যারা ভোর এনেছিল – ১

এক ছিল ব্যাঙ্গমা। আরেক ছিল ব্যাঙ্গমি। একটা আমগাছের ডালে ছিল তাদের বাস।

ওই আমগাছটা কোথায় ছিল?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা কোথায়?

পূর্ব পাকিস্তানে।

শেখ মুজিব অবশ্য কখনোই পূর্ব পাকিস্তান শব্দটা উচ্চারণ করতে চাইতেন না। ১৯৪৭-এর পরও তাঁর জন্মভূমিকে তিনি ডাকতেন পূর্ব বাংলা বলে। বিশ শতকের ষাটের দশকের শেষের দিকে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন বাংলা দেশ। আসলে, ইংরেজ শাসনের অবসানের পর, পাকিস্তানের পূর্ব অংশটাকে বহুদিন পূর্ব পাকিস্তান নাম দেওয়াও হয়নি, এটা পূর্ব বাংলা বলেই পরিচিত ছিল। তারপর যখন এর নাম সরকারিভাবে পূর্ব পাকিস্তান রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়, শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেছিলেন, স্যার, আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে আপনারা এটাকে বাংলা বলে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে ঐতিহ্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের খোলা চত্বরে ছিল আমগাছটা। এই আমগাছের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বও ছিল। ১৯৫২ সালে এই আমগাছের ছায়াতলে সমবেত হয়েছিল ঢাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তারা বেরিয়ে পড়েছিল মিছিল নিয়ে।

আমাদের এই গল্পে ওই আমগাছের গুরুত্ব অবশ্য সে কারণে নয়। সেই গাছে বসে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি মনের খেয়ালে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘ওগো শুনতেছ!’

ব্যাঙ্গমা তখন আমের ডালে তার ঠোঁট ঘষছিল। আরামে তার চোখ বুজে আসছিল। চোখ না খুলেই সে বলে, ‘শুনতেছি।’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘আচ্ছা, কও তো, এই সব স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা এসে এইখানে আমাদের বাসার নিচে মিটিং করে, মিছিল করে, বায়ান্ন সালে মিছিল করতে গিয়া তো শেষে কয়জন পুলিশের গুলিতে মারাও গেল। এই সব কইরা কোনো লাভ আছে?’

ব্যাঙ্গমা চোখ খুলে বলে, ‘হ, লাভ আছে না! আছে।’

‘কী লাভ?’

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘এই যে তুমি আমার সাথে এই সব নিয়া কথা কইতেছ। এইটাই তো লাভ।’

ব্যাঙ্গমি ঠোঁট বাঁকিয়ে পুচ্ছ নাচিয়ে বলে, ‘ইশ্। আমি বুঝি কথা কই না। সারাক্ষণ তো আমিই কথা কই। তুমি তো খালি…’

ব্যাঙ্গমার মুখে হাসি, ‘ক্যান, আমি কথা কই না? কত আদর-সোহাগ কইরা কথা কই।

ব্যাঙ্গমি তার ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে বলে, ‘না, তুমি মোটেও আদর- সোহাগ কইরা কথা কও না। আদর-সোহাগ করার মতলবে মিঠা মিঠা কথা কও। তারপর কাম ফুরাইলে মুখ ফিরায়া থাকো। কথা যা কওয়ার আমিই কই।’

ব্যাঙ্গমা গম্ভীর মুখে বলে, ‘আচ্ছা, আমি কথা কইতেছি। কথা কথা কথা…’ তারপর সে হেসে ফেলে।

ব্যাঙ্গমি দুই ডানা ঝাপটে বলে, ‘চালাকি করো! আমার লগে চালাকি কইরো না। যা কই, মন দিয়া শুনো।’

ব্যাঙ্গমার মুখ থেকে হাসি সরে না, ‘আগে কান দিয়া শুনি। তারপর মনে লই?’ সে তার এক পা দিয়ে কানের ওপরের পালক সরায়।

ব্যাঙ্গমি প্রবোধ মানে, বলে, ‘আচ্ছা, তা-ই করো। শুনো, এই যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এত ফাল পাড়তেছে, কোনো লাভ নাই। একটা লোক পূর্ব বাংলারে স্বাধীন করব।’

‘আচ্ছা।’ ব্যাঙ্গমা উৎকর্ণ। বলে, ‘কোন লোকটা?’

‘এই দেশের সবচেয়ে সুন্দর লোকটা। ছয় ফুট উঁচা। সাদা পাঞ্জাবির ওপরে কালো হাতাকাটা কোট পরে। এক আঙুল উঁচায়া কথা কয়।’

‘বুঝছি বুঝছি,’ ব্যাঙ্গমা নড়ে বসে, ‘আর কইতে হইব না। তুমি শেখ মুজিবরের কথা কও।

‘আচ্ছা, কও তো, শেখ মুজিব এক আঙুল তুইলা কথা কয় ক্যান?’

‘কারণ, সে নানা কথা কয়, নানা কাজ করে, কিন্তু শেষ লক্ষ্য তার একটাই।’ ব্যাঙ্গমা এবার বউয়ের ধাঁধার জবাব দেয়।

ব্যাঙ্গমি চোখ উজ্জ্বল করে বলে, ‘দেশ স্বাধীন করব। এইটাই তার জীবনের একমাত্র টার্গেট।’

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘দেশ স্বাধীন হইব। যুদ্ধ কইরা। সেই যুদ্ধের সময় মুজিবর আর একলা একটা মানুষ থাকব না, সাড়ে সাত কোটি মুজিবর হইয়া যাইব। ওই রকম মানুষ যদি সাড়ে সাত কোটি হয়, তার মানে কী দাঁড়ায়, তুমি বুঝলা!’

‘সাড়ে সাত কোটি আগুন-মানুষ। হা হা হা। পাকিস্তানিগুলান খুব নাস্তানাবুদ হইব।’ ব্যাঙ্গমি মুখের পালকগুলো ফুলিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, কও তো, ক্যান আমি কইলাম এই কথাটা? কোন হিসাবে যে বাংলাদেশের মানুষের জয় হইব?’

ব্যাঙ্গমা মুখ তোলে। ‘১০১টা কারণ আছে। এর মধ্যে একটা হইল, ছয় ফুট লোকটার ডান হাত হইয়া আছে একটা পাঁচ ফুট লোক। তার নাম তাজউদ্দীন। মুজিবর হইল ঝড়ের মতন। সবকিছু উড়ায়া নেয়। মুজিবর হইল সাগরের মতন। সবকিছু বুকে টাইনা লয়। আর তাজউদ্দীন হইল ঠান্ডা মাথার মানুষ। কথা কম কয়। আস্তে কয়। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাইখা পরিকল্পনা করতে পারে। বাঙালির পরম সৌভাগ্য যে তারা শেখ মুজিবরের মতন নেতা পাইছিল। তবে সোনার সঙ্গে সোহাগা পাইছিল তাজউদ্দীনরে।’

‘বাংলাদেশ স্বাধীন হইব। হি হি হি।’ দুজনে হাসতে থাকে। খলবলানো হাসি।

ব্যাঙ্গমা বলে,

বাংলাদেশটা স্বাধীন হইব একদিন।
মুজিবর নেতা তার সঙ্গী তাজউদ্দীন ॥
মুজিবর এক করে সমস্ত জাতিরে।
মুজিবর এক করে সকল সাথিরে ॥
মুজিবর অগ্নি করে সমস্ত মানবে।
তাজউদ্দীন সম্পাদক সাথে সাথে রবে ॥

ব্যাঙ্গমি বলে,

শেখ মুজিবর মানে মুক্তি স্বাধীনতা।
তাজউদ্দীনও সারাক্ষণ বলে সেই কথা ॥
বেঁচে থাকতে তাজউদ্দীন করেন সে উক্তি।
মৃত্যুতে প্রমাণ হলো সে কথার যুক্তি ॥
জীবন বিচ্ছেদময় উত্থানে পতনে।
মৃত্যু সব মিলে দেয় নিষ্ঠুর যতনে ॥

‘আপনি কাকে বেশি ভালোবাসেন? বঙ্গবন্ধুকে, না বাংলাদেশকে?’ তাজউদ্দীন আহমদকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তাজউদ্দীন আহমদকে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসতে হয়নি। কারণ, এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর বহু আগেই জানা।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে আসছেন, বিমানের সিঁড়িতে তাজউদ্দীন জড়িয়ে ধরলেন তাঁর মুজিব ভাইকে। পরস্পরের অশ্রু মিলেমিশে বইতে লাগল এক ধারায়। তাঁদের মাথার ওপর বাংলার আকাশ, পায়ের নিচে জন্মভূমির পুণ্য মাটি। কত দিন পর মুজিব ফিরে এসেছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত মুক্তির ঠিকানায়, স্বাধীনতার আলোয় ঝলমলে বাংলাদেশে!

প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে তাঁরা উঠলেন খোলা ট্রাকে। সেখানেও ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যেই তাজউদ্দীনের কানে কানে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাজউদ্দীন, আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হব।’ পরে আলোচনা করে সাব্যস্ত করা হলো, সংসদীয় গণতন্ত্রই হবে শাসনপদ্ধতি, আর বঙ্গবন্ধু হবেন প্রধানমন্ত্রী। ওই দিনটা ছিল তাজউদ্দীনের এক পরম সুখের দিন। কারণ, নেতা সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্রে রাজি হয়েছেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংযোগ কর্তা আলী তারেকের মনে দ্বিধা, তাঁর বোধ করি মনে হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি আর তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করলে তা হবে সব দিক থেকে সুন্দর। আলী তারেক ছুটে গেলেন তাজউদ্দীনের কাছে, বললেন, ‘আপনি প্রধানমন্ত্রী থাকুন, এখনই একটা কিছু করুন। বঙ্গবন্ধুকে বোঝান।’

তাজউদ্দীন বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হবেন, এইটাই তো আমরা সবাই চাই।’

‘আর আপনি?’

‘আমি? আমার আবার কী চাওয়া? আমার দুইটা চাওয়া ছিল। এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দুই. আমাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়া। আমার দুইটা চাওয়াই পূর্ণ হয়েছে। আমার তো আর কোনো চাওয়া নাই।’

তরুণ আলী তারেক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সেই সৌম্যদর্শন মানুষটার দিকে। তারপর বললেন, ‘আপনি কাকে বেশি ভালোবাসেন? বঙ্গবন্ধুকে, না বাংলাদেশকে?’

তাজউদ্দীন দ্বিধাহীন কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আলী তারেক, আমি বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালোবাসি।’

তাজউদ্দীন জানতেন, গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, বাংলা, বাংলাদেশ আর বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভালোবাসার কোনো তল ছিল না। কোনো খাদ ছিল না। মুজিব ভাই সারাটা জীবন একটা জিনিস‍ই চেয়েছেন, তা হলো বাঙালির মুক্তি। কাজেই মুজিব ভাইকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে ভালোবাসা যায়।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমির আদি বাসস্থান আমগাছটা ছিল পরবর্তীকালে যেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ স্থাপিত হয়, সেখানে। গাছটা কাটা পড়ে। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি হিসেবে তার একটা গুঁড়ি রেখে দেওয়া হবে।

উদ্বাস্তু ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি এসে আশ্রয় নেয় একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরের বটগাছের ডালে। এই জায়গাটা তাদের আরও পছন্দ হয়। এখান থেকে আকাশটা আরও বড় বলে মনে হয়। আর প্রাঙ্গণটাও কত বড়! সারা ঢাকা শহর থেকে যখন স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা এখানে এসে সমবেত হয়, সভা করে, মিছিলে মেলায় কণ্ঠস্বর, যখন তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত হয় আকাশের দিকে, তখন ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি রোমাঞ্চিত বোধ করে।

বটবৃক্ষের শাখায় বসে দুই বিহঙ্গ একদিন আবার কথা বলে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে।

‘মুজিবুর রহমান আর তাজউদ্দীন কেমন একসাথে মিলামিশা করতেছে, খেয়াল করছ?’

‘শেখ মুজিবুরের সাথে সবাই মিলামিশা কাজ করতেছে। খালি তাজউদ্দীন নাকি?’

‘কিন্তু তাজউদ্দীন ঠিক রাখতেছে কাগজপত্রগুলান, দাবি-দাওয়াগুলান লিখিত-পড়িত রাখতেছে। তোমারে কইছি না, এই দুইজনের এই ভালোবাসার সম্পর্ক বাংলারে স্বাধীনতা দিব।’

‘হ, তা তো কইছই। এইটাই তো পাকিস্তানের কপালে লেখা।’

‘কিন্তু এই দুই নেতা তো একসময় আলাদাও হইয়া যাইব।’

‘তা হইব। তখনই আসব আঘাত।’

‘কেমন?’

‘জানি না। কিন্তু আঘাত আসবই। সেইটা জানি। সেই আঘাত সামলানো কঠিন হইব। নেতারা মারা পড়ব। দেশটাও অন্ধকারের মেঘের নিচে ছাইয়া থাকব। দেশটারে বহুদিন আর চেনাই যাইব না।’

ব্যাঙ্গমা বলে,

‘মুজিবর-তাজউদ্দীনে দূরত্ব যখন হয়।
বাংলার আকাশে তখন ঘোর দুঃসময়।।’

ব্যাঙ্গমি বলে,

‘ঘোর দুঃসময় ছায় বাংলার আকাশ।
অশ্রু রক্ত অন্তর্ঘাত নিহত বিশ্বাস।।
হালভাঙা নৌকা যেন বিক্ষুব্ধ সাগরে।
ছেঁড়া পাল চিহ্নহীন ডুবে যেন মরে ॥’

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি মন খারাপ করে।

আর বটগাছের পাতাগুলো হয়ে পড়ে নিথর। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই রোদ মরে যায়। ছায়া নেমে আসে।

কিন্তু আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় সিআইএ সদর দপ্তরের টেলেক্স মেশিনের পাতাগুলো নিশ্চল হয় না। তারা নড়তে থাকে।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমির এই কথাগুলো ধরা পড়ে সিআইএর রাডারে। তারা পুরোটা ধারণ করে এবং কথাগুলোর মর্ম উদ্ধারে তৎপর হয়। তারা বলে, গ্রিসের রাজনীতিতে একদা অ্যাপোলোর এই সব ভবিষ্যদ্বাণীর ভূমিকা ছিল বটে। সফোক্লিসের ইদিপাসে দৈববাণী উচ্চারিত হয়েছিল, ইদিপাস নিজের পিতাকে হত্যা করবে, আর সঙ্গম করবে নিজের মাতার সঙ্গে। পুরো নাটকে থাকে সেই পরিণতি এড়ানোর চেষ্টা। কিন্তু সেই নিয়তিকে এড়ানোর সব চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যদ্বাণীটিকেই ফলিয়ে তোলে। এসব পুরাণকথা। বাস্তবে অ্যাপোলো এখন নাসার নভোযানের নাম, ফলে অ্যাপোলো এখন আমাদের। বস্তুত আমরাই অ্যাপোলো। আমরাই নির্ধারণ করব পৃথিবীর কোথায় কী ঘটবে। কে সিংহাসনে বসবে, কে সিংহাসনচ্যুত হবে, কে হবে রাষ্ট্রনায়ক, কে স্বায়ত্তশাসন পাবে আর কে হবে আরও অধীন, সেসব ঠিক করবে কারা? আমরা। কে বেঁচে থাকবে, কে মারা যাবে, তা তো এখন আমাদের হাতে।

তাহলে কারা এই ভবিষ্যদ্বক্তা! কেন তারা এই ভবিষ্যদ্বাণী করছে? কী তাদের উদ্দেশ্য? তাদের ক্ষমতার উৎসই বা কী?

আমরা যদি আজকের দিনেও গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোর মতো অলৌকিক হাতে নিয়তি নির্ধারণের ক্ষমতা দিয়ে রাখি, তাহলে আমরা আর আমেরিকা কেন? কী লাভ তাহলে আমাদের অ্যাটম বোমা রেখে? কী লাভ চাঁদের উদ্দেশে মানুষ পাঠিয়ে? কী লাভ সিআইএর অ্যাকাউন্ট থেকে মাসে মাসে, সপ্তায় সপ্তায় বেতন তুলে!

‘আমরা ঘটনা ঘটাব আমাদের ইচ্ছা অনুসারে।’

‘কী ঘটাব?’

‘আমরা আমাদের লোক ঢুকিয়ে দেব এই দুজনের মাঝে।’

‘কাকে ঢোকাব?’

‘বললামই তো, আমাদের লোক।’

‘কে সে?’

‘আছে। তাজউদ্দীন ছাড়াও মুজিবের খুব কাছে যথেষ্ট পারঙ্গম লোক আছে।’

‘তা তো আছেই। অনেকেই আছে।’

‘না। অনেকের কথা হচ্ছে না। হচ্ছে একজনের কথা।’

‘কার কথা?’

‘সে আমাদের লোক।

‘কে সে?’

‘মুজিবের পিছে পিছে সে ছায়ার মতো লেগে থাকে। মাথায় চোঙা টুপি! লোকটা ছোটখাটো। মিনমিন করে সব সময়। হাত কচলায়।’

‘বুঝেছি বুঝেছি। আর বলতে হবে না। একজনই আছে এই রকম, যে বলে বেড়ায় যে সে আমাদের লোক। আচ্ছা, তাকে আমরা লাগিয়ে রাখলাম। তারপর আমরা কী করব?’

‘আমরা দেখব আর উপভোগ করব। নিয়তির নির্ধারক আমরাই। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ কাজ করবে তার নিজের সাধ্যমতো, কিন্তু ফল ভোগ করবে আমাদের মর্জিমাফিক। প্রাচীন গ্রিসের উঁচু পাহাড়ের শানুদেশে ছিল ডেলফি। ক্যাস্টালিয়া ঝরনার জলপ্রপাত, গভীর খাদ থেকে উঠে আসা বাষ্পমালা, তারই আড়ালে তিন পা-অলা চৌকি থেকে উচ্চারিত হতো অ্যাপোলোর ভবিষ্যদ্বাণী। মানুষকে সেসব পথ দেখাত। কখনো বা জানিয়ে দিত, তাদের মুক্তি নাই, পথ যতই খোঁজা হোক না, ভবিতব্য কেউ খণ্ডাতে পারবে না। এখন সেই গ্রিস নাই, সেই অ্যাপোলো নাই, সেই ভবিষ্যৎ বলনেওয়ালি পাইথিয়া নাই। এখন আছে আমাদের মহান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আছে ল্যাংলে ভার্জিনিয়া, আছে হোয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, পেন্টাগন। এখন আমাদের কণ্ঠই একমাত্র দেববাণী আমাদের ইচ্ছাই একমাত্র স্বর্গীয় ইচ্ছা। এই সময়ে, এই বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে, বাংলা নামের ওই স্থানটিতে এ কোন রহস্যময় কণ্ঠস্বর শোনাচ্ছে এ কোন নতুন ওরাকল?

সত্য বটে, বাংলা চিরকালই গণ্য ছিল রহস্যলোক হিসেবে। হিমালয়ের পাদদেশে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এ হচ্ছে পৃথিবীর উর্বরতম জায়গা, যেখানে বীজ পড়ার আগেই প্রাণের সঞ্চার ঘটে! এ হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে বিদেশিরা সহজে ঢুকতে পারে না; কিন্তু একবার গেলে আর ফিরতেও পারে না, যেখানে জায়নামাজে চড়ে নদী পেরিয়ে যান আউলিয়ারা; সেখানে এমন কিছু ঘটতে পারে বটে। এখনো!

‘কোথা থেকে এল ওই কণ্ঠস্বর! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে! কারা কথা বলছিল তখন!’ কূলকিনারা করে উঠতে পারে না ঝানু এজেন্ট

আর তাদের গুপ্তলিপি-বিশেষজ্ঞরা। তারা কেবল মাথা ঝাঁকায় আর বলে, ‘ও মাই গড, ক্যান ইউ বিলিভ ইট!’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরের বটগাছটাও একদিন কাটা পড়ল। আবার উদ্বাস্তু হয়ে পড়ল বিহঙ্গদ্বয়

ষাটের দশকের শেষের দিকে যে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় বাংলায়, তখন এই বটগাছও তার ছায়াদায়ী ভূমিকা রাখতে থাকে। আন্দোলনের দিনগুলোয় ওই বটগাছের নিচেই হতো ছাত্র সভা-সমাবেশ। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক আর কামান নিয়ে হামলে পড়ল নিরস্ত্র ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর, কামান দাগল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোয়, কাতারবন্দী করে হত্যা করল ছাত্রদের, ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর চালাল স্টেনগানের গুলি, বিছানা-বালিশ ভাসিয়ে দিল রক্তে, বস্তির পর বস্তি জ্বালিয়ে দিয়ে কালো রাতের আকাশ করে তুলল রক্তিমাভ, সেই দিনও ত্রিকালদর্শী ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ওই বটগাছের আশ্রয়টুকু ছেড়ে যায়নি।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকদের আক্রোশ গিয়ে পড়ল ওই বটগাছের ওপর। তারা মজুর জোগাড় করল অনেক কজন, ওরা একযোগে শুরু করল কুঠার চালনা। ব্যাঙ্গমা বলল, ‘কী মূর্খ! আর কী নিষ্ঠুর!’

ব্যাঙ্গমি বলল, ‘আর কী আক্রোশ! একটা নিরীহ বটগাছকেও ওরা বাঁচতে দিতে চায় না।’

ব্যাঙ্গমা বলল, ‘কুড়াল দিয়া কি আর বটগাছ কাটা যায়? আরে মূর্খ, ইলেকট্রিক করাত আন।’

তারপর এল ইলেকট্রিক করাত। বিপুল জিঘাংসা নিয়ে বটগাছের শরীরে ওরা চালাল করাত। গুঁড়ো গুঁড়ো হলুদ রক্তে ভেসে যেতে লাগল জায়গাটা।

একাত্তরের এপ্রিলের ৪ তারিখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ওই বটগাছের। তখনো চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন। জগন্নাথ হলের নিহত ছাত্রদের যে গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল, সে মাটি তখনো কাঁচা। মুহসীন হল গোলার আঘাতে আংশিক ধ্বস্ত। রমনার কালীবাড়ি মন্দির মিশে গেছে মাটির সঙ্গে।

বটগাছটা যখন হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল ডালপালাসমেত, তখন ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি উড়াল দিল আকাশে। উড়তে উড়তে তারা বলতে লাগল, ‘পাকিস্তানি শাসকরা ভাবতেছে, গায়ের জোরে ইতিহাসের গতি বদলায়া দেওন যায়, বন্দুকের নলের মুখে মানুষের দাবি রোধ করা যায়, বটগাছ কাইটা ফেললে ইতিহাস কাইটা ফেলা যায়। এইটা ভুল।’

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি গিয়ে বসল রমনা পার্কের অশ্বত্থ গাছটায়। এই গাছটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ইতিহাসে।

যখন বিশ শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালিদের বাধা দিতে লাগল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে আর রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনে, যখন শাড়িকে বলা হতে লাগল হিন্দুয়ানি পোশাক, কাফেরদের পোশাক, যখন আরবি-ফারসি কিংবা রোমান অক্ষরে বাংলা লেখার চেষ্টা চলতে লাগল, তখন এই অশ্বত্থতলে সমবেত হতে লাগল বাঙালিরা, প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে, বাংলা নববর্ষ পালনের উদ্দেশ্যে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষ-শিশু এই বিটপীতলে সমবেত হয়ে গেয়ে উঠল বর্ষবরণের গান : এসো হে বৈশাখ।

কাজেই জায়গাটা অপছন্দ হলো না ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির।

ব্যাঙ্গমা বলল, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটির হেড দারোয়ান জামালউদ্দীন ঠিক কাজটাই করছে। আবার একটা বটগাছের চারা নিয়া যত্ন কইরা লাগায়া দিছে আগের জায়গাতেই।’

ব্যাঙ্গমি বলল, ‘হ। ঠিকই করছে লোকটা। আর কী কইতেছে, শুনো। পানি দেয় আর কয়, আর তো শত্রু নাই। এইবার গাছ বড় হইলে আর কেউই কাটতে পারব না!’

‘হুম। কাটতে পারব না। দেশ স্বাধীন। পাকিস্তানি বাহিনী সারেন্ডার করছে। মুজিব ফিরা আইছে। তাজউদ্দীন তার হাতে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার বুঝায়া দিয়া কী শান্তি পাইছে! বলে, আজকে আমার সবচেয়ে সুখের দিন। সবচেয়ে শান্তির দিন। আমি চাইছি, নেতা পার্লামেন্টারি ফরম মাইনা নিক। উনি মাইনা নিছেন।’

‘আর ওই যে কইল, দেশের চাইতেও বেশি ভালোবাসি বঙ্গবন্ধুরে। সেইটা?’

‘সেইটা তো ঠিকই কইছে। ২৮ বছরের ভালোবাসা। ২৮ বছর আগে ১৯৪৪ সালে দুইজনের পরিচয়। একাত্তরে যুদ্ধের সময় একটা দারুণ কথা কইছিলেন তাজউদ্দীন। জয়বাংলা পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিয়া কইলেন, সেই চুয়াল্লিশ সালে পরিচয়। আমি মুজিব ভাইরে কোনো দিনও হারতে দেখি নাই। এইবারও ওনার জয় হইব।

সাতাশ বৎসর চিনি মুজিব ভাইরে।
পরাজিত হতে তারে আমি দেখি নাই রে ॥
এমনি বিশ্বাস ছিল তাজউদ্দীনের।
অমোঘ বন্ধন যেন অনন্ত দিনের ।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *