যাজকীয় ক্ষমতা
আমি দুই প্রকার প্রথাগত ক্ষমতা নিয়ে এই অধ্যায় ও পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করব। এই দুই প্রকার ক্ষমতা হচ্ছে–যাজকীয় কর্তৃত্ব ও রাজকীয় কর্তৃত্ব। অতীতকালে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল এগুলো। অধুনা উভয়টিই কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। এর কোনোটিই পুনরুজ্জীবিত হবে না ভাবাটা হঠকারী হতে পারে। উভয় প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সম্ভব করে তোলে এগুলোর স্থায়ী বা অস্থায়ী পতন, যা অর্জিত হওয়ার নয় আরও তেজোবীর্য ক্ষমতার ক্ষেত্রে।
নৃবিজ্ঞানীদের পরিচিত সামজে প্রাথমিক হলেও যাজক এবং রাজা বিদ্যমান। একই ব্যক্তি কখনও উভয় কাজ সম্পাদন করে থাকেন। তা শুধু বর্বর সামজেই নয়, বরং অত্যধিক সভ্য সমাজেও দেখা যায়। রোমে প্রধান যাজক ছিলেন অগাস্টাস এবং প্রদেশগুলোতে দেবতা। ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের অধিকর্তা ছিলেন খলিফা। অনুরূপ বর্তমানকালে সিন্টো ধর্মের সিকাডোর অবস্থান। রাজার ধর্মনিরপেক্ষ কার্যকলাপ হারানোর এক প্রবল প্রবণতা দেখা দিয়েছে ধার্মিকতার জন্য এবং এভাবে তিনি পরিণত হন একজন যাজকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সত্ত্বেও স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট হয়ে পড়েছে রাজা ও যাজকের পার্থক্য।
চিকিৎসক হচ্ছে যাজকের প্রাচীনতম রূপ, যার ক্ষমতা দুই প্রকার। এই দুই প্রকার ক্ষমতাকে নৃবিজ্ঞানীরা ধর্ম ও ঐন্দ্রজালিক বলে অভিহিত করেছেন। অতিমানবীয় সত্তার সাহায্যের উপর ধর্মীয় ক্ষমতা নির্ভরশীল। অথচ ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা প্রাকৃতিক। যা হোক আমাদের কাছে উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয় এ ধরনের ক্ষমতা। গুরুত্বপূর্ণ যা তা হচ্ছে ধর্ম বা ইন্দ্রজাল দ্বারা অন্য লোকের উপকার বা ক্ষতি করতে সামর্থ্য চিকিৎসক। তাছাড়া সবার জন্য উন্মুক্ত নয় এই ক্ষমতা। এটুকু ভাবা হয় যে ইন্দ্রজাল পেশা বহির্ভুত কিছু মানুষ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে চিকিৎসকের ইন্দ্রজাল কঠিন। কেউ যখন পীড়িত হয় বা দুর্ঘটনায় পতিত হয় তখন বুঝতে হবে যে তা ঘটেছে কোনো শত্রুর অমঙ্গলকারী ম্যাজিকের দ্বারা। কি করে এই সম্মোহন দূর করা যায় চিকিৎসক তা জানেন। এভাবে ডিউক অব ইয়র্ক দ্বীপের একজন চিকিৎসক রোগীর পীড়িত হওয়ার কারণ বের করেন তার সুচতুর অনুমান দ্বারা। তিনি এক প্যাকেট চুন বের করেন এবং আওড়ান জাদুমন্ত্র : এই যাদুমন্ত্র অসাড় এটা মনে করা যাবে না। এ ধরনের মন্ত্রের প্রতি বেশি আকৃষ্ট সভ্য লোকের চেয়ে বর্বরেরা। এ জন্য এ জাতীয় মানুষের দ্বারা তাদের রোগ সৃষ্টি এবং উপশমও হয়।
রিভার্সের মতানুসারে একজন যাদুকর নতুবা ধর্মযাজক ম্যালোনেশিয়ার অধিকাংশ স্থানের রোগ উপশমকারী। চিকিৎসক ও অন্যান্য লোকের ভেতর আপাত স্পষ্ট পার্থক্য নেই এসব অঞ্চলে এবং যে কোনো মানুষ দ্বারা তা সহজতরভাবে উপশম সম্ভব।
যারা সমন্বয় ঘটিয়েছেন চিকিৎসার সাথে ধর্মীয় ও ঐন্দ্রজালিক আচরণের স্বভাবতই তারা দক্ষতা অর্জন করে থাকেন দীক্ষা এবং শিক্ষার মাধ্যমে। এমন জ্ঞান পয়সা দিয়ে কিনে নিতে হয় ম্যালোনেশিয়াতে। সবচেয়ে পরিপূর্ণ শিক্ষা ছাত্রদের কোনো কাজেই আসে না যতক্ষণ পর্যন্ত না চিকিৎসা-ইন্দ্রজাল বা চিকিৎসা-ধর্মীয় কলাকৌশলের কোনো শাখায় তাদের পকেট থেকে পয়সা প্রশিক্ষকদের হাতে পৌঁছায়।
এসব সূচনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, আরও গুরুত্বপূর্ণ ঐন্দ্রজালিক ও ধর্মীয় ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নির্দিষ্ট যাজক সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধি, পরিণামে যে সম্প্রদায় গোটা সমাজের উপর এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মিসর ও ব্যাবিলনের রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্বে তাদের ক্ষমতা রাজার চেয়ে বেশি–এটা প্রতীয়মান হয়। তারা নাস্তিক ফেরাউন ইকনাটনকে পরাজিত করেন এটা অনুমান করা যায় এবং সাইরাসকে বিশ্বাসঘাতকপূর্বক ব্যাবিলন বিজয়ে সাহায্য করেন। কারণ তাদের দেশীয় রাজা প্রবণতা দেখিয়েছেন যাজকমন্ডলীর বিরুদ্ধাচারণের।
প্রাচীন সমাজে গ্রিস ও রোম পৃথক সত্তার অধিকারী ছিল যাজকীয় ক্ষমতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকার জন্যে। অনুমিত হয়, গ্রিসে পরিচালিত এ রকম ধর্মীয় ক্ষমতা প্রধানত দৈববাণী প্রকাশের স্থান ডেলপিতে পুঞ্জীভূত ছিল, যেখানে পিথনেস ভাববিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং এপেলো কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে উত্তর। করেছিলেন। যা হোক মহাজ্ঞানীদের ঘুষ দেয়া হতো হেরোডেটাসের সময়। আলমেনিদে নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ এথেনীয় পরিবার পিসিস্ট্রেসাস কর্তৃক নির্বাসিত হয় বলে হেরোডেটাস ও এরিস্টটল উভয়েই উল্লেখ করেছেন এবং তার ছেলেদের বিরুদ্ধে ডেলপির সমর্থন লাভ করে দুর্নীতির মাধ্যমে। কৌতূহল উদ্দীপক ছিল হেরোডেটাসের বক্তব্য : তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, ব্যক্তিগত অথবা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে এথেনীয়রা ঘুষ দিয়ে পিথনেসকে এথেন্সবাদদিদের বলার জন্য রাজি করাতে পারতেন যে, তারা অবশ্যই এথেন্সকে মুক্ত করে দেবে। সুতরাং কোনো উত্তর না পেয়ে লেসিডিমনীয়রা অস্টারের পুত্র। এনকিমলিয়াসকে (যিনি এথনীয়দের বিরুদ্ধে সংগঠিত সেনাবাহিনীর প্রধান। ছিলেন) আদেশ করেন পিসিস্ট্রিডীয়দের তাড়িয়ে দেয়ার জেন্য; যদিও তাদের ভেতর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। কারণ তারা বেশি সম্মান প্রদর্শন করত মানবীয় বিষয়ের চেয়ে স্বর্গীয় বিষয়ের প্রতি।
পরাজিত হলেও এনকিমিলিয়াসের পরবর্তী বড় অভিযান সফল হয়েছিল। ক্ষমতা ফিরে পায় আলমেনিদ পরিবার অন্যান্য নির্বাসিতরা এবং পুনরায় স্বাধীনতা লাভ করে এথেন্স।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই বর্ণনায়। হেরোডেটাস পুরোপুরিভাবে বিশ্বনিন্দাবাদ বিবর্জিত একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এবং তিনি স্পার্টাবাসীদের সম্পর্কে ভালো মনোভাব পোষণ করতেন দৈববানী মেনে চলার জন্যে। কিন্তু তার কাছে স্পার্টার চেয়েও এথেন্সের গুরুত্ব বেশি। তিনি এথেন্সবাসীদের ব্যাপারে পিসিস্ট্রেসাস পরিবারের বিরোধী। তা সত্ত্বেও তিনি উল্লেখ করেন, এথেন্সবাসীরাই উৎকোচের কর্তৃত্বদানকারী এবং তাদের অধার্মিকতার জন্য বিজয়ী দল বা পিথনেস পরিবারের উপর শাস্তি নেমে আসেনি। হেরোডেটাসের সময়ও আলমেনিদ পরিবার প্রাধান্য বিস্তার করত। প্রকৃতপক্ষে আলমেনিদ পরিবারের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি তার সমসাময়িক পরিবেশক ছিলেন।
এরিস্টটল এসব কার্যাদির কলঙ্কময় বর্ণনা বিবৃত করেছেন এথেন্সের সংবিধান সম্বন্ধে প্রণীত বইয়ে। ৫৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আগুন দিয়ে ধ্বংস করা হয় ডেলপীয় গির্জা এবং আলমেনিদ কর্তৃক গ্রিসের সর্বত্র অর্থসগ্রহ করা হয় তা পুনঃনির্মাণের জন্য। দৃঢ়ভাবে এরিস্টটল বলেন, এই তহবিলের একটি অংশ পিথনেসকে উৎকোচ হিসেবে প্রদান করা হয় এবং পিসিস্ট্রেসাসের পুত্র হেপিয়াসের পতন ঘটানোর জন্য অবশিষ্টাংশ ব্যয় করা হয়। এভাবে তাদের পক্ষে নিয়ে আসা হয় এপোলোকে।
এসব কলঙ্ক সত্ত্বেও রাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয় হয়ে রইল ডেলপিতে দৈববাণীর নিয়ন্ত্রণ, আর এটাই মারাত্মক যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াল। ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার জন্য এটি ধর্মযুদ্ধ বলে অভিহিত হয়। কিন্তু পরিণামে দৈববাণী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্য উন্মুক্ত, এ সত্যের খোলাখুলি স্বীকৃতি মুক্তচিন্তা বিকাশে উৎসাহ সৃষ্টি করে। পরিশেষে রোমানদের জন্য অপবিত্রতাজনিত ঘৃণা ব্যতিরেকে গ্রিক গির্জাগুলোর অধিকাংশ সম্পদ ও এর সর্বসময় কর্তৃত্ব লাভ সম্ভব করে তোলে। অধিকাংশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হয় সাহসী ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষ উদ্দেশ্যে এবং এর ফলে বাজেয়াপ্ত হয় এগুলোর ক্ষমতানির্ভর সম্মান। আরও সুন্দরভাবে এবং অন্যান্য স্থানের চেয়ে তুলনামূলক কম চরমে পৌঁছেই তা ঘটেছিল গ্রিসীয় রোমান দুনিয়ায়। কারণ ধর্ম কখনও কোথায় এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যযুগীয় ইউরোপের মতো এত শক্তিশালী ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে চীন হচ্ছে গ্রিক ও রোমের অনুরূপ একমাত্র দেশ।
যেগুলো স্মরণাতীত কাল থেকেই চলে এসেছে এবং যেগুলোর ঐতিহাসিক উৎস আমাদের জানা নেই এ পর্যন্ত আমরা ঐসব ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু এর সবগুলোকে অতিক্রম করেছে প্রবর্তকের কাছ থেকে প্রাপ্ত ধর্ম। একমাত্র সিন্টো ও ব্রাহ্মণ্যবাদ হচ্ছে ব্যতিক্রম। নৃবিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ধর্মগুলোর মতো সনাতন ধর্মগুলোর উৎস সম্পূর্ণরূপে অস্পষ্ট বর্তমান বর্বর সমাজে। আমরা দেখেছি যে কোনো সুনির্দিষ্ট যাজক সম্প্রদায় ছিল না প্রাচীনতম বর্বর সমাজে; এটা অনুমিত হয় যে প্রাথমিক অবস্থায় অগ্রাধিকার ছিল যাজকয়ি কাজে বৃদ্ধ লোকের, বিশেষত যারা বিচক্ষণ এবং ক্ষতিকর যাদুবিদ্যায় খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
অধিকাংশ দেশে সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে যাজকরা অবশিষ্ট জনগণ থেকে ক্রমাগতভাবে পৃথক এবং ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। কিন্তু রক্ষণশীল ছিলেন প্রাচীন প্রথার ধারক হিসেবে। তারা ক্ষমতা ও সম্পদের অধিকারী হিসেবে ব্যক্তিগত ধর্মের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন অথবা উদাসীন হয়ে পড়ে। বিপ্লবী নবীর অনুসারীদের দ্বারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের সবকিছুই। ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত বুদ্ধ, খ্রিস্ট ও মোহাম্মদ (সাঃ)। তাদের অনুসারীদের ক্ষমতা প্রথমে বিপ্লবী ছিল এবং ক্রমান্বয়ে তা প্রথায় পরিণত হয়। প্রক্রিয়াগতভাবে তারা আত্মীকৃত করে নামমাত্র যেসব প্রথার পরিসমাপ্তি তারা পূর্বাহ্নে ঘটিয়েছেন সেসব প্রথার অধিকাংশই।
যে কোনো উপায়ে যতটুকু সম্ভব প্রথার প্রতি আবেদন রেখেছেন সবচেয়ে স্থায়ী সফল ধর্মীয় ও নিরপেক্ষ প্রবর্তকরা এবং পারতপক্ষে হ্রাস করেছেন তাদের পদ্ধতির অভিনবত্বের মাত্রা। স্বাভাবিক পরিকল্পনা হবে কাল্পনিক অতীত আবিষ্কার করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুনরুদ্ধারের দাবি করা। যাজকগণ কিভাবে আইনের বই পান এবং রাজা কিভাবে আদেশ পালনে প্রত্যাবর্তন ঘটান তা 2 kings xxii নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে। নবীদের কর্তৃত্বের প্রতি আবেদন রাখে নতুন টেস্টামেন্ট; এনাবেপ্টিস্টরা নতুন টেস্টামেন্টের প্রতি; ইংরেজ গোঁড়া খ্রিস্টানরা ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ে বিজয়পূর্ব ইংল্যান্ডের কাল্পনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি। জাপানিরা .৬৪৫ সালে মিকাডোর ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে; ১৮৬৮ সালে তারা ৬৪৫ সারেল সংবিধান পুনরুদ্ধার করে। একটা পুরো বিপ্লবী শ্রেণি মধ্যযুগব্যাপী এবং পরে ১৮ মেয়ার পর্যন্ত পুনরুদ্ধার করে রোমের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। শার্লিম্যানের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন নেপোলিয়ান, কিন্তু তা মনে করা হতো অতিশয় নাটুকেপনাপূর্ণ তুচ্ছ বলে। বাগিতার যুগকে তা প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়। এগুলো এলোমেলো কতগুলো উদাহরণমাত্র। এগুলো প্রথাগত ক্ষমতার বেলায় দেখিয়েছেন মহান প্রবর্তকরা।
ক্যাথলিক চার্চ হচ্ছে ইতিহাসে জ্ঞাত যাজকীয় সংগঠনগুলোর বেতর সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যায়ে আমি আলোচনা করব শুধু প্রথাগত ক্ষমতা নিয়ে। সুতরাং আমি আলোচনা করব বর্তমান বিপ্লবী আদর্শে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চার্চের ক্ষমতার প্রাচীন যুগ নিয়ে। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর, চার্চের পক্ষে দুটো প্রথা জনসমক্ষে তুলে ধরার সুযোগ হয় : খ্রিস্ট ধর্মের প্রথার সাথে তা রোমের প্রথারও বাস্তবরূপ দেয়। বর্বরদের ক্ষমতা ছিল, কিন্তু চার্চের ছিল উন্নত সভ্যতা ও শিক্ষা। একটা সুসঙ্গত নৈর্ব্যক্তিক উদ্দেশ্য, ধর্মীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীতির প্রতি আবেদন সৃষ্টির উপায় এবং সর্বোপরি তা ছিল একমাত্র সংগঠন যা পুরো পশ্চিম ইউরোপব্যাপী বিস্তার লাভ করে। তুলনামূলকভাবে গ্রিক চার্চ স্থিতিশীল সাম্রাজ্য কনস্টান্টিনোপোল ও মস্কোর সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক রক্ষাকারী রাষ্ট্রের অধীন হয়; কিন্তু সংস্কার সাধনের আগে পর্যন্ত পরিবর্তনশীল ভাগ্যের ভেতর দিয়ে সংগ্রাম চলছিল এবং তা আজ পর্যন্ত জার্মানি, মেক্সিকো ও স্পেনে শেষ হয়নি।
বর্বর আক্রমণের পর প্রথম ছয় শতাব্দী ধরে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি পশ্চিমা চার্চ দাঙ্গাবাজ ও আবেগপ্রবণ জার্মান রাজাদের এবং বেরনদের সঙ্গে। এই জার্মান রাজা ও বেরনরাই শাসন করত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও উভয় ইতালি এবং খ্রিস্টীয় স্পেন। জাস্টিনীয়দের বিজয় ছিল এর কিছু কারণ। একবার পৌরহিত্যিক বাইজেন্টাইন প্রতিষ্ঠা করে নেয় এই বিজয় এবং পশ্চিমে এর প্রভাব যথেষ্ট কমিয়ে দেয়। তারা নিয়োগ করত বিদেশি ও দূরবর্তী পোপদের চেয়ে যাদের সঙ্গে তারা অধিকতর একাত্ম বলে নিজেদের মনে করত সেই সমস্ত অভিজাত শ্রেণির ভেতর থেকে উচ্চমান পাদ্রিদের। কারণ তারা অপমানজনক মনে করত বিদেশি ও দূরবর্তী পোপদের হস্তক্ষেপ। অধিকাংশ নিম্নমান পাদ্রিরা ছিল অজ্ঞ এবং বিবাহিত। তাই তারা বেশি উদগ্রীব ছিল তাদের অধিকারভুক্ত সম্পত্তিগুলো চার্চের সংগ্রামের চেয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে হস্তান্তরের জন্যে। এত কষ্টকর ছিল যাতায়াত যে দুরবর্তী রাজ্যগুলোতে রোমান কর্তৃত্ব আরোপ করা যেত না। পোপের বিশাল এলাকার উপর প্রথম কার্যকর সরকার ছিল না, বরং তা ছিল শার্লিম্যানের, যা প্রশ্নাতীতভাবে পোপের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন তার সমসাময়িক ব্যক্তিরা।
সভ্যতার দ্রুত উন্নতি হতে লাগল তখন যখন দেখা গেল যে এক হাজার সালের পর বিশ্বের আকাঙ্ক্ষিত পরিসমাপ্তি ঘটেনি। পান্ডিত্যপূর্ণ দর্শনের উন্নতি ত্বরান্বিত হয় স্পেন ও সিসিলির মুরদের সঙ্গে সংস্পর্শে। সমসাময়িক শিক্ষা যা দিতে পারত নরম্যানরা ফ্রান্স ও সিসিলিতে তা ভোগ করল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জলদস্যুদের অত্যাচার ভোগ করে এবং বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে গড়ে উঠল সুশৃঙ্খল ধর্মীয় শক্তি। অধিকন্তুজকীয় কর্তৃত্ব কার্যকরি দেখতে পেল বিজয়। বৈধকরণে। সর্বপ্রথম তাদের দ্বারা যাজকীয় ইংল্যান্ড পুরোপুরিভাবে রোমের অধীনস্ত হলো। ইতিমধ্যে প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় সবচেয়ে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হলেন ফ্রান্সের রাজা ও সম্রাট উভয়ই। ঐ অবস্থায় যাজকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে শুরু করে গ্রেগরি-৭-এর নির্দয় শক্তি ও রাজনীতি এবং তা স্থায়ী হয় পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে। এই যুগ যাজকীয় ক্ষমতার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত বিধায় আমি তা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব।
পোপীয় শাসনের দিনগুলোর সূত্রপাত হয় গ্রেগরি-৭ এর সিংহাসন আরোহণের সঙ্গে এবং তা স্থায়ী হয় এভিগননে ক্লিমেন্ট-৫ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত পোপীয় শাসন ১৩০৬ খ্রিঃ পর্যন্ত। এই যুগে পোপের বিজয় অর্জিত হয় আধ্যাত্মিক অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা। অর্থাৎ অস্ত্রবলে নয় বরং কুসংস্কার দ্বারা। যুগব্যাপী পোপগণ নির্ভরশীল ছিলেন বাহ্যত নগরের বিদ্রোহাত্মক অভিজাত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত রোমের আন্দোলনমুখী জনগণের আগ্রহের উপর। কারণ খ্রিস্টান জগতের বাকি অংশ যা-ই ভাবুক না কেন, রোমানরা তাদের পোপের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। মহান হিলডিব্র্যান্ড নির্বাসনে মারা গিয়েছিলেন বটে কিন্তু তিনি অর্জন করেছিলেন ক্ষমতা এবং তা মহান শাসকদের অপদস্ত করতে হস্তান্তর করেছিলেন। সম্রাট হেনরি-৪ এর জন্য এর অব্যবহিত রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো সুবিধাজনক হলেও ক্যানোসা পরবর্তী যুগগুলোর জন্য তা প্রতীক হয়ে রইল। বিসমার্ক কুলটার ক্যাম্পের সময় বলেছিলেন, কেনোসায় আমরা যাব না। কিন্তু অকাল গর্বই করেছিলেন তিনি। হেনরি-৪, যিনি সমাজচ্যুত হয়েছিলেন তিনি তার পরিকল্পনা অগ্রসর করে নেয়ার জন্য পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন। যদিও গ্রেগরি অনুশোচনাকারীকে পাপমুক্ত করে দিতে অগ্রাহ্য করতে পারননি তারপও মর্যাদাহানিকর শর্তারোপ করেন চার্চের সঙ্গে মীমাংসার মূল্য হিসেবে। মানুষ রাজনীতিবিদ হিসেবে পোপের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে পারে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে শুধু প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীরাই, এমনকি সম্রাট ফ্রেডারিক-৩ পোপের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চরম পর্যায়েও প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে প্রদান করতে পারেননি নৈতিক সমর্থন।
যাজকীয় সংস্কার চরম পর্যায়ে পৌঁছে ৭ম গ্রেগরির পোপীয়কালে। সম্রাটের অবস্থান তার আগে পোপের উপরে ছিল এবং সম্রাট পোপ নির্বাচনে সিদ্ধান্তকারী ভূমিকার দাবি করতেন। ৬ষ্ঠ গ্রেগরিকে হেনরি-৪ এর পিতা হেনরি-৩ ঘুষ সম্বন্ধীয় অপরাধের জন্য ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং তার স্থলে পোপের পদে বসান একজন জার্মান ব্যক্তিকে। তিনি ছিলেন ক্লিটমেন্ট-২। তারপরও হেনরি-২ চার্চের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত ছিলেন না। অপরদিকে তিনি ছিলেন তাপস ব্যক্তি। তিনি তার সময়ের হিংসাপরায়ণ যাজক ব্যক্তিদের সঙ্গে এক কাতারে থাকতেন। তার সমর্থিত এবং গ্রেগরি-৭-এর দ্বারা বিজয়মণ্ডিত সংস্কার আন্দোলন অপরিহার্যরূপে সমাজতন্ত্রের দ্বারা কলুষিত হওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। রাজা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সামন্ত অভিজাত শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিদের ভেতর থেকে আর্কবিশপ ও বিশপ নিযুক্ত করতেন, যারা তাদের অবস্থানের একটি লৌকিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। মুলত সম্রাটের অধীনে রাজকর্মচারী ছিলেন সাম্রাজ্যস্থিত সবচেয়ে মহান ব্যক্তিরা এবং রাজপদের বলেই তারা জমির উপর তাদের অধিকার বজায় রাখেন; কিন্তু একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তারা বংশগতভাবে অভিজাত শ্রেণিভুক্ত হন, যাদের মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে বংশ পরম্পরায় হস্তান্তরিত হতো। চার্চের অভ্যস্তরে বিশেষত নিম্নমান লৌকিক পাদ্রিদের একটি বিপদ চিল। চার্চের সংস্কারক দল আক্রমণ চালায় চার্চের ভেতরকার ঘুষ ও উপপত্নীগ্রহণ নামীয় সমজাতীয় পাপাচারের উপর। তাদের অভিযানে তারা উৎসাহ, সাহস ও নিষ্ঠা এবং জাগতিক জ্ঞানের পরিচয় দেন। তারা পবিত্রতার দ্বারা জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেন এবং বাগ্মিতার দ্বারা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর জয়লাভ করেন, যারা মূলত শত্রুভাবাপন্ন ছিল। উদাহরণস্বরূপ ১০৫৮ সালে মিলানে সেন্ট পিটার পাদ্রিদেরকে আহ্বান করেন ডমিয়ান রোমের সংস্কারমূলক রায়ের প্রতি বাধ্য হতে। তিনি প্রথমে এতই উত্তেজিত হন যে তার জীবন বিপদাপন্ন ছিল। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। দেখা যায় যে, ব্যক্তিগতভাবে ঘুষের অপরাধে অপরাধী ছিলেন আর্কবিশপ থেকে নিচের দিকে মিলনিজদের প্রত্যেক যাজকই। সবাই তাদের দোষ স্বীকার করল এবং ভবিষ্যতে বাধ্য থাকার জন্য প্রতিজ্ঞা করল। এসব শর্তে তাদেরকে বেদখল করা হলো না। তবে এ কথা পরিষ্কার করা হলো যে ভবিষ্যতে এ রকম অপরাধের শাস্তি কোনোরকম অনুকম্পা ছাড়া প্রযোজ্য হবে না।
হিল্ডার ব্রান্ডের পূর্বের ধারণাগুলোর অন্যতম হলো যাজকীয় কৌমার্য। তা বলবৎ করার জন্য তিনি একটি তালিকা প্রস্তুত করেন যাজক ও তাদের স্ত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের অপরাধী ব্যক্তিদের। অবশ্য এই অভিযান পুরোপুরি সফল হয়নি। স্পেনে আজও তা সফল হয়নি, কিন্তু এর উদ্দেশ্যগুলোর ভেতর একটি অর্জিত হয়। তা ছিল এই যে, যাজকীয় পদে যাজকদের ছেলেমেয়েদের অধিষ্ঠিত করা যাবে না। ফলে বংশগত উত্তরাধিকার প্রথা রহিত হয় স্থানীয় যাজকত্বে।
১০৫৯ সালে রায়ের মাধ্যমে পোপ নির্বাচনে বিধিমালা প্রণয়ন ছিল সংস্কার আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। এই রায়ের আগে সম্রাট ও জনগণের কিছু অনির্দিষ্ট অধিকার ছিল। এর ফলে সৃষ্টি হতো অনৈক্য এবং পুনরাবৃত্তি ঘটত বিতর্কিত নির্বাচনের। অবিলম্বে তা সগ্রাম ছাড়া হয়নি বটে, কিন্তু সফল হয় নতুন রায় নির্বাচনের অধিকার বিশপদের হাতে সীমাবদ্ধ রাখতে।
চলমান সংস্কর আন্দোলন একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধব্যাপী এবোট, বিশপ ও আর্কবিশপকে সামন্ত অভিজাত শ্রেণি থেকে পৃথক করতে এবং পোপকে তাদের নিযুক্তির ব্যাপারে ক্ষমতা প্রদান করতে সফল হয়। কারণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হলে পোপ স্বাভাবিকভাবেই কলঙ্কের সম্মুখীন হতেন ঘুষের ব্যাপারে। এর ফলে জনসাধারণ প্রভাবিত হলো এবং চার্চের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। যাজক সম্প্রদায় স্পষ্টতই অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে পৃথক হয়ে পড়ে কৌমার্য প্রথা আরোপের ফলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কঠোর তপস্যার মতো নিঃসন্দেহে তাদের ক্ষমতা তাড়না উদ্দীপিত হয়। নেতৃস্থানীয় যাজকদের ভেতর তা একটি উদ্দেশ্যে নৈতিক আগ্রহের সঞ্চার করে। প্রচলিত দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান ব্যক্তিরা ছাড়া সবাই এ উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাসী ছিল এবং এ উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল উন্নতি বিধানের প্রধান উপায় হিসেবে পোপের প্রভূত ক্ষমতা বৃদ্ধিও।
প্রথমদিকে সাধারণত প্রচারণার উপর নির্ভরশীল ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন হয় এ ক্ষেত্রের মতো অসাধারণ সাহস ও আত্মোৎসর্গের। কিন্তু শ্রদ্ধা অর্জিত হওয়ার পর এসব গুণাবলি পরিত্যাগ করা যেতে পারে এবং জাগতিক উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে শ্রদ্ধা। এরপর সময়ের সাথে শ্রদ্ধা হ্রাস পায় এবং এর মাধ্যমে অর্জিত সুবিধাগুলো হারিয়ে যায়। কখনও এই প্রক্রিয়া কয়েক বছর স্থায়ী হয়, আবার কখনও হাজার বছর। কিন্তু মূলগতভাবে তা সবসময় একই ছিল।
শান্তিপ্রিয় ছিলেন না ৭ম গ্রেগরি। অভিশপ্ত সে-ই যে তার তলোয়ার রক্তপাত থেকে ফিরিয়ে রাখে ছিল তার প্রিয় কথা। কিন্তু তিনি এর ব্যাখ্যা দেন দেহধারী মানুষের ভেতর প্রচারণা থেকে বিরত থাকার উপায় নিষিদ্ধকরণ সম্বন্ধে এবং প্রদর্শন করেন প্রচারণা ক্ষমতার উপর তার দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিকতা।
ইংরেজদের ভেতর পোপের চেয়ার দখল করেন একমাত্র নিকোলাস ব্রেক্সপিয়ারই। তিনি অন্যভাবে দেখান পোপের ধর্মীয় ক্ষমতা। এবিলার্ডের ছাত্র ব্রেসিয়ারের আর্নল্ড এই মতবাদ প্রচার করেন যে, ভূসম্পত্তি আছে যে পাদ্রির, জায়গির ভোগ করেন যে বিশপ এবং সম্পদ আছে যে সন্ন্যাসীদের অধিকারে তারা কেউই রক্ষা পাবে না। এ মতবাদ অবশ্য গোঁড়া ছিল না। সেইন্ট বার্নার্ড তার সম্বন্ধে বলেন, যে ব্যক্তি পানাহার করে না সে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকে শয়তানের মতো শুধু আত্মার রক্তের জন্যে। তা সত্ত্বেও সেইন্ট বার্নার্ড স্বীকার করেন তার দৃষ্টান্তমূলক ধার্মিকতা। ফলে তিনি পক্ষ অবলম্বন করেন পোপ ও মৌলবাদীদের সঙ্গে পরিচালিত সংগ্রামে কার্যকরভাবে রোমানদের। ১১৪৩ সালে রোমানরা এদেরকে নির্বাসনে প্রেরণ করতে সমর্থ হয়। তিনি সমর্থন দান করেন তার মতবাদের নৈতিক প্রেরণা সন্ধানী পুনরুত্থিত রোমান প্রজাতন্ত্রের। কিন্তু একজন মৌলবাদীকে হত্যার ফলে সৃষ্ট সুযোগ গ্রহণ করে চতুর্থ অর্ডিয়ান (ব্রেক্সপিয়র) পবিত্র সপ্তাহে রোমে ধর্মকর্ম নিষিদ্ধ করে দেন। ধর্মীয় সন্ন্যাসীরা পবিত্র শুক্রবার আসন্ন হলে জোরপূর্বক সিনেট দখল করে নেয়। শোচনীয় বশ্যতা মেনে নেয় সিনেট। আর্নল্ডকে গ্রেফতার করা হয় সম্রাট ফ্রেডারিক বারবারসার সাহায্যে। ফাঁসি দিয়ে তার দেহ পুড়িয়ে ছাইভস্ম তাইবার নদীতে ফেলে দেয়া হয়। যাজকদের যে ঐশ্বর্যলাভের অধিকার আছে এভাবে তা প্রমানিত হয়। পুরস্কারস্বরূপ পোপ সম্রাটকে সেইন্ট পিটারের মুকুট পরিয়ে দেন। ক্যাথলিক বিশ্বাসের মতো এত উপকারী না হলেও সম্রাটের সেনাদল প্রয়োজনীয় ছিল। সম্রাটের সেনাদলের কাছে চার্চের ক্ষমতা সম্পদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সমর্থনের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ঋণী।
ব্রেসিয়ারের আর্নল্ডের মতবাদের বিষয়বস্তু চিল পোপ ও সম্রাটের ভেতর পারস্পরিক সমন্বয় বিধান। কারণ প্রত্যেকেই স্বীকার করে যে উভয়ের প্রয়োজন ছিল প্রতিষ্ঠিত প্রথার জন্যে। কিন্তু অনিবার্য দ্বন্দ্বটি নতুনভাবে দেখা দিল আর্নল্ড ক্ষমতাচ্যুত হলে। উদ্ভূত এই দীর্ঘ সংগ্রামে লম্বার্ড লীগ নামে এক নতুন সহযোগী পেলেন পোপ। লম্বার্ডির শহরগুলো বিশেষত মিলান সমৃদ্ধ ও বাণিজ্যিক দিকদিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখনকার দিনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্মুখভাগে ছিল ওইগুলো। স্বীকৃতিস্বরূপ ইংরেজরা একে লম্বার্ড স্ট্রিট নামে স্মরণ করে থাকে। সামন্তবাদের পক্ষে দাঁড়ালেন সম্রাট, কিন্তু ইতিমধ্যেই এর বিরোধী হয়ে গের বুর্জোয়া পুঁজিবাদ। চার্চ সুদ নিষিদ্ধ করলেও পোপ ঋণগ্রহীতা ছিলেন এবং উত্তর ইতালীয় ব্যাংকের মুলধন এত উপকারী দেখতে পেলেন যে অবশেষে ধর্মীয় কঠোরতা হ্রাসের প্রয়োজন মনে করেন। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে বারবারসার সঙ্গে পোপের দ্বন্দ্ব চলে এবং তা শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে। সম্রাটের জয়ী না হওয়ার প্রধান কারণ লম্বার্ড শহরগুলোই।
পোপ ও ফ্রেডারিকের ভেতর দীর্ঘ প্রতিযোগিতায় পোপের সার্বিক জয়ের পেছনে প্রধানত দুটো কারণ ছিল : উত্তর ইতালীয় বাণিজ্যিক শহর তাসকানি ও লম্বার্ডের সামন্ত প্রথার প্রতি বিরোধিতা এবং ফ্রান্সিসকানদের দ্বারা ধর্মীয় উৎসাহের জাগরণ। প্রেরিত পুরুষদের দারিদ্র্য ও বিশ্বজনীন প্রেমের বিচার করতেন সেন্ট ফ্রান্সিস; কিন্তু তার মৃত্যুর কয়েক বছরের ভেতর তার অনুসাীরা সার্জেন্টদের নিযুক্তি শুরু করেন চার্চের সম্পত্তি রক্ষার জন্যে তুমুল যুদ্ধের জন্যে। সম্রাটের পরাজয়ের কারণ ছিল এই যে, ঈশ্বরভক্তি ও নৈতিকতার ঢঙে তিনি দাঁড় করাতে পারেননি তার যুক্তিগুলো।
অনেকেই নৈতিকতার কারণে একই সময়ে পোপের এই সংগ্রামকালীন যুদ্ধ প্রস্তুতি পোপের মর্যাদা সম্পর্কে সমালোচনামুখর করে তোলে। CAMBRIDGE MEDIEVAL HISTORY (Vol-5, Page-176)-এ ফ্রেডারিকের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ পোপ চতুর্থ ইনোসেন্টের মৃত্যুর সময় উল্লেখ আছে।
তাঁর পূর্বসূরি যে কোনো পোপের চেয়ে পোপের মর্যাদা সম্পর্কে তার ধারণা অধিকতর ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। তার মতে তার দুর্বলতা ও এর প্রতিকার ছিল রাজনৈতিক। তিনি সর্বদা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ব্যবহার করতেন অর্থ সংগ্রহ, বন্ধুত্ব অর্জন এবং শত্রুকে ঘায়েল করার জন্যে। পোপীয় মর্যাদার প্রতি সর্বত্রই মানুষের ঘৃণার উদ্রেক করে তার অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ। কলঙ্কময় ছিল তার কর্মপদ্ধতি। আধ্যাত্মিক কর্তব্য এবং স্থানীয় অধিকার অবমাননা করে তিনি চার্চের সম্পত্তি, পোপীয় রাজস্ব ও রাজনৈতিক পুরস্কারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন। যাজকীয় বৃত্তির জন্য পোপের জন্য মনোনীত চার ব্যক্তিকে এক এক করে অপেক্ষমান থাকতে হতো। এ ধরনের পদ্ধতির নাম ছিল নিকৃষ্ট নিযুক্তি। আবার দূত নির্বাচন ছিল ধর্ম ও কূটনীতির ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে জাগতিক না হওয়ার চেয়েও বেশি কিছু। তার কারণে সৃষ্ট আধ্যাত্মিক প্রভাব ও সম্ভ্রমহানির ব্যাপারে ইনোসেন্ট সচেতন ছিলেন না। সদিচ্ছা থাকলেও তার নীতি ভালো ছিল না। খুব কমই সৌভাগ্য ও বিপর্যয় দ্বারা বিচলিত হয়েছে তার সাহস, অজেয় সংকল্প ও ধূর্ততায় সমৃদ্ধ ঠান্ডা মেজাজ। তিনি ধৈর্য সহকারে ধূর্ততা ও বিশ্বাসহীনতার সঙ্গে তার লক্ষ্যের দিকে ধাবমান ছিলেন, যার পরিণতিস্বরূপ চার্চের মান নিচে নেমে যায়। তার বিশাল প্রভাব ছিল ঘটনা প্রবাহের উপর। তিনি সাম্রাজ্য ধ্বংস করেন। পোপীয় পতনের সূচনা ঘটে তার হাতেই। তিনি নির্মাণ করেন ইতালির ভাগ্য।
পোপীয় নীতির কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি ইনোসেন্ট-৪-এর মৃত্যুতে। তার উত্তরাধিকারী URBAN-IV সম্পূর্ণ সফলতার সঙ্গে FREDERICK-এর পুত্র MANFRED-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান। এবং তৎকালীন ইতালির উদীয়মান পুঁজিবাদের সমর্থন লাভ করেন। কর্তৃত্বের আকর্ষনীয় ব্যবহার দ্বারা এর স্থিতিশীলতা যতই ব্যাহত হোক না কেন নৈতিকতার ক্ষেত্রে তা প্রচারণা ক্ষমতা থেকে অর্থনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। পোপীয় রাজস্ব সংগ্রহের ব্যাপক লেনদেনের জন্য অধিকাংশ ব্যাংকার ইতিমধ্যেই পোপের পক্ষে ছিল, কিন্তু কিছু শহরে যেমন, SIENA ও GHIBELLINE-এ অনুভূতি এত প্রবল ছিল যে, ব্যাংকাররা প্রথমত মেনফ্রেডের পক্ষ অবলম্বন করে। যেখানেই তা ঘটেছে পোপ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের জানিয়ে দেন যে, ঋণ পরিশোধ না করাই হচ্ছে খ্রিস্টানদের দায়িত্ব। তৎক্ষণাৎ এ ঘোষনা ঋণগ্রহীতাদের কাছে কতৃত্বাদেশ হিসেবে গৃহীত হয়। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য হারাল SIENA। ইতালির সর্বত্র যেসব ব্যাংকর ধ্বংস এড়াতে পারল তারাই পোপীয় কৌশলের দ্বারা বাধ্য হলো GUELPH হতে।
কিন্তু এ উপায়ে ব্যাংকারদের রাজনৈতিক সমর্থন লাভকরতে পারলেও পোপের স্বর্গীয় কর্তৃত্বের দাবির প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে পারেনি।
দুটি প্রথার ভেতর প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যের পতন থেকে শুরু করে যোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সমগ্র যুগটিকে দেখা যেতে পারে : একটি রাজকীয় রোমের অপরটি টিউটনিক অভিজাত শ্রেণির। প্রথমটি চার্চের অঙ্গীভূত এবং দ্বিতীয়টি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অঙ্গীভূত। রাজকীয় রোমের ঐতিহ্য অন্তর্ভুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন রোম সম্রাটরা। দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ছাড়া তারা সবাই অজ্ঞতাবশত রোমের ঐতিহ্যকে বুঝতে পারেনি। যে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচিত ছিল তা ছিল জার্মানির। পান্ডিত্যাভিমানীভাবে প্রাচীন তথ্যাদি থেকে গৃহীত হয় রাজকীয় চাকরিজীবীসহ সব শিক্ষিত ব্যক্তির ভাষা। রোমানদের ছিল আইন, গ্রিকদের ছিল দর্শন কিন্তু প্রথা ছিল উৎসের দিক থেকে টিউটনিক যা ভদ্র ভাষায় বর্ণনা করার মতো ছিল না। আধুনিক শিল্প পদ্ধতি বর্ণনায় বর্তমান যুগের সনাতনী পন্ডিতদের ল্যাটিন ভাষায় যে অসুবিধা মোকাবেলা করতে হচ্ছে তার অনুরূপ অসুবিধা ছিল। টিউটনিক প্রথা বর্ণনাময় সংস্কার আন্দোলন ও ল্যাটিনের পরিবর্তে আধুনিক ভাষা গ্রহণের আগে পশ্চিমা ইউরোপীয় সভ্যতার টিউটনিক উপাদান সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিল।
হোহেন স্টেফেনের পতনের পর চার্চ কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা দুনিয়ার উপর ইতালির শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল বলে মনে হয়। অর্থের মানদণ্ডে বিচার করলে দেখা যায়, এই শাসন সুসংহত ছিল এন্টানাইনের সময় পর্যন্ত। রোমানদের সেনাদল কর্তৃক সংগৃহীত অর্থের চেয়ে ইংল্যান্ড এবং জার্মান থেকে রাজস্ব হিসেবে যে অর্থ রোমে চলে যেত তা ঢের বেশি ছিল। কিন্তু তা পোপের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণেই আদায় করা সম্ভব হতো- কোনোরূপ অস্ত্রবলে নয়।
পূর্ববর্তী তিন শতাব্দী ধরে অর্জিত সম্মান পোপরা এভিগননে সরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারাতে বসে। তার একমাত্র কারণ ছিল না ফরাসি রাজার প্রতি পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার, বরং এর কারণ ছিল সংঘের সদস্যদের দমনের মতো নির্মমতায় অংশগ্রহণও। রাজা চতুর্থ ফিলিপ অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়ে এসব সম্পদের প্রতি অন্যায়ভাবে লাভ করে। বিরুদ্ধমত পোষণ করার অজুহাতে অন্যায়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাকে অভিযুক্ত করার জন্যে। যারা ফ্রান্সে ছিল পোপের সাহায্য নিয়ে তাদেরকে আটক করা হয় এবং অত্যাচার করা হয় যে পর্যন্ত না তারা স্বীকার করে যে শয়তানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিল এবং ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতিমূর্তির প্রতি থুথু ফেলেছিল। পরে পোপের জন্য কোনো উপরি পাওনা না রেখেই যখন রাজা তাদের সম্পত্তি থেকে সবটুকু হস্তান্তরিত করেছিলেন তখন তাদেরকে পুড়িয়ে ফেলা হয় অধিক সংখ্যায়। পোপের মর্যাদার নৈতিক অধঃপতনের সূচনা করে এসব কাজ।
পোপের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠল এই বিরাট বিভক্তি। কারণ দাবিদারদের ভেতর কে বৈধ তা কেউই জানত না। তারা একে অপরকে অভিশপ্ত মনে করত। প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষই এই মহাবিভক্তিকালে তাদের অশোভন অভিপ্রায় প্রদর্শন করে ক্ষমতার প্রতি। এমনকি তারা তাদের সংসক্ত শপথও পরিহার করে। উভয় পোপের প্রতি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র ও স্থানীয় চার্চ একত্রে বশ্যতা প্রত্যাহার করে। অবশেষে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ দুর্যোগের অবসান ঘটাতে পারে মাত্র একটি সাধারণ পরামর্শ সভাই। ভিন্নমত পোষণকারী হিসেবে তাদের পদচুতি ঘোষণা করলেও সাফল্যজনকভাবে উভয় পোপের প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ না করেই বিপথগামী হয়ে পিশার কাউন্সিল শুধু জন্ম দেয় তৃতীয় এক পোপের; অবশেষে কনস্টেন্সের কাউন্সিল সফলতার সঙ্গে তিনটিই অপসারণ করে এবং পুনরুদ্ধার করে সংহতি। কিন্তু সগ্রামী পোপের প্রতি ঐতিহ্যগত শ্রদ্ধাবোধ মর্যাদা সম্পর্কে বলা সম্ভব হয়েছিল যে, এ রকম দৈত্য থেকে ব্যাহতি চার্চের পক্ষে ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী; চার্চ তার ধ্বংসের জন্য কাজ করতে গিয়ে একান্তভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্যই কাজ করবে।
পোপীয় মর্যাদা ইতালির পরিবেশে উপযোগী হলেও পনেরো শতকে উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোর ঈশ্বর ভক্তির প্রতি পরিতৃপ্তি দানে তা অতিমাত্রায় জাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ এবং নগ্নভাবে নৈতিকতা বিবর্জিত ছিল। অবশেষে মুক্ত অর্থনীতির উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির অনুকূলে টিউটনিক দেশগুলোতে আনুপাতিক হারে জোরদার হয়ে ওঠে নৈতিক বিদ্রোহ। রোমের প্রতি সম্মান প্রর্দশনের একটি স্বাভাবিক অস্বীকৃতি দেখা দেয়। রাজপুরুষরা এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা চার্চের ভূমি দখল করে নেয়, কিন্তু তা সম্ভব হতো না প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ সংক্রান্ত বিদ্রোহ ছাড়া। আবার মহাবিভক্তি ও পোপীয় সংস্কারের কেলেঙ্কারী ছাড়া সংগঠিত হতো না প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ। অভ্যন্তরীণ কারণে চার্চের নৈতিক শক্তি দুর্বল না হলে এর আক্রমণকারীরা এতটুকু নৈতিক সাহস পেত না এবং তারা পরাজিত হতো ফ্রেডারিক-২-এর মতোই।
এই প্রেক্ষিতে এতটুকু খেয়াল করা মজার ব্যাপার যে, যাজকীয় শাসন বিষয়ে মেকিয়াভেলিকে তার প্রিন্স বইয়ের একাদশ অধ্যায়ে বলতে হয়েছে:
দশম ও লিও এর যাজকীয় কালে এই কথাগুলো লিখিত হয়েছিল। সংস্কার শুরু হয়ে যায় ওই সময়ে। এ কথা ধার্মিক জার্মানদের কাছে বিশ্বাস করা ক্রমে অসম্ভব হয়ে পড়ল যে ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের স্বজনপ্রিয়তা এবং লিও-এর অর্থ সংক্রান্ত প্রবল লোভ ঈশ্বর কর্তৃক প্রশংসিত ও রক্ষিত হতে পারে, লুথারের মতো। একজন বেপরোয়া দুঃসাহসী ব্যক্তি পোপীয় ক্ষমতার উপর আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন, যদিও তা থেকে পশ্চাৎপদ হয়েছিলেন মেকিয়াভেলি। চার্চবিরোধী নৈতিক ও ধর্মীয় সমর্থন লাভের সঙ্গে সঙ্গে স্বার্থজনিত বিরোধী প্রেরণা দ্রুতবেগে সম্প্রসারিত করে। যেহেতু চার্চের ক্ষমতা নির্ভর করত মূলনীতিগুলোর উৎকর্ষের উপর, তাই এটা স্বাভাবিক ছিল যে বিরোধিতার বৈধতা সংক্রান্ত নতুন মতবাদ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবে। কোনোরকমের ভীতি এবং প্রজাদের পক্ষ থেকে নৈতিক নিন্দাবাদ ছাড়াই লুথারের ধর্মতত্ত্ব অজ্ঞ যুবরাজদের চার্চ লুণ্ঠনে উদ্বুদ্ধ করে।
পোপবিরোধী ধর্ম বিপ্লব বিস্তারে অর্থনৈতিক প্রেরণার প্রভূত অবদান থাকলেও স্পষ্টত এর ব্যাখ্যাদানে ওইগুলো যথেষ্ট নয়, কারণ ওইগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্রিয়াশীল। পোপকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করেছিলেন অনেক ম্রাটই; অন্যত্র সার্বভৌম রাজা বা রানী এ রকমই করেছিলেন। যেমন ইংল্যান্ডের হেনরি-২ ও রাজা জন। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা অসৎ মনে করা হতো। এ কারণেই তা ব্যর্থ হয়। সফল প্রতিরোধ সম্ভব হয়ে ওঠে শুধু দীর্ঘকাল ধরে পোপীয় ঐতিহ্যগত ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে নৈতিক বিদ্রোহ ঘটলেই।
প্রচারণার মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন সম্পর্কে ধারণা লাভে ইচ্ছুক যে কোনো ব্যক্তির কাছে পোপীয় ক্ষমতার উত্থান-পতন একটি পাঠোপযোগী বিষয়। এটুকু বলা যথেষ্ট নয় যে, মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল এবং তারা বিশ্বাস করত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষমতায়। মধ্যযুগব্যাপী প্রচলিত ধর্মবিরোধী মতবাদ বিরাজমান ছিল এবং সার্বিকভাবে পোপ শ্রদ্ধা পাওয়ার উপযুক্ত না হলে তা প্রটেস্ট্যান্টবাদের মতো বিস্তার লাভ করত। প্রচলন বিরোধী মতবাদ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ শাসকরা চার্চকে রাষ্ট্রের অধীন রাখার জোর চেষ্টা করত, কিন্তু তা সফল হলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যর্থ হয়। এর রয়েছে অনেক কারণ।
প্রথমত, বংশগত উত্তরাধিকারমূলক ছিল না পোপীয় পদ এবং তাই ধর্মনিরপেক্ষ রাজতন্ত্রের মতো দীর্ঘকাল অবধি সংখ্যালঘুতা প্রসূত অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি। চার্চে ঈশ্বর ভঙ্গি, জ্ঞান ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছাড়া কেউ প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারেনি। ফলস্বরূপ অধিকাংশ পোপই এক বা একাধিক দিক থেকে সাধারণ স্তরের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। সামর্থ্য লাভ করতে পারতেন ধর্মনিরপেক্ষ সার্বভৌম রাজা। কিন্তু প্রায়ই ঘটেছে এর বিপরীতটি। তার ওপর পাদ্রিদের মতো আবেগ নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না তাদের। রাজারা বারবার পৃথক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্ট অসুবিধায় পড়েন, চার্চের বিষয় হওয়ার জন্য পোপের কারুণার মুখাপেক্ষী হতে হয়। কখনও তারা চেষ্টা করেন হেনরি-৮ এর মতো সমস্যা মোকাবেলা করার নীতি অনুসরণের। কিন্তু তাদের প্রজারা মুক্ত হয় অধীনতার শপথ থেকে এবং পরিশেষে তাদের স্বীকার করতে হয় বশ্যতা অথবা হতে হয় পরাজিত।
নৈর্ব্যক্তিক অবিচ্ছেদ্যতা হলো পোপীয় মর্যাদার অন্য একটি বড় শক্তি। কতই না আশ্চর্যজনক ফ্রেডারিক-২ এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোনো পোপের মৃত্যুতে সৃষ্ট ক্ষীণ পার্থক্য। এমন কিছু মতবাদ এবং রাষ্ট্রীয় শাসন প্রণালি ছিল যে সমাজ নির্ভরতার সঙ্গে রাজারা এগুলো বিরোধিতা করতে পারতেন না। একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলোর তুলনামূলক অবিচ্ছেদ্যতা বা উদ্দেশ্যের সংশক্তি অর্জন করে জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয়ের ফলে।
রাজারা সাধারণত একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে অজ্ঞ ছিল। অন্যদিকে অধিকাংশ পোপই ছিলেন জ্ঞানী এবং সর্ববিষয়ে উত্তমরূপে ওয়াকিবহাল। তার ওপর সামন্ত প্রথার সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধা ছিলেন রাজারা। ফলে সবসময় শক্ত ছিল অরাজকতাজনিত বিপদ মোকাবেলা করা। এই প্রথা নবতর অর্থনৈতিক শক্তির শত্রু ছিল। সর্বোপরি এ শতাব্দীতে রাষ্ট্রের চেয়ে চার্চ প্রদর্শন করে উন্নতর সভ্যতার প্রতিমূর্তি।
কিন্তু চার্চের বড় শক্তি ছিল স্বর্গীয় প্রভাবে অনুপ্রাণিত শ্রদ্ধাবোধ। এ ধরনের নৈতিক পুঁজি হিসেবে তা প্রাচীনকালে নির্বাহিত নির্যাতনের গৌরব উত্তরাধিকর সূত্রে অর্জন করে। আমরা দেখেছি যে, এর বিজয় সম্পর্কযুক্ত ছিল বলপূর্বক কৌমার্য প্রথার বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং মধ্যযুগীয় চিন্তাধারায় কৌমার্য প্রথা অত্যন্ত আর্কষণীয় ছিল। কিছু সংখ্যক পোপ ছাড়া অধিকাংশ যাজকই কষ্ট করেছেন নীতি বিসর্জন না দিয়ে। সাধারণ মানুষের কাছে এ কথা পরিষ্কার ছিল যে, বল্গাহীন লোভ-লালসা-লাম্পট্য ও আত্মকেন্দ্রিকতার এ বিশ্বে চার্চের মর্যাদাশীল প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা নৈর্ব্যক্তিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সাধারণ জীবনযাপন করেছেন এবং স্বেচ্ছায় ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদের অধীন করে দিয়েছেন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে চিত্তাকর্ষক পবিত্র ব্যক্তিরা-হিল্ডার ব্র্যান্ড, সেইন্ট বার্নাড, সেইন্ট ফ্রান্সি জনমত উদ্ভাসিত করেছেন এবং রোধ করেছেন নৈতিকতার অবক্ষয়। অন্যথায় তা উদ্ভূত হতো অন্যের দুষ্কর্মের ফলস্বরূপ।
আদর্শিক উদ্দেশ্য এবং ক্ষমতার প্রতি মোহের জন্য ক্ষমার অধিকারী যে কোনো সংগঠনের প্রতি শ্ৰেষ্ঠ গুণের জন্য খ্যাতি বিপজ্জনক এবং পরিণামে তা নিশ্চিতভাবে অপরিনামদর্শী নির্মমতার ভেতর শ্রেষ্ঠত্বের জন্ম দেয়। জাগতিক বস্তুর ব্যাপারে ঘৃণা প্রচার করে চার্চ এবং এভাবে কর্তৃত্ব অর্জন করে রাজপুরুষের উপর। দারিদ্র্যব্রত পালন করে খ্রিস্টান ভিক্ষুরা। এর ফলে বিশ্ব এতই প্রভাবিত হয় যে, এর আগে অর্জিত চার্চের প্রভূত সম্পদ আরও বৃদ্ধি পায়। ভ্রাতৃপ্রেম প্রচারের মাধ্যমে বিজয়মণ্ডিত দীর্ঘ ও নৃশংস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন সেইন্ট ফ্রান্সিস। পরিশেষে রেনেসাঁ চার্চের ক্ষমতা ও সম্পদের উৎস সব নৈতিক উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে এবং প্রয়োজন দেখা দেয় আকস্মিক সংস্কারের জন্যে পুনর্জাগরণ পুনরুদ্ভাবনের।
এর সবই অপরিহার্য হয়ে পড়ে যখন কোনো সংগঠনের উদ্দেশ্যে উৎপীড়নমূলক ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে সদ্গুণ ব্যবহৃত হয়।
প্রথাগত ক্ষমতার পতন সর্বদাই বিদেশি শক্তির দ্বারা বিজিত হওয়া ছাড়া ওইসব ব্যক্তির দ্বারা এর অপব্যবহারের ফল। মেকিয়াভেলির মতো এমন ভাবা হতো যে মানুষের মনে এর অবস্থান এত দৃঢ় যে এর অপসারণ অসম্ভব চরম অপরাধমূলক ব্যবস্থার দ্বারাও।
পোপের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হতো মধ্যযুগে। বর্তমানকালে যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিমকোর্টের প্রতি সেই সম্মান দেখানো হয় অনুরূপভাবে গ্রিকরা দৈববাণী প্রকাশের স্থানের প্রতি যে সম্মান দেখাত। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের কার্যকরিতা সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছেন এমন অনেকেই জানেন যে সুপ্রিমকোর্ট ধনতন্ত্র সংরক্ষণে নিয়োজিত শক্তিগুলোর একাংশ। কিন্তু এগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত মানুষের প্রতি সম্মান হাসের ব্যাপারে কিছুই করেন না। আবার কিছু সংখ্যক মানুষ আছে যারা সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের চোখে বিধ্বংসী ও বলশেভিক হওয়ার জন্য ঘৃণিত ও কলঙ্কিত। লুথারের মতো সংবিধানের সরকারি ব্যাখ্যাদানকারী কর্তৃপক্ষের উপর কেউ সফল আক্রমণ চালানোর আগে তার জন্য প্রয়োজন হবে স্পষ্টভাবে পক্ষভুক্ত মানুষ সংগ্রহের জন্য বেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করা।
ধর্মীয় ক্ষমতা ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষমতার চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে। এ কথা সত্য যে, ধর্মীয় রাজনৈতিক বিপ্লব শুরু হয় রাশিয়া ও তুরস্কে মহাযুদ্ধের পর। কিন্তু উভয় দেশেই রাষ্ট্রের সাতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল প্রথাগত ধর্ম। পঞ্চাশ শতাব্দীতে বর্বরদের উপর চার্চের বিজয় যুদ্ধে পরাজয় সত্ত্বেও ধর্মীয় ভাবধারা বজায় রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। সেন্ট অগাস্টিন রোম লুণ্ঠনের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত সৃষ্টিকর্তার শহরে ব্যাখ্যা দেন যে, প্রকৃত বিশ্বাসীদের কাছে অঙ্গীকার করা হয়নি জাগতিক ক্ষমতা এবং তাই তা আশা করা হয়নি ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলস্বরূপ। সাম্রাজ্যে অস্তিত্বশীল পৌত্তলিকরা যুক্তি প্রদান করে যে, রোম পরাজিত হয় দেবতাদের পরিত্যাগ করার জন্যেই। কিন্তু আপাত সত্য মনে হলেও এ ধরনের যুক্তি সাধারণ সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। পরাজিতের উন্নত সভ্যতা বিস্তার লাভ করে আক্রমণকারীদের ভেতর এবং খ্রিস্টীয় বিশ্বাস গ্রহণ করে বিজয়ীরা। বর্বরদের ভেতর এভাবে রোমের প্রভাব বজায় থাকে চার্চের মাধ্যমে। প্রাচীন সংস্কৃতির ভিত হিটলারের আগে কেউই টলাতে পারেনি।