॥ সত্তর ॥
এ ঠিক একমুহূর্তের কান্না নয়। ননীবালা বহুকাল আগে তাঁর ছেলেবেলায় হাজারিবাগের ওদিক বেড়াতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে একটা কুণ্ড দেখেছিলেন। পাথরের ভিতরে গর্তমতো, নানা ফাটল দিয়ে চুইয়ে জল বয়ে এসে সেইখানে জমছে নিরন্তর। ননীবালারও তাই। সংসারের কত ফাটা ভাঙা গুপ্তপথ দিয়ে কান্না চুইয়ে এসে বুক ভরে রাখে। ব্রজগোপালের হঠাৎ দেখা পেয়ে সেই কান্নাটাই বেরিয়ে এল।
আজ কেউ বাড়িতে নেই। সকালেই ছেলেমেয়ে নিয়ে রণেন আর বীণা গেছে দক্ষিণেশ্বরে। সোমেনও এ সময়ে বাড়ি থাকে না। ননীবালা একা। সেই একা থাকার মধ্যে হঠাৎ পর মানুষটা এল। বুকটা ভার হয়েই ছিল, ব্রজগোপালকে দেখে সেই ভারটা নড়ে উঠল, ফুলিয়ে তুলল বুক।
দরজা ছেড়ে ভিতরে পিছিয়ে এসে ননীবালা বললেন—এস।
ব্রজগোপাল ইতস্তত করেন। বুকটা বেসামাল লাগে। ননীবালা কঁদছে কেন? কোনও খারাপ খবর নেই তো? রণেন, সোমেন, শীলা, ইলা নাতিনাতনিরা সব ভাল আছে তো?
গলাখাঁকারি দিয়ে ব্রজগোপাল বলেন—খবরটবর কী?
—এস, বলছি।
ব্রজগোপাল ঘরে এলে ননীবালা দরজা বন্ধ করে দেন।
ব্রজগোপাল শূন্য বাসার নির্জনতা আর স্তব্ধতা টের পান। ভয় লাগে। সবাই ঠিকঠাক আছে তো! সংসারী মানুষের বুকে মায়ার পাথার দিয়ে রেখেছেন ঠাকুর। এত যে ছেড়ে থাকেন তবু ভুল পড়ে না। বিশ্বসংসারকে আপন করতে পারা সোজা নয়, তেমনি শক্ত নিজের জনকে পর করা। এ বড় ধন্ধ।।
—খারাপ খবর নেই তো!
ননীবালা হঠাৎ উভরে বলেন—খারাপ নয় তো কী? ভাল খবর আসবে কোত্থেকে?
ব্রজগোপাল ধুতির খুঁটে মুখের ঘাম মুছে হাতের বোঝা নামিয়ে বলেন—ভাল আর কী হবে? ভাল চাই না, খারাপ কিছু না হলেই হল। সংসারী মানুষের তো ওই সারাক্ষণ ভয়, ভাল না হোক খারাপও যেন কিছু না হয়।
ননীবালা বলেন—তুমি আবার সংসারী নাকি!
ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—ভেক বোঝা যায় না। কিন্তু আমিও যেমন জানি তুমিও তেমনি জানো, আমার মায়াদয়া ঠাকুর কম দেননি। তোমাদের শান্তির অভাব হবে বুঝেই আমি বেড়াল-পার হয়েছি। এসব তো কেউ বুঝবে না।
ব্রজগোপাল বাইরের ঘরের সোফাটায় বসতে যাচ্ছিলেন, ননীবালা বললেন—ওখানে বসছ কেন? ঘরে এস। আমার ঘরে।।
—এই তো বেশ। দুটো কথা বলে চলে যাব।
ননীবালা ঝংকার দিয়ে বলেন—কেন, বাইরের লোক নাকি যে বাইরের ঘরে বসে দুটো কথা বলে চলে যাবে! কোনওদিন তো অন্দরমহলে ঢোকো না। বাইরে থেকে বুঝে যাও যে আমরা খুব ভাল আছি।
—তা ভাবি না। স্মিত হেসে ব্রজগোপাল বলেন—দেশকালের যা অবস্থা তাতে ভাল কেই বা আছে। সবাই বাইরেটা চকচকে রাখার চেষ্টা করে, তবু ঢাকতে পারে না। তুমিও পারোনি।।
ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—কী পারিনি?
—ননীবউ, তুমি ছেলেদের কাছে বড় আদরে সম্মানে আছো, এটাই আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলে বরাবর। কিন্তু আমি বরাবরই টের পেয়েছি, তুমি নিজেকে ধোঁকা দিচ্ছো। তাই কি হয়! মা-বাপকে ছেলেমেয়েরা কবে আর বুঝতে শিখল! মা বাপের মনের মধ্যে কত মান-অভিমান জমা থাকে, ওরা কী তা বোঝে! স্নেহ নিম্নগামী, বড় সত্য কথা। তুমি ওদের জন্য যতই করো ওরা তোমাকে কোনওদিন বুঝতে পারবে না। অভিমান করে লাভ নেই।
ননীবালা কী উত্তর দেবেন! সত্য কথার কী উত্তরই বা হয়। তিনি আবার হঠাৎ চোখে-আসা জল আঁচল চেপে সামলান। বলেন—দোষ কার বলো তো! কে আমাকে ছেলেদের সংসারে যুতে দিয়ে সরে গেল?
—সে কি আমি ননীবউ
—তুমি ছাড়া কে
ব্রজগোপাল বললেন—আমাকে এত বড় মানুষের সম্মান তো তুমি কোনওদিন দাওনি। আমি যে তোমার কেউ তা তো শেষ দিকটায় বুঝতেই পারতাম না। তুমি ছেলেপুলে, নাতিনাতনি নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত ছিলে, সংসারে বুক দিয়ে পড়ে জমি তৈরি করছ, আমার দিকে মনোযোগ ছিল না। উপরন্তু ছেলেমেয়েদের কাছে আমার কত দোষের কথা বলে মন বিষিয়ে দিতে। মনে পড়ে?
ননীবালা স্তব্ধ হয়ে থাকেন। যেন ব্রজগোপাল যে সেসব কথা কখনও তুলবেন এটা তাঁর বিশ্বাস ছিল না।
ব্রজগোপাল বললেন-”ভালই করেছ। আমার ক্ষোভ নেই। কিন্তু আমি বাড়ি ছাড়া হয়ে যেমন বনবাসী, তুমি ঘরে থেকেও তেমনি বনবাসী। ছেলেরা বড় হলে মা-বাপ অপ্রয়োজন হয়, আর সেই বুঝে মা-বাপেরও অপ্রয়োজন হয়ে সরে আসা উচিত।
ননীবালা উম্মাভরে বলেন—আমার ছেলেরা সে রকম নয়।
—না, ছেলেরা বোধ হয় ভালই। ব্রজগোপাল বলেন—তবু বলি, বুড়ো বয়সের মা-বাপকে যদি ছেলেরা নিজের ছেলেমেয়ের মতো না দেখে তবে সংসারও বনবাস। ভাত-কাপড়টাই কি বড় কথা, মর্ম না বুঝলে ভাত কাপড় দিয়ে কী হবে!
ননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন—ভিতরের ঘরে এস বোসো। ওভাবে বাইরের ঘর থেকে চলে যাও, ও আমার ভাল লাগে না।
ব্রজগোপাল উঠলেন।
ননীবালা ঘরে এসে নিজের বিছানাটা ঝেড়েঝুড়ে বসালেন ব্রজগোপালকে। বললেন— শরীরটা তো ভাল নেই দেখছি।
—না। ব্রজগোপাল বলেন—গত সপ্তাহেও ব্যথাটা উঠেছিল। নইলে তখন আসবার কথা।
—বুকের ব্যথাটা নাকি?
—হ্যাঁ।
—প্রায়ই হচ্ছে, চিন্তার কথা।
—ব্রজগোপাল শান্তস্বরে বলেন—ওটা ছাড়া আর কোনও উপসর্গ নেই।
—নেই কেন? এবার তো নিজের চোখে দেখে এলাম, খাওয়া অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে। অত কম খেলে চলে নাকি?
—নেই কেন? এবার তো নিজের চোখে দেখে এলাম, খাওয়া অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে। অত কম খেলে চলে নাকি?
—ওতেই বেশ থাকি।
—দুধ-টুধও তো পেটে পড়ে না। বহেরুর কত গরু!
ব্রজগোপাল হাসলেন—ওর মধ্যে আমারও আছে দুটো। হরিয়ানার দুটো গাই কিনেছিলাম দুহাজার টাকায়। দেখোনি, না?
—না! বলোনি তো!
—ভুলে গেছি হয়তো! বুড়ো বয়সে সব মনে থাকে না।
—তা সে গরুর দুধ খায় কে?
—বহেরু বেচে দেয়, কিছু আমাকেও দিয়ে যায়।
ননীবালা আবার একটা শ্বাস ফেলে বলেন—সবই তো করলে, কিন্তু ভোগ-দখল যে কে করবে!
—কে আর করবে! যেই করুক, ভাবব যে আমার আপনজনই করছে। দুনিয়ার কেউ পর নয়।
ননীবালা মেঝেয় বসে চৌকির তলা থেকে সুটকেস টেনে বের করে সযত্নে ধুলোটুলো ন্যাকড়া দিয়ে মুছছিলেন। ব্রজগোপাল বসে আছেন চৌকির ওপর। আড়চোখে দেখলেন।
ননীবালা ডালা খুলে টুকিটাকি জিনিসপত্র বের করে রাখলেন। ট্রাঙ্ক খুলে শাড়ি সেমিজ বের করে থাক করতে থাকেন বিছানায়। কাজকর্ম করতে করতেই বললেন—আর মন টিকছে না।
—কোথায়?
—এখানে।
—কেন? সবিস্ময়ে ব্রজগোপাল বলেন।
—বঝতেই তো পারো। এতকাল গতর পাত করে দিলাম যাদের জন্য তারা মা বলে ভাল করে ডাকে না পর্যন্ত। বউমা এমন কথাও বলে, রণো যে পাগল হল সে নাকি আমার জন্যই। ছোট ছেলেও কত কথা শোনায়! এখন শুনছি, সে নাকি আমেরিকা না কোথায় চলে যাবে।
ব্রজগোপাল চমকে উঠে বলেন—তাই নাকি?
—বলছে তো। ভাল করে জিজ্ঞেস করিনি কেন যাবে। করলে হয়তো বলবে, আমার জন্যই সংসারে অশান্তি, তাই পালাতে চাইছে।
ব্রজগোপাল করুণাভরে বলেন—এখন তবে কী করবে?
—তোমার মতো বেড়াল-পার হব।
—তার মানে?
—ননীবালা একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে বলেন—শেষ পর্যন্ত মেয়েমানুষের জায়গা কোথায় তা কি জানো না?
—জানি। সেটা কি বুঝতে পেরেছ ননীবউ?
—না বুঝে যাব কোথায়? দুরমুশ দিয়ে ঘাঁচা ঘাঁচা করে সংসার জানিয়ে দিচ্ছে। তা ছাড়া—
বলে থামেন ননীবালা।
ব্রজগোপাল উদ্গ্রীব হয়ে তাকান।
ননীবালা ম্লান হাসি আর চোখের জলে উজ্জ্বল একরকম অদ্ভুত মুখে চেয়ে বলেন— তোমার জন্যও তো কিছু করিনি। খুব স্বাবলম্বী মানুষ হয়েছ, দেখে এসেছি। তবু আমি বেঁচে থাকতে তুমি নিজের হাতে রাঁধলে বাড়লে, কাপড় কাচলে আমি যে পাপের তলায় পড়ি।
॥ একাত্তর ॥
ছেলেটা সারাদিন ঘুমোয়। আর ঘুমের মধ্যে কখনও-সখনও গাল ভরে হাসে, কখনও ভ্রূ কুঁচকে কান্না কান্না মুখভাব করে।
শীলা বলে—ওদের পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে, জানো!
কথাটা অবিশ্বাস করতে পারে না অজিত। সে যদিও পূর্বজন্ম মানে না, তবু এখন তার মনে হয়—হবেও বা। নইলে একমাসও পুরো বয়স হয়নি যে শিশুর সে অমন চমৎকার ঘুম-হাসি হাসে কী করে! আধখানা ঠোটে বেশ একটু শ্লেষ বা বিদ্রুপের হাসি।
অজিত যেটুকু সময় পায় বিছানার পাশে বসে থাকে। এই এতদিনে সে নিজস্ব একটা মানুষের জন্ম দিতে পারল। নিজস্ব মানুষ, ছেলে। তারই অন্তর্গত বীজ থেকে প্রাণ পেয়ে শীলার জঠর বেয়ে এসেছে। কি সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! ভাবতে বসলে থই পাওয়া যায় না। তার ভিতরে ছিল, শীলার ভিতরে ছিল! তাদেরই রক্ত মাংস প্রাণ থেকে, ঠিক যেমন একটা আগুনের শিখা থেকে আর একটা ধরিয়ে নেওয়া, সেরকম।
শীলা আজকাল হাঁটাচলা করে অল্পস্বল্প। এ-ঘর ও-ঘর করে। নতুন একটা রান্নার মেয়েছেলে রাখা হয়েছে, বাচ্চা ঝিটা সারাদিন বাচ্চার খিদমদগারী করে।
ছেলের নাম রাখার জন্য একটা পৌরাণিক অভিধান কিনে এনে কদিন ধরে ঘাঁটছে অজিত। রামায়ণ মহাভারত আর পুরাণ যা পাচ্ছে কিনে আনছে। কোনও নামই পছন্দ হচ্ছে না।বই রেখে কখনও ছেলের মুঠো পাকানো ঘুমন্ত হাত দুখানার দিকে চেয়ে থেকে বলে— ব্যাটা বক্সার হবে নাকি শীলা? সব সময়ে ঘুষি পাকিয়ে থাকে কেন?
শীলা বলে—গুন্ডার ছেলে গুন্ডাই হওয়ার কথা।
—আমি গুন্ডা?
—গুন্ডাই তো। যা গুন্ডামিটা করো আমার সঙ্গে!
অজিত দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলে—ছেলেটা খুব চিন্তাশীল বলেও মনে হয়। ভ্রু কুঁচকে কী ভাবে বলো তো সবসময়ে?
শীলা ধমক দিয়ে বলে—সব সময়ে অত চেয়ে থেকো না তো! বাপ-মায়ের নজর খুব খারাপ। মা-ও সেদিন আমাকে বলে গেছেন, জামাই অত ছেলের দিকে চেয়ে থাকে কেন রে! ও সব ভাল নয়।
ছেলেটার গা থেকে পাতলা চামড়া উঠছে। তালুতে আর গায়ে চুপচুপে করে তেল মাখাননা। ঘানির সর্ষের তেল টিন ভরে কিনে এনে রেখেছে অজিত। ইটালিয়ান অলিভ অয়েলও। যে যা বলছে কিনে আনছে।
শীলা বলে—আদেখলা।
অজিত বলে— তুমিও কম কী?
দুজনেই তারপর হাসে।
ঘুমের মধ্যেই বাচ্চাটা দুধ খায়, ঘুমের মধ্যেই কাঁথা ভেজায় দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার, ঘুমের মধ্যেই চমকে চমকে ওঠে।
অজিত বিরক্ত হয়ে বলে—ও এত ঘুমোয় কেন?
শীলা বলে—চুপ চুপ। বাচ্চারা যত ঘুমোয় ততই ভাল। দশমাস ধরে পেটের মধ্যে যা ফুটবল খেলেছে তোমার গুন্ডা ছেলে, ঘুমোবে না?
একটা হালকা বালিশ বুকের ওপর চাপিয়ে রাখে শীলা। অজিত ভয় পেয়ে বলে— সাফোকেশন হবে যে!
—না গো, ভার রাখলে আর চমকায় না।
অজিত ছেলেটার শব্দ শুনতে চায়, হাসি কান্না কথা বা যেমন হোক শব্দ। কিন্তু অত ঘুম বলে বাড়িটা নিস্তব্ধ থাকে। বাচ্চাটা কাঁদেও কম। যতটুকু সময় জেগে থাকে ততটুকু সময় ধরে অল্প অল্প হাত পা নাড়ে। ভাল করে কোনও কিছুর দিকে তাকাতে পারে না। কী ভীষণ অসহায়! এসব ভাবলে বুকের মধ্যে মায়া চলকে চলকে ওঠে। প্রতিদিন ভয়ংকর প্লাবনের মতো বুক ভাসিয়ে দিয়ে মায়ার জল বাড়ে। পিপাসা বাড়ে। এই তার ছেলে, তার আপন মানুষ। তার সৃষ্ট।
সৃষ্ট? না, তা তো নয়। অজিত দ্রু কুঁচকে ভাবতে বসে। এই ছেলেটার জন্মরহস্যটুকুই মাত্র সে জানে। জানে, সে এর জন্মের কারণ। কিন্তু ওর ওই ছোট্ট শরীরের লক্ষ কলকব্জা, ওর চেতনা ও প্রাণ—এ তো তার সৃষ্টি নয়। তাকে দিয়ে কে যেন ওকে সৃষ্টি করেছে। যে করেছে সে কে? ঈশ্বর?
—শোনো শীলা।
—উঁ।
—জায়া মানে জানো?
—জানি। বউ।
—দূর! হল না।
—তবে কী?
—জায়া মানে যার ভিতর দিয়ে পুরুষ আবার জন্মায়। এই যেমন আমি তোমার ভিতর দিয়ে ওই ছেলেটা হয়ে জন্মেছি।
—ও।
এইসব অদ্ভুত রহস্য ক্রমে ধরা পড়ছে অজিতের কাছে। সে আজকাল অল্পস্বল্প টের পায় যে, বাস্তবতার অতিরিক্ত একটা শক্তির অস্তিত্ব আছে। সে শক্তিই হয়তো প্রকৃতি বা ঈশ্বর।
কদিন আগে ছেলেটা খুব হচত। ভয় পেয়ে গিয়েছিল অজিত। খুব শিশুদের সর্দি হলে বাঁচানো মুশকিল। ওরা তো শ্লেষ্ম তুলতে পারে না, দম আটকে মরেটরে যেতে পারে। শিশুদের সর্দি বড় ভয়ের।
তাই ছেলের হাঁচি দেখে অজিত উদ্বিগ্ন হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল—হায় ভগবান! ওর যে সর্দি হয়েছে।
লক্ষ্মণ ঘরে বসেছিল। বলল—দূর বোকা, ও সর্দি নয়। সদ্য হয়েছে তো, ওদের বুকে গলায় নানারকম কনজেশন থাকে। হাঁচি দিয়ে বের করে দেয়।
অজিত রুখে বলল—তুই জানলি কী করে? তোর কখনও ছেলে হয়েছে?
—ওসব বুঝতে কমন সেন্স যথেষ্ট।
পরে অজিত জেনেছে, লক্ষ্মণের কথাই ঠিক। লক্ষ্মণের কমন সেন্স বরাবরই অদ্ভুত। মানুষকে অনেক ভয়-ভীতি থেকে মুক্তি দিতে পারে লক্ষ্মণ। অজিতকে বরাবর দিয়েছে।
ছেলেটার গায়ে একটা অদ্ভুত আঁতুড়ের গন্ধ। এত মিষ্টি গন্ধ আর কখনও পায়নি অজিত। প্রায়ই সে ছেলের শরীরে নাক ডুবিয়ে বুক ভরে গন্ধ নেয়। আর খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওর গা। তেল চোবানো বলে ছেলেটার গলার খাঁজে ময়লা, মুঠো খুললে হাতের রেখায় রেখায় ময়লা জমে থাকতে দেখা যায়। প্রায়দিনই ওকে স্নান করানো হয় না। শীলা গ্যাদড়া বাচ্চাকে নাড়াচাড়া করতে ভয় পায়। দু-চারদিন পর পর ননীবালা আসেন, রোদ্দুরে নিয়ে গিয়ে গরমজলে স্নান করান। দৃশ্যটা ভয়াবহ। এক হাতের চেটোয় বাচ্চাটাকে অনায়াসে ধরে থাকেন, বাচ্চাটা ন্যাতার মতো বেঁকে ঝলে কাদতে থাকে, অন্য হাতে গামছায় জল নিয়ে ওর শরীর ঘষতে ঘষতে ননীবালা নাতির উদ্দেশ্যে কত যে কথা বলেন। স্নান করিয়ে পাউডার আর কাজল দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যান।
অনেকদিন স্নান হয়নি বাচ্চাটার। ননীবালাকে একটু খবর দিতে হবে।
লক্ষ্মণ দিন দশেক ধরে মুম্বই আর দিল্লি ঘুরে এল। একবছরের মধ্যেই ও পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসতে চায়। সেটা ঠিক করে যাওয়ার জন্যই এবার এসেছে।
দিল্লি থেকে ফিরে একদিন ম্লান মুখে এসে বললে—অজিত, বড় মুশকিলে পড়ে গেলাম।
কীরে?
ভাবছিলাম, এ দেশে একটা চাকরি বা পজিশন পেলে ফিরে আসব। কিন্তু পাচ্ছি না।
—কেন?
—আমার লাইনের বেশি প্রজেক্ট তো এখানে হয়নি। যা দু-চারটে আছে সেখানে সব উপযুক্ত লোক রয়েছে। তাই ভাল পজিশন পাচ্ছি না।
—তা হলে?
—মুশকিল হল। এরকম হলে ফিরে আসা শক্ত। ওখানে আমার মাইনেই শুধু বেশি নয়, কাজ করারও অঢেল সুযোগ। কী করি বল তো!
—কী করবি?
—আমি তো চলে আসতেই চাই। কিন্তু মোটামুটি একটু ভাল জায়গা না পেলে চলবে কী করে? ওখানে আমি অনায়াসে সিটিজেনশিপ পেয়ে যেতে পারি এখন। ইচ্ছে করেই নিইনি। কিন্তু যদি এখানে কিছু মেটেরিয়ালাইজ না করে তবে বাধ্য হয়ে এবার সেটা নিয়ে ওখানেই থেকে যেতে হবে।
—যাঃ
খুব মন খারাপ হয়ে যায় অজিতের। লক্ষ্মণ আশা দিয়েছিল যে ও ফিরে আসবে। সেটা একটা মস্ত জিনিস অজিতের কাছে। লক্ষ্মণ নিজেও বুঝি জানে না যে ও অজিতের কী ভীষণ প্রিয় ও আপন।
লক্ষ্মণ, এ কিছুতেই হতে পারে না। আমি ভীষণ লোনলি ফিল করি।
লক্ষ্মণ হেসে বলে—জানি।
—তোকে আসতেই হবে।
—আমিও তো চাই। কিন্তু পারছি না যে।
—লক্ষ্মণ প্লিজ! অজিত ভীষণ অস্থির হয়ে বলে।
॥ বাহাত্তর ॥
ননীবালা কেন স্যুটকেস গোছাচ্ছেন তা অনুমান করতে ভয় পাচ্ছিলেন ব্রজগোপাল। নিপাট ভালমানুষের মতো বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে করে বললেন—শোনো, এখন বয়স হয়েছে। তোমারও আমারও।
ননীবালা মুখ তুলে বলেন—সে তো জানি। বলছ কেন?
—এখন হুট করে কিছু করতে নেই, দৃষ্টিকটু দেখায়।
ননীবালা একটু শ্বাস ছাড়লেন। স্যুটকেস যেমন গোছাচ্ছিলেন তেমনই গোছাতে লাগলেন। বললেন—হুট করে নয়। অনেকদিন ধরেই এটা ভেবে আসছি। আজকাল আর মন টেকে না এখানে। ছেলেপুলে নাতিনাতনি সব থেকেও কেমন হাঁফ ধরে যায়। মনে হয় আমি বুঝি বাড়তি মানুষ।
ব্রজগোপাল ধীরগম্ভীর স্বরে বলেন—সে তো ঠিকই। তবু এমন কিছু করো না যাতে ওদের সামনে একটা কু-দৃষ্টান্ত থাকে। সংসারে সবসময়েই সব কাজেরই নিন্দে হয়।
ননীবালা তাঁর বিখ্যাত বড় বড় চোখে অপলক চেয়ে রইলেন ব্রজগোপালের দিকে। তারপর আস্তে করে বলেন—আমাকে বোকা ভাবছ!না? ভাবছ আমি এই বুঝি ঘাড়ে চেপে বসলাম পেতনির মতো।
ব্রজগোপাল উদারভাবে হেসে বলেন—আমি এই কথাটারই ভয় পাচ্ছিলাম। তোমাকে তো চিনি। আর তোমারই বা কথা কী, দুনিয়ার বোধ হয় সব মেয়েমানুষই ওইরকম করে ভাবতে শেখে। সংসারে কারও কাছে তার ওজন কমে গেল বুঝি কখন।
ননীবালা স্যুটকেসের ডালা বন্ধ করে বলেন—আমি ঠিক জানতাম, তুমি ভাল মনে আমাকে আর নিতে পারবে না। একেবারেই কি সংসারের বাইরে চলে গেলে? আর কি কখনও বাউণ্ডুলেপনা ছাড়তে পারবে না?
ব্রজগোপাল তটস্থ হয়ে বলেন—ওসব কথা থাক না। আমার কথা তো একটা জীবন ধরে সবাইকে বলে বেড়িয়েছ। আমি যা ঠিক তাই। ও নিয়ে আর উত্তেজিত হয়ো না। বলি কী, যাবেই যদি তো সবাইকে আগে থেকে বলেকয়ে রাজি করিয়ে তারপর চলো। আমিও তো পথ চেয়েই আছি। বুকে মাঝে মাঝে ঠেলা ধাক্কা লাগছে, কবে কী হয়ে যায়। শেষ বয়সটা না-হয় তুমি আমার কাছেই একটু কষ্ট করে…
ব্রজগোপাল আর বলতে পারলেন না। গলাটা ধরে এল। সহজে বিচলিত হন না। কিন্তু এখন হলেন। বারবার গলাটা ঝেড়ে পরিষ্কার করতে লাগলেন। এ সব দুর্বলতা কেন যে এখনও রয়ে গেছে! সকালে খুব সুন্দর একটি প্রণাম নিবেদন করে এসেছেন ঠাকুরকে। ভেবেছিলেন, সংসারের কাছে তার সব প্রত্যাশা বুঝি চুকেবুকে গেছে। কিন্তু যায়নি তো। বুকের কোন গর্ত থেকে এই দুর্বলতার কালসাপ বেরিয়ে এল!
ননীবালা অত্যন্ত কূটচক্ষে চেয়েছিলেন। হঠাৎ উঠে পাশে এসে বসে পিঠে আলতো হাত ছুঁইয়ে বললেন—কেন অত পাষাণ হওয়ার চেষ্টা করো বলো তো! তোমার মতো মানুষ কি কখনও এরকম হতে পারে। সংসারের দিক থেকে যতই চোখ ফিরিয়ে থাক, তোমাকে আমি চিনি।
ব্রজগোপাল সামলে গেলেন। হেসে বললেন—ভাল, ভাল।
—ভালই তো। তুমি ভেবো না, আমি যে তোমার কাছে চলে যাব এ কথা আমি আগে থেকেই গেয়ে রেখেছি। আমার আর ভাল লাগে না। তোমার ছোট ছেলেটা কোনওদিনই আমাকে দেখতে পারে না। তার ধারণা তোমাকে আমিই পর করেছি। তাই ভাবি, তোমার কাছে গিয়ে থাকলে বোধ হয় তার মন পাব। নইলে ও ডাকাত ঠিক আমেরিকা না কোথায় চলে যাবে।
ব্রজগোপাল আবার হেসে বলেন—বেশ ব্যাবসাবুদ্ধি তোমার। ছেলের মন পাওয়ার অত চেষ্টা করো কেন? এটা ঠিক জেনো, তুমি যত ওদের ভালবাসবে তার অর্ধেক তোমাকে ভালবাসার ক্ষমতাও ওদের নেই। স্নেহ নিম্নগামী, এ তো জানোই।
ননীবালা ব্রজগোপালের পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পানের বাটা খুলে বসলেন।
বললেন—ছেলেদের জন্য অনেক করেছি। তুমি ঠিকই বলেছ, অত করতে নেই। তাই এবার একটু দূরে সরে যেতে চাইছি। তাইতে হয়তো সম্পর্কটা ভাল থাকবে।
ব্রজগোপাল হাসিমুখে মাথা নেড়ে বললেন—কিংবা হয়তো সম্পর্ক থাকবে না সোমেন যখন আমার কাছে প্রথম গেল তখন চিনতে কষ্টই হচ্ছিল। বাবা বলে ডাকল, খুব আশ্চর্য লাগছিল শুনে। আমারই ছেলে, তবু সম্পর্ক রাখত না বলে কত পরের ছেলের মতো হয়ে গেছে। ছেলেরা সম্পর্ক রাখবে কেন, ওটা তো তাদের দায় নয়। চোর-দায়ে ধরা পড়েছে যত মা বাপ।
ননীবালা মুখখানা ম্লান করে বললেন—না গো, ওরকম ভাবা তোমার ভুল হয়েছে। সোমেন ফিরে এসে থেকেই তোমার কথা কত বলেছে। আমার ওপর সে কী চোটপাট! বড় হয়ে বুঝতে পেরেছে তো বাপ কত আপন! সেই বাপকে সংসার পর করে দিয়েছে এটা ও সইতে পারে না। ওকে খারাপ ভেবো না। একটু রাগী আর গোয়ার ঠিকই, কিন্তু মনটা ভাল।
ব্রজগোপাল পায়ের ওপর পা তুলে বসেছিলেন। গ্রীষ্মকালে ডাবের জল খেলে যেমন ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে যায়, এ কথা শুনে তাঁর ভিতরটাও তেমনি ঠান্ডা হচ্ছিল। কথাগুলি তিনি পান করছিলেন পরম আনন্দে।
বললেন—মায়েদের ওই দোষ। ছেলেদের কেউ কিছু ভালমন্দ বলতে পারবে না, এমনকী বাপও নয়। ওই করেই তোমরা ছেলেপুলে নষ্ট করো।
ননীবালা ব্রজগোপালের কণ্ঠের স্নিগ্ধতা লক্ষ্য করে হেসে ফেলে বলেন—সেও ঠিক কথা। আমরা মায়েরাই নষ্ট করি। তুমিও তো ওইরকম মায়ের আদর পেয়েই বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়াতে। সে কথা ভুলে যাও কেন!
ব্রজগোপাল অন্যমনস্কভাবে মনশ্চক্ষে এক জগদ্ধাত্রীর রূপ দেখতে পেলেন। বয়সের ভার, বিস্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে সেই বিসর্জিত প্রতিমার স্মৃতি আজও দেখা দেয়। গাঢ়স্বরে বললেন—মা! মায়ের মতো জিনিস আছে!
বহুকাল পরে সেই মা-ন্যাওটা শিশুর মতোই বুকটা আকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় মরার তো দেরি নেই। মরে মায়ের কাছে যাব। মা কত নাড় মোয়া করে রেখেছে!
ননীবালা বললেন—শোনো, আমি যা ঠিক করেছি তার আর নড়চড় হবে না। আমি যাবই। তুমি একটু বসো, সোমেন দুপুরে খেতে আসবে। ওকে সব বুঝিয়ে বলে আমি যাব। বীণা আর রণোকে দুই খোট চিঠি লিখে রেখে যাচ্ছি। ভয় পেয়ো না, ওরা কিছু মনে করবে না।
—যাবেই?
—হুঁ। নইলে সম্মান থাকে না। তোমারও আমাকে দরকার। বহেরুর ওই ভূতের রাজ্যে কে তোমাকে দেখে বলো তো! ঘাড়ের বোঝা মনে করো, পেতনি ভাবো, তবু জেনো আমার চেয়ে আপনার তোমার কেউ নেই।
ব্রজগোপাল উত্তর করলেন না। শুধু অস্ফুট ‘হুঁ’ দিলেন।
ননীবালা উৎকণ্ঠায় বললেন—কী? কিছু বলছ না যে!
—বড় হুট করে ঠিক করলে তাই ভাবছি। ঠিক আছে গুছিয়ে নাও।
ননীবালা অবহেলার ভাব করে বললেন—গোছানোর আর কী! তেমন কিছু নিজের বলতে নেইও। সবই রণোর সংসারের। এই দু-চারখানা জামাকাপড়…
কড়া নড়ল। ননীবালা উঠে গিয়ে সদর খুললেন। বিভ্রান্তের মতো সোমেন ঘরে এসে ঢুকেই থমকে গেল।
—বাবা!
—আয়।
সোমেন ভরদুপুরের ক্লান্ত মুখশ্রী ভেঙে ফেলে খুব খুশির একটা হাসি হেসে বলল— কখন এলেন? কেমন আছেন বাবা!
ব্রজগোপাল মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন।
॥ তিয়াত্তর ॥
ননীবালা সোমেনকে বললেন—তুই স্নান করে আয় খেতে দিই।
সোমেন জামা গেঞ্জি ছেড়ে প্যান্ট পরে পাখার তলায় মেঝেয় বসে বলল—উঃ, দাঁড়াও একটু জিরিয়ে নিই। দাদা বউদিরাও তো দুপুরেই ফিরবে, একসঙ্গে খেতে দিয়ো।।
বলে চৌকিতে বসা বাবার দিকে মুখ তুলে চেয়ে বলল—আপনার সেই বুকের ব্যাথাটা আর হয় না তো বাবা?
—না না। বেশ ভাল আছি।
বলে ব্রজগোপাল চোখ সরিয়ে নিলেন।
সোমেন অন্যমনস্কভাবে মেঝেয় রাখা স্যুটকেশ দেখছিল। মা হয়তো কিছু বেরটের করছিল। হাত দিয়ে সে স্যুটকেশটা চৌকির তলায় ঠেলে দিল ফের।
ননীবালা পানের পিক ফেলে এসে বসলেন। বললেন—বুঝে সমঝে থাকিস। তোর তো আবার হুট বলতেই মাথা গরম হয়। কিন্তু মা ছাড়া তো আর কেউ তোমার রাগের মর্ম বুঝবে না। তাই বলছি, রাগ-টাগগুলো এবার যেন কম করো।
সোমেন অবাক হয়ে বলল—তার মানে? কীসের রাগের কথা বলছ?
ননীবালা চোখের জল মুছলেন আঁচলে। তারপর ভার-ভার মুখখানা সোমেনের দিকে ফিরিয়ে খুব অস্ফুট গলায় বললেন—আমি চলে যাচ্ছি বাবা।
সোমেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। এতকালের মা, যাকে ছাড়া তার একমুহূর্ত চলে না, সেই মা কোথায় যাবে?
সে বলল—কোথায়? বাবার কাছে নাকি!
ননীবালা আঁচলে মুখ চেপে ফুপিয়ে উঠলেন।
ব্রজগোপাল সামান্য অস্বস্তি বোধ করে বললেন—ওঁর খুব ঝোঁক চেপেছে বনবাসী হবেন আমার মতো। আমি বলছিলাম যা করুন একটু ভেবেচিন্তে করুন। তোমাদেরও মতামতের দরকার। মা বাপ বুড়ো হলে ছেলেপুলেরাই তাদের অভিভাবক হয়। এখন তোমরা বিবেচনা করে দেখো—
অবাক ভাবটা সামলে নিল সোমেন। হঠাৎ তার খুবই ভাল লাগছিল ব্যাপারটা। এতকাল তাদের সংসারে কোথায় যেন একটা ছেড়া তারে বেসুর বেজেছে। কী যেন একটা অসঙ্গতি দৃষ্টিকটু হয়ে থেকে গেছে বরাবর। এতকাল পরে সেটা বড় স্পষ্ট ধরা দেয়। ঠিকই তো! মা কেন বাবাকে ছেড়ে থাকবে! থাকা উচিত নয়। বোধ হয় এই একটা কারণেই, মাকে ভালবেসেও এতকাল ধরে মার প্রতি একটা অলক্ষ্য বিতৃষ্ণাও রয়ে গেছে তার বুকের মধ্যে। তাই সে মা থাকবে না জেনেও খুব একটা দুঃখ পায় না।
ব্রজগোপালের দিকে চেয়ে সোমেন বলে—আপনার মত-ই মত।
ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—না না, সেটা কোনও কাজের কথা নয়। আমাদের বুড়ো বয়সে কত মতিভ্রম হয়।
সোমেন হাসল একটু। বড় হয়ে প্রথম যেদিন বাবার কাছে গিয়েছিল গাঁয়ে, সেদিনই তার মনে হয়েছিল, এই ব্রজগোপাল মানুষটির মধ্যে কিছু মৌলিক মানবিকতা আছে, যা তাদের নেই। ব্রজগোপাল অনেক কথা বলেন যা গ্রহণীয় নয়, যা কখনও হাস্যকর। তবু এ মানুষটা যে-মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তা বড় দেশজ।
সোমেন হেসেই বলে—কিন্তু আপনি তো না ভেবেচিন্তে কিছু করেন না। আমরা হুটহাট অনেক কথা বলে ফেলি, তাড়াতাড়ি ডিসিশন নিই। আপনি সবই আগে থেকে ভেবে রাখেন। মায়ের যাওয়া যদি আপনি ভাল বোঝেন আমারও খুব সায় আছে। আরও আগে হলে ভাল হত। অবশ্য সবচেয়ে ভাল হত, আপনি আমাদের কাছে চলে এলে।
এই কথায় ননীবালা হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন—না না, সংসারে না থেকে উনি ভালই করেছেন। এ বড় ছোট জায়গা বাবা। এতকাল ধরে দেখছি।
ব্রজগোপাল ছেলের চিক্কণ সুন্দর মুখশ্রী অবলোকন করতে করতে কিছু ধীরস্বরে বলেন—সংসারে বাইরে একটা জায়গা করে রাখা সব মানুষের পক্ষেই দরকার। ঠিক সময় বুঝে সরে যেতে হয়। এই সরে যাওয়াটার মানে অনেকে বোঝে না। আমার মনে হয় সময় মতো সরে যাওয়াটাই হচ্ছে বিচক্ষণের কাজ, তাতে কারও ভালবাসা হারাতে হয় না, নিরন্তর মানুষের সংসারে জায়গা ছোট হয়ে আসে—সেই জায়গা দখল করে থেকে বিরক্তি উৎপাদন করারও দরকার পড়ে না। বানপ্রস্থের ব্যবস্থা খুব মনোবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানসম্মত। বন মানে বিস্তার। সংসার ছেড়ে বৃহৎ সংসারে চলে গেলে আনন্দও পাওয়া যায়। মনটাও সজীব থাকে।
সরে যাওয়ার কথাটা ভালই লাগছিল সোমেনের। বানপ্রস্থের কথাটা খট করে কানে লাগল। বুড়ো বয়সের ওই দোষ। সব প্রাচীন প্রথার মধ্যে আশ্রয় খোঁজার অভ্যাস। তবু বাবাকে ঠিক সেরকম ভাবতে কষ্ট হয় সোমেনের। যদিও বাবাকে খুব ভাল করে জানা হয়নি তার আজও, কারণ তারা মানুষ হয়েছে মায়ের আঁচলের তলায়। বাবাকে ঠিকমতো চেনাই হয়নি। বাবা শাসন করতেন না, আদরও বড় একটা নয়। তবে খুব শান্ত গলায়, ভালমানুষের মতো কথা বলতেন ছেলেদের সঙ্গে। কারও সম্মান কখনও ক্ষুণ্ণ করেননি। ছেলেপুলেরাও যে সম্মান পাওয়ার অধিকারী এটা ব্রজগোপাল বরাবর বুঝতেন। বাবার হাতে চড়চাপড় বা ধমক খেয়েছে এমনটা মনেই পড়ে না তার। ব্রজগোপাল যখন স্থায়ীভাবে গোবিন্দপুরে চলে গেলেন তখনও তেমন কোনও দুঃখ পায়নি তারা। কিন্তু সোমেন বড় হয়ে ব্রজগোপালকে দেখেই এই নির্বাসিত লোকটির প্রতি বড় একটা আকর্ষণ টের পেয়েছে। সফল এবং ধনী পিতাকে সব ছেলেই কিছু সমীহ করে, ব্রজগোপালের সেদিক থেকে কিছু নেই। যা আছে তার কোনও মূল্য এখনকার সমাজ দেয় না। সে হল চরিত্র। আজ সোমেন বাবার ভিতরে সেই খাঁটি সোনার পুরনো গয়নার মতো অপ্রচলিত জিনিসটির প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করে। বাবার আর কিছু না থাক, লোকটি বড় ভাল। এ লোকটা ভুলেও এক পয়সা চুরি করবে না, একটা মিথ্যে কথা বলবে না, কাউকে আঘাত করবে না।
সোমেন বলল—কেন বাবা, আপনাকে কি আমরা অনাদর বা অসম্মান করব এই ভাবেন?
—না, তা নয়। ব্রজগোপাল হাসে—তোমরা তা করবে কেন? তেমন বাপের ছেলে নও তোমরা। ব্যাপারটা হল, আমি তো বরাবরই একটু বারমুখী। আমার কেমন আটক থাকতে ভাল লাগে না। কিন্তু তা বলে স্নেহ কিছু কম ছিল না তোমাদের প্রতি, ঠাকুর জানেন। তো আমি ভাবলাম, এই স্নেহটুকুই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, সংসারে এই স্নেহটুকু বুকে নিয়েই সরে যাওয়া ভাল। তা হলে সেটুকু বাঁচে। নইলে নানা স্বার্থের দ্বন্দ্বে কবে মন মরে যায়। আমি বাবা, বড় ভিতু মানুষ। স্নেহের কাঙাল। তুমি বরং স্নানটান করে নাও। বেলা হল, আমি বসিয়ে রাখছি।
সোমেন উঠল। মুখ কিছু বিষন্ন। আবার বিষন্নতার ভিতরেও একটু তৃপ্তিময় আনন্দ।
শরতের বেলায় বড় রোদ। সারা সকালটা সসামেন পুড়েছে ঘুরে ঘুরে। বাথরুমে খুব বেশি জল নেই। তাই সাবধানে জল বাঁচিয়ে স্নান করছিল। আর ভাবছিল। মা চলে গেলে ঘরটা তার একার হবে। আবোল-তাবোল বকে মাথা ধরিয়ে দিত মা। আর দেবে না। মাকে অনেক বকেছে সোমেন। ইদানীং সবচেয়ে বেশি রাগ হত মায়ের প্রতি। একটামাত্র নিরাপদ রাগের জায়গা। সত্যি কথা, আর কে তার রাগ অভিমানকে পাত্তা দেবে? তা হোক গে, সংসারে চিরকাল মা-মা করলে হবেও না। তার সামনে বিপুল পৃথিবী পড়ে আছে। সে না আমেরিকায় চলে যাবে চিরদিনের মতো? সংসারের ছোটখাটো দড়িদড়া ছিঁড়ে এবার জেটি ছেড়ে বার দরিয়ায় গিয়ে পড়তে হবে। সে তো আর ছেলেমানুষ নেই! কয়েকটা দিন একটু ফাঁকা লাগবে, কষ্ট হবে। তা হোক গে।
স্নান করতে করতেই টের পেল, দাদা বউদি আর বাচ্চারা ফিরেছে। খুব হইচই হচ্ছে।
স্নানের ঘর থেকে বেরোতেই বউদি তাকে নিজের শোওয়ার ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। নিচু গলায় বলল—কী ব্যাপার বলো তো! মা নাকি আজই চলে যাচ্ছেন!
—তাই তো শুনছি।
—রাগটাগ করেননি তো!
—আরে না। মা তো অনেকদিন থেকেই যাব যাব করছে।
বীণা মুখখানা শুকনো করে বলে—সে তো অনেক কথা বলেন রাগের মাথায়। সব কি ধরতে আছে?
সোমেন আস্তে বলল—যেতে দাও। তাতে ভালই হবে।
বীণা মাথা নাড়ল। একটু ধরা গলায় বলল—না সোমেন, এটা ভাল হল না। লোকে মনে করবে, বউ শাশুড়িকে তাড়িয়েছে।
—দূর। লোকের ভাবতে বয়ে গেছে। এটা কলকাতা, বনগাঁ নয়।
বীণা তেমনি বিষন্ন গলায় বলে—সেটা না হয় মানলাম, কিন্তু আমরাই বা কী করে থাকব? কদিন উনি ছিলেন না, তাইতেই বাচ্চারা ঠাম্মা ঠাম্মা করে অনাথ শিশুর মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। এখন কী হবে?
সোমেন নিঃশ্বাস ফেলে বলে—ও সব সেন্টিমেন্ট ছাড়ো তো। বাচ্চাদের সব সয়ে যায়। তা বলে মাকে আটকে রেখো না। বাবার কথা ভেবে ছেড়ে দাও। একা বাবার বড় কষ্ট।
বীণা উদাস গলায় বলে—কষ্ট হলেও ওঁর সয়ে গেছে। আমাদেরই কষ্ট হবে বেশি।
কথাটা শুনে একটু অবাক মানে সোমেন। বউদির সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক তো কোনওকালে! তেমন ভাল ছিল না! মুখ ফসকে সে বলে ফেলল—কষ্ট হবে মানে? মা গেলেই তো তোমার সুবিধে, ক্যাটক্যাট করার লোক থাকবে না।
জলভরা চোখে, কান্না আর ভর্ৎসনা মেশানো চোখে তারদিকে তীব্রভাবে মুখ ফেরাল বীণা। চোখের জল গড়িয়ে নামল, সেটা মুছবার চেষ্টাও না করে বলল—তাই মনে হয় না? আমি পরের মেয়ে, তোমাদের মনে তো হবেই। আমার কথা না হয় বাদ দাও, তোমার দাদাকে গিয়ে দেখে এস, তোমাদের ঘরে মার কোলে মুখ গুঁজে কেমন কঁদছে। পাষাণ গলে যায়। যাও, দেখে এস।
সোমেন উঠে এল।
সত্যিই দৃশ্যটা সহ্য করা যায় না। চৌকির ওপর মা বসা, তাঁর কোলে মাথা গুঁজে রণেন লম্বা হয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। মা তার চুলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে বসে আছে পাথর হয়ে। দুচোখে জলের ধারা। ছেলেমেয়েরা ঠাকুমা আর বাবার দৃশ্যটার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে।
রণেন কাঁদতে কাঁদতে বলে—আমিই তোমাকে তাড়ালাম মা। আমার সংসারে তুমি থাকতে পারলে না মা। কি করেছি বলো, আমাকে কেন ছেড়ে যাচ্ছো?
ননীবালা আকুল হয়ে বলেন—ওরে, ওসব কী বলছিস? বলিস না, বলিস না। আমি সে-যাওয়া যাচ্ছি নাকি? বুড়ো মানুষটা গতরপাত করে খায়, তার দিকটা একটু দেখে আসি।
সোমেন কিছু বিরক্ত হয়ে বলে—এ তোমরা কী শুরু করলে বলো তো? যাবে তো একটুখানি দূরে। এবেলা-ওবেলা ঘুরে আসা যায়।
রণেন মাথা তুলল না। পড়ে রইল।
ননীবালা তার চুলের মধ্যে বিলি কেটে দিতে থাকেন।
ব্রজগোপাল খুব গম্ভীর আর অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিলেন। বোধ হয় ভাবছিলেন যে, তিনি যখন চলে যান তখন কেউ এভাবে তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেনি।
সোমেন বাবার দিকে চেয়ে বলে—বাবা, আপনি একটু দেখুন। এত কান্নাকাটি ভাল লাগে না।
ব্রজগোপাল ছেলের দিকে তাকালেন। মাথা নেড়ে বললেন—ও খারাপ নয়। কান্না জিনিসটা ভাল। তুমি বরং খেয়ে নাও গে। যদি তোমার অসুবিধে না হয়, বরং হাওড়ায় তুলে দিয়ে এস। তোমার মা যাবেনই, তাঁকে আটকানো যাচ্ছে না।
রণেন মুখ তুলে বলে—বাবা, আমাকেও নিয়ে যান সঙ্গে। আমি মাকে আর আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
ব্রজগোপাল একবার কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। তারপর আবার সময় নিয়ে বললেন—তুমি বড় ভাল মানুষ বাপকুমোনা, তাই অত কষ্ট পাচ্ছো। মনটাকে শক্ত করো। মনকে বেশি প্রশ্রয় দিতে নেই। পুরুষ মানুষ, ওঠো।
রণেন কোলে মাথা রেখেই বলে—আমার কেমন যেন মনে হয় বাবা যে, আমি খুব ছোট্ট হয়ে গেছি। আদুরে ছেলে। বড় মা-মা আর বাবা বাবা করে প্রাণটা।
শুনে বুবাই হেসে ফেলল। টুকাই-ও। শুধু মেয়েটা ঠাকুমার দেখাদেখি কাঁদছিল। মেয়েরা কান্নার অভ্যাস নিয়েই জন্মায়। আর বীণা কখন অলক্ষ্যেতে নিঃশব্দে এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিল, দুচোখে অঝোর জল, ফেঁপাচ্ছে। একটা হাত বাড়ালেন ননীবালা, বীণা নিঃশব্দে এসে বুক ঘেঁষে বসল।
ননীবালা তাকে বুকের সঙ্গে সিটিয়ে নিয়ে বললেন-বউমা, এই একটা অবোধকে রেখে যাচ্ছি, বুক-বুক করে রেখো। আর ওই ছোটটা ওকে ছেলের মতো—বুঝলে? কোনওটাই আমার পাকা মানুষ নয়, ন্যাংলা হাবলা।
বুবাই টুকাই ফের হেসে ওঠে ন্যাংলা হাবলা শুনে। সোমেন ওদের নড়া ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘর থেকে। বাইরের ঘরে এনে ধমক দেয়—হাসছিলি কেন? খুব হাসির ব্যাপার হচ্ছে ওখানে, না? দেব থাপ্পড়?
কাকাকে ওরা ভীষণ ভয় খায়। ভয়ে অবশ হয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখের পাতা ফেলছে।
—যা, ঘরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধো।
সোমেন বাইরের ঘরে বসে সিগারেট ধরায় দাদার প্যাকেট থেকে।
এ-ঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছিল সোমেন, ননীবালা বীণাকে বলছেন—না গো বউমা, হঠাৎ নয়। মনে মনে ঠিকই ছিল। যোগাযযাগটা হঠাৎ হয়ে গেল। আজকের দিনটা পঞ্জিকায় সকালে দেখলাম বড় ভাল দিন। অমৃত যোগ আছে আর এই দিনেই হঠাৎ উনিও এসে পড়লেন। ভাবলাম, ঠাকুরই বুঝি যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। তা এই যোগাযোগ ছাড়ি কেন? রোজই যাব-যাব ভাবি, যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। এইবার হঠাৎ মনটা ‘যাই’ করে উঠেছে যখন, তোমরা তখন আর আটকে রেখো না। এই তো কাছেই, যখন খুশি আসব, তোমরাও যাবে।
খেতে খেতে অনেক দেরি হয়ে গেল। গল্প আর কথা আজ যেন আর শেষ হতে চায় না। বীণা নিজে ননীবালার বিছানা সাজিয়ে দিল, রণেন বাঁধল। গোছগাছেরও শেষ নেই।
কান্নাও চলছে। ফাকে ফাকে হাসিঠাট্টার কথাও। ননীবালা বললেন একবার—ও বউমা, সব জিনিস যে দিয়ে দিচ্ছো বড়! তোমরাই তো পর করে দিলে দেখি!
এইরকম ভাবে সারাক্ষণ বাড়ি সরগরম রইল। বিস্তর পোঁটলাপুঁটলি বাক্স বিছানা সদরে জড়ো করে রেখে সোমেন ট্যাক্সি ডেকে আনল। কান্নাকাটিটা আর বেশি দীর্ঘায়িত করতে দিল না সে। মাকে প্রায় কোলে করে টেনে নিয়ে ট্যাক্সিতে বসাল। ননীবালা কাঁদতে কাঁদতে রণেনকে বলেন—বাড়িটা শেষ করিস। পরের বাড়িতে আর কতকাল পরবাসী থাকবি? আমরা যেন দেখে যেতে পারি।
রণেন কাঁদছিল ছেলেমানুষের মতো হাউহাউ করে। কান্না দেখেই বোঝা যায়, তার ভিতরটা এখনও সুস্থির নয়। বীণা কঁদছে, বাচ্চারাও। পাড়া-প্রতিবেশী বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছিল। কয়েকজন বয়স্কা মহিলা চোখের জল ফেলে গেলেন।
গাড়ি গড়িয়াহাটা ছাড়িয়ে এলে আর কাঁদছিলেন না ননীবালা। পানের বাটা খুলে একটা পান খেলেন। সোমেন ড্রাইভারের পাশে সামনে বসেছিল। পিছন ফিরে একবার মাকে দেখে নিয়ে বলল—উঃ বাবা, তোমরা কাঁদতেও পারো। আমার মাথা ব্যথা করছে।
ননীবালা তাঁর বড় বড় চোখে ছেলেকে স্থিরভাবে একটু দেখে বললেন—শোনো ছোটকা, তুমি মাথা থেকে আমেরিকা তাড়াও।
খুব আদরের সময়ে কখনও-কখনও সোমেনকে ছোটকা বলে ডাকেন ননীবালা।
সোমেন বলে—কেন?
—না। অতদূরে তোমাকে ছাড়তে পারব না। তা ছাড়া, রণেনের কী অবস্থা তা তো দেখছই! এ অবস্থায় ওকে ছেড়ে তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। সুস্থির মাথায় সবটা বিবেচনা করো।
—বাঃ, আমার ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই?
ব্রজগোপাল গলা খাকারি দিয়ে বললেন—বাবা, ওটা ঠিক কথা নয়। আমেরিকা তৈরি দেশ, তারা টাকা দিয়ে বিদেশি চাকর রাখবে। আর তোমার দেশ তোমারই, গরিব মায়ের হাল দেখে কুপুত্রই পালায়। পালানোর জন্য যেয়ো না। যদি বোঝো গিয়ে জ্ঞানী মানী হবে তো যেয়ো। সব কাজের পিছনে নিজের উদ্দেশটা যাচাই করা ভাল। উদ্দেশ সৎ ও সাধু হলে মঙ্গলার্থে সব কাজই করা যায়। অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণও পাপ। আর সৎ উদ্দেশে নারীহরণও পুণ্য।
সোমেন উত্তর দিল না। মনটা খারাপ লাগছে।
হাওড়ায় বড় ঘড়ির নীচে বহেরু দাড়িয়েছিল বশংবদ। ব্যাপার দেখে হইচই করে উঠল— মা ঠাকরুন যাবেন! অ্যাঁ! চন্দ্রসূর্য ওঠে তা হলে! কী ভাগ্য আমাদের! ও ঠাকুর, কালই রাজমিস্ত্রী লাগাব ঘর পাকা করতে। ব্রাহ্মণকে গৃহদান করব। মহাপুণ্য!
টানা-হ্যাঁচড়া করে সেই মালপত্র তুলল গাড়িতে।
সন্ধের মুখে মুখে গাড়িটা ছাড়ল। মা বাবাকে প্রণাম করে প্রায় চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে এল সোমেন।
তারপরই খুব ফাঁকা লাগতে লাগল। বহুক্ষণ সিগারেট খাইনি। সিগারেট ধরাতেই মাথাটা চন-ন করে পাক খেল একটা। হু-হু করে উঠল বুক। ফাঁকা লাগছে।
অনেকদিন বাদে তার মনে হল, আজ বাসায় ফিরে খারাপ লাগবে। রোজই লাগে। তবু আজ যেন আগে থেকেই লাগছে।
ষোলো নম্বর বাস ধরে সোমেন আজ ইচ্ছে করেই রিচি রোডে নেমে গাব্বুকে পড়াতে না গিয়ে রিখিয়াদের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। অনেককাল দেখা হয় না।
॥ চুয়াত্তর ॥
অন্যমনস্ক সোমেন আজও গেট পেরিয়ে ঢুকে যাচ্ছিল রিখিয়াদের বাড়িতে। হঠাৎ একটা মোটরের হেডলাইট পড়ল এসে সেই লেখাটার ওপর—প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ। কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড। লেখাটা নজরে পড়তেই চমকে উঠল সোমেন। এই লেখাটার কথাই চিঠিতে তাকে জানিয়েছিল মধুমিতা। দেওয়ালে এ কটা কথা লিখেছিল জিতু নামে একটা ছেলে, যে প্রথম মানুষ খুন করার শক সামলাতে পারেনি। খুন করে নিহত মানুষের হাত কেটে নিয়ে যে শ্রেণীশত্রুর রক্ত মাংস খেয়েছিল, তারপর উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আজও। সেই জিতুকে ভালবাসত মধুমিতা।
জিতুকে চেনেও না সোমেন। তবু আজ মধুমিতার চেয়েও বেশি হঠাৎ করে জিতুর কথা মনে হয়। কেমন ছিল ছেলেটা! সোমেনের মতোই কি? হয়তো এরকমই বয়স, একমাথা বোঝাই নানা অবাস্তব স্বপ্ন আর চিন্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াত। রোমান্টিক বিপ্লবী। হঠাৎ কেউ ভুল করে তাকে শ্রেণীশত্রুর রক্তপাত করতে প্ররোচিত করে। সেটা খুবই ভুল হয়েছিল। পৃথিবীতে যারা জন্মায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যাদের খুনির ইনস্টিংট থাকে, আর কারও তা থাকে না। সেই জিতুকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে হয় সোমেনের। ছেলেটা কি আজও বেঁচে আছে? থাকলেও নেই। ওরকম উন্মত্ত অস্তিত্বের কোনও মানে হয় না। সোমেন শুধু অনুভব করে, দেশময় লক্ষ লক্ষ অল্পবয়সী ছেলে কিছু একটা করতে চাইছে, এমন কিছু—যার জন্য সর্বস্ব পণ করা যায়, প্রাণ দেওয়া যায়, নেওয়া যায়। শুধু সেই মহৎ কারণটি তাদের হাতে দাও, তারা লড়ে যাবে। কিন্তু তা তো হল না। কেউই আদর্শ বলে কোনও জিনিস দিতে পারল না যুবাদের। তারা তাই আদর্শের পিপাসা মেটাতে ভিনদেশ থেকে রাজনৈতিক মত ধার করে আনল, আর তার জন্যই কত কাণ্ড করল তারা। বেকারকে চাকরি দেওয়ার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল তাদের একটা সুন্দর আইডিয়াল দেওয়া, বাস্তববাচিত চিন্তা ও ব্যাপকতার ধারণায় সমৃদ্ধ একটি কার্যকরী আদর্শ। কে বুঝবে সে কথা? সস্তা কথা শুনে শুনে সকলের কান পচে গেল।
অচেনা এক জিতুর জন্য প্রাণটা হঠাৎ হু হু করতে থাকে তার। অবশ্য সেই হুহু করা বুকে মায়ের জন্যও খানিকটা অভাব বোধ আছে, বাবার জন্যও আছে একরকম ব্যথা। আর আছে তার সারা জীবনের নানা ব্যর্থতা ও অসফলতার স্মৃতিও। কোনও ক্ষরণে মনে একটু দুঃখ এলেই হাজারে’ দুঃখের স্মৃতি ভিড় করে আসে।
মধুমিতার চিঠিটার কোনও জবাব দেয়নি সোমেন। ও কেমন আছে?
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে রিখিয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিল সোমেন। খেয়াল হল, বাডিটা বড় নিস্তব্ধ। এত চুপ কেন সব? মিটমিট করে ভূতুড়ে সব কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে বড় বাতিগুলো সব নেবানো। শৈলীমাসির কিছু হয়নি তো? একটু অসঙ্গতি দেখলেই আজকাল কেবল অজানা ভয়ে বুক চলকে রক্ত ঝরে যায়।
রিখিয়া তার ঘরে নেই, পড়ার ঘরেও নয়। একা-একা এঘর থেকে ওঘর খুঁজে দেখল সোমেন। চারধারে দামি জিনিস ছড়ানো। ক্যামেরা, ঘড়ি, কলম, ট্রানজিস্টার সেট, স্টিলের জগ। সে যদি এর কিছু তুলে নিয়ে চলে যায় তো কেউ ধরতে পারবে না। বড় অসাবধানী এরা।
সোমেন করিডোরে এসে ডাকল—রিখিয়া।
গলাটা কেঁপে গেল। সোমেন একটু চুপ থেকে আবার ডাকল।
অপ্রত্যাশিতভাবে শৈলীমাসির ঘরের দিক থেকে রিখিয়ার বাবা বেরিয়ে এলেন। খুবই উদভ্রান্ত ও অন্যমনস্ক মুখ চোখ। দরজা খুলে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন সোমেনের দিকে। খুবই গম্ভীর তাঁর মুখ।
সোমেন চমকে গিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। দুজন দুজনের দিকে খামোখা চেয়ে আছে। কেউ কথা বলতে পারছে না। কথা নেই বলে। এমনি সময়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ করে সেই অন্ধ কুকুরটা এসে সোমেনের পায়ে কুঁই কুঁই করে চেটে চেটে লেজ নেড়ে অসম্ভব আদর জানাতে থাকে। কুকুরেরা ভোলে না।
রিখিয়ার বাবা আজও নেশা করেছেন। কুকুরটাকে ধমক দিয়ে বললেন—স্টপ!
সেই স্বর শুনেই বোঝা গেল, গলাটা অন্যরকম।
সোমেনের দিকে চেয়ে বললেন—কুকুরটা তোমাকে চেনে দেখছি! তুমি কি এ বাড়িতে প্রায়ই আসো?
—মাঝে মাঝে। শৈলীমাসি আমাকে চেনেন।
উনি হাত তুলে বললেন—বুঝেছি। আর পরিচয় দিতে হবে না। তুমি বোধ হয় ওঁর সইয়ের ছেলে! না?
খুব বিস্মিত হয়ে সোমেন বলে—হ্যাঁ।
সে ভাবতেই পারে না যে, এ লোকটার অত মনে থাকে। কিন্তু তার চিন্তাকে আর একবার চমকে দিয়ে লোকটা বলে—একদিন সন্ধেবেলা তোমাকে দেখেছিলাম এখানে, সোমেন লাহিড়ি না তোমার নাম?
সোমেন এত অবাক হয় যে, বাতাস গিলে বলে—হ্যাঁ। আপনার আমাকে মনে আছে?
উনি তেমনি একটা উদাসীন ভ্যাবলা চোখে চেয়ে থেকে বললেন—আমার সবই মনে থাকে। এসো। এ ঘরে শৈলী আছে, রাখু আছে। আমরা সবাই বসে একটু গ্যাদারিং করছি। কাম অ্যান্ড জয়েন দি ক্রাউড।
সোমেন দ্বিধাভরে বলল—আমি বরং চলে যাই।
উনি বললেন—যাবে কেন? ইউ আর এ ভেরি হ্যান্ডসাম ইয়ং ম্যান। তবে একটু লিন অ্যান্ড থিন। তবু তোমাকে দেখলেই বেশ একটা ফ্রেশনেস আসে। চলে এস।
বলে উনি দরজার পাল্লাটা মেলে ধরলেন। কুকুরটা আগে গেল। পিছনে সোমেন!
প্যাসেজ দিয়ে ঢুকলে শৈলীমাসির ঘরের আগে আর একটা ঘর পড়ে। সেটা বসবার ঘর বলে মনে হয়। এখন সেখানে ধুলো পড়ছে। কেউ ব্যবহার করে না। এদের কত ঘর অব্যবহৃত পড়ে থাকে।
সেই ঘরে এসে রিখিয়ার বাবা একটু দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরনে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দামি গ্যাসলাইটার বের করে সিগারেট ধরিয়ে বললেন— তুমি কার কাছে আসো বলো তো? রাখুর কাছে, না শৈলীর কাছে?
সোমেন লজ্জা পেয়ে বলে—কারও কাছে পার্টিকুলারলি নয়। আসি।
—ও। তোমার বয়সি আমার একটা ছেলে আছে, জানো?
—জানি।
—সেটা একটা হতচ্ছাড়া ছেলে। হি রাইটস টু আস অল দি ক্রুয়েল থিংস। সে নাকি আর কখনও আসবে না। আমরা তার প্রতি কোনও অন্যায় ব্যবহার করিনি, স্বাধীনতা দিয়েছি, তার পিছনে টাকাও কম খরচ করিনি। তবু হি হ্যাজ বিকাম আনবিকামিং…
সোমেন ইংরেজি কথাটা ভাল করে বুঝল না। ইংরেজিটা এখনও তার খুব রপ্ত হয়নি। আমেরিকায় যাওয়ার আগে রামকৃষ্ণ মিশনে স্পোকেন ইংলিশের ক্লাসে ভরতি হয়ে শিখে নেবে, এরকম ইচ্ছে আছে।
উনি বললেন—আজও তার চিঠি এসেছে। শৈলী খুব কাঁদছে। তুমি এ ঘরে একটু অপেক্ষা করো, আমি শৈলীকে একটু খবর দিই, তুমি এসেছ শুনলে ও নিশ্চয়ই শান্ত হবে।
—আমি বরং—
বলে সোমেন উৎসুক হয়ে চলে যাওয়ার কথা বলতে যাচ্ছিল। উনি মাথা নেড়ে বললেন—না, যাবে কেন? উই উইল লাইক ইওর কম্পানি। এ সময়ে আমার ছেলের বয়সি কেউ সামনে থাকলে ভাল লাগবে। তুমি কী করো?
—কিছু করছি না।
—বেকার?
—হ্যাঁ।
—সবাই বেকার আজকাল। আমার অফিসে আর কারখানায় কত ছেলেছোকরা রোজ এসে কাজ খুঁজে যায়। অত কাজ কে কাকে দেবে?
সোমেন মৃদু একটু ম্লান হাসল।
—কি করবে ঠিক করোনি
সোমেন একটু ইতস্তত করে বলে—আমি বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
উনি ভ্রু কুঁচকে বলেন—কোথায়? অ্যাব্রড?
—হ্যাঁ। আমেরিকায়।
—ওঃ। বলে উনি স্তব্ধ থেকে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর গভীর একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন—আমি কয়েকবার গেছি। বেশ ভাল দেশ। যাও।
সোমেন মাথা নত করে।
উনি বললেন—এই বুড়ো বয়সে আবার হয়তো যেতে হবে।
—কোথায়?
—লন্ডন। ছেলের খোঁজ খবর করতে। কেন যে আর আমাদের পছন্দ করে না তা জেনে আসতে। আমি নিজের ইচ্ছেয় যাচ্ছি না, শৈলীর জন্য যেতে হচ্ছে। দাঁড়াও ওদের খবর দিই—
বলে উনি ও ঘরে চলে গেলেন।
মুহূর্ত পরেই রিখিয়া দৌড়ে আসে, পরদা সরিয়েই উভ্রান্ত একটা আনন্দে শ্বাসরুদ্ধ অস্ফুট স্বরে বলে—তুমি!
তুমি শুনে একটু হাসে সোমেন। এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে, এই বালিকাটিকে সে…সে বোধ হয়…হ্যাঁ…ভীষণ
ভাবতেই সোমেন—যে সোমেন মেয়েদের সঙ্গে বহুকাল ধরে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছে, কারও কারও শরীরও ছুঁয়ে রেখেছে—সেই সোমেনের কান মুখ ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে লজ্জায়। বুকে ডুগডুগি বাজে।
সোমেন বলে—কেমন আছো?
—এতদিনে মনে পড়ল? কথা বলব না তো, কিছুতেই না।
—আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম।
—কী নিয়ে শুনি!
সোমেন কী উত্তর দেবে! সে কিছু নিয়েই ব্যস্ত ছিল না, আবার ছিলও।
—প্রায় একমাস। রিখিয়া বলে।
—তুমিও তো খোঁজ নাওনি। সোমেন বলে।
রিখিয়া মুখ ভার করে বলে—আমাকে কোথাও বেরোতে দেয় বুঝি! আজকাল খুব কড়া ডিসিপ্লিনে রেখেছে মা। কোথাও ছাড়ে না। দাদা ওরকম করেছে বলেই এখন আমার ওপর সকলের নজর। বলে মৃদু আদুরে হাসি হাসে। আবার গম্ভীর হয়। বলে—অবশ্য রাস্তাঘাটও ভাল চিনি না। তা হলেও ঠিক একদিন চলে যেতাম ঢাকুরিয়ায়। রোজ ভাবি, আজ আসবে। ওমা, কেউ আসে না।
—তুমি কোনওদিন যাওনি বলেই আসিনি। সোমেন মিথ্যে করে বলে। পরমুহূর্তেই যোগ করে দেয়—তুমি না গেলেও মধুমিতা কিন্তু যেত।
একটু যেন শিউরে ওঠে রিখিয়া। বড় চোখে চেয়ে বলে—কে গিয়েছিল? মধুমিতা?
সোমেন মাথা নাড়ল। মধুমিতার কোনও খবর সে এখনও জানে না। বুকের মধ্যে মেঘের মতো ভয় জমে ওঠে স্তরে স্তরে। আস্তে করে বলল—সে কথা থাক।
রিখিয়া বোধ হয় বুঝল। সেও বলল—থাক গে। কিন্তু আপনার বাসায় যেতে আমার খুব লজ্জা ছিল। মধু তো আমার মতো নয়। ওর কোনও লজ্জা নেই। এমনকী ও স্কুলের দেয়াল টপকে ক্লাস থেকে পালাত ছেলেদের সঙ্গে মিশবে বলে। পুলিশ দেখলে ঢিল ছুঁড়ত।
—তাই নাকি!
রিখিয়া মুখ গম্ভীর করে বলে—আমি অত স্মার্ট নই। আপনি তো জানেন।
—আবার আপনি করে বলছ কেন?
রিখিয়া অবাক হয়ে বলে—আপনি করেই তো বলি!
—একটু আগেই ‘তুমি’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলে যে!
—যাঃ! ভুল হয়েছিল তবে।
—ভুল!
—ভুলই। আসুন, মা বসে আছে আপনার জন্য।
সোমেন ঘরে ঢুকে দেখে, শৈলীমাসি খুব রোগা আর শুকনো হয়ে গেছেন। তাঁর শরীরে যেটুকু জীবনীশক্তি অবশিষ্ট আছে, সেটুকু সব জমা হয়েছে চোখে। বোঝা গেল একটু আগেও কাঁদছিলেন। এইমাত্র চোখ মুছে হাসিমুখে বসেছেন। চোখ সজল।
ভারি গলায় বললেন বাবা, তুমি কেন আমেরিকায় যাবে? উনি এসে এইমাত্র বললেন, তুমিও চলে যাচ্ছো।।
সোমেন হেসে বলে—এখনও ঠিক নেই, তবে চেষ্টা করছি।
—না, না। কেন যাবে? ননী তোমাকে যেতে দিচ্ছে কেন? ও কি রাজি হয়েছে।
—না।
—ওকে শীগগীর একদিন আসতে বোলো। আমি ওকে বলে দেবো, যেন কিছুতেই তোমাকে যেতে না দেয়।
—কেন মাসি? ছেলেরা কী চিরকাল ঘরে থাকে?
শৈলীমাসি হঠাৎ চুপ করে কী যেন ভেবে বলেন—সে কথাও ঠিক। ছেলেদের আটকে রেখে আমরা তাদের ক্ষতিই তো করি। কিন্তু, তোমরা সব দূরে গিয়ে পর হয়ে যাও যে! আমার ছেলেটা বলে শৈলীমাসি বিছানা হাতড়ে একটা এয়ারোগ্রাম খুঁজে পেয়ে সোমেনের দিকে বাড়িয়ে বললেন—দেখো।
সোমেন চিঠিটা নিল না, বলল—থাক মাসি।
চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে থেকে শৈলীমাসি অনেকক্ষণ বাদে বললেন—উনি যাচ্ছেন লন্ডনে। কিন্তু তাতে কিছু হবে না। আমি নিজে যদি যেতে পারতাম! বলে সোমেনের দিকে চেয়ে বলেন—কি করে যাব বলো তো! কত দূর! আমি এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেতে পারি না। পৃথিবীটা যে আমার কাছে কি বিরাট জায়গা হয়ে গেছে তা তোমরা বুঝবে না। কেবল। মনে হয় চারদিকটা আমার কাছ থেকে কত কত ভীষণ দূরের হয়ে গেছে!
রিখিয়ার বাবা কোনের দিকে অন্ধকারে একটা ইজিচেয়ারে বসেছিলেন, পায়ের কাছে কুকুর, হাতে গেলাস। আস্তে, সেই এড়ানো গলায় বলেন—অত অ্যাটাচমেন্ট বলেই তো ছেলে তোমাকে পছন্দ করে না। ছেলেরা একটু বয়স হলে আর মা-বাপের অতিরিক্ত স্নেহকে ভাল চোখে দেখে না। তখন তারা অনেকের ভালবাসা আর মনোেযোগ চায়। কিন্তু এসব সাইকোলজি তুমি তো মানেন না।
—মানি। শৈলীমাসি বলেন—ওকে ফিরিয়ে আননা, দেখো আমি আর অত ছেলেছেলে করব না। করার আর সময়ও নেই। বেশিদিন কি বাঁচব বলে ভেবেছ নাকি তোমরা? |
—মা, চুপ! রিখিয়া ধমক দেয়।
আজও সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা হচ্ছিল সোমেনের। শৈলীমাসির অস্তিত্ব থেকে যেন মৃত্যুর জীবাণু উড়ে আসছে ঝাঁক বেঁধে। শ্বাসে শ্বাসে ঢুকে যাচ্ছে বুকের ভিতরে।
শৈলীমাসি বলেন—যাও সোমেন, রিখিয়া, ওকে নিয়ে যা। রুগির ঘরে অত বসে থাকতে নেই।
সোমেন হাঁফ ছেড়ে উঠে এল।
রিখিয়ার ঘরে এসে উজ্জ্বল আলোয় রিখিয়ার দিকে তাকাতে সংকোচ হচ্ছিল সোমেনের।।
রিখিয়া কথা বলছিল না। হুট করে এক ফাকে বেরিয়ে গিয়ে বোধ হয় চাকরকে চা খাবারের কথা বলে এল। এসে গোমড়ামুখে বসে থাকল সামনে। অ্যালবামের পাতা। ওলটাচ্ছে। উপেক্ষা নয়, অভিমানের ভঙ্গি।
সোমেন বলে—রিখিয়া, মধুমিতা তোমাকে চিঠি লেখেনি?
—লিখেছিল। কেন?
—এমনিই।
—ওর কথা ভুলতে পারছেন না?
সোমেন মাথা নেড়ে বলে—ভুলব কেন? ও একটু অদ্ভুত মেয়ে ছিল।
—ওর কোনও খবর পাননি?
—না।
—আমিও না। ও আসে না। বোধ হয়—
বলে খুব বিষন্ন চোখে চেয়ে রিখিয়া চোখ নামিয়ে নিল। বলল—জানাই ছিল।
—হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ না কেন?
—বলব কেন? আপনি আমেরিকায় কেন যাবেন?
সোমেন বিষন্ন মুখে বলে—কেন যাব না বলো তো? কেউ যেতে দিতে চাইছে না। মা, বাবা না, তোমরা নও। কেন?
—উই হ্যাড বিটার এক্সপিরিয়েন্স। কিন্তু সে কথা থাক।
রিখিয়া অ্যালবাম বন্ধ করে বলে—আমেরিকায় আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করে। বিদেশ কার না ভাল লাগে বলুন? কিন্তু এখন আমি মত পাল্টে ফেলেছি। দাদার জন্যে।
—জানি। কিন্তু আমার তো তা নয়!
—না তোক গে। আপনি যাবেন না। আমার তা হলে ভীষণ খারাপ লাগবে।
এ খুবই গোলমেলে কথা। কিন্তু সোমেন কথাটা বুঝল। তবু দুষ্টুমি করে বলে-কেন খারাপ লাগবে রিখিয়া?
—আমার চেনা জানা লোকের সংখ্যা খুব কম। আমার ভাল লাগে এমন লোক হাতে। গোনা যায়। তার মধ্যেও যদি একজন চলে যায় তো খারাপ লাগবে না!
—তোমার ভাল লাগা লোক কে কে রিখিয়া? | রিখিয়া হাসছিল। এ কথা শুনে হেসে উপুড় হয়ে পড়ল। বলল—আপনাকে দেখে। বোঝাই যাচ্ছে যে আপনি কিছুতেই আমেরিকায় যাবেন না।
—সে কী।
—আপনি যেতে চাইছেন না।
—কী করে বুঝলে?
—আমি বুঝি।
—তুমি থট রিডার?
রিখিয়া ঠ্যাং নাচিয়ে বলে—নয় কেন?
সোমেন খুব নিস্পৃহভাবে যেন ভুল বুঝতে পেরে বলে—তাই তো! নয় কেন?
রিখিয়া বলে—বাবা অনেক মহাপুরুষের বই এনে মাকে শোনান। এর মধ্যে একটা বং থেকে বাবা পড়ছিলেন। একজন মহাপুরুষ বলেছেন—আমি যে তোমার অন্তর্যামী তাক। এমনিতে নয়। তুমি যতক্ষণ আমাকে ভালবাসো ততক্ষণই আমি তোমার অন্তর্যামী। তোমার ভালবাসাই আমাকে অন্তর্যামী করেছে নইলে আমি তোমার কেউ নই।
বলে রিখিয়া হাসল। সোমেন ওর বুদ্ধি দেখে অবাক। তারপর অনেক ভেবে বলল—শোনো রিখিয়া, আমি মাত্র বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমার এক চেনা ভদ্রলোক কতগুলো ফার্মের ঠিকানা দিয়েছেন, আমি অ্যাপ্লাই করেছি অ্যামেরিকায়। সেই ভদ্রলোক ওখানেই থাকেন, তিনি ফিরে গিয়েও চেষ্টা করবেন যাতে আমি একটা চাকরি পেয়ে যাই। ওখানে অনেক প্রসপেক্ট। এখানে আমার কিছু হবে না।।
—যান না, কে বারণ করছে।
—তুমিই তো করছ।
—আমার বারণে কার কি যায় আসে?
সোমেন অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। এই সব ভাবপ্রবণতাকে কি সে প্রশ্রয় দেবে? দিয়ে কী লাভ? সেই গাব্বুকে পড়িয়ে জীবন কেটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রিগ্রেট লেটার পাবে। বয়স গড়িয়ে যাচ্ছে, সরকারি চাকরি আর পাবে না, প্রাইভেট ফার্মেও না। কি হবে থেকে! বড়জোর কয়েকজন মানুষ খুশি হবে।
—আমাকে যেতে হবে রিখিয়া।
রিখিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে—তা হলে আমি খুব কাঁদব।
অনেকটা রাত করে সোমেন বাড়ি ফিরল।
সবাই শুয়ে পড়েছে, বউদি এসে দরজা খুলে দিল। বলল—তোমার খাবার ঢাকা আছে। সোমেন।
—হুঁ।
—তোমার দাদাকে সামলাতে পারছি না। কি কান্না! এ অবস্থায় ওঁকে ফেলে মার চলে যাওয়াটা বোধ হয় ভাল হল না সোমেন।
সোমেন অন্যমনস্কভাবে বলে—দাদা অত কাদছে কেন? আমারও তো মন খারাপ, কাদছি না তো।
—তোমার সঙ্গে ওঁর তুলনা করছ কেন? ও তো নরমাল নয়। সব সময়ে একটা শিশুর মতো হাবভাব, শিশুর মতোই খুঁতখুঁতে। এখন ওঁর মা বা বাবাকে দরকার। নইলে খুব হেলপলেস ফিল করে।।
সোমেন বুঝে মাথা নাড়ল। বউদি চলে গেলে সে একা একা খেয়ে নিয়ে ঘরে এসে সিগারেট নিয়ে বসে। মার বিছানাটা ফাকা। তার খুব খারাপ লাগছেনা। এ ঘরটা আজ থেকে। তার একেবারে একার ঘর হয়ে গেল। কেউ ডিস্টার্ব করবে না।
আজ অনেকক্ষণ জেগে থাকতে ইচ্ছে হল সোমেনের। অন্য দিন এ সময়ে ঘুম পায়। মা পানের বাটা নিয়ে কথার ঝুড়ি খুলে বসে। সে সব কথা শুনতে ইচ্ছে করে না সোমেনের। আজ কেউ বলার নেই, তাই বুঝি ঘুম আসে না।
অনেকগুলো সিগারেট খেল সোমেন। আমেরিকায় যাবে কি যাবে না তা নিয়ে অনেকবার লটারি করল। ছোট্ট ছোট্ট কাগজে কয়েকবার যাব’ আর ‘যাব না’ লিখে কাগজগুলো ভাঁজ করে দু’ হাতের তেলো জড়ো করে ভাল করে মিশিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর ফেলল ছড়িয়ে। চোখ বুজে একটা তুলে নিয়ে খুলে দেখল, লেখা আছে—যাব না। দ্বিতীয়বার উঠল—যাব। বারবার তিনবার। তিনবারের বার কাগজ তুলতে যাচ্ছে এমন সময়। তাকে ভীষণ চমকে দিয়ে কে যেন কাছ থেকে ডাকল—সসামেন।
সোমেন ঘুরে বসে দেখে, দাদা।
—দাদা!
—মা চলে গেল? বলে উভ্রান্ত রণেন ঘরের চারদিকে তাকায়।
সোমেন উঠে বলে—রাত একটা বাজে দাদা, ঘুমোবে না?
—তুই কী করছিস?
—ও কিছু নয়। ঘুম আসছিল না।
—আমারও আসছে না। মা যাওয়ার সময় কেঁদেছিল?
—হ্যাঁ।
রণেন মায়ের চৌকিতে বসে বলে—আমার হার্ট খুব খারাপ। ডাক্তার বলেছে। আমি মা। বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তা হলে হার্ট আরও খারাপ হবে। আমাকে মার কাছে কাল পৌঁছে দিয়ে আসবি।
—বাঃ, তা হলে চাকরি করবে না?
—চাকরি করব কী করে? শরীর যদি ভাল না থাকে!
—বউদি আছে, দেখবে। ডাক্তার ওষুধ দেবে। চিন্তা কী?
—না। রণেন খুব জোরে মাথা নাড়ে। বলে—আমি যাবই।
—আচ্ছা, এখন গিয়ে শুয়ে থাকো।
রণেন চলে গেল। কিন্তু একটু বাদেই সোমেন শুনল, বাইরের ঘরে রেডিয়োয়াগ্রামে খুব মৃদুস্বরে বাজছে রবি ঠাকুরের নিজের গলায় গাওয়া সেই অবিস্মরণীয় গান—অন্ধজনে। দেহো আলো, মৃতজনে দেহে প্রাণ…
চোখ ভরে জল আসে সোমেনের। কি করবে সে? কিছু করার নেই।
তবু উঠে গিয়ে বাইরের ঘরে দেখে, রণেন সোফা কাম-বেডে বসে আছে চুপ করে। ভূতের মতো। তাকে দেকে ঠোটে আঙুল তুলে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করল।
সোমেন আস্তে আস্তে গিয়ে দাদার পাশে বসে থাকে।
গান শেষ হয়। রেকর্ডে পিনের একটা ঘটানির শব্দ হতে থাকে।
রণেন মুখ ফিরিয়ে বলে—ভাল না?
—কী দাদা?
—গানটা?
—খুব ভাল।
রণেন মাথা নেড়ে বলে—খুব। আমাকে একটা সিগারেট দে। আমার প্যাকেটে আর। নেই।
খুব লজ্জা পায় সোমেন। দাদা তার কাছে সিগারেট চাইছে! কত বড় দাদা তার চেয়ে!
তবু সোমেন উঠে গিয়ে নিজের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট এনে দেয় রণেনকে।। সিগারেটটা নিয়ে বসে থাকে রণেন। অনেকক্ষণ বাদে বলে কাঁদবি না?
—কেন কাদব?
—মার জন্য? আয় দুই ভাই মিলে একটু কঁদি।
সোমেন হেসে বলে—পাগলামি কোরো না দাদা। কেঁদে লাভ কি? মা গিয়ে ভালই হয়েছে। নইলে বাবার বড় কষ্ট।
রণেন কয়েকবার ফুপিয়ে উঠল। তারপর অতি কষ্টে সংযত হয়ে বলে—মাকে তুই চিনবি কী করে? তোর বয়সে কতদিন মাকে দেখেছিস! আমি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে…
বলেই রণেন থমকায়, হঠাৎ বলে—কত বয়স হল আমার বলো তো! অ্যা!
বীণা অন্ধকারেই নিঃশব্দে উঠে আসে।
কোনও ভূমিকা না করেই এসে রণেনের হাত ধরে বলে—চলো তো।
রণেন সন্ত্রস্ত চোখে তাকায়, তারপর ওঠে। রেডিয়োগ্রামের খুব মৃদু আলোতেও ওর মুখ। দেখতে পায় সোমেন। অদ্ভুত একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিদ্ধ মুখ।
সোমেন দাদার মুখটা ভুলতে পারে না। তার সারারাত ভাল ঘুম হল না। আজেবাজে স্বপ্ন। দেখে উঠে বসল বার বার। ভোরের দিকে ঘুমলো খানিকক্ষণ। বেলা করে উঠল।
সকালে উঠেই তার মনে হল, দাদা এখনও তার আমেরিকায় যাওয়ার প্ল্যান জানে না। জানলে? আবার চেঁচামেচি করবে, কাঁদবে, বলবে—তুই যাস না। গেলে আমি বাঁচব না। দাদা কীরকম স্পর্শকাতর আর স্যাঁতসেঁতে মানুষ হয়ে গেছে।।
সকালবেলাতে আবার সে ভাবতে বসল। কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। কী করবে?
তার এই বয়সে, এখন মাত্র দুটো জিনিস খুব ভাল লাগে। এক হল, রিখিয়ার কথা। আর একটা, আমেরিকার কথা।
একটা শ্বাস ফেলল সে। দুটোই পরস্পরকে শত্রুতা করছে। হঠাৎ কেন যেন খুব বাবার কথা মনে পড়ছিল। খুব ইচ্ছে করছে কাউকে সব উজাড় করে বলতে। সে শুনবে, ভাববে, সিদ্ধান্ত নিয়ে সোমেনকে বলে দেবে পথ। এরকম ঈশ্বরের মতো মানুষ একজনকেই সে চেনে। বাবা।
যাবে নাকি একবার বাবার কাছে?
যাবে। আজ না হয় কাল। মার জন্য মনটা খারাপ লাগে। মা চলে যাওয়ার পর একটা দিন চলে গেল। আরও দিন যাবে। তারপর আর খারাপ লাগবে না।