাৎ কৌতূহলীরা অনেকে যেন প্রাণভয়ে দৌড়ে ফিরে আসতে লাগল, ও দিকে নাকি ইট-পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলল, গ্রামবাসীরা নাকি এ দিকেই তেড়ে আসছে।

খবরের কাগজে প্রায়ই পড়ি, কোথাও এমন গন্ডগোল হলে পুলিশের খবর পেতে পেতেই নাকি দু’তিন ঘণ্টা কেটে যায়। কিংবা গড়িমসি করে পুলিশ আসে না। দিনের বেলা এমন প্রকাশ্য রাস্তায় পুলিশের খবর না পাওয়ার তো কোনও কারণ নেই। এর মধ্যে নানান গাড়ির নানান রকম প্যাঁ পোঁ শুরু হল, যে যে-দিকে পারছে গাড়ি ঘোরাচ্ছে। আমাদেরও আর এখানে অপেক্ষা করাটা সুবিবেচনার পরিচয় হবে না, এরপর গাড়িতে গাড়িতে ঠোকাঠুকি লাগবে, আমাদের গাড়ির চালক খুব দক্ষতার সঙ্গে গাড়িটি উল্টো দিকে নিয়ে যেতে সমর্থ হল। এখন ছোটখাটো গ্রাম্য রাস্তা ধরে বর্ধমানের দিকে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে।

উল্টো দিকে কিছুটা যাওয়ার পর একটা সেতুর তলা দিয়ে ডান দিকে ঘোরা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে জনা পাঁচেক পুলিশ। সঙ্গে তাদের গাড়ি। এরা এখানে দাঁড়িয়ে কি ভেরেন্ডা ভাজছে? এগিয়ে গিয়ে গন্ডগোলটা থামাচ্ছে না কেন?

কারণটা পরের মুহূর্তেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ও-দিকে পঞ্চাশ ষাঠ জন উগ্র মেজাজের মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে ঘুরছে, ইট-পাটকেল ছুড়ছে, সেখানে এই পাঁচ জন পুলিশ গিয়ে কী করবে? বেধড়ক মার খাবে। এদের কোমরে রিভলবার আছে বটে, কিন্তু উত্তেজিত জনতার দিকে গুলি চালানো এখন প্রায় নিষিদ্ধই বলতে গেলে। জনতাও তা জেনে গেছে। তাই পুলিশের প্রতি তাদের ভয় বা সমীহ নেই। পুলিশকে ইট মারতে তারা দ্বিধা করে না।

পুলিশ তাই নিরাপদ দূরত্বে ব্রিজের তলায় দু’তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে। বেলা পড়লে খিদের তাড়নায় জনতা এমনিতেই অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। তার পর যাবে পুলিশ।

তুমি মনস্থির করো

অত্যন্ত অশান্ত, অস্থির আর যার একেবারেই মনস্থির নেই, এটা সেই লেখিকার কবিতার বই। নবনীতা দেব সেন। এই বিদূষী, প্রতিভাময়ী লেখিকাটি সম্পর্কে এক দিন শোনা যাবে, ইনি খুবই অসুস্থ। পরের দিন শোনা যাবে, তিনি আলাস্কায় চলে গেছেন কোনও অভিযানে।

এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই ছোট ছোট, স্ফুলিঙ্গধর্মীয়। শেষ কবিতাটি এ রকম:

তুমি যতো বলো,
‘চিরদিন চিরদিন’
আমি শুনি শুধু
‘আজকেই আজকেই!’

৩. ১১. ২০১০

যে প্রশ্নের উত্তর এখনও জানি না

বাংলাদেশে গেলে প্রত্যেক বারই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যার উত্তর আমি জানি না।

আমি সবজান্তা নই, ভাল ছাত্রও ছিলাম না। সুতরাং অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আমার না-জানা হতেই পারে কিন্তু এ এক এমন প্রশ্ন, যা শুনলেই অপরাধবোধ হয়।

বাংলাদেশ ঘড়ির দিক থেকে আমাদের চেয়ে আধঘণ্টা এগিয়ে। আমাদের এখানকার অনেক টিভি চ্যানেলে দু’রকম সময় দেওয়া থাকে। কোনও অনুষ্ঠান এখানে সাড়ে ছ’টায় শুরু হলে বাংলাদেশে দেখা যাবে সাতটায়। সত্যিই কি সে সব অনুষ্ঠান দু’দেশে একসঙ্গে দেখা যায়? এটা নিছক বিজ্ঞাপন নয়, সত্যি দেখা যায়। এখানকার কোনও কোনও অনুষ্ঠান বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। এবং শুধু বাংলা নয়, হিন্দি চ্যানেলও পাওয়া যায় কয়েকটি। কিছু কিছু ধারাবাহিক সোপ দেখার নেশা আছে অনেকের। বেশ। কিন্তু বাংলাদেশ টিভি-র কোনও অনুষ্ঠানই কলকাতা কিংবা ভারতের কোথাও দেখা যায় না কেন? কেন এই বৈষম্য। এটাই সেই কঠিন প্রশ্ন।

এ প্রশ্নের উত্তর আমি এখানে অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি। এমনকী দিল্লিতেও। কিন্তু কোথাও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাইনি। আমাদেরই মতন, বাংলাদেশেও একটি সরকারি চ্যানেলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বেসরকারি চ্যানেল রমরমিয়ে চলে। সেগুলি দেখার সুযোগ কেন পাব না আমরা? বেশ কিছু বছর আগে কিন্তু দিব্যি পাওয়া যেত। হুমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক দেখার নেশা জন্মে গিয়েছিল অনেকের, আমি জানি। কী করে সে সব বন্ধ হয়ে গেল, কোন কলা-কৌশলে, কার স্বার্থে? অনেকেই বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাবে বাঙালি ও বাংলা দু’ভাগ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হব না। এই কি তার নমুনা? এখন বাংলাদেশের কেউ কেউ যদি উগ্রভাবে দ্বিতীয় প্রশ্ন করে যে, এটা ও-দেশের ওপর ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বা সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের চেষ্টা। তারই বা উত্তর দেব কী করে?

বই ও পত্র-পত্রিকার বিনিময় নিয়েও প্রশ্ন আছে। ভারত, বিশেষত পশ্চিমবাংলা থেকে প্রকাশিত যত বেশি সংখ্যক বই ও পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশে যায়, সেই তুলনায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বই আসে অনেক কম। পত্র-পত্রিকা প্রায় কিছুই আসে না। এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য তেমন জটিল নয়। শুধু বিধিনিষেধ নয়, চাহিদারও একটা ব্যাপার আছে। হয়তো তা সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশের কোনও কোনও অতি জনপ্রিয় লেখকের বই পশ্চিমবাংলায় প্রকাশিত হলেও পাঠকদের মধ্যে এখনও তত বেশি আগ্রহের সৃষ্টি হয়নি। আবার এ কথাও ঠিক, পশ্চিমবাংলার কয়েকজন লেখকের রচনা বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে সমাদৃত। তবে, ওখানকার কিছু প্রকাশক এ সমস্যার এক সহজ সমাধান করে ফেলেছেন। পশ্চিমবাংলায় সেই সব লেখকের গ্রন্থ প্রকাশ মাত্রই ও-দেশে জাল সংস্করণ বেরিয়ে যায়। তাতে মূল লেখক ও প্রকাশকের ভাগ্যে জোটে লবডঙ্কা। এমনকী কলকাতায় প্রকাশের আগেই ঢাকায় পাওয়া যায় জাল বই। কী করে? হয়, তা-ও হয়।

রক্তকরবী না শক্তকরবী?

সে বারে রবীন্দ্রনাথ সপরিবার গিয়েছেন শিলং। রথী আর প্রতিমা, কন্যা মীরা। মীরার মেয়ে বুড়ি আর রথীদের দত্তক কন্যা পুপে। এবং কাশী থেকে আনানো হয়েছে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ রাণুকে। রাণু অধিকারী, পরবর্তী কালে লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়। সে সময় এই উচ্ছল মেয়েটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহ ও সখ্যের সম্পর্ক হয়েছিল। তাঁর সে সময়ের কোনও কোনও রচনায় এর ছায়াও লক্ষ করা যায়।

সেখানে রবীন্দ্রনাথ একটি নতুন নাটক লিখতে শুরু করেন। প্রাথমিক নাম দেন ‘যক্ষপুরী। প্রধান চরিত্র তিনটি।

রবীন্দ্রনাথ ভাল অভিনেতা ছিলেন। নিজের নাটকে অভিনয় করেছেন বহু বার। নতুন নাটক লেখার সময় নিজের জন্যও একটি চরিত্র নির্মাণ করতেন। ঠাকুর্দা কিংবা বৈরাগীর মতন গায়ক-অভিনেতা হিসাবে তিনি সার্থক। আবার ‘বিসর্জন’ নাটকে তিনি কখনও ‘জয়সিংহ’, কখনও ‘রঘুপতি’র মতন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি ভূমিকায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এই নতুন নাটকে তাঁর ভূমিকা কোনটি। গায়ক বিশু পাগল, না রাজা? বিশু পাগলে নাট্যবস্তু কম, রাজার চরিত্রেই ফুটেছে স্রষ্টার আসল ব্যক্তিত্ব ও কণ্ঠস্বর। আর মুক্তির দূতী নন্দিনীতে পুরোপুরি রাণুর আদল। আর কাহিনির নায়ক রঞ্জন-এর কল্পনা বিশ্বসাহিত্যেই দুর্লভ, সমগ্র নাটকে তার কোনও সংলাপ নেই। তাকে এক মাত্র দেখা যাবে শেষ দৃশ্যে, মৃতদেহ রূপে। এই চরিত্র রচনার সময় কবির মনে লেওনার্ড এলমহার্স্ট নামে ইংরেজ যুবকটির কথা মনে এসেছিল, যে তখন শান্তিনিকেতনের পরিপার্শ্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত এবং রাণুর সঙ্গেও খেলাধুলোতে উৎসাহী। এই নাটক মঞ্চস্থ করার অভিপ্রায় ছিল রবীন্দ্রনাথের, প্রথম দুটো চরিত্র তো ঠিক হয়েই আছে। আর রঞ্জনের চরিত্রে এলমহার্স্ট, ঠিক বাংলা উচ্চারণ করতে পারবেন না, তাই কি তার মুখে একটিও সংলাপ নেই?

তবে রবীন্দ্রনাথ এ নাটক মঞ্চস্থ করে যেতে পারেননি। আমরা যখন এই নাটক পড়ি, তখনই মনে হয়েছিল পাঠ্যনাটক হিসেবে অসাধারণ হলেও অভিনয় জমিয়ে তোলা খুবই শক্ত। তার প্রধান কারণ, প্রায় সব সংলাপই উপমাবহুল, কথ্য ভাষায় যা কৃত্রিম শোনাতে বাধ্য।

কিন্তু আমাদের সেই সংশয় চুরমার করে দিল বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’ প্রোডাকশন। এখন তা ইতিহাস। বাংলার পেশাদারি থিয়েটারের প্রায় অবসান ঘটিয়ে সেই শুরু হল গ্রুপ থিয়েটারের জয়যাত্রা। এর পর পঞ্চাশ বছরে আরও কয়েকটি দল ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করেছে। সেগুলি দেখতে গিয়ে বার বার আমাদের মনে এসেছে বহুরূপীর সেই প্রোডাকশনের সঙ্গে তুলনা। কানে ভেসে আসে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের কণ্ঠস্বর।

সম্প্রতি ‘পূর্ব-পশ্চিম’ দলের ‘রক্তকরবী’ দেখার পর আমার মনে একটা খটকা লেগেছে। বার বার বহুরূপীর সঙ্গে তুলনা করাটা কি ঠিক? সত্যিই কি বহুরূপীর সেই প্রোডাকশন ততটাই সার্থক হয়েছিল, না এ আমাদের নিছক স্মৃতিকাতরতা? শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্র, দু’জনেরই কণ্ঠস্বর ও স্বরক্ষেপণ ছিল অ্যাফেকটেড, অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম, যা অনেকটা আবৃত্তিসুলভ। এ কালের সচেতন অভিনেতারা সেই দুর্বলতা বা বিশেষত্ব থেকে মুক্ত। নন্দিনী রূপে তৃপ্তি মিত্রের তুলনায় চৈতী ঘোষালের আর্তি কি কম অভিঘাত তোলে? সেই ‘রক্তকরবী’তে সর্দারের ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন তা আমার মনে নেই। এখানে সৌমিত্র মিত্রের অভিনয় দেখে কোনও প্রতিতুলনা তাই মনে এল না। ভিলেনের ভূমিকায় অতিনাটকীয়তা এবং গর্জনটর্জন বর্জন করা সোজা কথা নয়। এই অভিনেতা চাপা অভিনয়ে এক অসাধারণ আদর্শ স্থাপন করেছেন। জালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা রাজার সঙ্গে সর্দারের একটা সংঘর্ষের দৃশ্য। যা মূল নাটকে নেই, তা-ও সামান্য ইঙ্গিতে সংযুক্ত করে পরিচালক গৌতম হালদার (এঁর নামের পাশে ‘চলচ্চিত্র’ লেখা থাকে) বেশ সৌকর্যের পরিচয় দিয়েছেন। একটু বাড়াবাড়ি করলেই সবটা মাটি হয়ে যেতে পারত।

মোট কথা, সাধারণ ভাবে আমরা অনেক সময়েই মনে করি যে, আগেকার যা কিছু অনেক ভাল বা উন্নত ছিল (যেমন, আগেকার বাংলায় ছিল গোলা ভরা মাছ, পুকুর ভরা দুধ, গোয়াল ভরা ধান ইত্যাদি) সেই তুলনায় এখনকার সব কিছুই দুর্বল। এটা এক প্রকার অতীতচারী রোগ বিশেষ। যাঁরা পথপ্রদর্শক, তাঁরা যোগ্যতাতেও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ না হতে পারেন, তবু তাঁদের কীর্তি একটুও ন্যূন হয় না। ‘ন্যূন’ কেটে দিয়ে ‘কম’ লিখলেও ক্ষতি কী?

যুগ্মপ্রচেষ্টা

শিবরাম চক্রবর্তী থাকতেন ঠনঠনে কালীবাড়ির কাছে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে। এক মেসবাড়ির একখানা ছোট ঘরে। দেয়ালভর্তি সব ঠিকানা লেখা। একদিন মাঝরাতে খুঁটখাট আওয়াজে ঘুম ভাঙার পর দেখলেন, ঘরের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি। শিবরাম জিজ্ঞেস করলেন, কে? ছায়ামূর্তি স্মার্টলি উত্তর দিল, আমি একজন চোর স্যর। শিবরাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, চোর তো এখানে কী করছ? সে বলল, কিছু টাকাপয়সা খুঁজছি। শিবরাম বললেন, টাকাপয়সা? দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি উঠছি। তার পর দু’জনে ভাল করে খুঁজব।

১৭. ১১. ২০১০

বাঙালি কোথায় নেই? বাঙালি এখন কোথায়?

পঞ্জাবের অমৃতসর শহরে, শিখদের অতি পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের কাছেই জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যান। সব শহরেই এ রকম দু’চারটে পার্ক থাকে। জালিয়ানওয়ালাবাগের দৃশ্যত আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তবু সারা ভারতের সব মানুষ এই বাগটির নাম জানে। (না, সব মানুষ নয়, শিক্ষিত শ্রেণির কিছু এবং স্থানীয় লোকজন) । তার কারণ, ব্রিটিশ রাজত্বে নানান কুকীর্তির মধ্যে এই উদ্যানে এক দিনের ঘটনা অতি কলঙ্কের ইতিহাস হয়ে আজও দগদগ করে।

সে ইতিহাস বিস্তৃত ভাবে বলার দরকার নেই, বর্তমানের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ। সংক্ষেপে এইটুকু বলা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বহু পঞ্জাবি সৈনিক ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে প্রাণ দিয়েছে সেই যুদ্ধে। যুদ্ধ চলার সময় ভারতে স্বায়ত্তশাসনের টোপ দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে সে সব আর উচ্চারণও করে না শাসকরা। বিক্ষুব্ধ, অশান্ত পঞ্জাবে চলছে ধরপাকড়, গ্রেফতার হয়েছেন গাঁধীজি, অমৃতসরে সব রকম জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরই মধ্যে, এপ্রিলের ১৩ তারিখ (১৯১৯ সাল) বৈশাখী পূর্ণিমা, গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ আসে শহরে, তারা ওই সব ১৪৪ ধারা-টারার কথা জানে না। তারা অনেকেই এসে জড়ো হয়েছে ওই পার্কে, একটা মঞ্চও বাঁধা হয়েছে। পার্কটা এমনই যে বাইরে থেকে দেখা যায় না, দু’পাশের বাড়ির মধ্য দিয়ে একটা সরু প্রবেশপথ, চার দিকে বড় বড় বাড়ি ও দেওয়াল, বেরোবার রাস্তাও ওই একটাই। হঠাৎ এক সময় জেনারেল ডায়ার নামে এক বীরপুঙ্গব তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে ওই পথটা আটকাল। জনতাকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার জন্য কোনও সাবধানবাণীও উচ্চারিত হল না, হুকুম দিল গুলি চালাবার। সেই বীভৎস দৃশ্য কল্পনা করাও শক্ত, প্রতিবাদহীন, নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ তাদের খুন করতে পারে মানুষই? কান্না, আর্ত চিৎকার, হুড়োহুড়ির মধ্যে সরকারি হিসেবেই মৃত্যু হয় ৩৭৯ জনের। আহত কয়েক হাজার। বেসরকারি মতে, মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। সৈন্যদের বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলেই তারা সবাইকে হত্যা করতে পারেনি।

ব্রিটিশ সরকারের এমন বর্বরতার কাহিনি সারা দেশ জানতে পারেনি, কারণ তখন সমস্ত সংবাদপত্রে কঠোর ভাবে সেন্সরশিপ জারি ছিল। ক্রমশ প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে কিছু কিছু তথ্য নেতাদের কানে আসে। কিন্তু তাঁরা তখনই কোনও প্রতিবাদ আন্দোলন করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ তখন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষমতার দরাদরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।

রাজনৈতিক নেতারা আবেগে চালিত হন না। কিন্তু এক কবিকে এই ঘটনা দারুণ ভাবে বিচলিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন গাঁধীজি ও চিত্তরঞ্জন দাশকে এর প্রতিবাদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ওঁরা এড়িয়ে যান। এক নিদ্রাহীন রাত্রির পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই একক ভাবে জ্বলন্ত ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে জরুরি চিঠি পাঠান ভারতের বড়লাটকে, তাঁর নাইটহুডও ফিরিয়ে দেন।

হঠাৎ এত দিন পর এই প্রসঙ্গ কেন? এখন রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর উপলক্ষে নানান অনুষ্ঠান হচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। তারই অঙ্গ হিসেবে একটি কবি- সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ওই জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানের মধ্যেই ম্যারাপ বেঁধে। সারা দেশ থেকে নানান ভাষার কবিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন অমিতাভ চৌধুরী। প্রতিবাদ নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রতি কবিদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। সাহিত্য অকাদেমির এই পরিকল্পনা খানিকটা অভিনব তো বটেই।

প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় একটা তথ্য দেখে আমি চমকে উঠলাম। সেই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে, নারকীয় তাণ্ডবের মধ্যে একজন বাঙালিও ছিলেন! তাঁর নাম ডাক্তার ষষ্ঠীচরণ মুখোপাধ্যায়, গুলি চালনার সময় তিনি কোনওক্রমে মঞ্চটার তলায় ঢুকে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। পরে তিনি ওই উদ্যানটিতে নিহতদের স্মৃতিরক্ষা ব্যবস্থায় অগ্রণী হয়েছিলেন। ওঁরই বংশধর সুকুমার মুখোপাধ্যায় এখনও সপরিবার ওই পার্কের প্রবেশপথের ধারেই এক বাড়িতে থাকেন, একতলার একটি ঘরে একটা সংগ্রহশালাও চালাচ্ছেন।

এই সব দেখতে দেখতে আমার এক সঙ্গী সবিস্ময়ে বলে উঠল, বাঙালি কোথায় নেই?

ঠিক। তবে, এই কথাটা শুনলেই আমার মনে হয়, বাঙালি এখন কোথায়?

কবিতা লেখার জন্য কারাগারে

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেটে গেল তেষট্টি বছর। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কত মানুষ আত্মত্যাগ করেছে, সে সব এখন ইতিহাস। অনেকে ইতিহাসেও স্থান পাননি। আন্দামানের জেলে ১৬০০ রাজবন্দির নাম দেখেছি, তাঁদের ক’জনের কথা লোকে মনে রেখেছে? মনে রাখা স্বাভাবিকও নয়।

কিন্তু কবিতা লেখার জন্য যাদের কারাবরণ করতে হয়েছিল, তাঁদের কথা একেবারে ভুলে যাওয়া অন্তত সাহিত্যজগতের পক্ষে অনুচিত। বাঙালিদের মধ্যে সে রকম ক’জন ছিলেন তার একটি তালিকা প্রস্তুত করার ভার কি কেউ নেবে?

সে রকমই একজনের নাম দয়াল কুমার, এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বিংশ শতাব্দী’ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল এবং ‘১৯০৮ আর ১৯৩১’ শীর্ষক একটি কবিতার জন্য তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন তিরিশের দশকে। তার পরেও তিনি কয়েক বার জেল খেটেছেন, এমনকী দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও।

দয়াল কুমার প্রায় সারা জীবনই ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িত। দেশসেবার আদর্শে তিনি প্রথম দিকে ছিলেন গাঁধীজির প্রতি আকৃষ্ট, তারপর সাম্যবাদী আর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। চুঁচড়োয় বাড়ি, তিনি ছিলেন সেই অঞ্চলের সকলের পরিচিত দয়ালদা। তাঁর পরিবারটি ছিল সে কালের কমিউনিস্টদের একটি আদর্শ প্রতিচ্ছবি। তাঁর স্ত্রী মুক্তাও ছিলেন সমাজকর্মী, ছেলেমেয়েদেরও রাজনীতির সংস্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়নি। দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী। বিষয় ভোগ কিংবা ক্ষমতার লোভ এই সব মানুষের মধ্যে সামান্যতম স্থানও পেত না, বরং দারিদ্র্য নিয়ে অহংকার ছিল। নজরুল ইসলামের সেই লেখা— ‘হে মহান’— অনেকে জীবন দিয়ে বিশ্বাস করতেন। অভাবের সংসার, অনেকগুলি ছেলেমেয়ে, তবু স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে যখন ভারত সরকার তাঁকে পেনশন ও তাম্রপত্র দিতে চায়, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

দয়াল কুমার ছিলেন নজরুল ইসলামের খুব ভক্ত, সে ধারারই কবি। এ কালের দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর রচনাগুলি কতটা স্লোগানধর্মী আর কতটা কাব্যরসসম্পৃক্ত, তা নিয়ে মতভেদ হতেই পারে। কিন্তু এমন মানুষের জীবন অবশ্যই এখনও স্মরণীয়।

এবং অধৃষ্য কুমার

দয়াল কুমারের এক সন্তান তার বাবার আদর্শকেও ছাড়িয়ে নকশালপন্থী নেতা হয়ে ওঠেন সেই ষাট-সত্তরের দশকে। ধরা পড়ে জেলও খেটেছেন। পরিচিতরা অনেকেই তাঁর নাম বলতেন, এখনও বলেন, অদৃশ্য কুমার। শুনলেই মনে হয় ছদ্মনাম। কিংবা কোনও রোমহর্ষক ডিটেকটিভ গল্পের প্রতিনায়ক। তা কিন্তু নয়, কুমার এঁদের পারিবারিক পদবি, প্রথম নামটি অদৃশ্য নয়, অধৃষ্য। সংস্কৃতগন্ধী হলেও এটা একটা বাংলা শব্দ, কেন না বাংলা অভিধানে স্থান পেয়েছে। এর অর্থ, যাকে দমন করা যায় না।

১. ১২. ২০১০

পোশাকের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য পোশাক

ফিল্‌ম ফেস্টিভাল থেকে বেরিয়ে এক বন্ধু বললেন, চলো, কিছুক্ষণের জন্য আমাদের ক্লাবে গিয়ে বসা যাক। তারপরই, সম্মতির জন্য আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে তিনি তাকালেন আমার পায়ের দিকে। এবং উচ্চারণ করলেন একটা আফশোসের শব্দ।

গোটা গরমকালটায় মোজা ও জুতো (শু) পরার অভ্যেস আমার নেই, প্যান্ট-শার্টের সঙ্গে চটি পরলেই চলে যায়। শীতের সময় বা শীতের দেশে গেলে মোজা পরতেই হয়। আমাদের দেশের উচ্চাঙ্গ ক্লাবগুলিতে চটি-পরা পায়ের মানুষদের প্রবেশ নিষেধ। এ ব্যাপারে আমার কয়েক বারই নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে।

এক বার এক বন্ধু আমার পায়ের দিকে লক্ষ না করেই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন এ শহরের এক প্রান্তে একটি বনেদি ক্লাবে। সেখানেও চটি সমস্যা। তার সমাধানেরও ব্যবস্থা আছে সেখানে, মজুত রাখা নানান ধরনের কিছু জুতো। তার থেকে বেছে এক জোড়া আমাকে দেওয়া হল, চটির বদলে পরে নেওয়ার জন্য। আগে যেগুলিকে বলা হত কাবুলি জুতো, এখন তাকেই বলা হয় স্ট্র্যাপ শু। সামনের দিকটা আমার চটিরই মতন, তফাত শুধু গোড়ালি পেঁচিয়ে একটা সরু চামড়ার ফিতে। শুধু এই ফিতেটুকু থাকা না-থাকার জন্য অনেক মান-সম্মান নির্ভর করে। তফাত অতি সূক্ষ্ম, তবে জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই তো আমরা এ সব অনেক সূক্ষ্মতার মর্ম বুঝতে পারি না।

পাজামা-পাঞ্জাবিও বেশ আরামদায়ক পোশাক, প্রায় সারা বছরই, উত্তুরে হাওয়া বইলে তার ওপর একটা সোয়েটার বা আলোয়ান জড়িয়ে নিলেই চলে। কিন্তু এ পোশাকও ক্লাবগুলিতে অচল। ধুতি পাঞ্জাবি কিংবা শেরওয়ানি জাতীয় পোশাকের অন্তর্গত। শেরওয়ানির বিশেষ চল আমাদের এ দিকে নেই, ধুতির ব্যবহারও ক্রমশ কমে আসছে, তবু পাজামা-পাঞ্জাবি আজও ভদ্র পোশাক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশে অনেকেই প্যান্টের ওপরে কুর্তা পরেন (আর সবাই বলে কুর্তা, শুধু আমরা এ দিকে কেন পাঞ্জাবি বলি, তা জানি না)! এক বার কয়েকজন বাংলাদেশি বন্ধুকে নিয়ে কী লজ্জাতেই পড়েছিলাম! সকালে একটা অনুষ্ঠানের পর কয়েকজন মিলে গেছি একটা ক্লাবে, পানাহারের জন্য। গেট দিয়ে ঢোকার পরই একজন এসে ফিসফিস করে বাংলাদেশি বন্ধুদের জানিয়ে বললেন, ওঁদের তো এখানে স্থান দেওয়া যাবে না। প্যান্টের ওপর কুর্তা আর চটি। ওঁদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমান এবং জনপ্রিয়তম ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ। মরমে মরে গিয়ে আমাকে বলতেই হল, ঠিক আছে, আমরা চলে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে আমিও আর কোনও দিন এ ক্লাবে পা দেব না! তখন ভেতর থেকে এক কর্তাব্যক্তি ছুটে এসে বললেন, আপনাদের মাঠের এক কোণে বসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তাতে আশা করি অন্য মেম্বাররা আপত্তি করবে না। ভাগ্যিস এই সব কথা শামসুর রাহমান ও হুমায়ুন আহমেদরা শুনতে পাননি!

ক্লাবের ধারণাটি আমরা পেয়েছি সাহেবদের কাছ থেকে। ইংল্যান্ডের নানান ধরনের ক্লাব সম্পর্কে অনেক মজার গল্পও প্রচলিত আছে। অধিকাংশ পুরুষদের উদ্যোগেই গঠিত এই সব ক্লাবে এক কালে নারীদের সদস্য তো করা হতই না, প্রবেশও নিষিদ্ধ ছিল। স্ত্রীদের চোপা এড়াবার জন্য, শান্তিতে মদ্যপান ও তাস খেলার জন্যই পুরুষরা ক্লাবে জমায়েত হতেন। এ ছাড়া ব্যবসায়িক লেনদেন এবং ছেলে-মেয়েদের বিয়ের কিংবা জীবিকা সংস্থানের আলোচনার জন্যও ক্লাব একটি প্রকৃষ্ট স্থান। লন্ডনের একটি ক্লাবে ব্রেকফাস্টের সময় এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলারও নিয়ম ছিল না। ইংরেজরা আমাদের দেশে এসে ক্লাব স্থাপন করে দেশীয় মানুষদের কঠোর ভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ডগ্স অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস নট অ্যালাউড, এমনও নোটিস থাকত কোথাও কোথাও। গাঁধীজি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রথমবার কলকাতায় আসার সময় তাঁকে একটি ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তখন অবশ্য তিনি মহাত্মা হননি, ব্যারিস্টার। পোশাকে কোনও খুঁত ছিল না, বাধা ছিল গায়ের রং। স্বাধীন দেশে অবশ্য গায়ের রঙের বাধা নেই, তবু অন্য রকম বাধা আছে কিছু কিছু। শিল্পী হুসেন এবং আনন্দশঙ্কর বাধা পেয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে কিছু কিছু নিয়ম বদলাচ্ছে, তার প্রতিফলন পড়ছে এখানকার ক্লাবগুলিতেও, তবে বিলম্বিত ভাবে। এই কিছু দিন আগেও কলকাতার অধিকাংশ ক্লাবে স্বাধীন, স্বাবলম্বী, স্বতন্ত্র নারীদের সদস্য হওয়ার অধিকার ছিল না। এখন সে নিয়ম শিথিল হয়েছে, তবে আজও কোনও রমণী প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কি? কোনও কোনও ক্লাবে একটা মেন্‌স রুম থাকে, সেটা কিন্তু পুরুষদের টয়লেট নয়!

পোশাকের ব্যাপারে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যুট ও টাই। সাহেবদের দেশে টাই-এর ব্যবহার অনেকটা কমে আসছে, এ দেশে ক্রমশ বাড়ছে। ১৫ অগস্ট দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা ভোজসভা হয়। কুর্তা-শেরওয়ানির বদলে স্যুট-টাই পরিহিত অতিথিই অধিকাংশ। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আবদুল কালাম যে বার প্রেসিডেন্ট হলেন, তিনি বলেছিলেন, অগস্ট মাসে দিল্লিতে প্রচণ্ড গরম, তাই টাই পরার দরকার নেই। অনেকেই সে নির্দেশ মানেনি। টিভি’তে দেখা যায়, সংবাদ-পাঠকরা সবাই স্যুট-টাই পরে থাকেন, এমনকী বাংলা চ্যানেলগুলিতেও। এটা বুঝি টিভি-র ড্রেস কোড! বাংলাদেশে অবশ্য পোশাকের ব্যাপারে স্থানীয় রীতি মানিয়ে নিয়েছে টিভি’তে এবং কলকাতার একটি ক্লাবের সহোদরা ঢাকা ক্লাবেও, সেখানে কোনও দিন জামা-কাপড়ের ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন শুনিনি।

ক্লাবগুলি সব প্রাইভেট এবং সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাঁদের নিজস্ব নিয়ম-নীতির ব্যাপারে বাইরের কারও, এমনকী সরকারেরও নাক গলাবার অধিকার নেই। ঠিক কথা, ক্লাবের কোনও মুখপাত্র বলতেই পারেন যে, সেখানকার নিয়ম-কানুন যাঁরা মানতে না চান, তাঁরা আসবেন না, এটাও ঠিক। আবার, কিছু কিছু ব্যক্তি ওই সব ক্লাবের কোনও অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলেও পোশাকের কড়াকড়ির কারণেই ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন, তা-ও দেখেছি।

হাওড়া স্টেশনের কুলি

ট্রেন লেট, ক্যারেজওয়েতে একটা গাড়িতে বসে আছি। দু’পাশের প্ল্যাটফর্মই এখন ট্রেনশূন্য, শুনশান। এক জায়গায় সাত-আট জন কুলি গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে বিশ্রম্ভালাপ করছে। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে একটা প্রশ্ন এল, কত কাল ধরে এদের দেখছি। অবিশ্বাস্য রকম এদের মোট বইবার শক্তি। মাথায় দু-তিনটি ট্রাঙ্ক বা স্যুটকেস, দু’কাঁধে দু’টি ব্যাগ, তার পরেও হাতে একটা কিছু। এত মালপত্র নিয়েও বেঁকে যায় না, দৌড়তে শুরু করে। ছেলেবেলায়, মা-বাবা বলতেন, ওই কুলির পেছন পেছন যা, যেন ভিড়ে হারিয়ে না যায়। দৌড়ের পাল্লায় কুলিদের সমকক্ষ হওয়া খুব শক্ত ছিল। মালপত্র নিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমি কখনও দেখিনি। ওরা বেশ বিশ্বস্ত, ঠিক কামরায় উঠে জায়গার ব্যবস্থাও করে দিত, শুধু মজুরির ব্যাপারে খিটিমিটি হত খানিকটা।

এখন ভাবলাম, এই কুলিদের তো বয়েস বেড়েছে আমাদের মতন। আর কত দিন মোট বইতে পারবে? বুড়ো হয়ে গেলে কী করবে? এদের কি কোনও প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে? এই সব অসংগঠিত শ্রমিকদের ইউনিয়ন হয়? এদের কি কোনও পেনশনের ব্যবস্থা হতে পারে? কিছুই জানি না।

একটা ট্রেনের শব্দ হতে এরা উঠে দাঁড়াল। দু-এক জনের কোমরে হাত, মাথার চুল প্রায় সাদা। তবে একটা তফাত বেশ নজরে পড়ে। বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা এই সব কুলিদের প্রত্যেকেরই গোঁফ দেখেছি আমাদের ছেলেবেলায়। একজন আমাকে ভর্ৎসনা করে বলেছিল, পুরুষ মানুষদের গোঁফ না থাকলে জওয়ানি কমতি হয়ে যায়! এখন দেখছি, ওদের অর্ধেকেরই সেই শেয়ালের ল্যাজের মতন গোঁফ নেই, একেবারে কামানো! এটা এত দিন বাংলা মুলুকে থাকার খারাপ প্রভাব।

পরের দিনই সংবাদপত্রে দেখলাম, রেল স্টেশনগুলিতে মাথায় মোট বওয়া কুলিদের বদলে রেল-সেবকদের নিয়োগ করা হবে— যারা ট্রলিতে মালপত্র নিয়ে যাবে। অত্যন্ত ভাল প্রস্তাব। অন্যান্য দেশে তো সে রকমই হয়। সেই রেল-সেবকদের বৃদ্ধ বয়েসের জন্য সংস্থানও হতে পারে।

তবু মনটা খচখচ করে, কবে থেকে চালু হতে পারবে এই পরিকল্পনা? হাতে টানা রিকশা এই শহর থেকে একেবারে উঠিয়ে দেওয়ার কথাও তো অনেক দিন থেকেই শুনছি, কিন্তু এখনও সেই সব রিকশা চলছে তো চলছেই। সেই রিকশাওয়ালারাও বা বুড়ো হয়ে গেল কী করে?

শ্রমের প্রকৃত মর্যাদা

কিছু দিন আগে আমরা কয়েক বন্ধু গুজরাত-রাজস্থানের সীমান্ত অঞ্চলে দ্রষ্টব্য স্থানগুলিতে ঘুরছিলাম। ভাড়া করা গাড়ি, ড্রাইভারের বয়েস বাইশ-তেইশের বেশি নয়। এক দিন সন্ধে হয়ে এসেছে। সামনের একটি রাস্তা ধরে গেলে আমাদের রাত্রির আশ্রয়স্থলে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছনো যায়। অন্য একটা ঘুর-পথও আছে, তাতে লেগে যাবে তিন ঘণ্টার বেশি।

ড্রাইভারটি সোজা পথে যেতে রাজি নয়। কেন? ওই রাস্তার একটা গ্রামে ডাকাত থাকে, তাদের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনাতেই তার মুখ শুকিয়ে গেছে।

গাড়িতে আমরা চারজন পুরুষ মানুষ, সঙ্গে বেশিটাকা-পয়সা বাদামি জিনিসপত্রও কিছু নেই, দু-একজনের পকেটে প্লাস্টিক মানি। ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং ডাকাত দলের মুখোমুখি হবার রোমাঞ্চে আমরা ছেলেটিকে বললাম, চলো, চলো, ডাকাতরা আমাদের ধরলে আমাদের সঙ্গে যা আছে, সব দিয়ে দেব।

ছেলেটি ঘাড় শক্ত করে বলল, না স্যার, যাব না। ডাকাতরা খুব মারবে!

আমরা বললাম, সব কিছু দিয়ে দেব, তা হলে আর মারবে কেন? চলো—। সে বলল, তবু মারবে। ওরা পরিশ্রম না করে কিছু রোজগার করতে চায় না!

১৫. ১২. ২০১০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *