যাও পাখি – ৭৫

॥ পঁচাত্তর ॥

অনেকরকম ভয়ভীতি ছিল ব্রজগোপালের মনে। ঠাকুর যেমন চাইতেন তেমনি জীবনটাকে খুব সাদামাটা করে এনেছিলেন তিনি। খুব কম আয়োজন তাঁর জীবনে। যত অল্প উপকরণে দিন কাটানো যায় ততই মনটা ভাল থাকে, বিষয়লগ্ন হয় না বলেই ঊর্ধ্বমুখী হয়। এখন ননীবালা এলেন, ব্রজগোপালকে বুঝি আবার সংসারী করে ফেলেন।

টর্চ জ্বেলে অন্ধকারে পথ দেখিয়ে রাস্তা থেকে ঘর পর্যন্ত যখন ননীবালাকে নিয়ে আসছিলেন তখনই এরকমটা মনে হল। এখটু ভয়, একটু সংশয়। অবশ্য ভাল না লাগলে ননীবালা ফের চলে যাবেন এবং ব্রজগোপালও আবার যেমন তেমন হয়ে যাবেন। তবু মনটা উদ্বিগ্ন লাগছিল।

ঘরে একটা চৌকি ছিলই। সেটাতে বিছানা পাতা হল ননীবালার। নিঝুম রাত। ঘুম আসে নতুন জায়গায়। কয়েকদিন বার বার রাতে উঠে পান খেতেন, ব্রজগোপালকে সজাগ করে বাইরে যেতেন।

ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করেন—মন খারাপ করছে তো ওদের জন্য? বরং আবার কিছুদিন গিয়ে থেকে এস।

ননীবালা মাথা নেড়ে বলেন—না। এখানে এসে পৌঁছে সংবাদ দিলাম, সে চিঠিটারও উত্তর আসেনি। ওরা কি আমার কথা ভাবে নাকি? আমারও আর দরকার নেই যাওয়ার।

—ওরা না ভাবুক, তুমি তো মা, তোমার তো আর ছাড়ান কাটান নেই।

ননীবালা অন্য কথা পাড়েন—শোনো, খুব তো পরের জমিতে আর পরের ঘরে বাস করে কর্তাত্তি করছ, বহেরু চোখ বুজলে উৎখাত হবে। বরং বাস্তুজমিটায় একটা কুঁড়েঘর হলেও তোলো। এরকম থাকা আমার ভাল লাগে না। পাকিস্তান হয়ে অবধি পরের দরজায় পড়ে আছি।

ব্রজগোপাল গম্ভীর হয়ে বলেন—গুচ্ছের টাকা নষ্ট। আমরা চোখ বুঝলেই সব ফরসা। ছেলেরা কি এতদূর আসবে?

ননীবালা বলেন—আসল কথাটা কী বলো তো? এর আগেরবার এসে বহেরুর মেয়ের কাছে শুনেছিলাম ষষ্ঠীচরণকে নাকি সব উইল করে দিয়েছ!

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—দিয়েছি কিছু। দুকাঠা বাস্তু, সে ওই পুবধারে। ও জমিটা দিইনি, ও তোমার নামে কেনা। কুয়ো কাটিয়ে, বাঁধিয়ে, চারধারে বেড়া দিয়ে যত্নে রেখেছি।

—সে বেশ করেছ। এবার ঘর তোলো। বহেরুকে আজই বলব, বাঁশ টিন সব জোগাড় করবে।

বহেরু পরদিন এসে সব শুনল, রামভক্ত হনুমানের মতো। তারপর লাফ দিয়ে উঠে বলল—কর্তার এক পয়সা খরচ করতে হবে না। বাড়ি আমি তুলে দেব।

ব্রজগোপাল ধমক দিয়ে বলেন—তুই তুলবি কেন?

—ব্রাহ্মণকে গৃহদান মহাপুণ্য। ও আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার কর্মফল কিছু কাটুক। অনেক খুনজখম করেছি কর্তা, এই দুই হাতে আপনার মতো সৎ-ব্রাহ্মণের জন্য কিছু করি। তারপর আপনি গুরুস্থানীয়ও বটে।

ব্রজগোপাল আরও ধমকালেন। বহেরু শোনে না। সে বলে—বাঁশ টিনের পলকা জিনিস বছর বছর পালটাতে হয়। গতবারে ইট কেটেছিলাম, তার হাজার দশেক পড়ে আছে। এখনও। সিমেন্ট না পাই চুন সুরকির গাঁথনি দিয়ে পাকা ঘর তুলে দেব।

বিশাল দলবল নিয়ে বহেরু গিয়ে জমিটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মচ্ছবের মতো ব্যাপার। লাগিয়ে দিল, তার চোখেমুখে একটা প্রচণ্ড আনন্দ। দিনে পাঁচবার এসে ননীবালাকে ডাকে—মাঠান, এসে দেখে যান কেমন হচ্ছে।

ব্রজগোপাল গা করেন না। কিন্তু ননীবালা যান, বলেন—ও বাবা বহেরু, পায়খানা বাথরুম সব, অতদূরে করিস না। শহরে থেকে অভ্যাস, সব সেখানে এক ছাদের তলায়। তোদের এখানে শেয়াল কুকুর সাপ ভূতের তো অভাব নেই, রাতবিরেতে বেরোতে ভয়। করে। তারওপর বুড়োবুড়ি, কে কখন হোঁচট খেয়ে পড়ে হাড়গোড় ভাঙি।

বহেরু রাজি, বলে—তাই হবে। বাংলো প্যাটার্ন।

শুনে ননীবালা হাসেন। এক ছাদের তলায় হলেই তা বহেরুর কাছে সাহেবি বাংলো।। অনেককাল আগে কলকাতায় বাসা দেখে ও বলেছিল—এ হচ্ছে বাংলো প্যাটান। কার থেকে যেন শিখেছিল ইংরেজি কথাটা! তাই শুনে কত হেসেছে রণেন আর সোমেন।

ব্রজগোপাল ঘরেদোরে বেশি থাকেন না। বেরিয়ে পড়েন যাজনে। ঘরবাড়ি তার জন্য। নয়। মানুষ যে আছে সে হল তার অস্তিত্ব, আর মানুষ যে কিছু হয় সে হল তার বৃদ্ধি। এই অত্তি-বৃদ্ধির মামলোত সংগ্রহ করতে হয় আবার পরিবেশ থেকে। সার কথা, নিজের পরিবেশকে সেবা দিয়ে, সাহায্য দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে পরিপুষ্ট করে তোলো। তা নইলে সে। যদি শুকিয়ে যায় তো জীবনের রস টানবে কোত্থেকে? তুমিও শুকিয়ে মরবে যে, তা যতই তুমি কেষ্টবিষ্ট হয়ে থাকো। সিধে মানুষ, বড় মানুষ বড় একটা দেখা যায় না আজকাল, সব পোকা লাগা। হাত-পাওলা মানুষও কেমন যেন নুলোন্যাংলা, ধনীও ভিখিরির সামিল হয়ে হা-পয়সা জো-পয়সা করে খাবি খাচ্ছে। আঝকাল লোকজনের চোখেমুখে সব সময়ই একটা মাতলা ভাব লক্ষ করেন ব্রজগোপাল, কেমন একটা মানসিক নেশার ঘোরে চলেছে। কলকাতার মতো বড় শহরে সে-ভাবটা আরও বেশি। মানুষ বড় তিতিবিরক্তি, রাগী, লোভী, বড় বেশি অস্থির। কীসে ভাল হবে বুঝতে পারে না। যত মানুষ তত সমস্যা। এইরকম গোলমেলে সমাজে ব্রজগোপাল সুস্থির হয়ে বসে থাকেন কী করে! ঘুরে ঘুরে পচনের ধারাটা দেখেন, লক্ষ করেন কতটা নিরাময়ের যোগ্য, আর কতটাই বা কেটে বাদ দিতে হবে। দেখে শঙ্কিত হন। অবসাদও আসে। ঠাকুরই আবার শক্তি যুগিয়ে দেন। এই বয়সেও ব্রজগোপাল ফের কষ্টসহিষ্ণু হচ্ছেন।

ননীবালা বলেন—অত সইবে না, এখন বসে বিশ্রাম নেওয়ার বয়স।

ব্রজগোপাল শান্তস্বরেই বলেন—ঠাকুর শরীর দিয়েছেন, বসিয়ে রাখার জন্য নয়, কাজ করার জন্য।

ভূতের বেগার। ধর্মকথা আজকাল কেই বা শুনছে?

ব্রজগোপাল ভেবে বলেন—ঠিক, তবু বলি, আজকাল ধর্মের বড় দাপট বেড়েছে। কত ম্যাজিকঅলা দু-পয়সা করছে দেখছ না! দেশে এখন দীক্ষার বান ডেকেছে। গুরু গুরু করে পাগল হচ্ছে লোক। নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে এরকম ক্ষেপে যায় মানুষ। ম্যাজিক না। দেখলে কিছু বিশ্বাস করে না। সবাই কৃপা চাইছে। বোঝে না যে কৃ অর্থে করা, তারপর পা অর্থাৎ পাওয়া। করে না পেলে কি ঠাকুরের কৃপা এমনি হয়! মানুষকে এটুকু বোঝানো দরকার যে সেই চির-রাখাল আজও বসে আছেন কদম্ববৃক্ষের তলায়, কত বাঁশি বাজাচ্ছেন, তবু তাঁর হারানো গোধন দূরের চারণক্ষেত্র থেকে ফিরে আসবার পথ পাচ্ছে না। তাঁর সেই হারানো গোধন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। আর কী করব?

দু’মাসের মধ্যেও চিঠিপত্র এল না কলকাতা থেকে। কেউ দেখা করতেও এল না। মনটা বড় উচাটন লাগে ননীবালার। দিনরাত প্যাঁচাল পাড়েন—কে কীরকম আছে কে জানে! খবরবার্তা নেই। খোঁজ না নিলি, নিজেরা কেমন আছিস তা তো দুখোট লিখে জানাতে পারিস?

ব্রজগোপাল শুনে মাথা নেড়ে বলেন—তোমার মন কেমন করছে। যাও বরং গিয়ে দু-চারদিন থেকে এস।

ননীবালা ঝামড়ে ওঠেন—কেন যাব? ওদের যদি টান না থাকে তো আমারই বা কি দায় ঠেকেছে? দুমাস হয়ে গেল! একটা পোস্টকার্ড পর্যন্ত লিখতে পারল না।

ব্রজগোপাল হেসে বলেন—এ হল অভিমানের কথা। ওরা তো দায়িত্বজ্ঞানহীন হবেই, জানা কথা। দায় তোমারই।

ননীবালা মাথা নেড়ে বলেন—না। দেখি, কতদিনে বুড়োবুড়ির কথা মনে পড়ে।

সারাদিনটাই প্রায় নয়নতারা এসে ননীবালার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। বেড়ালের মতো। বিন্দু আসে রোজ, রান্নার কাঠ দিয়ে যায়, ক্ষেতের কলাটা মুলোটা রেখে যায়, কোটা চিড়ে, ভাজা মুড়ি পৌঁছে দেয়। আসে মতিরাম বামনবীর, কালীপদ ষষ্টীচরণ এসে খেলা করে দোরগোড়ায়। বামুনবাড়ির পেসাদের লোভে হামাগুড়ি দিয়ে গন্ধ বিশ্বেসও এসে বসে থাকে। রান্নাঘরের দরজায়। চোখে দেখে না, কিন্তু নাকে গন্ধ টেনে বলে—উরেব্বাস, কী গল্প। মাঠান, তোমাদের চচ্চড়িতে! কোকা, কপিল যেমন-তেমন হোক একবার দিনান্তে এসে খোঁজ নেবেই। বৃহস্পতিবার সন্ধেয় লক্ষ্মীর পাঁচালি শুনে বাতাসা, শশা আর ফলটলের প্রসাদ নিতে সবাই জুটে যায়। হরির লুটের বাতাসা কুড়োতে আসে। এসব ভুলে গিয়েছিলেন। ননীবালা কলকাতায়। এখানে এসে আবার সব করতে শুরু করেছেন। সকলের সঙ্গে। জড়িয়ে পড়েছেন খুব। ছেড়ে যেতে মন চায় না। এ বছর প্রথম দুর্গাপূজা করল বহেরু। পুজোর আগেই চলে এসেছিলেন ননীবালা। দুঃখ ছিল। বহেরু পুজোয় মেতে গিয়ে সে দুঃখ ভুললেন। বেশ লাগল গাঁয়ের পুজো, অনেককাল পর। একটু একটু করে কলকাতাকে ভুলছেন। কত বড় জায়গা এটা, আর কি শীতটাই পড়েছে এবার!

বহেরু ময়দানবের মতো খেটে বাড়িটা খাড়া করে দিল। ছাদ ঢালাইয়ের অনেক ঝামেলা বলে ওপরটায় টিন লাগাল। জানলা দরজা বসে গেছে। গৃহ প্রবেশের নেমন্তন্ন করে ফের কলকাতায় চিঠি দিলেন ননীবালা। বুকটা দুরদুর করে। আসবে তো কেউ?

ননীবালা সবিস্ময়ে একটা জিনিস বুঝতে পারেন। আগে ভেবে রেখেছিলেন যে, হাভাতে স্বামীর ঘর করতে এসে বুড়ো বয়সে বড় অভাবের কষ্ট পাবেন। কিন্তু এসে দেখছেন, কোনওদিন অভাবের ছায়াও মাড়াতে হচ্ছে না। যা চাইছেন তাই জুটে যাচ্ছে। শুধু যে বহেরু দেয় তা নয়, হঠাৎ কোত্থেকে কোন দূরান্তের মানুষ এসে ঝপাস করে একজোড়া চওড়াপেড়ে শাড়ি পায়ে ফেলে উবু হয়ে প্রণাম করে যায়। কেউ বা একঝুড়ি তরকারি এনে ফেলে গেল। ব্রজগোপাল যাজনে বেরিয়ে যখন ফেরেন তখন কত কী বয়ে আনেন। বলেন, সব জোর করে গছিয়ে দেয়, ফেলতে পারি না। তা দেওয়ার অভ্যেস ভাল। যে দিতে শেখে, তার বুদ্ধি অনেকটা ঠিক আছে। ব্রজগোপাল নিজে গুরু নন, গুরুর নাম বিলিয়ে বেড়ান ঋত্বিক বা পুরোহিত হিসেবে। কেউ তাঁকে গুরু বলে ভুল করলে হেসে বুঝিয়ে দেন—গুরু মানে হচ্ছে। ওজনে ভারী। যার জ্ঞানের ওজন, উপলব্ধির ওজন যত বেশি সে তত বড় গুরু। সেই হিসেব। ধরলে দুনিয়ার কে গুরু নয় বলো, কাঙালের কাছেও শেখবার আছে, তার নিজস্ব অর্জিত জ্ঞানও তো কম নয়! কিন্তু সদগুরু যিনি, সন্ত যিনি, তাঁর মধ্যে থাকে সর্বজ্ঞত্ব বীজ। আমি তাঁর পাঞ্জাধারী পুরুত, লোককে তাঁর ঠিকানা দিয়ে বেড়াই। তোমরা নিজের চেষ্টায় পৌঁছেও বাবারা। তো পুরুত হয়ে তাঁর যজমান কম নয়। ব্রজগোপালকে হাত পাততে হয় না, লোকে হাত পাতবার আগেই দেয়। তাই ব্রজগোপালের কোনও অভাব নেই।

এইটে দেখে বড় বিস্ময় ননীবালা। হাড়-হাভাতে বাউণ্ডুলে তাঁর স্বামী। তিনি কষ্ট পাবার জন্য তৈরি হয়েই এসেছিলেন। এসে দেখেন, ঘরে সোফাসেট বা রেডিয়োগ্রাম না থাকলেও ব্রজগোপালের ঘরে লক্ষ্মীর গায়ের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে তরিতরকারি বিলিয়ে। দিতে হয়। দুমাসে প্রায় তিরিশখানা মিহি জমির শাড়ি পেয়েছেন। প্রণামীর টাকা প্রতি মাসেই অন্তত শখানেক কেবল তাঁর হাতে এসেছে। ননীবালা এসব নিয়ে খুব খুশি। বলেন—তোমার। যে খুব রবরবা গো।।

ব্রজগোপাল গম্ভীর হয়ে বলেন, এ কী দেখছ। বিবেকানন্দের নামে কত হাজার বিদেশি কারেন্সির প্রণামী আসে একবার জেনে এস। চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। তাই ভাবি, ফরেন ক্যাপিটালের জন্য হা-পিত্যেশ করে না থেকে যদি একশো বিবেকানন্দ তৈরি হত দেশে তো টাকাপয়সায় ভাসাভাসি কাণ্ড হত। লোককে যদি ধর্মদান করতে পারো তো পঞ্চভূত এসে তোমার সংসারে বেগার খেটে যাবে।

গৃহপ্রবেশের আয়োেজন নমোনমো করে সারতে চাইলেও হল না। ব্রজঠাকুরের বাড়ি হচ্ছে শুনে বৈঁচী, গোবিন্দপুর, বর্ধমান থেকে বিস্তর লোক খোঁজখবর করতে এল। জানালা দরজার কাঠ পাওয়া গেল বিনা পয়সায়, রং পাওয়া গেল, সস্তায় কিছু লোহালক্কড়ও দিল একজন। সবাইকে বলতে হয়, তাই বলেন ননীবালা, বাদ রাখলেন না।

উৎসবের দিন মচ্ছব লেগে যাবে আন্দাজ করে বহেরু বলে দিল—কর্তা, সোজা খিচুড়িভোগ, লাবড়ার তরকারি, আর চাটনির ব্যবস্থা করুন। শেষ পাতে কিছু মিহিদানা আর দই।

কলকাতার জমিতে বাড়ি হবে-হবে করেও হল না। কত আশা ছিল ননীবালার। একবার কৌশল করে রণেনের বউ জমিটা নিজেও কিনতে চেয়েছিল। জমিটায় অভিশাপ আছে বোধ হয়। কতকাল পড়ে থাকবে কে জানে! ছেলেরা কী করবে তাও ঠাকুর জানেন। কিন্তু এখানে। এতদিন পর স্বাধীন হতে পেরেছেন তিনি। যেমন হোক, তবু নিজের বাড়ি। চারদিকে অনেকটা জমি। বাচ্চারা জমি কুপিয়ে এরমধ্যেই গাছ লাগিয়েছে কত! বাড়ি তৈরি শেষ হওয়ার আগেই জমির ক্ষেতে ফুল ফল আসতে লেগেছে। এখানে জীবনটা শান্তিতে না হোক স্বস্তিতে কাটবে। একটু একা লাগবে কি! লাগুক। বলতে কী, জীবনটা তো তাঁর একাই হয়ে গেছে। ছেলেরা খোঁজ নিল না।

গৃহপ্রবেশের দিনটায় সকাল থেকে পুজোর শেষ অবধি উপোস করে থাকা ছাড়া আর কোনও ঝক্কি পোয়াতে হয়নি ননীবালার। রাশি রাশি জিনিসপত্র জড়ো হয়েছে। কে কুটছে, কে বাটছে বোঝা মুশকিল। তবে চেনা-অচেনা সবাই খাটছে। বিশাল এক তেরপলের তলায় যজ্ঞির রান্না হচ্ছে। পুজো চলছে উঠোনে। ব্রজগোপাল নিজে পুজো করলেন না, পুরুত করছে। তিনি গা আলগা দিয়ে বহেরুর উঠোনে বসে আছেন। খোলা রোদে তাঁকে ঘিরে বিস্তর লোক ঠাকুরের কথা শুনছে। উপপাসী মুখে কোনও ক্লান্তি নেই, বৈকল্য নেই। পারেও বটে লোকটা—ননীবালা ভাবেন। প্রতি মাসে একবার করে চতুরহ সহ শিশু প্রাজাপত্য করেন। সে ভারী কষ্টের। প্রথম দিন পূর্বাহ্নে হবিষ্যান্ন মাত্র, দ্বিতীয় দিন অপরাহ্নে একবার হবিষ্যান্ন, তৃতীয় দিন অযাচিত—অর্থাৎ কেউ ব্ৰতর কথা জেনে কিছু দিলে তাই দিয়ে হবিষ্যান্ন, চতুর্থ দিন কাঠ-উপোস। ননীবালা আপত্তি করলে বলেন—কত অজানিত অপরাধ করছি প্রতিদিন, তার প্রায়শ্চিত্ত করে রাখি। প্রায়শ্চিত্ত মানে দণ্ড নয়, পুনরায় চিত্তে গমন, স্বাভাবিকতায় প্রকৃতিতে ফিরে আসা।

ননীবালা তত্ত্বকথা বোঝেন না, কষ্টটা বোঝেন। মানুষটা চিরজীবন তাঁর অচেনা রয়ে গেল। এখন অবশ্য আর বাধা দেন না। এখানে এসে বুঝেছেন, ব্রজগোপাল খুব হালকা লোক নন। চারদিকে তাঁকে গুরুত্ব দেওয়ার লোকের অভাব নেই। ফকির সাহেব পর্যন্ত এসে কত সম্মান আর আদর দেখিয়ে যান রোজই। স্বামীর সম্মানের ভাগ এই প্রথম পাচ্ছেন ননীবালা। এর আগে কয়েকদিনের জন্য এসে এত বুঝতে পারেননি।

উৎসবের এত হইচইয়ের মধ্যেও ননীবালা উদগ্রীব হয়ে আছেন রাস্তার দিকে। কেউ কি আসবে না? বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। কলকাতার গাড়ির খোঁজ নিচ্ছেন বার বার। মনে মনে। নিজেকে বোঝাচ্ছেন—ওরা তো সব দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। তারপর চা-টা খেয়ে রওনা হবে, হাওড়া তো কম দূর নয়। হাওড়া থেকে প্রায় দুঘণ্টা গাড়িতে এসে আবার এতখানটা পথ। সময়ের হিসেব করে ননীবালা দেখেন, বারোটা একটার আগে এসে পৌঁছোবে না। কেউ। তবু যদি আসে। কাউকে জোর করার নেই, দাবিদাওয়া নেই, দয়া করে যদি আসে।। বড় অভিমান হয় ননীবালার। একটা জীবন বুক দিয়ে ছেলেপুলে আগলে রেখে মানুষ। করলেন, ওরা তবু কী করে সব ভুলে যায়!

ব্যাপার-বাড়িতে কিছু গণ্ডগোল হবেই। কপিলের ছেলে গাছে উঠেছিল, পড়ে গিয়ে তার। ড্যানা ভেঙেছে! হইচই কাণ্ড। বৈচীর হাসপাতালে তাকে নিয়ে রওনা হল কজন। এর মধ্যে রব উঠল, নন্দলালের পাঞ্জাবির সোনার বোতাম চুরি হয়েছে। নন্দলাল থানা-পুলিশ করবে। বলে চেঁচাচ্ছে। বিন্দু এসে ননীবালাকে বলে—এ হচ্ছে মেঘু ডাক্তারের ছেলেদের কাজ। ওরা বড্ড চোর! নন্দলাল ঘেমো পাঞ্জাবি খুলে বেড়ার গায়ে রোদে দিয়ে পাশ ফিরতে না। ফিরতে চুরি। এত চটপটে হাত আর কার হবে! ফকিরসাহেবের ভূতুড়ে বাড়িতে দিনমানে লোক যায় না, সেইখানে পর্যন্ত গিয়ে ওরা ফকিরসাহেবের পেতলের মোমদানী চুরি করেছিল। অমন ডাকাবুকো আর কে আছে!

এই সব গোলমালে ননীবালা একটু আনমনা হয়েছেন, ঠিক এই সময়ে নয়নতারা ধেয়ে এসে চেঁচিয়ে বলল—ও মা, তোমার ছেলেরা সব এসেছে, নাতিপুতি সব। দেখো গে যাও, চার রিকশা বোঝাই।।

ননীবালা বড্ড তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়েছেন উঠে। মাথাটা চন করে পাক মারল, বুকটায় ধরল। চাপ। শ্বাসকষ্ট। উপোসী শরীরের দুর্বলতাও আছে। চোখ অন্ধকার করে ধীরে ধীরে এসে বসে পড়েন ফের। নয়নতারাই এসে ধরে তাঁকে—ও মা, কী হল গো?

ফ্যাকাসে ঠোঁটে ননীবালা বলেন—নয়ন, তুই যা, ওদের নিয়ে আয়। আমার বুকটা —

কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেন না। বুড়ো বয়সের শরীর, বেশি সয়বয় না। নয়নতারা হাপুর-হুপুর হাতপাখার হাওয়া করে, বুক মালিশ করে দেয়। বলে—চিন্তা করো না মা, এসেছে যখন সবাই ঠিক তোমার কাছে আসবে।

—তবু তুই যা। বলে ননীবালা নিজেই ওঠেন আবার। বলেন—এখন একটু ভাল। লাগছে।

ননীবালা বাইরে আসেন। বিশ্বাস হয় না, তবু দেখেন, কুঞ্জলতায় ছাওয়া শুড়ি পথ ধরে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে চারদিক দেখতে দেখতে সব আসছে। পথ দেখিয়ে আনছে বহেরু। সে ননীবালার দিকে চেয়ে একটা ডাকাতে হাঁক পেড়ে বলে—মাঠান, সব আসে পড়েছে! দেখেন। জয় ভগবান।।

ভগবানের বড় দয়া। বড় দয়া। ননীবালার বুকের অন্তস্থলে থিতিয়ে ছিল চোখের জল। নাড়া খেয়ে তারা উঠে এল। চোখ ঝাপসা, কণ্ঠায় আটকে আছে কান্নার দলা।

প্রথমে সোমেন, তার হাত ধরে টুবাই, পিছনে রণেন, বীণা, বুবাই আর বেলকুঁড়ি। কিন্তু তার পিছনে ছেলে কোলে সুন্দর মেয়েটা কে? ও মা! শীলা নাকি! কী সুন্দর হয়েছে শীলা! কোল ভরা মোটাসোটা ছেলেটাই বা কী সুন্দর! স্বয়ং গোপাল। ও কি অজিত? তাই তো! হায় সর্বনাশ, এ আবার কাকে দেখছেন ননীবালা? এ কি সত্যি? ইলা না! মুম্বই থেকে ইলা আবার কবে এল? হাত ধরে গুটগুটিয়ে তার ছেলেও আসছে। ইলার পিছনে ইলার বরকেও দেখা যাচ্ছে যে! এ কি স্বপ্ন দেখছেন ননীবালা? সত্যি তো! ভগবান এটা যেন স্বপ্ন না হয়। এটুকু দয়া করো ভগবান।

রণেনের হাতে বিশাল এক মিষ্টির হাঁড়ি, সোমেনের হাতে মস্ত সন্দেশের বাক্স, রণেন। এসে সোজা পায়ের ওপর পড়ে কান্না—মাগো, আমাদের কি আর মনে পড়ে না?

তাকে ধরে তুলবেন কী, তার আগেই রক্তের ছানাপোনারা সব ঘিরে ধরেছে তাঁকে—মা ঠাকুমা ডাকে অস্থির করে তুলল বাতাস। এত সুখ বুঝি সইবে না শরীরে। বুজি দম ফেটে মরে যাবেন। বুকের ভিতর তুফান ছুটছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে অবিশ্বাস্য আনন্দে। অবিরল বয়ে যাচ্ছে চোখের জল। ফোঁপাচ্ছেন।

ইলা এসে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। টুবাই কোলে চড়ে বসে থাকে। শীলা তার। ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে নিয়ে বলে—বাব্বা! কী রাস্তা!

ননীবালা একটাও কথা বলতে পারেন না। অবিশ্বাস্য বোবা হয়ে যান। ছেলেরা জামাইরা প্রণাম করে যাচ্ছে, আশীর্বাদটুকু পর্যন্ত মনে করতে পারছেন না। কেবল মাথায় হাত রাখছেন। কাঁদছেন। বিশ্বাস হয় না।

ব্রজঠাকুরের ছেলেপুলে শহর থেকে এসেছে শুনে বিস্তর ভিড় হয়ে গেল ঘরের মধ্যে। বহেরুর বউরা সব ঘোমটা টেনে এসে দাঁড়াল, বড় মেয়ে এল, পড়শিরা এল। বামন মতিরামও ঝলমলে পোশাক পরে এসে কয়েকটা ডিগবাজি দেখিয়ে দিল সবাইকে।

ব্রজগোপাল এসে দাঁড়ালেন একটু দূরে পর মানুষের মতো। তিনি জানেন একটু দূরত্ব থাকলেই সঠিক নিরীক্ষণ হয়। যত মাখাজোখা করবে, যত কাছে টানবে, তত দেখাটা হবে। অস্পষ্ট। তাঁর মুখে স্মিত সংযত ভাব। ছেলেমেয়ে জামাই আর নাতি-নাতনিরা প্রণাম করছে, তিনি চোখ বুজে দয়াল ঠাকুরকে স্মরণ করছেন। দয়াল, ওরা যেন সুখে থাকে। যেন ওরা কারও দুঃখের কারণ না হয়। ওদের সুখ যেন কাউকে দুঃখী না করে। নিজে সুখী হয়ে ওরা যেন সবাইকে সুখী করে।

এই সুখ-দুঃখের তত্ত্বের মধ্যেই পৃথিবীর সব সত্য নিহিত আছে। বড় শক্ত ব্যাপার। নিজে সুখী হও, সবাইকে সুখী করো—এ কি পারবে তোমরা?

ছোট জামাই বিদেশ ঘুরে এসেছে। হাসিমুখে সে বলল—এ খুব খাঁটি জায়গায় আছেন বাবা। গাছপালা মাটি—এ সবই হচ্ছে মানুষের এলিমেন্টাল জিনিস।

—তোমরা কবে এলে?

—আমি মুম্বই ফিরেছি দিন-দশেক আগে। লন্ডনের এক কোম্পানি চাকরি অফার করেছে কলকাতায় তাদের অফিসে। তাই চলে এলাম কন্ডিশন দেখতে। মাসখানেক পরে এসে জয়েন করব। কলকাতায় এলে মাঝে মাঝে উইক এন্ডে চলে আসব এখানে। কী সুন্দর জায়গা!

অজিত বেশি কথা বলে না। ব্রজগোপাল তারদিকে চেয়ে বলেন—অজিত, তোমার শাশুড়ির বাড়ি দেখেছ?

—দেখব। বাইরে থেকে দেখেছি। খুব ভাল লাগছে।

ব্রজগোপাল গম্ভীর হয়ে বলেন—ভালই। তিনচারখানা ঘর হয়েছে শেষ অবধি। আমার প্রথমে খুব ইচ্ছে ছিল এখানে বাড়ি করার, পরে নানা কারণে আর ইচ্ছে হয়নি। তোমার শাশুড়ি এসে পড়ায় শেষ পর্যন্ত হল। অনেকগুলো ঘর আছে, কলকাতার ওপর কখনও বিরক্তি এলে তোমরা চলে এস এখানে, যতদিন খুশি থেকে যেয়ো।

—আসব। জায়গাটা বড় ভাল। অ্যাওয়ে ফ্রম ম্যাডেনিং ক্রাউড।

—চলো, দেখবে। বলে ব্রজগোপাল জামাইদের নিয়ে এগোনে। চোখের ইঙ্গিতে সোমেনকে ডাকেন, সেও আসে।

নতুন চুনের সোঁদা গন্ধঅলা ঘর। চারদিকে জানলা দরজা খোলা। ফটফটে রোদ আর হাওয়ায় ঝলমল করছে। সামনের ঘরে যজ্ঞ হচ্ছে, পুরুতের মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পেঁয়ো উচ্চারণে সংস্কৃত মন্ত্র, তবু শুনতে শুনতে শৈশব ফিরে আসে। ঘুরে ঘরে। ঘরদোর দেখান ব্রজগোপাল। সোমেনের দিকে চেয়ে বলেন—কেমন?

সোমেন তার সুন্দর মুখশ্রীতে চমৎকার হাসির আলোটি ছড়িয়ে দিয়ে বলে—আমাদের। কোথাও একটা বাড়ি আছে, এটা ভাবতেই ভাল লাগবে এখন থেকে।

ব্রজগোপাল ভ্রু কুঁচকে একটু ভেবে আস্তে করে বলেন—কথাটা শুনতে ভাল, কিন্তু ওর অর্থ ভাল নয় বাবা, তুমি তো অসহায় নও যে দুনিয়ার কোথাও তোমার আশ্রয় নেই এ বাড়িটা ছাড়া।

—আমাদের নিজের বলতে তো কিছু নেই বাবা।

ব্রজগোপাল শ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলেন—জানি। তবু বলি, পুরুষমানুষ হয়েছ, নিজেকে কখনও নিরাশ্রয় ভেবো না। ঠাকুর সকলের জন্যই সব দিয়ে রেখেছেন, খুঁজে পেতে অর্জন করে নিতে হয়। আবার স্বার্থপরও হতে নেই। তোমার ঘর যেন হয় মন্দিরের মতো।

ননীবালার কান্না থেমেছে। শরীরে শক্তির জোয়ার এল বুঝি। নাতিদের, ছেলেপুলেদের, নাড়ু-মোয়া দিচ্ছেন, জল গড়িয়ে আনছে নয়নতারা। ননীবালা বলেন—এটুকু খেয়ে নে সব। ভাতে বসতে দেরি আছে।

বীণা বলে—এবার পুজোয় আপনাকে কাপড় দিতে পারেনি আপনার ছেলে। মাইনে-টাইনে সব কেটে নিত তো কামাইয়ের জন্য। এখন কিনে এনেছে।

ননীবালা বলেন—কাপড়! সে কথা বোলো না বউমা, কাপড়ের অভাব নেই। এসে অবধি এ পর্যন্ত কতগুলো যে পেয়েছি। এক ছেলে দেয়নি তো কি হয়েছে, কত ছেলে আমাকে। দিয়ে যায়।

ঝোলা ব্যাগ থেকে বীণা শাড়ি বের করে দেখায়। বেশ শাড়ি, খুব চওড়া পাড়ে মুগার সুতোর টান রয়েছে। অন্তত ষাট পঁয়ষট্টি তো হবেই। শীলা আর ইলাও শাড়ি এনেছে। ননীবালা বলেন—তোরা কি আমাকে শাড়িতে ঢেকে দিবি নাকি?

ভারী আনন্দ। ঘর ভরতি। আপনজনদের কথার কলরোল, হৃৎপিণ্ডের শব্দ, রক্তের গুঞ্জন। বাতাসটা পবিত্র হয়ে গেল।

শীলার ছেলেটা চিত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। একরাশ জুই ফুল পড়ে আছে যেন। ননীবালা বলেন—ও শীলা, আমার এই বরটির নাম কী রেখেছিস শুনি!

শীলা মোয়ায় কামড় দিয়ে বিষম খেয়ে হেসে ফেলল। ননীবালা বললেন—ষাট ষাট।

সামলে নিয়ে শীলা বলে—আবার কী! বাবা নাম লিখে পাঠিয়েছিল, সেই নামই রাখল। তোমার জামাই। বলল—শ্বশুরমশাই শাস্ত্রজ্ঞ লোক, জেনেশুনে বুঝেই নাম রেখেছেন নিশ্চয়ই। তাই নাম রাখা হয়েছে ঋতম্ভর।

—বেশ নাম। ইলা, তোর ছেলের?

—আর বোলো না, আমার শাশুড়ি নাম রেখেছেন ননীচোর। সেই নামই নাকি থাকবে। বড় হয়ে ছেলে আমাদের মারতে আসবে দেখো। চোর-টোর দিয়ে কেউ নাম রাখে! তার ওপর আবার দিদিমার নামও ননীবালা। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে! বরং স্কুলে ভরতি করার সময়ে চুপ চুপ করে নাম পালটে দিয়ে আসব।

নাম শুনে সবাই হাসে।।

কিছু সময় পার হয়ে যায়। বেলা হল। ননীচোরকে নিয়ে বেলকুঁড়ি বাইরে কাক বক দেখাচ্ছে। ননীবালা তাকে ডাক দিয়ে বলেনননীবালাকে চুরি করবি নাকি ও ভাই? নিয়ে যা চুরি করে। তোর দাদু বুড়ো বয়সে একটু কাঁদুক।

শীলা বলে—মা, বেশ তো থেকে গেলে এখানে! একবার খবরটাও দিয়ে আসোনি! আমি শুনে তো হাঁ। বিশ্বাসই হয়নি প্রথমে যে, তুমি সবাইকে ছেড়ে বাবার কাছে চলে। আসতে পারো।

ননীবালা চুপ করে রইলেন খানিক। ভেবে বললেন—হুট করে এলাম বটে, কিন্তু কাজটা খারাপ হয়নি মা। এখানে এসে বেশ আছি। মনটা হু-হু করে বটে, তবু বেশ লাগে। তোরা। আসবি, থাকবি, বেড়িয়ে যাবি। হ্যাঁ রে, সোমেন কী বলে। আমেরিকা না কোথাকার পোকা। যে ঢুকেছিল মাথায়!

শীলা মাথা নেড়ে বলে—লক্ষ্মণবাবু ফিরে গিয়ে সোমেনকে লিখেছেন—না আসাই ভাল। লক্ষ্মণবাবুও ফিরে আসছেন। চাকরিবাকরি করবেন না, নিজেই একটা কোম্পানি খুলবেন বলে ঠিক করেছেন এখানে। সোমেনকে সেখানে চাকরি দেবেন।

—ওমা, তাই নাকি?

শীলা হেসে বলে—গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। তবে লক্ষ্মণবাবু মানুষটা তো খুব খাঁটি। যা বলেন তাই করেন।

ননীবালা বলেন—সে যেমনই হোক, তুইয়েবুইয়ে ভুলিয়ে রাখিস ওকে। কোথাও যেতে দিস না। ওর জন্যই আমার চিন্তা। বলতে কী, ওর জন্যই আমার এখানে আসা। |

—কেন মা?

—ও বড্ড বকত আমাকে। বুঝতাম, বাবাকে আলাদা রেখে মা ছেলের সংসারে থাকে—এটা ও ভাল চোখে দেখে না। তাই বুঝি আমাকে ইদানীং সহ্য করতে পারত না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে সব দিক বজায় রাখতে চলে এসেছি। এখন যদি আবার দূরান্তে চলে যায় তবে বড় দুশ্চিন্তা নিয়ে মরব।

ঘুরে ঘুরে সব দেখে সোমেন। এর আগে এমনি এক শীতকালে সে এসেছিল এখানে। এর মধ্যে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। শুধু সেই বিশাল মানুষ বহেরু একটু যা বুড়িয়ে গেছে। গন্ধ বিশ্বেসেরও বাঁচার শেষ নেই। এখনও টিকে আছে। মচ্ছবের গন্ধে-গন্ধে এসে বসে আছে গাবগাছের তলায়। দিগম্বরকেও ভিড়ের মধ্যে এক-আধবার দেখা গেছে। খোলটা সঙ্গেই আছে, যখন নির্জনতা পাবে বাজাতে বসবে। বিন্দুর সঙ্গেও চোখাচোখি হয়েছে। কয়েকবার। সেবার যখন এসেছিল তখন বিন্দুর শরীরের অসহ্য উত্তাপ টের পেয়ে গেছে। এবার তাই লজ্জা-মেশানো ভয় করল তাকে। সে বড় ভীতু। হেমন্ত বা অন্য বন্ধুরা কেউ হলে, এমনকী শ্যামল যদি আসত তা হলেও একটা কিছু প্র্যাকটিক্যাল প্রেম করতই। সে পারে না। ব্রজগোপালের ছেলে তো, তাই কতগুলো ভয়-ভীতি ছেলেবেলা থেকেই বাসা বেঁধে আছে ভিতরে।

চারদিকেই গুরুজন বলে সে উত্তরধারে কাঁটাঝোপের পাশে একটা ঢিবির ওপর এসে নির্জনে সিগারেট ধরিয়ে বসল। এখান থেকে অনেকটা দেখা যায়। বহেরুর বাড়ি ক্ষেত, আর একটু দূরে তাদের নতুন বাড়িটা। যজ্ঞধূমের গন্ধ আসছে, থিক থিক করছে লোকজন। হাল্লা-চিৎকার শোনা যাচ্ছে। শীতের বাতাস এই দুপুরেও হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, পুকুরের জলে বিশাল জলহস্তীর মতো রণেন সাঁতার কাটছে। না, জলহস্তী বলাক। হল না। রণেন আর তেমন মোটাসোটা নেই। অনেক রোগা হয়ে গেছে। প্রায়ই বলে—আমি মা বাবার কাছে চলে যাব। এছাড়া আর কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। হ্যাঁ, আর একটা আছে।। এখনও রাতেরবেলা চুপি চুপি উঠে কলের গান শোনে। নইলে, সবই ঠিক আছে।।

সোমেন অনেকক্ষণ বসে থাকে, টিবিটার ওপর। মনে কত রকমের চিন্তা শরতের মেঘের। মতো ছায়া ফেলে যায়। এত চিন্তা সোমেনের ছিল না কখনও। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। এই তো কিছুদিন আগে ম্যাক্স চলে গেল। তাকে দমদমে তুলে দিতে গিয়েছিল, সোমেন, যাওয়ার সময়ে ম্যাক্স তার হাত ধরে বলেছিল—নোংরা গরিব ঠিকই, তবু তোমার দেশের বেশি কিছু শিখবার নেই বিদেশ থেকে, একসেপ্ট সাম টেকনিক্যাল নলেজ, এনডিভার, অ্যান্ড এ প্র্যাকটিক্যাল আউটলুক ইন সাম ম্যাটার্স।

কথাটা শুনে খুব অহংকার হয়েছিল সোমেনের। নিজের দেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে না সোমেন, কিন্তু ম্যাক্স জেনে গেছে। ম্যাক্স সারা ভারতবর্ষ কয়েকবার ঘুরেছে, কাশীতে সংস্কৃত শিখে বেদ-বেদান্ত পড়েছে, ভিখিরি কাঙাল থেকে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের সঙ্গে অবাধে মিশেছে, উগ্রপন্থীদের সঙ্গে বিপ্লব করতে গিয়ে কিছুদিন জেলও খেটে গেছে। রোগা সাহেবটা অল্প কদিনে যা করে গেছে সোমেন হয়তো সারা জীবনেও করতে পারবে না। উলটেপালটে এদেশকে দেখে গেছে ম্যাক্স। তাই তার কথায় নিজের দেশের ওপর আবার আস্থা ফিরে আসে সোমেনের। লক্ষ্মণকে এইসব কথা বলেছিল সোমেন। লক্ষ্মণ অনেক চিন্তা করে বলেছিল—সেক্স আর টেকনোলজি ছাড়া ওদেশে কিছু নেই, এমন নয় সোমেন। তবে ভাল যা আছে তা সবই একটু থমকে গেছে। কিন্তু যেহেতু ওরা খুব উদ্যোগী মানুষ সেইহেতু যেদিন ভুল ধরা পড়বে সেদিনই ভূতের মতো খেটে ভুল শোধরাতে কাজে লেগে যাবে। আমাদের মতো ম্যাদামারা মানুষ ওরা নয়। বারংবার ম্যাক্সও বলে গেছে—সোমেন, ইওর্স ইজ এ গুড কান্ট্রি। আমি বুড়ো বয়সে বেনারসে এসে সেটেল করব দেখো।

বাতাসে সিগারেটটা তাড়াতাড়ি পুড়ে যাচ্ছে। দাদা এখনও সাঁতার কাটছে। বোধ হয় বার দুই-তিন পুকুরটা এপার-ওপার করল। আর বেশিক্ষণ জলে থাকলে ওর ঠান্ডা লেগে যাবে। সোমেন তাই ঢিবির ওপর থেকে নেমে আসে আস্তে আস্তে পুকুরধারে গিয়ে ডাকে—দাদা!

রণেন গলা-জলে দাঁড়িয়ে মুখে জল সমেত বলে—আয় আসবি? তোকে সাঁতার শিখিয়ে দিই।

—আমি জানি দাদা। তুমি উঠে এস।

—আর একটু থাকি। খুব ঠান্ডা।

—সর্দি লাগবে যে।

রণেন তার দিকে তাকিয়ে বলে—পাগলের কখনও সর্দি লাগে না, বুঝলি, সর্দি লাগলে। পাগলামি সেরে যায়।

সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে—তা হলে বউদিকে ডেকে আনি।

রণেন কোমর থেকে গামছা খুলে ছপাং করে জলে লম্বা করে ফেলে বলে—দাঁড়া, উঠছি।

গৃহপ্রবেশ হয়ে গেল। অনেক লোক জুটে ব্রজগোপালের সামান্য জিনিসপত্র মুহূর্তের মধ্যে বয়ে এনে দিল নতুন বাড়িতে। শীলা আর ইলা সাজাতে লাগল। বীণা রান্নাঘর গুছোয়। বলে—মা, আমাদের একটা জায়গা হল এতদিনে।।

ননীবালা গভীর শ্বাস ফেলে বলেন—আর জায়গা! কখনও কি এসে থাকবে বউমা? আমরা বুড়োবুড়ি মাটি কামড়ে পড়ে থাকব মরা ইস্তক। যদি মনে হয় তো এস। আমাদের বুক জুড়িয়ে দিয়ে যেয়ো। মা দুর্গার মতো ছানাপোনা নিয়ে ঝুমঝুমিয়ে আসবে যাবে, তা কি আমার ভাগ্যে হবে বউমা!

সোমেনকে দেখে নিরালায় ডাকেন ননীবালা, বলেন—কিরে, রোগা হয়ে গেছিস নাকি?

—না, তোমাদের সবসময়েই রোগ দেখা।

—হ্যাঁ রে, একা লাগে না ঘরটার মধ্যে ওখানে, অ্যাঁ? মায়ের কথা মনেও পড়ে না বুঝি?

সোমেন হেসে লজ্জার ভাব করে বলে—পড়বে না কেন?

—খুব সিগারেট খাস, না? ঠোঁট কালো হয়ে গেছে। চোখ বসা কেন? রাগবাগ করিস না তো বউদির সঙ্গে?

—না না। তুমি যে কি ভাবো!

ননীবালা কাঙালের মতো বলেন—এখন তো তোর হাতে কোনও কাজ নেই, থাকবি এখানে কদিন?

—এখানে?

—তবে কোথায় বলছি! থেকে যা, একটু শরীরটা সারিয়ে দেবখন। আমাদের দু-দুটো গোরু রোজ পনেরো ষোললা সের দুধ দিচ্ছে। কত তরিতরকারি, মাছ, ফল খায় কে! এত। ঘি আর ক্ষীর করে রেখেছি। আজ সবাইকে দিয়ে দিচ্ছি কলকাতার জন্য। তুই কদিন থেকে যা।।

সোমেন উদাস গলায় বলে—পাগল হয়েছ! কলকাতায় কত কাজ!

—আহা! কী কাজ তা তো জানি! একশো টাকার একটা টিউশানি।

সোমেন মৃদু হেসে বলে—না মা, তুমি খোঁজ রাখো না। সেই টিউশানি আছে বটে, আবার এক বন্ধুর সঙ্গে ঠিকাদারির কাজে নেমেছি।

—তাই নাকি?

অবশ্য আমার তো টাকা নেই, তাই খুব কিছু হয় না। টাকা থাকলে হত।

—তোর বাবার কাছ থেকে নিস।

—বাবা! সোমেন অবাক হয়ে বলে—বাবা কোখেকে দেবেন?

জবাব দিতে গিয়ে ননীবালার গলাটা অহংকারি হয়ে যায়, তবু আস্তে করে বলে—তাঁকে ভিখিরি ভাবিস না। আমার এখানে লক্ষ্মীর বাস। চেয়ে দেখিস, দেবেন।

সোমেন মাথা নেড়ে বলে—এখন থাক। পরে দরকার মতো দেখা যাবে।

খাওয়া-দাওয়া সারতেই শীতের বেলা ফুরিয়ে গেল। দূর মাঠপ্রান্তরে সন্ধ্যার ঘনায়মান। আবছায়া। পাখি উড়ে যাচ্ছে বাসার দিকে। দিনশেষ। সারাদিন লোকজন ছিল, তারা সব। বিদায় নিয়েছে। কুকুরেরা এখনও ঝগড়া করছে এঁটো পাতা নিয়ে, কাক ওড়াউড়ি করছে। হু-হু করে শীতের বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

মেয়েরা তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। সাজও শেষ। ছেলেরা জামাইরা পোশাক। পরে বসে আছে নতুন বাড়ির বারান্দায়। ননীবালা কাঁদছেন শীলার ছেলেকে বুকে চেপে, অন্য হাতে ধরা আছে টুবাই। আঁচল ধরে টান দিচ্ছে ননীচোর। সারাদিনে তার দিদিমার মত খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। বেলকুঁড়ি আর বুবাই কাঁদছে, রণেন ভ্যাবলার মতো বাপের পাশে বসে আছে বারান্দায়। দুই জামাই নিচু স্বরে কথা বলছে পরস্পর। সোমেন বাড়ির বাগানে। কুয়োর ধারে আড়ালে সিগারেট খায়।

কে যেন রাস্তায় হাঁক পাড়ছে—কলকাতার লোকেরা ফিরবে, চারটে রিকশা নিয়ে আয় গগাবিন্দপুর থেকে। ছটার গাড়ি ধরবে সব।।

সোমেন ঘড়ি দেখে বিরক্ত হয়। খুব বেশি সময় নেই। মেয়েছেলে যেখানে, সেখানেই। দেরি।

রিকশা এসে গেল। হর্ন মারছে। ছেলেরা এগিয়ে গেল। মেয়েরা ননীবালাকে ঘিরে কাঁদছে এখনও।।

—আবার কবে আসবি সব? ননীবালা জিজ্ঞেস করেন।

—আসব মা, এখন তো আমাদেরই বাড়ি এটা।

—ওসব মুখের কথা। ননীবালা বলেন—শোন, তোদের বাড়ির সব উৎসব অনুষ্ঠান যখন করবি, তখন এ বাড়িতে এসে করিস। আমি খরচা দেব। কলকাতার মানুষদের না হয় পার্টি। দিবি।

এ সবই স্তোক। জানেন ননীবালা, ওরকম হয় না। হবে না। চোখের জলের ভিতর দিয়ে ভাঙাচোরা দেখায় চারধার। সেই অস্পষ্ট দৃষ্টির ভিতর দিয়েই ওরা চলে গেল। রিকশা। যোজন-বিস্তৃত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। পৃথিবীটা কী বিশাল!

একা-একা ঘরের দিকে ফিরছিলেন দুজন। ব্রজগোপাল বললেন—আজ আর কোথাও বেরবো না।

ঘরে এসে অন্ধকারেই বসলেন ননীবালা। বুকটা খামচে ধরে আছে চাপা একটা দুঃখ, একটা ব্যথা। একটু বাদেই নয়নতারা এসে লণ্ঠন জ্বালে। বিন্দু এসে ননীবালার চুল আঁচড়ে দিতে থাকে। বহেরু এসে বাইরের ঘরে তক্তপোশের তলায় মেঝেতে ব্রজগোপালের পায়ের কাছে বসে থাকে। তত্ত্বকথা শোনে। ষষ্ঠীচরণ তার বইপত্র নিয়ে এসে গুটি গুটি খোলা। দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে। মতিরাম আনাচ-কানাচ দিয়ে ঘুরঘুর করে আর কুকুর বেড়াল তাড়ায়। দিগম্বর খোল নিয়ে এসে বসে বাইরের ঘরের কোনে। ষষ্ঠীর মা আসে খোঁজ নিতে, বহেরুর বউ আসে। ঘর ভরে যায়। মানুষজন বড় ভালবাসেন ব্রজঠাকুর। মানুষজনও তাই তাঁকে ভালবাসে। ননীবালার খারাপ লাগে না। ওরা এসে চলে গেল বলে যে দুঃখটা ছিল। তা উবে গেল মুহুর্তের মধ্যে। একটু বাদেই তিনি হেসে কথা বলতে থাকেন। এখানে তিনি কত্রী, ব্রজবামুনের বামনি ঠাকরুন, তাঁর দাম অনেক।

॥ ছিয়াত্তর ॥

বিখিয়াদের বাড়ির ফোন অনেকক্ষণ ধরে বাজল। এ-পাশে সোমেন কান পেতে সেই গুড়ুক গুড়ুক তামাক খাওয়ার মতো শব্দ শুনছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন কেউ ধরল না। ঘড়ি ধরে প্রায় সাত মিনিট।

কী আর করে সোমেন, হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিল। ওরা হয়তো কেউ বাড়িতে নেই।

রিখিয়ার সঙ্গে একবার মুখোমুখি দেখা হলে বড় ভাল হত। কিন্তু আর তো সময় নেই। কাল বিকেলের ডাকে বিজয়নগর ইস্কুল থেকে একটা চিঠি এসেছে! আজকের তারিখে চাকরিতে যোগ দিতে হবে।

জায়গাটা কত দূরে তা সঠিক জানে না সোমেন। তবে, ইস্কুলের চিঠিতে পথের হদিশ দেওয়া আছে। ট্রেনে ক্যানিং, সেখান থেকে লঞ্চ ধরে গোসাবা। গোসাবার ঘাটে ওরা নৌকো। রাখবে। নৌকোয় আরও ঘণ্টাখানেকের পথ, তারপর খানিকটা হাঁটা। সুন্দরবনের একদম কোলের মধ্যে।

কত কিছু হওয়ার কথা ছিল সোমেনের। হল না। না হল আমেরিকায় যাওয়া, না হল বন্ধুর সঙ্গে ঠিকাদারি ব্যাবসা। লক্ষ্মণদা গিয়ে কোনও আশা ভরসার চিঠি দিলেন না। সোমেনকে। বোধ হয় ভুলেই গেছেন।

বাড়িটা আজকাল খাঁ-খাঁ লাগে। যতদিন যায় তত মায়ের কথা মনে পড়ে। আর শুধুই মা নয়, আরও একটা কী যেন অভাবের হাহাকার বুকের মধ্যে কুয়ো খোঁড়ে দিনরাত। সেটা যে কী তা বোঝা যায় না, ভাষা দিয়ে কিছুতেই তার চেহারা ফোটে না। মনে হয়, কী যেন নেই, কী যেন থাকার কথা ছিল। যখন অপালা, পূর্বা, শ্যামদের সঙ্গে রইরই আড্ডা হয়, সিনেমায় যায়, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরে, ফুটবল মাঠে গিয়ে চেঁচায়, টেস্ট ক্রেকেট দেখতে ভোর রাতে গিয়ে রঞ্জি স্টেডিয়ামে লাইন দেয়, তখনও হঠাৎ হঠাৎ ওই এক ভূতুড়ে কী-নেই কী-নেই ব্যাকুলতায় বুকটা খালি খালি লাগে।

সোমেন সবচেয়ে কম যায় রিখিয়াদের বাড়িতে। বরাবরই সে স্বভাবে লাজুক। আজকাল সে অমোঘভাবে বুঝে গেছে, রিখিয়ার মতো কেউ তাকে এত চুম্বকের মতো টানে না। সমস্ত কাজকর্ম, অন্যমনস্কতার ভিতরেও অলক্ষিতে তার ভিতরে একটা কাঁটা থর থর করে কেঁপে কেঁপে একটা দিক নির্দেশ করে। যে ঘরে কাঁটাটা গিয়ে কাঁপে সেই হচ্ছে রিখিয়ার ঘর। যখনই এটা টের পেল সোমেন তখনই হাতে-পায়ে লজ্জার ভার এসে চেপে ধরল। আজকাল সে কেবলই ভাবে—ছিঃ, বেশি গেলে ও আমাকে হ্যাংলা ভাববে।

কলকাতায় থেকে আর লাভও নেই সোমেনের। পত্রিকা দেখে মফঃস্বলের স্কুলে কয়েকটা দরখাস্ত পাঠিয়েছিল। কয়েকটা স্কুল থেকে ইন্টারভিউ এল। শুধু বিজয়নগর স্কুলই সরাসরি নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। চিঠিটা পেয়ে অনেক ভেবেছে সোমেন। বউদি আর দাদাও শুনেছে।

রাত্রে দাদা খেতে বসে বলল—সুন্দরবন! সেখানে তো খুব বাঘের উপদ্রব হয়েছে শুনি।

বউদি প্রতিবাদ করে বলল—আহা, মানুষ বুঝি তা বলে আর সেখানে নেই!

দাদা মাথা নেড়ে বলে—থাকগে। সোমেনকে যেতে হবে না অত দূরে। মা চলে গেল, বাবা চলে গেল, এখন সসামেন গেলে বাড়িতে টেকা যাবে না। তুই যাবি না সোমেন।

বউদি অবশ্য চুপ করে রইল। কিন্তু সসামেন জানে, বউদির এ ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না। সূক্ষ্ম এক ধরনের অনাদর যেন সে আজকাল টের পায়।।

রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত প্রায় সিগারেট খেতে খেতে ভেবেছে। যাবে কি যাবে না! এতদিনকার কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতে বড় কষ্ট হয়। আবার ভাবে, থেকেই বা হবে কী!

খুব ভোরবেলার দিকে হঠাৎ খুব শান্তভাবে সে সিন্ধান্ত নিল। যাবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে ম্যাক্স-এর একটা সুদূর প্রভাব কাজ করেছিল তার মনে। সে ম্যাক্সকে দেখেছে। পড়াশুনো ফেলে রেখে যখন-তখন বেরিয়ে পড়ত গ্রামে গঞ্জে, সুদূর দুর্গম অঞ্চলে। পয়সাকড়ির চিন্তাও করত না। কখনও গাড়িতে, কখনও পায়ে হেঁটে, যেমন-তেমন করে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে দেখে গেছে ম্যাক্স। শরীরে কোনও আলস্য ছিল না রোগা সাহেবটার। মনে ছিল না কোনও জড়তা বা বন্ধন। সে যেন এই বিশাল দুনিয়ায় এক সদানন্দ মুক্ত পুরুষ, কোথাও নোঙর বাঁধেনি। অনেক চোখে দেখা, উপলব্ধি করা জ্ঞান ঝুলি ভরে নিয়ে গেছে। ম্যাক্স। সোমেনকে সে প্রায়ই বলত—তোমরা কি করে বসে বসে অলস সময় কাটাও? তোমার দেশের লোকের অনেক কাজ পড়ে আছে। শ্রীকৃষ্ণ তোমাদের কর্মের কথা। বলেননি? আর কিছু না পারো, বেরিয়ে পড়ো দেশ দেখতে। তোমার দেশটা কেমন তাও তুমি জানো না সোমেন। শুধু কলকাতা নিয়ে পড়ে আছে।

ম্যাক্স-এর সেসব কথা বড্ড মনে পড়ে সোমেনের। সত্যিই তো, দেশটার কিছু অন্তত তার দেখা দরকার। তা ছাড়া, ইদানীং সংসারের ওপর তার একটা অবুঝ অভিমান জন্ম নিয়েছে। কেবলই তার মনে হয়, কেউ তাকে বোঝে না, ভালবাসে না, আপন বলে ভাবে না। তার নিজের মানুষ কেউই বুঝি নেই।

বিজয়নগর যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করে সে ভোরে উঠে স্যুটকেস গুছিয়েছে নিজেই। বিছানা বেঁধেছে।

ঘুম থেকে উঠে বউদি বলল—ও মা! এ কি! যাচ্ছো না কি?

—যাই বউদি। কিছু একটা করা দরকার।

—আমি তো তাই বলি। কিন্তু তোমার দাদাকে বুঝিয়ে বলে যাও, নইলে আবার অস্থির হবেন।

রণেন উঠে সব শুনেটুনে কেমন উদাস হয়ে যায়। বলে—চলে যাচ্ছিস? তোকে এখনও আমি খাইয়ে পরিয়ে রাখতে পারি।

—সে তো রেখেছই। তবু একটু ছেড়ে দাও এবার। ভাল না লাগলে চলে আসব।

রণেন কি ভেবে অনেকক্ষণ বাদে বলল—যা।

ক্যানিং-এর গাড়ি পৌনে সাতটায়। স্টেশনে এসেই রিখিয়ার বাড়িতে ফোন করবে বলে। ডাক্তারখানায় গেল। দোকানটা খোলেনি তখনও। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বিপিন কম্পাউন্ডারকে। তুলে নিল টেলিফোন করে সোমেন ফিরে আসে স্টেশনে। গলায় একটা কান্নার দলা ঠেলা মারছে। চলে যাচ্ছে রিখিয়া।।

গাড়ি আসে।

স্বপ্নের ভিতর দিয়ে সোমেন যেতে থাকে। ভাবনার ঘোরের আচ্ছন্নতার ভিতর দিয়ে গেল। ক্যানিং-এর দীর্ঘ বাঁধের রাস্তা পার হয়। পুরনো আমলের লঞ্চ, জোয়ার ঠেলে ঘাটে ঘাটে ঠেকে আস্তে ধীরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে কলকাতা থেকে দূরে। দেশের গভর বুকের মধ্যে।

গোসাবার ঘাটে নৌকো ছিল। একজন কালো, লম্বামতো সরল লোক, ধুতি পাঞ্জাবি পরা, দুজন মাঝি সমেত অপেক্ষায় ছিল। পরিচয় দেওয়ার আগেই তারা কী করে যেন চিনে। ফেলল সোমেনকে। লম্বা লোকটা বলল—যেতে তো দেরি হয়ে যাবে। এখনই বেলা একটা। প্রায়। এখানেই এক বাড়িতে আপনার জন্য রান্না করা আছে।

এ জায়গাতে একসময়ে লন্ডন অফ দি ইস্ট বলা হত। হ্যামিলটন সাহেবের কুঠিবাড়ি আছে এখানে। কিন্তু এ গঞ্জে একটুও ভাল রাস্তাঘাট নেই, মোটরগাড়ি বা রিকশা নেই। এক আদিম পৃথিবীর দৱজা খুলে গঞ্জটা বসে আছে। যে বাড়িতে খেলো সোমেন তা গেরস্তবাড়ি।। খুব যত্ন করল।

গোসাবা ছেড়ে পড়বেলায় ছোট নদী বেয়ে নৌকো তাকে নিয়ে চলল কোন অজানা। রাজ্যের মধ্যে। দুধারে হেতালের বন, গোমমা গাছের সারি, শুকনো পাতা ঝরছে। নিচ্ছিদ্র নীরবতা। ঘনিয়ে আসছে মৃত্যুর মতো হিম শীত।।

কলকাতায় এখন আর তত শীত নেই। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ চলছে। কিন্তু এখানে শীতের কামড় বসে আছে। নদীর ওপরে একটি ভাসা বাতাস। ঘোলাটে কুয়াশা। লালচে রোদ গাছগাছালির দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে।

লম্বা লোকটা ওই স্কুলের সেক্রেটারি। বলল—এখন কোনও ভয়টয় নেই। সাপখোপ এ সময়ে থাকে না।

—বাঘ?

লোকটা হেসে বলে—বাঘ কোথায়? সে অনেক দূর সেই রিজার্ভ ফরেস্টে। দুই আড়াই মাইল হবে।

বাঘের কথা অবশ্য মোটেই চিন্তা করছিল না সোমেন; এমনিই মনে পড়ল বলে বলল। সে ঝুকে নদীর ঠান্ডা চলন্ত জলে হাত দিয়ে এককোষ জল তুলে ছিটিয়ে দিল। দুলে দুলে নৌকো যাচ্ছে।

সেক্রেটারির চিঠিতে গোটা তিনেক ভুল ইংরেজি ছিল, মনে পড়ল। সোমেনের একটু হাসি পেল। কিন্তু লোকটা এমনিতে বেশ আলাপী। ভাল লোক, না মন্দ লোক তা বুঝতে কিছু সময় লাগবে সোমেনের।

লোকটা ইস্কুলের এক গণেশবাবুর নিন্দে করছিল খুব। বার বার বলল—ওদের গ্রুপের সঙ্গে একদম মিশবেন না কিন্তু। ইস্কুলটার ওরাই সর্বনাশ করছে।

এসব কথা সোমেনের গভীরে পৌঁছোয় না। সে শুধু ভাবে, এখানকার নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, গভীর নিস্তব্ধতা, আর নিঃসঙ্গ সময় তার কেমন লাগবে?

মাইলের পর মাইল কোনও গ্রামের চিহ্ন প্রায় নেই। এক-আধটা ছোট গাঁ-ঘর দেখা যায় বটে, তারপর অনেকটা ফাঁকা। নদীর ধারে কোনও মানুষ, কুকুর, বেড়াল কিছু চোখে পড়ে না।

নৌকো ভিড়ল এক আঘাটায়। ভাটির টানে জল সরে গিয়ে গোড়ালি-ডুব কাদা বেরিয়ে পড়েছে। টকটকে লাল রঙের হাজার হাজার কাঁকড়া হালকা পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাদার ওপর। মানুষের সাড়া পেয়ে মাটিতে সেঁধিয়ে গেল।

কাদায় পা দিতে হল না সোমেনকে। মাঝি দুজন তাকে কাঁধে বয়ে পিছল খাড়া পাড় বেয়ে বাঁধে দাঁড় করিয়ে দিল। মালপত্র তুলে নৌকোটা টেনে হড় হড় করে কাদায় এনে ফেলল। তারপর রওনা দিল সবাই। আদিগন্ত মাঠ ভেঙে পথ আর ফুরোয় না। টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। গভীর ছায়া ঘনিয়ে আসছে মাঠে। দূরে এক সবুজাভ গভীর বনের রেখা দেখা যায়। সেক্রেটারি দেখিয়ে বলল—ওই ওখানে বড় নদীর ধারে রিজার্ভ ফরেস্ট।

সোমেন বৈরাগ্যভরে দেখল। এদিকে রাস্তাঘাট নেই। যানবাহন চলে না। বহেরুর গ্রাম এর তুলনায় অনেক আধুনিক।

সেক্রেটারি বলল—ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। এখনও তেমন কিছু হয়নি।

কলকাতা থেকে কত দূরে যে এসে পড়ল সোমেন! শীতের সন্ধ্যার মতোই ভার আর বিষন্ন হয়ে গেল মনটা। বড় অনাত্মীয় এই গ্রাম। বড় অচেনা। মনটা খারাপ হতেই ফের ম্যাক্স-এর মুখ মনে পড়ে গেল। রোগা, তীব্র কৌতূহলে ভরা একখানা মুখ। পোড়-খাওয়া। রোদে জলে ঘাতসহ একটা চেহারা। পৃথিবীর মানুষ।

ইস্কুলের সায়েন্সরুমের এক পাশে চৌকি পাতা। হারিকেন জ্বলছে।

—এইখানে থাকবেন। ইস্কুলের বেয়ারাও থাকে, রান্নাবান্নাও সেই করে দেবেখন।

সন্ধেবেলা কয়েকজন দেখা করতে এল। অন্যরকম মানুষ সব। কেউ বেশি চালাক-চালাক। কথা বলে। কেউ একটু ঠেশ দিয়ে দু-চারটে বাকা বলে। দু-একজন বেশ গম্ভীর। সে এসেছে। বলে কেউ কি খুশি হয়েছে? কিংবা দুঃখিত? বুঝল না সোমেন। হারিকেনের আলোয় সে তো ভাল দেখতে পায় না। অভ্যাস নেই।

দিন যায়। রাত যায়। ক্যালেন্ডার দেখে না সোমেন। ইস্কুলের সময়ে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে বহুদূর থেকে ছেলেদের আসতে দেখে। যেন ওরা মাটির ভিতর থেকে উদ্ভিদের মতো জন্ম নিয়ে চলে আসছে, আবার ছুটি হলে ফিরে যাবে মাটির তলায়। রাত হলে সারা ইস্কুলবাড়িটায় ফাঁকা নির্জনতায় হাওয়া বয়ে আসে অদূর সমুদ্র থেকে। কত দেশ দেশান্তরের কথা বলে।

কয়েকবারই পৌঁছে সংবাদ দেবে বলে পোস্টকার্ডে ঠিকানা লিখে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত কাউকেই চিঠি দিল না। বুকজোড়া কেন যে এই অভিমান! মনে হয়, তাকে কেউ বুঝল না, চিনল না, কেউ ভালবাসল না। তার জন্য কে ভাবছে বুকভরা দুঃখ নিয়ে? কেউ না।।

সারাটা দিন প্রায়ই কাজ থাকে না। চার-পাঁচটা ক্লাস করে সোমেন। তারপরই কর্মহীনতা। দু-চারজন তাস খেলতে নিয়ে গেছে কয়েকবার। এক রাতে যাত্রা দেখল দুটো বিয়ের প্রস্তাব এসে গেল এর মধ্যেই। ছাত্রদের বাড়ি থেকে প্রায় সময়েই নানারকম ফল, সবজি বা মাছও আসে। মাসখানেকের মধ্যে দু-চারজন ছেলে লণ্ঠন ঝুলিয়ে চলে এল প্রাইভেট পড়তে, সন্ধেবেলাটায় কাজ পেয়ে বেঁচে গেল সোমেন। মাথাপিছু কুড়ি টাকা মাসে, তাতে প্রায় আশি। টাকা বাড়তি রোজগার।

প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই একদিন ঠিক করল, কলকাতা যাবে। ভেবে শনিবার টিফিনে ছুটি করে নিয়ে সাজগোজও করে ফেলল সে। ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি। হঠাৎ বেরোবার মুখে। হার্ট অ্যাটাকের মতো একটা অভিমানের যন্ত্রণা দেখা দিল বুকে। কেন যাব? কার কাছে যাব? আমার তো কেউ নেই!

সাজ খুলে না ফেলেই অনেকক্ষণ বসে রইল সোমেন। জানলা দিয়ে পুকুরঘাটে গাছের ছায়ায় চেয়ে রইল। একটা গরিব মেয়ে কচুর শাক তুলছে। অনেকক্ষণ চেয়ে রইল সোদকে। ভাবল, এ জায়গায় যতদিন মন না বসছে ততদিন কলকাতায় না যাওয়াই ভাল। তা হলে আর ফিরতে ইচ্ছে করবে না।

গেল না সোমেন। সে কাউকে চিঠি দেয়নি, ঠিকানা জানায়নি। সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ হয়ে। আছে। এ অবস্থাটা আরও কিছুদিন চলুক। চারদিকে তার খোঁজ হোক। তারপর দেখা যাবো।

একদিন ছুটির দুপুরে শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সোমেন। ব্রাহ্মণভোজনের একটা নিমন্ত্রণ ছিল এক বাড়িতে। খুব খাওয়া হয়েছে। এক টাকা দক্ষিণাও পেয়েছে। একজন বুড়ো। লোক নেমতন্ন বাড়িতে তাকে ডেকে বলল—আমার বাবার বাৎসরিকে মন্ত্রটা সামনের। রোববার একটু পড়িয়ে দেবেন মাস্টারমশাই।

সোমেন বলে—মন্ত্র তো জানি না।

লোকটা বিশ্বাস করে না, কেবল বলে—ও আর জানাজানি কী! বিপ্রের ছেলে। আপনারা অং বং যা বলবেন তাই মন্ত্র। রক্তটা তো গায়ে আছে।

সোমেন সেই কথা ভেবে আপনমনে হাসে। ক্ষতি কি? একখানা পুরোহিত দর্পণ জোগাড় করে অবসর সময়ে বসে শিখে নেবে। তার বাবা ব্রজগোপাল এরকম কত করেছেন।

ভেবেই হঠাৎ থমকে গেল সোমেন। মনটা পাশ ফিরল। বাবা! আরে, সোমেনও যে ঠিক তার বাবার মতোই হয়ে যাচ্ছে। এই রকমই এক অভিমানে তার বাবাও গিয়েছিলেন। স্বেচ্ছানির্বাসনে। দূরে বসে একটা জীবন সকলের মঙ্গল চেয়েছেন। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।

সোমেন ঠ্যাং নাচানো বন্ধ করে উঠে বসল। বুকে একটা চাপা বেদনার দম আটকানো ব্যথা। সবাইকে ছেড়ে সে চলে এসেছে কত দূরে। এই নিঝুম দুপুরে বসে সে হঠাৎ বুঝতে পারে আজ, কারও ওপর রাগ করে থাকার, অভিমান করে থাকার কোনও মানেই হয় না। সেটা ভীষণ বোকামি হবে।

একটা বাঁধানো খাতায় কয়েকটা কবিতা লিখেছিল সে। সেই খাতাখানার মাঝখানে একটা সাদা পাতা বের করে সে গভীর মনোযোগে সুন্দর হাতের লেখায় লিখল—ভগবান, উহারা। যেন সুখে থাকে।

লিখে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল লেখাটার দিকে। একসময়ে চোখের জলে দৃষ্টি ছেয়ে গেল। ঝাপসা হয়ে আসে বাক্যটি। সোমেন উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে একটু কাঁদে।

তিন মাস পেরিয়ে চার মাসে পড়ল সোমেনের চাকরি। এবার গ্রীষ্মের ছুটি হবে। বড় অসহায় লাগে সোমেনের। দুঃসহ এই ছুটি কি করে কাটাকে সে।

এর মধ্যে সে অনেকবার গোসাবায় গেছে। সুন্দরবনে ঘুরে বেড়িয়েছে, পক্ষী-আবাস দেখতে গেছে। এ অঞ্চলটা ক্রমশ তার অভিজ্ঞতায় চলে আসছে। স্কুলের সবাই তাকে পছন্দ করছে আজকাল। তার সুন্দর চেহারাটি, তার নম্র কথাবার্তা, এ সবই তার বরাবরের মূলধন ছিল। কদাচিৎ কেউ তার শত্রু হয়েছে। সোমেন জানে, মানুষকে ভোলাবার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে তার। কয়েকটা মেয়ের বাপ বড় জ্বালাতন করে আজকাল, তার বাবার ঠিকানা চায়। এ ছাড়া এ অঞ্চলে তার আর কোনও ঝামেলা নেই। কিন্তু এই ছুটি কাটানো বড় মুশকিল হবে।

কলকাতায় যাবে? না, সেটা ঠিক হবে না। সোমেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

মে মাসের গোড়ায় কলকাতার নামজাদা এক সাপ্তাহিকে তার একটা কবিতা বেরল। ক্যানিংয়ে লোক গেলে সে মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকা আনিয়ে নেয়। একদিন এরকমই। আনানো কাগজে নিজের কবিতা দেখে বড় অবাক হয়ে গেল সে। অনেক জায়গায় পাঠিয়েছিল কবিতা, এই প্রথম ছাপা হল বড় কাগজে।

খুব কি আনন্দ হল সোমেনের?

না। কারণ, এখানে তার আনন্দে আনন্দ করার কোনও ভাগীদার নেই। আনন্দ তো একার জন্য নয়।

নিজেকেই সে প্রশ্ন করল—জীবনের সব ক্ষেত্রেই কি কথাটা সত্যি নয় সোমেন? জীবনে একা-একা কোনও উপভোগ হয় না। জীবনে যত রকমের আনন্দ আছে তার সবই ভাগ করে নিতে হয়।

মাঝখানে দাড়ি কেটে ফেলেছিল সোমেন। এখন আবার রাখছে। তার দাড়ির রং অল্প লালচে আর নরম। গালে হাত বোলালে রেশমের স্পর্শ পাওয়া যায়। চুলও ছাঁটে না। অনেকদিন। অল্প ঢেউ-খেলানো চুল প্রায় কাঁধে নেমে এল। তার কাছে আয়না নেই। চিরুনিরও ব্যবহার খুব কম। চেহারাটা কেমন দেখতে হয়েছে আজকাল তা তার জানা হয় না। চেহারা নিয়ে কোনও ভাবনাও নেই তার। তাকে সুন্দর দেখলে খুশি হয় এমন মানুষজন। থেকে সে বহুদূরে রয়েছে। এখন তার কেমন একটা আপনভোলা অবস্থা।

সে আজকাল মাছের জাল ফেলতে শিখেছে, নৌকো বাইতে পারে, অল্পস্বল্প চাষবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছে। আগে গাছপালা চিনত না, অড়হর গাছকে ভাঙ গাছ বলে ভুল করত। এখন সে সব ভুল বড় একটা হয় না। ইস্কুলের জমি কুপিয়ে চমৎকার বাগান বানিয়ে ফেলেছে। এইভাবে সে এখানকার আবহাওয়ায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে প্রাণপণে।। মাঝে মাঝে ভাবে—এখানেই একটা যে কোনও মেয়েকে বিয়ে করে ফেলি না কেন? হয়ে যাই এখানকার স্থায়ী লোক?

যেই ভাবে অমনি অলক্ষ্যে মেঘগর্জনের মতো ডেকে ওঠে এক অন্ধ ও সতর্ক কুকুর। চোখে ঝলসে যায় একটা ক্যামেরার লেনস। এ তার একটা মনোরোগ। কেন যে বার বার সেই কুকুরটার কথা মনে পড়ে, আর সেই ক্যামেরার মস্ত একচক্ষু গভীর কাচ!

সে কি খুব বিখ্যাত কবি হবে একদিন? কিছু একটা হবে? মানুষের মতো মানুষ কোনও? নাকি, হয়ে থাকবে এক অসফল ও অভিমানী মানুষ? কিংবা এক ব্যর্থ প্রেমিক? আস্তে আস্তে সে কি হয়ে যাবে একদিন গেঁয়ো কবিয়াল।

বেশ সোরগোল তুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী করাল সে ছেলেদের দিয়ে। গ্রীষ্মের ছুটির দিন। নিজের লেখা একটা নাটক অভিনয় করাল। লোক ভেঙে এল দেখতে। সারাক্ষণ দেখলেও সবাই চোখ কান মন দিয়ে। খুব একটা আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেল সে। নাটকের পর অনেকে এসে পিঠ চাপড়াল।

তবে কি তার ভবিষ্যৎ বাঁধা আছে নাটকের সঙ্গে?

ঠিক বুঝতে পারে না।

গ্রীষ্মের ছুটি পড়তেই দুরন্ত গরমের মধ্যে সে একবার বেরোল পদযাত্রায়। গাঁয়ে গায়ে। অনেক চেনা হয়ে গেছে। কোথাও তেমন অসুবিধে হয় না। রাস্তাঘাট নেই, যানবাহন নেই, মাঠ ময়দান পেরিয়ে তবু চলে যেতে আজকালতার অসুবিধে হয় না। বর্ষার কাদা অনায়াসে। ভাঙে। চার মাসে সে এক জীবনের অভ্যাস অর্জন করছে।

একদিন গোসাবার নদীর ধারে জ্যোৎস্নারাত্রে বসেছিল আদিনাথ নামে আর একজন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। গত দুদিন সে আদিনাথের বাড়িতে আছে। খুব খাতিরযত্ন করে আদিনাথ, কিন্তু তার সঙ্গে সোমেনের মনের পার্থক্য অনেক। সোমেন যেমন গভীরভাবে ভাবতে পারে, অনুভব করতে পারে, আদিনাথ তা পারে না। রাত বারোটার বিপুল জ্যোৎস্নার রহস্যানুভূতি সোমেন যেমন টের পায়, আদিনাথ পায় না। বার বার সে একটা নৌকো চুরির গল্প বলার চেষ্টা করে অবশেষে কাত হয়ে শুয়ে ঘাসে ঘুমোতে লাগল। একা বসে জেগে থাকে সোমেন। পৃথিবীতে এখন সে সম্পূর্ণ একা। যেখানে সে বসে আছে তার বিস হাত পিছনে আদিনাথের ঘুমন্ত বাড়ি। কেউ কোথাও জেগে নেই। বসে থেকে সোমেন জলে জ্যোৎস্না দেখে। কোনও মানে হয় না এই জেগে বসে থাকার, তবু থাকে। একটা আচ্ছন্ন মাতলা ভাব। ভিতরে এক অবিরল অস্থিরতা। কেবলই মনে হয়, কী নেই! কী একটা। নেই যেন!

সে কি মেয়েমানুষ সোমেন? নিজেকেই প্রশ্ন করে সে। নিজেই ভেবেচিন্তে বলে, হবেও বা। মেয়েমানুয বউ হয়ে এসে জীবনের অনেকখানি একাকীত্ব কেড়ে নেয় বটে, কিন্তু সবটুকু কি পারে নিয়ে নিতে? পারবে কি কিশোরী রিখিয়া?

রিখিয়ার কথা কেন যে ভাবে সোমেন! ভাবার কোনও মানেই হয় না। সে তো এক পেঁয়ো ইস্কুলমাস্টার হয়ে গেল ক্রমে। রিখিয়াদের বাড়ির মাপ মতো পাত্র তো সে নয়। তবে ভেবে কি হবে। তার ভাগ্য তাকে সফলতা দেয়নি, কিছুই হতে দেয়নি জীবনে। তবে কেন এই চাঁদের দিকে দুহাত বাড়ানো ভিখিরির মততা? দেশে তার মতো কত লক্ষ লক্ষ ছেলে তারই মতো অসফল জীবনযাপন করছে। সে তবু যা হোক একটা কাজ পেয়েছে, কত ছেলে তাও পায়নি। গণেশবাবুর দলের সঙ্গে সেক্রেটারির গণ্ডগোল ছিল বলেই সেক্রেটারি তাড়াহুড়ো করে বাইরের ছেলে সোমেনকে চাকরি দিয়েছিল। নইলে এই সামান্য মাস্টারিটুকুর জন্যও উমেদার কম ছিল না, এখানে এসেই সে খবর পেয়েছে। এ কি তার সৌভাগ্য নয়?

সোমেন নিজেকে বলে, এর চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার ছিল না তোমার।

গাব্বকে এখন কে পড়াচ্ছে। অণিমা কি ফিরল শ্বশুরবাড়ি থেকে? ওর বাচ্চাটাচ্চা হবে কি? অপালা কি মিহির বোসকে এখনও খেলাচ্ছে? পূর্বার বুঝি এখনও কোনও প্রেম হল না, বিয়ে হবে কি? অনেকদিন হেমন্তকে দেখে না সোমেন, গেস্ট কিন ছেড়ে মুম্বই যাবে বলেছিল, চলে গেছে নাকি! একে একে বুবাই টুবাই বেলকুঁড়ি, ননীচোর, বড়দির বাচ্চাটা সকলের কথা মনে পড়ে।

বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের খাঁজে একটা জোঁক লেগেছে। প্রথম প্রথম এ অঞ্চলে এসে গায়ে জোঁক লাগলে টের পেত না সে, আজকাল পায়। জোঁকটা আঙুলে টিপে ধরে ছাড়িয়ে আনল সে। ছুঁড়ে জলে ফেলে দিল। তারপর আদিনাথের ডেকে বলল—চলো, শুয়ি পড়ি ঘরে।

হাই তুলে আদিনাথ উঠে বসে বলল—জ্যোৎস্নার আর হাওয়ায় ঘুমটা এত জমে!

ঘুমের সঙ্গে জ্যোৎস্নার কী সম্পর্ক তা না ভেবেই সোমেন অন্যমনস্কভাবে হু’ দিয়ে হাঁটতে থাকে। তখন টের পায়, বুকে এখনও একখানা আস্ত পাথরের মতো অভিমান জমে আছে। সকলের ওপর, গোটা পৃথিবীর ওপর তার রাগ।

রিখিয়ার ওপরও। কিন্তু রিখিয়া তো কোনও দোষ করেনি। সোমেনের তবু অভিযোগ, কেন রিখিয়া অত বড়লোকের ঘরে জন্মাল? যদি আমাদের মতো ঘরে জন্ম নিতে তুমি রিখিয়া, তবে কবে তোমাকে বউ করে নিয়ে আসতাম এই সুন্দরবনের গাঁয়ে। কুঁড়েঘরে ডেরা বাঁধতাম।।

মাস ছয়েক আগে এক শীতের বিকেলে রিখিয়াদের বাড়ি গিয়েছিল সোমেন। সেই শেষবার। তারপর আর যাওয়া হয়নি।

রিখিয়া বসেছিল দোতলার বারান্দায়, রেলিঙে হাত, হাতের ওপর থুতনি। একটু কৃশ হয়েছে, একটু গম্ভীরও। তাকে ফটক দিয়ে ঢুকতে দেখেই উঠে ঘরে চলে গেল। হাসল না। পর্যন্ত। রাগ হয়েছিল সোমেনের।

স্বভাবসংকোচের সঙ্গে সিড়ি বেয়ে যেমনি দোতলায় পা দিয়েছে সোমেন, অমনি এক কপাটের আড়াল থেকে আধখানা বেরিয়ে এসে থমথমে মুখে রিখিয়া বলল—খুব, না?

কী খুব?

এমনিতেই আমাদের মন ভাল নেই, তার ওপর আবার একজনের এমন অহংকার হয়েছে। আজকাল।

সসামেন একটু লাল হয়ে বলে—মন ভাল নেই কেন?

বাবা লন্ডন থেকে ঘুরে এল। দাদা ওখানে বিয়ে করেছে।

ওঃ। সোমেন খুব অবাক হয় না। বলে—আমার অহংকার কীসে দেখলে? বরং আমি। লজ্জায় আসতে পারি না।

তুমি ভীষণ অহংকারী।।

‘তুমি’ শুনে কেঁপে গেল সোমেন। কথা এল না মুখে।

রিখিয়া তক্ষুনি ভুল সংশোধন করে বলল—মা পথ চেয়ে থাকে, রোজ জিজ্ঞেস করে—ওরে, সোমেন আসে না? মার ধারণা, আমি একজনের সঙ্গে ঝগড়া করেছি, তাই একজন। আসছে না।

সেই ‘একজন’ যে সে নিজেই তা ভেবে এই এতদিন পরেও গা শিউরে ওঠে। মন আনচান করে সোমেনের।

সসামেন রিখিয়ার দিকে চেয়ে বলল—আবার আপনি-আজ্ঞে হচ্ছে কেন? দিব্বি তো। তুমি করে বলে ফেলেছ। ওটাই চলুক।

রিখিয়া জিভ কেটে বলে—ওমা, কখন বললাম! যাঃ। ওটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।

সেদিন চলে আসবার আগে রিখিয়া পরদার কাছে কেমন একভাবে দাঁড়িয়েছিল। অকপট চোখে নির্লজ্জের মতো দেখছিল সোমেনকে। দুটি বড় বড় চোখ ভরে নিথর মুগ্ধতা। নিচু স্বরে বলল—শোনেনা, বিদেশে যেয়ো না।

—যাচ্ছি না।

আমার মন ভীষণ খারাপ। তুমি কেন আসো না?

সোমেন বলল—লজ্জা করে। ভীষণ।

একদিন তোমাদের বাসায় নিয়েও গেলে না বেড়াতে। বেশ!

সোমেন একটা গভীর শ্বাস চেপে রেখে বলল—নিয়ে যাব একদিন।

দেখব কেমন নিয়ে যাও!

নিশুত রাতে আদিনাথের বাইরের ঘরে একা বিছানায় উঠে বসল সোমেন। চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এক্ষুনি চলে যেতে ইচ্ছে করছে।

প্রবল মনের জোরে নিজেকে ঠেকাল সোমেন, যেমন স্রোতের উজানে নৌকাকে কষ্টে। নিয়ে যেতে হয় তেমনি এক অসম্ভব কষ্টে উজিয়ে আনল নিজের মনকে। তবু স্রোত টানে।। অন্ধের মতো টানে।

॥ সাতাত্তর ॥

স্কুল খুলতে আর মোটে দশ দিন বাকি। বাসন্তী থেকে লঞ্চ-এ ফিরতে একটা লোকের বগলে খবরের কাগজ দেখে চেয়ে নিয়েছিল সোমেন। রবিবারের বড় কাগজ দেখতে দেখতে দুইয়ের পাতায় ‘নিরুদ্দিষ্টের প্রতি কলমে চোখ আটকে গেল। এ কলমে অনেক মজার বিজ্ঞাপন বেরোয় বলে সোমেন নিয়মিত পড়ে। আজ দেখল, প্রথম বিজ্ঞাপনেই তার একটা অস্পষ্ট ছবি, নীচে লেখা—সোমেন, কোথায় আছ ঠিকানা জানিয়ে চিঠি দাও। সবাই আমরা চিন্তিত। মা বাবা শয্যাশায়ী। দাদা রণেন।।

বিজ্ঞাপন দেখে হঠাৎ হেসে ফেলে সোমেন।

তারপর গম্ভীর মুখে দাড়িতে হাত বোলায়। খবর না দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।

কলেজ-ঘাটে লঞ্চ লাগতেই নেমে পড়ল সোমেন। সেখান থেকেই ক্যানিংয়ের ফিরতি লঞ্চ ধরল দুপুরে।

সন্ধেবেলা যখন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে ঢুকছে তখন তার পরনে সাধারণ পাজামা আর পাঞ্জাবি, গালে দাড়ি, কাঁধে ঝোলা, মুখে একটু অপরাধী হাসি।

দাদা বউদি প্রথমে চিনতেই পারেনি কয়েক সেকেন্ড, তারপর হইচই বেধে গেল। রণেন। রেগে গিয়ে চেঁচাতে থাকে—এ তুই কী হয়েছিস! আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জোগাড়। প্রত্যেক দিন শীলা আর ইলা খবর নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে কান্নাকাটি। তোর বউদির অবস্থা নিজের চোখে দ্যাখ, কী রকম শুকিয়ে যাচ্ছে সব। |

কথাটা মিথ্যে নয়। বউদি কেঁদেও ফেলল কথা বলতে গিয়ে। বলল—তোমাকে যেতে। তো আমিই বলেছিলাম সোমেন। সেই অপরাধে দিনে দশবার মাথা খুঁড়ছি।

—মা বাবা শয্যাশায়ী বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছ। সত্যি নাকি?

ন। খবর দিলে দুজনেরই স্ট্রোক হয়ে যেত। প্রতি সপ্তাহেই চিঠিতে তোমার কথা লেখেন দুজনে। তোমার চাকরির খবর দিয়েছি নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা জানাইনি।

সোমেন ফের আড্ডা দিতে বেরল। কলকাতাকে অনেক ঘিঞ্জি, ময়লা আর দূষিত বলে মনে হয়। জীবাণুর মতো মানুষ। এ কয় মাসে তো আর কলকাতা পালটায়নি। সোমেনের মন আর.চোখই গেছে পালটে।

পরদিন সকালে বউদি সেফটি রেজার, জল আর আয়না সাজিয়ে দিয়ে বলল—জঙ্গল। সাফ করো তো বাপু, সুন্দর মুখখানা একটু দেখি। নইলে বুঝতে পারছি না, আমার দেওরটাই এল না অন্য লোেক দেওর সেজে এসেছে। কী কালো হয়ে গেছ সোমেন! |

রোগা হইনি তো বউদি?

ন।, একই রকম।

সোমেন হাসল। বলল—তার মানে, একটু গত্তি লেগেছে গাছে কি বলল? তোমরা তো নজর লাগার ভয়ে কাউকে মোটা হয়েছ’ বলতে পারো না।

থুঃ থুঃ। বলে বউদি গায়ে থু থু ছিটোনোর ভাব করে বলল —রং-টা একদম জ্বলে গেছে। অমন রং কি আর ফিরে আসবে?

নোনা জল-হাওয়ায় ওরকম হয়। রং দিয়ে হবেই বা কি বলো! কেউ তো পছন্দ করল ন।।

তাই বুঝি! বলে বউদি ঘরে গিয়ে তক্ষুনি দুটো নীল মুখবন্ধ খাম নিয়ে ফিরে এসে। বলল—মনে ছিল না, কতদিন হল এসে পড়ে আছে। ঠিকানার লেখা দেখে তো মনে হয় পছন্দের লোকই লিখেছে।।

সোমেন খাম দুটো নিয়ে সস্নেহে বীণার দিকে চেয়ে বলে—খুলে পড়োনি তো!

তেমন ভাব নাকি? আচ্ছা যা হোক। পড়লে পড়েছি। ঠিকানা দেবে না, নিরুদ্দেশ হয়ে থাকবে, তো আমরা করব কী? ঠিকানা জানা থাকলে কবে রি-ডাইরেক্ট করে দিতাম।

রিখিয়ার হাতের লেখা সসামেন চেনে। ঝরঝরে। পরিষ্কার, গোটা গোটা অক্ষর। প্রথম। চিঠিটা এসেছিল দুমাস আগে। ছোট্ট চিঠিতে লেখা—কতদিন দেখা নেই। ভয় হচ্ছে বিদেশে চলে যাননি তো? যাবেন না প্লিজ, তা হলে আমার কেউ থাকবে না।…

দ্বিতীয় চিঠিটা বড়। মাত্র সাত আটদিন আগে এসেছে। রিখিয়া লিখেছে..যদি কখনও। এমন ঘটে যে, আপনার সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক রইল না। আমার কথা আপনার মনেও। পড়বে না, জানি। আমার খুব মনে হবে। একদিন অনেক খুঁজে খুঁজে গিয়েছিলাম আপনাদের বাসায়। শুনলাম, মাস্টারি নিয়ে সুন্দরবনে গেছেন। কী ভীষণ কান্না পেয়েছিল শুনে। ঠিকানাটা পর্যন্ত জানাননি। কত ভয় হয় জানেন না তো! আপনি এরকম কেন? যদি চিঠি পান, তবে? তবে কী করবেন? বলে দিতে হবে? নাকি নিজের বুদ্ধিমতো কাজ করবেন? আমি বড় একা। কেন বোঝেন না?…

সোমেন মুখ তুলে বীণাতে বলল—রিখিয়া এসেছিল নাকি বউদি?

বীণা ভ্রু কুঁচকে বলল—রিখিয়া মানে? মায়ের সেই সইয়ের মেয়ে তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, মস্ত গাড়ি করে একদিন তোমার খোঁজে এসে হাজির। বাচ্চাদের জন্য এত মিষ্টি আর খেলনা এনেছিল। ও কি তারই চিঠি?

হুঁ। সোমেন আস্তে বলে।

বেশ দেখতে। শ্যামলার মধ্যে মিষ্টি চেহারা। ভীষণ লাজুক। বিয়ে করো না ওকে সোমেন! করবে? তোমার দাদাকে বলি?

দূর! ওরা আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে কেন? আমার কী আছে?

বাজে বোকো না। ভালবেসে বিয়ে করবে, কার কী? দরকার হলে রেজিস্ট্রি করে রাখো, আমি সাক্ষী দেব।

দেবে? বলে হেসে ফেলল সোমেন। বলল—খুব চালাক হয়েছ। শহরে থেকে থেকে অ্যাঁ!

করবে বিয়ে? করো না, লক্ষ্মীটি। দাও তো চিঠিগুলো, দেখি কী লিখেছে।

সোমেন চিঠিগুলো দিয়ে দিল অনায়াসে।

বউদি পড়তে লাগল। পড়ে ভিজে চোখে চেয়ে বলল—আহা রে, কত প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালবাসে মেয়েটা। ওকে যদি ফিরিয়ে দাও সোমেন, তোমার সঙ্গে আমি আর কোনওদিন কথা বলব না।

সোমেন চুপ করে রইল।

সোমেন দাড়ি কামাল না, ফরসা জামাকাপড় পরল না। খুব সাধারণভাবে একদিন চলে গেল রিখিয়াদের বাড়ি। তার শরীর জুড়ে এক তপ্ত জ্বরভাব। সমস্ত স্নায়ুগুলো টনটন করছে এক ক্ষ্যাপাটে আবেগে। যে কোনও সময়ে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে।

রিখিয়া কোখেকে কীভাবে তাকে দেখেছে কে জানে, কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই, নীচের প্রকাণ্ড টবে একটা দেড় মানুষ উঁচু ঘর-সাজানো পামগাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে ভরা চোখে দেখছিল তাকে। তখনও হাঁফাচ্ছে রিখিয়া।

সোমেন তাকে দেখতে পায়নি, স্নায়বিক এক অসহ্য তাড়নায় খুব দ্রুত উঠে গিয়েছিল। মাঝসিড়ি অবধি।

তখন চাপা, জরুরি গলায় রিখিয়া ডাক দিল—শোনো!

ক্ষ্যাপা বাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল সোমেন। পাজামা, পাঞ্জাবি পরা, দাড়িতে চুলে এক জবরজং মূর্তি। খুব চেনা লোকও হট করে চিনতে পারবে না। কিন্তু রিখিয়ার চোখ ভুল করবে কেন! আর, সেই ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে এমন একটা সতেজ সৌন্দর্য ফুটে উঠল সোমেনের যা রিখিয়া কখনও দেখেনি। সোমেনের সৌন্দর্যের মধ্যে এতকাল ছোট্ট একটু অবাক ছিল বুঝি, সে অভাব পূর্ণ হয়ে সোমেন এখন কানায় কানায় সেই পুরুষ, যার সম্পর্কে। রিখিয়ার আর কোনও দ্বিধা নেই।

পামপাতার আড়ালে খুব সাধারণ একটা সাদা খোলের কালোপেড়ে শাড়ি পরে রিখিয়া দাঁড়িয়ে। হাতে পোর মোটা বালা, কানে পলার টব, এলো চুল ঢলের মতো নেমেছে। পিছনে। কচি মুখখানা একটা হাসি কান্নার আলোছায়া ফুটে আছে।

মাঝসিঁড়ি থেকে নিজের লম্বা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে অপ্রতিভ হাসি মুখে সোমেন নেমে এল হলঘরে। বলল—খুব মুডে ছিলাম, তাই তোমাকে দেখতে পাইনি।

রিখিয়া কোখেকে ছুটে এসে এখানে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখনও হাঁফাচ্ছে অল্প। নাক ফুলে ফুলে উঠছে ঘন শ্বাসে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একটু হাসল, তারপর দুধারে মাথা নেড়ে বলল—ওপরে যেতে হবে না।

কেন?

পরে যেয়ো। অন্য দিন। তুমি কখনও আমাকে কোথাও নিয়ে যাওনি। আজ নিয়ে যাবে?

শৈলীমাসির সঙ্গে দেখা করব না?

পরে কোরো। আজ আমার অনেক কথা আছে।

কোথায় যাবে?

বাঃ, তার আমি কী জানি? একজন যেখানে নিয়ে যাবে।

তা হলে মাসিকে বলে নাও। পোশাক পালটাবে না?

কিছুই করব না।

সোমেন হেসে ফেলে বললএক—বস্ত্রে চলে যাবে?

রিখিয়ার চোখ ঝিকমিকিয়ে উঠল, বলল—রাজি।

কলকাতার কোথাও বেড়ানোর তেমন জায়গা নেই। লেক-এ গুচ্ছের লোক আর ফিরিওলা, ময়দানে ভিড়, রাস্তাঘাটে অসম্ভব আলো।

অনেক টাকা ট্যাক্সি ভাড়া গুণল সোমেন। কথা তো ভারী!কখনও দুজনে বয়সের হিসেব করে অবাক হয়ে দেখল, সোমেনের চেয়ে রিখিয়া প্রায় বছরের ছোট।

থিয়েটার রোডের একটা দামি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে রিখিয়া হুকুম করল—খাও তো। তোমার খিদে পেয়েছে।

তুমি?

আমি শুধু আইসক্রিম।

এ রকমই সব তুচ্ছ, সামান্য কথাবার্তা। রিখিয়াকে কুড়ি টাকা দিয়ে একটা চামড়ার ব্যাগ কিনে দিল সোমেন। ফিরিওলা প্রথমে বত্রিশ টাকা দাম চেয়েছিল। রিখিয়া তাতেই বাজি। সোমেন তাকে ঠেকিয়ে দরাদরি করে কিনল।

রিখিয়া অবাক হয়ে বলল—ইস, রোজ আমি তা হলে কত ঠকি!

ভীষণ। আরও ঠকবে তুমি।

কেন ঠকব?

আমাকে প্রশ্রয় দিচ্ছ বলে।

নতুন কেনা ব্যাগটা ঠাস করে তার পিঠে মারল রিখিয়া। বলল—সেটাই একমাত্র জিৎ। বাবাঃ, যা অহংকারী! পাত্তাই দিতে চায় না।

ঘুরেটুরে একটুও ক্লান্ত হল না দুজনে। কিন্তু রাত সাড়ে আটটায় সাদার্ন অ্যাভেনিউ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে সোমেন বলল—রিখি, এবার বাড়ি যাও, সবাই ভাববে।।

রিখিয়া মুখখানা পাশে ঘুরিয়ে তাকাল। মৃদু একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল—আগে। বলো, আমাদের কী হবে!

বড় জটিল প্রশ্ন। বড় জরুরি প্রশ্ন।

সোমেন তাকায় রিখিয়ার দিকে। কচি বয়সের ভালবাসা আর মায়া মেশানো মুখ। আর। একটু বয়স হলে ও যখন হিসেবি হবে তখন ঠিক এরকম বলতে সাহস পাবে না হয়তো। তখন অনেক সুখ দুঃখের ভবিষ্যৎ-চিন্তা এসে ভর করবে মনে।

সোমেন তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল—রিখি, তুমি আমার দাড়ি সম্বন্ধে আজ একটাও কথা বলেনি।

রিখিয়া হেসে বলল—তাতে কী হবে? আমার ভাল না লাগলে যেদিন কেটে ফেলতে বলব সেদিনই তো তুমি ঠিক কেটে ফেলবে।

তাই বুঝি?

তা নয় বুঝি?

সোমেন একটা ত্রাস ফেলে বলে—হ্যাঁ, তাই।

তবে মশাই? শোনে, কখনও আমার অবাধ্য হবে না।

না হলাম।

সোমেন একটা ট্যাক্সি থামানোর চেষ্টা করে। পারে না। সব ট্যাক্সি অন্য লোক নিয়ে চলে যাচ্ছে।

রিখিয়া নিরুদ্বেগে হাঁটে। এক-একবার হেসে বলে—আমার চেয়ে ওঁর ভয়টা বেশি হল বুঝি?

শৈলীমাসি ভাববে যে।

কেউ ভাববে না। আমি তো প্রায়ই ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে বা বন্ধুর বাসার যাই।

সে তো গাড়িতে যাও। আজ তো গাড়ি নিয়ে বেরোওনি, ঠিক ভাববে সবাই।

ভাবুকগে। আগে বলো, আমাদের কী হবে!

সোমেনের মুখ শুকিয়ে যায়। বিবেকানন্দ পার্কের পাশে অন্ধকারে একটু দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় সে। ততক্ষণ ভাবে। তারপর বলে—রিখি, যা স্বাভাবিক তাই হওয়া উচিত।

স্বাভাবিকটা কী?

বিয়ে।

এই ছোট্ট কথাটায় যেন ঢেউ হয়ে গেল রিখিয়া। লজ্জায়, হাসিতে ভরে গেল তার মুখ।। সামান্য অসংলগ্ন পা ফেলল কয়েকবার। এলো খোঁপা ঠিক করল অকারণে।

রিখিয়া আজ একটুও সাজেনি। সাদামাটা ঘরোয়া পোশাকে বেরিয়ে এসেছে। তবু তার স্বাভাবিক শ্রী থেকে একটা বিকিরণ বেরিয়ে তাকে ঘিরে ধরে।

কিন্তু আমি তো কিছু হতে পারিনি রিখি। আমাকে…

রিখিয়া পাশমুখে তাকিয়ে বলল—হতে বারণ করেছে কে?

কী চাও বলো তো! কেমন চাও আমাকে?

যেমন আছো।

ঠিক?

ঠিক।

—যদি সারাজীবন আর সুন্দরবনের মাস্টারি ছেড়ে আসতে না পারি?

রিখিয়ার এখনও হিসেবি বুদ্ধি হয়নি। অকপটে বলল—আমাকে অত ভয় দেখিয়ো না। তুমি পুরুষমানুষ, ভাবনা-টাবনা তোমার। আমি নিশ্চিন্ত।

সোমেন দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে—কবে এত পাকলে বলো তো রিখি! এই সেদিনও খুকিটি ছিলে।

এখন আর নেই কিন্তু।

॥ আটাত্তর ॥

ভরদুপুরে ননীবালা কাঁচা আম কেটে রোদে শুকোতে দিয়েছেন। আমশির ডাল ব্রজগোপাল বড় ভাল খান। কিছু কলকাতাতেও পাঠানো যাবে।

ব্রজগোপাল দুদিন হল যাজনে বেরিয়েছেন। আজ কালই ফেরার কথা। ননীবালার একটু একা- ফাঁকা লাগে ঠিকই, কিন্তু এখানে জনের অভাব টের পান না। বহেরুর ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি অনবরত আসছে যাচ্ছে। যজমানদেরও আনাগোনা কম কী! তা ছাড়া কামলা, মুনিশ, চাষাভূষোরা অনবরত কাজটাজ করছে। একা লাগে না। পাখি-পক্ষী, কুকুর-বেড়াল, গাছপালা, মাটি-আকাশ নিয়ে বড় প্রাণবন্ত জগৎ। সবাই যেন সঙ্গে থাকে। সঙ্গী হয়।

আমের টুকরো রোদে দিয়ে উঠে আসছেন, উঠোনে একটা লম্বাপানা ফরসা দাড়িঅলা ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে ঢুকেই ডাক দিল—মা!

হাসবেন কি কাঁদবেন তা ভেবে পান না ননীবালা।

ওরে, আয় আয়। বলে নিজে গিয়েই সাপটে ধরেন ছেলেকে। যেন কতকাল দেখেন না।

হাঁকডাক শুনে লোকজন এসে পড়ল। ননীবালা কোকাকে ডেকে বললেন—একটা মাছ। পুকুর থেকে ধরে আন তো।

বলে সোমেনের দিকে চেয়ে বলেন—তোর বাবা কিন্তু মাছ ঢুকতে দেয় না বাড়িতে।

সঙ্গে সঙ্গে সোমেন গম্ভীর হয়ে বলল—তা হলে কেন মাছ রাঁধবে মা? বেঁধো না।

বলে কোকাকে ডেকে নিজেই বারণ করে দিল সোমেন।

ননীবালা বলেন—তা হলে কী দিয়ে দুটো ভাত খাবি? ঘি তো খুব ভালবাসিস, গরম ভাতে এক খাবলা তাই দিয়ে খা তো আগে, তারপর দুটো ডাল ডালনা দিয়ে খাস। দুধ আছে।

সোমেন কৃত্রিম রাগ করে বলে—ভাল করে বাসায় পা না দিতেই খা-খা করতে লাগলে!

খাওয়া নিয়েই তো তোর যত পিটির পিটির। কোথায় যেন মাস্টারি পেয়েছিস, সে কি অনেক দূর?

না, কাছেই।

চিঠি লিখতে তোদের যে কি আলিস্যি। হাকুচ কালো হয়ে গেলি কী করে? অমন টকটকে রং একদম জ্বলে গেছে। নিজের ছেলেটা বলে চিনতে কষ্ট হয়। জামাটা খোেল তো দে। হাড়পাঁজরা কেমন বের হয়েছে।

বোকো না মা। তিন কেজি ওয়েট বেড়েছে।

—উরে বাবা, তাই নাকি? হ্যাঁ। কনুইয়ের তিনকোনা হাড় বেরিয়ে আছে। ওয়েস্ট বেড়েছে কি না সে আমি জানি। এখন এখানে ক’দিন থাকবি। ইচ্ছেমতো খেয়েদেয়ে ঘরে। শরীর সারিয়ে তবে মনে করলে যাবি। বুঝেছিস?

সোমেন কেবল হাসে।

ননীবালা বলেন—হাসলে হবে না বাবা। চিরদিন হাসি দিয়ে আমাকে ভোলাও। কদিন। আমি এখন কাছে কাছে রাখবই। ওই দাড়ি গোঁফ রেখে সন্নিসী হলে চলবে না। কি, ভেবেছিস কি তুই?

চিরকালই যত গোপন কথা মার কাছে বলে সোমেন। আজ দুপুরে মায়ের কাছ ঘেঁষে ছোট্ট শিশুর মতো শুয়েছিল। তখন একটি দুটি প্রশ্নের উত্তরে মা কেমন করে সব কথা বের করে নিল। অবশ্য বলার আগ্রহ সোমেনেরই ছিল আগে থেকে।

শুনে ননীবালা উঠে বসে বললেন—শৈলীর মেয়ের কথা তত তোকে কত জিজ্ঞেস করেছি। তখন গা করতিস না।

এখন কী করব মা?

কী আবার করবি! বিয়ে করবি। আমি আজই শৈলীকে চিঠি লিখব।

দূর। ওসব করো না। ওরা ভীষণ বড়লোক। যদি রিফিউজ করে তো অপমানের একশেষ।

দূর বোকা! ছেলের কোনও কাজে মায়ের আবার মান-সম্মান কী? আমি ওর মেয়েকে ভিক্ষে চাইব।

না মা। অপমান তোমার একার নয়, আমারও। তা ছাড়া, বাবার পরামর্শ আগে নিয়ে। নাও।

এর মধ্যে আবার ওঁকে টানিস কেন? উনি সেকেলে লোক। ভাবের বিয়ে শুনলে খুশি হওয়ার মানুষ নয়।

সোমেন তবু মাথা নেড়ে বলল—শোনো মা, আমার বুদ্ধি স্থির নেই, তুমিও দুনিয়ার কিছু জানো না। এসব ব্যাপারে স্থিরবুদ্ধির লোক চাই। বাবার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।

বিস্মিত ননীবালা ছেলের দিকে চেয়ে বলেন—ছোটকা, কবে থেকে এত বাপভক্ত হলি বল তো! চিরটাকাল তো মায়ের আঁচলের তলায় বড় হলি, বাপকে চিনলি কবে?

সোমেন পিঠটা মার দিকে ঘুরিয়ে বলে—বাঁ ধারটা চুলকে দাও। জোরে।

ননীবালা একহাতে পিঠ চুলকে দেন, অন্য হাতে পাখার বাতাস করেন। বলেন—সব। শুনে তোর বাবা যদি অমত করে?

এ কথার কোনও উত্তর দেয় না সোমেন। বাবার ডায়েরিতে লেখা একটা বাক্য শুধু মনে পড়ে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।

একটু ঝুম হয়ে পড়ে থেকে ভাবল সোমেন। তারপর মুখ তুলে মার দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল—তুমি কি ভাবো, আমার মনের জোর নেই?

সে আছে থাক। তা বলে অমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটাকে হাতছাড়া করতে হবে নাকি? এই তো বললি, কথা দিয়েছিস। কথার খেলাপ করবি শেষে? তার চেয়ে ওঁকে না জানানোই ভাল।

সোমেন মাথা নেড়ে বলল—না মা, তা হয় না। আমার বড় অহংকার। কোনও অপমান আমার সহ্য হবে না, তার চেয়ে বিয়ে না হওয়া ভাল। সেইজন্যই আমি বাবার পরামর্শ চাইছি।

ননীবালা পাখাটা ফেলে দিয়ে একটু হতাশ গলায় বললেন—তোর মধ্যে ঠিক তোর। বাবার ছাপ দেখতে পাই। হুবহু। যে-ই তোর বউ হোক সে বড় কষ্ট পাবে।

ব্রজগোপাল এলেন সন্ধে পার করে। সোমেন বেরিয়েছিল বাঁধের দিকে। বহেরুর। খামারবাড়ির অনেক উন্নতি দেখল ঘুরে ঘুরে। গন্ধ বিশ্বেস এখন আর তোক চিনতে পারে ন।। দিগম্বরের খোলের আওয়াজ বড় মৃদু, তাও কচিৎ শোনা যায়। নানা রকমের লোক আমদানি হয়েছে এখানে। একটা কামারশালা বসিয়েছে বহেরু, একজন পুতুলের কারিগরকে জমি দিয়েছে। একটা পাঁচ মন ওজনের পেল্লায় মোটা লোককে কচ্ছপের মতো ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। বিন্দু সেই আগের বারের মতোই সঙ্গে ছিল আজও। বলল—ও লোকটা সত্যিই একটা আস্ত খাসির মাংস খেয়ে নেয় একবারে।

চিড়িয়াখানায় একটা কাকাতুয়া এসেছে নতুন, সাতশো টাকা দাম। একটা হরিণ এসেছে। একটা বনবেড়াল।

বিন্দু বলল—চলে যাচ্ছি।

কোথায়?

আর কোথায়? কোকাদাদা বলে দিয়েছে, বাবা মরলে ঝেটিয়ে তাড়াবে। যা চুলের মুঠি ধরে কিল দেয় কোকাদাদা! এখানে ঠাঁই হচ্ছেনা। তাই সেই ম্যাদামাকা লোকটার বাড়িঘরেই যাব, আর জায়গা কোথায়?

বিন্দুকে খুব দুঃখী মনে হল না। নিজে থেকেই বলল—কেবল নয়নদিদিরই গতি হল না। কিলটা, চড়টা খেয়ে মরবে। আমি তবু পালিয়ে বাঁচব।

সন্ধেবেলা ঘরে ফিরতেই বাবাকে দেখে মনটা কেন যে বেশ ভাল লাগল।

প্রণাম আশীর্বাদ সব হয়ে যাওয়ার পর ব্রজগোপাল হঠাৎ খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন—তোমার মার কছে সব শুনেছি। তোমার সৎসাহস দেখে অবাক হই বাবা, এ যুগে কেউ ভাব ভালবাসার ব্যাপারে বাপ মাকে টানে না, পরামর্শটৰ্শ করে না।

সোমেন মাথা নিচু করে থাকে।

ব্রজগোপাল চৌকিতে সিধে হয়ে বসে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন—ছেলেদের অবশ্য কোনও মেয়েকে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া ঠিক নয়। সেটা পৌরুষের বিরোধী। তোমার মা বলছিলেন, প্রস্তাবটি সেই মেয়েই দিয়েছে।

সোমেন চুপ করে থাকে।

ব্রজগোপাল বলেন—ভাল। সে মেয়েটি কি তোমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে?

কী বলবে সোমেন! ননীবালা বলেন করে না আবার! ওর মধ্যে চরিত্রওলা ছেলে পাবে। কোথায়?

ব্রজগোপাল বললেন—শ্রদ্ধা বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। তোমার সঙ্গে তার বয়সের কত তফাত হচ্ছে হিসেব করেছ?

সোমেন চুপ। ননীবালা বললেন—ন-বছরের মতো। না রে সোমেন?

সোমেন ক্ষীণ মাথা নাড়ে।

আর একটু হলে ভাল হত। বউ ইয়ার বন্ধুর মতো হলে ভাল হয় না। বয়সের তফাত বেশি হলে শ্রদ্ধাটা আপনি আসে।

ননীবালা মাঝখানে পড়ে গেলেন—তোমাদের সব সেকেলে নিয়ম বাপ।

ব্রজগোপাল মৃদু হেসে বলেন—তুমি কবে থেকে আবার মডার্ন হলে?

ননীবালা লজ্জা পেয়ে পানের বাটা নিয়ে বসেন। বলেন—ছেলে ছোকরাদের ব্যাপারে। অত খুঁত ধরলে হয়!

ব্রজগোপাল লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোতে একটু দূর চোখে চেয়ে বলেন—শিক্ষা, দীক্ষা। আর বিয়ে, এ তিন ঠিক না হলে জাতি পতিত হয়ে যায়। বিয়ে কি সোজা কথা! ওই বিয়ে থেকেই বিপ্লবের শুরু।

সোমেন একবার তাকাল বাবার দিকে। চোখ সরিয়ে নিল ফের।

ব্রজগোপাল বলেন—মেয়েটির পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল শুনেছি।

ননীবালাই বললেন—টাকার লেখাজোখা নেই। দেবেথোবে অনেক।

সোমেন রাগত চোখে মার দিকে তাকাল।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—কাকে দেবে? তোমার ছেলেরা কাঙাল না কি? বলে একটু চুপ করে থেকে বলেন—ঠাকুর জানেন, আমি কখনও চাইনি যে, আমার ছেলেরা অর্থবান তোক, বরং চিরকাল চাই, ছেলেরা চরিত্রবান হোক, শ্রদ্ধাবান হোক, ধর্মশীল,হোক।

সোমেন বাবার মুখের দিকে তাকায়। এই এক মানুষ, যেমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল হয়ে আসছে ক্রমে।।

ব্রজগোপাল বললেন—অকপটে বলো বাবা, মেয়ের বাড়ির স্বচ্ছলতা তোমাকে আকর্ষণ করেনি তো?

না, না। ছিঃ। সোমেন লজ্জায় মরে গিয়ে নিচু স্বরে বলে।

জেনে রাখলাম। এখন নিশ্চিন্তে এগোতে পারি।

ননীবালা জরদার হেঁচকি তুলে বলেন—না হয় কিছুই চাইব না আমরা। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবের কী করবে?

ব্রজগোপাল তেমনি উদাস ভঙ্গিতে বসে থেকে বলেন—বিষয়আশয়ে অনেক তফাত হয়ে যাচ্ছে দুই পরিবারের। ভয় হয় মেয়েটা এত বড় পরিবর্তন সইতে পারবে কিনা। তার মা বাপও যেন খুশি হয়ে মেয়ে দেন তাও আমাদের দেখতে হবে। সবদিক ভেবে দেখা কাজ বড় সোজা নয়।

সোমেনের মধ্যে একটা মরিয়া ভাব এল। সে হঠাৎ বলল—বাবা, আপনি যা ভাল বুঝবেন, করবেন। আমার কোনও মতামত নেই।

এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ব্রজগোপালের মুখ ভরে গেল। মাথা নেড়ে বললেন—তোমায়। জ্বালাযন্ত্রণা নিয়ে আমার চেয়ে বেশি কেউ ভাববে না। নিশ্চিন্ত থাকো বাবা, তোমার সুখের জন্য, ভালর জন্য যতখানি করা যায় সব আমি দেখব। আমি শুধু বাপের চোখের জগৎ দোৰ। ন।, একটা আদর্শের চোখ দিয়ে দেখি। আমাকে দেখতে হবে, তোমার ভিতর দিয়ে যেন পারিপার্শ্বিকের কল্যাণ আসে। সব ঘটনারই ভাল মন্দ দুটো দিকের জন্যই নিজেকে প্রস্তুত। রেখো। যদি মন্দটা ঘটে তা হলেও ভেঙে পোড়ো না।

পরদিন দুপুরে ফিরে যাচ্ছে সোমেন। ব্রজগোপাল রিকশা করে স্টেশন পর্যন্ত এলেন তার। সঙ্গে।

গাড়ি আসবার আগ মুহূর্তে শুধু বললেন—স্থির থেকো।

কথাটা বুঝল না সোমেন।।

গাড়ি এল। গাড়ি ছেড়ে দিল।

যত বড় করে সমস্যাটাকে দেখেছিল সোমেন আসলে তা মোটেই তত বড় ছিল না। সে সমস্যাকেই দেখেছিল, ভেবেছিল রিখিয়াকে বিয়ে করার সব দায়িত্বই বুঝি তার। অবোধ মেয়ে রিখিয়া, সে আর কী করবে?

কলকাতার বাসায় ফিরে এসেই সে পেল শৈলীমাসির চিঠি। লেখা—বাবা সোমেন, রিখি আমাকে সব বলেছে। জানো না তো, সে যা চায় তাই হয়। সে তোমাকে চেয়েছে। আমিও কতদিন তোমার কথা ভেবেছি রিখির জন্য। আমার নিজের ছেলে পর হয়েছে। তুমি পরের ছেলে আপন হও। ননীর কাছে চিঠি লিখেছি। রিখির বাবা তোমার বাবাকে চিঠি দিল আজ। কতদিন দেখি না তোমাকে। শুনলাম, খুব কালো হয়ে গেছ? রবিঠাকুরের মতো দাড়ি রেখেছ, তাও শুনেছি। বিয়ের দিন কিন্তু ওভাবে এস না। তার আগে এস একদিন, তোমার সন্তপুরুষের মতো মুখখানা একবার দেখব। আসবে তো?…

চিঠি পড়ে বউদিকে ডেকে দেখাল সোমেন।।

বীণা একটা চাপা হর্ষের চিৎকার করে ওঠে। সোমেনের দিকে হাঁক করে চেয়ে থেকে বলে—আচ্ছা চালাক ছেলে যা হোক, বড়লোকের মেয়েটাকে ঠিক বেঁধে ফেলেছ।

বাঃ রে, তুমিই তো বললে!

ন। বললে বুঝি ছেড়ে দিতে?

দুদিন পরেই ব্রজগোপাল আর ননীবালা এলেন।

বাড়িতে উৎসবের হাওয়া বয়ে যেতে লাগল।

সুন্দরবন থেকে আর একবার ঘুরে এল সোমেন। শ্রাবণের মাঝামাঝি রিখিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল তার।

বিয়ের পর বউভাতের দিন ভাড়াটে বিয়ে বাড়ির ছাদে তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে অপালা বলল—বিট্রে করলি তো! তোর আশায় ছিলাম ঠিক, এখন মিহির বোস ছাড়া আর কোন শালা বিয়ে করবে আমাকে বল তো!

ভাগ। সোমেন বলে—বিট্রে করেছি বলে দুঃখের তো চিহ্নও দেখলাম না। আট পিস ফিস ফ্রাই খেলি বসে বসে দেখলাম।

এঃ মা, হোস্ট কখনও খাওয়ার খোঁটা দেয় বুঝি! আর কখনও যদি তোর নেমন্তন্ন খাই দেখিস।

আমিও আর বিয়ে করছি না।

অনিল রায় আজ একদম মদ খাননি। হার্ট অ্যাটাকের পর খানও কম। পাইপ ধরিয়ে ঘুর ঘুর করছিলেন চারদিকে। সোমেনকে ডেকে বললেন—বিয়েতে খাওয়ানোর সিস্টেমটা কেন তুলে দিচ্ছ না তোমরা? নিতান্তই যদি না পারো তো বক্স সিস্টেম করো। বাই দি ওয়ে সোমেন, তোমার সেই পুরনো হবিটার কী হবে?

কী হবি স্যার?

সেই যে প্রায়ই একে-ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে।

সোমেন হেসে ফেলে। বলে—হবিটা এখন মিহির বোসকে দিয়ে দিয়েছি স্যার। শুনেছি ও নাকি প্রায়ই একবার অপালাকে আর একবার পূর্বাকে প্রোপোজ করে। দুজনেই কেবল রিফিউজ করছে।।

পূর্বা তেড়ে এসে বলল—ইঃ, আমাকে করুক তো প্রোপোজ।

করেনি তোকে? সোমেন অবাক।

মোটেই না। অত সাহস আছে?

করলে কী করবি?

অনেকদিন বাদে পূর্বা খুব বুদ্ধি করে উত্তর দিল আজ। ফচকে হেসে বলল—মাইরি। রাজি হয়ে যাব।

দারুণ হাসল সবাই। মিহির বোস নিজেও।

অণিমা আসেনি। ওর বাড়ি থেকে গান্ধু আর তার মা এল। প্রায় দুই ভরি ওজনের। সোনার হার দিয়ে গেল। অণিমা পার্সেলে একটা বালুচর শাড়ি পাঠিয়েছে, চিঠিতে। লিখেছে—যাওয়া হল না সোমেন। খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে। মেয়েদের যে কত বাধা!

রাতে শুতে গিয়ে আর এক বিপদ। দুই দিদি আর বিস্তর আত্মীয়া পাশের হলঘরে ডেকরেটারের শতরঞ্জিতে চিল্লাচিল্লি করছে। শতবার তারা এসে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে—ও সোমেন, আমাদের বালিশ কম পড়েছে, দরজা খোল। এমনকী ছোড়দি পর্যন্ত এসে দরজার গোড়ায় বসে গান গাইতে থাকে।

সোমেন গিয়ে দরজা হাট করে খুলে দিয়ে বলে—নে বাপু, কোনও সিক্রেসি রইল না আর। এবার একটু ঘুমোতে দে। বড় ধকল গেছে।

বিয়ের পরই সুন্দরবনে ফিরে গেল সোমেন। একা। মনে একটা লজ্জা আর অপরাধবোধ কাজ করে সব সময়ে। ভাবে, ছিঃ, আমি কেন বড়লোকের ঘরে বিয়ে করতে গেলাম! কী। দরকার ছিল? লোকে ভাববে, লোভি সোমেন এইভাবে নিজের প্রবলেম সলভ করে নিল। ভাববে, শ্বশুরের পয়সায় বড়লোক হয়ে গেল সোমেন। ছিঃ ছিঃ, যদি তাই ভাবে?

বড় যন্ত্রণা গেল এদিন। এসব যন্ত্রণার কথা কাকে আর জানাবে। রিখিয়াকেই মস্ত চিঠি লিখল সে।

রিখিয়ার, এখন কোনও স্থায়ী ঠিকানা নেই। বাপের বাড়ি দুদিন থাকল, রণেন এসে নিয়ে। গেল ঢাকুরিয়ায়। ঢাকুরিয়ায় তিনদিন কাটবার আগেই শীলা এসে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে যায়। তার বাড়িতে, চারদিন পাঁচদিন আটকে রাখে। খারাপ লাগে না রিখিয়ার। তার নিলেন। বাড়িতে এত লোক, এত আদর করার মানুষ সে পায়নি কখনও। মা চিরকাল বিছানায়, বা। ব্যস্ত, সংসার ছিল গভর্নেস, আয়া, ঝি আর চাকর দারোয়ানের হাতে। এদের বাড়িতে ল সব নেই। সম্পূর্ণ অন্য রকম লাগে। বড় ভাল লাগে দিদি, বউদি, দাদা ডাকতে।

ব্রজগোপাল এলেন একদিন। রিখিয়াকে দেখে বললেন—মাগো, চেহারাটা ভাল সেন। এরা বিশ্রাম দিচ্ছে না তোমাকে, ওদিকে তোমার শাশুড়িও তোমার জন্য অস্থির। বাক্সটাক্স গুছিয়ে নাও তো। বেলা তিনটেয় অমৃতযোগ।

বিন্দুমাত্র আপত্তি হয় না রিখিয়ার। ব্রজগোপাল অসম্ভব কর্তব্যপরায়ণ মানুষ, নিজেই বেয়াইবাড়িতে ফোন করে অনুমতি নিয়ে আসেন।

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ঠিকানায় লেখা সোমেনের চিঠি রি-ডাইরেক্ট হয়ে গোবিন্দপুরে রিখিয়ার হাতে গেল। চিঠি পড়ে রিখিয়া কেঁদে অস্থির। চিঠির শেষে সোমেন লিখেছে—আমি পুজোর ছুটিতে যাব না। এখন কিছুদিন আমাকে দূরে থাকতে দাও। বিয়ের পর থেকে আমার মন খুব অস্থির।…আরও সব অনেক কথা লিখেছে। বড়লোকের ঘরে। বিয়ে করা গরিবের ছেলের ঠিক হয়নি। আরও কত কী!

রিখিয়ার কান্না সামলে নিলেন ননীবালা। তারপর গোপনে, চুরি করে বউকে লেখা। ছেলের চিঠি পড়লেন দুপুরে। একটা গভীর শ্বাস ফেলে আপনমনে বললেন—বউটাকে কষ্ট দেবে, আগেই জানি। হুবহু বাপের মতো হল কেন যে ছেলেটা!

তারপর ননীবালা রিখিয়াকে স্বামী বশ করার নানা কৌশল শেখাতে থাকেন। কত উপদেশ দেন। সোমেনের স্বভাবের নানা কথা শতখান করে বোঝাতে থাকেন। তাঁর প্রাণে বড় ভয় এই ছেলেটাকে নিয়ে। যত বড় হচ্ছে তত ওর মধ্যে বাপের অবশ্যম্ভাবী প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে।

রিখিয়া সোমেনকে লেখে—শোননা, আমার সত্যিকারের আপনজন কেউ কখনও ছিল না। জন্মের পর থেকে আমি একা। একা একা খেলতাম, ঘুমোতাম, গান গাইতাম। তেমন আদর পাইনি কারো। বিছানায়, বাবা বাইরে, দাদা নিজের পড়াশুনা খেলা আর বন্ধু নিয়ে ব্যস্ত। ভেবেছিলাম, বিয়ে করলে বুঝি এই অসহ্য একাকীত্ব কাটবে। তা বুঝি হল না আমার। তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? কেন তুমি আমাকে বোঝো না একটুও পাগল?…পুজোয় না এলে বিষ খাব…

সোমেন আবার দাড়ি রেখেছে। চুল বড় হয়েছে। গায়ের রঙে চাষাভুষোর মতো কালো। কিন্তু চেহারাটা অনেক শক্তপোক্ত হয়েছে তার। মেদহীন রুক্ষ পৌরুষের চেহারা। মুখে একটু লজ্জার হাসি নিয়ে পঞ্চমীর দিন এসে গোবিন্দপুরে পৌছল ননীবালা আর রিখিয়া ঢেউ। হয়ে এখানে-সেখানে ধেয়ে যাচ্ছেন আয়োজন করতে।

নির্জনে পেয়ে সোমেন রিখিয়াকে বলে—আর কখনও বিষ খাওয়ার কথা লিখবে?

অকপটে রিখিয়া তাকিয়ে থেকে বলে—কেন আসবে না লিখেছিলে?

—বড় লজ্জা যে!

—ছিঃ। ওরকম আর ভেব না। আমি কিন্তু অনেকবার বিষ খাওয়ার কথা ভেবেছি। জীবনে। সেটা মনে রেখো।

—কেন ভেবেছ?

—একা থাকা অসহ্য লাগত যে!

—আর ভেব না।

—আমাকে একবার তোমার ওখানে নিয়ে যাবে না।

সোমেন হেসে বলে—হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছ কতদিন হয়ে গেল, কলেজে ভরতি হলে না যে বড়? ভেবেছ কী?

—কী হবে আর পড়ে? আমার ভাল লাগে না। শ্বশুরমশাই বলেছেন, আমি যেন কখনও চাকরি-টাকরি না করি।

—চাকরি না করলে। কলেজ ভরতি হয়ে যাও।

রিখিয়া মাথা নেড়ে বলল—আচ্ছা।

—লেখাপড়া অনেক কাজে লাগে।

—তা হলে তুমিও এম এ পরীক্ষা দাও।

—দেব।

দুজনে হাসে।

অবসর সময়ে সোমেন তার বাবার সব পুঁথিপত্র খুলে বসে হাঁটকায়। বাবার অনেক | লেখাপত্র আছে। টীকা, ভাষ্য, ব্যাখ্যা। সেসব খুলে পড়ে। ব্রজগোপাল যখন বাসায় থাকেন তখন নিবিষ্ট হয়ে বসে বাবার সঙ্গে সমাজ সংসারের হাজারো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। ব্রজগোপালের মুখ চোখ দীপ্ত হয়ে ওঠে। বলেন—সারাটা জীবন এইটুকুর অপেক্ষায় থেকেছি বাবা। আমার কুড়োবামুনের কথা যদি আমার ছেলেদের কেউ কখনও জানতে চায়। তবে শোননা…

অবিরল বোঝাতে থাকেন ব্রজগোপাল। সোমেন শোনে।

তারপর একদিন বাপের ছায়ার মতো বেরিয়ে পড়ে সোমেন। ব্রজগোপালের সঙ্গে যজমানদের বাড়ি বাড়ি ফেরে। যাজন শোনে, নানা সমাবেশে যায়। ব্রজগোপালের পরিচিতির বহর দেখে বড় অবাক মানে সে। চাষাভুষো থেকে সমাজের সবচেয়ে উঁচুতলার লোক সবাইকেই চেনেন বাবা। সবাই বাবাকে চেনে এক ডাকে। ব্রজগোপাল হাত পাতলে একবেলায় চার-পাঁচহাজার টাকার দান উঠে আসে।

রহস্যটা সোমেনকে জানতেই হবে।

॥ উনআশি ॥

এসব দেখে ননীবালা বড় হতাশ হন।

রিখিয়াকে বলেন—ও বউ, আমার ছেলেকে সামলিও। এ আমি ভাল বুঝছি না। বাপের রোগ।

রিখিয়া অবাক চোখে তাকায় ননীবালার দিকে। বলে—কীসের রোগ মা?

—পরভুলানি রোগ মা। ওরা সংসারের কেউ নয়, ওরা সব বিশ্বসংসারের জন্য জন্মেছে।

রিখিয়ার একরকমের লাজুক, মিষ্টি হাসি আছে। মাথা নেড়ে বলে—আমার বেশ লাগে তে।।

দুহাতে রিখিয়ার মুখখানা তুলে চোখের কাছে এনে ননীবালা নিবিড় দৃষ্টিতে দেখেন। রিখিয়া হেসে ফেলে। গভীর শ্বাস ছেড়ে ননীবালা বলেন—তুমি একটু অন্যরকম। তুমি ঠিক আমাদের মতো নও মা।

—কেমন মা?

—বোধ হয় ভাল। খুব ভাল।

রিখিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে—অত ভাবো কেন মা? ওকে পথ খুঁজে নিতে দাও। সবাই একরকমের জীবন কাটাবে?

রিখিয়াকে তুমি ডাকতে ননীবালাই শিখিয়েছেন ইদানীং। ‘তুমি’ শুনলে একদম মেয়ের মতো লাগে।

আদর ভালবাসার একটা একটা দলা এল গলায়। এখন কাঁদবেন ননীবালা। তাই রিখিয়াকে ছানার ডালনা রাঁধতে শেখাতে বসেও বললেন—যা তো মেয়ে, ঘরে গিয়ে একটু দুধ খেয়ে আয়।

—না, অত খেতে পারি না।

—যা না। দুটো হাত ধরছি, যা।

রিখিয়া অনিচ্ছায় উঠে যায়।

ননীবালা কাঠের জ্বাল ঠেলে তুললেন। তারপর আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন ঠায়। দুচোখ বেয়ে অবিরল জলের ধারা বুক ভাসিয়ে নেয়।

মশলামাখা দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রাণভরে ঠাকুরকে ডাকেন, বিড়বিড় করে বলেন—ওদের সুখে রেখো ঠাকুর।

তারপর হঠাৎ মনে হল, কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনাল না তো! ব্রজঠাকুরের বামনি কি শুধু নিজের জনের সুখ চাইতে পারে? তাতে ঠাকুর হয়তো বিমুখ হবেন।

তাই আবার প্রাণভয়ে দুহাত জড়ো করে বলেন—ঠাকুর, বিশ্বসংসারের সবাই যেন সুখে থাকে।

***

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *