যাচাই

যাচাই

গোরুরগাড়ি ঢুকল চাঁদপুর গ্রামের মধ্যে। ননীবালা ছেলেকে বললে—বাবা, চেয়ে দ্যাখো

—ঘুমুইনি মা। চেয়ে আছি–

—এই গাঁয়ের সীমানা। ওই গেল দুলেপাড়া—

—ব্রাহ্মণপাড়া কতদূর?

—আরও আগে।

ননীবালার সারা দেহেমনে একটি অপূর্ব অনুভূতির শিহরণ!

মনে পড়ল আজ ত্রিশ-বত্রিশ বছর পূর্বে একদিন এই গ্রামে নববধূরূপে ঢুকবার সেই দিনটির কথা। তিনি ছিলেন পাশে—আজ যেমন ছেলে সুরেশ তার পাশে বসে রয়েছে। তেমনি মুখচোখ, তেমনি চোখের দৃষ্টি, বয়েসও তাই।

চাঁদপুর গ্রামে ঢুকবার কিছু পরেই কাক-কোকিল ডেকে ভোর হয়ে গেল। সুরেশ গাড়ি থেকে নেমে গাঁয়ের পথের ধুলো তুলে মাথায় দিলে। মাকে বললে—তোমরা কতদিন গাঁ থেকে গিয়েছিলে?

—তোর বয়েস।

—একুশ বছর?

—হ্যাঁ। ওঁর ইস্কুলের চাকরি গেল—আমরা এখানকার মায়া কাটালুম।

–বাবা দুঃখ করেননি?

—আহা! মরবার আগেও প্রায়ই বলতেন—বড়ো বউ, একবার যদি চাঁদপুর যেতে পারতাম ফিরে, তবে বোধহয় কিছুদিন আরো বাঁচতাম। ওখানে এখনো চৈত্র মাসের দুপুরে বুড়িমা কুলচুর শুকুচ্চে রোদুরে। বাঁশবনে কত কোকিল পাপিয়া ডাকচে। আমি গাঁয়ে যাব। শহরের ছোট্ট বাসার মধ্যে উনি চিরকাল হাঁপিয়ে এসেছেন। আর তেমনি গরম সেখানে।

—আমি যদি তখন বড়ো হতাম, বাবাকে বাবার জন্মভূমিতে ঠিক নিয়ে আসতাম বলে দিচ্চি।

সুরেশ ছিপছিপে চেহারার শক্ত হাতপাওয়ালা যুবক। ফুটবল খেলে ভালো। দেশ স্বাধীন হবার পরে রাইফেল ক্লাবে যোগ দিয়ে খুব রাইফেল ছোড়া অভ্যেস করচে। এইবার রেলের শিক্ষানবিশি শেষ করে ভালো চাকুরি একটা পাবে। শিক্ষানবিশির সময়েই ও খেলোয়াড় হিসেবে রেলের উপনিবেশের শহরটির অনেক বড়ো বড়ো অফিসারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। শিক্ষানবিশির ছাত্রও সে ভালো—অঙ্ক বেশ ভালো জানে বলে অঙ্কের টুইশানিতে মাসে আজকাল সত্তর-আশি টাকা রোজগার করে।

স্বামী মারা গিয়েচেন আজ দশ-এগারো বছর। সুরেশ তখন দশ বছরের ছেলে, নীচের ক্লাসে পড়ে। কী আতান্তরেই ফেলে গিয়েছিলেন সেদিন! মনে হয়নি যে আবার একদিন এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারা যাবে! রেল উপনিবেশের সকলেই খুব দয়া করলেন। একটা বাসা দেখে দিলেন, কারণ রেলের কোয়াটার ছাড়তে হল, ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি রায় বাহাদুর হরিচরণ বসু নিজে দেখাশোনা করলেন। সুরেশের লেখাপড়া যাতে বন্ধ না-হয়, যাতে এ গরিব অসহায় পরিবারটি অনাহারের পথ থেকে রক্ষা পায়—এ সমস্তই ওখানকার বড়ো বড়ো লোকেরা করলে। সে-সব দিনের কথা ভাবলে জ্ঞান থাকে না। এমন দিনও আসে মানুষের জীবনে!

আজ মনে হচ্চে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে এসে অদূরে এবার কুলরেখা যেন দেখা দিয়েছে। ওরা সবাই বলে আমাদের দেশ এখন স্বাধীন, আর সে-যুগের মতো কষ্ট করতে হবে না। এখন ছেলেপিলেদের ভালো চাকুরি হবে, চাকুরিতে উন্নতি হবে, আগের মতো অল্প মাইনেতে ঘষটাতে হবে না। না-খেয়ে মরবে না কেউ এ স্বাধীন। ভারতের মাটিতে। অনেক বড়ো বড়ো আশার কথা সে শুনেচে, ছেলে-ছোকরারা কত মিটিং করে, বক্তৃতা দেয়। গান্ধীজির ছবিতে মালা দিয়ে গান করতে করতে শহর ঘুরে বেড়াল এই তো সেদিন। তাঁর মৃত্যুর পরে সেদিন এক বৎসর বুঝি ঘুরল। সুরেশও চমৎকার গান গাইতে পারে। আর একটা গান গায় সুরেশ, গান্ধীজি নাকি বড়ো ভালোবাসতেন। সবাই বলে, রামধুন গান।

রঘুপতি রাঘব রাজারাম
পতিতপাবন সীতারাম।

ভোরের আলো বেশ ফুটেছে। সামনের পুরোনো কোঠাবাড়িটা থেকে একজন বার হয়ে এসে পথের ওপর দাঁড়িয়ে ওদের গোরুরগাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলে। ননীবালা চুপিচুপি বললে–ও সুরেশ, ওই বোধহয় তোর বিনোদ কাকা, ওঁর খুড়তুতো ভাই। আমি চিনেচি। তুই এগিয়ে যা। পরিচয় দিয়ে প্রণাম করবি। ওঁকেই চিঠি দেওয়া হয়েছিল।

মিনিট পনেরো কেটে গেল উভয়ের কথাবার্তায়—সুরেশ আর তার বিনোদ কাকার। তারপর বিনোদ কাকা এগিয়ে এসে ননীবালাকে আদর করে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলেন।

বহুদিন পরে গ্রামের বউ গ্রামে ফিরে এসেচে। আজ কুড়ি-একুশ বছর পরে। গ্রামের বউ-ঝি দেখা করতে এল এপাড়া-ওপাড়া থেকে। অভয় নাপিতের বউ এসে বললে–ও বউ, কেমন আছ? খোকা কই? কতবড়ো হয়েচে দেখি? দাঁড়াও, একটু পায়ের ধুলো দ্যাও দিনি আগে।

তারপর দুই পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে সে সামনে বসল।

অভয়ের বউকে দেখে ননীবালা যেমন আশ্চর্য হয়ে গেল তেমনি মনে মনে কেমন এক ধরনের দুঃখও হল। অভয়ের বউ তার চেয়ে অন্তত কুড়ি-পঁচিশ বছরের বড়ো, তার মার বয়সি, চুল অর্ধেক পেকে গিয়েছে—শুধু ধাত ভালো আছে বলে অত বয়েস বোঝা যায় না—কিন্তু অভয়ের বউ এখনো সধবা। পাকা চুলে সিঁদুর পরচে। অভয় নাপিত এখনো বেঁচে থাকবে সেটা ভেবে দেখলে এমন কিছু আশ্চর্যের কথা নয়, বড়ো জোর সত্তর-বাহাত্তর না-হয় তার বয়েস হয়েছে— কিন্তু–

এ ‘কিন্তুর’ কোনো সান্ত্বনা ননীবালা মনের মধ্যে খুঁজে পেলে না। ওঁর কি মরবার বয়েস হয়েছিল? পরদিন সে দেখলে, শুধু অভয় নাপিতের বউ নয় তার চেয়ে অনেক বড়ো বয়সে বউ এখনো দিব্যি সিঁদুর পরছে পাকা আধপাকা চুলে। কেন চলে গেলেন অল্পবয়সে ওদের বিদেশে ভাসিয়ে? গ্রামের মেয়েরা যখন দেখা করতে আসে, তখন বার বার ওই কথাটাই মনে হয় ওর।

ননীবালার শ্বশুরবাড়ি বিনোদ কাকাদের বাড়ির দক্ষিণ গায়ে। কুড়ি-একুশ বছর ধরে সে বাড়িতে কেউ না-থাকায় উঠোনে একগলা নোনা, ভাঁট, সেঁউতি লতার জঙ্গল, জংলি ডুমুরের বড়ো গাছে ডুমুর ফলচে পাঁচিলের মাথায়, জানলায় কাঁটালতা উঠে জানালার কবাট ঢেকে ফেলেছে।

সুরেশ কেবলই বলছিল, মা, আমাদের নিজের বাড়িতে চলে গিয়ে। গ্রামে এসে পরের বাড়িতে থাকব কেন? আজ তিন-চার দিনে জঙ্গল কাটিয়ে উঠোন পরিষ্কার করে তবে ননীবালা নিজেদের ভিটেতে ঢুকল।

মাত্র তিনখানি ঘর, দুটো বারান্দা দু-দিকে, ভাঁড়ার-রান্নাঘর আলাদা। কতকাল পরে আবার এ ভিটের মাটিতে সে পা দিল? দীর্ঘ একুশ বছর। এও তার জীবনে ঘটবার ছিল।

সুরেশ বলে—কই মা, আমার তো কিছু মনে নেই এ বাড়িতে থাকবার কথা?

ননীবালা বলে—দূর, তোর বয়েস যখন ন-মাস তখন এ বাড়ি ছেড়ে আমরা চলে যাই যে।

—এখন এখানে কিছুদিন থাকো মা। আমার বড় ভালো লাগছে।

—থাকতেই তো এলাম। এখন মা মঙ্গলচণ্ডী যা করেন।

ননীবালা সারাদিন ঘর ঝাড়ে পোঁছে সাজায়। আজ একুশ বছরের ধুলোর স্তর পড়েচে ঘরখানার ওপর। কেবলই ওর মনে পড়ছে আজকাল ওদের বিবাহিত জীবনের সেই মধুমাখা দিনগুলি—নববধূর নতুন স্বপ্ন মাখানো অপূর্ব রাত্রি ও দিনগুলি। উনি তখন একেবারে তরুণ, সে চোদ্দো বছরের কিশোরী।

ওই তো সেই কুলুঙ্গিটা। ওটাতে উনি একদিন রসগোল্লা এনে লুকিয়ে রেখে মজা করেছিলেন। একটা বিলিতি ওষুধের কাগজের বাক্সের মধ্যে রসগোল্লা ছিল লুকোনো। উনি বলেছিলেন—কি বলো তো ওতে?

প্রগলভা নববধূ বলেছিল—তোমার জিনিস তুমিই জানো। ও তো একটা বিলিতি ওষুধ।

–বাজি ফেলবে?

—অতশত আমি বুঝিনে। কী ওতে?

–রসগোল্লা।

—হাতি।

—গা ছুঁয়ে বলচি। এই দ্যাখো–ক-টা খাবে বলো।

তারপর দুজনে কাড়াকাড়ি করে সেই রসগোল্লা খেয়েছিল—ত্রিশ বছর আগের কথা। মনে হচ্ছে কাল ঘটেছে। এখানে বসে বড্ড বেশি করে স্বামীর কথা মনে পড়চে ননীবালার। সব ঘরে, সব বারান্দায়, প্রতি কোণে, ওই রান্নাঘরের খেতে বসবার বড়ো কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িখানায় ওর নববধূ-জীবনের স্মৃতি মাখানো। তরুণ স্বামী সেখানে ঘুরচেন এঘরে-ওঘরে, ও নিজে সেখানে ব্রীড়ান কুণ্ঠিতা কিশোরী বধূ, নতুন প্রেমের স্পর্শে দুরুদুরু বুক নিয়ে আলতাপরা পায়ে এঘরে ওঘরে গৃহকাজ করে বেড়াচ্চে নবীন উৎসাহ নিয়ে!

ননীবালার মনে হচ্চে যেন ওঘরে গেলেই দেখবে তিনি বসে আছেন তক্তপোশে, আবার ওঘরে থাকলে মনে হয় বুঝি এঘরে এলেই দেখা পাবে। আগেকার দিনের মতো লুকোচুরি খেলা এখনো কি চলচে?

একবার উনি নতুন ধানের শিষ নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন। বললেন—লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে রেখে দাও। নতুন জমির নতুন ধান। শাঁখ বাজাও, তুমি ঘরের লক্ষ্মী, শাঁখ বাজিয়ে অভ্যর্থনা করা নিয়ম তোমার।

ঠিক দুপুরের গমগম রোদে অলস নিমফুলের গন্ধের মধ্যে কতকাল আগের তাঁর কথাই মনে পড়ে। ননীবালা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে বাঁশঝাড়ের ঘন ডালের দিকে, কিন্তু মন তখন অতীত দিনের কোনো আবেশাতুর মুহূর্তটিতে স্থিরনিবদ্ধ। হয়তো সে-সময় ছেলে সুরেশ বলে ওঠে—মা, একটু খাবারজল দাও না। ননীবালা চমকে ওঠে ধ্যান ভেঙে, লজ্জা পায় পাছে ছেলে কিছু বা বুঝে ফেলে। ছেলেকে জল দিয়ে হয়তো কাঁথা সেলাই করতে বসে গেল, কিংবা নতুন পাড়া তেঁতুলের রাশ বঁটি পেতে কাটতে আরম্ভ করে দিলে।

অমনি মনে পড়ে যায় সেইসব দিনে এমন চৈত্রের দুপুরে—

বাড়ির পেছনের গাছের তেঁতুলের রাশ এমনি কাটতে বসেছিল একদিন।

উনি পেছন থেকে এসে চুপিচুপি বললেন—তেঁতুল কাটা রাখো। নুন দিয়ে নেবুপাতা দিয়ে তেঁতুল জরাও দিকি বেশ করে।

—চুপ। মা টের পাবেন। পালাও তুমি। তেঁতুল খেলে জ্বর হয়।

—ইস! উনি যেন আর খাবেন না, একলা আমি খাব কিনা। মা ঘুমুচ্চে। তুমি তাড়াতাড়ি ওঠো তো লক্ষ্মীটি। জিভে জল আসচে না তেঁতুলের নামে? সত্যি কথা বলো।

ননীবালাকে উঠে যেতে হয় কাটা তেঁতুল নিয়ে রান্নাঘরের দিকে। উনি বলেন —দাঁড়াও, আমি নেবুপাতা নিয়ে আসছি। তেঁতুলগুলো একটু ধুয়ে নিও, বড্ড বালি কিচকিচ করবে নইলে—

ননীবালা ধমকের সুরে বলে—হ্যাঁ গো হ্যাঁ। সর্দারি করতে হবে না। তেঁতুল ধুয়ে কেউ জরায় না। জিগ্যেস করো গিয়ে। পানসে হয়ে যায়।

দুজনে কাড়াকাড়ি করে সেই একতাল জরানো তেঁতুল খেয়ে ফেলে। পরদিনই ওঁর সর্দি আর গলাব্যথা, ননীবালা আঙুল তুলে কৌতুকের সুরে বলে—কেমন? বলেছিলাম না? কথা শোনা হল? আমার কথা শোনা হবে কেন—আমি কী আর কেউ?

—মাকে যেন কোনো কথা বোলো না—

—ঠিক বলে দেব। চালাকি বার করে দেব, দেখো। আর একটু তেঁতুল চলবে? নিয়ে আসব নুন-নেবুপাতা দিয়ে?

ননীবালার দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি মুছে ফেলে আঁচল দিয়ে, ছেলে পাছে টের পায়। আজ যদি তিনি থাকতেন! মরার বয়েস হয়নি তো। অনায়াসেই থাকতে পারতেন। আজ কী সুখের দিন তা হলে! খোকা এত বড়ো হয়েছে, যে দেখে সেই ভালো বলে। দু-দিন পরে মা মঙ্গলচণ্ডীর কৃপায় রেলে ভালো চাকরি করবে। উনি পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খান না কেন! আমরা তাঁকে কাজ করতে দিতাম না। আরাম করে খান না ছেলের রোজগার। এই দুপুরে বসে বসে কত গল্প করতাম দুজনে। ছেলের বউ সেবা করত, তেঁতুল জরিয়ে নিয়ে আসত।

পৃথিবীর পথে সে যেন একা।

সঙ্গী চলে গিয়েছে তাকে ফেলে।

দীর্ঘ পথ সামনে দুর থেকে বিস্তৃত। কে জানে কতদিন চলতে হবে এই টানা পথ বেয়ে?

না না, তার খোকা, তার সুরেশ আছে। বেঁচে থাক সে। তার ঘরকন্না গুছিয়ে দিতে হবে না? আজ বাদে কাল সুরেশের বিয়ে দিতে হবে। ছেলেমানুষ ওরা, সংসারের কী জানে? তাকেই গুছিয়ে দিতে হবে সব।

সুরেশ এসে বললে—মা, একটু তেঁতুল জরাও না? নুন দিয়ে, নেবুপাতা দিয়ে?

ননীবালা চমকে উঠে ছেলের তরুণ মুখের দিকে চেয়ে থাকে অবাক হয়ে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সে চোখের জল রোধ করলে।

ছেলে কী করে জানলে তার বাবা অবিকল এমনি সুরে, এমনি টান দিয়ে কথা বলত?

গ্রামে ফিরে আসা পর্যন্ত ওঁর প্রতি পদক্ষেপ যেন সে শুনতে পায়। কী জানি, কিছুই যেন ভালো লাগে না। সব যেন ফাঁকা, অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। কোনো কাজে আর উৎসাহ নেই।

 

একদিন ওপাড়ার হরিদাস চক্কত্তির বাড়ি সত্যনারাণের পুথি শোনা ও প্রসাদ খাওয়ার নিমন্ত্রণে সে-পাড়ার ঝি-বউদের সঙ্গে গেল। সেকেলে কোঠাবাড়ি, দালানে পুজোর জায়গা হয়েছে, মাদুর পেতে দেওয়া হয়েচে নিমন্ত্রিতা মেয়েদের জন্যে। পুরুষেরা বসেচে বাইরের রোয়াকে। পূর্ণিমার রাত্রে উঠোনের বড়ো নারকোল গাছগুলোর ছায়া পড়েছে রোয়াকে। সদ্য তোলা জুই ফুলের সুগন্ধে ভুরভুর করচে পুজোর বারান্দা।

হরিদাস চক্কত্তির বউ বললেন—এসো এসো ভাই। কতদিন গাঁয়ে আসোনি, সেই একবার এসেছিলে অনন্তচতুর্দশীর ব্রত উদযাপনের সময়, মনে পড়ে?

ননীবালা বললে—খুব মনে পড়ে।

—তখন তোমার নতুন দু-এক বছর বিয়ে হয়েছে।

—দু-বছর হবে।

—চেহারা আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গিয়েছে।

—আর চেহারা দিদি! কী দরকার আমাদের চেহারায় বলুন! সে পাট তো ঘুচে গিয়েছে।

—আহা-হা, সে আর বোলো না ভাই। ঠাকুরপো তো ছেলেমানুষ। আমাদের ওঁদের চেয়ে কত ছোটো। তার কী এখন যাবার বয়েস হয়েছিল? সবই অদেষ্ট! কী বলব বলো।

ননীবালার দু-চোখ ততক্ষণে জলে ভরে গিয়েছে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল, নয়তো জল গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। সে একটা লজ্জার কথা এদের সামনে। তার মনে যে কি অভাব, সে-কথা এরা কেউ বুঝবে না। সে মধুর অনুভূতির স্মৃতি এদের জীবনে পুঁজি নেই, স্কুল জীবনযাত্রা চালিয়ে যায় রান্নাবাড়া করে, খাইয়ে, ঘরকন্না গেরস্থালি করে। তার মনের সে অনুভূতির ধারণাই নেই এদের। চোখের জল দেখে ভাববে ঢং করে কাঁদছে লোক দেখানোর জন্যে।

পাশের বাড়ির কানাই গাঙ্গুলীর পুত্রবধূ এসে বসল ওর পাশে। ওর সঙ্গে আলাপ করে ফেললে। অল্পদিন বিয়ে হয়েছে, একটি মাত্র মেয়ে, ন-মাস বয়েস। বাপেরবাড়ি শান্তিপুরের কাছে হবিবপুর। বেশ শহুরে টান কথাবার্তায়। ওকে বললে

—কাকিমা, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব ভাবচি আজ ক-দিনই।

—আমার কথা কে বললে তোমায়?

—সবাই বলে। আমার পিসশাশুড়ি বলছিলেন, বড়ো ভালো বউ ছিল এ গাঁয়ের। গিয়ে দেখা করে এসো বউমা। আপনার নাম কী কাকিমা?

—ননীবালা। তোমার?

—প্রীতিলতা।

—বেশ নামটি। খুকির নাম কী?

—এখনো কিছু রাখিনি। ডাকনাম টুলু। আপনার কাছে যাব এখন, একটা নাম ঠিক করে দেবেন এখন আপনার নাতনির!

—দেব না কেন বউমা, কালই যেয়ো। গান করো নাকি?

—গাই। সে তেমন কিছু না। আপনার মুখে শুনব। এইমাত্র ওরা বলছিল আপনি ভালো গান জানেন।

—আমি? আমার গানের পাট তো চুকে গিয়েচে মা। আবার—

নাঃ, যখন-তখন চোখে জল এসে বড়ো অপ্রতিভ করে দেয়, এইসব ছেলেমানুষ ঝি-বউয়ের সামনে। তার কি এখন চোখ পানসে করে কাঁদবার বয়েস? সে না গিন্নিবান্নি? ছেলের মা?

প্রীতিলতা মেয়েটি বেশ দেখতে, কত আর বয়েস হবে—আঠারোর বেশি নয়। ননীবালা সামলে নিয়ে বললে—যেয়ো বউমা। তোমাদেরই মুখের দিকে চেয়ে তো আবার এ গাঁয়ের মাটিতে পা দিলাম। যাবে বই কী।

সব বেশ ভালোভাবেই চলছিল, এমন সময় আর একটি ওর সমবয়সি মেয়ের সঙ্গে দেখা হল, তার নাম কনক, এপাড়ার কোনো এক বাড়ির মেয়ে, বোধহয় উপেন ভটচাজের মেয়ে। কনক ছুটে এসে ওর হাত দু-খানা চেপে ধরে বললে— মনে পড়ে বউদি? মনে পড়ে?

একে খুবই মনে পড়ে। স্বামীর ঘরে প্রথম প্রথম যাবার সময় এই মেয়েটি আর রায়চৌধুরী পাড়ার সুবাসিনী এই দুজনে কী অসাধারণ ধৈর্য ও অধ্যাবসায়ের সঙ্গেই তাদের রুদ্ধ দুয়ারের বাইরে আড়ি পেতে বসে থাকত রাতদুপুর পর্যন্ত।

একদিন—না, সেসব কথা এখন মনেই চাপা থাক।

জুইফুলের গন্ধে ভরা দীর্ঘবিলসিত তাদের পুরোনো বাতাস কোন দিগন্তে বিলীন হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এসব পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের জ্ঞানকাণ্ড বোধহয় একটু কম। নইলে সে যেটা প্রাণপণে চাপা দিতে চাইছে, ওরা সেটা খুঁচিয়ে তুলতে চাইবে কেন? একটা সাধারণ বুদ্ধিও তো আছে! কনক সামনে এলেই মনে পড়ে সেসব মাধবী-রাত্রির টাটকা জুই-চাঁপার গন্ধ। কেন এরা সামনে আসে? ননীবালা মুখে অতিকষ্টে হাসি টেনে বললে—হ্যাঁ ভাই, কনক ঠাকুরঝি। ভালো?

—ভালো। তুমি?

—দেখতেই পাচ্চ।

—তা তো দেখচি। আহা, মনে পড়লে বুক ফেটে যায়। সেদিনের কথা। সেই রাত্রে দাদা আমার মুখে খুড়িগোলা মাখিয়ে দিলে আড়ি পাতবার জন্যে, মনে পড়ে?

না, এদের যেন আর কোনো কথা নেই আজকার দিনে। ননীবালা চুপ করে রইল দেখে কনক বোধহয় কিছু অপ্রতিভ হল। সেও চুপ করে গেল।

খুব লোকজনের ভিড়। দালানের মধ্যে মেয়েদের প্রসাদ খাবার পাতা সাজিয়ে দেওয়া হল। ননীবালা এবং অন্যান্য মেয়েরা সেখানেই বসল। সত্যনারাণের পুথি পড়া আরম্ভ হল।

খানিক পরে সেখানে একজন বৃদ্ধ লাঠি হাতে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধের বাঁ-হাতে একটা বাটি। বৃদ্ধ এসে বলল—পুজো হয়নি?

হরিদাস চক্কত্তির ছেলে বললে—না। আসুন জ্যাঠামশায়। বসুন—

—মেয়েদের মধ্যে আর বসব না। যাই বাইরে। কত দেরি হবে?

—বেশি দেরি হবে না জ্যাঠামশায়।

—আবার বাড়ি গিয়ে রুটি করতে হবে, তবে খাব। বেশি রাত্তির না-হয়।

ননীবালা পাশের কাউকে জিগ্যেস করলে—উনি কে ভাই?

সে বলল—চাটুয্যে বুড়ো। ছেলেরা মস্ত রোজগেরে, কলকাতায় থাকে। বুড়ো বাবা এখানে পড়ে আছে, খোঁজও নেয় না।

–বউ বেঁচে নেই বোধ হয়?

–খুব আছে। ছেলেদের কাছে কলকাতায় থাকে।

—ইনি যান না কেন ছেলেদের কাছে?

—তা কী জানি দিদি। তা বলতে পারিনে। এখানে থাকে, তাই তো দেখি। আর তুমিও যেমন! নিজের খবরই রাখতে পারিনে, তার আবার পরের খবর নিতে যাচ্চি।

রাত অনেক হয়ে গেল পুজো ও পুথি-পড়া শেষ হতে। ননীবালা যখন ছেলের সঙ্গে বাড়ি যায়, তখন দেখতে পেলে সেই বৃদ্ধ ওদের আগে আগে চলেচেন লাঠি ঠকঠক করতে করতে। ওদের দেখে বললেন—কে যায়? তোমাদের তো বাবা চিনতে পারলাম না?

সুরেশের পরিচয় পেয়ে বড়ো খুশি হলেন। তাকে কত আশীর্বাদ করলেন, ননীবালাকে বললেন—তোমার বিয়ের পর একবার বউমা তোমায় দেখেছিলাম— বিয়ের বউভাতের দিন। যেয়ো আমাদের বাড়ি, কেমন? কালই যেয়ো।

পরদিন বিকেলে ননীবালা চাটুয্যে বুড়োর বাড়ি গেল। সামনে বারান্দাওয়ালা সেকেলে কোঠাবাড়ি, একদিকে ডুমুরগাছ অন্যদিকে একটা বাতাবিনেবুর গাছ— উঠোনের পুবদিকে একটা পেঁপেগাছে অনেকগুলো পেঁপে ধরেছে।

বুড়ো বললে—কী দেখচ বউমা, ও সব আমার নিজের হাতে করা। সবাইপুরের বিশ্বেসদের বাড়ি থেকে বিজ আনিয়েছিলাম আজ ন-বছর আগে। সেই গাছ। তখন ওরা সব এখানে ছিল।

ননীবালা বললে—ওরা কারা জ্যাঠামশায়?

—তোমার জেঠিমা।

—আপনাকে এখানে বেঁধে দেয় কে?

—নিজেই। খুব ভালো রাঁধতে পারি। এই এখন বসে পরোটা করব।

—জেঠিমা থাকেন না এখানে?

–না না। ওরা বড়ো ছেলের কাছে থাকে কলকাতায়।

—ক-ছেলে আপনার?

—তিনটি। তা নিজের মুখে বলতে নেই, তিন ছেলে ভালো চাকুরিই করে। শ্যামবাজারে তেতলা বাসা। ইলেকট্রিক লাইট, ফ্যান। বড়ো ছেলের মোটরগাড়ি।

দশে মানে, দশে চেনে। চাটুয্যে সায়েব বললে সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের একডাকে সকলে চেনে। চেহারাও একেবারে সায়েবি—নিজের ছেলে বলে বলচি তা ভেব না—

বৃদ্ধের মুখে-চোখে গর্বের ভাব অতিস্পষ্ট হয়ে উঠল। নিজের মনে আপনা আপনি হেসে উঠে বললেন—জন্মাবার পরে এতটুকু ছিল। ওর মা ফুলে-নবলার পাঁচু ঠাকুরের দোর ধরে তবে ওই ছেলে বাঁচায়! ছ-বছর বয়সে কাঁকড়াবিছের কামড়ে ছেলে নীলবর্ণ হয়ে মরে যাবার জোগাড় হয়েছিল। কাঁটানটের শেকড় বেটে খাইয়ে জলপড়া দিয়ে তেলপড়া দিয়ে সে-যাত্রা অতিকষ্টে রক্ষা হয়। তবে আজ আমাদের নৃপেন—তা এসো, বোসো বউমা। এই পরোটা ক-খানা ভাজি আর তোমার সঙ্গে গল্প করি।

একটা ক্ষুদ্র ভাঁড়, চেঁচে-মুছে ঘি বেরুল আধ ছটাক খানেক।

বৃদ্ধ ভাঁড় দেখিয়ে বললেন—দালদা। ভালো দালদা। আর তা ছাড়া পাচ্চি কোথায়? শ্রীঘি আট টাকা সের।

—কেন আপনার ছেলে টাকা পাঠায় না?

বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন—নৃপেন? তার অনেক খরচ। রোজগারও যেমনি, খরচও তেমনি। আমি আর তাকে বিরক্ত করিনে। আমার বিঘে তিনেক ধানের জমি আছে, আর ধরো লাউ করি, কুমড়ো করি, তেঁড়স, ডাঁটা—সব তৈরি করি নিজের হাতে। বেশ চলে যাচ্চে। নৃপেন পুজোর সময় একখানা ভালো থান কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছে—ফাইন থান—তা বউমা সে আমি তুলে রেখে দিয়েছি। বার বার দেখি, বলি বড়ো খোকা আমায় দিয়েছে। ছোটো ছেলের বাসা আগে ছিল কলকাতায়— এখন মণিপুরে। সে একজোড়া চুটিজুতো পাঠিয়ে দিয়েছিল পুজোর সময়।

ননীবালা ইতিমধ্যে পরোটা ক-খানা বেলে দিয়ে বললে—আপনি ভেজে নেবেন, না, আমি দেব?

–না মা, আমিই নিচ্চি।

—কেন কষ্ট করবেন? সরুন—আমি করে দিচ্চি।

ননীবালা খাবার তৈরি করে জ্বাল দিয়ে সিঁড়ি পেতে বৃদ্ধকে যত্ন করে খেতে বসিয়ে দিলে। চাটুয্যে বুড়োর মুখের ভাব দেখে মনে হল অনেকদিন তাকে এমন যত্ন করে কেউ খাবার করে খাওয়ায়নি।

বুড়ো বললে—কী সুন্দর পরোটা হয়েছে! মেয়েমানুষ না-হলে কী খেয়ে তৃপ্তি? মেয়েদের হাতের রান্নাই আলাদা। বেঁচে থাকো বউমা, বেঁচে থাকো। মুখ বদলালাম অনেক দিন পরে।

—আপনার ছেলেদের বউ কেউ এখানে থাকেন না কেন?

-না না, পাগল! তাদের কি এই অজ পাঁড়াগাঁয়ে থাকতে বলতে পারি? তুমি জানো না, এসব অশিক্ষিত স্থানে তাদের আমি আসতে বলতে পারি না। তাদের মন টেকে এখানে? গরিব ছিলাম নিজে বটে কিন্তু ছেলেদের মানুষ করে দিয়েছি কষ্ট-দুঃখ করে। বিয়েও দিয়েছি তেমনি ঘরে। বড়ো বউমার বাবা মতিহারিতে সিভিল সার্জন। মেজো বউমার বাবা নেই, মামারা খিদিরপুরে বড়ো কনট্রাকটর, রায়চৌধুরী কোম্পানির নাম শুনেছ? সেই রায়চৌধুরী কোম্পানি। ছোটো বউমার বাবা এখন বাঁকড়োর সদর এস ডি ও। বড়ো বউমা ম্যাট্রিক পাস। ছোটো বউমা বি. এ. পর্যন্ত পড়েছিলেন, পরীক্ষা দেননি। ইংরিজি বলেন কি! আড়াল থেকে শুনেচি—যেন মেমসাহেব! হুঁ হুঁ বউমা—এসব গল্পকথা এখান থেকে শোনাবে। নিজের চোখে না-দেখলে—

—তাঁরা কখনো এখানে আসেননি?

–বড়ো বউমা এসেছিলেন একবার পুজোর সময়, যেবার আমার বড়ো নাতির ভাত হয়। প্রথম ছেলের ভাত এখান থেকেই হয়েছিল কিনা! সে আজ বিশ বছর আগের কথা। সে নাতি এবার ডাক্তারি পড়ছে মেডিকেল কলেজে। ওর পরে দুই মেয়ে, তারা ইস্কুলে পড়ে। এইবার ম্যাট্রিক দিয়েছে একটি। ছোটো বউমাকে নিয়ে আমার ছোটো খোকা এসেছিল সেবার মোটরে করে, ঘণ্টা চার-পাঁচ ছিল সবাই। আমি অনেকদিন দেখিনি কিনা, তাই চিঠি লিখেছিলাম। চিঠি পেয়ে বউ নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। ছোটো বউমা এসে শুধু ডাব আর চা খেয়েছিলেন—পাড়াগাঁয়ের জল খেলেই ম্যালেরিয়া হবে। তাদের অবস্থা ভালো, শিক্ষিত, সব বোঝে তো। রাত কাটাল না এখানে। কোথায় বা শুতে দিতাম—না-বিছানা, না-মশারি। নিজে শুই একটা হেঁড়া মশারি টাঙিয়ে। সারারাত মশা কামড়ায়, নিজে ভালো দেখতে পাইনে চোখে যে সেলাই করব।

—আমি কাল আপনার মশারি সেলাই করে দিয়ে যাব জ্যাঠামশাই।

–তা বেশ। এসো বউমা। একটু গুড় সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারো? খাবার ইচ্ছে হয়, এবার কিনতে পারিনি। বড় দাম। পরোটা দিয়ে খেজুরের গুড় লাগে বড়ো ভালো।

খাওয়া শেষ করে চাটুয্যে বুড়ো তামাক সাজতে বসল। ননীবালা চলে এল। তার মনে সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাব।

সুরেশকে সে খেতে দিলে। সুরেশ বল্লে–বেশ জ্যোৎস্না উঠেছে মা, এখানে বোসো।

ননীবালা বল্লে—তাঁকে তোর মনে পড়ে?

-খুব। আমায় নামতা পড়াতেন রোজ সকালে উঠে। বাবা যদি আজ থাকতেন! সুরেশের গলার স্বর ভাঙা, আবেগে আড়ষ্ট।

ননীবালা ভাবলে, এই ভালো, এই ভালো। খোকা আজ তোমার নাম করছে, তুমি নেই বলে। ওর চোখের জলে তোমার স্মৃতি সার্থক হোক। বেঁচে থাকো মানে-মানে খোকার মনে। মন শুকিয়ে যায়, তুমি বেঁচে থাকলে হয়তো চাটুয্যে জ্যাঠামশায়ের মতো তোমাকেও অবহেলা পেতে হত। ভালোই হয়েছে তুমি মানে মানে চলে গিয়েছো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *