যাও পাখি – ৬০

॥ ষাট ॥

সরকার একটা খেলা দেখাতেন। বার্ডস ফ্রম নোহোয়ার। চমৎকার খেলা। একেবারে শূন্য থেকে অজস্র সজীব ডানা-ঝাপটানো পাখি ধরে আনতেন। নিস্তব্ধ মঞ্চ হঠাৎ ভরে যেত ডানার শব্দে, কাকলিতে। কী চমৎকার খেলা! তার কৌশলটা আজও অধিকাংশ ম্যাজিশিয়ানের কাছে অজানা।

অনেকবার চেষ্টা করেছে অজিত। পারেনি।

কয়েকটা পাখি কিনে রেখেছে সে। বারান্দায় খাঁচায় ঝোলানো আছে। ঝি মেয়েটা তাদের দানাপানি দেয়। অজিত সন্ধেবেলা চুপ করে সেই খাঁচাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে পাখিরা ডানা ঝাপটাল কয়েকবার। ভয়ের শব্দ করল। এখন ঝিমোচ্ছে। অজিত চেয়ে থাকে। সে পাখি দেখছে না, সে ম্যাজিকের কথা ভাবছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে শীলাকে সে বড় অন্যায় সন্দেহ করেছিল। শীলা যদি না বাঁচে তবে তাকে অন্তত এ কথাটা জানিয়ে দেওয়া দরকার যে, অজিত বড় অন্যায় করেছিল তার প্রতি। পাখিদের দেখে কেন কথাটা মনে হল, কে জানে।

ঘরে এসে সে ঝিকে চা দিতে বলল। এই নিয়ে বোধ হয় পাঁচবার চা হল। আর সিগারেট? না, তার কোনও হিসেব নেই। বিকেল থেকে সে অবিরল সিগারেট টানছে। এখন আর ধোঁয়ার কোনও স্বাদ নেই। আলোতে একবার দুটো হাত চোখের সামনে তুলে ধরল। দেখল, আঙুল স্থির নেই। হাত কাঁপছে। একটু বাদেই কেউ আসবে। বলবে—শীলা নেই। সেই অমোঘ ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করছে সে। কী করবে? কিছু করার নেই। যা হওয়ার হোক।

মনে পড়ে, এ বাড়িটা শীলার তাগাদাতেই করেছিল সে। কত প্ল্যান করে, কত শখের নকশায় তৈরি করা বাড়ি! শীলা নিজের গয়না দিয়েছে, কষ্টের রোজগারও ঢেলেছে কম নয়। বুকের পাঁজরের মতো আগলে থেকেছে। মানুষ কী ভীষণ মরণশীল: কেমন হুট বলতেই সব রেখে চলে যেতে হয়!

গরম চায়ে জিব পুড়ে গেল অজিতের। গ্রাহ্য করল না। তিন চার চুমুক খেয়েই উঠে হঠাৎ ফুলপ্যান্ট পরতে লাগল। না, যাই গিয়ে একবার দেখে আসি। ফুলপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে। জামাটা গায়ে দিতে গিয়েই ফের মনে হয়—থাকগে। ও দৃশ্য আমি দেখতে পারব না।

ফের চায়ের কাপ নিয়ে বসে অজিত। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার ঝিকে ডেকে চা দিতে বলে। সিগারেট ধরায়। হাত দুটো দেখে। আর বিড়বিড় করে বলে—তোমার ওপর নেই ভুবনের ভার…।

হঠাৎ বিদ্যুৎ স্পর্শে চমকে ওঠে অজিত। তাই তো! আজ লক্ষ্মণ এসেছে। বহুকাল পরে, বহু যুগ পরে। সম্ভবত জন্মান্তর থেকে এসেছে লক্ষ্মণ। তার কাছেই কি চলে যাবে অজিত। লক্ষ্মণের কাছে গেলে মাঝখানের এই কটা বছর মুছে যাবে। সেই কলেজের ছোকরা হয়ে যাবে অজিত! লক্ষ্মণের কাছে গেলে আর চিন্তা নেই, বয়স নেই। দুজনে চিনেবাদাম ভাঙতে ভাঙতে আজ ময়দানে হাঁটবে। আর লক্ষ্মণ তাকে আকাশতত্ত্ব বোঝাবে। বলবে অসীম শূন্যতা আর নিরবধি সময়ের কথা। সংসারের স্মৃতি থাকবে না, মৃত্যুর ভয় থাকবে না, শীলার কথা মনে পড়বে না! অজিত উঠে জামা পরল। ঝিকে ডেকে বলল—আমি বেরোচ্ছি। সদর বন্ধ করে দে।

—ও মা! চা করতে বললে যে!

—করতে হবে না।

বলে অজিত বেরিয়ে গেল।

রাস্তায় বেরিয়েই তার মনে হল, সে বড় অপরাধ করেছে শীলার প্রতি। সে চার দিন বাড়ি ফেরেনি। চারটে দিন সে উপেক্ষা করেছে, অবহেলা করেছে। শীলা তো তেমন কিছু অন্যায় করেনি। বড় ভাল মেয়ে শীলা। ভাবতে বুকের মধ্যে এক চৈত্রের ফাঁকা মাঠে হু হু করে যেন শুকনো খড়-নাড়া তৃণের জঙ্গলে আগুন লেগে গেল। বড় দহন। বড় জ্বালা। চার দিন সে কি করে আসন্নপ্রসবা শীলাকে ভুলেছিল?

এ সময়ে বাস-টাস চোখেই পড়ে না অজিতের। বড় রাস্তা থেকে ট্যাক্সি নিল। কোথায় যাবে তা হঠাৎ এখন আবার ঠিক করতে পারছিল না অজিত। শীলা কোন হাসপাতালে আছে তা জানে না। জানলেও লাভ নেই। ভিজিটিং আওয়ার সব হাসপাতালেই শেষ হয়ে গেছে। ভাবল, কালীঘাটে লক্ষ্মণের বাসায় যায়। পরক্ষণেই মনে হয়, শীলার একটা খোঁজ পেলে। নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, তারপর লক্ষ্মণের কাছে যেতে ভাল লাগবে।

দু-তিনবার মত পালটে অবশেষে ঢাকুরিয়ার শ্বশুরবাড়ির কাছেই চলে আসে অজিত। ভিতরে ঢুকতে সাহস হয় না। ট্যাক্সিটা দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে নামে। ওপরদিকে তাকিয়ে উৎকর্ণ বুঝতে পারে না। তারপর মনে হয়, একটা মেয়ে-গলার কান্নার আওয়াজ খুব ক্ষীণ শোনা যাচ্ছে। মনটা নিভে গেল। তা হলে শীলা…! ওপরে আলো জ্বলছে, জানালায় পরদা, বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। কিন্তু কান্নার শব্দটাই জানান দিচ্ছে, এ বাড়ির কেউ…।

মাথাটা গরম। ফের ট্যাক্সিতে বসে সে বলল—গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। কালীঘাট যাব। একটু তাড়াতাড়ি।

ট্যাক্সি চলে। অজিত চুপ করে বসে থাকে। তার চারধারে কলকাতার কোলাহল নেই, আলোর অস্তিত্ব নেই, বর্তমান নেই। এক নিস্তব্ধ, সময়হীন অনন্ত পরিসরে ভিতরে কেবল তাকে গতিময় রেখেছে বেঁচে থাকাটুকু। নিস্তব্ধতায় ভাসমান শব্দহীন একটা স্পেসক্রাফটে বসে আছে সে। সে বেঁচে আছে, কিন্তু কিছু বোধ করছে না।

লক্ষ্মণ লক্ষ্মণ ঠিক ফিরেছে তো! নাকি গিয়ে দেখবে যে লক্ষ্মণ গিয়েছিল তার নির্মোক পরে অন্য একজন সুখী মোটা সাহেবি মানুষ এসেছে! লক্ষ্মণকে নিয়ে তার বড় ভয়।

ট্যাক্সি ঠিক জায়গায় থামল। অজিত ভাড়া মিটিয়ে নামল। কিন্তু রাস্তার নির্দেশ দেওয়া থেকে ভাড়া মেটানো, বা দরজা খুলে নামা, এ সবই সে করেছে এক অবচেতন অবস্থায়। সে। টের পাচ্ছে না যে সে কী করছে।

লক্ষ্মণদের দরজা খোলাই রয়েছে। খুব আলো জ্বলছে আর অনেক লোকের ভিড়। অজিত দরজায় দাঁড়িয়ে ভিতরে তাকাতেই একদম সোজা লক্ষ্মণের চোখে চোখ পড়ল। খালি গা, একটু ধুতি পেঁচিয়ে বসে আছে। তাকে দেখেই লাফিয়ে উঠল—এলি? এসকেপিস্ট কোথাকার! এয়ারপোর্টে তোকে কত খুঁজেছি।

একলাফে এসে লক্ষ্মণ তাকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে মুখ, বলল—চলে এলাম। বুঝলি?

অজিত চোখের জল কষ্টে সামলায়। হেসে বলে—চলে এলি মানে? পার্মানেন্টলি?

লক্ষ্মণ মাথা নাড়ল—না, আর একবার যাব। তারপর ফিরে আসব।

অজিত নিবে গিয়ে বলে—তোকে বিশ্বাস নেই। গেলে যদি আর না আসিস!

ঠিক বটে, লক্ষ্মণ কিছু মোটা হয়েছে, একটু ফরসাও। কিন্তু মুখচোখের সেই দীনভাব আজও যায়নি। ওর ঠোঁটের গঠনে লুকনো আছে একটা চাষির সরলতা, চোখ এখনও স্বচ্ছ ও অকুটিল। সেই লক্ষ্মণ।

লক্ষ্মণ বলল—আমি ভাবছিলাম, তুই তো এসকেপিস্ট, বরাবর ঘটনা এড়িয়ে চলিস। তাই বুঝি এয়ারপোর্টে ভিড়ের মধ্যে পাছে দেখা হলে একটা সিন হয় সেই ভয়ে যাসনি।

অজিত মাথা নেড়ে বলে—না রে। আমি আজ বিকেলে ফিরেছি। তখন চিঠি পেলাম।

লক্ষ্মণ চারদিকে চেয়ে বলল—এখানে বড় ভিড়। খবর পেয়ে সবাই এসেছে। এখানে তো কথা হবে না।

অজিত খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলল—শোন লক্ষ্মণ, শীলা হাসপাতালে। অবস্থা খুব খারাপ। হয়তো এতক্ষণ বেঁচেও নেই বলতে বলতে অজিতের গলা বন্ধ হয়ে গেল।

লক্ষ্মণ চরকির মতো ঘুরে দাঁড়াল—বলিস কী? তুই এই অবস্থায় শীলাকে ফেলে এসেছিস?

—এলাম। বলতে গিয়ে চোখ ভেসে গেল অনিচ্ছাকৃত অশ্রুতে। ঠোঁট কাঁপল, তবু হাসবার চেষ্টা করে অজিত বলে—এলাম। তোর কাছে। তোকে দেখতে। আজ চলি। পরে দেখা হবে।

অজিত বেরিয়ে এল। এখন বয়স হয়ে গেছে। এখন কি আর সেই বয়ঃসন্ধির কালের মতো বন্ধুর আশ্রয় ভিক্ষে করতে হয়! এই বয়সে নিজের আশ্রয় হতে হয় নিজেকেই।

বেরিয়ে আসছিল, পিছন থেকে লক্ষ্মণ চেঁচিয়ে বলল—দাঁড়া। এক মিনিট।

অজিত দাঁড়াল। লক্ষ্মণ তার সেই লুঙ্গি করে পরা ধুতির ওপর একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে বেরিয়ে এল, পিছন ফিরে কাকে যেন বলল—আমি অজিতের সঙ্গে যাচ্ছি। আজ হয়তো ফিরব না।

বলে অপেক্ষা করল না। চলে এল।

সেই লক্ষ্মণ। ডাকলে বরাবর বেরিয়ে আসত।

অজিত এইটুকুই চায়। আর কিছু নয়। আর কেউ না হলেও খুব ক্ষতি নেই। কেবল লক্ষ্মণ হলেই চলে যায়। ডাকামাত্র সে আসে। যাকে বলতে হয় না হৃদয়ের দুঃখ বিষাদের কথা। বুঝে নেয়।

ট্যাক্সিতে লক্ষ্মণের পাশে বসে, নিজের হাতের আঙুলে কপাল ছুঁইয়ে জিত তার কান্নার বাঁধ ভেঙে দিচ্ছিল। নিঃশব্দ কান্না। কেবল লক্ষ্মণ টের পায়। চুপ করে থাকে। অজিতের ভিতরটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। চৈত্রের সেই আগুন লাগা ক্ষেতের ওপর ঘন মেঘ। ধারাজলে নিভে যাচ্ছে আগুন।

॥ একষট্টি ॥

এইখানে এক পিরের কবর। তার চার ধারে বাঁশঝাড়, আর শিমূল আর শিরীষ গাছের জড়াজড়ি। একটা ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপের ওপর সবুজ শ্যাওলা জমেছে। তার ভিতর দিয়েই মেঠো রাস্তা। ভাঙা বাড়িটার ভিতরবাগে এখনও গোটা দুই নোনা-ধরা ঘর খাড়া আছে। ছাদ ধসে পড়ে গেছে, তাই ওপরে টিনের ছাউনি। মেঝেতে অজস্র ফাটল, অশ্বথের শিকড় দেখা যায় দেওয়ালের ফাটলে। দিনে-দুপুরে ঘরের চারপাশে পায়রা ডাকে, রাতে চামচিকে আর বাদুড়। হাতখানেক লম্বা পাকা তেঁতুলের রঙের তেঁতুলবিছে লসলস করে হেঁটে যায় এক ফাটল থেকে অন্য ফাটলে। বর্ষায় উঁচু হুল বাগিয়ে তুরতুর করে তেড়ে যায় কাঁকড়া বিছে। আর ইটের স্থূপে ইদুরের গর্তে, ভিতের ফাটলে বাস্তু সাপের প্রকাণ্ড সংসার। মুহুর্মুহু দেখা যায় ধূসর রঙের গোখরো দাওয়া পেরিয়ে যাচ্ছে, বর্ষার রোদ উঠলে অজস্র জাত সাপের বাচ্চা ফাঁকায় বেরিয়ে কিলবিল করে, মাটির ওপর ঢেউ খেয়ে খেয়ে ধীরে ধীরে চলে যায় চন্দ্রবোড়া।

এইখানে থাকেন ফকিরসাহেব, হাজি শেখ গোলাপ মহম্মদ ওস্তাগার। ব্রজগোপাল ছাড়া এ নাম আর কেউ জানে না। সবাই জানে ফকিরসাহেব বলে। এই ভাঙা বাড়ি তাঁর নয়। এক ভক্ত মুসলমান মরবার আগে সমস্ত সম্পত্তি দিন দুনিয়ার মালিক আল্লাহর নামে ওয়াকফ করে দিয়ে যায়। সম্পত্তি বলতে অবশ্য ভাঙা বাড়িটাই—যা একসময়ে প্রকাণ্ড ছিল, জাঁকজমকও ছিল হয়তো। এখন দাবিদার কেউ নেই। সেই ভক্তজনই ফকিরসাহেবকে এখানে বসিয়ে দিয়ে যায়। ফকির থাকেন। প্রতি পদক্ষেপে সাপের দাঁত, বিছের হুল, পাখি-পক্ষীর পুরীষ। ফকিরসাহেব গ্রাহ্য করেন না।

সন্ধেয় আজ প্রকাণ্ড পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। ফকিরসাহেব মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে বললেন—চলুন, দাওয়ায় গিয়ে আল্লার আলোতেই বসি, সেই ভাল।

ব্রজগোপাল গম্ভীর ভাবে বললেন—হুঁ।

দুজনে বাইরের খোলা চাতালে এসে বসলেন। ফকিরসাহেব জ্যোৎস্নার আভায় ব্রজগোপালের মুখখানা দেখে নিয়ে বলেন—কীরকম আওয়াজ শোনেন ধ্যানের সময়ে।

ব্রজগোপাল বলেন—সে বড় ভীষণ আওয়াজ। সহস্র ঘণ্টার ধ্বনি, সহস্র শাঁখের আওয়াজ। পাগল করে দেয়। আর একটা নীল আলোর পিণ্ড হঠাৎ ফেটে গিয়ে চারধারে আলোর ফুলঝুরি ছড়াতে থাকে। তখন বড় ভয় করে, আবার আনন্দও হয়।

ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বলেন—গুরুর কৃপা।

ফিসফিস করে ব্রজগোপাল বলেন—যত দিন যাচ্ছে তত স্পষ্ট হচ্ছে। কান বন্ধ করলে একরকমের শব্দ শোনা যায়, ছেলেবেলায় শুনতাম সে নাকি রাবণের চিতার শব্দ। বলে। হাসলেন ব্রজগোপাল। ফকিরসাহেব মাথা নাড়লেন। ব্রজগোপাল বলেন—আসলে তা তো নয়। আমাদের দেহযন্ত্রের মধ্যে যে অবিরল বেঁচে থাকার কারখানা চলছে ও হচ্ছে তারই শব্দ। আমাদের বহির্মুখী ইন্দ্রিয়গুলি তা ধরতে পারে না। তেমনি ধ্যানে বসে মনটা কূটস্থে ফেলে দিলে সৃষ্টির মূল শব্দ পাওয়া যায়। আপনি বিশ্বাস করেন না?

ফকিরসাহেব মৃদু হাসলেন, বললেন—ব্রজঠাকুর, পথ একই, বিশ্বাস করব না কেন? আমি কি অবিশ্বাসী বিধর্মী? শব্দ শব্দেই তাঁর লীলা টের পাই।

বলে একটা শ্বাস ফেললেন ফকিরসাহেব। মুখে পান ছিল। সেটা আবার চিবোতে চিবোতে এক টিপ দোক্তা ফেললেন মুখে। জ্যোৎস্নায় একটা মোরগ ভুল করে ডেকে উঠল। হাত কয়েক দূরে জ্যোৎস্নায় একটা সাপকে দেখা গেল খোলা হাওয়ায় বেড়াচ্ছে। ফকিরসাহেব একটা হেঁচকি তুলে বললেন—যা যা…

সাপটা আস্তে ধীরে ইটের পাঁজার ওপর উঠে গাছের ছায়ায় মিলিয়ে গেল। সেদিকে চেয়ে থেকে ফকিরসাহেব নিমীলিত নেত্রে বললেন—ব্রজঠাকুর, শব্দের কথা মানুষকে বলবেন না। ওরা বিশ্বাস করবে না, ভাববে বুজরুকি।

—বুজরুকেরও অভাব নেই। ব্রজগোপাল উদাস গলায় বলেন—এখন শুনি অনেক ম্যাজিকওয়ালা সব গুরুঠাকুর সেজে বসেছে। আহাম্মকেরা তাদের কাছে ভগবান বলে ধেয়ে যায়। বুদ্ধিমান লোকে তাই বুজরুকি বলে পুরো ধর্মকেই অগ্রাহ্য করে। এ বড় ভীষণ অবস্থা।

জ্যোৎস্নাতে কাক ডেকে উঠছে। নিঃশব্দ বাদুড় ঝুলে পড়ল শূন্যে, চাঁদের চারধারে পাক খেয়ে মিলিয়ে গেল। ভারি নিঃঝুম চারদিক। কেবল মাঝে মাঝে রাতের শব্দ হয়। পাখির অস্পষ্ট ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ, ঝিঁঝি ডাকছে অবিরল, গাছে গাছে ফিসফিস কথা, আর কখনও টিকটিকি ডাকে, কখনও তক্ষক। চারধারে গাছগাছালির ছায়া নিবিড় হয়ে পড়ে আছে। পাতানাতা মাড়িয়ে একটা শেয়াল দৌড়ে গেল, পিছনে দূরে কোনও গেরস্তর কুকুর তাড়া করে এল খানিক দূর।

দুজনেই আসনপিঁড়ি হয়ে মুখোমুখি বসে আছেন। চারধারে মানুষের সাড়া নেই কোথাও। কিন্তু পৃথিবীর গভীর ও রহস্যময় প্রাণস্পন্দনে সজীব আবহ। আকাশে বৃক্ষে ও মাটিতে কত কোটি কোটি প্রাণ বেঁচে আছে। টের পাওয়া যাবে।

ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বলেন, ইটিন্ডাঘাটে এক বুজরুক ছিল, ঘরে বসে সে নাকি কলকাতার নামি দোকানের রসগোল্লা কিংবা অসময়ের ল্যাংড়া আম খাওয়াত। লোকে বলত, তার পোষা ভূত আছে, সে-ই সব এনে দেয়। খবর পেয়ে দেখতে গেলাম লোকটাকে, কিন্তু আমার ফকিরি চেহারা দেখেই লোকটা ঘেবড়ে গেল। কিছুতেই আর রসগোল্লা বা আম আনারস আনতে রাজি হয় না। লোকজনের বিস্তর ঝোলাঝুলি সত্ত্বেও বলে আজ আমার শরীর ভাল না। পরে আমাকে আড়ালে ডেকে বলল—আপনি তো সবই জানেন, ভাঙবেন না। বলে ফকিরসাহেব হাসলেন, বললেন—ব্রজঠাকুর, আদতে কিন্তু আমি কিছুই জানি না। আমি লোকটার ঐশী শক্তি দেখতেই গিয়েছিলাম, ভাল হাতসাফাই হলে ধরতেও পারতাম না।কিন্তু লোকটা ভয় খেয়ে সব স্বীকার করে ফেলল।

ব্রজগোপাল বলেন—আমার বড় জামাইও কার পাল্লায় পড়েছে শুনছি। ছোকরার ধর্মকর্মের ওপর খুব রাগ ছিল, এখন নাকি পথে পথে কেত্তন করে চাঁদা তোলে, কোথায় আশ্রম করবে। ঘরে পোয়াতি বউ পড়ে থাকে, আর সে বাবা বাবা’ বলে গুরুর নামে চোখের জল ফেলে নামগান করে। তা গুরুর নামে চোখের জল আসে সে ভালই, কিন্তু এসব তপ্ত আবেগ তো বেশিক্ষণ টেকে না। একদিন চটকা ভাঙলেই ছিটকে যাবে। তখন হয় ধর্মকর্মের ওপর মহা খাপ্পা হয়ে উঠবে, নয়তো সাত গুরু ধরে বেড়াবে। এও বড় ভয়ংকর অবস্থা। তারচেয়ে নাস্তিক ছিল, সে ঢের ভাল ছিল। নিষ্ঠাবান নাস্তিকেরও উদ্ধার আছে, দুর্বলচিত্তরাই উদ্ধার পায় না।

ফকিরসাহেব নিমীলিত চোখে চেয়ে রইলেন।

পিরের কবর অনেক দূর। গাছগাছালির আড়াল পড়েছে। সেই দূর থেকে কে যেন হাঁক পাড়ে—ব্রজকর্তা, ও ব্রজকর্তা!

কোকা কিংবা কালিপদ হবে। আজকাল একটুক্ষণ বাইরে থাকলে বহেরু চারধারে লোকজন পাঠাতে থাকে। তা সেই লোকজনেরা কেউ এতদূর আসতে সাহস পায়নি। গাঁ গঞ্জের মানুষ সব, এমনিতে সাহসের অভাব নেই। কিন্তু ফকিরসাহেবের আস্তানায় সন্ধের পর ঢুকতে চায় না কেউ। পায়ে পায়ে সাপ ঘোরে। তার ওপর লোকে জানে, এ সময়টায় ফকিরসাহেব ভূত আর পরি নামান। অনেকে দেখেছে ক্ষুদে ক্ষুদে পরি গাছের পাতায় পাতায় দোল খায়। জিন ঘুরে বেড়ায়, ভূত এসে ফকিরসাহেবের পা দাবায়, পাকা চুল বেছে দেয়। সেইসব ভয়ে কেউ ঢোকে না। ভূতের গায়ের গন্ধ অনেকটা বুড়ো পাঁঠার গায়ের গন্ধের মতো, সেই বিদঘুটে গন্ধে নাকি তখন জায়গাটা ম ম করে। মরার পর মেঘু ডাক্তারও নাকি এখানে থানা গেড়েছে। তাই কেউ আসে না।

একমাত্র ব্রজগোপাল আসেন। সঙ্গে একটা টর্চবাতি থাকে, আর একটা মজবুত লাঠি।

ফকিরসাহেব বললেন—ওই আপনার শমন এসেছে।

—হ্যাঁ। যাই।

ফকিরসাহেব হেসে বলেন—আমরা দুই ফকির এক ঠাঁই থাকতে পারতাম তো বেশ হত। তাঁর দয়ায় কথা বলতে বলতে একটু কাঁদতাম দুজনে। কী বলেন?

ব্রজগোপাল একটা শিহরিত আনন্দের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—ওই হচ্ছে কথা। তাঁর কথাই হচ্ছে কথা।

টর্চবাতি আর লাঠি নিয়ে উঠলেন। টর্চ ফেলতেই একটা বিশাল দৌড় দিল। চাতালের ঠিক নীচেই মাথা তোলা দিল বাদামি রঙের গোখরো। টর্চ আর লাঠি দু-বগলে চেপে নিয়ে হাততালি দিলেন ব্রজগোপাল। সাপটা ধীরেসুস্থে উত্তরবাগে সরে গেল। ব্রজগোপাল মুখ ঘুরিয়ে বললেন—এ জায়গায় বড় মধু। পরম পিতা খোদার ভক্ত থাকেন তো, ইতরজীবও তাই টের পায় এ জায়গায় ভালবাসার তাপ রয়েছে।

—আল্লা মালিক। ফকিরসাহেব বললেন।

ব্রজগোপাল হাঁটতে থাকেন।

ঘরে এসে একটা পোস্টকার্ড পেলেন তিনি। লণ্ঠনের আলোটা উসকে পড়তে লাগলেন। বুধবার রাত বারোটা কুড়ি মিনিটে শীলার একটি ছেলে হয়েছে। প্রসবে খুব কষ্ট পেয়েছে শীলা, রক্ত দিতে হয়েছে। শীলার কষ্টের কথা আরও অনেকখানি লিখেছেন ননীবালা। জামাই বাড়ি ছিল না। ছেলে হওয়ার পর সে খবর পেয়েছে। তারপর জামাইয়ের সাম্প্রতিক স্বভাবের ওপরেও অনেকটা লেখা, ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষর পড়তে গিয়ে চোখে জল চলে আসে। আরও লিখেছেন, ছেলেরা আজকাল তাঁর খোঁজখবর করে না। বীণার ব্যবহার ভাল নয়। ইত্যাদি।

ব্রজগোপাল চিঠি রেখে পঞ্জিকা খুলে বসলেন। কাগজ কলম নিয়ে নিবিষ্টমনে কোষ্ঠীর ছক তৈরি করতে লাগলেন নাতির। মনটায় বেশ একটা ফুর্তির হাওয়া খেলছে। নাতি হয়েছে। আরও তো কটা নাতি-নাতনি আছে তাঁর, তবু এই যে একটা রক্তের সম্পর্কিত মানুষছানা জন্মাল, এই খবরটাই কেমন একটা মায়া সৃষ্টি করে বুকের মধ্যে।

একটা লোক এনেছে বহেরু যে মাটি ছাড়াই গাছ গজিয়ে দিতে পারে। সেই শুনে বহেরু তাকে হাওড়া না কোত্থেকে ধরে এনে কদিন জামাই আদরে রেখেছে। একটা বেশ বড়সড় জায়গা বাঁশ-বাঁখারি দিয়ে ঘিরে বাঁশের খুঁটি পুঁতে কী সব কাণ্ড মাণ্ড হচ্ছে। এই রাতেও সেখানে দু-দুটো ডে-লাইট ঝুলছে জাম আর সজনে গাছের সঙ্গে। মেলা লোকজন তামাশা দেখতে ভিড় করেছে। এখন সেখানে মাটি কেটে কেটে সিমেন্ট জমিয়ে চৌখুপি করা হচ্ছে সেইখানেই চাষ হবে।

ব্রজগোপাল বাইরে এসে দূর থেকে ভিড়টা দেখলেন। সেই ভিড়ে একমাথা উঁচু বহেরু কোমরে হাত দিয়ে জমিদার-টমিদারের মতো দাঁড়িয়ে।

ব্রজগোপাল ডাকতেই বহেরু ছুটে আসে।

—কর্তা ডাকলেন নাকি?

—তুইও ছেলেমানুষ হলি নাকি?

বহেরু হাসে, বলে—না, কায়দাটা দেখে রাখছি, কী করে করে। দরকার হলে নিজেরাই করতে পারব।

—তোর মাটি ছাড়া চাষের দরকার কি? তোর কি মাটির অভাব?

বহেরু ঝুপ করে সুমুখে বসে পড়ে। লাজুক হেসে বলে—তা হতেও পারে একদিন। শুনি, এই সেদিন তারাদাস মাস্টারমশাই কচ্ছিলেন যে, এত মানুষ জন্মাবে পৃথিবীতে যে সব গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শোওয়া বসার জায়গাটুকুও থাকবে না। তা তখন পৃথিবীর জমিতে তো টান পড়বেই। শিখে রাখা ভাল।

ব্রজগোপাল গম্ভীর হয়ে বলেন—তুই যে সেই মোড়লটার মতো কথা বলিস। আমার সেই যজমান মোড়লকে একদিন বলেছিলাম—বাপু হে, মাছ মাংস খেলে শরীরে টকসিন হয়, রোগবালাই হলে সহজে ছাড়তে চায় না, ওসব আর খেয়ো না। সে তখন হাতজোড় করে বলে—দাদা, মাছমাংস খাওয়া সবই ছেড়ে দিলে যে নদী পুকুর সমুদ্দুর সব মাছে মাছে মাছময় হয়ে যাবে, ঘটি ডুববে না জাহাজ চলবে না। আর ডাঙায় পাঁটা ছাগল মোরগে সব ভরে যাবে, দিনরাত চারধারে ভ্যা-ভ্যা ম্যা-ম্যা কোঁকর কোঁ আওয়াজে কান ঝালপালা। যেন বা সেই ভয়েই ব্যাটা মাছমাংস খাওয়া ছাড়তে পারে না।

বহেরু হেসে বলে—তা হলে তত্ত্বটা কী কর্তা?

—তুই তো কেবল চিরকাল তত্ত্ব শুনতে চাস। মাথায় তো কিছুই সেঁধোয় না। তবে জেনে রাখিস এই দুনিয়াটা যার সে সব দিক নিয়ে ভেবে রেখেছে। তোর আমার ওপর দুনিয়াটা পুরো ছেড়ে দেয়নি। গায়ে গায়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে, শোওয়া বসার জায়গা থাকবে না—তাই হয় নাকি রে হারামজাদা? তার অনেক আগেই মানুষে মানুষের মাংস খেতে শুরু করবে।

বহেরু বুঝল। ব্রজঠাকুরের কথা শুনলেই তার বুকের মধ্যে একটা বলভরসা এসে যায়।

ব্রজগোপাল তার হাতে কুড়িটা টাকা দিয়ে বললেন—একটু মিষ্টিটিষ্টি কিনে বাচ্চাগুলোকে খাওয়াস। আমার নাতি হয়েছে একটা, বড়মেয়ের ঘরে।

বামনবীরটাকে এনে ফেলেছে বহেরু। তার খুব ইচ্ছে ছিল লম্বা সাঁওতাল আর বেঁটে বামনকে জোড় মিলিয়ে বহেরু গাঁয়ে ছেড়ে দেবে। তারা যেখানে যাবে হাঁ করে দেখবে সবাই। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। সাঁওতালটা শয্যাশায়ী রয়েছে কমাস, এখনও মরেনি বটে কিন্তু গোবিন্দপুর আর বৈঁচী থেকে ডাক্তার এসে দেখে বলে গেছে যে, এ আর খাড়া হবে না। যে কদিন বাঁচে বিছানাতেই বাঁচবে। তাই বামনবীর লোকটা একা-একাই ঘোরে। তার ধারণা লোক হাসানোই তার একমাত্র কাজ। রঙচঙে জামা কাগজের টুপি পরে সে নানা কসরত করে তোক হাসায়। ব্রজগোপাল তাকে ভাল চোখে দেখেন না। তোক হাসানোর তাগিদে সে একবার ব্রজগোপালের কাছা টেনে আলগা করে দিয়ে দৌড়েছিল। বহেরু তাকে মারতে গেলে ব্রজগোপালই ঠেকিয়েছিলেন। কিন্তু লোকটাকে এড়িয়েই চলেন তিনি। নিজের শরীরের খুঁত বাজিয়ে ব্যাবসা করে যে লোক তাকে তাঁর পছন্দ নয়।

ব্রজগোপাল ঘরমুখো হতেই কোত্থেকে একটা শিশুর মতো বামনটা ছুটে এল। সামনে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট ঠুকল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একধরনের অদ্ভুত সরু মেয়েলি গলায় বলল—ব্রজকর্তা, আপনাকে একটা কথা বলব।

ব্রজগোপাল একটু অবাক হয়ে বলেন—কী?

ঘরে এসে লোকটা টিনের চেয়ারে হামা দিয়ে উঠে বসল। বলল—আমার বয়স কত বলুন তো!

ব্রজগোপাল অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলেন। কোনও আন্দাজ করতে পারলেন না। বললেন—কত আর হবে। বেশি নয়।

॥ বাষট্টি ॥

বামনবীরের পেটটি নাদা। দু-হাতে ঢোলের মতো চাটি মেরে পেট বাজিয়ে খি-খি করে হেসে বলে—বেশি নয়? অ্যাঁ! বেশি নয়? বেঁটে বলে সবাই ভাবে মতিরামের বয়স বুঝি বারো তেরো। তা নয় গো!

বলে বামনবীর মতিরাম খুব হাসে।

ব্রজগোপাল কিছু বিরক্ত হন। মুখে কিছু বলেন না।

মতিরাম হাসতে হাসতে চোখের জল মুছে বলল—তা ব্রজকর্তা, তোমার বয়স কত শুনি!

একটু আগে আপনি আজ্ঞে করছিল, এখন স্রেফ তুমি বলছে। তাতে ব্রজগোপাল অসন্তুষ্ট হন না। সাধারণ মানুষেরা ওরকমই বেশিক্ষণ আপনি আজ্ঞে চালাতে পারে না, মানা মানুষ দেখলে কিছুক্ষণ প্রাণপণে আপনি আজ্ঞে করে, তারপরই তুমি বেরিয়ে পড়ে।

ব্রজগোপাল বলেন—তা পঁয়ষট্টি ছেষট্টি হবে।

মতিরাম হেসেটেসে চোখ কুঁচকে, ছোট দু-খানা হাতে ব্রজগোপালকে বক দেখিয়ে বলে—দুয়ো! হেরে গেলে।

ব্রজগোপাল অসহায় ভাবে চেয়ে থাকেন।

মতিরাম মাথা নেড়ে বলে—পাল্লে না তো!

ব্রজগোপাল শান্ত গলায় বলে কীসে পারলাম না?

—বয়সে। বলে মতিরাম আবার বিকট মুখভঙ্গি করে বলে—আমারও পঁয়ষট্টিই।

কথাটা ব্রজগোপাল বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু কিছু বললেনও না।

মতিরাম চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে এক পা তুলে দু-খানা হাত নুলোর মতো পেটের দুদিকে ভাঁজ করে, দাঁত বের করে চোখ পিটপিট করল কিছুক্ষণ। তারপর হুপ করে মেঝেয় লাফিয়ে নেমে বিচিত্র কায়দায় হাতের ওপর ভর করে পা দুটো পিছন দিকে ঘুরিয়ে নিজের কাঁধের ওপর তুলে দিয়ে ব্যাঙের মতো লাফাল খানিক। মুখে অবিরল ব্যাঙ ডাকার শব্দ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হাতটাত ঝেড়ে বলল—দেখলে, মতিরামের বয়স হলে কী হয়। এখনও অনেক খেলা দেখাতে পারে।

—দেখলাম। ব্রজগোপাল উদাস উত্তর দেন।

মতিরাম আবার হামাগুড়ি দিয়ে চেয়ারে উঠে বসে ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে খুব বিরক্তির সঙ্গে বলে তুমি হাসো না কেন বললা তো! সার্কাসে আমি বিশ বচ্ছর জোকার ছিলাম, কত লোককে হাসিয়েছি। এখনও গাঁয়েগঞ্জে সব জায়গায় আমাকে দেখলেই লোকে হাসে। আর যখন মজাটজা বা খেলাটেলা করি তখন তো কথাই নেই। হাসতে হাসতে গর্ভবতীর প্রসব হয়ে যায়, মানুষ পুত্রশোক ভুলে যায়, মরা মানুষ পর্যন্ত শ্মশানে যাওয়ার পথে ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ফেলে। তুমি হাসো না কেন বাবু? ব্যারাম-ট্যারাম নেই তো?

ব্রজগোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন—বাপু, তোমাকে দেখে আমার হাসি পায় না।

মতিরাম ভারী অবাক হয়ে বলে—পায় না? অ্যাঁ! পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এইটুকুন একটা মানুষ, বামনবীর—বলে নিজের লম্বার মাপ হাত দিয়ে দেখিয়ে মতিরাম বলে—এ দেখেও হাসি পায় না।

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—বেঁটে লম্বা কতরকম মানুষ আছে, মানুষের শরীরের খুঁত দেখে হাসি পাবে কেন? আমার পায় না।

—এই যে এত কেরানি দেখালাম তাও হাসি পেল না?

—না।

—তোমার বাপু ব্যারাম আছে।

ব্রজগোপাল সে কথার উত্তর না দিয়ে বলেন—লোক হাসানোর অত দরকার কি তোমার?

মতিরাম একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ অভিমানভরে বলে—সার্কাসে এক জন্ম এই তো করেছি। কাজ বাজ কেউ তো আর দেয়নি। তোক না হাসালে পেট চলে কেমন করে? সাকাসটা উঠে গেলে হাটে-বাজারে এইসব করে ভিক্ষেসিক্ষে জুটত।

—আর কিছু করোনি?

—করেছি। মতিরাম পা দোলাতে দোলাতে বলে—পদ্য-টদ্য লিখতে পারতাম, বুঝলে ব্ৰজকর্তা? উদ্বাস্তু আর নেতাজি নিয়ে পদ্য ছাপিয়ে ট্রেনে বিক্রি করতাম। লোকে আমাকে দেখে হাসত, পদ্য কিনত না। দুই বাড়িতে দুবার চাকরের কাজও করেছি। সে সব পোষায় না। তারপর পাণ্ডুয়ার বাজার থেকে বহেরু ধরে নিয়ে এল, খোরাকি দেবে আর হাত খরচা। তো ভাবলাম বুড়োবয়সে আর যাই কোথা! মরার আগে কিছু জিরেন নিয়ে হাঁফ ছাড়ি বাবা। সকাল থেকে আর পেটের চিন্তা করতে হবে না। এইটুকুন তো মোটে পেট, একমুঠো ভাত দিলে ভরে যায়। তা এইটুকুনের জোগাড় করতেও কত নাচনকোঁদন লাগে বাবা।

ব্রজগোপাল বললেন—তা থাকো, এইখানেই থেকে যাও।

মতিরাম অভ্যাসবশত ফের চোখ নাচায় মুখ বিকৃত করে। বলে—তা হলে আর ভাবনা কী ছিল? এ বেশ জায়গা, কাজকর্ম নেই, ঘোরোফেরো, লোক হাসাও, খাও দাও বগল বাজাও। বহেরু বিশ্বেস মানুষের চিড়িয়াখানা খুলেছে, নতুন রকমের গ্রামপত্তন করবে—এ সবাই জানে। কিন্তু ছেলেরা বড় হারামজাদা। যেখানে যাই কপিল শালা আর ওই কোকা খুনে হুড়ো দেয়। ওরাও তোমার মতো, হাসে না। কেবল বলে—যা যা, নিষ্কর্মা গতরখাস। বহেরু পটল তুললে এরা ঠেঙিয়ে তাড়াবে। পারলে এখনই তাড়ায়। কাক শালিক, শেয়াল কুকুরেও গেরস্তর ভাত খেয়ে যায় বাবা, তেমনি কাঙাল ফকির অভাগাও খায়। এদের সহ্য হয় না। বড্ড ছোট মানুষ। আমার চেয়েও। বলে হাসে মতিরাম।

ব্রজগোপাল উত্তর দেন না। ব্যাপারটা তিনি জানেন।

মতিরাম বলে—তাই তো ভাবি বসে বসে। আমার বয়স সত্যিই পঁয়ষট্টি। লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি আর তেমন পারি না। চোখেও ছানি পড়ছে। দেখবে? দেখো না!

বলে মতিরাম লাফ দিয়ে নেমে কাছে এসে আঙুল দিয়ে চোখের পাতা তুলে দেখায়। ব্রজগোপাল দেখেন, সত্যিই বাঁ চোখের মণির মাঝখানে সাদাটে ছানি। ডান চোখেও আসছে, তবে অতটা নয়।

মতিরাম ফের চেয়ারে গিয়ে উঠে বসে বলে—আন্দাজে আন্দাজে চলাফেরা করি, কেরানি দেখাই। কোনদিন হুট করে পড়েটড়ে গেলে বুড়ো বয়সে শয্যা নিতে হবে। মাগ-ছেলে নেই যে দেখবে।

বলে ফের দুঃখের কথাতেও খি-খি করে হাসে। বোধ হয় মাগ-ছেলের কথাতেই হাসিটা আসে।

ব্রজগোপাল কোনও প্রশ্ন করেন না। মতিরাম হাসতে হাসতে নিজে থেকেই বলে—বিয়ে করতে গিয়েছিলাম দুবার। সার্কাসে থাকতে পয়সাকড়ি পেতাম কিছু এক গরিব মেয়ের বাপকে রাজি করাই পয়সাকড়ি দিয়ে। কিন্তু বিয়ে করতে যেই গেছি গাঁয়ের ছেলেছোকরা একজোট হয়ে খুব ঠ্যাঙালে আমাকে। টাকাটাও গেল। আর একবার বছর দশ আগে সিমলাগড়ের একটা পশ্চিমা ঘুঁটেউলি বিয়ে বসল। তার আগের পক্ষের বড় বড় ছেলেপুলে ছিল। তো সেই মেয়েছেলেটা আমার পয়সা হাতাত, খেতেটেতে দিতে চাইত না। শেষপর তার ছেলেরা আর সে মিলে খুব মারধর করত আমাকে। মারের চোটে পালিয়ে বাঁচি। সে কী মার বাবা!

ফের খুব হাসতে থাকে মতিরাম।

ব্রজগোপাল আস্তে করে বলেন—কেউ নেই?

মতিরাম বলে—আমিই আছি আর কাকে দরকার বাবা! একাই চলতে পারি না তো আর কেউ! বুঝলে ব্রজকর্তা, দরজির কাজ খানিকটা জানি। জামা পায়জামা বানাতে পারি, লোক হাসাতে পারি। দেখো তো একটু। কেউ রাখলে থাকব।

বলে মতিরাম উঠে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট করে। তারপর লেফট রাইট করতে করতে বেরিয়ে যায়। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ছানিপড়া চোখ নিয়ে দিব্যি আছে।

কয়েকদিনের মধ্যেই ভারী ন্যাওটা হয়ে গেল মতিরাম। এমনিতে ভাঁড়ামি করে বেড়ায়। কিন্তু ফাঁক পেলেই ব্রজগোপালের কাছে এসে বসে থাকে। পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করে বেড়ায়। যেমন ষষ্ঠীপদ তেমনি মতিরাম দুজনেই সারাক্ষণ ব্রজগোপালের গন্ধ শুঁকে শুঁকে তাঁর শরীরের ছায়ায় ছায়ায় ঘোরে। ব্ৰজোগাপাল তাকিয়ে মাঝে মাঝে হাসেন। প্রায় সমান মাপের দুজন। একজনের বয়স পঁয়ষট্টি, অন্যজন নেহাত শিশু। দুজনে ঝগড়াও লেগে যায় মাঝে মাঝে।

ষষ্ঠীপদ বলে—আমার দাদুকে যন্তন্না করবে না বলে দিচ্ছি।

মতিরাম মুখ ভেঙিয়ে বলে—ইঃ দাদু। বাপের সম্পত্তি নাকি রে ব্যাটা!

বড় মায়া জন্মায়। বুকের মধ্যে প্রাণপাখি ডানা ঝাপটায়। কবে খাঁচা ছেড়ে যায়। তবু কেন যে অবোধ মায়া!

শরীরটা কিছুদিন যাবৎ ভাল নেই ব্রজগোপালের। বেলপুকুরে যজমানবাড়ি ঘুরে যাজন সেরে এসে বুকে ব্যথাটা টের পেলেন ফের। ফকিরসাহেব খবর পেয়ে এসে বিছানার ধারে বসে বলেন—ওষুধ কি দেব ব্রজঠাকুর? অনুমতি পেলে দিই।

ব্রজগোপাল হেসে বলেন—পরমপিতা খোদার নাম করুন।

ফকিরসাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন—শিব স্বয়ম্ভু।

এক রাতে শীলাকে স্বপ্ন দেখলেন। ঘুম বড় একটা হয় না। তবু ভোরবেলার তন্দ্রায় এক আলো-আঁধারিতে শীলা যেন সামনে এসে দাঁড়াল। কোলে একটা বাচ্চা। বাচ্চাটার মুখ হুবহু শীলার মতো। শীলা বলল, বাবা আমার ছেলের নাম রাখবে না?

ব্রজগোপাল কষ্টের সঙ্গে বললেন—আমি নাম রাখলে কি তোদের পছন্দ হবে? পুরনো দিনের মানুষ আমরা। রণোর বড় ছেলের নাম রেখেছিলাম, তা সে ওরা পালটে দিয়েছে।

শীলা বলল—না বাবা, এ ছেলের নাম তুমিই রাখো। তুমি তো ভগবানের লোক বাবা, তুমি নাম রাখলে ও বাঁচবে।

ব্রজগোপাল বললেন—তবে নাম রাখো ঋতম্ভর।

—মানে কী বাবা?

—সত্যপালক। বিষ্ণু।

এই দেখে ঘুমের চটকা ভাঙল, উঠে বসলেন। ভোরের স্বপ্ন। ভাবলেন, নামটা আজই লিখে পাঠাবেন শীলাকে। আবার ভাবলেন, নাতির মুখশ্রী একবার দেখে আসবেন গিয়ে। হয়তো শেষ কথা। শরীরটা এখনও পড়ে যায়নি। এইবেলা না দেখে এলে আর হয়তো দেখাই হবে না। ওরা তো আর আসবে না বুড়ো বাপের কাছে।

॥ তেষট্টি ॥

দিন দুই আগে সোমেন ডাকে একটা খাম পেয়েছিল। তাকে চিঠি বলা যায় না। খামের মুখ ছিঁড়তে একটা কেবলমাত্র রঙিন সিনেমার টিকিট বেরিয়ে এল। দু-দিন পরের তারিখ। সঙ্গে একটা চিরকুটও নেই যে বোঝা যাবে টিকিটটা কে পাঠিয়েছে।

পঁচিশ বছরে পা দিয়ে সোমেন আজকাল টের পায় তার জীবনে খুব একটা রহস্য বা চমকে ওঠার মতো কিছু নেই। এই তো সেদিন সে মোটে তার শৈশব পেরিয়ে এল। শীতের সকালে মা একটা ছোট্ট ছেঁড়া আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে পিঠের দিকে গিঁট বেঁধে দিত, আর সোমেন একটা বড় টিনের কৌটো আর খুচরো পয়সা মুঠো করে নিয়ে মুদির দোকান থেকে মুড়ি আনতে যেত। ঢাকুরিয়ার রেল লাইনের ওপর ওভারব্রিজটা তখনও হয়নি। যোধপুরের দিকে ফাঁকা জমি পড়ে আছে। শীতের সকালে কুয়াশামাখা ঝিল-এর মলিন জল ছুঁয়ে কনকনে বাতাস আসত। সেই দূরটুকু কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া দিগন্তটা আর রেল ইঞ্জিনের কহুধ্বনি সবই গায়ে কাঁটা-দেওয়া রহস্য জাগিয়ে দিতে যেত। লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে বাস থেমে আছে, গেট বন্ধ, আর ঠিন ঠিন করে দূরের দমকলের মতো ঘণ্টি বাজছে। সেই ঘণ্টির শব্দ কি একটা অজানা আনন্দের সংবাদ নিয়ে আসত মনের মধ্যে। মুদির দোকানে একটা কেমন মশলাপাতির ঝাঁঝাল গন্ধ উঠত। বুড়ো মুদিচরণ সাহা একটা রঙিন খদ্দরের চাদরে মাথা মুখ ঢেকে জিনিস ওজন করে দিত। চরণ সাহা কখনও ফাউ দিত না, বরং মাপা জিনিস থেকে এক চিমটে তুলে রাখত বরাবর। তার ওপর একটা রাগ ছিল সোমেনের। কিন্তু খুব বেশি দোকান তখনও ওদিকে ছিল না। রাস্তাঘাট অনেক ফাঁকা ছিল, এত বাড়িঘর হয়নি। স্টিম-ইঞ্জিন ঝিক ঝিক করে কাঠের গাড়ি টেনে নিয়ে গেছে লাইন দিয়ে। সন্ধেবেলা কতদিন রেলগাড়ির শব্দ দূরে মিলিয়ে যেতে মন উদাস হয়ে গেছে সোমেনের। তখন মনে হত পৃথিবী কি ভীষণ গভীর গহীন। এর মধ্যে না জানি কত অজানা অচেনা রহস্য লুকিয়ে আছে। শীতে কত পাখি আসত, বর্ষার ব্যাঙ ডাকত। এখন আর সে-সব দেখে না, শোনে না সোমেন। আজকের যারা শিশু তারা হয়তো এই আবরণহীন, যান্ত্রিক পৃথিবীর কিছু রহস্য টের পায় এখনও। সোমেন পায় না।

টিকিটটা অনেকবার হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করল সোমেন। কোনও হদিশ করতে পারল না। কিন্তু রহস্যটা বেশ ভাল লাগছিল তার কাছে। যে-ই পাঠাক সে অন্তত দু-দিন সোমেনকে মনে মনে উদ্‌গ্রীব রাখছে।

আজ সকালে উঠেই টিকিটটা বের করে দেখল সোমেন। আজই ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট মেট্রোয়। টিকিটের ওপর মেট্রো কথাটা দেখে ফের শিশুবেলার কথা মনে পড়ে সোমেনের। মেট্রো হল-এর নাম তখন মা-মাসির মুখেও শোনা যেত। সে নাকি এক আশ্চর্য মায়াপুরী। মেট্রো হল-এর চূড়ায় যে খাঁজকাটা প্যাটার্ন আছে তারই অনুকরণে তখনও মেট্রো প্যাটার্নের নেকলেস বা গলার হার গড়াত বাঙালি মেয়েরা। আজ মেট্রোর সেই কারুকাজ কেউ চোখ তুলেও দেখে না। ওই হল-এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো অনেক হল হয়েছে কলকাতায়। তবু তখনও সোমেনের কাছে ওই নামটার একটা চমক আছে।

আজকাল সোমেনের বড় পুরনো কথা মনে পড়ে। একদিন অনিল রায় তাকে বলেছিলেন—দেখো সোমেন, যখনই দেখবে তোমার খুব বেশি পুরনো কথা মনে পড়ছে তখনই বুঝবে যে তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। নস্টালজিয়া বলো, শৈশবের স্মৃতি বলো—ওর খুব বেশি ভাল নয়। ও মানুষকে শেখায় বর্তমানকে উপেক্ষা করতে, ভবিষ্যতের প্রচেষ্টা থেকে নিশ্চেষ্ট রাখতে। বাঙালি মাত্রই বড় বেশি নস্টালজিয়ায় ভোগে। আসলে যারা নিজেরা চারপাশকে উপভোগ করতে পারে না, যারা নিজেদের জীবনকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত করতে পারে না, যারা ঘরকুনো তারাই দেখো, বর্তমানকে উপেক্ষা করে অতীত নিয়ে থাকে।

সোমেনের আজকাল তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, পঁচিশেই বুঝি বা তার যৌবন ফুরল। আর কিছু হওয়ার নেই। কিছু করার নেই। দাদার এই দুঃসময়ে সে সংসারের কোনও কাজে আসে না। একটা পয়সাও দিতে পারে না সংসার খরচ। তাই সোমেন দুবেলা বড় লজ্জার ভাত খায়। রাতে গোপনে কখনও বা চোখের জল ফেলে।

সকাল থেকেই টিকিটটা ঘিরে তার একটা পিপাসা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল গিয়ে যদি দেখে চেনা কেউ নয়, একজন অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রতীক্ষায়! কিংবা যদি এমন হয় যে, এই টিকিটের সূত্রেই তার জীবনের মস্ত পরিবর্তন আসছে?

ভাবতে গিয়ে আপন মনেই হেসে ফেলল সোমেন। তাই কি হয়? চেনা মানুষই পাঠিয়েছে টিকিট। একটু শুধু রহস্য জড়িয়ে দিয়েছে টিকিটের গায়ে। তাই শৈশবের সব হারিয়ে যাওয়া রহস্যের গন্ধ আজ মেট্রোর তুচ্ছ টিকিটটার গা থেকে শুঁকে নিচ্ছিল সোমেন।

ননীবালা এসে বললেন—পাগল ছেলে, একা-একা হাসছিস কেন?

সোমেন গম্ভীর হয়ে বলল—ও কিছু না।

ননীবালা বললেন—একবার শীলার বাড়ি যা। ছেলে হওয়ার পর থেকেই মেয়ের বড় খিদে হয়েছে। ঝি-ছুঁড়িটা কী ছাইমাটি রেঁধে দেয়, ও দিয়ে কি আর পোষ্টাই হয়! এখন হুড় হুড় করে বুকের দুধ নামাতে হলে বাটি বাটি দুধ-সাগু খাওয়াতে হয়, ফলি মাছের ঝোল, লাউ। তা সে-সব আর কে করছে! কয়েকটা গোকুল পিঠে করে রেখেছি, বউমা কৈ-মাছ করছে, টিফিন ক্যারিয়ারে করে দিয়ে আয় গে।

সোমেন মুখটা বিকৃত করে বলে—দিদির শাশুড়ি আর কে যেন এসে ওখানে আছে শুনলাম। তারা থাকতে দিদির জন্য আমাদের ভাববার কী?

ননীবালা একটা তাচ্ছিল্যের ‘হুঁঃ’ দিয়ে বললেন—সে যেই হোক, পেটে তো আর আমার মতো ধরেনি মেয়েটাকে। তারা সব অতিথির মতো এসে আছে। আলগোছে কদিন থেকে চলে যাবে।

সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে—তুমি খাবার পাঠালে তারা বিরক্ত হতে পারে। প্রায়ই তো পাঠাচ্ছ শুনি।

ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—ও মা! বিরক্ত হবে কেন? বরং না পাঠালে খোঁজ না নিলে উলটে বলত। এমনিতেই নার্সিং হোমে রাখা হয়নি, হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে বলে জামাই সুদ্ধু সকলেরই গাল ফুলে আছে। বিপদের সময় সব কোথায় হাওয়া হয়েছিল, তাই ভাবি। কাজ উদ্ধার হয়ে যাওয়ার পর খুঁত ধরতে সবাই পারে।

সোমেন বেশি কথা বলতে চান না। টিকিটের রহস্যচিন্তা ছিঁড়ে যেতে চায়। বলল—উঃ বড্ড বেশি কথা বলো তুমি। খাবার দিয়ে আসতে হবে, দিয়ে আসব। অত কথায় কাজ কি?

ননীবালা আজকাল এই ছেলেটাকে বড় ভয় পান। রণোর মতো শান্ত নয়, বড্ড রাগী। অবশ্য চাকরি-বাকরি পায় না বলেই বোধ হয় মেজাজটা খিঁচড়ে থাকে। বয়সকালে স্থিতু হতে না পারলে পুরুষমানুষের ওরকম হয়ই, মেয়েদের হয় বয়সকালে বিয়ে না হলে। শীলার কিছু দেরিতে বিয়ে হয়েছিল, শেষ দিকটায় বড্ড মুখ করত।

ননীবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—তোমরা বাবা সব ভি আই পি, কথা বলতে গেলেই ভয় পাই।

সোমেন মার মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলে৷ বলে—ওঃ বাবা, আজকাল যে ইংরেজি বলছ! ভি আই পি-টা কোত্থেকে শিখলে?

ননীবালা উদায় হলায় বলেন—শুনে শুনেই শেখা।

সোমেন বহুকাল পর হঠাৎ উঠে ননীবালাকে দু-হাতে জড়িয়ে মাটি থেকে তুলে নিয়ে শূন্যে একটা পাক খাওয়াল। ননীবালা ‘ছেড়ে দে, ছেড়ে দে’ বলে চেঁচালেন, হাসলেনও। সোমেন বলল—খুব আপ-টু-ডেট হয়ে যাচ্ছে, বুড়ি, অ্যাঁ?

যখন শীলার বাড়ি যাবে বলে বেরোতে যাচ্ছে সোমেন তখন বীণা টিফিন ক্যারিয়ার দিতে এসে বলল—হই-হুজ্জুতে মনে পড়েনি সোমেন, সেই যে টাকাটা চেয়ে রেখেছিলে সেটা নাওনি এখনও। লাগবে নাকি?

বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে সোমেনের। অণিমার সেই শাড়ির দাম।

বলল—লাগবে বউদি। দেবে? নইলে প্রেস্টিজ থাকবে না।

—দেব না কেন? বহুদিন ধরেই খামে ভরে রেখে দিয়েছি। এক মিনিট দাঁড়াও এনে দিই।

—তোমার কষ্ট হবে না তো বউদি?

বীণা একরকম অদ্ভুত ঠাট্টা আর বিষণ্ণতা মাখানো হাসি হেসে বলল—প্রেস্টিজটা তো এখন রাখি। আর কষ্ট? সে তো আছেই। দেড়শো টাকায় তার কিছু সুরাহা হবে না।

ননীবালা কথাবার্তা শুনে এগিয়ে এসেছিলেন—কী কথাবার্তা হচ্ছে রে সোমেন? ও বউমা, টাকার কথা কী বলছ?

—ও কিছু নয়। বীণা বলল। এক ঝটকায় কোত্থেকে একটা পুরনো চিঠির খামে ভরা দশটাকার নোটের গোছা এনে সোমেনের প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিল।

অণিমা এখনও কলকাতায় আছে কিনা সোমেন জানে না। কয়েকদিন গাব্বুকে পড়াতে যায়নি।

অজিত কদিন ছুটি নিয়ে আজকাল বাড়িতেই থাকে। একটা ইজিচেয়ার টেনে শীলার বিছানার পাশেই বসে থাকে। আঁতুর টাঁতুর বড় একটা মানে না। নিজের মা আর এক বুড়ি বিধবা খুড়িমা এসে আছে কদিনের জন্য, তাদের সামনেই লজ্জাহীনের মতো বসে থাকে বউয়ের কাছে।

আজও ছিল। জানালার ধারে একটা চেয়ারে লক্ষ্মণ বসে আছে।

শীলার বাচ্চাটা দিব্যি মোটাসোটা হয়েছে, ফরসা রং, নাকমুখ এখনও ফোলা-ফোলা, তাই আদল বোঝা যায় না। বাচ্চাটা কাঁদে না, কেবল ঘুমোয়। আর পাঁচ সাত মিনিট অন্তর অন্তর কাঁথা ভেজায়।

শীলা কিছু কষ্টে নেই। হাসপাতাল থেকে ডাক্তাররা এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে চায়নি। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই অজিত প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছে। বত্রিশ টাকা ভিজিটের গায়নোকোলজিস্ট প্রতিদিন এসে দেখে যাচ্ছে, হামেহাল পাশ করা নার্স বহাল আছে। ফ্রিজ ভরতি ফলটল কিনে রেখেছে অজিত, রাশি রাশি ওষুধ, ভিটামিন, কৌটোভরতি গুঁড়ো প্রোটিন আর পুষ্টিকর সব ফুড আসছে রোজ। প্রতিদিন বিকেলের দিকে কিছু ঘরে-করা খাবার নিয়ে ননীবালা, বীণা বা রণেন দেখতে আসে।

সোমেন এসব লক্ষ করে ননীবালার কথা ভেবে মনে মনে রাগ করে। বড়দি কিছুমাত্র অযত্নে তো নেই-ই, উপরন্তু খুব বেশি যত্নে আছে, তবু ননীবালা খুঁত বের করবেনই।

সোমেন ঘরে ঢুকতেই শীলা তাকিয়ে হাসল—আয়।

সোমেন বলল—তোর জন্য মা খাবার পাঠিয়েছে, রান্নাঘরে দিয়ে এসেছি।

—কত খাব রে? শীলা হেসে লক্ষ্মণের দিকে চেয়ে বলল—একে চেনেন? আমার ভাই।

—চিনি, ছোট দেখে গেছি। সেদিনও আবার পরিচয় হল। বড় হয়ে গেছে। লক্ষ্মণ বলে।

লক্ষ্মণদার গলার স্বরটা অদ্ভুত সুন্দর লাগে সোমেনের। এত ভদ্র, আন্তরিক আর ভরাট গলা যে, শুনলেই মানুষটার দিকে আকর্ষণ জন্মায়। চেহারাটা খুব লম্বা চওড়া, কিন্তু কোথাও কোনও কর্কশতা নেই। মুখে সরল একটা হাসি। সেদিনও দেখেছে সোমেন, শীলার খবর পাওয়া মাত্র কেমন চটপট সব খবরাখবর নিল, ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলল, চেহারা এবং কথাবার্তায় সকলের সম্ভ্রম এবং মনোযোগ আকর্ষণ করার নিহিত একটা গুণ আছে লক্ষ্মণদার। শরীরে একবিন্দু আলস্য নেই, বরং খুব কেজো লোকের লঘু গতি আছে।

লক্ষ্মণ তাকে কাছে ডেকে বসাল। বলল—কী করছ?

সোমেন তার উত্তরে বলে—আমাকে আমেরিকা থেকে একটা জব ভাউচার পাঠাবেন লক্ষ্মণদা?

শুনে লক্ষ্মণ চমৎকার করে হেসে বলে—পালাতে চাও? বলে দুহাতে মুখটা একটু ঘষে নিয়ে বলে—সবাই পালাতে চাইছে কেন বলো তো!

—এখানে থেকে কী করব? কিছু হচ্ছে না।

লক্ষ্মণ ফের হাসে। বলে—ওখানে গিয়েই বা কী হবে? কদিন একটু ভাল খাওয়াপরা জুটবে। গুড লিভিং। তারপর দেশে ফিরে এলে বড্ড মুশকিল হয়। বড়লোকের দেশ থেকে এসে নিজের গরিব দেশকে আর ভাল লাগতে চায় না। সেটা ভাল নয়। ও এক ধরনের ব্যাঙ্করাপসি। তারচেয়ে নিজের দেশটাকে বড় করার চেষ্টাই ভাল।

সোমেন কথাটার উত্তর দেয় না।

লক্ষ্মণ তার কাঁধে হাত রেখে বলে—আমিও চলে আসছি।

—কবে?

—এবার গিয়েই চলে আসব।

সোমেন কিছু উৎসুক হয়ে বলল—অত বড় চাকরি ছেড়ে আসবেন?

লক্ষ্মণ মাথা নেড়ে বলে—আসব। আসতেই হবে।

—বউদিকে নিয়ে আসবেন?

লক্ষ্মণ একটু থমকাল। ফের সেই অপকট হাসি হেসে বলল—না। সে আসবে না। ও ঠিক আমাকে বোঝে না, আমি ওকে বুঝি না। আমাদের বিয়েটা ভেঙে গেছে সোমেন।

॥ চৌষট্টি ॥

সোমেন যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, অজিত মুখ তুলে বলল—শালাবাবু, ভাগ্নেটিকে কেমন দেখছ? তোমার মতো সুন্দর হবে?

সোমেন লজ্জা পেয়ে বলে—আমি আবার সুন্দর নাকি? ও আরও বেশি সুন্দর হবে।

অজিত খুব একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল—তা হলে বলছ বয়সকালে আমার ছেলের পিছনে বিস্তর মেয়ে লাইন দেবে?

শীলা ভ্রূ কুঁচকে বলে—অত আদেখলাপনা কোরো না তো! লোকে হাসবে।

অজিত উঠে নতুন কেনা একটা দামি নাইলনের মশারি খাটের স্ট্যান্ডে টাঙাতে শুরু করলে শীলা বলল—বাব্বাঃ, পারোও তুমি। এখন মশারি টাঙালে দমবন্ধ লাগবে না?

—লাগুক। এখানে দিনের বেলাতেই মশা বেশি লাগে। আজ বেরিয়ে ওর জন্য একা ক্ষুদে ফোল্ডিং মশারি কিনে আনবে।

শীলা বাহ্যত রাগ কিন্তু অন্তর্লীন প্রশ্রয়ের গলায় বলে—আর কি কি কিনবে লিস্ট করে নিয়ে যেয়ো৷ ছেলে যেন আর কারও হয় না।

লক্ষ্মণ উঠে বলল—চলো সোমেন, আমিও যাই।

—তুই যাবি? বোস না! অজিত বলে।

—না রে, কাজ আছে। মোটে তো মাসখানেক সময়, কত লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বাকি আছে, বউঠান, আজ বিদায় হই। সময় পেলে কাল আসব।

—আসবেন। শীলা পাশ ফিরে বলে—আপনার বিরহে আপনার বন্ধু এতকাল শুকিয়ে যাচ্ছিল।

লক্ষ্মণ ম্লান একটু হেসে বলে—আমরা খুব বন্ধু বউঠান। জীবনে একজন দুজনের বেশি বন্ধু কারওই বড় একটা জোটে না। আমরা সেই রকম বন্ধু। তবে দুঃখ করবেন না, এখন তো অজিতের ছেলে হল, এবার আর বন্ধুর জন্য তেমন উতলা হবে না। মানুষ যার মধ্যে নিজেকে পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে। এককালে অজিত আমার মধ্যে নিজেকে পেত, এবার ছেলের মধ্যে আরও বেশি সেটা পাবে। সন্তান মানে তো নিজেরই পুনর্জন্ম।

শীলা হেসে বলে—বাবাঃ, আপনার কথা ভীষণ শক্ত। বুঝতে পারি না।

লক্ষ্মণ বলে—অজিত বোঝে, না রে অজিত?

অজিত খাটের চারধারে ঘুরে ঘুরে খুব যত্নের সঙ্গে মশারি গুঁজছিল। মুখ না তুলেই বলল—সোমেন না থাকলে তোকে এমন একটা গাল দিতাম না।

লক্ষ্মণ সভয়ে বলে—ওর মুখটা বড় খারাপ বউঠান, সামলে রাখবেন।

অজিত মশারির আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলে—তুমি শালা খুব সবজান্তা হয়েছ। ছেলে কি বন্ধুর জায়গা নিতে পারে? ছেলে একরকম, বন্ধু অন্যরকম। কাল আসিস কিন্তু।

—দেখি।

বলে লক্ষ্মণ বেরিয়ে আসে, সঙ্গে সোমেন।

যে মানুষ বিদেশে থাকে তারদিকে বরাবরই আকর্ষণ সোমেনের। লক্ষ্মণের গায়ে সেই অদ্ভুত সুদূরের গন্ধ, যে রহস্যময় দূর বরাবর মানুষের রক্তে জীবাণুর মতো নিহিত থাকে। দূরত্বই রহস্য, দূরত্বই আকর্ষণ। যে মানুষ পৃথিবীর সব দূরত্ব অতিক্রম করেছে সেও আকাশের দিকে তাকালে বুঝি ফের দূরত্বের রহস্য টের পায়। আমেরিকা, ইয়োরোপ, এই শব্দগুলো শুনলেই সোমেনের বুকে অদৃশ্য ঢেউয়ের ধাক্কা এসে লাগে, তীরভূমি ভেসে যায়।

লক্ষ্মণ একটা ট্যাক্সি নিল। বলল—চলো, তোমাকে একটা লিফট দিই। কোথায় যাবে?

—আমি যাব বালিগঞ্জ সারকুলার রোড। আপনি আমাকে কালীঘাটে নামিয়ে দেবেন। ওখান থেকে চলে যাব। ট্যাক্সিতে উঠে বসে সোমেন খুব লজ্জার সঙ্গে বলল—আমরা ভেবেছিলাম আপনি আর ফিরবেন না লক্ষ্মণদা, ওখানেই থেকে যাবেন।

লক্ষ্মণ অবাক হয়ে বলে—কেন? ফিরব না কেন?

সোমেন বলে—শুনলাম ওখানে বিয়ে করেছেন, বাড়ি করেছেন। আপনার এখানকার জমিটাও তো বিক্রি করে দিলেন।

লক্ষ্মণ মাথা নেড়ে বলল—না। ফিরতাম। আমি খুব বেশিমাত্রায় ভারতীয়। কখনও পুরোপুরি বিদেশি হতে পারলাম না। অবশ্য হতে পারলেই সুখী হওয়া যেত। প্রথম গিয়ে আমি তো ঠিকই করেছিলাম হয় কানাডা কিংবা স্টেটসে সেটল করব। হুইমসিক্যালি বিয়েও করে ফেললাম। কিন্তু তারপরই কতকগুলো ভুল ধরা পড়তে লাগল। প্রগ্রেসিভ দেশগুলোতে মেয়েরা বড্ড বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। বলে লক্ষ্মণ হঠাৎ পাশে মুখ ঘুরিয়ে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে—আচ্ছা সোমেন, বলো তো স্বাধীনতার সন্ধিবিচ্ছেদ কী হবে!

সোমেন হেসে ফেলে, বলে—স্ব প্লাস অধীন।

—হল না। লক্ষ্মণ মাথা নাড়ে—নিজের অধীন হওয়া মানে যথেচ্ছাচারের অধীন হওয়া। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হল স-এর অধীন। স্বাধীনতা তাই শুভ বা মঙ্গলের অধীনতা। সে যাকগে। যেখানে মেয়েরা স্বাধীন, তারা সমাজে পুরুষের সমান সব অধিকার ভোগ করে, পুরুষের সঙ্গী হয়, বন্ধু হয়, পার্টনার হয়। তাদের ভাবপ্রবণতা খুব কম। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমান জিনিসটা প্রায়ই দেখা যায় না। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে বাবা কিংবা কাকিমার সঙ্গে ঝগড়া করে কাকা ভাতের ওপর রাগ করেছে, খায়নি। আর মা কাকিমা কত সাধ্যসাধনা করে খাইয়েছে, ওদেশে এটা ভাবাই যায় না। অভিমান করে থাকলে লোকে অবাক হয়, রাগ ভাঙানোর সময় কারও নেই। বিয়ে করলেই বউ আপন হয়ে গেল, এই আমরা জানি। আমার তা হয়নি। সোমেন, তুমি তো যোলো বছর বয়স পার হয়ে এসেছ, তোমাকে বলতে আপত্তি কী যে ও দেশে সবাই বড্ড বেশি অ্যাডাল্ট। আদর ভালবাসার ক্ষেত্রেও কেউ খুব ছেলেমানুষ বা ইললজিক্যাল হয়ে যায় না। আমার স্ত্রী চাকরি করত, ক্লাবে যেত, তার আলাদা পুরুষ আর মেয়ে বন্ধু ছিল, আলাদা একটা জীবনও ছিল যেখানে আমি ঢুকতে পারতাম না। অর্থাৎ স্বামীর অধিকারও সীমাবদ্ধ ছিল। হয়তো এরকমই হওয়া উচিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। কিন্তু আমি তো ওদের মতো করে ছোট থেকে বড় হইনি, তাই আমার পদে পদে নিজের ভুল চোখে পড়ত। আমার দাবি-দাওয়া ছিল বেশি। আর একটা কথা, আমাদের দেশে যেমন সাধারণত বিয়ের পরই ছেলেমেয়েদের প্রথম সেক্সের অভিজ্ঞতা হয় ওখানে তো তা নয়। অল্পবিস্তর যৌন অভিজ্ঞতা ওখানে প্রায় সকলেরই বয়ঃসন্ধিতে ঘটে যায়। অন্তত যৌনতার কারণে বিয়ে সেখানে আবশ্যিক নয়। বিয়ে হচ্ছে কমপ্যানিয়নশিপ, সঙ্গ, বন্ধুত্ব—যা বলো। সবই আবার পারস্পরিক সম্মান ও অধিকার বজায় রেখে। সে ভারী জ্বালা হয়েছিল আমার। তাকে ভালও বাসতাম খুব, সেও বাসত, কিন্তু পরস্পরের গভীরে যাওয়ার কোথায় যেন বাধা হচ্ছিল। উই হ্যাড রিলেশন, বাট উই ওয়্যার নট রিলেটিভস। তুমি ঠিক বুঝবে না। সোজা কথা, আমার ভিতরকার একটা ভারতীয় মনোভাবই সব ভণ্ডুল করছিল। আর সেই মনোভাবটাই আমাকে ওখানে পাকাপাকিভাবে থাকতে দেয় না। কেবলই বলে—মন, চলো নিজ নিকেতনে।।

রাস্তাটুকু ফুরিয়ে গেল চট করে। লক্ষ্মণ গলিতে ঢুকবে, তার আগে সোমেনকে বড় রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বলল—অনেক কথা বলে ফেললাম, এসব মনে রেখো না।

সোমেন হেসে বলল—সেই যাই বলুন, আমার কিন্তু আপনার মতো হবে না। আমি আমেরিকায় গেলে ঠিক ওদের মতো হয়ে যাব।

—বটে! বলে লক্ষ্মণ হাসে খুব।

সোমেন বলে—আমাকে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করুন, জব ভাউচার দিন, দেখবেন আমি কীরকম ওই লাইফ অ্যাডপ্ট করে নিই।

—তা হলে তো তোমাকে কিছুতেই যেতে দেওয়া যায় না। লক্ষ্মণ ট্যাক্সির দরজাটা বন্ধ করবার আগে বলল—খুব যদি যেতে ইচ্ছে করে তা হলে একটু সিরিয়াসলি ভেবে আমাকে বোলো, চেষ্টা করব।

এই বলে লক্ষ্মণ দরজা বন্ধ করে দিল। ট্যাক্সি মোড় নিল। সোমেন রাস্তাটা পার হতে হতে বুকের মধ্যে বহুদূর ছুঁয়ে আসা সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে টের পেল। তার চেতনার বেলাভূমি ভেসে যাচ্ছে। যাওয়া হবে কি? বড় বেশি অল্পের মধ্যে আটকে আছে সোমেন। জীবনটা বড় ছোটের মধ্যে ছবির ফ্রেমে আটকানো। ফ্রেমটা ভাঙা দরকার। লক্ষ্মণদার মনে থাকবে তো?

আজকাল বর্ষার মেঘ কেটে গেলেই কেমন আচমকা চারধারে একটা শরৎকালের আভা এসে পড়ে। চারদিকে একটা পুজোর আয়োজন। এসময়ে গ্রাম গঞ্জে নদীর ধারে কাশফুল আসছে, শিউলি ফুটি-ফুটি করছে। কলকাতাতেও বাতাস বৃষ্টির পর পরিষ্কার। আকাশের ময়লা ধুয়ে গভীর নীল দেখা যায়। মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে যায়।

বাস থেকে নেমে বালিগঞ্জ সারকুলার রোডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সোমেন সিগারেট ধরাল। আর তক্ষুনি মনে পড়ল, মা বলেছিল খাবার দিয়ে বড়দির বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ারটা ফেরত আনতে। বাসায় একটা বৈ দুটো টিফিন ক্যারিয়ার নেই। কাল ফের খাবার দেওয়ার দরকার হলে কে তখন টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে যেতে আসবে? মা খুব রাগ করবে হয়তো।

কিন্তু এই চব্বিশ পূর্ণ পঁচিশে-পা জীবনে বেশিক্ষণ টিফিন ক্যারিয়ারের চিন্তা মাথায় থাকতে চায় না। কত আনন্দে শিউরে ওঠার মতো আচমকা চিন্তা মাথা ভাসিয়ে দিয়ে যায়। অনিল রায়ের বাড়িতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় দেখা হাজার হাজার সুন্দর দৃশ্যের ছবি চোখের সামনে বৃষ্টিপাতের মতো ঝরে পড়ছে! চারদিকে শরৎকালের মতো আলো। একটা রহস্যময় সিনেমার টিকিট। সব মিলিয়ে বড় অদ্ভুত আজকের দিনটা। এক-একটা দিন আসে এরকম। খুব ভাল দিন।

মেট্রোতে আজ কার সঙ্গে দেখা হবে?

অন্যমনস্ক সোমেন পিছনে একটা মোটরের হর্ন শুনে ফুটপাতে উঠে এল। গাড়িটাও তার পাশাপাশি ধীরে ধীরে হাঁটছে। সোমেন ভেবেছিল, গাড়িটা থামবে বুঝি। থামল না, চলছিল।

সোমেন সম্বিত পেয়ে তাকিয়ে দেখল, গাড়ির জানালায় অণিমা তারদিকে তাকিয়ে খুব হাসছে।

—কার কথা ভাবছ সোমেন? উঠে এসো।

গাড়িতে একা অণিমাই, সামনে শুধু ড্রাইভার।

—ওঃ, তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। বলে সোমেন উঠে বসল অণিমার পাশে।

রাজ্যের মার্কেটিং করেছে অণিমা, স্তূপাকার সব জিনিস পড়ে আছে সিটে, সিটের পিছনে পিছনের উঁচু থাকটায়, সামনের সিটেও।

—বাব্বাঃ, কতক্ষণ ধরে হর্ন দিচ্ছি, শুনতেই পাচ্ছিলে না? কার কথা ভাবছিলে সোমেন?

—তোমার কথা।

—বাজে বোকো না, কোনওদিন ভাবোনি।

—সত্যি বলছি। তোমাকে ছুঁয়ে—

বলেই চমকে গেল সোমেন।

অণিমা অমনি তার একখানা অপরূপ রঙিন, সুন্দর ডৌলের হাত বাড়িয়ে বলল—ছোঁও। ছুঁলে কিছু হয় না। জাত যায় না।

—দূর! আমি ওসব ভাবিনি। আমার মনে হল, তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে লাভ কী? তুমি আমার কে?

অণিমা মুখ টিপে হেসে বলে—এ জন্মে তুমি আমার কেহ নও অমরনাথ, কিন্তু যদি পরজন্ম থাকে—

সোমেন মুখ তুলে অণিমার চোখে চোখ রেখে বলল—কিন্তু যদি পরজন্ম না থাকে অণিমা? এ জন্মেই যদি শোধবোধ হয়ে যায়?

—বোলো না সোমেন, বোলো না।

সোমেন ভ্রূ কুঁচকে বলে—বলা হল না অণিমা। এখনও চাঁদটাঁদ ওঠে, ফুলটুল ফোটে, লোডশেডিংও হয় মাঝে মাঝে…

অণিমা হাসল।

সোমেন হঠাৎ বলল—আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি অণিমা।

—ওমা! কেন?

—দুঃখে, এদেশে কেউ পাত্তাই দিল না। নিজের ভ্যালুয়েশনটাই বুঝতে পারলাম না।

অণিমা চোখ বড় বড় করে বলে—কেউ দেয়নি?

সোমেন হেসে ফেলে, বলে—তুমি একটু দিয়েছিলে, তারপর সুট করে কেটে পড়েছ, সেটাই তো দুঃখ।

—ইয়ারকি হচ্ছে?

সোমেন প্যান্টের পকেট থেকে খামটা বের করে হাতে রেখে বলে—অণিমা, বাড়িতে কদিন ধরে একটা ক্রাইসিস চলছিল বলে আসতে পারিনি, ভেবেছিলাম, তুমি বুঝি চলে গেছ।

অণিমা পা নাচিয়ে পা-তোড়ার একটা ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে বলল—বিয়ের প্রথম বছরে শ্বশুরবাড়িতে শ্রাবণের জল মাড়াতে নেই। তাই শ্রাবণ মাসটা কাটিয়ে যাচ্ছি।

সোমেন অবাক হয়ে বলে—এটা কি শ্রাবণ মাস অণিমা, আশ্বিন নয়?

অণিমা সেই ইউনিভার্সিটির সময়কার মতো হেসে বলে—তুমি আমেরিকা যাওয়ার আগেই আমেরিকান হয়ে গেছ। বাংলা মাস জানো না। আজ পয়লা ভাদ্র, আমি কাল চলে যাচ্ছি।

সোমেন বলল—খুব লাকি অণিমা। তুমি চলে গেলে একটা ঋণ শোধ হতে আবার দেরি হত।

—কীসের ঋণ?

—সে তুমি বুঝবে না। বলে খামটা অণিমার কোলে ফেলে দিয়ে বলল—এটা আমার আড়ালে খুলো, আর আমাকে এখানে নামিয়ে দাও।

অণিমা খামটা খুলল না, কেবল হাতে ছুঁয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বলল—আমি জানি সোমেন এতে কী আছে।

সোমেন একটু লাল হল। এখন তার হঠাৎ খুব লজ্জা করছিল। বলল—গাড়িটা থামাতে বলো।

—ঋণটা না হয় থাকত সোমেন, সব ঋণ শোধ করে ফেললে আমেরিকা গিয়ে তুমি সব ভুলে যাবে।

—ভুলব না অণিমা। সোমেনের গলাটা ধরে বসে গেল। কতকটা ফিসফিসানির মতো করে বলল—টাকা পয়সার প্রসঙ্গটা বড্ড বাজে, তবু বলি, ওই ঋণটা আমাকে বড় জ্বালাতন করত। কিছু মনে কোরো না।

অণিমা একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলল—তুমি ভীষণ বাজে হয়ে গেছ। এমন জানলে কক্ষনো ভাবই করতাম না তোমার সঙ্গে।

বলে অণিমা চোখে চোখ রেখে ম্লান হাসল। সোমেনের হাসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, তবু হাসল। বলল—থ্যাঙ্ক ইউ।

—কেন?

—খুব বেশি প্রশ্ন করোনি বলে। ঋণ শোধ করতে দিয়েছ বলে। আর, সারাজীবন ধরে ভাববার জন্য আমাকে একটা অদ্ভুত আচমকা জিনিস দিয়েছিল বলে!

অণিমার বাড়ির দরজার কাছে নেমে চলে এল সোমেন। মনটা বড় খারাপ লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *