যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল – তৃতীয় ভাগ

তৃতীয় ভাগ

সকাল হয়েছে পাঠকেরা জেগে ওঠে
পাঠকের পাশে জাগে পাড়া প্রতিবেশী
তার মানে যারা ছাপা অক্ষর পড়ে
ছাপা বই থেকে—না কেবল তারা নয়
যারা পড়ে ওই সামনের সোজা গাছ
যারা পড়ে থাকে গাছ থেকে খসা পাতা
যারা পড়ে থাকে পাতা খসে পড়া ঝিল
যে-ঝিলে এখন সকালের রোদ পড়েছে।
যে ঝিলের পাশে নরম ঘাসের ঘেরা
সাত আটটা গাছ হাতে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে
এখন আমরা দেখছি যে তারই একটা
গাছে পিঠ রেখে চরিত্র বসে আছে
সেই চরিত্র, যে কাব্যে মধুময়
সেই চরিত্র যে লেখক হবে বলে
ক’দিন আগেই বন্ধু প্রহরী নিয়ে
কবিতা সভায় কলকাতা গিয়েছিল
এখন সে বসা, গাছে পিঠ রাখা তার
হাতে দেশলাই, ঘাসে রাখা সাইকেল
ধরাবে বলেও সে ধরাতে ভুলে গেছে
বহুক্ষণের বানানো তাম্রকূট
খাওয়া কম হবে বলে ইদানীং ওই
বন্ধুর পরামর্শে এ মশলাটি
ব্যবহার করা ধরেছে, সস্তা হয়
এই কল্পনা আশ্বাস দেয় তাকে
যদিও সে নয় টাকাপয়সার লোক
একেকটা দিন বন্ধুর ধাঁতানিতে
মাঝে মাঝে ভাবে, না না এটা ভাল নয়
আমাকেও কিছু সঞ্চয়ী হতে হবে
বয়েস তো আজ চব্বিশ পেরিয়েছে
পঁচিশে পড়ল, চাকুরীর সন্ধান
চলছে, একটা হয়ে যাবে মনে হয়
ছাত্র তো ভাল, কাছাকাছি ইস্কুলে
এর বেশি আর উচ্চাশা নেই তার
বাড়ি নিজেদের, দিদির বিয়েটা হলে
চিন্তা ছিল না, কে জানে করবে কি না
দিদিকে বলতে যাওয়াই তো মুশকিল!
না-ই যদি করে না করুক, ক্ষতি কিসে?
পিসিমা কিন্তু বলেছে যে লোকে তা-তে
ভাইকে দুষবে, বলবে স্বার্থপর
খরচার ভয়ে দিদির বিয়েটা দেয়নি!
সে সবে এখন মন যাচ্ছে না তার
সে দেখছে শুধু জল, রোদুর পাতা
এই গাছ থেকে ওই গাছে যাওয়া পাখি
পুচ করে পাখি হাগু করে তার জামায়
সেদিকেও তার মন নেই আপাতত
এখানে বসতে গেলেই ওসব হবে
ঘাসে শোয়ানো যে-সাইকেল, কেরিয়ারে
একটা বাঁধানো খাতা, মন সেই দিকে
ছাত্র বয়স থেকেই পালিয়ে ছুটে
কেরিয়ারে নিয়ে বই খাতা নোটবই
এইখানে বসে ঘণ্টা ঘণ্টা একা
সে খুঁজে পেয়েছে দু’চার ছ’দশ লাইন
সে দেখছে এই গাছের পিছন দিকে
দূরে হাইরোড, পিঠে কুঁজতোলা লরি
ছোট পাল্লার, দূর পাল্লার বাস
শব্দ আসে না, এলেও আবছা আসে
কারণ এখানে অনেক ঢুকতে হয়
টাউন ছাড়িয়ে অন্ততপক্ষে তো
মাইল চারেক হবেই,—বাগান ঘেরা
এ পুকুর হলো চাটুজ্যেদের ঝিল।
কাঁটাবেড়া দিয়ে ঘেরা এই জায়গাটা
দারোয়ান আছে, কেয়ারটেকার আছে
চরিত্রকেও চেনে এরা বহুদিন।
সে এলে, বসলে, আপত্তি নেই কিছু
হবেই বা কেন আপত্তি? চুপচাপ
বসে থাকে আর বইপত্তর খুলে
পড়াশুনো করে, লিখে নেয় পড়াশুনো
বোঝা যায়, ছেলে উলটোপালটা নয়!
সকাল থেকেই আজ সেইখানে এসে
বসে আছে এই সোজা ও নিরীহ ছেলে
শুধু মন তার ঘুরে ঘুরে চলে যায়
খাতায়, যে-খাতা কেরিয়ারে, সাইকেলে
না আর কখনো সভা-আহ্বানে নয়
সে ঠিক করছে, যথেষ্ট হয়ে গেছে
বন্ধুকে কাল জানাতে বন্ধু বলল:
অসুবিধে কিসে? ভালই তো হল সব!
তাছাড়া কবিতা পড়ে পাওয়া দুশো টাকা
এসব কখনো কল্পনা করেছিলে?
ঠিক! ঠিক! কথা ঠিকই তো বলেছে সঙ্গী
তবু তার চেয়ে ঝিলে ডুবে মরা ভাল
টাকা পাওয়া গেছে সেটা অবশ্য ঠিক
কিন্তু টাকা তো আরও কতকিছু করে
পাওয়া যায়, ধরো এই যে ছেলে পড়াই…
অথবা গাছের ডাব-নারকোল বেচে
ব্যবসাট্যাবসা করেও তো লোকে টাকা…
ব্যবসা? বন্ধু আচমকা রেগে যায়!
ব্যবসাকে বুঝি ফেলনা জিনিস ভাবো?
পৃথিবী চালায় ব্যবসা বাণিজ্যই
এই রাজনীতি, শিল্পটিল্প সব
ব্যবসায়ীদেরই হাতে টানা ছুঁচ-সুতো
ব্যবসাকে অত হেলাফেলা করছ যে
তুমি কি পারবে? সে কতো কঠিন, জানো?
টাকা পয়সাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আমি সাধুবাদ দেব উদ্যোক্তাকে
টাকা দিয়ে উনি তোমার কবিতাপড়া
কিনে নিয়েছেন। শুকনো কথায় নয়!
মোটেই না! আজ ভাবছে চরিত্রটি
সামনে সে কিছু বলতে পারেনি ওকে
কেনা নয়, উনি কবিসম্মান রূপে
ওটা দিয়েছেন—স্নেহ-শ্রদ্ধার দান
বলেনি, কিন্তু বললে বলত বন্ধু
টাকাতেই ভাই স্নেহ বা শ্রদ্ধা সব
প্রকাশিত হয়, কেন বুঝছ না এটা?
নাকি তা বুঝেও মেনে নিতে পারছ না?
হ্যাঁ ঠিকই বলত। মানা যাচ্ছে না মোটে
লিখে টাকা পেলে আনন্দ হয় ঠিকই
তাই বলে শুধু টাকা ভেবে লেখা যায়?
টাকা নেওয়া মানে বিক্‌কিরি? বেচে দেওয়া?
ভালোবাসা নয়? বাকিটা জীবন তবে
এইভাবে যাবে? কেবলই এই তুফান
পাড়ি দিতে হবে? নিতে হবে তরী পার?
চরিত্র ফিরে তাকিয়েছে কেরিয়ারে
কেরিয়ারে নয় বাঁধানো খাতার দিকে
একহিসেবে তার খাতাটিই কেরিয়ার
যা সে আরম্ভ করেছে তাগাদা শুনে
কেবল কালকে, মাত্রই গতকাল!
বন্ধুটি তাকে আঠেরো তারিখ থেকে
তাগাদা দিচ্ছে, খাতা করো খাতা করো
আঠেরো তারিখ মানে হলো সেই দিন
যেদিন দুপুরে কবিসভা গেল ওরা
আর রাস্তায়, স্টেশনের বেঞ্চিতে
বসে চরিত্র করেছে সংশোধন
পাণ্ডুলিপির পাতা উড়ে গিয়ে শেষে
বন্ধুর তৎপরতায় বেঁচে গেল
এমনকি ওই সম্মিলনের শেষেও
টুলের তলায় পড়ে ছিল একগোছা
খেয়াল করেনি। সমাগতদের কেউ
‘পড়ে রইল যে’—বলেছিল, তাই গিয়ে
উদ্ধার করে এনেছে চরিত্রটি
বন্ধু বলল: দ্যাখো টাকা পাওয়া যায়
এর আগে তো বই ছাপিয়েছে প্রকাশক
তুমি নিজে টাকা দিয়েছ, সে দিল ছেপে
কিন্তু পয়সা হাত-উপুড় করল না
তোমার বই কি বিককিরি হবে, বলো?
যদি এই কথা বলে, তুমি সেই ভয়ে
পরে আর কোনো যোগাযোগ করলে না?
হয় বলতো, কী-বা হতো হাতিঘোড়া!
যা লেখা পাঠাও, সমস্ত ডাকযোগে।
ছাপা হয় ঠিকই, ডাকখরচা কি ওঠে?
কপি পাঠাতেও কতো লোক গড়িমসি
‘দপ্তরে এসে সংগ্রহ করে নিন’
দপ্তর, সে-ও বহুতর গলিখুঁজি
খুঁজে খুঁজে গিয়ে পৌঁছলে দেখা যায়
আজকে বন্ধ, সোম-মঙ্গল খোলা
সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে ন’টা সাক্ষাৎ
কিন্তু তাহলে টিউশনি মিস্‌ হয়
বন্ধু বলল: টাকা দেয় কয়জন?
দু’চার পত্র দক্ষিণা দিয়ে থাকে
তথায় বছরে দু’টোর বেশি তো নয়
এত ভিড় ঠেলে জায়গা করা কি সোজা?
সেইখানে দ্যাখো এই ভদ্দরলোক
পত্রে ছেপেছে, তারপর চিঠি দিয়ে
ডেকে নিয়ে গেছে, অত লোকজন ডেকে
তোমাকে তো ভাই পরিচয় করিয়েছে
তবু ঘ্যানঘ্যান, ‘না যাবো না, আর নয়’
তোমার তো বাপু মন পাওয়া খুব শক্ত
চরিত্র বলে: ‘না না সেজন্য নয়’
‘কী জন্য তবে?’ বন্ধু ধৈর্যহারা
‘আর কী কারণে তোমার বাহানা শুনি?’
না মানে… আসলে… কী জানো… মানে কি… আমি’
‘থামো তো, তোমার আমতা আমতা রাখো
যা মোদ্দা কথা শুনে নাও কান খুলে
এখন থেকেই যদি চলো চোখ বুজে
যদি মার্কেটভ্যালু না বিচার করো
গোস্পদে খাবে হাবুডুবু নির্ঘাৎ
তখন তোমাকে কে বাঁচাবে, ভাই কবি?
ভাই কবি বলে, না মানে ব্যাপারটা তো
ঠিক সে রকম নয়’— ‘কী রকম তবে?
— ‘মানে কী, আমি যা ভাবছি… নিজের দিকটা
আগে তো নিজের দিকেই দেখতে হবে।’
—‘আমিও তো দাদা সেই কথাটাই বলছি
আপনি বাঁচলে বাপদাদাদের নাম
তাই না?’— ‘হ্যাঁ তাই নিজের তো প্রস্তুতি
থাকবে একটা’— ‘থাকতেই হবে ভাই!
কতবার বলি, আমি তো সেটাই চাই!’
‘তুমি চাও মানে?’ —বলছি যে ছেড়াখোঁড়া
অত পৃষ্ঠার কাগজপত্র নিয়ে
ঘুরে বেড়ানো কি ঠিক?’ — ‘না ঠিক তো নয়’
‘তবে খাতা করে ফেললেই হয়’— ‘খাতা?
খাতা করাটাই হয় না।’ — ‘হয় না? কারণ?’
‘কারণ আমি যে বারবার বদলাই’
‘সে তুমি লেখায় যা খুশি করোগে যাও
তা নিয়ে কি আর মাথা ঘামাচ্ছে কেউ
তার আগে নিজের চরিত্র পালটাও!
সেই যে, যে লেখা, পথে উড়ে যাচ্ছিলো
যে লেখাগুলোকে টুলের তলায় ফেলে
চলে আসছিলে, সেইসব লেখাতেই
তোমাকে তারিফ দিয়েছে আহ্বায়ক
পারিশ্রমিকও দিয়েছে তো? এইবার
ওই লেখাগুলো যদি কোনো প্রকাশক
বই করে ছাপে, যদি লোকে বলে, ভালো
সেটাকেই বলে, উন্নতি, নাম করা
তাছাড়া তখন টাকাও তো কিছু পাবে
বুঝেছ? তা নয় তুমি হেলেদুলেদুলে
কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে —রাবিশ্‌!
যাও বাড়ি গিয়ে আজকেই খাতা করো
পালটাও আরও চরিত্র পালটাও!
আহ্বায়কের প্রশংসাচিঠি নিয়ে
যাও ঘুরে দ্যাখো প্রকাশক পাও কি না
সেদিন সভায় কতো লোক দেখেছ তো!
অত ভিড় ঠেলে মুখ দেখানো কি সোজা?
আজ এই সকালে গাছে পিঠ রেখে বসে
চরিত্র ভাবে, চরিত্র পালটাবো?
কিন্তু কীভাবে, কেমনে তা করা যায়
বন্ধুর কাছে উপায় তো শেখা গেল!
ছড়ানো কাগজ খাতায় বন্ধ করা
দ্বিতীয় ধাপটি প্রশংসাচিঠি আনা
তৃতীয় ধাপটি খুঁজে ফেরা প্রকাশক
চতুর্থ নামখ্যাতি, পঞ্চম টাকা
বন্ধু বলেছে তাকাও নিজের দিকে
বন্ধু বলেছে জায়গা করা কী সোজা?
খুবই কি জরুরি এত ঠেলাঠেলি করা?
মুখ দেখাতেই, মুখ চেনাতেই হবে?
না-ই যদি জানে, না-ই চেনে বহুলোক
কী মহাভারত অশুদ্ধ হবে তা’তে
কী বা ক্ষতি হবে? কিছুটা তো ক্ষতি হবেই
যা লিখি, লিখছি, পড়ছে তা শতজন
ভাবলে তো ভাল, জানলে তো ভাল লাগে
বন্ধু বলেছে, নিজের দিকটা দ্যাখো
নিজদিক মানে ওর কাছে যোগাযোগ
বন্ধু বলেছে সুযোগের সুতো ধরো
নইলে কিচ্ছু হবে না ইহজীবনে
বন্ধু বলেছে: আগে ঘর সামলাও
চরিত্র ভাবে, আমিও তো ভাবি তা-ই
ঘর মানে লেখা। শব্দ,ছন্দ,ভাষা
ভাষা ভেঙেচুরে কৌটোবন্ধ প্রাণ
খুঁজে তুলে আনা, প্রতি মুহূর্তে কতো
কতো সহস্র ছবি ও অভিজ্ঞতা
বিদ্যুৎবেগে সরে যায় ট্রেনে পোস্ট
তার থেকে আমি ক’টা বা ধরতে পারি?
যতটুকু পারি, যে ক’টি দৃশ্যছবি
এসে ধরা দেয়, তাদের যা প্রয়োজন
সেই সেই মতো শব্দ-ছন্দ-ভাষা
দিতে পারি আমি? যার যার যা গঠন
সমুচিত, আমি গড়ে দিতে পারি, সব?
সব দূরে থাক, দু চারটেও কি পারি?
আমি কি সেসব আসন্ন রচনাকে
মানুষ করতে পারি ঠিক ধরে ধরে?
না পারি না। আজ স্পষ্টই বলা ভালো
যাদের লিখেছি, যা কিছু এসেছে হাতে
অধিকাংশের ক্ষেত্রেই মনে হয়
কী যেন হয়নি, কী একটা বাকি আছে।
কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে
কী বাকি রয়েছে সেটা বোঝাই তো বাকি
এই হল ঘর, এই হল নিজদিক
এ অবস্থায় ঘরটিকে একা ফেলে
বাইরে বাইরে ঘুরে ঘুরে যদি হই
ঘোরাঘুরি আর যোগাযোগ সম্বল
তবে কি ঘরের ফাঁক কোনোদিন ভরবে?
আমি আছি আর আমার সামনে জীবন
এই গাছ, ওই পাতা, রোদুর, জল
ওই দূরে লরি, ধাবায় খাটিয়া, রিক্সা
পিছনে শহর, চেনা-আধোচেনা লোক
বাড়িতে বাড়িটি। পিসিমা-দিদি মা-বাবা।
মা-বাবা তো নেই। কিন্তু স্মৃতিতে আছে
মা-স্মৃতি আবছা, পিতা-স্মৃতি উজ্জ্বল
স্মৃতিও কিন্তু জীবিত একটা কিছু
আবছা, স্পষ্ট, দু’রকমই বোঝা যায়
যেমন জীবিত রোজ খবরের কাগজ
কারণ তা থেকে শতসহস্র জীবন
শতসহস্র ঘটনা ঘটনা হা হা
ধাওয়া করে আসে প্রতিদিন পরদিন
তা থেকেও কিছু ঘটনা-দূর্ঘটনা
পাশ ফেরে আর মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ে
দু বছর পরে তাকে বলে ইতিহাস
আমি আছি আর ইতিহাস আছে সামনে
বইপড়া যুগ? বই জীবন্ত নয়?
যে-মুহূর্তে যে-গ্রন্থটি পাঠ করি
প্রতি অধ্যায় দেহ ধরে আসে সামনে
সে-ও তো আমারই জীবনঅংশ হলো!
আর ওই সূর্য, ওই যে সূর্যপথ
যে সূর্য তার পুরো পরিবার নিয়ে
আমাদের এই গ্যালাক্সি ঘুরে আসে
এত এত এত বিলিয়ন বৎসরের
সে-বর্ষব্যাপী আমারও জীবৎকাল
কী করে? কারণ যে মুহূর্তেই আমি
জানি এ তথ্য, সূত্রটি পাঠ করি
তখনই সে পথে জীবদশা ছুটে যায়
অর্থাৎ এই আমি ও আমার সামনে
পুরোটা অতীত, অর্থাৎ যে সময়
সময়ই প্রথম আরম্ভ হলো, সেই
বিস্ফোরণের বিন্দুটি থেকে আমি
একাধারে সব সময় দেখতে পাই
কী করে তা পাও নিজেকে স্পষ্ট করো
জানো বিজ্ঞান একঅর্থে অনুমান?
জানো বিজ্ঞানও কল্পনা নিয়ে দ্যাখে?
প্রথমে, প্রথমে! খুঁজে খুঁজে একদিন
সত্যিই নিজ লক্ষ্যটি পেয়ে যায়
ফেটে যাওয়া তারা, নীহারিকা, ব্ল্যাকহোল
ফাইভ হান্ড্রেড বিলিয়ন সূর্যের
ভর গিলে নিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে
আমাদের সেই নিকটবর্তী কালো
গহ্বর, তার থাকাও তো অনুমান!
প্রথমে তো জ্ঞান কল্পনা দিয়ে দ্যাখে
দ্যাখে, লিখে রাখে, লিখে ফের আরও দেখা
হয়তো কখনো কল্পান্তেরও পরে
সে দেখাটি আসে প্রমাণটি হাতে নিয়ে
অথবা হঠাৎ পরদিন সকালেই
সেই দেখা এসে দাঁড়ায় সবার সামনে
সবই হয়। সবই হতে পারে, শুধু এই
মুহূর্তে আমি দেখছি আমার সামনে
রোদ্দুর, জল, পাতা, ঘাস, ঘাসে পোকা
ফড়িং লাফায় তাকে তাড়া করে পাখি
পাতা বেয়ে নামে শুঁয়োপোকা, মাটি ফুঁড়ে
কেঁচো বেরোচ্ছে, শামুকটি দাগ টেনে
একমনে চলে সিমেন্ট বাঁধানো ঘাটে
ঝুপ করে ব্যাঙ ঝাঁপ দিল, তীরে ঢেউ
মোরগ লাফিয়ে উঠল দূরের চালে
বাছুর ছাড়ল পাশে দারোয়ান বউ
বাচ্চার ঢিলে ছুটে পালাচ্ছে হাঁস
এতো এতো প্রাণ, চারিদিকে কোটি কোটি
প্রাণ বয়ে চলে প্রাণ ভেসে উঠে যায়
বিস্ফোরণের প্রথম বিন্দু থেকে
এই আজ, ওই কাল, সেই চিরকাল
কোথায় ধরব, কী করে বলব আমি
কোথায় ধরবে? তুমি জানো। এই মন।
মনেই তো সব গ্রথিত, সংকলিত,
বলবে যা দিয়ে তা-ও তো নিজেই জানো
শব্দ, ছন্দ, ভাষাজীবন্ত ধনু
এখনো তোমার কিছু আয়ত্ত হয়নি
প্রতিদিন শুধু শিখে যেতে হবে, শিখে
প্রতিদিন লিখে, না লিখে না লিখে, লিখে
প্রতি মুহূর্তে ভুল করে ভুল ভেঙে
লিখে যেতে হবে, আর কে লেখাবে? মন—
সেই মনই যদি যোগাযোগ, প্রকাশক
সেই মন যদি নামটাকাউন্নতি
সেই মন যদি কবিসভাসমাবেশ
এইসবে যায়, তাহলে জানবে কবে?
যোগাযোগ করে নামটি ছাপিয়ে কবি?
তা হবে হয়তো হয়তো। কিন্তু আসল কাজ?
মন দিয়ে লেখা। সেই মনটাই যদি
নাম, খ্যাতি আর প্রকাশকে পুড়ে যায়
লেখার কী হবে? লেখাটি কোথায় যাবে?
চরিত্র ওঠে, চরিত্র উঠে গিয়ে
ঝিলে পা ছোঁয়ায়, পা দিয়ে নাড়ায় জল
নিচে নিচে গেঁড়ি গুগলি শ্যাওলা ঝাঁঝি
আরও নিচে জল, কালচে সবুজ রং
সাপের মতন বাঁকা বাঁকা লতাগাছ
জলনিম্নেই সামান্যতম দুলছে
ঠিক এসময় ভারী একঝাঁক মেঘ
পিঠ দিয়ে খোলা রোদুর ঢেকে দিলো
হাওয়াও আবার ধেয়ে আসে ভিজে, ঠাণ্ডা
যে কোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে
আজ ঊনতিরিশ। খাতাটা কিনেছে কাল
তিনটে কবিতা কপিও করেছে রাত্রে
আর না, এবার যখন যেমন আসবে
লিখবে তেমন। হারিয়ে যায় তো যাক।
ভাবতে ভাবতে সাইকেল তুলে নিয়ে
চরিত্র চলে, বাগানের গেট ঠেলে
রাস্তায় আসে, ভাবে সে খাতাটা থাক
খাতায় ওঠানো খারাপ তো কিছু নয়
ভালো অভ্যেস। কিন্তু ওই যে বন্ধু
বুঝিয়ে দিয়েছে খাতাটাই কেরিয়ার
এরপর আর মন যাচ্ছে না ওতে
তার চেয়ে নয় ঘরে বসে লিখে যাবো
পাঠাবো ডাকেই, যদি ছাপা হয় হবে
সভাসমিতিতে না আর কখনও নয়
ভিড়ের ভেতরে ভিড়ব না আমি আর
তাতে যদি নাম না হয় তো না-ই হবে
প্রশংসা ভাল। টাকাপয়সাও ভালো
কিন্তু অত যে অতিথি-অভ্যাগত
অত সভ্যের সামনে নিজের লেখা
পড়তে গেলেই মনে হয় কী রকম
যেন বা নিজের সমস্তটাই খোলা
যেন বা নিজের শরীরে পোষাক নেই
যেন এত লোক ভালো-খারাপ কী বলে
তার জন্যেই এত কষ্টের লেখা
তার জন্যেই কুণ্ঠিত হয়ে থাকা
কী-রকম যেন দয়াভিক্ষার মতো
আর উলটো দিকে? কচিৎ দু’ একবার
সময়ের সেই সূচনাবিন্দু থেকে
একেবারে ওই সূর্যমৃত্যুকাল
যদি বা ঝলকমাত্রই দেখা যায়
যদি বা নিজেকে ভেদ করে চলে যায়
দুইদিকে খোলা চিরযাতায়াত পথ
বহু শ্রম বহু প্রাণপাত চেষ্টায়
একবার সেই যথার্থ্য্য প্রকরণ
একবার সেই শব্দছন্দ রং
পাওয়া যায় যদি, হাতে আসে একবার
সে আনন্দের তুলনা হয় কী আর?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হালকা লাগে
কলকাতা থেকে ফিরে আসবার পর
কী একটা ভার সে বয়ে বেড়াচ্ছিলো
নাম যশ নিয়ে, চেনা পরিচয় নিয়ে?
ঝাঁকি দিয়ে সব কাঁধ থেকে ফেলে দেয়
আজ কী স্বাধীন, আজ সে নিজেকে বলে :
আমি আর লেখা। লেখা আর আমি। এই
একটাই পথ, কোনো বিকল্প নেই।
ভাবতে ভাবতে মাটির পথটি ছেড়ে
সে এসে আবার বড় রাস্তায় ওঠে
চরিত্র বলে : ‘সাইকেল, চলো বাড়ি!’

আমরা এই অব্দি এসে কী দেখছি পাঠক?
দেখছি, চরিত্রের বাছা খুলে গেছে চোখ
সে পেয়েছে দিব্যজ্ঞান, যা দুর্বলে পায়
সে ভাবছে কেন মরতে যাব কলকাতায়?
সে বাড়িতে লিখে যাবে, নাম না করুক !
লোকসামনে গেলে তার বক্ষ ধুকধুক
সেকালে ইস্কুলশিশু ছিল না অনেকে?
বাড়িতে মাস্টার রেখে অজো আমো লেখে !
কোন ইস্কুলে পড় খোকা? না, বাড়িতে পড়ি!
এ হলো সেই জিনিস। যদি প্রশ্ন করি
তবে কথা বেড়ে যাবে, চরিত্রও জ্ঞান
দিয়ে দেবে বহু কিছু, বিজ্ঞান-ফিজ্ঞান !
কী দরকার? সে থাকুক নিজের মতই
আমরা দেখি আমাদের গল্প গেল কই?
গল্পটি এগিয়ে গেছে একমাস আরো
ঘটেনি বিশেষ কিছু ধরে নিতে পারো।
বর্ষা আরো বেড়ে গেছে কয়েকদিন ধরে
কেবল ঝিরঝির, রোদ অবরে সবরে
চরিত্র বন্ধুকে চলছে এড়িয়ে এখন
বন্ধু বলে গেছে : পরে বুঝবে বাছাধন!
এবার গল্পটি এসে যেথা ল্যান্ড করে
সেখানে চরিত্র ফিরছে সন্ধেবেলা ঘরে
নিজ গলিমুখে পৌঁছে অবাক দ্যাখে সে
পিসিও গলির মুখে দাঁড়িয়েছে এসে
‘কী হল? এখানে?’ পিসি বলে : ‘তোর কাছে
দুটো মেয়ে অনেকক্ষণ এসে বসে আছে’
‘মেয়ে ! দুটো? কোথাকার?’ —‘কলকাতা থেকে
এসেছে, শিক্ষিত খুব মনে হচ্ছে দেখে
বয়েস তোদেরই মতো, কিছু ছোটবড়
জিগ্যেস করেছি যেই, তোমরা কিসে পড়ো?
একটা বলে পাস করেছি, একটা বলে পড়ি
এখানে কী করতে এল, আমি ভেবে মরি।’
—‘চলো, দেখি…’— ‘দাঁড়া আগে। বাজার নি’আয়।’
—‘বাজার কী হবে?’—‘ওরা রাতে থাকতে চায়।’
—‘সে কী গো?’ —‘হ্যাঁ। এই বৃষ্টি-বাদল মাথায়—
দুটো মেয়ে… সন্ধেবেলা যেতে দেওয়া যায়?
তোর দিদিকে বলছিল…’— ‘দিদি আছে বাড়ি?’
—‘হ্যাঁ, আজ অফিস থেকে এল তাড়াতাড়ি।
ওরা নাকি এক গাড়িতে এসেছে সবাই
তোর দিদিকে চিনত না তো, কথা হয়নি তাই।
বাড়ি এসে হল।’ —‘ওরা কী বলছে দিদিকে?’
—‘বলছিল, হোটেল কিছু আছে কি এদিকে?
রাতে গিয়ে থাকবে, ভাবলে রাগ ধরে যায়।’
—‘হোটেল? থাকবার মতো এখানে কোথায়?’
—‘তাই তো বললাম আমরা। তা তোর কাছে কী
দরকার…’ —‘কী আনতে হবে জলদি দাও দেখি !’
—‘মাছ আর চারটে ডিম। এক কেজি পটলও
আনিস’—‘যা আমি চাই না, তাই করতে হল
সন্ধেবেলা মাছবাজারে প্যাচপ্যাচে কাদা’…
‘আর হ্যাঁ। পেঁয়াজ পাঁচশো। আর একটু আদা…’
‘সকালে বাজার হয় না’, —‘হবেটা কী করে
বাড়ির ছেলেই যদি বাইরে বাইরে ঘোরে !…
আরে ! ছাতাটা তো নিবি ! আর একটু মিষ্টিও
আনিস, তোর পয়সা থেকে’… ‘পরে দিয়ে দিও’…
চরিত্র এরপর ঘোরে মাছের বাজারে
ভেবে পায় না কারা এল? কারা আসতে পারে?

সত্যি কারা এল আর কী কী ঘটল তারই বিবরণ
এবারে চলেছি বলতে, হে পাঠক, রেডিস্টেডি হোন।
চরিত্রের ঝোলাসহ বাড়িতে প্রবেশ, হাতে ছাতা
পিসি ‘ওমা ওমা’ বলল, দিদি বলল, ‘মুছে ফ্যাল মাথা’
চরিত্র ‘ঠিক আছে’ বলে গামছা হাতে ঢুকল সেই ঘরে
যে ঘরে তরুণী দুটি অতি-আবছা নমস্কার করে
অতি আবছা, কারণ হলো, মুখ দেখা যাচ্ছেই না প্রায়
এক্ষুনি বিদ্যুৎ গেছে… দিদি ঘরে আলো রেখে যায়।
সে আলো সামান্য অতি, টেবিলের কোণে রাখা মোম
তাকে শুধু ঝাপসামতো দেখা যাচ্ছে, যে ব’সে প্রথম।
পশ্চাতে একজন বসে, জানালার সম্মুখ চেয়ারে
বৃষ্টি তাই সব বন্ধ, বইপত্র ভিজে যেতে পারে।
প্রথমা দাঁড়িয়ে নাম জানিয়েছে, লম্বা রোগাপানা।
সে বলল, ‘আমার নাম হয়ত আপনার আগে জানা।
‘নিশি-পত্র সম্পাদনা করি আমি। আপনার কাছে
লেখাও নিয়েছি।’ —‘হ্যাঁ হ্যাঁ চিঠিপত্রে যোগাযোগ আছে’।
—‘এ হল আমার বন্ধু, এম-এ ছাত্রী, আপনার রচনা
এ বিশেষ পাঠ করে, মানে ফ্যান, আচ্ছা বলব না’…
—‘ও আসলে’— ‘না মানে কি… আচ্ছা আচ্ছা আপনিও লেখেন।’
—‘না লিখতে পারি না।’ কণ্ঠ মিষ্ট বড়—‘আমাদের ট্রেন
সম্পাদিকা বলে চলে, ‘খুব লেট করল, ততক্ষণ
আমরা তো আপনার বই-ই পড়ছিলাম, কোন
বইতে ওই লেখাটা আছে? যেটা সেই আমার কাগজে
ছাপা হয়েছিল?’ এরা সত্যি কাব্য বোঝে?
চরিত্রটি হতবাক : ‘না মানে আমার মাত্র ওই
একটাই তো সংকলন।’—‘মানে?’ সম্পাদিকা বলে, বই
আর নেই আপনার?’ সে কি? তবে যে আমাকে একটা ছেলে
বলল যে নতুন বইটা এনে দেবে কলেজ স্ট্রিট গেলে !’
—‘আর আমি তো একদিন সারা কলেজ স্ট্রিট খুঁজে খুঁজে…’
কথা শেষ না করেই থেমেছে দ্বিতীয়া। চোখ বুজে
শুনলে মনে হবে যেন কত কত দূর থেকে গলা
ভেসে আসছে, আর তাই চরিত্রের শ্রীচৌষট্টিকলা
যেন একলাফে জাগল। ভো চরিত্র ! স্তম্ভিত আরোই !
একটি মেয়ে খুঁজে ফিরছে, ওহো, তব না-বেরোনো বই !
চা নিয়ে ঢুকেছে দিদি : ‘কতো কষ্ট করে এ দুজন
এসেছে তা শুনেছিস তো!’ —‘না শুনিনি!’ —‘সে কী এতক্ষণ
শুনিসনি?’—‘বলিনি আর কি! আমরা, মানে ওঁর ঠিকানা তো
ছিলই আমার কাছে…’ —‘না, খাবো না’ —‘শিগ্রি হাত পাতো!’
দিদি বলছে পাঠিকাকে। সম্পাদিকা বলে : ‘না আমার
মিষ্টিতে আপত্তি নেই। মাসখানেক আগে একবার
ভেবেও ছিলাম আসব। ও-ই বলতো। কিন্তু তারপর
বাড়ি থেকে আমরা সব বেড়াতে গেলাম জামনগর।
তাই এত দেরি হলো। আজকে তো, বললাম যে ট্রেন লেট
তা-তে বৃষ্টি। কিন্তু আমরা আসবো তো আসবই… না না পেট
পুরো ভর্তি, পারবো না তো।’ —‘ঠিক পারবে, বয়স তো এইটুকু !’
—‘না আমরা যথেষ্ট বড়। দেখতে ছোট লাগে।’— দুই খুকু
মিষ্ট প্রতিবাদ করে। দিদি বলে, ‘আচ্ছা বেশ তাই।
ওরা এত কষ্ট করে কেন এল, শুনেছিস তো, ভাই?’
ভাই বলে : ‘না শুনিনি।’ —‘আমরাই বলিনি আরকি !’—‘তবে
বলে ফ্যালো’, দিদি বলে, ‘তোকে কিন্তু রাজি হতে হবে’
বলে দিদি চলে যায়। —‘রাজি মানে?’ সম্পাদিকা বলে :
‘ওঁকে বলছিলাম, আপনি ছিলেন না তো। শুধু কৌতূহলে
এতটা আসিনি কিন্তু।’ কৌতূহল? আমার বিষয়ে
মেয়েদের কৌতূহল, শহরের মেয়ে? ভাবলে ভয়ে
পেটে গুড়গুড় করে। চরিত্র থমকায়, ‘কী ব্যাপার
বুঝিয়ে বলুন একটু।’ সম্পাদিকা বলে : ‘একবার
আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে চাই।’ —‘আমাকে? কোথায়?’
—‘কলেজে।’ —‘কোথায় সেটা?’—‘কেন কলকাতায়।’
—‘কলকাতায়?’
—‘আমরা আপনার লেখা শুনতে চাই অনেকক্ষণ ধরে’
—‘না। আমি চাই না। কিছু মনে করবেন না দয়া করে’
ব্যাস, সারা ঘর স্তব্ধ। কারও কোনো কথা নেই আর।
বহুক্ষণ পরে ক্ষীণ : ‘কিন্তু, কেন?’ কণ্ঠ দ্বিতীয়ার।
পুনশ্চ চৌষট্টিকলা ধ্রিনা ধ্রিন কেঁপেছে গোপনে
এমন অপূর্ব বস্তু কে শোনে কে সারাক্ষণ শোনে!
চরিত্র দুর্বল হয়ে পড়ল কিন্তু জানান দিল না
‘হ্যাঁ, আমি ঠিক করেছি এইসব সভা-আলোচনা
পরিহার করে চলবো। গিয়ে পড়লে এমন সভায়
কী-বা লাভ হবে যদি কেউ কিছু শুনতেই না পায় !’
—‘এমন বলছেন কেন!’ সেই কণ্ঠ ! অসহ্য মিনতি !
—‘বলছি অভিজ্ঞতা থেকে, কারণ আমি খুবই সম্প্রতি
এমন এক সভাকক্ষে কবিতাপড়ার পর দেখি
কেউ কিছু শুনতে পায়নি ! উঠে গেছে !…’—‘কী বলছেন, এ কী!’
এবার সে মোহকণ্ঠ যতটা সম্ভব আর্তনাদে
পৌঁছে যায়, সর্ব স্বর সহায় হারানো সুর বাঁধে
—‘এমন বলছেন কেন?’ আমি ওই সভায় ছিলাম !
আমি তো শুনেছি। আমরা, স্পষ্টই শুনেছি, স্বরগ্রাম
আপনার নিচুই একটু… তাই বলে? সত্যি ! এ কী ! ছি ছি..’
সম্পাদিকা বলে : ‘ও তো পরদিনই বলেছে… মিছিমিছি
আপনি অত ভাবছেন…’ একবারে অতটা আর্তি শুনে
চরিত্র দাঁড়িয়ে গ্যাছে একশো চৌষট্টি পাপড়ি গুনে
অথচ দ্যাখেনি মুখ, তখনো সে মুখ অন্ধকারে
মোম জ্ব’লে অর্ধ হলো। লম্বা ছায়া নড়ে চারিধারে।
আবার পাঠিকা বলে, মোহতীব্র মোহক্ষীণ স্বর—
‘সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন আমার প্রফেসর
তিনিও সমান মুগ্ধ ! সকালের স্টেটসম্যান দেখে
বাড়ি থেকে ফোন করে আমাকে নিলেন সঙ্গে ডেকে
আপনার কবিতা শুনতে’… স্টেটসম্যানে দিয়েছিল নাকি?
দিনের এনগেজমেন্টে? আহ্বায়ক কিছু আর বাকি
রাখলেন না। ভদ্রলোক সত্যি সত্যি নতুন কবিকে
অগ্রসর করে দিতে চান তার পাঠকের দিকে
না ওঁকে এবার সত্যি লিখে ফেলতে হবে একটা চিঠি
উনি যেন না ভাবেন অকৃতজ্ঞ নতুন কবিটি !
সম্পাদিকা বলে, ‘আপনি চলুন না ! কোনো অসম্মান
হবে না, অন্তত এসে নিজেই একবার দেখে যান’
চরিত্র লজ্জায় পড়ে, ‘না আসলে, অসম্মান নয়
নিজেরই অপারগতা। দ্বিধা, কিংবা, ঠিক বললে, ভয়।
সেদিন কবিতা পড়ে যখন ফেরত আসছি সিটে
অমনি, “পড়ে রইল যে”—কে একটা বিদ্রূপ ছুঁড়ল পিঠে।
ঘুরে দেখি, সত্যি সত্যি’ (কে আছে তোমার মতো বোকা?
টুলের তলায় খাচ্ছে লুটোপুটি কাব্য এক থোকা।)
‘না, বিদ্রূপ কেন হবে?’ —‘ও-ই তো বিদ্রূপ, হুলফোটা’
—‘কখনো না। আমি জানি। আমিই বলেছিলাম ওটা !
দেখলাম যে পড়ে আছে। হয়তো হারিয়েই যাবে সব
কী করে চুপ করে থাকব, চুপ করে থাকা কি সম্ভব?’
—‘আপনি?’ —‘আমি’ —‘আপনি?’ —‘হ্যাঁ,
এখনও কি বিশ্বাস হচ্ছে না?’
কী বিশ্বাস-অবিশ্বাস ! চরিত্র দেখছে যে কে অচেনা
কোথাকার মেয়ে এসে বসে আছে ছ’হাত তফাতে
যার কিচ্ছু জানা নেই, মোমবাতির ছায়া ছায়া হাতে
মুখটাও আড়াল করা ! এ কে? মেয়ে এলো কোথা থেকে?
হে চরিত্র, ধ্বসে যাচ্ছো এমনকি মুখটাও না দেখে !
সম্পাদিকা বলে : ‘আচ্ছা। আপনি যদি না-ই যেতে চান
জোর করব না। কিন্তু আমাদের কবিতা শোনান।’
—‘কবিতা? এখন? মানে?’— ‘হ্যাঁ আমরা কবিতা শুনতে চাই’
মোহমন্ত্রস্বর বলে : ‘না শুনে কী করে ফিরে যাই?
সামনে গিয়ে আলো ধরব?’—‘না থাক। চরিত্র আঁতকে ওঠে !
থাক, অন্ধকার থাক। অন্ধকারে দেবীপুষ্প ফোটে !
বাইরে বৃষ্টি জোর হয়। ছাদ থেকে দু’চার ফোঁটা পড়ে
মোমবাতিটা হেলে যাচ্ছে, চরিত্র কবিতা শুরু করে…
কাগজে বসাই তবে অনুবাবু। আরো একবার ঐ আধমরা
গাছের তলা থেকে
তোমাকে বসাই এসো সাদা কাগজের মধ্যে। সবটা
না হোক, অন্তত হাঁটার ভঙ্গি, কিংবা ওই হাত নেড়ে বারণ করাটা
বসাতে সম্মতি দাও। চুপচাপ দুপুর চলছে। মাসীমা কি শুয়েছেন?
চমকে দেব, উঠে যাচ্ছি সিঁড়ি দিয়ে, হঠাৎ খুপরিতে
পায়রা ঝটপট করল, খুব নিচু ভলমে রেডিও, মাখা ময়দা স্কুপ করে
রেখেছো একপাশে, অনুবাবু, সারামুখে ঘাম!
তাহলে ঘামের ফোঁটা বসিয়ে দি এইখানে? বসিয়ে দি মিন্টু আর
ঝুমুকে স্টেশন থেকে টা টা?
বাস থেকে নামার পর হোঁচট বা চটি ছেঁড়া? বসাই চায়ের ভাঁড়?
নোনতা বিস্কুটগুলো বাজে?
না দিগন্ত বসাব না, মেঘ নয়, ধানক্ষেত পড়ে থাক বাঁয়ে
বরং দাঁত উঁচু লোকটা—যে প্রায় আকাশে চড়ে আমাদের তিনটে নারকেল
পেড়ে দিল ঝুপঝাপ, তাকে লিখি, যে বউটি মুড়ি দিল কাঁসারবাটিতে
নিয়ে আসি তাকেও— কিন্তু ‘অতগুলো খেতেই পারবো না’
এই ‘খেতেই’ বলবার টান আনতে পারছি না কিছুতেই। মাথা
হেলিয়ে দাঁড়ানো টিউকলে
ঝুঁকে জল খাওয়া আর চটিতে সেফটিপিন, পিনফুটে আঙুলে রক্ত,
সাবধানে শুষে নেওয়া চুনি…
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাত্রে যেতে যেতে একদিন
জন্তুর শরীরে গুলে ঢুকে গেছে; সবসময় ঝরে পুঁজ;
অথচ সে উঠে যাচ্ছে
সিঁড়ি দিয়ে, চমকে দেবে, বাড়িতে কেউ নেই,
ছাদ থেকে আলো এসে সমুখে পড়েছে অল্প। দরজা কি এখনো খোলা?
অনুবাবু, অনু, বুকের ঢেউদুটি এত ছোটো!
শ্বাস দিয়ে বাজিয়েছি ঐ শাঁখ, আর চুল মুঠো করে রেখেছিল ততক্ষণ
রোগা রোগা ফরসা আঙ্গুলেরা
তাতে অল্প নখ—না, না, এসব না। আজ এই
আধমরা গাছের তলা থেকে
বসাই পরীক্ষা সামনে, চোখে কালি, হনু জেগে উঠেছে দু-গালে
বসাই পেন্সিল দিয়ে কপালের ঝুরো চুল সরানো—বসাই
কাগজে সবশেষে এক স্নানহারা জন্তুর ক্ষত, রক্তে লাল-হওয়া
জল আর ভোরবেলা
সকলে জাগার আগে লোকালয় ছেড়ে
নিঃশব্দ পালানো তার লিপিবদ্ধ করে রাখি,
অনুবাবু, যদি পারো প’ড়ো খুঁজে নিয়ে…
সমস্ত একটানা ব’লে, নিচুস্বরে, যতিচিহ্নে থেমে
সে পাঠ সম্পূর্ণ করে, দেখে যে কপাল গেছে ঘেমে
দুই কন্যা বসে আছে—কেউ আর বলছেই না কিছু
ক্ষীণ আলোয় বোঝা যাচ্ছে আগুপিছু মুখশশী নিচু
মেনিটা শীতকাতর, গুটিসুটি শুয়ে পড়ল কোলে
মোমটা দপ করে নেভে। চরিত্র, ‘মোমবাতি আনছি’ বলে
উঠতে যায়, সম্পাদিকা বলে, ‘থাক না। থাক অন্ধকার’
— ‘আচ্ছা বেশ থাক তবে।’ — ‘এটা কবে লেখা আপনার?’
সম্পাদিকা প্রশ্ন করে। ‘এই কদিন আগেই তো লিখলাম’
— ‘কোথাও কি দিয়েছেন? —না দিইনি তো।’ — ‘এটার কি নাম?’
— ‘অনুবাবু।’—’যদি দেন আমাদের কাগজে ছাপাব।’
— ‘পাণ্ডুলিপি আছে এর? যদি থাকে আমি ওটা পাব?’
এই আর্জি পাঠিকার। এই গলাটা কী যে করছে তাকে!
— ‘লেখার কাগজ কি আছে? দেখতে হবে।’ ‘যদি ওটা থাকে
আমাকে দেবেন তো আপনি।’ — ‘হ্যাঁ নেবেন। কি আশ্চর্য!’ ‘তাতে
অসুবিধে হবে না তো?’— ‘দেখুন কাগজপত্র হাতে
থাকে না, হারিয়ে যায়। আবার নতুন করে লিখি।’
— ‘কবিতা? হারিয়ে যায়!’ (মেয়ের রকম দেখ দিকি!’)
সব যাক, চলে যাক, ভেসে যাক, এইকণ্ঠ শুনে।
কবিতা, সেটাও যাক। নাক যাক। হৃদয়, নরুনে।
কী তীব্র নরম স্পর্শ গানের অধিক টানছে কথা
গা দিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে কী যেন মঙ্গেশকর লতা।
— ‘আচ্ছা একটা কথা বলবো? কিছু মনে করবেন না? ঠিক?’
— ‘না। বলুন।’ (মন যদি মনে করে সেই মনকে ১০৮ ধিক্‌)
— ‘অনুবাবু, নাম। মানে?’ সম্পাদিকা ক্রুদ্ধ! ‘সে কী! মানে?
কবিতার কি মানে হয়?’ (এ দেখি অনেক কিছু জানে)
পাঠিকা লজ্জিত — ‘না না আমি বলছি অনুবাবু বলে
সত্যি কেউ আছে?’ ব্যস! বল অমনি চরিত্রের গোলে।
— ‘না, মানে, হ্যাঁ, ও, তা হবে, হুঁ না হুঁ না’ করে
চরিত্র পালিয়ে বাঁচে… ‘অনুবাবু আপনার বান্ধবী?’
সম্পাদিকা বাধা দেয়— ‘এই প্রশ্ন শুনতে কিন্তু কবি
বাধ্য নন।’ (হো হো ওগো বালিকারা আমি শুনতে চাই
আমাকে এমন প্রশ্ন করবার তো আজও কেউ নাই)
— ‘ও আচ্ছা দুঃখিত’ বলে পাঠিকা থমকায়। সম্পাদিকা
বলে, ‘পরে এই নিয়ে গবেষকরা টীকা লিখবে, টীকা!’
— ‘সত্যি যদি লেখে তবে কবিসাক্ষ্য মানবো না তখন?’
(কি জানো পণ্ডিতদিদি অনুবাবু আসলে দুজন!)
জনান্তিকে হাহাকার করে কবি আর কেহ না শোনে
অন্যদিকে তর্কে মেতে ওঠে সদ্যবিদুষী দুজনে।
মেয়েটি গাছের কাঁধে ভর দিয়ে। নাম অনুরাধা।
দেখিনি। শুনেছি মাত্র। ছবি তুলল কলেজের দাদা।
হাতে পড়ল সেই ছবি। একটি গাছ একটি মেয়ে তাতে।
দু এক ঝলক দেখে ফেরত দিই প্রেমিকের হাতে।
সামনের বাড়িতে একটা মেয়ে আসতো। বাবু ডাক নাম।
ভাল নাম জানা নেই। দুয়ে মিলে কবিতা লিখলাম।
বান্ধবী তো নয়ই। নেই কারো সঙ্গে মুখেরও আলাপ
যা কিছু পড়েছ তোমরা সবই শুধু সত্য অপলাপ।
যা লিখি সকলই মিথ্যা যত কাণ্ড সমস্ত বানানো
ও মেয়ে, নতুন এলে, তুমি আর কতটুকু জানো
মেয়েরা আসেনি কেউ। লজ্জা পাই সে কথা স্বীকারে
শুধু আগে দেখতাম খাতা হাতে কলেজের ধারে
কিংবা পোস্টাফিস মোড়ে নিচু মুখে যেত একজন
কোনদিন কথা হয়নি। তাকে আর দেখি না এখন
মন মুখ পৃথক করা হাহাকারে চরিত্র চাপড়ায়
যেইক্ষণে নিজবক্ষ, অমনি দিদি ডাকতে এসে যায়
‘তোমরা সব খাবে চলো! এই ভাই তুই আগে চল্‌ …’
তখনি বিদ্যুৎ আসে, সারাঘর আলো ঝলমল।
সবাই হৈ হৈ করল। দিদি বলে শান্তি এইবারে
ছ ঘণ্টা ছিল না আজকে। চরিত্রটি তাকাতে না পারে।
কী জানি কেমন মুখ, যা হবার তো হয়ে গেছে আগে
মুখ দেখা বাকি আছে, তেঁই ধাক্কা হৃদ্‌পদ্মে লাগে।
সবাই অবাক দেখছে সারা ঘর ছড়ানো কাগজ
দিদি বলে, ‘দেখ তোমরা, এর মধ্যে রোজই খোঁজ-খোঁজ
খড়ের গাদায় ছুঁচ, আমি তো এইজন্য ওকে বকি।’
পাঠিকা বিনম্র বলে ‘আমি একটু গুছিয়ে দেব কি?’
এই কথা শুনে মেঘে মুহুর্মুহু চরিত্র চমকায়
এ মেয়ে কোথায় থাকে? এ পাঠিকা কোথা বহে যায়?
সে দেখে আধেক চোখে ফর্সা হাত সুচারু আঙুল
মাটি থেকে লেখা তুলে যত্নে ঝাড়ে ধুলো আর ঝুল
এই এতক্ষণে যেন, ধকোধকো, সে সাহস ক’রে
পূর্ণ পাঠিকার দিকে তাকায় সম্পূর্ণ চোখ ভ’রে!
দেখে যে গৌরাঙ্গি তার আধবসা চোখের নিচে কালো
ছায়া ঘিরে আছে দীঘি, দু দণ্ড জিরিয়ে গেলে ভালো
খাড়া নাক, চাপা চোখ, টানা চুল, শরীর ছিপ্‌ছিপে
সাধারণ শাড়িজামা, প্রসাধন মাত্র লম্বা টিপে
তবু যেন কোথা থেকে চিবুকের নিচে একটি তিল
অকাট্য প্রমাণ সহ বিউটিসাক্ষ্য করেছে দাখিল!
অপর মেয়েটি সেও ঝাড়া ঝাপটা সালোয়ার কামিজে
কেমন মেঘলা দেখতে! চশমাপারে দৃষ্টি ভিজে ভিজে
গড়ন, বলেছি আগে, শ্যামলিম, লম্বা রোগাপানা।
নাসিকা ঈষৎ বোঁচা, মায়াময় চক্ষু টানা টানা।
বর্ষার দুপুর যেন কিন্তু বাক্য কিছু খরতর।
পিসি বলল ‘তোমরা বুঝি এর মতো লেখাটেখা করো?’
‘না আমি না। আমি নই।’ পাঠিকা আপত্তি করে, আর
দিদি আসে, তুলে দেয়, হাতে হাতে রাতের খাবার।
খেতে খেতে আড্ডা জমে। কথা চলে। দিদি ও পিসিমা
বলে ভাই ভাইপোর কুঁড়েমির নেই কোন সীমা
ও তাই হ্যাঁ তাই নাকি এইসব হয় বহুবিধ
কথক বলেন, ওগো পঞ্চশর বুঝেশুনে বিঁধো
কবির তো অবস্থা দেখছ! (তাতে আমরা পাঁচজনে কী করি?)
এতটা যা হ’ল তাকে কী উপায়ে উল্টো ক’রে ধরি
এই যে পাঠিকা এর চোখদুটি জানে না বিদ্যুৎ
চরিত্রটি অন্যমন খুঁজে পায় না পাঠিকার খুঁত
পাঠিকা যখন হাসে চোখ তার হাসে না কিছুতে
এ মুহূর্তে খেয়ে উঠে বারান্দায় হাত ধুতে ধুতে
জানা গেল ওরা যাচ্ছে বেড়াতে। প্রত্যেকবার যায়।
‘এইবার কোনদিকে?’ ‘গঙ্গোত্রি ও অলকানন্দায়।’
— ‘অতদূর?’ —’অতদূরই। কাছাকাছি গেলে থ্রিল নেই
ছবি তুলব, ওর আবার সবচাইতে থ্রিল ছবিতেই।’
— ‘কবে স্টার্ট করছেন?’ ‘দেরি আছে। অগস্টের শেষে।’
‘আপনিও চলুন না?’ ‘আমি?’ পুনশ্চ টায়ার গেছে ফেঁসে!
চরিত্র আহ্বান বুঝল। ভুল কিংবা ঠিক সেটা পরে।
আপাতত দেখা যাক এ তিনজন আর কী কী করে
এর দৌড় বোঝা গেছে বাদ দাও হা হা হা হি হি তো
বহু হ’ল বলো দেখি গল্পে আর কি আছে নিহিত
আর একটু সবুর করো। এ গল্প অনেকদূর যাবে।
এ দুটি দারুণ মেয়ে। ছাত থেকে ফেললে ড্রপ্‌ খাবে!
এ বয়সের ছেলেমেয়ে! এরা চলছে এত রেখেঢেকে?
নিজেদের মধ্যে আপনি ব’লে যাচ্ছে সেই কখন থেকে।
এরা তুমি বলবে না? নাই যদি বলে ক্ষতি কিসে?
তাহলে তোমার গল্প নিয়ে বাপু তুমি খোঁজো দিশে
আমরা সব কেটে পড়ছি। গল্পের বানের জলে ভেসে
পুনরায় দিদি ঢুকল— ‘বিছনা হয়ে গেছে, তোমরা এসে
শুয়ে পড়ো, ক’টা বাজে তা জানিস? একটা চল্লিশ!
তুই এতক্ষণ কেন ওদের জাগিয়ে রেখেছিস?’
চরিত্র ওদের দিকে একটি বিষাদসিন্ধু হাসি
উপহার দিল, ‘আচ্ছা।’ ‘শুয়ে পড়ুন।’ ‘গুডনাইট’। ‘আসি।’
পরদিন ভোর ভোর তিনজনে স্টেশনে পৌঁছল
সম্পাদিকা বলে ‘সত্যি এসে একটা অভিজ্ঞতা হ’ল’
আবার আসবেন তো ব’লে চরিত্র কাতরমুখে চায়
আসব সম্পাদিকা বলে। পাঠিকা ভ্যানিটি হাতড়ায়।
কাগজ প্রকাশ পায় ব্যাগ থেকে, ময়লা, ছেঁড়াখোঁড়া
অনুবাবু লেখাটার পাণ্ডুলিপি। এটা ছাপবে ওরা
— ‘আমি এটা রেখে দিচ্ছি।’ ‘হ্যাঁ নিন্ না। ওটার বিষয়ে
আমার আগ্রহ নেই!’ ‘আমার আছে।’ ব’লে চক্ষুদ্বয়ে
পূর্ণমেঘ নিয়ে বলে— ‘সত্যি আপনি যাবেন না তাহলে?’
প্রায় ‘যাব’ ব’লে ফেলতে যাচ্ছে আর সম্পাদিকা বলে
‘কলেজে না গিয়ে যদি আপনি আমাদের বাড়িতেই
কবিতা পড়েন। তবে? তবে তো আপত্তি কিছু নেই?’
‘না নেই’ সে ব’লে ফেলে, ব’লে ফেলতে পেরে যেন বাঁচে
এভাবে কবিতা শুনতে কে চেয়েছে কবে তার কাছে?
কেবল এজন্য তার এ জীবন এ যৌবন—অ্যাল!
মনে মনে জিভ কেটে কবিপ্রাণ তাকায় ফ্যালফ্যাল।
মেয়েদুটি নেচে ওঠে সাফল্যে ফুর্তিতে ঝরঝন
‘আমরাই খবর দেব তার আগে সমস্ত আয়োজন
করে ফেলি। কলেজেরও যা কিছু ঝামেলা মিটে যাক’
‘কবে মিটবে?’ কবি বলে। কবির মাথায় তীর্থকাক।
কী তীর্থ? পাঠিকা তীর্থ। কে কাক? না কাব্যের বায়স।
ইনি তো কঙ্কালবুদ্ধ উনি তার সুজাতাপায়স।
মেয়ে দুটি কথাব্যস্ত চলছে খুব দিন ভাবাভাবি
সম্পাদিকা বলে ‘তুই আজকেও কি স্যারের বাড়ি যাবি?’
পাঠিকার মুখ যেন কীরকম বদলে যায়: ‘আজ?
আজই তো স্যারের সঙ্গে বাকি আছে নানা সব কাজ’
বলতে বলতে গাড়ি ঢোকে, সামনে এসে থেমে যায় ট্রেন
চরিত্র স্খলিত হয়, পুনঃ বলে আবার আসবেন
ওরা দ্রুত উঠে পড়ে সম্পাদিকা জায়গা নিয়ে বসে
পাঠিকা দরজায় এসে দাঁড়ায় এবং ভাগ্যদোষে
একমিনিটও লেট করে না আজ ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়ে
আর আমরা দেখতে পাই, যতক্ষণ দেখা যায়, কবি ও পাঠিকা
হাত নাড়ে।

যেই ট্রেন চ’লে গেল ঘুরে গেল বাঁকে
কবি অমনি হেথাহোথা পেন চাইতে থাকে
চায়ের দোকান থেকে পানের দোকান
পানের দোকান বলে মালঘরে যান
শেষে এক ভেণ্ডারের কলমটি পায়
পাওয়ামাত্র নেমে পড়ে কাগজভিক্ষায়
ফিল্টার উইল্‌স্ কিংবা চারমিনার প্লেন
যা পারিস ওরে কবি যা পাচ্ছিস কেন্
ভুলে গেছে মানিব্যাগ পকেটটি ফাঁকা
এতকাল ধরে শুধু টাকা মাটি টাকা।
কাগজ যে ফেলে দাও কথায় কথায়
এখন কাগজটুকরো পাবেটা কোথায়?
ভেণ্ডারটি তাড়া দিল পেন ফেরত দিতে
কেননা সে চলে যাবে পরের গাড়িতে
জয় মা চেকারবাবু শেষ ক্যাপস্টান
ধরিয়ে প্যাকেটখানি ছুঁড়ে দিয়ে যান
লাফিয়ে কুড়ায় কবি, কবিটি মরিয়া
হৃদয়ে সাগর, সিন্ধু, সমুদ্র, দরিয়া
অতএব আমরা তাকে দেখি বেঞ্চিকোণে
ঝুঁকে কিছু লিখে যাচ্ছে অতি একমনে
উঁকি মেরে দেখি চলো গুটিগুটি হেঁটে
কী লেখে কী লেখে কবি সিগ্রেট প্যাকেটে

সিগ্রেট প্যাকেটে যা লেখা

হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে
অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা, পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো।
করেছো অতল; করেছিলে; প’ড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল—ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে
— ‘পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকত—সে-লেখা তুলবে ব’লে
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।

—সে কেমন? রাজপুত্তুর?
—কী ভালো! অসাধারণ!
—তাই নাকি? কী বলল সে?
—মুখে তার বলবে কেন?
তাকালেই সব বোঝা যায়!
—তাই বুঝি? কী বোঝা যায়?
—কী কবি! তুলনা নেই!
সারাঘর উড়ছে কাগজ
কোলে এসে বেড়াল বসে
ভিজে এল। বৃষ্টিভেজা
ঝলমলে পাঞ্জাবি আর
রঙচটা পুরনো প্যান্ট
দেখলেই বুঝবে যে-কেউ
ভিতরে সকল সময়
কবিতাই ফুটছে যেন!
—তবে তো ভালই হ’ল।
পেয়ে গ্যাছো রাজপুত্তুর।
—ধ্যাৎ। সেই ঠাট্টা আবার!
—না না না। ঠাট্টা কেন?
—বুঝি রাগ হয় না আমার?
—হোক না। রাগ তো ভাল।
এইবার তোমায় নিয়ে
কবিতাই লিখবে দেখো।
—ইস্‌। তা কী সত্যি হবে?
সম্পাদিকা ও পাঠিকার আহ্বানে
চরিত্র যবে ঘরোয়া আসরে গেল
তারই কিছু আগে পাঠিকাকে ডাকযোগে
পাঠালো উপরিউক্ত কবিতাখানি
লেখা পেয়ে বুঝি পাঠিকাও বেয়াকুল।
তাকে নিয়ে কেউ কবিতা লিখতে পারে
যেন সে ভাবেনি, হেন উত্তর দিল।
তার উপর সেটি কে প্রেরণ করে
তাকে?
যে কিনা সবচে’ মনপছন্দ কবি
ফের চিঠি লিখে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক’রে।
চরিত্র এসে দাঁড়াল ঘড়ির নিচে।
মাথার উপরে ঘড়ি, তবু টেনশন
হাতঘড়ি-পরা লোককে শুধিয়ে বসে
ক’টা বাজে দাদা? লোক বলে: ‘দেখে নিন!’
পাঠিকা এলেন সামান্য দেরি করে
চরিত্র তাঁকে দেখেই তো যথারীতি
ঘাবড়ে, সামলে, হেসে, জল খেয়ে, তোতলা
‘লে-লেখায় কিছু ম-মনে করেন নি তো?
পাঠিকা বলেছে, আমি কি যোগ্য এর?
চরিত্র বলে, আমিই যোগ্য নই
পাঠিকা বলেছে, ছি ছি কী যে বলছেন
কবি বললেন কী যে বলছেন ছি ছি
কিছুক্ষণেই অবস্থা ঘুরে গিয়ে
দুজনেই শুধু: কী যে বলো, কী যে বলো…
এ অবস্থায় ফুলচন্দন পড়ে
চরিত্র আর পাঠিকার দুই মুখে
এদিকে বন্ধু ওদিকে সম্পাদিকা
দুজনে দু’ভাবে কগ্র্যাচুলেট করে
এ অবস্থায় চরিত্র ছাড়া-গরু
অথবা বামন, হাতে পেয়ে গেছে চাঁদ
কলকাতা আসে দুইদিন অন্তর
ছয়-সাতদিনে একেবারে হাবুডুবু
ওরা দ্যাখা করে প্রথমে রেলস্টেশনে
যত্রতত্র হাঁটা-পাড়া সারাদিন
চরিত্র বলে হাজার বারোশো কথা
পাঠিকা কেবল দু’ একটা— ‘তাই বুঝি?’
ফলে কী হয়েছে, এতদিনে পাঠিকার
বাড়িতে কে আছে সে বড় হয়েছে কীভাবে
কোথায় বাড়িটি, কোন অ্যাভিনিউপারে
চরিত্র এর কিচ্ছুটি জানলো না
দ্যাখা হলে শুধু পাঠিকাপ্রশ্ন এই
নতুন লিখেছ? কী করলে এ ক’দিন
এ বইটা পড়া? ও ছবিটা দ্যাখা আছে?
কী পরিচালনা! ক্যামেরার কাজও ভাল
ফলে দুইজনে ফিলিম দেখতে চলে
ফিলিম দেখায় ঘন হয়ে পাশাপাশি
বসায়, অথবা রাস্তা হাঁটতে গেলে
কখনো কখনো কাঁধে কাঁধ লেগে যায়
বাড়ি এসে লেখে, পালকে পালক লাগে
বাড়ি এসে লেখে, আগুনে কাটুক দিন
চরিত্র তবু যখনই যে ছুতো পায়
তা-তে গড়গড় আত্মজীবনী বলে
ধরো আমি এক পুরাতন বটগাছ
বা আমি একটি হতভাগা ভাঙা বাড়ি
পি. আচার্য-র রচনাবইতে বাস
তোমার মতন মেয়েকে কখনো পাবো
প্রেমিকা হিসেবে, ভাবিনি জিন্দেগীতে
—এসেছিল? রাজপুত্তুর?
—হ্যাঁ ওকে ট্রেনে তুলেই
এই সোজা আসছি। বাবা!
দেরি হল সেইজন্যেই
—কী বলে রাজপুতুর?
—যা বলে, আবাল তাবোল
অত কে ভাবতে যাবে?
রোজ ওই একই কথা
আমার আর ভাল্লাগে না!
—আহা অত বকছ কেন?
বেচারা রাজপুত্তুর!
এ কথা উঠলে পাঠিকা তৎক্ষণাৎ
দৃষ্টি সরায়, ভিন কথা পেড়ে আনে
চকিতে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়
ওরা মাঝে মাঝে সম্পাদিকার কাছে
দেখা করে আসে। সম্পাদিকাও খুব
আনন্দ করে বসায়, যত্ন করে
সম্পাদিকার বাড়িতে অন্য কেউ
নেই, একা থাকে, বাবা-মা অন্য বাড়ি
ওয়ানরুম ফ্ল্যাট, কলবাথরুম, কিচেন
সদ্য ঢুকেছে বিজ্ঞাপনের কাজে
বলে, ‘এইবার দিন ঠিক করে ফেলি?’
— ‘কীসের?’— ‘তোমার কবিতা পড়ার দিন।’
— ‘কবে হবে? ‘বলো, তোমার যেদিন খুশি।’
— ‘তোমরা না সব বেড়াতে যাচ্ছো?’— ‘না
এক বন্ধুর বাবা মারা গেছে তাই
বন্ধ হয়েছে অলকানন্দা যাওয়া’
সম্পাদিকার ঘরে ওরা মাঝে মাঝে
বসে, কথা বলে, নিরিবিলি থাকা যায়
সম্পাদিকা তো তখন অফিসে থাকে
পাঠিকার কাছে আছে একখানা চাবি
চরিত্র ফাঁকা ঘর পেয়ে একদিন
বলল: ‘তোমার হাতটা একটু ধরবো?’
‘ধরো না, অমন বলার কী আছে এতে?’
একদিন বলে, ‘চোখটা বন্ধ করো’
‘হঠাৎ?’ ‘চোখের পাতাটা একটু ছোঁবো’
‘ছোঁও।’ পাঠিকাও বসে পড়ে চোখ বুজে
চোখ ছুঁতে গিয়ে কেঁপে-টেপে একাকার
চরিত্র বলে নার্ভাসমতো হেসে
‘সত্যি আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না’
‘কীসের আবার বিশ্বাস?’ ভুরু কুঁচকে
পাঠিকা তাকায়। ‘তোমার চোখের পাতা
সত্যি সত্যি ছুঁলাম?’ — ‘পাগল ছেলে।’
পাঠিকাহাস্য বলে, ‘চলো উঠে পড়ি’
চরিত্র শোনে সম্পাদিকার কাছে
পাঠিকারা হল একবোন তিনভাই
দাদারা তো দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত
ইনি কনিষ্ঠ, আদরের ছোটবোন
এই পরিবারে সবেধন নীলমণি
পাঠিকা কখনও বলেনি বাড়িতে যেতে
ঠিকানা দিয়েছে, সম্পাদিকার ঘর
চিঠি লিখবে তো এ বাড়ির ঠিকানায়
প্রেমপত্রেও কবির কলমে ঝড়
দুজনেই পড়ে চিঠি হুটোপাটি করে
এ কথায় কবি শরমে কুঁকড়ে যায়
সম্পাদিকাটি গম্ভীর ভাবে বলে
আমি চাই না তো, জোর করে ও পড়ায়
সম্পাদিকার পত্রিকা উঠে গেছে
ঘরখানি তাই পাঠিকার অবারিত
মাঝেমধ্যেই নিজবাড়িঘর ছেড়ে
ক’দিন কাটায় সম্পাদিকার ঘরে
সেই কক্ষেই সভা আয়োজন হলো
সভা বলতে তো সব মিলে দশজন
সম্পাদিকার কবিবন্ধুরা চার
তিনজন হলো পাঠিকার সহপাঠী
আর একজন, তিনি প্রেমিকার স্যার
বলতে ভুলেছি বাড়িতে আনেনি ঠিকই
কিন্তু প্রেমিকা একদিন তাকে ধরে
নিয়ে গিয়েছিল অধ্যাপকের কাছে
ব’লে নিয়ে গেছে, উনিই দীক্ষাগুরু
কাব্য শিল্প চলচ্চিত্র সব
সবকিছুতেই ওঁর সাহায্যে রুচি
‘তোমার কথাও ওঁর কাছেই তো শোনা’
চরিত্র গিয়ে পদধূলিকণা নেয়
‘ওর গুরু মানে গুরু নন আমারও কি?’
স্যার স্মিত হেসে স্নেহাশিবাদ দ্যান:
‘পড়েছি কবিতা, অনন্যসাধারণ
মন দিয়ে লিখে যাও।’
যাই হোক সেই সফল বিকেলবেলা
ওই দশজন শ্রোতাসাক্ষাতে কবি
প্রাণভরে পড়ে পাঠিকামুগ্ধ লেখা
অভ্যাগতরা সকলেই বুঝে যায়
এই কবিতার লক্ষ্যটি কে ও কেন
পাঠিকাও খুব ‘এ আর এমন কী’
মনোভাবে করে অতিথি আপ্যায়ন
দু’ দিন আগেই হঠাৎ বৃষ্টি ভিজে
চরিত্র কিছু জ্বরজ্বরভাবে ছিল
একটা ওষুধ গিলে নিয়ে বলে, ‘যাই?’
পাঠিকা-সম্পাদিকারা বললো: ‘থাকো।
এত জ্বর নিয়ে বাড়ি যাওয়া ঠিক নয়।’
তিনজনে কিছু গল্পগাছার পরে
শুয়ে পড়ে, দু’টি বিছানায় তিনজন
একটাই ঘর, ঘর যথেষ্ট লম্বা
দুই কোণে দুটি জোড়া ও একলা খাট
একলা খাটেই চরিত্র শুয়ে পড়ে
জোড়া খাটে ওরা দু’জন
হঠাৎই যখন ঘুম ঠিক আসে আসে
কী যেন আওয়াজে তন্দ্রাটা ভেঙে যায়
ফোঁসফোঁস জোরে নিঃশ্বাসবায়ু বয়
ফিসফিসে কথা, আলত আর্তনাদ
কী ব্যাপার ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না
চরিত্র তার চোখ খুলে তাকিয়েছে
দেখা যাচ্ছে না। ঘরে তো অন্ধকার
কষ্টে সে চোখ সইয়ে সইয়ে খোলে
যা ঘটছে সেটা ঘরের অপরদিকে
কী ঘটছে সেটা বলা বেশ মুশকিল
একটি চাদর দুটি মনুষ্যমূর্তি
জড়ায় পিণ্ড তালগোলাকার হয়ে
ছটফট করে, নিঃশ্বাস যেন ঝড়
ফিসফিস কথা, দাঁতে দাঁত চেপে রাখা
যেন কষ্টের আওয়াজ রিলিজ করে
উপর্যুপরি দু’বার। সমস্তই
বোঝা যায় তার উপস্থিতিকে মেনে
সতর্কভাবে পুলকটি শেষ হতে
একজন তার চাদর সরিয়ে মাথা
বার করে দ্যাখে—সে ঘুমোচ্ছে তো ঠিক?
সে অসাড়। কাঠ। নড়ছে চড়ছে না।
সকালবেলা কেউ উঠবার আগে
সে উঠে পালায়, দ্বিরুক্তি না করেই
দেখে আসে ওরা দুই সখী দুজনাকে
জড়াজড়ি করে এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে
সে শুধু একটি খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে
লিখে এল: আজ যাচ্ছি
সে বাড়ি পৌঁছে ভাবল এসব থাক
সকাল সকাল স্নান করে শুয়ে পড়ি
ঘুম আসতেই হঠাৎ সে শোনে ওই
ঘন নিঃশ্বাস ফাঁকে ফাঁকে ফিসফিস্
অমনি চমকে ধড়মড় করে উঠে
দ্যাখে যথারীতি কোথাও কিছু নেই
সে শুয়ে রয়েছে, বাইরে বৃষ্টি পড়ে
রাতে অবশ্য ঘুম এলো ঠিকঠাক
ঘুমে সে দেখল সামনে চাদরপিণ্ড
দুমড়ে মুচড়ে ফোটে আধো কাতরানি
চাদরের থেকে খোলা পা বেরিয়ে এলো
তখনই চমকে বিছানায় উঠে বসে
নাকচোখকান জ্বালাপোড়া করে কেন?
সে উঠে আস্তে কলতলা পৌছোয়
ঘাড়ে মুখে কানে জলের ঝাপটা দেয়
ঘরে ফেরবার পথে সে শুনতে পেলো
ঘুমের মধ্যে দিদি নিঃশ্বাস নিচ্ছে
হ্যাঁ গতরাতের সেই নিঃশ্বাসঝড়
একটা সময় স্বাভাবিক হয়ে এলে
অনেকটা যেন এরকম হয়েছিল
সে কখনও কোনো ঘুমন্ত মানুষের
নিঃশ্বাস ঠিক এত কান পেতে শোনেনি
দিদির জানলা ছেড়ে পিসিমার ঘরে
দাঁড়াল, পিসির নিঃশ্বাস টানা টানা
কোথাও একটু সামান্য ঘড়ঘড়ে
কোথাও কি মিল আছে?
হঠাৎই চমক ভাঙল, কী করছে সে?
আড়ি পেতে পেতে দিদি আর পিসিমার
ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়া শুনছে?
আচমকা দিদি ঘরের মধ্যে থেকে
ঘুমে পাশ ফিরে উঃ আঃ করে ওঠে
তার মনে পড়ে দাঁতচাপা ফিসফিসে
কথা ছিড়ে ওঠা গত রাত্রের ‘আঃ!’
সে ভয় পেয়েছে, উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি?
নাঃ এরকম হতে দেওয়া ঠিক নয়
আজ শোয়া নয়। বই পড়ে রাত কাটাবো
সে বই পাড়ল। স্টোরি অফ ম্যানকাইন্ড
স্কুলে পেয়েছিল। হেনড্রিক্ ভ্যান লুন
অনুবাদ করা। আজও মাঝে মাঝে পড়ে
পড়া শুরু করে ষষ্ঠ পাতায় এসে
সে বোঝে হঠাৎ আগের পাঁচটা পাতা
কী পড়েছে তার কিচ্ছুটি মনে নেই।
সে পড়েনি। এই সাড়ে পাঁচ পাতা ধরে
কথা বলে গেছে, মনে মনে শত কথা
পাঠিকা এবং সম্পাদিকার কাছে।
এই কথাবলা চলল কয়েকদিন
ঘরে বসে বসে মনে মনে কাটাকুটি
শোয় না, খায় না, মান নেই কতোদিন
টিউশানি যাওয়া, সেটাও বন্ধ হল।
সাতদিন পরে ট্রেন ধরে ভোরবেলা
সে চলে গিয়েছে সম্পাদিকার বাড়ি
অফিস যাচ্ছে, সেজেগুজে প্রস্তুত
‘আরে এসো এসো, আমি তো বেরিয়ে যাচ্ছি
বিশ্রাম করো। চাবি রেখে যাই তবে’
— ‘আচ্ছা বসছি। কখন আসবে তুমি?’
— ‘আমি তো বিকেলে ফিরব।’— ‘ও আসবে না?’
— ‘উহু। ও তো আজ আসবে না বলে গ্যাছে
বাড়ি চলে যাও। বাড়িতে থাকতে পারে।’
সে বলে ফেলল: ‘ঠিকানাটা?’— ‘সে কী তুমি
ঠিকানা জানো না? ও দেয়নি? — ‘ভুলে গেছে।’
‘আচ্ছা দাঁড়াও। আমি সব লিখে দিচ্ছি।
সুবিধেই হবে। থার্টি ফাইভ-সি।
ওমুক রাস্তা। বরানগরের কাছে।
সিঁথির মোড়েই নেমো। রিকশাও পাবে।
কিন্তু তোমাকে ভাল তো দেখাচ্ছে না
দাঁড়াও দাঁড়াও। টাকা আছে? নিয়ে যাও।
সোজা একদম ট্যাকসিতে চলে যেও।’
— ‘না, না, বাসে যাব। তা’তেই সুবিধে হবে।’
— ‘বুঝেছি। আমার কিচ্ছু নেবে না তুমি
বেশ তবে চলো। বাসস্টপে চলে যাই।’
সে এলো বাসেই। বহুপথ খুঁজে খুঁজে
সে যখন এল থার্টি ফাইভ-সি-তে
বাড়ি দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ
গেট দেওয়া বাড়ি। তিনজন দারোয়ান।
দুটো গাড়ি। তার একটা ত্রিপল ঢাকা।
দারোয়ান বলে পাঠিকার নাম শুনে
সিধা চলে যান। সিঁড়ি আছে। চারতলা।
এদিক ওদিক তাকিয়ে সে হাঁটে, থামে।
দাসী ও ভৃত্য পাশ থেকে দেখে যায়
বলে: দিদিমণি? উপরে। চারতলায়।
সে পৌঁছে দ্যাখে ছাদে একটাই ঘর
দরজা বন্ধ। ভিতরে কি লোক নেই?
ঘুমিয়ে আছে কি? সাবধানে টোকা দেয়
প্রথমে আস্তে। পরে আরেকটু জোরে।
ভিতরে অমনি পাঠিকাকণ্ঠ, ‘যাই’
সেই গলা। তবু এখন অন্যরকম
দরজা খুলেই, দ্যাখো কী কাণ্ড! এসো
কী সারপ্রাইজ। এই যে, কে এসে গ্যাছে!
লম্বা বিছানা। বিছানায় প্রফেসর।
দুটো খোলা বই। বাঁধানো একটা খাতা
সৌম্য মানুষ। স্মিত আহ্বান ‘এসো’।
— ‘পড়ছিলে? আমি ডিস্টার্ব করলাম!’
—‘কিছু না, কিছু না ! কতদিন পরে এলে!’
এইটুকু শুনে চরিত্রচোখে জল
জল লুকাতে সে ঝটিতি মুখ ঘোরায়
মুখ ঘোরাতেই চোখে পড়ে যায় তার
দলা করে আছে খাটের পিছন কোণে
সবুজ ম্যাক্সি, কালো অন্তর্বাস।
সে জানে এগুলো কার।
কে পরে? কে ছাড়ে? মুহূর্তে যেন সামনে
সে একটি খোলা শরীর দেখতে পায়
মুখে এসে তার আবার চাবুক পড়ে।
পাঠিকা বলেছে, ‘তোমাকে কেমন লাগছে!
শরীর ভাল না? সেদিনের সেই জ্বর
এখনো সারেনি? ডাক্তার দেখিয়েছ?
কী আশ্চর্য! দেখাওনি? বলো কেন?
নিজেকে কেন যে এত হেলাফেলা করো!’
পাঠিকা কী আজ একটু উচ্ছ্বসিত?
একসঙ্গেই এত কথা বলে গেল!
নাকি তাকে দেখে সত্যি সত্যি খুশি?
এত বড় বাড়ি। ঠাকুর চাকর ছাড়া
অন্যরকম কাউকে তো দেখলো না!
এ বাড়িতে কোনো পরিজন তবে নেই?
সম্পাদিকার কাছে শুনেছিল পূর্বে
বাবা থাকেন না প্রায়ই, বড় ব্যবসায়ী
সারাটা বছর হিল্লিদিল্লী ঘুরে
বাড়িতে থাকার অবকাশ পান কম
মেয়ে নয়নের মণি, ছোটবেলা থেকে
যেমন ইচ্ছে ঘোরা চলাফেরা তার
শাসনের ছলে খর্ব হয়নি কখনো
মা খুব শান্ত, সত্যি ভালোমানুষ
সম্পাদিকার বর্ণনা অনুযায়ী
ছোট্ট একটা ছবিও টেবিলে, তাতে
মিষ্টি হাসির মহিলা ঘোমটা টানা
পাশেই একটি বালিকা, দুষ্ট মুখ
— ‘তোমার মা বুঝি? পাশে তুমি?’
— ‘হ্যাঁ, দ্যাখো না
মাও নেই আজ। মা গেছে বর্ধমানে
তোমার কথা তো অনেক বলেছি মাকে
দেখলে কী খুশি হতো!
অধ্যাপকটি পুনরায় স্মিত মুখে
বলেন, ‘আচ্ছা। আমি তবে চলি আজ।’
— ‘না, না। আমি যাই।’ চরিত্র অপরাধী।
উনি বললেন, ‘তা হয় না। আজ শুধু
কবির সঙ্গে কাটাও। সেটাই ভাল।
—‘আপনি থাকুন।’ চরিত্র অনুগত
—‘না আজ আমার কাজ পড়ে গেছে। শোনো
আর একটা দিন এরকম বসা যাবে।’
স্যার চলে যেতে পাঠিকা বলল: ‘এ কি!
এই ক’দিনেই কী চেহারা হয়ে গেছে!
এই ক’দিন কি খাওনি? ঘুমোওনি?’
এটুকু শুনেই চরিত্র ভেঙে পড়ে।
হাপুশ নয়নে বারি ঝরোঝরো তার
— ‘কী হয়েছে? আরে! কী হল? আহা হা শোন।’
চরিত্র ভাবে নরম গলাটি শুনে
ছুটে যাই। ছুটে কোলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে
পায়ে মুখ রেখে কান্না উজাড় করি।
কিন্তু পাঠিকা ঠেস দিয়ে জানলায়।
মুখ স্বাভাবিক। ভরুটিতে কুঞ্চন।
দৃষ্টিও স্থির। এক পা এগোচ্ছে না।
কবি বলে ওঠে, ‘মিথুন মেরেছি আমি।
আমি সে নিষাদ। যে মিথুন বধ করে।’
(কী কহিছ বাপ? এটা কী কইলে তুমি?
নিজ সদুক্তি নিজে কিছু বোঝলা না!)
সে পরে অনেক ভেবেছে, হঠাৎ কেন
সে মিথুনবধ প্রসঙ্গ বলেছিল
সে তো নিজে কোনো বিঘ্ন ঘটায়নি
মরার মতন পড়েছিল কাঠ হয়ে।
ওরা যা করার সমস্ত করে গেছে
তা নয়, আসলে পাঠিকাকে নিয়ে তার
মনের ভিতরে মিথুনমূর্তি ছিল
সেদিন রাতের ঘটনায় সেটা ভাঙে
তাই সে অমন বাল্মিকী হয়ে গেল
যা হোক আমরা এই মুহূর্তে আসি
এখানে তো কবি খাটের প্রান্তে বসে
হাতে মুখ ঢেকে অশ্রুনিপাত করে
পাঠিকা সামনে, কিছু দূরে মোড়া পেতে
বসল। ‘এই যে, শুনতে পাচ্ছো? শোনো
বলো কী হয়েছে? বলো।’
চরিত্র মুখ তোলে
‘সেদিন তোমরা অমন করলে কেন?’
পাঠিকা স্তব্ধ। চোখ জানলার দিকে।
‘আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি তো।’
‘ক্ষতি?’ পাঠিকার ভুরু কিছু বেঁকে আছে
‘তুমি তো জানতে! আমি ওই ঘরে আছি।’
‘আছো। তো কী তা’তে?
‘জানতে না জেগে আছি?’
‘জানতাম।’
‘আর সম্পাদিকাও?’
‘জানতো।’
‘তবুও?
‘কী তবু? কী করতে পারি বলো
আমি তো কখনো নিজেকে দমন করিনি।’
ঘরে যেন বাজ পড়ে।
চরিত্রমুখে একবাক্যও নেই।
সে দেখছে দূরে, জানলার বাইরেটা।
অনেক বাগান। অনেকটা ঘেরা জমি।
কোণায় মালির ঘর। তার পাশাপাশি
আরো দু ছাউনি ভৃত্যনফর থাকে।
বেল বাজলেই এখুনি আসবে তারা
ত্রিপল ওঠালে গাড়ি গর্জন করবে
দমন করার দরকারই নেই কোনো।
সেই নীরবতা ভেঙে পাঠিকাই বলে
‘তাতে তুমি এত কষ্ট পাচ্ছো কেন।’
চরিত্র সাত হ্যাংলার এক হ্যাংলা
কাঁদে, ‘আমি হুঁ হুঁ আমি তো কখনও পাইনি’
‘তাই এত কিছু! ও হো এই জন্যেই!’
পাঠিকা আবার জানলার দিকে চোখ
‘নাও উঠে পড়ো স্নান খাওয়া করবে তো
কিরকম যেন তিনদিন স্নান করনি।’
‘তিনদিন নয় সাতদিন।’ বলে কবি
‘বা চমৎকার। এই যে ঘরের পাশেই
বাথরুম এই সাবান এই যে জল
উঠে কী পরবে?’ পাঞ্জাবি আছে?’— ‘আছে।
জানো তো স্যারের পাঞ্জাবি ছিল সেটা
আমি একদিন বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে
ওঁর পাঞ্জাবি পরেই তো বাড়ি এলাম
‘কি কাণ্ড!’ ‘কেন সালোয়ার পাঞ্জাবি
পরাই তো যায়…সম্পাদিকাও তো
এটা পরেছিল! ‘এইটাই? তার মানে?’
ও তো একদিন ছিল। এ বাড়িতে। রাতে।
সে দিনই পরেছে…’
‘রাতে ছিল? ফের চরিত্র ঝরা ফুল!
‘এই নাও। ভারি ভালো না রঙটা! সফট!
এটা এই নিয়ে তিনজন পরল তো
স্যার, তুমি আর ও-ও, না, না, একি, আরে!
আমিও তো ওটা পরলাম! চারজন!
তুমিও পরছো! এই পাঞ্জাবিটাই!’
এ তথ্য জেনে চরিত্র ফের তাজা
জলে চুন তাজা, তেলে চুল, যেরকম…
পাঞ্জাবি হাতে কবি চিত্রার্পিত।
দুপুরে যখন স্নান খাওয়া হয়ে গেল
পাঠিকা বলেছে ‘বিশ্রাম করে নাও
বালিশ দিচ্ছি শুয়ে নাও এক্ষুনি!’
‘তুমি থাকবে না?’ ‘এই তো, এই তো আছি’
বলে পাঠিকাও তার পাশে আধশোয়া
কনুইতে ভর, তুলে রাখা মাথা। আহ্
এত এত কাছে! চরিত্র শ্বাস নেয়
স্নানের গন্ধ! এই তো একটু আগে
তাকে ঘরে রেখে পাঠিকাও স্নানে গেল
সে বসে শুনেছে ঝরোঝরো জলশব্দ
পাঠিকা আঙুল বাড়িয়ে এবার ছোঁয়
পাঞ্জাবি। বলে ‘রঙটা দারুণ! পিঙ্ক!’
চরিত্র রোগা আঙুল দেখতে থাকে
‘যদিও আমাকে একটু বেরোতে হবে
তোমাকে তখন বাসে তুলে দেবো। কেমন’
‘এক্ষুনি যাবে?’ ‘না বাবা! এখন নয়!
সত্যি পাগল!’ সেই গলা! সেই কথা!
কী স্নানগন্ধ তিন ইঞ্চি দূরে মুখ
সেই ছায়া-দিঘি চোখ, সেই তিলবিন্দু
এত কাছে? ব্যাস্। সাত আটদিন পরে
ঘুমে চরিত্র আবছায়া হয়ে আসে
কী শান্তি যেন! হঠাৎই পাঠিকা বলে
‘আর আমি বালিশ নি’আসতে পারছি না
তোমার বালিশে মাথাটা একটু রাখি?’
হাঁ-হাঁ করে উঠে চরিত্র সাত হাত
তফাতে সরেছে, ‘হ্যা হ্যা নিশ্চয় রাখবে।’
ভুরু কুঁচকোয় পাঠিকা। ‘এটা কী হলো?
পালাবার এত কী হয়েছে বোকুরাম?
সত্যি কবিরা এত হাঁদা হয় বুঝি?’
বলেই কবির চুল মুঠো করে ধরে
পাঠিকা ঝাঁকায়। মুহূর্তে নেমে আসে
পাঠিকার ঠোঁট চরিত্র ওষ্ঠেই
সঙ্গে সঙ্গে হাঁকপাঁক করে উঠে
চরিত্র ধরে পিঠ বেড়ে জাপটিয়ে
‘এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি আমি
মাটিতে যে আজ স্বর্গ এসেছে নামি’
কাঁধে মুখ রেখে স্বপ্ন দাঁড়িয়ে যায়
পাঠিকাও বুকে মুখ ঘসে ঘসে বলে
ভালো না রঙটা? কী দারুণ সফ্‌ট রঙ
ভালো পাঞ্জাবি সেভাবে আদর করো,
যেভাবে সেদিন ও আদর করেছিল…
চরিত্র এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলে
‘কী বললে ! তুমি কী বললে!’—’কেন? কী?’
পাঠিকার চোখে ঘোর যেন যাচ্ছে না
চরিত্র দ্যাখে পেটে পাক দিয়ে ওঠে
থাকতে পারে না, বাথরুমে দৌড়ায়
প্যানের সামনে ঝুঁকে গলগল বমি
একটু আগের ভাত তরকারি সব
যা খেয়েছে তার সবই তো বেরিয়ে গেল
পাঠিকা স্তব্ধ। এমন কী হল হঠাৎ?
‘এই নাও জল, এই যে তোয়ালে, ওঠো
ধরে ধরে ওঠো’ চরিত্র তাকে ধরে না
হাঁপায়। তাকায় ফের পাঠিকার মুখে।
পাক দিয়ে ফের পেট থেকে বমি ওঠে
প্যানে ঝুঁকে পড়ে। চোখ বোজে। সাদা প্যান।
‘এ কী আচমকা এমন হচ্ছে কেন?
ডাক্তার ডাকি?’ চরিত্র মাথা নাড়ে
‘নাও শুয়ে পড়ো ফ্যানটা বাড়িয়ে দিই
আমি এক্ষুনি নিচ থেকে ফোন করে
আসছি’ পাঠিকা সত্যিই বিচলিত
‘লক্ষ্মীটি তুমি একটু একলা থাকো
কেমন? ‘আচ্ছা।’ চোখ বুজে উত্তর
সিঁড়ি দিয়ে নামে নেমে যায় পদশব্দ
ঘরে সে শুয়েছে। চোখ যায় জানলায়
বাইরে বিরাট ছাদ রোদুরে ভাসে
ছাদের ওপরে ছায়া দোলাচ্ছে গাছ
ঘুম এসে যায় তার
সে একটু পরে চোখ চাইতেই দ্যাখে
একটু দূরেই মোড়া টেনে বসে আছে
দুই বান্ধবী। চিন্তান্বিত মুখ।
চরিত্র উঠে বসে আর দু’জনেই
‘শোও। শুয়ে থাকো। উঠতে হবে না’ বলে
দৌড়ে আসে ও খাটের দু’দিকে দাঁড়ায়
সে বলে, ‘এখন ভালোই লাগছে। তুমি?
তুমি তো তখন অফিস যাচ্ছি বললে।’
পাঠিকা বলেছে : ‘গেছিল তো! আমি ওকে
ফোন করলাম। ডেকে আনলাম। তাই…
মানে তোমাকে তো বলেছি একটু আগে
আমাকে একটু বেরোতেই হবে এখন
আমি অবশ্য ইতিমধ্যেই লেট্‌
আজকে আসছি। ও তোমাকে তুলে দেবে।’
পাঠিকা যেতেই বলেছে সম্পাদিকা
‘শোনো, তুমি আজ আমার সঙ্গে যাবে
থাকবে আমার বাড়িতে।’
‘না। আমি এখনই ট্রেন ধরে চলে যাব’
‘যাবে না। তোমাকে একা
আমি কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারব না।
বলছি, আজকে আমার বাড়িতে থাকো
আমি নিয়ে গিয়ে তোমাকে পৌঁছে দেব
তোমার বাড়িতে।’—‘কোনো দরকার নেই।’
‘শোনো, এরকম করতে আছে কি? বলো…
এমন করলে আমার খারাপ লাগে না?’
‘তুমি কি আমার খারাপ লাগবে কি না
ভেবেছিলে সেই রাতে?’
সম্পাদিকার মুখ নিচু। কথা নেই।
তাকায়। ‘আচ্ছা সে সব কথা
পরে বলা যাবে, এখন তো বাড়ি চলো।’
‘না আমি যাব না। তোমার বাড়িতে গেলে
না-জানি আবার কী খেলা দেখাবে তুমি!’
‘প্লিজ। প্লিজ…তুমি…
এরকম বলবে না!’
সম্পাদিকার চোখে টলটলে
জল দুই গালে ভেঙে পড়ে।
মুহূর্তে মুখ ঘুরিয়ে জল লুকোয়
চরিত্র চুপ। সে এতটা আশা করেনি।
মোড়া থেকে ঘুরে বলেছে সম্পাদিকা
ঈষৎ ধরা গলায় :
‘তুমি শুয়ে থাকো। আমি অপেক্ষা করছি।’
চরিত্র ওঠে।
পাঞ্জাবি খুলে নিজ পাঞ্জাবি পরে।
পাশে যায়, বলে, ‘চলো।’

সম্পাদিকার বাড়ি এসে ঘরে ঢুকে
চরিত্র দ্যাখে, দুই দিকে দুটো
এই খাটে! এই খাটে!
চরিত্র বলে, ‘আমি আজকেই ফিরব’
‘তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যাই?’
চরিত্র বলে, ‘না’—
(আমি শিকলে ধরা
নাহি দিব। নাহি দিব।)
খাটে সে বসে না। পাশের চেয়ারে বসে।
সম্পাদিকাও বসে তার মুখোমুখি।
‘বলো কী হয়েছে?’ ‘কী আবার হবে।’
‘না আমায় খুলে বলো’
—‘আঃ কী বলব। বলার তো কিছু নেই।’
‘তাহলে এমন কষ্ট পাচ্ছো কেন?’
‘কারণ তোমাকে’…চরিত্র থমকায়
‘কারণ আমাকে…? হ্যাঁ, বলো?’—‘তোমাকে আমি
সহ্য করতে পারছি না একদম।’
সম্পাদিকার চোখ ম্লান বিস্ময়ে
স্তম্ভিত হয়। ‘আমাকে? আচ্ছা! কেন?’
‘তুমি! তুমিই তো ওকে কেড়ে নিয়ে গেলে!
আমি কেউ নয়। ও কেবল তোমাকেই’…
সম্পাদিকার মুখে কষ্টের দাগ
বলেছে আস্তে, বলেছে ধরা গলায়
‘আমিই কেড়েছি কী করে জানলে সেটা?’
‘আমি স্বচক্ষে দেখিনি? নিজের চোখে?
তুমিও জানতে। বললা তুমি জানতে না?
মাত্র কয়েক ফুটের ব্যবধানেই।
আমি শুয়ে আছি জেনেও অংশ নাওনি?
সারা রাত জেগে তোমাদের নিঃশ্বাস
শুনেছি। যখন যেখানেই যাই আমি
তাড়া করে আসে তোমাদের নিঃশ্বাস
তন্দ্রা এলেই দেখি তন্দ্রায় ঢুকে
ফিসফিস করে, গোঙায় চাদরপিণ্ড
নিঙড়ে ওঠানো আনন্দ গলাটিপে…’
তার কাছে এসে দাঁড়ায় সম্পাদিকা
‘শোনো, মুখ ভোলো, এদিকে তাকাও, ছেলে!’
‘ছেলে, যদি কোন ছেলে এসে জিতে নিতো
তবু বুঝতাম সংগত এই হার
কবিতা ছাড়া তো যোগ্যতা নেই কিছু
শুধু কবিতায় প্রেমিকা বাঁচানো যায়?
অর্থপুরুষ, প্রতিষ্ঠাপুরুষেরা
চিরকাল জেতে, সে-হারে লজ্জা নেই
কিন্তু একটি মেয়ের নিকটে হার
বলো তো আমাকে, বলো তো সম্পাদিকা
আমি কি তোমার কোনো অনিষ্ট করেছি?
তাছাড়া তোমরা আড়ালে যা খুশি করো
আমাকে…আমাকে,.. আমার সামনে কেন?
আমার সামনে না করলে চলতো না?
ওয়াক্‌। ভগবান। ও কেবল তোমাকেই
ভাবছে এখন। তুমি কোন পাঞ্জাবি
পরেছ, কীভাবে আদর করেছ ওকে!
মেয়েরা মেয়ের প্রেমিকা হয় কখনো?
এ-ও সম্ভব? অথচ তা-ই তো হলো
মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে জানলাম
আমার প্রেমিকা আমারই প্রেমিকা নয়
সম্পাদিকার মুখে নীল কঠিনতা
ঠোঁট কামড়ানো, কোণের টেবিলে বসে,
হাতে ডটপেন, একমনে দাগ দেয়
কাগজে, কাগজ দাগে দাগে ছিড়ে যাচ্ছে
‘তোমার প্রেমিকা? তোমারই প্রেমিকা ব’লে
যাকে জানো তুমি, কতটুকু জানো তার
বলে, উঠে গিয়ে দাঁড়ায় জানলা ধ’রে
‘তার আগে নিজের বিষয়ে স্বীকার করি
আমি মেয়েদের, মেয়েদেরই ভালবাসি
প্রেমিক-প্রেমিকা যা বোঝায়, প্রেম বলতে
নারীপুরুষের দেহঘনিষ্ঠ প্রেম
আমার কাছে তা নারীর দিকেই যায়
পুরুষের কোনো ভূমিকা সেখানে নেই
শুধু দেহ নয়। দেহছিনিমিনি নয়
মন খারাপ বা আকুল দেখতে চাওয়া
মনে মনে কথা। সঘনস্পর্শইচ্ছে
এমনকি লেখা বর্ষার দিনে চিঠি
আমার সবই তো মেয়েদের সঙ্গেই
আমার এমন দুই প্রণয়িনী ছিল
একটি কিশোরী, অন্যটি বিবাহিতা
কাছে নেই তারা। নানান বিদেশে আছে
পুরুষরা নেই, পুরুষরা কেউ নয়।
কিন্তু বালক, তোমার মতন যারা
শিশুরও অধিক, তাদের জন্য কোল
অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে থাকে
কবি, তোমাকেও সন্তান বলে ডাকি
হ্যাঁ তাই, তোমার কাছেই স্বীকার করি
সেই রাত্রিতে, অন্যায় রাত্রিতে
আমি যা করেছি শুধু শরীরের ঝোঁকে
শরীর কখনও মনের উপরে নয়
যার হয় সে তো মানুষ না, জন্তু সে!
আমাকে টানলো আর আমি গেলাম? ছিঃ!
আমি জানতাম, তুমি জেগে ছিলে! তবু?
ঠিক করিনি গো। দেহ ব্যবহার, সে-তো
নিভৃত শিল্প, সে তো গোপনতা চায়…
তোমাকে, তোমাকে কষ্ট দিয়েছে! তা-ও
তুমি কবি, তাই দাও, মাপ করে দাও…’
সম্পাদিকার দুটি হাত নেমে আসে
কবির আননে, কবিমুখ তুলে ধরে,
‘মাপ করে দাও, মাপ করো’—‘বেশ। মাপ।’
বলা মাত্রই স্ফুটচিৎকারে নারী
কবির মাথাটি টেনেছে বক্ষপরে
থুতনি ডুবেছে কবির ঝাঁকড়া চুলে
কবি দ্যাখে বুকে সামান্য দুটি ঢেউ
সকালের ক’য় মুহূর্ত বাদ দিলে
জীবনে প্রথম বক্ষস্পর্শ বুঝি!
তবু একটুও কামভাব জাগলো না
বরং অঝোরে কবিচক্ষুর জল
সম্পাদিকার ভেজালো বুকের জামা
সম্পাদিকাও অশু মুছাতে গেলে
হাতে কান্নার নালঝোল লেগে গেল!
কবি এরপর নাক টেনে, চোখ মুছে
নিজেকে সামলে নেবার প্রয়াস পায়
সম্পাদিকাও বলে, ‘মন দিয়ে শোনো
আরও কিছু কথা জানা খুব দরকার
তোমার হয়ত অবাক লাগছে ভেবে
কতদিন আগে কী রকম ভাবে হলো
সম্পর্কটি, আমার সঙ্গে ওর।
খুব বেশিদিন আগেকার কথা নয়।
তোমার ওখানে যাবার পরে-পরেই
একদিন খুব বৃষ্টিতে রিক্সায়
জড়াজড়ি করে ফিরছি, পর্দা ঢাকা,
হঠাৎ বললো: ‘তুই কী সাংঘাতিক!’
ব্যাস সেই দিন বাড়ি গিয়ে হয়ে গেল।
সেদিনই প্রথম ও এখানে থেকে যায়
পরে বিছানায়, যখন আমরা শুয়ে
ওকে বললাম, মেয়েরা যেমন বলে,
কেউ কি কখনও আদর করেছে তোকে?
“করবে না কেন? এখনও আদর করে
একজন আছে। ভীষণ আদর করে”
‘কবেকার কথা, কবেকার’, বলে কবি
তার বক্ষের ধকধক বেড়ে যায়
‘আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেছে’?”
‘হ্যাঁ’, বলে মাথাটি নাড়ায় সম্পাদিকা
‘কী বলল, বলো, কী বলল ও তখন?’
কবি ভাবে, সেটা আমি ছাড়া কেউ নয়
দু’দুদিন হাত ধরেছে! কপাল থেকে
চুল সরিয়েছে তিনবার! একদিন
চোখের পাতাও ছুঁয়েছে আঙুল দিয়ে
সে-আঙুলে ছিল সর্বস্বটি তার
এ যদি আদর না হয় আদর কি সে?
‘চুপ করে আছো কেন? বলো, কী বলেছে?’
এবার একটু এগিয়ে সম্পাদিকা
দুই হাতে ওর মুখ তুলে ধরে বলে:
‘বলেছে, আমাকে আদর করেন স্যার।
—‘কে স্যার?’
—‘ওই যে। ওর সেই প্রফেসর।’
‘প্রফেসর? মানে?’—‘হ্যাঁ।
শান্ত সৌম্য মানুষ আনম্যারেড
গ্রামে নাকি বহু ভূসম্পত্তি আছে
কাব্যশিল্পচলচ্চিত্রকলা
সব কিছুতেই দখল প্রশ্নাতীত
উনি ওর গুরু। উনি বাপ্পার কাকা
বাপ্পা কে জানো? এখন জার্মানি
অল্পবয়সী উজ্জ্বল ‘ভারতীয়
দেশে ফিরলেই সেট্‌ল করবে ওরা।’
—‘তাহলে আমি কে?’
—‘কেউ নও। তুমি কবি।
বাঁচতে চাও তো প্রাণ নিয়ে চলে যাও।’
‘যাই’ বলে যেই উঠে দাঁড়িয়েছে— ওয়াক্‌
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় বাথরুমে
সম্পাদিকাও দৌড়ে পিছন থেকে
দুহাতে জড়িয়ে পতনটি রুখে দেয়
‘এই যে বেসিন। হ্যাঁ আমাকে ধরে থাকো।
ওয়াক ওয়াক জল টক জল ওয়াক তেতো
জল ছাড়া আর পেটে কিছু নেই তবু
ওয়াক ওয়াক, কবি প্রাণপণ চেষ্টায়
বারবার করে উগরে ফেলতে চায়
জলের সঙ্গে স্বেচ্ছায় গেলা ব্যাঙ!
খুব সাবধানে, সন্তর্পণে ধরে
ঘরে নিয়ে আসে কবিকে সম্পাদিকা
শুইয়েও দেয় যত্নে, শয্যা’পরে
কয়েকমিনিটি পরে চোখ মেলে কবি
বহু সিনেমায় দ্যাখা ও নভেলে পড়া
দৃশ্যটি তার জীবনে দেখতে পায়
মুখে ঝুঁকে আছে ঝাপসা একটি মুখ
উদ্বেগাকুল চোখ দুটি মা-জননী!
একটু পরেই ডাক্তার এসে গ্যাছে
দেখেছে, বলেছে, নাভাস ব্রেকডাউন
বিশ্রাম চাই। লিখে দিয়ে গেছে ঘুম।
তৎসত্ত্বেও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে
কবি দ্যাখে তার শিয়রে চেয়ার টেনে
নরম আলোয় বসে আছে একাকিনী
একদিন বাদে, তার পরদিন ভোরে
পৌঁছে দিয়েছে কবিকে সম্পাদিকা
বলে দিয়ে গ্যাছে দিদি আর পিসিমাকে
কতো অসুস্থ, প্রেসক্রিপশন কী কী
কোন ওষুধটা কখন খাওয়াতে হবে
ওষুধপত্র? কিনে দিয়ে গ্যাছে তা-ও
তবু সে যেতেই দিদি আর পিসিমার
অন্য মূর্তি, কেউ কথা বলছে না
দুদিন, ছ’দিন, দশদিন, এক মাস
রাতে একসাথে খাওয়া ছিল, সেটা বন্ধ
দুবেলা দু’থালা টেবিলে নামিয়ে দেয়
চরিত্র আরো ভেঙে ও দুমড়ে গ্যাছে
পথে বেরোয় না। বেরোলেও রাত্তিরে।
মেয়েদের মুখ দেখলেও ওয়াক্‌ পায়
নিজেকে দমন নীল গাড়ি দারোয়ান
দমন করিনি বেল টিপে চাপরাশি
নিজেকে নিজেকে বাগান মালির ঘর
যা চেয়েছ তাই পেয়ে গেছ ছোট থেকে
তাই বুঝি মনে সংকীর্ণতা নেই
একদেহগামী একমনগামী নও
বহুমুখী তুমি, হে মালটিপারপাস
হে প্রেম তাহলে দুয়ে দুয়ে পাঁচ তুমি
নারী ও পুরুষ দুয়ে আনন্দ পাও
এক পাঞ্জাব ছুঁয়ে তুমি তিনজন
নারীপুরুষের সঙ্গে মিলনস্মৃতি
মনে করছিলে—সেই মুহূর্তে তবে
কোথা রেখেছিলে এই চতুথটিকে?
মনের কোন কোনায়?
না কি রাখোইনি? এ খোয়াব দেখছিল?
সবার স্পর্শ নেওয়া একজন থেকে
একেই তাহলে দমন না করা বলে?
সে তো বোকা, সে তো ভাবেনি তোমাকে ছাড়া
তোমাকেই মনে জ্বালে সে—দমন করে…
দমন দমন আদরের ছোট বোন
দমন শিল্পকবিসাহিত্যকলা
কে অবদমিত পালিয়ে বাঁচতে পারে?
সে-ও তো পারেনি। খুবই দ্রুত একদিন
বুঝেছে নিজের পুরুষার্থটি গেছে
গায়ে ছিটেফোঁটা বাসনাভস্ম নেই
সাত চড়ে আর রা করে না তার পিন্টু
কিন্তু কবিতা রা করে যাচ্ছে তার
খাম কেনে আর ডাকে দিয়ে বাড়ি ফেরে
ছাপা হয় আর লেখা চেয়ে চিঠি আসে
প্রকাশকও আসে। সে দেয় পাণ্ডুলিপি।
বহুদূর থেকে বই ছাপা হয় তার।
আজ সেরকমই একটি পত্রিকায়
প্রকাশিত তার একটি কবিতা দেখে
দুইজন পড়ে। থামে। আলোচনা করে
আচ্ছা আমরা বরং একটু শুনি
ওরা কী বলছে। না, না, চলো তারও আগে
ওরা যা পড়ল সেইটাই পড়ে দেখি :

ওরা যা পড়ছে

পথের মধ্যে শত্রুবাড়ি; শত্রু সদাশিব
আশীর্বাদ করেন, কিন্তু বুক করে ঢিবঢিব।
বুক ঢিবঢিব করে আমার বক্ষ দুরু দুরু
সব কি তাঁকে বলতে পার,? তিনি তো সদ্‌গুরু
অমন গুরুর ছিচকে চেলা আমি হারামখোর
পরের জিনিস লুকিয়ে দেখে মন করেছি ভোর
চোখ খুললেই দেখছি তাকে, আর তাকে দেখলেই
কী বলছি কী করছি, আমার কিচ্ছু খেয়াল নেই
কিন্তু যখন ছুটল নেশা, পড়ি চুরির দায়ে
কপাল ভালো বলতে হবে— হাত দেয়নি গায়ে
দেয়নি? কেন দেয়নি? যদি একটিবার দিত
ভাবতে গিয়ে আবার আমার শরীর রোমাঞ্চিত
শুখা শরীর, ভুখা শরীর, শরীর ছেড়ে মন
ভোরের কাছে গ্যাছে, ও ভোর, ঘুমোচ্ছ যখন
কেমন লাগে ঘুমোয় যদি? কেমন লাগে স্নানে?
পুলক ঝরে পড়ল আমার রাস্তার মাঝখানে
রাস্তায় তো পুলিশবাড়ি, পুলিশ দয়াময়
বলেন, তাতে কী হয়েছে, অমন একটু হয়
জানতিস না পরের জিনিস, তুই ছিলি আশ্রিত
সে যদি না থাকত তোকে কেউ কি কোলে নিতো?
কোলে নিয়েছে, ফেলে দিয়েছে, আর কাকে তোর ভয়
সত্যি কথা বলতে, অমন কোল কি কারো হয়
মায়ের মতো, পিতার মতো, চিতার মতো কোল
দারুণ পোড়া পুড়ছ— সবাই বলুক হরিবোল॥

ওদের আলোচনা

—‘কী লিখেছে রাজপুত্তুর?
কা’কে নিয়ে লিখল এটা?’
—কা’কে নিয়ে নিজেই জানে
পড়বার দরকার কী?
আজকাল ওকে নিয়েই
দেখছি মুশকিল খুব’
—‘আগে তো ভাবতে হ’তো।’
—কী করে বুঝবে বলো?
আসলে প্রথম দিকে
এরকম মনে হয়নি
দেখলে তো কবিসভায়?
দেখলেই চমক লাগে
ও যেন কবিতাতেই
ডুবে আছে সবসময়
কবিতাই পড়ছে, সভায়,
তবু কেউ কোথ্‌থাও নেই
নিজেরই পাণ্ডুলিপি
ফেলে রেখে চলে আসছে—
আর কারো উপস্থিতি
ও যেন জানছেই না!
এতখানি ইনভলবমেন্ট!…
কী রকম লাগলো যেন।
কীরকম থই হারালাম…
—তাই বাড়িদৌড়ে গেলে?
আর ও-ও তোমায় নিয়ে
লিখে দিলো দু-চার লাইন?
—তারপর এলো যখন,
জানো তো নিজেই এল,
আর আমি কেমন যেন…
—তুমিও, সত্যি কথা,
অতটা আশা করোনি!
—মোটেই না, তরুণ কবি
ভাবলাম আশ্রয় দিই
তারপর মিশতে গিয়ে
আমার তো শিক্ষা হল
বড় বেশি ভাবুক মতো
এলে আর যেতে চায় না
সারাদিন কথা, কথা
সারাদিন কাজের ক্ষতি
কীরকম সর্বসময়
আমাকে আঁকড়ে রাখে
আমার তো হাঁফ ধরে যায়!
—আসলে শিল্প ভালো
অথচ শিল্পী ভারি
তোমাকে বলেই ছিলাম!
—তাছাড়া গরীব ব’লেও
একটু গর্ব আছে।
স্বেচ্ছায় আধময়লা।
পাঞ্জাবী চাপিয়ে ঘোরে
ফরসাটা পরবেই না!
—এটা তো হতেই পারে
কবিরা ওই রকমই!
—রাখো তো! ঝঞ্জাট সব!
তাছাড়া হিংসে আছে
আমার আর সখীর এত
মেলা মেশা যাওয়া আসাও
ইদানীং মানছিল না
—সে আবার কেমন কথা
কবি কী করলটা কী?
—‘এই তো সেদিন এসে
কী রকম করল যেন!’
—‘ও, যেদিন আমি ছিলাম?’
—‘তুমি তো বেরিয়ে গেলে
শুরু হল তারপরই তো
বমিটমি করে… তখন
দুপুর তো পেরিয়ে গেছে
ভাবছি তুমি তো ঠিক
নন্দনে দাঁড়িয়ে আছ
নাভাস লাগছিল খুব
তারপর ফোন করলাম…’
—‘সখীকে?’ —‘ও ছাড়া আর
কাকেই বা ধরব তখন
ও এল। এসেই ওকে
নিয়ে গেল নিজের বাড়ি
তারপর মুক্তি পাওয়া
দেখছি সেদিন থেকে
যোগাযোগ রাখছে না আর’
—‘যাকগে ভেবো না আর
ভুলে যাও, হাত ধুয়ে নাও
জানো কি, আজকে তোমায়
ডেকেছি কী কারণে—’
—জানি না, বলো, বলো!
—‘আ হা হা ধীরজ ধরো
একজন তরুণ লেখক
আজ তার প্রথম নভেল
পড়বেন ওই বাড়িতেই
ওই সেই আহ্বায়কের…’
—‘কী ভালো, দারুণ ব্যাপার’
—‘দাঁড়াও না, ধীরজ ধরো
এইবার জানিয়ে রাখি
গল্পটি কাব্যে লেখা।’
—‘কী দারুণ চলো চলো!’
—‘বেশ তবে এখোন যাক…
আজকেও মৌলালী জ্যাম
সন্ধের ভীষণ ট্রাফিক
সরিয়ে নিজের মতো
অসমবয়সী দুই
পথচারী নামল পথে
পথচারী এগিয়ে গেল…

সেই থেকে আর ওদের কী হল
আমরা জানি না কেবল চরিত্রকেই জানি
চরিত্র আরো চুপচাপ হয়ে গেছে
চুপচাপ আর শান্ত ও সাবধানী
সম্পাদিকার সঙ্গেও আর কোনো
যোগাযোগ নেই, সে নাকি দিল্লিবাসী
আমাদেরও আর অতীত দিয়ে কী কাজ
আমরা বরং বর্তমানেই আসি
যে বর্তমানে চরিত্র বসে নেই
করে কাছাকাছি ইস্কুলে মাস্টারি
তাকে দেখা যায় একা বসে দূর মাঠে
অথবা ফিরছে সাইকেল হাতে বাড়ি
সকালে এখন নিজেই বাজার করে
বয়স তো হল সাড়ে-পঁয়ত্রিশ প্রায়
কেবল কোথাও মেয়েদের দেখলেই
তাকায় না, মুখ নিচু করে চলে যায়
না আগের মতো সে-অসুস্থতা নেই
সে-বিমর্ষতা, বমি পাওয়া নেই আর
কিন্তু এখনো পুরনো সে-ধাক্কায়
শরীর স্তব্ধ। শরীর অন্ধকার।
ক’দিন আগেই সহকর্মীরা সব
বাস নিয়ে গ্যাছে কনডাকটেড টরে
সেখানেও দুটি মেয়ে এলো কাছাকাছি
আর সে যত্নে পরিহার করে দূরে
সে দ্যাখে এখন পিসিমার লাউলতা
পৌঁছে যাচ্ছে সামনে টালির ছাতে
পিসি লাগাচ্ছে বাতাবিলেবুর গাছ
ছেলেরা যাচ্ছে হাফপ্যান্ট, বল হাতে
সে মাঠে দাঁড়ায়, টিফিনকৌটো নিয়ে
দ্যাখে মেয়ে যায়, বাবা তার ক্ষেতে-মাঠে
সে দ্যাখে রাস্তা চলে গ্যাছে কত দূর
ড্রাইভার শুয়ে ঘুমোয় দড়ির খাটে।
রিক্সাওয়ালাকে নাম জিগ্যেশ করে
কোন ইসকুলে পড়ছে তোমার ছেলে
ওদের সঙ্গে পথের ধারে চা খায়
ওরা হাত নাড়ে ‘মাস্টামশাই’ গেলে
সে ভাবে তাকিয়ে রাত্রে আকাশপথে
এত এত তারা কত দিকে দিকে যায়
জানি খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়
তবু চোখ যদি কবির দৃষ্টি পায়
কত দেরি তার? থাক দেরি। মনে মনে
শান্ত একটি আলো জ্বালা আছে তার
আমি ও পৃথিবী, পৃথিবী ও আমি, এই
একটাই পথ লেখায় পৌঁছোবার
সে লেগে রয়েছে। ইস্কুল থেকে রোজ
বাড়ি ফিরে এসে নিজেকেই পড়া ধরে
একপা একপা প্রতিদিন পৌঁছনো
দিদিরা যেমন ফুলগাছ বড় করে
দিদিও এখন চল্লিশ পার হয়ে
পৌঁছে গিয়েছে বিয়াল্লিশের ঘর
আগের মতই নিরিবিলি আছে দিদি
মাঝে মাঝে বলে : ‘পড় না ! কবিতা পড়’
সে পড়ে শোনায় নিজের নতুন লেখা
বিদ্যুৎ যায়, মোমবাতি আসে ঘরে
বৃষ্টিবাদল পার হয়ে ওঠে চাঁদ
নারকোলপাতা জ্যোৎস্নার লেখা পড়ে?
কখন দিদির কোলটিতে মাথা রেখে
শুয়ে পড়ে, দিদি কপালে হাত বোলায়
‘ঘুমোলি?’ ঘুমোল। বালিশে নামিয়ে মাথা
দিদি গায়ে ঢাকা টেনে দিয়ে চলে যায়।
আজ সে ভাবছে আবারও দিদির কথা
কারণ সে আজ কলকাতা এসেছিল
ভেবেছিল ক’টা বই কিনে নিয়ে যাবে
কিন্তু বৃষ্টি হঠাৎ বাগড়া দিলো
ভোরে বেরিয়েছে, তখন বৃষ্টি নেই
গিয়েছিল সেই আহ্বায়কের কাছে
ইনি আজও খুব স্নেহশীল ওর প্রতি
সভায় যায় না, তবু যোগাযোগ আছে
ওঁর বাড়ি গিয়ে ঢুকতেই শুরু হলো।
এখনো থামেনি। সে একটা বাস ধরে
বৃষ্টি ও গাছ দেখতে দেখতে ফিরছে
ভাবছে দিদিটা ফিরবে কেমন করে।
যখন ভাবছে তখন ঠিক দুপুর
দিদির অফিস ছুটি হতেও তো আরো
ঘণ্টা তিনেক লাগবে, ততক্ষণে
বৃষ্টি বাড়বে, এটা ধরে নিতে পারো।
তবে কি দিদির অফিসেই চলে যাবো?
ভাবতে ভাবতে সে ঢোকে শেয়ালদায়
এখানে ওখানে জটলা, ট্রেনের সিটি
দিদিকে একটা ফোন করে দেখা যায়
বহু চেষ্টায় পাবলিক বুথ থেকে
‘আমি ওর ভাই বলছি’ বলে যখন।
পরিচয় দিল, শুনলো: ‘অফিস থেকে
উনি তো বেরিয়ে গ্যাছেন অনেকক্ষণ’
সে নিশ্চিন্ত। যাক বাড়ি ফিরে গেছে।
না, আমরা জানি দিদি তো এখনও ট্রেনে
ট্রেনে কী হচ্ছে, কী হয়েছে আগে-পরে
এবার আমরা সেইটাই নেবো জেনে।
ইত্যবসরে চরিত্র উঠে যাক
পরের গাড়িতে, যথাসময়ের পরে
গাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে দেখা যাক
এ-গল্প কোন বৃষ্টির মুখে পড়ে।

দিদির কথা

স্টেশনে নামলাম, দশটা দশ
নেমেই দেখি, মেঘে কালো আকাশ
হাওয়ায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি, আর
মিনুদি বললেন, ‘সামলে যাস।’
মিনুদি আমাদের লেডিসে যান
কাজ করেন এ.জি. বেঙ্গলে
বলেছি মনে মনে: এসেছো মে
যমুনা কিনারে কী শ্যাম চলে
হঠাৎ নিজের এই ভাব দেখে
ভাবছি আমি, আরে! কী উদ্ভট
আমি তো সারাদিন ফাইল আর
টাইপরাইটার। খটাসখট্‌।
ভেবেছি যা-ই থাক কপালে আজ
এটুকু রাস্তা তো, হেঁটেই যাই
যদিও ছাতা আছে, ভিজে যাবো
দেরিও হবে, নয় বুকনি খাই
একটু গিয়ে ছাতা উলটে যায়
জলের তোড়ে যেন ঢুকি অফিস
কপালে চোখ তুলে রীতা চ্যাঁচায়
বীণাদি বলে: ‘এটা কী করেছিস?’
বলেছি: ‘আজ খুব ভিজে গেলাম।’
অনিতা বলে, ‘বাবা রোজ ভিজিস।’
জানে না বৃষ্টি তো বন্ধু হয়
আমার দিকে দ্যাখে সারা অফিস
চুলেও জল ঝরে; শাড়িতে জল
বড়বাবুকে বলি: ‘রায়দা, কাজ
কালকে এসে সব করে দেব
হাফ সি. এল. নিয়ে পালাবো আজ।’
রায়দা বললেন: ‘আচ্ছা, যাও
দেখো আবার যেন জ্বর না হয়।’
হোক না জ্বর, হোক আরও কিছু
কাউকে আমার আর কিসের ভয়?
অনিতা-বীণাদির মসকরা
সরিয়ে হেসে বলি: ‘আজ চলি’
আবারও বৃষ্টির সঙ্গে যাই
‘আসুন। শর্টকাট এই গলি!’
পিছনে চেয়ে দেখি কিরণ রায়
এত বছর পরে আবার সে-ই!
বলেছি: ‘যেতে হলে আপনি যান
আমার শর্টকাটে ইচ্ছে নেই!’
লম্বা ছাতা নিয়ে কিরণ রায়
এগিয়ে আসে, বলে: ‘সরে দাঁড়ান।
পিছনে গাড়ি যাবে, ছেটাবে জল।’
‘ছেটাক’, আমি বলি, আপনি যান।’
—‘যাব তো। কাল থেকে আসব না
চাকরি আজ থেকে ছেড়ে দিলাম
আচ্ছা চলি তবে। নমষ্কার।
এইটা বলতেই এসেছিলাম।’
থমকে যাই। এটা কী বলছে?
চাকরি করবে না? দিব্যি তো
চালিয়ে যাচ্ছিলো। কী হলো কী?
—‘শুনুন। স্যরি। আমি দুঃখিত।
আপনি কাল থেকে’— ‘আসব না।’
—‘কারণ? ম্লান হাসে কিরণ রায়
—”আপনি শুনবেন ভেবেছিলাম।’
‘শুনবো। পার্কটায় দাঁড়ানো যায়।’
বৃষ্টিভেজা এই পার্কে আজ
আইসক্রীম নেই। নেই বাদাম।
দেখি যে আজকেও এ লোকটার
উঁচু বোতাম আর নিচু বোতাম!
একটা বড় গাছ, বেদী তলায়
গাছের পাতা থেকে জল ঝরে
কিরণ রায় তার বড় ছাতা
ধরেছে। নিচে আমি, গাছঘরে …
এপথ দিয়ে যদি এখন কেউ
অফিসচেনা যায়? যাক্‌। দেখুক।
উলটোপালটা কে ভাবে অত?
কিরণ রায় দ্যাখে আমরা মুখ।
কী অত দ্যাখো বাপু?— ‘নিন বলুন।’
—‘ছোট থেকেই হার্ট ফুটো আমার
বিদেশে নিয়ে গিয়ে অপারেশন
জরুরি। করাবো না। আমি এবার
দেশের বাড়ি গিয়ে থাকবো। আর
যে ক’টা দিন আছে হাতে গোনা
(কিরণ … ‘ক’ দিয়ে … ‘ক’ … কী বলছে!!)
দশটা পাঁচটায় থাকবো না।’
‘শুনুন এরকম করতে নেই
চিকিৎসায় যত খরচই হোক
চালাতে হয়। কেন এই দেশেই
অপারেশন ক’রে অনেক লোক’…
—‘সুস্থ আছে, জানি। কিন্তু এই
আমার প্রবলেম আরো কঠিন
বলে তো ডাক্তার। পরিভাষায়
কী বলে ভুলে গেছি। এই ক’দিন
ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবো না!’
হঠাৎ রেগে যাই:’স্বার্থপর
পুরুষ মানুষেরা। আপনিও।
বাড়িতে যে রয়েছে তার ওপর
কতটা চাপ যাবে তা ভেবেছেন?
তা ছাড়া ছেলেমেয়ে, বড় তারা?
ভাসিয়ে দিয়ে বুঝি চলে যাবেন?
এবং অফিসের লোক যারা
তাদের কথা নয় ছেড়ে দিলাম …
কিরণ রায় চুপ, দূরে তাকায়
গোঁফটা কাঁচাপাকা জুলপি শ্বেত
বৃষ্টিফোঁটা জমে টাক মাথায়…
কিরণ রায় বলে: ‘বাড়ি আমার
আছে তা ঠিক। নেই বাড়ির লোক
আমাকে বলা যায় চিরকুমার
আক্ষরিক ভাবে। বিবাহ হোক
চাননি ডাক্তার। ‘না’ বলেছেন।
কারণ বিবাহের সকল গুণ
এ হার্টে সইবে না। “সব রকম
উত্তেজনা থেকে দূরে থাকুন”
ফলে তো বিয়ে নয়, বিয়ে হলেও
সন্তানের কথা উঠতো না
এখন এরকম পুরুষকে
কোনো মেয়ে তো বিয়ে করতো না!
তাছাড়া কেন তার জীবনটা
নষ্ট করে দেব! তাই না? আজ
ভাবছি বহুদিন বেঁচে গেলাম!
এবং বেঁচে যাওয়া দারুণ কাজ
আরও দারুণ এই দেখা পাওয়া
যেমন আপনার সঙ্গে এই
পার্কে, বৃষ্টিতে দাঁড়ানো। আর
যেমন খুঁজে দেখা, আপনি নেই।
কখন সিটে এসে বসেন আর
কখন উঠে যান, রোজ কখন
রবিকে দিয়ে দুটো পান আনান…
হয়ত ভাবছেন, লোভীর মন
হয়ত ভাবছেন, আড়ি পাতে
একটা ইচ্ছে বা জোর তো চাই
যা থেকে খুশি লাগে, আনন্দ!
আপনি তাই, ঠিক, আপনি তাই!
কখনো বলবো না ভেবেছিলাম
কিন্তু আজ বলে দিলাম সব …’
কিরণ রায় থামে, আকাশে ফের
বেড়েছে বৃষ্টির মহোৎসব
‘চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই …’
দু’ধারে রাস্তায় জমেছে জল
‘আমার ঠিকানাটা দিয়ে গেলাম
বাঁ’দিকে গিয়ে প্রাচী সিনেমাহল…’
বসেছি ট্রেনে উঠে। কোনো কথা
বলিনি ওকে আজও বলিনি আর
হঠাৎ দেখি সেই মেয়ে এসে
পরীক্ষার পড়া করছে তার
আমার টেবিলেই মেয়ে বসে
দু বেণী বাঁধা আর রঙিন ফ্রক
টেবিলে জল ঢাকা। কাগজে পান
হাতে কলম তার ফাইলে চোখ
মেয়েটা কী ভেবেছে? এইভাবে
কেবল কষ্টই দেবে আমায়?
হঠাৎ দেখি ওর বিপরীতে
চেয়ারে বসে আছে কিরণ রায়!
হ্যাঁ, ওর পড়া ধরে কিরণ রায়

দিদির কাজ

সেদিন বিকেলে দিদি বৃষ্টিমুখে বাড়ি ফিরে গিয়ে
ভিজে শাড়ি না ছেড়েই বসেছে কাগজ পেন নিয়ে
লিখেছে প্রথম বাক্য, কোনরকম সম্বোধন ছাড়া
আপনার বাড়ি থেকে কতদূর, টেলারিং পাড়া?
একপাতা বোতাম লাগবে। ছুঁচসুতো বাড়িতে আছে কি?
না থাকলে নিয়ে যাবো। মাঝেমধ্যে যাবো কিন্তু আমি
বোতামগুলোও যদি ঠিকমতো লাগানো যায়, দেখি…

১০

এই চিঠিখানি লিখছে দিদিটি যখন
একই শহরের রেল স্টেশনে তখন
মেয়েটি অপেক্ষা করছে সুটকেস হাতে
ভাবছে রীণা যদি আজ না-ই ফেরে রাতে!
সন্ধ্যা নামে ঘন হয়ে, বারি ঝরোঝরো
সখীটি না ফিরলে কন্যা কী করো কী করো!
আর যাই করি আমি ফিরব না বাড়ি
কিন্তু সব ভিজে গেছে চুল, জামা শাড়ি
এদিকে ওদিকে ঘুরছে উল্টোপাল্টা লোক
শরীর সামান্য, তবু তার দিকেও চোখ
চায়ের দোকান তার পাশে কাউন্টার
ভাবে কন্যা, রীণা নইলে কোথা যাব আর?
আছে তো সম্বল বলতে সাত-আটশো টাকা
দুটো বালা, দুটো হার—হাতব্যাগে রাখা।
এই হলো ভাগ্য। এই ললাটের লিখা
মাসীর বাড়িও বন্ধ। মাসী আমেরিকা।
সে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারকোণে
হঠাৎ আপের ট্রেন থেমেছে স্টেশনে।
সব ভুলে দৌড়ে গিয়ে ডেকেছে: ‘রীণা রে!’
রীণা চাইছে ইতিউতি/চমকে গিয়ে : ‘আরে!’
‘রীণা আমি চলে এসছি। — ‘মানে’ তার মানে?’
—‘ক’টা দিন থাকব।’—’থাকবি?’— ‘হ্যাঁ, তোর ওখানে।’
—‘অমন করছিস কেন? কী হয়েছে শুনি?’
—‘তুই তাড়িয়ে দিবি না তো?’ —‘হ্যাঁ দেব এক্ষুনি।’
‘চলে এসেছিস?’—‘হ্যাঁ রে।’— ‘সত্যি এসেছিস?
ডাকলে ফিরে যাবি না তো?’— যাবো না—‘প্রমিস?’
—‘প্রমিস্। প্রমিস্।’— উঃ। পারলি শেষকালে।
—‘এখন তো পারলাম, পরে কী আছে কপালে…’
—‘কপাল বললেই কিন্তু মার খাবি এবার।
মা’য়ের কাছে যাবি নাকি?’— ‘না যাবো না আর!’
—‘বর কোথায়?’ —‘ট্যুরে গেছে। সেই রকম ট্যুর!’
—‘কখন বেরিয়েছিস?’— ‘তখন দুপুর।’
—‘সেই থেকে দাঁড়িয়ে? ইস্‌, ভিজে একটা কাক।
চলতো এবার গিয়ে রিকসা ধরা যাক’
এমন বৃষ্টির মধ্যে রিকশা তো যাবে না!
হঠাৎ একজন লোক, একটু চেনাচেনা
বৃষ্টিতে না যেতে পেরে সাইকেল রেখে
দাঁড়ালো। বলোতো কন্যা, চিনতে পারো একে?
লোকটি এইমাত্র এল এই একই গাড়িতে
গিয়েছিল স্টান্ডে রাখা সাইকেল নিতে।
না, যেতে পারল না। গিয়ে ফিরতে বাধ্য হল
ও কন্যা কে ফিরে আসছে! দ্যাখো, মুখ তোলো।
ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার গায়ে বইছে জল
পাঞ্জাবি সসপে আর চশমা ছলোছল।
কন্যা স্তব্ধ। তারও দেহে বৃষ্টি গ্যাছে ভেসে।
‘কী হলো?’ রীণার প্রশ্ন। কন্যা বলে: ‘সে।’
লোকটি এগিয়ে আসছে। কিছু বলছে, তাকে?
‘ভালো আছেন? অনেকদিন দেখিনি আপনাকে।
কথা নেই ! কন্যামুখে হ্যাজাকের আলো
পাশে চা-দোকান থেকে দোকানী জ্বালালো
—‘আপনি ভাল?’ বহুকষ্টে বলে বিধিমতো
(কী চুল ছিল মাথায় ! উঠে গ্যাছে কতো।)
লোকটি বলে: ‘একরকম। আপনি বুঝি আর
এখানে থাকেন না?’ — ‘না তো।’— ‘আজ থেকে আবার
এখানেই থাকবি সেটা বলে দে না বাবা!’
রীণার মুখেও পড়ছে হ্যাজাকের আভা।
—“আবার থাকবেন? সত্যি?’ লোকটির চোখেও
হ্যাজাকের আলো এসে বলে: কে ও? কে ও?
উঁচু কণ্ঠা, চোখে ক্লান্তি। কালিপড়া মুখ
বৃষ্টি ভিজে ফুটে আছে ছোট্ট দুটো বুক।
শুকিয়ে গিয়েছে ওরা? কেন? বলো কেন?
ভাবতেই হঠাৎ মনে পড়েছে কী যেন।
হ্যাঁ আছে এয়োস্ত্রী চিহ্ন। শাঁখা আর পলা।
সিঁদুর যে বৃষ্টিতে বোয়া বাহুল্য তা বলা।
—‘চল রে। বৃষ্টি তো আর ধরবে না বোধহয়’
—‘যাই।’ সম্মোহন ভেঙে যেন জ্ঞান হয়।
কন্যাটি সুটকেস তুলে স্তব্ধ হয়ে থাকে।
লোকটি বলে: আপনি চিনতে পারলেন আমাকে?
মেয়েটি হেলায় ঘাড় : কলেজের মোড়ে
বিকেলে আসতেন আপনি’ … রীণা হাত ধ’রে
সুটকেসটা কেড়ে নেয়। ‘নে চল এবার।’
এবার লোকটিই স্তব্ধ। কথা নেই আর।
রীণা ও নায়িকা উঠে বসেছে রিকসায়
নায়ক বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল চালায়
রিকসাও বৃষ্টিতে ভিজছে। দুই আরোহিণী।
একজন প্রশ্ন করে: ‘ইনি আবার কিনি?’
—‘কে রে লোকটা?’ ঘন হয়ে জানতে চায় রীণা
—বলবি না তো? বাড়ি গিয়ে? রিকসায় বলবি না?
কাছে টানল: বলবি না, কে? এই, বলবি কি না
হাতে মুখ ঢাকে কন্যা: জানি না … জানি না …

১১

এরপরে আর কিছু জানি না আমরাও
কী হবে এখন তোমরা ঠিক করে নাও।
ওই যে প্রধান পাত্র, মেয়েদের দেখে
ও পালাতো, জানতে পারছি, উপন্যাস থেকে।
তবে নায়িকাকে দেখে কেন গেল কাছে?
কথক বলেন যে এরও মধ্যে প্যাচ আছে।
যে-কিম্ভুত কাণ্ড তার ঘটেছে জীবনে
তারপর মেয়ে দেখলে তা-ই আসতো মনে।
কিন্তু এ মেয়ের সঙ্গে সে বয়সে দ্যাখা
তখন সে অপাপবিদ্ধ। প্রেমপ্রার্থী। একা।
কখনও বলেনি ব’লে আজ অবধি তার
এই প্রেম ব্যয় হয়নি। হয়নি ব্যবহার।
তাই মুখ ফেরালেও অন্যদের থেকে
‘শান্তিবারি’ বলে ঠিক চিনতে পারল একে।
নিমেষেই মধ্যবর্তী অভিজ্ঞতা স’রে
সে আবার পৌঁছে গ্যাছে সমাপ্ত কৈশোরে
অন্যপক্ষে মেয়েটির কথাও তো জানো
বিকেল, কলেজপাড়া হৃদয়ে সাজানো।
তার মনে পুরুষের প্রথম ছবিটি
আজও এ যুবক, তার না-চেনা কবিটি।
তাহলে এখন এই গল্পের কী হবে?
গল্পের যা হয় তোক। কী হবে বাস্তবে?
প্রথমত: রীণাদের বাড়িটা কোথায়?
সে রাস্তায় স্কুলমুখে যে পথটি যায়।
বাড়িটি প্রকাশ্য, বড় রাস্তার উপরে
সে পথে মাস্টারও নিত্য যাতায়াত করে
আর সেই যাতায়াতে আচমকা আবার
মুখোমুখি হয়ে পড়া আশ্চর্য কী আর!
হয়তো বিকেলবেলা ছাদে তুলছে শাড়ি
তখনই মাস্টার ফিরছে স্কুল থেকে বাড়ি।
যদি মুখ তুলে তাকে ছাদে দেখতে পায়?
কন্যাও ছাদ থেকে যদি নিচে দৌড়ে যায়?
যায় তো যাক না। তা তো অসম্ভব নয়!
এরকম এ জীবনে কত কিছু হয়!
পূর্বে তো সংকোচ ছিল, সে-অল্প বয়েসে
আজ ভাঙছে সে সংকোচ, দুঃখদিনে এসে
একজন কামশীতল।
অন্যজন পুরুষত্বহারা।
এদের মাঝখানে প্রেম
এসে দাঁড়াচ্ছেন সালংকারা
এবং এবার এই কথক বিদায় নিচ্ছে।
শ্রোতাদের হাতে বাজছে ভেরী
যারা বৃষ্টি ভিজেছিলে, সার বেঁধে দাঁড়াও সব
প্রণাম জানাও শ্রোতাদেরই …

সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *