তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

যা ছিল, একদিন নেই হবে, যা ছিল না, তা একদিন আছে হবে, শেষ হবে না কিছুই

যা ছিল,একদিন নেই হবে,যা ছিল না,তা একদিন আছে হবে,শেষ হবে না কিছুই

চলে যাওয়া মানেই শূন্যতা। এক সময় ছিল, এখন আর নেই। হয়তো সামান্য একটু স্মৃতি পড়ে থাকে। একটি দালানের ভগ্নাবশেষ। একটি গাছের কোনও মানুষের চলার স্মৃতি একজোড়া চপ্পল। একটি উত্তরীয়। পাখি উড়ে গেছে, গাছের তলায় একটি রঙিন পালক। দেওয়ালে কালির দাগ। নিটোল একটি সংসার ছিল কোথাও। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ভাইবোন, হয়তো লোমওয়ালা ফুটফুটে একটি কুকুর। কোথা থেকে কি হয়ে গেল! সব মিলিয়ে গেল বুদবুদের মতো। যে ঘরে পরিবারের রান্না হত, সে ঘরের উত্তরের দেওয়ালে আঁকা রয়েছে ধোঁয়ার লেখা। কলকাকলি ভেসে চলে গেছে। রন্ধনের সুবাস মিলিয়ে গেছে বাতাসে। মেলায়নি ধোঁয়ার চিহ্ন। কোথাও পড়ে আছে নদীর ধারে একটি ভাঙা ঘাট, কত মানুষের স্নানের স্মৃতি নিয়ে!

কীসে আমরা ভাসছি? সময়ের স্রোতে। দানা দানা মুহূর্ত দিয়ে তৈরি সময়ের অনন্ত স্ফটিক। সময়ের কোনও শূন্যতা নেই। চূর্ণচূর্ণ হয়ে ঝড়ে পড়লেও, সময় অনন্ত। বর্তমান কেবলই অতীত হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ কেবলই চলে আসছে বর্তমানে। যে সময় চলে গেল তার জন্যে আমাদের কোনও শূন্যতার বোধ নেই। যে সময় কাছে চলে এল তার জন্যে আমাদের তেমন কোনও অনুভূতি নেই। সন্ধে সাতটায় আমরা হাত-পা ছড়িয়ে ভাবতে বসি না, সকাল সাতটা কোথায় চলে গেল! সময় অনবরতই পেছন দিকে চলছে বলেই আমরা সামনে চলেছি। আসলে আমাদের কোনও গতি নেই। আপেক্ষিক গতিতেই কাল থেকে কালে, মহাকালে লীন হয়ে যাই। অনেকটা সিনেমার দর্শক ঠকানো কায়দা। স্থির মোটর গাড়িতে নায়ক স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে, পাশের ঘরবাড়ি গাছপালা-আঁকা প্রেক্ষাপটটি একজন উলটোদিকে টেনে নিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে গাড়ি ছুটছে সামনের দিকে।

পুরোনো বাড়ির পাশে একটি নতুন বাড়ি এসে প্রমাণ করতে চায় তুমি প্রাচীন হয়েছ। সংসারে একটি শিশু এসে বলতে চায়, আমি এলুম তোমাদের যাওয়ার সময় হল এবার। সৃষ্টির হাতে স্রষ্টা এইভাবেই মার খেয়ে চলেছে চিরকাল। ‘old order changeth yielding place to new.’ সময় জীবজগৎকে যত তাড়াতাড়ি গ্রাস করে, বস্তুজগৎকে তত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করতে পারে না। আমার শরীরের ত্বকে যত তাড়াতাড়ি কুঞ্চন ধরবে, আমার বাড়ির পলস্তারায় তত তাড়াতাড়ি ধরবে না। আমি চলে যাওয়ার পরেও বাড়িটা থাকবে। হয়তো পরের আরও তিন পুরুষ সেখানে বসবাস করে যাবে। যে ভূখণ্ডের ওপর বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটি পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যাবে। হয়তো হাত পালটাবে, তবু থাকবে। মাঠকোটা থেকে দালানকোটা, দোতলার ওপর তিনতলা উঠবে। সিমেন্ট রং ঝলসাবে শরতের রোদে। যে রোদদুরে আমি ফড়িং-এর নাচানাচি দেখেছি ঘাসের ডগায়, কেউ-না-কেউ সে নাচ দেখবে। সেই একই ভঙ্গি। আরামকেদারায় এলানো শরীর। কোলের ওপর সেই একই খবরের কাগজ। মাঝে মাঝে মেঘ-ভাসা নীল আকাশের দিকে চোখ চলে যাওয়া। অন্দরমহল থেকে ভেসে আসা সেই একই ধরনের শব্দ, রান্নার গন্ধ।

ল্যাম্পপোস্টে, টিভি অ্যান্টেনায় যে ঘুড়িটিকে আমি আটকে থাকতে দেখেছিলুম, ঠিক সেই রকম একটি ঘুড়ি আটকে থাকবে। পথের ওপাশে সেই একই কৃষ্ণচূড়ায় ডালপালার বিস্তার। দোয়েলের নাচানাচি। দেখা সেই এক, চোখ দুটোই যা ভিন্ন।

বর্ষা চলে গেলেও যেমন জলের স্মৃতি জমে থাকে কোথাও-কোথাও, তেমনি সময় চলে গেলেও লুটানো আঁচলের মতো সময় কোথাও-কোথাও তো পড়ে থাকে। দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলার মতো বর্তমানের গায়ে লেগে থাকে অতীত। চোরকুঠুরিতে জমা আছে সংসারের অজস্র জিনিস। কোনও কোনওটা প্রায় শতাব্দীর মত প্রাচীন। ভিক্টোরিয়ার আমলের ভাঙা চেয়ার। পেতলের বাতিদান। গিল্টি করা ছবির ফ্রেম। ছেঁড়া-খোঁড়া কিছু বই। একটি বৃহৎ আকৃতির বিধ্বস্ত বইয়ের নাম মেটাফিজিক্স। সামনের আর পেছন দিকের পাতা নেই। কীটদষ্ট মধ্যভাগটি কালের প্রহরণ থেকে কোনও রকমে আত্মরক্ষা করেছে। মার্জিনে কপিং পেনসিলে প্রপিতামহের নোট। খুদে খুদে অক্ষর এখনও স্পষ্ট। উনিশশো ছয় কী সাত সালে এক যুবক কলকাতার এক মিশনারি কলেজে, বি.এ. ক্লাসের নোট নিয়েছিলেন। যুবক থেকে প্রৌঢ়, শেষে বৃদ্ধ। অবশেষে তিরোধান। এক সময় ছিলেন, এখন আর নেই। তৃতীয় পুরুষের এক প্রবীণ নির্জন দ্বিপ্রহরে সেই বইটির পাতা ওলটাচ্ছে। সময় পিছু হাঁটতে শুরু করেছে। সামনের পিচের রাস্তা কাঁচা হয়ে গেছে। লোকসংখ্যা কমে এসেছে। আশেপাশের অনেক বাড়ি নেই। ইলেকট্রিক পোস্টের বদলে গ্যাসপোস্ট এসে গেছে। রায়বাহাদুর সূর্য সেন আমবাগানে ট্যানা পরে বসে আছেন। থেকে থেকে হুশহাস করে কাক তাড়াচ্ছেন। স্টেট বাসের বদলে চিতপুর দিয়ে কেরাঞ্চি গাড়ি চলেছে। পেছনের আসনে বসে আছেন পাগড়ি মাথায় কোনও ব্যানিয়ান। পালকি চড়ে বউঠান চলেছেন শ্বশুরালয়ে। পান্থির মাঠে বসেছে স্বদেশিসভা। ইডেনের ব্যান্ডস্ট্যান্ডে বাজছে গোরা-বাদ্যি।

বইটির পাতা থেকে কলকাতার প্রাচীন এক রঙ্গালয়ের টিকিট বেরিয়ে এল। যুবক প্রপিতামহ থিয়েটার দেখেছিলেন। সে রাতের অভিনেতা কে ছিলেন! তিনি এখন কোথায়? কিন্তু আগে আর পরে দর্শক আর অভিনেতা দুজনেই কালের শিকার হয়েছেন। চোরকুঠুরিতে সময়ের কিছু অভ্রচুর্ণ পড়ে আছে।

নিমেষে আবার বর্তমানে ফিরে আসা। অতীতের মরীচিকা অদৃশ্য। যা ছিল, তা ফিরে আসে। যা ছিল না, তা আর আসে কী করে! স্মৃতি পরগাছা। বর্তমানের গা বেয়ে অতীত লতিয়ে ওঠে। বর্তমান থেকে শুষতে থাকে প্রাণরস! অতীত আছে বলেই বর্তমান নিরালম্ব নয়। ভাসমান মেঘ নয়। জপের মালার মতো। মুহূর্তের রুদ্রাক্ষ জীবন-জপ-মন্ত্রে ঘুরে ঘুরে আসছে আবার ফিরে ফিরে যাচ্ছে। বছরে বছর জুড়ে জীবনের সূত্র দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। এরই মাঝে যুদ্ধ, শান্তি, দেশবিভাগ, মানচিত্রের নববিন্যাস, নতুন দেশসীমার জন্ম, রিপাবলিক, ডিকটেটারশিপ থেকে ডেমক্রেসি।

তবু, বর্তমান যতই চেষ্টা করুক অতীতকে একেবারে ঠেলে বের করে দিতে পারে না। অতীত সময়ের ছোট ছোট ডোবা তৈরি হয়। কোনও কোনও অঞ্চলে শতাব্দী আটকে থাকে। এপাশে তিরাশি সাল বইছে, ওপাশে ছয় সাল আটকে আছে গাছের ডালে ঘুড়ির মতো।

দেড়শো বছরের প্রাচীন মন্দির দাঁড়িয়ে আছে আকাশের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে। অষ্ট ধাতুর ধর্ম পতাকাটি হেলে গেছে একপাশে। মন্দির-গাত্রের কারুকার্য কিছু কিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। বহুকাল বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়নি। সন্ধ্যায় ক্ষীণ তেজের একটি বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে। পুরোহিত একজন আছেন। বয়েসে নবীন হলেও সাজপোশাক প্রাচীনের মতোই। আরতির ঘণ্টা বাজে টিংটিং করে কেঁদে কেঁদে। শীর্ণ একটি মানুষ কোণে বসে কাঁসর বাজায় থেমে থেমে। তার আবার একটি চোখে দৃষ্টি নেই। তার একটি পাশে চুপটি করে বসে থাকে এক বৃদ্ধা। সময় তার শরীরের সমস্ত রস শুষে নিলেও প্রাণশক্তিটি এখনও কেড়ে নিতে পারেনি। মন্দির চত্বরের বাইরে কিছু দূরে অবন মালাকারের ভিটে। তালাবন্ধ পড়ে আছে দীর্ঘকাল। বিশাল বিশাল বৃক্ষে নিশীথের বাতাস কানাকানি করে। কর্কশ সুরে প্যাঁচার ডাকে প্রেতেরা নড়েচড়ে ওঠে। মিত্তির বাড়ির মেজোবাবু শতাব্দীর ধাপ বেয়ে বেয়ে নেমে আসেন, ফিনফিনে পাঞ্জাবি গায়ে, শুঁড় তোলা চটির শব্দ তুলে। দক্ষিণের চিলেকোঠায় ঝুলতে থাকে সুন্দরী মেজোবউ মনের দু:খে। ভাঙা আস্তাবলে অদৃশ্য ঘোড়া পা ঠুকতে থাকে। উন্মাদ বড়বাবু মাঝরাতে চাতাল থেকে তাল ঠুকে লাফিয়ে পড়েন কুস্তির আখড়ায়। পরনে লাল ল্যাঙোট। পালোয়ান রামখেলোয়ান বোঝাতে থাকে, বাবু, এখনও ভোর হয়নি।

রাতে পৃথিবীর পরিসর বড় কমে আসে। দিন যেন মানুষের দান ফেলে দাবা খেলতে বসে। রাত এসে ছক গুটিয়ে নেয়, বোড়েরা উঠে যায় খোলে। গজ এলিয়ে পড়ে ঘোড়ার গায়ে। রাজা শুয়ে পড়ে রানির পাশে। মন্ত্রী চলে যায় বোড়েদের পায়ের তলায়। রাতে মানুষ চলে আসে মানুষের কাছে। অতীত সরে আসে বর্তমানে। নিদ্রার অচেতনতা এগিয়ে আনে অদৃশ্য ভবিষ্যৎ। গাছের ডালে প্রথম রাতে যা ছিল কুঁড়ি, ভোরের আলো ফোটার আগেই তা হয়ে দাঁড়ায় পরিপূর্ণ একটি স্থলপদ্ম। দিন চলে যায়। জঠরে ভ্রূণের আকার একদিনের মাপ বাড়ে। ফাঁসির আসামি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় আরও একদিন। কারুর আসার দিন এগিয়ে আসে, কারুর যাওয়ার দিন।

সময় পৃথিবীর সর্বত্র একতালে চলছে না। কোথাও ঘোড়ার চাল, কোথাও বলদের চাল, কোথাও স্থির। পৃথিবী কখনও জ্যোতির্ময়ী, কখনও তামসী। মহামায়ার পদতলে শ্বেতশুভ্র শিব। দিন গেল, রাত এল, সময়ের এই হল সহজ হিসেব। জন্ম আর মৃত্যু—এই হল নাটকের এক-একটি অঙ্ক। যা ছিল, তা একদিন নেই হবে, যা ছিল না, তা একদিন আছে হবে। শেষ হবে না কিছুই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *