যারা ভোর এনেছিল – ১৫

১৫

জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। কাঁঠালপাকা গরম। কাঁঠালগাছগুলোর কাঁঠাল নিশ্চয়ই পাকতে শুরু করেছে। শুধু নদীর ধারের মড়াঘাঁটির কাঁঠালগাছটার কাঁঠাল অবশ্য বর্ষাকালে পাকে। কিন্তু এই রকম গরম পড়লে কাঁঠাল তো কাঁঠাল, পাথরও পেকে গলে যেতে পারে।

এই গরমে শেখ লুৎফর রহমান সাহেব বেরিয়েছেন তাঁর বাড়ি থেকে। হেঁটে হেঁটে নদীর ঘাটে গেলেন তিনি। ওখানকার দোকান থেকে চারটা ব্যাটারি কিনলেন। রেডিওটা কাল খুব শোঁ শোঁ আওয়াজ করেছে। ব্যাটারি না বদলালেই নয়।

হেঁটেই ফিরলেন বাসায়।

রেডিওতে আজ আছে বিশেষ অনুষ্ঠান। ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ভাইসরয় লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন (অব বার্মা) তাঁর ঘোষণা দেবেন। ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ে হবে এই ঘোষণা।

শেখ লুৎফর রহমান সাহেব হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। সাতটা ১০ বাজে। দিল্লি সময় সাতটায় ভাষণ হবে। তার মানে, ঢাকার সময় সাতটা ৪০ মিনিট। এখনো ২০ মিনিট দেরি আছে।

সাতটা ২৪ বেজে গেল। আবার ঘড়ির দিকে তাকালেন শেখ লুৎফর রহমান।

মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা দিলেন আরও কয়েক মিনিট পর। ইংরেজিতে বললেন, ভারত দুটো দেশে ভাগ হবে—ভারত আর পাকিস্তান। এইভাবে ভারত স্বাধীনতা পাচ্ছে।

এরপর বললেন জওহরলাল নেহরু আর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। দুজনেই জানালেন, এই প্রস্তাবে তাঁরা সম্মত আছেন। জওহরলাল নেহরু বক্তৃতা করলেন হিন্দিতে। তাঁর গলার স্বরেই বোঝা গেল, তিনি কিছুটা হতাশ। তিনি মহাত্মা গান্ধীকে ধন্যবাদ দিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল আত্মবিশ্বাস।

লুৎফর রহমান সাহেব খুশি।

তিনি হাঁক ছাড়লেন, ‘রেনু রেনু।’

রেনু এল। ‘বাবা, ডেকেছেন?’

‘মা, তোমার স্বামীর মোকসেদ তো পুরো হয়ে গেল। পাকিস্তান হয়েই যাচ্ছে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভাষণ দিল। কায়েদে আজম ভাষণ দিলেন। যাও। খুশির খবরটা তোমার মারে জানাও।’

রেনু বলল, ‘বাবা, বাংলা কি দুই ভাগ হবে?’

‘হ্যাঁ। তাই তো।

‘কলিকাতা কি ইন্ডিয়াতে পড়বে, আর ঢাকা পাকিস্তানে?’

‘তা-ই তো মনে হয়।’

‘সোহরাওয়ার্দী সাহেব তো এখন সেইটা আর চায় না।’

‘চায় না! তাইলে কী চায়?’

‘তারা এখন চায়, বাংলা স্বাধীন হোক। কিন্তু বাংলা ভাগ করা যাবে নানে।’

‘একেক সময় একেকটা চাইলে হবে?’

‘কী জানি।’ রেনু বলল।

‘আরে, আমি আরও খুশি মনে চাইরটা ব্যাটারি কিইনে আনলাম। খবরটা শুনে খুশি হলাম। এর মধ্যে অরা আবার নতুন লাইন ধইরেছে।’

শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে আর সবার সঙ্গে বসে মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণা শুনলেন। তবে তিনি হতাশ নন। দিল্লিতে বসেছে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল। সেখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেব, আবুল হাশিমরা বাংলার পক্ষ থেকে কথা বলবেন। জানিয়ে দেবেন, বাংলা ভাঙার পক্ষে তাঁরা নন। শরৎ বসু, আবুল হাশিম এই মর্মে একমত হয়েছেন। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের এই দুই নেতার মধ্যে। জিন্নাহও বলেছেন, দুই বাংলা এক থাকলে তো খুব ভালো হয়। কলকাতা ছাড়া বাংলাকে নেওয়ার কোনো মানে হয় না। কাজেই এই মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা মুসলিম লীগের কাউন্সিলে প্রত্যাখ্যানও হতে পারে।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব, আবুল হাশিম সাহেব আর বাংলার কাউন্সিলররা বসেছিলেন থিয়েটার রোডের সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাসভবনে। সবাই ঠিক করেছেন, বাংলা ভাঙার প্রস্তাব এলে তাঁরা বিরোধিতা করবেন। এর অন্যথা তো হওয়ার কথা না। কাউন্সিলরদের একজন ঢাকার তাজউদ্দীন। তাঁর সঙ্গে মুজিবের কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে একমত। জিন্নাহই তো বলেছেন, পোকায় খাওয়া পাকিস্তান তিনি চান না।’

তাজউদ্দীন আহমদ আর ঢাকার কাউন্সিলররা আবুল হাশিমকে ঘিরে বসে আছেন দিল্লির ইম্পিরিয়াল হোটেলের লবিতে। এই হোটেলেই আজ তাঁদের কাউন্সিল হয়ে গেছে। সকালবেলা। এখান থেকে গিয়ে জিন্নাহ রেডিওতে বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁরা খুবই হতাশ। কারণ, সোহরাওয়ার্দী তাঁর কথা রাখেননি। তিনি আগেভাগে দিল্লি এসেছিলেন প্লেনে। সোহরাওয়ার্দীকে ডেকে জিন্নাহ বলেছিলেন, জিন্নাহর প্রস্তাব যেন তাঁরা সমর্থন করেন। জিন্নাহর কথায় সোহরাওয়ার্দী রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।

আজ রেডিওতে ভাষণের আগে, সকালবেলা, কাউন্সিলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জিন্নাহ পাস করিয়ে নিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বাংলা ভাগ করে পাকিস্তান বানানোর প্রস্তাবটা সমর্থন করার জন্য জিন্নাহ উপস্থাপন করলেন।

এই সময় তাজউদ্দীন যা ঘটতে দেখলেন, তা মনে করে তাঁর শরীর এখনো কাঁটা দিচ্ছে।

হোটেলের রান্নাঘর থেকে খাকসার আন্দোলন নামে একটা স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর সদস্যরা বেলচা হাতে আক্রমণ করতে এল সভাকক্ষের সামনে ও পেছনে—দুই দিক থেকেই। সামনের দিকে সভা পাহারা দেওয়ার জন্য ছিল বাংলা ও পাঞ্জাবের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আর পেছন দিকে ছিল পাঞ্জাবি স্বেচ্ছাসেবকের দল। খাকসারদের ওপরে তারা চড়াও হলো। খাকসারদের রক্তে ভেসে গেল সম্মেলনকক্ষের মেঝে। রক্তাক্ত খাকসারদের সরিয়ে আবার সভার কাজ শুরু হলো। আবুল হাশিম বললেন, ‘আমার কিছু কথা আছে।’

জিন্নাহ বললেন, ‘না, আবুল হাশিমকে বলতে দেওয়া হবে না।’ কাউন্সিলররা বললেন, ‘না, আমরা আবুল হাশিমের কথা শুনতে চাই।’ জিন্নাহ বললেন, ‘আমি যদি এখন আবুল হাশিমকে বলতে দেই, তাহলে তাঁর বক্তব্য খণ্ডন করতে আমার ১০ জন প্রথম শ্রেণীর বক্তাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এত সময় আমার হাতে নাই।’

কাউন্সিলররা তবু হইচই করতে লাগলেন।

জিন্নাহ কঠিন গলায় বললেন, ‘আলোচনা করার কী আছে। বাংলা আর পাঞ্জাবের ভাগ নিয়ে কথা তো! এই বিষয়ের মীমাংসা হয়ে গেছে বলে ধরে নিতে হবে। আপনাদের মাউন্টব্যাটেনের রোয়েদাদ হয় সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে হবে, না হয় সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিতে হবে। বলুন, হ্যাঁ কি না?’

হাত উঠিয়ে ভোট হলো। সোহরাওয়ার্দী বিজয়ীর ভঙ্গিতে বললেন, ‘কায়েদে আজম, কেবল ১১ জন আমাদের বিপক্ষে, আর সবাই পক্ষে। প্রস্তাব পাস।

তাজউদ্দীন আর কামরুদ্দীন আবুল হাশিমকে বললেন, ‘কী করবেন এখন।’

আবুল হাশিম বললেন, ‘একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছি। তাতে লিখেছি, মুসলিম লীগের কাউন্সিলরদের সিদ্ধান্ত তিন প্রকার ভয়ের পরিণাম—এক. জিন্নাহর প্রতি চিরাচরিত ভীতি, দুই. অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কা আর তিন. জিন্নাহ অসন্তুষ্ট হলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানে সরকারি পদ পেতে অসুবিধা হবে, এই ভয়। তাজউদ্দীন, কেমন হলো আমার বিবৃতিটা?’ আবুল হাশিম জিজ্ঞেস করলেন।

‘ভালো। কিন্তু এই সব বলে এখন কী হবে?’

‘বলে রাখলাম। ভবিষ্যতের ইতিহাস জানবে, আবুল হাশিম প্ৰতিবাদ করেছিল।’

‘এরপর আমাদের আর কোনো আশা নাই?’

কামরুদ্দীন বললেন, ‘একমাত্র আশার জায়গা হলো বাংলার এমএলএদের ভোট। তাঁরা যদি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন, তাহলে বাংলা ভাগ রোধ করা যাবে।’

সেই আশা নিয়ে তাজউদ্দীনসমেত পূর্ব বাংলার কাউন্সিলররা গেলেন দিল্লির খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগা শরিফে। সেখানকার পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করলেন তাঁরা।

প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসল। প্রথমে পূর্ব বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর এমএলএরা ভোটাভুটিতে অংশ নিলেন। ১০৬- ৩৫ ভোটে প্রস্তাব পাস হলো, বাংলা ভাগ করা চলবে না।

এরপর পশ্চিম বাংলার অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর এমএলএরা ভোট দিলেন। এবার বাংলা ভাগ না করার প্রস্তাব গৃহীত হলো ৫৮-২১ ভোটে।

এরই মধ্যে একটা কিছু ঘটল। এরপর উভয় অংশের যুক্ত অধিবেশন বসল। এবার দেখা গেল, বাংলা ভাগের পক্ষে প্রস্তাব পাস হলো ১২৫-৯০ ভোটে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী সংবাদপত্রে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালেন, ‘আশা- নিরাশার যন্ত্রণার ইতি হলো অবশেষে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রের আদর্শের পিঠে ছুরিকাঘাত করা হলো। বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করা হবে অচিরেই। মুসলিম বাংলার ক্ষোভের বিশেষ কোনো কারণ নেই। আমরা অবশ্য চেয়েছিলাম সুষম ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র, যেখানে আমরা স্বনির্ভর হয়ে আমাদের সম্পদের সদ্ব্যবহার করে বিশ্বের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গড়তে পারতাম। কিন্তু সেই লক্ষ্যের পথে যৌথভাবে এগিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি।’

এবার তিনি কেন আবার বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বললেন, তাজউদ্দীন কিছুই বুঝছেন না। খবরের কাগজে সব পড়ছেন। কামরুদ্দীন সাহেবের বাসায় গিয়েই খবরের কাগজ পড়েন তিনি। ইত্তেহাদ-এ ছাপা হয় সোহরাওয়ার্দীর পক্ষের খবর ও লেখা। আজাদ-এ ছাপা হয় খাজা নাজিম উদ্দিনের পক্ষের খবর। পরস্পরকে আক্রমণও করছে তারা।

কামরুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘মনে হয় সোহরাওয়ার্দী সাহেব বুঝে গেছেন, পাকিস্তানে তিনি মন্ত্রিত্ব পাচ্ছেন না। লিয়াকত আলী খান তো তাঁকে দুই চক্ষে দেখতে পারেন না।’

‘কী জানি।’ তাজউদ্দীন মাথা চুলকাতে লাগলেন।

‘চলেন, কলকাতা থেকে ঘুরে আসি। আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে আসি।’

‘চলেন।’

১৬

তাজউদ্দীন আবার গেলেন কলকাতা। তিনি একা নন। পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগের বিভিন্ন জেলার আবুল হাশিমপন্থী কর্মীরা। এখন তাঁদের কর্তব্য কী। এত দিন তাঁরা একবার পাকিস্তান, একবার অখণ্ড বাংলার পক্ষে কাজ করেছেন। সব সময় তাঁরা আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপে ছিলেন। খাজা নাজিম উদ্দিনদের দলে কখনো ভেড়েন নাই। এবার তাঁরা কী করবেন। বাংলা যদি সত্যি ভাগ হয়ে যায়, তাহলে আবুল হাশিম ঢাকায় আসবেন তো?

আবুল হাশিম বললেন, ‘না, আমি কলকাতা ছাড়ব না। আপনারা, বাংলাদেশের সমস্ত বামপন্থীরা একটা যুক্তফ্রন্ট গঠন করুন। ঢাকা যান। ঐক্য রচনা করুন।’

শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, ‘আমি তো এখন ঢাকায় ফিরতে পারব না। কারণ, সামনে আমার পরীক্ষা। বিএটা দিয়ে যাই অন্তত। তার ওপর সামনে প্রাদেশিক পরিষদ তাদের নেতা নির্বাচন করবে। এবার মনে হচ্ছে, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ওরা সরাতে চাচ্ছে। আমি দেখি, লিডারের পাশে থাকি। আপনারা যান। পরীক্ষা দিয়ে আমিও আসব। আমাদের আবার শুরু করতে হবে। আমরা পূর্ব বাংলাতেই আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমরা হার মানব না।’

এই বার্তা নিয়ে তাজউদ্দীন ফিরে এলেন ঢাকায়।

মুজিব রইলেন তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। নেতা আদেশ করলেন, ‘সিলেটে গণভোট হবে। ওরা পাকিস্তানে থাকবে, নাকি ভারতে থাকবে। মুজিব, তুমি যাও। সিলেটবাসীকে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করো।’ ৫০০ কর্মী নিয়ে শেখ মুজিব চলে গেলেন সিলেটে। ব্যাপক প্রচার চালালেন পাকিস্তানের পক্ষে। সিলেটবাসী পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিল।

এখানেই শেখ মুজিবের দেখা হলো মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। তিনিও সিলেটে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। মুজিব গিয়ে তাঁর পায়ে সালাম করলেন, ‘হুজুর, আমার নাম শেখ মুজিব। আমার জন্য দোয়া করেন।’

‘তুমি শেখ মুজিব? মুজিবকে জড়িয়ে ধরলেন ভাসানী। ‘মিয়া, তোমার নাম আমি অনেক শুনছি। তোমারে দেখার ইচ্ছা ছিল। আল্লাহ সেইটা মিটায়া দিল।’

সিলেট রেফারেন্ডামে পাকিস্তানপন্থীদের জয় হলো।

ক্লান্ত দেহে কিন্তু হৃষ্টচিত্তে মুজিব ফিরলেন কলকাতায়।

এবার বঙ্গীয় আইন পরিষদের নেতা নির্বাচন। কে হবে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী (চিফ মিনিস্টার)।

এইবার আবুল হাশিম বললেন, ‘আমি যখন সভাপতি হতে চেয়েছিলাম, সোহরাওয়ার্দী নিরপেক্ষতা দেখিয়েছিলেন। এবার আমি নিরপেক্ষতা দেখাব।’

বামপন্থীরা আবারও দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল।

আর তখন পাকিস্তানের জোশ সর্বত্র। এত দিন ধরে খাজাপন্থীরা প্রচার করেছে যে অখণ্ড বাংলার সমর্থক সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান নিয়ে কথা বলার অধিকার নাই।

সিলেটের ১৭ জন পরিষদ সদস্য সোহরাওয়ার্দীর কাছে প্রস্তাব দিলেন, তাঁদের থেকে যদি তিনজন মন্ত্রী নেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা সোহরাওয়ার্দীকেই সমর্থন দেবেন। সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘শর্ত দিয়ে আমি ভোট কিনে নেতা হতে চাই না।’

খাজা নাজিম উদ্দিন টাকা ছড়াতে লাগলেন।

মির্জাপুরের আর পি সাহা টাকার ব্যাগ নিয়ে হাজির হলেন সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে। বললেন, ‘ওরা এমএলএ কিনছে। আপনিও কিনুন। আপনার জন্য এই যে টাকা…’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘টাকা দিয়ে এমএলএ কিনতে হবে? আমি কেনাবেচার রাজনীতি করি না।’

ভোট হলো। প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন—সোহরাওয়ার্দী আর খাজা নাজিম উদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী পেলেন ৩৯ ভোট, নাজিম উদ্দিন ৭৫ ভোট।

তিনি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব খাজাকে, আর পশ্চিম বাংলার দায়িত্ব প্রফুল্ল ঘোষকে অর্পণ করলেন।

মুজিব গেলেন তাঁর কাছে। ‘নেতা, এখন আমার কী কর্তব্য? কাজ দেন।’ নেতা বললেন, ‘গান্ধীজির সঙ্গে আমি যাব শান্তিমিশনে।’

মাথায় কংগ্রেসি টুপি, পরনে খদ্দর পরে গান্ধীজির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন সোহরাওয়ার্দী।

শেখ মুজিবের মনে হতাশা। এখন তাঁরা কী করবেন? তিনি ইসলামিয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলা হলে ডাকলেন তাঁর ছাত্র-যুব নেতা-কর্মীদের। ‘দরজা বন্ধ করো।’ দরজা বন্ধ হলো।

‘এখন আমরা কী করব?’ একেকজন একেক রকম বক্তব্য দিলেন। এবার মুজিবের বলার পালা। মুজিব বললেন, ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম শেষ হয়নি। এবার আমাদের যেতে হবে বাংলা দেশের পবিত্র মাটিতে। এই স্বাধীনতা স্বাধীনতাই নয়। মুসলিম লীগের বুর্জোয়া মনোবৃত্তি ও তাতে পশ্চিমাদের যে প্রাধান্য, তা থেকে আমার মনে হচ্ছে, হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’

তারপর শেখ মুজিব বসলেন পরীক্ষার হলে।

১৭

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন ডিস্ট্রিক্ট কলম্বিয়ায় এখন গ্রীষ্মকাল। রাস্তায় রাস্তায় ছেলে-বুড়ো সব হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভেতরে শীত বা গ্রীষ্ম আলাদা করে বোঝার উপায় নাই। শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র সরকারি দপ্তরগুলোর ভেতরের আবহাওয়া বারো মাস একই রকম রেখে দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্শাল তাঁর নিজের কেদারায় বসে আরামে পা দোলাচ্ছেন। তাঁর পরনে ঘিয়ে রঙের স্যুট। টাইয়ের রং নীল আর লাল। আমেরিকার পতাকার রং। তাঁর হাতে একটা চিঠি। এই চিঠি যাবে প্রেসিডেন্টের কাছে।

তাঁর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী চিঠিটা মুসাবিদা করেছেন। করেছেন তাঁরই নির্দেশ ও পরামর্শমাফিক। তিনি দুটো ছোট সংশোধনী দিলেন। আরেকবার ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে খটখট শব্দ তুলে সংশোধিত হয়ে কাগজটি এল তাঁর হাতে। তিনি নিচে স্বাক্ষর করে দিলেন।

স্মারক চলে গেল প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের কাছে। চিঠিটা প্রেসিডেন্ট হাতে তুলে নিয়েছিলেন অন্যমনস্কভাবে। পড়তে গিয়ে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ চিঠি।

মার্শাল লিখেছেন, ‘১৫ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তান রাষ্ট্র বলে একটা নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, ভারতের উত্তর-পশ্চিমের একটা বড় অংশ আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটা ছোট্ট অংশ নিয়ে।

‘আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে যদি আমরা রাষ্ট্রটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বীকৃতি দিয়ে দিই; এটা করা যাবে সম্ভাব্য রাষ্ট্রদূত বিনিময়ের অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে।

‘পঁচাত্তর মিলিয়ন লোকের পাকিস্তান হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র, আর এটা হবে রণকৌশলের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।’

হ্যারি এস ট্রুম্যান হাত পাকিয়েছেন হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে। যুদ্ধে জেতার জন্য এটা দরকার ছিল না, দরকার ছিল ওই বোমা কতটা মানুষ মারতে পারে, সেটা যাচাই করে দেখা।

এবার তিনি সেই হাত ব্যবহার করলেন একটা ইশারা প্রদানের কাজে। তিনি মার্শালকে হাত নেড়ে সম্মতি দিলেন, এগিয়ে যাও। মার্শাল শুভেচ্ছাবাণী পাঠালেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটার গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে।

জিন্নাহ ১৫ আগস্টের চার দিন আগে, অ্যাসেম্বলির বৈঠকে জানিয়ে দিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আর জনগণ আমাদের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন। আপনাদের আসন্ন মহান কর্তব্যের সুমহান সাফল্য কামনা করেছেন তাঁরা।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তখন সূর্যস্নান করছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছের ডালে। হঠাৎই ব্যাঙ্গমা উদাসীন হয়ে গেল। ব্যাঙ্গমি বলল, ‘কী হলো?’

ব্যাঙ্গমা বলল, ‘বর্ষাকালে আজকে একটু রোদ উঠছে, কী একটু আরাম কইরা পালকগুলা তাপায়া নিব, ওই দিকে শোনো না আমেরিকানরা কী করে? এই পাকিস্তান রাষ্ট্রটা কী হইব না হইব, না জাইনাই তারা তাগো পেছনে ত্যাল ঢালা শুরু করতাছে।

ব্যাঙ্গমি ঠোঁট দিয়ে লেজটা ঠুকরে নিয়ে বলল, ‘গরিব দেশগুলান ভাবে, তারা নিজের ভাগ্যের চাকা নিজে ঘোরায়। ঘোরায় বটে, তবে সেইটা কোন দিকে যাইব, সেই দিকটা ঠিক কইরা দেয় ওপরঅলা।’

‘ঠিক করব, কিন্তু পুরাটা এবার শ্যাম চাচা পারব না। সেইটা বুঝতে দুই যুগ অপেক্ষা করতে হইব।’

ব্যাঙ্গমি বলে,  

কোন দেশে কী ঘটবে, কে বা করে ঠিক।
নেতা নাকি সৈন্যদল, কিংবা পাবলিক ॥
শ্যাম চাচা কলকাঠি নাড়ে তলে তলে।
গরিবের ভাগ্যচাবি তাদের দখলে ॥

ব্যাঙ্গমা বলে,

তলে তলে নয় কাঠি প্রকাশ্যেই নাড়ে,
পাকিস্তানে নেবে তারা উন্নতির দ্বারে?
ছয় দশকের পরে পাকিস্তান কবে—
আমারে ছাড়িলে তুমি মোর ভালো হবে ॥
তোমার ভাতিজা আমি, তুমি শ্যাম চাচা,
আমারে ছাড়িয়া চাচা প্রাণ মোর বাঁচা

১৮

আজ রাতে স্বাধীন হবে দেশ?

কীভাবে?

পাঞ্জাবিদের অধীনে?

খাজা নাজিম উদ্দিন, লিয়াকত আলী খাঁকে মন্ত্রী বানিয়ে?

তাজউদ্দীনের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। তিনি সকালবেলা উঠে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লেন। প্রেসে যেতে হবে। নতুন দলের কর্মসূচি ছাপাতে হবে এক হাজার।

মুসলিম লীগের সভ্য তিনি। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে আজ রাত ১২টায় ব্রিটিশ শাসনের অবসান হতে যাচ্ছে। তাঁর তো স্বাধীনতা নিয়ে খুশি থাকার কথা। কিন্তু তাঁর মনে এই সব নিয়ে কোনো ভাবনা নাই, উত্তেজনা নাই। তিনি আছেন তাঁর নতুন দলের ম্যানিফেস্টো ইত্যাদি নিয়ে।

তাঁরা আবুল হাশিমের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। ঢাকায় এসে প্রগতিপন্থী সবাই বসেছেন অনেকবার। এবার তাঁরা ঠিক করেছেন, নিজেরা একটা দল করবেন। দলটার নাম একবার ভাবা হয়েছে গণ- আজাদি লীগ। এর মানে হলো, যে আজাদি আমরা পাচ্ছি, তা জনগণের নয়। গণ-আজাদি লীগ তাই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

কামরুদ্দীন সাহেব আছেন। তিনিই আহ্বায়ক।

সেই গণ-আজাদি লীগের ম্যানিফেস্টো প্রেসে কম্পোজ করতে দেওয়া হয়েছে।

তাজউদ্দীন প্রেসে ঢুকলেন। এখনো পেছনের দিকে পাটি বিছিয়ে একজন কর্মচারী ঘুমুচ্ছে। তিনি ঢুকতেই আরেক কর্মচারী তাকে জাগানোর জন্য ‘এই উঠ, এই উঠ, হালায় কত ঘুমায়’ বলে চিৎকার করে উঠল।

প্রুফ তোলা হলো। কাগজে আঠা দিয়ে সেই কাগজ ঠেসে ধরা হয় কম্পোজ করা পাতের ওপর। কালি লাগানো থাকে। ছাপ পড়ে।

তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রুফ দেখলেন। ভুল ছিল। তিনি লাল পেনসিল দিয়ে সেসব কেটে সঠিক অক্ষর বসালেন। বললেন, ‘এখনই এই সব কারেকশন করো। সেকেন্ড প্রুফ দেখে যাব।’

রোজার দিন। তিনি রোজা আছেন।

কোরআন শরিফ খুব সুন্দর পড়তে পারেন।

এখনো গ্রামে গেলে মসজিদে নামাজে ইমামতি করেন।

একটা একটা করে অক্ষর বদলে সংশোধনের কাজ চলছে। কম্পোজিটর ছেলেটার বয়স বেশি নয়। কিন্তু এরই মধ্যে চোখে চশমা নিতে হয়েছে। তার শুকনো পাতলা মুখটাকে দেখাচ্ছেও বুড়োর মতো।

সেকেন্ড প্রুফ এসে গেল। তিনি সেটাও মন দিয়ে দেখলেন।

এক হাজার কপি ছাপবেন। তিনি অর্ডার দিলেন।

বাইরে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি আনমনে বৃষ্টি দেখতে লাগলেন। বাংলার বৃষ্টির অপরূপ রূপ তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বৃষ্টি থেমে গেল আধঘণ্টা পরই। আকাশ একদম ঝকঝকে। রোদ উঠে গেল। রাস্তায় একটু একটু পানি জমেছে।

একটা ইনজেকশন নিতে হবে। ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন হাসপাতালে। ইনজেকশনটা নিলেন

তারপর আবার ছাপাখানা। ছাপার জিনিসটা নিজে সব সময় তত্ত্বাবধান করতে হয়। এখন ধরিয়ে না দিলে কাজটা তারা মেশিনে তুলবেই না। ছাপাখানার ম্যানেজার এরই মধ্যে এসে গেছেন। তিনি বললেন, ‘ভাই, বিলটা তো দেওন দরকার আছিল।

তাই তো। বিল দিতে হবে। কাজ তো উঠে গেছে। আবার ছুটলেন কামরুদ্দীন সাহেবের বাসায়। বাহন তাঁর সাইকেলটা। ২২ বছরের যুবক সাইকেলে চলাচল করেন অনায়াসে।

কামরুদ্দীন সাহেব চেক লিখলেন। কুড়ি টাকার চেক। তাজউদ্দীনের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘শহরে কোনো কিছু দেখলেন? আজ রাতে না স্বাধীন হচ্ছে ভারত।’

তাজউদ্দীন বললেন, ‘আর আমাদের দেশটা হচ্ছে পাকিস্তান। না, তেমন কোনো কিছু দেখিনি। তবে ডেকোরেটরের লোকজন দেখলাম তোরণ বানাচ্ছে।’

‘কাল কি ওরা র‍্যালি-ট্যালি করবে?’

‘নবাব তো বলে দিয়েছেন র‍্যালি মিছিল না করতে। কমিটিরও তো সেটাই সিদ্ধান্ত। কী করবে ওরা, কে জানে?’

চেক নিয়ে তাজউদ্দীন গেলেন পার্টি অফিসে। সেখান থেকে আবার ছাপাখানায়। ম্যানেজারের হাতে চেক তুলে দিলেন। একজন বাইন্ডার দরকার। নিজেই বেরিয়ে গেলেন বাইন্ডারের খোঁজে। কুমারটুলী গিয়ে ধরে আনলেন একজনকে। নিজেরই সাইকেলের সামনে বসিয়ে তাকে নিয়ে চলে এলেন ছাপাখানায়। ততক্ষণে ছাপা শুরু হয়ে গেছে। পড়তে গিয়ে দেখলেন, ভুল রয়েই গেছে। উফ্! কোনো কিছু শুদ্ধভাবে প্রকাশ করা যে কত কঠিন। মেশিন থামালেন। আবার প্রুফ কাটলেন। আবার কারেকশন হলো। ছাপা শেষ হতে হতে বিকেল পেরিয়ে গেল। বাইন্ডারের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন সেখান থেকে।

পার্টি অফিসে এলেন। সেখান থেকে আবার কামরুদ্দীন সাহেবের বাসায়। ইফতারের সময় হয়ে এসেছে। ইফতারি খেলেন।

এর মধ্যে নবাববাড়ি মুসলিম লীগ থেকে প্যাম্ফলেট বেরিয়েছে। কাল শোভাযাত্রা বেরোবে। খাজা নাজিম উদ্দিন এসে পৌঁছেছেন ঢাকায়।

তারাবির নামাজসহ এশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলেন, রাতের আকাশে তারা ঝলমল করছে। তারই পাশে আবার মেঘ। আকাশে এত তারা! সেই আকাশে আবার মেঘ। তিনি তাকিয়ে রইলেন আকাশের দিকে।

এখন থেকে এটা আর ব্রিটিশ ইন্ডিয়া না। এ আকাশ স্বাধীন। আজ শুরু হচ্ছে নিজেদের শাসন।

রাত ১২টার পর ঘুমুতে গেলেন।

স্বাধীনতার ভোরে উঠে নামাজ সেরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন বাইন্ডারের কাছে। সকাল আটটার মধ্যে সেখানে পৌঁছানো সারা। ৫০০ কপি ম্যানিফেস্টো নিয়ে গেলেন কামরুদ্দীন সাহেবের বাসায়। তিনি বাসায় নাই। কার্জন হলে গভর্নর আর তাঁর কেবিনেটের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেছেন।

বিকেলে শুরু হলো স্বাধীনতা দিবসের শোভাযাত্রা। সামনে একটা গাড়িতে খাজা নাজিম উদ্দিন। মধ্যখানে ঢাকার নবাব। বিরাট শোভাযাত্রা। তবে গত বছর ১৬ আগস্টের ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসে এর চেয়ে বড় শোভাযাত্রা হয়েছিল। অবশ্য গতবারের সঙ্গে আজকের শোভাযাত্রার একটা বড় পার্থক্য আছে। আজকেরটায় হিন্দুরাও যোগ দিয়েছে।

সাড়ে চারটার দিকে শোভাযাত্রা পৌঁছাল ভিক্টোরিয়া পার্কে। খাজা নাজিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে পতাকা তোলা হলো। মুসলিম লীগের পতাকা। এখনো জাতীয় পতাকা ঠিক হয়নি। জাতীয় সংগীত ঠিক হয়নি। মাইকে গান বাজতে লাগল। আব্বাসউদ্দীন ও জসীমউদ্দীন সাহেব বেদার উদ্দীন আর সোহরাব হোসেনকে নিয়ে গাইতে লাগলেন ‘আমার সোনার পূর্ব পাকিস্তান’ আর গোলাম মোস্তফার ‘পাকিস্তানের অভাব কী!’ প্ৰধানমন্ত্ৰী নাজিম উদ্দিনসমেত মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা বক্তৃতা করলেন। লাখো লোকের সমাগম হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে বিনি পয়সায় ট্রেনে চড়ে এসেছে অনেকে।

তারা এসেছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী দেখতে। রমনা দেখল তারা, সেখানেই রেসকোর্সের মাঠ। পাশেই ঢাকা ক্লাব। রমনার ভেতরে কালীমন্দির। গাছ আর গাছে সবুজ এই এলাকা। ওই ওখানে চামেরি হাউজ, মেয়েদের হোস্টেল। তার পাশে তোপখানা রোডে ইডেন কলেজ। সেই ইডেন কলেজ এখন হবে সচিবালয়। বর্ধমান হাউস আজ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি। যুদ্ধের সময় নির্মিত মুরলি বাঁশের নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক। সদরঘাট ঢাকার কেন্দ্র। পাঁচ রাস্তার মোড়। বুড়িগঙ্গার পাশে করোনেশন পার্ক। সদরঘাটের কাছেই সবচেয়ে বড় পোস্টাফিস। নবাবপুর রোড সবচেয়ে জমজমাট সড়ক। দুধারে সারি সারি বাড়ি আর দোকান। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন।

রাজধানী দেখতে আসা জনতার বেশির ভাগই এসেছে ময়মনসিংহ থেকে।

তাজউদ্দীন সভা শেষ হওয়ার আগেই অকুস্থল ত্যাগ করলেন। তারপর নামল বৃষ্টি। অল্পক্ষণ পরই থেমেও গেল।

ভাগ্যিস তোরণগুলো বানানো হয়েছিল পাতা দিয়ে! কাজেই ভিজে নষ্ট হয়নি।

কার্জন হলের সকালের অনুষ্ঠানে কী হলো জানতে পারলেন তারপর। সকালে খাজা নাজিম উদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন।

রাতের বেলা ফুটে উঠল আলোকসজ্জা। বংশীবাজার, বাবুবাজার সেতু থেকে মোগলটুলী পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে জ্বলজ্বল করছে রঙিন বৈদ্যুতিক বাতি। আহসান মঞ্জিলের চূড়ার আলোকসজ্জা হয়েছে নয়নজুড়ানো।

সারা রাত আতশবাজি, পটকাবাজি ফুটল।

হোটেল, মসজিদ, রেলওয়ে স্টেশন, এমনকি খোলা মাঠে লোক আর ধরছে না। অনেকেই সারা রাত ঘোরাঘুরি করল। তারা তাদের অনেক স্বপ্নের আর কষ্টের স্বাধীনতা লাভ করেছে।

আকাশে তারাও জ্বলছে।

শুধু এক কোণে তারা দেখা যাচ্ছে না। মেঘ জমছে সেই কোণটায়।

.

টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে রেনু এপাশ-ওপাশ করছেন। তাঁর ঘুম আসছে না। প্ৰচণ্ড গরম। আর তাঁর শরীরটাও ভালো নয়। তিনি সন্তানসম্ভবা। তাঁর স্বামী এখনো কলকাতায়। কিন্তু কলকাতা আলাদা দেশ হয়ে গেছে।

তবু তিনি আসছেন না। পরীক্ষা দিচ্ছেন। আচ্ছা। দিক। বিএটা তো পাস করতেই হবে। শুধু দেশের সেবা করলে হবে! কিছুদিন আগে তাঁর চিঠি এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘রেনু। তুমি সারাটা জীবন কষ্ট করেছ। জন্মের পর থেকেই তুমি কষ্টই পেয়েছ শুধু। আর এমন একটা লোকের সঙ্গে তোমার বিয়ে হলো, যে তোমাকে সময়ও দিতে পারে না! এমন স্বামী থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।’

কী বলে লোকটা!

লোকটা কি জানে না, তাকে তিনি কত ভালোবাসেন? কী অলক্ষুনে কথাই না লিখে ফেলল!

তবে এত যে দেশের জন্য কাজ করল, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জন্য কাজ করল, কী হলো?

সোহরাওয়ার্দী সাহেবও তো মন্ত্রী হতে পারলেন না। কায়েদে আজম তো তাঁকে পাত্তাই দিলেন না। আর এত দিন যে তাঁরা স্বাধীন বাংলার কথা বললেন, সেটাও তো হলো না। তবে?

ভোর হচ্ছে। বাইরে কাক ডাকছে। রেনু আস্তে আস্তে বাইরে গেলেন। বারান্দায় পিতলের বদনায় পানি তোলাই ছিল। তিনি অজু করলেন।

আবার আঁধার করে এল।

তিনি আকাশে তাকালেন। তারা তো দেখা যাচ্ছে। তার মানে মেঘ নাই। তাহলে আবার অন্ধকার হয়ে এল কেন?

তাঁর মনে পড়ল, এ হলো সুবহে কাজিব। কপট প্রভাত।

দুই দিন পর ঈদ। তবু তিনি আসবেন না? আর কী কাজ তাঁর? রেনু এসে আবার শুয়ে পড়লেন। তাঁর শরীরের ভেতরে আরেকটা শরীর। আরেকটা প্রাণ। মাঝেমধ্যে তা জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব, তার আগমনী সংবাদ। তাঁর সন্তান। তাঁদের সন্তান।

১৯

ট্রেন শেয়ালদা ছাড়ল। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের হুস হুস শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস। বাক্স-পেটরা নিয়ে মুজিব আর শাহাদৎ উঠেছেন ট্রেনে। মুজিব যাবেন ঢাকায়। শাহাদৎ নামবেন গোয়ালন্দ, সেখান থেকে চলে যাবেন গোপালগঞ্জ।

ট্রেনে বেশ ভিড়। হিন্দু-মুসলিম, পূর্ববঙ্গীয়-পশ্চিমবঙ্গীয়, বাঙালি- বিহারি সব গাদাগাদি করে আছে। মুখ না খুললে বোঝাই যাবে না কে বিহারি, কে বাঙালি, কে বাঙাল, কে ঘটি। যতক্ষণ ট্রেনটা থেমে থাকে, দমবন্ধমতো লাগে। মানুষের ভিড়েরও একটা গন্ধ আছে। ট্রেন ছেড়ে দিলে বাতাস ঢোকে জানালা দিয়ে। আরাম বোধ হয়। শেখ মুজিব বসেছেন জানালার ধারে। সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্ট, কাঠের আসন। ট্রেন চলতে থাকলে স্টেশনের ঘরবাড়ি, স্তম্ভ, কড়িবর্গা—সব পেছাতে থাকে। প্রথমে যেন ওই সব দরদালান-স্থাপনা-বৃক্ষরাজি হাঁটছিল, পরে জোরে দৌড়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। দূরের আকাশে আলো আর মেঘ, মেঘগুলো কিন্তু সামনের দিকেই দৌড়াচ্ছে।

শেখ মুজিব মনে মনে আবৃত্তি করতে থাকেন তার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা,

এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে
কোন্ পার হতে কোন্ পারে।
ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে—
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে!”

কলকাতার পাট তাঁর চুকল। তিনি তাঁর পূর্ব বাংলায় ফিরে যাচ্ছেন। কলকাতা থেকে তিনি এর আগেও বহুবার গেছেন টুঙ্গিপাড়ায়, যাওয়ার সময় বলেছেন, ‘দেশে যাচ্ছি’; সবাই তা-ই বলে, গ্রামের বাড়িটাকে বলে দেশের বাড়ি। টুঙ্গিপাড়াই তাঁর দেশ! দেশ আসলে কী? এত দিন ছিল ব্রিটিশ ভারত। তার পর তিনি স্লোগান দিলেন, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। চোঙা তাঁর হাতে থাকত, নাকের নিচে মুখে ধরতেন চোঙা, গোঁফের জায়গাটায় চোঙার কোনা লেগে ক্ষতমতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর সোহরাওয়ার্দী সাহেব, শরৎ বসু আর আবুল হাশিমের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনি অবিরাম প্রচার করে গেলেন অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার কথা, বৃহত্তর বাংলার কথা, যে বাংলায় থাকবে আসাম, দার্জিলিং, পূর্ব আর পশ্চিম বাংলা। কায়েদে আজম পর্যন্ত তাতে রাজি ছিলেন। রাজি হলো না কংগ্রেস, রাজি হলো না সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দু আর মুসলিম নেতারা, রাজি হলেন না নেহরু আর বল্লভ ভাই প্যাটেল। আর এদিকে মুসলিম লীগের উর্দুঅলা নেতা খাজা নাজিম উদ্দিন প্রমুখ চান না কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানে পড়ুক, তাহলে তাঁদের কর্তৃত্ব থাকবে না, সোহরাওয়ার্দী সাহেবই তখন হয়ে উঠবেন গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই তাঁরাও কলকাতাকে বাদ দেওয়ার পক্ষে। তাঁরা বলে বেড়াতে লাগলেন অখণ্ড স্বাধীন বাংলাকে সমর্থন করা মানে পাকিস্তান আন্দোলনের পিঠে ছুরি মারা। গান্ধীজিও বাংলা ভাগকেই মেনে নিলেন। বাংলা ভাগ হলো। পূর্ব বাংলা এখন পাকিস্তানের অংশ। কলকাতা ভারতের।

নিজের দেশের মধ্যে যাতায়াত করছেন, এই বাস্তবতা হিসেবে একদিন গোপালগঞ্জ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। সেখান থেকে যখন ফিরছেন, কলকাতা তখন অন্য দেশ হয়ে গেছে, ঢাকা পড়েছে নিজের দেশে। তাহলে নিজের দেশে তিনি ফিরছেন? বিদেশ থেকে?

পাকিস্তান আন্দোলনে তো মুজিবও ছিলেন। এখনো তো তিনি মুসলিম লীগারই। কিন্তু তাঁর মুসলিম লীগ আর লিয়াকত আলী খান বা খাজা নাজিম উদ্দিনের মুসলিম লীগ কখনো এক ছিল না।

পাকিস্তান হাসিল হয়েছে, তাই বলে তাঁর কাজ শেষ হয়নি। মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ক্ষমতায়। তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ১৫ আগস্টে কলকাতা শহরে মিছিল বেরিয়েছিল, হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। সেই মিছিলে তিনি যোগ দেননি, কিন্তু এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে মিছিলের পাশাপাশি হেঁটে বেড়িয়েছেন অনেক জায়গায়। ফিরে এসে লেখাপড়ায় মন দিয়েছেন, কিন্তু তিনি তাঁর সহকর্মী বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছেন, পূর্ব বাংলায় গিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করা তাঁদের পরের কাজ। হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে।

আজকাল ট্রেনে বড় বেশি ভিড় হয়। দেশভাগ লাখ লাখ মানুষকে পথে পথে ঘোরাচ্ছে। লোকজন কলকাতা ছাড়ছে। যদিও কলকাতায় ১৫ আগস্ট এসেছে শান্তি ও সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কারণ অবশ্য গান্ধীজি। এখানে তিনি অবস্থান নিয়েছেন স্বাধীনতার বেশ কয়েক দিন আগেই। করাচি থেকে এসে সোহরাওয়ার্দীও তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

তবে সেপ্টেম্বরের শুরুতে আবার কিছুটা বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলে গান্ধীজি অনশন শুরু করেন। তাঁর অনশনের কারণে দাঙ্গার শক্তি পিছু হটে, শান্তিবাদীরা এগিয়ে আসেন।

সোহরাওয়ার্দী কাল গান্ধীজিকে নিজ হাতে ফলের রস তুলে দিয়ে অনশন ভঙ্গ করিয়েছেন।

আজ মুজিব তাঁর লিডার সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব উষ্ণ আলিঙ্গনের মাধ্যমে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ২৭ বছর বয়সী এই যুবক কর্মীটিকে বিদায় দিয়েছেন। বলেছেন, ‘শেখ মুজিব, টুঙ্গিপাড়ায় যেয়ো। বউমার সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটিয়ো। বউমাকে তোমার যে সময় দেওয়ার কথা ছিল, তা থেকে আমি অনেকটাই নিয়ে নিয়েছিলাম। আপাতত আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি।’

মুজিবের চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, ‘লিডার, আপনি চলুন পূর্ব বাংলায়। খাজা নাজিম উদ্দিনের মতো সাম্প্রদায়িকতাবাদী লোকদের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার ছেড়ে দেওয়া হলে সেটা হবে সবার জন্য খারাপ। আপনাকে পাকিস্তানের দরকার হবে।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘ভারতের চার কোটি মুসলমানকে অনিশ্চয়তার হাতে ফেলে রেখে আমি চলে যেতে পারি না। আমি গান্ধীজির সঙ্গে আছি। দেখি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কতখানি ফিরিয়ে আনা যায়।’

নেতাকে খদ্দর আর গান্ধীমার্কা টুপিতে এমনিতেই অদ্ভুত লাগছে। শেখ মুজিব তাঁর চোখের দিকে তাকালেন। ছোটখাটো মানুষটির চৌকোনো মুখে দুটো ঠান্ডা চোখ। সেই চোখে মুজিব দেখতে পেলেন অপার্থিব মায়া।

মানুষটা এখন পর্যুদস্ত। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগে জিন্নাহ তাঁকে রাখলেন না। প্রাদেশিক আইনসভায় পার্লামেন্টারি দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন খাজা নাজিম। সোহরাওয়ার্দী সব দিক থেকে হেরে গেলেন। অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব নিয়ে ছোটাছুটি করলেন তত দিন, জিন্নাহ যত দিন এতে সম্মত ছিলেন। তারপর জিন্নাহ যেদিন বললেন, তিনি চান মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব মেনে নিতে, সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী সাহেবও মত পাল্টালেন। সবকিছু করেছেন জিন্নাহর আস্থা অর্জন করতে। কিন্তু স্তাবকতায় নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে তিনি পারবেন কেন!

পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা মনে করছে, তিনি জিন্নাহর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আর হিন্দুরা বিশ্বাস করে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে হাজার হাজার হিন্দুর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী

অথচ শেখ মুজিব খুব ভালো করে জানেন, (পরবর্তীকালে ব্রিটিশ তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও বলা হবে), সোহরাওয়ার্দী সেদিন লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বসে সব জায়গায় পুলিশ পাঠাচ্ছিলেন শান্তি স্থাপনের জন্য। তিনি সেনাবাহিনী চেয়ে পাঠিয়েছিলেন কেন্দ্রের কাছে, নিজের জীবন বিপন্ন করে ছুটে বেড়িয়েছেন পাড়ায় পাড়ায়, শান্তি স্থাপনের জন্য। কিন্তু শান্তি আসেনি। সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। মানুষ মারা গেছে।

বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীকেই দায়ী করেছে সর্বমহল। এমনকি গান্ধীও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রশাসনের ব্যর্থতার দায়িত্ব তো তাঁকেই নিতে হবে।

১৫ আগস্টে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলো।

এরই মধ্যে করাচি থেকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এসেছেন সোহরাওয়ার্দী।

গান্ধীজি হিন্দুদের ওপর হামলার আশঙ্কায় নোয়াখালী গেলেন। সোহরাওয়ার্দী করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে এসে গান্ধীজিকে বললেন, তিনি যেন কলকাতায় থাকেন। কলকাতায় সম্ভাব্য দাঙ্গা মোকাবিলার জন্য কলকাতায় তাঁর থাকাটা জরুরি।

গান্ধী বললেন, ‘যদি আপনি আমার পাশে থেকে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে আমি কলকাতায় থাকতে রাজি আছি।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘নিশ্চয়ই।’

গান্ধী উঠলেন একটা বস্তিবেষ্টিত পরিত্যক্ত প্রাসাদ হায়দারি ম্যানশনে। হাজার হাজার হিন্দু সেখানে গান্ধীকে ঘিরে ধরল। তারা বলল, ‘কেন আপনি মুসলমানদের রক্ষা করতে এখানে এসেছেন। আপনি কেন নোয়াখালী যাচ্ছেন না?’

এই তুমুল হট্টগোলের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী সেখানে হাজির হলে জনতা ‘চোর’

‘খুনি’ বলে তাঁর প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করতে লাগল। গান্ধীর শিষ্যরা এসে সোহরাওয়ার্দীকে গাড়ি থেকে বের করে ভেতরে নিয়ে গেলেন আর জনতাকে এই বলে শান্ত করেন যে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁদের দেখা হবে।

বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দীর উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে ঢিল-পাটকেল-থুতু।

তারা সোহরাওয়ার্দীর নাম ধরে ডাকছে, ‘খুনি চোর সোহরাওয়ার্দী, বেরিয়ে এসো।’

সোহরাওয়ার্দী জানালার ধারে দাঁড়ালেন। তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গান্ধীজি।

জনতা বলল, ‘সোহরাওয়ার্দী, মহানিধনযজ্ঞের জন্য আপনিই দায়ী।’

স্বীকার করুন কলকাতার

‘হ্যাঁ, আমরা সবাই দায়ী।’ সোহরাওয়ার্দী বললেন।

আমাদের প্রশ্নের জবাব দিন।

সোহরাওয়ার্দী পলকহীন চোখে জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমার দায়িত্ব।

বরফের মতো চোখে জনতার দিকে তাকিয়ে আছেন সোহরাওয়ার্দী। তাঁর চোখে এমন কিছু আছে, সেই ক্রুদ্ধ-রাগী জনতা শান্ত হয়ে এল।

আওয়াজ উঠল, ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই।’

হত্যাকাণ্ড বন্ধ হলো কলকাতায়।

১৫ আগস্টের মিছিলে একটাই স্লোগান, ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। মুসলমানপাড়ায় হিন্দুরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মসজিদ থেকে মিঠাই বিলি করা হচ্ছে হিন্দু পথচারীদের মধ্যে। ট্রামে, বাসে সর্বত্র খুবই ভিড়। শেখ মুজিব তাঁর বন্ধুদের নিয়ে হাঁটছেন। পার্ক স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গী, এসপ্লানেড, কার্জন পার্ক। সেখান থেকে ময়দান ঘুরে গঙ্গার তীরে তাঁরা দাঁড়ালেন রেলিং ধরে। গঙ্গার জলে সূর্য ডুবছে। সূর্যের সোনালি প্রতিবিম্ব কাঁপছে জলের গায়ে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। আকাশে লাল রঙের মেঘ। সকালে বৃষ্টি হয়েছিল। এখন বৃষ্টি নাই।

মুজিব আবৃত্তি করতে লাগলেন :

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জাগিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

কলকাতায় ব্রিটিশ অবসানের দিনগুলোয় দাঙ্গা হলো না বললেই চলে। রক্ত ঝরল পাঞ্জাবে। ছয় লাখ হিন্দু-মুসলমান খুন হয়েছিল বিভক্ত পাঞ্জাবে।

শেখ মুজিব জানেন, তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দী এখন ফিরবেন না পূর্ব বাংলায়। এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগের পশ্চিম বাংলার পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন।

কিন্তু শেখ মুজিবকে ফিরতে হবে। পূর্ব বাংলায় তাঁর জন্ম। পদ্মাপাড়ের ছেলে তিনি।

হারার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি।

তিনি বললেন, ‘লিডার। আমি যাচ্ছি ঢাকায়। আপনি থাকেন। চার কোটি মুসলমানের স্বার্থ দেখেন। কিন্তু মনে রাখবেন, ওই বাংলাতেও আপনাকে লাগবে। আমি যাই। গ্রাউন্ড ঠিক করি। আপনি কথা দেন, আপনি বাংলায় আসবেন।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘মুজিব, তোমাকে একটা কথা বলি। রাজনীতিতে কথা দেওয়া বলতে কিছু নাই। কিন্তু তুমি জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাংলাকে ভালোবাসি। পাকিস্তানকেও ভালোবাসি। আমার মন বলছে, আমি পাকিস্তানে যাবই।’

‘পাকিস্তানে যাবেন। এবং আমার মন বলছে, আপনাকে আমরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানাব। আজ আসি।’

মুজিব হনহন করে চলে এলেন সোহরাওয়ার্দীর সামনে থেকে। এরপর আর পেছনে তাকানো বিপজ্জনক। মুজিবের চোখের জল লোকে কম দেখেছে। সব সময় দেখেছে তাঁর কর্মীমূর্তি। নির্ভীক রুদ্রমূর্তি। নেতাকে তাঁর চোখের জল দেখানোর মানে হয় না।

নেতা অবশ্য ব্যস্ত গান্ধীজিকে নিয়ে। এখন ভারতে আর পাকিস্তানে শান্তিমিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ানোই হবে তাঁর কাজ।

মুজিব ঢাকায় আসার জন্য গোছগাছ করেন। ইসলামিয়া কলেজের সবার কাছ থেকে বিদায় নেন। ২৪ নম্বর রুমটার দিকে শেষবার তাকিয়েও তাঁর বড় মায়া হয়। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

এর মধ্যে টুঙ্গিপাড়া থেকে রেনুর চিঠি এসেছে। রেনু লিখেছেন, তাঁর সন্তানের জন্মক্ষণ এগিয়ে আসছে। শরীরটাও খুব ভালো যাচ্ছে না। তিনি যেন পরীক্ষা শেষ করেই দেশে চলে আসেন।

প্রথম সন্তানের জন্মের সময় মুজিব রেনুর পাশে থাকেননি। সেই সন্তানটা বাঁচেনি। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় তিনি তাঁর পাশে থাকতে চান।

কিন্তু তবু তিনি সরাসরি টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন না। আগে তিনি নামবেন ঢাকায়। ঢাকার পরিস্থিতি তাঁকে বুঝতে হবে। এরই মধ্যে ঢাকার মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ একটা প্রতিনিধি সভা ডেকেছে। সেটাতে কী হয়, তাদের উদ্দেশ্য কী, একটু বোঝা দরকার। ঢাকায় কয়েক দিন থাকবেন। সেখান থেকে যাবেন টুঙ্গিপাড়ায়।

গোয়ালন্দ ঘাটে এসে থামে ট্রেন। তখন রাতের শেষ প্রহর। চারদিক অন্ধকার।

কুলিরা দৌড়ে এসে ওঠে চলন্ত ট্রেনের কামরায়।

শাহাদৎ বিদায় নেবেন। মুজিবকে স্টিমারে উঠতে হবে। তাঁরা দুজনেই ট্রেন থেকে নামেন। প্রায় একটা পাথারে এসে থেমেছে ট্রেনটা। আকাশে নক্ষত্ররাজি। দূরে স্টিমারের সার্চ লাইট। কালো আকাশের গায়ে আলোর ঝাপটা ছোটাছুটি করছে। পায়ের নিচে নদীচর। জোনাক পোকার আলো দেখা যায় অন্ধকারে, থোকা থোকা।

মুজিবের স্যান্ডেলের মধ্যে বালি ঢুকে গিয়ে কিচকিচ করে।

সবাই ছুটছে স্টিমারের দিকে। যেন খানিক পরে গেলে স্টিমারে সিট পাওয়া যাবে না। কিংবা স্টিমার ছেড়ে দেবে এখনই।

মুজিব শাহাদৎকে আলিঙ্গন করেন। বলেন, ‘ভালোভাবে যাও বাড়ি। আমি কদিন পরেই আসতেছি। আব্বার সঙ্গে দেখা করে বলো, আমি ভালো আছি।’

চলন্ত মানুষের ধাক্কায় কথা বলাই মুশকিল।

তাঁরা দুজন মানবস্রোতের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।

স্টিমারের নাম নারায়ণগঞ্জ মেইল।

বড়সড় স্টিমার।

সেকেন্ড ক্লাসে একটা আসন ঠিকই জুটে যায় মুজিবের। পাঞ্জাবির ওপর একটা চাদর মুড়ি দিয়ে নেন তিনি। স্টিমার সাইরেন বাজাচ্ছে। এখনই বোধ হয় ছেড়ে দেবে। মুজিব চোখ বন্ধ করেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে যান ঘুমের অতলে।

ঘুম ভাঙে যখন, তখন চারদিক ঝকঝক করছে আলোয় আলোয়। অনেক পরিচিত মুখ দেখা যায়। এরা ঢাকা যাচ্ছে। মুজিব ভাইকে পেয়ে ঘিরে ধরে তারা। স্টিমারের খাবার ঘরের দিকে মুজিব এগিয়ে যান সদলবলে। চা খাওয়া দরকার।

নদীর ওপারে নারায়ণগঞ্জ।

স্টিমারটা ঘাটে ভেড়ার আগেই কুলিরা কী কায়দায় যে স্টিমারে উঠে যায়। কিছু বলার আগেই দুটো বাক্স ওদের মাথায় উঠে গেছে। স্টিমার থেকে জনস্রোতে গা ভাসিয়ে নেমে পড়ে সোজা প্ল্যাটফরমে। আবার ট্রেন। ওপারে রেল ছিল ব্রডগেজ। এপারে এসে হয়ে গেল মিটারগেজ।

দিনের আলোয় ট্রেনের জানালা দিয়ে তিনি দেখেন তাঁর পূর্ব বাংলা। যতবার তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে এসেছেন, ততবার তাঁর একই অনুভূতি হয়েছে। পূর্ব বাংলা অনেক সবুজ, অনেক জলমগ্ন। চারদিকে জলা আর জংলা। সুন্দর করে বললে বলা যায়, সুজলা-সুফলা, শস্য- শ্যামলা। আর যতই তুমি পশ্চিমে যেতে থাকবে, আস্তে আস্তে সবকিছু হয়ে যেতে থাকবে ধূসর।

ট্রেন ধীরে ধীরে ফুলবাড়িয়া স্টেশনের প্ল্যাটফরমে থেমে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে। প্ল্যাটফরমের আলোকস্তম্ভে বাতি জ্বলছে।

ট্রেন পুরোপুরি থেমে যায়। ‘কুলি কুলি’ বলে রব তুলে লাল শার্ট পরা কুলিরা এসে মালপত্রে হাত লাগায়। শেখ মুজিবের সঙ্গে দুটো বড় বড় বাক্স। একটা বাক্সে শুধু বই। আরেকটায় তাঁর কাপড়চোপড় ইত্যাদি। কলকাতা থেকে তিনি কতগুলো গানের রেকর্ডও এনেছেন। তাঁদের গ্রামের বাড়িতে গ্রামোফোন আছে। গান শোনাটা তাঁর নেশা। রেনুও খুব গান পছন্দ করেন। রেনুর জন্য আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া দুটো রেকর্ড, কাজী নজরুল ইসলামের গান, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে এসেছেন তিনি।

আর আছে মা, বাবা, ভাইবোনের জন্য ছোটখাটো উপহার। বাবার জন্য নিয়েছেন মহাভৃঙ্গরাজ তেল, মার জন্য ব্লাউজের কাপড়, বোনদের জন্য চুড়ি, ফিতা ইত্যাদি। রেনুর জন্য কিনে এনেছেন শাড়ি আর তাঁর আসন্ন সন্তানের জন্য একটা ছোট্ট মশারি।

কুলির সাহায্য নিতেই হলো।

ফুলবাড়িয়া স্টেশনে নেমে দেখেন গোপালগঞ্জের মোল্লা জালাল আর খন্দকার আবদুল হামিদ তাঁর জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা একটা ঘোড়ার গাড়ি ডাকেন। কুলি মালপত্র গাড়িতে তুলে ফেলে ঝটপট। তাঁরা গাড়িতে ওঠেন।

গাড়ি চলছে কোর্ট-কাচারির দিকে।

সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারে ঢাকাকে একটা প্রায় মফস্বল শহরের মতো লাগে। চলন্ত গাড়িতে বসে থাকায় মুখে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগে।

মুজিব বলেন, ‘এখানকার কী অবস্থা? কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা?’

হামিদ বলেন, ‘না। এই দিক থেকে ঢাকা ঠিক আছে।’

মোল্লা বলেন, ‘কলকাতার কী অবস্থা?’

মুজিব গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন, ‘গান্ধীজি আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব কলকাতাবাসীকে ঠিক করে ফেলেছেন। এবার আর গন্ডগোল করার সুযোগ দেন নাই। তো নতুন রাজধানী কেমন চলছে?’

রিকশার পেছনে জ্বলা লন্ঠনের আলোগুলোর দিকে তাঁর দৃষ্টি।

হামিদ বলেন, ‘আরে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তো কিছুই নাই। ইডেন কলেজে বসানো হয়েছে সেক্রেটারিয়েট। ঢাকা ইউনিভার্সিটির জগন্নাথ হলে অ্যাসেম্বলি, স্কুলে হাইকোর্ট।’

টমটমের হুডের রেলিং শক্ত করে ধরে মোল্লা বলেন, ‘তবে পাকিস্তানে অপশন দিয়ে যে আইসিএস অফিসাররা এসেছে, তারা খুব আন্তরিকতার সাথে খাটছে। সবাই ঝাড়ু হাতে ঘর পরিষ্কার করছে। মাথায় রুমাল বেঁধে ইট সরাচ্ছে। দেখার মতো দৃশ্য।’

মুজিব বলেন, ‘ওরা ভাবছেন, ওরা সব পেয়ে গেছেন।’

হামিদ বলেন, ‘আর সবার খুব রাগ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম আর শরৎ বসুর ওপরে। ওরা কেন অখণ্ড বাংলা চেয়েছিলেন।’

মোল্লা বলেন, ‘খাজা নাজিম উদ্দিন চিফ মিনিস্টার। প্রত্যেক সন্ধ্যায় নবাব পরিবারের মেম্বারদের নিয়ে দরবার বসান। গান-বাজনা হয়।’

মুজিব বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিজের ছেড়ে দেওয়া আসনে খাজাকে এমএলএ নির্বাচিত করে আনলেন তো, এই হচ্ছে তার প্ৰতিফল।

টমটম ছুটে চলেছে। ঘোড়ার খুরের ঠকঠক আওয়াজ ওঠে পিচঢালা রাস্তায়। সন্ধ্যার ম্লান আলো তাড়িয়ে রাত্রি জেঁকে বসছে। ভ্রাম্যমাণ রিকশার পেছনে লন্ঠনের আলো সেই অন্ধকারকে যেন আরও গাঢ় করে তুলছে। দোকানে দোকানে আলো আর লোবানকাঠি জ্বলে ওঠে।

তাঁরা কোর্ট-কাচারির পেছনে খাজে দেওয়ান লেনের মেসের সামনে থামেন।

শেখ মুজিব দ্রুত টাকা বের করে টমটমঅলার ভাড়া মিটিয়ে দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *