যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল – প্রথম ভাগ

প্রথম ভাগ

সে বড় নিকটকথা যা বর্ণনা করি—
কিছু বলব ধীরে আস্তে, কিছু তড়িঘড়ি
কিছুটা অতীতে ঘটল, কিছু বা এক্ষুণি
কিছু তার চোখে দেখা কিছু কর্ণে শুনি
কিছু তার মেঘে রইল কিছু বৃষ্টিপাতে
ধুয়ে মুছে মনে আসছে দিবসে ও রাতে
কাক-পক্ষী মুখে করে নিয়ে গেল কিছু
কিছু উড়ল কুটো হয়ে বাতাসের পিছু
কথাখানি উড়ে গিয়ে যথা তথা পড়ে
শুনে কেউ মুগ্ধ কেউ চক্ষু বড় করে
দু’আনি চারআনি দিয়ে কথা শুনতে হয়
এ কথা তেমন কথা নয় মহাশয়
এ অতি নিকটকথা বুকে মারবে ছুরি
কথাখানি সত্য কিন্তু বলাটি চাতুরি
বনে-উপবনে নিত্য কত মেয়ে ঘোরে
বলো তো একজন কাউকে নির্বাচন ক’রে
সে বড় কঠিন কর্ম, সে বড় মুশকিল
লাগে যন্ত্রপাতি লাগে লেবারের স্কিল
একদিন এক দেবী বৃক্ষে দিয়ে ঠেস
বলে বসল: মন খারাপ আপনার অভ্যেস
তুমি চমকে গেছ তুমি অতটা ভাবনি
মনে উঠছে বারংবার চমৎকার ধ্বনি
তখন শীতের হাওয়া শিরীষ শাখায়
বাসটি দাঁড়িয়ে, ফুটো বাসের চাকায়
একসঙ্গে যাওয়া ছিল রাঙামাটিগড়
সেখানে দু’চার বাক্য—আলাপের পর
সারাতে সময় লাগবে, শীতের দুপুরে
অন্যরা বলেছে: আসছি কাছাকাছি ঘুরে
তুমি থেকে গেলে যেতে চাইছিল না মন
দলে হ’ল অনিচ্ছুক আরও একজন
সে খুলে রেখেছে শাল, মুখে পড়ছে চুল
গুঁড়ো টিপ ঝরছে, কানে পোড়ামাটিদুল
গলায় চিকচিকে হার, সালোয়ার কামিজ
মুঠোভর্তি বুক, আঃ থামো বেতমিজ!
এক পা মুড়েছে দেবী গাছে পিঠ রেখে
মনে ভাবছ আগে কোথা দেখেছি কি একে?
হ্যাঁ দেখেছ না দেখনি কত জায়গায়
যেতে কাঁটা আসতে কাঁটা অঙ্গ ছড়ে যায়
আঘাতে ঔষধ দিতে চক্ষে দিতে ধুলো
পিসিমা গজগজ করতো: ঢঙ্গী মেয়েগুলো
—‘তোমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই কোনো’
মুখে বলতে, মনে জানতে, যাবে না লুকোনো
এখনো গেল না, যেই দেবী বললেন
‘কাল বাইরে অত রাত্রে কী করছিলেন’
তুমি থতমত: ‘আমি, কাল,… বাইরে… মানে…’
—‘হ্যাঁ বাইরে। ঠাণ্ডার মধ্যে। সুপর্ণাও জানে—’
—‘এক্ষেত্রে, সুপর্ণা… মানে… আসলে… আমি তো’
—‘রাত্রে ও দেখেনি, ও তো ঘুমোলেই মৃত!
আজ ভোরে বেরিয়ে দেখল রাস্তায় মাফলার
টুরিস্ট লজের সামনে, এই যে! এটা কার?’
—‘হ্যাঁ আমার। ধন্যবাদ। চিনলেন কী করে?’
—‘এমন ক্যাটকেটে রং কটা লোক পরে?
সুপর্ণা চিনেছে, বলল, মরবে ভদ্রলোক
ঠাণ্ডায় বেঘোরে মরবে। দিয়ে দিস্—যা হোক
কী করছিলেন কালকে? রাত্রি একটায়?’
—‘একটা হয়ে গিস্‌ল বুঝি? তবে তো অন্যায়’
—‘বলুন কী করছিলেন?’ —দেবী চেয়ে আছে
নাকে ঘাম, আবছা তিল চিবুকের কাছে
—‘গাছ ছুঁয়ে দেখছিলাম। রাস্তার দু’ধারে
ওই গাছগুলো, ওরা ছোঁয়া বুঝতে পারে?’
—‘রাত্রে গাছ ধরতে নেই, পোকাটোকা থাকে—’
—‘ওরা লোক চেনে, কিছু বলবে না আমাকে’
—‘গাছ ছুঁতে ইচ্ছে করে?’ —‘ইচ্ছে তো করেই’
—‘আপনার বুঝি কোনো গাছবন্ধু নেই?’
—‘ওই যে সুপর্ণা আছে! গাছ বললে গাছ
মাছ বললে মাছ আমরা, নাচ বললে নাচ
জল পেলে সাঁতার কাটি গান পেলেই নাচি
কোথাও হইহই পেলে ঠিক আমরা আছি
হুড়ুদ্দুম লেগে যায় ছুটিছাটা পেলে
আমরা বেরিয়ে পড়ি বাড়িঘর ফেলে
আমি ও সুপর্ণা কিংবা সুপর্ণা ও আমি
কলেজে সবার চেয়ে দ্রুত, দ্রুতগামী।’
এত বলে থামলেন দেবী অবশেষে
বসলেন তোমার পাশে বৃক্ষপাদদেশে
—‘আপনাকে দেখলাম কাল বারান্দার থেকে
দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে, গেটে হাত রেখে
—অত রাত্রে? বারান্দায়?’ —‘আসছিল না ঘুম
ভাবলাম বেরোই’… —(না না এস না কুসুম!)
ওই যে ওরা এসে গেছে, আমাদের দল
গাছের ফাঁক দিয়ে উঁচুনিচু কোলাহল
একথা সেকথা চলতে বাস তুমি রেডি?
তাহলে ছাড়বার কথা এখনই বলে দি’?
দেবী উঠে গিয়ে বসে সুপর্ণার পাশে
এদের সখীত্ব দেখে কিছু মনে আসে?
সে অতি নিকট, অতি নৈকট্যকথন
সে ধর্মের কথা নাহি ভোলে চোরামন
দেবীসঙ্গ সাঙ্গ হয় ফেরৎ রাস্তায়
ঠিকানাটি কিছু কাল সঙ্গে থেকে যায়
তারপর তেড়েফুঁড়ে দিন যায় ছুটে
ঝাঁকায় জীবন, নিচে ব্যর্থ ঝাঁকামুটে
সকল বন্ধুত্ব বলা সে বড় দুষ্কর
দু’একখানা বলি, বাকি অনুমান কর
বারেক পাই যদি তার শ্রীআন্দাজখানি
ফাঁক দিয়ে দেখা দৃশ্য মুখেও না আনি
ওলটপালট করে কারা ওরা-কারা?
আগে থেকে অত কিছু জানতো না বেচারা
লেখাটি বেরিয়ে পড়ে গল্পের সন্ধানে
কাহিনী কোনখানে যায় চরিত্র কি জানে?
তোমার চরিত্র দেখছি ওঠে বেলা করে
উঠেই বাজারে যায় গলিরাস্তা ধরে
উপকণ্ঠ শহরের বাড়ি ছোট ছোট
গলি থেকে দরজায় তিন সিঁড়ি ওঠো
একআধটু বাগান কারো, দু’তিন জানালা
‘টু লেট’ ঝোলানো কারো, দরজায় তালা
সামনেই মেজ রাস্তা, কাছে রিকসা থামে
বড়টি শহরে গেছে, ছোট রাস্তা গ্রামে
দূরে উঁচু রেললাইন, ফোকর তলায়
ঠ্যালা রিক্সা ম্যাটাডোর কোনোক্রমে যায়
এইটুকু পরিপার্শ্বে ঘোরে চরিত্রটি
ঘটনা, সামান্য জল, ডুবছেই না ঘটি
যতটুকু ডোবে তাতে, —দক্ষিণপবন,
মরা শক্ত নয়, —মৃত্যু? বান্ধবীর বোন
অবশ্য বান্ধবী বলতে বোঝে যা সকলে
এ পাত্র পাত্রীকে আমরা নেবো না সে-দলে—
যেতো মাস্টারের বাড়ি সেই ক্লাস টেন-এ
তখনই যা চেনাশোনা, তুইতোকারি মেনে
এখন শ্বশুরঘরে, মাঝে মাঝে আসে
বোনও এসে ঘুরে যায় দিদির সকাশে
ওরা সহোদরা নয়, মাসিপিসিতুতো
পাশাপাশি খেতো আর পাশাপাশি শুতো
ওরা নরনারীজোড়া, বলে প্রতিবেশী
চরিত্র বলেনি কথা দু’দিনের বেশী
মাঝে মাঝে আসতে যেতে বাজারে রাস্তায়
ভগ্নিটি বেড়াতে এলে চোখে পড়ে যায়
চোখে পড়ে বালি আর চোখে পড়ে কুটো
বহিনজি, এমন কাণ্ড দেখেছ কি দুটো?
সেই কাণ্ডকারখানা থাক আপাতত
কাজের কথায় আসতে দেরী হচ্ছে কতো
চরিত্র কী করে বলো? ইস্কুল শিক্ষক
বয়স? তা কত হবে, পঁয়তিরিশই হোক
বাড়িতে কে আছে? এক পিসিমা ও দিদি
দু’জনের কারও কিন্তু বিয়ে দেয়নি বিধি
দিদি সাতবছর বড়। তার হিস্ট্রি আছে
দশ ক্লাসে পড়ত সুধামাস্টারের কাছে
কে সুধামাস্টার? আসত কাঁকিনাড়া থেকে
দিদিকে পড়াতে বসত সন্ধে ছ’টা থেকে
দুপুরে ইস্কুল ক’রে—বিকেলে কোচিং—
ছ’টা বাজতে পাঁচে রিক্সা কিড়িং কিড়িং
ছুটে ছুটে ধরত রাত ন’টার লোকাল
হপ্তায় তিনদিন, তবু ফের আসত কাল
বড় চাকরি পেয়ে গেল কলকাতা শহরে
তা-ও আসা যাওয়া মাসে এক আধবার ক’রে
দিদিকে দেয়নি বাবা তিলমাত্র বাধা
দিদিও ‘স্যার’ বলা ছেড়ে বলেছে: সুধাদা।
চিঠি লিখত বি.এ ক্লাস পড়ুয়া দিদিকে
দিদিও তাকিয়ে থাকত পিওনের দিকে
শেষে খেলা সাঙ্গ হল, যোগ হল ক্ষীণ
বিয়ে করল অফিসেরই মেয়েকে একদিন
পাড়ার সবাই জানত, এই রিস্তা পাকা
পরে সব বলতে লাগল: টাকা, ভাই টাকা
চাকরি করা মেয়ে পাচ্ছে, ঠিক থাকে মেজাজ?
ও ব্যাটা লম্পট, লোভী, মহা ফেরেববাজ
কথা ঘুরল শহরের এ গলি সে গলি
মেয়েটা খারাপ, নইলে অত ঢলাঢলি!
দিদি কিন্তু ভাঙল না, মুছলও না চোখ
যেমন কে তেমনই রইল, যা হবার হোক!
মা-কে এটা দেখতে হয়নি, গেছে শিশুকালে
পিসিমা গজগজ করল: এ-ও ছিল কপালে
বাবা বলল, অপমান, অপমান এটা
এত বড় ভুল করল আমার মেয়েটা?
কীসের কী ভুল? দিদি বলেনি সে কথা
বি.এ পাস ছিল, হ’ল এম.এ পাঠরতা
চার পাঁচ স্টেশন দূরে ইউনিভার্সিটি
নির্জন সড়ক, পাশে দেবদারুবীথি
দিদিটি সেখানে যাওয়া শুরু করল আর
চরিত্র ম্যাট্রিক দিল তার পরের বার
ম্যাট্রিক? সে কী হে? —আহা, হায়ার সেকেন্ডারি
এত দোষ ধরলে বলা ভারি ঝকমারি!
যা হোক, বাবা তো ক্ষিপ্ত, কী করি তা’ দেখ
সম্বন্ধ আনতে লাগল একের পর এক
দিদি বলল, না। আর ‘না’-মানে যে ‘না’-ই
সে কথা বোঝবার জন্যে শক্ত কলজে চাই
সবার থাকে না। যেম্নি ছিল না বাবার
—‘জায়গা পায়নি এত জেদ দেখাবার।’
পিসিমা দিদিকে চিনত, ঘেঁসেনি কাছেও
দেয়ালকে শোনাতে লাগল: কী ভেবেছে ও?
দিদির আশ্চর্য নেই, তাপ-উত্তাপও নেই
সে রইল নিজের কাজে নিজের মনেই
কিছুদিন কাটল নানা তর্জনগর্জনে
শেষে ধীরেধীরে বাবা ক্ষান্ত দিল রণে
দিনগুলি যেতে লাগল দিনের নিয়মে
রাগ শান্ত হয়, শোক মরে আসে ক্রমে
একদিন কাজ থেকে ফিরে সন্ধেবেলা
চা নিয়ে বসেছে বাবা, ভূতে মারল ঢেলা
হঠাৎ কী হ’ল, উঠল ছিটকে-ছটফটিয়ে
কাশল, জল খেল, দেখি রক্ত নাক দিয়ে
বমি করল দু’চারবার, গড়াল মেঝেতে
সময় লাগল না বেশী হাসপাতাল যেতে
মুখ বেঁকে গেল আর উলটে গেল চোখ
ডাক্তার কপাল মুছল: সেরিব্রাল স্ট্রোক
সবাই হুতাশে বলল: কী-বা করবি আর?
সময় দিলো না মোটে চিকিৎসা করার
সমস্ত চোখের সামনে ঘটল আমাদেরই
তখনও রিটায়ার করতে এক বছর দেরী
চরিত্রেরও দেরী ছিল ফাইনাল দিতে
পড়া ছেড়ে দিদি ঢুকল বাবার চাকরিতে
সেই থেকে দিদি করছে ডেলি প্যাসেঞ্জারি
চরিত্র পাসটাস করে জোটাল মাস্টারি
সেই থেকে এ বাড়িরও নিরিবিলি কাটে
গড্ডলিকা, কলরোল হেথা নাহি খাটে
এ বাড়িতে গরু আছে, বেড়াল আছে ক’টি
গাছ আছে কিছু, আহা, যেন পঞ্চবটী
পিসিমা ভোরবেলা উঠে ধেনুটি দোহান
দু’বাড়িতে দুধ দিতে গুটিগুটি যান
ভাইবোন ওঠার আগে দুধ দেওয়া সারা
‘তুমি এসব করবে কেন?’: বলে থাকে তারা
পিসিমার মত: ‘কেন, আপত্তি কী এতে?
কতো আর পরিশ্রম এইটুকু যেতে?
তোদের তো বেশি বেশি, শ্রীহরি শ্রীহরি
পড়শিরা নিজেই আসত, আমি মানা করি।’
এর বেশি কিছু বলা যায়নি পিসিমাকে
যে যার নিজের মতো এ বাড়িতে থাকে
দিদিকে বিয়ের কথা বলার ক্ষমতা
কারও হয়নি, পিসিমাও মেনেছে বশ্যতা
কেবল গজগজ করে: ‘দ্যাখ্‌ হাতে গুনে
এমন ভুতের বাড়ি ক’টা এ টাউনে
আমি মরলে বাড়ি হবে আরও নিরিবিলি
সেইদিন বুঝতে পারবি, কার রাজ্যে ছিলি’
এসব বাক্যের লক্ষ চরিত্রটি বোঝে
শুনেছে লুকিয়ে পিসি তার পাত্রী খোঁজে
চরিত্র সে পাত্র নয়, আছে অন্য শখ
সে কেবল হতে চায় শ্রীকাব্যলেখক
শহরে বন্দরে একটু আছে নামধাম
বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা: দিদিকে দিলাম
বই আছে? দু’চারখানা। পত্রিকারা ছাপে
এই বয়সে বিয়ে করতে যাবে কোন পাপে!
সে কী হে? কাব্যের লোক, প্রেম ছাড়া হয়?
নারে ভাই, এর আবার মেয়ে দেখলে ভয়!
কী ব্যাপার, এরও কোনো হিস্ট্রি আছে তবে?
আজ নয় কাল থেকে হিস্ট্রি শুরু হবে
আমি সে-কালের কথা সেই ইতিহাস
বলব বলে এত পংক্তি চিবাইলাম ঘাস
এইবার বলো সেই কাল কোথা পাই
তা ধরো পঁচাশি সাল আঠারো জুলাই
দশ বছর দূর থেকে যা যা দেখা যায়
তাই দিয়ে শুরু করছি পরের অধ্যায়

একটি ফাঁকা স্টেশন, এক কোণে
দু’ জন বসে, তাদের এক জনের
উস্কো চুল, পার্শ্বে রাখা ঝোলা
পাঞ্জাবির বোতামদ্বয় খোলা
কেবলই হাত চালায় রুখু চুলে
মাঝে মাঝেই কাগজপাতি খুলে
কী সব লেখে, কী করে কাটাকুটি
সামনে দিয়ে হকার গেলে দু’টি
বন্ধু বলে ‘ক’টায় ট্রেন আছে?’
‘আপে যাবেন?’ —‘ডাউন’—‘দু’টো পাঁচে’
‘তাহলে দেরী নেই’: বলেই ঘুরে
সে দেখে দু’টো কাগজ গেল উড়ে
দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে নেয়, আর
ধমক দেয়: ‘তোমাকে কতবার
বলেছি কতো করেছি সাবধান
কী দরকার এত কারেকশান
যেখানে পাও সেখানে যাও বসে
হারালে এটা হারাতো কার দোষে?’
উস্কোচুল যুবক তার জ্ঞান ফেরৎ আসে
হাত বাড়িয়ে কাগজ নেয় দোষীর মতো হাসে
‘কী জানো ওই দুটো লাইন মনের মতো নয়
বদ্‌লে নিচ্ছিলাম যদি আজ পড়তে হয়’
বন্ধু ফের ধমক দেয়: ‘ওইটা ছাড়া কোনও
লেখা কি নেই পড়ার মতো?’ — ‘রেগে যেও না, শোনো,
নতুন লেখা পড়তে গেলে একটু তো ভয় হয়’
—‘ইচ্ছে তোমার ষোল আনাই থাকে, কি তাই নয়?
ভয় করে তো পড়বে না ব্যাস, চুকেছে ঝঞ্ঝাট
তা নয় এই রাস্তাঘাটে কাগজপত্র হাট!
তোমার জিনিস তুমি বুঝবে, আমি বলছিলাম
হারিয়ে গেলে বলবে তো ইস্‌ হারিয়ে ফেললাম
ওই নিয়ে তো ভাবতে ভাবতে অবস্থা সঙ্গীন
হারানো এক লেখার শোকে গুমরোবে সাতদিন’…
এই বন্ধু রোগা লম্বা, চারমিনার খায়
মাথার চুল কুঁচিয়ে ছাটা, হাফহাতা শার্ট গা’য়
লেখকের সে বন্ধু ঠিকই কিন্তু লেখে না সে
একটু সময় সুযোগ পেলেই কবির কাছে আসে
—‘আসলে ঠিক ভয় না জানো, আছি বরং দ্বিধায়
কে কী বলবে আজকে’—‘কেন তোমার তাতে কী দায়?
লেখা পড়বে লেখা শুনবে, আর যা সব বাকি
সভায় পড়ে থাক না, ভাবার দরকারই বা কি?’
—‘একদিকে তো ঠিকই বলছ’ (কাব্যলেখক বলে)
‘কিন্তু লোকে কী বলছে তা না শুনলে কী চলে?
নিজের কোথায় ভুল হচ্ছে তা নিজেই ধরা যাবে
এমন তো নয়, বরং সেটা অন্যরা বোঝাবে!
এছাড়া আর শেখার উপায় কী আছে? অন্যরা
দেখতে পাবে ঠিক রেসটায় ছুটছে কি না ঘোড়া’
—‘রেসের ঘোড়া? দৌড়? উহুঃ, ঠিকঠিক হল না
ঘোড়ার সঙ্গে রেসের সঙ্গে লেখার কী তুলনা?
তুমি লিখবে তোমার কথা, সেও লিখবে তার
এর মধ্যে ছুটোছুটির এত কী দরকার’
—‘না, ধরো, এই, শব্দ’—হঠাৎ তাল গিয়েছে কেটে
মাইক বলছে ট্রেন আসছে তিরিশ মিনিট লেটে
তর্ক ভাঙলো মধ্যিখানে, কী করা যায় তবে
কবি বলল ‘জায়গা খুঁজে হিসি করতে হবে’
দু’ দশ কদম এগিয়ে দেখে ঠিক উলটো দিকে
একটি লোক দাঁড়িয়ে, ভিড় ঘিরেছে লোকটিকে
শুকিয়ে যাওয়া মুখখানা তার, চুপসে যাওয়া গাল
গর্তে ঢুকে গিয়েছে চোখ, ভাঁজপড়া কপাল
ইস্ত্রি ছাড়া পাজামা শার্ট হাওয়াই চপ্পল
শর্ট হাইটের লোকটা, হাতে গেলাসভরা জল
পায়ের কাছে কাঁচের বোয়াম, জলভরা মুখ ঢাকা
তার ভেতরে দু’ তিনটে মাছ, আর একটা ব্যাঙ রাখা
বন্ধু থেমে পড়ল, ‘দাঁড়াও একটু দেখে যাই’
বয়ামঅলা বলে উঠল: ‘তালি লাগাও ভাই’
লোকটি শুরু করল হাত মুখের কাছে রেখে
‘যাতায়াতের পথে দাদা আপনারা যান দেখে
এই ব্যাঙ এই মাছকে আমি জ্যান্ত গিলব আর
আপনাদেরই চোখের সামনে ওগরাবো আবার
এই বলে সেই বয়াম উঁচু করে সে আলগোছে
মাছ ব্যাঙ সব গিলে ফেলে হাতায় মুখ মোছে
এবার সে লোক জামা খুললো, কুঁচকে ধরল পেট
সমস্ত জল উগরে দিল মাছব্যাঙ সমেত
লোকটা এবার হাঁপিয়ে গেছে মুখ ভিজেছে ঘামে
বলল ‘আমি খেলা দেখাই কোম্পানির নামে
আমার কাছে বিশুদ্ধ সব গাছগাছড়া দিয়ে
তৈরি ওষুধ পাবেন, এই যে, দেখুন একটা নিয়ে
অম্বল বুকজ্বালা ঢেঁকুর ঘুম হয় না রাতে
পেটের সকল প্রবলেমে ফল পাবেন হাতে হাতে
এক শিশি এক টাকায় পাবেন নিয়েই দেখুন না’
—‘ট্রেন আসছে ট্রেন আসছে, এই মুন্না, মুন্না’—
কে যেন কোন মুন্নাকে ডাক দিল, ভিড়ের লোকে
তাকিয়ে দেখে দু’ নম্বরে ডাউনট্রেন ঢোকে
সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে সব কামরায় কামরায়
উঠতে লাগল: দেখি কোথায় জায়গা পাওয়া যায়
বন্ধু বলল: লেট হলো খুব, পৌনে তিনটে বাজে
কবি বলেন: কিন্তু আমার হিসিই হলো না যে
‘হবে অখন’, বন্ধু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘সব ব্যাপারে যখন খুশী তাড়া করলে চলে?
তখন সেরে নিলেই পারতে, অত সময় পেলে’
ইনি বলেন, ‘তুমিই তো ওই খেলা দেখতে গেলে’
‘আমার তো আর পায়নি রে ভাই আমি যেতেই পারি
নিজেরটা তো বুঝবে, কখন কোনটা দরকারী?’
খেলার কথা ভেবেই তো এঁর গা গুলিয়ে ওঠে
সত্যি শুধু আমার সামনে এসব এসে জোটে
তখন কিছু মনে হয়নি, এখন গা পাকায়
ব্যাঙ গিলে ওই লোকটা রোজ কটা পয়সা পায়?
এইতো সবাই উঠে পড়ল যা দেখার তা দেখে
কিনল না কেউ। লোকটাকে কী আবার প্রথম থেকে
শুরু করতে হবে এখন? ওসব জিনিস ফের
গিলতে হবে? আবার মাথা ঘুরল চরিত্রের।
দুপুরবেলার ট্রেন বলে ঠিক ভিড় নেই তেমন
চরিত্রটি দরজা ধরে। ‘সামনে কী স্টেশন?’
বন্ধু শুধোয় জিনিসপত্র গুছোনো যাত্রীকে
‘পূর্বপাড়া’: বলেই যাত্রী মালপত্রের দিকে
মন দেয় ফের। বন্ধু বলে, ‘সামনের স্টেশনে
জায়গা হবে, এগিয়ে এসো’,—চরিত্রটি শোনে
অর্ধমনে, বাকি অর্ধ রেলপথে লুটায়
ব্যাঙ গিলে ওই লোকটা করে ক’পয়সা উপায়?
কী সাংঘাতিক জীবিকা সব, কী ভাবে লোক বাঁচে
এসব লেখার শক্তিসাহস আছে, তোমার আছে?
পারবে? পারবে? —ট্রেনের চাকা বারবার জিজ্ঞাসে
চরিত্রটি কলকাতা যায় কবি হবার আশে
এই পেরোলো মাঝের পাড়া, এরপর পিলখানা
লোকাল এবার গ্যালপ করছে, আর দাঁড়ানো মানা
বন্ধু ঢুলছে জায়গা পেয়ে, চরিত্র দরজায়
ছিটকে ছিটকে ইলেকট্রিকের স্তম্ভ সরে যায়
বর্ষাকালের দুপুর ঢলে, মেঘে নরম রঙ
ওরা কোথায় যাচ্ছে এবার জেনে নিই বরং
মাঝে মাঝেই শহরে খুব সাহিত্যপাঠ হয়
নতুন লেখা নতুন কবি আলাপ পরিচয়
কেউ পড়ে, কেউ মত বাতলায়, কেউ নেয় ঠিকানা
কোথায় থাকেন আপনি? আছে কোথায় চেনাজানা?
আজ তেমনি ঘরোয়া এক কবি সম্মেলন
দু’ তিনজন পড়বে, শ্রোতা পঁচিশতিরিশ জন
দু’ তিনজনের একটি হলেন আমাদের এই ইনি
‘জীবনে এই প্রথম, আগে কোথাও যা-ই নি’
প্রথম? সেকী? ইনি-ই দেবেন কাব্যগাছে মই?
ইনিই আবার হুঁ হাঁ মতন, পারেন না হইচই
অনেক আগু অনেক পিছু অনেক সাতেপাঁচে
ঠেকতে ঠেকতে দেখলাম যে সম্মতিটি আছে
যা হোক এই প্রথম বলে নতুন লেখা সব
পড়তে হবে, বুকের মধ্যে ঢিবঢিবঢিব রব
তাই না অত কাটাকুটি, ভ্রম সংশোধন
পাঠের কথা ভেবে এবার চাঙ্গা হচ্ছে মন
ট্রেন ঢুকছে টার্মিনাসে, বন্ধু আড়ামোড়া
ভেঙে বলল: ‘দেখি কেমন ছোটে তোমার ঘোড়া…’

বিকেলের মৌলালি পথ
একজন প্রৌঢ় মানুষ
ট্রাফিকের সামনে পড়ে
বেরোবার কূল পান না
পাঞ্জাবি, চশমা, ধুতি
কাঁধে এক নম্র থলি
চোখজোড়া চশমা ছেড়ে
ভেসেছে দূরের দিকে
সৌম্য মানুষটি আজ
হঠাৎই ভয় পেয়েছেন
কীভাবে পথ পেরোব?
ওই যে অত ট্রাফিক
যতবার নামতে যাবেন
ততবারই সগর্জনে
মিনিবাস, স্পেশাল বাসের
ফাঁক দিয়ে অটো সেঁধোয়
ফাঁক দিয়ে রিক্সা সেঁধোয়
হেই হট্‌ মোটরবাইক
প্রৌঢ় ভাবছেন আজ
তাঁর কি দেরীই হবে?
দেরীতে কোথাও যাওয়া
তাঁর ঠিক পছন্দ নয়
তবে কি যাওয়া হবে না?
হঠাৎই পেছন থেকে
ডাকলো একটি গলা
—‘এই যে এই যে আমি
শুনছেন, শুনছেন স্যার
এদিকে আসবেন না
ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন
এই যে যাচ্ছি আমি…’
ছুটে এলো একটি মেয়ে
সারামুখ উদ্বেগাকুল
সত্যিই আজকে যা জ্যাম!
তরুণী, কিশোরী-প্রায়
খাড়া মুখ লম্বা গড়ন
পিছনে টানবাঁধা চুল
চিবুকে সামান্য তিল
প্রৌঢ় তরুণীকে
দেখে আশ্বস্ত হলেন
‘আপনি, আপনি কি স্যার
একদম কলেজ থেকে?’
‘আজ আমার ক্লাস ছিল না
এসেছি এইমাত্রই
ভাবলাম এলে না আর’
‘আসবো না হয় কখনো!
কিন্তু যাবেন কীসে?
প্রৌঢ় চিন্তা করেন
‘এত জ্যাম, হেঁটেই চলো’
‘অতটা?’ —‘কতোটা আর!’
‘তা ধরুন রাজাবাজার
ছাড়িয়েও দু দুটো স্টপ!’
‘তাতে কী? —নরম হেসে
বললেন প্রৌঢ় মানুষ
‘হাঁটা তো ভাল জিনিস
হাঁটলেই মন খুলে যায়
হ্যাঁ শোনো, আজকে বোধহয়
ফিরতে দেরীই হবে
বাড়িতে বলে এসেছো?
মা বাবা ভাববেন না?’
‘বলেছি—আপনি আছেন
আর কেউ চিন্তা করে?’
মেয়েটি হাসলো এবং
তাকালো গভীর চোখে
কী মানুষ! সত্যি বাবা
মুখে কিছু বলল না আর
বিকেলের মৌলালি-পথ
চারিদিকে ক্রুদ্ধ ট্রাফিক
সরিয়ে নিজের মতো
অসম বয়সী দুই
পথচারী নামলো পথে
পথচারী এগিয়ে গেল…

এবার এসেছি আমরা সম্মেলন ঘরে
তথা কিছু ব্যক্তি নিচু কোলাহল করে
মাঝখানে ফরাস পাতা, বেঞ্চি রাখা ধারে
মধ্যে টুল, পাঠকর্তা বসিবার পারে
বেদীসম ডেস্ক আছে, নিতে পারো তা-ও
কাব্যছাড়া রাখতে পারো বক্তব্যকথাও
একদিকে লম্বা জানলা, পশ্চিমমুখীন
নিভন্ত বিকেল ঘরে, তালো ঢুকছে ক্ষীণ
মধ্যভাগে দুটি পাখা পুরো বেগে ছোটে
বাইরে জুতোর ভিড় ক্রমে বেড়ে ওঠে
ঘরের মাঝারে ঝুলছে পাঁচশো পাওয়ার
দুই পাশে দুটি দরজা, আসার যাওয়ার
এ সময় চরিত্রটি— বাউণ্ডুলে ড্রেস—
বন্ধু পাশে নিয়ে ঘরে করেছে প্রবেশ
যথারীতি ঘাবড়ে যায় সভাস্থল দেখে
কেউ চেয়ে দেখল, তাকে চিনল না অনেকে
এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক প্রান্তে সরে এসে
জায়গা দিলে সে বসেছে পিছনদিক ঘেঁসে
উঠে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহ আহ্বায়ক
বলেন এবার তবে সভা শুরু হোক
প্রথমে রয়েছে দুটি প্রবন্ধভাষণ
তারপর নব্যলেখা পড়বেন একজন
প্রবন্ধ পাঠের পর চা এসেছে ভাঁড়ে
চা খেয়ে চরিত্র গিয়ে বসে পড়ল দাঁড়ে
পাঠ করল, পাঠ করল, করে চলল পাঠ
লোকে উঠল, চলে গেল, ফাঁকা হলো মাঠ
শেষে একসময় তার এসেছে সম্বিত
সে উঠে চলেছে ফিরে যেথা ছিল সিট্‌
হঠাৎ পিছনে কণ্ঠ: ‘পড়ে রইলো যে!’
সে ব্যস্তসমস্ত ঘুরে পাণ্ডুলিপি খোঁজে
শেষে পায়, টুলনিম্নে আছে কতকগুলি
পড়া-লেখা, পড়ে আছে, শূন্য করে ঝুলি
সে গুছোয়, বন্ধু এসে বলে! ‘ঠিক আছে তো?’
—‘হ্যাঁ, দ্যাখো রাস্তার মতো যদি খোয়া যেত!
পাণ্ডুলিপি রক্ষা করে উঠে অতঃপর
সে দেখেছে শুরু হলো প্রশ্ন ও উত্তর
এক বলে: আপনার পদ্যপ্রাণে বেশ
মাধুরী রয়েছে, কেন নেই ঠাট্টা-শ্লেষ?
অন্যে বলে: আপনার মূল প্রেরণা কি
আপনি নিজে? পড়ে রইলো বিশ্ব বাদবাকি?
সব শেষে ওঠে এক ছোকরা বলিহারি
চুল ঝাঁকিয়ে বলে আজ সবচে’ দরকারী
এই বিশ্বে যে পথটি তা অমুকতন্ত্রই
কই পথটি তোর কাব্যে ওই রাস্তা কই?
চরিত্র প্রশ্নের সামনে নাকানিচুবানি
খেতে থাকে, এত তত্ত্ব আমি কী বা জানি।
ছাড়ুন আমারে আমি ফিরে যাই দেশে।
যা কিছু লিখেছি সবই দেবীর আদেশে।
কে দেবী কে? প্রসাদ না পদ? সেন? বোস?
যাকে তাকে আজ্ঞা দেয় কার এত সাহস?
এ সময় আহ্বায়ক দাঁড়িয়ে চৌকাঠে
বললেন: আমরা মুগ্ধ আপনার পাঠে
(ইনিও লেখক, ইনি প্রবীণ চিন্তক,
চেয়েছেন নব্য কবি সাবালক হোক।)
এই নিন, খামে রইলো আপনার দক্ষিণা
চিন্তা ছিলো আপনি আসতে পারবেন কিনা
কিছুটা বিহ্বল আর কিছু অভিভূত
চরিত্র বন্ধুর সঙ্গে পথে নামল দ্রুত
সে বলে, বলোতো কেন লোকে গেল উঠে?
যাবে না? শোনবার জন্যে মরবে মাথা কুটে!
একটাও কথা যদি না-ই ঢোকে কানে
মিথ্যে ওইখানে বসে থাকবার কী মানে?
এ কী বলছ, শোনা যায়নি? আহ্বানকারী যে
বারবার ‘ভালো লাগলো’ জানালেন নিজে!
সে তো যারা সামনে ছিল শুনেছে খানিক
নইলে তো তোমার গলা স্টিরিওফোনিক
এরপর কোথাও গেলে হ্যান্ডমাইক কিনো
যাতে লোকে শুনতে পায় দু’চারটে লাইনও
হেন রসতর্কে দোঁহে পদচারণ ক’রে
শেয়ালদায় চলে এসে ফিরতি ট্রেন ধরে
বন্ধু বলে: খোলো দেখি দক্ষিণার খাম?
চরিত্র চমকায়, বলে, কোথায় রাখলাম?
পাঞ্জাবিপকেট? নাকি ঝোলার গহন?
বুকপকেটে মুখ দেখায় খামটির কোণ
দেখা গেল তাতে আছে টাকা দুই শত
কাব্যপাঠে এই অর্থ উপায় করতঃ
দু’ বন্ধু স্পষ্টই খুশি, বিস্মিত স্পষ্টই
এতটা ভাবিনি কিন্তু, কেনা যাবে বই
চরিত্রের তাও ক্লান্ত লাগে মাথা ভোঁ-ভোঁ
মনে হয় কতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছোবো
এত মত এত পথ এত যে বিরোধী
এর মধ্যে পড়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে যাই যদি!
শেষমেষ ট্রেন গৃহস্টেশনে পৌঁছয়
লম্বা উড়ানের পর চাকা মাটি ছোঁয়
তখন দোকানপত্র বন্ধ চারিদিকে
দু’ একটা কুকুর ডাকছে এদিকে ওদিকে
এগারোটা বাজে তা-ও নিশুতি নগর
বন্ধু ও চরিত্র ফেরে নিজ নিজ ঘর
চরিত্র দরজায় দ্যাখে কুকুরটি শুয়ে
উঠে অভ্যর্থনা করে নাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে
‘আজ কিছু আনা হয়নি, তোকে যে কী দিই
কাল আনব’…, চরিত্রটি দরজা নাড়ে, ‘দিদি
এই দিদি, দরজা খোল।’ দিদি দরজা খোলে
ঘুমচোখে উঠে এল বেড়াল নিয়ে কোলে
‘মিঁয়াউ’! নালিশ করে— ‘আজ কিছু আনেনি!’
‘সব বন্ধ হয়ে গেছে’, যা এখন, মেনি’
দিদি খেতে দিয়ে বলে, ‘কী হলো ওখানে?’
‘হলো তো অনেককিছু, কী হলো কে জানে?’
পকেটের খামটা দেখ্‌ খবর আছে জোর
পিসিমার একশো আর একশো টাকা তোর’
‘টাকাও দিয়েছে বুঝি?’ —‘ভদ্রলোক ভালো
আবার বললেন আসতে, অন্যেরা জ্বালালো’
মেনিটা পাতের সামনে, একটু নেই ভয়
ভুলো ছুটে গেল, ব্যাঙ দেখেছে বোধহয়
ব্যাঙ বলতে পুনরায় মাথা উঠল ঘুরে
সেই লোকটা কী-বা করছে এই রাতদুপুরে?
আর ওরা? মতাদর্শী অতিকায় ব্যাঙ
একই মত বারংবার গিলে উগরে দেন!
—‘পিসিমা শুয়েছে, দিদি?—’ শুলো একটু আগে
সন্ধে থেকে গজগজ করছিল তো রাগে!’
‘কী হলো আবার?’ বলছে, গেলি কলকাতায়
বলা থাকলে কালীঘাটে পুজো দেওয়া যায়’
‘পিসীমার মাথা দেখছি গেছে একেবারে
আমি তো গিয়েছি উলটো! সেই রাজাবাজারে
তারপরেও দু’টো স্টপ। জ্যাম ছিল তাই
হাঁটলাম, যাওয়া আসা পুরো রাস্তাটাই
দুজন ছিলাম, রক্ষে… কালীঘাটে গেলে
ভোরেই বেরোতে হতো’—‘এ কী ভাত ফেলে
উঠে পড়ছিস কেন?’ —‘আর পারছি না
গা গুলোচ্ছে, দেখি বাইরে ভুলো আছে কি না’
‘ভুলো, ভুলো’—- থালা হাতে চরিত্র বেরোয়
দিদিটি মেনির জন্যে ভাত মেখে থোয়
হাত ধুয়ে ভাইবোন বারান্দার ধারে
মাদুর বিছোয়, চাঁদ নিমগাছপারে
বাইরে রাত্রির হাওয়া, নারকোলপাতারা
জ্যোৎস্না লেগে ঝিকমিকোয়, মাথাভর্তি তারা
দিদি বলে, দ্যাখ এই রাত্রির বাতাসে
কেমন একটা গন্ধ! কতো দূর থেকে আসে?
ছিল যে পুকুরপাড়ে জঙ্গলমতন
বল ফেলে কাঁদতিস, নামতাম তখন
কুড়িয়ে আনতাম আমি, এইসব হাওয়া
ততদূর থেকে আসে? তারও আগে যাওয়া
আরো, আরো আগে— তুই হোসনি যখন
ভোরবেলা থেকে বসে দেখতাম কখন
এক গামলা জল, সেই এক গামলা জলে
দিন হতো রাত্রি হতো, জলের বদলে
নিজে শুয়ে পড়তাম উঠে গামলায়
তারপর দেশ দেশ গামলা ভেসে যায়
মনে মনে ভেসে ভেসে এ নদী সে নদী
ঘুরতাম, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হতো যদি
মা বক্‌তো, পিসি বক্‌তো, অথচ জানিস
কত বা বয়স হবে? সাতবছর?… ইস্‌
বেচারা ঘুমিয়ে গেছে, দিদি বলে, ভাই
এখানে ঘুমোসনি, ওঠ্‌, চল ঘরে যাই
আর ভাইবোন গিয়ে শুয়ে পড়ল যদি
নিঝুম বাড়িটি বলে, থাক এ অবধি।
যার গল্পে বাধা পড়ল, কাল কিছুক্ষণ
আমরা শুনব সেই দিদির কথন।

দিদির কথা

সকালবেলা আমার ভেতর থেকে
একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে রোজ
আমি তাকে আধেকমতো চিনি
অন্য কেউ রাখে না তার খোঁজ
কেননা কেউ দেখতে পায় না তাকে
আমি যখন চাকরি করতে যাই
সে যায় আমার পাশের সিটে বসে
কথাও বলে সমস্ত পথটাই
একেক দিন একেক বয়স যদি
আজকে ষোলো কাল আঠেরো তবে
কানের কাছে সে করে ফিসফিস
ভুলে গেছিস চিঠি লিখতে হবে?
কীসের চিঠি? অবাক হয়ে বলি
—আ-হা-হা যেন কিচ্ছুটি জানে না
নিজের বুকে হাত দিয়ে বল দেখি
সন্ধেবেলা সুধাদা আসবে না?
পরক্ষণে দেখি যে সেই মেয়ে
সন্ধেবেলা স্যারের কাছে বসে
খাতার উপর ঝুঁকে কীসব যেন
তুলে ফেলছে রবার দিয়ে ঘষে
দেখি যে সেই মেয়ের আঙুল ধরে
খেলা করেন তরুণ শিক্ষক
মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে
থমকে যায়, চোখে দাঁড়ায় চোখ
স্যার বলেন, অমন হাত থেকে
বেরোতে পারে এত খারাপ লেখা!
পরে সবাই কী বলবে বলো তো?
বলবে, আরশোলার কাছে শেখা
‘যাঃ’ মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নেয়
ছদ্ম রাগে, ‘আপনি খুব বাজে’
আবার হাতে আড়াল করে হাসি
‘কী লিখব তা মাথায় আসে না যে’
‘আনতে হব! কী বল্‌ছি তোমায়
হাতের লেখা ভালো করার দুটি
উপায় আছে— বাঃ কী সুন্দর!’
হাত বাড়িয়ে ছুঁলেন ভুরু দুটি,
মেয়েটি মুখ সরায়, চোখ নিচু
‘যা বলছিলাম, একটি হলো রোজ
দেয়ালে ঘুসি চালানো, অন্যটি
সে তুলনায় অনেকটা সহজ
সেটাই হলো চিঠি লেখার হ্যাবিট
তাকেই, মুখ মনে পড়বে যার
জগৎ ভরে কতই মুখ আছে
যেমন এই বেচারা মাস্টার’
পরক্ষণেই মাস্টারটি নেই
ছাত্রী একা অন্ধকার ঘরে
ছাদ থেকে তার পাশে চতুর্দিকে
চিঠির পর চিঠি আছড়ে পড়ে
আর মেয়েটি হাজার হাজার চিঠি
তুলতে তুলতে ঘরের মধ্যেটায়
পাক খায়, পাক খেতেই থাকে আরো
দেখতে দেখতে বয়স বেড়ে যায়
ওই যে ছুটে বাগানে এলো— তার
মাথায় কেউ বৃষ্টি ছুড়ে মারে
বৃষ্টি নয়, চিঠির অক্ষর
মাথায়, মুখে, গলায়, বুকে, ঘাড়ে
গড়ায়, যেন ছিন্ন সব আঙ্গুল—
নিজেকে মেয়ে আরও আগলে ধরে
চিঠির থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা
কথারা তার শ্লীলতাহানি করে
শরীর থেকে দু’হাতে খুলে কথা
ছুঁড়ে ফেলে সে মাটিতে ভেজা ঘাসে
শ্রান্ত মুখ, কপালে ভাঙা চুল
ভেঙেচুরে সে পড়ার ঘরে আসে
জানলা দিয়ে ডাকতে আসে যখন
সূর্যালোক— অবাক হয় দেখে—
এ’ পাশে ব্যাগ, ও’পাশে বইখাতা
ঘুমোয় মেয়ে টেবিলে মাথা রেখে

সত্যি কি জানি ভোর কাকে বলে?
ভোরে উঠে যাই গাছেদের কাছে
এ শিউলি আর ও গন্ধরাজ
ফুল ফুটে আছে, ফুল ঝরে আছে
হাত দিয়ে ওই পাতাগুলো ছোঁয়া
গাছকে কুশল প্রশ্নই কাজ
শুরু করতেই গাছগুলো বলে:
কে আসবে আজ? কে আসবে আজ?
কেউ আসবে না, এ বয়সে আর
ওইসব দিকে মন যায় না রে
গাছেরাও বলে: কী হয় কখন
কে বলতে পারে? কে বলতে পারে?
লজ্জা পাই না, খারাপও লাগে না
ভালোও লাগে না, এ এক রকম
মাথা ছুঁয়ে বলি বেলিগাছটাকে
তোদের সঙ্গে বকমবকম
এটাই তো ভালো! আমিও এখন
থাকতে পারি না তোদেরকে ছেড়ে
ওমা ওই দেখ পাতাবাহারের
গাছেও একটা ফুল ধরেছে রে
হ্যাঁ শোন, আসতে দেরি হলো কাল
পিসিমা তোদের জল দিয়েছে তো?
গাছেরা বলল, ‘রাতে তো বৃষ্টি
জল না দিলেও কিছু এসে যেত?
বিকেল চারটে বাজলেই হলো
দরজার দিকে আমরা তাকাই’
আমি হেসে বলি, চারটে! তখন
বেরোবার আগে আমরা চা খাই
‘অফিস? অফিস? অফিসে তোমার
বন্ধুরা আছে? বন্ধুরা আছে?’
বড় হল্‌ঘর কত লোক বসে
দূরে কাছে দূরে আনাচে কানাচে
আলাপ তো আছে সবার সঙ্গে
—‘বন্ধু কি তারা? বন্ধু কি তারা?’—
মাঝে মাঝে ভাবি সারা ঘর ভরে
কথা বলে শুধু টাকাপয়সারা
হেসে কথা বলি হেসে উঠে পড়ি
সাড়ে সাতটায় বাড়ি পৌঁছই
রিকশায় উঠে মন ছটফট
বেলকুঁড়ি কই? বেলকুঁড়ি কই?
কিন্তু জানিস, সমস্যা আছে
সেই যে মেয়েটা ট্রেনে যায় রোজ
আমার সঙ্গে, আর কেউ যাকে
দেখতে পায় না— ব্যাপারটা বোঝ—
সে-ই নানা সব জিনিস দেখায়
নানা কথা টানে, কী পাজি কী পাজি
প্রত্যেকদিন মন ঠিক করি
হেস্তনেস্ত করে নেব আজই
পরদিন ঠিক অন্য একটা
বয়স নিয়ে সে ওঠে কামরাতে
কী করি বলতো মেয়েটাকে নিয়ে?
ভালো ছেলেটেলে আছে নাকি হাতে?

সেদিন আমাদের সেকশনে
এসেছে একজন নতুন লোক
ফর্সা ছিপছিপে টাকমাথা
বীণাদি বললেন, ‘আহম্মক’
‘কেন গো?’ রীতা বলে— ‘ওই যে দেখ
বোতাম উঁচুনিচু। পকেটে পেন
তলায় লিক্‌করা কালির দাগ
সাহেব দেখলেই ধমকাবেন’—
বলল রীতা— ‘আরে, সত্যি তো
এ’ লোক নির্ঘাৎ ঝাড়-খাওয়া
অনিতা সেন বলে— ‘দ্যাখ্‌ গিয়ে
অন্য কারও সাথে বউ হাওয়া’
‘অনিতা, চুপ চুপ, ওই যে, ওই
এদিকে তাকিয়েছে’— যাই বলিস
দেখতে বেশ, ভাই,’— ‘কতো বয়েস
বলব ঠিক?’—‘বল্‌’—‘ছেচল্লিশ!’—
রায়দা’ উঠে এসে দাঁড়ান, ‘সেই
চিঠিটা হয় নি তো? দাও, কোণে
ওই যে বসে আছে, কিরণ রায়,
ও’ আগে ছিল বিলসেকশনে
আলাপ হয়েছে তো? ‘হয়ে যাবে’
—চিঠিটা ও-ই করে দিক বরং’
রায়দা চলে যান, অনীতা সেন
মুখ বেঁকায়, বলে, ‘কীসব ঢং
রায়দা লোক দেখে নতুন হন
আমরা যেন সব ভেসে গেলাম।’
একথা ওই কথা সেই কথায়
অফিস ঘুরে আসে জাহান্নাম…
বিকেলে বেরিয়েছি। স্টেশন-পথ
মিনিট কুড়ি হাঁটা। হেঁটেই যাই।
হঠাৎ দেখি সেই ভদ্রলোক
আমার সামনেই! চোখ নামাই।
কেন যে নামালাম, জানি না ঠিক।
লোকটি নিজে থেকে হাসলো, আর
বলল, “আমাদের একই তো ঘর…
আমার নাম’—।‘জানি। নমস্কার’।
‘—কী করে জানলেন?—‘শুনেছিলাম
অফিসে’। —‘আপনার’? নাম বলি।
—‘যাবেন কোন দিকে?’—‘শেয়ালদায়’।
—‘আসুন, শর্টকাট এই গলি’।
—‘না.. মানে… আপনিও?’—‘শেয়ালদা-ই।
ডেলি প্যাসেঞ্জার। রামনগর।
আপনি?’ —বললাম।—‘আরও-ই দূর।
আরও তো পাঁচছ’টা স্টেশন পর।’
সামনে ছোটোমতো একটা পার্ক।
প্রেমিকপ্রেমিকারা। চিনেবাদাম।
আইসক্রিমগাড়ি। বাচ্চারা।
‘সত্যি, আগে কতো ঘুরে যেতাম’
বলিনি। ভাবলাম। লোকটা বেশ
লম্বা। উঁচু কাঁধ… কী যেন নাম?
‘র’ দিয়ে?… এই দ্যাখো! ‘র’ দিয়ে নয়?
উঁচু বোতাম আর নীচু বোতাম
পকেটে কালিলাগা… ভুলে গেছি!
—‘আমার আদিবাড়ি কীর্ণাহার
(—‘ক’ দিয়ে, ক্‌—কিরণ। কিরণ রায়!)
মা-বাবা দু’ জনেই এ বাংলার
আপনি?’—‘আমি… মানে.. মা ওদিকের’
কিসের বাপু এত কৌতুহল?
থামলে বাঁচি— ‘ওই, ওই দেখুন
বাঁ দিকে ঘুরে প্রাচী সিনেমা হল।’
হঠাৎ আমি সোজা ঘুরে দাঁড়াই
‘গলিটা চেনা হ’ল। ধন্যবাদ।
এবার আসি তবে।’ না তাকিয়েই
টপকে চলে যাই, পেরোই খাদ।
ওপারে ঘুরে দেখি লোকটা হাঁ!
আমার মতো যেন দ্যাখেনি আর
হাঁটবো কেন আমি ওর পাশে?
পুরুষে আর আমার কী দরকার?
কিন্তু, ভেবে দ্যাখো, লোকটা তো
বলেনি কিছু! কেন? বলতে হয়?
অমন উঁচু কাঁধ, তাকানো ওই!
ভেতরে গিয়ে বিঁধে… না। আর নয়।
পরের দিন থেকে লোকটা রোজ
আমাকে দেখে গেছে। হেসেছে তা-ও।
হেসেছি, হাসিনি বা, বুঝিয়ে দিই
চোখ ফেরাও, আগে চোখ ফেরাও!
সে-চোখ ফিরে গেছে। দ্যাখেনি আর।
আমিও পুনরায় ঝামেলাহীন।
একই তো হলঘর। কাজের মুখ।
দিনের নিয়মেই চলেছে দিন।
হঠাৎই একদিন সেই মেয়ে
আবার ট্রেনপথে এসে দাঁড়ায়
এবং হাতে তার ছুঁচসুতো
এবং মুখোমুখি কিরণ রায়
দ্রুত আঙুল খোঁজে বোতামঘর
গায়ের শার্টে ছুঁচ! কী অন্যায়!
বুকের কাছে মাথা… বন্ধ শ্বাস…
কিরণ… ‘ক’ দিয়ে… ‘ক’… কী করে ও?
বোতামে মুখ… সুতো… সে ছিঁড়ে নেয়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *