যাও পাখি – ৬৫

॥ পঁয়ষট্টি ॥

অনেকদিন এমন এক সুন্দর দিন আসেনি। বাদল-মেঘ ছিঁড়ে মাঝে মাঝে শরৎকালের মতো আকাশ দেখা যাচ্ছে। শরৎকালই তো! ভাদ্র পড়ে গেল। বরাবরই শরৎকাল সোমেনের সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। শরতের আবহাওয়া তো আছেই, তা ছাড়া বহু দিনকার লজ্জাকর ধারটা শোধ দেওয়া গেল। ফের অবশ্য ধার হয়েছে বউদির কাছে। তো সোমেনের জীবনটা বোধ হয় এইভাবেই যাবে। একজনের কাছে ধার নিয়ে অন্যজনকে শোধ করবে। তবু দিনটা আজ ভালই। যদি লক্ষ্মণদা চেষ্টা করে, যদি হয়ে যায় আমেরিকায় একটা চাকরি!

দাড়িটা কামানো দরকার। আজ সেই ভূতুড়ে সিনেমার টিকিটের দিন। মনে পড়লেই বুকটা লাফিয়ে ওঠে রহস্যের গন্ধে।

পাড়ার সেলুনে আজ বড্ড ভিড়। চেনা নাপিত ফুলেশ্বর দুঃখ করে বলল—সারা সকাল দোকান খালি গেল বাবু, তখন তো এলেন না! এখন ভরদুপুরে যত ভিড়। বাবুদের সব সময় হয়েছে।

অগত্যা বাসায় ফিরে দাদার রেজারে কামিয়ে নেবে বলে রণেনের ঘরে ঢুকেছিল সোমেন। দাদা একটা ঝকঝকে নতুন জিলেট-এর ওয়ান পিস সেট কিনেছে। পুরনো সেটটা দিয়েছিল সোমেনকে। কিন্তু সেটার প্যাঁচফ্যাঁচ কেটে গেছে। পড়েছিল, বুবাই টুকাই খেলতে নিয়ে কোথায় ফেলেছে কে জানে! নতুন সেটটায় কামিয়ে আরাম, দারুণ সব উইলকিনসন ব্লেডও আছে দাদার।

রণেন বিছানার একপাশে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। খালি গা, পরনে দারুণ একটা বাটিকের কাজ-করা ছেলেমানুষি লুঙ্গি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা এঁটে বই পড়ছে। আজকাল রণেন একদম কথা বলে না। সে যে বাড়িতে আছে তা টের পাওয়াই ভার। বরাবরই সে শান্ত ছিল, কিন্তু এখানকার নীরবতা প্রায় নিশ্ছিদ্র।

সোমেনের খেয়াল হল, গত প্রায় দিন দশেক সে দাদার সঙ্গে কোনও কথা বলেনি। আজ বলল।

—দাদা, তোমার সেভিং সেটটা নেব?

—রণেন একবার তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল।

এধার-ওধার কোথাও খুঁজে পাচ্ছিল না সোমেন। ড্রেসিং টেবিলের টানায় সাধারণত থাকে।

হাতের মোটা বইটা খুব জোর শব্দ করে বন্ধ করে দিল রণেন। বিরক্ত হয়ে বলল—কী খুঁজছিস? জমির দলিল? সে তো মার কাছে।

—জমির দলিল! একটু অবাক হয়ে সোমেন বলে—না তো। বললাম যে শেভিং সেটটা!

—ও! বলে রণেন উদাস হয়ে বলল—আমার কাছে নেই। তোর বউদিকে জিজ্ঞেস করিস।

—না হলেও চলবে। বলে একবার গালে হাত বোলায় সোমেন, বলে—না হয় বেরনোর সময়ে সেলুনে কামিয়ে নেব।

—তুই কী করিস আজকাল? রণেন যেন খানিকটা জবাবদিহি চাইবার মতো করে বলে—শুধু ঘুরে বেড়াস?

সোমেন দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুপুরে রোদে ঘোরা শরীরটা তেতে আছে। মাথাও গরম। একটু চুপ করে থেকে বলল—কিছুই করি না। কী করব বল?

খুব বিরক্তির সঙ্গে রণেন বলে—এতগুলো ইন্টারভিউ আর রিটন টেস্ট দিলি, কিছু হয় না কেন? সকলের হয়, তোর হয় না?

সকলের হয় না, কারও কারও হয়। এ সত্য রণেনও জানে। তবু তার মুখে একথা শুনে বিস্মিত সোমেন বলে—না হলে কী করব?

—কিছু তো করতেও হবে। বসে থাকা কি ভাল? নানারকম বদ দোষ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তোকে যে আই এ এস দিতে বলেছিলাম।

বদ দোষ কথাটা কানে খট করে লাগল। তবু মাথাটা স্থির রেখে সোমেন বলে—সে সব আমার দ্বারা হবে না। কম্পিটিটিভ পরীক্ষা কি সকলের দ্বারা হয়? তা ছাড়া বয়সও বোধ হয় নেই।

রণেন চশমাটা খুলে তার দিকে গম্ভীর চোখে চেয়ে বলে—তোর বয়স কত হল যেন?

—পঁচিশ-টচিশ হবে। ভাসা ভাসা উত্তর দেয় সোমেন। সঠিক উত্তর দিলে যদি আই এ এস পরীক্ষাটা আবার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় দাদা!

—পঁচিশ! বলে রণেন ভাবনায় পড়ে—তোরও পঁচিশ হয়ে গেল? অনেক বয়স হল তো তোর। সেদিনও ছোট্ট ছিলি। আমার তা হলে কত হল? মাকে একবার জিজ্ঞেস করে আয় তো।

—জিজ্ঞেস করার দরকার কী? তুমি আমার চেয়ে কত বছরের বড় সেটা হিসেব করলেই তো হয়।

—তোর কি সার্টিফিকেটে বয়স বাড়ানো আছে?

—না তো! বরঞ্চ কমানো আছে বোধ হয়।

রণেন অবাক হয়ে বলে—তাই বা হয় কী করে! সার্টিফিকেটেও তো বয়স বেশি বা কম থাকবার কথা নয়। বাবা নিজে ইস্কুলে ভরতি করে দিয়ে এসেছিলেন। বাবা তো আর বয়স ভাঁড়ানোর লোক নয়। তোর সার্টিফিকেটটা একটু দেখিস তো, ওইটেতেই ঠিক বয়স আছে। আচ্ছা দাঁড়া—

বলে রণেন উঠে খাটের তলা থেকে একটা পুরননা কব্জাভাঙা তোরঙ্গ টেনে আনল। তার ভিতরে গুচ্ছের পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে কয়েকটা পাকানো কোষ্ঠীপত্র বের করে আনল। খুলে খুলে দেখতে লাগল।

মাথা নেড়ে বলল—তোরটা নেই। আমারটাও দেখছি না। মাকে একটু জিজ্ঞেস করিস তো কোথাও রেখেছে কিনা।

—করব।

—এত বয়স হওয়ার কথা তো তোর নয়। পঁচিশ। বলিস কী? তা হলে আমি কি চল্লিশ পার হলাম নাকি? তোরঙ্গটা খাটের তলায় ঠেলে দিয়ে রণেন খাটে উঠে বসে বলল— এখানে বোস।

সোমেন বসে। কিন্তু রণেন কিছু বলে না। কেবল অন্যমনস্কভাবে কী ভাবতে ভাবতে বিষণ্ণমুখে আঙুল মটকাতে থাকে।

এ সময়ে স্নান করে বউদি ঘরে আসে। শায়া ব্লাউজের ওপর শাড়িটা ভার করে পরা হয়নি, স্তূপ করে ধরে রেখেছে। চুলে গামছা জড়ানো। সেটা খুলতে খুলতে বলল—যাও তো, বাথরুম খালি আছে এখন, তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এস। আমি ঠাকুরকে ফুলজল দিই।

রণেন সে কথায় কান না দিয়ে খুব অসহায়ভাবে বীণাকে বলে—সোমেন বলছে ওর বয়স না কি পঁচিশ!

বীণা একটু ভ্রূ ভঙ্গি করে বলে—পঁচিশ! যাঃ বলে আয়নার সামনে দাড়িয়ে মুখে কোল্ড ক্রিম মাখতে মাখতে বলে—বাইশ-তেইশ হবে বড়জোর।।

সোমেন বলল—বাঃ রে, তুমিই তো সেদিন হিসেব করে বললে আমার চব্বিশ পূর্ণ হয়ে পঁচিশ—

আয়নার ভিতর দিয়ে বীণা তাকে চোখ টিপে একটা ইশারা করল।

রণেন খুব টালুমালু চোখে এদিক-ওদিক চাইছিল। বলল—পঁচিশ হলে আমারও তো অনেক হয়ে গেল। ওর চেয়ে আমি বয়সে—

বীণা ধমক দিয়ে বলল—স্নান করতে যাবে না কি! তোমার আদুরে মেয়ে বাথরুমে ঢুকলে কিন্তু একটি ঘণ্টা। সে আজকাল খুব সাজুনী হয়েছে। যাও।

—যাচ্ছি। রণেন বলে—তুই যেন কি খুঁজছিলি সোমেন?

—তোমার রেজারটা।

—আমার রেজারটা ওকে দাও তো। বলে কী যেন বিড়বিড় করতে করতে রণেন উঠে যায়।

বউদি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার পিছন দিক থেকে শেভিং সেটটা বের করে দিয়ে বলে—ওর সামনে বয়সটয়সের কথা কখনও তুলো না। বয়স হওয়াকে ও ভীষণ ভয় পায়। কেবল মৃত্যুচিন্তা করে তো, তাই বয়সকে ভয়।

সোমেন আলটপকা কিছু না ভেবেই বলে ফেলল—দাদাকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও না। বাবা মন্ত্র-টন্ত্র দিলে ভাল হয়ে যেতে পারে।

বীণা একবার মুখটা ফেরাল। ভ্রূ কুঁচকে একটু তাকে দেখে মুখঠা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল— সোমেন, শ্বশুরমশাই তাঁর গুরুর মন্ত্র বিলিয়ে বেড়ান। অনেকে তাঁকে বিশ্বাসও করে। এসব আমি জানি। কিন্তু তুমি কি তাঁর মন্ত্রে বিশ্বাস করো? কিংবা তাঁর আদর্শে? ঠিক করে বলো তো!

সোমেন একটু লজ্জা পেয়ে বলে, ঠিক ভেবে দেখিনি। তবে থাকতেও পারে কিছু।

আয়নাতেও বীণার কোঁচকানো ভ্রূ দেখা যাচ্ছিল, বলল—তা হলে ওরকম বললে কেন? আজকাল সবাই না ভেবে না চিন্তে বড্ড আলটপকা কথা বলে। বলে হোমিওপ্যাথি করাও, কেউ বলে জ্যোতিষের কাছে যাও, কিংবা দীক্ষা দাও। আমি জানতে চাই, কোনটা ঠিক রাস্তা! কোন চিকিৎসাটা ঠিক চিকিৎসা। যে যা বলছে করছি, কিছু তো হল না। এখন ঘরের মানুষ তুমিও ওরকম সব উপদেশ দেবে নাকি?

সোমেন বড় অপ্রতিভ হয়ে বলে, দাদার অসুখটা তো আমি জানি না বউদি।

বীণা খুব ব্যথাতুর মুখে বলে—জাননা না কেন? এক ছাদের তলায় থাকো, এক রক্তের সম্পর্ক, তবু কেন জানো না? তোমরা যদি একটু জানবার চেষ্টা করতে তা হলে আমাকে এত ভেবে মরতে হত না। একা আমিই ভাবছি, ছোটাছুটি করছি, আর সবাই বাইরে থেকে কেবল ‘এটা করো সেটা করো’ বলে। আমার মাথার ঠিক থাকে না। শ্বশুরমশাইয়ের কাছে মন্ত্র নিলেই যদি ভাল হত তো উনি সেটা দিয়ে দিলেই পারতেন। আমার অনুমতির দরকার ছিল না। তোমরা যদি ওর এত পর হয়ে যাও তো কী করে হবে?

সোমেন কথা বলতে পারল না। নিঃশব্দে উঠে এল।

ঝকঝকে শেভারটা নিয়ে যখন নিজের ঘরে দাড়ি কামাতে বসেছে, তখন কী জানি কেন তার দুচোখ ভরে জল এল। উঁচু নিচু, অসমান হয়ে গেল তার প্রতিবিম্ব। আবছায়ায় কাঁপতে লাগল। ভাবল, দাড়িটা কামাবে না আজ। থাক। সিনেমায় যাবে না।

এক গালে সাবান লাগানো হয়ে গিয়েছিল। সেটা গামছায় মুছে ফেলল সোমেন। শেভারটা দাদার ঘরে রেখে এল। সিগারেট খেতে লাগল শুয়ে শুয়ে। আর ঠ্যাং নাচাল। বাস্তবিক সে না ভেবেচিন্তে বলেছে ও কথাটা সত্যিই তো দাদার অসুখের জন্য তার তেমন মাথাব্যথা নেই। সে কেমন দিব্যি আছে, খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন দাদার সব দায় বউদিরই। আর কারও নয়। মাঝে মাঝে দাদার কথা মনে করে কষ্ট হয় বটে। কিন্তু যৌবনের নানা দিকের ডাক এসে সব ভুলিয়ে দেয়। এবার এখন থেকে সে দাদার কথা একবু বেশি ভাববে।

খাওয়ার পর দুপুরে শুতে গিয়ে সোমেন মার সঙ্গে ঝগড়া করল। বলল—বউদি ঠিক বলে। আমরা কেউ দাদার জন্য কিছু করছি না। দাদার জন্য আমাদের একটুও সিমপ্যাথি নেই। একা বউদি কত দিক সামলাবে?

শুনে ননীবালা অবাক। বলেন—বলিস কী! কে ভাবছে না? দিনরাত ঠাকুরের কাছে মাথা কুটছি। এই সেদিন গোবিন্দপুর নিয়ে গেলাম। ফকিরবাবার ওধুধ খাইয়ে আনলাম। তোর বাবা কোষ্ঠী বিচার করল ভাল করে। ওর এ সময়টা ভাল নয়, বলে দিল। ভাবছি না বললেই হল!

সোমেন খুশি হল না। বলল—আমি তো শুনি কেবল বাড়ি-বাড়ি আর টাকা-টাকা করছ দিনরাত। দাদার কথা ভাবলে কখন?

ননীবালা বলেন—তা বাড়ি বা টাকাই কি ফ্যালনা নাকি! সংসারে থাকতে গেলে নিজের একটা কুঁড়েঘর হলেও লাগে। সে হল সংসারের স্থিতু: লক্ষ্মীর থান। আর টাকার জোরেই মানুষ চলে, বড় হয়।

—তত্ত্ব কথা রাখো তো মা। সংসারের সবকিছুই মানুষের জন্য। মানুষটাই যদি কষ্ট পায় তো ওসব দিয়ে কী হবে!

—ছাই ভগবান। বলে উঠে পড়ল সোমেন। প্রায় আড়াইটা বাজে। ঘরে থাকলে আরও মাথা গরম হবে। পোশাক পরতে পরতে বলল—আমার আর এসব ভাল লাগে না। সংসারের কথা শুনলেই মাথা গরম হয়ে যায়।

ননীবালা একটু নরম হয়ে বলেন—তো করবি কী? সংসারে থাকতে গেলেই একটু ভালমন্দ শুনতে হয়।

—আমার শুনতে বয়ে গেছে। আমি পালাচ্ছি শিগগিরই। আমেরিকায় গিয়ে আর খোঁজও নেব না, দেখো।

ননীবালার হতবাক ভাবটা তখনও যায়নি, সোমেন আর ভেঙে কিছু বলল না। বেরিয়ে গেল।

সিনেমায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু রাস্তায় বেরোনোর পর গরম মাথাটা টপ করে ঠান্ডা হয়ে গেল। আর তখন ভূতগ্রস্তের মতো তাকে সিনেমার টিকিটটা টানতে লাগল।

মেট্রোর তলায় যখন পৌঁছল সসামেন তখন তিনটে বাজতে মিনিট পাঁচেকও নেই। লবিতে বহু লোক দাঁড়িয়ে। একটা চেনামুখ দেখা গেল না। তবু যে টিকিট পাঠিয়েছে তার জন্য একটু দাঁড়ায় সোমেন। হয়তো এখনও আসেনি। নিউজরিলের পরে ঢুকলেও ক্ষতি নেই।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও যখন কেউ এল না তখন হল-এ ঢুকল সোমেন। অন্ধকারে টর্চ বাতি এসে পড়ল তার গায়ে। অচেনা হাত এসে টিকিট নিল। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল রো-এর কাছে। প্রথম সিটটাই তার। পরদার প্রতিফলিত আলোয় সে পাশে-বসা মেয়েটাকে দেখবার চেষ্টা করল। বাইরের আলো থেকে অন্ধকারে এসে চোখ ধাঁধিয়ে আছে। ঠিক দেখতে পেল না।

বসবার পর হঠাৎ নরম, আলতো একটা হাত এসে তার হাতের ওপর চাপ দিল। মেয়েলি হাত।

॥ ছেষট্টি ॥

নরম হাতটা তার হাত ওইভাবে স্পর্শ করেই সরে গেল। সোমেন একটু অবাক হয়ে তাকায় পাশের মহিলার দিকে। আর তখনই পাশাপাশি সিটে বসা পাঁচ-ছজনের মধ্যে একটা চাপা হাসি খেলে যায়।

ওপাশের কে একজন বলে—আহা বেচারা! কত কী ভেবে এসেছিল!

আবছায়ায় পাশে-বসা অপালাকে তখন চিনতে পারে সোমেন। ভীষণ সেজেছে তাই চিনতে পারছিল না এতক্ষণ। তার ওপাশে পূর্বা, অণিমা, একটা অচেনা মেয়ে, তারপর অনিল রায়, তার ওপাশে শ্যামল আর মিহির বোস।

—জানতাম তোরাই। সোমেন নিস্পৃহ গলায় বলে।

—আহা জানতিস! বলে অপালা একটা চিমটি দিল সোমেনের উরুতে। পূর্বার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল—ও নাকি জানত! শুনলি!

—গাঁট্টা মার না। বলে পূর্বা।

অণিমা কিছু বলল না। একবার কেবল আবছায়ায় মুখ ফিরিয়ে দেখল। অণিমার পাশেই অচেনা মেয়েটি। সেইখানেই একটু রহস্য থেকে গেল। কে মেয়েটা?

সিনেমাটা ভালই। দেখতে দেখতে সোমেন রহস্য ভুলে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে কেবল অপালার চিমটি টের পাচ্ছিল। একবার চাপা গলায় বলল—বডড জ্বালাচ্ছিস তো। যা ওপাশে গিয়ে পূর্বাকে আমার পাশে দে।

—ইল্লি। তোমাকে প্ল্যান করেই এখানে বসানো হয়েছে বাবু। আমার পাশেই থাকতে হবে।

সোমেন চাপা গলায় বলে—ভাগ্যিস চিরকাল পাশে থাকতে হবে না।

—হবে না কে বলল? হতেও তো পারে!

—মিহির বোস তা হলে আমাকে আস্ত রাখবে?

পূর্বা খুক করে হেসে ফেলল। আশপাশের লোকেরা বিরক্ত হচ্ছে। অনিল রায় ওপাশ থেকে একবার বললেন—চুপ।

—মেয়েটা কে রে? সোমেন খানিক বাদে জিজ্ঞেস করে।

—হবে কেউ। তোর দরকার কী তাতে?

—কৌতূহল।

—ইঃ। যদি একদিন পার্ক স্ট্রিটে খাওয়াস তা হলে বলব।

—খাওয়াব।

—বলে যদি না খাওয়াস?

—ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড। সোমেন বলে।

অপালা একটা শ্বাস ফেলে বলল—বটে! এত কৌতূহল? হ্যাংলাও বটে তুই! আমরা এতগুলো মেয়ে পাশে থাকতেও ওই একজনের কথা জানতেই হবে!

—তোরা মেয়ে নাকি? শাড়িপরা পুরুষ।

—মারব। বলে অপালা ফের চিমটি দেয়।

সোমেন ‘উঃ’ করে ওঠে।

ছবির পরদায় তখন এক সাহেব এক মেমসাহেবকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। হলসুদ্ধ লোক শ্বাস বন্ধ করে আছে। চুমুর পর মেমসাহেব হঠাৎ রেগে গিয়ে সাহেবের গালে একটা চড় মারল।

—ওইরকম একটা থাপ্পড় তোর গালে দিতে পারলে—অপালা বলে।

—থাপ্পড়ের আগেরটা কী হবে?

—কী বলছে রে? পূর্বা মুখ এগিয়ে জিজ্ঞেস করে।

—ওই একটু আগে যা হল তাই চাইছে। অপালা বলে।

—থাপ্পড় দে না।

—দেব, ছবিটা শেষ হোক।

ছবিটা টপ করেই শেষ হয়ে গেল। বাইরের লবিতে বেরিয়ে এসে অনিল রায় পাইপ ধরালেন। তামাকের ধোঁয়ার সঙ্গে অ্যালকোহলের গন্ধ পাওয়া গেল। বললেন—ওঃ সোমেন, তোমার কাছে একটা ক্ষমাপ্রার্থনা বাকি আছে।

—কেন স্যার?

—একদিন তুমি আমার বাড়ি গিয়েছিলে। আমি তোমার সঙ্গে রিয়্যাল খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। আই ওয়াজ ড্রাঙ্ক।

—ও কিছু না স্যার। আমি ভুলে গেছি।

—না, না। আমি সত্যিই খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। ইদানীং মাত্রাটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছিল। একা-একা বড্ড ফাঁকা লাগত তো! আমার আবার খানিকটা ভূতেরও ভয়ও আছে।

—বলেন কী? বলে সোমেন অবাক।

—সত্যি স্যার? বলে চেঁচিয়ে ওঠে পূর্বা। অপালাও চেঁচায়।

—আস্তে। অনিল রায় বলেন—সবাই শুনতে পাবে। আমার ভূতের ভয়ের ব্যাপারটার বেশি পাবলিসিটি দিয়ো না। চলো রেস্টুরেন্টে বসে বলছি।

দঙ্গলটা পার্ক স্ট্রিটের দিকেই এগোয়। আগে আগে শ্যামল আর মিহির বোস। বোধ হয় আগামী নাটকের ব্যাপার নিয়ে ওরা খুব উদ্বিগ্ন আর মগ্ন হয়ে কথা বলতে বলতে দলছুট হয়ে হাঁটছে। একটু পিছনে অনিল রায়ের দুপাশে সোমেন আর অপালা, পিছনে ম্লানমুখ অণিমা, সেই অচেনা মেয়েটি, পূর্বা। মেয়েটাকে লক্ষ্য করল সোমেন। সুন্দরী নয়, রোগা বেঁটে। তবে বয়স খুব অল্প। কুড়ি বাইশের মধ্যেই মুখখানায় খুব একটা হাসিখুশি আনন্দের ভাব। গেঁয়ো বলে মনে হয়।

অনিল রায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললেন—বাই দি ওয়ে। অপালা সোমেনকে কি আর রহস্যের মধ্যে রাখা ঠিক হচ্ছে? ও হয়তো এ দলে একটি নবাগতাকে দেখে খানিকটা বিমূঢ় না কি যেন বলে হয়ে আছে। না?

—না স্যার, ওকে বলবেন না। চেঁচিয়ে ওঠে অপালা—ওর কাছ থেকে আগে খাওয়া আদায় করি তারপর বলব।

অনিল রায় স্মিত হেসে বললেন—খুব তো খাওয়া খাওয়া করো, কিন্তু খাওয়ার সময়ে তো দেখি সব পাখির আহার। তোমাদের তো আবার ডায়েট কন্ট্রোল না কি ছাই যেন আছে, তবে অত খাওয়ার আওয়াজ কেন?

—সোমেনটা হাড় কিপটে স্যার, খরচ করে না। অপালা বলে।

—থাকলে তো করব। সোমেন মৃদু হাসি হেসে বলে—দেখছিস তো চাকরি নেই।

—চাকরি হলেই বুঝি খাওয়াবি?

—সোমেন চাপা গলায় বলে—আমারটা তো তুই-ই সারাজীবন খাবি বাবা!

—ইস, কী অসভ্য স্যার, দেখুন সোমেন আমাকে অসভ্য কথা বলছে! অপালা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে।

—বলেছ সোমেন? অনিল রায় স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করেন।

—না স্যার, যা বলেছি তা ওর বাপের জন্মে ওকে কেউ বলেনি। অসভ্য কথা! এঃ। বলে সোমেন মুখ ভেঙিয়ে বলল—কেউ বলবে না, ওই মিহির বোসও না। এই শৰ্মাই বলল। যখন কেউ জুটবে না তখন এসে আমার দোরগোড়ায় বসে কাঁদবি।

—বয়ে গেছে। কাকের ঠোঁটে কমলালেবু! শখ কত!

—আমি কাক? তুই কমলালেবু? শুনুন স্যার, কত বড় আস্পর্দা!

অনিল রায় হাত তুলে দুজনকে থামান। বলেন—তুমি কি অপালাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে সোমেন?

সোমেন মাথা চুলকে বলে—ঠিক তা নয় স্যার।

—এর আগেও যেন কয়েকবার তুমি কাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছ বলে শুনেছি। ওটাই কি তোমার ‘হবি’ নাকি?

সোমেন ম্লান মুখ করে বলল—কেউ রাজি হয় না স্যার, তাই সবাইকে বাজিয়ে দেখছি। যদি কেউ রাজি হয়ে যায়! বান্ধবীরা সব এসে একে খসে পড়ছে। এরপর আর কে থাকবে।

অনিল রায় অন্যমনস্ক হয়ে বলেন—তাও বটে। আমিও অনেককে দিয়েছিলাম প্রস্তাব। কিন্তু আমি বড় ফান্টুস টাইপের ছেলে ছিলাম বলে কেউ রাজি হত না। তোমার অবশ্য অন্য প্রবলেম, কাউকেই বোধ হয় কনভিনসড করাতে পারছ না যে তোমারও ভবিষ্যৎ আছে!

—ঠিক স্যার।

অনিল রায় উদার কণ্ঠে বললেন—অপালা, বি জেনেরাস। ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। যদি বোঝো ও সত্যিই অপদার্থ তা হলে বরং পরে একটা ডিভোর্স করে নিয়ো।

অপালা গম্ভীর মুখ করে বলে—শুভদৃষ্টির সময়ে ওকে দেখলেই যে আমার হাসি পাবে!

—হেসো। তবু রাজি হয়ে যাও।

—ভেবে দেখি স্যার। অপালা গম্ভীর মুখে বলে—না হয় একটা জীবন আত্মত্যাগ করেই কাটবে।

সোমেন চোখ তাকিয়ে বলে—এঃ, আত্মত্যাগ!

অপালা চোখ গোল করে বলল—তারচেয়েও বেশি। প্রাণত্যাগও করতে হতে পারে। তোকে বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত সুইসাইড না করতে হয়।

পূর্বা পিছন থেকে করুণ স্বরে ডাকছিল—স্যার, স্যার, আপনারা কোথায়? এঃ মা, আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।

এসপ্ল্যানেডের অফিস-ভাঙা ভিড়ের শব্দের মধ্যে ডাকটা খুব ক্ষীণ হয়ে সকলের কানে পৌঁছায়। ফুটপাথে নাচুনি পুতুল দেখে কিনতে বসে গিয়েছিল পূর্বা। পিছিয়ে পড়েছে।

সোমেন গিয়ে তাকে ধরে আনতে আনতে অনিল রায়কে বলে—এদের সব সময়ে একজন করে গাইড দরকার। তবু ছাড়া গরুর মতো ঘুরবে, কাউকে অ্যাকসেপ্ট করবে না।

পার্ক স্ট্রিটের দারুণ একটা রেস্তোরাঁয় সবাই এসে বসে হাঁপাচ্ছিল। অনেক দূর হাঁটা হয়েছে।

অচেনা মেয়েটি আর অনিল রায় পাশাপাশি।

অনিল রায় জিজ্ঞেস করেন—কেউ ড্রিঙ্কস নেবে?

সোমেন মাথা নাড়ল। নেবে না। শ্যামল আর মিহির প্রায় একসঙ্গে বলল—জিন।

সেই রহস্যময়ী মেয়েটি বলল—আবার খাচ্ছো কেন?

অনিল রায় বললেন—খাচ্ছি কোথায়? এ ঠিক মদ্য পান নয়। জাস্ট অ্যাপেটাইজার।

মেয়েটা মুখটা একটু বিকৃত করে বলে—বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। রাতে তো বাসায় খাবার খেতেই পারো না।

সোমেন হঠাৎ হেসে বলল—স্যার, আমি কিন্তু বলতে পারি উনি কে!

—কে বলো তো!

—নতুন মিসেস রায়।

—অপালা বলল—আহা! কী বুদ্ধি তোর!

—কী ভীষণ বোকা রে বাবা! বুঝতে এত সময় লাগল? পূর্বা বলে।

—ঠিক বলেছি স্যার? সোমেন একটু বোকা-হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে।

অনিল রায় একটু ভেবে বলেন—ঠিক! হ্যাঁ সেন্ট পারসেন্ট। এ হচ্ছে আমার স্ত্রী মিলু রায়। আর এই হচ্ছে সোমেন লাহিড়ি।

সোমেনের মনে হল অনিল রায় একটা অদ্ভুত বিয়ে করেছেন। বয়সে মেয়েটি প্রায় অর্ধেক, দেখতেও তেমন কিছু নয়। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো। মেয়েটি বেশি সাজেনি। নতুন বউরা যেমন সাজে মোটেই সেরকম নয়। একটা হালকা ক্রিম রঙা শাড়ি পরেছে, মুখে প্রসাধন নেই, একটা এলো খোঁপায় চুল বাঁধা, বেশি সাজলে তাকে ভাল দেখাত না। একটু অহংকারী মেয়েটি। নমস্কার করে একটু হাসল মাত্র। কথা বলল না।

অনিল রায় বললেন—তুমি কিছু নিলে না সোমেন? একটু জিনও নয়!

—বড্ড মাথা ধরে স্যার।

—একটু বেশি করে খাও, সেরে যাবে। নাহলে বরং হুইস্কি নিতে পারো।

সোমেন একটু দ্বিধা করে বলল—আচ্ছা, একটু খাই।

সোমেনের ডান ধারে ম্লানমুখী অণিমা বসেছে। আজ বিকেলে সে প্রায় কথাই বলছে না! অনেকক্ষণ ধরে তাকে লক্ষ্য করছে সোমেন। বুকটা মাঝে মাঝে শূন্য লাগছে।

হঠাৎ অণিমা সোমেনকে কনুই দিয়ে অল্প একটু ধাক্কা দিল।

সোমেন প্রথমে বুঝতে পারেনি। তাই একটু সরে বসে। তারপর নির্ভুল টেবিলের তলায় অণিমার হাত সোমেনের হাঁটু স্পর্শ করে। অণিমা প্রায় শ্বাসবায়ুর শব্দে সোমেনের দিকে না ফিরে বলে—খেয়ো না।

সোমেন ফের দ্বিধায় পড়ে। মদ খেতে বারণ করছে নাকি অণিমা? একবার মুখ ফিরিয়ে নতমুখী ও লাজুক মুখখানা দেখে নেয় সোমেন। অণিমা খুব গম্ভীর, মুখে ভ্রূকুটি।

সোমেনও আস্তে করে বলে—খাবো না।

—না।

—কেন?

—কেন আবার! আমি বলছি তাই খাবে না।

সোমেন সামান্য হাসল। বুকের মধ্যে, মনের মধ্যে আজও কেন যে একটা থেমে যাওয়া ঝড় জেগে ওঠে।

সোমেন বলে—আচ্ছা।

বেয়ারা সোমেনের সামনে হুইস্কির গেলাস রেখে গেল। সোমেন সেটা হাতে নিল, দেখল, রেখে দিল আবার। বলল—স্যার, ভূতের গল্পটা বলবেন না?

—ও! হ্যাঁ! বলে হাসলেন অনিল রায়। বললেন—কে বিশ্বাস করবে বলো যে আমার ভীষণ ভূতের ভয় আছে! খুব ছেলেবেলা থেকেই ছিল অবশ্য, কিন্তু ইদানীং সেটা খুব বেড়েছিল। কাউকে বোলো না।

—না স্যার।

—সেদিন রাতে শুয়েছি, বেশ নেশা ছিল, তবু কেন যেন ঘুম আসছিল না। যতবার ঘুমোই ততবার চটকা ভেঙে যায়। কে যেন জাগিয়ে দিচ্ছে। চাকরটার বাড়িতে অসুখ বলে একবেলার ছুটি নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেও রাতে ফেরেনি। বার বার জেগে উঠে কান পেতে শুনছি যদি চাকরটা রাতের শেষ গাড়িতেও আসে বারুইপুর থেকে। একদম একা একাটা ফ্ল্যাটে আমি, এটা ভাবতেই ভারী গা ছমছম করে। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে, বেশ ভূতুড়ে দেখাচ্ছে সবকিছু। খুব নিস্তব্ধও চারদিক। এক-একবার চোখ খুলে ঘরটার আলোছায়া দেখি। ফের চোখ বুজে ফেলি ভয়ে। পাছে কিছু দেখা দেয়! এরকম কয়েকবার হল। বালিশের কাছেই রিভলভার থাকে, সেটা হাতে নিয়ে শুয়ে রইলাম। আবার ভয়ও করছে, যদি ওটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি তো ঘুমের মধ্যে ট্রিগারে চাপ দিলে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। কিন্তু কী করি! জেগে চোখ বুজে রিভলভার হাতে শুয়ে আছি। এমন সময়ে ঠিক একটা টরেটক্কার মতো শব্দ পেলাম। না, শব্দটা বাইরে কোথাও নয়, আমার মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যেই কোথাও হচ্ছিল। সে খুব নিস্তব্ধ শব্দ। যেন আমাকে চোখ খুলতে বলছে। একবার চোখ চাইলাম। ফাঁকা ঘর। কিন্তু মনে হল, কে যেন এসেছে। সে এসে বসল আমার বিছানার একটা ধারেই। আমি রিভলভারটা তুললাম। ফের সেই টরেটক্কার ভাষা শুনলাম, অস্ত্র নামাও। নামালাম। যে এসেছে সে আমার দিকে চেয়ে আছে। তাকে দেখতে পাচ্ছি না। ঘরে শুধু ভূতুড়ে চাঁদের আবছা আলো। খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম—কে? ফের সেই টরেটক্কা বলল—তোমার একাকীত্ব। আজ রাতে সেই একাকীত্বের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে।

সবাই হেসে ওঠে।

অনিল রায় হাসলেন না। হাত তুলে বললেন—শোনাই না। খুব সিরিয়াস ব্যাপার।

॥ সাতষট্টি ॥

অনিল রায় বড় চট করে মাতাল হয়ে যান।

টপাটপ চার পাঁচ পেগ খেয়ে আজও গেলেন। গেলাস রেখে বললেন—কী যেন বলছিলাম! একটা ভূতের কথা না!

—হ্যাঁ স্যার। সোমেন বলে।

অনিল রায় সামান্য ভ্রূ কুঁচকে ভেবে নিয়ে বলেন—খুব অদ্ভুত। পরিষ্কার সেই ভূতটাকে টের পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি না। ভয়ে পাগল হয়ে যাই আর কী! ভীষণ ভূতের ভয় আমার। তো ভূতটাকে টের পেয়েই আমি ভর ভরতি রিভলভার থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকি। চেম্বার খালি হয়ে গেল, সটাক সটাক বুলেট বেরিয়ে আমার ক্যাবিনেট ফুটো করছে, দেওয়ালের ছবি ভাঙছে, শার্শি চৌচির করছে, চুনবালি খসাচ্ছে—সব টের পাচ্ছি। আর নিস্তব্ধতার মধ্যেই এক নিঃশব্দ হা-হা হাসি টের পাচ্ছি। আমার পিস্তলের গুলিতে তার কোনও রি-অ্যাকশনই হল না। কলকাতায় সব সময়ে বোমা বন্দুকের শব্দ হয় বলে লোকে গা করে না, তাই প্রতিবেশীরাও কেউ দৌড়ে আসেনি। সে যে কী ভয়ংকর অবস্থা! আমার একটা খাওয়ার টেবিল আছে, পুরনো। এক সাহেবের কাছ থেকে সেটা কিনেছিলাম। আসল মেহগিনী। সেই টেবিলটাকে আমার বরাবর কিছু ভয় ছিল। সন্দেহ হয়, সেই টেবিলটার সঙ্গে এক মেমসাহেবের আত্মার কিছু যোগাযোগ আছে। সোমেন, তুমি মুখ লুকিয়ে হাসলে নাকি?

—না স্যার।

অপালা বলে—হ্যাঁ স্যার, হাসল!

অনিল রায় গম্ভীর হয়ে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন—তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে যে আমি মাতাল হয়ে গেছি?

—একটু হয়েছ, আর খেয়ো না।

—সবাই হাসছে নাকি? আমি খুব ভাল লক্ষ্য করতে পারছি না, তুমি একটু দেখো তো!

—না তো, কেউ হাসছে না।

অনিল রায় মাথা উঁচু করে সবাইকে বললেন—হেসো না। এটা সিরিয়াস ব্যাপার।

—সেই টেবিলটা স্যার! সোমেন বলে।

—কোন টেবিলটা? বলে ভ্রূ কোঁচকালেন অনিল রায়। পরমুহূর্তেই মাথা নেড়ে বললেন—ইয়েস। সেই মেহগিনী টেবিলটা। আমি অনেকদিন টের পেয়েছি, নিশুত রাতে কে যেন আসে। মেয়েলি হাই হিল জুতার শব্দ। এসে ঘুরে ঘুরে টেবিলটার চারধারে পাক খায়। সে টেবিলটার একপাশে চেয়ার টেনে বসে। তারপর টেবিলে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কঁদে।

—মাগো! বলে অপালা মিহির বোসের হাত খামচে দেয়।

—সত্যি স্যার? পূর্বা উত্তেজিত হয়ে বলে।

অনিল রায় মাথা নাড়লেন। বললেন—সত্যি। অনেকদিন ধরেই আমি তার আনাগোনা টের পাচ্ছি। বান্টির মা যখন ছিল, তখনও। তখন ওকে কতবার ডেকে বলেছি সে কথা। কিন্তু বড় বেশি মডার্ন ছিল বলে গা করত না। আমাকে মাতাল ভাবত।

—ওসব কথা থাক না, দ্বিতীয়পক্ষ আস্তে করে বলে।

বিরক্ত হয়ে অনিল রায় বললেন—ওরা সব জানে। লজ্জার কিছু নেই। বলে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন—তো টের পেলাম সেই রাতেও আমার রিভলভারের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর একটা হাই হিলের শব্দ পাশের ঘরে আস্তে জেগে উঠল। কী পরিষ্কার টনটনে শব্দ। পরদা সরালেই যেন দেখতে পাব। ঘুরল, বসল চেয়ার টেনে। তারপর কাঁদতে লাগল। আমি পাগলের মতো সেই ঘরের দিকে রিভলভার তাক করে গুলি ছুঁড়বার চেষ্টা করি, আর কেবলই নিলা ট্রিগারের ফ্লিক ক্লিক শব্দ হয়। কীভাবে রাতটা কেটেছিল কে জানে! তবে আমি অনেকবার চিৎকার করতে চেষ্টা করছি, দৌড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, পারিনি।

—তারপর স্যার? পূর্বা শ্বাস বন্ধ করে শুনছে।

অনিল রায় আরও একটা নিট হুইস্কি খেয়ে নিলেন। মুখটা ওয়েস্টার্ন ছবির নায়কের মতো হাতের পিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে বললেন—তো সকালে এই মেয়েটি এসে হাজির। তোমাদের জুনিয়ার, এ বছরই পরীক্ষা দিচ্ছে। হাতে বইখানা, একটু ডিসকাস করতে এসেছে। আমি ওকে দেখে ধড়ে প্রাণ পেলাম। সোজা সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বললাম—তুমি যেয়ো না, থাকো। তোমার পায়ে পড়ি।

বলে অনিল রায় মিলুর দিকে তাকালেন, বললেন—ঠিক বলিনি?

মিলু মাথা নেড়ে বলল—ঠিক।

অনিল রায় আর একটু মাতাল হয়ে বললেন—ও আমার চেহারা আর অ্যাটিচুড দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, কিন্তু আমারও তো উপায় নেই। সারাদিন কেবল চাকরটাই থাকে। তো সেও আসেনি। একটু ভূতুড়ে রাত্রির পর আমার ইমিডিয়েটলি একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী দরকার—যে থাকবে, ছেড়ে যাবে না। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পারলাম, ও ঈশ্বরপ্রেরিত, ও আমার জন্যই নির্দিষ্ট, মেড ফর ইচ আদার। ও ভয় খেয়ে বলল—থাকব কী করে, আমি যুবতী মেয়ে, লোকে বলবে কী? আমি তখন বিনা দ্বিধায় বললাম—বিয়ে করো আমাকে। বিয়ে করো, বিয়ে করো। বলেই ফের মিলুর দিকে তাকিয়ে বলেন—ক’বার কথাটা বলেছিলাম যেন মিলু?

—অনেকবার, মিলু বলল।

—হ্যাঁ অনেকবার, বলতে বলতে ও রাজি হয়ে গেল। আর সেইদিনই আমরা মিলুর অভিভাবকের অনুমতি নিই, রেজিষ্ট্রি করি আর একসঙ্গে থাকতেও শুরু করি। বিশ্বাস করো সোমেন, তুমি বড্ড বেশি হাসছ।

—এ যে ভাবা যায় না স্যার।

উদারভাবে অনিল রায় বললেন—আমিও ভাবতে পারি না। দেয়ার ওয়াজ নো লাভ, নো থট, নো অ্যাট্রাকশন। ওনলি ওয়ান অর টু ঘোস্টস মেড আস হাজব্যান্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। না মিলু?

মিলু মাথা নত করে বসেছিল। সোমেন আচমকা লক্ষ্য করে যে মিলু কাঁদছে। বড় বড় ফোঁটা দু-একটা ঝরে পড়ল টেবিলে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল সোমেন, অণিমার নির্ভুল হাতটি তার হাঁটুতে চাপ দিল।

চুপ করে গেল সোমেন।

বহুকাল সে-দৃশ্যটা ভুলতে পারেনি। আর হাঁটুর ওপর অণিমার ওই মৃদু স্পর্শ, কী বলতে চেয়েছিল অণিমা! সোমেন, ওকে কাঁদতে দাও। বোকা, মেয়েমানুষের বুকে কত কান্না জমা থাকে জানো না তো।

অণিমার সেই চপলতা নেই, ইয়ারকি নেই। কেমন বিষণ্ণ গম্ভীর আর সুন্দর মহিলা হয়ে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে মিশবার মধ্যেও একটা আলগা ভাব। কেবল অপালা আর পূর্বার সঙ্গে যা একটু ফিসফাস করে।

বিকেলটা খুব অন্যরকমভাবে কেটে গেল সেদিন। পরদিন অণিমা চলে গেল।

ঠিক যেমন একটা সিনেমার টিকিট ডাকে এসে চমকে দিয়েছিল সোমেনকে, তেমনি হঠাৎ এসে চমকে দিল মধুমিতার চিঠি লিখেছে—ডার্লিং, এখানে আসার পর বেশ লাগছে। হাসপাতালে অনেক চেক-আপ করাতে হচ্ছে। আমি বাপির সঙ্গে এর মধ্যেই কন্যাকুমারিকা ঘুরে এসেছি, কী ভাল যে লাগল! একদিন ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম, খুব বেড়াতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উপায় কী বলো! আজ কদিন হাসপাতালে শুয়ে আছি। পরশু অপারেশন হবে, শুনছি। বাপি রোজ প্রায় সারাদিন আমার কাছাকাছি থাকে। বাপি খুব শক্ত মানুষ। এত শক্ত মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি। ধরো, আমাকে যে অত ভালবাসে বাপি তা কিন্তু কখনও বাইরের আদর দিয়ে বুঝতে দেয় না। ছেলেবেলায় পর্যন্ত আমি বাপির কোলে উঠবার সুযোগ পাইনি। বাপি কোলে নিত না, হামলে আদর করত না, এমনকী সারাদিনে হয়তো মাত্র এক-আধবার দেখা হলে এক-আধ পলক তাকিয়ে দেখত মাত্র। কিন্তু তাইতেই বুঝতে পারতাম, পৃথিবীতে এই মানুষটাই আমাকে সরচেয়ে ভালবাসে। কী করে বুঝতাম বলো তো! এই ভালবাসার ব্যাপারগুলো ভারী অদ্ভুত, ঠিক বোঝা যায়, বলতে হয় না। এই যে এখন বাপি আমার কাছে কাছে আছে, এখনও মুখে কোনও আদর নেই। কিন্তু দেখতে পাই, বাপি খুব অস্থির, চিন্তিত। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছে, আলোচনা করছে, ফাঁকে ফাঁকে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছে। তেমন বেশি কথা বলে না বাপি, মাঝে মাঝে কেবল সকালে উঠে গীতার শ্লোক ব্যাখ্যা করে শোনায়। হাসপাতালে বেড নেওয়ার আগে কয়েকদিন হোটেলে ছিলাম। মস্ত হোটেল। পুরো একটা অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আমরা ছিলাম। একদিন মাঝ রাতে মাথার যন্ত্রণা হতেই জেগে বাপিকে ডাকতে গিয়েই অবাক হয়ে দেখি, বাপি আমার মাথার কাছে চুপ করে বসে আমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। এই বোধ হয় প্রথম বাপির মধ্যে একটা স্পষ্ট আবেগ বা দুঃখবোধ যা তোক দেখলাম। কোনওদিন কঁদি-টাঁদি না, বুঝলে? কান্না-টান্না আমার আসেই না, কী করে কাঁদে লোক তাও জানি না। সেই রাতে হঠাৎ বাপির সেই চেয়ে থাকা দেখে আমার গলা-ব্যথা, চোখ জ্বালা করে কী একটা অদ্ভুত ব্যাপার হতে লাগল, বুকটা ধড়ফড় করছে। তারপর হঠাৎ ঠোঁটটোঁট কেঁপে, ফুঁপিয়ে একাকার কাণ্ড। কোনওদিন কাঁদি না তো, তাই সেই আচমকা কান্নাটা আমাকে একেবারে ভাসিয়ে নিল। ডার্লিং, বিশ্বাস করো, নিজের জন্য একটুও দুঃখ নয়, কেবল মনে হচ্ছিল—আমি মরে গেলে বাপি বড় দুঃখ পাবে। শুধু বাপির সেই শোকের কথা ভেবে ভয়ংকর ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু সে মাত্র ওই একবার। এখন আবার হেইল অ্যান্ড হার্টি আছি। বাপি যতক্ষণ কাছে থাকে, সারাক্ষণ নানা মজার গল্প বলে আমাকে খুশি রাখছে। আমি খুশিও হই। হবো না কেন বলো? পৃথিবীটা কি কারও জন্য থেমে থাকে? কারও মৃত্য শোক পালন করতে সে কি এক সেকেন্ডও তার আহ্নিক গতি বন্ধ করে? পৃথিবীতে কেউ অপরিত্যাজ্য নয়। এমন কেউ নেই যাকে ছাড়া পৃথিবী চলে না। আমরা নিজেদের যত ইম্পর্ট্যান্ট ভাবি মোটেই তা নই আমরা। তোমাকে একটা ছেলের কথা বলি। ভীষণ ভাল ছেলে, একস্ট্রিমিস্ট। অপরাজিতাদের বাইরের দেওয়ালে যে লেখাটা আছে, দেখেছ? প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ। কমরে, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড। ওই কথাটা সে লিখেছিল। সেই ছেলেটাকে আমার ভীষণ ভাল লাগত। একদিন থাকতে না পেরে আমি তাকে বলে বসলাম—জিতু, আমি তোমাকে চাই, বিয়ে করব। সে ভারী অবাক হয়ে বলল—বিয়ে করবে? কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত আমি তো বাঁচব না। আমি বললাম—কেন বাঁচবে না? সে কেবল হাসে আর বলে—আমার তো বাঁচার কথা নয়। আমি যত তাকে বলি—তোমাকে বাঁচতেই হবে। সেও তত বলে বাঁচতে তো খুব ইচ্ছে হয়, কিন্তু মরবার দরকার হলে মরব নাই বা কেন?

ডার্লিং, সে কিন্তু মরেনি। জীবনে প্রথম যে খুনটা ও করে সেইটের শক্ ও সামলাতে পারেনি। যারা ওকে খুন করতে উত্তেজিত করে তোলে তারা জানত না যে, ওর প্রকৃতি খুব দুর্বল, নার্ভ ভীষণ সেনসিটিভ। শুনেছি তিলজলার কাছে ও একটা ছেলেকে খুন করে তখন এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, চিৎকার করে নাচ গান করতে থাকে। তারপরও ও ছেলেটার হাত দুটো কেটে নিয়ে সেই কাটা হাত থেকে রক্ত মাংস চিবিয়ে খেতে খেতে চিৎকার করে বলতে থাকে—এই দ্যাখ, আমি শ্রেণী-শত্রুর রক্ত খাচ্ছি, মাংস খাচ্ছি।

সেই থেকে ও উন্মাদ পাগল। এখনও ওকে সি আই টি রোডের কাছে দেখা যায়। আধ ন্যাংটো, গায়ে ভীষণ ময়লা পড়েছে, মস্ত চুল-দাড়ি, সারাদিন বিড়বিড় করে ঘুরে বেড়ায়। এর ওপর কেউ প্রতিশোধ নেয়নি। হয় পাগল বলে ছেড়ে দিয়েছে নয়তো প্রতিশোধ নেবে যারা তারাও কেউ নেই।

ডার্লিং, জিতুর কথা কেন বললাম বলো তো! ওই যে ও একটা কথা বলেছিল—মরবার দরকার হলে মরব নাই বা কেন? তার মানে মরে যাওয়াটাই ও ধরে নিয়েছিল, একমাত্র সত্য বলে। কেউ ওর মাথায় সেই বিশ্বাসটাই সেট করে দেয়। আমার মাথাতেও সেই রকম একটা বিশ্বাস সেট হয়ে গেছে। তাই আর তেমন দুঃখ হয় না। কেবল একটা কথা ভেবে মন খুব খারাপ লাগে ডার্লিং। আমাকে তোমরা ভুলে যাবে না তো! প্লিজ, ভুলো না। যদি ভোলো তবে ধূপকাঠি নিবে যাওয়ার পর যে একটু গন্ধের রেশ থাকে, আমার সেটুকুও থাকবে না।

বাপি আমাকে সুন্দর সুন্দর লেখার প্যাড, আর হ্যান্ডমেড কাগজের খাম এনে দিয়েছে চিঠি লেখার জন্য। সবাইকে চিঠি লিখছি—ভুলো না, ভুলো না, মধুমিতাকে ভুলো না।

পরশু আমার অপারেশন হবে বোধ হয়। তারপরে কী হবে ডার্লিং। ব্রেন অপারেশন বড্ড শক্ত। কয়েকজন অচেনা, অনাত্মীয় ডাক্তারের হাতে আমার জীবন। ডাক্তারদের মধ্যে একজনের মুখে অনেকটা বাপির মুখের আদল দেখদে পাই। খুব ইচ্ছে হয়, ওই লোকটাই আমার অপারেশন করুক। ভুলো না।

তোমারই মধুমিতা।

বিকেলের আলোয় চিঠিটা পড়ছিল সোমেন। দীর্ঘ সন্ধ্যাটা তারপর যেন কাটতে চায় না। জীবন ভরে এক আলো-আঁধারি নেমে এল বুঝি।

চিঠি পাওয়ার কয়েকদিন পর একদিন উত্তরটা লিখতে বসল সোমেন। পুরো একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজের ওপর দিকে লিখল—প্রিয় মধুমিতা,

তারপরই খেয়াল হল, কাকে লিখছে। এতদিনে মধুমিতার অপারেশন হয়ে গেছে। কি হয়েছে? যাই হোক, মধুমিতা এ চিঠি পড়তে পারবে না নিশ্চই। তাই আর লিখল না সোমেন। একটা সাদা কাগজের ওপর দিকে কেবল ছোট্ট করে লেখা রইল—প্রিয় মধুমিতা, ব্যস আর কিছু নেই। বাকি সাদা কাগজটা ধু-ধু মরুভূমি।

যত্ন করে কাগজটা ভাঁজ করে সঞ্চয়িতার মধ্যে রেখে দিল সোমেন। দিনের আলোতেও এক অদ্ভুত আঁধার পৃথিবীতে নেমে এসেছে, সোমেন টের পায়। ফুসফুস ভরে বাতাস টেনেও যেন শ্বাসের তৃপ্তি হয় না। হাঁফধরা হয়ে থাকে বুক। সোমেন তাই ছটফট করে।

না, এ দেশে আর থাকবে না সোমেন। এই যে এত প্রিয়জন চারদিকে, এদের মধ্যে বেশিদিন থাকা ভাল নয়। কে কবে বুক ঝাঝরা করে দিয়ে চলে যাবে! বাবা মা বুড়ো হয়েছে, দাদার শরীর ভাল নয়। তা ছাড়া কার কখন নিয়তি কে জানে! মৃত্যু তার টিকিটঘর খুলে বসে আছে, ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে মানুষের মুখ। যখন যার মুখ পছন্দ হয় তখনই তাকে ধরিয়ে দেয় টিকিট। তাই প্রিয়জনদের কাছে বেশিদিন থাকা ভাল নয়।

॥ আটষট্টি ॥

এদিককার জমিতে ভাল আখ হয় না। যৌবনকালে ব্রজগোপালের খুব প্রিয় ছিল আখ। বলতেন—মিষ্টি লাঠি। কেষ্টঠাকুরের মত ধুতিটা কোমরে বেঁধে, খালি গায়ে এক গা থেকে অন্য গাঁ চলে যেতে যেতে যৌবন বয়সে কতবার ক্ষেত থেকে আখ ভেঙে নিয়েছেন। চিবতে চিবতে লম্বা পথ ফুরিয়ে গেছে। এখন দাঁত নেই বলে চিবনোর প্রশ্নই ওঠে না। তবু রান্নাঘরের মুখোমুখি একটু জমিতে কয়েকটা আখ গাছ লাগিয়েছিলেন। ভাতের ফ্যান, তরকারির খোসা এই সব দিয়ে বেশ ফনফনে হয়ে উঠেছে গাছগুলি। গোড়াগুলো বাঁশের মতো মোটা। ষষ্ঠীচরণ বুক দিয়ে দাদুর আখ গাছ পাহারা দেয়, সেও আবার নিজের বিবেচনা মতো পচা গোবর, খোল যা পারে এনে আখের গোড়ায় দেয়। জমি নিয়ে নানারকম পরীক্ষা করেছেন ব্রজগোপাল। আপেল ন্যাসপাতি লাগিয়ে দেখেছেন, ডালিম লাগিয়েছেন, কমলালেবুও। ষষ্ঠীচরণ সে সবও আগলে আগলে বেড়ায়। তার ধারণা, দাদুর সব গাছেই ফল ফলবে। সে খাবে। পেয়ারা গাছটায় এবার কেঁপে ফল ধরেছে, দিন রাত পাখি-পক্ষীর অত্যাচার, দু-চারটে হনুমান আছে, তারাও এসে হামলা করে। ষষ্ঠীচরণ লগি হাতে দিন রাত পাহারা দেয়। বহেরুর অন্য সব নাতিপুতির সঙ্গে সেই কারণেই তার ঝগড়া হয় রোজ। দৌড়ে এসে দাদুকে নালিশ করে—ও দাদু, অমুক আমাকে এই বলল, কী সেই বলল।

ব্রজগোপালের আর তেমন মায়া হয় না ফলপাকুড়ের প্রতি। তিনি বলেন—তা পেয়ারাগুলো যতদিন কষ্টা ছিল ততদিন পাহারা দিয়েছিস, এবার সব পেকে উঠেছে, এখন সবাইকে দিবি৷ দেখিস যেন গাছ না ভাঙে৷

ষষ্ঠীচরণের সে কথা পছন্দ নয়। সে বলে—ও তো তোমার গাছ, ওরা খাবে কেন?

ব্রজগোপাল বলেন—তুই বড় কৃপণ মানুষ হবি তো! যা ব্যাটা, গিয়ে পেয়ারা পেড়ে ওদের সব হাতে হাতে দে। নিজে গাছে উঠবি না। বরং কালিপদকে বল, পেড়ে দেবে। কয়েকটা পাকা পেলে আমাকে এনে দিয়ে যাস, কলকাতায় যাব আজ, ওদের জন্য নিয়ে যাব।

এই বলে ব্রজগোপাল দা হাতে বেরিয়ে গোটা দুই মস্ত আখ কেটে আনেন। আগার পাতাটাতাগুলো ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে নেন। রসে টসটস করছে মিষ্টি লাঠি। তা শহুরে ছেলেরামেয়েরা এ সব তেমন পছন্দ করে না বেশি। অথচ ব্রজগোপালের যৌবন বয়সে এ সবই ছিল প্রিয়। ক্ষেত থেকে কাঁচা ছোলা গাছ থেকে এক ঝড় তুলে খোসা খুলে মুখে ফেলতে ফেলতে মাইল মাইল পার হয়ে গেছেন। এমনকী দণ্ডকলস গাছের ফুলের মধুটুকুও চুষে খেতে কত ভালবাসতেন। দেশ মাটির সঙ্গে ওইরকমভাবে বাঁধা পড়ে যেতেন গভীর মায়ায়। কলকাতায় বড় হওয়া তার ছেলেপুলেরা জীবনের এ সব মজা কখনও উপভোগ করেনি, কিছুটা করেছিল কেবল রণেন। গাছের ফুটি কিংবা মাদারফল, পানিফল কতবার দিয়ে এসেছেন কলকাতার বাসায়। কেউ খায়নি, পচে ফেলা গেছে। এই সরস আখের স্বাদও ওরা বুঝবে কি?

না বুঝুক, তবু নিজের হাতে করা এই সব ফলপাকুড় প্রিয়জনদের কাছে পৌঁছে না দিয়েও পারেন না তিনি। দেওয়া নিয়ে কথা। ওরা যদি ফেলে দেয় তো দেবে।

ষষ্ঠীচরণ আর তার বাপ বিশাল ধামা ভরতি রাজ্যের পেয়ারা নিয়ে আসতেই ব্রজগোপাল রেগে উঠে বলেন—গাছশুদ্ধ পেড়ে নিয়ে এলি নাকি বোকারা?

—তাই তো বলেছেন শুনলাম। কালিপদ মাথা চুলকে বলে।

—দূর ব্যাটা! পাখিপক্ষীর জন্যও তো কিছু রাখতে হয় গাছে, না কি! তোরা বড় স্বার্থপর হয়েছিস, সব কেবল নিজে দখলাতে চাস। এরকম কৃপণ হলে তোদের সব বাড়িঘরে আর পাখিটাখিও আসতে চাইবে না, ভূতের বাড়ি হবে সব। যা, সবাইকে বিলি করে দে। আমি এত নিয়ে কী করব, গুটি দশেক বেছেছে রেখে যা। যাদের জন্য নিয়ে যাই তারা এ সব আদর করে খাবে কিনা কে জানে!

ব্রজগোপাল পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে তৈরি হচ্ছিলেন। সেদ্ধ ভাত খেয়ে নিয়েছেন এক চিমটি। হাতেকাচা পরিষ্কার ধুতি পরেছেন, ফতুয়ার ওপর পাঞ্জাবিটা চাপাবেন কেবল, এই সময়ে বহেরু এসে রাগারাগি শুরু করল—কর্তা, এই শরীর নিয়ে বেরোচ্ছেন, ভালমন্দ কিছু হলে তখন সবাই বলবে, বহেরু কর্তাকে দেখেনি। এই তো সেদিনও বুকের ব্যথাটা উঠল আপনার।

সত্য বটে, কদিন আগেও ব্যথাটা উঠেছিল। সেদিনও শীলার ছেলের নামটা দিয়ে আসবেন বলে একটা পরিষ্কার কাগজের উপরে ঠাকুরের নাম লিখে, নাতির নামটা গোটা গোটা অক্ষরে মাঝখানে লিখেছিলেন। কোষ্ঠীর ছকটাও করেছিলেন সেই সঙ্গে। কোষ্ঠীপত্র তৈরি করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ছকটা বিচার করেও একটু ভাবনায় পড়েছিলেন। নাতিটার ভবিষ্যৎ খারাপ নয়, কিন্তু ছবছর বয়স থেকে কেতুর দশা পড়বে, তখন ভোগাবে। এ সব বিষয়ে আগে থেকেই শীলাকে সতর্ক করে আসাও দরকার।

সেদিড়ও এরকম তৈরি হয়ে বেরোবার মুখে হঠাৎ যেন একখানা ভারী দৈত্যের হাত এসে বুকটাকে চেপে ধরল। সে কি শ্বাসকষ্ট, ব্যথা। সেই হাতটাই তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল বিছানায়। দিন চারেক উঠতে দেয়নি। যাদের কাছে কলকাতায় যাচ্ছেন, তারা জানেও না। জানার চেষ্টাও নেই।

ব্রজগোপাল একটু গম্ভীর হয়ে বলেন—শুয়ে মরার চেয়ে হেঁটে মরা ভাল। যা তো এখন, দিক করিস না। আমার কোনওখানে যাওয়ার নাম হলেই তোর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

বহেরু খুব কূট চক্ষে চেয়ে আছে। মনে মনে নানারকম প্যাচ কষছে, যাতে ব্রজঠাকুরকে আটকানো যায়, এটা ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারেন ব্রজগোপাল। তবে চাষাড়ে মাথায় বেশি বুদ্ধি খেলে না। তাই কিছুক্ষণ ভেবে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে—তবে যান, আমাদের ওপর তো আপনার মায়া নাই। মানুষ না কি আমরা!

ব্রজগোপাল মৃদু হাসেন। বহেরু অভিমান করে চলে যায়। অত বড় মানুষটার অভিমানী মুখ দেখলে মজা লাগে।

গাড়ির এখনও ঢের দেরি আছে। কদিন হল বহেরু একটা ঝকঝকে রিকশা কিনেছে। খুব বাহারি রিকশা। তার হুড-এ নানারকম রঙিন কাপড়ের ফ্রিল লাগান। বেলদার সাইনবোর্ড লিখিয়ে অম্বিকাচরণ নানা রঙের আঁকিবুকি নকশা করে দিয়েছে গায়ে। রিকশার পিছনে একটা আকাশের গায়ে বক উড়ে যাওয়ার ছবি এঁকে তলায় লিখে দিয়েছে—পথবান্ধব, বহেরু গ্রাম। সেই রিকশাটা এনে দরকারমতো ব্যবহার করে এখানকার লোকেরা, কে চালায় তার ঠিক নেই। কখনও কোকা বা কপিল, কখনও কোনও মুনিশ কিংবা কালিপদ। আজকাল ওই রিকশাতেই স্টেশনে বেশ যাওয়া চলে। অবশ্য ব্রজগোপাল হাঁটতেই ভালবাসেন। কিন্তু বহেরু হাঁটতে দেয় না। ডাক্তারের বারণ।

কিছুক্ষণ বাদে রিকশাটা এসে দরজার সামনে ঘণ্টি মারে। মুনিশটা সিট থেকে নেমে এসে জানান দিয়ে যায় যে, রিকশা তৈরি আছে। ব্যাগ আর একটা পোটলা নিয়ে গিয়ে রিকশায় তুলে রাখে।

ঠাকুরের ছবির কাছে একটি সর্বাঙ্গীণ প্রণাম করলেন ব্রজগোপাল। প্রণাম রোজই করেন, কিন্তু প্রণাম কি আর রোজ হয়? মাথা নিচু হয় বটে, কিন্তু মনটা তার সর্বস্ব নিয়ে ওই পায়ে ঢেউয়ের মতো ভেঙে পড়ে না তো! দেহ প্রণাম করে তো মনটা আলগা আনমনা হয়ে সরে বসে থাকে। সংসারী মানুষের এ বড় বাধা। যদিও সংসার বলতে কিছুই নেই তাঁর। তবু মনের মধ্যে কেবলই এক সংসারের ছায়া ঢুকে বাস করে। কত কী চিন্তা আসে, কত উদ্বেগ, কত দখলসত্ত্ব, কত অভিমান ও ক্ষোভ আজও মনের মধ্যে ইঁদুরের গর্তের মতো রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছে। সবাইকে পরিপূর্ণ ক্ষমা করে নেওয়া হল না আজও। এখনও কত পাওনাগণ্ডা যেন আদায় হয়নি, কত প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি, কত ঋণ শোধ করেনি লোকে। এই সবই বাধা হয়ে দাঁড়ায়, পিছুটান প্রণামকে প্রণাম হতে দেয় না। আজ বহুকাল বাদে একটা সুন্দর প্রণাম হল। যখন মাথা নিচু করলেন তখন যেন তার সঙ্গে পূর্ণ জগৎটাও ঝুঁকে পড়ল ঠাকুরের পায়ের উপর। ঢেউ উঠে ভিজিয়ে দিল তাঁর পা।

যখন উঠলেন তখন দুই চোখে জল, মুখটা তৃপ্ত, মনটা বড় শান্ত ও উদাস। তুমি আজ প্রণাম নিয়েছ, সে তোমারই দয়া। ঠাকুর, আর কিছু না, রোজ যেন একবার আমার প্রণাম প্রণামের মতো হয়।

কপালের আড়াল থেকে ছোট্ট একটা মাথা সাবধানে উঁকি দিচ্ছে।

উদার আনন্দে ব্রজগোপাল ডাকলেন—কে রে, ষষ্ঠী? আয়।

—না। আমি মতিরাম।

এই বলে বামন মতিরাম ঘরে ঢোকে। মুখটা বিষন্ন। ওকে ঠিক এরকম গম্ভীর মুখে মানায় না সব সময়ে ফষ্টিনষ্টি ইয়ারকি করে, তাই ওটাই ওর স্বাভাবিক ব্যাপার।

—কী গো মতিরাম? বলো।

—আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন ব্রজকর্তা? আমি পালাব।

—সে কী?

—বড় মারে এরা। কালও কপিল লাথি মেরেছে। তাদের কেবল ওই কথা, চলে যা, বসে খেতে পারবি না। আমি খাই কতটুকু ব্ৰজকর্তা? পেটটা দেখুন না, কতটুকু।

—তাই পালাবি? বহেরুকে বলগে যা না।

—ও বাবা, সে বড় কড়া মনিব। তার ওপর ছেলেদের ভয় খায়। আপনি রিকশায় যান, আমি বেলদার বাজার পর্যন্ত ছুটে চলে যাব, সেখানে আমাকে রিকশায় তুলে নেবেন। কলকাতার রাস্তায় ছেড়ে দেবেন। ঠিক পেট চালিয়ে নেব। কলকাতার লোকে মজা দেখতে ভালবাসে।

—বহেরু শুনলে রাগ করবে।

—করুক রাগ। তখন তো আমাকে খুঁজে পাবে না

ব্রজগোপালের মনটা খারাপ হয়ে যায়। ডাকাত বহেররুও একটা গৃহস্থ মন ছিল। সে কাউকে ফেলত না। তার সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন যারা তার জায়গায় দখল নিচ্ছে তারা লম্বায় চওড়ায় কম নয়, কিন্তু মনুষ্যত্বে ওই মতিরামের মতোই বামন।

ব্রজগোপাল বললেন—যাবি তো চল।

—একগাল হেসে মতিরাম চলে যায়।

ব্রজগোপাল ঘড়ি দেখে রিকশায় উঠতে গিয়ে দেখেন বহেরু সাজগোজ করে এসেছে। গায়ে পিরান, পরনে পরিষ্কার ধুতি, পায়ে একটা দেশি মুচির তৈরি চটিও। ব্রজগোপাল উঠতেই সেও উঠে রিকশার পা রাখার জায়গায় ব্রজগোপালের পা ঘেঁষে বসে পড়ে বলল— চলুন আমিও যাচ্ছি। একা আপনাকে ছাড়ব না।

॥ উনসত্তর ॥

একটা দানোর মতো বিশাল বহেরু উবু হয়ে পায়ের কাছে বসে আছে। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় রিকশাটা জোর ঝাকুনি দিচ্ছে মাঝে মাঝে, বহেরু গাড়োয়ান যেমন তার গরুর গাড়ির গরুকে ধমকায়, ঠিক তেমনই ধমক মারে রিকশাঅলাকে’—র’, র’, হেই!

মুনিশটা রিকশা চালাচ্ছে, সে তেমন পাকা লোক নয়। রাস্তাটা খারাপ৷ বর্ষার পর রাস্তার খানাখন্দ সব বেরিয়ে পড়েছে। কবে যে কে এ রাস্তা মেরামত করবে তার ঠিক নেই।

বহেরু মুখটা তুলে ব্রজগোপালের দিকে চেয়ে বলে—বহুকাল কলকাতায় যাই না।

ব্রজগোপাল ভ্রুকুটি করে বলেন—যাওয়ার দরকারটা কী ছিল?

—সেখানকার মচ্ছবটা দেখে আসি একটু। কালিমায়ের মন্দিরেও যাব। মাথাটা ঠুকে দিয়ে আসি। বহুকাল যাই না।

ব্রজগোপালের অবশ্য অন্য চিন্তা। মতিরাম বলেছিল বেলদার বাজারের কাছে এসে রিকশায় উঠবে। একটু কষ্ট হল ব্রজগোপালের। বহেরুকে দেখলে ভড়কে যাবে মতিরাম। বেঁটে মানুষ বলে তাকে কেউ পাত্তা দেয় না, ছেলেছোকরারা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে গাঁট্টা মারে, খামোখা চড় চাপড় দেয়। ওসবই মজা। কিন্তু মতিরামের জীবনটা এইসব মজায় তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। এখন আবার দোটানায় পড়ে বেচারার প্রায় যায়। বহেরু তাকে রাখে। তো ছেলেরা তাড়াতে চায়। তা আজ বোধ হয় মতিরামের পালানো হল না।

ওই সামনে বেলদার বাজারের বড় বটগাছটা দেখা যাচ্ছে।

ব্রজগোপাল বলেন—গাড়ির দেরি আছে নাকি রে?

বহেরু বলে—অনেক দেরি।

বটগাছের কাছে মুনিশটা রিকশা থামিয়া গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খায়। রিকশা চালিয়ে অভ্যাস নেই। হেদিয়ে গেছে। বলে—একটু চা মেরে আসি। গাড়ির দেরি আছে। বসেন!

বহেরু নেমে পড়েছে। ময়লা ধুতির ওপর ফরসা পিরানে তার চেহারায় পেঁয়ো ভ.বটা ফুটে উঠেছে। বলল—এই ঝ্যাঁকোর-ম্যাকোর করে রিকশায় আসতে মাজাটা ধরে গেল। হাঁটাচলা না করলে জুৎ পাচ্ছি না।

গাঁ-গঞ্জের লোকের স্বভাবই এই, কোথাও যাওয়ার তাড়া থাকে না, রাস্তায়-ঘাটে দশবার জিরোয়, দশবার চেনা লোকের খবর করে।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—মুনিশটাকে তাড়া দে। নইলে ঠিক গাড়ি ফেল করাবে। তারপর ঘণ্টাভর বসে থাকো পরের গাড়ির জন্য।

বহেরু হুমহাম করতে করতে মুনিশকে তাড়া দিতে গেল। ব্রজগোপাল জানেন বহেরু এখন বাজারের বিস্তর লোকের খবর করবে, বিষয়কর্মের ধান্ধা মেটাবে, তারপর আসবে।

ব্রজগোপালও রিকশা থেকে নেমে পড়েন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী বুড়ো রাম কবিরাজ বলেছিল গোলমরিচ দিয়ে একটা পেটের অসুখের ওষুধ তৈরি করে দেবে। বাজারের পশ্চিম ধারে তার একটা টিমটিমে দোকানঘর আছে।

একটা গোরুর গাড়ি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সামনেই। গরু দুটো গাছের সঙ্গে বাঁধা। গাড়িটা পেরিয়ে যাচ্ছিলেন ব্রজগোপাল। হঠাৎ শুনলেন মতিরামের গলা—ব্রজকর্তা!

ব্রজগোপাল একটু চমকে চারদিকে তাকালেন। দেখতে পেলেন না। বেঁটে মানুষ, কোথায় কোন আড়ালে পড়ে গেছে?

বললেন—সামনে এসো, অত ভয়ের কী?

গরুর গাড়ির চাকার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল মতিরাম, ডাক শুনে বেরিয়ে এল। তার মুখ ঘামে জবজবে। একটু কেমনধারা কষ্টের হাসি হাসছে।

বলল—রিকশায় বহেরুকে দেখে ঘাবড়ে লুকিয়ে পড়লাম।

ব্রজগোপাল বললেন—বরং ফিরে যাও মতিরাম। মাথা ঠান্ডা করে ভাবো গে যাও। পরে না হয় বলেকয়ে যেও। পালিয়ে গেলে লোকে নানা সন্দেহ করে। তার ওপর ধরো যদি কোনও জিনিসপত্র বা টাকা পয়সা এধার-ওধার হয় তো তোমাকে চোর বলে সন্দেহ করবে। তারচেয়ে আমিই বরং বহেরুকে বলবখন, সে তোমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবে।

মতিরাম কোমরে হাত রেখে দাড়িয়ে থাকে অসহায়ভাবে। তারপর উবু হয়ে বসে পায়ের একটা ফাটা আঙুলের ক্ষতটা নিবিষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করে বলে—দৌড়ে এসেছি। কোথায় যে হোঁচট খেয়ে চোটটা লাগল, বুঝতে পারলাম না। এখন ব্যথা করছে বড়।

এই বলে রাস্তার ধুলো তুলে ক্ষতে চাপা দিচ্ছিল।

ব্রজগোপাল ধমক দিয়ে বললেন—ওটা কী করছ। বিষিয়ে যাবে যে!

—ধ্যৎ! ব্রজকর্তা কিছু জানেন না। ধুলোর মতো ওষুধ নেই। যখনই কাটবে একটু ধুলো চাপান দিয়ে দেখবেন, একদম ফরসা।

ব্রজগোপাল আর কিছু বলেন না। যার যেমন বিশ্রাম।

মতিরাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে দেখল। বলল—একটা রিকশা হলে চলে যেতে পারতাম। এ পা নিয়ে কি হঁটা যায়!

রিকশা তো আছেই, ফিরতি পথে তোমাকে নিয়ে যাবেন, আমি বলে দেব।

মতিরাম হাসে—ব্রজকর্তার যেমন কথা। নিয়ে যাবে কি! বললে এমনিতে না করবে না। কিন্তু মুনিশ ব্যাটাদের আমাকে দেখলেই নানারকম মজা চিড়বিড়িয়ে ওঠে। ঠিক মাঝপথে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। নয়তো এই বেলদার বাজারেই লোক জড়ো করে আমাকে বাঁদর নাচ নাচাবে। তার ওপর বহেরু যদি টের পায় যে পালিয়ে এসেছি তো বড্ড রেগে যাবে। রিকশায় কাজ নেই ব্রজকর্তা, হেঁটেই মেরে দেব।

এই বলে মতিরাম কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ল সট করে। ব্রজগোপাল দেখলেন বহেরু আটাচাক্কির দোকান থেকে বেরিয়ে আসছে। মুনিশটাও রিকশার ভেঁপু বাজাচ্ছে প্যাঁ প্যাঁ করে।বহেরু বলল—কর্তা, সময় গড়িয়ে গেছে, গাড়ি এল বলে।

ভিড়ের গাড়ি। অফিসের লেক ঠেসেটুসে উঠেছে। তার মধ্যেই বহেরু একটা চেনা লোক পেয়ে হেঁকে বলল—ওঠো তো কালাচাঁদ, উঠে এই বুড়ো মানুষটাকে বসতে দাও। ব্রাহ্মণ মানুষ দাঁড়িয়ে যাবেন নাকি!

কালাচাঁদ নামে লোকটি তাড়াতাড়ি উঠে ব্রজগোপালকে সত্যিই জায়গা ছেড়ে দেয়।

ব্রজগোপাল লজ্জা পান, বিরক্তও হন, বলেন—তোর যত গা-জোয়ারি ব্যাপার বহেরু। লোকটাকে ওঠালি, দরকারটা কী ছিল?

—না না, ও দাঁড়িয়ে যাবেন আমার সঙ্গে গল্পগাছা করতে করতে। আপনি বুড়ো মানুষ। ব্রজগোপাল হেসে ফেলেন। বলেন—বয়েস কি তোরই কম নাকি!

—চাষার আবার বয়েস! বলে বহেরু মাথা চুলকোয়।

সারাক্ষণ দরজার কাছে বসে ব্রজগোপালের চোখের আড়ালে ওরা গাঁজা টানল দুজনে। ব্রজগোপাল স্পষ্টই টের পেলেন। হাওড়ায় নেমে দেখেন, বহেরুর চোখ দুটো ভারী ঝলমল করছে, মুখখানা টসটসে। তার অর্থ বেশ নেশা হয়েছে।

—কোনদিকে যাবি? ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করেন।

—কালিমায়ের থানটাই আগে দেখে আসি।

বাইরে বেরিয়ে এসে বহেরু অবাক মানে।

বলে কর্তা, এ শহর যে থিক থিক করছে লোকে!

—হুঁ।

—ই বাবা, কতদিন, কতদিন পরে এলাম! তা এত পালটে গেছে বুঝব কী করে! সবই অন্যরকম লাগছে।

বাসে উঠবার হুড়োহুড়ি চলছে। একটা বাস চলে গেল। আর নেই। লোকজন হাপিত্যেশ করে দাড়িয়ে আছে।।

—এত গুঁতোগুঁতি আপনার সইবে না কর্তা, চলুন হেঁটে মেরে দিই। কতদূর আর হবে!

ডালহৌসি পর্যন্ত হেঁটেই এলেন ব্রজগোপাল বহেরুর সঙ্গে। সেখান থেকে বাসে উঠে কালিঘাট পর্যন্ত একসঙ্গে। বহেরু নেমে যাওয়ার আগে বলল—ছটা পাঁচের ট্রেনে থাকব কিন্তু কর্তা।

ব্রজগোপাল স্নিগ্ধস্বরে বলেন—আচ্ছা। দুপুরে কোথাও দুটি খেয়ে নিস।

বেশ লাগছে। শরৎকালটা বেশ সুন্দর গোবিন্দপুরের তুলনায় কলকাতায় একটু গরম বেশি। তা হোক, তবু এই বর্ষার ভারী চমৎকার লাগে চারদিক। মনটাও ভাল, কারণ এখন আর কারও কাছে কোনও প্রত্যাশা নেই।

ঢাকুরিয়ার বাড়িতে পা দিয়েই কিন্তু বড় থতমত খেয়ে গেলেন ব্রজগোপাল। দরজা খুললেন ননীবালা নিজেই। খুলে বিষন্ন অদ্ভুত একটা মুখ বের করে খুব অবাক হয়ে দেখলেন ব্রজগোপালকে। চিরকালের সেই বড় বড় টানা চোখ ননীবালার, এই চোখই পেয়েছে সোমেন। এই বুড়ো বয়সেও ননীবালার চোখ দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।

কিন্তু সেই বড় বড় চোখ দুটো হঠাৎ জলে ভরে টসটস করছিল। ননীবালা আঁচলে আড়াল করলেন মুখ। কথা বলতে পারলেন না। একবার কেবল ফুপিয়ে উঠলেন।

বুক কাঁপছিল। তবু ব্রজগোপাল গুলা ঝেড়ে বলেন—কী হল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *