যামল

যামল

ভূমিকা

একত্রিংশ শতাব্দী, পৃথিবী

পাণ্ডুর চাঁদ আলো দেয় সামান্যই, মাঠে বসানো রোশনি স্তম্ভের মধ্যেও অর্ধেক অকেজো হয়ে পড়েছে। সেই আলো-আঁধারির মধ্যে একটা দানবিক ডাইনোসরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে ল্যান্ডারটা। তার সামনের অংশ থেকে নিঃশ্বাসের মতন বেরিয়ে আসে বাষ্পের কুণ্ডলী।

ল্যান্ডারের একপাশ থেকে বেরিয়ে আসা র‍্যাম্পের দিকে মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়ায় আতঙ্কিত মানুষের দল। মাঠের চারপাশে লাগানো কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে তাদের দিকে মাঝে মধ্যেই ছিটকে আসে এনার্জি অস্ত্রের আলোক রেখা।

বেড়ার উলটোদিকে যারা ক্রুদ্ধ গর্জন করে বেড়া টপকে আসতে চেষ্টা করে তাদের শরীর আদল অনেকটা মানুষের মতো হলেও তারা সম্পূর্ণ মানুষ নয়। মাত্রাছাড়া জেনেটিক এক্সপেরিমেন্টের ফসল সেইসব নরপশুর চেহারা দেখলে মনে হতে পারে কোনও দুঃস্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছে প্রাচীন মিশরের অর্ধ-নর দেবতার দল।

অনেকক্ষণ ধরে তাদের ঠেকিয়ে রেখেছে অতি-ইস্পাতের বেড়া, আর বেড়ার পাশে বকের মতো হেঁটে বেড়ানো স্বয়ংসিদ্ধ এনার্জি কামান। কিন্তু লম্বা লড়াইয়ের পর সে সব কামানের ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষিত, কয়েক জায়গায় দুর্বল হয়ে হেলে পড়েছে বেড়াও।

আর শিকারকে হাত ফস্কে যেতে দেখে ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে পড়ছে বাইরের আক্রমণকারীরাও।

বাইরে থেকে ছিটকে আসা একটা প্লাজমার রেখা পড়ে দৌড়তে থাকা ভিড়ের মধ্যে। তার আঘাতে মাটি থেকে ফোয়ারার মতো ছিটকে ওঠে পাথরের টুকরো। আতঙ্কে চিৎকার করে একটা ছোট মেয়ে, বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে যায় মাঠের অন্যদিকে। পেছনে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে তার পরিজনরা।

ঠিক সেই মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে বেড়ার একাংশ। বন্যার জলের মতো ভাঙা অংশ দিয়ে ঢুকে পড়ে অর্ধ-নরের দল। মাঠের মধ্য দিয়ে তারা ছুটতে থাকে ল্যান্ডারের দিকে। তাদের লক্ষ করে ল্যান্ডার থেকে ছিটকে আসে এনার্জি অস্ত্রের আলোর রেখা, মাঠের অন্যদিক থেকে বকের মতো লম্বা পায়ে দৌড়ে আসে স্বয়ংসিদ্ধ কামান।

আর সেই রণক্ষত্রের মধ্যে আচমকাই ছুটতে থাকা ছোট মেয়েটির সামনে এসে পড়ে একটি অর্ধ-নর।

চেহারা তার মানুষের মতন, কিন্তু মুখে তার ভাল্লুকের আদল স্পষ্ট। হাতের খাটো কুঠারটা মাথার ওপর তুলে শিকার পাওয়ার উল্লাসে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে সে।

আতঙ্কের একটা চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকে থরথর করে।

হঠাৎ যেন বাতাসে বিদ্যুৎ খেলে যায়। মাথার ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে নর-ভাল্লুকের পথ রোধ করে দাঁড়ায় একজন কৃষ্ণকায় তরুণী। তার পরনের ধূসর পোশাকে রক্তের কালচে ছোপ, চুল চুড়ো করে মাথার ওপর বাঁধা, ডান হাতে প্লাজমা পিস্তল, বাঁ হাতে লম্বা তলোয়ার।

হাঁটু বেঁকিয়ে, শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে হাতদুটো শিকারী পাখির ডানার মতন দু-দিকে ছড়িয়ে দেয় তরুণী। তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে চ্যালেঞ্জের তীক্ষ্ণ চিৎকার।

হকচকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায় নর-ভাল্লুক। তারপর হুঙ্কার তুলে দ্বিগুণ উদ্যমে ছুটে আসে কুঠার উঁচিয়ে।

দ্বার-কপাটের মতন আছড়ে পড়া কুঠারের আঘাতটা অনায়াসে মাথা নিচু করে এড়িয়ে যায় তরুণী। তার বাঁ হাতের তলোয়ারটা নিচে থেকে উঠে এসে আড়াআড়ি ভাবে একটা রেখা টেনে দেয় নর-ভল্লুকের গলায়।

ফিনকি দিয়ে ছিটকে আসা রক্তের ফোয়ারা ছিটিয়ে দেয় তরুণীর মুখ, টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে নর-ভাল্লুক।

মেয়েটিকে নিচু পিঠে হয়ে তুলে নেয় তরুণী, ‘আমার গলা জড়িয়ে ধরে রাখ। পড়ে যাসনি।’

দূর থেকে তাদের লক্ষ করে তখন অস্ত্র উঁচিয়ে ছুটে আসছে আরও একদল অর্ধ-নর। সেদিকে তাকিয়ে মাথার ওপর রক্তমাখা তলোয়ার তুলে এক বিকট অট্টহাসি হেসে ওঠে তরুণী। তার কৃষ্ণকালো মুখে রক্তাক্ত দাঁতগুলো চকচক করে চাঁদের আলোয়।

‘তুমি কে?’ তার গলা জড়িয়ে থাকা মেয়েটি সভয়ে জিজ্ঞেস করে পিছন থেকে।

‘তোর মা!’

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের রাত্রি গোলার্ধ

তুহিনের অন্ধকার পিঠের অনেক ওপরে খানিকটা জমাট অন্ধকারের মতন ভাসে শত-শতঘ্নী, স্বরাজের স্তবক যান।

মহাকাশের অন্ধকার প্রেক্ষাপট থেকে শত-শতঘ্নীকে যদি আলাদা করে চেনা যেত, তাহলে মনে হত ধাতুতে গড়া গোটা তিরিশেক পেটমোটা চুরুটকে যেন একটা চওড়া আংটির ভেতর দিয়ে একসঙ্গে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই অদ্ভুত গঠনের একপ্রান্তে একটুকরো এবড়োখেবড়ো কয়লার মতন বসানো ধাতব কৃস্টালে গড়া শত-শতঘ্নীর কন্ট্রোল-কামরা। তাকে ঘিরে নিষ্পত্র গাছের মতন ডালাপালা মেলে মাথা উঁচিয়ে থাকে এনার্জি অস্ত্রের নানান ক্ষমতা আর পাল্লার অ্যান্টেনা, এনার্জি বর্ণালীর প্রতিটি ব্যান্ডে তাদের দখল অবাধ।

কন্ট্রোল-কামরার মেঝে থেকে ছত্রাকের মতন বেড়ে ওঠা লম্বা টুলে বসে থাকে শত-শতঘ্নীর ট্রিবিউন হিমাংশু প্লুটার্ক। তাকে ঘিরে একই রকমের টুলে বসে থাকে তার ইকুয়াইট অফিসাররা, কন্ট্রোল-কামরার নরম সোনালী আলোয় চমকায় তাদের নানান রঙের কৃস্টালের বর্ম।

নিজের স্ফটিক-সাদা বর্মের দিকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখ চলে যায় হিমাংশুর। তার মতন একজন প্লেবিয়ানের দেহে ট্রিবিউনের বর্ম চড়াটা পেশাদারী কৃতিত্বের কম পরিচয় বহন করে না, কিন্তু সে বর্মে বংশগৌরবের রঙের ছোঁয়া লাগতে এখনও কয়েক পুরুষ দেরি।

‘আমরা কি এইভাবেই এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল হয়ে বসে থাকব?’

প্রশ্নকর্তার দিকে তাকায় হিমাংশু। অফিসারটির পরনের বর্মে লালচে-বেগুনি রঙের ছোঁয়া, মাথার চুল পনিটেল করে টেনে বাঁধা, মুখের ভাবে ধৈর্য্যের অভাব সুস্পষ্ট।

ইকুয়াইট শৌভিক সিসেরো।

শৌভিকের বর্মের বেগুনি বর্ণের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস টানে হিমাংশু। শৌভিক যে কোনও এক বনেদী বংশের সন্তান তার বর্মের ওই রং থেকেই স্পষ্ট। তাকে হিমাংশুর মতন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিচু পদ থেকে অফিসার হতে হয়নি, বংশগৌরব আর দৌলতের জোরে আকাদেমির পাঠ চুকিয়ে সরাসরি ইকুয়াইটের পদে যোগ দিয়েছে সে।

প্রায় দু-দশকের সামরিক জীবনে এই ধরণের বেপরোয়া, দুর্বিনীত অফিসারদের রাশ টেনে রাখতেই সবচাইতে বেশি বেগ পেতে হয়েছে হিমাংশুকে। মিশনের লক্ষ্য হাসিল করা নয়, বরং যে কোনও মূল্যে লড়াইয়ে নাম কামানোটাই যেন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। বিশেষত হিমাংশুর মতন স্বল্প বংশমর্যাদার অফিসারদের সামনে এদের ঔদ্ধত্য যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

শৌভিকের চোখে চোখ রাখে হিমাংশু। কণ্ঠে আনে সামান্য শ্লেষের ছোঁয়া।

‘আমাদের মিশন অবজেক্টিভ কি ইকুয়াইট শৌভিককে একবার মনে করিয়ে দেবে ইকুয়াইট নয়না?’

ইকুয়াইট নয়না লুক্রেসিয়াসের কৃস্টালের দস্তানা মোড়া হাতটা সশব্দে আছড়ে পড়ে তার নীল কৃস্টালের বর্মের বুকে।

‘কোনওরকম উত্তেজনা সৃষ্টি না করে পথিককে যথাসম্ভব সংগোপনে হিমেলগাঁও থেকে তুলে স্বরাজে নিয়ে যাওয়া। ট্রিবিউন!’

হিমাংশুর ঠোঁটের কোণ ছোঁয় তার কণ্ঠের শ্লেষ, ‘সংগোপনে শব্দটার মানে আশা করি ইকুয়াইট শৌভিকের মতন একজন আকাদেমি-ফেরত অফিসারকে বোঝাতে হবে না? আমাদের উদ্দেশ্য হিমেলগাঁওয়ের মানুষজন কিছু জানার বা বোঝার আগেই পথিককে ছিনিয়ে নিয়ে আসা।’

সামান্য হাত নাড়ায় হিমাংশু। কন্ট্রোল-কামরার মেঝে থেকে ধোঁয়ার মতন পাক খেয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে কালো কৃস্টালের গুঁড়ো, আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে একটা কালো বলের আকার নিয়ে পাক খেতে থাকে হিমাংশু আর তার ইকুয়াইটদের মাঝে।

আর একবার হাত নাড়ে হিমাংশু, আলোর একটা মৃদু ঝিলমিল খেলে যায় কালো বলের ওপর দিয়ে, রং আর গড়ন বদলে সেটা চেহারা নেয় একটা বরফে ঢাকা গ্রহের।

তুহিন।

তুহিনের এক পিঠে দিনের আলো, অন্যদিক অন্ধকার।

আলোকিত দিকে ফুটে ওঠে একটা নীল ফুটকি। আঙুল তুলে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে হিমাংশু, ‘হিমেলগাঁও এখন তুহিনের দিবা ভাগে। রাত্রি নামার আগে আমরা আমাদের অভিযান শুরু করতে পারব না। আর তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না তুহিন তার অক্ষে পাক খেয়ে হিমেলগাঁওকে নিয়ে আসছে রাত্রি ভাগে।’

ইকুয়াইটদের সারির ওপর একবার চোখ বোলায় হিমাংশু, ‘আমাদের মিশনের মূল উদ্দেশ্য পথিককে আটক করে স্বরাজে নিয়ে যাওয়া। যথাসম্ভব সংঘাত এড়িয়ে।’

হঠাৎ একটা লাল বিন্দু জ্বলে ওঠে তুহিনের ভাসতে থাকা প্রতিকৃতির আলোকিত দিকে। একটা তীক্ষ্ণ সাইরেনের আওয়াজ ভরিয়ে ফেলে কন্ট্রোল-কামরা।

ইকুয়াইটদের মাঝখান থেকে ভেসে আসে সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকার কণ্ঠস্বর, ‘সংঘাত বোধহয় এড়ানো যাবে না ট্রিবিউন। স্বরাজের যুদ্ধজাহাজ এইমাত্র এসে পৌঁছেছে তুহিনের কক্ষপথে।’

বিস্মিত দৃষ্টিতে নয়না তাকায় বিজয়ার দিকে, ‘কিন্তু কেন?’

ছোট ছোট করে ছাঁটা মাথার কাঁচাপাকা চুলে হাত বোলায় বিজয়া সেনেকা, ‘হাওয়া খেতে নিশ্চয়ই নয়। খুব সম্ভব আমাদের মতো ওরাও এসেছে পথিকের সন্ধানে।’

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হিমাংশু। শৌভিকের ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসির ছোঁয়াটা তার নজর এড়ায়নি।

তিন সপ্তাহ আগে, স্বরাজ

মেঘের আস্তরণ ভেদ করে অটোকপ্টার নেমে আসে মাটির দিকে, জানলা দিয়ে নজরে পড়ে এক সুবিশাল হ্রদ, ভোরের আলো পড়ে ঝকঝক করছে তার জল। হ্রদের একপাশে জঙ্গল, তার লালচে-হলুদ বিস্তৃতি চাদরের মতন পাতা দিগন্ত অবধি। হ্রদের অন্যপাশে তার প্রশস্ত রাজপথ, কুঞ্জভবন, ফোয়ারা আর মর্মর মূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রমোদনগরী বিলাসপুর।

হ্রদের ওপর দিয়ে পাক খেয়ে বিলাসপুরের দিকে নেমে আসে অটোকপ্টার, তার রোটেরের বাতাস বৃত্ত এঁকে দেয় জলের বুকে। জঙ্গলের সীমানায় দাঁড়ানো জলহাতীর পাল চোখ তুলে একবার তাকায় ওপরের দিকে, তারপর ফের মন দেয় হ্রদের জলে শিঙার মতন শুঁড় ডুবিয়ে জলজ শ্যাওলা ছাঁকার কাজে। একটা শেয়াল-চিল পাশ কাটিয়ে ছেড়ে দেয় অটোকপ্টারের পথ, তারপর ছাতার মতন বড় পাখাদুটো ছড়িয়ে ঝাঁপ দেয় হ্রদের বুকে।

বিলাসপুরের বাইরে একটা ল্যান্ডিং প্যাডে এসে নামে অটোকপ্টার। ছোট ফোলিও ব্যাগটা হাতে নিয়ে লাফিয়ে নামে হিমাংশু। গত রাতে হয়তো বৃষ্টি হয়েছিল, জলে ভিজে চকচক করে ল্যান্ডিং প্যাডের রংবেরঙের মোজায়েক।

চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখে হিমাংশু, তার পেছনে হ্রদ, সামনে শুরু হয়েছে বিলাসপুরের কুঞ্জভবনের সারি। এখানে এই তার প্রথম আসা। তার মতন একজন মাঝারি মাপের সামরিক অফিসারের পক্ষে এই ধরণের প্রমোদনগরীতে বেড়াতে আসা সাধ্যের অতীত। আর কাজে আসার প্রশ্ন নেই, স্বরাজের এই লাগোয়া গোলার্ধে কোনও সরকারি অফিস নেই, সবই তফাত গোলার্ধে।

মাথা ঘুরিয়ে পশ্চিমের আকাশটা দেখে হিমাংশু। ভোরের নরম আলো মাখা আকাশের অর্ধেকটা জুড়ে ঝকঝক করে স্বরাট, স্বরাজের যুগ্ম গ্রহ। স্বরাজের লাগোয়া গোলার্ধে না এলে এ দৃশ্য দেখা যায় না।

লাগোয়া গোলার্ধ।

মানুষ স্বরাজে পা দেওয়ার পর এই নতুন শব্দ যোগ হয়েছে তার ভূগোলের পরিভাষায়। আর তার কারণ স্বরাজ আর স্বরাটের বিচিত্র গতি প্রকৃতি।

প্রকৃতির কোনও এক অদ্ভুত খামখেয়ালে অর্ক নামক নক্ষত্রটির চারপাশের ঘোরার সময় নিজেদের অক্ষে লাট্টু্র মতন পাক খেতে খেতেই পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে স্বরাজ আর স্বরাট।

আর সেই একই প্রাকৃতিক বেখেয়ালে তাদের অক্ষে পাক খাওয়ার গতি আর পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করার গতি এক।

অতএব গাণিতিক নিয়মেই স্বরাজের একটি মাত্র গোলার্ধ সর্বদা সম্মুখীন হয়ে থাকে স্বরাটের। স্বরাজের একটি মাত্র পিঠ থেকে দেখা যায় স্বরাটের একটি মাত্র পিঠকে। স্বরাট থেকেও তাই।

স্বরাটের মুখোমুখি দিকটা তাই নতুন পরিভাষায় স্বরাজের লাগোয়া গোলার্ধ। বিপরীত দিকটা তফাত গোলার্ধ।

স্বরাজ আর স্বরাটের শত্রুতার জন্য, স্বরাজের এই গোলার্ধে মানুষের বসবাস বিশেষ নেই। আছে কেবল লুকানো সামরিক ঘাঁটি আর আড়ি পাতার কমিউনিকেশন যন্ত্র।

আর আছে বিলাসপুরের মতন দু-একটা প্রমোদনগরী। স্বরাজের লাগোয়া গোলার্ধে স্বরাটের আকাশজোড়া শোভা আর দিনরাত্রির অদ্ভুত ছন্দ দেখতে অনেকে এখানে ছুটি কাটাতে আসে।

সুতরাং এখানে আসার ডাক পেয়ে খানিকটা অবাক হয়েছিল হিমাংশু। হেডকোয়ার্টার থেকে গতকাল আসা দু-লাইনের ছোট্ট মেসেজটা তাকে বিলাসপুরে হাজির হতে বলা ছাড়া আর কোনও ব্যাখা দেয়নি।

কিন্তু অর্ডার মানে অর্ডার। অতএব মাঝরাতেই হেডকোয়ার্টারের পাঠানো অটোকপ্টারে চড়ে বসেছিল হিমাংশু।

ল্যান্ডিং প্যাডের ভিজে মোজায়েক থেকে বাতাসে জলকণা ছিটকে গড়িয়ে আসে একটা টাঙ্গা। হ্রদের দিক থেকে এক ঝলক ভিজে বাতাস বয়ে আনে কোনও অজানা ফুলের উগ্র সুবাস আর শেয়াল-চিলের কর্কশ ডাক।

টাঙ্গা এসে থামে হিমাংশুর সামনে। তার ভেতর থেকে কোথাও বেজে ওঠে সুরেলা কণ্ঠ, ‘বিলাসপুরে স্বাগতম ট্রিবিউন। আপনি উঠে বসলেই আমরা গন্তব্যের

দিকে যাত্রা শুরু করতে পারি।’

বিনা বাক্যবায়ে উঠে পড়ে হিমাংশু, সারথিবিহীন টাঙ্গা ছুটতে আরম্ভ করে বিলাসপুরের রাস্তা ধরে।

বড় রাস্তা দিয়ে দৌড়নোর পর একদিকে বাঁক নেয় টাঙ্গা, একটা গলিপথ ধরে কিছুটা ছুটে এসে দাঁড়ায় একটা বন্ধ ফটকের সামনে।

আপনা থেকেই খুলে যায় ফটক, টাঙ্গা থেকে নেমে ভেতরে পা রাখে হিমাংশু। নজরে পড়ে একটা পাথরে বাঁধানো উঠোন, আর তার সামনে ছড়ানো দোতলা বাড়ি। বাড়ির ছাদের লাল টালির অর্ধেক ছেয়েছে কোনও লতানে ফুল গাছে, খিলেন দেওয়া উঁচু জানলাগুলোর কাচের শার্সিতে চমকায় সকালের রোদ।

একতলার দরজা খুলে বেরিয়ে আসে একজন, পরনে সাদামাটা হালকা পোশাক। খোলা দরজার দিকে তুলে ধরে হাত, ‘ট্রিবিউন প্লুটার্ক! আসুন। এইদিকে।’

তার কবজিতে বাঁধা ব্রোঞ্জের খোদাই করা ব্রেসলেটটা নজর এড়ায় না হিমাংশুর।

প্রেটোরিয়ান গার্ড। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তাদের নিরাপত্তা প্রহরী।

বিস্ময় চেপে রেখে মর্মর মূর্তি আর বিশাল ফুলদানি দিয়ে সাজানো করিডোর দিয়ে হাঁটে হিমাংশু। শার্সি দিয়ে আসা অর্কের আলো কার্পেটের মতন লুটিয়ে থাকে মার্বেলের মেঝেতে। কোথা থেকে ভেসে আসে সুরের মৃদু মূর্ছনা আর জল পড়ার নিক্কণ ধ্বনি।

ব্রোঞ্জের কারুকাজ করা একটা উঁচু দু-পাল্লার দরজার সামনে শেষ হয়েছে করিডোর। তারই একটা কপাট খুলে ধরে প্রেটোরিয়ান।

ঘরের ভেতর পা রাখে হিমাংশু। পেছনে বন্ধ হয়ে যায় দরজা।

‘এসো ট্রিবিউন।’

ঘরের অপর প্রান্তে একটা বিশাল মার্বেলের টেবিলের পেছন থেকে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর।

টেবিলের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে সজোরে একটা নিঃশ্বাস টানে হিমাংশু। টেবিলে দু-হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো চেহারাটা তার চেনা। কুচকাওয়াজে, মিলিটারি সেমিনারে, দূর থেকে অনেকবার ও চেহারা দেখেছে সে। পাতলা নাক, ঋজু পিঠ, মাথার কালো চুলের দু-এক জায়গায় রুপোলি ছোঁয়া।

লেগেট সঞ্চিতা অরেলিয়াস। স্বরাজের মিলিটারি কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান।

নিজের অজান্তেই গোড়ালিদুটো একসঙ্গে ঠুকে যায় হিমাংশুর। ডান হাতের মুঠোটা আছড়ে পড়ে বুকের ওপর।

‘আভীই লেগেট!’

হাত তুলে একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করেন লেগেট সঞ্চিতা, ‘আভীই ট্রিবিউন। বসো।’

চওড়া টেবিলের অপর দিক থেকে হিমাংশুর দিকে তাকান লেগেট সঞ্চিতা, ‘তোমাকে একটা অত্যন্ত গোপন মিশনের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য এখানে ডেকে আনা হিমাংশু।’

‘কিন্তু এখানে কেন, লেগেট? মিলিটারি হেডকোয়ার্টারে—’

হিমাংশুর কথায় মাঝপথেই বাধা দেন লেগেট সঞ্চিতা, ‘হেড কোয়ার্টারে তোমাকে ডেকে পাঠালে অনেকের নজরে পড়ত। স্বরাটের চর সর্বত্র। অফিসিয়াল রেকর্ডে তুমি এখানে দিন কয়েকের ছুটি কাটাতে এসেছ। আমার সঙ্গে তুমি যে দেখা করছ তা মিলিটারি কাউন্সিলে দু-একজন আর আমার প্রেটোরিয়ান গার্ড ছাড়া কেউ জানে না।’

কপাল কুঁচকোয় হিমাংশু, ‘আমরা কি কোনও হামলার আশঙ্কা করছি লেগেট? স্বরাট কি আবার কোনও ষড়যন্ত্রের ছক কষছে?’

টেবিলের পেছনে একটা উঁচু শার্সি ঠেলে খুলে দেন লেগেট সঞ্চিতা। বাইরে থেকে ভেসে আসে ফোয়ারার জল পড়ার শব্দ।

‘ষড়যন্ত্র একটা অবশ্যই চলছে ট্রিবিউন। তবে তার পেছনে স্বরাটের হাত আছে কি না ঠিক এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’

‘মানে স্বরাট ছাড়া অন্য কেউ ষড়যন্ত্র করছে আমাদের বিরুদ্ধে! স্বরাট ছাড়া অর্কমণ্ডলীতে আমাদের আর শত্রু কে আছে?’

কণ্ঠের বিস্ময় চেপে রাখতে পারে না হিমাংশু।

একটা লম্বা নিঃশ্বাস টানেন লেগেট সঞ্চিতা, ‘হিমেলগাঁওয়ে এক প্রচারকের

আবির্ভাব হয়েছে। সে নিজেকে পরিচয় দেয় পথিক বলে। আমাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সে ক্ষেপিয়ে তুলছে। বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করছে।’

কপালে রেখা পড়ে হিমাংশুর।

‘হিমেলগাঁও! তুহিনের বুকে ঘিঞ্জি বস্তী! সেখানে বসে আমাদের বিরুদ্ধে কেউ চক্রান্ত করছে? অতি অবশ্যই তাহলে স্বরাটের চর হবে।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন লেগেট সঞ্চিতা, ‘আমরাও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পথিক কেবল আমাদের বিরুদ্ধে নয়, স্বরাটের বিরুদ্ধেও মানুষকে উস্কানি দিচ্ছে।’

বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে হিমাংশুর দু-চোখ, ‘স্বরাজ আর স্বরাট, দুইয়েরই শত্রু! কে এই পথিক?’

সামান্য হাত নাড়েন লেগেট সঞ্চিতা। টেবিল থেকে মার্বেলের গুঁড়ো ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে ওপর দিকে, ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে তৈরি করে একটা মানুষের অবয়ব, আপাদমস্তক তার আলখাল্লায় ঢাকা।

‘পথিক কে আমরা জানি না ট্রিবিউন। কিন্তু হিমেলগাঁওয়ে তার উপস্থিতি আমাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘কিন্তু কেন লেগেট? হিমেলগাঁও একটা জঘন্য বস্তির বেশি কিছু নয়। স্বরাজ আর স্বরাট শাসনের মুঠো থেকে পালানো সব মানুষের বাস সেখানে। স্বরাজের বিরুদ্ধে সেখানে কিছু বললেই বা কী এসে যায়?’

দু-হাতে ভর দিয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়েন লেগেট সঞ্চিতা।

‘কারণ পথিক তার বিষাক্ত প্ররোচনা আর কেবল হিমেলগাঁওয়ে আটকে রাখছে না ট্রিবিউন। ডেরা পালটে-পালটে ক্রমাগত ব্রডকাস্ট করে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্বরাজের সর্বত্র।’

লেগেট সঞ্চিতার শরীরের ধাক্কায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়ে পথিকের অবয়ব।

‘ট্রিবিউন, তোমাকে হিমেলগাঁও থেকে তুলে নিয়ে আসতে হবে পথিককে। যথাসম্ভব গোপনে।’

‘কিন্তু হিমেলগাঁওতে তাকে খুঁজে পাব কী করে?’

‘শত-শতঘ্নীকে নিয়ে তুহিনের কক্ষপথে অপেক্ষা করতে থাকো। পথিক

সাধারণত রাতের দিকে ব্রডকাস্ট করে। তার সন্ধান পেলেই তাকে হিমেলগাঁও থেকে তুলে নিয়ে আসবে।’

হিমাংশুর চোখে চোখ রাখেন লেগেট সঞ্চিতা, ‘আর মনে রেখো, কাজটা করবে যথাসম্ভব ঝামেলা এড়িয়ে। হিমেলগাঁও বা স্বরাজ, কারও সঙ্গেই এই মুহূর্তে সংঘাতে যেতে চাই না আমরা।’

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের দিবা গোলার্ধ

নিষ্কাশনীর নীলচে শিখা নিবিয়ে ফেলে কোনও অতিকায় জল-জীবের মতো তুহিনের কক্ষপথে ভাসে বিঘ্ন-বিজয়; বাছাই করা অস্ত্রে সাজানো স্বরাটের বিধ্বংসী মানোয়ার। তার একদম মাথার কাছে সুবিশাল এক পলকাটা মণির মতন জ্বলজ্বল করে কবচ-কাচে মোড়া জাহাজের কন্ট্রোল-কামরা।

ঘেরাটোপের তলায় কাচের দেওয়াল বরাবর ধনুকের আকারে বসানো কন্ট্রোল প্যানেল। তার সামনে টান টান পিঠে ইস্পাত-কঠিন চাহনি নিয়ে বসে থাকে মানোয়ারের অফিসাররা।

ধনুকের আকারে প্যানেলের ঠিক মধ্যভাগে কাচের দেওয়ালের দিকে মুখ করে সুবিশাল কন্ট্রোল চেয়ারে বসে থাকে রোহিণী। রোহিণী বিসমার্ক। স্বরাটের সর্বকনিষ্ঠ কাপিটান। দুই হাত তার আলতো করে রাখা চেয়ারের হাতলে, মাথায় টায়রার মতন জড়িয়ে রাখা কমিউনিকেশন ব্যান্ডে ছোটাছুটি করে আলোক সংকেত।

কাচের ওপারে মহাকাশের কালো ক্যানভাসে আঁকা তুহিনের বরফে মোড়া চেহারা ঝকঝক করে অর্কের আলোয়। তার দিকে দিকে তাকিয়ে বহু আগে পড়া গ্রহের ইতিহাসটুকু মনে করার চেষ্টা করে রোহিণী। কোনও এক ধূসর অতীতে তুহিনের পিঠ ফেটে ব্যাধির মতন বেরিয়ে এসেছিল একের পর এক আগ্নেয়গিরি। তাদের থেকে ছিটকে যাওয়া ভস্ম ঢেকে ফেলেছিল তুহিনের সমস্ত আকাশ, অর্কের আলো তুহিনে পৌঁছতে পারেনি। দীর্ঘ সময় পরে যখন সরে গেল ভস্ম মেঘের আস্তরণ, ততক্ষণে বরফের চাদর ঢেকে ফেলেছে তুহিনকে। সে চাদর এতই উজ্জ্বল যে অর্কের উত্তাপের বেশিরভাগটাই প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে যায় তুহিন থেকে। সেই থেকে এক নিরন্তর তুষার যুগে বাঁধা পড়ে আছে তুহিন।

জাহাজের ডেকে পায়ের শব্দ ওঠে। তুহিনের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরায় রোহিণী। লিয়্যুট্‌নান্ট সন্দীপ নিৎসে। পরনে জাহাজি ফৌজের নীলচে-ধূসর

ইউনিফর্ম, কাঁধের পটিতে জ্বলজ্বল করে র‍্যাঙ্কের পরিচয় দেওয়া আলোক রেখা।

কেতাবী ঢঙে নিখুঁত স্যালুট করে সন্দীপ।

‘রিপোর্টিং কাপিটান!’

‘রিপোর্ট!’

রোহিণীর মাথার কমিউনিকেশন ব্যান্ডে এদিক-ওদিক ছুটে যায় বিন্দু বিন্দু আলো।

‘সব সিস্টেম নর্মাল। ইঞ্জিন অফলাইন। স্ক্যানিং চালু। অর্ডার কাপিটান?’

তুহিনের দিকে ফের দৃষ্টি ফেরায় রোহিণী, ‘কোনও অর্ডার নেই সন্দীপ। আপাতত আমাদের কাজ কেবল নজর রাখা। পথিকের সন্ধান পেলে তারপরে শুরু হবে মিশনের পরের ধাপ।’

তুহিনের দিকে চোখ রাখে সন্দীপও, ‘এখানে কি সব সময়েই শীতকাল?’

ঠোঁটে ফুটে উঠতে চাওয়া হাসিটাকে মনের ভেতরেই চেপে রাখে রোহিণী। কাপিটানের সব আদবকায়দা স্বরাটের মিলিটারি ডিসিপ্লিনের নিগড়ে বাধা।

‘না এখানেও ঋতু পরিবর্তন হয়। ঠিক এই সময়ে তুহিনে গ্রীষ্মকাল চলছে।’

‘গ্রীষ্মকাল! ওই বরফের মধ্যে গ্রীষ্ম!’

চেষ্টা করেও নিজের কণ্ঠস্বরের বিস্ময়টা চেপে রাখতে পারে না সন্দীপ।

‘গরমটা অপেক্ষাকৃত সন্দীপ। গ্রীষ্মকালে তুহিনের তুষার কিছুটা হলেও গলে যায়। বিষুব অঞ্চলটা লক্ষ করো।’

একই ঋজু ভঙ্গীমায় বসে থাকে রোহিণী, কেবল আলতো করে বাতাসে নাড়ে একটা হাত, আবার ছুটোছুটি করে তার মাথার কমিউনিকেশন ব্যান্ডে আলোর বিন্দুগুলো। কেমন একটা আবছা কাঁপুনি লাগে কন্ট্রোল-কামরার পলকাটা কাচে, বাইরে মহাকাশের নিকষ কালো ক্যানভাসে আঁকা গ্রহটা হঠাৎ যেন তিনগুণ বড় হয়ে যায়।

মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দেখে সন্দীপ নিৎসে। তুহিনের বিষুবরেখা বরাবর একটা নীল ফিতের মতো আকার নজরে পড়ে তার।

‘এটা কি হ্রদ?’

‘না। সমুদ্র। গ্রীষ্মকালে তুহিনের সমুদ্রের এই অংশটুকুর বরফ গলে যায়।’

আবার হাত নাড়ে রোহিণী। আয়তনে আরও বড় হয়ে ওঠে তুহিনের বরফ

ঢাকা চেহারা, আরও পরিষ্কার ভাবে দেখা যায় তার বিষুবরেখা বরাবর লম্বা টানা সমুদ্রটা।

সমুদ্রের ধারে এক জায়গায় সাদা তুষারের ওপর ছত্রাকের মতো ছড়িয়ে রয়েছে একটা কালচে ছোপ। তার দিকে আঙুল তুলে দেখায় রোহিণী।

‘হিমেলগাঁও!’

রোহিণীর কন্ট্রোল চেয়ারের একপাশে ভেসে ওঠে আলোয় গড়া একটা ত্রিমাত্রিক ছবি। সাদা তুষারের ওপর অগোছালো ভাবে বসানো নানান টুকরো-টাকরা দিয়ে গড়া অসংখ্য হতশ্রী কুঁড়েঘরের এক কদর্য জটলা।

বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটে ওঠে সন্দীপ নিৎসের চোখে মুখে।

‘সমস্ত গ্রহমণ্ডলীর যত চোর-বদমাইসের আখড়া! এটাকে আমরা সহ্য করি কেন কাপিটান? একটা টর্পেডোতে তো এই জঞ্জাল সাফ করে দেওয়া যায়!’

মাথা নাড়ে রোহিণী, তার হাতের সামান্য ইশারায় আরও বড় হয়ে ওঠে হিমেলগাঁওয়ের কুৎসিত বিস্তার।

‘সহ্যের কারণটা তুমিও জানো সন্দীপ। যেখানে আজ হিমেলগাঁও, তার কাছেই বহুকাল আগে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন লোকমাতা। বহু মানুষের কাছে ও ভূমি আজও পবিত্র। ওর ওপর আঘাত করলে আমাদের ওপরে আছড়ে পড়বে জনরোষ।’

ত্রিমাত্রিক ছবিটা ঝুঁকে পড়ে দেখে লিয়্যুট্‌নান্ট সন্দীপ নিৎসে। ঝুপড়ি আর কুঁড়েঘরের ভিড়ের মধ্যে কোনওমতে অস্তিত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে কালো ব্যাসাল্ট পাথরে গড়া এক নারীমূর্তি। পাথর কোঁদা কঠিন চোয়াল, পেনসিলের আঁচড়ের মতন পাতলা ঠোঁট, মুঠো করা হাত তুলে ধরা বুকের কাছে।

লোকমাতা অনন্তা।

একটা হালকা শিহরণ নেমে যায় সন্দীপ নিৎসের মেরুদণ্ড বেয়ে।

হিমেলগাঁও ধ্বংস করতে গিয়ে রক্তের বন্যা বয়ে গেলে ক্ষতি নেই, কিন্তু ওই মূর্তির গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগলে মানুষ তাদের ছিঁড়ে খাবে।

চেয়ার ঘুরিয়ে সন্দীপের দিকে ফেরে রোহিণী, ‘হিমেলগাঁও ধ্বংস করা সম্ভব নয় লিয়্যুট্‌নান্ট, আর তার প্রয়োজনও নেই। পথিক ওই হিমেলগাঁওয়ের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে। আমাদের মিশন তাকে জীবিত অবস্থায় আটক করে স্বরাটে নিয়ে যাওয়া। তাকে হত্যা করা নয়। রিপিট।’

আবার কেতাবী কায়দায় স্যালুট করে সন্দীপ নিৎসে।

‘আমাদের মিশন পথিককে জীবিত অবস্থায় আটক করে স্বরাটে নিয়ে যাওয়া। কাপিটান!’

উচ্চগ্রামে বলা সন্দীপ নিৎসের কথাগুলো ছড়িয়ে যায় কন্ট্রোল-কামরার চারপাশে।

এক সপ্তাহ আগে, স্বরাট

ড্রামের বুককাঁপানো বাজনাটা চড়তে চড়তে হঠাৎ থেমে যায়। লম্বা মূর্ছনায় বেজে ওঠে বিউগ্‌ল।

হাতে কফির কাপ নিয়ে টেরাস থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখে রোহিণী। আজকের মতো শেষ হল প্যারেড। নিচের বাঁধানো আঙিনা থেকে লাইন দিয়ে ফেরত চলে যায় কিশোর আর কিশোরী ক্যাডেটের দল, টানটান পিঠে তাদের দিকে নজর রাখে ড্রিল ইন্সট্রাক্টররা। সকালের আলো ঝলসায় আঙিনার পালিশ করা জ্যামিতিক নকশা আর ক্যাডেটদের ধাতুর বোতাম থেকে।

চোখ তুলে সামনের দিকে তাকায় রোহিণী। তফাতভাগের আকাশে স্বরাজের জগদ্দলের উপস্থিতি নেই, সমুদ্রের মতো নীল আকাশে কেবল খেলা করে রোদমাখা মেঘ।

মেঘ আর আকাশের নিচে নিখুঁত ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিতে গড়া কোনও যন্ত্রাংশের মতন দিগন্ত অবধি ছড়িয়ে থাকে বীরগঞ্জ। স্বরাটের রাজধানী।

বীরগঞ্জের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে ছুঁচের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারি টাওয়ারের ওপরের কোনও তলায় না এলে অবশ্য এ দৃশ্য দেখা যায় না। এখানে কাজে এলেই তাই এই টেরাসের কাফেতে অন্তত কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় রোহিণী।

কাপে ঠোঁট ঠেকায় রোহিণী, চুমুক দেবার আগে কফির কড়া সুগন্ধ বুকে টেনে নেয় লম্বা নিঃশ্বাসের সঙ্গে। স্বরাজে তার কাজ আপাতত শেষ, এবার জাহাজ নিয়ে ফের মহাকাশে ফেরার পালা।

‘ফ্রয়লাইন কাপিটান! কাপিটান বিসমার্ক!’

কফির আস্বাদ নেওয়া হয় না রোহিণীর। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একজন জুনিয়র অফিসার। স্যালুট করে বাড়িয়ে ধরে একটা ভাঁজ করা কাগজ, সিলমোহর দিয়ে তার মুখ বন্ধ করা।

বিস্ময়টা মুখে ফুটে উঠতে দেয় না রোহিনী। অত্যন্ত গোপন বার্তা ছাড়া এ ধরণের কাগজ ব্যবহারের প্রচলন নেই।

কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নেয় অফিসার। সাবধানে সিলমোহর ভেঙে ভাঁজ খোলে রোহিণী।

এক লাইনের ছোট্ট চিঠি। শহরের উপকণ্ঠের একটা ঠিকানায় হাজির হওয়ার নির্দেশ। নিচে হলোগ্রাম জ্বলজ্বল করে গেস্টাপো অফিসের।

খানিকটা উৎকণ্ঠা নিয়ে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে রোহিণী। গেস্টাপো। অর্থাৎ সিক্রেট পুলিস।

এ ধরণের চিঠির দুটো অর্থ। হয় তাকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে কোনও গোপন কাজের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য, অথবা তার বিরুদ্ধে গেস্টাপোর কাছে রাষ্ট্রদ্রোহের মতো কোনও গুরুতর অভিযোগ এসেছে।

কিন্তু কারণ যা-ই হোক, নির্দেশ অমান্য করা যায় না। ঠিকানাটা মুখস্থ করে নেয় রোহিণী, তারপর চিঠিটাকে ছুঁড়ে দেয় টেরাস থেকে বাইরে।

দপ করে জ্বলে ওঠে চিঠির কাগজ, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার ধূসর ছাই মিশে যায় বাতাসে।

টেরাসের পেছনে সারি সারি ভূ-টান টিউবের একটাতে পা রাখে রোহিণী, তার শরীরটা ধীরে ধীরে ভেসে নেমে আসে মিলিটারি টাওয়ারের বেসমেন্টে।

টিউব থেকে বেরিয়ে সামনেই পার্কিং। সেখানে সার দিয়ে দাঁড়ানো একটা চুম্বক-ভাসি গাড়িতে উঠে বসে রোহিণী।

কর্কশ স্বরে কথা বলে ওঠে গাড়ি, ‘স্বাগতম কাপিটান বিসমার্ক। বলুন আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারি।’

ঠিকানাটা আউড়ে গাড়ির সিটে পিঠ হেলিয়ে দেয় রোহিণী। বহুতল বীরগঞ্জ শহরকে ধাতুর ফিতের মতো পেঁচিয়ে রেখেছে নানান চুম্বক-পথ। তারই একটা ধরে ছুটতে আরম্ভ করে গাড়ি, দু-পাশ দিয়ে ছবির মতন সরে যায় বীরগঞ্জের ইমারত আর রাজপথের ত্রুটিহীন জ্যামিতি।

মিনিট দশেক ছোটার পর একটা বহুতল ইমারতের প্রায় ওপরতলার একটা বারন্দার সামনে এসে দাঁড়ায় গাড়ি।

বারন্দায় নেমে একটু অবাক হয় রোহিণী। কোনও সরকারি বা মিলিটারী অফিস নয়, সামনে একটা ছোট কফিখানা।

দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখে রোহিণী। দোকানের ভেতরটা আলো-আঁধারি,

একটা পর্দা ফেলা জানলা দিয়ে আলো আসে অল্পই। তবে সেটুকু আলোতেই পরিষ্কার যে ছোট্ট দোকানটা একদম ফাঁকা, কেবল পেছনের একটা টেবিলে দরজার দিকে চোখ রেখে বসে একজন অফিসার।

‘আসুন, আসুন কাপিটান বিসমার্ক। আমি ওবার্স্ট বিমলেন্দু গ্যেটে। বসুন। প্লীজ।’

একটা দায়সারা স্যালুট করে বসে পড়ে রোহিণী। ওবার্স্ট বিমলেন্দুর মাথার চুল পেছন দিকে টানটান করে আঁচড়ানো, চওড়া কপালে দু-একটা হালকা বলিরেখা, পাতলা কাঁধদুটো যেন কোনও অজানা ভারে ঝুঁকে রয়েছে সামনের দিকে।

হাতের দুটো আঙুলের মৃদু ইশারা করেন বিমলেন্দু। কফিখানার কোণ থেকে টেবিলের সামনে গড়িয়ে আসে কফি ডিসপেন্সার। যান্ত্রিক গুঞ্জনে কফি ঢেলে নামিয়ে রাখে কাপ।

রোহিণী খেয়াল করে কাপে ঢালা কফিটা তার পছন্দের ফ্লেভারের। ওবার্স্ট বিমলেন্দুর ঠোঁটের কোণের হালকা হাসিটাও নজর এড়ায় না তার।

কফিটা যে স্রেফ একটা অছিলা, গেস্টাপো যে তার নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখে, ওবার্স্ট বিমলেন্দু সেটাই তাকে বোঝাতে চাইছে—সে কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না রোহিণীর। টেবিলের ওপর আলতো করে দুটো হাত রেখে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে সে।

আর একটু স্পষ্ট হয় বিমলেন্দুর ঠোঁটের কোনের হালকা হাসিটা।

‘কফি নিন কাপিটান। প্লীজ।’

অস্বস্তি এড়াতে সামান্য কাশে রোহিণী, ‘আমাকে ঠিক কী জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে জানতে পারলে ভালো হত ওবার্স্ট গ্যেটে।’

‘নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই! আপনাকে তো আপনার জাহাজে ফিরতে হবে’ কফির কাপে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখেন বিমলেন্দু, ‘আপনি পথিকের নাম শুনেছেন?’

ঘাড় নাড়ে রোহিণী, ‘পথিক? না, শুনেছি বলে তো মনে হচ্ছে না!’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোহিণীর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন বিমলেন্দু, ‘শোনেননি? যাক, শুনুন তাহলে। তুহিনের হিমেলগাঁওয়ে বসে কেউ একজন আমাদের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছে। বিদ্রোহ করতে উস্কানি দিচ্ছে।’

‘কে সে? স্বরাজের এজেন্ট?’

একটা লম্বা নিঃশ্বাস টানেন ওবার্স্ট বিমলেন্দু। তাঁর সরু কাঁধ দুটো যেন আরও খানিকটা ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে।

‘স্বরাজের এজেন্ট নয়। কারণ পথিক স্বরাজের বিরুদ্ধেও মানুষকে প্ররোচনা দিচ্ছে।’

হতভম্ব হয়ে বিমলেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রোহিণী। স্বরাজ আর স্বরাটের চিরাচরিত শত্রুতার বাইরেও যে তৃতীয় কোনও প্রতিপক্ষ থাকতে পারে, তা তার কল্পনাতেও আসে না।

দুটো হাত টেবিলের ওপর জড়ো করে রাখেন বিমলেন্দু। তাঁর ঠোঁটের কোণের হাসিটা উধাও।

‘কাপিটান বিসমার্ক, আমাদের কাছে খবর আছে স্বরাজ পথিককে হিমেলগাঁও থেকে তুলে আনার তোড়জোড় করছে। খুব সম্ভব তাদের জাহাজ তুহিনের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে। পথিক স্বরাজের হাতে বন্দী হওয়ার আগেই আপনাকে তাকে আটক করে স্বরাটে নিয়ে আসতে হবে। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আসল মাথা কারা আমাদের জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।’

‘কিন্তু কে এই পথিক? তার আসল পরিচয় কী?’

মাথা নাড়েন ওবার্স্ট বিমলেন্দু গ্যেটে, ‘আমাদের জানা নেই কাপিটান। পথিকের চেহারাটুকু পর্যন্ত আমাদের অজানা।’

‘কিন্তু তাহলে তাকে খুঁজে পাব কী করে?’

হালকা হাসিটা ফের ফেরত আসে বিমলেন্দুর ঠোঁটের কোনে, ‘পথিক যে কম্যুনিকেটর ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে বিষ ছড়ায়, আমাদের বিজ্ঞানীরা তার সিগন্যালের একটা পরিচয়রেখা তৈরি করে ফেলেছেন। কম্যুনিকেটর ব্যবহার করলেই আমরা পথিককে দূর থেকেই সনাক্ত করে ফেলতে পারব।’

পিঠ সোজা করে বসেন ওবার্স্ট বিমলেন্দু, ‘কাপিটান বিসমার্ক, হিমেলগাঁও বা স্বরাজের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে পথিককে অক্ষত অবস্থায় স্বরাটে হাজির করার মিশনের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হল। আপনি জাহাজে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে হেডকোয়ার্টার থেকে অফিসিয়াল নির্দেশ পেয়ে যাবেন।

যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায় রোহিণী। তার চোখে চোখ রাখেন বিমলেন্দু।

‘আর হ্যাঁ, কাপিটান বিসমার্ক। দয়া করে অকৃতকার্য হবেন না।’

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের রাত্রি গোলার্ধ

হিমাংশু আর ইকুয়াইটদের মাঝে ভাসে বিঘ্ন-বিনাশের একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি। কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকায় হিমাংশু, ‘কী মনে হয় সেঞ্চুরিয়ান সেনেকা? ওরা অপেক্ষা করবে?’

মাথায় হাত বোলায় সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকা, ‘খুব সম্ভব না। স্বরাট মিলিটারি ক্ষমতা প্রদর্শনে অভ্যস্ত। পথিকের সন্ধান পাওয়ামাত্রই তাকে তুলে আনতে পল্টন পাঠিয়ে দেবে। আমাদের মতো চোরগোপ্তা আক্রমণের সুযোগ খুঁজবে না।’

‘তাহলে আমাদের আর আত্মগোপন করে থেকে কোনও লাভ নেই!’

হিমাংশুর নিজের কানেই কেমন নিরাশ শোনায় তার নিজের কণ্ঠস্বর।

‘না ট্রিবিউন, গোপনে পথিককে তুলে আনার তো আর কোনও সম্ভাবনা নেই। এই মুহূর্তে আমাদের চ্যালেঞ্জ স্বরাটকে ঠেকিয়ে রাখা।’

ঘাড় নেড়ে সায় দেয় হিমাংশু, ‘বেশ। আমরা স্বরাটের মানোয়ারের মুখোমুখি অবস্থান নেব। কিন্তু সরাসরি সংঘাতে যাব না। একবার ওদের নিরস্ত করা গেলে, তারপর আমরা পথিককে ওদের নজর এড়িয়ে তুলে আনার চেষ্টা করব।’

হাত নাড়ায় ইকুয়াইট শৌভিক সিসেরো। সামনে ভাসতে থাকা বিঘ্ন-বিনাশের ত্রি-মাত্রিক ছবিটা গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ধোঁয়ার মতন হয়ে যায়।

‘সংঘাত এড়ানোর সময় পার হয়ে গেছে ট্রিবিউন। কে না কে পথিক, তার কথা পরে ভাবলেও চলবে। বরং এই সুযোগে যদি স্বরাটের জাহাজটা ধ্বংস করে দেওয়া যায়, তাহলে আমাদের আসল শত্রুকে একটা বড় ধাক্কা দেওয়া যাবে।’

কন্ট্রোল-কামরার সোনালী আলোয় শৌভিকের বেগুনি কৃস্টালের বর্মের মতোই চকচক করে তার চোখ।

মাথা নাড়ে হিমাংশু, ‘আমাদের মিশন শুরু থেকে যা ছিল, এখনও তাই আছে

—পথিককে আটক করে স্বরাজে নিয়ে যাওয়া। তার বদলে মিশনের লক্ষ্য পালটে স্বরাটের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইতে নেমে পড়ার অধিকার আমাদের নেই।’

বাকি ইকুয়াইটদের দিকে ফিরে তাকায় শৌভিক। উত্তেজনায় বিস্ফারিত তার দুই চোখ।

‘একটা ভোট নেওয়া হোক তাহলে। পথিক না স্বরাট—এই মুহূর্তে কোনটা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’

‘হুঁঃ!’ একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ ভেসে আসে বিজয়া সেনেকার থেকে, ‘শৌভিক এটা সেনেট নয়, আর তুমিও সেনেটর নয়, যে ভোট হবে!’

রাগে কদাকার হয়ে ওঠে শৌভিকের মুখের চেহারা, ‘সেঞ্চুরিয়ান সেনেকা! আমি কে সেটা আপনি হয়তো ভুলে গেছেন!’

‘না ভোলেনি!’ হিমাংশুর কণ্ঠস্বরে হিমশীতল ইস্পাতের ছোঁয়া, ‘কেউ ভোলেনি শৌভিক, তুমি কে! এক তুমি ছাড়া। তাই তোমাকে মনে করিয়ে দিই আর-একবার। তুমি একজন জুনিয়র ইকুয়াইট, যে মতামত দেওয়া আর অবাধ্যতার মধ্যে পার্থক্যটা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। এটা আমার কমান্ড। এখানে শেষ কথা বলি আমি।’

হিমাংশুর কঠিন দৃষ্টির সামনে কেমন গুটিয়ে যায় শৌভিক। মাথা নামিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে।

বসে থাকা ইকুয়াইটদের দিকে একবার পালা করে তাকায় হিমাংশু, ‘আর কারও কোনও প্রশ্ন আছে?’

নীল কৃস্টালের দস্তানা মোড়া হাত অল্প তোলে ইকুয়াইট নয়না লুক্রেসিয়াস, ‘ট্রিবিউন, যদি স্বরাটের জাহাজ হিমেলগাঁওতে কোনও ল্যান্ডিং পল্টন পাঠানোর চেষ্টা করে?’

একটা হালকা হাসি খেলে যায় হিমাংশুর মুখে, ‘তাহলে আমরা তাদের বাধা দেব না, যেতে দেব।’

‘যেতে দেব!’ বিস্ময়ের ছোঁয়া লাগে ইকুয়াইট নয়নার কণ্ঠস্বরে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাকি ইকুয়াইটরাও।

হাসিটা একটু চওড়া হয় হিমাংশুর, ‘হ্যাঁ যেতে দেব। স্বরাটের পল্টন তাদের

বন্দুকের জোরে পথিককে হিমেলগাঁও থেকে তুলে আনুক। তারপর তাদের ল্যান্ডার যখন তুহিনের পিঠ ছেড়ে ফের মহাকাশে উঠে আসবে—’

‘—তখন আমাদের একদল স্বরাটের জাহাজকে ব্যস্ত রাখবে, আর একদল ল্যান্ডার থেকে পথিককে কেড়ে আনবে।’ হিমাংশুর কথাটা সম্পূর্ণ করে সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকা। চওড়া হাসিতে ঢেকেছে তার মুখও।

ঘাড় নেড়ে সায় দেয় হিমাংশু, ‘স্বরাটের জাহাজ যতই শক্তিশালী হোক, মনে রেখো ওরা এক, আর আমরা অনেক। গগন-বাণে নিজেদের পজিশন নাও।’

টুল থেকে এক-এক করে লাফিয়ে নামে ইকুয়াইটরা। তাদের পেছনে টুলগুলো গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে মেঝেতে। কন্ট্রোল-কামরার দেওয়াল ঘিরে একের পর এক দেখা দেয় ছোট ছোট ছিদ্র। ছিদ্রগুলোকে কেন্দ্র করে ঘুর্ণির মতো পাক লাগে দেওয়ালের গায়ে, ক্রমশ বড় হতে হতে দরজার আকার নেয় ছিদ্রগুলো।

কৃস্টালের দস্তানা মোড়া হাত মুঠো করে ঠেকায় হিমাংশু সাদা কৃস্টালে গড়া বর্মের বুকে।

‘সি উইস পাকেম—’

শান্তি যদি আশা কর—

কৃস্টালের দস্তানা মোড়া গোটা তিরিশেক হাত আছড়ে পড়ে কৃস্টালের বর্মের বুকে। সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে গোটা তিরিশ কণ্ঠস্বর।

‘—পারা বেলুম!’

তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও!

কন্ট্রোল-কামরার দেওয়ালে সদ্য ফুটে ওঠা দরজা দিয়ে এক এক করে দৌড়ায় ইকুয়াইটরা। তাদের পেছনে ঘূর্ণিপাক খেয়ে বুজে যেতে থাকে দরজাগুলো।

দরজার পেছনে হারিয়ে যেতে থাকা কৃস্টালের বর্ম মোড়া চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে হিমাংশু।

দান চালা হয়ে গেছে। পাশায় শান্তি পড়বে না যুদ্ধ তা ভবিষ্যৎই বলবে।

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের দিবা গোলার্ধ

কন্ট্রোল-কামরার চারপাশে একবার নজর বোলায় রোহিণী। ভাবলেশহীন মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে বসে থাকে সারি বাঁধা অফিসাররা। তাদের সামনের কনসোলের আলোয় গড়া স্ক্রিনে ফুটে উঠে মিলিয়ে যায় নানান গাণিতিক সংকেত।

সামনের বাতাসের দিকে তাকায় রোহিণী। তার মাথার কমিউনিকেশন ব্যান্ডে ছুটে যায় আলোর বিন্দু।

‘ট্রুপফুয়েরার অজিতেশ!’

ভারী পায়ের শব্দ হয়। জাহাজের অভ্যন্তর থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে ট্রুপফুয়েরার অজিতেশ ওয়াগনারের কালো সেরামিকের বর্ম মোড়া চেহারাটা। তার মাথায় বাঁধা কমিউনিকেশন ব্যান্ড, শরীর আর বাঁ হাতের ফাঁকে চেপে ধরা কালো হেলমেট।

মাপা ছন্দে রোহিণীর চেয়ার অবধি হেঁটে এসে স্যালুট করে অজিতেশ। তার বর্ম মোড়া গোড়ালি আর জাহাজের ডেকের ঠোকাঠুকির ধাতব শব্দটা হাওয়ায় ভাসে বেশ কিছুক্ষণ।

‘কাপিটান বিসমার্ক!’

‘হের ট্রুপফুয়েরার! রিপোর্ট!’

‘ল্যান্ডার রেডি ফ্রয়লাইন কাপিটান। পল্টন ল্যান্ডারে অপেক্ষা করছে। আপনার অর্ডার পেলেই আমরা তুহিনের বুকে ঝাঁপ দেব।’

‘পথিকের সন্ধান পেলেই আমি অর্ডার দেব হের ট্রুপফুয়েরার। আপনি আপনার পল্টন নিয়ে তৈরি থাকুন। সন্দীপ?’

উঠে দাঁড়ায় কনসোলে বসে থাকা সন্দীপ নিৎসে।

‘স্ক্যানিং জারি কাপিটান। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পথিকের কমিউনিকেশন ডিভাইসের কোনও সন্ধান পাইনি।’

‘স্ক্যান করতে থাকো। পথিক তোমার স্ক্যানারের নজরে এলেই—’

কথা সম্পূর্ণ হয় না কাপিটান রোহিণীর। একটা বিপবিপ আওয়াজ ওঠে, কন্ট্রোল-কামরার আলোর বর্ণে লালচে ছোঁয়া লাগে।

বিস্মিত চোখে কনসোলে বসা অফিসারদের সারির দিকে তাকায় রোহিণী, ‘কিসের অ্যালার্ম? ফ্লুগমেইস্টার সুশান্ত?’

সচকিত ভাবে কনসোল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় একজন অফিসার, মুখে তার উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট।

‘ফ্রয়লাইন কাপিটান! স্বরাজের জাহাজ। তুহিনের উলটো পিঠে।’

ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকায় রোহিণী, ‘গন্তব্য?’

‘আমাদের দিকেই আসছে কাপিটান।’

‘সময়?’

‘খুব জোর মিনিট দশেক কাপিটান।’

চোয়াল শক্ত হয়ে যায় রোহিণীর, ‘আমাদের পথ আটকাতে আসছে! লিয়ুট্‌ন্যান্ট সন্দীপ, ফায়ারিং সিস্টেম তোমার দায়িত্বে।’

কনসোলের ওপর হাতদুটো ছুটোছুটি করে সন্দীপ নিৎসের।

‘ফায়ারিং সিস্টেম অনলাইন কাপিটান। স্বরাজের জাহাজ নজরে এলেই ফায়ারিং শুরু করার অর্ডার কাপিটান?’

সন্দীপের চোখেমুখে ক্রোধের ছাপটা নজর এড়ায় না রোহিণীর। মাথা নাড়ে সে, ‘না লিয়ুট্‌ন্যান্ট সন্দীপ। স্বরাজের জাহাজ আমাদের সামনে আসার অর্থ ওরা এখনও পথিকের নাগাল পায়নি। ওদের কোনও মতে আটকে রেখে পথিকের সন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। সরাসরি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ার সময় এটা নয়।’

বিপবিপ আওয়াজটা হঠাৎ আরও জোর হয়ে ওঠে, কন্ট্রোল-কামরার আলোর বর্ণ আরও গাঢ় লাল হয়ে ওঠে। রোহিণীর মাথার কমিউনিকেশন ব্যান্ডে ছুটোছুটি করতে আরম্ভ করে বিন্দু বিন্দু আলো।

চেয়ার ঘুরিয়ে পলকাটা কাচের ভেতর দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় রোহিণী। তুহিনের দুধ সাদা প্রেক্ষাপটে ভাসে স্বরাজের অদ্ভুতদর্শন স্তবক যান শত-শতঘ্নী। যেন একটা আংটি দিয়ে আটকানো গোটা তিরিশ পেটমোটা চুরুট, আর তাদের সামনে অতিকায় কীটের মতো এনার্জি অস্ত্রের অ্যান্টেনা উঁচিয়ে থাকা কন্ট্রোল-কামরা।

কবচ-কাচের মধ্যে দিয়ে রোহিণী দেখতে পায় পিঠে লেগে থাকা আংটির অংশটুকু নিয়েই ধাতুর চুরুটগুলো সরে যাচ্ছে পরস্পরের থেকে। শত-শতঘ্নীর কন্ট্রোল-কামরাকে ঘিরে তাদের বৃত্তের ব্যাসটা বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে।

সজোরে একটা নিঃশ্বাস টানে রোহিণী, ‘ট্রুপফুয়েরার অজিতেশ, ল্যান্ডার নিয়ে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান। স্বরাজের জাহাজের সঙ্গে কোনও রকম সংঘর্ষ হলে আপনি আটকে পড়বেন। তুহিনে নেমে আপনি হিমেলগাঁওয়ের বাইরে পজিশন নিন, পথিকের অবস্থান জানতে পারলেই আপনাকে জানিয়ে দেব।’

সেরামিক বর্মের গোড়ালিতে আওয়াজ তুলে স্যালুট করে অজিতেশ, ‘রাইট ফ্রয়লাইন কাপিটান! স্বরাট উবের আলেস!’

চেয়ার থেকে নেমে পড়ে স্যালুট করে রোহিণীও, ‘স্বরাট উবের আলেস! সর্বোপরি স্বরাট!’

মাথায় হেলমেট বসাতে বসাতে দৌড় লাগায় অজিতেশ।

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের যুদ্ধ

তুহিনের তুষারের অনেক ওপরে লড়াইয়ের প্রস্তুতিপর্ব সারে যুযুধান দুই পক্ষ।

বিঘ্ন-বিনাশের কন্ট্রোল-কামরায় উঁচু চেয়ারে বসে পলকাটা কবচ-কাচের পেছন থেকে প্রতিপক্ষের দিকে নজর রাখে কাপিটান রোহিণী বিসমার্ক। একটা নীলচে আলোর প্রলেপের মতো বিঘ্ন-বিনাশকে তখন ধীরে ধীরে ঢেকে ফেলছে শক্তি বর্ম।

লিয়ুট্‌ন্যান্ট সন্দীপ নিৎসের আঙুলগুলো অবলীলায় খেলা করে কনসোলের ওপর। তার সঙ্গে তাল রেখে বিঘ্ন-বিনাশের নানা অংশে মাথা তোলে বিভিন্ন এনার্জি কামান, টর্পেডো আর প্রাস প্রক্ষেপাস্ত্রের সারি।

বিঘ্ন-বিনাশের অভ্যন্তরে তখন ট্রুপফুয়েরার অজিতেশ ওয়াগনার ব্যস্ত ল্যান্ডারে বসা তার সৈন্যদলকে শেষ নির্দেশ দিতে।

বিঘ্ন-বিনাশের ঠিক উলটোদিকে শত-শতঘ্নীর আলাদা আলাদা চুরুটের মতো গগন-বাণগুলো তাদের ইকুয়াইটদের নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে ততক্ষণে কন্ট্রোল-কামরাকে ঘিরে রচনা করে ফেলেছে এক বিশাল বৃত্ত। তার কেন্দ্রবিন্দুতে কন্ট্রোল-কামরায় ট্রিবিউন হিমাংশু প্লুটার্ক আর সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকা দেওয়ালের গায়ে একটা স্বচ্ছ অংশ দিয়ে নজর রাখে বিঘ্ন-বিনাশের দিকে। একই সঙ্গে তাদের হাত আলতো করে খেলা করে মেঝে থেকে ক্যাকটাসের মতন বেড়ে ওঠা নানা কন্ট্রোল যন্ত্রে। কন্ট্রোল-কামরার সামনে বসানো নিষ্পত্র গাছের মতন অ্যান্টেনার সারি স্থান আর কালের সীমানার পেছন থেকে টেনে আনতে থাকে বিচিত্র বিধ্বংসী শক্তি, রংবেরঙের বিদ্যুৎ খেলে যায় তাদের ডালপালার মধ্যে দিয়ে।

হাতের ছন্দে গতি আনে হিমাংশু, রঙিন বিদ্যুতের শিরা-উপশিরা শত-শতাঘ্নীর কেন্দ্র থেকে ছিটকে গিয়ে স্পর্শ করতে থাকে বৃত্তে ভাসতে থাকা প্রতিটি যানকে। সে সব ভয়ানক শক্তির বলে বলিয়ান হয়ে, এবার প্রতিটি যানের শরীর থেকে সজারুর কাঁটার মতো মাথা তোলে অজস্র এনার্জি অস্ত্র।

মহাকাশের কালো ক্যানভাসে আঁকা নক্ষত্র তারারা নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে এক ভয়ানক সংগ্রামের প্রতীক্ষায়।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে বিঘ্ন-বিনাশ আর শত-শতঘ্নী দুটো জাহাজেরই শক্তিশালী কমিউনিকেশন রিসিভারে ধরা পড়ে হিমেলগাঁও থেকে রেডিয়ো তরঙ্গে ভর করে উঠে আসা একটা মেসেজ ক্লিপ।

‘ফ্রয়লাইন কাপিটান! পথিকের ব্রডকাস্ট! অর্ডার কাপিটান?’ বিঘ্ন-বিনাশের কবচ-কাচের ঘেরাটোপের নিচে উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করে সন্দীপ নিৎসে।

সন্দীপের দিকে তাকায় রোহিণী, ‘লোকেশন ট্র্যাক করো। ক্লিপ স্টোর করে রাখো, কিন্তু চালিও না।’

শত-শতঘ্নীর কন্ট্রোল-কামরায় সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকাকেও একই নির্দেশ দেয় হিমাংশু, ‘ক্লিপ রিসিভ করো কেবল, চালিও না।’

দু-জনেরই নির্দেশ বৃথা যায়। পৌঁছান মাত্রই দু-পক্ষের সব যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্ত নিরাপত্তা প্রোটোকলের বাধা অবলীলায় টপকে সেই ক্লিপ চলতে থাকে প্রতিটি চ্যানেলে আর কমিউনিকেটরে।

ক্লিপের শুরুতেই স্যাক্সোফোনের মতো সুরেলা অথচ গম্ভীর অথচ সুরেলা কণ্ঠে কেউ কথা বলে ওঠে।

‘আজ যারা পরস্পরের মুখোমুখি, এককালে তারা কিন্তু ছিল একই পথের পথিক।’

তারপরে ভেসে উঠতে শুরু করে এক অতি প্রাচীন, কিন্তু অতি পরিচিত এক অতীতের ছবি। একের পর এক।

আগমাব্দ ০০১, অর্কমণ্ডলীর বহির্ভাগ

মন্থর গতিতে মহাকাশের গভীর কালো অন্ধকার কাটে ম.যা. দিশারী। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া তার রংচটা টোল খাওয়া শরীরে পড়ে সামনের নক্ষত্রের সোনালী আলো।

জাহাজের একপাশের লম্বা করিডোরে দাঁড়িয়ে বড় বড় পোর্টহোলে মুখ ঠেকিয়ে সে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে শিশুরা, চোখেমুখে তাদের আনন্দ উপচে পড়ে। তাদের একটু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে বড়রা, শিশুদের আনন্দের প্রতিফলন পড়ে তাদের মুখেও।

‘বাবা, আমরা তাহলে পৌঁছে গেছি? এখানেই আমাদের নতুন বাড়ি হবে?’ পোর্টহোলের কাচ থেকে মুখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করে একটি ছোট মেয়ে।

তার মাথায় সস্নেহে হাত রাখে একজন, খুব সম্ভব তার পিতা, ‘হ্যাঁ, মা। প্রায় পৌঁছে গেছি। ওই যে তারাটা দেখছ ওর নাম অর্ক। ওর গোল্ডিলকস অঞ্চলে তিন-তিনটে গ্রহ আছে। তার মধ্যে একটা-না-একটাতে আমাদের বাড়ি বানানোর জায়গা হয়ে যাবে।’

‘গোল্ডিলকস অঞ্চল? গোল্ডিলকস অঞ্চল কাকে বলে বাবা?’

‘গোল্ডিলকস অঞ্চল—!’ উত্তর দিতে গিয়ে খানিক ইতস্তত করে মেয়েটির পিতা।

‘আমি বলছি। এসো!’ ভিড়ের পেছন থেকে ভেসে আসে নারীকণ্ঠ।

পেছনে ফিরে সসম্ভ্রমে তাকায় বড়রা।

করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘদেহী নারী, কৃষ্ণকালো তার গাত্রবর্ণ, ভ্রমরকালো দুই চোখের ওপরের কপালে লাল টিপ, মাথার কালো চুলে দু-একটা রুপোলি আঁচড়।

মাথা ঝুঁকিয়ে, বুকে হাত রেখে শ্রদ্ধা জানায় বড়রা, ‘মাতা! মাতা অনন্তা!’

ছোট মেয়েটির অবশ্য অত সম্ভ্রমের বালাই নেই, সে লাফিয়ে অনন্তার কোলে চড়ে পড়ে, ‘বলো গোল্ডিলকস অঞ্চল কাকে বলে!’

মেয়েটিকে কোলে তুলে কয়েক পা এগিয়ে যান অনন্তা। তাঁকে ঘিরে ধরে বাকি শিশুরাও।

‘বলছি। তার আগে একটা গল্প শোনো। অনেক দিন আগে তোমার মতো একটা ছোট্ট মেয়ে একবার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল। নাম ছিল তার গোল্ডিলকস।’

‘কোথায়? পৃথিবীতে?’ কৌতূহলী প্রশ্ন করে একটা শিশুকণ্ঠ।

‘হ্যাঁ পৃথিবীতে। তারপর শোনো। পথ হারিয়ে গোল্ডিলকস গিয়ে পৌঁছাল এক ভাল্লুকের ডেরায়।’

‘ভাল্লুকরা যদি তাকে খেয়ে ফেলত?’ উৎকণ্ঠার ছোঁয়া লাগে শিশু কণ্ঠস্বরে।

সামান্য হাসেন অনন্তা, ‘ভাল্লুকরা তখন ছিল না, রান্না করে রেখে বেড়াতে বেরিয়েছিল।’

‘তারপর কী হল?’

‘গোল্ডিলকসের খুব খিদে পেয়েছিল। একটা টেবিলে তিনটে খাবারের বাটি দেখে সে খেতে বসে গেল।’

‘তিন বাটি খাবারই খেয়ে ফেলল?’ এবার বিস্ময়ের ছোঁয়া লাগে শিশু কণ্ঠে।

‘না না তিন বাটি খাবার খায়নি।’ আশ্বস্ত করেন অনন্তা, ‘প্রথম বাটির খাবারটা গোল্ডিলকস চামচে করে চেখে দেখে একদম ঠান্ডা, খাবার মুখে তোলা যায় না। পরেরটা মুখে দিতে গিয়ে দেখে ভয়ানক গরম, খেতে গেলেই মুখ পুড়ে যাবে।’

‘তিন নম্বর বাটিটা?’

‘তিন নম্বরের বাটির খাবারটা একদম ঠিকঠিক ছিল।’

‘খাওয়া হয়ে যেতে গোল্ডিলকস কী করল? ঘুমিয়ে পড়ল?’

‘হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু সে গল্প অন্য আর একদিন। এবার এইটা দেখ।’

হাত নাড়েন অনন্তা। হাওয়ায় ভেসে ওঠে এক আলোয় গড়া নক্ষত্রের প্রতিকৃতি।

‘এই দেখ এই তারাটার নাম অর্ক।’

‘যেটা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, সেইটা।’ ছোট মেয়েটিকে কোল থেকে নামিয়ে দেন অনন্তা, ‘এই তারাটার

যদি খুব কাছে কোনও গ্রহ থাকে, তাহলে সেখানে গরমের চোটে কিচ্ছু বাঁচবে না। আবার খুব দূরে যদি থাকে, তাহলে আবার সেখানে এত ঠান্ডা যে কিচ্ছু বাঁচবে না। কিন্তু যদি এমন জায়গায় থাকে যেখানে না খুব গরম, না খুব ঠান্ডা, সেখানে প্রাণীরা বেঁচে থাকতে পারে।’

‘গোল্ডিলকসের খাবারের মতন?’ কথা বলে ওঠে আর একটা শিশুকণ্ঠ।

‘হ্যাঁ, গোল্ডিলকসের খাবারের মতন। তারার কাছের এই অঞ্চলটাকে বলে গোল্ডিলকস অঞ্চল। বুঝলে?’

‘হ্যাঁ!—’

সমস্বরে সাড়া দেয় অনেকগুলো শিশুকণ্ঠ।

আর-একবার হাত নাড়ান অনন্তা। হাওয়ায় ভাসতে থাকা অর্কের প্রতিকৃতির পাশে ফুটে ওঠে একটা বরফে ঢাকা গ্রহের ছবি, ‘এই দেখো। এ গ্রহটার নাম তুহিন। এট গোল্ডিলকস অঞ্চলের ভেতরেই পড়ে, নানা রকম প্রাণীও আছে বটে, কিন্তু সবসময় বরফ পড়ে। থাকার পক্ষে খুব একটা ভালো জায়গা নয়। কিন্তু এইটা দেখ।’

ফের হাত নাড়ান অনন্তা। ফুটে ওঠে দুটো নীল-সবুজ গ্রহের ছবি।

‘পৃথিবী! পৃথিবী! দুটো দুটো পৃথিবী!’ ফের সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে অনেকগুলো কণ্ঠ।

মৃদু হাসি খেলে অনন্তার ঠোঁটে, ‘না পৃথিবী নয়, তবে পৃথিবীর মতন। এখানেই আমরা আমাদের নতুন বাড়ি বানাবো।’

বড়দের একজন এগিয়ে আসে, ‘মাতা, গ্রহ দুটো খুব কাছাকাছি নয়?’

মাথা নাড়েন অনন্তা, ‘হ্যাঁ। দুটো যুগল গ্রহ। কেন্দ্রের নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করার সঙ্গে সঙ্গে এরা পরস্পরকেও প্রদক্ষিণ করে।’

‘এদের কিছু নাম রেখেছেন মাতা।’

চোখ তুলে তাকান অনন্তা, ‘হ্যাঁ। স্বরাজ আর স্বরাট।’

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের যুদ্ধ

বিঘ্ন-বিনাশের কবচ-কাচের নিচে পাংশু মুখে সন্দীপ নিৎসে তাকায় রোহিণীর দিকে। বিন্দু বিন্দু স্বেদ চকচক করে তার কপালে, ‘ফ্রয়লাইন কাপিটান, ক্লিপে কী ছিল জানি না, আটকাতে পারলাম না! অনায়াসে আমাদের কমিউনিকেশন সিস্টেমের দখল নিয়ে নিল।’

মাথা নাড়ে রোহিণী, ‘যেতে দাও। এ ইতিহাস আমাদের সবার জানা। নতুন কিছু নয়।’

মুখে সন্দীপকে আশ্বস্ত করলেও, পথিককে নিয়ে স্বরাটের গেস্টাপোর উদ্বেগের কারণটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে রোহিণী।

যেভাবে পথিকের পাঠানো একটা সামান্য মেসেজ ক্লিপ সব রকম প্রোটোকল মুহূর্তের মধ্যে এড়িয়ে গেল, তাতে পথিক ইচ্ছেমতো স্বরাটে যে-কোনও বিদ্রোহের বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে সে কথা বুঝতে কষ্ট হয় না।

কনসোল থেকে উঠে দাঁড়ায় ফ্লুগমেইস্টার সুশান্ত, ‘ফ্রয়লাইন কাপিটান, ট্রুপফুয়েরার অজিতেশ ল্যান্ডার নিয়ে লঞ্চ করার জন্য রেডি।’

‘লঞ্চ! স্বরাট উবের আলেস!’

নির্দেশ দিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকায় রোহিণী।

শত-শতঘ্নীর কালো কন্ট্রোল-কামরায় ঠোঁটের কোনে একটুকরো মুচকি হাসি নিয়ে সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকার দিকে তাকায় ট্রিবিউন হিমাংশু প্লুটার্ক, ‘ওপর মহলের দুঃশ্চিন্তার কারণ বোঝা যাচ্ছে। এই পথিক যেখানে-সেখানে যখন-তখন যা ইচ্ছে বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে।’

একটা কড়কড় আওয়াজে তুলে হাওয়ায় ভেসে ওঠে শৌভিক সিসেরোর প্রতিচ্ছবি। মুখটা ক্রোধে বিকৃত দেখায় তার, ‘এ সব স্বরাটের শয়তানী। এই পথিক স্বরাটেরই কোনও ষড়যন্ত্রের চাল।’

শৌভিকের ছবির দিকে তাকিয়ে ধমক দেয় হিমাংশু, ‘ইকুয়াইট শৌভিক। নিজের কাজের খেয়াল রাখো! এই মুহূর্তে এর চাইতে বেশি তোমার কিছু ভাবার

দরকার নেই।’

সামনের স্বচ্ছ জানলার দিকে হিমাংশুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিজয়া সেনেকা, ‘ট্রিবিউন, স্বরাটের ল্যান্ডার।’

বাইরের দিকে তাকায় হিমাংশু। একটা বর্গাকার কচ্ছপের আকারের ল্যান্ডার স্বরাটের মানোয়ারের জঠর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে নীল শিখায় ভর করে ভেসে যায় তুহিনের দিকে।

ভ্রূ কুঁচকে তার যাত্রাপথের দিকে তাকায় হিমাংশু, ‘যেতে দাও। পথিককে ওরা যদি আটক করে ফেরত আসে তখন পরের পদক্ষেপ—’

শেষ হয় না হিমাংশুর কথা। শত-শতঘ্নীর মহাকাশ জোড়া ব্যুহের কোনও এক দিক থেকে হঠাৎ পরের পর ল্যান্ডার লক্ষ করে ছুটে আসে রঙিন বিদ্যুতের ক্রকচ রেখা।

ল্যান্ডার এদিক-ওদিক বেঁকেচুরে এড়াতে চেষ্টা করে সেই সব মারণ বিদ্যুৎ, কিন্তু সফল হয় না। একটা রঙিন বিদ্যুৎ স্পর্শ করে তার শরীর, এক প্রবল বিস্ফোরণে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায় ল্যান্ডার, মহাকাশের কালো মখমলে পড়ে থাকে কেবল খানিকটা জ্বলন্ত ধুলো।

একটা সজোরে নিঃশ্বাস নেয় হিমাংশু, বিস্ফারিত নয়নে তার দিকে তাকায় বিজয়া।

‘কে? কে করল এই কাজ সেঞ্চুরিয়ান? কে নির্দেশ অমান্য করল আমার?’

একটা বিকৃত খলখল হাসি ভেসে আসে ইকুয়াইট শৌভিক সিসেরোর প্রতিকৃতি থেকে, ‘আমি করেছি। যা করার দরকার ছিল তাই করেছি। ওই পথিকের ঝুটো গল্পে না ভুলে স্বরাটকে বুঝিয়ে দিয়েছি স্বরাজের ক্ষমতা।’

জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকায় বিজয়া, ‘ট্রিবিউনের হুকুম অগ্রাহ্য করার শাস্তি তুমি কি জানো না শৌভিক? কেউ বলেনি তোমাকে আকাডেমিতে?’

শৌভিকের বিকৃত অট্টহাসি ছড়িয়ে যায় কন্ট্রোল-কামরার চারপাশে, ‘হুকুম! আমার কাছে স্বরাজের স্বার্থ আগে, কোনও নীচ কুলের ট্রিবিউনের হুকুম নয়! স্বরাজের স্বার্থে যা করার ছিল আমি করছি।’

‘শৌভিক!’ হিমাংশুর ইস্পাত কঠিন কণ্ঠস্বরে থেমে যায় শৌভিকের সদম্ভ বাক্যস্রোত, ‘স্বরাজের মিলিটারি আইনে ট্রিবিউনের নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি

মকুব করার ক্ষমতা খোদ প্রোকন্সালেরও নেই।’

বাইরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ল্যান্ডারের শেষ কয়েকটি অগ্নিকণার দিকে তাকায় হিমাংশু, ‘শৌভিক, প্রার্থনা করি এই লড়াইতে তুমি বীরগতি প্রাপ্ত হও। কারণ যদি বেঁচে স্বরাজে ফেরো, তাহলে তোমাকে আমি ফোরামের মাঝখানে নিজের হাতে ক্রুসে লটকে দেব। তোমার নীল রক্ত তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।’

শৌভিককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত নাড়ে হিমাংশু, মিলিয়ে যায় তার প্রতিকৃতি।

একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বিজয়ার দিকে তাকায় হিমাংশু, ‘শৌভিক একটা দানবকে জাগিয়ে তুলেছে। এর পরিণতি কী হবে জানি না। মরণপণ লড়াইয়ের জন্য তৈরি হও সেঞ্চুরিয়ান।’

বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকায় বিজয়া, নিম্নস্বরে বলে, ‘সি উইস পাকেম—’

মাথা নাড়ে হিমাংশু, ‘পারা বেলুম! অন্তত সেটুকুই আশা।’

বিঘ্ন-বিনাশের কন্ট্রোল-কামরায় কাচের পেছন থেকে মহাকাশের প্রেক্ষাপটে মিলিয়ে যেতে থাকা স্ফুলিঙ্গগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে থাকে রোহিণী, হাতের আঙুলগুলো তার শিকারী পাখির নখের মতো চেপে বসে চেয়ারের হাতলে।

‘অর্ডার কাপিটান? ফ্রয়লাইন কাপিটান?’ রোহিণীর মনে হয় অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে সন্দীপের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।

বাইরের দিকে আর একবার তাকায় রোহিণী। মহাকাশের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে ল্যান্ডারের শেষ জ্বলন্ত কণিকাগুলো। নিমেষে মুছে গেছে অনেকগুলো প্রাণ। আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনও অবকাশ নেই।

বুক ভরে একটা লম্বা শ্বাস নেয় রোহিণী, ‘স্বরাট উবের আলেস। ফায়ার!’

লিয়ুট্‌ন্যান্ট সন্দীপ নিৎসের আঙুলগুলো দক্ষ পিয়ানো বাদকের মতো খেলে যায় কনসোলের ওপর দিয়ে। বিঘ্ন-বিনাশের পিঠ থেকে শত-শতঘ্নীর দিকে ছুটে যায় টর্পেডো, প্রাস আর ফোটন গোলকের ঝড়। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহকাশের কালোয় লাইন টানে লেসার আর প্লাজমার রেখা।

শত-শতঘ্নীর কন্ট্রোল-কামরায় তখন মেঝে থেকে বেড়ে ওঠা যন্ত্রের ঝাড়ের

ওপর দিয়ে হাত চালায় ট্রিবিউন হিমাংশু আর সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া। কন্ট্রোল-কামরার সামনের নিষ্পত্র গাছের মতো অ্যান্টেনা বেয়ে বিঘ্ন-বিজয়ের দিকে ধেয়ে যায় বিজাতীয় শক্তির বহুবর্ণের ক্রকচ, সর্পিল আর কুটিল রেখা।

ব্যুহ ভেঙে সামনের দিকে ছুটে যায় শত-শতঘ্নীর কন্ট্রোল-কামরাকে ঘিরে রাখা গগন-বাণের বৃত্ত, তাদের পিঠ থেকে শক্তি বর্ষণ করতে থাকে এনার্জি কামানের সারি।

অনেক অস্ত্রই বৃথা যায়। টর্পেডোর দল মাঝপথেই বিস্ফোরিত হয়ে নিমেষের জন্য জন্ম দেয় নতুন নক্ষত্রের। শক্তি রেখার আঘাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট প্রাস পরিণত হয় জ্বলন্ত ধূলিকণায়। বিঘ্ন-বিনাশ থেকে ছুটে আসা প্লাজমা আর ফোটনের রেখা অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যায় শত-শতঘ্নীর গগন-বাণ। শত-শতঘ্নী থেকে ধেয়ে আসা বিচিত্র এনার্জির তরঙ্গ বিঘ্ন-বিনাশের শক্তি প্রলেপের বাধা প্রতিহত করতে না পেরে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে ফুলঝুরির মতো।

অনেক অস্ত্র বৃথা যায়। আবার কিছু অস্ত্র বৃথা যায় না।

একটা প্রাসের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ইকুয়াইট নয়নার গগন-বাণ। ফোটন গোলার আঘাতে নিমেষে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায় শত-শতঘ্নীর আরও দুটো গগন-বাণ। উত্তরে সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকা সমস্ত এনার্জি রেখা একত্রিত করে আঘাত করে বিঘ্ন-বিনাশের একটি মাত্র অংশে। ঢিমে হয়ে আসে সে অংশের এনার্জি প্রলেপের আলো, তার ওপর উন্মত্তের মতো গগন-বাণ নিয়ে হামলা চালায় ইকুয়াইট শৌভিক সিসেরো। তার যানের কামান থেকে ছিটকে আসা অগুন্তি শক্তি রেখার সম্মিলিত প্রহারে একটা বিস্ফোরণ ঘটে বিঘ্ন-বিনাশের অভ্যন্তরে, কোনও অসুস্থ জলজীবের মতো বিঘ্ন-বিনাশ মহাকাশে উগরে দেয় বিনষ্ট যন্ত্রাংশ আর মানুষের শব। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিঘ্ন-বিনাশের পিঠ থেকে লাফিয়ে ওঠে প্লাজমা আর লেসারের রেখা, টুকরো টুকরো হয় যায় ইকুয়াইট শৌভিকের যান।

আর বিনাশের সেই প্রথম প্রহরে হঠাৎ বিঘ্ন-বিনাশ আর শত-শতঘ্নীর সমস্ত চ্যানেল আর কমিউনিকেটরে বেজে ওঠে পথিকের গম্ভীর সুরেলা কণ্ঠ, ‘এই নিরর্থক ভ্রাতৃদ্বন্দ আর চলতে দেওয়া যায় না।’

এবং সঙ্গে সঙ্গে কোনও অজানা কারণে স্বরাটের মানোয়ার আর স্বরাজের

স্তবক যানে নীরব হয়ে পড়ে সমস্ত অস্ত্র।

পথিকের সে গম্ভীর কণ্ঠ আবার কথা বলে ওঠে, ‘অনেক আশা নিয়ে মানুষ বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিল অর্কমণ্ডলীতে। নতুন বসত গড়তে, নতুন জীবন গড়তে, নতুন সমাজ গড়তে। কিন্তু সঙ্গে করে কি গোপনে নিয়ে এসেছিল দ্বন্দ্বের বীজ? যে বীজ পোঁতা হয়েছিল আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে, আজকের এ সংঘর্ষ কি তারই ফল?’

তারপরে ফের ভেসে উঠতে শুরু করে এক প্রাচীন, কিন্তু অতি পরিচিত এক অতীতের ছবি। একের পর এক।

আগমাব্দ ৪৭, স্বরাজ—অ্যাসেম্বলি হল

আধখানা চাঁদের মতো ছড়ানো অ্যাসেম্বলি হলে ওপরের দিকে থাকে থাকে উঠে গেছে গ্যালারি। এখানে কেউ কোথাও বসার বাধা নেই, কিন্তু অ্যাসেম্বলিতে প্রথম পা রাখা কোনও মানুষও বুঝতে পারবে যে গ্যালারিতে বসা ভিড়টা দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাঁ-দিকে যারা বসে তাদের কড়া ইস্তিরি করা গলাবন্ধ পোশাক আর টান টান পিঠ থেকেই স্পষ্ট তারা স্বরাটের প্রতিনিধি। তাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে গ্যালারির ডান পাশ ঘেঁসে বসে স্বরাজের প্রতিনিধিরা। তাদের পরনে ঢিলেঢালা হালকা পোশাক, দেহভঙ্গী শিথিল। গ্যালারির একদম ওপর দিকে একটা আলাদা বসার আসন, লোকমাতা অ্যাসেম্বলি হলে এখানেই বসেন।

অন্যদিনের মতো এ জায়গাটা আজও খালি, অনেকদিন হয়ে গেল লোকমাতা অনন্তা আর অ্যাসেম্বলিতে আসেন না।

গ্যালারি যেখানে শেষ হয়েছে বাধানো চাতালে। গ্যালারি থেকে সেখানে নেমে এসেন দাঁড়ান স্বরাট অধ্যক্ষ রজতাভ। মাথার পাতলা চুল পেছন দিকে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চওড়া কাঁধ, ঘাড় আর পিঠ ধরে রাখা এক সরলরেখায়। আলোয় চমকায় তাঁর কোমরের বেল্ট আর হাঁটু-উঁচু বুটের ঝকঝকে পালিশ।

তাঁর পেছনে গ্যালারির আর একপাশ থেকে নেমে আসেন স্বরাজ অধ্যক্ষা শতরূপা। পায়ে বিনুনী করা স্যান্ডাল, পাতলা দুই কাঁধের ওপর আলগোছে জড়ানো বেগুনি পাড় দেওয়া শাল, মাথার রুপোলি দাগ লাগা চুলগুলো অগোছালো ভাবে ছড়ানো পিঠের ওপর।

দুই যুযুধান প্রতিপক্ষের মতো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েন দুই অধ্যক্ষ। তাদের মাথার ওপর চক্কর কাটে গোটা পাঁচেক ত্রিমাত্রিক ক্যামেরা, অ্যাসেম্বলির তর্ক- বিতর্ক স্বরাজ আর স্বরাটের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

শালটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে গ্যালারিতে বসা স্বরাজের প্রতিনিধিদের

দিকে তাকান শতরূপা, ‘আমাদের সমাজের শাসন ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ চেহারা কেমন হবে তা স্থির করতে আমাদের এই অধিবেশন ডাকা। কিন্তু তার আগে আমাদের বুঝতে হবে পৃথিবীতে ঠিক কোন কোন সমস্যার জন্য মানুষের সভ্যতা ভেঙে পড়েছিল।’

একটা গুঞ্জন ওঠে। গ্যালারির ওপরের দিকে একটা দরজা দিয়ে নিজের নির্দিষ্ট আসনে এসে বসেন লোকমাতা অনন্তা। মাথার চুলে কয়েকটা বাড়তি রুপোলি ছাপ ছাড়া বয়স আর প্রমাণ রেখে যায়নি কোথাও। কৃষ্ণকালো মুখে খোদাই করা নাক আর চিবুকের কাছে যেন হার মেনে গেছে বলিরেখারাও। পরনে ধূসরবর্ণ জোব্বা, কালো কপালে জ্বলজ্বল করে লাল টিপ।

লোকমাতার দিকে ফিরে মাথা নিচু করে সম্ভ্রম জানান রজতাভ আর শতরূপা দু-জনেই। তারপর পরস্পরের দিকে ফেরেন আগের মতো আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতেই।

গলাবন্ধ টিউনিকের কলারের ফাঁকে একটা আঙুল গলিয়ে কলারটা খানিকটা ঢিলে করার চেষ্টা করেন রজতাভ। গ্যালারিতে বসা স্বরাটের প্রতিনিধিদের ওপর একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে সোজা তাকান শতরূপার দিকে।

‘উত্তরটা খুব সহজ, শতরূপা। পৃথিবীর মূল সমস্যা ছিল লোভ। মানুষের নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে সমাজের ভালোমন্দ গৌণ হয়ে পড়েছিল। যে সমাজে মানুষ সমষ্টির কথা ভুলে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, সে সমাজে পচন ধরতে সময় লাগে না।’

হাততালি দেয় স্বরাটের প্রতিনিধিরা। গ্যালারিতে বসা স্বরাজের প্রতিনিধিদের দিক থেকে উড়ে আসে বিদ্রূপ।

মাথা নাড়েন শতরূপা, ‘ভুল রজতাভ। পৃথিবীতে যে দিন থেকে নানা অছিলায় মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছিল, সেই দিন থেকে শুরু হয়েছিল মানব সভ্যতার পতনের পালা।’

কপালে ভুরু তোলেন রজতাভ, ‘গণতন্ত্র! হুঁঃ! গণতন্ত্র একটা মরিচীকা। যতদিন মানুষ কিছু জিনিসকে কেবলমাত্র তার নিজের বলে দাবি করবে ততদিন গণতন্ত্র সম্ভব নয়।’

আরও জোরে মাথা নাড়েন শতরূপা। গ্যালারিতে বসে থাকা স্বরাজের

প্রতিনিধিদের থেকে উড়ে আসে দু-একটা বিরূপ মন্তব্য।

‘ভুল কথা!’

হাত দুটো দু-পাশে ছড়িয়ে দেন রজতাভ। আলো পড়ে চকচক করে তাঁর জামার হাতায় বসানো ধাতুর বোতাম, ‘ভুল নয় শতরূপা। ব্যক্তিস্বার্থ থাকলেই তাকে রক্ষা করার জন্য সমাজকে নানা নিয়ম শৃঙ্খলায় বাঁধতে হয়, এই শৃঙ্খলাই একদিন মানুষের শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের চূড়ায় বসে থাকা মানুষেরা সে শেকলে বেঁধে ফেলে নিচুতলার মানুষদের। মানুষ জন্মায় স্বাধীন হয়ে। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র বাধা পড়ে যায় শেকলে।’

বিস্ময়ের ছাপ পড়ে শতরূপার চোখেমুখে। একটা ক্যামেরা নিচে নেমে এসে চেষ্টা করে তাঁর আরও কাছ থেকে ছবি তুলতে।

‘মানে তোমার এই পরিকল্পিত নতুন সমাজে মানুষের নিজের বলতে কিছুই থাকবে না! মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে তাহলে?’

‘মানুষের উদ্দেশ্য ঠিক করে দেবে সমাজ। মানুষ বাঁচবে সমষ্টির জন্য, নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নয়।’

ডান হাতটা সজোরে ছোড়েন শতরূপা, তাঁর সামনে উড়তে থাকা ক্যামেরা ছিটকে সরে যায় পেছনের দিকে।

‘অসম্ভব রজতাভ। মানুষের উদ্দেশ্য কেউ বাইরে থেকে বেঁধে দিলে সে যন্ত্রের মতন হয়ে পড়ে। সে মানুষের সমাজে বিজ্ঞান, কলা, শিল্প, রুচি সবই গতিহীন হয়ে পড়ে, সমাজ একটা মজে যাওয়া নদীর মতন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে তার নিজের জীবনের উদ্দেশ্য বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা না দিলে সমাজ তার সৃজনশীলতা হারায়।’

বিদ্রুপের হাসিতে বেঁকে যায় রজতাভর ঠোঁট। বিদ্রুপের হাসি ভেসে আসে গ্যালারিতে বসা স্বরাটের প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও।

‘সৃজনশীলতা! সৃজনশীল সমাজ একটা আকাশকুসুম আদর্শ শতরূপা! সমাজের প্রয়োজন উপেক্ষা করে মানুষকে কেবল তার নিজের জন্য বাঁচার স্বাধীনতা দিলে সে সৃজনশীলতার নয়, বশবর্তী হয়ে পড়ে লোভের। অন্যকে বঞ্চিত করে সমাজের সম্পদের সিংহভাগ নিজের কুক্ষিগত করাটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে পড়ে।’

‘সৃজনশীলতা না থাকলে সমাজে বৈচিত্র্য থাকে না রজতাভ!’ অ্যাসিডের মতো ব্যঙ্গ চুঁইয়ে পড়ে অধ্যক্ষ শতরূপার কণ্ঠস্বরে। হাত তুলে গ্যালারিতে বসে থাকা স্বরাটের প্রতিনিধিদের দিকে নির্দেশ করেন তিনি, ‘তোমাদের প্রতিনিধিদেরই দেখো। এক বেশ, এক পোশাক। কোনও বৈচিত্র নেই। কোন শৃঙ্খলের কথা তুমি বলছ রজতাভ? বিধি নিয়মের বশ্যতা আর প্রশ্নহীন আনুগত্যের শেকলে নিজেরাই বেঁধে ফেলেছ তোমরা নিজেদের।’

এবার হাসি নয়, প্রতিবাদের ঝড় ভেসে আসে গ্যালারিতে বসে থাকা স্বরাটের প্রতিনিধিদের থেকে।

হাত তুলে নিজের প্রতিনিধিদের নিরস্ত করেন অধ্যক্ষ রজতাভ। চোখে চোখ রাখেন শতরূপার। ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে তাঁর গলাতেও, ‘আর তোমাদের পোশাকে খানিকটাই বেশি বৈচিত্র নজরে পড়ছে শতরূপা। সম্পদ, বংশমর্যাদা, পদের অহমিকা, এর সবই ছাপ ফেলেছে তোমাদের পোশাকে। তোমরা নিজেদের বেঁধে ফেলেছ সামাজিক দূরত্ব আর বিভেদের শৃঙ্খলে।’

এবার প্রতিবাদের উচ্চস্বর ভেসে আসে স্বরাজের প্রতিনিধিদের দিক থেকেও। উত্তরে গর্জে ওঠে স্বরাটের প্রতিনিধিরাও। দুই দলই গ্যালারিতে বসে চিৎকার করতে থাকে পরস্পরের প্রতি। ক্রমশ বাদানুবাদ পরিণত হয় অশ্রাব্য গালিগালাজে। তারপর একজন-দু-জন করে শুরু করে দুটো দলই পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হাতাহাতিতে।

হঠাৎ গ্যালারির ওপর দিক থেকে ভেসে আসে একটা অস্ফুট কান্নার আওয়াজ! মুহূর্তের মধ্যে থেমে যায় সমস্ত কোলাহল আর কলহ। সবাই অপরাধীর মতো দৃষ্টি নিয়ে তাকায় ওপরের দিকে।

লোকমাতার আসন শূন্য। কেবল গ্যালারির পেছন দরজায় এক ঝলকের জন্য নজরে এসেই মিলিয়ে যায় তাঁর বসনের অন্তিম প্রান্তটুকু।

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের যুদ্ধ—বিঘ্ন-বিনাশ

আগের মতোই পাংশু মুখে বসে থাকে লিয়ুট্‌ন্যান্ট সন্দীপ নিৎসে। ঘাম চুঁইয়ে পড়ে তার কপাল দিয়ে।

‘কাপিটান, আমাদের কোনও কন্ট্রোলই কাজ করছে না! পথিকের পাঠানো ক্লিপে কিছু লুকানো ভাইরাস ছিল, সমস্ত ফায়ারিং সিস্টেমকেই অকেজো করে দিয়েছে।’

‘অন্য সিস্টেম? ফ্লুগমেইস্টার সুশান্ত?’

কনসোল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সুশান্ত, ‘বাকি সব সিস্টেম ঠিক আছে কাপিটান। লাইফ সাপোর্ট, ভূ-টান, নেভিগেশন, কোনও সিস্টেমেই কোনও সমস্যা নেই।’

কপালের ঘাম মোছে সন্দীপ, ‘কাপিটান, স্বরাজের স্তবকযান যদি এখন আক্রমণ করে, তাহলে আমরা কোনওরকম জবাব দিতে পারব না। কয়েক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাব।’

মাথা নাড়ে রোহিণী। আঙুল তোলে কবচ-কাচের পেছনে মহাকাশে ভাসতে থাকা শত-শতঘ্নীর দিকে, ‘পথিকের মেসেজ ক্লিপের ভাইরাস কেবল আমাদের নয়, স্বরাজের জাহাজের ফায়ারিং সিস্টেমও নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। আমাদের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াটা যে কোনও কারণেই হোক তার পছন্দ নয়।’

‘কিন্তু কেন কাপিটান?’

‘উত্তর আমার জানা নেই সন্দীপ। এই মুহূর্তে পথিক আমাদের কাছে একটা প্রহেলিকা। তাকে আটক করতে পারলে এ সবের উত্তর হয়তো পাওয়া যেতে পারে। তার আগে নয়।’

‘ফ্রয়লাইন কাপিটান!’ কনসোল ছেড়ে ফের উঠে দাঁড়ায় ফ্লুগমেইস্টার সুশান্ত, ‘ফ্রয়লাইন কাপিটান, পথিকের লোকেশন পাওয়া গেছে।’

চেয়ার ঘোরায় রোহিণী, ‘কোথায়?’

‘হিমেলগাঁওয়ের উত্তরে।’

একটা লম্বা শ্বাস নেয় সন্দীপ নিৎসে, ‘এখন আর পথিকের লোকেশন জেনে কী লাভ? স্বরাজ আমাদের ল্যান্ডার ধ্বংস করে দিয়েছে, পথিকের ভাইরাস আমাদের ফায়ারিং সিস্টেম অকেজো করে আমাদের মানোয়ারকে নখদন্তহীন করে ফেলেছে!’

মাথা নাড়ায় রোহিণী, ‘না সন্দীপ। আমাদের যা ক্ষতিই হয়ে থাকুক, মিশনের লক্ষ্য পাল্টায়নি। পথিককে আটক করার শেষ একটা চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।’

‘কিন্তু কীভাবে কাপিটান? আমাদের ল্যান্ডার নেই যে আমরা তুহিনের বুকে নামব।’

সন্দীপের চোখে চোখ রাখে রোহিণী, ‘জীবন-গোলা! জীবন-গোলা নিয়ে তুহিনে নামা যেতে পারে!’

বিস্ফারিত চোখে সন্দীপ তাকায় রোহিণীর দিকে। জীবন-গোলা একটা বড় বলের মতো আধার। একটা মানুষ কষ্টেসৃষ্টে তার মধ্যে বসতে পারে। ভেতরে জীবনধারণের জন্য থাকে কিছুটা অক্সিজেন আর জল। বাইরে বসানো থাকে একটা ছোট কেমিক্যাল জ্বালানীর ইঞ্জিন। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মহাকাশযান থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য জীবন-গোলা ব্যবহার হয়ে থাকে, তাতে চড়ে গ্রহের বুকে নামার দুঃসাহস কেউ কোনওদিন দেখায়নি।

‘কাপিটান, জীবন-গোলা মহাকাশে ভেসে থাকার মতো করে বানানো। বায়ুমণ্ডল দিয়ে নিচে নামার মতো মজবুত নয়। ঘর্ষণে আগুন ধরে যেতে পারে।’

‘ইঞ্জিনিয়ারিংকে বলো, গোলার ওপরে বাড়তি দু-তিন স্তর সেরামিকের প্লেট লাগিয়ে দিতে।’

বিস্মিত মুখে ঘাড় নাড়ে সন্দীপ, ‘আর ল্যান্ডিং কাপিটান?’

‘ইঞ্জিনিয়ারিংকে বলো, সেরামিকের প্লেটের নিচে গোটা তিনেক প্যারাশুট লাগিয়ে দিতে। সেরামিকের প্লেট জ্বলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে প্যারাশুট আপনা থেকে খুলে যাবে। যাও!’

বিস্মিত মুখে সন্দীপ তবু দাঁড়িয়ে থাকে, ‘কাপিটান, জীবন-গোলা মাত্র একজন ধরে। কে যাবে?’

‘আমি!’

রোহিণীর ছোট্ট উত্তরটা যেন বাজ পড়ার মতো শোনায় কন্ট্রোল-কামরায়। সচকিতে কনসোল থেকে মুখ তুলে তাকায় অফিসাররা।

সন্দীপের বিস্ময়ের নিঃশ্বাসটা একটা অস্ফুট আর্তনাদের মতো শোনায়, ‘কাপিটান, মানোয়ারের দায়িত্ব ছেড়ে আপনি কীভাবে যাবেন। অর্ডার দিন, আমি যাচ্ছি।’

হাত তুলে সন্দীপকে নিরস্ত করে রোহিণী, ‘না সন্দীপ, আমার দায়িত্ব থাকাকালীন অনেকগুলো প্রাণহানি হয়েছে। আমি আর কাউকে প্রাণের ঝুঁকি নিতে বলতে পারি না।’

‘কিন্তু বিঘ্ন-বিনাশের দায়িত্ব, কাপিটান?’

‘যতক্ষণ না ফেরত আসি বিঘ্ন-বিনাশের দায়িত্ব সামলাবে তুমি।’

‘আমি কাপিটান!’

সন্দীপের মুখের ভাব দেখে মনে হয় সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

‘হ্যাঁ, তুমি। মন দিয়ে শোনো, তোমাকে কী করতে হবে। আমি পথিককে হিমেলগাঁওয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করব—’

‘আপনি বিঘ্ন-বিনাশে ফিরবেন কী করে?’

‘আমি যাওয়ার পর স্বরাজে বাড়তি ফৌজ চেয়ে খবর পাঠাবে। স্বরাজ থেকে নতুন ল্যান্ডিং পল্টন এসে পড়লে, তারা হিমেলগাঁও থেকে আমাকে আর পথিককে তুলে আনবে। দেরি কোরো না। যাও!’

যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে সন্দীপ।

‘কাপিটান, পথিকের মেসেজ ক্লিপ এখনও চলছে।’

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নাড়ে রোহিণী।

‘চলতে দাও। পুরোনো ইতিহাস। সবাই জানে।’

আগমাব্দ ৪৭, স্বরাজ—অ্যাসেম্বলি হল

আজ অ্যাসম্বেলি হল খালি, অনুপস্থিত হাওয়ায় ভাসা ক্যামেরাও। পালিশ করা মেঝেতে দাঁড়িয়ে থাকেন কেবল স্বরাট অধ্যক্ষ রজতাভ আর স্বরাজের অধক্ষ্যা শতরূপা।

গ্যালারিতে পায়ের শব্দ হয়। নেমে আসে চার-পাঁচজন মানুষ। পরনে উর্দি, মুখে নিরাশার ছাপ স্পষ্ট।

সাগ্রহে এক পা এগিয়ে যান রজতাভ, ‘কিছু খবর পেলে অরুণ?’

মাথা নাড়ে অরুণ, ‘না। লোকমাতা কাউকে কিছু জানাননি। একাই একটা ছোট গগন যান নিয়ে তুহিনের দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন। তুহিনে নামার সময় তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে—’

বাধা দেন শতরূপা। কণ্ঠে বিরক্ত ঝরে পড়ে তাঁর, ‘এই কথাগুলো আমরা জানি অরুণ। মাতার কোনও খবর পেলে?’

মাথা নাড়ায় অরুণ, ‘না। যান ভেঙে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমদের সার্চ টিম তন্নতন্ন করে সমস্তটা খুঁজেছে। কিন্তু মাতার পরনের কাপড়ের খানিকটা ছেঁড়া টুকরো ছাড়া আমরা আর মাতার কোনও চিহ্ন খুঁজে পাইনি।’

একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মুখে হাত চাপা দেন শতরূপা। তাঁর দু-চোখের কোণে জমে ওঠে জল।

দুই হাত মুঠো করেন রজতাভ, ‘তাহলে মাতা হয়তো জীবিতই আছেন। কোথাও আশ্রয় নিয়েছেন।’

মাথা নাড়ে অরুণ, ‘আশা কম! আটচল্লিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যদি দুর্ঘটনাতেও মাতার কিছু হয়ে না থাকে, তুহিনের ঠান্ডাতে খোলা আকাশের নিচে এতক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়।’

একটা অস্ফুট কান্না বেরিয়ে আসে শতরূপার কণ্ঠ থেকে। একটা কাঁপা কাঁপা আঙুল তোলেন তিনি রজতাভর দিকে, ‘তোমরা! এর জন্য তোমরা দায়ী।

তোমাদের স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ গড়ার স্বপ্নই মাতাকে ঠেলে দিল মৃত্যুর দিকে!

‘আমরা!’ রাগে ফেটে পড়েন রজতাভ। আঙুল তোলেন তিনিও, ‘শতরূপা, স্বরাজে তোমাদের লোভ আর স্বার্থপরতাই দায়ী এই ঘটনার জন্য। সমস্ত স্বরাট জানবে তোমাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা।’

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিনের যুদ্ধ—শত-শতঘ্নী

ক্লিপের শেষ ছবিটা মিলিয়ে যায় বাতাস থেকে। অন্যমনস্ক ভাবে তবু সেদিকেই তাকিয়ে থাকে হিমাংশু। মাথায় প্রশ্নের ঝড় ওঠে তার। কে এই পথিক? কেন সে থামিয়ে দিল যুদ্ধ? কেনই বা সে ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার দুই পক্ষকেই?

‘ট্রিবিউন! ট্রিবিউন!’

সেঞ্চুরিয়ান বিজয়া সেনেকার ডাকে সম্বিৎ ফেরে হিমাংশুর।

‘ট্রিবিউন, স্বরাটের মানোয়ার থেকে একটা জীবন-গোলা এখুনি নেমে গেল তুহিনের দিকে।’

‘জীবন-গোলা!’ চিন্তিত মুখে হিমাংশু বাইরের দিকে তাকায় স্বচ্ছ জানলা দিয়ে, ‘ল্যান্ডার নষ্ট হয়ে গেছে, তাই বোধহয় ওরা একটা জান-গোলাকে জোড়াতালি দিয়ে নামাচ্ছে তুহিনে।’

‘কিন্তু কেন ট্রিবিউন?’

‘খুব সম্ভব পথিকের সন্ধান পেয়েছে ওরা। কাউকে তাই পাঠাচ্ছে পথিককে আটকে রাখার জন্য।’

কপাল কুঁচকোয় বিজয়া, ‘তাহলে কোনও ইকুয়াইটকে ওর পেছনে পাঠিয়ে দিলে হয় না ট্রিবিউন? তাহলে পথিককে আমরা আটক করতে পারি।’

জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় হিমাংশু, ‘পথিককে আটক করতে কাউকে যেতে অবশ্যই হবে। কিন্তু তার জন্য কোনও ইকুয়াইটকে পাঠানো যাবে না বিজয়া। এদের মধ্যে কে শৌভিকের মতো অর্ডার অমান্য করে নিজের খুশিমতো কাজ করবে বলা যায় না। পথিককে বন্দী করতে আমিই যাব।’

ঘাড় নেড়ে সায় দেয় বিজয়া, ‘বেশ! তাহলে আপনি কোনও ইকুয়াইটকে বলুন তার গগন-বাণ আপনাকে ছেড়ে দিতে!’

আর একবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকাইয় শৌভিক, ‘না বিজয়া। আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্বরাটের মানোয়ারের ফায়ারিং সিস্টেম ফের কখন তার ক্ষমতা ফিরে পাবে জানা নেই। এ অবস্থায় আমি কোনও যান নিয়ে নিলে ব্যুহ দুর্বল হয়ে যাবে।’

একটা হালকা হাসি লাগে বিজয়ার ঠোঁটের কোণে, ‘মানে আপনি ত্রাণ-যানে তুহিনে নামার ছক কষছেন!’

মৃদু হাসে হিমাংশু, ‘নয় কেন? স্বরাটের কেউ যদি জীবন-গোলা চড়ে তুহিনে নামার দুঃসাহস দেখাতে পারে, আমারই বা ত্রাণ-যান ব্যবহারে বাধা কোথায়?’

দু-দিকে হাত ছড়িয়ে দিয়ে চওড়া কাঁধদুটো ঝাঁকায় সেঞ্চুরিয়ান বিজয় সেনেকা, ‘আপনাকে আটকানোর আমার ক্ষমতা নেই। সে আপনি আত্মহত্যা করতে চাইলেও না।’

ঠোঁটের হাসিটা সরে না হিমাংশুর।

‘আমি পথিককে নিজের কবজায় নিতে পারলে জানাব। তবে এর মধ্যে সাহায্য চেয়ে স্বরাজে খবর পাঠিও। বাড়তি ফৌজ এলে এলে দু-তিনজন ইকুয়াইটদের আমাকে আর পথিককে আনার জন্য তুহিনে পাঠিয়ে দিও।’

হাওয়ায় হাত নেড়ে ইঙ্গিত করে বিজয়া। কন্ট্রোল-কামরার মেঝে থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো কৃস্টাল উঠে এসে ধোঁয়ার মতো পাক খেতে আরম্ভ করে হিমাংশুর চারপাশে, মিনিট কয়েকের মধ্যেই তার আড়ালে হারিয়ে যায় সে। হিমাংশুকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলা কৃস্টালের গুঁড়ো ধীরে ধীরে জমে আকার নেয় একটা লম্বাটে বাক্সের।

এই ত্রাণ-যান। ক্ষতিগ্রস্ত যান থেকে পালাতে ব্যবহার করা হয়।

হাত নাড়ে বিজয়া। লম্বাটে বাক্সটা ধীরে ধীরে ডুবে যেতে আরম্ভ করে কন্ট্রোল-কামরার মেঝেতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাক্স অদৃশ্য হয়ে যায় মেঝের নিচে।

একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় বিজয়া। কন্ট্রোল-কামরার তলা থেকে বেরিয়ে মহাকাশে দু-একবার পালটাপালটি খায় ত্রাণ-যান। অর্কের আলো ছিটকে যায় তার অবয়ব থেকে। তারপর তার দুই পাশ থেকে বেরিয়ে আসে দুটো লম্বাটে ডানা, একপাশে জ্বলে ওঠে জ্বালানী পোড়ার নীল আলো।

নীলচে শিখার রেখা টেনে ত্রাণ-যান পাড়ি দেয় তুহিনের দিকে।

আগমাব্দ ৩৭৩, হিমেলগাঁও

ইঞ্জিনের নীল শিখা মাটির দিকে ফেরানো, যাতে পড়ার গতি খানিকটা কমানো যায়। কিন্তু তবু দুরন্ত বেগে পড়তে থাকে রোহিণীর জীবন-গোলা। জ্বলে পুড়ে খসে পড়ে গেছে জীবন-গোলার বাইরে বসানো দু-দুটো সেরামিকের খোলস, রোহিণীর হেলমেটের ফেসপ্লেটে লাল রঙের সাংকেতিক চিহ্নগুলো জানান দিচ্ছে যে তিন নম্বরটার আয়ুও বেশি নেই।

ফেসপ্লেটে ভাসতে থাকা জমি থেকে উচ্চতা বোঝানো আঁকাবাঁকা রেখাগুলোর দিকে একবার তাকায় রোহিণী। প্রায় অনেকটাই নিচে নেমে এসেছে জীবন-গোলা। যদি সময়মতো সেরামিকের তিন নম্বর প্লেটটা খসে পড়ে প্যারাসুট না খোলে, তাহলে জীবন-গোলা মাটিতে আছড়ে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে। তার বাঁচার কোনও সম্ভাবনা থাকবে না।

ফেসপ্লেটের লাল চিহ্নগুলো দপদপ করতে থাকে, বিপবিপ করে একটা অ্যালার্ম বেজে ওঠে কিছুক্ষণের জন্য। রোহিণী বুঝতে পারে তিন নম্বর প্লেটটাও খুলে পড়ে গেল। হু হু করে পড়তে থাকে জান-গোলা, ফেসপ্লেটের মিটারে বোঝা যায় কমে আসছে মাটি থেকে দূরত্ব।

একটা ঝটকা লাগে, কমে আসে জান-গোলার গতিবেগ। রোহিণী বুঝতে পারে, খুলে গেছে বাইরের প্যারাশুট। কিন্তু জান-গোলা ততক্ষণে নেমে এসেছে মাটির আরও কাছাকাছি। ফেসপ্লেটে ফের দপদপ করতে থাকে লাল আলোর সংকেত চিহ্ন, আগের চাইতেও জোরে বেজে ওঠে অ্যালার্ম।

হাঁটু দুটো বুকের কাছে তুলে এনে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রোহিণী, মাথাটা দুই হাঁটুর মধ্যে গুঁজে অপেক্ষা করে জান-গোলা মাটিতে পড়ার।

শেষবারের মতো আর্তনাদ করে অ্যালার্ম, ফেসপ্লেটে ভাসা আলোর সাংকেতিক চিহ্নগুলো সমস্ত লাল হয়ে যায়।

আর ভয়ানক শব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ে জীবন-গোলা। সে সংঘর্ষে রোহিণীর মনে হয়ে যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তার শরীরের প্রত্যেকটি হাড়।

শরীরের যন্ত্রণাকে আমল দেয় না রোহিণী। পা দুটো উঁচু করে সজোরে লাথি মারে জীবন-গোলার দেওয়ালে। দেওয়ালের খানিকটা অংশ খসে যায় বাইরের দিকে, গড়িয়ে মাটিতে এসে পড়ে রোহিণী।

মাটিতে দু-হাতে ভর দিয়ে খানিকক্ষণ হাঁপায় রোহিণী। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নজর বোলায় চারপাশে। তার পেছনে হিমেলগাঁওয়ের ভাঙাচোরা কুঁড়ে ঘরের সারি, সামনে দিগন্ত জোড়া তুষার প্রান্তর থেকে ছিটকে যায় অর্কের আলো।

হেলমেটের ফেসপ্লেটে একটা লাল আলোর তিরচিহ্ন দপদপ করে পথিকের অবস্থান নির্দেশ করে। সেটা অনুসরণ করে তুষার প্রান্তরে একটা ছোট ঢিপির দিকে ছোটে রোহিণী।

তুষারে মোড়া ঢিপি, চড়তে গেলে হাঁটু অবধি ডুবে যায় বরফে, কিন্তু তবু কোনওরকমে ঢিবির মাথায় উঠে সামনের দিকে তাকায় রোহিণী।

নির্মেঘ আকাশের নিচে ঊষর, শূন্য বরফের প্রান্তর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।

ফেসপ্লেটের চিহ্নের দিকে আর একবার তাকায় রোহিণী। দপদপ করতে থাকা লাল তিরচিহ্ন যেখানে পথিকের অবস্থান নির্দেশ করে সেখানে কেবল শূন্যতা ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না।

আশ্চর্য হওয়ার সুযোগ পায় না রোহিণী। মাথার ওপর থেকে ভেসে আসে আসে একটা সাইরেনের মতো তীক্ষ্ণ আওয়াজ।

ওপরের দিকে তাকায় রোহিণী, লক্ষ করে আকাশ থেকে জ্বলন্ত উল্কার মতো নেমে আসছে লম্বাটে একটা বাক্স। তার পেছনের অংশে লালচে হলুদ অগ্নিশিখা, দু-পাশের ডানা দুটো আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে ক্ষয় হয়ে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।

তুষারের ঢিবির পেছনে ঝাঁপ দেয় রোহিণী, পিঠ থেকে খুলে নেয় বর্মের সঙ্গে আটকানো প্লাজমা রাইফেল।

পথিকের সন্ধানে স্বরাট পিছু নিয়েছে তার! ঢিবির পেছনে উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেলের স্কোপে চোখ রাখে রোহিণী।

ত্রাণ-যানের শেষ অংশটুকু অঙ্গার হয়ে বাতাসে মিশে যাবার আগে পড়তে পড়তেই হেলমেটের ফেসপ্লেটে নিচের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে হিমাংশু। বরফের ওপর প্যারাশুট ছড়িয়ে পড়ে থাকা জীবন-গোলা, আর সেখান থেকে শুরু হয়ে দূরের একটা ঢিপিতে শেষ হওয়া পায়ের চিহ্ন দেখে তার পরিস্থিতি বুঝে নিতে বিশেষ সময় লাগে না।

ত্রাণ-যান মাটি ছোঁয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে দু-পা জড়ো করে বাক্সের গায়ে সজোরে লাথি মারে হিমাংশু। ত্রাণ-যানের শেষ অংশটুকু জ্বলন্ত কয়লার মতো ছড়িয়ে পড়ে একপাশে, হিমাংশু ছিটকে যায় আর একদিকে।

উত্তপ্ত টুকরোগুলো বরফের ওপরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুণ্ডলী পাকিয়ে বাষ্প ওঠে, আকাশের দিকে উঠে যায় বাষ্পের স্তম্ভ, তার সঙ্গে মেশে ত্রাণ-যান জ্বলার কালো ধোঁয়া।

সেই ধূসর মেঘ লক্ষ করে বাজ পড়া শব্দে এবার পরের পর ছিটকে আসে প্লাজমার রেখা।

মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে প্লাজমা কোথা থেকে আসছে একবার বুঝে নেয় হিমাংশু, তারপর কোমর থেকে একটা ছোট বল বের করে ছুঁড়ে দেয় আকাশের দিকে।

গুঞ্জন তুলে বল ছিটকে যায় ওপরে, আঁকাবাঁকা পথে উড়তে শুরু করে বাতাস কেটে।

উড়তে থাকা বলটার দিকে তাকায় হিমাংশু। অস্ত্র নয়, সাধারণ ক্যামেরা মাত্র, কিন্তু হয়তো কিছুক্ষণের জন্য হলেও শত্রুর নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখবে।

হিমাংশুর অনুমান বৃথা হয় না, বরফের ঢিবির আড়াল থেকে ক্যামেরা লক্ষ করে ছুটে আসে একের পর প্লাজমার রেখা।

কোমরের হোলস্টার থেকে ফোটন পিস্তলটা টেনে বের করে হিমাংশু, তার পর ঝুঁকে পড়ে দৌড়তে আরম্ভ করে তুষার ঢিবি লক্ষ করে।

চাতুরী বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। একটা প্লাজমার রেখার আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে আকাশ থেকে ঝরে পড়ে ক্যামেরা। প্লাজমা এবার এসে আঘাত করতে আরম্ভ করে হিমাংশুর আশপাশের তুষারে।

গতি বাড়িয়ে দেয় হিমাংশু। প্লাজমার আঘাতে তুষার থেকে ওঠা বাষ্পের কুণ্ডলী পেছনে ফেলে সর্বশক্তি নিয়ে ছুটতে আরম্ভ করে ঢিবির দিকে।

এবার দু-একটা প্লাজমার রেখা খুঁজে পায় তার শরীর। ফেসপ্লেটের জ্বলে ওঠে অনেকগুলো লাল আলোয় লেখা চিহ্ন, কৃস্টালের বর্ম প্লাজমার এনার্জি শুষে নিয়ে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে থাকে বাতাসে।

কিন্তু ততক্ষণে হিমাংশু পৌঁছে গেছে তুষার ঢিবিটার অনেক কাছে। ঢিবির আড়ালে তার নজরে পরে হেলমেটে ঢাকা মাথা আর প্লাজমা রাইফেলের ব্যারেল।

এবারে হাতের পিস্তল তোলে সে, ব্লিপ ব্লিপ আওয়াজ করে পরের পর ছুটে যায় নীলচে-সাদা শক্তিপুঞ্জ, তুষারের ঢিবি থেকে বিস্ফোরণে ছিটকে যেতে থাকে বরফের চাঙড়।

ফোটন রাইফেলের এনার্জি বিন্দু এড়াতে একদিকে ঝাঁপ দেয় রোহিণী, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একটা এনার্জি বিন্দু আঘাত করে তার কাঁধে।

সেরামিকের বর্ম এনার্জির অনেকটা প্রতিহত করে ছড়িয়ে দেয় বাইরের দিকে, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে রোহিণী চিত হয়ে পড়ে যায় মাটিতে, তার হাত থেকে ছিটকে যায় রাইফেল।

ততক্ষণে পিস্তল হাতে হিমাংশু এসে পড়েছে তার ঘাড়ের ওপরে।

মাটি থেকে রাইফেল তোলার আর চেষ্টা করে না রোহিণী। তার ডান হাত কোমরের হোলস্টার থেকে টেনে বের করে পিস্তল, শরীরটা স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠে আছড়ে পড়ে হিমাংশুর দেহের ওপর।

ধাক্কা খেয়ে এবার চিত হয়ে পড়ে যায় হিমাংশু, তার পিস্তল ধরা ডান হাত ততক্ষণে ধরা পড়েছে রোহিণীর বাঁ হাতের বজ্রমুষ্টিতে।

হিমাংশুর শরীরের ওপর শুয়ে রোহিণী এবার চেষ্টা করে তার ডান হাতের পিস্তলটা হিমাংশুর মাথায় ঠেকানোর, কিন্তু তার আগেই হিমাংশুর বাঁ হাতের মুঠো এবার চেপে ধরে সে হাতে, ঠেলে দেয় তার নিজের শরীর থেকে দূরে।

দুই বর্মাবৃত প্রতিপক্ষের মধ্যে তুহিনের তুষারের বুকে এবার শুরু হয় এক মরণপণ মল্লযুদ্ধ। দু-জনেই চেষ্টা করে প্রতিপক্ষের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে তার মাথায় পিস্তলের নলটা ঠেকিয়ে দিতে। প্রাণপণ শক্তিতে দু-জনেই কেউ কখনও ওপরে, কেউ কখনও নিচে থেকে বাধা দিতে থাকে অপরকে।

হঠাৎ হাওয়া টেনে নেওয়ার মতন একটা অদ্ভুত শব্দ হয়। তারপর রোহিণী

আর হিমাংশু দু-জনকেই অমানুষিক শক্তিতে ঘাড় ধরে মাটি থেকে তুলে দূরে ছুড়ে ফেলে কেউ।

দু-জনে দু-পাশে ছিটকে পড়ে মাথা তুলে দেখে তাদের থেকে কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘদেহী কেউ, তার আপাদমস্তক ঢাকা ধূসর জোব্বায়, মুখা ঢাকা ধাতব মুখোশে। তার পেছনে, তার পিঠকে কেন্দ্র করে বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে বৃত্তের পর বৃত্ত, যেমন জলে ঢিল ফেললে দেখা যায়।

একটু দূরে ছিটকে যাওয়া পিস্তলটা তোলার চেষ্টা করে হিমাংশু। কিন্তু তার আগেই হাত তোলে দীর্ঘদেহী, মাঝপথেই হাত আটকে যায় হিমাংশুর। সভয়ে হিমাংশু খেয়াল করে, তার কৃস্টালের বর্ম আর কাজ করছে না। তার সুষুম্না কাণ্ডে বসানো ইমপ্ল্যান্টের কোনও আদেশ আর মানছে না বর্ম। কার্যত সে তার নিজেরই বর্মে বন্দী।

একটু দূরে মাথা ঝেড়ে উঠে বসতে চেষ্টা করে রোহিণী, কিন্তু দীর্ঘদেহীর হাতের ইঙ্গিতে অচল হয়ে পড়ে তার সেরামিকের বর্মও। তার মাথার কমিউনিকেশন ব্যান্ডের প্রতিটি নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তার বর্ম তাকে আটকে রাখে নিজের খোলসের মধ্যে।

আরও কয়েক পা এগিয়ে আসে দীর্ঘদেহী, নিচু হয়ে দুই হাতে চেপে ধরে রোহিণী আর হিমাংশুর এক একটি গোড়ালি।

দু-জনেরই হেলমেটের পেছনে ঝলসে ওঠে এক অতি উজ্জ্বল আলো, তার দ্যুতিতে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পরে দু-জনেই।

দু-জনের গোড়ালি ধরে দীর্ঘদেহী পা রাখে হাওয়ায় ভাসতে থাকে বৃত্তের মাঝখানে, দু-জনকেই টানতে টানতে হারিয়ে যায় বৃত্তের অন্তরালে।

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিন—গুপ্তগুহা

ঘোরলাগা ভাবটা কেটেও যেন কাটে না রোহিণীর, চোখের পাতাদুটো অসম্ভব ভারী লাগে তার।

‘ঘুম ভাঙল রোহিণী?’

কাছাকাছি কোথাও থেকে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর। সুরেলা অথচ গম্ভীর। স্যাক্সোফোনের মতো।

চমকে ওঠে চোখ খোলে রোহিণী। এ কণ্ঠস্বর তার চেনা! এ তো পথিকের কণ্ঠ।

আবার প্রশ্ন করে সুরেলা কণ্ঠ, ‘ঘুম ভাঙল রোহিণী?’

এবার ঘোর পুরোটাই কেটে যায় রোহিণীর। সে বুঝতে পারে সে বসে রয়েছে একটা আলো-আঁধারি জায়গায়। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে একটু আগে দেখা সেই দীর্ঘদেহী। সর্বাঙ্গ ঢাকা জোব্বায়, মুখ লুকানো মুখোশের আড়ালে।

পথিক! পথিককে বন্দী করতে এসে সে নিজেই বন্দী পথিকের হাতে!

দূরে কোথাও থেকে জল পড়ার শব্দ আসে। একটা ঠান্ডা ভিজে হাওয়া এসে লাগে রোহিণীর মুখে, সে বুঝতে পারে তার ফেসপ্লেট খোলা।

আঙুল তুলে একদিকে দেখায় পথিক, ‘দেখো তো হিমাংশু উঠল কি না?’

মাথা ঘোরায় রোহিণী। একপাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসা কৃস্টালের বর্ম মোড়া একটা শরীর, মাথাটা তার ঝুঁকে বুকের ওপর।

নিজের অজান্তে সজোরে একটা নিঃশ্বাস টানে রোহিণী, ‘স্বরাজ!’

মাথা নাড়ে পথিক, ‘এখানে স্বরাট, স্বরাজ কেউ নেই। আছে শুধু হিমাংশু আর রোহিণী।’

মাথা তুলে তাকায় হিমাংশু। মাথা ঘুরিয়ে পালাক্রমে তাকায় পথিক আর রোহিণী দু-জনেরই দিকে। দু-চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে হিমাংশুর, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সে, কিন্তু না পেরে ফের বসে পড়ে।

হিমাংশুর দিকে তাকায় পথিক, ‘এখনি উঠতে যেও না। পড়ে যাবে। স্বাভাবিক

হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।’

‘আমরা কোথায়?’ হিমাংশুর নিজের কানেই তার নিজের কণ্ঠস্বর কেমন কর্কশ লাগে।

‘তুহিনেই আছ, তবে হিমেলগাঁও থেকে অনেক দূরে। মাটির নিচে।’

একটা মৃদু ইশারা করে পথিক, চারপাশটা হঠাৎ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

বিস্ময়ের একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে আসে হিমাংশুর গলা থেকে। পথিকের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে দেওয়ালের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। তার দেখাদেখি উঠে দাঁড়ায় রোহিণীও।

উজ্জ্বল আলোতে রোহিণী দেখতে পায় তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা বিরাট গুহার এক প্রান্তে। সে গুহা এত বিশাল যে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তার ছাদ, কেবল ধোঁয়ার মতো দেখা যায় গুহার বাকি অংশ।

তবে যতটুকু দেখা যায়, সেখানে চোখে পড়ে পরের পর সারি দিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল আকৃতির সব দানবিক যন্ত্র, তাদের অতিকায় কীটের মতো আকারে স্পষ্ট যে তাদের নির্মাণ কোনও মানুষের হাতে হয়নি।

বিস্ময়ের আওয়াজ বেরিয়ে আসে এবার রোহিণীর কণ্ঠ থেকে, ‘এটা কোন জায়গা? তুমিই বা কে?’

‘কোন প্রশ্নটার জবাব আগে দেব রোহিণী?’ পথিকের স্যাক্সোফোনের মতো কণ্ঠস্বরে মনে হয় কৌতুকের ছোঁয়া লাগে।

উত্তরে দেয় না রোহিণী, বরং ফের প্রশ্ন করে, ‘তুমি আমার নাম জানলে কী করে?’

কৌতুকের ছোঁয়াটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে পথিকের কণ্ঠস্বরে, ‘শুধু নাম কেন, তোমার সব কথাই জানি। তুমি রোহিণী বিসমার্ক, মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে সরকারি হোমে মানুষ। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী, খেলাধুলোতেও তেমনি তুখোড়। ক্যাডেট স্কুলের গোল্ড মেডালিস্ট। সবচেয়ে কম বয়সে মানোয়ারের কম্যান্ড। ভালোবাসো কফি খেতে, বিশেষত মিলিটারি হেড কোয়ার্টারের টেরাসে দাঁড়িয়ে।’

রোহিণীর মনে হয় সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। গুহার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কোনওমতে টাল সামলায় সে।

হিমাংশুর দিকে ফেরে পথিক। কৌতুক আরও কয়েক মাত্রা বৃদ্ধি পায় তার কণ্ঠে, ‘শুধু তুমি কেন? হিমাংশুর ব্যাপারেও সব জানি। হিমাংশু প্লুটার্ক, অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে রোজগারের প্রয়োজনে মিলিটারিতে যোগ দাও তুমি। শুধু নিজের দক্ষতার জেরে পদোন্নতি পেয়ে বংশমর্যাদা থাকা না সত্ত্বেও ট্রিবিউন হয়ে ওঠো। কাজের চাপে সংসার করা হয়ে ওঠেনি, বছরখানেক আগে মাকেও হারিয়ে আপাতত মিলিটারিই একমাত্র জীবন। কি ঠিক বলেছি?’

‘এ সব কথা তুমি জানলে কী করে? কে তুমি?’

‘প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দিতে কিছুটা সময় লাগবে। দ্বিতীয়টার উত্তর সোজা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না।’

কয়েক পা এগিয়ে আসে পথিক। এক ঝটকায় মাথা থেকে সরিয়ে দেয় জোব্বার ঢাকা, মুখ থেকে খুলে নেয় মুখোশ।

এবার আর টাল রাখতে পারে না রোহিণী, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে মাটিতে।

হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে হিমাংশুও। তার দু-চোখ বিস্ফারিত, চোয়াল নেমে এসেছে বিস্ময়ে।

সামনে যে দাঁড়িয়ে তার কৃষ্ণকালো মুখে নাক আর চিবুক যেন বাটালি দিয়ে খোদাই করা, ভ্রমরকালো দুই চোখের ওপরের কপালে উজ্জ্বল লাল টিপ, মাথার কালো চুলে দু-একটা রুপোলি দাগ।

স্বরাজ বা স্বরাটে এমন কেউ নেই, যে ওই মুখ চেনে না।

লোকমাতা অনন্তা।

‘অসম্ভব! অসম্ভব!’

শব্দগুলো যেন ঘষটে বেরিয়ে আসে বেরিয়ে আসে হিমাংশুর কণ্ঠ থেকে।

কালো মেঘের বুকে বিদ্যুৎ খেলে যাওয়ার মতোই হাসি ছড়িয়ে যায় লোকমাতার মুখে, ‘বলেছিলাম না! বিশ্বাস করতে চাইবে না!’

রোহিণী খেয়াল করে মুখোশের সঙ্গে উধাও হয়েছে সেই সুরেলা কণ্ঠস্বর, তার জায়গা নিয়েছে স্বাভাবিক নারীকণ্ঠ। কিন্তু কী অসীম মমতা মাখানো সে কণ্ঠস্বরে।

মাথা ঝাঁকায় রোহিণী, ‘বিশ্বাস করি না! এ নিশ্চয়ই স্বরাজের কোন চাল!’

ফের হাসেন অনন্তা, ‘স্বরাজের চাল হলে, হিমাংশুকে কি পাঠানো হত আমাকে বন্দী করার জন্য? আর স্বরাটের চাল হলে তুমিও নিশ্চয়ই আসতে না?’

তবুও মাথা ঝাঁকায় রোহিণী, নিজের মনে ‘অসম্ভব’, ‘অসম্ভব’ বলে বিড়বিড় করতে থাকে।

হাসি লেগে থাকে লোকমাতার মুখে, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা তোমরা আমার হাতে পড়ার পর কী ঘটছে চলো একবার দেখে আসি।’

হাতের সামান্য ইঙ্গিত করেন লোকমাতা। বিস্ময়ের অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে রোহিণী আর হিমাংশু দু-জনেরই কণ্ঠ থেকে।

মিলিয়ে গেছে গুহার অভ্যন্তর আর অদ্ভুত যন্ত্রের সারি। প্রকৃতির নিয়ম অগ্রাহ্য করে তারা ভাসছে মহাকাশে, নিচে ঝকঝক করে তুহিনের বরফে মোড়া চেহারা।

তুহিনের কক্ষপথে ভাসতে থাকা একটা বিশাল মানোয়ারের দিকে আঙুল তোলেন অনন্তা, ‘এটা কোন জাহাজ রোহিণী?’

‘শৈল-দলন! ভোল্কসফুয়েরার হিরন্ময় রোমেলের নিজের জাহাজ!’ বিস্ময়ে প্রায় বুজে আসে রোহিণীর গলা। চাপা স্বরে উত্তর দেয় সে।

‘আর ওইটা?’ শৈল-দলনের কিছুটা দূরে ভাসতে থাকা একটা স্তবক-যানের দিকে ইঙ্গিত করেন অনন্তা।

বিস্মিত হওয়ার পালা এবার হিমাংশুর, ‘দীপ্ত-অগ্নি। কন্সাল মৃণাল আগ্রিপ্পার জাহাজ।’

মৃদু ইশারা করেন অনন্তা। মিলিয়ে যায় মহাকাশ, মিলিয়ে যায় তুহিন, হিমাংশু আর রোহিণী খেয়াল করে তারা বসে রয়েছে সেই বিশাল গুহার অভ্যন্তরেই।

দু-জনের মুখোমুখি মাটিতে বসেন অনন্তা।

‘যতই পথিকের ছদ্মবেশ ধরি, আর যতই কণ্ঠস্বরের আওয়াজ পালটাই না কেন, তোমাদের শাসকদের আমার পরিচয় অজানা নেই। আমাকে বন্দী করতে তাই দু-পক্ষেরই সর্বোচ্চ অধিনায়ক সশরীরে হাজির লড়াইয়ের ময়দানে। তোমরা দু-জনে ছিলে দাবার বোড়ে, কেবল আমার ক্ষমতার সীমানা বোঝার জন্য

ব্যবহার করা হয়েছে তোমাদের।’

বিস্মিত দৃষ্টিতে অনন্তার দিকে তাকিয়ে থাকে রোহিণী আর হিমাংশু দু-জনেই। কাছাকাছি কোথা থেকে ভেসে আসে জল পড়ার শব্দ, ভিজে হাওয়া বয়ে আনে জলজ গুল্মের ভারী গন্ধ।

কৃস্টালের বর্মে ঢাকা হাতদুটো মুঠো করে হিমাংশু, ‘কয়েকশো বছর ধরে দুই গ্রহের মানুষ জানে আপনি মৃত—’

ঈষৎ সামনের দিকে মাথাটা ঝোঁকান অনন্তা, ‘আমি মৃতই ছিলাম। যাদের পৃথিবী থেকে অর্কের গ্রহমণ্ডলী অবধি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, তাদের পৃথিবীর মানুষের মতনই দলাদলি করতে দেখে অভিমান চেপে রাখতে পারিনি। সবাইকে ছেড়ে একা থাকার ইচ্ছে নিয়ে উড়ে এসেছিলাম তুহিনে। কিন্তু তুষার ঝড়ের আমার যান আছড়ে ফেলল মাটিতে।’

‘তবে?’

‘তারপর একদিন জেগে উঠলাম এখানে।’

অনন্তার মুখের দিকে তাকায় রোহিণী, ‘কিন্তু কীভাবে?’

উঠে দাঁড়ান অনন্তা, বাড়িয়ে দেন হাতটা, ‘বলছি। এসো।’

গুহার মধ্যে বিকট আকারের যন্ত্রের পাশ দিয়ে হাঁটেন অনন্তা। তাঁকে অনুসরণ করে হিমাংশু আর রোহিণী, তাদের চলার সঙ্গে তাল রেখে উজ্জ্বল হতে থাকে গুহার আলো।

কিছুদুর গিয়ে থামেন অনন্তা। জোর হয় জল পড়ার আওয়াজটা, আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আলো।

জলের আওয়াজের দিকে তাকায় হিমাংশু, গুহার ওপরের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার থেকে নেমে এসেছে একটা বিশাল থাম, থামের একপাশ থেকে ঝরনার মতো জল ঝরে পড়ে গুহার মেঝেতে একটা জলের কুণ্ডে। ভিজে থামের গায়ে জমেছে পুরু শ্যাওলার স্তর, গা বেয়ে জড়িয়ে উঠেছে জলজ গুল্ম।

থামের পাশ দিয়ে পড়তে থাকা ঝর্ণার দিকে তাকান অনন্তা, ‘এই থামটা ওপরে শেষ হয়েছে একটা গ্লেসিয়ারের নিচে। আমার যান ভেঙে পড়ার আগে আমি সিটের ইজেক্ট সুইচ টিপেছিলাম মনে আছে। ছিটকে গিয়েছিলাম ডিগবাজি খেতে থাকা যান থেকে অনেকটা দূরে। কিন্তু প্যারাশুট খোলেনি। তুহিনের তুষার ঝড় তার মুঠোয় ধরে আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছিল এই গ্লেসিয়ারের ফাটলে। মরেই হয়তো যেতাম। কিন্তু—’

একটা ঝপাং করে শব্দ হয়। পাথরের থামে জড়ানো গুল্মের পেছন থেকে কিছু একটা লাফিয়ে পড়ে জলে। ছিটকে যায় কুণ্ডের জল, সচকিত হয়ে এক পা পেছনে সরে যায় হিমাংশু।

কুণ্ডের জল থেকে গা ঝাড়া দিয়ে গুহার পাথুরে মেঝেতে উঠে এসে দাঁড়ায় একটা অদ্ভুত একটা সরীসৃপের মতো জীব। দৈর্ঘ্যে ফুট দেড়েকের বেশি হবে না, শরীরের ভর তার রাখা পেছনের দু-পা আর তাদের মাঝের মোটা ল্যাজের ওপর, সামনের পা দুটো সরু আর ছোট।

কিন্তু সরীসৃপের সঙ্গে তার সাদৃশ্য সেখানেই শেষ।

হিমাংশু খেয়াল করে তার সামনের পায়ে নখের বদলে রয়েছে মানুষের মতো হাত।

আর লম্বাটে ঘাড়ের ওপর বসানো আখরোটের মতো মাথাটা সরীসৃপের নয়, মানুষের মতো দেখতে।

অদ্ভুত জীবটার দিকে নির্দেশ করেন অনন্তা, ‘মারাই গিয়েছিলাম। কিন্তু বাঁচিয়ে তুলল এরা।’

একই রকম দেখতে আরও কয়েকটা জীব জল থেকে উঠে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ায় প্রথমটার পাশে। আলো পড়ে চকচক করে তাদের রঙিন গাত্রবর্ণ।

‘এরা কী?’ অদ্ভুত জীবগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রোহিণী।

উত্তর না দিয়ে হাতের মৃদু ইশারা করেন অনন্তা।

আশ্চর্য হয়ে রোহিণী আর হিমাংশু দেখে তাদের মাথার ওপরের নীল আকাশে ঝকঝক করে একজোড়া সূর্য। তাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে নানা রঙের বিচিত্র বর্ণ আর গড়নের উদ্ভিদে ঢাকা মাঠ। মুখে রোদের উষ্ণতা টের পায় হিমাংশু, অজানা ফুলের সুবাস মাখা বাতাস নিঃশ্বাসে টেনে নেয় রোহিণী।

অনেকটা দূরে মাঠের মধ্যে মাথা তুলেছে এক বিচিত্র শহর, যেন নানা রঙের আর আকারের স্ফটিক খোদাই করে গড়া হয়েছে।

দূরের শহরটার দিকে আঙুল তোলেন অনন্তা, ‘যা দেখছ তা কেবল স্মৃতি। কালের নিয়ম মেনে এই গ্রহ আর ওই শহর ধুলোয় মিশে গেছে লক্ষ লক্ষ বছর আগে। যারা এই শহর বানিয়েছিল, লক্ষ লক্ষ বছর আগে ছায়াপথ জুড়ে ছিল তাদের উপস্থিতি।’

‘কারা ছিল তারা?’ প্রশ্ন করে হিমাংশু।

‘তারা নিজেদের যে নামে ডাকতো, আমাদের ভাষায় অনুবাদ করলে তার মানে দাঁড়ায় সৃষ্টিকর্মা।’

‘বিচিত্র নাম।’ দূরের স্ফটিকে গড়া শহরের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করে রোহিণী।

ঘাড় নেড়ে সায় দেন অনন্তা, ‘হ্যাঁ। কিন্তু ও নামের একটা কারণ ছিল। ও শহর যারা গড়েছিল, জাতিগত ভাবে সেই প্রজাতির একমাত্র নেশা ছিল সৃষ্টি করা।’

‘সৃষ্টি করা! কী সৃষ্টি?’ স্ফটিক শহরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে হিমাংশু।

কোন জাদুবলে যেন তারা চলে এসেছে স্ফটিক শহরের ভেতরে। তার রঙিন অনচ্ছ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনন্তা হাত ছড়িয়ে দেন দু-পাশে, ‘যা তাদের খেয়াল খুশি। স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, শহর, গ্রহ, প্রাণ!’

নিঃস্তব্ধ রাস্তায় প্রতিধ্বনি হয় চলার শব্দের। দু-পাশের উঁচু স্ফটিকের বাড়িতে আলোর রঙিন আলপনা থেকে চোখ সরায় হিমাংশু, ‘প্রাণ? তারা প্রাণেরও সৃষ্টি করত?’

রাস্তা মিশেছে একটা বিশাল চত্বরে। তার কেন্দ্রে একটা স্ফটিকের ফোয়ারা থেকে স্ফটিকের মতো জল গড়িয়ে পড়ে। ফোয়ারার পাড়ে বসেন অনন্তা, একটা হাত আলতো করে ডুবিয়ে দেন জলে।

‘হ্যাঁ প্রাণ। তাদের নির্মাণ কাজে সাহায্য করার জন্য সৃষ্টিকর্মারা জন্ম দিয়েছিল এক নতুন প্রজাতির, যারা জন্ম থেকেই নির্মাণকর্মী।’

হঠাৎ ফাঁকা চত্বর ভরে যায় গুহার জলকুণ্ডে দেখা সেই অদ্ভুত জীবেদের ভিড়ে। তফাত কেবল তাদের আয়তনে। গুহায় দেখা জীবগুলো ছিল দৈর্ঘ্যে ফুট দেড়েক মাত্র। আর এখানে তাদের আয়তনে বহু বৈচিত্র, হাতখানেক লম্বা থেকে পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া ডাইনোসরের মতো বিশালদেহী, কোনও আয়তনই বাদ নেই।

মাথা তুলে ইঙ্গিত করেন অনন্তা, ‘কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী এই নির্মাণ

কর্মীদের দেহের আয়তন বাড়ে কমে। সৃষ্টিকর্মারা এদের নাম রেখেছিল ময়।’

সরীসৃপের আকারের ময়দের দিকে তাকায় রোহিণী, ফোয়ারার জলের ভিজে ঝাপটা লাগে তার মুখে, ‘কোথায় গেল সেই সৃষ্টিকর্মারা?’

মৃদু মাথা নাড়েন অনন্তা, ‘জানি না। হয়তো কালের নিয়মে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিংবা বিবর্তনে পাওয়া শরীরের মায়া কাটিয়ে রূপ নিয়েছে শুদ্ধ চৈতন্যের। কিন্তু তারা চলে গেলেও ছায়াপথের নানান জায়গায় রয়ে গেছে তাদের নির্মাণ কর্মীরা।’

একটা কাঁপুনি দিয়ে মিলিয়ে যায় স্ফটিক নগর। হিমাংশু আর রোহিণী খেয়াল করে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তুহিনের গুহার জলকুণ্ডের ধারে।

জলের পাশে দাঁড়ানো ময়দের দিকে নির্দেশ করেন অনন্তা, ‘এ গুহা বহুযুগ আগে ছিল সৃষ্টিকর্মাদের যন্ত্রশালা। আমার মৃতপ্রায় শরীরটাকে এরা নামিয়ে আনে এখানে, শুরু করে তাকে আবার জোড়া লাগানোর কাজ।’

পাখির সুরের মতো সুরেলা শব্দে সায় দিয়ে ওঠে একটি ময়। নিচু হয়ে তার মাথায় একটা আঙুল বুলিয়ে দেন অনন্ত।

‘এদের চেষ্টায় আমি ফের জেগে উঠলাম বটে। কিন্তু ততদিনে পেরিয়ে গেছে কয়েকশো বছর। চেতনা পেয়ে দেখলাম পালটে গেছে আমার চেনা জগৎটা। পৃথিবী থেকে আমার সঙ্গে যারা এসেছিল, তাদের বংশধররা আজ পরস্পরের শত্রু।’

ভুরু কপালে তোলে হিমাংশু, ‘মেনেও যদি নিই, আপনাকে এরা পুনরুর্জ্জীবিত করে তুলেছে, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ কাজ করতে কয়েকশো বছর লাগল কেন?’

বিদ্যুতের মতো উজ্জ্বল হাসিটা ফের ছড়িয়ে যায় অনন্তার মুখে, ‘কারণ ওদের মনে হয়েছিল আমি অপূর্ণ। তাই শুধু আমার জীবনটুকু ফেরত দিয়ে ক্ষান্ত থাকতে চায়নি ওরা। তিলতিল করে আমাকে গড়ে তুলেছে ওদের হারিয়ে যাওয়া সৃষ্টিকর্তাদের মতো শক্তিমান করে। কাজটা সহজ ছিল না।’

ফের ডেকে ওঠে ময়রা। তাদের সুরেলা আওয়াজে মেশে জল পড়ার শব্দ। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রোহিণী আর হিমাংশু।

‘কয়েকশো বছর বাদে যখন আমি চোখ মেললাম, তখন আমি আর কেবল

অনন্তা নেই। তার চাইতেও অনেক বেশি কিছু।’

আবার হাসেন অনন্তা, ‘তার কিছুটা বোধহয় টেরও পেয়েছ তোমরা। তোমাদের জাহাজ দুটোকে নিরস্ত্র করে দেওয়া, তোমাদের বর্ম নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া, এসব ওই নতুন অর্জিত শক্তির জোরেই।’

অনন্তার হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে রোহিণী। তার কেমন মনে হতে থাকে, ও হাসিতে উপহাস নেই, শক্তির দম্ভ নেই, আছে কেবল অদ্ভুত মমত্ববোধ। চোখের কোণটা কেমন ভিজে ওঠে তার, ‘কিন্তু মাতা। আপনি ফেরত আসতে চান না কেন? স্বরাটের মানুষ আপনাকে তো আজও শ্রদ্ধা করে।’

রোহিণীর চোখে চোখ রাখেন অনন্তা, ‘কারণ স্বরাট হোক বা স্বরাজ, তোমাদের প্রভুরা আমাকে ব্যবহার করতে চাইবে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তারের স্বার্থে। আমাকে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে আমার আড়াল থেকে নিরঙ্কুশ করতে চাইবে নিজের আধিপত্য।’

হিমাংশু কিছু বলতে যায়, কিন্তু তার আগেই হাত তুলে বাধা দেন অনন্তা, ‘পরে শুনব। কিন্তু এখন কাজ আছে। হিমেলগাঁওয়ের বাইরে ফের মুখোমুখি হতে চলেছে স্বরাজ আর স্বরাটের ফৌজ। তাদের মাঝখান থেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিতে হবে হিমেলগাঁওয়ের বাসিন্দাদের। আর পারলে আটকে দিতে হবে দু-পক্ষের লড়াই।’

একটা আঙুল তোলেন অনন্তা। তাঁর আঙুলের ডগা থেকে হাওয়ায় ছড়িয়ে যেতে থাকে বৃত্তের পর বৃত্ত। যেমনটা দেখায় জলে পাথরের টুকরো পড়লে।

বৃত্তের ভেতরে পা রাখেন অনন্তা, হাত বাড়িয়ে দেন হিমাংশু আর রোহিণীর দিকে, ‘এসো।’

আগমাব্দ ৩৭৩, তুহিন—হিমেলগাঁও

অনন্তাকে অনুসরণ করে হাওয়ার বৃত্তের মধ্যে দিয়ে হিমেলগাঁওয়ের বাইরে পা রাখে রোহিণী আর হিমাংশু। উজ্জ্বল তুষারের ওপর পড়ে অর্কের উজ্জ্বল আলো, আর তার মধ্যে আরও কুৎসিত লাগে টুকরো-টাকরা দিয়ে বানানো বাঁকাচোরা কুঁড়েঘরগুলো। প্রতিকূল আবহাওয়ায় অনটনের জীবনযাপনের নিত্য সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে বরফ-শীতল বাতাস তাদের সারির মধ্যে দিয়ে বয়ে আনে নানা অপ্রিয় গন্ধ।

নাক কুঁচকোয় রোহিণী, ‘মাতা, শুনেছি এখানে সমস্ত চোর-জোচ্চরের বাস।’

রোহিণীর দিকে তাকান অনন্তা। হিমাংশু খেয়াল করে তাঁর মাথা ঢেকেছে জোব্বায়, মুখ চাপা পড়ে গেছে পথিকের মুখোশে, ‘চোর-জোচ্চোর? তা হয়তো কয়েকজন থাকতে পারে। স্বরাজ বা স্বরাটে নেই? কিন্তু এখানে যারা আছে তাদের বেশির ভাগই সেইসব মানুষ যাদের তোমাদের সমাজ বর্জ্য বলে মনে করে। তোমাদের সমাজের ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিয়েছে এখানে।’

কুঁড়েঘরের সারির মধ্যে দিয়ে হাঁটেন অনন্তা। পায়ের নিচে খচখচ আওয়াজ করে ঘোলাটে কাদালাগা বরফ। তাকে দেখে এগিয়ে আসে কয়েকজন। পরনে শতচ্ছিন্ন পোশাক, মুখে ময়লার ছোপ। তাদেরই একজনকে হাত তুলে ডাকেন অনন্তা, ‘পরেশ, সবাইকে খবর দাও, তোমাদের কয়েকদিনের জন্য হিমেলগাঁও ছেড়ে চলে যেতে হবে।’

পরেশের চোখের কোণে বলিরেখার আঁচড়, মাথার উসকোখুসকো চুলগুলো সব সাদা।

‘কেন পথিক?’

তুহিনের নির্মেঘ আকাশে হঠাৎ শুরু হয় গর্জন। মুখ তুলে দেখে সবাই। নজরে পড়ে হিমেলগাঁওয়ের দু-দিকে আকাশ দিয়ে নেমে আসছে উল্কার সারি।

বুঝতে অসুবিধে হয় না রোহিণী আর হিমাংশুর। স্বরাট আর স্বরাজ তুহিনের

বুকে তাদের ফৌজ নামাচ্ছে।

আকাশের দিকে আঙুল তোলেন অনন্তা, ‘স্বরাট আর স্বরাজ এখানে পরস্পরের সঙ্গে মাতবে যুদ্ধে। এখানে থাকলে তোমরা পড়ে যাবে তাদের লড়াইয়ের মধ্যে। দু-পক্ষই তোমাদের রেয়াত করবে না।’

‘কিন্তু কোথায় যাব পথিক?’

হাত তুলে হিমেলগাঁওয়ের বাইরের দিকে নির্দেশ করেন অনন্তা, ‘ওইখানে বরফের নিচে একটা গুহা আছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তুমি সবাইকে হিমেলগাঁওয়ের বাইরে জড়ো করো, আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।’

হিমেলগাঁওয়ের ভেতরে দিকে দৌড়ে যায় পরেশ, চিৎকার করে ডাকতে থাকে লোকজনকে।

তুহিনের পাণ্ডুর আকাশের দিকে তাকায় হিমাংশু, ‘ইতিহাসের বিদ্রূপ! লোকমাতাকে বন্দী করতে স্বরাজ আর স্বরাট মুখোমুখি।’

লম্বা পায়ে হিমেলগাঁওয়ের কাদামাখা তুষারের ওপর দিয়ে হাঁটেন অনন্তা, ‘ইতিহাস! না দোষ ইতিহাসের নয়। দোষ তাদের, যারা বর্তমানের চাইতে ইতিহাসকে বেশি গুরুত্ব দেয়।’

অনন্তার পায়ে পা মেলায় রোহিণী, ‘ইতিহাসকে কি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয় মাতা? ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতে আমরা কি একই ভুল করব না?’

হিমেলগাঁওয়ের জীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন কুঁড়ের সারির মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকেন অনন্তা। মাথার ওপরের পাণ্ডুর আকাশে উল্কার মতো নেমে আসতে থাকে স্বরাট আর স্বরাজের ফৌজ।

‘শিক্ষা আর শৃঙ্খল এক নয় রোহিণী। নিজেদের পরিচয়ের ভিত কেবল ইতিহাসের ওপর দাঁড় করালে সে ইতিহাসের সংঘাতের অংশও অবধারিত ভাবে সঙ্গী হয়ে পড়ে।’

‘আমাদের ইতিহাস কি আমাদের পরিচয় নয়?’ বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে হিমাংশু।

হিমেলগাঁওয়ের মাঝখানে কুঁড়েঘরগুলো কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে। তাদের ফাঁকে মাথা তুলেছে লোকমাতার কালো পাথরে গড়া মূর্তি। তার নিচে

কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ান অনন্তা।

‘ইতিহাসের বাইরেও যে মানুষের একটা পরিচয় থাকে সে কথা স্বরাজ আর স্বরাট, দু-পক্ষই ভুলে গেছে হিমাংশু। যে পরিচয়ে মানুষ প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, যে পরিচয়ে মানুষ মানুষের মুখের মাধুরী খুঁজে পায়, ইতিহাসের দাস হয়ে সে পরিচয় যেন দু-পক্ষই হারিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে গিয়ে সে ইতিহাসের শেকল জড়িয়ে ফেলেছে নিজেদের সর্বাঙ্গে।’

রোহিণী খেয়াল করে নির্মেঘ আকাশ থেকে মুছে গেছে উল্কার দাগ। যার অর্থ হিমেলগাঁওয়ের দু-পাশে এবার লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে দু-পক্ষ।

ভাঙাচোরা বাসন, দড়িতে টাঙানো শতচ্ছিন্ন পোশাক, জঞ্জালের স্তূপ, হিমেলগাঁওয়ের প্রান্তিক জীবনযাত্রার সদ্য পরিত্যক্ত নিদর্শনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকেন অনন্তা।

‘পৃথিবীর মানুষ কেমন সমাজ গড়ে তুলেছিল জানো? ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, অনুভব করা যায়, এমন প্রত্যক্ষ কিছু দিয়ে নয়, সে সমাজের অবয়ব গড়া ছিল যেন নানান বিমূর্ত উপাদানে। তার কোনওটা সরকারী নিয়মকানুনের গোলকধাঁধা, কোনওটা যান্ত্রিক জীবনের ঊষর প্রান্তর, কোনওটা আপোসহীন মতাদর্শের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর, আবার কোনওটা বা কাল্পনিক পরিত্রাতায় ভরসা রাখা অন্ধ বিশ্বাসের কানাগলি।’

অনন্তার মুখ ঢাকা পথিকের মুখোশে, তাঁর নিজের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেছে স্যাক্সোফোনের মতো মধুর গম্ভীর আওয়াজে, তবু যেন তাঁর কথায় একটা দুঃখের রেশ পায় হিমাংশু আর রোহিণী দু-জনেই।

‘স্বরাট আর স্বরাজে আমরা নতুন, সম্পূর্ণ আলাদা এক সমাজ গড়তে পারতাম। কিন্তু ইতিহাসের শৃঙ্খল আমাদের টেনে নিয়ে গেল পেছনে, বাধ্য করল পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে।’

শেষ হয়ে যায় হিমেলগাঁওয়ের কুঁড়ের সারি। তুহিনের পাণ্ডুর আকাশের নিচে উজ্জ্বল তুষার প্রান্তর ঝকঝক করে অর্কের আলোয়। তার ওপর শতচ্ছিন্ন পোশাক গায়ে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে মানুষের ভিড়।

দাঁড়িয়ে পড়ে তাদের দিকে তাকান অনন্তা, তারপর ফেরেন রোহিণী আর

হিমাংশুর দিকে।

‘যারা তোমাদের সমাজে বর্জ্য, পরিত্যক্ত, আমার পথ গেছে তাদের সঙ্গে। হিমেলগাঁওয়ের দু-দিকে স্বরাজ আর স্বরাটের ফৌজ আস্তানা গেঁড়েছে, সুতরাং তোমাদের পথ তোমরা বেছে নিতে পারো।’

ভিড় থেকে একটা ছোট মেয়ে এগিয়ে আসে। ঠান্ডায় পুড়ে যাওয়া গাল, ঠোঁট ফেটে জমে থাকা রক্ত, চোখের নিচে কালি। অবাক দৃষ্টিতে অনন্তার মুখোশ ঢাকা মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কে?’

দু-হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নেন অনন্তা, ‘তোর মা।’

শিশুটিকে কোলে তুলে তুষারের ওপর দিয়ে হাঁটেন অনন্তা। পেছনে হাঁটে ক্লিষ্ট মানুষের ভিড়। তুষারে পড়ে তাদের পায়ের চিহ্ন।

হিমাংশু আর রোহিণী দু-জনে নীরবে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকে হিমেলগাঁওয়ের দু-দিকে, যেখানে অপেক্ষা করে তাদের চেনা সমাজের স্বস্তি।

তারপর পা মেলায় ভিড়ের সঙ্গে।

.

প্রথম প্রকাশ: পরবাসিয়া পাঁচালী, জানুয়ারি ২০১৯

ঋণস্বীকার:

১। রবীন্দ্রনাথ: মহাকাশযানের নামগুলি রবীন্দ্রনাথের থেকে নেওয়া।

‘তব দীপ্ত-অগ্নি-শত-শতঘ্নী-বিঘ্নবিজয় পন্থ।

তব লৌহগলন শৈলদলন অচলচলন মন্ত্র॥’

২। অ্যালবার্ত কাম্যু: We live in terror because persuasion is no longer possible; because man has been wholly submerged in History; because he can no longer tap that part of his nature, as real as the historical part, which he recaptures in contemplating the beauty of nature and of human faces; because we live in a world of abstractions, of bureaus and machines, of absolute ideas and of crude messianism. We suffocate among people who think they are absolutely right, whether in their machines or in their ideas.

(Neither Victims nor Executioners/Albert Camus)

৩। রুসো: Man is born free and everywhere he is in chains. (The Social Contract/ Jean-Jacques Rousseau)

৪। ল্যাটিন প্রবাদ: Si vis pacem, para bellum—‘If you want peace, prepare for war’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *