যাত্রা হল শুরু

যাত্রা হল শুরু

‘The soup is too hot’— আইনস্টাইনের উচ্চারিত প্রথম বাক্য!

তখন তাঁর বয়েস চার।

অ্যালবার্টের যে মস্তিষ্ক বলে কিছু নেই, সে যে নেহাৎ বোকাহাঁদা, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না তাঁর বাবা-মায়ের। যে-ছেলের চার বছর বয়েস পর্যন্ত মুখে কথা ফোটেনি, তার দ্বারা কিছুই হওয়ার নয়, এ-ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল অ্যালবার্টের পরিবারে। এমন সময় চার বছরের অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মুখে পুরো একটি বাক্য— স্যুপটা বড্ড গরম!

অ্যালবার্ট কথা বলছে! তাও আবার পুরো একটা বাক্য!

অ্যাদ্দিন কথা বলিসনি কেন? মা জিজ্ঞেস করলেন অ্যালবার্টকে।

অ্যালবার্ট তখুনি উত্তর দিল, সবকিছুই তো বেশ মনের মতো। অপছন্দের মতো কিছু ঘটলে তো জানাব। তাই কথা বলিনি। Because upto now, everything has been fine, এই ছিল অ্যালবার্টের ক্ষুদে উত্তর।

ছোট্ট অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কথা বলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আর-এক বিপদ।

তার মুখে শুধু অনর্গল প্রশ্ন। সে শুধু জানতে চায়। অন্য বাচ্চারাও তো জানতে চায়। প্রশ্ন করে। কিন্তু অ্যালবার্টের প্রশ্ন অন্যরকম। বড়রা দিশেহারা, কখনও কখনও নার্ভাস তার প্রশ্নের সামনে।

অ্যালবার্টের বাবা-কাকার ছোট্ট একটা ব্যাবসা ছিল। তারা ব্যাটারি, জেনারেটর, ইলেকট্রিকের তার— এইসব বিক্রি করতেন। ছোট্ট অ্যালবার্ট ভাবতে শুরু করল ইলেকট্রিসিটি নিয়ে। যতই সে ভাবে ততই সে অবাক হয়। আর তার মনের মধ্যে উদয় হয় নানা প্রশ্নের।

অ্যালবার্টের বিস্ময়ের কারণ কী?

ইলেকট্রিসিটি তো দেখা যায় না, অদৃশ্য। তাও তার কী শক্তি আর কী বিপজ্জনক এই শক্তি! Invisible, powerful and dangerous, অদৃশ্য, ক্ষমতাবান, বিপজ্জনক— অবাক হব না? বলল অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

কিন্তু শুধু অবাক হয়ে থেমে থাকল না অ্যালবার্ট।

বাবা-কাকাকে প্রশ্নবানে অহরহ বিদ্ধ করতে লাগল।

ইলেকট্রিসিটির গল্পটা তার কাছে রহস্যের গল্পের মতো।

সে জানতে চায় বিদ্যুতের প্রাণের কথা, তার উত্সের ব্যাপার। রহস্যের অন্তরে ঢুকতে চায় সে।

বাবার কাছে ছোট্ট অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম প্রশ্ন— How fast is electricity? বিদ্যুৎ কত দ্রুত?

তারপর আরও এক প্রশ্ন, আচ্ছা বাবা, ইলেকট্রিসিটিকে কখনওই কি দেখা যায় না? কোনও উপায় নেই দেখার?

আর একদিন কাকার কাছে জানতে চাইল অ্যালবার্ট— ইলেকট্রিসিটি কী দিয়ে তৈরি?

তারপর একদিন সে এই মোক্ষম প্রশ্নটি করল তার বাবাকে— Just like there’s electricity, could there be other strange forces in the universe? এই জগতে ইলেকট্রিসিটির মতো আরও অন্যসব রহস্যজনক শক্তিও আছে, তাই না? ছোট্ট অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে নানা রকম কল্পনা করতে শুরু করল। এক একটি কল্পনা যেন এক একটি পাখি। কল্পনার ডানায় অসীম রহস্যের মধ্যে উড়ে চলে অ্যালবার্টের মন। অনেক বড় বয়সে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন লিখলেন—

Imagination is more important than knowledge. Knowledge is limited, imagination embrases the entire world.

জ্ঞানের চেয়ে বেশি জরুরি হল কল্পনা। জ্ঞান সীমাবদ্ধ। কল্পনা ঘিরে থাকে সারা বিশ্বলোককে!

আগেই বলেছি, অ্যালবার্টকে একটি কম্পাস কিনে দিয়েছিলেন তার বাবা।

অ্যালবার্ট তখন অসুস্থ। বাবা ভেবেছিলেন, কম্পাসটা নিয়ে অ্যালবার্ট শুয়ে শুয়ে নানারকম খেলা খেলতে খেলতে সময় কাটাবে। কিন্তু অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যে পরীক্ষানিরীক্ষা আর চিন্তা করার জন্যেই জন্মেছে।

সে প্রথমেই দেখল কম্পাসের কাঁটা সব সময় উত্তরমুখী। সে কম্পাসটাকে যে-দিকেই ঘোরায়, কাঁটা যায় উত্তরদিকে। হয়তো আলোর মধ্যে এমন হচ্ছে, অন্ধকারেও কি তাই হবে? অ্যালবার্ট দেখল, অন্ধকারেও তা-ই!

কম্পাসটাকে উপুড় করে দিল অ্যালবার্ট। তখনও সেই একই ব্যাপার! কেন এমন! বাবা কি উত্তর জানে?

বাবা, কেন কম্পাসের কাঁটা সবসময়ে উত্তর দিকে ঘুরে যাচ্ছে? প্রশ্ন করল অ্যালবার্ট।

বাবা উত্তর দিলেন খুব সহজ করে— Because the earth is like a big magnet, that’s always pulling on the compass’s magnetic needle.

অ্যালবার্টের বয়স তখন ঠিক পাঁচ। বাবা আর বেশি কিছু তাই বললেন না।

কিন্তু সেই বয়সেই অবাক অ্যালবার্ট— তা হলে কোনও এক রহস্যময় শক্তি সব সময়ে রয়েছে আমাকে ঘিরে! আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না। জানতে পাচ্ছি না। তবু এই শক্তিই কম্পাসের কাঁটাটাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে!

অনেক বছর পরে লিখলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—

I can still remember that this experience made a deep and lasting impression on me. Something deeply hidden had to be behind things.

কম্পাসের ঘটনাটা আমার আজও মনে আছে। ঘটনাটা আমার মনের ওপর গভীর এবং স্থায়ী দাগ কেটেছিল। আমার মনে হয়েছিল, সব কিছুর পিছনে অবশ্যই গভীরভাবে নিহিত আছে কোনও কিছু।

ছোট্ট আইনস্টাইন বেহালা বাজাতে শিখল। মা বাজাতেন পিয়ানো। আর মায়ের সঙ্গে অ্যালবার্ট বাজায় বেহালা।

হঠাৎ একদিন এক কাণ্ড ঘটল। বিদ্যুৎ চমকের মতো এই ভাবনাটি এল আইনস্টাইনের মনে— সে অনুভব করল, সংগীতের তারগুলি যেন সংখ্যার প্যাটার্ন!

অর্থাৎ অ্যালবার্টের মনের মধ্যে সংগীত আর গণিত একাকার হয়ে গেল।

সে মাকে তখুনি খুশি হয়ে জানাল, music is just like numbers!

কয়েক বছর কেটে গেছে। তখন সুইত্জারল্যান্ডে অ্যালবার্টের সঙ্গে বেড়াতে গেছে বোন মায়া। অ্যালবার্ট খুব ভালবাসে মায়াকে। ওরা দু’জনেই হেঁটে বেড়ায় একসঙ্গে। বনের পথে ঘুরে বেড়াতেই ওদের বেশি মজা।

খুড়তুতো ভাইবোনেরাও সঙ্গে থাকে। সবাই মিলে পাহাড়ে ওঠে। যত উঁচু পাহাড়, তত ভাল লাগে অ্যালবার্টের। উঁচু পাহাড়ে উঠলে আকাশের তারারা কত যেন কাছের! অ্যালবার্ট তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।

সে শুয়ে পড়ে পাহাড়ের ওপর, আর তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। ভাইবোনেরা বেড়াতে বেড়াতে দূরে চলে যায়। অ্যালবার্ট একা। সে ভাবে। কী ভাবে সে?

সে ভাবে আকাশের ওপারে আরও কোনও আকাশ আছে কি না?

কত বড় এই আকাশ?

আসলে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সেই আট-ন’বছর বয়েস থেকেও ভাবতে শুরু করে মহাশূন্যের কথা!

মহাশূন্যে যেতে গেলে কত দ্রুত যেতে হবে? How fast would somebody have to travel to get there? আচ্ছা, তারার আলো অতদূর থেকে কী করে আসে আমাদের চোখে? অ্যালবার্ট জিজ্ঞেস করে নিজেকে।

মহাশূন্যের কি কোনও শেষ আছে? না কি, মহাশূন্য সীমাহীন? এ-প্রশ্নও জাগে অ্যালবার্টের কচি মনে।

তারপর একদিন ছোট্ট আইনস্টাইন ভাবতে ভাবতে পৌঁছল এই প্রশ্নে— আমি কি আলোর রেখার ওপর চড়ে পাড়ি দিতে পারি মহাশূন্যে? আলোর আরোহী হওয়া কি সম্ভব? কিংবা সম্ভব কি আলোর সঙ্গে দৌড়ে পাল্লা দেওয়া? এখানেই শেষ নয়। আরও একটি প্রশ্ন অ্যালবার্টকে খুব ভাবায়— প্রশ্নটি হল, এই মহাজগতের চেয়েও বড় কিছু কি কোথাও আছে?

অ্যালবার্টের সময় বেশ ভালই কাটছিল যতদিন সে ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় বা এলিমেন্টারি স্কুলে। ছয় বছর বয়সে ভর্তি হয়েছিল সেখানে। তার নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেন মাস্টারমশাইরা। কিন্তু অ্যালবার্টের বয়েস নয় হতেই তাকে যেতে হল উচ্চ বিদ্যালয়ে।

জার্মান হাইস্কুলের নিয়মকানুন ভারী কড়া। ছাত্ররা শুধু পড়া মুখস্থ করবে আর মাস্টারমশাইদের কথা শুনে চলবে।

তারা নিজেরা ভাববে না, প্রশ্ন করবে না।

এইরকম স্কুলে কী করে খাপ খাইয়ে চলবে অ্যালবার্ট? অঙ্ক তার বিশেষ ভালবাসার বিষয়। গণিত নিয়ে তার নানা প্রশ্ন।

কিন্তু প্রশ্ন করলেই রেগে যান শিক্ষকরা। বাড়িতে অ্যালবার্টের অঙ্কের শিক্ষক তার কাকা। অ্যালজেব্রার নানা সমস্যা অ্যালবার্টকে তিনি দেন সমাধান করতে।

কাকা বিস্মিত— এই বয়সেই বীজগণিতের গূঢ় সমস্যার সমাধান করতে পারে অ্যালবার্ট?

বীজগণিতে কতরকমের ইকুয়েশনস! অ্যালবার্টের কাছে ইকুয়েশনস ধাঁধার মতো। খুব মজা পায় সে ইকুয়েশন সলভ করতে।

এই সময়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটল।

এখন যাওয়া যাক সেই গল্পে। এই গল্প ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে বুঝতে সাহায্য করবে।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জন্মেছিলেন ইহুদি পরিবারে। ইহুদি সংস্কৃতির একটি রেওয়াজ হল, প্রতি শুক্রবার নৈশভোজে কোনও ধর্মীয় স্কলার বা পণ্ডিতকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করা। আইনস্টাইনের পরিবার আমন্ত্রণ জানালেন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ছাত্র ম্যাক্স-কে। ম্যাক্স দশ বছরের অ্যালবার্টকে বিজ্ঞান, গণিত আর দর্শন শেখাতে শুরু করল। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন বই এনে দেয় ম্যাক্স। আর অ্যালবার্ট সেইসব বই গোগ্রাসে পড়ে ফেলে। অ্যারন বার্নস্টাইনের ‘The People’s Books on Natural Science’ দশ বছরের অ্যালবার্টের কল্পনাকে উস্কে দিল। সব থেকে বেশি অ্যালবার্টকে ভাবাল আলোর গতি।

আলোর সঙ্গে রেস করতে ঠিক কেমন লাগবে? অ্যালবার্টের কল্পনা আলোর সঙ্গে দৌড়য়।

এই সময়ে একদিন ম্যাক্স অ্যালবার্টকে উপহার দিল ইউক্লিডের জ্যামিতি!

রুদ্ধশ্বাস উদ্বেগের সঙ্গে জ্যামিতি পড়তে শুরু করল অ্যালবার্ট। কয়েক মাসের মধ্যে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির সব রহস্যের মধ্যে ঢুকতে পারল সে।

জ্যামিতিকে কেন এত ভালবাসল বারো বছরের অ্যালবার্ট? সে প্রশ্নের উত্তর আইনস্টাইন দিয়েছিলেন অনেক পরে এই ভাষায়—

I became more and more convinced that nature could be understood as a relatively simple mathematical structure. This lucidity and certainty made an indescribable impression upon me.

আমি এই বিশ্বাসে ক্রমশ দৃঢ়বদ্ধ হলাম যে, প্রকৃতিকে তুলনামূলক সহজ গাণিতিক আকারে বোঝা সম্ভব। এই স্বচ্ছতা এবং নিশ্চয়তা আমার মনে এক অবর্ণনীয় ছাপ রেখে যায়।

অনেক বছর পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে এসে বললেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—

If Euclid failed to kindle your youthful enthusiasm, then you were not born to be a scientific thinker.

ইউক্লিড যদি কারওর যৌবনের উৎসাহকে জ্বালিয়ে দিতে না পারে, তা হলে সে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার জন্যে জন্মায়নি।

বারো বছরের অ্যালবার্টকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে ম্যাক্সের অভিজ্ঞতা কেমন?

সে-কথা ম্যাক্সের মুখেই শোনা যাক—

After a short time, a few months, he had worked through the whole book (Euclid’s ‘Elements’). He thereupon devoted himself to higher mathematics. Soon the flight of his mathematical genius was so high that I could no longer follow.

কিছুদিনের মধ্যেই, কয়েক মাস হবে, অ্যালবার্ট ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির সবটুকু জেনে ফেলল। তারপর সে নিজেকে নিয়োগ করল উচ্চতর গণিতের সাধনায়। খুব তাড়াতাড়ি তার গাণিতিক প্রতিভা এত উঁচুতে উড়ে গেল যে আমার পক্ষে আর নাগাল পাওয়া সম্ভব হল না!

আইনস্টাইনের বাবা-কাকার ব্যাবসা মিউনিখে ফেল করল।

ইতালির মিলানে তাঁরা নতুন করে ব্যাবসা শুরু করলেন। অ্যালবার্ট স্কুলের লেখাপড়া শেষ করার জন্যে জার্মানিতেই দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের কাছে থেকে গেল। কিন্তু বোন মায়া আর বাবা-মায়ের জন্যে তার মন কেমন করতে লাগল। জার্মান স্কুলের শিক্ষকদেরও তার ভাল লাগে না। তার প্রতিও শিক্ষকদের তেমন কোনও মায়ামমতা নেই। এক শিক্ষক তো অ্যালবার্টকে প্রায়ই বিদ্রূপ করে বলতেন, তুমি তো শুধু পিছনের বেঞ্চিতে একটু হেসে বসে থাকো। এর ফলে ক্লাসের অন্য ছেলেরাও শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতে শিখছে না।

অ্যালবার্ট ক্রমে বুঝল তার পক্ষে এই স্কুলে পড়া সম্ভব নয়। তখন সে স্কুল-পালাবার একটা ফন্দি করল। ম্যাক্সের দাদা বার্নার্ড ডাক্তার। সে বার্নার্ডের কাছে অনুরোধ করল, তাকে লিখে জানাতে যে সে ‘neurasthenic exhaustion’-এ ভুগছে এবং তার বিশ্রাম প্রয়োজন। স্কুল এই নোট পাবার পর সঙ্গে সঙ্গেই অ্যালবার্টকে ‘ছুটি’ দিয়ে দিল। তখন তার বয়েস পনেরো।

অ্যালবার্ট ইতালির ট্রেন ধরল। এবং এসে পৌঁছল মিলানে তার বাবা-মায়ের কাছে। বাবা-মাকে জানাল, সে আর মিউনিখে ফিরতে চায় না। এবং সে আরও একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে— সে জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চায়! কারণ, যে-কোনও জার্মান পুরুষের আঠেরো বছর বয়েস হলেই তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। অ্যালবার্ট জার্মান স্কুলেও পড়বে না, সেনাবাহিনীতেও যোগ দিতে চায় না। অতএব সে জার্মান নাগরিকই থাকতে চায় না।

জুরিখের এনট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করে কাছে আরাউয়ের এক নামকরা বিদ্যালয় Swiss Cantonal School-এ শেষপর্যন্ত ভর্তি হল অ্যালবার্ট। আর ভর্তি হয়েই তার খুব ভাল লাগল। কারণ স্কুলে মাস্টারমশাইরা জার্মান স্কুলের শিক্ষকদের মতো কড়া মেজাজের নন। তাঁরা ছাত্রদের নিজের মতো করে ভাবতে বলেন। প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন না।

অ্যালবার্ট তো নিজের মতো করে ভাবতে চায়। ভাবনার স্বাধীনতা ছাড়া সে আর তেমনভাবে কিছুই ভালবাসে না। সুইস বিদ্যালয়কে তার মনে হল মুক্তভাবনার প্রাঙ্গণ। অনেক বছর পরে আইনস্টাইন লিখলেন—

That institution left an unforgettable impression on me; the comparison with the six years I spent in a German High School run with an iron fist made me truly understand just how superior is an eduation based on freedom of choice and self accountability over an education that relies on regimentation, external authority and ambition.

সুইস বিদ্যালয়টি যে আইনস্টাইনের মনের ওপর অবিস্মরণীয় ছাপ ফেলেছে, একথা অকপটে স্বীকার করলেন তিনি। তুলনা করলেন ছ’বছর জার্মান স্কুলে তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সুইস বিদ্যালয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার। জার্মান হাইস্কুলে লোহার হাত দিয়ে শাসন করা হয়। সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতি নির্ভর করে কঠোর নিয়ম আর শাসনের ওপর। এই শাসনের কোনও অন্তর নেই। সুইস শিক্ষা পদ্ধতি ভাবনার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এইখানেই এই শিক্ষাপদ্ধতির শ্রেয়তা।

এই মুক্তভাবনার পরিবেশে যেন নতুন করে জন্মালেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। জীবনে অনেক পরে তিনি লিখেছিলেন, Ideas come from God. আর তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর লক্ষ্য কী, তিনি বলেছিলেন, To read God’s mind!

সুইস স্কুলের মুক্ত মননের পরিবহে ষোলো বছরের অ্যালবার্ট বোধহয় প্রথম শুরু করল ঈশ্বরের মন পড়তে। আলো নিয়ে আরও ছোট বয়েসে কত কথাই না ভেবেছে অ্যালবার্ট। তার কাছে আলো যেন রূপকথার নায়ক। এই প্রথম যেন সে নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রশ্ন করল, What it would be like to travel on a beam of light? এ প্রশ্ন আগেও মনে এসেছে তাঁর। কিন্তু এবার যে প্রশ্নটা অন্য মাত্রা পেল এইভাবে— Would the light wave stand still? And if it did, what would that look like? আলোর তরঙ্গ কি থমকে দাঁড়াবে? যদি থমকে দাঁড়ায় কেমন দেখতে লাগবে তাকে? আচ্ছা, যদি আলোর গতিতে যেতে যেতে সে নিজের মুখের সামনে একটা আয়না ধরে তা হলে সেই আয়নায় কি সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে?

অ্যালবার্টের এইসব অদ্ভুত ভাবনায় সুইস স্কুলের শিক্ষকরা কিন্তু এতটুকু রেগে যেতেন না। তাঁরা বরং অ্যালবার্টের এইসব ভাবনার একটা নাম দিলেন— Gedankenexperiment— ভাবনার-পরীক্ষানিরীক্ষা। শুধু কি বিজ্ঞানের ভাবনা? জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগের ভাবনা, তাও তো অ্যালবার্ট ভুলতে পারেনি। ১৮৯৬ সালে সত্যিই সে বাবার অনুমতি নিয়ে ত্যাগ করল জার্মান নাগরকিত্ব। কিন্তু এখনও যে তার সুইস নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করার বয়েস হয়নি! তা হলে? কয়েকটি বছর অ্যালবার্টকে থাকতে হল দেশহীন হয়ে।

অ্যালবার্টের একমাত্র উদ্দেশ্য, বিজ্ঞানী হওয়া। কিন্তু বিজ্ঞানী হতে হলে তো গবেষণা করতে হবে, লিখতে হবে নতুন কিছু, ভাবতেও হবে এমন কিছু যা আগে কোনও বিজ্ঞানী ভাবেননি।

খুব অল্প বয়সেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন লিখে ফেলল তার প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা। অবশ্য কোনও উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানপত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়নি।

বিষয় কী সেই গবেষণাপত্রের? বিষয় হল, ইথার অ্যান্ড ম্যাগনেটিজ়ম। এই বিষয়টা নিয়ে অ্যালবার্ট তো সেই ছেলেবেলা থেকেই ভেবে চলেছে। সুতরাং অ্যালবার্ট যে ইলেকট্রিসিটি বা ম্যাগনেটিজ়ম নিয়েই কিছু একটা লিখবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু অ্যালবার্টের বক্তব্যে সবাই বিস্মিত!

কারণ, এতদিন ধরে বিজ্ঞানীরা যা বিশ্বাস করে এসেছেন, জীবনের প্রথম প্রকাশিত গবেষণাপত্রে কিশোর অ্যালবার্ট তার বিরুদ্ধে যুক্তি শানিয়েছে!

বিজ্ঞানীরা এতদিন বিশ্বাস করেছে যে মহাশূন্যের শূন্য ভরে রেখেছে ‘ইথার’ নামের এক বস্তু। ইথারটা ঠিক কী? বিজ্ঞানীরা তখন জানেন না ‘ইথার’ কী দিয়ে তৈরি, কেমন দেখতে, ইথার স্পর্শ করলে কেমন অনুভূতি হয়, ইথারের কোনও গন্ধ আছে কি না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সবাই একমত— মহাশূন্যের শূন্যস্থান ভরে আছে ইথারে।

অ্যালবার্ট এই বিশ্বাসের বিরোধিতা করল তার প্রথম প্রকাশিত গবেষণাপত্রে। অ্যালবার্ট যুক্তি দিয়ে বোঝাল, মহাশূন্যের শূন্যস্থান প্রকৃতই খালি, ইথার বা কোনও কিছু নেই সেখানে।

অ্যালবার্টের এই প্রথম প্রকাশিত গবেষণাপত্র। কেউ তেমন গ্রাহ্যই করল না। কেনই বা গ্রাহ্য করবে? অ্যালবার্টের কি কোনও পরিচয় আছে? সবাই তো জানে সে স্কুল পালানো এক কিশোরমাত্র। হাইস্কুল থেকে সে বলতে গেলে বিতাড়িত। থাকে বাবা-মায়ের আশ্রয়ে। তার এত বড় স্পর্ধা, পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের সে চ্যালেঞ্জ করে বসল।

কিন্তু অনেক বছর পরে এই বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাই অ্যালবার্টের সেই প্রথম গবেষণাপত্রটি খুঁজে বের করে পড়ে বিস্মিত!

কী অসামান্য প্রতিভা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের। সেই কিশোর বয়সে লেখা গবেষণাপত্রে তিনি যা বলেছিলেন, তা যে কত সত্য!

কিশোর অ্যালবার্ট। তার ভারী ভাল লাগে পাহাড়ি পথে ঘুরে বেড়াতে। ভাল লাগে একাকিত্ব, ভাল লাগে নির্জনতা, ভাল লাগে একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলতে, ভাল লাগে নিজস্ব ভাবনা ভুবনে মগ্ন হয়ে থাকতে। অ্যালবার্ট নির্জনে হেঁটে বেড়ায় পাহাড়ি পথে আর ভাবনায় মশগুল হয়ে থাকে। সেই অভিজ্ঞতার কথা জীবনের প্রান্তে এসে বলেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—

I lived in solitude in the country and noticed how the monotony of a quiet life stimulates the creative mind.

আমি থাকতাম শহর থেকে দূরে জনহীন নিঃসঙ্গতার মধ্যে। সেইভাবে থাকতে থাকতে অনুভব করলাম কীভাবে শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের একঘেয়েমি সৃষ্টিশীল মনকে উস্কে দেয়।

কথাগুলি আইনস্টাইনের না হয়ে রবীন্দ্রনাথেরও হতে পারত। শহর কলকাতায় জমিদার বাড়ির ছেলে হয়েও তিনি চলে গিয়েছিলেন শিলাইদহের পদ্মানদীর নিঃসঙ্গ চরে। বেশির ভাগ সময়ে নির্জন চরে নোঙর ফেলে তিনি থাকতেন বোটের মধ্যে। নিজেকে এইভাবে স্বইচ্ছায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দশ বছর ধরে করেছিলেন নির্জনতার চর্চা। বাকি জীবনের বেশিরভাগ সময়ও তাঁর কেটেছিল শহর থেকে দূরে তখনকার কোলাহলবিহীন শান্তিনিকেতনে। এই নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা প্রাণিত করেছিল তাঁর সৃষ্টিশীল মন ও কল্পনাকে।

নিঃসঙ্গ অ্যালবার্ট কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিল। প্রথম সিদ্ধান্ত, সে পদার্থ বিজ্ঞান পড়বে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, সে প্রফেসর হবে। আর তৃতীয় সিদ্ধান্ত, সে বজায় রাখবে তার জীবনে স্বাধীন চিন্তার অধিকার। হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে অ্যালবার্ট সুইত্জারল্যান্ডেই থাকল। এবার তার কলেজে পড়ার পালা। আরাউতে পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি পেয়ে সে ভরতি হল সুইস ফেডারাল পলিটেকনিক-এ। কলেজটা জুরিখে। সেইখানেই শুরু হল অ্যালবার্টের নতুন জীবন।

অ্যালবার্টের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। বাবা কাকার নতুন ব্যাবসা চলল না। অ্যালবার্টের পকেটে টাকা নেই। জামা-কাপড়ের অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের। কারণ মাথায় শুধু নতুন নতুন ভাবনাচিন্তা। সবচেয়ে সে বেশি ভাবে সময় নিয়ে। ‘সময়’ তার প্রিয়তম বিষয়।

সময় প্রসঙ্গে কত প্রশ্ন অ্যালবার্টের মনে—

কত দ্রুত চলে যায় সময়?

ভবিষ্যৎ কাকে বলে?

আমরা কি অগ্রসর হই ভবিষ্যতের মধ্যে?

না কি ভবিষ্যৎ সব সময়েই হয়ে উঠছে বর্তমান?

সময় কি কখনও ফুরিয়ে যাবে?

এইসব প্রশ্ন যার মনে ডুবছে-ভাসছে সর্বদা, তার কাছে টাকার অভাব কি তেমন কিছু?

তা ছাড়া, তার ভারী ভাল লাগছে কলেজজীবন। কত নতুন বন্ধু হয়েছে।

অ্যালবার্টের ক্লাসে একটি মাত্র মেয়ে। তার নাম মিলেভা মারিচ।

অ্যালবার্ট পছন্দ করে এই বুদ্ধিমতী মেয়েটিকে। তার নতুন নাম রেখেছে অ্যালবার্ট— ডলি।

ডলিও ভাবুক প্রকৃতির। অ্যালবার্ট আর ডলি, ওদের মনের মিল হল।

তারপর ওরা প্রেমে পড়ল পরস্পরের। ফলে দু’জনেরই মন পড়াশোনা থেকে কিছুটা সরে গেল। তাই ফাইনাল পরীক্ষায় দু’জনের রেজাল্টই খুব খারাপ হল।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

এই সময়ে মারা গেল অ্যালবার্টের বাবা।

চারধার অন্ধকার। কোথাও নেই আশার আলো।

অ্যালবার্টের জীবনে একমাত্র আলো তার নতুন ভালবাসা— মিলেভা।

অ্যালবার্ট ঠিক করল মিলেভাকে বিয়ে করে শুরু করবে নতুন জীবন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *