যারা বেঁচে ফেরেনি
‘হলোকাস্ট’ বললেই ফিরে ফিরে আসে কয়েকটা শব্দ। ইহুদি, নাৎসি, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, গ্যাস চেম্বার…
হলোকাস্ট এক বিভীষিকার সমনাম। এই শব্দের মানে হল আগুনে উৎসর্গ করা। প্রাচীন গ্রিসে দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য পশুকে আগুনে উৎসর্গ করা হত। ইহুদিদের কাছে হলোকাস্ট মানে ‘সোয়াহ’। বাংলা অর্থ ‘বিপর্যয়’।
কিন্তু বিপর্যয় কেন?
খ্রিস্টধর্ম শুরুর দিক থেকেই একটা প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যে, ইহুদিরাই যিশু খ্রিস্টের বিরোধী তথা হত্যাকারী।
কারণ কী?
এক, রাজা হেরড। হ্যাঁ, এই রাজাই শিশু যিশুকে হত্যা করার জন্য ছল, বল এবং কৌশলের সার্বিক প্রয়াস করেছিলেন। সফল হননি সে কথা অবশ্য আলাদা।
দুই, যে রোমান কর্তৃপক্ষ যিশুর ক্রুশিফিকেশনের জন্য দায়ী ছিলেন, তাঁরা ইহুদি ছিলেন বলেই জানা যায়।
এরপর থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক বা মহামারী সব ক্ষেত্রেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হত ‘ক্রাইস্ট কিলার’ ইহুদিদেরই। মোদ্দা কথা এই জাতিটাই হয়ে গিয়েছিল বলির পাঁঠা।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক পাঠক-বন্ধুরা। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব ঘটল। পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের ইহুদিদের সবার মতো সমান অধিকার দেওয়া হল। কিন্তু উনবিংশ শতকের পরে শিল্পায়নের খারাপ দিকগুলোর জন্য ইহুদিদের দায়ী করা হয়। গোটা ইহুদি জাতিকেই একটা সমস্যা হিসাবে দেখা হতে থাকে।
যুগে যুগে ইহুদিদের ওপর চরম অত্যাচার হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে। কখনো ক্রুসেডে, কখনো স্প্যানিশ আক্রমণের সময়ে, আবার কখনো হলোকাস্টে।
হলোকাস্টের কথা বলতে গেলে যে ব্যক্তির নাম না করলে এগোনোই যাবে না সে হল অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার মানেই ইহুদিদের ত্রাস। হিটলার মানেই ইহুদিদের যম।
কিন্তু এমন কী ঘটেছিল যার জন্য ইহুদি জাতিকে ধ্বংস করতে উঠে-পড়ে লাগল হিটলার?
দক্ষিণ জার্মানির অস্ট্রিয়া সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্রোনাউ গ্রামে হিটলারের জন্ম। বালক হিটলারের দারুণ ইচ্ছা ছিল ভিয়েনাতে আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার। দু’ বার চেষ্টা করেও সে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেই সময়ে আর্ট কলেজের শিক্ষকরা ছিলেন ইহুদি। ইতিহাসবিদেরা বলছেন, হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের সূত্রপাত সম্ভবত এখান থেকেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়। জার্মানিকে ভার্সাই-এর চুক্তি সাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের সীমা ও সৈন্যবাহিনীতে সেনার সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। শুধু কি এটুকুই? স্থির হয়েছিল যে, জার্মানি ক্ষতিপূরণ হিসাবে ফ্রান্সকে প্রতি বছর দেবে ৮০ লক্ষ পাউন্ড। এই চুক্তি জার্মানির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিয়েছিল।
১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় এল। জার্মান রাষ্ট্রপতি পল ভন হিন্ডেনবুর্গ হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর পদে বসালেন। আর হিটলার ক্ষমতায় এসেই শুরু করে দিল ইহুদিদের প্রতি বিষোদগার।
ঠিক কী বলেছিল হিটলার?
জার্মানির দুরবস্থার জন্য ইহুদিরাই দায়ী।
হিটলার জার্মানির সবকিছু হতে চেয়েছিল। তাই চ্যান্সেলর হওয়ায় পরপরই সে নতুন করে নির্বাচনের ডাক দেয়- যাতে জার্মান পার্লামেন্ট রাইখস্ট্যাগকে পুরোপুরি কবজা করতে পারে। অন্য পার্টির নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিরোধীদের সমস্ত মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাইখস্ট্যাগ বিল্ডিংয়ে আগুন লাগে। অনেকেই এই আগুনের জন্য নাৎসি পার্টিকেই দায়ী করে। নাৎসিরা অবশ্য বলেছিল, এই ঘটনা কমিউনিস্টদের কাজ। এই ঘটনার পর জার্মানির গণতন্ত্রের পতন ঘটে। রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকাণ্ডের পরের দিনই নাগরিকদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয় ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। ৫ মার্চের ভোটে ৪৪% ভোট পায় নাৎসি পার্টি। কনজারভেটিভদের সাহায্য নিয়ে তারা সরকার গঠন করে। ২৩ মার্চ আইন পাশ করে হিটলারকে ডিক্টেটরশিপ চালানোর বৈধতা দেওয়া হয়।
জার্মানিতে সিগমন্ড ফ্রয়েড, ম্যাক্সিম গোর্কি, আঁরি বারবুস, হাইনরিখ হাইনে, আইনস্টাইন, বের্টোল্ট ব্রেখট, টমাস মান, জ্যাক লন্ডনের বই নিষিদ্ধ ঘোষণা
করা হয়। এই সময় জার্মানির প্রথম সারির লেখক, বিজ্ঞানী ও শিল্পীরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। প্রাণ বাঁচাতে আইনস্টাইন ও ব্রেখটের মতো অনেকেই জার্মানি থেকে বেরিয়ে আসেন।
১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে গঠন করা হয় গেস্টাপো বাহিনী বা এসএস পুলিশ (সেক্রেট স্টেট পুলিশ)। ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এসএস বাহিনী যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পায়।
পুলিশবাহিনীর সাহায্যে হিটলার বিরোধীদের শাসাত, মারধোর করত, এমনকী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেও পাঠাত। মিউনিখের বাইরে ডাখাউ নামক স্থানে রাজনৈতিক বন্দিদের রাখার জন্য এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানানো হয়েছিল। পরবর্তীতে এরকম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো ইহুদিদের গণহত্যা বা মাস কিলিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৯৩৪ সালের শেষের দিকে হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করল। নাৎসিরা অভিযোগ তুলল যে, ইহুদিরা নাকি জার্মান জাতিকে কলুষিত করেছে। জিগির উঠল, ‘ইহুদিরা শয়তান! ওরা কাপুরুষ!’ জার্মানরা প্রোপাগান্ডা ছড়াতে আরম্ভ করে দিল যে তারা কর্মঠ, সাহসী ও সৎ।
সেই সময় জার্মানিতে প্রথম সারির সাংবাদিক, লেখক, অভিনেতা, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানীরা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন ইহুদি। খুব স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা হয়ে উঠলেন নাৎসিদের চক্ষুশূল।
এরপর এল হিটলারের ‘আর্য তত্ত্ব’। নাৎসিরা জোর গলায় প্রচার চালাতে থাকল যে, জার্মানরা হল আর্য। জার্মানরা হল শ্রেষ্ঠ। আর যেহেতু জার্মানরা উন্নত একটি জাতি তাই জার্মানিকে শাসন করবে একমাত্র জার্মানরাই। ডারউইনের তত্ত্বকে সামনে রেখে তারা বলতে আরম্ভ করল, শক্তিশালী জার্মানরাই একমাত্র টিকে থাকবে, আর দুর্বল ও মিশ্র ইহুদি নামক জাতিটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে ইহুদিরা সবসময় একটা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। ইহুদিদের লেখা সমস্ত বই পুড়িয়ে দিতে লাগল নাৎসিরা।
দেশের যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য হিটলার একটা নতুন পদক্ষেপ নিল। ইহুদিদের সরকারি চাকরি থেকে বিতাড়িত করে বেকার জার্মান যুবকদের নিয়োগ করা শুরু হল। ইহুদি আইনজীবীদের আদালতে প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। ইহুদি ডাক্তারদের হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দিল জার্মানরা। বন্ধ করা হল তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসও। স্কুল ও কলেজগুলো থেকে ইহুদি ছাত্র-ছাত্রীদের তাড়ানো হল। ইহুদিদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল জার্মান গভর্নমেন্ট। সমস্তরকম পাবলিক ইভেন্ট থেকে ইহুদিদের বহিষ্কার করল জার্মান সমাজ।
১৯৩৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ন্যুরেমবার্গ আইন পাশ করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে জার্মান সংস্কৃতি থেকেই ইহুদিদের বাদই দিয়ে দেওয়া হয়। অনেক দোকানে, হোটেলে সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেল— ‘কুকুর ও ইহুদিদের প্রবেশ নিষেধ।’ এভাবেই হিটলার নিরন্ন, বেকার ‘আর্য’ জার্মানদের চিন্তাশক্তিকে বিপথে চালিত করে তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে।
পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের হিন্দুদের বিতাড়ন মনে পড়ে কি?
সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষকে রাষ্ট্রশক্তি বাধা দেয়নি। সেইরকম ভাবেই সারা জার্মানির এই কর্মকাণ্ডকে হিটলার নীরবে অনুমোদন দিয়েছিল। আর হিটলার তা করেছিল কেবল ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে। আর এসবের ওপরে ছিল নাৎসিদের নৃশংস দমননীতি। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে হত্যা করা হত। ইহুদিদের এত দিনের প্রতিবেশী জার্মান পরিবার নির্লজ্জভাবে ইহুদিদের সম্পত্তি গ্রাস করতে আরম্ভ করে দিল। ঠিক যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষ বিতাড়িত হিন্দুদের জমি-বাড়ি আত্মসাৎ করে নিয়েছে কিংবা এই ভারতভূমিতেই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘরবাড়ির দখল নিয়েছিল সেখানকার সংখ্যাগুরুরা।
এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। সেই সময় জার্মানিতে দু’ থেকে আড়াই লক্ষ ইহুদি ছিল অত্যন্ত ধনী। ইহুদিরা জার্মানি ও পোল্যান্ডে বসবাস করছে স্মরণাতীত কাল থেকে। নিজেদের নিষ্ঠা, বিদ্যা ও বুদ্ধির দ্বারা তারা এই ধনসম্পদ সঞ্চয় করেছে। নাৎসিরা বুঝেছিল যে, ওদের খতম করতে পারলেই সব সম্পদ চলে যাবে তাদের হাতে। আর জার্মানির অর্থনীতির যা হাল ছিল, তাতে এই সম্পদের জন্য মরিয়া ছিল নাৎসি পার্টি।
ভয়ভীত ইহুদিদের পলায়ন আরম্ভ হল জার্মানি থেকে। কয়েক হাজার ইহুদি পালিয়ে গেল বেলজিয়াম, চেকোস্লোভাকিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও হল্যান্ডে। জার্মানির বাইরে বেরোনো কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। যা কাগজপত্র জোগাড় করতে হত, তাতেই লেগে যেত কয়েক মাস।
জার্মানির অন্দরমহলের এই খবর জানাজানি হতেই চাপানউতোর শুরু হয় বাইরের বিশ্বে। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সের এভিয়ান শহরে ৩২টি দেশের প্রতিনিধি সম্মিলিত হলেন জার্মানির নাৎসি পার্টির কারণে তৈরি হওয়া উদ্বাস্তু-সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য।
কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমাধান বেরোল না। আর ওদিকে হিটলারও বুঝে গিয়েছিল যে, ইহুদিদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই এবং ইহুদিদের নিকেশ করার পথ একদম মসৃণ। ১৯৪১ সালের মধ্যে ইউরোপের দেশগুলো ইহুদিদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ করে দেয়। খাঁচায় আটকানো ইঁদুরের মতোই অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদিদের। না পারছিল জার্মানিতে থাকতে, না পারছিল সেখান থেকে বেরোতে।
১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর প্যারিসে এক ইহুদি বালকের হাতে গুলিবিদ্ধ হন জার্মান দূতাবাসের কর্তা আর্নেস্ট ভম রথ। ৯ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়। আগুনে যেন ঘি পড়ল! জার্মানিতে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্র হিংসা ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। এরপর নাৎসি বাহিনী বার্লিন শহর ও অন্যত্র সুপরিকল্পিতভাবে ইহুদিদের ৭,৫০০টি দোকান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুঠপাট চালায়। ইহুদিদের ১০১টি উপাসনাস্থল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ৭৬টি উপাসনাস্থল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক ইহুদিকে হত্যা করা হয়। ৩০,০০০ ইহুদিকে গ্রেপ্তার করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সারা রাত ধরে এই ধ্বংসলীলা চলে। এই ধ্বংসলীলার পরে শহরের রাজপথে যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই ছড়িয়ে রয়েছিল শুধু ভাঙা কাচের টুকরো। এই ঘটনা বার্লিনের ইতিহাসে ‘আ নাইট অব ব্রোকেন গ্লাস’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করল। আরম্ভ হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময় পোল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় ১০% ছিল ইহুদি, সংখ্যায় প্রায় ৩০ লক্ষ। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা পোল্যান্ডের ইহুদিদের জন্য তৈরি করল ‘ঘেটো’।
এই ঘেটো জিনিসটা কী?
‘ঘেটো’ হল কাঁটাতার ঘেরা এমন এক একটা মহল্লা যেখানে গাদাগাদিভাবে ইহুদিদের থাকতে বাধ্য করা হত। ঘেটোর কোনো বাসিন্দা যদি জার্মান জাতির তথাকথিত আর্য পুণ্যভূমিতে আসতে চাইত, তবে তাকে ঘেটো কাউন্সিল জুডেনরাটের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হত। সারা দিনমানে বাইরে যে যেখানেই থাকুক না কেন সূর্যাস্তের আগেই ফিরে যেতে হত তাদের ঘেটোতে। এই ঘেটোগুলোতে না ছিল পর্যাপ্ত খাবার, না ছিল পান করার মতো জল কিংবা শৌচাগারের ব্যবস্থা। কত ইহুদি যে এই ঘেটোতে অনাহারেই মরেছে তার ইয়ত্তা নেই।
কিন্তু সব পাত্রের মতোই ঘেটোর ধারণ ক্ষমতাও তো ছিল নির্দিষ্ট। তাহলে ঘেটো উপচে পড়লে ইহুদিদের কী হত?
সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে নাৎসিরা তাদের পাঠিয়ে দিত ডেথ ক্যাম্পে। ডেথ ক্যাম্পের কথায় পরে আসছি সুধী পাঠক।
হিটলার চারটি ঘাতক দল তৈরি করে।
১. আইনজাটসগ্রুপেন এ
২. আইনজাটসগ্রুপেন বি
৩. আইনজাটসগ্রুপেন সি
৪. আইনজাটসগ্রুপেন ডি
প্রত্যেকটা দলে কয়েকটা করে কমান্ডো ইউনিট থাকত। এরা এক একটা শহর থেকে ইহুদিদের ধরে ধরে আনত। তারপর আগে থেকে খুঁড়ে রাখা গর্তের সামনে তাদেরকে বিবস্ত্র করে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে পরপর গুলি করে হত্যা করা হত। হত্যার পর তাদের সেই গর্তেই পুঁতে দেওয়া হত।
পোল্যান্ড আক্রমণের আগে হিটলার রাশিয়ান রাষ্ট্রনায়ক স্ট্যালিনের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করে। ১৯৪০ সালে জার্মানি পদানত করে ডেনমার্ককে। তারপরে তাদের আক্রমণের অভিমুখ হয় নরওয়ে। একে একে জার্মানি গিয়ে দখল করে নিল হল্যান্ড ও বেলজিয়াম। জার্মানির আক্রমণের মুখে পড়ল ফ্রান্স। হিটলারের দুর্ধর্ষ পানজার বাহিনীর হাতে ফ্রান্স পদানত হল ২২ জুন। এরপর হিটলারের নিশানায় এল ব্রিটেন। দীর্ঘ এক বছর ধরে যুদ্ধ চলার পরও হিটলার ব্রিটিশদের পরাজিত করতে পারল না। লন্ডনে নিরবচ্ছিন্ন কার্পেট বম্বিং করেও হিটলার চার্চিলকে নতজানু করতে পারেনি।
১৯৪১ সালের জুন মাস। অনাক্রমণ চুক্তিকে ছুড়ে ফেলে দিল হিটলার। আক্রমণ করল সোভিয়েত ইউনিয়নকে। ঐতিহাসিকরা একে হিটলারের চরমতম মূর্খতা বলে বর্ণনা করেন। রাশিয়া ভূমির শীতের প্রবল দাপটের কথা সম্ভবত হিটলার বুঝতে পারেনি।
সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মানির আক্রমণের পাশাপাশি আইনজাটসগ্রুপেন পূর্ব পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়াতে ইহুদি গণহত্যা চালাতে থাকে। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এরা প্রায় ১৩ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে।
১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি জার্মান সরকারের উচ্চ আধিকারিকরা বার্লিনের অদূরে ওয়ানসি নামক স্থানে একটা বৈঠক করে। এই বৈঠক করার জন্য ১৯৪১ সালের ৩১ জুলাই নাৎসি নেতা হারমান গোয়েরিং এসএস আধিকারিক রাইনহার্ড হেডরিখকে আদেশ দিয়েছিল। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ১৫ জন উচ্চপদস্থ নাৎসি আমলা, যাদের মধ্যে উপস্থিত ছিল রাইনহার্ড হেডরিখ ও অ্যাডলফ আইখম্যান। আইখম্যান ছিলেন রাইখ সেন্ট্রাল সিকিউরিটি অফিসের ‘চিফ অফ জিউস অ্যাফেয়ার্স’। এই ওয়ানসি কনফারেন্সে ইহুদিদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। আর এই পরিকল্পনা দেখাশোনার দায়িত্ব নিল হেনরিখ হিমলার।
১৯৪২ সালের মধ্যেই নাৎসিরা পোল্যান্ডে ছ’টা ডেথ ক্যাম্প তৈরি করে চেলমুনো, বেলজেক, সবিবর, ট্রেব্লিঙ্কা, মাজদানেক ও আউসভিৎস। সব ক’টা ডেথ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল রেললাইনের ধারে যাতে ইহুদিদের রোজ রেলগাড়ি বোঝাই করে আনা যায়। একটা নির্দিষ্ট বিন্দু পর্যন্ত ইহুদিদের পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে জড়ো হওয়া ইহুদিদের ঠেসে ঠেসে ঢোকানো হত মালগাড়ির কামরায়। যে বিন্দু অবধি আনার পর ইহুদিদের মাথাটাকা ক্যাটল-ওয়াগনে তোলা হত, তাকে জার্মানরা নিজেদের ভাষায় বলত ‘উমশ্লাগপলাজ’— যার অর্থ ‘কালেকশন পয়েন্ট’। দু-তিন দিন টানা চলত মালগাড়িগুলো। বিভীষিকাময় এই যাত্রায় অনেকেই দমবন্ধ হয়ে মারা যেত। আর যারা বেঁচে থাকত, তাদের পাঠানো হত গ্যাস চেম্বারে।
এই ক্যাম্পগুলোর মধ্যেও ভাগ ছিল। কিছু ছিল ইহুদিদের বেগার খাটানোর ক্যাম্প, কিছু ছিল ট্রানজিট ক্যাম্প; আর ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ও তার শাখা। তবে যতরকম ভাগই থাকুক না কেন, প্রত্যেকটি ক্যাম্পই ছিল নৃশংস। জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মূল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ছিল রাভেনসব্রুক, নয়ে গামে, বেরগেন-বেলসেন, জাকসেন-হাউসেন, গ্রসরোজেন, বুখেনভাল্ড, থেরেজিয়েনস্টাট, ফ্লোর্সেনবুর্গ, নাসভাইলার, দাখাউ, মাউটহাউজেন, টুটহফ ও নর্ডহাউসেন।
নাৎসিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সমস্ত দেশগুলির ইহুদিদের বাহুতে ধারণ করতে হত বিশেষ শনাক্তিকরণ চিহ্ন। হলুদ রঙের চওড়া ফেট্টি— তার মাঝখানে কালো কালিতে আঁকা আদি পুরুষ ডেভিডের ঢাল। দুটি সমবাহু ত্রিভুজ, একে অপরের গায়ে উলটো ভাবে চাপানো। স্ত্রী, পুরুষ, শিশু সব্বাইকে এই ফেট্টি পরতে হত যাতে দূর থেকেই ‘আর্য’ নাৎসি জার্মানরা বুঝতে পারে ওটা মানুষ নয়, জিউ বা ইহুদি!
নাৎসি শাসন তো কেবল জার্মানিতে আবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপে। একটা রোগের মতোই। তারা গড়ে তুলেছিল একটা সুবিশাল ক্রীতদাস-সাম্রাজ্য। বেগার খাটাত ইহুদিদের। খাটলে খিদেও যে পায়! খেতে চাইত ইহুদিরা, দুই হাত পেতে। ‘রুটি দাও! জল দাও!’ প্রার্থনায় মুখর হয়ে উঠত দাসভূমি।
বদলে কী মিলত?
জলের মতো পাতলা স্যুপ আর এক খণ্ড পাঁউরুটি।
ওতে কি আর খিদে মেটে? তৃষ্ণা কমে? তবুও, প্রাণরক্ষার জন্য খেতেই হত। জার্মানরা দুটো বিকল্প তুলে ধরেছিল ইহুদিদের সামনে—
১. হয় জার্মানির দ্বারা বিজিত ভূমির বাইরে পালাও অথবা
২. এখানেই থাকো। ক্রীতদাস হয়ে থাকো। আমৃত্যু!
প্রথম পন্থা বাছলে নিজের ভিটেমাটি, টাকাপয়সার মায়া ত্যাগ করে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো শুধু একটাই বস্তু— পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটুকু। এর অন্যথা করলে পাসপোর্ট পাবে না। লুকিয়ে কিছু নিয়ে পালাবার রাস্তাই ছিল না, শহরে সেসব জিনিস নাৎসিদের চোখ এড়িয়ে গেলেও সীমান্তের ছাঁকনিতে ধরা পড়তই।
আর যারা গেল না? দ্বিতীয় পথের লোকেরা? তাদের কী হল?
তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে আরম্ভ করে দিল গেস্টাপোর কুকুরেরা। নাৎসি পশুর দল সেই অভিযানগুলোকে বলত— অ্যাকটিয়ন। জিউদের গায়ে ছেড়ে দেওয়া হত পুলিশের কুকুর। চালানো হত বন্দুকের বাট। উফ! সে কী অত্যাচার বন্ধুরা! ভাষায় বর্ণনা দেওয়া কঠিন।
শুধু যে জিউদের পাড়ায় গেস্টাপোরা অ্যাকটিয়ন চালাত তা-ই নয়। এই অভিযান চলত ঘেটোতেও। হঠাৎ করে সশস্ত্র বাহিনী এসে ঘেটো থেকে কয়েকশো ইহুদিকে কোথায় যেন তুলে নিয়ে চলে যেত। যারা রয়ে যেত, তারা জিজ্ঞেস করত, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ওদের?’
বাহিনীর পক্ষ থেকে মুখ খোলা হত না। উত্তর দিত আধিকারিকেরা। এদের মধ্যে আবার কিছু বিশ্বাসঘাতক তথা নাৎসিদের পা-চাটা জিউও ছিল। তারা বলত, ‘পোল্যান্ডের পূর্ব দিকটাতে ইহুদিদের জন্য মহল্লা বসাচ্ছেন হিটলার।’
‘ইহুদিদের মহল্লা? শুধু ইহুদিদের? কেন?’
‘ওই যে, যার সন্ধানে হাজার হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে সিনাই পর্বতের দিকে রওনা দিয়েছিলেন আব্রাহাম, মোজেস— প্রমিসড ল্যান্ড অব জিউস!’
ধর্মপ্রাণ জিউদের মাথা নুউয়ে আসত এসব পবিত্র নাম শুনে। আশ্বস্ত চোখগুলো বুজে তারা বলত, ‘হিটলার তাহলে ভালোই করছেন। আমাদের হিল্লে হবে।’
কেউ কেউ বলত, ‘তা অমন গুঁতিয়ে, পিটিয়ে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার বাপু? ভালো করে বুঝিয়ে বললেই তো পারে। আমরা কি আর যাব না?’
নিয়ে যাওয়া হত বটে, কিন্তু তারা আর ফিরত না।
ডেথ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরে কী হত?
সেখানে তাদের হাতে একটা উলকিচিহ্ন এঁকে দেওয়া হত, যা আদপে ছিল একটা সংখ্যা। তারা নিজেদের নাম ভুলে গিয়ে এক একটা সংখ্যায় পরিণত হত। ডেথ ক্যাম্পে তাদের জামাকাপড় ও জিনিসপত্র সব কেড়ে নিত নাৎসি সৈন্যরা। ন্যাড়া করে দেওয়া হত মাথা। এসএস আধিকারিকেরা মাইকে ঘোষণা করত: ‘পাশের কক্ষে প্রবেশ করুন। আপনাদের কোনো ভয় নেই। কারো, কোনো ক্ষতি হবে না। ওই কক্ষে প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ হলে গভীর ভাবে শ্বাস নেবেন। এতে আপনাদের ফুসফুস পরিষ্কার হবে। বাড়বে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। যান, যান, ঢুকে পড়ন!’
প্রত্যেক ইহুদিই বুঝতে পারত কী ঘটতে চলেছে। কারণ ‘কক্ষ’ নামক গ্যাস চেম্বারের পাশেই বিশেষ চুল্লিতে নিহত ইহুদিদের পোড়াবার ব্যবস্থা থাকত। সেই ঘর থেকে চামড়াপোড়ার কটু গন্ধ এসে ঝাপটা দিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর নাকে-মুখে। কিন্তু নিয়তির লেখা কে খণ্ডাতে পারে? শেষে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হত। প্রায় ৩৫ লক্ষ ইহুদিকে এভাবে এই ডেথ ক্যাম্পগুলিতে হত্যা করা হয়েছিল।
কর্মক্ষম ইহুদিদের অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হত না। যুদ্ধের বাজারে তখন জার্মানদের প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। তাদেরকে জার্মানির অস্ত্র তথা অন্যান্য কারখানায় খাটাত নাৎসির দল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদেরকে দিয়ে আমানুষিক পরিশ্রম করানো হত। বিনিময়ে পর্যাপ্ত খাবার বা আশ্রয় কোনোটাই দেওয়া হত না। কয়েক হাজার ইহুদি অনাহারে ও অর্ধাহারে এই পরিশ্রমের ধকল সহ্য করতে না পেরে মারা যায়।
একদা রাশিয়ার শীতের কথা বুঝতে পারেননি নেপোলিয়ান। পোড়ামাটির নীতির সামনে নতজানু হতে হয়েছিল তাঁকে। আর হিটলার তো মন দিয়ে পড়াশোনা করেনি, তাই নেপোলিয়ানের এই ঐতিহাসিক ভুল সে জানতেও পারেনি। আগেই বলা হয়েছে প্রবল শৈত্য হারিয়ে দিয়েছিল হিটলারের বাহিনীকে। যুদ্ধের শেষের দিকে হিটলারের বাহিনী সোভিয়েত লাল ফৌজের কাছে পিছু হটতে থাকে। এবার নাৎসিদের টনক নড়ল। তারা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে, তাদের এই কুকীর্তিগুলো দুনিয়ার সামনে চলে এলে কী হতে পারে। তারা চাইছিল ইহুদিদের সমাধিগুলো যেন কোনো ভাবেই বাইরের দুনিয়া না দেখে। তারা সমাধি থেকে দেহগুলোকে বের করে আনে। তারপর সেগুলোকে আগুনে ভস্মীভূত করে। ডেথ ক্যাম্পগুলোকে মানচিত্র থেকে মুছে দেয়। তবুও শেষ রক্ষা হল না। ১৯৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি লাল ফৌজ আউসভিৎসকে মুক্ত করে। এই আউসভিৎস এত কুখ্যাত ছিল যে হলোকাস্ট আর আউসভিৎস প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী তখন জার্মান এসএস বাহিনী ও পুলিশের অত্যাচার চরম সীমা অতিক্রম করে। তারা বন্দিদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বাকি বন্দিদের তারা পশ্চিম দিকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদেরকে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। কয়েকশো মাইল পর্যন্ত হাঁটতে হত বন্দিদের। ধকল সহ্য করতে না পেরে অনেকে পথেই মারা পড়ে। যারা পালানোর চেষ্টা করে, এসএস বাহিনী তাদের কুকুরের মতো গুলি করে হত্যা করে। এই যাত্রা খুব স্বাভাবিকভাবেই ‘ডেথ মার্চ’ নামে পরিচিত হয়। পশ্চিমে তখন পর্যন্ত জার্মানির দখলে থাকা এলাকার ক্যাম্পে পৌঁছায় বেঁচে থাকা ইহুদিরা। এখানে পৌঁছানোর পরেও বহু বন্দি কেবল ধকল সইতে না পেরেই মারা যায়।
ডেথ ক্যাম্পগুলোকে ধীরে ধীরে মিত্রশক্তির বাহিনী মুক্ত করতে থাকে। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলার আত্মহত্যা করে। ওই বছরই মে মাসের গোড়ার দিকে জার্মানি আত্মসমর্পণ করল। বেঁচে থাকা ইহুদিদের জন্য তৈরি হয় ডিসপ্লেসড পার্সন্স ক্যাম্প। ইহুদিরা তখন এতটাই আতঙ্কিত যে কেউই আর নিজেদের বাড়িতে ফিরতে রাজি হয়নি। ইহুদিবিদ্বেষী প্রতিবেশীদের ভয়ে তারা ওমুখো হতে নারাজ ছিল। তারা ওই ক্যাম্পেই দিন কাটাতে থাকে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হবার পর তারা ধীরে ধীরে সেখানে চলে যায়। এভাবে শেষ ক্যাম্পটি বন্ধ হয় ১৯৫৭ সালে।
একদা জার্মানির অধীনস্থ এই দেশগুলোতে ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছিল—- আলবানিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেকোস্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, গ্রিস, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরী, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড ও রোমানিয়া। জার্মানি, জার্মানির অধীনে থাকা দেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলিয়ে মোট ৬২,৫৮,৬৭৩ জন ইহুদিকে হত্যা করা হয় বলে একটা আন্দাজ পাওয়া গেছে। এই সংখ্যাটি কিন্তু আনুমানিক। কারণ বহু হত্যার কোনো নথিই নেই এবং তাদের দেহও উদ্ধার হয়নি। তাই মৃতদের সঠিক সংখ্যা আর কোনোদিনই জানতে পারা যাবে না।
যুদ্ধ শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স নাৎসিদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। রাষ্ট্রসংঘের ১৯টি প্রধান দেশ এই উদ্যোগকে সমর্থন করে। জার্মানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ন্যুরেমবার্গের ঐতিহ্যমণ্ডিত বিচারালয় ভবনে বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে। এই বিচার ‘ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল’ হিসাবে পরিচিত এবং সেটাও নজির তৈরি করেছে।
জার্মানির নাৎসি দলের এবং সরকারের ২২ জন কর্মকর্তার বিচার শুরু হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি ছিল—
১) সমস্ত ধরনের অপরাধে জড়িত থাকা
২) শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ৩) যুদ্ধাপরাধ
৪) মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
১৯৪৬ সালের ১৬ অক্টোবর রায় ঘোষণা করা হয়। ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
আলাদা করে বলার মতো বিষয় হল ১৯৬১ সালে অ্যাডলফ আইখম্যানের বিচার হয় জেরুসালেমে। আর্জেন্টিনাতে বসবাসরত অবস্থায় ইসরায়েলি সিক্রেট এজেন্টরা তাকে অপহরণ করে জেরুসালেমে নিয়ে যায়। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। আর এই বিচার চলাকালীনই গোটা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় হলোকাস্ট।
ইউনাইটেড নেশন ২৭ জানুয়ারিকে ‘হলোকাস্ট মেমোরিয়াল ডে’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসরায়েল হলোকাস্ট ভিকটিমদের স্মৃতিরক্ষার্থে তৈরি করেছে ‘য়াদ ভাসেম’।
পৃথিবীতে গণহত্যার বিষয় নতুন কিছু নয়। কিন্তু একটা জাতিকে পুরোপুরি পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়ার এই পৈশাচিক প্রয়াস সম্ভবত আগে কখনো হয়নি আর ভবিষ্যতেও হয়তো হবে না। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ ইহুদি চিরতরে হারিয়ে গেছে এই নারকীয় হত্যালীলায়। ইতিহাসে হলোকাস্ট এক কলঙ্কিত অধ্যায়। হলোকাস্টের দোষীদের আদালতে শাস্তি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানবজাতি কখনোই তাদের ক্ষমা করতে পারবে না। আর ইসরায়েলিরা তাদের ভুলবে না। কারণ তারা বলে, ‘আমরা কক্ষনো ভুলি না!’