যারা ভোর এনেছিল – ১০

১০

সোহরাওয়ার্দী তাঁর বাসভবনে ডেকেছেন। মুজিব কয়েকজন ছাত্রনেতাসমেত গেলেন মুখ্যমন্ত্রীর থিয়েটার রোডের বাড়িতে। সোহরাওয়ার্দীকে আজ বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তিনি আঙুল ফোটাতে ফোটাতে বললেন, জিন্নাহ ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সারা ভারতে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডের ডাক দিয়েছেন। জেনারেল স্ট্রাইক হবে।

মুজিব বললেন, ‘লিডার, ২০টা ট্রাক দেন। আর মাইক দেন কতগুলো। ১৫ আগস্ট থেকেই প্রচার চলবে। লিডার, খাজা নাজিম উদ্দিন তো ঘোষণা করে দিয়েছে, এই অ্যাকশন হিন্দু ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। সঙ্গে সঙ্গে আবুল হাশিম বিবৃতি দিলেন, এই অ্যাকশন ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে; কংগ্রেস বা হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘খাজা তো বলবেই। সে তো ব্রিটিশ প্রভুদের খুশি করতে চায়।’

‘আমাদের সাবধান থাকতে হবে।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘শিয়োর। আমরা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করতে চাই না। আমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিব; কংগ্রেসের বিরুদ্ধে না।’

চা-বিস্কুট খেয়ে মুজিব বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর অনেক কাজ। সব ছাত্রকে সংগঠিত করতে হবে। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে গড়ের মাঠে যেতে।

১৫ আগস্ট বিকেলবেলা বেকার হোস্টেলের সামনে ট্রাক আর মাইক এসে যায়। সবাই সমবেত হয়েছে ডাইনিংরুমের সামনের লনে। মুজিব বললেন, ‘সবাই খেয়ে নাও।’

খাওয়া সেরে নিয়ে সবাই ভিড় করে আছে লনে। মুজিব বললেন, ‘আমরা এখন ট্রাকে করে মিছিল নিয়ে বার হব। স্লোগান দেব। স্লোগান যেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হয়, উসকানিমূলক না হয়। সবাই ট্রাকে ওঠো।

সবার সামনের ট্রাকে শেখ মুজিব। তাঁর হাতে একটা চোঙা। তিনি স্লোগান ধরলেন। স্লোগান উঠল : ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর,’

‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ,’

‘গড়ের মাঠে মিস্টার জিন্নার জনসভায় যোগ দিন,’

‘ডাউন ডাউন ব্রিটিশ ইম্পেরিয়ালিজম,’

‘আপ আপ লীগ ফ্লাগ লীগ ফ্লাগ।’ বড়বাজার থানার সামনে মিছিল গেলে থানার ইনচার্জ শেখ মুজিবকে অনুরোধ করলেন, মিছিল যেন শান্তিপূর্ণ থাকে। স্লোগান যেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে না হয়। ওসি নিজেও মুসলমান। মুজিব বললেন, ‘এই, সবাই সুশৃঙ্খলভাবে মিছিল নিয়ে চলো।’

তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সেরে ফিরে এলেন হোস্টেলে।

পরের দিন সভা। বিকেল তিনটায় সভা শুরু হবে। মুজিবের নেতৃত্বে বেকার হোস্টেলের ছেলেরা মিছিল করে আগেভাগেই পৌঁছে গেছে মাঠে।

তাদের হাতে মুসলিম লীগের পতাকা।

কিন্তু পরের দিন সভা চলাকালেই শোনা গেল, শহরে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়ে গেছে।

সোহরাওয়ার্দী নির্দেশ পাঠালেন, ‘মুজিব, শান্তভাবে সব ছেলেকে নিয়ে হোস্টেলে ফিরে যাও। সারা রাত গেটে তালা দিয়ে রাখবে। কাউকে বের হতে দেবে না।

মুজিব সব ছাত্রকে নিয়ে ফিরে আসছেন। সবাইকে অভয়ও দিচ্ছেন, বলছেন, ‘একসাথে আছি আমরা, কিছু হবে না।

কিন্তু ফেরার পথে হ্যারিসন রোডের ছাদের ওপর থেকে হঠাৎই মিছিলে আক্রমণ শুরু হয়।

বেকার হোস্টেলের ছেলেরা হোস্টেলে ফিরে এলে মুজিব গেটে তালা লাগিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করলেন। ছাত্রদের বাইরে যাওয়া মানা।

সোহরাওয়ার্দী হোস্টেলের ছেলেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ৪০-৫০ জন অস্ত্রধারী পুলিশ পাঠিয়ে দিলেন।

মুজিব ছাত্রদের সঙ্গে নিজের রুমে সারা রাত আলোচনা করে কাটালেন। তাঁর মন খুবই খারাপ। মানুষ এইভাবে মানুষকে হত্যা করতে পারে! মানুষ এইভাবে ঘৃণার অস্ত্র শাণিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে অন্য মানুষের ওপর! মানুষ কি কোনো দিনও মানুষ হবে না?

কলকাতার সেই দাঙ্গা ছিল খুবই মারাত্মক। হাজার হাজার মানুষ মারা গেল। ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে সেই ঘটনা ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা আছে।

মুজিব ছাত্রদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দাঙ্গাবিরোধী তৎপরতায়। তাঁরা রাস্তা পাহারা দিতে লাগলেন, যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে না পারে। বালিগঞ্জ থেকে ইসলামিয়া কলেজের রাস্তা হিন্দুদের জন্য হয়ে পড়েছিল বিপজ্জনক। মুজিব সেই রাস্তায় অবস্থান নিলেন। এই পথে কোনো হিন্দু গোয়ালা বা মুচি বা শিক্ষক বা উকিল যদি ভুল করে এসে পড়ে, তার জন্য এটা হতো ভয়ংকর ব্যাপার। তেমনি হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় কোনো মুসলমান ভুলে গিয়ে যদি পড়ে, তার প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। এমন ভয়ংকর ছিল ওই দিনগুলো।

ভবতোষ দত্ত ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক। তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর মুসলমান ছাত্রদের মধ্যেও দুটো গ্রুপ। দুদলই পাকিস্তান চায়, এমনকি মুসলমান শিক্ষকেরাও। কিন্তু একদল আছে উর্দুভাষী। তারা নিজেদের কুলীন ভাবে। আরেক দল আছে বাংলাভাষী, তাদের নেতা শুকনো লম্বা একটা ছেলে। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তার দলটাই ভারী। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতির দিকেই তার টান।

দাঙ্গার দিন কটায় তিনি দেখলেন, মুজিবের নেতৃত্বাধীন অংশটা শান্তির পক্ষে কাজ করছে। তারা রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। ভবতোষ দত্ত ওল্ড বালিগঞ্জের মোড়ে এসে দেখতেন, ছেলেরা আছে পাহারায়। তাঁকে দেখে নমস্কার দিয়ে তারা বলত : ‘আর ভয় নাই, স্যার। চলুন, আমাদের সঙ্গে। আমরা এগিয়ে দিচ্ছি।’ ওরা তাঁকে ওয়েলেসলি স্ট্রিটে কলেজ পর্যন্ত পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত। ছুটির পর আবার ছাত্ররাই ফিরিয়ে দিয়ে যেত। এই শান্তি প্রহরীদলের নেতা ছিলেন মুজিবুর রহমান।

ব্যাঙ্গমা ঘাড় বাঁকিয়ে ঠোঁট দিয়ে নিজের পিঠের পালক ঠুকরে বলে, ‘বুঝছ?’

‘না কইলে বুঝুম কেমনে?’ ব্যাঙ্গমি একটা ছোট্ট পোকা টুপ করে গিলে বলে।

‘এই যে ভবতোষ বাবু, শেখ মুজিবের এই সকল ঘটনা কিন্তু তার মনে দাগ কাইটা ফেলতাছে। জীবনেও উনি ভুলতে পারবে না এই ঘটনা। এই ঘটনার ৪২ বছর পরে এই লোকে একখান বই লিখব। সেই বইয়ে উনি লেখব শেখ মুজিবের এই সব ঘটনা।’

ব্যাঙ্গমি বলে,

ভবতোষ বাবু লেখে নিজ স্মৃতিকথা,
মুজিব শান্তির পক্ষে লেখা রহে তথা।
সময় বহিয়া চলে নদীর মতোন,
সিন্দুকে রহিয়া যায় স্মৃতির রতন।

.

পার্ক সার্কাসের কাছে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ। সেখানে ছাত্ররা ত্রাণকার্য পরিচালনা করতে শুরু করল। দুস্থ মুসলিম পরিবারগুলোকে তারা সাহায্য করছে। শেখ মুজিব ছুটে এলেন তাঁর দল নিয়ে। বললেন, ‘আমি এসে গেছি, আর কোনো দুশ্চিন্তা নাই। এখন থেকে সব কাজের ভার তোমরা নিশ্চিন্তে আমার ওপরে ছেড়ে দাও।’ তাঁর পরিশ্রম করার ক্ষমতা সাংঘাতিক, নেতৃত্বের গুণ অপ্রতিরোধ্য, মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন তিনি অমোঘভাবে। ঠিকই এই ত্রাণকেন্দ্রটির পুরোটাই যেন তাঁরই হয়ে গেল।

দিনরাত পরিশ্রম করছেন তখন মুজিব। নাওয়া-খাওয়ার কথা তাঁর মনে থাকত না। কলেজের ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক তিনি, তাঁর দায়িত্ব তো কম নয়।

১১

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘বিহারিদের প্রথম ব্যাচটা আসবে বাংলায়। শরণার্থীদের জন্য সীমান্তে আমরা আশ্রয়শিবির খুলেছি। সরকারি লোকেরা তো করবেই। আমাদের মুসলিম লীগের পক্ষ থেকেও তো করা উচিত। ছাত্রলীগ আর মুসলিম লীগের ন্যাশনাল গার্ডের ভলান্টিয়ার কোর ফর্ম করো। এ কাজটার নেতৃত্ব তুমি দাও। বর্ডারে গিয়ে তুমি যদি শরণার্থীদের প্রথম ব্যাচটাকে অভ্যর্থনা জানাও, খুবই ভালো হয়। যাবে?’ গলা থেকে টাইটা ঢিলা করে নামিয়ে নিলেন সোহরাওয়ার্দী। সারা দিনের পরিশ্রমে তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

মুজিবও ক্লান্ত। দাঙ্গাদুর্গত মানুষের ত্রাণের কাজে ব্যস্ত তিনি। আহতদের শুশ্রূষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, গৃহহারাদের আশ্রয় দেওয়া, উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর খাদ্যের ব্যবস্থা করা—কাজ কি কম!

মুজিব বললেন, ‘আমাকে কয়েকটা দিন সময় দেবেন। আমি আপনাকে জানাই।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘কয়েকটা দিন সময় চাচ্ছ কেন?’

মুজিব বললেন, ‘রেনু একটু বলছিল বাড়ি যেতে। কলিকাতার নানা খারাপ খবর ওরা পায়। দেখতে চায়।’

‘রেনুর শরীরটা কেমন? বাচ্চাটা মারা গেল। ওর মনটা নিশ্চয়ই খারাপ থাকে। তোমার উচিত ছিল ওকে একটু বেশি করে সময় দেওয়া। দেখো। এদিকে বিহারে লক্ষ লক্ষ বিহারি শরণার্থী। আমার মনটা ভালো না। শরীরটাও। দেশটার কী হলো? এই সব দেখেশুনে মনটা খুবই দমে গেছে।’

‘মানুষে মানুষে এত হিংসা, এত বিদ্বেষ ভালো লাগে না। আমারও খুব বিষণ্ন লাগে। তবে মন খারাপ করবেন না, লিডার। আপনি আপনার সাধ্যমতো করেছেন। আমরা জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি জানমাল রক্ষার। আমাদের দিক থেকে আন্তরিকতার, চেষ্টার কোনো কমতি নাই, এটা বলতে পারি।’

থিয়েটার রোডের মুখ্যমন্ত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে মুজিব হাঁটতে লাগলেন। নেতাকে তিনি এত মন খারাপ করতে কখনো দেখেননি। তাঁর নিজেরও শরীরটা ভালো না। এই কদিন খাওয়াদাওয়া একদমই ঠিকমতো করা হয়নি। গোসল হয়নি। মানুষ মারা যাচ্ছে, মানুষ কাতরাচ্ছে, মানুষের ঘরদোর নাই, সেখানে নিজের শরীর আবার কী? কিন্তু শরীরটা একসময় ভেঙেও তো আসে। তার ওপর যদি মন ভেঙে যায়?

মুসলিম লীগের দোষ দেওয়া হচ্ছে ঘটনার জন্য। বিশেষ করে, সোহরাওয়ার্দীকে। কেন তিনি ১৬ আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন? তাতেই তো বেশি করে এই দাঙ্গা ঘটতে পারল।

কথা ঠিক নয়। ছুটি ছিল বলেই যে যার বাড়িতে থাকতে পেরেছিল, ফলে রাস্তায় দাঙ্গা কম হয়েছে। আরেকটা অভিযোগ উঠেছে নেতার বিরুদ্ধে। তিনি কেন লালবাগে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গিয়ে বসে ছিলেন। তিনি নাকি পুলিশকে বলেছেন অ্যাকশন না নিতে। ঘটনা তা নয়। তিনি গিয়ে অনুরোধ করেছেন সেনাবাহিনী ডাকতে। আর আগের দিন তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ না করতে।

যদি দোষ কারও থাকে তো খাজা নাজিম উদ্দিনের। উনি কেন বলতে গেলেন, এই অ্যাকশন কংগ্রেস আর হিন্দুদের বিরুদ্ধে?

আর দোষ যদি কারও থাকে তো সেটা হিন্দু-মুসলমানের নিয়তির। মুসলমানেরা ওই দিন জনসভায় যোগ দিতে মিছিল করে আসছে, হিন্দুবাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া হয়েছে। আর মুসলমানেরাও মিছিল থেকে হিন্দু দোকানে ঢিল ছুড়েছে, ওরা কেন দোকান খোলা রেখেছে? এইভাবে শুরু। ঢিল-পাটকেলে আহত লোকেরা আসতে লাগল ময়দানের জনসভায়। আহত লোকদের রক্তমাখা পতাকা হয়ে উঠল তাদের নিশান। জনতা ফুঁসে উঠল। তারই পরিণতি এই দাঙ্গা। কত নিরপরাধ মানুষের অকারণ মর্মান্তিক মৃত্যু! কলকাতা থেকে দাঙ্গা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো—নোয়াখালীতে, বিহারে, ঢাকায়। মানুষ যখন মানুষকে হত্যা করতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখন মানুষের ওপর আস্থা রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব বিড়বিড় করে, রবিবাবু, আপনি বলেছেন, মানুষের ওপর আস্থা হারানো পাপ, এত মৃত্যু দেখেও কি আস্থা রাখা যায়?

মুজিব হাঁটছেন। আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। শিউলি ফুলের গন্ধ আসছে নাকে। ফুটপাতের ধারে একটা ঝাঁকড়া শিউলিগাছ। মাথার ওপর তার পাতা, ফুল আর শাখা-প্রশাখার সম্ভার। হাত বাড়িয়ে তিনি গাছের একটা ডাল অলক্ষ্যে স্পর্শ করলেন। একটা চিকন ডাল ধরে টেনে নিচে নামিয়ে ছেড়ে দিতেই সেটা ঝাঁকি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। শিশির আর শিউলি ফুল টুপটাপ করে ঝরে পড়ল তাঁর মাথায়, শরীরে, পায়ের কাছে। তিনি দুটো ফুল কুড়িয়ে নেবেন বলে উপুড় হলেন। তখন মনে হলো, বাকি ফুলগুলো ফুটপাতে পড়ে থাকলে কোনো পথচারীর পায়ের চাপে পড়ে থেঁতলে যেতে পারে। তিনি সব কটা ফুল কুড়িয়ে হাতে নিয়ে দুই হাতে ধরে হাঁটতে লাগলেন। মাথার ওপরের চাঁদটাও হাঁটছে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে।

হোস্টেলে ফিরে নিজের রুমে ঢুকে প্রথম কাজ যেটা করলেন, তা হলো চিঠি লেখা। চিঠি লেখার প্যাডের কাগজ আর কলম তাঁর তৈরিই থাকে। প্রায়ই তাঁকে চিঠি লিখতে হয়।

তিনি লিখলেন :

প্রিয় রেনু, ভালোবাসা নাও।

আশা করি, তুমি ভালো আছ। বাড়ির সকলেও খোদার ফজলে ভালো আছে। তুমি আমাকে বাড়ি এসে কটা দিন সময় কাটাতে বলেছিলে। আমিও তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, সেপ্টেম্বরে আসব। কিন্তু আসা হয়ে ওঠে নাই।

তুমি জানো, আমরা দেশের জন্য কাজ করছি। মানুষের সেবা করছি। মানুষের বিপদে তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছি। নিজের আরাম-আয়েশের কথা আমি কখনো চিন্তা করি নাই।

লিডার সোহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে একটা নতুন কাজ দিয়েছেন। তিনি চান, আমি বিহারের সীমান্তে যাই। ওখানে বিহারি শরণার্থীদের জন্য যে অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়েছে, সেটার দেখাশোনা করি। তুমি জানো, লিডার এই সব ব্যাপারে আমার ওপর কত নির্ভর করে থাকেন। সরকারি লোকজনের চাইতে আমার ওপরেই তাঁর বেশি ভরসা।

এদিকে তোমার জন্যও আমার খুবই মায়া বোধ হচ্ছে। তোমার কাছে যেতে ইচ্ছা করছে। তোমার কাছে যেতে পারি নাই, সেই অপরাধবোধে আমি এমনিতেই আক্রান্ত আছি।

এখন আমার কী করা উচিত আমি ঠিক জানি না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তোমার ওপরে। এর আগেও আমি বহু ব্যাপারে তোমার পরামর্শ নিয়েছি। তোমার বিচক্ষণতার ওপরে আমার ভরসা আছে। তুমি যা বলবে, আমি তা-ই করব।

তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিয়ো।

আব্বা-মাসহ গুরুজনদের সালাম দিয়ো। ছোটদের স্নেহাশিস দিয়ো। ইতি—

তোমার মুজিব

.

চিঠিটা পরের দিনের জরুরি ডাকে ধরিয়ে দিলেন মুজিব। ১০ দিন পর এল উত্তর।

রেনু লিখেছেন, ‘তুমি শুধু আমার স্বামী, এইটাই তোমার একমাত্র পরিচয় নয়। দেশের একজন সেবক তুমি, এইটাও তোমার একটা পরিচয়। তুমি কেবল আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করো নাই, দেশমাতার সেবার জন্যও জন্মেছ। দেশের কাজই তোমার সবচেয়ে বড় কাজ। তুমি নিশ্চিন্ত মন নিয়ে সেই কাজে যাও। আমার জন্য চিন্তা করবে না। আল্লাহর ওপরে আমার ভার ছেড়ে দাও।’

মুজিব পড়লেন। তাঁর বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল। তিনি আরেকবার চিঠিটা পড়ে তাতে একটা চুমু দিলেন। খামসহ যত্ন করে চিঠিটা রেখে দিলেন।

এবার তাঁর ছুটে যাবার পালা নেতার কাছে। একেবারেই তৈরি হয়ে বের হলেন। বিহারের সীমান্তে যেতে হবে। সোহরাওয়ার্দীকে বললেন, ‘আমি ভলান্টিয়ার বাহিনী নিয়ে বিহারে যেতে প্রস্তুত। একবারে তৈরি হয়েই এসেছি।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘তুমি বিবির সাথে কথা বলেছ?’

মুজিবের চোখ চকচক করে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমি তার চিঠি পেয়েছি, লিডার। সে লিখেছে, “তুমি নিশ্চিন্ত মনে বিহার যাও, আমার জন্য ভেবো না।”’

।শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাধারণত আবেগাক্রান্ত হন না। কিন্তু আজ তাঁকে খানিকটা দ্রবীভূত মনে হলো। তিনি মুজিবের কাছে এসে বললেন, ‘মুজিব, শি ইজ অ্যা ভেরি প্রেশাস গিফট টু ইউ ফ্রম গড। ডোন্ট নেগলেক্ট হার, প্লিজ…’

মুজিব কী বলবেন বুদ্ধি না পেয়ে পকেটে হাত দিলেন। পকেটে কতগুলো কী যেন লাগছে। বের করে দেখলেন, সেদিনের শিউলি—সেই শিউলি ফুলগুলো। শুকিয়ে গেছে। তবে বোঁটার লালচে ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

১২

খুবই শীত পড়েছে কলকাতায়। ট্রেনের জানালা দিয়ে শীতের বাতাস আসছে। তখন সকাল আটটার মতো বাজে। শিয়ালদা স্টেশন আসতে আরও আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরি হবে। আকাশে এখনো কুয়াশা। জানালা দিয়ে তবু এক টুকরো ম্লান আলো ঢুকে পড়েছে কামরার মেঝেতে আর সিটে। কোনো গাছ বা বাড়ি সেই রোদটুকরাটাকে বাধা দিলে তা একবার জ্বলছে, একবার নিবছে।

তাজউদ্দীন বললেন, ‘কামরুদ্দীন সাহেব, এই যে শুনি পশ্চিমে শীত নাই। শীত তো ভালোই পড়েছে। আপনি চাদরটা গলা পর্যন্ত উঠিয়ে নিন। আপনার শীত করতে পারে।’

কামরুদ্দীন বললেন, ‘আপনার শীত লাগছে তাই বলেন। মাঘ মাস চলছে। মাঘের শীতে বাঘ পালায়।’

তাজউদ্দীন বলেন, ‘না, আমার তেমন লাগছে না শীত। কারণ, আমাদের কাপাসিয়ার বনে বাঘ আছে। আমি একবার বাঘ শিকারে গিয়েছিলাম। আমি বন্দুক ধরিনি। কয়েকজন বীরের হাতে বন্দুক ছিল। আমাদের হাতে ছিল লাঠি। বাঘের গায়ে গুলি লাগল। বাঘ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। বন্দুকঅলারা সব পালাতে লাগল। আমার সাথে যে ছিল, সে বলল, ‘বাঘ তো এদিকেই আসছে। চলেন, পালাই।’

‘আমি বললাম, হাতে লাঠি আছে কী জন্য? আসুক না বাঘটা, তারপর দেখা যাবে?’

‘কবেকার ঘটনা?’ কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে অ্যাডভোকেট কামরুদ্দীন আহমদ জিজ্ঞেস করলেন।

‘এই তো ছেলেবেলার।’

‘আরে, আপনার ছেলেবেলা কেটেছে নাকি?’

‘কী বলেন, আমার বয়স এখন একুশ। সাড়ে বিশ তো বটেই।’

‘আর বাঘের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন কবে?

‘এই তো বছর পাঁচেক আগে হবে।’

‘হুম। তাহলে তো তখন রীতিমতো বালক ছিলেন।’

‘তখন বালক থাকলে এখনো বালকই আছি।’

‘না না। মুসলিম লীগ করতে গিয়ে আপনার বয়স বেড়ে গেছে। বিশেষ করে, আমার মনে পড়ে সেই দিনের ঘটনা।’

‘কোনটা, বলুন তো?’

‘ওই যে গফরগাঁওয়ে। সেদিনও এই রকম ট্রেনে করেই তো যাচ্ছিলাম আমরা। আপনি সেদিন ওই বুদ্ধি না করলে কী যে হতো!’

তাজউদ্দীন হাসেন। বুদ্ধি কি আর এমনি বেরিয়েছিল। জীবন বাঁচানোর জন্য।

গফরগাঁওয়ে মুসলিম লীগের সম্মেলন ছিল। সব কেন্দ্রীয় নেতা গেছেন সেখানে। এর মধ্যে আছেন নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিম উদ্দিন প্রমুখ। কিন্তু গফরগাঁওয়ে এমারত পার্টি নামের স্থানীয় একটা পার্টি খুব শক্তিশালী। তাদের হাজারো সমর্থক লাঠিসোঁটা-সড়কি- রামদা-বর্শা নিয়ে প্রস্তুত। মুসলিম লীগারদের ঢুকতে দেবে না গফরগাঁওয়ে। পুলিশ প্রহরায় নেতারা নামতে যাবেন। অমনি ঢিল এসে পড়ল দরজায়। পুলিশি তৎপরতায় নেতারা ট্রেন থেকে নামতে পেরেছিলেন।

তাঁরা টেলিগ্রাম করলেন ঢাকায়: জলদি তিন-চার শ গুন্ডাজাতীয় নিৰ্ভীক লড়িয়ে লোক নিয়ে গফরগাঁও আসো। এসওএস। সেভ আওয়ার সোলস।

কামরুদ্দীন আর তাজউদ্দীন পার্টির সঙ্গে মিটিং করে দেড় শ বাছাই করা দুর্ধর্ষ মাস্তান নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। গফরগাঁও স্টেশনে গিয়ে দেখেন, তারা চিৎকার বড় বড় রামদা হাতে হাজার হাজার লোক। করছে—এমারত পার্টি, জিন্দাবাদ।

এই সশস্ত্র হাজারো মানুষের কাছে এই দেড় শ গুন্ডা কিছু না।

তাজউদ্দীন তখন এক বুদ্ধি করলেন। স্লোগান ধরলেন : ‘লাঙল যার জমি তার, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করো, জমিদার নিপাত যাও।’ তাঁর সঙ্গে দেড় শ গুন্ডা এই স্লোগান দিতে দিতে নামল। তাজউদ্দীন একবারও নিলেন না মুসলিম লীগের নাম। মারমুখী স্থানীয় জনতা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। ‘এরা আবার কারা। এরা যে দেখছি আমাদের মনের কথা বলে।’ তারা তাদের ওপর আর হামলা করল না।

ঠিক এক বছর আগের ঘটনা। এমনই শীতকাল। এমনই এক ট্রেনেই তাঁরা গিয়েছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও।

আজকে তাঁরা যাচ্ছেন কলকাতায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে।

কামরুদ্দীন বললেন, ‘আমরা কিন্তু সম্মেলনে আবুল হাশিমকেই সভাপতি পদে সমর্থন করব।’

তাজউদ্দীন বললেন, ‘তাঁর তো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকার কথা নয়। তিনি হয়ে যাবেন।’

কামরুদ্দীন বললেন, ‘না। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবার সভাপতি হবার চেষ্টা করতে পারেন। জিন্নাহ সাহেব যেহেতু তাঁকে মুসলিম লীগে ফেরার অনুমতি দিয়েছেন, ফজলুল হক সাহেবই সভাপতি হয়ে যাবেন। আমরা গিয়ে দেখি পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়। শুনি সোহরাওয়ার্দী সাহেব কী বলেন।’

এর মধ্যে ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকে পড়েছে। আস্তে আস্তে তার গতি মন্থর হচ্ছে। তাঁরা তাঁদের মালপত্র গুছিয়ে নিলেন।

সম্মেলনস্থলে এসে দেখলেন, এ কে ফজলুল হকের দিকেই সমর্থনের পাল্লা ভারী। এর আগে মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ। তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

আশ্চর্য যে সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেন।

কামরুদ্দীন সাহেব রাতের বেলা গেলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাসায়। তাঁকে বললেন, ‘আপনি এটা কী করছেন! ফজলুল হক সাহেব সভাপতি হলে তিনিই তো প্রধানমন্ত্রী হবেন। আপনার তো তখন বিদায় নেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।’ কিন্তু তিনি নিরপেক্ষতা পরিত্যাগ করলেন না।

একসময় ছাত্ররা আবুল হাশিমের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করল। মনে হচ্ছে, তারা লোহার রেলিং আর গেট ভেঙে আবুল হাশিমের ওপর চড়াও হবে। ছাত্রনেতারা দোতলা থেকে বিক্ষোভ দেখছেন।

এই সময় মারমুখী ছাত্রদের সামনে এগিয়ে গেলেন অকুতোভয় একজন—শেখ মুজিবুর রহমান। বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন, ‘সব চুপ। কেউ এক পা আগাবা না। একটা কথা বলবা না।’

কামরুদ্দীন সাহেবের মনে হলো, ছাত্ররা না আবার মুজিবকেই আক্রমণ করে বসে।

না, তা হলো না। শেখ মুজিবের ওই ধমকেই যেন কাজ হলো। তাজউদ্দীনের শ্রদ্ধা চিরদিনের জন্য কিনে নিলেন শেখ মুজিব।

কিন্তু আবুল হাশিম আর এ কে ফজলুল হকের এই দ্বন্দ্বের সুযোগে মওলানা আকরম খাঁ খবর পাঠালেন, তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করছেন। কাজেই তিনিই সভাপতি।

এটা ছিল একটা খেলা, ফেরার পথে ট্রেনে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তাজউদ্দীন বললেন কামরুদ্দীনকে।

কামরুদ্দীন বললেন, ‘হ্যাঁ। এক ঢিলে তিন পাখি মারা হলো। আবুল হাশিম আউট। এ কে ফজলুল হক আউট। এর পরের ধাপ হবে সোহরাওয়ার্দীকে আউট করা।’

কামরুদ্দীন সাহেব হতাশায় নিচের ঠোঁট কামড়াতে লাগলেন। তাজউদ্দীন বললেন, ‘সোহরাওয়ার্দী সাহেব কেন এই রকম আচরণ করলেন? জিন্নাহ সাহেবের আস্থা অর্জনের জন্য?’

‘হতে পারে। পলিটিকসটা তো উনি আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন বলেই মনে হয়।’

রাতের ট্রেন। কলকাতা শহরের আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। আস্তে আস্তে অন্ধকারের পেটের ভেতর ঢুকে গেল ট্রেনটা।

শীতের ঝাপটা আসছে খোলা জানালাপথে। তাজউদ্দীন জানালার কবাট নামিয়ে দিতে দিতে বললেন, এক মাঘে শীত যায় না।

১৩

মুজিব এখন ব্যস্ত অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রচারণায়। তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড স্বাধীন বাংলা চান। তিনি এই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করছেন, সংবাদপত্রে বিবৃতি দিচ্ছেন, কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে দেখা করছেন, জিন্নাহকে চিঠি লিখছেন, ব্রিটিশদের বোঝাচ্ছেন। অতএব, শেখ মুজিবও আছেন অখণ্ড বাংলার পক্ষে। আসাম, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা—সবটা মিলে একটা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা।

সোহরাওয়ার্দীর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেহাদ-এ অখণ্ড বাংলার পক্ষে খুব লেখা হচ্ছে।

আর নাজিম উদ্দিন প্রমুখের দৈনিক আজাদ-এ বলা হচ্ছে, অখণ্ড বাংলা হচ্ছে মুসলমানদের জন্য মৃত্যুপরোয়ানা।

মুজিব যাচ্ছেন ইসলামিয়া কলেজের দুই হোস্টেলের রুমে রুমে। ছাত্রদের বোঝাচ্ছেন। তাঁর বিরোধিতা করছেন ছাত্রলীগের ডানপন্থী গ্রুপের নেতা শাহ আজিজ প্রমুখ।

হোস্টেলের লনে দাঁড়িয়ে এখন মুজিব কথা বলছেন, অখণ্ড বাংলার পক্ষে যুক্তিগুলো উপস্থাপন করছেন। ছাত্ররা গোল হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনছে। তিনি বললেন, ‘স্বাধীনতা এলে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাও থাকবে না। এটা হচ্ছে, কারণ, ঔপনিবেশিক শাসকরা বিভেদ জিইয়ে রাখতে চায়। মানুষের পেটে ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই; তাই তারা নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য হিন্দু বা মুসলমানকে দায়ী ভাবছে। বাংলা স্বাধীন হলে এই সমস্যা থাকবে না। বাংলা হবে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। মানুষের অন্ন- বস্ত্রের সমস্যা না থাকলে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাও থাকবে না।’

একজন বললেন, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি যে বলছেন, বাংলা হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু বাংলা দিল্লি থেকে প্রতিবছর ৬৪ কোটি রুপি পায়। সেটা না পেলে আমাদের কী হবে?’

মুজিব একটু থমকে গেলেন।

তাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে এলেন তাঁর সহপাঠী একজন। তাঁর নাম সালাহউদ্দীন। তিনি অর্থনীতি ভালো বোঝেন। তিনি বললেন, ‘দিল্লি বাংলাকে ৬৪ কোটি রুপি দেয়, কিন্তু বাংলা ট্যাক্স থেকে, কাস্টমস থেকে ৬৪ কোটি রুপির চেয়ে অনেক বেশি দেয় দিল্লিকে।

মুজিব বললেন, ‘তাহলেই বুঝুন, আমাদের কী করা উচিত? আমরা চাই বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা।’

১৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছের পাতায় পাতায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। কাল রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ত্রিকালদর্শী ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি গাছের ডালে বসে পরস্পরের চোখের দিকে তাকায়। বৃষ্টিটা হওয়ায় গরমটা একটু কমেছে। শহরের মানুষেরা একটু জিরোতে পারবে। যা গরম পড়েছে এবার!

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘ব্যাঙ্গমি, নেহরু কী করতেছে, খেয়াল করতেছ!’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘নেহরু কী করে, সেইটা দেখার আমার দরকার নাই। তুমি দেখো!’

‘আহা, শোনো না, ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কী কন?’

‘উনি তো এখন ব্যস্ত কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের মধ্যে সালিসিতে। ভারত কীভাবে স্বাধীন হইব। ভাগ হইব, নাকি প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসন পাইয়া যুক্তরাষ্ট্র গড়া হইব—এই সব নিয়া তিনি ব্যস্ত।’

ব্যাঙ্গমা হাসে। ‘উনি তো এই সব নিয়াই ব্যস্ত থাকবেন। ওনার ঘর- সংসার নিয়া তো কোনো টেনশন নাই। বউ শান্তিতে আছে। উনি তাঁর প্যালেসের আঙিনায় খাড়ায়া আকাশের দিকে তাকায়া হাঁপ ছাড়তেছেন, পামেলার মা একটা ভালো বন্ধু পাইয়া গেছে, ও খুব ভালো আছে, নেহরুর সাথে ওর বনে ভালো।’

‘হ, কথাটা খারাপ কইল কী?’

‘আরে, জহরলাল নেহরু তখন প্ৰেম চালায়া যাইতেছে

মাউন্টব্যাটেনের বউ এডুইনা মাউন্টব্যাটেনের সাথে। দেখতেছ না?’

‘অরা প্রেম করে নাকি গোসসা করে করুক। আমগো কী?’

‘কোনখানে শুরু হইল প্রেমটা, কও তো দেখি। ম্যাশোবরায়। ওই পাহাড়ি স্টেশনটা, ওইখানে। তারা সবাই বেড়াতে গেল, না কী একটা ফ্যামিলি পার্টি করল। তখনই ওই প্রেমের শুরু।

‘কিসের প্রেম? ওই যে অরা সোফায় বইসা কথা কইতেছে, নেহরু আর এডুইনা। কই, খালি তো দেখি কথাই কয়। শরীরের পোশাক- আশাকও তো ঠিক আছে। তুমি খালি বানায়া কথা কও। ওনাদের মাইয়া পামেলাও তো দেখি ওইখানে ঘুরঘুর করে।

‘তুমিও তো দেখি মাউন্টব্যাটেনের মতো নিশ্চিন্ত। যাক। এডুইনা ভালো আছে। নেহরুর সাথে তার বনে ভালো। অরা একসাথে থাকলে বড় ভালো থাকে। থাকুক।

‘হ, ভালো থাকলে থাকুক।’

‘আর এই সুযোগে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতকে স্বাধীনতা দিয়া দিতেছে।’

‘ভালো। স্বাধীনতা পাইতেছে ভারত। খারাপ কী?’

‘খারাপ-ভালো বলার তো আমরা কেউ না। আমরা শুধু কী ঘটতেছে, সেইটা দেখতে পারি। ঘটনার গতিপথ তো আমরা বদলাইতে পারি না। তাই না?’

‘সেই। আগামী ১০ বছর ধইরা এডুইনা আর নেহরু চিঠি লেখালেখি চালায়া যাইব। এইটাও আমগো দেখতেই হইব। আমরা কিছু কইতে পারব না।’

‘এক সুটকেস ভরা চিঠি লেখব। ১০ বছর পরে চিঠিতে মনে করব এখনকার দিনগুলানের কথা, কী লেখব আমি তোমারে কই—সম্ভবত তুমিও বুঝতে পারলে, আমাদের মধ্যে আছে এক গভীর গভীরতর লগ্নতা, কী এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি যেন আমাদের দুজনকে পরস্পরের কাছে টানছে। আমি অভিভূত হলাম, হলাম উল্লসিত, এই নতুন আবিষ্কারে। আমরা আরও অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতে লাগলাম, যেন কোনো পর্দা গেল সরে, আমরা পরস্পরের চোখে তাকাতাম কোনো শঙ্কা বা অস্বস্তি ছাড়াই। ‘ ‘তুমি তো দেখি ভালোই পড়ো। শেখো শেখো। দেখলা, কত সুন্দর কইরা লিখছে। তুমি কোনো দিনও আমারে এমন সুন্দর কথা কইছ?’ ব্যাঙ্গমি বলে।

‘নেহরু তার বউরে কোনো দিনও কইছে?’ ব্যাঙ্গমা জিজ্ঞেস করে। ‘তার বউ তো মইরা গেছে।’ ব্যাঙ্গমি জানায়।

‘তাইলে। তুমি চাও, আমি লেডি মাউন্টব্যাটেনরে এই সব কথা কই?’ ব্যাঙ্গমা রসিকতা করার চেষ্টা করে।

ব্যাঙ্গমি কপট রাগ দেখায়, ‘ওরে। মনে মনে তোমার এই…’

‘আরে না। কাউরে প্রেম করতে দেখলে ভালো লাগে, তাই না? নেহরু কত কী করব এই লেডির লাইগা। এরপরে নেহরু হইব ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তারপর ব্রিটেনে নেহরু রানিরে চিঠি লিখব : লর্ড মাউন্টব্যাটেন আর তার বউ লেডি মাউন্টব্যাটেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য অনেক কিছু করছেন, তাঁদেরকে পুরস্কার দেন। এই চিঠি নিয়া রানির অফিসে অনেক হাসাহাসি হইব। যে উত্তরটা অরা লিখব, সেইটা মোটেও ভালো কিছু না।’ ব্যাঙ্গমা বলে।

ব্যাঙ্গমি মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘আরে, বাদ দাও। অরা প্রেম করে, অন্যদের সহ্য হয় না।’

‘তবে প্রেমটা কিন্তু হইব অমর প্রেম। ১০ বছর পর যখন এডুইনা মারা যাইব, তখন প্রধানমন্ত্রী নেহরু ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠায়া দিব সেইখানে, যেইখানে সাগরের বুকে সমাহিত করা হইব এডুইনারে। নৌবাহিনী গিয়া নেহরুর পক্ষ থাইকা ফুল দিব এডুইনার সলিলসমাধিতে।’

ব্যাঙ্গমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আহা, কী গভীর ভালোবাসা!’

ব্যাঙ্গমা ঠেস দিয়ে বলে, ‘অরা যখন প্রেম করে, তখন মাউন্টব্যাটেন ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করে। পাকিস্তান হইব। ভারত হইব। কাটাছেঁড়া চলব।’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘তাই তো।’

ব্যাঙ্গমা বলে,

নেহরু এডুনা করে পিরিতি যখন।
মাউন্টব্যাটেন ভাঙে ভারত তখন ॥
কলমের দাগ দিয়া খণ্ডিল ভারতে।
এডুনা নেহরু ওড়ে ভালোবাসা রথে ॥
এক বাক্স চিঠি লিখবে প্রেমিকযুগলে।
এই কথা লেখা থাকে কর্তিত ভূগোলে ॥
এডুনার মাথা নিল নেহরু কিইনা।
পোকা কাটা পাকিস্তান পাইল জিন্নাহ ॥

ব্যঙ্গমি বলে,

আমরা সেসব দেখি দর্শক কেবলি।
করতে পারি না কিছু শুধু কথা বলি ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *