যার কেউ নেই, তার ড্রোন আছে

যার কেউ নেই, তার ড্রোন আছে

১৯৬৮ সাল। ইসরায়েলের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের অফিস। এই ইন্টেলিজেন্স সংস্থার হিব্রু নাম ‘আমান’।

আমানের অফিসে যেন একটু বেশিই ভিড়। তার কারণও আছে অবশ্য। কৌতূহলের কেন্দ্রে আছে কয়েকটা ছবি। ছবিগুলো সংগ্রহ করে এনেছেন আমানের একজন স্পেশাল এজেন্ট সাবতাই ব্রিল। মিশরে ঢুকে গোপনে এই ছবিগুলো তিনি সংগ্রহ করেছেন।

ব্রিলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হলেন কর্নেল আব্রাহাম আরনান। ভদ্রলোক খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি উপস্থিত বিশ্লেষকদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কীসের ছবি বলে মনে হচ্ছে?’

‘স্যর, সম্ভবত সৈন্য চলাচলের জন্য একটা সেতু তৈরি করা হয়েছে’, একজন অ্যানালিসিস্ট উত্তর দিল।

অফিসরুমের পরিবেশটা মুহূর্তের মধ্যে থমথমে হয়ে গেল। একগাদা প্রশ্ন আর একরাশ সংশয় দেখা দিল আমান-কর্তা আরনানের মনে— মিশর কি তাহলে সত্যিই আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?

এর মাত্র এক বছর আগেই এই দুটো দেশ যুদ্ধ লড়েছে। ‘সিক্স ডেজ ওয়র’ বা ‘ছ’ দিনের যুদ্ধ’। অবিশ্বাস্য ভাবে ইসরায়েল যুদ্ধে জয়ী হয়। মিশরের কাছ থেকে তারা ছিনিয়ে নেয় সিনাই। মিশর এই এলাকা ফেরত নেবার জন্য মরিয়া হয়ে রয়েছে। সুয়েজ খাল মিশরের মূল ভূখণ্ডকে সিনাই থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। মিশরীয়রা সুয়েজ খালের ওপর এই সেতু বানিয়েছে ট্যাঙ্ক ও সৈন্য বহনকারী যানবাহন চলাচলের জন্য। এই সেতু ব্যবহার করে ইসরায়েল আক্রমণ অনেকটাই সহজ হবে। এই কথাগুলোই একের পর এক নিজের মনে সাজালেন আরনান।

এরকম একটা আশঙ্কা আগে থেকেই করেছিল ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স এজেন্সিগুলো। তাই এই এলাকার ওপরে নজরদারি করা আরম্ভ হয়। গোপনে নজর রাখার এই ব্যাপারটা অবশ্য মোটেও সহজ কাজ ছিল না। চতুর্দিকে মোতায়েন ছিল ইজিপ্সিয়ান স্নাইপার টিম। সামান্য ভুলচুক হলেই ইসরায়েলি সেনারা মিশরীয় সেনার স্নাইপারের টার্গেটে পরিণত হতে লাগল।

তাহলে কী উপায়?

ব্যবহার করা শুরু হল ইসরায়েলি এয়ারফোর্সের যুদ্ধবিমান। বিমান ওড়ার সময়ে ছবি তোলারও চেষ্টা করা হল। কিন্তু শত্রু এলাকায় বিমান উড়লে সহজেই আক্রান্ত হওয়ার ভয় তো থাকবেই, তাই মিসাইলের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিমানগুলোকে অনেক উঁচু দিয়ে উড়তে হত। ফলে অত উঁচু থেকে তোলা ছবি কোনো কাজেই লাগল না ইসরায়েলের।

আর অন্য কোনো উপায় না থাকায় মিশরে গুপ্তচর পাঠিয়ে আসল খবর জানার চেষ্টা করা হল। গেলেন স্পেশাল এজেন্ট সাবতাই ব্রিল। ব্রিল ছবি তো তুলে আনলেন। তার ফলে বোঝাও গেল যে, সেখানে কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটছে।

কিন্তু এই কথা জানার আরও বেশি দরকার ছিল যে, প্রতি মুহূর্তে সেখানে নতুন কী-কী ঘটনা ঘটে চলেছে।

এই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন ব্রিল— কিছু একটা তো করতেই হবে যাতে সেখানকার সবকিছুর খুঁটিনাটি জানা যায়।

চিন্তা ক্রমশ পরিণত হল দুশ্চিন্তায়। ব্রিল কিন্তু ভাবা থামালেন না, একটা উপায় চাই! কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি একটা সিনেমা দেখেছিলেন। সেই চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছিল একটি আমেরিকান-ইহুদি বালক একটা খেলনা বিমান ওড়াচ্ছে। বিমানটা ছিল রিমোট কন্ট্রোলড। ‘ইউরেকা!’ ব্রিলের মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটা বুদ্ধি খেলে গেল— ‘কয়েকটা এরকম রিমোট কন্ট্রোলড খেলনা বিমান কিনে তাতে ক্যামেরা লাগিয়ে সুয়েজ খালের ওপর দিয়ে ওড়ালেই তো মিশরের সেনার উপস্থিতির এবং গতিবিধির সব বিবরণ পাওয়া যাবে।’

চটপট কাজে নেমে পড়লেন ব্রিল। প্রথম পদক্ষেপ ছিল, এমন কাউকে বেছে নেওয়া যে রিমোট কন্ট্রোলড এরোপ্লেন ওড়ানোয় দক্ষ। খোঁজ খোঁজ! এজেন্সির পক্ষ থেকে সামনে এনে ফেলা হল এক অফিসার স্লোমো বারাকের নাম। এই আধিকারিক প্রতি সপ্তাহান্তের ছুটিতে খেলনা বিমান উড়িয়ে অবসর বিনোদন করেন। ব্রিল বুঝে গেলেন যে, একে দিয়েই কাজ হবে।

পরবর্তী ধাপ কী ছিল?

সেটা হল এই পরিকল্পনার সরকারি অনুমোদন। ব্রিল চাইছিলেন, বায়ুসেনা নিজেই এই কাজের দায়িত্ব নিক। ইসরায়েলি এয়ারফোর্সকে আমানের তরফ থেকে এই দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে বায়ুসেনার টেকনিকাল বিভাগের আধিকারিকরা কটাক্ষ করে বললেন, ‘আরে ভাই, ওগুলো খেলনা বিমান, ওগুলো দিয়ে কিস্যু হবে না!’

এই কথা শুনে ভয়ানক নিরাশ হলেন ব্রিল। তিনি ছুটলেন তাঁর কমান্ডার কর্নেল আব্রাহাম আরনানের কাছে। আরনান সব শুনে বললেন, ‘আগে তুমি নিজে আমাকে এরকম একটা খেলনা বিমান চালিয়ে দেখাও, তারপর আমি দেখছি কী করা যায়।’

দিনক্ষণ ঠিক করা হল। তেল আভিভ থেকে কিছুটা দূরে একটা এয়ারস্ট্রিপ বাছা হল ট্রায়ালের জন্য। নির্ধারিত দিনে স্লোমো বারাক রিমোট দিয়ে বিমান টেক অফ করালেন। আকাশে ওড়ালেন। তারপর নিজস্ব কিছু কায়দা দেখিয়ে নির্ভুলভাবে ল্যান্ডও করালেন বিমানটাকে।

সব দেখে আরনান খুশি হলেন। তিনি ব্রিলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আনুমানিক কত খরচ পড়বে?’

ব্রিল হিসাব করে বললেন, ‘তিনটে এরোপ্লেন, ছ’টা রিমোট, পাঁচটা ইঞ্জিন, বাড়তি টায়ার আর প্রপেলার নিয়ে পড়বে মোট ৮৫০ মার্কিন ডলার।

‘গো আহেড!’ বললেন আরনান।

আরনান সবুজ সংকেত দেওয়ার পরই ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের একটি টিম নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটনে একটা খেলনার দোকানে গিয়ে হাজির হল। প্ল্যানমাফিক সরঞ্জামগুলো কেনার পর সেগুলো ইসরায়েলি দূতাবাসের ডিপ্লোম্যাটিক পাউচে করে পাঠানো হল দেশে। ইসরায়েলে পৌঁছনোর পর মালগুলোকে সটান হস্তান্তরিত করা হল ইন্টেলিজেন্স ডিরক্টরেটের টেকনিকাল টিমের কাছে। সেখানে প্লেনগুলোতে জার্মান ৩৫০ এমএম ক্যামেরা বসল। এই ৩৫০ এমএম ক্যামেরার বিশেষত্ব হল, এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতি ১০ সেকেন্ড অন্তর একটা করে ছবি উঠবে।

এবার আসরে নামার পালা। কিন্তু সরাসরি অপারেশনে নামার আগে একবার যাচাই করে নেওয়া দরকার। সবার একটাই ভয় হচ্ছিল যে মিশরের সেনা খেলনা বিমান দেখলেই তো গুলি করে এর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবে। সুতরাং, পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

গ্রীষ্মের এক দুপুরে ইসরায়েলের দক্ষিণে নেগেভ মরুভূমির মিলিটারি বেসক্যাম্পে আরনান ও ব্রিল গিয়ে উপস্থিত হলেন। রাস্তার একটা দিক ছেড়ে দেওয়া হল রানওয়ে হিসাবে ব্যবহারের জন্য। আর অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট মেশিনগানগুলোকে প্রস্তুত রেখে ওপরের দিকে তাক করা হল তাদের মুখ। ব্রিলের হার্টবিট বেড়ে গেল। যদি মেশিনগানগুলো গুলি করে বিমানটাকে নীচে নামাতে পারে তাহলে যাবতীয় পরিকল্পনা তৎক্ষণাৎ বাতিল করে দেওয়া হবে।

বিমান উড়ল। টেক অফ করার পর যখন খেলনা প্লেনটা আকাশে চক্কর কাটতে থাকল, তখন তার দিকে গোলাবর্ষণ করার আদেশ দেওয়া হল। কান পাতা দায় হয়ে গেল বিকট শব্দে। আর ধোঁয়ায় ভরে গেল চারদিক। কিছুক্ষণ পর ব্রিল বিমানটিকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। মনে অনে ভাবলেন, ‘বোধহয় সব শেষ এবার।’

একটা সময়ে ফায়ারিং থামল। ধোঁয়া খানিকটা পরিষ্কার হলে ব্রিল ওপরের দিকে তাকালেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুটে বলে উঠলেন— ‘অবিশ্বাস্য!’ আকাশে তখনও অক্ষত অবস্থায় উড়ছে এরোপ্লেনটা।

আসলে খেলনা বিমান আকারে আসল বিমানের থেকে এতটাই ছোট যে, একে নিশানা লাগানো ভীষণ কঠিন ব্যাপার।

আর আরনান তো নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বিমান নীচে নামার পর তিনি ব্রিলকে জড়িয়ে ধরলেন। বলাই বাহুল্য যে, ব্রিল এই বিমান মিশরের আকাশে ব্যবহার করার অনুমতি পেয়ে গেলেন।

প্রথমে সুয়েজ খালের পাশে ইসমালিয়া শহরের কাছে মিশরের মিলিটারির অবস্থান জানার জন্য এটাকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বিমানের দায়িত্ব দেওয়া হল দুজনকে। একজন হল পাইলট, মানে যার হাতে কন্ট্রোলিং রিমোট থাকবে। আরেক জন দিকনির্দেশক, যে বাইনোকুলার দিয়ে প্লেনটার ওপর নজর রাখবে।

পাইলটের দায়িত্বে ছিলেন বারাক। আরনান মিশরের মাত্র এক কিমি ভেতর পর্যন্তই যাওয়ার অনুমতি দিলেন। প্রথমেই বেশি ঝুঁকি তিনি নিতে চাইছিলেন না। অবিশ্বাস্য সাফল্য এল প্রথম বারের উড়ানেই। যে ছবিগুলো হাতে পাওয়া গেল, তাতে পরিষ্কার ভাবে মিশরের সেনার পরিখা বা মিলিটারি ট্রেঞ্চগুলো দেখা যাচ্ছিল। এমনকী কমিউনিকেশন কেবলগুলো পর্যন্ত দৃশ্যমান হচ্ছিল স্পষ্ট ভাবে।

এরপর জর্ডন উপত্যকাতে একইরকম অভিযান চালানো হল। সাফল্য এল সেখানেও। এর কার্যকারিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবার কিছু সিরিয়াস চিন্তাভাবনা শুরু করল আমান কর্তৃপক্ষ। তৎকালীন মিলিটারি ইন্টেলিেেজন্সর প্রধান, মেজর জেনারেল আহারন য়ারিভ একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন— ইসরায়েল এবার এ ধরনের আরো ছোট আকারের বিমান নিজেই বানাবে এবং তা নিয়মিত ব্যবহার করবে।

য়ারিভ ব্রিলকে এই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন। এর কয়েক সপ্তাহ পরে ব্রিলের পদোন্নতি হয় ও তাঁকে সিনাইতে আর্লি ওয়ার্নিং ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমের কমান্ডার বানিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিল বেশ খুশিই হয়েছিলেন। না পদোন্নতির জন্য নয়, তাঁর প্রোজেক্টটা সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে তাই। কিন্তু ব্রিলের এই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হল না। তিনি এক পুরোনো বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেলেন যে, তাঁর এই প্রোজেক্টটাকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

কারণ কী ছিল?

য়ারিভ যাদের নিয়ে টিম বােিনয়ছিলেন, তাদের তৈরি করা বিমান বারবার ক্র্যাশ হচ্ছিল। আর এদিকে প্রোজেক্টে অনেক টাকাও ঢালা হয়ে গিয়েছিল 1 কোনো উপায় না দেখে এই প্রোজেক্ট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

এই খবর শুনে ব্রিলের মাথায় যেন বাজ পড়ল। এটা কীভাবে সম্ভব?

ব্রিলও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি য়ারিভ সহ ইন্টেলিজেন্সের পদস্থ অফিসারদের সবাইকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন যাতে এই প্রোজেক্ট হঠাৎ বন্ধ না করা হয়। তিনি এটাও সতর্ক করলেন যে, এর ফলে ইসরায়েলের ইন্টেলিজেন্সের ক্ষতি হবে। সেদিন ব্রিলের কথায় কেউ কান দেয়নি। প্রোজেক্ট বন্ধ করে দেওয়া হল।

ব্রিলের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। ইসরায়েলকে এই ভুলের খেসারত দিতে হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর (য়ম কিপ্পুর) মিশরীয় সেনা সুয়েজ পেরিয়ে সিনাই উপদ্বীপ এলাকায় অতর্কিতে হামলা চালায়। প্রায় বিনা বাধায় তারা এই এলাকায় প্রবেশ করে। ইসরায়েলের স্বাধীনতার পর এটাই সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ ছিল। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইসরায়েলি সেনা সিনাই উপদ্বীপ নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু এর ফলাফল ছিল মারাত্মক। প্রায় ২,০০০ ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয়েছিল।

এই ঘটনা দেখে সবথেকে বেশি আহত হয়েছিলেন ব্রিল। রাগে, দুঃখে নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। ব্রিলের প্রোজেক্ট বন্ধ না করা হলে মিশরের সেনার আক্রমণের আগাম খবর হয়তো পাওয়া যেত। তাহলে আগে থেকে প্রতিরোধও করা যেত, এড়ানো যেত শত শত লোকের মৃত্যু।

আমানের পক্ষ থেকেও এই ভুল উপলব্ধি করতে বেশি সময় লাগেনি। স্থানীয় ডিফেন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হল। শুরু হল হালকা আনম্যানড এরিয়াল ভেইকল বা ইউএভি তৈরির কাজ। এই ইউএভি-ই আজকের দিনের ‘ড্রোন’। কয়েক বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৯৭৯ সালে তৈরি হল প্রথম ড্রোন, যার নাম দেওয়া হল ‘স্কাউট’ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এটাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

১৯৮২ সালের জুন মাস। লেবানন থেকে রকেট আক্রমণের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল ইজরায়েল। এই আক্রমণের হোতা ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। এদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্যই থাকে যেনতেনপ্রকারেণ ইসরায়েলের ক্ষতিসাধন। ইসরায়েলের তরফে ঠিক করা হল যে, লেবাননে ঢুকে এদের সমূলে উৎপাটন করা হবে। লেবাননে এয়ার স্ট্রাইক করা ছিল কার্যত অসম্ভব। কারণ ওদের হাতে ছিল সোভিয়েত নির্মিত সারফেস- টু-এয়ার মিসাইল। এরকম প্রায় কুড়িটি মিসাইল ব্যাটারি লেবাননের বেকা উপত্যকায় সক্রিয় ছিল। স্কাউটকে এবার মাঠে নামানো হল। এই ড্রোনের মাধ্যমেই প্রথমে মিসাইল ব্যাটারির লোকেশনগুলো ইসরায়েলি বায়ুসেনার হাতে পৌঁছায়।

৬ জুন, ১৯৭৯। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমের মাধ্যমে মিসাইলের সমস্ত ব্যাটারিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হল। এরপর ইসরায়েলি ফাইটার জেট বোমাবর্ষণ করে প্রায় সব ক’টা মিসাইল ব্যাটারি ধ্বংস করে দেয়।

অভাবনীয় সাফল্য! একটা ফাইটার জেটেরও েেকানা ক্ষতি হয়নি এই অপারেশনে। এত নিখুঁত অভিযান একমাত্র ড্রোনের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। যারা এত দিন পর্যন্ত ড্রোনের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান ছিল, তারাও মেনে নিল যে যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের ভূমিকা হবে অপরিসীম।

এদিকে আমেরিকাও ড্রোন বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তখন। তারা ড্রোনকে ঠিকঠাক টেক অফ করাতে পারছিল না। কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচা করার পরও যখন সাফল্য এল না, তখন তারা ড্রোন বানানোর প্রোজেক্ট বন্ধ করে দেয়।

১৯৮৩ সালের জুন মাস নাগাদ আমেরিকা ইসরায়েলের কাছে সাহায্য চাইল। তার কারণও ছিল অবশ্য। একটা আমেরিকান গুপ্তচর বিমানকে সিরিয়া গুলি করে নীচে নামিয়েছিল। আর তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে বেইরুটের কাছে সিরিয়ার অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট ব্যাটারি লক্ষ্য করে আমেরিকা বিমান হামলা চালায়। এই হামলাতে আমেরিকা দুটো যুদ্ধবিমান ও একজন পাইলটকে হারায়। মিশন ব্যর্থ হয়। এনকোয়ারিতে জানা গেল যে, সিরিয়াতে টার্গেট আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের ক্যাননের রেঞ্জের মধ্যেই থাকলেও তার সঠিক লোকেশনটাই জানা নেই। আর সেটা জানতে গেলে আমেরিকার দরকার একটা ড্রোন। নিজেদের বিমান এবং পাইলট হারানোর কয়েক সপ্তাহ পর ইউএস নেভির সেক্রেটারি জন লেম্যান বেইরুট ছুটলেন, আর সেখানে তিনি ড্রোন সম্পর্কে জানার জন্য তেল আভিভ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৮২ সালেই তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, ইসরায়েলিরা ড্রোন ব্যবহার করছে। কিন্তু তিনি ইসরায়েলি ড্রোন ‘স্কাউট’কে একটি বার কাছ থেকে দেখতে চাইছিলেন। ইসরায়েলে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানকার মিলিটারি হেডকোয়ার্টারের একটা ঘরে। তাঁর সামনে একটা টিভি আর তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একটা উড়ন্ত ড্রোনকে কন্ট্রোল করার জয়স্টিক! ড্রোনের ব্যবহার দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন লেম্যান।

এরপর মেরিন কের্পেসর কমান্ডান্ট জেনারেল পল জিয়ার কেলিকে ইসরায়েলে পাঠানো হল এবং তিনিও স্বচক্ষে সব দেখলেন। লেম্যান ও কেলি দুজনেই ড্রোন কিনতে সমান ভাবে আগ্রহী হলেন। কারণ, ড্রোন হাতে পেলে সিরিয়াকে শিক্ষা দেওয়া ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা।

তাঁরা সরাসরি আমেরিকান নেভি এবং ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে একটা চুক্তি করলেন। আমেরিকা চাইছিল আরেকটু বড় ও শক্তিশালী ড্রোন, যার প্রযুক্তি হবে আরো উন্নত এবং যুদ্ধজাহাজও ব্যবহারের উপযোগী। শীঘ্রই একটা প্রোটোটাইপ তৈরি করা হল, তার নাম দেওয়া হল ‘পায়োনিয়ার’। মাজোভে, মরুভূমিতে পরীক্ষামূলক উড়ান করা হল। আমেরিকান নেভির কর্তারা যারপরনাই বিস্মিত হলেন এবং সঙ্গে আনন্দিতও। তারা ১৭৫টা পায়োনিয়ার তখনই অর্ডার দিয়ে দিলেন।

১৯৮৬ সাল থেকে আমেরিকাতে পায়োনিয়ারের ডেলিভারি শুরু হয়। আমেরিকাকে অবশ্য পায়োনিয়ার ড্রোন যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হুসেনের ইরাক, কুয়েত আক্রমণ করে। আমেরিকা কুয়েতের পক্ষ নেয়। ইরাকের বিরুদ্ধে এরকম একটা অপারেশনের সময়কার একটা ঘটনা। এক দল ইরাকি সৈন্যদের ওপর দিয়ে পায়োনিয়ার উড়ে যাচ্ছিল। ইরাকি সৈন্যরা ভয়ে নিজেদের সাদা গেঞ্জি উড়িয়ে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম বার েেকানা রোবটের কাছে একটা গোটা মিলিটারি ইউনিট আত্মসমর্পণ করেছিল। এর কৃিতত্ব ইসরায়েলরই প্রাপ্য।

ওদিকে লেম্যান ইসরায়েল থেকে আমেরিকা ফেরার পর জানতে পারলেন যে, লস আঞ্জেলেসে কেউ এরকমই একটা ড্রোন তৈরি করছে।

কে সেই ব্যক্তি?

একজন ইসরায়েলি এঞ্জিনিয়ার এই কাজটা করছিলেন। তাঁর নাম আবে কারেম। কারেম ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রির একজন প্রাক্তন পদস্থ আধিকারিক। ১৯৭৩ সালে য়ম কিপুর যুদ্ধের সময় কারেম নিজের প্রথম আনম্যানড এয়ারক্রাফ্ট বানান। ইসরায়েল যখন মিশরের সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ভেদ করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন কারেম এমন একটা মিসাইল বানিয়েছিলেন যেটা জয়স্টিক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হত। এর মাধ্যমে মিশরের রাডারগুলোকে সক্রিয় করে তাদের সঠিক অবস্থান জানা গিয়েছিল। এই মিসাইল ব্যবহার করে রাডারগুলোকে সক্রিয় করে তোলা হয়। তারপর ফাইটার জেট থেকে রাডারে মিসাইল নিক্ষেপ করে রাডারগুলোকে নষ্ট করা সম্ভব হয়েছিল। এই সাফল্যের পর কারেম ভেবেছিলেন যে, এটা ইসরায়েলে বানানোর জন্য সরকার বিনিয়োগ করবে দেশি ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে। কিন্তু কারেম অবাক হলেন যখন তিনি জানলেন যে ইসরায়েল রিমোট কন্ট্রোলড মিসাইল মার্কিনদের কাছ থেকে কিনছে। তাঁর একটা স্বপ্নের প্রোজেক্ট এভাবে ধূলিস্যাৎ হওয়াতে কারেম ভীষণ হতাশ হয়েছিলেন। শেষে তিনি ইসরায়েল ছেড়ে আমেরিকাতে চলে আসেন।

কারেমের লক্ষ্য ছিল খুব কম খরচে একটা ড্রোন তৈরি করা। তিনি ‘অ্যাম্বার’ নামে একটা প্রোটোটাইপ বানালেন, যেটার ইঞ্জিন ছিল একটা বাইকের, আর বড়ি ছিল প্লাইউড এবং ফাইবার গ্লাসের। অ্যাম্বার একটানা ৩০ ঘণ্টা উড়তে পারছিল। লেম্যানের উদ্যোগে আমেরিকান নেভি ২০০টা অ্যাম্বার কিনতে চাইল। কারেম ভাবলেন যে, এবার তাঁর কপাল ফিরল। ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে কাজ করতে এগোলেন। কিন্তু ১৯৮৭ সালে গভর্নমেন্ট ডিফেন্সের বরাদ্দ বাজেট কমিয়ে দিল। ফলে সেই অর্ডার বাস্তবে আর সম্ভব হল না। কারেম এবার এক্সপোর্ট কোয়ালিটি ড্রোন বানানোর কাজ আরম্ভ করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ঠিক তখনই ব্যাঙ্ক তাঁর কাছ থেকে লোনের ৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত চাইল। বাধ্য হয়ে কারেম তার যন্ত্রপাতি সব বেচে দিলেন।

১৯৯৩ সালে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়াতে এথনিক ওয়র শুরু হয়। সেনা ও জঙ্গি উভয়পক্ষই সাদা পোশাকে লড়াই করছিল। এমতাবস্থায় আমেরিকার পক্ষে বাস্তবিক পরিস্থিতি বোঝা একরকম অসম্ভব ছিল।

একইরকমভাবে বসনিয়ায় যুদ্ধের সময় সিআইএ একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। তৎকালীন সিআইএ ডিরেক্টর ছিলেন রবার্ট জেমস উলসে। তিনি জানতেন, ড্রোনের সাহায্য ছাড়া পরিস্থিতির অনুমান করা সম্ভব নয়। উলসে পেন্টাগনের ড্রোন এক্সপার্টদের ডেকে পাঠালেন। বিশারদরা জানালেন, ‘বসনিয়ায় ড্রোন পাঠাবেন তো? হয়ে যাবে। ড্রোন তৈরি করতে সময় লাগবে ছ’ বছর আর খরচ পড়বে পাঁচশো মিলিয়ন ডলার।’

বলাই বাহুল্য যে, সময় এবং অর্থের পরিমাণ, দুটোই ছিল অত্যন্ত বেশি। উলসে তখন আবে কারেমকে ডেকে পাঠালেন। আসলে কয়েক বছর আগে উলসের সঙ্গে কারেমের একবার দেখা হয়েছিল এবং প্রথম দেখাতেই উলসে বুঝে গিয়েছিলেন যে, কারেমের অদ্ভুত ইনোভেটিভ সব আইডিয়া আছে। কারেমকে ডেকে এনে সিআইএ ডিরেক্টর সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘বসনিয়ার জন্য ড্রোন বানাতে তোমার কত সময় ও কত খরচ পড়বে?’

‘সময়… স্মমমমম… এই ধরুন ছ’ মাস। আর খরচ হবে ফাইভ মিলিয়ন ডলার।’

সিআইএ-এর পক্ষ থেকে জেন নামের একজন ব্যক্তিকে কারেমের সহায়ক হিসাবে দেওয়া হল। ছ’ মাস পর কারেম ও জেনের তৈরি ড্রোন ‘ন্যাট ৭৫০’ বসনিয়ার আকাশে উড়তে শুরু করে দিল। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই উলসে সিআইএ-এর ল্যাংগলের অফিসে বসে সরাসরি সব খবর পেতে থাকলেন। ‘ন্যাট’-এর সাফল্যে পেন্টাগন থেকেও শুভেচ্ছাবার্তা এল। সেই বার্তায় বলা হল— ‘আরও শক্তিশালী ড্রোন বানাও, যার এঞ্জিন হবে আরও বড় ও পাখনা হবে আরও শক্তিশালী।’

এবারের ন্যোট একটা পরিবর্তন আনা হল। ন্যাটকে স্যাটেলাইটের সঙ্গে লিঙ্ক করে দিল সিআইএ। আর নতুন নামকরণের জন্য আয়োজন করা হল এক প্রতিযোগিতার। শেষ পর্যন্ত নাম বাছা হল ‘প্রিডেটর’, যার অর্থ ‘শিকারি’। শত্রুর কাছে সঠিক অর্থেই এটা প্রিডেটর ছিল। সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক এবং ইয়েমেনে অসংখ্যবার প্রিডেটরের ব্যবহার করা হয়েছে এবং সাফল্যও পাওয়া গেছে। এই কাজ ইসরায়েল এবং এক ইসরায়েলি এঞ্জিনিয়ারের সাহায্য ছাড়া সম্ভবই হত না।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ড্রোনের এত জনপ্রিয়তার কারণ শুধু যুদ্ধে এর সাফল্য দিয়ে বিচার করলেই কিন্তু চলবে না। আসলে ড্রোনের েেকানা বিকল্প নেই।

-মানুষ ১০-১২ ঘণ্টা টানা কাজ করার পর তার বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ড্রোন একটানা ৫০ ঘণ্টা আকাশে উড়তে পারে।

-ড্রোন কেমিক্যাল ও বায়োলজিকাল অস্ত্রের নাগালের বাইরে থাকে বলে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

-আকারে ছোট বলে একে টার্গেট করা মুশকিল। আর ড্রোনের শব্দ এতই কম যে রাস্তার ট্রাফিকের শব্দের মাঝে এর শব্দ আলাদা করে বোঝাই যাবে না।

-যুদ্ধবিমান নির্মাণের চেয়ে ড্রোন তৈরি করার খরচ অনেকটাই কম।

.

১৯৮৫ সাল থেকে ইসরায়েল ড্রোন রফতানিতে প্রথম স্থানে আছে। প্রায় ৬০% আন্তর্জাতিক বাজার ইসরায়েলের হাতে। দ্বিতীয় স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যার বাজারে শেয়ার প্রায় ২৩.৯%। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রাজিলের মতো দেশ ইসরায়েলের ড্রোন ব্যবহার করে। ইসরায়েলি মিলিটারি এখন ব্যাপক হারে ড্রোন ব্যবহার করছে। তারা ‘হেরন’ নামে যে ড্রোনটা ব্যবহার করছে তার একটা বিশেষত্ব আছে। এর ফ্লাইট রুট আগে থেকেই এতে প্রোগ্রাম করে দেওয়া যায়। এই ড্রোন পূর্বনির্ধারিত পয়েন্টে ল্যান্ড করতেও সক্ষম। এর ফলে হেরন-এর অপারেটর মিশনে বেশি করে মনোযোগ দিতে পারে।

ড্রোনকে প্রথম দিকে শুধু ইনটেলিজেন্স এবং নজরদারির প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হত। ড্রোনগুলোতে লেসার ডেসিগনেটর লাগানো হয়েছিল, যা লেসার রশ্মির মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুকে আলোকিত করে তুলত আর ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট বা হেলিকপ্টার থেকে মিসাইল ছুড়ে লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করা হত। একজন হিজবুল্লাহ জঙ্গির গাড়িকে ঠিক এভাবেই টার্গেট করে তাকে হত্যা করেছিল ইসরায়েলি সেনা। এবার ড্রোন নিয়ে আরেকটু ভাবনাচিন্তা শুরু হল। ড্রোন যদি এত কিছু করতে পারে তবে মিসাইলও নিশ্চয়ই নিক্ষেপ করতে পারবে।

ইসরায়েলের কাছে ‘হেরন’ ও ‘হার্মিস ৪৫০’ নামে যে ড্রোন আছে তারা মিসাইল বহন করতে পারে ও প্রয়োজনে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। গাজা এলাকায় ২০১২ সালে ১,০০০টা আন্ডারগ্রাউন্ড রকেট লঞ্চার ও ২০০টি টানেল আক্রমণ করে ইসরায়েলি সেনা। আর এদের অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছিল এই ড্রোন।

আহমেদ জাবারি, হামাসের একজন মিলিটারি কমান্ডার এবং ইসরায়েলের কাছে একজন মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসবাদী। গাজার রাস্তায় তার গাড়িতে ইসরায়েলি মিসাইল অকস্মাৎ আঘাত হানে। ড্রোনের মাধ্যমে তার অবস্থান সুনিশ্চিত করে তবেই এই মিসাইল-হামলা চালানো হয়েছিল। এর আগে চার চার বার তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গিয়েছিল। যে কাজ চার বারে সফল হয়নি, ড্রোনের সাহায্যে তা অনায়াসেই করে ফেলল আইডিএফ।

২০১০ সালের আগে পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনার মধ্যে ‘পালসার’ নামে একটা ছোট ইউনিট ছিল। পালসার ইউনিটের কাজ ছিল ট্যাঙ্কগুলোর আগে আগে চলা এবং শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে টিমকে সতর্ক করা। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এই কাজটি সৈন্যদের করতে হত। এই কাজ ড্রোন দিয়ে করানো শুরু হলে পালসার ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস। গাজা স্ট্রিপ থেকে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করেছে সবে চার বছর হয়েছে, কিন্তু প্যালেস্টাইনের তরফ থেকে রকেট আক্রমণ থামছিল না। শুধু আগের বছরই দু’ হাজারেরও বেশি রকেট ও মর্টার ধেয়ে এসেছে প্যালেস্টাইন থেকে। তৎকালীন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন য়হুদ অলমার্ট। তিনি গাজা স্ট্রিপে সেনা নামানোর নির্দেশ দিলেন। এবার হয় এসপার, নয় ওসপার! গাজাতে সেনা নামল।

ওদিকে ইসরায়েলের জন্য আরেকটা খারাপ খবর অপেক্ষা করছিল। খবরটা দিল মোসাদ। ইরান থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রবোঝাই একটি জাহাজ লোহিত সাগরে সুদানের বন্দরে নোঙর করেছে। অস্ত্রগুলির মধ্যে ছিল ফজু আর্টিলারি রকেট, যা কিনা অনেক লম্বা রেঞ্জের এবং তেল আভিভ পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এই অস্ত্র যদি প্যালেস্টাইনে পৌঁছয়, তাহলে সর্বনাশ নিশ্চিত। মোসাদের কাছে খবর ছিল, অস্ত্রভর্তি কন্টেনারগুলো ট্রাকে করে সুদান ও মিশর হয়ে গাজা সীমান্তে পৌঁছানো হবে। সেখান থেকে সুড়ঙ্গ মারফত অস্ত্রগুলো গাজা ভূখণ্ডে পাচার করা হবে। তৎকালীন আইডিএফ চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গবি আশকেনাজি এই ট্রাকের কনভয় আক্রমণের ছক কষতে লেগে পড়লেন। যে করেই হোক অস্ত্রবোঝাই গাড়ির কনভয়কে মিশরে ঢোকার আগেই আক্রমণ করতে হবে। মিশরের সঙ্গে তখন ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি চলছিল। মিশরে আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে পড়তে হত ইসরায়েলকে। তাই তারও আগে, সুদানের সীমানার মধ্যেই যা করার তা করে ফেলতে হবে। সুতরাং, হাতে সময় ছিল খুবই কম।

এরকম অপারেশন চালানোর আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দরকার হয়। এর আগেও দেশের বাইরে সিরিয়াতে নিউক্লিয়ার রিয়্যাকটর গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ইজরায়েলি বায়ুসেনা। আমেরিকার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও হামলা করা হয়েছিল। দেশের বাইরে এভাবে হামলা চালাতে থাকলে আন্তর্জাতিকভাবে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এবারের আক্রমণ এমনভাবে করতে হবে যাতে কেউ যেন কোনো ভাবেই ইসরায়েলকে সন্দেহ না করতে পারে।

ফাইটার জেট পাঠালে রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলন্ত ট্রাককে শনাক্ত করে টার্গেট করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। আর সুদানের আকাশে বেশি সময় ওড়াও যাবে না, কারণ ফাইটার জেটের জ্বালানির ক্ষমতাও যে সীমিত। আসকেনাজি তার অপারেশন বিভাগের প্রধানদের ডেকে পাঠালেন। আলোচনার পর ড্রোন দিয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর পড়ল। প্রধানমন্ত্রী এবারে অবশ্য ‘সেন্ড ইয়োর বয়েজ’ বলতে পারলেন না, কারণ আক্রমণকারীরা তো যন্ত্র ছিল।

আক্রমণের আগে নেগেভ মরুভূমিতে শুরু হল মহড়া। মহড়ার প্রথম ধাপ ছিল কনভয়ের সঠিক অবস্থান সুনিশ্চিত করা। দ্বিতীয় ধাপ, টার্গেটে আঘাত হানা। আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও সুদানের বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে ট্রাকের কনভয় খুঁজে বের করা ছিল খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজারই সামিল। এই অপারেশনের জন্য হেরন টিপি এবং হার্মিস ৪৫০ ড্রোনকেই বেছে নেওয়া হল। হেরনের কাজ ছিল কনভয়কে শনাক্ত করা ও তার গতিবিধির খবর দেওয়া। হেরনের উপস্থিতি যাতে ধরা না পড়ে তার জন্য তাকে ওড়াতে হত অনেক বেশি উচ্চতা দিয়ে। আর হার্মিস ড্রোন মিসাইল দিয়ে আঘাত হানবে কনভয়ের ওপর। প্রয়োজনে ফাইটার জেট ব্যবহারের পথও খোলা রাখা হল। তবে সেটা ছিল ব্যাকআপ প্ল্যান।

আক্রমণের সময় হিসাবে বেছে নেওয়া হল রাত্রিবেলা। হামলার দিনে আকাশ আংশিক মেঘাচ্ছন্ন ছিল। জানুয়ারিতে সুদানে এরকমই আবহাওয়া থাকে। সুদান ও প্যালেস্টাইনের পাচারকারীরা নিশ্চিন্তে পথ চলেছিল মরুভূমির মধ্যে দিয়ে।

ইসরায়েল যে ড্রোন দিয়ে হামলা চালাতে পারে এটা পাচারকারীদের ধারণার বাইরে ছিল। তারা যখন দেখল মিসাইলগুলো উল্কাবেগে তাদের দিকে ছুটে আসছে, তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। এই হামলায় ৪৩ জন পাচারকারী নিহত হয়, আর সব ক’টা ট্রাকই ধ্বংস হয়ে যায়। ইসরায়েলের মিশন সফল হয়েছিল।

এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরেই ইরান আবার অস্ত্র পাচার করার চেষ্টা করে। এবারেও অলমার্ট আরেকটা এয়ার স্ট্রাইকের অনুমতি দিলেন। অবশ্যই ড্রোন স্ট্রাইক। এই হামলায় ৪০ জন পাচারকারী মারা পড়ল আর ডজনখানেক ট্রাক ধ্বংস হল।

পরপর দুটি ঘটনায় গোটা সুদানে সাড়া পড়ে গেল। সুদান জানত যে, ইরান ও হামাস মিলিতভাবে অস্ত্র পাচার করার জন্য গোপনে সুদানের মাটি ব্যবহার করছে। কিন্তু সুদানের রাষ্ট্রপতি ওমর আল-বসিরের সরকার ঘুণাক্ষরেও এটা

আন্দাজ করতে পারেনি যে, ইসরায়েল সুদানে প্রবেশ করে এরকম দুঃসাহসিক অভিযান চালাতে পারে। তাদের সন্দেহের তির ছিল আমেরিকার দিকে। তাই ২৪ ফেব্রুয়ারি সুদানের বিদেশ মন্ত্রক আমেরিকান এমব্যাসির ইন-চার্জ আলবার্তো ফার্নান্ডেজকে আমেরিকার বিভাগগুলোর দায়িত্বে থাকা নাসেরুদ্দিন ওয়ালির সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজধানী খতুমে ডেকে পাঠায়।

‘আমাদের ধারণা, আমেরিকান প্লেনগুলোই এই হামলা চালিয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা করছি! এর জবাব আমরা দেব সঠিক সময়ে! দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার আমাদের আছে এবং যে কোনো মূল্যে আমরা সেটাকে রক্ষা করব,’ ওয়ালি কথাগুলো ফার্নান্ডেজকে শোনালেন।

ফার্নান্ডেজ আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো কথাই বলেননি। তিনি শুধু ওয়ালিকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, সুদানের উদ্বেগ তিনি ওয়াশিংটনকে জানাবেন।

সুদানের আমেরিকাকে সন্দেহ করাটা নিতান্ত অমূলক ছিল না। তার কারণ, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই ফার্নান্ডেজ সুদান সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, ইরান গাজার হামাসকে অস্ত্র পাচার করার জন্য সুদানের এলাকা ব্যবহার করছে এবং সুদান সরকারের এতে প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। তাই সুদান গভর্নমেন্ট ভেবেছিল, হয়তো আমেরিকাই সুদানের বিরুদ্ধে মিলিটারি অ্যাকশন শুরু করেছে।

ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল যখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী অলমার্ট তেল আভিভে একটা সিকিউরিটি কনফারেন্সে ঘোষণা করলেন যে, ইসরায়েল দেশের বাইরে একটা কাউন্টার-টেররিসম অভিযান চালিয়েছে— ‘আমি এর থেকে বেশি বিস্তারিত আর কিছুই বলব না, বাকিটা আপনারা বুঝে নিন। যে জানতে ইচ্ছুক, সে ব্যাপারটা ঠিকই জেনে যাবে… তবে জেনে রাখুন, পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ইসরায়েল অভিযান করতে পারে না।’ সমঝদারকে লিয়ে ইশারা হি কাফি হোতা হ্যায়!

ইসরায়েলের তুলনামূলক ভাবে নতুন একটি মিলিটারি ইউনিটের নাম ‘ম্যাগলান’। তুখোড় একটি ইউনিট! ১৯৮৬ সালে একে গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরে প্রায় প্রায় দুই দশক ধরে দুনিয়াবাসীর কাছে গোপন ছিল এর অস্তিত্ব। ২০০৬ সালে একটা আলাদা ইউনিট হিসাবে ম্যাগলানের নাম প্রকাশ্যে আনা হয়। শত্রুর সীমানায় ঢুকে শত্রুকে ধরাশায়ী করতে ম্যাগলানের জুড়ি মেলা ভার। এই ইউনিটের একজন তরুণ সদস্য ছিলেন অমিত উল্ফ। উল্ফ যত দিন এই ইউনিটে ছিলেন, প্রায় প্রতিদিনই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও দক্ষিণ লেবাননে

হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলত। মিলিটারি সার্ভিস পুরো করার পর উল্ফ এরোস্পেস এঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। পড়া শেষ করার পর উল্ফ ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই)-এর ড্রোন ডিভিশনে যোগ দেন।

মিলিটারিতে সার্ভিস করার সময় থেকেই উল্ফের ইচ্ছা ছিল এমন একটা ড্রোন বানানো যেটা একজন সৈনিক খুব সহজেই নিজের পিঠে বহন করে নিয়ে যেতে পারবে। পাহাড়ি এলাকায় নজরদারির জন্য এই ড্রোনগুলি খুব দরকারি। উল্ফের মাথায় আরেকটা চিন্তা কাজ করছিল। পাহাড়ি এলাকা বা ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় ড্রোন ওড়ানোর জন্য রানওয়ে পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। তাঁর এমন ড্রোন বানানোর ইচ্ছা ছিল, যা রানওয়ে ছাড়াই উড়তে পারে। ২০০৮ সালে উল্ফ একটা কফি শপে বসে তার সহকর্মীদের সঙ্গে এই আলোচনাই করছিলেন। সেখানে বসেই একটা ন্যাপকিনের ওপর একটা নকশা এঁকে দেখালেন। এর কয়েক দিন পর তিনি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট বিভাগের প্রধানের সঙ্গে দেখা করে নিজের পরিকল্পনার কথা শোনালেন। সব ধীরেসুস্থে শোনার পর বিভাগীয় প্রধান প্রাথমিকভাবে ৩০,০০০ মার্কিন ডলার অনুমোদন করলেন এই প্রোজেক্টের জন্য। সেই অর্থ জলে যায়নি। প্রায় দু’ বছর পর আইএআই তৈরি করে ফেলল এমন এক ড্রোন, যা হেলিকপ্টারের মতো উল্লম্ব ভাবে টেক অফ ও ল্যান্ড করতে পারে এবং প্রায় ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় থেকে টার্গেটের ওপর নজরদারি করতে সক্ষম। এটা টানা ছ’ ঘণ্টা আকাশে ভেসে থাকতে পারে। এর নাম দেওয়া হল ‘প্যান্থার’। প্যান্থার এতটাই হালকা যে একজন সৈন্য খুব সহজেই এটাকে অভিযান চলাকালীন পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে। উল্ফ এক দিকে যেমন ছিলেন একজন সৈনিক, তেমনই তিনি একজন এরোস্পেস এঞ্জিনিয়ারও ছিলেন। এই দুইয়ের অভিজ্ঞতারই ফসল হল প্যান্থার।

ড্রোনের আবিষ্কার সবকিছু বদলে দিয়েছে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েলে শুরু হয়েছিল ‘লাভি’ নামে এক প্রোজেক্ট, যার উদ্দেশ্য ছিল ফোর্থ জেনারেশনের মাল্টিরোল, একক এঞ্জিনের এক ফাইটার জেট ডেভেলপ করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতায় চলছিল এই প্রোজেক্ট। কয়েকটি প্রোটোটাইপও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সমস্যা হল, এর খরচ পড়ে যাচ্ছিল আকাশছোঁয়া। ফলে ইসরায়েলি ক্যাবিনেট ১৯৮৭ সালে এই প্রোজেক্ট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন এক প্রচণ্ড বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

আইএআই-এর পক্ষে এই সিদ্ধান্ত এক কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। প্রশ্ন উঠল, এই প্রোজেক্টের কাজে নিযুক্ত কয়েকশো এঞ্জিনিয়ারকে এবার কোথায় নিয়োগ করা হবে?

তাদের নিজের নিজের দক্ষতা অনুযায়ী স্যাটেলাইট, মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ও ড্রোনের প্রোজেক্টগুলোতে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় ড্রোনই ছিল ইসরায়েলের বিকল্প শক্তি।

বলা বাহুল্য, ড্রোনের আবিষ্কার আধুনিক যুদ্ধের পরিভাষাটাই পালটে দিয়েছে। টার্গেটের সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে ড্রোনের কোনো বিকল্প নেই। কারো জীবন ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে ড্রোনের মাধ্যমে অনেক অসম্ভব কাজও করা সম্ভব হয়েছে। ড্রোন হাতে থাকাতে ইসরায়েল শত্রুর চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগার মতো সময় বা সুযোগ ইসরায়েল কখনোই পায়নি। ২০০৬ সালের ১২ জুলাই। ইরানের মদতপুষ্ট হিজবুল্লাহ জঙ্গিরা ইসরায়েলে ঢুকে আইডিএফ-এর দুজন সৈন্যকে অপহরণ করে। ইসরায়েলও জবাবি হামলা চালায়। শুরু হয় দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধ। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলি সেনা হিজবুল্লা জঙ্গিদের শুরুতেই কোণঠাসা করে দেয়। জঙ্গিরা সাদা পোশাকে থাকত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যেত। এর ফলে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে ওঠে। এভাবেই যুদ্ধ চলতে থাকল। এর মধ্যে ১২১ জন ইসরায়েলি সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। ইসরায়েলি সেনা হিজবুল্লাহকে খুব হালকাভাবেই নিয়েছিল। এবার হিজবুল্লাহ বেশ তৈরি হয়েই যুদ্ধে নেমেছিল। লাগাতার ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের আক্রমণের মাঝেও তারা দিনে গড়ে ১২০টা রকেট নিক্ষেপ করছিল। তারা ইসরায়েলি রেডিও সিস্টেম এবং সীমান্ত এলাকার সেলুলার নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছিল। ইসরায়েলের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। যুদ্ধ তখন শেষের দিকে। ইসরায়েলের আকাশে হিজবুল্লা ৩টে ইরানি ড্রোন দিয়ে হামলা চালাল। ড্রোনগুলোতে ২০ পাউন্ডেরও বেশি বিস্ফোরক বহন করছিল। টার্গেটে পৌঁছানোর আগেই এদের মধ্যে দুটো ড্রোন ক্র্যাশ করে আর একটা ড্রোন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গুলি করে নীচে নামায়। এই ঘটনা ইজরায়েল প্রশাসনকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। যে দেশ ড্রোন আবিষ্কার করল, তার ওপরই ড্রোন-হামলা চালাল এক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন! বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম।

২০১২ সালে আবার একটা ড্রোন ইসরায়েলের ভেতরে প্রবেশ করে। ড্রোনটি ডিমোনা শহরের থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে ছিল। ডিমোনা, এখানে ইসরায়েলের নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর রয়েছে। লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগে এটাকেও গুলি করে নামানো হয়। ২০১৪ সালে গাজা স্ট্রিপ থেকে হামাস জঙ্গিরা নাশকতার লক্ষ্যে ইসরায়েলে ড্রোন পাঠাতে শুরু করে। ইসরায়েলের নিজের তৈরি অস্ত্রেই এবার নিজের বিপদ তৈরি হল। হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে ড্রোন পাঠানোর আগে আইডিএফ-এর ধারণা ছিল যে, এই অঞ্চলে ইসরায়েল ছাড়া আর কারো কাছে ড্রোন নেই। আর ইরানের কাছে যদিও বা এক দুটো ড্রোন থেকেও থাকে, তাহলে সেটা ইসরায়েলের ড্রোনের থেকে কয়েক প্রজন্ম পিছিয়ে এবং সেটা ইজরায়েল পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না। এর জন্য তারা ইসরায়েলি রাডারে ড্রোন শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থাই রাখেনি। কিন্তু এই ঘটনার পর ইসরায়েল নতুন রাডার বানাতে শুরু করে ও পুরোনো রাডারগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে।

আরেকটা কাজ ইসরায়েল গোপনে গোপনে করছিল। তা হল হিজবুল্লাহ পার্টিতে ড্রোন নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের ওপর নজর রাখা। হাসান আল- লাক্কিস ছিল হিজবুল্লাহর ড্রোন বিভাগের কমান্ডার ইন চার্জ। ২০১৩ সালে লেবাননের রাজধানী বেইরুটে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লেবাননের রিপোর্ট মোতাবেক দুজন গুপ্তঘাতক পর্যটকের ছদ্মবেশে আল-লাক্কির গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে সাইলেন্সার লাগানো বন্দুক দিয়ে তাকে গুলি করে। হিজবুল্লাহ ইসরায়েলকেই এর জন্য দায়ী ঘোষণা করে। কিন্তু ইসরায়েলের তরফ থেকে এই ঘটনার দায় স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করা হয়নি। কিন্তু হিজবুল্লাহ যাতে কোনোভাবেই ড্রোন ব্যবহার না করতে পারে সেজন্য ইজরায়েল সদা সচেষ্ট এটা নিশ্চিত।

উগ্রপন্থী সংগঠনের হাতে ড্রোন সত্যিই মারাত্মক! সাধারণ রাডারে এর উপস্থিতি ধরা পড়ে না। যদি কোনো দেশের ড্রোন অন্য দেশের ভেতরে প্রবেশ করে তাহলে কি তাকে ফাইটার জেট বা মিসাইল স্ট্রাইকের গোত্রে ফেলা হবে?

২০১২ সালে যখন হিজবুল্লাহ ড্রোন উড়িয়ে ডিমোনার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল, তখন ইসরায়েল এই ঘটনা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। কোনো দেশের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যায়নি তারা। কিন্তু যদি কখনো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শত্রুরা একটা সফল ড্রোন স্ট্রাইক করে ফেলতে পারে, তবে কি ইসরায়েল সেই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে?

সেটা অবশ্য সময়ই বলবে।

ইসরায়েলে গোটা বছরে যতগুলো আকাশযান-উড়ান হয় তার অর্ধেকটাই হল ড্রোনের উড়ান। এর থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় ইসরায়েল ড্রোনের

ব্যবহারকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। পরের কয়েক বছরের মধ্যে পুরোনো এফ-১৫ আর এফ-১৬ বিমানগুলোর জায়গা নেবে ড্রোন। শীঘ্রই শুধু ড্রোনেরই একটা বাহিনী তৈরি করা হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো মানুষই নেবে। রোবটের মতো ড্রোনকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি যে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *