যাচ্ছেতাই ডাকাত
একটা কালো রঙের গাড়ি খুব জোরে এসে যেই বেঁকল বাঁ দিকে অমনি ধাক্কা লাগল একটা সাইকেল ভ্যানের সঙ্গে৷ ভ্যানটা তো উলটে গেল বটেই, গাড়িটাও ঘুরে গিয়ে উঠে গেল ফুটপাথে৷ একটা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে লেগে গাড়িটার রেডিয়েটার ফেটে জল পড়তে লাগল ঝরঝর করে৷
এরকম দুর্ঘটনা হলেই রাস্তায় ভিড় জমে যায় কিন্তু তার আগেই ঝড়ের বেগে গাড়ি থেকে নেমে এল চারজন লোক৷ তারা চারজনেই পরে আছে খাকি প্যান্ট ও কুচকুচে কালো রঙের শার্ট৷ মুখে রুমাল বাঁধা৷ পরপর তিনটে বোমা ফাটাল৷
ঠিক মোড়ের মাথায় পাঁচতলা বাড়ির ছাদে টেনিস বল নিয়ে ফুটবল খেলছিল টোটো আর তার বন্ধুরা৷ মাঝে মাঝেই বলটা রাস্তায় পড়ে যায়৷
তখন যে বলটা ফেলেছে, সে ছুটে নেমে যায় বলটা আনতে, আর অন্যরা পাঁচিলের কাছে এসে উঁকি দিয়ে রাস্তাটা দেখে৷
সাইকেল ভ্যান আর কালো গাড়িটার ধাক্কা লাগার ঠিক আগের মুহূর্তেই টোটোদের বলটা পড়েছে রাস্তায়৷ টানটু দৌড়েছে বলটা আনতে আর টোটোরা সাতজন রয়েছে পাঁচিলের ওপর ঝুঁকে৷ সেই জন্য ওপর থেকে ওরা সব ব্যাপারটা দেখল৷
গাড়ি থেকে নেমেই যারা বোমা ছোড়ে, তারা নিশ্চয় ডাকাত৷ তার ওপরে ওদের মুখে আবার মুখোশের মতন রুমাল বাঁধা৷ একজনের হাতে ভোজালি আর একজনের হাতে কালো মতন একটি রিভলভার৷
প্রথম বোমার আওয়াজটা হতেই ওরা সবাই ভয় পেয়ে পেছিয়ে এসেছিল পাঁচিল থেকে৷ আবার ছুটে ফিরে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে৷ পরের দুটো বোমা ফাটার সময় ওরা ভয় পেল না৷ বরং টোটো তার বন্ধুদের সঙ্গে চোখাচোখি করল৷ প্রত্যেকেরই চোখ বড় হয়ে গেছে আর ভুরু উঠে গেছে উঁচুতে৷ অর্থাৎ সত্যি সত্যি ওরা জ্যান্ত ডাকাতদের দেখেছে? ডাকাতরা সত্যি সত্যি ওদের চোখের সামনে বোমা ফাটাচ্ছে৷ ঠিক যেমন বইতে পড়া যায়৷
বোমাগুলোর আওয়াজ যেমন সাঙ্ঘাতিক, সেই রকমই ধোঁয়া৷ ওপর থেকে টোটোদের মনে হল একটা মেঘ যেন রাস্তা ঢেকে দিয়েছে৷ তবে ডাকাতরা যে ট্রাম লাইনের মোড়ের দিকে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে ঠিকই৷ মেঘের তলা থেকে চারজনকে বেরিয়ে আসতে স্পষ্ট দেখতে পেল টোটো-রা তারপর সেখানে আর একটা বোমা ছুড়ে তারা আবার একটা মেঘ তৈরি করল৷
বাবুন বলল, টানটুটা যদি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে?
টোটো বলল, ইস ডাকাতরা তো আমাদের বাড়ি অ্যাটাক করল না? তবে কোন বাড়ি অ্যাটাক করবে বল তো?
রণ বলল, নিশ্চয়ই মোড়ের মাথায় যে গয়নার দোকানটা আছে…
টোটো বলল, ওই দ্যাখ! ছোটকাকা!
ট্রাম লাইনের মোড়ের দিক থেকে হেঁটে আসছেন টোটোর ছোটকাকা, বোমার আওয়াজে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন৷
বাবুল বলল, আরিব্বাস! এইবার কী হবে দ্যাখ৷ পুলিশ এসে গেছে৷
টোটো বলল, দারুণ ফাইট হবে, ডাকাত আর পুলিশের৷
রণ বলল, যদি আমাদের গায়ে গুলি লাগে? আয় আমরা পাঁচিলের আড়ালে বসে পড়ি৷
অন্য কেউ অবশ্য তার কথা গ্রাহ্য করল না৷ বরং কৌতূহল নিয়ে দেখতে লাগল আরও ঝুঁকে৷
পাঁচতলার ছাদ থেকে ট্রাম লাইনের মোড় পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়৷ এখান থেকে প্রায় পঁচিশ-তিরিশখানা বাড়ি দূরে৷ সেখানে পুলিশের গাড়িটা এসেই থেমে গেল৷ তার থেকে টপাটপ সাত-আটজন পুলিশ নেমে সার বেঁধে দাঁড়াল৷ একজন অফিসার রিভলভার সমেত ডান হাত তুলে কী যেন চেঁচিয়ে বললেন৷ তা শোনা গেল না৷
ডাকাতরা আরো চারটে বোমা ফাটাল পরপর৷ সেগুলো পুলিশের গায়ে লাগল না কার গায়ে লাগল তা বোঝা গেল না৷ গোটা রাস্তা ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার৷ তারপর সব চুপচাপ৷ তার মানে বোমা কিংবা গুলিটুলির শব্দ আর কিছু শোনা গেল না কিন্তু অনেকের চেঁচামেচি শোনা যেতে লাগল ঠিকই৷
বাবুল বলল, ডাকাত নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছে৷
টোটো বলল, অত সোজা নয়৷ ডাকাতরা শেষ পর্যন্ত ফাইট না করে ধরা দেয় না৷
ধোঁয়া একটু কেটে যেতে দেখা গেল রাস্তায় একদিকে ভিড় করে আছে অনেক লোক৷ আর একদিক থেকে অশ্বক্ষুরের মতন লাইন করে এগিয়ে আসছে পুলিশরা, মাঝখানে কেউ নেই৷
টোটো বলল, এ কি, ডাকাতরা কোথায় গেল?
বাবুল বলল, ডাকাতগুলো হাওয়া?
কারুকে কিছু না বলে টোটো ছুটল সিঁড়ির দিকে৷ অন্যরাও দুদ্দাড় করে অনুসরণ করল তাকে৷ প্রায় হুড়মুড় করে ওরা নেমে এল নীচে৷ কিন্তু বাইরে বেরুতে পারল না৷
ওদের ফ্ল্যাট বাড়ির দরজার কাছে বেশ ভিড়৷ দারোয়ান ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে৷ কারুকে রাস্তায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না৷ টানটু গোবেচারা মুখ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ বন্ধুদের দেখেই কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল, দেখ না আমায় বাইরে যেতে দিল না, তাই বলটা আনতে পারিনি৷
বাবুল দারোয়ানকে বলল, এখন দরজা খুলে দাও না, ডাকাতরা চলে গেছে৷
সব ফ্ল্যাট বাড়িতেই যেমন একজন লোক থাকে যে নিজে নিজেই সকলের গার্জেন হয়ে যায়, এ বাড়িতেও সেরকম আছেন রাজেনবাবু৷ তিনি ধমক দিয়ে বললেন, না, দরজা খুলবে না৷ বাইরে পুলিশ ফায়ারিং করছে৷
টোটো তার দলের দিকে ইশারা করল চোখ দিয়ে৷ অর্থাৎ ছাদে৷ একটা দমকা হাওয়ার মতন ওরা ফের উঠে এল ছাদে৷ পাঁচিলের কাছে এসে উঁকি মেরে দেখল, তিন দিকের রাস্তা দিয়ে পিলপিল করে লোক ছুটে আসছে এ পাড়ার দিকে, সেই ভিড়ে পুলিশরা এলোমেলো ভাবে ঘুরছে, কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে অ্যাকসিডেন্ট করা কালো গাড়িটার পাশে৷
ডাকাতদের কিন্তু সত্যি আর খুঁজে পাওয়া গেল না৷ তারা যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে৷
রণ বলল, ধুস, কোনো ফাইট-ই দেখতে পেলুম না৷ শুধু কয়েকটা বোমার আওয়াজ৷
বাবুল বলল, পুলিশগুলো কী রে, গুলি করতে পারল না?
সুদীপ কম কথা বলে৷ সে বলল, গুলি করেছিল৷ ফাটেনি!
অজয় বলল, ডাকাতগুলো কোথায় গেল বল তো৷ নিশ্চয়ই এ পাড়ারই কোনো বাড়িতে ঢুকে পড়েছে৷
টোটো বলল, আমাদের দারোয়ানটা ক্যাবলা৷ আগেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে৷ নইলে ডাকাতরা বেশ আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পারত!
বাবুল বলল, ওই তিনতলার রাজেনবাবুটার জন্যই তো! নইলে আমরা বেশ কাছ থেকে ডাকাতদের দেখতুম৷
রণ বলল, এ বাড়িতে ঢুকলে যদি আমাদের মারত?
টোটো বললে, অত সোজা নয়৷ আমরা বুঝি মারতে জানি না!
দড়াম করে শব্দ হল ছাদের দরজায়৷ দু’জন পুলিশ ওপরে উঠে এসেছে৷ তার একজনের হাতে রিভলভার৷
ওদের কিছু জিজ্ঞেস না করেই পুলিশ ঘুরে দেখল সারা ছাদ৷ জলের ট্যাঙ্কের তলায় উঁকি মারল৷ তারপর আবার ফিরে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে গিয়ে একজন বলল, খোকা, তোমরা কিছু দেখেছ? কোন বাড়ি লোক ঢুকেছে…কিংবা কোন দিক দিয়ে পালাল…
ওদের মধ্যে কে প্রথমে উত্তর দেবে, তাই সবাই সবার মুখের দিকে তাকাল৷ টোটো ওদের লিডার৷ কিন্তু পুলিশ এসে প্রথমেই ওদের কিছু জিজ্ঞেস না করে ছাদ খুঁজে দেখেছে বলে টোটো চটে গেছে৷ সে বলল, রাস্তায় দুটো হাইড্রেনের ঢাকনা নেই৷ দেখুন৷ ওর মধ্যেই ঢুকে পড়েছে নিশ্চয়ই৷
একঝাঁক পাখির ডাকের মতন ওরা হেসে উঠল একসঙ্গে৷
রিভলভার-হাতে পুলিশ অফিসারটি এবারে এগিয়ে এসে ওদের পাশ দিয়ে উঁকি মারল রাস্তায়৷ অন্য পুলিশটি টোটোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে ভালো করে দেখল৷ তারপর বলল, পাকা ছেলে, অ্যাঁ? কোন ক্লাসে পড়ো?
টোটো বলল, ক্লাস এইট!
কোন স্কুল?
বালিগঞ্জ গভমেন্ট৷
নাম কি তোমার?
তিমিরবরণ সেন৷
তোমরা অনেকক্ষণ থেকে ছাদে আছো?
হ্যাঁ৷
তোমায় থানায় যেতে হবে৷ তোমাকে স্টেটমেন্ট দিতে হবে৷
টোটো সগর্বে বন্ধুদের দিকে তাকালে৷ আজ সকালে সে কার মুখ দেখে উঠেছে? এতবড় সম্মান দেওয়া হচ্ছে তাকে৷ এখন তাকে পুলিশের সঙ্গে থানায় গিয়ে ডাকাত ধরার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে৷
রিভলভার হাতে পুলিশটি বলল, না, না, এইটুকু ছেলেকে থানায় নিয়ে যাবার কী দরকার! যা জিজ্ঞেস করার এখানেই….৷
টোটো খুব বিরক্তভাবে সেই পুলিশটির দিকে তাকায়৷ এ লোকটা তো বড্ড বোকা৷ টোটো থানায় যেতে রাজি আছে, তাও বলে কিনা নিয়ে যাবার দরকার নেই৷ টোটোও জানে, কী করে এদের শায়েস্তা করতে হয়৷
সেই পুলিশটি বলল, তোমরা এখান থেকে ঠিক দেখেছ, বলো তো?
টোটো উদাসীন ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ঘুড়ির প্যাঁচ লড়া দেখছিলুম!
বোমার শব্দ শুনে রাস্তার দিকে দেখোনি?
ওগুলো বোমা বুঝি? আমি তো ভেবেছিলুম কালীপটকা৷
অন্য পুলিশটি বলল, দেখলেন তো কীরকম বিচ্ছু ছেলে? থানায় না নিয়ে গেলে মুখ খুলবে না৷
বাবুল বলল, শুধু ধোঁয়া দেখেছি৷
সেই পুলিশটি এবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তাহলে একজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া যাক৷ এখান থেকে খুব ক্লিয়ার ভিউ পাবার কথা৷
টোটোকে কিন্তু তখুনি থানায় নিয়ে যাওয়া হল না৷ একজন পুলিশ তার ছোটকাকাকে বলে গেল টোটোকে নিয়ে তৈরি থাকতে৷
দু’ঘণ্টা ধরে পাড়ায় সমস্ত বাড়ি সার্চ করা হল৷ কাগজের লোক এসে ছবি নিল কালো গাড়িটার৷ সাইকেল ভ্যানটার মালিকের গায়ে একটু-আধটু চোট লেগেছে, বেশি ক্ষতি হয়নি৷ তবে তার ভ্যানের ভেতরের একুশটা মুর্গির ডিম ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে৷ ডাকাতদের বোমার আঘাতেও কেউ আহত হয়নি৷ ওরা আসলে ধোঁয়ার আড়ালে পালাবার জন্যই বোমা ছুড়েছিল৷
কিন্তু ডাকাতগুলো পালাল কী করে? একদিকে ছিল পুলিশ, আর একদিকে অনেক লোকের ভিড়, সে দিক দিয়ে যে ডাকাতরা পালায়নি, তা সবাই বলেছে একবাক্যে৷ কোনো বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে৷ কিন্তু এ পাড়ায় সব ভালো ভালো লোক থাকে, কেউ তো ডাকাতদের আশ্রয় দেবে না৷ আর, কোনো বাড়ির মধ্যে জোর করে ঢুকে পড়লেও একেবারে উবে যাবে কী করে?
ডাকাতদের সম্পর্কে শোনা গেল কতরকম যে গল্প! কেউ বললে, ওরা চম্বলের ডাকাত৷ কেউ বলল, দিল্লির৷ কেউ বলল, ওরা ব্যাঙ্ক ডাকাত, কেউ বলল, একটু আগে পাঁচটা খুন করেছে৷
একমাত্র টোটোর ছোটকাকাই পুলিশের কাছ থেকে শুনে এসেছেন পাকা খবর৷ এরা একেবারে নভিস ডাকাত৷ আর ওদের ভাগ্যটাও খারাপ৷ ওরা নিউ আলিপুরে একটা ব্যাঙ্কে ডাকাতি করতে ঢুকেছিল, কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি৷ ব্যাঙ্কের কর্মচারী ও পাড়ার লোকেরা ওদের দু’জন সঙ্গীকে ধরে ফেলে৷ বে-গতিক দেখে বাকিরা গাড়িতে উঠে পালাচ্ছিল৷ কিন্তু কাছেই ছিল একটা পুলিশের গাড়ি৷ সেই গাড়ি ওদের তাড়া করল৷ কলকাতার অনেক রাস্তা ঘুরে শেষ পর্যন্ত এ পাড়াতেই অ্যাকসিডেন্ট করল ওদের গাড়ি৷
তারপর যে কী করে ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার৷
টোটোদের আর খেলা হল না৷ টানটুর সঙ্গে ওরা সবাই মিলে অনেক খুঁজেও আর টেনিস বলটা পায়নি৷ এত লোকের ভিড়ে কে বলটা নিয়েছে কে জানে৷ টানটুর খুব মন খারাপ হয়ে গেছে৷ যার জন্য বল হারায়, তাকেই পরের বলটা কিনে দিতে হয়৷ বেচারা টানটু, গত সপ্তাহেই ওর আর একটা বল হারিয়েছিল৷
টোটো ভেবেছিল সে একলা একলা পুলিশের গাড়ি চেপে বীরের মতন থানায় যাবে৷ পাড়ার সব লোক তাকে দেখবে৷ সেরকম কিছুই হল না৷ পুলিশের গাড়ি চলে গেল আগেই৷ সন্ধেবেলা ছোটকাকা মিনিবাসে করে টোটোকে নিয়ে গেলেন লালবাজারে৷
বাস থেকে নেমে ছোটকাকা বললেন, কী ঝামেলা পাকালি বল তো! এখন কতক্ষণে ছাড়বে কে জানে! কেন ছাদে খেলতে গিয়েছিলি! আমি তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে, পুলিশ আমাকে ধরল না, আর তোকে ধরল!
টোটো গম্ভীরভাবে বলল, তুমি রাস্তায় থাকলেও তুমি তো কিছু দেখতে পাওনি৷ আমি সব দেখেছি৷
তুই দেখেছিস? কী দেখেছিস?
এখন বলব না৷ পুলিশ কমিশনারের কাছে বলব৷
টোটো আশা করেছিল, লালবাজারে তাকে দেখা মাত্র হৈ হৈ পড়ে যাবে৷ বড় বড় সব পুলিশ অফিসাররা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে৷ সে এলেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে একটা গোপন ঘরে৷ সেখানে বড় বড় ফ্লাড লাইট জ্বলছে৷
কিন্তু লালবাজারে অনেক ভিড়৷ কেউ কাউকে গ্রাহ্য করছে না৷ ছোটকাকা অনেক খুঁজে খুঁজে অ্যান্টি ডেকইটি বিভাগে গেলেন৷ সেখানেও অনেক লোক, তার মধ্যে টোটোদের পাড়ারও কয়েকজন আছে৷
একটা ঘরের মধ্যে কাকে যেন জেরা করা হচ্ছে, আর সবাই অপেক্ষা করছে বাইরে৷ সকলের বসবারও জায়গা নেই৷ একটা মাত্র বেঞ্চ, অনেকের সঙ্গে টোটোকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হল৷ কতক্ষণ পরে যে তার ডাক আসবে তার ঠিক নেই৷
এক ঘণ্টার বেশি সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেটে গেল৷ আর ছোটকাকা ক্রমেই বিরক্ত হতে লাগলেন৷ একবার তিনি বললেন, আমার কি ইচ্ছে করছে জানিস, টোটো? তোকে এখানে জেলে পুরে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাই৷
টোটোর মনের তেজও অনেক কমে গেছে এতক্ষণে! সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, বাঃ, আমার কী দোষ?
একটু পরেই দারুণ একটা হৈ হৈ পড়ে গেল৷ ছোটাছুটি করতে লাগল অনেকে৷ কে যেন বলল, ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে!
সত্যিই কয়েকজন পুলিশ গোল করে ঘিরে নিয়ে এল সেই চারজন ডাকাতকে৷ এখন অবশ্য তাদের পোশাক অন্য৷ তারা পরে আছে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি৷ এই পোশাকের জন্যই বোধ হয় তাদের বেশ ছোট দেখাচ্ছে৷ মনে হয় যেন কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে৷ একজনের বয়েস তো আঠেরোর বেশি হতেই পারে না!
ছোটকাকা বললেন, যাক বাঁচা গেল! আর তো দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই৷ এবারে বাড়ি যাওয়া যাবে!
টোটো নিরাশ ভাবে বলল, আমায় কিছু জিজ্ঞেস করবে না?
ছোটকাকা ভেংচি কেটে বললেন, ডাকাত ধরা পড়ে গেছে, এখনো কি তুই পলিশকে সাহায্য করতে চাস নাকি? তুই এখানে দাঁড়া, আমি গল্পটা শুনে আসি কী করে ওরা ধরা পড়ল৷
সেই ঘরটার দরজার কাছে এখন অনেকে ভিড় করেছে৷ একজন সেপাই চেঁচিয়ে বলছে, হঠ যাও! তবু কেউ সরছে না অবশ্য৷ ছোটকাকা ঢুকে গেলেন সেই ভিড়ের মধ্যে৷
একটু বাদে ফিরে এসে বললেন, জলের মতন সোজা! আমিও তাই ভেবেছিলুম, বুঝলি৷ ওরা ঢুকেছিল চ্যাটার্জিদের বাড়িতে৷ ওদের উঠোনের পেছনে একটা পাঁচিল আছে না? সেটা ডিঙিয়ে ওরা চলে যায় পেছনের বস্তিতে৷ ও বাড়ির একটা বুড়ি ঝি ওদের দেখেছিল, ভয়ে কিছু বলেনি আগে৷ বস্তিতেও কিন্তু ওরা থাকেনি৷ জানে তো পুলিশ বস্তিতেও খুঁজবে৷ তবে বেশিদূর যেতে সাহস পায়নি৷ বস্তির সামনেই যে বাজার তার একটা ঘরে ঢুকে বসেছিল৷ ডাকাত না ক্যাবলাকান্ত! যাচ্ছেতাই! চল, বাড়ি চল৷
ছোটকাকাও টোটোর হাত ধরে সবে মাত্র টেনেছিল৷ এমন সময় টোটো দেখতে পেল সেই রিভলভার হাতে পুলিশটাকে৷ কাকে যেন ভিড়ের মধ্যে খুঁজছে৷ এখন অবশ্য তার হাতে রিভলভার নেই, মুখখানিও বেশ খুশি খুশি৷
টোটোকে দেখতে পেয়েই সে এগিয়ে এসে বলল, তোমরা ছাদে টেনিস বল খেলছিলে না? বলটা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল৷ তারপর খুঁজে পেয়েছিলে?
টোটো দু’ দিকে মাথা নাড়ল৷
পেছনে লুকোনো একটা হাত সামনে এনে পুলিশটি বললেন, এই নাও তোমাদের বল৷ ডাকাত ছেলেগুলোকে সার্চ করে এই বলটা আমরা পেয়েছি৷ আজ তো সারাদিনে ওদের কোনো রোজগার হয়নি৷ তাই ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে ছোট সে রাস্তা থেকে এই বলটা কুড়িয়ে নিয়েছিল৷ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ! ছোকরা নিজে আমার কাছে স্বীকার করেছে, হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ!
টোটো ছোটকাকার দিকে ফিরে ভারিক্কি চালে বলল, আমার জন্যই ওরা ধরা পড়ল কি না, সেটা দেখলে তো!
—