যাচ্ছেতাই লেখা লিখছি
পরিণত বয়সে খ্যাতি ও সমৃদ্ধির চূড়ান্ত শিখরে উঠে মহামতি পিকাসো এক করুণ স্বীকারোক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “মানুষ এখন অর শিল্পের মধ্যে সমবেদনা বা অনুপ্রেরণার খোঁজ করে না। সংস্কৃতিবান মানুষেরা, যাঁরা ধনী, অলস, বেহিসাবি, গোলমেলে তাঁরা সব সময়ই নতুন কিছু চান, অসাধারণ কিছু চান। এবং আমিও গতিক বুঝে সেই কিউবিসম-এর যুগ থেকে এই সব লোককে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছি। অবাস্তব বিমূর্ত হিজিবিজি অর্থহীন যা কিছু আমার মাথায় এসেছে তাই দিয়ে।
এই লোকগুলি যত কম বুঝতে পেরেছে, তত আমার প্রশংসা করেছে। আমি নিজেকে এ রকম সব নিরর্থক খেলায় নিযুক্ত করেছিলাম। এবং এই সব ছবির গোলকধাঁধা ও জটিল হিজিবিজিতে যা হওয়ার তাই হল। আমি বিখ্যাত হয়ে গেলাম খুব দ্রুত। এ যুগে ছবির জগতে একজন সেলিব্রিটি মানে অগাধ অর্থ, প্রচুর বিক্রি, প্রচুর আয় ও সম্পদ।
এখন সবাই জানে আমি অতি বিখ্যাত এবং ধনী। কিন্তু যখন আমি নিজের সঙ্গে থাকি, তখন আমার সাহস হয় না নিজেকে শিল্পী বলে ভাবতে। আজ আমি বুঝি আমি সামান্য এক জনচিত্ত মনোরঞ্জনকারী, যে জানে, যে বুঝতে পেরেছে জনসাধারণ কী চায়।”
শুধুমাত্র পিকাসোই এ ধরনের কথা বলতে পারেন। জীবনবোধের কোন পর্যায়ে চলে গেলে মানুষ এ রকম সাহসী ও বিনয়ী হতে পারে। আমাদের প্রধান শিল্পী-সাহিত্যিকরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেকে কেষ্ট-বিস্টু ভাবেন। সবাই অমরত্বের সিঁড়ি ধরে দ্রুত গতিতে উঠে যাচ্ছেন। কারও মনে কোনও গ্লানি নেই।
কোথায় কবে পিকাসোর এই উদ্ধৃতিটা পেয়েছিলাম, সে এখন আর মনে নেই। বহুকাল মানিব্যাগের মধ্যে ছিল।
মানিব্যাগ বদলের সময় টাকা-পয়সা খুচরো কাগজপত্র সুদ্ধ পরের মানিব্যাগ-এ চলে এসেছে। আগে কখনও কখনও খুলে পড়তাম। আমার নিজের দুর্দশা দেখে মন খারাপ হত, চোখে জল আসত। এবার মানিব্যাগ বদলানোর সময় কাগজটা আবার চোখে পড়ল। খুবই জীর্ণ অবস্থা। ভাজা পাঁপরের মতো।
আমি পিকাসো নই। পিকাসোর প্রতিভা কণামাত্র আমার নেই। তাঁর মতো প্রতিভা ভারতীয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভাগ্যে কখনও জুটবে কি না সন্দেহ। কিন্তু এই লেখাটুকু পড়তে পড়তে এর বক্তব্যের সঙ্গে আমি আমার মনের মিল খুঁজে পাই।
আমিও তো এক প্রতারক লেখক। জনপ্রিয়তার লোভে সারা বছর ধরে, বছরের পর বছর, আবার বছরের পর বছর সেই একঘেয়ে যাচ্ছেতাই লেখা লিখে যাচ্ছি। বোকা বোকা বস্তাপচা রসিকতা করে যাচ্ছি। আমার নিজের উপর কেমন মায়া হয়। এইরকম লেখার কথা কি ছিল? কী লিখতে চেয়েছিলাম? কী লিখলাম?⋯
…এই পর্যন্ত লিখেছি এই সময় গঙ্গারাম এসে উদ্ধার করল। গঙ্গারাম প্রশ্ন করল, ‘সেই জগৎজয়ী লেখকের কথা মনে আছে, যিনি বলেছিলেন বিশ পঁচিশটা বই লিখে আমি টের পেলাম আমার কোনও প্রতিভা নেই। লেখক হিসাবে আমি অযোগ্য।’
তারপর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘তা হলে লিখছেন কেন? লিখে যাচ্ছেন কেন?’ তিনি দঃখের হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘কী করব। কোনও উপায় নেই, আমি যে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছি, জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছি’।”