যারা ভোর এনেছিল – ৫

তিন বছরের ফুটফুটে মেয়েটা। পূর্বপুরুষ এসেছিলেন আরব দেশ থেকে, ইসলাম প্রচারের জন্য। ভারতের এই পূর্বাঞ্চলে নদনদীধোয়া পাণ্ডববর্জিত চরাঞ্চলে কেন তাঁরা এসে আস্তানা গেড়েছিলেন, বলা মুশকিল। আশ্চর্য যে পশ্চিম দিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে যাঁরা এসেছেন, পশ্চিমের চেয়ে পুবে, এই পূর্ব বাংলায় তাঁরা তাঁদের প্রচারকাজে বেশি সফল হলেন, পূর্ব বাংলার কৃষকেরা ইসলাম গ্রহণ করল বেশি। এই প্রদেশে মুসলমানেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মেয়েটার নাম রেনু। পূর্বপুরুষের গায়ের ধবধবে সাদা রংটা পেয়েছে সে, আর পেয়েছে চোখের ঈষৎ কটা ভাবটা। গোলগাল চেহারা।

তাদের নিকটতম পূর্বপুরুষদের অবশ্য ব্যবসা ছিল কলকাতায়।

ছোট্ট মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে হাঁটে, আধো আধো কথা বলে, নতুন নতুন শেখা শব্দ বলে সবাইকে উদ্বেলিত করে, মাটিতে বসে কাঠি দিয়ে ছবি আঁকে। উঠোনে মা-মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো মুরগির ছানা আর গোটা পাঁচেক হাঁসের ছানা নিয়ে। হঠাৎ চিলে ছোবল দিয়ে মুরগির ছানা তুলে নিয়ে গেলেই কককক করে ডেকে ওঠে মা-মুরগি। রেনু ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন মা, তাকে কোলে তুলে নেন। মেয়েটির পুতুল খেলারও বয়স হয়নি। তার পায়ে ঘুঙুর বাঁধা, একা একা কোথাও গেলে যেন খুঁজে পাওয়া যায়। উঠোনে মাদুরে তাকে বসিয়ে সামনে একটা কাঁসার বাটিতে কিছু খই দিয়ে রাখলেই সে দিব্যি বসে থাকে। লালা ফেলতে ফেলতে খই তুলে খায়। খায় যত, তার চেয়ে বেশি ছিটায়। মুরগি আর পায়রারা তখন তাকে ঘিরে ধরে।

আর আছে তার খেলার সাথি। তার চেয়ে দুই বছরের বড় তার বোন। বুবু তার মাথার চুল আঁচড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তার নাকের নিচে ঝুলে থাকা সর্দি মুছে দেয় নিজের জামার কোঁচা দিয়ে।

কিন্তু মেয়ে দুটোর জীবনে এক আলোকিত দুপুরে হঠাৎ নেমে এল দুখের কুয়াশা। তাদের বাবা শেখ জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করলেন। রেনু দেখল, উঠোনভরা মানুষ, মেয়েদের মাথায় কাপড়, ছেলেদের মাথায় টুপি। চারদিকে কান্নার রোল। সবচেয়ে বেশি কাঁদছেন মা।

বুবু এসে বলল, ‘রেনু, তুই কেন্দে নে। কানলে বুকটা হালকা হবি।’ বাবাকে উঠোনে গোসল করানো হলো, সাদা কাপড় পরিয়ে তাঁকে একটা খাটিয়ায় তুলে লোকজন কাঁধে করে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলতে বলতে। মা কাঁদছেন, মাথায় বড় ঘোমটা দেওয়া মহিলারা কোরআন শরিফ পড়ছে আর তসবিহ গুনছে। আগরবাতির ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

রেনুর দাদা তখনো বেঁচে। বিষয়-সম্পত্তি তাদের ভালোই ছিল, কিন্তু বাবা মারা গেছেন, দাদা বেঁচে আছেন, এই অবস্থায় নাতি-নাতনিরা দাদার সম্পত্তির কোনো ভাগই পাবে না, এই ছিল আইন। রেনুর মা তাই নিঃস্ব হয়ে যেতে পারতেন। মা এক কাজ করলেন—তিনি দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। রেনুকে বিয়ে দেওয়া হলো একই বংশের শেখ লুৎফরের ছেলে খোকার সঙ্গে। একই বাড়ি তাদের, আলাদা ঘর, তারা নিকট- প্রতিবেশী।

দাদার ছেলে ছিল একটাই। তিনি তাঁর ছেলের প্রাপ্য সম্পত্তির অংশ দুই নাতনির নামে লিখে দিলেন, আর রেনুর সম্পত্তির গার্জিয়ান করলেন বরের আব্বা শেখ লুৎফরকেই।

বিয়ের মর্ম রেনু কী বুঝল, সে-ই জানে!

খোকাই বা কী বুঝল! সে তো ব্যস্ত ছিল তার দুরন্তপনা নিয়ে। ফুটবল খেলত সে। বাবা লুৎফর রহমানও খেলোয়াড় ছিলেন। মাঝেমধ্যে বাবা-ছেলেও নেমে পড়তেন মাঠে। রোগা একরত্তি একটা ছেলে খোকা। ফুটবলে লাথি মারলে ফুটবল নড়ে না, নিজেই উল্টো পড়ে যায়। বাবা হেসেই গড়াগড়ি খান। খোকা রেগে যায়।

বাড়ির কাছে বাইগার নদী। মধুমতী নদীর একটা শাখা। কিন্তু বর্ষাকালে সেই নদীই দুই কূল উপচে যেন সাগর হয়ে যায়। শীতকালে একটা পোষমানা শীর্ণ স্রোতধারা মাত্র। নদীতে সাঁতার কাটা খোকার একটা প্রিয় কাজ।

মা খুব নিষেধ করতেন খোকাকে, ‘নদীতে যাস নে খোকা।’ তাঁর মনে ভয়, কখন কী হয়ে যায়! দুই মেয়ের পরে তাঁর এই ছেলে। ছেলে বাড়িতে কুকুর পোষে। সারাক্ষণ ভুলু তার পায়ে পায়ে ঘুরছে। খোকা একদিন একটা বানরের বাচ্চা ধরে নিয়ে এল কোত্থেকে। কী? না, সে বানর পুষবে। ছোট বোন হেলেনের দায়িত্ব বানরকে দেখাশোনা করা। খোকা পড়ে গ্রামেরই স্কুলে। গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। বাড়ির এক পাশে খালের ওপরে বড় কাচারিঘর। তার পাশে মাস্টার, পণ্ডিত আর মৌলভি সাহেবদের থাকার ঘর। দুরন্তপনা করে বেড়ালেও খোকার মুক্তি নাই। মাস্টার পড়ান ইংরেজি আর অঙ্ক, পণ্ডিত পড়ান বাংলা আর মৌলভি পড়ান আরবি।

ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে খোকাদের শেখবাড়ি। পূর্বপুরুষেরা কোঠাবাড়ি বানিয়েছিলেন। নদীপথে ইট, কাঠ আর মিস্ত্রি এসেছিল কলকাতা থেকে। সেই দালানটায় এখন আর কেউ থাকে না। খোকাদের বাড়িটা পাকা। সুন্দর ছিমছাম ঘরের সঙ্গে ছোট্ট বারান্দা। উঠোন পেরিয়ে দূরে খোলার ওপরে কাচারিঘর। চারদিকে আম- জাম-তাল-সুপুরিগাছের ঝাড়, বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়।

বাড়ি থেকে স্কুল মাইল খানেক দূর। নৌকায় চড়ে খোকা স্কুলে যায়। প্রথমে খাল, তারপর বাইগার নদী। একদিন নৌকা গেল ডুবে, বই- খাতাসমেত খোকা ভাসতে লাগল, কিন্তু বই সে ছাড়বে না। মাঝি তাকে কোলে তুলে নিয়ে তীরে উঠল। ভেজা জামায় আর স্কুলে যাবে কী। ফিরিয়ে আনা হলো বাড়িতে। দেখে মা অস্থির। রোজ এই ছোট নৌকায় স্কুলে যাওয়া। ভাগ্যিস এখন নদীতে পানি কম, স্রোতও নাই। বর্ষাকালে হলে মাঝি নিজেকে সামলাত, নাকি খোকাকে বাঁচাতে যেত! না, স্কুল বদলাও।

খোকার বাবা শেখ লুৎফর রহমান চাকরি করেন গোপালগঞ্জে।

গোপালগঞ্জ কোর্টের সেরেস্তাদার। ছেলেকে তিনি ভর্তি করালেন গোপালগঞ্জ সীতানাথ একাডেমিতে। তৃতীয় শ্রেণীতে। বাবার সঙ্গে গোপালগঞ্জেই থাকে খোকা। মাঝেমধ্যে বাড়ি আসে। এসেই প্রথমে খোঁজ করে কেমন আছে তার কুকুর, কেমন আছে পোষা বাঁদরটি। এই সব নিয়েই যখন সে ব্যস্ত, তখনই একদিন বাবার হাত ধরে বাড়ি ফেরা। আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন মা। ওই যে খাল থেকে উঠে আসছে খোকার বাবা আর খোকা।

হঠাৎ বাড়ি আসা কেন?

‘খোকা, তোর বিয়ে।

কী বুঝেছিল খোকা তখন? বিয়ে কী? কার সাথে বিয়ে?

‘রেনুর সাথে। তোর জহুর চাচার মেয়ে।’

খোকাকে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরানো হলো। মাথায় পরানো হলো কিস্তি টুপি। খোকা চলল বিয়ে করতে। একই বাড়ি। হেঁটেই চলল বরযাত্রী। মৌলভি এলেন। কনে বসে আছে শাশুড়ির  ালে। কবুল বলো, মা, কবুল বলো। অতটুকু মেয়ে কবুল বললেই কী, না বললেই কী। কনের অভিভাবক রাজি থাকলেই হলো।

মৌলভি সাহেব দরুদ শরিফ পড়তে লাগলেন। তারপর দায়া। ভেতরবাড়িতে খবর পাঠাও। এখন মোনাজাত হবে। মহিলারা অ পুরে বসে দুই হাত তুলে মোনাজাতে শামিল হলো। টুপি পরে বসে ছি। বর। তার হাতে কে যেন ধরিয়ে দিয়েছিল রুমাল। সেটা মুখে চেপে রেখেছিল সে। মোনাজাতের সময় সে মুশকিলে পড়ল। এক হাতে রুমাল ধরে এক হাতে মোনাজাত করবে? নাকি মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে দুই হাতে মোনাজাত করবে?

শেষে সে দুই হাতই মুখের কাছে এনে রুমালসমেত মুখটা ঢেকে রাখল।

আমিন।

বাবা বললেন, ‘খোকা, দাঁড়িয়ে সবাইরে সালাম দ্যাও।’

খোকা দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘এই তবারক দ্যাও। তবারক।’

খোরমা বিতরণ করা হলো সমবেতদের মধ্যে।

ব্যস, বিয়ে হয়ে গেল।

‘বউরে কোলে ন্যাও। বউরে কোলে ন্যাও।’ পরের দিন রেনুকে কোলে করে এনে একজন উঠোনে খুঁজে বের করলেন খোকাকে। ‘কই থাকো তুমি, তোমারে পাই না।’ ভাবিগোত্রীয় তরুণীটি হাসিতে ঢলে পড়ছেন। ‘দুলারে আমি আর রেনু বলে কত খুঁজলাম। ল রেনু, দুলার কোলে উঠ।’

‘যাও।’ খোকা লজ্জা পায়। বউকে সে কোলে নেবে না।

নেবে না বললেই হলো! তার কোলে রেনুকে চাপিয়ে মহিলা দূরে সরে যান। খিলখিল করে হাসতে থাকেন।

খোকা কী করবে এখন। বাচ্চাটাকে নামিয়ে দেবে?

বিকেলে আবার নৌকায় উঠে গোপালগঞ্জ যাত্রা। প্রতিবার গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার সময় খোকার মন খারাপ লাগে। মাকে ছেড়ে যেতে হয়। মায়ের শাড়িতে একটা আশ্চর্য গন্ধ আছে। সেইটা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তার ওপর তার পোষা প্রাণীগুলো তাকে দেখলেই কেমন করে। ভুলু নামের কুকুরটা তো তার পিছে পিছে ঘোরে। তার গায়ের গন্ধ শোঁকে। যেন বলতে চায়, এত দিন আমাদের ছেড়ে কোথায় ছিলে?

আর মা? মা যে কী করেন তাকে পেলে! কী যে ব্যস্ত হন! আগে গ্রামের স্কুল থেকে সে যখনই আসত, প্রথমেই পিঁড়িতে বসে কাঁসার বাটিতে এক বাটি দুধ খেতে হতো ভাত দিয়ে। সঙ্গে গুড় অথবা কলা। গুড় মাখলেই দুধ লাল হয়ে যায়। এখন গোপালগঞ্জে দুধ পাওয়া যায় কি না, সেই দুধ খাঁটি কি না, এই সব নিয়ে মা যে কত প্রশ্ন করেন!

আজ শুধু মা নয়, এই গ্রামের খেলার সাথি নয়, নয় শুধু পোষা প্রাণীগুলো; তার খুব মনে পড়ছে রেনুর কথা। ছোট বাচ্চা একটা। কেমন করে তার কোলে উঠে তার চুল টেনে দিয়েছিল।

নৌকায় উঠে বসে আছে খোকা। পাশে বাবা। নৌকা চলছে। লগি ঠেলছে বিমল মাঝি। পানি দুভাগ করে নৌকা এগিয়ে চলেছে। খালের পাড়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে আছে বোনেরা। আর দাঁড়িয়ে আছেন চাচি। গতকাল থেকে তার শাশুড়ি তিনি

চাচি কোলে রেনুকে নিয়ে এলেই তো পারতেন। বাড়িতে রেনু কার কাছে?

খোকা আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ। সে নিচে তাকায়। জলে তার ছায়া পড়েছে। পানির পোকা লকলকিয়ে ছুটে যাচ্ছে পানির ওপর দিয়ে, তিরতির করে কাঁপছে পানি। সে নৌকার পাটাতনে বসে হাত বাড়িয়ে পানি ছোঁয়। একটা কলমিলতার পাতা ছিঁড়ে নেয়। বাবা বলেন, ‘বেশি ঝুঁকে বইসো না খোকা। পানিতে পড়ে যাবানে।

বাবার কথা খোকার কানে ঢোকে, মনে ঢোকে না।

আজ তার গোপালগঞ্জ যেতে ইচ্ছা করছে না।

.

রেনুর দুখের দিন ফুরোয় না।

দুই বছর পর তার মা-ও মরে যায়।

বাবা যখন মারা যান, তখনকার কথা তার কিছুই মনে নাই। কিন্তু মায়ের মৃত্যুটা সে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারে। মা আর আসবেন না। মা মরে গেছেন। তার বুবু তাকে বোঝায়। বাড়িময় কান্না। চাচিরা, খালারা এসে তাকে কোলে নিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ সে আর বুবু সবার মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে পড়েছে।

মাকে গোসল করানো হয় চাদরঘেরা একটা জায়গায়, উঠোনের এক কোণে। গাছের নিচে। মাকে নিয়ে যাচ্ছে খাটিয়ায় করে। আগরবাতির ধোঁয়া পেরিয়ে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দুই বোন সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

তাদের চোখে জল।

আত্মীয়ারা বিলাপ করছে। মুরব্বিরা ধমক দেন, ‘মাইয়া মাইনষের গলা বাইরে যায় ক্যান। জানো না, কানলে মুর্দার কষ্ট হয়। আল্লাহ- রসুলের নাম লও। দোয়া-দরুদ পড়ো।’

রেনুর পিঠে হাত। সে পেছনে তাকায়।

দুলার মা। তারও মা। সায়রা বেগম, তার শাশুড়ি তাকে কোলে তুলে নেন। তারপর সোজা নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে।

রেনু শাশুড়ির কাঁধে মুখ লুকায়। তার ভারি কান্না পায়। কিন্তু সে মাকে না ডেকে বাবাকে ডাকতে থাকে ‘বাবা বাবা’ বলে। হয়তো তার মায়ের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে, বাবার মুখটাও ধূসর হয়ে এসেছে, শাশুড়ির কোলে উঠে মায়ের মৃত্যুদিনে তাই সে বাবাকে ডাকছিল। সায়রা বেগম নিজের চোখের জল সামলানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলেন, ‘আমিই তোর বাবা, রেনু রে, আমিই তোর বাবা।’

খোকা আসে মাঝেমধ্যে গোপালগঞ্জ থেকে। এলেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা খালপাড়ে ভিড় করে। রেনুর কাছে খবর নিয়ে আসে শেফালি, বুলি, জরিনারা। দুলা এসেছে। দুলা এসেছে। রেনু বুঝত না যে তাকে খবরটা কেন বিশেষভাবে দেওয়া হচ্ছে। সে-ও ছুটে যেত নদীর ধারে, কিংবা তার ‘বাবা’ সায়রা বেগমের কাছে, তার হলুদের গন্ধমাখা আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলত, ‘বাবা, দুলা এসেছে।’

দুলা বাড়িতে নেমে জুতা-স্যান্ডেল ছুড়ে মেরে মায়ের হাতে দুধভাত খেয়ে প্রথমে যেত বাঁদরটার কাছে। ভুলু তো আগেই তার পায়ে পায়ে ঘুরতে শুরু করেছে। তারপর পাড়াটা ঘুরে এসে বন্ধুবান্ধবের খবর নিয়ে ঝিমধরা বিকেলে তারা কাচারিঘরের চৌকিতে শুরু করত পুতুল খেলা।

পাড়ার ছেলেমেয়েদের দলের এই খেলায় পুতুলের বিয়ে হতো। ছেলেপুতুল মেয়েপুতুলের মা-বাবা সাজত ছেলেমেয়েরাই। খোকাও সেই খেলায় মেতে উঠত ।

হঠাৎ কী একটা ব্যাপারে রেনুর ওপরে রাগ করল খোকা। তাকে একটা আলতো করে ধাক্কা দিতেই সে গাল ফুলিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল, ‘দুলা আমারে মেরেছে। দুলা আমারে মেরেছে। বাবা বাবা, দেখো’—বলে সে সোজা চলে গেল তার শাশুড়ি সায়রা বেগমের কাছে।

‘কী হয়েছে রে, মা। কান্দিস ক্যান?’

‘দুলা আমারে মেরেছে।’

সায়রা বেগম হাসি গোপন করে মুখটা গম্ভীর করে তুলে বলেন, ‘খোকার তো সাহস বড় কম নয়। আমার মায়ের গায়ে হাত তোলে। খোকা খোকা… ‘

খোকা আসে। ‘মা, ওরে আমি মারি নাই, মা। ও বানায়ে বলে। ‘না, মারিস নাই। ও বানায়ে বলে। না মারলে ও কান্দে ক্যান?’

‘আরে, একটু হাত দিয়ে সরায়ে দিতে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে কানতে শুরু করেছে।’

‘না, মারবি না। দেখি পিঠটা।’ খোকা পিঠ এগিয়ে দিলে মা তার পিঠে নিজের হাতটা রেখে সেই হাতে চড় মারেন। মারের শব্দ হয়। রেনু তাতেই খুশি। চোখের জল সামলে মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে। সায়রা বেগম বলেন, ‘হয়েছে? খুশি এখন?’

‘হুঁ,’ জামা সামলাতে সামলাতে রেনু বলে।

‘এখন এসো, হাতমুখ ধোও। দুধভাত দিই। খাও।’

দুজনে পিঁড়ি পেতে বসে রান্নাঘরে। মা দুজনের সামনে দুটো কাঁসার বাটিতে দুধ দেন। দুধের পাতিলে সর ভাসছে। তিনি সরটা তুলে দুভাগ করে দুজনের মুখে পুরে দিতে চামচ বাড়ান। খোকা মুখ ফিরিয়ে নেয়। রেনু সর খেতে পছন্দ করে। সে দিব্যি খেয়ে নেয়।

গুড়ের কৌটায় পিঁপড়া উঠেছে। রেনুর দুধের বাটিতে পিঁপড়া সাঁতার কাটছে। রেনু বলে, ‘দুলা, দেখো কী?’

‘কী?’

‘পিঁপড়া।’

খোকা বলে, ‘মা, একটা চামচ দ্যাও তো। পিঁপড়াটা তুলি।’ তার নাকের নিচে দুধের গোঁফ।

চামচ দিয়ে পিঁপড়া তোলা বড় মুশকিল। ভাসমান পিঁপড়ার নিচে চামচ ধরে দুধটা তুলতে পিঁপড়াটা ঠিক পড়ে যায়। খোকা কয়েকবার চেষ্টা করে। পারে না রেনুর পাতের পিঁপড়াটা তুলতে। শেষে বলে, ‘খাও একটা পিঁপড়া, সাঁতার শিখতে পারবা।’

মা হাসেন। দুটো ক্ষুদ্র হৃদয়ের এই সব সামান্য কাণ্ডকীর্তি তাঁর মাতৃহৃদয়ে এক অপার্থিব মায়ার সঞ্চার করে। তিনি মনে মনে প্ৰাৰ্থনা করেন, আল্লাহ এদের বাঁচায়ে রাখুক।

.

খোকার বয়স ১৪। গোপালগঞ্জ থেকে বাবা বদলি হয়েছেন মাদারীপুরে। ছেলেকেও বাবা নিয়ে চললেন তাঁর সঙ্গে। মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে সে ভর্তি হয় ক্লাস ফোরে। বাবার কাছে থেকে সে স্কুলে যায়। বাবার আশা, ছেলে বড় হয়ে আইনজীবী হবে। আদালতের সেরেস্তাদার বাবা দেখেন, উকিলদের বড় সম্মান, বড় প্রতিপত্তি। আল্লাহর রহমতে ছেলে তাঁর এই রকম কোনো ডাকসাইটে উকিল যদি হতে পারে, তাঁর মনের সাধ পূর্ণ হয়। ছোট ছেলে নাসের তো এখনো ছোট। তার মধ্যে ছোটবেলায় নাসেরের পোলিও হয়েছিল, একটা পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছেলেটা খুঁড়িয়ে হাঁটে। তার জন্যও বড় মায়া হয় লুৎফর রহমানের।

খোকা পড়তে পারছে না। বলে, ‘বাবা, বই পড়তে পারি না। সবকিছু ঝাপসা দেখি।’ এ অবস্থায় কিসের লেখা, কিসের পড়া। বাবা মাদারীপুরের সবচেয়ে বড় চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। নানা ওষুধপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু ছেলের চোখের জ্যোতি দিন দিন যেন কমেই যাচ্ছে। আশপাশে যেখানে যে ডাক্তারের নাম শোনেন, বাবা তাঁর কাছেই নিয়ে যান ছেলেকে। কোনো লাভ হয় না।

ডাক্তাররা বলেন, ‘ছেলের বেরিবেরি হয়েছে। তাকে বেশি করে ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল খাওয়ান। ভিটামিন বি-এর অভাবে এই রোগ হয়। সেখান থেকে নার্ভের সমস্যা হতে পারে।’

ছেলেকে বাড়ি নিয়ে আসেন তিনি। আপাতত বাড়িতেই থাকুক। বাড়িতে সব সময় ঢেঁকিছাঁটা চালই খাওয়া হয়। এই কদিন গোপালগঞ্জ-মাদারীপুর করেই ছেলের শরীরটা গেছে।

রেনুর বয়স সাত বছর। রেনু এখনো বোঝে না, দুলা মানে কী। তবে দুলার শরীরটা ভালো না, এখন তার যত্নের প্রয়োজন, ওইটুকুন মেয়ের সেই উপলব্ধিটা ঠিকই আসে। কোত্থেকে আসে, আল্লাহ মালুম। সে দুলার কাছে যায়। নিজের জামার খুঁট কামড়ে ধরে বলে, ‘দুলা, তোমার কী হয়েছে?’

‘আমার? না, কিছু হয় নাই।’

‘তাইলে যে সবাই কয় তোমার অসুখ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, হয়েছে। লাল চাউল খাওয়ার অসুখ।’

‘হি হি হি। সেইটে কী ধরনের অসুখ?’

‘এই অসুখ হলে খালি লাল চাউল খেতে হয়।’

‘তুমি আর যাবা না নে?’

‘কোথায়?’

‘মাদারীপুর?’

‘না। আপাতত বাড়িতেই থাকব। বাড়িতে থাকব আর হামিদ মাস্টারের কাছে পড়ব।’

‘আমিও মাস্টারের কাছে পড়ব।’

‘না, তুমি পড়বা আমার কাছে।’

গৃহশিক্ষক আবদুল হামিদ ছিলেন অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। স্বদেশি করতে গিয়ে জেল খেটেছেন। হামিদ মাস্টার খোকাকে পড়াতেন। খোকার চোখ খারাপ। কাজেই যতটা না পড়ত, তার চেয়ে বেশি শুনত গল্প। হামিদ মাস্টার তাকে শোনাতেন মাস্টারদা সূর্য সেনের গল্প, তিতুমীর আর ক্ষুদিরামের গল্প।

খোকা জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার, জেলে তো যায় চোর-ডাকুরা। আমরা চোর-দারোগা, বাবু বাবু খেলি না! আপনি স্যার জেলে গিয়েছিলেন? আপনার খারাপ লাগে না?’

হামিদ মাস্টার বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান, শোনো, দেশের জন্য যদি কেউ পুলিশের হাতকড়া পরে, বুঝবা দেশমাতা তাকে গলায় ফুলের মালা পরাবেন। দেশের জন্য জেলে যাওয়া গৌরবের ব্যাপার

হামিদ মাস্টার খোকাকে ডাকেন পুরো নাম ধরে।

‘এই যে সূর্য সেনের ফাঁসি হয়ে গেল, সূর্য সেন কি চোর ছিলেন? তিনি হচ্ছেন বিপ্লবী। ফাঁসির আগে তিনি কী বলে গেছেন? বলেছেন, ‘মৃত্যু আমার দরজায় কড়া নাড়ছে। আমার আত্মা উড়ে যাচ্ছে অনন্তের দিকে, আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব আমার প্রিয়তম বন্ধুর মতো, এই সুখী, পবিত্র, কঠিন মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি? একটামাত্র জিনিস। আমার স্বপ্ন। আমার সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন। প্রিয় বন্ধুরা, সামনে এগিয়ে চলো। পিছনে ফিরবে না। ওই যে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার আলোকরশ্মি। জাগো, হতাশার কাছে হার মেনো না। জয় আমাদের হবেই।’ শোনো শেখ মুজিবুর রহমান, যে মরতে ভয় পায় না, তাকে কেউ হারাতে পারে না। জয় তার হবেই।’

খোকার ছানি পড়া চোখ চকচক করে ওঠে, সে মেরুদণ্ড সোজা করে নড়েচড়ে বসে। তার চোয়াল শক্ত হয়।

হামিদ মাস্টার ক্ষুদিরাম বসুর গল্প করেন। ১৮ বছরের বালক কী করে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিল। তার জন্য আজ কবিরা গান লিখেছেন, হামিদ মাস্টার কেশে গলা পরিষ্কার করে গাইতে থাকেন, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।’

এই গানের সুর খুবই করুণ আর মর্মস্পর্শী। হামিদ মাস্টার গাইছেন ও খুবই দরদ দিয়ে। বালক শেখ মুজিবের চোখে জল আসে। তার মনে হয়, সে-ও যদি যোগ দিতে পারত বিপ্লবীদের দলে, এমনি করে দেশমাতার জন্য যদি সে-ও ফাঁসিতে ঝুলতে পারত…

অনেক পরে, একাত্তর সালে, পাকিস্তানের কারাগারে যখন শেখ মুজিবের গোপন বিচার অনুষ্ঠিত হবে ইয়াহিয়ার সামরিক আদালতে, রায়ে তাঁর জন্য বরাদ্দ হবে মৃত্যুদণ্ড। তাঁর সেলের পাশে কবর খোঁড়া হতে থাকবে আর তাঁকে চাপ দেওয়া হতে থাকবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ভুল স্বীকার করে পাকিস্তানিদের বশ্যতা স্বীকারমূলক একটা বিবৃতিতে স‍ই দিতে। তিনি তা দিতে অস্বীকার করবেন। মৃত্যুভয় ও কারাবাসের ভয় তাঁর কোনো দিনও ছিল না। তিনি বলবেন, ‘আমি ক্ষমা চাইব না। তোমরা আমাকে ফাঁসি দিতে পারো, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, জয় বাংলা। শুধু একটাই অনুরোধ, মৃত্যুর পর আমার দেহটা বাংলাদেশের মাটিতে পৌঁছে দিয়ো…..’

না, বেরিবেরির চিকিৎসায় খোকার চোখের উন্নতি হয় না, বরং পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকে। তখন শেখ লুৎফর রহমান ছেলেকে নিয়ে যান কলকাতায়, কলকাতা মেডিকেল কলেজের চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডাক্তার টি আহমেদ তাঁর চোখের ছানি অপারেশন করেন। খোকা আবার সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে শুরু করে, তবে চশমা জিনিসটা তার জীবনের চিরসঙ্গী হয়ে যায়।

তিন বছর পর খোকাকে আবার ভর্তি করা হয় স্কুলে, এবার গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে, ক্লাস ফাইভে। শেখ লুৎফর রহমানও বদলি হয়ে এসেছেন গোপালগঞ্জে। ছেলের বয়স বেশি। সহপাঠীরাও তাকে ভাই বলে ডাকে। তাতে তার নেতাগিরি করতে সুবিধাই হয়।

মজার ব্যাপার হলো, একই স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয় রেনু। তার ভালো নাম শেখ ফজিলাতুন্নেছা।

খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফলে বালক মুজিবের দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত হয়। সে বুঝতে শেখে, পৃথিবীতে ধর্ম অনেক রকম—কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ বা খ্রিষ্টান; কিন্তু সবাই আসলে মানুষ। সবারই ক্ষুধা পায়, তৃষ্ণা পায়। আনন্দে সবাই হাসে, দুঃখে কাঁদে। সূর্য সবাইকে সমান আলো দেয়, মেঘ দেয় সমান বৃষ্টি। সৃষ্টিকর্তা মানুষে-মানুষে ভেদ করেন না।

মুজিব এইবার ভালো করতে থাকে ফুটবলে। তিন বছর মায়ের কাছে খেয়ে আর বসে থেকে থেকে তার স্বাস্থ্যটা আগের চেয়ে ভালো। পায়ে জোর হয়েছে। এবার আর ফুটবল লাথি দিয়ে পড়ে যায় না।

পরে মুজিব গোপালগঞ্জের একজন কৃতী ফুটবলার হয়ে উঠেছিলেন।

একদিন মুজিব ফিরছে প্রাইভেট পড়ে। তার স্কুলের শিক্ষক রসরঞ্জন সেনগুপ্তের বাড়িতে গিয়ে প্রাইভেট পড়ে সে। তখন শীতকাল। ভীষণ শীত পড়েছে। মুজিবের পরনে লুঙ্গি, গায়ে শার্ট, তার ওপরে চাদর। পথে সে দেখতে পেল, একটা বালক, তার চেয়েও কম বয়সী হবে, তার পরনে শুধু শতচ্ছিন্ন একটা নেংটি, গায়ে কিছুই নাই। মুজিব করল কি, চটপট কোমরে জড়িয়ে নিল চাদরটা। পরনের লুঙ্গি খুলে দিল ছেলেটার হাতে। লুঙ্গি দেওয়ার পরও ছেলেটার গা খালি। কী যে ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া বইছে! মুজিব দেখল, তার চাদর দিয়ে নিজের শরীরের ঊর্ধ্বাংশও বেশ ঢাকা চলে। সে গায়ের শার্টটাও খুলে ফেলল। ছেলেটাকে নিজ হাতে লুঙ্গি আর শার্ট পরিয়ে দিল সে। তারপর কায়দা করে গায়ের চাদর দিয়ে পুরোটা শরীর ঢেকে সে ফিরে এল বাসায়।

ছেলের ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে বাবা শেখ লুৎফর রহমান ঘরের বাইরে পায়চারি করছেন। মা তখন গোপালগঞ্জে ছিলেন। তিনি বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় দেখেন, ছেলে আসছে। ‘এই, তোমার কী অবস্থা? চাদর এইভাবে পরে আছ ক্যান?। শাড়ির মতো কইরে?’

মুজিব মা-বাবাকে খুলে বলে সব।

বাবা বলেন, ‘দিয়েছ, ঠিক করেছ। তবে লুঙ্গি-শার্ট না দিয়ে গায়ের চাদরটা দিলেও তো পারতা?’

মুজিব বলে, ‘আমার লুঙ্গি-শার্ট আরও আছে। গায়ের চাদর তো একটাই।’

বাবা বলেন, ‘দান করে দিলে কিনাই তো দিতাম।’

শেখ মুজিব মাঝেমধ্যে টুঙ্গিপাড়ায় আসেন। এসে দেখেন, হামিদ মাস্টার একটা ছোটখাটো সংগঠন গড়ে তুলছেন। সেটাকে বলা হয় ধর্মগোলা। ধান কাটার মৌসুমে সচ্ছল কৃষকদের কাছ থেকে ধান, চাল ইত্যাদি সংগ্রহ করে আকালের জন্য রেখে দেওয়া। তারপর যখন অভাব পড়ে গ্রামে, গরিব মানুষের ঘরে খাবার থাকে না, পকেটে কানাকড়িও থাকে না, তখন ওই ধর্মগোলা থেকে তাদের মধ্যে খাদ্যসাহায্য বিতরণ করা হয়। মুজিবও লেগে পড়েন এই কাজে। মাস্টারের সহকারী হিসেবে তিনিও ঘুরতে থাকেন বাড়ি বাড়ি। সংগ্রহ করতে থাকেন ধান-চাল।

ধর্মগোলার কথা এলে আমাদের মনে পড়ে যাবে আরও একজনের কথা, যিনি মুজিবকে ভালোবাসেন, যিনি মুজিবকে চেনেন সেই ১৯৪৪ সাল থেকে, এবং তাঁকেই ভালোবেসেছেন দেশের চেয়েও অধিক দেশ ভেবে। তাজউদ্দীন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা, অনাহারে অগুনতি মানুষের মৃত্যু, ক্ষুধিত মানুষের সার সার নীরব মিছিল, পথের ধারে কুকুর-বেড়ালের মতো পড়ে থাকা লাশ অথবা জ্যান্ত কঙ্কাল তাজউদ্দীনকে নাড়া দিয়েছিল খুব। তিনিও তাঁর নিজ গ্রাম দরদরিয়ায় ফিরে গিয়ে স্থাপন করলেন ধর্মগোলা, ধনীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করলেন ধান-চাল, রেখে দিলেন আগামী বছরের আকালের মৌসুমের জন্য।

তাঁদের চিন্তার সাযুজ্য তাঁদের কাছে আনতে থাকবে, যে নৈকট্য ভবিষ্যতে রচনা করবে বাংলাদেশের জন্মমুহূর্ত।

.

মুজিবের বয়স ১৮। রেনুর ১১। এবার তাঁদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে দিতে হয়। লুৎফর রহমান দিনক্ষণ ধার্য করেন। এক শুভদিন দেখে টুঙ্গিপাড়ার আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। তত দিনে রেনু ক্লাস ফাইভ পাস দিয়ে ফেলেছেন। এখন শাড়িই তাঁর একমাত্র পোশাক। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রের বই এখন তিনি তড়তড়িয়ে পড়তে পারেন। শুধু পড়তে পারেন তা না, এই সব তাঁর খুব প্রিয়ও হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছে আরও একটা জিনিস, তার নাম পান।

রেনু খুব ভালো পান সাজাতে পারেন। আস্ত একটা খিলি মুখে দিয়ে খানিকটা চিবিয়ে যখন পানের বোঁটা থেকে চুন জিবে লাগান, দেখে মনে হয় একেবারেই পাকা গৃহিণী।

মুজিব বলেন, ‘আমাকে একটা খিলি সাজিয়ে দ্যাও দেখি।’

দুলা পান চেয়েছে। যত্ন করে পান সাজান রেনু।

মুজিব বলেন, ‘আমারে দুটো পান, ডবল সুপারি দ্যাও। খালি চুনটা কম দিবা। আমার সবকিছুই চাই ডবল ডবল।’

রেনু দ্বিগুণ আনন্দে বরের জন্য ডবল পান সাজান। কিন্তু তাতে চুন দেন চার গুণ।

‘কী করো? ভিতরে যে চুন দিয়া চুনকাম করে ফেললা?’

‘তোমার না সবকিছু ডবল। আমি তো এমনিতেই চুন বেশি দেই, তোমার জন্য চার ডবল দিছি।’

বিয়ে হলো বটে, কিন্তু এখনই একসঙ্গে থাকা হচ্ছে না দুজনের। মুজিব আবার ফিরে গেলেন গোপালগঞ্জে, মিশনারি স্কুলে। পড়াশোনা চলছে, প্রাইভেটও পড়ছেন, কিন্তু পড়ার চেয়ে তাঁর মন বেশি পড়ে থাকে বাইরে। রাজনীতিতে। তাঁর গৃহশিক্ষক আবদুল হামিদের মুখে শোনা বিপ্লবীদের বীরত্বগাথা তাঁর রক্তে বাজে। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে। ইংরেজ তাড়াতে হবে। মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছে। গোপালগঞ্জেও আছে তার মহকুমা অফিস। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ফিরে এসেছেন ইংল্যান্ড থেকে, মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াকত আলী খান তাঁকে জোর করে ফিরিয়ে এনেছেন ভারতবর্ষের মুসলিমদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। গত বছর প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ ভালো করেছে। নেহরু মুসলিম লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চুক্তি করেছেন। মুজিব মুসলিম লীগের গোপালগঞ্জ অফিসে যেতে শুরু করলেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এটা-ওটা কাজ করেন। পার্টির যেকোনো কাজের ডাক পড়লেই হলো, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। শিগগিরই তাঁকে মুসলিম লীগ গোপালগঞ্জ শাখার নিরাপত্তাবিষয়ক সম্পাদক পদে ভূষিত করা হলো।

এরই মধ্যে তিন-তিনবার তাঁকে পুলিশ ধরেছে।

প্রথমবার ধরেছে গোপালগঞ্জের মেলা থেকে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় মিলেমিশেই শুরু করেছিল মেলা। কিন্তু মেলার আধিপত্য নিয়ে গন্ডগোল লেগে গেল উদ্যোক্তাদের মধ্যে। অচিরেই সেটা আকার পেল সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের। এই বুঝি দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি বেধে যায়। সদা প্রস্তুত মুজিব ছুটলেন তাঁর অনুগত ছাত্র-যুবাদের নিয়ে। হাতে লাঠি। কেউ মারামারি করতে পারবে না। হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। দাঙ্গা থেমে গেল।

কিন্তু দাঙ্গায় যারা উসকানি দিচ্ছিল, দু-চারটা লাঠির বাড়ি খেয়ে তারা গেল খেপে। তারা মুজিবুর রহমানের নামে মামলা ঠুকে দিল থানায়।

মুজিব তখন তাঁর গোপালগঞ্জের বাসায়। স্কুল থেকে সবে ফিরেছেন। তাঁর বন্ধুরাও তাঁর সঙ্গে। চুলোর ওপরে হাঁড়িতে দুধ ছিলই, শেখ লুৎফর রহমান জানেন, ছেলে দুধভাত খায় স্কুল থেকে ফিরে, আসার সময় বন্ধুবান্ধবদেরও ধরে আনে। সবাই মিলে কেবল দুধের বাটি নিয়ে পিতা বসেছেন, অমনি বাড়ি ঘিরে ফেলল পুলিশ। শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ লুৎফর রহমান, আপনার বিরুদ্ধে পরোয়ানা আছে, আপনি গ্রেপ্তার।

বাড়িতে খবর গেল। ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।

মা সায়রা বেগম বিলাপ করতে শুরু করলেন, ‘পোলা আমার সবই হামিদ মাস্টারের কাছে শিখেছে, হামিদ মাস্টারও জেলে ছিল, আমার পোলারেও জেলে নিল। আমি তখনই কইছিলাম, স্বদেশি করে, এই রকম মাস্টার রাখার দরকার নাই।’

সাত দিনের জেল হলো মুজিবের। তাঁর জীবনের প্রথম কারাদণ্ড। মুক্তি পেয়ে এলেন বাড়িতে। রেনু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী চুরি করেছ যে তোমারে জেলে নিল?’

‘চুরি করি নাই, রেনু। মানুষের উপকার করতে গিয়েছিলাম। হিন্দু- মুসলমানে মারামারি-কাটাকাটি করতে নিয়েছিল, আমি সেইটা থামাতে গিয়েছিলাম।’

‘তাইলে তোমারে ধরল ক্যান?’

‘এইটারে কয় পলিটিকস। তুমি সূর্য সেনের গল্প শুনো নাই, ক্ষুদিরামের গল্প? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম শুনো নাই? আমাদের হামিদ মাস্টারের কথা জানো না? দেশের যারা ভালো চায়, তাদেরকে জেলে যেতে হয়। সূর্য সেন কী বলেছেন, “মৃত্যু আমার দরজায় কড়া নাড়ছে। আমার আত্মা উড়ে যাচ্ছে অনন্তের দিকে, আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব আমার প্রিয়তম বন্ধুর মতো, এই সুখী, পবিত্র, কঠিন মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি? একটামাত্র জিনিস। আমার স্বপ্ন। আমার সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন। প্রিয় বন্ধুরা, সামনে এগিয়ে চলো। পিছনে ফিরবে না। ওই যে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার আলোকরশ্মি। জাগো, হতাশার কাছে হার মেনো না। জয় আমাদের হবেই”।’ মুজিব যেন যাত্রার পার্ট গাইছেন, বাক্যের তোড়ে ভেসে যাচ্ছেন, নিজেই হয়ে উঠেছেন সূর্য সেন।

‘তুমি যে গেলা লাঠি নিয়ে মারামারি থামাতি, তোমার মাথায় যদি একটা বাড়ি মারত লাঠি দিয়ে?’ রেনু আঁচলে নাকের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন।

মুজিব তাঁর পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে জবাব দেন, ‘শুনো রেনু, যে মরতে ভয় পায় না, তাকে কেউ হারাতে পারে না। জয় তার হবেই। আমি ভয় পাই না। জয় আমার হবেই।

গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে তো রেনুও পড়েছেন। ব্যাপারগুলো সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারণা তাঁরও হয়েছে। তিনি তাঁর দুলার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কী সুন্দর করে কথা বলতে পারে দুলা! একেবারে যাত্রার রাজার মতো।

রেনু ধরেই নিয়েছেন, এটা তাঁর বিধিলিপি। তাঁর বর প্রায়ই কারাগারে যাবেন।

আর অনেক দিন পর স্বাধীন বাংলাদেশে বসে নিজ জীবনের ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মুজিব বলবেন, ‘আমার যেদিন প্রথম জেল হয়, সেদিনই আমার নাবালকত্ব ঘুচে গেছে।’

এন্ট্রান্স পাস করেছেন মুজিব। রেজাল্টের পর বাড়ির সবাই খুশি। যে দুরন্ত ছেলে, সে যে পাস করেছে, এই বেশি।

রাজনীতির নামে সারা দিন কোথায় কোথায় থাকে, কী সব করে বেড়ায়। মা একা একা বকে চলেন।

বাবা বলেন, ‘ছেলে তো তোমার মুসলিম লীগের কাউন্সিলর হয়েছে। মন্দ কী?’

মা কৃত্রিম রোষ ফুটিয়ে বলেন, ‘ছেলে তো তোমার খালি জেলখানায় যায়। লোকে আমারে কয়, সে নাকি সিনেমা হলে আগুন দিয়েছিল?’

বাবা বলেন, ‘তুমিও যদি এই কথা বিশ্বাস করো, কেমনে হয়! সেদিন সোহরাওয়ার্দী সাহেব, আবুল হাশিম সাহেবের মিটিং ছিল না গোপালগঞ্জে? কাদের মোল্লা আছে না, ওয়াহিদুজ্জামানের বাপে, সে গুন্ডাপান্ডা নিয়ে গেছে মিটিং ভাঙতে। ভাঙতে পারে নাই, খোকা তো টের পেয়ে তার পোলাপান নিয়ে আগেই মাঠ ঘেরাও দিয়ে রেখেছে, না পেরে গুন্ডাগুলান গেছে সিনেমা হলে আগুন দিতে, যাতে গন্ডগোল পাকে। তারপর উল্টা নাম দিয়েছে খোকার, যে সে-ই সিনেমা হলে আগুন দিতে গেছে। ফলস কেসে পুলিশ ধরেছে খোকারে। তারপর আমি জামিনের চেষ্টা করি, মুসলিম লীগের নেতারা চেষ্টা করেন, জামিন হয় না। কাদের মোল্লা সবকিছু আগে থেকে ম্যানেজ করে থুয়েছে।’

মা বলেন, ‘খালি তোমার ছেলে ধরা পড়ে। সে বোকা নাকি। অন্যে দেয় আগুন আর হাজত খাটে সে!’

রেনু এগিয়ে আসেন। বলেন, ‘বাবা,’ বলে ফেলেই তিনি জিব কাটেন : কারণ, তিনি তাঁর শাশুড়িকে অভ্যাসবশত বাবা বলে ফেলেছেন, আসলে শ্বশুরের সামনে শাশুড়িকে বাবা বলে ডাকার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু অসুবিধা হয় না; কারণ, শ্বশুর বলেন, ‘কও, বউমা!’

রেনু আর তাঁর শাশুড়ি চোখে চোখ রেখে গোপন হাসিবিনিময় সেরে নেন। তারপর রেনু বলেন, ‘বাবা, আমার সাথে আপনার ছেলের কথা হয়েছে। সে বলেছে, পুলিশের দড়ি হলো দেশপ্রেমিকের গলার মালা। সে বলেছে, যদি কেউ ভয় না পায়, তাইলে তাকে কেউ হারাতে পারে না!’

মা হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে বলেন, ‘তুমি আর এই সব বইলে বইলে পাগলরে সাঁকো নাড়ানোর কথা মনে করায়া দিয়ো না।’

এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতা চললেন মুজিব। ১৯৪২ সাল। গেলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়বেন বলে। পড়াটা উপলক্ষমাত্র, আসল লক্ষ্য হলো রাজনীতি করা। কলকাতা তখন উপমহাদেশের এবং বাংলার রাজনীতির এক কেন্দ্রীয় লীলাক্ষেত্র। মুজিব উঠলেন বেকার হোস্টেলে। রোল নম্বর ১৪। আইএ ক্লাস। ২৪ নম্বর রুমে থাকেন। একই রুমে থাকতেন শাহাদৎ হোসেন, গোপালগঞ্জের স্কুলজীবনের সহপাঠী। ভূমিহীন খেতমজুরের ছেলে ছিলেন শাহাদৎ। বাড়ি থেকে তাঁর টাকাপয়সা আসত না। শেখ মুজিবের নামে বাবা শেখ লুৎফর রহমান পাঠাতেন মাসে ৭৫ টাকা। সেটা দিয়েই দুই সহপাঠীর বেশ চলে যেত।

হোস্টেলের রুমে সারাক্ষণ চলছে রাজনৈতিক আড্ডা। মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হবে কি না, হলে দুই বাংলা কি এক থাকবে? শেরেবাংলা ফজলুল হক যে লাহোর প্রস্তাবে বললেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকা নিয়ে দুটো আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, তা কি নেতারা ভুলে গেলেন? কলকাতা কার ভাগে পড়বে? কত তর্কবিতর্ক! এই রুমে রাখা হয় দুটো পত্রিকা, দৈনিক আজাদ আর সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ। সেই পত্রিকা পড়তে ভিড় করে ছাত্ররা। আর চলে নানা রকমের আলোচনা।

কলকাতা তখন পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জাপানিরা যেকোনো সময় বোমা মারতে পারে। শহরে নিষ্প্রদীপ মহড়া হচ্ছে, এখানে-ওখানে খোঁড়া হচ্ছে পরিখা। একদিন বোমাও পড়ল।

লোকেরা ছড়া বানিয়ে বলতে লাগল,

সা রে গা মা পা ধা নি
বোম ফেলেছে জাপানি
বোমের মধ্যে কেউটে সাপ
ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ।

দলে দলে লোক শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

কিন্তু ইসলামিয়া কলেজ আর বেকার হোস্টেল সরগরম। মুসলিম তরুণেরা সব ঝুঁকে পড়ছে রাজনীতির দিকে। এই হোস্টেলের দুই নূর—নুরুল হুদা আর নূরুদ্দিন। নুরুল হুদা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের রাজনৈতিক সচিব হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। তিনি নতুন সক্রিয় মুসলিম লীগকর্মী মুজিবকে বলেন, ‘চলুন, আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’

‘কোন জায়গায়?’

‘লিডারের বাড়িতে।’

‘কোন লিডার?’

‘সোহরাওয়ার্দী সাহেব।’

‘আচ্ছা চলেন।’

‘আপনার মতো একজন কর্মী পাওয়া আমাদের জন্য খুব লাভজনক হবে। লিডার খুশি হবেন।’

বেরিয়ে পড়লেন মুজিব। কলকাতা শহরে সন্ধ্যা নামছে। গ্যাসবাতিগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। জাপানিদের ভয়ে বর্মা থেকে আসছে শরণার্থী। তারা ধ্বস্ত, ক্লান্ত। তাদের কারও কারও পায়ে জুতোর বদলে বিচালি।

থিয়েটার রোডে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাংলোর সামনে পুলিশ। গেটে নাম লিখে ঢুকলেন দুজন। বিশাল ড্রয়িংরুম। বড় বড় গদিঅলা সোফা। সবকিছু বিদেশি কেতায় সাজানো।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব এলেন। নুরুল হুদা বললেন, ‘লিডার, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।’

সোহরাওয়ার্দী চোখ তুলে তাকালেন। আরে, এ যে মুজিব! শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন মুজিবের দিকে। মুজিবের পরনে শেরওয়ানি। ইসলামিয়া কলেজে শেরওয়ানি পরাটাই ছিল দস্তুর। হেমন্তের শীত শীত সন্ধ্যায় মুজিব সেটাই পরে গিয়েছিলেন।

নুরুল হুদা বিস্মিত। শেখ মুজিবের সঙ্গে নেতার আগে থেকে পরিচয় ছিল! কেউ তো কিছুই বলেনি!

.

শেখ মুজিবের সঙ্গে ফজলুল হক আর সোহরাওয়ার্দীর প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটা বেশ নাটকীয়।

মাঘ মাসের দুপুর। আকাশে সূর্য আছে, তবু যেন তেজ নেই। ছায়াগুলোকে বেশ দীর্ঘ দেখাচ্ছে। মফস্বল শহর গোপালগঞ্জ আজ তটস্থ। হাফ প্যান্ট পরা পুলিশ লাল টুপি পরে বেত হাতে শহরের মোড়ে মোড়ে পাহারা দিচ্ছে। গোয়েন্দাও গিজগিজ করছে, নানা ছদ্মবেশে। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে আসবেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুলে তাই সাজ সাজ রব পড়ে গেছে কয়েক দিন আগে থেকেই। প্রতিটা ঘর পরিষ্কার করা, বাগানগুলো ঝকঝকে করে তোলা। প্রধান শিক্ষক গিরিশবাবু ধুতি সামলে সেই সব তদারক করে বেড়াচ্ছেন। ছাত্রদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন ধোপদুরস্ত কাপড় পরে আসে।

ছাত্রদের মধ্যেও বেশ একটা উত্তেজনা। এত বড় দুজন মানুষ আসছেন তাদের স্কুলে! হঠাৎ যদি শেরেবাংলা বা সোহরাওয়ার্দী কোনো প্রশ্ন করে বসেন, কে উত্তর দেবে, ক্লাসে ক্লাসে সব শিখিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষকেরা।

শুধু ক্লাস এইটে পড়া একটা ছেলের মাথায় অন্য মতলব। ছেলেটার চোখে মোটা কাচের চশমা। বেরিবেরি রোগ হয়েছিল, চোখে অপারেশন করতে হয়েছে, অনেক দিন লেখাপড়া বন্ধ ছিল তার। স্কুলের অন্য ছেলেদের তুলনায় সে বয়সে একটু বড়, উচ্চতায়ও। শীতের রাতে হোস্টেলের চালের দিকে তাকিয়ে তার ঘুম আসে না। চালটা ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। এখন এই বিছানায় কাঁথার নিচে শুয়ে কুয়াশাঢাকা চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে ছাদের ফুটো দিয়ে। বালিশের কাছে রাখা চশমাটা চোখে পরে নিয়ে সে টিনের ছাদের ফুটো দেখে।

এই হোস্টেলে সে নিয়মিত থাকে না। কাল প্রধানমন্ত্রী আসছেন, তারই উত্তেজনায় আজকের রাতটা সে কাটাচ্ছে হোস্টেলে। মাননীয় অতিথির জন্য স্কুলের প্রবেশপথে দেবদারুপাতা দিয়ে তোরণ বানানো হয়েছে। তারা তাদের ক্লাসরুমটার মেঝে নিজেরা ঝাড়ু দিয়ে সুন্দর করে মুছেছে। আজ রাতে সে থেকে গেছে হোস্টেলে। তাকে একটা বিছানা ছেড়ে দিয়েছে তার বন্ধুরা।

হেডমাস্টার কি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন তাঁদের হোস্টেলের ছাদের দুর্দশার কথা? কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হবে?

ছেলেটি বিছানায় তড়াক করে উঠে বসে। ‘এই তোরা ঘুমাস, ঘুমালে হবে? ওঠ।’

‘কী, মুজিব ভাই?’ তার চেয়ে বয়সে মোটামুটি সবাই ছোট। সবাই তাকে ভাই বলেই ডাকে। কিন্তু একটা এক-পা ছোট ছেলে, যে পড়ে ক্লাস নাইনে, তার খুবই ভক্ত, তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে। অন্য ছাত্ররাও মোটামুটি তাকে মেনেই চলে।

‘সবাই শোনো।’

সবাই কাঁথা থেকে লেপ থেকে মাথা বের করে।

‘আমাদের হোস্টেলের ছাদ ভাঙা, কিন্তু এইটা ঠিক করার কোনো নামগন্ধ তো নাই। আমরা কাল প্রধানমন্ত্রীকে বলব এটা ঠিক করে দিতে। তাঁদের ডেকে এনে দেখাব ছাদের কী হাল। তোমরা সবাই থাকবা আমার সাথে।’

‘জি, মুজিব ভাই।’

‘কী, থাকবা তো?’

‘জি, মুজিব ভাই।’

পরের দিন কালো আচকান আর মাথায় লাল ফেজ টুপি পরা বিশালদেহী ফজলুল হক আর তাঁর পাশে কোট-প্যান্ট-টাই পরা ছোটখাটো গোলগাল চেহারার সোহরাওয়ার্দী এলেন স্কুল পরিদর্শনে। সঙ্গে মহকুমা প্রশাসক গোলাম আহাদ। আর আছে নিরাপত্তারক্ষী আর প্রটোকল-কর্মীরা। তাঁরা হেডমাস্টারের রুমে ঢুকলেন। খানিকক্ষণ কাটালেন। বারান্দা ধরে হাঁটলেন। ক্লাসরুমেও উঁকি দিলেন।

তারপর ফিরে যেতে লাগলেন সদলবলে। পাশেই ডাকবাংলো। চোরকাঁটাভরা মাঠের মধ্যে মাথার সিঁথির মতো পায়ে চলা সরু পথ। সেই পথে উঠে পড়েছেন তাঁরা।

ক্লাস এইটের ছেলেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ‘মুজিব ভাই, মন্ত্রীরা চলে যাচ্ছে তো।’

‘তাই তো। চল সবাই আমার সাথে।’

মুজিবের পেছনে পেছনে বেরিয়ে গেল কয়েকজন ছাত্র। তারা পড়িমরি করে দৌড়াতে লাগল। যে করেই হোক, মন্ত্রীদের পথ রোধ করে দাঁড়াতেই হবে।

তারা দৌড়ে সামনে চলে গেল সপারিষদ মন্ত্রীদের। হেডমাস্টার সাহেবের পিলে চমকে উঠল। কী করছে এই ছাত্ররা!

এসডিও সাহেব রেগে অগ্নিশর্মা। ‘এই, কী করো? পথ ছাড়ো।’

বেতের মতো চিকন শরীর, লম্বা, চোখে কালো চশমা—মুজিব এগিয়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর পর্বতপ্রমাণ শরীরের সামনে, বলল, ‘আপনারা চলে যাচ্ছেন? আমাদের বোর্ডিং ঘরের চালের কী হবে?’

‘কী সমস্যা তোমাদের বোর্ডিং ঘরের?’

‘চালটা পুরানা হয়ে ফুটা হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। এখন শীতের রাতে ঠান্ডা হাওয়া ঢোকে। কুয়াশা পড়ে।’

‘কত টাকা দরকার?’ এ কে ফজলুল হক বললেন।

‘হাজার-বারো শ টাকা হলে হবে।’

‘আচ্ছা। স্কুল বোর্ডিং ঘর মেরামত বাবদ বারো শ টাকা এখনই বরাদ্দ করছি। আমার নিজস্ব ফান্ড থেকে এটা দেওয়া হবে।’ তিনি তাঁর সঙ্গের কর্মকর্তাকে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

সূর্যকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলেন শেরেবাংলা, তাঁরই পেছনে উঁকি দিচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী। তাঁর চোখে মিটিমিটি হাসি। শেখ মুজিবের কিশোর-মুখে পড়েছে শীতদুপুরের হলদেটে আলো, তার উজ্জ্বল ঈষৎ বাদামি চোখে সেই আলো চিকচিক করছে।

ডাকবাংলোয় ফিরে গেলেন দুই নেতা। দুপুরের খাবার খেতে খেতে কথা উঠল ওই লম্বা চশমাঅলা ছেলেটাকে নিয়ে। কী রকম সাহস? কী রকম স্পষ্ট করে জানাল তাদের অভাব-অভিযোগ। ‘এই রকম তরুণই তো চাই।’ বললেন, সোহরাওয়ার্দী। একটা আস্ত মুরগির রোস্ট পাতে তুলে নিয়ে বিশাল থাবায় সেটা কবজা করতে করতে সম্মতি জানালেন বাংলার বাঘ। সোহরাওয়ার্দী পার্শ্ববর্তী কর্মকর্তাকে বললেন, ‘চেনেন নাকি ছেলেটাকে?’

‘স্যার।’

‘ডেকে আনুন না তাকে।’ ভাঙা বাংলায় বললেন সোহরাওয়ার্দী। ‘ছেলেটাকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। একটা স্লিপ পাঠিয়ে দিন। যেন ও এসে সরাসরি আমার সাথে দেখা করতে পারে।’

মুজিবকে ডেকে আনা হলো স্কুল থেকে। হেডমাস্টার সাহেব ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কী-না-কী শাস্তি হয়ে যায় মুজিবের!

মুজিবকে ডেকে এনে সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘তোমার নাম মুজিবুর রহমান।’

‘জি, শেখ মুজিবুর রহমান।’

‘তোমার সাহস, তোমার কথাবার্তা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার মতো ছেলেই আমাদের দরকার। দেশের দরকার।’ সোহরাওয়ার্দীর ভাঙা ভাঙা বাংলা বলাও মুজিবের খুবই পছন্দ হলো।

কলকাতায় সোহরাওয়ার্দীর বাসভবনের বৈঠকখানায় বসে সেই সব কথা আবার মনে পড়ে গেল দুজনেরই। সেদিনও লিডার বলেছিলেন, মুজিবের মতো ছেলে দরকার দেশের রাজনীতিতে, আজকেও তা-ই বললেন। ‘এসেছ। খুব ভালো করেছ। কাজে লেগে পড়ো

সোহরাওয়ার্দী বাংলারই নেতা ছিলেন, কিন্তু ঠিক বাঙালি ছিলেন না। তিনি কথা বলতেন ভাঙা বাংলায়, কিন্তু উর্দু কিংবা ইংরেজিটা ভালো বলতেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ফেরত সোহরাওয়ার্দী ব্যারিস্টার হিসেবে ছিলেন খুব নামকরা। আজও মুজিবকে যথারীতি উর্দু-ইংরেজি মেশানো বাংলায় অভ্যর্থনা জানালেন সোহরাওয়ার্দী। উর্দি পরা বেয়ারা তাঁদের জন্য খাবার নিয়ে এল।

খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প করলেন তাঁরা, আলোচনা করলেন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে, বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আর তাঁদের এখনকার কাজ সম্পর্কে।

.

মুজিব খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কলকাতার মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ে। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে দুটো ভাগ। একটায় জমিদার ও সামন্তশ্রেণী, আরেকটায় আবুল হাশিম প্রমুখের মতো বামপন্থী প্রগতিশীলেরা, যাঁরা জনগণের জন্য মুসলিম লীগকে খুলে দিতে চান, আর ধর্মীয় রক্ষণশীলতার ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতি করতে চান মানুষের কল্যাণের জন্য। মুজিব প্রগতিশীলদের দলে।

১৯৪৩ সাল। মন্বন্তর দেখা দিয়েছে দেশে। ‘একটু ফেন দাও মা’ বলে কলকাতার বাড়িগুলোর দরজায়-দরজায় ঘুরে ফিরছে অনাহারী মানুষের স্রোত। পথেঘাটে নিরন্ন মানুষ পড়ে আছে অসহায়, মুমূর্ষু। শেখ মুজিব প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দুর্গত অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য। মুসলিম লীগ দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কমিটি প্রতিষ্ঠা করল। তহবিল সংগ্রহ করে ভুখা মানুষদের খাদ্য সাহায্য করার কাজ চলতে লাগল পুরোদমে। এই কাজে সবার আগে শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি সরকারও মুজিবের তৎপরতা ও অবদানের প্রশংসা করতে বাধ্য হলো।

বেকার হোস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন সাইদুর রহমান। আকালের ধাক্কা তাঁর হোস্টেলেও এসে লাগল। দেশে খাদ্যসংকট। কাজেই তিনি নিয়ম করে দিলেন, হোস্টেলের ডাইনিংরুমে সবার জন্য এক বাটি করে তরকারি। হয় মাছ, নয়তো মাংস, যেদিন যেটা দেওয়া হবে। কিন্তু সবাই এক বাটি করে নেবে, কেউ দুই বাটি নিতে পারবে না।

শিগগিরই সাইদুর রহমানের কাছে অভিযোগ এল, একজন ছাত্র রোজ দুই কাপ তরকারি খায়।

কে?

শেখ মুজিব।

বারবার অভিযোগ আসায় সাইদুর রহমান ডেকে পাঠালেন মুজিবকে। মুজিব এলেন।

‘মুজিবুর, তুমি নাকি রোজ দুই বাটি করে তরকারি খাও?’

‘জি, স্যার, খাই।’

‘তুমি জানো না, এটা অন্যায়? নিয়ম করা হয়েছে, সবাই এক বাটি করে তরকারি খাবে?’

‘কী করব, স্যার। এক বাটিতে যে আমার হয় না।’

সাইদুর রহমানের মনে পড়ে গেল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন চেরিগাছ কেটে ফেলে বাবার কাছে সত্য কথা স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। এ-ও তো দেখছি আরেক জর্জ ওয়াশিংটন। অপরাধ করে অকপটে স্বীকার করে। আবার সে যে ত্রাণের তহবিল জোগাড় করছে, বিতরণ করছে—এসব করছে চরম সততার সঙ্গে। সেটা সবার মতো সাইদুর রহমানও জানেন, একটা পয়সা সে এদিক-ওদিক হতে দিচ্ছে না। ‘আচ্ছা,’ সাইদুর হেসে বললেন, ‘তোমার চাহিদা যখন দুই বাটি, তখন তোমাকে আর মানা করি না। তুমি দুই বাটিই খাবে।’

মুজিবকে নিয়ে সাইদুর রহমানের আরেকটা অসুবিধা হতে লাগল। মুজিব রোজ দেরি করে ছাত্রাবাসে ফেরেন। কিন্তু ছাত্রাবাসের নিয়ম, রাত আটটার মধ্যে সবাইকে হোস্টেলে ঢুকে পড়তে হবে। হোস্টেলের গেটে একটা রেজিস্টার খাতা আছে। ওখানে নাম লিখে স্বাক্ষর দিয়ে ফেরার সময় উল্লেখ করে ঢুকতে হয়। সেই খাতা যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, মুজিবের ফেরার কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। সে মেলা রাত করে হোস্টেলে ফেরে।

সাইদুর রহমান জানেন, মুজিব রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। সে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবা করছে। কিন্তু হোস্টেলের নিয়ম তো মানতেই হবে। তিনি তাঁর কক্ষে ডেকে পাঠালেন মুজিবকে।

‘শেখ মুজিবুর রহমান, তুমি রোজ নটার পরে হোস্টেলে ফেরো। এটা ঠিক নয়। আর করবে না। এবারের মতো মাফ করে দিলাম। আটটায় না পারো, নটার মধ্যে তোমাকে ফিরতেই হবে। কিন্তু আরেক দিন যদি তুমি দেরি করে আসো, তোমাকে জরিমানা দিতে হবে। যাও।’

‘স্যার, আমি নটার মধ্যে ফিরতে পারব না। জরিমানা দিতে হলে সেটাই বরং দেব। আপনি জানেন, বাইরে আমাকে অনেক রকমের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। দেশে দুর্ভিক্ষ। মানুষ খেতে পায় না। আমরা নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন জোগানোর চেষ্টা করছি। একটা মানুষও যদি একমুঠো খেতে পায়, সেটা ভালো। বরং আমি ফাইনই দেব।’

সাইদুর রহমান দেখতে পেলেন, মুজিবের দুই চোখ জল ও মায়ায় চকচক করছে। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, এক কাজ করো। গেটের দারোয়ান তো আর লেখাপড়া জানে না। তুমি যখন রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর করবে, তখন ফেরার সময় লিখে দিয়ো নয়টা। যাও।’

মুজিব ব্যস্ত কলকাতায়। ওদিকে আমাদের গল্পের আরেক কুশীলব তাজউদ্দীন তখন পড়েন ক্লাস নাইনে। ঢাকা মুসলিম বয়েজ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে। এর আগে পড়তেন নাগরী সেন্ট নিকোলাস স্কুলে। ক্লাস সিক্সে তিনি বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছেন। ভীষণ ভালো করছেন লেখাপড়ায়। আগের বছর তাঁদের স্কুল থেকে অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আহসান উল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং পরিদর্শনে। ফিরে আসার পর স্যার বললেন, ‘সবাই লেখো তো দেখি কে কী দেখলে।’ সবাই লিখল। তাজউদ্দীন লিখেছেন ইংরেজিতে। সেটা পড়ে শোনালেন শিক্ষক। বললেন, ‘এই রকম লেখা তো ইংরেজিতে এমএ পাস লোকেরাও লিখতে পারবে না।’

তাঁরা থাকেন ডাফরিন মুসলিম হোস্টেলে। হোস্টেলের নিয়মকানুন খুবই কড়া। নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক। নামাজ না পড়লে খাবার দেওয়া হয় না। বাইরে যাওয়া বারণ। কিন্তু তাজউদ্দীন ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সবকিছুতে তিনি ভালো। বিনয়ী, নম্রভদ্র। তাকে হোস্টেলের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। হোস্টেল সুপার অম্বর আলী ভীষণ রাগী। তাঁর ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপে। তিনি ছেলেদের ইংরেজি পড়ান। তাজউদ্দীনকে তিনি বললেন, ‘ভালো ভালো ইংরেজি ছবি দেখতে যাবে। তাহলে তোমার ইংরেজির উচ্চারণ ভালো হবে। লিসেনিং ক্যাপাসিটি বাড়বে।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তিনি সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং নিলেন। তারপর রাতের বেলা তাঁদের পাঠানো হয় ইউনিফর্ম পরে লোকালয় পাহারা দিতে। তাঁদের বলা হয় হোমগার্ড। তাজউদ্দীনের ডিউটি পড়ে বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায়। কয়েক মাস তিনি এই কাজ করেছেন। প্রতি রাতের জন্য তাঁর বেতন আট আনা। ক্লাস টেনে উঠে তিনি স্কুল বদলালেন। এবার গেলেন সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে। উঠলেন কলতাবাজারের এক মেসে। বন্ধুদের বললেন, পরীক্ষার ফল ভালো করে কী হবে। আসল হলো দেশ। দেশের কাজে লাগতে হবে।

কামরুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা। ছোটখাটো মানুষ। তাঁর চিন্তাভাবনা সংস্কারমুক্ত। কামরুদ্দীন সাহেবের কাছে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলেন তাজউদ্দীন।

স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই তাঁকে ঢাকা জেলা উত্তর মহকুমার মুসলিম লীগের তরুণ কর্মী হিসেবে সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হলো। ফরিদপুর জেলার জন্য এই দায়িত্ব পড়ল শেখ মুজিবের ওপর।

তাজউদ্দীন খুব মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ করতেন। পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁর ধারণা কী? স্কুলে ফিরে এসে সহপাঠীদের বলতেন, পাকিস্তান হতে পারে, কিন্তু ভায়াবল হবে না। বন্ধুরা এই সব কথার মাথামুণ্ডু বুঝত কি না, কে জানে।

তাজউদ্দীন ছিলেন অন্তর্মুখী। তিনি কখনো মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করতেন না। ফলে, সাধারণ ছাত্র বা কর্মীরা তাঁকে তেমন চিনত না। কিন্তু নেপথ্যে থেকে পার্টি গড়ে তোলার জন্য তিনি খাটতেন প্রচুর।

এত কিছু করার পরও যথাসময়ে বসলেন পরীক্ষার হলে। ১৯৪৪ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল, তিনি প্রথম বিভাগে মেধাতালিকায় দ্বাদশ স্থান অধিকার করেছেন।

সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল। সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউট। দুটো খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুল। মধ্যখানে মুসলিম বয়েজ। অথচ তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল মক্তবে পড়ে। ঢাকা জেলার কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামের সম্পন্ন ভূস্বামী ইয়াসিন খানের রক্ষণশীল পরিবার তাঁদের এই সন্তানকে প্রথমে পড়িয়েছিলেন মক্তবে। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা নাকি দিল্লি থেকে এখানে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য। ছেলে তাঁর শিক্ষা শুরু করল কোরআন শরিফ হিফজ করার চেষ্টা দিয়ে। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। সহজেই সে কোরআন শরিফের কয়েক পারা মুখস্থ করে ফেলল। তার এই মেধাশক্তির পরিচয় পেয়ে মক্তবের শিক্ষকই একদিন বলে বসলেন তার বাবাকে, ‘আল্লাহ ছেলেটার মগজ ভালো দিছে। খান সাহেব, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করায়া দিলে হতো না? এই মক্তবের পড়া তো শেষ করে ফেলছে।

বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব দুই মাইল। নয় বছর বয়সী তাজউদ্দীন গ্রামের অন্য ছেলেদের সঙ্গে দল বেঁধে হেঁটে পৌঁছাতেন স্কুলে। স্কুলের নামটাও সুন্দর। ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়। শাল-গজারির বন আর নদী-খালে ভরা জনপদ। গাছের ছায়ায় পাখির ডাক শুনতে শুনতে তিনি

স্কুলে যান। সমস্যা হলো, পথে অনেকগুলো খাল পেরোতে হয়। সাঁকো নাই। নৌকায় বা হেঁটে খাল পেরোতে হয়। হাফ প্যান্ট টেনে ওপরের দিকে তুলতে তুলতেও খানিকটা ভিজে যায়। ‘তাহলে এক কাজ করা যায় না, আমরা নিজেরাই সাঁকো বানিয়ে ফেলি। গ্রামে বাঁশের তো অভাব নাই। কটা বাঁশই বা লাগে একটা সাঁকো বানাতে।’ বন্ধুদের উৎসাহিত করে তিনি লেগে পড়েন সাঁকো তৈরির কাজে। বাঁশঝাড়ে বাঁশের অভাব ছিল না। দা নিয়ে তাঁরা চললেন বাঁশ কাটতে। একটু বয়স্ক ছাত্ররাও এগিয়ে এসে হাত লাগাল। ব্যস, পাঁচটা সাঁকো তৈরি হয়ে গেল। এখন স্কুলে যাওয়া অনেক সহজ হলো না কি!

ক্লাস ওয়ান থেকে টুতে ওঠার সময়ই পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে গেলেন তাজউদ্দীন। তাঁকে এ জন্য পুরস্কার দেওয়া হলো। পুরস্কারের মূল্য ১০ পয়সা। দেড় পয়সা দামি কালির দোয়াত, সাড়ে আট পয়সার কলম। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত তিনি এই স্কুলেই পড়লেন। এরপর পাঁচ মাইল দূরে কাপাসিয়া এমই স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হলেন তিনি।

তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর। তখনকার দিনে যোগাযোগব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল। ফলে, বাড়ি থেকে স্কুলে রোজ ১০ মাইল যাতায়াত করা ছিল ওই কিশোরের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে জায়গির থেকে স্কুলে যেতে লাগলেন।

স্কুলে একদিন শুনতে পেলেন, রাজবন্দী এসেছেন।

স্কুলে রাজবন্দী?

তাজউদ্দীনের ঔৎসুক্যের সীমা নাই।

জায়গিরবাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে কাপাসিয়া পুলিশ স্টেশন। শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে বড় জায়গাজুড়ে এই থানা। সেখানে তিনজন রাজবন্দীকে রাখা হয়েছে ডিটেইনি। দিনের বেলা পুলিশ প্রহরায় তাঁরা বেরিয়েছেন এলাকা দেখতে। হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা চলে এসেছেন তাঁদের স্কুলে।

তাজউদ্দীন শুনতে পেলেন এক শিক্ষকের মুখ থেকে, এঁরা সবাই ব্রিটিশবিরোধী। স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান।

তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে হেডমাস্টারের রুমের সামনে দাঁড়ানো তিনজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

প্রহরারত পুলিশ বলল, ‘কী, খোকা?’

পুলিশ সদস্যটি হেসে ফেললেন। ‘রাজবন্দী দেখবে? ওই যে দেখো?’

তাজউদ্দীন বললেন, ‘রাজবন্দী কোথায়? ওরা তো দেখতে রাজবন্দীর মতো না।

‘রাজবন্দীর মতো না!’ দারোগা তাঁর বেতটা মাটির সঙ্গে ঠোকাতে ঠোকাতে বললেন, ‘রাজবন্দীরা দেখতে কেমন?

‘আমাদের ব্যাকরণ বইয়ে পড়েছি, রাজবন্দী মানে রাজা হইয়াও যিনি বন্দী। ওরা তো রাজা না?’

‘এটা ব্যাকরণ বইয়ে লেখা আছে?’

‘রাজর্ষির ব্যাসবাক্য লেখা আছে : রাজা হইয়াও যিনি ঋষি। তাহলে রাজবন্দী মানে তা-ই হওয়া উচিত, নয়?’

দারোগা হেসে বললেন, ‘রাজবন্দীরা রাজা হয় না। রাজারা যাঁদের বন্দী করেন রাজনীতির কারণে, তাঁদের রাজবন্দী বলে।’

রাজবন্দী বলা হচ্ছে যাঁদের, সেই তিনজন তাঁদের কথোপকথন শুনছিলেন। তাঁদের একজন বললেন, ‘বাব্বাহ্, তোমাকে তো বেশ বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। এদিকে এসো তো তুমি। তোমার নাম কী?

এইভাবে আলাপ-পরিচয়ের শুরু।

তাঁরা ছেলের সব বৃত্তান্ত—নামধাম, কোন স্কুল, কোন ক্লাস— জেনে নিলেন।

তাজউদ্দীন বললেন, ‘আপনারা যদি রাজবন্দী হন, তাহলে আপনাদের বেঁধে রাখে নাই কেন? আপনাদের তো বাইরে ছেড়েই রেখেছে?

তাঁদের একজন বললেন, ‘ছেড়ে দিয়ে রাখেনি। এই যে দেখো না আমাদের পাহারা দিয়ে রেখেছে।

আরেকজন বললেন, ‘আমরা আসলে রাজার অতিথি। তাই আমাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের পাহারা।’

ওঁদের মধ্যে লম্বা মুখের একজন বললেন, ‘কারণ, আমরা চাই, ব্রিটিশরা এই দেশ থেকে চলে যাক। আমাদের ভারত আমাদের হাতেই দিয়ে যাক। শুনে রানিমাতা এত খুশি হলেন যে আমাদের রাজ-অতিথি হিসেবে বরণ করলেন। বললেন, ‘যাও, তোমাদের থাকা-খাওয়ার চিন্তা নাই। আমরাই তোমাদের খাওয়াব-পরাব’।’

বাকি দুজন হেসে উঠলেন। ইয়া বড় গোঁফঅলা একজন বললেন, ‘এই, ওকে কনফিউজড করে দিয়ো না।’

তিনি বললেন, ‘দেখো, ভারতের লোক খেতে পায় না, পরতে পায় না। কিন্তু ইংরেজদের বাবুগিরি তাতে কমে না। ওদের কোনো চিন্তাভাবনাই নাই এই দেশের মানুষকে ভালো রাখার। কেন নাই? কারণ, এটা তো তাদের দেশ না। যার দেশ, তারই শাসন করা উচিত, তাই না? সে জন্য আমরা বলছি, আমরা ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়াতে চাই। আমরা স্বরাজ চাই।’

পুলিশ সদস্যটি বললেন, ‘এই, তোমরা রাজনৈতিক আলোচনা কোরো না। ব্রিটিশরাজের কর্মচারী হিসেবে আমি সেটা অ্যালাউ করতে পারি না।’

ওঁরা বললেন, ‘আমাদের কাছে বই আছে। তুমি বই পড়ো। তুমি এসো থানায়। তোমার সঙ্গে গল্পও করা যাবে। আর তোমাকে বইও দেওয়া যাবে। কাজী নজরুলের কবিতা পড়েছ? তুমি থানায় এসো। তোমাকে বই দেব।’

পরের দিনই তাজউদ্দীন থানায় গিয়ে হাজির। তারপর রোজ যেতেন ওঁদের কথা শুনতে। একজনের নাম রাজেন্দ্র নারায়ণ চ্যাটার্জি। তিনি খুব আমুদে। কথায় কথায় হাসেন আর হাসান।

একজনের নাম বীরেশ্বর চ্যাটার্জি। তাঁর গোঁফ আছে। তিনি প্রতিটা ঘটনা, প্রতিটা বিষয় খুব যত্নের সঙ্গে বোঝাতে চেষ্টা করেন।

আরেকজন মণীন্দ্র শ্রমণি। তিনি মাঝেমধ্যে গান করেন। তাঁর প্রিয় গান হলো, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা…’

তাজউদ্দীন রোজ একটা করে বই নিয়ে আসেন ওই রাজবন্দীদের কাছ থেকে। সেটা বাড়িতে এনে পড়েন। কী সব আগুনে তাতানো নেশা ধরা একেকটা বই। পরের দিন বইটা ফেরত দেন। নতুন বই নেন। বন্দীরা তাঁর সঙ্গে আগের দিনের পড়া বইটা নিয়ে আলোচনা করেন।

পেছনে শীতলক্ষ্যা নদী। তাজউদ্দীনের চোখ নদীতে। নৌকা চলছে। জাহাজ চলছে। কিন্তু তাজউদ্দীন সেসবের কিছুই দেখছেন না। তিনি মন দিয়ে বন্দীদের আলোচনা শোনেন। বিভোর হয়ে যান। দুনিয়াতে মানুষ মুক্তির জন্য ও শান্তির জন্য, স্বাধীনতা আর অধিকারের জন্য কী কাণ্ডটাই না করছে!

এইভাবে ৫০-৬০টা বই পড়া হয়ে যায় তাজউদ্দীনের।

এর মধ্যে রাজবন্দীদের মুক্তির দিন আসে। ওপর থেকে আদেশ এসেছে, ওঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওঁরা এরই মধ্যে থানার বাগানে গোলাপগাছের যত্ন করে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন কয়েকটা গোলাপ ফুল। সেই বাগান থেকে একগুচ্ছ গোলাপ তুলে তাঁরা বিদায় নেওয়ার জন্য যান তাজউদ্দীনের জায়গিরবাড়িতে। এই কদিনেই এই মেধাবী ছেলেটি তাঁদের চিত্ত জয় করে নিতে সমর্থ হয়েছে। ছেলেটার সঙ্গে গল্প করে, কথা বলে, বই নিয়ে আলোচনা করে তাঁরা সময়টা কাটিয়েছেন আনন্দে।

জায়গিরবাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তাজউদ্দীন নাই। তিনি গেছেন ফুটবল ম্যাচ খেলতে।

বন্দীরা গোলাপগুচ্ছ রেখে যান ওই বাড়িতেই।

ফিরে এসে তাজউদ্দীন বাড়ির লোকদের কাছে জানতে পারেন, ওঁরা এসেছিলেন। তিনি ছুটে যান থানায়। ততক্ষণে ওঁরা কাপাসিয়া থেকে চলে গেছেন।

ওই বিপ্লবীদের সাহচর্য তাজউদ্দীনের মনের একটা দুয়ার খুলে দিয়ে যায়।

তাই তো ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘আমার লেখাপড়ার দরকার নাই। আসল কাজ হলো দেশের উপকার করা।’

ঢাকা কলেজে আইএতে ভর্তি হয়েও তাজউদ্দীন ঠিকমতো ক্লাস করেন না।

তাজউদ্দীন একদিন গেছেন সিরাজউদ্দৌলা পার্কে। এখানে জনসভা হবে। বক্তৃতা করবেন মুসলিম লীগের নেতা আবুল হাশিম।

আবুল হাশিম ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী পুরুষ। ভাষার ওপর যেমন তাঁর দখল ছিল, তেমনি ছিল ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত। তাজউদ্দীন আকৃষ্ট হলেন সেই বক্তব্যে। আবুল হাশিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কামরুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে তাঁরা ১৫০ চক মোগলটুলীতে গড়ে তুললেন পার্টি হাউস। ঢাকার উত্তর মহকুমা মুসলিম লীগ গড়ে তুলতে এই মেধাবী ছাত্রটি কলেজের পড়াশোনায় বিরতি নিলেন।

কলকাতায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বার্ষিক সভা হবে। তাজউদ্দীন যাবেন সেখানে। তিনি একজন কাউন্সিলর। এর আগে ঢাকায় কমিটি নির্বাচনে ভোটাভুটি হয়েছে। তাজউদ্দীনদের লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে এনে সাধারণ মানুষদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। আবুল হাশিমের মতানুসারী এই উপদলকে বলা হতো বামপন্থী। ডানপন্থীদের নেতা খাজা নাজিম উদ্দিন তখন প্রধানমন্ত্রী। তাঁরা তাঁদের মতো নবাব পরিবারের সদস্যদের দিয়ে কমিটি করার জন্য পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদরা চাইছিলেন নবাব পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করা। শেষ পর্যন্ত বামপন্থীরাই এতে জিতেছে। তাজউদ্দীন আহমদ এই নির্বাচনের জন্য বড়ই খায়খাটুনি খেটেছেন।

কামরুদ্দীন সাহেবসমেত তাঁরা তিনজন যাবেন কলকাতা।

বাবা চান না যে তিনি কলকাতা যান। এমনিতেই পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটছে, এটা বাবার পছন্দ হচ্ছে না। তাজউদ্দীন ছাত্র হিসেবে খুবই ভালো বলে গণ্য। প্রতিটা ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছেন। ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষায় ও ফার্স্ট হয়েছেন। সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে পেয়েছেন আশি। এ সবই এখন যন্ত্রণার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির সবাই চাইছেন, তাজউদ্দীন যেন মন দিয়ে ক্লাস করে। রাজনীতি করে কী লাভ?

লাভের জন্য তো তিনি রাজনীতি করছেন না। তিনি রাজনীতি করতে চান মানুষের জন্য। দেশের ভালোর জন্য। সবাই যেন খেতে পায়। মাত্র গত বছরই নিদারুণ দুর্ভিক্ষ ঘটে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী মানুষ না খেতে পেয়ে মরে পড়ে ছিল। এই মানুষের মুখে খাদ্য দেওয়া যদি রাজনীতি হয়, তিনি তো সেটা করবেনই।

কলকাতা যেতেই হবে। খাজা-নবাবদের হাত থেকে মুসলিম লীগকে উদ্ধার করতে হবে। এটাকে সাধারণ মানুষের লীগ করে গড়ে তুলতে হবে। আবুল হাশিম সাহেবদের হাত শক্তিশালী করতে হবে। কলকাতা যাওয়ার পেছনে তাঁর আরেকটা উদ্দেশ্য আছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হবে। গোপালগঞ্জের এই মানুষটার কথা প্রায়ই পার্টি অফিসে শোনা যায়।

বাবা বললেন, ‘পড়াশোনার ক্ষতি করে কলকাতা যাওয়ার দরকার নাই।’

তাজউদ্দীন বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আব্বা, আমি কখনো আপনার কথার অবাধ্য হই নাই। এবারও হতে চাই না। আমি কলকাতা যাবই। আপনি অনুমতি দেন।

মৌলভি ইয়াসিন খান সাহেব টুপি খুলে হাতে নিলেন। ফুঁ দিয়ে আবার পরলেন। তার মানে, তাঁর মনের মধ্যে টানাপোড়েন। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও।’

জীবনে এই প্রথমবারের মতো কলকাতা যাত্রা। প্রথমে স্টিমার, তারপর ট্রেন।

শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে দেখেন, মুসলিম লীগের কর্মীরা তাঁদের স্বাগত জানানোর জন্য ভিড় করে আছে। একজন বলল, ‘দাদা, আমি অমৃতবাজার কাগজ থেকে এসেছি, দেখুন, কী লিখেছি আমাদের কাগজে।’ তাজউদ্দীন দেখলেন, অমৃতবাজার সত্যি বিরাট করে লিখেছে, খাজা নাজিম উদ্দিনের পরাজয়। আরেকজন বলল, ‘দাদা, আমাদের কাগজটাও দেখুন।’ সেটার দিকে দৃষ্টি দিলেন তাজউদ্দীন। আহসান মঞ্জিলের নেতৃত্বের অবসান।

তাঁদেরকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো আবুল হাশিমের কাছে।

কাউন্সিল শুরু হলো। এইখানে তাজউদ্দীন আহমদের দেখা হলো শেখ মুজিবের সঙ্গে।

তাজউদ্দীন খেয়াল করলেন, শেখ মুজিব খুবই দৃঢ়চেতা, সাহসী আর পরিশ্রমী। তিনি যা করতে চান, তা করে ফেলতে কোনো দ্বিধা করেন না, আলস্য বলতে কোনো জিনিসও তাঁর মধ্যে নাই। আর প্রগতিশীল তরুণদের মধ্যে তিনি প্রবল জনপ্রিয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে তিনি ডাকেন লিডার বলে। লিডারকে তিনি খুবই মান্য করেন।

সোহরাওয়ার্দী এই কাউন্সিলে নিজেকে দুই গ্রুপের দলাদলির ঊর্ধ্বে রাখার একটা ভাব দেখাচ্ছেন।

কিন্তু তাঁর শিষ্য মুজিবের অবস্থান আবুল হাশিমের পক্ষে স্পষ্ট ও বাঙ্ময়।

শেখ মুজিব এক ফাঁকে ডেকে নিলেন তাজউদ্দীনকে। বললেন, ‘তোমার নাম তাজউদ্দীন তো?’

তাজউদ্দীন বললেন, ‘জি।’

‘ঢাকা থেকে আসছ?’

‘জি।’

‘তোমরা তো চমৎকার কাজ করছ, মিয়া। আহসান মঞ্জিলরে হারায়া দিছ। এইবার আমাদের পালা।’

তাজউদ্দীন বললেন, ‘শহীদ সাহেব তো মনে হচ্ছে নিউট্রাল থাকবেন। তাহলে হাশিম সাহেবের পক্ষে সুবিধা করা সম্ভব হবে?’

শেখ মুজিব বললেন, ‘লিডার নিউট্রাল আছেন। থাকুক। আমি মুজিবুর রহমান তো নিউট্রাল না। ইনশাল্লাহ আবুল হাশিম সাহেবেরই জয় হবে।’ কাউন্সিলে শেখ মুজিব বক্তৃতা করলেন। অসাধারণ বাগ্মিতা দিয়ে তিনি কাউন্সিলরদের সম্মোহিত করে ফেললেন। কাউন্সিলররা বেশির ভাগই অবস্থান নিলেন আবুল হাশিমের পক্ষে।

দিনটা ছিল ১৭ নভেম্বর ১৯৪৪। ওই দিন ভোট হয়। বামপন্থীদের প্রার্থী আবুল হাশিম আবারও জয়লাভ করেন সাধারণ সম্পাদক পদে।

ঢাকার কাউন্সিলররা ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে।

বিজয়ীর গৌরবের আলো পড়ে শেখ মুজিবের চোখেমুখেও।

তাজউদ্দীন ফিরে আসেন এই বিশ্বাস নিয়ে যে শেখ মুজিব হারেন না। এর পরও তাঁকে বহুবার দেখেছেন, বহু সংকটে, বহু জাতীয় বা দলীয় সংঘাতে মুজিব লড়েছেন, যে লড়াইয়ে কেউ কোনো দিন জেতার কথা ভাবতেও পারবে না, মুজিব সেখানেও বাজি ধরেছেন এবং শেষ পর্যন্ত জিতেছেন।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানি কারাপ্রাচীরের অন্তরালে, কোনো খবর নাই, কোনো কুশল নাই, আর বিরূপ ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগরে তীরহারা নাবিকের মতো একটা যেন কাঠখণ্ড ধরে তাজউদ্দীন ভাসছেন, তখনো তিনি স্থিরপ্রত্যয় ছিলেন, ‘মুজিব ভাইকে আমি কোনো দিনও হারতে দেখিনি। এইবারও তিনি জিতবেন।

কলকাতা থেকে ট্রেনে ফিরে আসছেন তাজউদ্দীন আর সতীর্থরা। কলকাতা পেছনে রেখে। মুজিব ভাই বলেছেন, ‘আমি আসছি! আমার গোপালগঞ্জ কমিটিটাতেও আছে ডানপন্থীদের ভূত। ওইটাও তাড়াতে হবে।’

‘লিডারকে সাথে নিয়া আসব।’

সেই কথাগুলোও যেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আসছে।

ট্রেন চলে। ঢাকা মেইল। ট্রেনের চলার একটা ছন্দ আছে। শব্দটার মধ্যে একটা সুর আছে।

স্লোগানের সুরের মতো। ট্রেনের সিটে বসেই তাজউদ্দীন ঘুমিয়ে পড়েন।

তাজউদ্দীন স্বপ্ন দেখেন। মুজিব ভাই বলছেন, ‘তাজউদ্দীন, তৈরি থাকো। আমি আসতেছি।’

.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছে বসে এক ব্যাঙ্গমি তার ব্যাঙ্গমাকে বলে, ‘গত দুই দিনে একটা ঘটনা ঘটল।’

‘কী ঘটনা?’

‘যেই পাকিস্তান জন্মায় নাই, তার মৃত্যুর জন্য যে দুইজনের সাক্ষাৎ

হওন দরকার আছিল, সেইটা হইয়া গেছে। বুঝলা কিছু?’

‘কিছু কিছু…’

‘কিছু কিছু বুঝবা কেন। পুরাটাই তো জলের মতো সোজা, ভোরের আলোর মতো পরিষ্কার। শেখ মুজিব আর তাজউদ্দীনের দেখাটা হইয়া গেল।’

‘হ। তা হইল।’

‘এইটা খুব বড় ঘটনা। ভবিষ্যতে মনে রাইখো।’

প্রত্যহ ঘটনা ঘটে হাজার হাজার।
ইতিহাসে সেসবের মূল্য কিবা আর ॥
তাজউদ্দীনের সাথে দেখা শেখ মুজিবের।
বিশাল ঘটনা এটা পরে পাবা টের ॥

রেনু বললেন, ‘এবার তুমি আমাকে কলিকাতায় নিয়ে যাবা?’

বাইগার নদী থেকে বাড়ির পাশ ঘেঁষে খালটা এই শীতে শীর্ণ। হিজলগাছগুলো বর্ষাকালে কোমরপানিতে ডুবে যায়। এখন পানি নাই, পুরো গাছ জেগে আছে। আমন ধান উঠে গেছে। খোলাজুড়ে খড় শুকানো হয়। ইতস্তত খড় ছড়িয়ে আছে। একটি গরু বাঁধা জিগাগাছের সঙ্গে। তার পিঠে তিনটা কাদাখোঁচা পাখি। পিঠের পোকা খাচ্ছে। গরুটা আরাম করে চোখ বুজে শুয়ে আছে।

কাচারিঘরের সামনে টং। ছড়ানো খড়ের গায়ে লুটাচ্ছে বিকেলের রোদ।

সেই রোদে পা ডুবিয়ে টঙে বসে আছেন রেনু। বেগুনি ধরনের একটা শাড়ি তাঁর পরনে।

শাড়ির আঁচল মাথায় জড়ানো। বেগুনি শাড়ির ফাঁকে ফরসা মুখটাকে লাগছে শালিকের রোগা ঠ্যাঙের মতো।

মুজিব তাঁর দিকে ঘুরে বসেন। বাঁশের টং মচমচ করে শব্দ তোলে।

রেনু কলকাতা যেতে চাইছেন।

নিয়ে যাওয়াই তো উচিত। তাঁর কাজের অসুবিধা হবে। রাজনীতির কাজে তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত। আবার সামনে আইএ পরীক্ষাও। এই অবস্থায় রেনুকে নিলে হোস্টেলের বাইরে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হবে। বাসা জোগাড় করা কোনো ব্যাপার নয়। কলকাতায় এখন বাসা ভাড়া পাওয়া যায় সহজেই। যুদ্ধে জাপানি বোমার ভয়ে যারা শহর ছেড়ে চলে গেছে, তাদের অনেকেই ফেরেনি।

হোস্টেলে পরীক্ষার আগে থাকলে সুবিধা। সহপাঠীদের কাছ থেকে পড়া বুঝে নেওয়া যেত। বইপত্র, সিলেবাস, নোট—সব পাওয়া যেত হাতের কাছেই। তবে অসুবিধা হলো, সারাক্ষণ রুমে মানুষজন গিজগিজ করে। এরই মধ্যে তিনি কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ছেলেরা তাঁর রুমে নানা কারণে আসে, অকারণেই আসে বেশির ভাগ। মুজিব ভাইয়ের দরোজা সবার জন্য খোলা।

তবে রেনুর একটু হাওয়া বদল করা দরকারও। মেয়েটা কী রকম রোগা হয়ে গেছে। ১৭-১৮ বছরের তরুণীর মুখখানা কী রকম ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আর কী রকম দুখী!

তাঁদের একটা ছেলে হয়েছিল। ছেলেটা কয়েক দিন বেঁচে ছিল।

মুজিব চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, হাতের কাজগুলো শেষ করেই বাড়ি চলে আসবেন। হাতের কাজ কি সহজে শেষ হয়? কলকাতায় পার্টির প্রাদেশিক সম্মেলন হলো। তারপর যেতে হলো কুষ্টিয়া। মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক সম্মেলন। এই সম্মেলনে হাশিম গ্রুপের সমর্থিত বামপন্থী প্যানেল ছিল। মুজিবকে সেই প্যানেলকে জিতিয়ে আনার জন্য নানা চেষ্টাচরিত্র করতে হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে দেখা গেল, ডানপন্থীরা দলে ভারী। মারামারি পর্যন্ত লেগে গেল। শেখ মুজিব কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিলেন খাজাদের ধামাধরা শাহ আজিজের মুখ বরাবর। শেখ মুজিবের পেছনে ছিলেন বামপন্থীদের অনেকেই। খানিকটা পেছনে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদরাও। কিন্তু শেষতক তাঁদের সমর্থিত প্যানেল হেরে গেল।

তারপর মুজিব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ফরিদপুর আর গোপালগঞ্জের সম্মেলন নিয়ে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব উঠেছেন তাঁর বন্ধুর বাসায়। আবুল হাশিম সাহেব উঠেছেন শহরের উপকণ্ঠে নদীর ধারে এক বাংলোয়। আবুল হাশিম সাহেব নিজে দায়িত্ব দিয়েছেন মুজিবকে। ডানপন্থী মোহন মিয়া খাজার এক নম্বর দালাল। তাঁরা যেন জিততে না পারেন। না, এখানে ডানপন্থীদের জিততে দেওয়া যায় না। এটা মুজিবের নিজের এলাকা। মোহন মিয়া আর ওয়াহিদুজ্জামানের দল তাঁর চিরদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী। হাতে লাঠি, সড়কি, রামদা নিয়ে তাঁদের ভাড়াটে গুন্ডারা সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত। কিন্তু তাঁর নাম মুজিবুর রহমান। এসব দেখে ভয়ে দমে যাওয়ার পাত্র তো তিনি নন। তিনিও নির্দেশ দিলেন কর্মীদের, ‘লাঠি আনো।’ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর আবুল হাশিম বসে আছেন মঞ্চে। সঙ্গে আছেন অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার। তিনি আবুল হাশিমদের নিরাপত্তা দেবেন। শেখ মুজিব মঞ্চের একদিকে অবস্থান নিয়েছেন। বিপরীত পাশে ডানপন্থীরা। প্রথমে শুরু হলো কথা-কাটাকাটি। তারপর ধস্তাধস্তি। পুলিশ কমিশনার রিভলবার বের করলেন। সোহরাওয়ার্দী অভূতপূর্ব সাহসের পরিচয় দিলেন। তিনি মঞ্চ থেকে নামলেন। বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হতে দাও। ভোটে যে প্যানেল জিতবে, তাকেই মেনে নেব আমরা। এর নাম গণতন্ত্র।’

ভোট হলো। শেখ মুজিবের প্যানেলই জয়লাভ করল। ফরিদপুরেও তিনিই জিতলেন।

গোপালগঞ্জে সম্মেলন শেষে সোহরাওয়ার্দী আর আবুল হাশিমকে মুজিব তাঁদের গোপালগঞ্জের বাসায় নিয়ে গেলেন। চা এল। সবাই গল্পে মেতে উঠলেন।

গোপালগঞ্জ থেকে অতিথিদের বিদায় দিয়ে মুজিব রওনা দিলেন টুঙ্গিপাড়ার পথে। খবর পেয়েছিলেন, রেনুর শরীরটা ভালো নয়। কিন্তু ছেলে যে মারা গেছে, জানতেন না।

সেটা শুনলেন সমীর মাঝির কাছে। নৌকায় চড়ে বসার পরই সমীর মুখ খুলল, ‘মিয়া ভাই, এত দিনে আইলেন! ছাওয়ালটার মুখটাও তো দেখতে পারলেন না। ভগবান ভগবান!

সমীর মাঝির মুখের দিকে তাকাতে সাহস পেলেন না মুজিব। তিনি শীতার্ত নদীটির দিকে তাকালেন। তখন সন্ধ্যা। আকাশ লাল হয়ে আছে। লালচে ঢেউগুলো তিরতির করে কাঁপছে।

আকাশে একঝাঁক পাখি। ঘরে ফিরছে।

একটা মাছ লাফিয়ে উঠল বইঠার আঘাত পেয়ে।

তাঁর চোখে জল এসে যাচ্ছে। তিনি চশমাটা খুলে কাচ মুছলেন পকেট থেকে রুমাল বের করে। চশমার কাচের দোষ নাই, আসলে তাঁর চোখই ঝাপসা।

রেনু তাঁর পাশে বসে আছে। এই মেয়েটি তাঁর জন্ম থেকেই যেন তাঁর সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে বেঁধে ফেলেছে। কিন্তু তিনি তাকে সময় দিতে পারলেন কই। একা একা মেয়েটা দশ মাস তাঁর সন্তানকে ধারণ করেছে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে। তারপর দেখেছে ছেলের মুখ। বাবা আসার আগেই ছেলে বিদায় নিয়েছে।

সেই দুখের দিনগুলো কী করে পার করেছে রেনু!

এবার আসার পরও রেনুর কোনো অভিযোগ নাই। শুধু বললেন, ‘এত দিনে আসলা? ভালো ছিলা? শুনেছ সব?’

শেখ মুজিব তাঁর ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনলাম।’

‘কালকে কবরস্থানে যাইয়ো। রাতের বেলা আর যাওয়ার দরকার নাই। হাতমুখ ধোও। আমি পানি তুইলে দেই।’

‘তোমাকে পানি তুলে দেওয়া লাগবে না। বাড়িতে লোকের অভাব পড়েছে নাকি।’

মা-ই বরং কাঁদলেন, ‘খোকা, পোলা হয়েছিল। ঠিক তোর মতন দেখতে হয়েছিল।’

শেষরাতে সেদিন ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মুজিবের। নিঝুম রাত্রিতে ঝিঁঝির ডাক, বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক ভেদ করে তিনি শুনতে পান কান্নার শব্দ। লেপটা সরিয়ে রেনুর চোখে হাত দিয়ে টের পান অশ্রু।

রেনু কাঁদছে।

‘কী হয়েছে, রেনু? কানতেছ ক্যান?’

‘তুমি আসলা না, আমি তো তোমার ছেলেরে তোমারে দেখাতে পারলাম না!’

‘কাইন্দো না, রেনু। দোষ তো আমারই। আমিই তোমার পাশে থাকতে পারি নাই।’

.

সকালবেলা ছেলের কবরের কাছে এলেন মুজিব। জিয়ারত করলেন। বাঁশঝাড়ের নিচে পারিবারিক গোরস্থান। সেখানে একটা ছোট্ট কবর। বাঁশের বেড়া এখনো কাঁচা। শিথানে খেজুরের পাতা হলদে হয়ে গেছে।

বিকেলে রেনুকে নিয়ে একটু বের হলেন। মেয়েটা কত দিন ঘরের বাইরে আসে না! শরীরটা সূর্যের আলো পায়নি কত দিন, তাই তাকে আরও ফরসা, আরও নীরক্ত দেখাচ্ছে।

উঠান পেরিয়ে কাচারিঘরের পাশে এই টঙে এসে বসলেন দুজন। মুজিবের পরনে লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া। রোদটা চনমনে থাকায় চাদরটা আর নেননি।

রেনু লাল রঙের গায়ের চাদরটা নিয়েছিল, সেটা গুটিয়ে কোলের ওপর রেখেছেন।

মুজিব বললেন, ‘আচ্ছা, বাবাকে বলে তোমাকে নিয়ে যাব কলকাতায়।’

লুৎফর রহমান সাহেব রাজি হলেন না। বললেন, ‘এমনিতেই মাইয়ার শরীরটা ভালো না, তার ওপরে ও কলকাতায় নিয়ে গিয়ে মেয়েটারে কষ্ট দেবে। নিজের কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। কলিকাতা ঢাকা কুষ্টিয়া কইরে বেড়ায়। আজ হিল্লি তো কাল দিল্লি। মিছিল-মিটিং করে। মাইর খায়। আবার কোন দিন অ্যারেস্ট হবিনে। এর মধ্যে বউমারে নিয়ে গিয়ে সে থাকবে কই, বউমা থাকবে কই? সারা দিন সে বউয়ের খোঁজখবর নিতে পারবে?’

বাবার কথার ওপর তো কথা চলে না। রেনুও বললেন, ‘থাক তাইলে, বাবা যখন মানা করতেছেন।’

মুজিব গিয়ে ধরলেন মাকে। ‘মা, তুমি বাবারে বুঝাও, আমি কিন্তু রেনুরে নিয়া যাবই। কলিকাতা গেলে ওর মনটা যদি একটু ভালো লাগে!’ মা মুশকিলে পড়লেন। এক দিকে বাপ, আরেক দিকে পোলা। তিনি এখন কী করবেন?

শেষে বললেন, ‘খোকা, তুই যা। আমি বউমারে পাঠায়া দিব নে।’

‘কেমনে দিবা?’

‘তুই যা না। দ্যাখ, কেমনে কী করি?’

‘আচ্ছা, আমি কলিকাতা গিয়া বাসা ঠিক করে তোমারে চিঠি লিখতেছি। তখন তুমি পাঠায়া দিয়ো।’

মুজিব চলে গেলেন কলকাতা। কিন্তু মনটা ভার হয়ে রইল। যাওয়ার দিন রেনুর দিকে তাকানোর সাহসও হচ্ছিল না। মেয়েটা তাঁর সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। তিনি তাকে সঙ্গে নিতে পারলেন না!

মা বললেন, ‘খোকা, অত মন খারাপ করে আছিস কেন? বললাম না, আমি পাঠায়া দিব।’

মুজিব কলকাতা গেলেন। বাসা ভাড়া করলেন একটা। চিঠি লিখলেন মাকে। ‘মা, এই যে আমার বাসার ঠিকানা। তুমি বলিয়াছিলা পাঠাইবা। এখন ব্যবস্থা করো।

চিঠি পেয়ে সায়রা বেগম গেলেন লুৎফর রহমানের কাছে।

বললেন, ‘খোকার চিঠি আসছে।’

লুৎফর রহমান বললেন, ‘চিঠি আসছে? কেমন আছে খোকা? পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’

‘সামনে পরীক্ষা। কিন্তু পড়াশোনা ভালো হচ্ছে না। আলাদা বাসা নিছে। হোটেলে খায়। সেখানকার রান্না ভালো না। খোকার পেটের অসুখ।’

‘আলাদা বাসা ভাড়া নিছে ক্যান?’

‘পরীক্ষার সময় হোস্টেলে রুমে ভিড়-হইচইয়ে সে পড়তে পারে না।’

‘তাইলে এখন কী করবা? ভালো ডাক্তার দেখাইতে কও?

‘রান্না খারাপ হইলে ডাক্তার কী করবে?’

‘তাইলে তো দুশ্চিন্তার কথা?’

‘বউমারে পাঠায়া দেই। পরীক্ষার কয়টা দিন থেইকে আসুক। রান্নাও করতে পারবে, আবার একটু হাওয়াও বদল হবেনে। পোলাটা মারা যাওয়ায় বউমার মনটাও খারাপ।

‘কার সাথে যাবে?’

‘তুমি রাজি হইলে সে ব্যবস্থাও আছে।’

লুৎফর রহমান রাজি হলেন। রেনুকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। মুজিবের পরীক্ষার কটা দিন কলকাতায় থেকে আবার ফিরে এলেন রেনু।

কারণ, মুজিবের অনেক কাজ। দেশ তাঁকে চায়।

মুসলিম লীগের সম্মেলন হচ্ছে কলকাতায়। মুসলিম ইনস্টিটিউটে। ঢাকা থেকে তাজউদ্দীন গেছেন কাউন্সিলর হিসেবে। শরৎকালের শেষ দিক। ধীরে ধীরে গরমের ভাব কমে গিয়ে আবহাওয়াটা মিষ্টি হয়ে উঠেছে। এই কাউন্সিলটা হচ্ছে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠনের জন্য। এই বোর্ড থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, কারা হবেন প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রার্থী।

এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের। তাজউদ্দীন সব সময়ই বামপন্থী গ্রুপের সঙ্গে আছেন।

শেখ মুজিব আছেন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে।

কিন্তু সোহরাওয়ার্দী নিজেই দোটানায় পড়ে গেছেন। তরুণেরা সবাই আবুল হাশিমের ভক্ত। শেখ মুজিব নিজেও চান আবুল হাশিমই সাধারণ সম্পাদক থাকুন। এদিকে প্রবীণদের মধ্যে কানাঘুষা, আবুল হাশিম আসলে কমিউনিস্ট। তাকে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে রাখা ঠিক হবে না। খাজা নাজিম উদ্দিন, মওলানা আকরাম খাঁ এসে ধরলেন সোহরাওয়ার্দীকে। আবুল হাশিমকে সরাতে হবে। আবুল হাশিমের বদলে ডাক্তার আবদুল মোত্তালিব হবেন সাধারণ সম্পাদক। সোহরাওয়ার্দী সেই কথা জানিয়ে দিলেন আবুল হাশিমকে। আবুল হাশিম বিনা বাক্যে সেই প্রস্তাব মেনে নিলেন

সোহরাওয়ার্দী মানতে পারেন, আবুল হাশিমও মানতে পারেন। কিন্তু তরুণেরা কি তা মানবে? শেখ মুজিব কি তা মেনে নেওয়ার পাত্র?

সন্ধ্যার পর কাউন্সিল চলছে।

সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সামনে তরুণেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করল।

ডানপন্থীরা খেপে গেল। তারা শুরু করল হাতাহাতি।

ফরিদপুরের মোহন মিয়া হঠাৎই মুন্সিগঞ্জের বামপন্থী গ্রুপের শামসুদ্দিন আহমেদকে সজোরে লাথি মেরে বসলেন। লাথি তাঁর পেটে লাগল। তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। শেখ মুজিব এই দৃশ্য সহ্য করার ব্যক্তি নন। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন মোহন মিয়ার ওপর। তাঁর গলা চেপে ধরে তাঁকে ফেলে দিলেন মাটিতে। ওইখানে চেপে ধরে রাখলেন।

সভার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেল।

পরের দিন আবার শুরু হলো অধিবেশন

তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন।

তিনি আবুল হাশিমের পক্ষে। আর কে সাধারণ সম্পাদক হবে, সে সিদ্ধান্ত ভোটের মাধ্যমে নেওয়ার পক্ষে জোরালো ভাষায় বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন। শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বরে অমিত তেজ, তার বক্তব্য অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। পুরো সভা স্তব্ধ হয়ে রইল তার ভাষণের সময়। ওই বক্তব্যে কেবল পুরো কাউন্সিল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল না, সোহরাওয়ার্দী নিজেও অভিভূত হয়ে গেলেন।

সোহরাওয়ার্দী দুটো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। একটা সিদ্ধান্ত তিনি জানিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক কে হবে, তার সিদ্ধান্ত নেবে কাউন্সিলররা, ভোটের মাধ্যমে। আরেকটা সিদ্ধান্ত সোহরাওয়ার্দী নিলেন মনে মনে, তাঁর বাকি জীবনের জন্য। এত এত কর্মীর মধ্যে কে হবেন তাঁর একান্ত নির্ভরতা, কার ওপরে বাকিটা জীবন তিনি ভরসা করবেন, আজীবন কাকে তিনি তার স্নেহ ও সমর্থন দিয়ে যাবেন, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। এই কর্মীদলের মধ্যে শেখ মুজিবই শ্রেষ্ঠ। যেমন তাঁর সাহস, তেমনি তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা, তেমনি পরিষ্কার তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। এই রকম একজন রাজনৈতিক কর্মীকেই তাঁর দরকার, দরকার দেশের।

কাউন্সিলররা ভোট দিলেন। বামপন্থীরা জয়লাভ করল। আবুল হাশিম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন।

সোহরাওয়ার্দী ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছেন পার্লামেন্টারি দলের নেতা, সেটাও স্থির হয়ে গেল।

কাউন্সিল শেষে মুজিব গেলেন লিডারের বাসায়। সোহরাওয়ার্দী মুজিবকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘মুজিব, আমার জীবনে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আবুল হাশিমকে আর সাধারণ সম্পাদক রাখব না। এই সিদ্ধান্ত আবুল হাশিম সাহেবও মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা তরুণেরা এটা মানলে না। কিন্তু আমি আমাদের আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি কেবল তোমার বক্তৃতা শুনে। সত্যি তো, কাউন্সিলররা সিদ্ধান্ত নেবে কে হবেন সাধারণ সম্পাদক। এটাই তো ডেমোক্রেসি। তোমাকে ধন্যবাদ আমার চোখ খুলে দেওয়ার জন্য।’

মুজিব সোহরাওয়ার্দীর আলিঙ্গনে। তাঁর কালো ফ্রেমের চশমার নিচে জল টলমল করছে। এত বড় নেতা সোহরাওয়ার্দী, তিনি কী অনুপ্রেরণাই না দিচ্ছেন একজন তরুণ কর্মীকে। গণতন্ত্রের জন্য সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অঙ্গীকারটাও কত তীব্র।

.

কেন্দ্রীয় আইনসভার ১৩২টি আসনের নির্বাচন নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে মুসলমানদের আসন ৩০টি। শেখ মুজিবুর রহমানের ওপরে দায়িত্ব পড়েছে ফরিদপুরের মুসলিম লীগের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা। দিন নাই, রাত নাই তাঁকে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে হচ্ছে।

ঢাকার দায়িত্ব পড়েছিল কামরুদ্দীন সাহেবের ওপর। তিনি ছিলেন তাজউদ্দীনের নেতা, আর তাজউদ্দীনকে করা হলো উত্তর মহকুমার নির্বাচনী সম্পাদক। কাজেই মুসলিম লীগের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য তাজউদ্দীনও যে দিবারাত্রি খাটবেন, তাতে আর সন্দেহ কী!

শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন—এ দুই তরুণ নেতা তখন একই উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার দুই প্রান্তে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে লাগলেন।

মুজিব ফরিদপুরের সব মহকুমা আর থানায় যান। বক্তৃতা করেন। অসাধারণ বাগ্মী মুজিব এই সময় ফরিদপুরে সবার মুজিব ভাই হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালের ১০ ও ১২ ডিসেম্বরের শীতের দিন দুটো নির্বাচনের হাওয়ায় গরম হয়ে ওঠে 1

নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থীরা ৩০টি আসনেই জয়লাভ করে। বাংলার ছয়টি আসনের সব কটিতেই।

কলকাতার অক্টার লি মনুমেন্টের পাদদেশে মুসলিম লীগ শুকরিয়া দিবসের সভা আহ্বান করে। দলে দলে মুসলমানেরা সেই জনসভায় যোগ দেয়। তাদের মুখে স্লোগান: ছিনকে লেয়েঙ্গে পাকিস্তান, লড়কে লেয়েঙ্গে পাকিস্তান, সিনামে গুলি লেয়েঙ্গে পাকিস্তান।

ছেলেপুলেরা ছড়াও কাটে : কানমে বিড়ি মুখে পান, লড়কে লেয়েঙ্গে পাকিস্তান।

কামরুদ্দীন আহমদ কলকাতায় সেই দৃশ্য দেখেন। তাঁর বুক ভেঙে আসতে চায়। তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন, সমস্তটা সমাজ যেন পাগল হয়ে গেছে।

.

এরপর ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন।

নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব মনোনয়ন ঘোষণা করবেন। তার আগে এলাকায় পৌঁছে একটু জনমত যাচাই করে নেওয়া দরকার। সিন্দিয়াঘাট থেকে দেশি নৌকায় চলেছেন সোহরাওয়ার্দী। সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানসহ গোটা ১৫ জন কর্মী। রাতের মধ্যে গোপালগঞ্জ পৌঁছানো

গোপালগঞ্জ পৌঁছানো দরকার। সকালবেলাতেই সোহরাওয়ার্দীকে মনোনয়ন ঘোষণা করতে হবে।

এমনিতেই যাত্রারম্ভ করতে দেরি হয়ে গেছে।

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘আমরা কি ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারব, মুজিব?’

মুজিব বললেন, ‘আচ্ছা, একটা কাজ করি। মাঝি ভাই, আপনারা নেমে যান নৌকা থেকে। গুণ টানেন।’

মাঝিরা বলল, ‘আমরা গুণ টানলে দাঁড় বাইব কেডা? হাল ধরব কেডা?’

মুজিব বললেন, ‘আমরা বসে থাকব নাকি। আমরা পালা করে দাঁড় বাইব, হাল ধরব। আপনারা গুণ টানেন।

মাঝিরা নেমে গেল।

মুজিব নিজে দাঁড় টানতে লাগলেন।

পানিতে দাঁড় পড়ছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ উঠছে। পানির ছিটা এসে পড়ছে তার গায়ে।

তারা বহুক্ষণ কিছু খাননি। সবারই খিদে পেয়েছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।

সাতপাড় বাজার দেখা যাচ্ছে। দূর মাঠে আলপথে বাঁক কাঁধে, ঝাঁকা মাথায় হাটুরেরা যাচ্ছে হাটের দিকে।

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘তোমরা একটু নৌকাটা থামাবে? আমি আসছি।’ তিনি নেমে গেলেন নৌকা থেকে। ফিরলেন খেজুরের গুড় আর চিড়া কিনে।

সেই চিড়া-গুড় তিনি বিতরণ করলেন সবার মধ্যে। আগে দিলেন নৌকার মাঝিদের। তারপর কর্মীদের। শেষে তিনি নিজেও চিড়া আর গুড় চিবুতে লাগলেন।

ওই চিড়া-গুড় খেয়েই তারা কাটিয়ে দিলেন। কেউই ভাতের নাম মুখে আনলেন না।

.

বঙ্গীয় আইনসভার ২৫০ আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৯ আসন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ আর শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে। ১০ হাজার যুব স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে শেখ মুজিব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারণার কাজে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করতে লাগলেন। তাজউদ্দীন ব্যস্ত রইলেন ঢাকা অঞ্চলে।

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘মুজিব, আমার একটা গোপন প্ল্যান আছে। আমি চাই, তুমি ফজলুল হক সাহেবকে বরিশালে ব্যস্ত রাখো। তাহলে তিনি আর বাংলার অন্যত্র প্রচার চালাতে পারবেন না। তাহলে আমাদের মুসলিম লীগের কাছে তাঁর কৃষক প্রজা পার্টি সহজেই হেরে যাবে।’

মুজিব বললেন, ‘তা-ই হবে, লিডার।’ তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের নামিয়ে দিলেন বরিশাল অঞ্চলে।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রচারাভিযানে বেরোলেন। ৪২টি জলযানের এক বিশাল বহর নিয়ে বরিশাল চললেন তিনি। সঙ্গে শেখ মুজিবসহ আরও আরও নেতা। তাঁরা এক মাস প্রচার চালালেন বরিশাল অঞ্চলে।

ফরিদপুরে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন মোহন মিয়া। তিনি ডানপন্থী গ্রুপের লোক। মুজিব ফরিদপুরের নির্বাচনী প্রচারদলের প্রধান। স্বেচ্ছাসেবক, নির্বাচনী প্রচারণার নানা জিনিসপাতি—সব তাঁর অধীনে। তিনি নানা জায়গায় মুসলিম লীগের জন্য ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন, শুধু ফরিদপুরে মোহন মিয়াকে টাকা দিচ্ছেন না, স্বেচ্ছাসেবক পাঠাচ্ছেন না, জিনিসপাতি দিয়েও সাহায্য করছেন না। মোহন মিয়া লিখিত অভিযোগ দিলেন মুজিবের বিরুদ্ধে। মুজিব বললেন, ‘অভিযোগ সত্য। মোহন মিয়া নিজে জমিদার। তাঁর কেন কেন্দ্রের সাহায্য লাগবে। এসব যার নাই তার জন্য, যার আছে তার জন্য না।’

১৯৪৬ সালের মার্চে নির্বাচন হলো। সর্বত্র মুসলিম লীগের জোয়ার। ১১৭টা আসনের ১১০টাই জিতল মুসলিম লীগ। যে সাতটা আসনে জিততে পারল না, তার একটা ফরিদপুরের মোহন মিয়ার আসন।

শেখ মুজিব এইখানে রাজনীতির মধ্যে একটু ‘পলিটিকস’ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

বৈশাখের এক উত্তপ্ত দিনে অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবের লিডার সোহরাওয়ার্দী শপথ নিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *