॥ পঞ্চাশ ॥
মাটির উঠানে সাদা রোদ পড়ে আছে। ধান সেদ্ধ করার জোড়া উনুন, বড় মেটে হাঁড়ি কয়েকটা। ঝিঙে মাচানে ফুলের যুদ্ধু লেগে গেছে। ভিতরের ঝুঁঝকো আঁধারে উঁকি দিলে দেখা যায় সুঠাম শিশুরা ফুল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
মাটির দোতলা বাড়ি। ওপরে খোড়ো চাল। উঠানে পা দিতেই মণ্ডলরা তিন ভাই খবর পেয়ে বেরিয়ে এল। সঙ্গে ছেলেপুলে। সব উপুড় হয়ে পড়ল পায়ে। মুখে ভক্তি মেশানো হাসি।
ব্রজগোপাল হাতজোড় করে বলেন—সব ভাল তো?।
—আপনার যজমান, ভাল রাখবেন তো আপনি। মোজোভাই একথা বলল। বি-এ পাস ছেলে, ইস্কুলে পড়ায়।
কথাটা শুনে ব্রজগোপাল খুশি হন। বাড়ির মায়েরা সব আসে। বড় বড় ঘোমটা, দূর থেকে না ছুঁয়ে প্রণাম করে। বাড়িতে একটা চাপা আনন্দের বিদ্যুৎ খেলা করছে।
বড় ভাইয়ের গায়ে কাপড়ের খুঁট জড়ানো। গোটা কয় শশা তুলে আনল পটাপট বাগান থেকে। মুখখানা হাসিতে ভিজে আছে। কপালে কণ্ঠায় ঘাম। মমতার চোখে চেয়ে থাকেন ব্রজগোপাল। এইসব তাঁর মানুষ। তাঁর সম্পদ। বুড়ো বামুনের নাম দিয়ে বেড়ান তিনি। বদলে এঁদের পান। আর কিছু নেই।
দোতলার মাদুর পেতে দেওয়া হয়েছে বারান্দায়। ব্রজগোপাল কাঠের মই বেয়ে উঠে এলেন। পোঁটলাটা পাশে রাখলেন। বাচ্চা একটা ছেলে পাড় লাগানো হাতপাখা টানতে লাগল বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। অন্য হাতে ঢিলে পেন্টুল সামলাচ্ছে।
—পুরনো তেঁতুল চেয়েছিলেন সেবার। মনে করে আনলাম। বলে ব্রজগোপাল পোঁটলার মুখ খুলে শালপাতায় জড়ানো আফিঙের মতো কালো পুরনো তেঁতুল বের করে দেন। শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে, মুখে দিলে টক লাগে না, মিষ্টি।
—বড় মণ্ডল অবাক হয়ে বলে—মনে রেখেছেন! আমিই তো ভুলে গেছি।
—তোদের ভুলো মন, কাজেকম্মে থাকিস। আমার তো ভুললে চলে না, তোদের নিয়ে কারবার। তোর খুকির একটা সম্বন্ধও এনেছি। বাশুলী গাঁয়ে।
বড় মণ্ডল একটু ইতস্তত করে বলে—এখানেও একটা ছিল। গয়লা ঘোষ। নিজেরা প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
ব্রজগোপাল একবার তাকান। বড় মণ্ডল চুপ করে যায়। ব্রজগোপাল ধীর গম্ভীর স্বরে বলেন—ওসব মাথা দিবি না। বিয়ে দেওয়ার মালিক তুইও না, আমিও না। বর্ণাশ্রম ভাঙবি কেন? যোগেযাগে এই ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশ-দেশান্তর, কত বিয়ে ঘটাচ্ছি, এ বড় পুণ্যকর্ম, ঠিক ঠিক বিয়ে ঘটালে দেশের কাজ হয়। ঘটকরা একসময়ে ভাল বামনুই ছিল। বর্ণে, গোত্রে, শিক্ষায়, চরিত্রে ঠিক বিয়েটি ঘটিয়ে দিত। সেইসবের জন্যই জাতটা এতদিন টিকে গেল। ঘটকালিতে পয়সা ঢুকে সর্বনাশ। বাশুলী গাঁয়ের পাত্রও ভাল, তোদেরই স্বঘর মাহিষ্য।
লোকটা তর্কটর্ক, কী প্রতিবাদ জানে না। একগাল হাসল, বলল—আজ্ঞে।
ওই হাসিটুকু দেখে ব্রজগোপাল ভরসা পান। দু-মাস তিন-মাস ফাঁক দিয়ে এলে দেখেন ব্যাটারা রাজ্যের অনাচারী কর্ম করে বসে আছে। সব ঠিকঠাক করে মেরামত করে দিয়ে যান। মানুষ যন্ত্রটাই সবচেয়ে গোলমেলে। বিগড়োলে, ভুল কাজ করে যেতে থাকে। তাই বার বার আসতে হয়। ঘুরে ঘুরে আসেন, ঘড়ির কাঁটার মতো। তবে গেঁয়ো লোক, বিশ্বাসটা বড় সরল। খুব বেশি খাটতে হয় না পিছনে। ধর্মভয়ে কথা মেনে চলে।
হাত পা ধুয়ে দু-টুকরো শশা মুখে দিয়ে বিশ্রাম করছেন। উনুনে আগুন দিয়ে দুটো ফুটিয়ে নেবেন একটু বাদে। দোলনায় একটা বাচ্চা ঘুমোচ্ছে। অন্য একটা মেয়ে দোলাচ্ছে দোলনাটা। ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ আসে। বীজমন্ত্র জপে একটু বাধা হয়। তারপর বীজমন্ত্রের স্পন্দনটা আপনই দোলনার শব্দের সঙ্গে মিলে গেল। চার অক্ষরী বীজমন্ত্রটা আর দোলনার ক্যাঁচকোঁচ শব্দ, এই দুইয়ে যেন একটু লড়াই চলল খানিক। তারপর দোলনার শব্দটা মিলিয়ে গেল। কলকাতার স্বামীচরণ মুখুজ্জে তার হাওড়ার লোহার কারখানায় একটা লোককে কুড়ি টাকা বেশি মাইনে দেয়। কারণ নাকি, লোকটা যখন হাতুড়ি পেটায় তখন সেই শব্দের মধ্যে স্বামীচরণ বীজমন্ত্রের ধ্বনি শুনতে পান। ব্যাপারটা এখন বুঝলেন ব্রজগোপাল।
সেজো মণ্ডল এক আণ্ডিল ডাব কেটে নিয়ে এল। ডাব কেটে কেটে এগিয়ে দেয়। ব্রজগোপাল দুটো ডাব খেয়ে বলেন—ও নিয়ে যা।
—এ ক’টা খাবেন না?
—পাগল নাকি! দশটা ডাব খেলে পেটে সহ্য হবে না।
—আগে কিন্তু খেতেটেতে পারতেন। বলে মেজো মণ্ডল দুঃখিত চিত্তে নিজে গোটা চারেক খেল, একটু ফিরে বসে।
আকাশের দিকে মুখ করে যোজন জুড়ে পড়ে আছে চিতেন ঠাকুর। চিত হয়ে পড়ে থাকে বলেই ব্রজগোপাল ওই নাম দিয়েছেন। লোকে বলে মা-বসুন্ধরা, ব্রজগোপাল বলেন চিতেন ঠাকুর। শনির মতো বদমেজাজি দেবতা। বুক চিতিয়ে পড়ে থাকে বটে ভালমানুষের মতো, কিন্তু বুকখানার মধ্যে নানা রসিকতার বাসা। ফুক করে শ্বাস ছাড়লেন তো বীজ ছাই হয়ে গেল, আবার চোখের ইশারায় মেঘ তাড়িয়ে আনলেন ভেড়ার পালের মতো, ভাসালেন সেবার।
মণ্ডলদের বুড়ো বাপ এখনও বেঁচে। খবর পেয়ে মই বেয়ে উঠে এল। রোগা মানুষ। বয়সের যেন গাছপাথর নেই। উবু হয়ে সামনে বসে পড়ল। আজকাল একটু ভীমরতি হয়েছে। বলল—ছেলেরা বোরো চাষ দিয়েছে। মানা শুনল না। মাঠ দেখে এসেছেন? সব লাল হয়ে গেল। বীজধানটাই নষ্ট।
ব্রজগোপাল ব্যাপারটা জানেন। খরায় তিনটে-চারটে বড় পুকুর যখন মজে এসেছে তখন তাইতে বোরো লাগিয়েছিল মণ্ডল ভাইরা। বোরো চাষে জল লাগে। তাই খুব বুদ্ধি খাটিয়ে মজা পুকুরে চাষ দিয়েছিল। তলানি জলটুকু চোঁ করে টেনে নিয়েছে চারাগাছ। তারপর এখন শুকনো টনটনে হয়ে খরখর শব্দ তুলছে হাওয়ায়। বহেরুর মতো বড় চাষা এরা নয় যে পাম্পসেট কিনবে, কী ডিপ টিউবওয়েল বসাবে। আগের বার ব্রজগোপাল দেখে গেছেন তিন পো পথ দূর দিয়ে খাল গেছে। সেখান থেকে খাত কেটে আনা যায়। বড় মণ্ডল বলল—তা অন্যের জমির ওপর দিয়ে নালা কাটতে দেবে কেন?
ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন—জমির মালিকদের বলেকয়ে দেখেছিস? সবার সঙ্গেই কী তোদের ঝগড়া নাকি?
বড় মণ্ডল মাথা চুলকে বলেছিল—তা বলিনি বটে। কিন্তু লোকের মন বুঝি তো, জমি ছাড়বে না।
ব্রজগোপাল বলেছিলেন—ছাড়বে। ছাড়াতে জানতে হয়। তোরা ব্যাটা কেবল স্বার্থের সময়ে লোকের খোঁজ করিস। এমনিতে খবর বার্তা নিস না। নিজেদের সামলাতে ব্যস্ত। পরের জন্য তোর যদি কিছু করা থাকে তো দরকারেও পরেই এসে বেগার দিয়ে যাবে। পাঁচহাত জমি ছাড়া তো কোনও ত্যাগই না। যা গিয়ে লোককে বোঝা গে, জল আনলে তাদেরও জমি সরেস হয়। আর বছর সীতাশাল ধান করা চাই।
কিন্তু কোথায় নালা! কোথায় কী? বোরো গেছে, বৃষ্টি না হলে বড় চাষও যাবে। চিতেন ঠাকুরের মতলব এবার ভাল না। টেরা চোখে চায় যদি! পরিবেশটা অনুকূল করে নিলে মানুষের কষ্ট থাকে না। প্রকৃতির সবদেওয়া আছে, মানুষে মানুষে আড় হয়ে সব নষ্ট করে। এইটে কতবার বুঝিয়েছেন, ওরা ভুলে যায়। লোককে সেবা দিয়ে সাহায্য দিয়ে নিজের মানুষ করে নিতে হয়। পরিবেশের রসকষ টেনে বেঁচে আছিস, পরিবেশটাকে রসস্থ রাখতে হবে না? নইলে ছিবড়ে হয়ে গেলে পরিবেশ তো রস ওগরাবে না, বাঁচবি কাকে নিয়ে?
বুড়ো মণ্ডল কপালে হাত চেপে কোঁকানির শব্দ করতে করতে বলে—আপনার চিতেন ঠাকুর আমাকে স্বপ্নে দেখা দেয়। বলে, মাটির সতীত্ব নাশ করেছিস হারামজাদা, ফসলে বিষ দিলি, নিজেরাই খেয়ে আস্তে আস্তে মরবি। তা বাবামশাই, পোকাও লাগে বটে। জন্মে এত পোকা দেখিনি।
ব্রজগোপাল বিরক্তির শব্দ করেন। চিতেন ঠাকুরের আর কাজ নেই, বুড়ো মণ্ডলকে স্বপ্নে পেয়ে গুহ্যকথা সব বলতে গেছেন। তবু ওর মধ্যে একটু সত্যি কথা আছে।
বুড়ো মণ্ডল বলে—ভয়ানক স্বপ্ন বাবা। শশা কাটছি তাতে পোকা বিজবিজ, আলু কাটছি তো পোকা বিজবিজ, রসাল চেহারার ঝিঙে কাটলুম তো ভিতর থেকে ঝুরঝুরিয়ে পোকা বেরিয়ে গেল হাসতে হাসতে। এই স্বপ্ন। তারপর দৌড়ে এসে দোলনার খোকাটাকে তুলতে গিয়ে দেখি তারও চোখে কানে নাকে মুখে পোকা থিকথিক করে ধরেছে। কী ভয়ানক বলুন দিকি। ওই যে সব কেমিকেলি সার দেয়, কলের লাঙল দিয়ে চাষ, বিষ ছড়ায়, ও হচ্ছে চিতেন ঠাকুরের বুকে হাঁটু দিয়ে ফসল আদায়। ওইতেই ঠাকুর ক্ষেপে যান। পচানো সার, বৃষ্টির কি খালের জল, কাঠের লাঙলে হেলেবলদ—এই হল গে লক্ষ্মীমন্ত চাষ। জোর করে ফসল ফলালে মাটি রক্ত উগরে দেয়। ভাল হয় না তাতে। না কি বলেন?
ব্রজগোপাল হাসেন। পুরনো দিনের লোক বুড়োমণ্ডল। সেই হেলেবলদে চাষ ভুলতে পারে না। তবে পোকার উপদ্রব বাড়ছে বটে। কেমিক্যাল সারের জন্যই।
জলের ব্যবস্থা একটা করে দিয়ে যেতে হয় এবার। বড় ভাইকে ডেকে বলেন—জলের কী করলি?
—উরেব্বাস, জল নিয়ে মারামারি। খাল থেকে জল চুরি যাচ্ছে। সেই নিয়ে মারদাঙ্গা। আমরা সে সবে গেলাম না এবার। বোরোটা ক্ষতি হল।
জলের কথাটা সারাদিন বসে ভাবেন ব্রজগোপাল। এই বুদ্ধিহীন যজমানগুলি ভেসে না যায় দুর্দিনে। গ্রাম ঘুরে কথাটথা বলেন লোকজনের সঙ্গে। লোকের তেমন গা নেই। যে যার ধান্ধায় আছে।
পরের দিন বড় আর ছোট দুভাই ব্রজগোপালকে তুলে দিতে এল বাসরাস্তায়। বাসের দেরি আছে, ব্রজগোপাল দুভাইকে দুদিকে নিয়ে বসেন গাছতলায়। বলেন—চাষবাস যো হোক গে, মানুষকে বুকে ঠেসে ধর, মানুষগুলোকে যদি অর্জন করতে পারিস তো তোদের ভাত উপচে পড়বে, এই বেলা মেখে ফ্যাল বাবা, একটু মিষ্টি কথা, একটু, হাসি, একটু দরদ সিঁচে সিঁচে দিয়ে মেখে ফ্যাল মানুষগুলোকে। খুব আকাল যখন আসবে তখন পাশে দাঁড়ানোর মতো জন পাবি।
—আকাল কি আসবেই?
—আসবেই।
ইদানীং কী হয়েছে। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। বাস গোবিন্দপুরমুখো চলেছে। কিন্তু কেবলই সেই খুপরিতে গিয়ে উঠতে একটা অনিচ্ছা হতে থাকে। মাঝরাস্তায় শিবপুরে নেমে পড়েন। এখানেও যজমানদের বাড়ি। দিন সম্পূর্ণ হয়ে সন্ধ্যা লাগছে। তবু কিছু চিন্তা হয় না। পৃথিবীটা বেশ বড়সড় হয়ে উঠছে আজকাল। মাধ্যাকর্ষণ কি বেড়ে গেল এক লহমায়? মাঝে মাঝে ভাবেন, শেষ দিনটা আসার আর বুঝি দেরি নেই। তাই এত মায়া ভাবতে এখন আনন্দই হয়। মরে যেতে তেমন কষ্ট হবে না। তবে কাজ ঢের বাকি রয়ে যাবে না কি?
একটা ঢিবির উপর উঠে দাঁড়ান তিনি। বেশ জায়গাটা বাঁ ধারে একটা বাঁশবন। অবিকল পুজোর ঘণ্টার শব্দ করে একটা ঘন্টানাড়া পাখি ডেকে চলেছে। তপ্ত দিনের শেষে ঝিল থেকে ভাপ উঠে আসছে। তাতে জোলো গন্ধ। নিথর জলে একটা ডিঙি দাঁড়িয়ে আছে। তাতে একটা কালো মানুষ পিঁপড়ের মতো দাঁড়িয়ে, তার পিছনেই গলিত সোনার ঝোরা গলে গলে জলে মিশে যাচ্ছে। কী অপরূপ সন্ধ্যা। ব্রজগোপাল দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা ফোটা দেখেন। ওই যে মেঘখণ্ডের ওপর তারা, ব্রাহ্মীমানুষেরা ওইরকম।
দু-দিনের নাম করে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এলেন সাত দিন পরে।
বাড়ির হাতায় পা দিতে না দিতেই বহেরুর নাতি এসে হাঁটু পেঁচিয়ে ধরল—ও দাদু, একটা ধাপানী লাট্টু কিনে দেবে?
বাচ্চা সবে বেড়ে উঠেছে। ব্রজগোপালকে পেলে আর ছাড়তে চায় না। গায়ে গায়ে পুলটিশের মতো লেগে থাকে। কোথা থেকে সব আসে, কোন শূন্য থেকে শরীর ধারণ করে। জন্মে এক লহমায় পৃথিবীতে চারদিকে মায়ার আঠা মাখিয়ে দেয়। এই সেদিনও এটা ছিল না, আর আজকে কী গভীরভাবে আছে!
ব্রজগোপাল ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলেন—দেব রে দাদা।
—মুকুন্দর দোকানে পাওয়া যায়।
—দেবখন। হাত মুখ ধুই, কাপড়-টাপড় ছাড়ি, কী লাট্টু বললি?
—ওই যে সুতো বাঁধা চাকতি, ছুঁড়ে দিলে ফের হাতে চলে আসে পালটি খেয়ে।
—বটে! তাজ্জব জিনিত তো!
ছেলেটা করুণ মুখ করে বলে—কিনে দেবে?
—তুই আমাকে কী দিবি তোর বদলে?
—পুজোর ফুল তুলে দেব সকালে। সাদা ফুল।
—যে ছড়াগুলো শিখিয়েছিলাম, বল তো! মনে আছে?
ছেলেটা একগাল হেসে মাথা নাড়ে। গম্ভীর হয়ে দাঁড়ায়। একটু দোল খেয়ে বলে—মানুষ আপন, টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর। ধর্মে সবাই বাঁচে বাড়ে, সম্প্রদায়টা ধর্ম না রে। মাতৃভক্তি অটুট যত, সেই ছেলেই কৃতী তত। মুখে জানে, ব্যবহারে নাই, সেই শিক্ষার মুখে ছাই। বাঁচা বাড়ার উলটো চলে, ম্লেচ্ছ জানিস তাদের বলে।
আরও চলত। ব্রজগোপাল থামালেন। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দোরগোড়ায় এসে পড়েছেন, ছেলেটা বলল——দাদু, তোমার মা বড় রাগী।
—কে রাগী? ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করেন।
—তোমার মা। কাল এসেছে তো! তোমার ঘরে আমার সব খেলনাপত্র রেখেছি, যতবার নিতে যাই বকে দেয়। আর একটা মোটা মানুষ এসেছে, সেও ভারী রাগী। হাসে না।
ব্রজগোপাল বুঝতে পারলেন না কে এসেছে। মা? মা সেই কবে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।
কপাট ভিতর থেকে বন্ধ। শেকল নাড়া দিলেন ব্রজগোপাল। বুকের মধ্যে কেমন একটা উলটো রক্তস্রোত বইছে। কে এল! কে এল!
—কে? একটু গম্ভীর বয়স্কা নারীকণ্ঠ সাড়া নেয়।
ও স্বর ভুলবার নয়। কতকাল বাদে এতদূর আসতে পারল মানুষটা। কোনওদিন আসবে না, ভেবেছিলেন ব্রজগোপাল।
—আমি। বলতেই গলার স্বর একটু কেঁপে গেল। প্রদীপের শিখা যেমন দোল খায়।
ননীবালা দরজা খুলে সামনে থেকে সরে গেলেন। ঘোমটা টেনে কপাল ঢেকে বললেন—এই এলে?
—হুঁ।
—আমি আর রণো কাল থাকে বসে দুর্ভাবনায় মরে যাচ্ছি। দু-দিনের নাম করে সাত দিন! এরকমই চলছে বুঝি আজকাল? দেখার কেউ নেই।
ব্রজগোপাল ঘরে ঢুকে দেখেন, তাঁর বিছানায় রণেন ঘুমোচ্ছে। একবার তাকালেন সেদিকে। তারপর ননীবালার দিকে ফিরে বললেন—কে থাকবে?
ননীবালা মুখটা ফিরিয়ে নিলেন।
॥ একান্ন ॥
ঠিক দুপুর বেলাতেই সুভদ্র আসে আজকাল। দুপুরটাই নিরাপদ সময়।
শীলার ইস্কুলের গ্রীষ্মের বন্ধ শেষ হয়ে এল। দুপুরে সে ঘুমোয় না ঠিক। শুয়ে থাকে। ঘুমোবে কি? পেটের মধ্যে ছেলেটা ফুটবল খেলছে সব সময়ে। কলকল করে জল নড়ে। ছেলেটা মায়ের শরীরের মধ্যে সাঁতরায়। ছেলেটা কি খেলোয়াড়ই হবে, নাকি সাঁতারু। এই ছেলে জন্মাবে, বড় হবে, বিয়ে করে বউ আনবে। ভাবা যায়? শীলা নিজের মুখ চেপে ধরে। মনটাই অলুক্ষুণে, উঠে পড়ে। ঘরদোরে ঘুরে ঘুরে জিনিস নাড়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখে, একটু হাঁটাচলা করে। আর ক’টা দিন। তারপর ইস্কুল খুললে দুপুরটা আর একা লাগবে না।
লাগেও না। সুভদ্র প্রায়ই আসে৷ কড়া নাড়ে না। বাইরে থেকে এ রকম শিসের শব্দ করে। দোর খুলে প্রায়ই শীলা বিরক্ত ভাব করে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। বলে—ও কী অসভ্যতা। শিস দিয়ে ডাকে কেউ? পাঁচজনে কী মনে করবে?
পাঁচজনের মনে করাকরি নিয়ে ভাবতে বয়ে গেছে সুভদ্রর। সে একথা শুনে কেবল হাসে। দাড়িটাড়ি বড় একটা কামায় না, মাঝেমধ্যে গালে ঝোপঝাড় গজায়, চুল বেড়ে হিপি হয়ে যায়। ইচ্ছে ক’রে করে না এসব, আলসেমি ক’রে করে। সাজুক বা না সাজুক, দাড়ি থাক বা নাই থাক, ও জানে সব অবস্থাতেই ওকে দারুণ সুন্দর দেখায়। গার্লস স্কুলে ওকে চাকরি দেওয়াটা খুব বিপজ্জনক কাজ হয়েছিল।
শীলা ওকে বাইরের ঘরে বসিয়ে শোওয়ার ঘরে চলে আসে। আয়নায় মুখখানা দেখে। কী শ্রী হয়েছে! চেনা যায় না। পেতনি একটা। চুলটা ফেরায়, মুখটা মুছে নেয়, পাউডারের পাফটা একটু বুলিয়ে নেয়, ব্লাউজটা পালটায় কখনও-সখনও। এটুকু করতেই হয়। মনে পাপ নেই। তবু।
ধৈর্যশীল সুভদ্র ততক্ষণ বসে থাকে। শীলা ফের ঘরে আসতেই বলে—কেস্ পাচ্ছি না এজেন্সিটা চলে যাবে।
—খাটতে হয়।
—খাটি না নাকি! সারাদিন ঘুরছি। গোটা কয়েক বড় কনসার্নে স্যালারি সেভিংস ধরতে পারলে খুব কাজ হত। কিন্তু কোনও জায়গাতেই চান্স পাচ্ছি না। সব জায়গায় আগে গিয়ে কে যেন কাজটা অলরেডি করে ফেলেছে। আমি লেট লতিফ।
শীলা মৃদু হেসে বলে—দুপুরে রোজ তো এখানে এসে আড্ডা হয়। ঘোরেন কখন?
সুভদ্র বলে—ইস্, রোজ নাকি? তাহলে আর বরং আসব না৷ উঠি।
শীলা পা নাচায়। নিশ্চিন্ত মনে বলে—রোজ না হোক, প্রায়ই।
—ঠিক আছে, আর আসব না।
—আসতে কে বারণ করেছে? এসে কাজের কথা তুলে গুচ্ছের মিছে কথা না বললেই হয়। আসলে এজেন্ট মানে তো দালাল, ওসব করতে আপনার ভাল না লাগবারই কথা।
সুভদ্র হাসে, বলে—ভাল লাগে না কে বলল! ঘুরতে ঘুরতে কত লোকের সঙ্গে আলাপ হয়! বেশ লাগে।
—তবে হচ্ছে না কেন?
—হবে কী করে! যাঁদের পলিসি করার তারা সব তিন চারটে করে পলিসি করে ফেলেছে। যারা করেনি তারা অন প্রিন্সিপল করবে না। তার ওপর এখন ব্যাঙ্কে রেকারিং ডিপোজিট-টিট করে এল আই সি-র পপুলারিটি কমিয়ে ফেলেছে। বললাম না, আমি সব জায়গায় লেট লতিফ।
শীলা হারের লকেকটা মুখে তুলে বলে—তা হলে কী করবেন?
—ভাবছেন কেন? কিছু একটা হয়ে যাবে।
এই রকমই সব কথা হয়। নির্দোষ কথা। কেউ সাক্ষী থাকে না অবিশ্য। ঝি-মেয়েটা ঘুমোয়। পড়শিরা কেউ কান পাতে না। চারদিকে তবু কী যেন একটা ওত পেতে থাকে। লাফ দেবে, ছিঁড়ে খাবে। ঘরসংসার ভেঙে ফেলবে। বাতাসে তড়িৎক্ষেত্র রচিত হয়।
ভাল নয়। ভাল নয়। তবু কী ভীষণ ভাল!
কদিন আগে শীলার স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হয়ে গেল। গার্ড দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু মুশকিল হল, আজকাল মেয়েরা পরীক্ষা দিতে যখন আসে তখন তাদের সঙ্গে আসে ছেলে-বন্ধু, প্রেমিক বা পাড়ার দাদারা। বাইরে থেকে তারা হামলা করে, শাসায়, স্কুলের ঘরে ঘরে এসে অনায়াসে ঢুকে যায়। বড় দিদিমণি যদিও খুব কড়া লোক, তবু এ এবস্থায় তেমন কিছু করতে পারেন না আজকাল। পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, তার মধ্যেই বাইরের ছেলেরা ঢুকছে স্কুলে, বাইরে থেকে নকল পাচার করছে ভিতরে।
সুভদ্রর তেমন কোনও কাজ নেই, তাই শীলা বড় দিদিমণিকে গিয়ে বলল—সুভদ্রকে গার্ড দেওয়ার জন্য ডাকুন না। ও তত বেকার বসে আছে। এক-আধজন পুরুষমানুষ থাকলে আমাদের সুবিধে হয়।
বড় দিদিমণি রাজি হলেন, এবং সুভদ্র গার্ড দিতে এল।
পরীক্ষার গার্ড দেওয়া বড় একঘেয়ে কাজ। কেবল ঘুরে বেড়ানো, কাগজ দেওয়া, স্টিচ করা, আর মাঝে মাঝে মৃদু ধমক দেওয়া। সময় কাটে না। কিন্তু সুভদ্র এল বলে চমৎকার কাটছিল সময়টা। যে তিনটে স্কুলে সিট পড়েছিল তার মধ্যে দুটো স্কুলই সুভদ্রর পাড়ার। প্রায় সবকটি মেয়ে ওকে চেনে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার তিন দিনের দিন সুভদ্র স্কুলে পা দিতেই চারদিকের মেয়েদের মধ্যে চাপা বিদ্যুৎ খেলে গেল। তারপরই ডাকাডাকি—মিন্টুদা, এদিকে আসুন। মিন্টুদা, কোশ্চেন বুঝতে পারছি না। মিন্টুদা জল খাব। এমনকী বাইরে যে সব ইতর টাইপের ছেলে রোজ এসে জড়ো হয় তারাও হকে নকে এসে সুভদ্রকে ডাকাডাকি করে, গোপনে কথা বলে, খাতির জমানোর চেষ্টা করে। সুভদ্র তাদের তাড়া দিলে চলে যায়।
পাড়ায় যে সুভদ্রর যথেষ্ট প্রতিপত্তি তা বুঝতে কষ্ট হয় না। মেয়েরা পরীক্ষা দিতে দিতেও অনেকে মুখ তুলে সুভদ্রর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতের হাসি হাসে, ছলে ছলে তাকে ডাকে, অকারণে কথা বলে। শীলার ভিতরটা জ্বালা করে ধিংগী মেয়েদের কাণ্ড দেখে। কী নির্লজ্জ বাবা! কোমরে আঁচলের আড়ালে, ব্লাউজের ফাঁকে সব বইয়ের পাতা, চোথা কাগজ নিয়ে বসেছে। তবু সিকিভাগ মেয়ে লিখতেই পারছে না। কিছুই পড়েনি, কোথা থেকে টুকতে হবে তাও জানে না। কলম কামড়ে বসে থাকে তখনই তাদের কারও কারও সুভদ্রকে বড্ড বেশি দরকার হচ্ছে। মিন্টুদা, ও মিন্টুদা।
অবশেষে শীলা একদিন ঠাট্টা করে বলল—মিন্টুদা, আপনি হল্,-এর বাইরে থাকুন। নইলে বড্ড মিস ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে।
সুভদ্র গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলে—দোহাই, ওদের একটু লিখতে-টিখতে দিন। ওদের অনেকের একমাত্র ভরসা হায়ার সেকেন্ডারির সার্টিফিকেটখানা। আপনারা কড়া হলে ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
শীলার এটা সহ্য হয় না। ডিসিপ্লিন জিনিসটাকে সে বুক দিয়ে ভালবাসে। স্কুলে তারা ভীষণ ডিসিপ্লিন মেনে চলে। ক্লাস ফুরিয়ে গেলেও সবাই সাড়ে চারটে পর্যন্ত স্কুলে থাকে, আগে বেরোয় না। অ্যানুয়েল পরীক্ষার পর যখন ক্লাস থাকে না, তখনও তারা স্কুলে বসে এগারোটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত উল বোনে, গল্প করে, তবু আগে চলে যায় না। মেয়েদের ব্যাপারেও তাই। ইউনিফর্ম ঠিক না থাকলে, ক্লাস-ওয়ার্কের খাতা না আনলে, কিংবা এ-রকম সামান্য কোনও ত্রুটি বিচ্যুতি হলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।
সুভদ্রর উদার নীতি দেখে তাই শীলা রেগে গিয়ে বলে—আপনাকে ডেকে আনাই ভুল হয়েছিল সুভদ্র।
সেই রাগ থেকেই শীলা একদিন একটা মেয়ের খাতা কেড়ে নিল। বের করে দিল ঘর থেকে। মেয়েটা প্রথমে শীলার সঙ্গে তর্ক করল, তারপর মিন্টুদার খোঁজ করল। সুভদ্র ছিল নীচের তলার ঘরে, তাই তাকে ডেকে না পেয়ে সোজা গিয়ে বাইরের ছেলেদের কাছে নালিশ করল। তারপরই ইস্কুলে ঢিল পড়তে শুরু করে, সেই সঙ্গে শাসানি। মেয়েটার গার্জিয়ান পরিচয় দিয়ে এক বয়স্কা মহিলা দুজন ছোকরাকে নিয়ে এসে শীলাকে ঘিরে কী তম্বী! সেই হাঁকডাক শুনে হেডমিস্ট্রেস উঠে এলেন, অন্য দিদিমণিরাও। কিন্তু মিটমাট করতে পারছেন না। এমন সময় সুভদ্র উঠে এল। শীলাকে সরিয়ে নিজে দাঁড়াল প্রতিপক্ষের মুখোমুখি। দুমিনিটে মিটিয়ে দিল ব্যাপারটা। মেয়েটি ফের এসে বস্ল পরীক্ষা দিতে।
ইস্কুলে একটা ছোট্ট ঘর আছে তিন তলার ল্যাবরেটরির পাশে। তাতে মেয়েদের গান বাজনা শেখার বাদ্যযন্ত্র থাকে, প্রাইমারি সেকশনের অফিস হয় সকালে। সেই ঘরে এসে শীলা টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছিল। কী অঝোর কান্না! সেই মেয়েটা বা তার গার্জিয়ানের ওপর ততটা নয়, যতটা রাগ বা অভিমান তার সুভদ্রর ওপর। ও কেন এসে মাঝখানে পড়ল? ওর জন্যই তো নষ্ট হচ্ছে পরীক্ষা, আবহাওয়া দূষিত হয়ে যাচ্ছে।
একা ঘরে কাঁদতে কাঁদতেই টের পেল সুভদ্র এসেছে। ওর লজ্জা সংকোচ কিছু কম, সাহস বড্ড বেশি। পিঠে অনায়াসে হাত রাখল সে, বলল—এ মা, ছি ছি! কাঁদছেন কেন?
শীলা এক ঝাপটায় হাত সরিয়ে দিয়ে ফণা তুলে বলল—আপনি যান। আর ভালমানুষ সাজতে হবে না।
সুভদ্র গেল না। উলটোদিকের চেয়ারে বসল মুখোমুখি। শীলা কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অভিমানের বান ডেকেছে বুকে। কান্না কি ফুরোয়? টেবিলের ওপর তার পড়ে-থাকা একখানা হাত দুহাতে ধরে সুভদ্র গাঢ় স্বরে বলল—ক্ষমা চাইছি, লক্ষ্মী মেয়ে। কাঁদে না। আপনি বরং আমাকে একটা চড় মারুন, বা যা খুশি করুন। তবু প্লিজ শান্ত হোন। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না যে দিনকাল পালটে গেছে! যে কোনও স্কুলে গিয়ে দেখে আসুন, সকলের চোখের সামনে আনফেয়ার মিনসে চলছে। আপনি আমি ঠেকাব কী করে!
শীলা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। মুখ তুলে বলল—আপনি ঠেকাচ্ছেন না কেন? আপনাকে তো ওরা চেনে, মানে।
সুভদ্র চুপ করে চেয়ে রইল একটু। তারপর চমৎকার দীনতার হাসি হেসে বলে—ওটা আপনার ভুল ধারণা। ওপর ওপর খাতির দেখাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু যদি আমি কড়া হওয়ার চেষ্টা করি সঙ্গে সঙ্গে মস্তানদের ছুরি বেরোবে, বোমা ফাটবে। আপনি তাই চান?
না শীলা তা চায় না। তবু চুপ করে অভিমানভরে বসে রইল। উত্তর দিল না।
সুভদ্র ফের বলে—তা ছাড়া, আমি ওদের প্রতি সিমপ্যাথিটিক। জানি তো আমাদের এডুকেশনটা একটা ফোর্স। সেই প্রহসনের স্বরূপটা এবার লোকে ভাল করে জেনে যাক। দেশ-বিদেশে রটে যাক, এ দেশে শিক্ষার নামে কী চলছে। আপনি বাধা দেবেন না।
শীলা আর বাধা দেয়নি। বরং গার্ড দেওয়ার ছলে ঘুরতে ঘুরতে সুভদ্রর সঙ্গে আড্ডা মেয়েছে করিডোরে, বারান্দায়, তেতলার নির্জন ঘরে। মেয়েরা সুভদ্রকে ডাকলে খুব বিরক্ত হয়েছে। কী এত কথা ওদের সুভদ্রর সঙ্গে! কেবল মিন্টুদা, আর মিন্টুদা!
বলেছে—মেয়েরা আপনাকে অত খোঁজে কেন?
সুভদ্র হাসে, বলে—হিংসে হচ্ছে?
কী অকপট কথা! হিংসে! হিংসেই তো। শীলা তাই লজ্জায় লাল হয়।
সুভদ্র তখন বলে—পাড়ায় সবাই চেনে, তাই ডাকে। জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে নেয় আর কী, পড়াশুনো তো করে না।
বড্ড বেশি উদার আপনি।
ভীষণ অসভ্য হয়ে গেছে সুভদ্র আজকাল। সাহসও বেড়েছে। প্রশ্রয় পায় তো। তাই দিব্যি চোখ হেনে বলল-কারও উদারতা বাড়ছে, কারও উদর।
শুনে শীলা লুকোবার পথ পায় না। হাতে একটা সাবমিট করা খাতা ছিল, পাকিয়ে হাতে নিয়ে ঘুরছিল, সেইটি দিয়ে ঠাস ঠাস মারে সুভদ্রকে। আর তখন একটা তাৎক্ষণিক আবেগে সুভদ্র একটা কাণ্ড করে ফেলেছিল, স্কুলের মধ্যে। চারদিকে লোকজন। তিনতলার নির্জনতা খুবই ক্ষণভঙ্গুর তখন, যেকোনও সময়ে লোকজন চলে আসতে পারে। তবু দুরন্ত পুরুষটি দু-হাতে খামচে ধরল কাঁধ, বুকের মধ্যে টেনে নিল। শীলা ঢেওয়ের মতো পড়ে গেল বুকের মধ্যে। তারপর তীব্র বিস্ময় অসহ্য একটা ধাঁধার মধ্যে সুভদ্রর জ্বরতপ্ত শুকনো ঠোঁট একপলকের জন্য স্পর্শ করেছিল তার গাল। শীলা পালিয়ে এসেছিল।
পরে দেখা হতে বলেছিল—আপনার সঙ্গে আর মিশব না।
সুভদ্র যথেষ্ট লজ্জিত, ভীত। চোখে আনত দৃষ্টি। খুব ভয় পেয়েছে। শীলা মনে মনে খুশি হল। কিন্তু ওর অত ভয়ের কী? ‘মিশব না’ কথাটা মুখের কথা মাত্র, কি কি ও বোঝে না? শীলার মুখে যে প্রশ্রয়ের হাসি, চোখে যে উজ্জ্বল দৃষ্টি তা কি অন্য কথা বলে না!
সুভদ্র আসে ঠিক দুপুরবেলায়। প্রচণ্ড গরমের দুপুর। বসে থাকে দরজা জানালা বন্ধ- করা শীলাদের ঠান্ডা বৈঠকখানায়। শীলা মুখোমুখি। রাজ্যের আজেবাজে কথা হয় দু-জনের। যা বলে না তা বুঝে নিতে কারও অসুবিধে হয় না।
শীলা জানে, শীলা ওকে ভালবাসে। ভীষণ ভালবাসে। বলে না। দরকার হয় না। সুভদ্র জানে সুভদ্র ওকে ভালবাসে। বলে না। দরকার কী?
অজিত আজকাল বড্ড ব্যস্ত। অফিসে তেমন কাজকর্ম নেই। আজকাল খুব ম্যাজিকের শো করার ডাক পায়। কথা ইংরেজি, হিন্দি আর বাংলায় আজকাল অনর্গল ম্যাজিকের প্যাটার বলে যেতে পারে। ‘শো’ করে স্কুল-কলেজে, ক্লাবে, পাড়ায়। বার দুই খবরের কাগজে ছোট্ট করে তার ম্যাজিকের খবর বেরিয়েছে। সবাই বলে, এবার নিউ এম্পায়ার বা আকাদেমি হল ভাড়া করে নিজের শো করতে। তাতে বড় করে খবর বেরোবে, জাতে উঠে যাবে। অজিতের ইচ্ছে করে না।
ম্যাজিক দেখানোর খবরটা কোন চিঠিতে যেন লক্ষ্মণকে লিখেছিল অজিত।লক্ষ্মণ জাহাকে এক প্যাকিং বাক্স ভরতি ম্যাজিকের জিনিস পাঠিয়েছে। নানারকমের তাস, জাম্বো কার্ড, হরেক অ্যাপারেটাস। সেইসঙ্গে কালো একটা ম্যাজিসিয়ানের স্যুট, টুপি সমেত। কাস্টমস থেকে বাক্সটা চাড়িয়ে এনে গলদঘর্ম হয়ে কদিন জিনিসগুলো নিয়ে ম্যাজিক অভ্যাস করল সে। কিন্তু বড্ড ক্লান্তি লাগে। তার ভাগ্য কেন তাকে ম্যাজিসিয়ান হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেন? জনতার সামনে দাঁড়িয়ে অবিরল মুখস্ত প্যাটার বলে যেতে যেতে, চোখমুখের নানা মেধাবী ভঙ্গি করে অবিরল ম্যাজিক দেখাতে তার ইচ্ছে করে না। তবু দেখাতে হয়। আজকাল সে ম্যাজিক দেখালে টাকা পায়। গত বছর পর্যন্ত পঞ্চাশ-ষাট টাকা পেত একটা ‘শো’য়ে। এ-বছর দুশো তিনশো টাকা না চাইতেই অগ্রিম দিয়ে যায় তোক। এও একটা ঝামেলা। টাকা দিলে ফেরানো যায় না। নিতে হয়। টাকার প্রয়োজন তো ফুরোয় না কখনও। কিন্তু ওই টাকাটাই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে ম্যাজিকের সঙ্গে। কিন্তু জীবনের কোথাও কোনও ম্যাজিক নেই, রহস্য নেই। সব রহস্য যেন তার জানা হয়ে গেছে। তাই বিস্বাদ।
॥ বাহান্ন ॥
কুমুদ বোস একদিন বলেছিল—ম্যাজিসিয়ান, তুমি শালা কী আর ম্যাজিক জানো? কুমারস্বামীর কাছে নিয়ে যাব তোমাকে একদিন, ব্যোমকে যাবে। তার হাতের পাঁচ আঙুলে গ্রহ-তারা নড়েচড়ে।
অজিত আগ্রহ বোধ করে না। কুমারস্বামীর কথা সে আগেও শুনেছে। অফিসের অনেকেই তার কাছে যায়। সেনদা এম এসসি পাশ, সায়েন্স কলেজে রিসার্চ করত, সেও একদিন এসে বলেছিল—ওরকম সিদ্ধপুরুষ দেখিনি। মিনিস্টার, বড় বড় মার্চেন্ট, ফিলমের লোকজন সব মাছির মতো জমে আছে। আমি ঘরে ঢুকতেই নাম ধরে ডেকে বলল— এতদিনে আসার সময় পেলি?
অজির হেসেছে। ভারতবর্ষে সিদ্ধপুরুষদের সংখ্যা ইদানীং খুব বেড়ে গেছে। তাদের গ্ল্যামার এখন সবয়েচে বেশি। তাদের কেউ ভোটে যদি দাঁড়ায় তো পি-এম পর্যন্ত হেরে যাবে। অবশ্য ভোটে দাঁড়ানোর দরকার হয় না, ভোটে জিতলে যা পাওয়া যায় তারা তার একশো গুণ পেয়ে যাচ্ছে ভক্তদের কাছ থেকে। টাকা, যশ, ভক্তি। এদের রবরবা যত বাড়ছে তত বোঝা যাচ্ছে যে জাতটার মেরুদণ্ড কত নমনীয়, ভঙ্গুর। জনসাধারণের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন চোর, একজন ফাঁকিবাজ, তৃতীয়জন মস্তান। শতকরা হিসেব করলে পুরো একজনকেও পাওয়া যাবে না যে সৎ এবং চরিত্রবান। এই সব লোভী, স্বার্থপর, হৃদয়হীন মানুষদের সব সময়ে বিবেক পরিষ্কার রাখার জন্য সিদ্ধপুরুষরূপী একটা খুঁটির দরকার হয়। সেইখানে নিজেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ইচ্ছেমত চরে বেড়ায়। যে যতবড় ম্যাজিকওয়ালা সে তত বড় মহাপুরুষ। ম্যাজিক না দেখালে লোকের ভক্তি টসকে যায়।
এইসব কথা অজিত যখন বলে তখন কুমুদ বোস ভারী চটে যায়। সে একসময়ে গোবরবাবুর কাছে নাড়া বেঁধে কুস্তি শিখেছিল। হাতের গুলি দেখানোর জন্য হাফহাতা জামার হাতাও অনেকখানি গুটিয়ে তুলে রাখে। প্রকাণ্ড স্তম্ভের মতো হাত দু-খানা টেবিলের ওপর প্রদর্শনীর জন্য রেখে বলে—পাপ কথা মুখে আনবে তো ঝাপড় মারব। পি সি সরকারেরও একজন ধর্মীয় গুরু ছিলেন, সেটা জানো?
অজিত মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলে—বোসদা, কটা কথা খুব ধীরস্থির ভাবে জেনে রাখুন। একনম্বর, ভগবান বলে কোথাও কিছু নেই। দু-নম্বর, একবার মরলে আর কেউ জন্মায় না। তিন নম্বর, ধর্ম হচ্ছে ব্ল্যাক মার্কেটিং, ভেজাল ঘুষ এসবের মতোই আর একটা জোচ্চুরি।
—আর, তুমি যে পলিটিক্স করতে সেটা জোচ্চুরি নয়? তুমি যে ম্যাজিক করো, সেটা জোচ্চুরি নয়?
অজিত একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলে—বটেই তো, পলিটিক্স যে জোচ্চুরি তা সবাই জানে। তবু করতাম কেন জানেন? জোচ্চোরদের সঙ্গে লড়বার জন্য ওটাই সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্র। আর আপনারা জানেনই না যে জোচ্চোরদের পাল্লায় পড়ে যাচ্ছেন। তফাতটা এখানেই। আমি যে ম্যাজিক করি, সেটাও একরকম লোক ঠকানো জোচ্চুরিই। লোকে জেনেশুনেও পয়সা খরচ করে দেখতে আসে। সে তবু ভাল। আমি তো ম্যাজিক দেখানোর সময়ে বলেই দিই যে ম্যাজিকে মন্ত্র-টন্ত্র কিছু নেই, সবই হাত সাফাই। আপনার কুমারস্বামীর সে কথা বলার সাহস আছে?
কুমুদ বোসের চেহারাটা যেমন, বুদ্ধিটা তেমন নয়। তর্কে ঠিক যুৎ করতে পারে না সে। মাথা গরম করে চেঁচামিচি শুরু করে দেয়। তখন সবাই বলে—অজিতের সঙ্গে তুমি পারবে কেন বোসদা? ইউনিয়ন করে করে ও তর্কে পাকা হয়ে গেছে। তার ওপর বারেন্দ্র। ওদের মহা কূটবুদ্ধি।
অজিত টের পাচ্ছিল সে যত তর্কই করুক, ইদানীং কুমারস্বামীর একটা হাওয়া বইছে অফিসে। দুজন চারজন করে কুমারস্বামীর ভক্ত বাড়ছে। যারা সাতদিন আগেও ঠোঁট বেঁকিয়েছে তারা আজ গুজ গুজ ফুস ফুস করে কুমারস্বামীর মিরাকলের গল্প করছে। দু-চারজন তাকেও এসে ভজাবার চেষ্টা করে। খুবই ঠান্ডা চোখে তাকায় অজিত, ঠান্ডা গলায় কথা বলে। তারা সরে পড়ে।
শীলার বন্ধু সুভদ্র নামে সেই ছেলেটা দু-চারবার অফিসে এসে দেখা করে গেছে। বার দুই এসেছিল কমিশনের জন্য। তারপর একদিন এসে বলে—অজিতদা, আপনার তো অনেক জানাশুনো। আমাকে একটা অফিস বা স্কুল-কলেজ যাহোক স্যালারি সেভিংস ধরিয়ে দিন। সিংগল পলিসি করিয়ে লাভ হয় না।
ছেলেটার চেহারাটা এত সুন্দর যে চট করে মায়া বসে যায়। অজিত তাই ছেলেটাকে এড়িয়ে যায়নি। সেনদা একটা স্কুলের সেক্রেটারি, তাকে ধরে স্যালারি সেভিংস করিয়েও দিয়েছে। ওই সূত্রেই ছেলেটার সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠতা। সুভদ্র কার্ল মার্কস-এর ভক্ত, অজিতও তাই। খানিকটা প্রশ্রয় অজিত তাকে দেয়। অফিস থেকে ফিরে কখনও-সখনও দেখে সুভদ্র বাইরের ঘরে বসে আছে, খুশি হয়েছে অজিত। ছেলেটাকে তার ভাল লাগে।
আবার এও ঠিক তার মনের মধ্যে একটা কাঁটা মাঝেমধ্যে খচ করে বেঁধে। ছেলেটাকে বড্ড বেশি পছন্দ করে শীলা। নইলে সুভদ্র যেদিন আসে সেদিন শীলার একটু সাজগোজ কেন? খুব বেশি কিছু নয়, তবু অজিত ঠিকই লক্ষ করে, শীলার মুখে হালকা ফাউন্ডেশন মেক-আপ লাগানো, ঠোঁটে পিলস্টিকের বিলীনপ্রায় রং পরনে একটু বেশি নির্লজ্জ ব্লাউজ, শাড়িটা সাধারণ হলেও পাটভাঙা, চুল এলো খোঁপায় বাঁধা, চোখে কাজল। সুভদ্রর সামনে ও একটু বেশি বড় বড় করে তাকায়, একটু বেশি ধীরে চলাফেরা করে, একটু বেশি সুরেলা গলায় কথায় বলে। এগুলো টের পাওয়া যায়। শীলা ওই সময়টায় আটপৌরে থাকে না।
সন্দেহটা প্রথমে মাঝেমধ্যে উঁকি মারত, তারপর নানা ভাবনা চিন্তা, কাজকর্ম আর ম্যাজিকের দমকা হাওয়ায় উড়ে যেত মন থেকে। কিন্তু ওই একফোঁটা বিষ—ও কখনও ফিকে হয় না। দিনে দিনে ঘনীভূত গাঢ় হয়ে ওঠে, ছড়ায়। একদিন নয়, বেশ কয়েকবারই অজিত অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে। কিছু তেমন দেখতে পায়নি। প্রতিদিনই যে সুভদ্র ছিল, তাও নয়। দুদিন ছিল, কিন্তু ওরা দুজন দুদিকে বসে গল্প করছিল মাত্র। বেশ কয়েকবার অফিস কামাই করেও লক্ষ্য করেছে অজিত। মাঝে মাঝে আসে সুভদ্র। রোজ নয়।
একদিন শীলাকে বলল—ও এসে ওরকম শিস দেয় কেন বাইরে থেকে?
শীলাও বিরক্ত হয়ে বলেছে—দেখ না। ওইরকমই স্বভাব। কতবার বারণ করেছি, শোনে না।
শিস দিয়ে ডাকে। খুব সরলভাবে হাসে। চমৎকার কথা বলে। আর ওই সুন্দর চেহারা, যা দেখলে পুরুষেরও বুকে মায়া জন্মায়! ভাবতেই গায়ে একটা শিরশিরানি ওঠে অজিতের। বুকে ভয়। আর একটা কূট তীব্র সন্দেহ মাঝে মাঝে সাপের দাঁদের মতো ঝিকিয়ে ওঠে বিষভরা। শীলার পেটে যে বাচ্চাটা….!
একদিন বলল—সেনদা, আপনি তো বায়োলজিক্যাল সায়েন্স পড়েছিলেন, না?
সেনদা মাথা নেড়ে বলেন—পড়েছিলাম। সেসব কিছু মনে নেই।
—হেরিডিটি ব্যাপারটা কী বলুন তো!
সেনদা হেসে বলেন—তোমার কার্ল মার্কস কী বলেন? হেরিডিটি কি তোমরা তেমন মানো?
অজিত চিন্তান্বিত মুখে বলে—মার্কস অবৈজ্ঞানিক ছিলেন না। যা মানা যুক্তিসঙ্গত তা মানতেন।
কুমারস্বামীর ব্যাপার থেকে সেনদা অজিতের ওপর একটু চটা। মাঝে মাঝে মার্কসকে খুঁচিয়ে কথা বলেন। কিন্তু অফিসের অন্য সকলের মতোই সেনদাও মার্কস-বিষয়ে কিছুই জানেন না, কথা বললেই বোঝা যায়। শুনে শুনে সবাই মার্কসিজম বা কমিউনিজিম সম্পর্কে এক একটা মনগড়া ধারণা সৃষ্টি করে নিয়েছে। সেই ধারণা থেকেই তর্ক করতে আসে, আর হেরে যায়।
সেনদা একটু বুদ্ধি রাখেন, তর্কে না গিয়ে বললেন—তুমি কী জানতে চাও?
—ছেলে বাপের কাছ থেকে কী কী পায়। রক্ত? স্বভাব? সংস্কার?
সেনদা হেসে বলেন—সেই হেরিডিটি আর এনভিরনমেন্টের প্রশ্ন তুলবে নাকি? তা হলে একটা কথা বলে নিই। সেদিন রিডার্স ডাইজেস্টে একটা হিউমার পড়ছিলাম, একজন বলছে—হেরিডিটি আর এনভিরনমেন্ট বিচার করা খুব সোজা। তোমার সন্তানের মুখে যদি তোমার আদল থাকে তবে সেটা হল হেরিডিটি, আর যদি তোমার সন্তানের মুখে তোমার প্রতিবেশীদের কারও আদল থাকে তবে তা হল এনভিরনমেন্ট।
কথাটা শুনেই অজিদ কেমনধারা হয়ে গেল। হাসির কথা, তবু সে হাসলও না তেমন। খুব অন্যমনস্ক আর অস্থির লাগছিল তার। সেনদা কিছু জেনে বলেনি, তবু তার মনের কোন গুপ্ত গভীরে ঠিক এইরকমই একটা প্রশ্ন ছিল। শীলার পেটের বাচ্চাটা…।
কোনওকালে কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে যায় না অজিত। হঠাৎ এক রবিবারে একা বেরিয়ে পড়ল। বহুদূর পর্যন্ত একা একা ঘুরল সাবারবান ট্রেনে উঠে, বাসে, হেঁটে। মনটা বড় অস্থির। ঘুরে ঘুরে সে অনেক ভাবল। আর ভাবতে ভাবতে হঠাৎ টের পেল, পৃথিবীতে লক্ষণ ছাড়া তার আর একটাও আপনার জন নেই। এমন একটা লোক নেই তার নিজস্ব যার কাছে মনের সব দুঃখ বেদনার কথা, সব সন্দেহ ক্ষোভ আর হতাশার বীভৎস চেহারাটা খুলে দেখানো যায়। এই চল্লিশ বছর ধরে প্রতিদিন সে কত মানুষের সঙ্গে মিশেছে, কত ঝগড়া ভালবাসা হয়েছে, তবু কেউ লক্ষ্মণের মতো আপন হল না, ওই যে শীলা, যার দেহের আনাচকানাচ পর্যন্ত তার মুখস্ত হয়ে গেছে, যার আলজিবের স্বাদটি পর্যন্ত তার জানা, তাকেও কত কথা গোপন করে চলতে হয়। পৃথিবীতে এখন এমন একজন মানুষকে তার চাই যে তার হৃদয় থেকে ওই সব বিষ হরণ করে নেবে। তাকে শুদ্ধ করবে। লক্ষ্মণ ছাড়া আর কে আছে? কিন্তু লক্ষ্মণ কত দূরে! কত ভীষণ দূরে। সে যেন মৃত্যু নদীর পরপার এক বিদেশ। কবে আসবি লক্ষ্মণ?
লক্ষ্মণের শেষ চিঠিটা এসেছে নিউইয়র্ক থেকে। খুব বেশি কিছু লেখা নেই। তবু একটা খুব জরুরি খবর লুকিয়ে আছে চিঠিটায়। লক্ষ্মণ নিউইয়র্কে একটা পেল্লায় ভাল চাকরি পেয়েছে, কানাডায় আর ফিরবে না। কিন্তু ওর বউ কানাডায় ফিরে গেছে, সে নাকি নিউইয়র্ক সহ্য করতে পারেনি। এটাই সবচেয়ে জরুরি খবর। এমন নয় যে ওর বউ ছেড়ে গেছে চিরদিনের মতো, কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। তবু অজিতের প্রাণে একটা সুবাতাস লাগে। যদি তাই হয় তবে কি আবার দেশে ফেরার কথা মনে পড়বে লক্ষ্মণের? অজিতের কথা মনে পড়বে?
চিঠিটা সারাদিনে কতবার পড়ল অজিত! ছোট চিঠিটায় কত রহস্যময় সংকেত রয়েছে যেন। দুর্গ্রহগুলো সরে যাচ্ছে আকাশ থেকে, শুভগ্রহেরা সন্নিবেশিত হচ্ছে অজিতের ভাগ্যে। লক্ষ্মণ কি আসবে? চমকে ওঠে অজিত। সে তো ভাগ্য মানে না। তবু কি মানুষের সুসময়, দুঃসময় বলে কিছু নেই!
লক্ষ্মণের কথা ভাবতে ভাবতে শীলা আর সুভদ্রর কথা প্রায় ভুলেই গেল সে। কয়েকটা দিন লক্ষ্মণই রইল মন জুড়ে। খুব সুন্দর দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল সে লক্ষ্মণকে। লিখল…মেয়েমানুষদের কাছ থেকে আমরা কী চাই বলো তো! কিছু ঠিক পাই না। আমরা ভাবি, বউ বুঝি আমার নিজস্ব মেয়েমানুষ। কিন্তু তাই কি কখনও হয়? আমি এক খণ্ডিত মানুষ। ও-ও এক খণ্ডিত মেয়ে। আমাদের ভাঙা অংশগুলো যদি ঠিক ঠিক জোড় না মেলে তবে? আমি ওকে সব দিতে পারি না, ও-ও পারে না। কী করে তবে এক হই বলো তো!
গুছিয়ে লিখতে পারল না। কিন্তু আবেগ দিয়ে লিখল। অনেকটা। লিখে একরকমের স্বস্তি পেল।
তবু একধরনের অবিশ্বস্ততার ওপরে তার গড়া সংসার এখন দাঁড়িয়ে আছে। যে সন্তান আসছে মায়ের কোল জুড়ে—সেই বা কে? এই কঠিন ক্রুর প্রশ্নের কোনওদিন সঠিক উত্তর হয় না। তাই অজিত বড় অস্থির। কেবলই সিগারেট খায়। ঘুরে বেড়ায়। অফিসের পর অনেকক্ষণ বসে তাস খেলে, কাজ করে, রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না। খাওয়া কমে গেছে। ঘুম কমে গেছে। যতটুকু সময় বাড়িতে থাকে ততক্ষণ অবিরল ম্যাজিকের পর ম্যাজিক দেখায় একা-একা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে—সোরসারার ওঃ সোরসারার ইউ আর নট গড। তারপর মাথা নেড়ে বলে—আমার ওপর নেই ভুবনের ভার…। এক প্যাকেট তাস খুলে সে নিজেকে দেখায়, বাহান্নখানা তাস রয়েছে, পলকে সেই তাসটাই আবার উলটোবাগে মেলে ধরে দেখায় বাহান্নখানা তাসই এক, হরতনের বিবি। বিদেশি ম্যাজিক কার্ড। লক্ষ্মণ পাঠিয়েছে।
অজিতকে আজকাল বড় ভয় পায় শীলা। খুব নরম গলায় কথা বলে, খুব ভদ্র ব্যবহার করে। যেন অতিথি সজ্জন কেউ। মাঝে মাঝে বলে—তোমার কী হয়েছে বলো তো!
—কী হবে! অফিসে বড্ড কাজের চাপ।
—শরীর ভাল আছে তো?
—ভালই।
শীলা আর বেশি কথা বাড়ায় না। তাদের সম্পর্ক এইরকমই। কখনও আদরে সোহাগে উজ্জ্বল, উচ্ছল। কখনও বা তারা পরস্পর প্রায় অপরিচিত। নিস্পৃহ।
—ম্যাজিসিয়ান, চলো একবার কুমারস্বামীর কাছে তোমাকে নিয়ে যাব। কুমুদ বোস একদিন বলল।
অজিত খুব অন্যমনস্ক মুখ তুলে হঠাৎ হেসে বলল—যাব। আজই চলুন। বলেই উঠে পড়ল।
॥ তিপ্পান্ন ॥
ঘর-সংসারের যে ছবিটা হারিয়ে গিয়েছিল সেটাই কি ফিরে পেলেন ব্রজগোপাল!
গেঁয়ো ছুতোরের তৈরি দুটো ভারী চৌকি ঘরে এনে ফেলেছে বহেরু। তোশক, মশারি, চাদর, বালিশ, সবই জোগাড় করে এনেছে। ফাঁকা ঘরটা সংসারের সামগ্রীতে ঠাসাঠাসি। ব্রজগোপাল দেখেন।
ননীবালা বলেন—একটা দুটো দিনের জন্য এত ঝামেলা করছিস কেন বহেরু? মাটিতে খড়ের গদি পেতে দিবি শোওয়া যায়।
বহেরু চোখ কপালে তুলে বলে—একটা-দুটো দিন কি বলেন মা! তেরাত্তির কম সে কম থেকে যেতে হবে। কর্তামশাই একাবোকা পড়ে থাকেন, ওইভাবে জীবনটা কেটে গেল। এসে যখন পড়েছেন মা দুর্গা, একটু সব সিজিল মিছিল করে দিয়ে যান। ওঁর দেখবার কেউ নেই, আমাদের ছোঁয়া জলটুকু পর্যন্ত খান না। রোগেভোগে বড় মুশকিল।
ননীবালা উত্তর করেন না। এ লোককে কে দেখবে! কার দেখার তোয়াক্কা করেছে লোকটা?
হা ক্লান্ত ব্রজগোপাল পুকুর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আহ্নিক সেরে নিয়েছেন। শুদ্ধবস্ত্রটা ছাড়ছেন এমন সময় মাথায় আধ-ঘোমটা দিয়ে ননীবালা পাথরের বাটিতে কাটা পেঁপে সাজিয়ে আনলেন।
—খাও।
—এই কি খাওয়ার সময়!
—তবে কখন খাবে?
—এ সময়ে খাই না, একেবারে রাতে খই দুধ খাব।
ননীবালা একটা শ্বাস ফেললেন, বহুকাল ঘর করেননি, তাই লোকটার অভ্যাস-টভ্যাসগুলো জানা নেই। বললেন—না খেয়ে-খেয়ে শরীরটা যাচ্ছে।
—খেয়েই যায়। একটা বয়সের পর খাওয়ার সংযম ভাল।
—আমার হাতে রান্না খাবে তো! নাকি ছোঁয়া বারণ আছে?
উদাসভাবে ব্রজগোপাল বলেন—খাওয়া যায়।
রণেন ঘুম থেকে উঠল সন্ধ্যা পার করে। এখানে ফ্যান নেই, ঘরটাতেও বেশ গুমোট, তবু বহুকাল বাদে রণেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। বড় এক শিশুর মতো ঘুম-চোখে উঠে বাবার দিকে চেয়ে রইল একটু। চোখ কচলে ফের দেখে একগাল হেসে বলল-বাবা!
ব্রজগোপাল উঠে এলেন কাছে। পিঠে হাতখানা রেখে বললেন—শরীরটা কেমন লাগে বাবা? ভাল?
রণেন মাথা নেড়ে বলে—ভাল।
—তুমি বড় ভাল ছেলে বাবা। সংসার তোমাকে নষ্ট করছে।
রণেন চেয়ে থাকে বাবার দিকে। চোখে এখনও অবোধ ভাব। বলে-বাবা, এবার আমাদের কাছে চলুন।
ব্রজগোপাল একটু বিষন্ন হেসে বললেন—কেন, তোমরা কি সেখানে খুব সুখে আছো?
রণেন কথাটা হয়তো বুঝতে পারে না। হয়তো পারে, বলে—আপনাকে কে দেখবে এখানে?
ব্রজগোপাল শ্বাস ফেলে বলেন—বাপকুসোনা, আমাকে দেখার জন্য তো লেকের দরকার নেই, বরং তোমাদেরই দেখাশোনা করার মানুষ চাই।
অনেকদিন বাদে রণেন বুদ্ধি খাটিয়ে একটা কথা বলতে পারল। বলল—সেইজন্যই তো আপনি যাবেন। আপনি না দেখলে কে দেখবে আমাদের?
ব্রজগোপাল একটু হাসলেন, বললেন—আমার ভালমন্দের বুঝ কি তোমাদের বুঝের সঙ্গে মেলে? দুদিন পর যখন মিলবে না, তখন আবার সম্পর্ক নষ্ট হবে। এই বেশ আছি। আমাকে বাবা ডাকার লোক আছে, এইটুকু জেনেই সন্তুষ্ট আছি।
—যাবেন না? করুণস্বরে রণেন জিজ্ঞেস করে।
—দূরে তো থাকি না। একদৌড়ের রাস্তা। যখনই মুশকিলে পড়বে তখনই চলে আসবে আমার কাছে। আমিও তো যাই মাঝে মাঝে।
দুঃখিত চিত্তে রণেন ঝুম হয়ে বসে রইল। ননীবালা বাইরে গেছেন। রণেন হঠাৎ জলভরা চোখ তুলে বলে—বাবা, সংসারে শান্তি নেই।
ব্রজগোপাল কথাটা আগেও শুনেছেন। একটু দৃঢ়স্বরে বললেন—শোনো। যেমন একটা সিঁড়ি, তা বেয়ে ওঠাও যায়, নামাও যায়, সংসারও তেমনি। তোমার বউ খারাপ তুমি ভাল, একথা আমার মনে হয় না। আসলে তোমরা দুজনেই ভালমন্দের মানুষ। জোড়টা ঠিক মেলেনি, তাই অশান্তি। হিসেব করলে আমিও সংসারকে শান্তি দিতে পারিনি, তাই পালিয়ে আছি। লোকে হাসে। তোমারও সংসার টানতে কত কষ্ট হয়েছে। অশান্তি আছে তো আছে, তুমি মনটা অন্যদিকে পেলে রাখো।
একদিন গায়ে হাত তুলেছিলাম বাবা।
ব্রজগোপাল তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধস্বরে বলেন—ও আর কোরো না। বলে গলাটা একটু নামিয়ে ব্রজগোপাল বলেন—আজকালকার মেয়েরা স্বামীকে পুরোপুরি একলা-একলি চায়, বুঝলে। স্বামীটা যে সংসার বা সমাজের একজন তা হিসেব করে না। কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। স্বার্থপরতার যুগ তো, নিজের বুঝ বুঝে নিতে চায়। তুমি ওরকম ভাবটা হয়ো না বাপকু। বউয়ের গালে ঠোনা মেরে আদর দেখাবে, তলে তলে নিজের কাজ সারবে। হাত পা চালালেই কি পুরুষসিংহ হওয়া যায় বাবা! বরং ওতে মেয়েমানুষ আরও বেহাত হয়ে যায়।
খানিক চুপ করে থেকে বলেন—বাবা যেতেন বিদেশে। সারাটা বছরই প্রায় বাইরে বাইরে কাটত। মা শতখানটা হয়ে সংসার চালাতেন। এখনকার মতো সব ক্ষুদে সংসার তো নয়। বিশ ত্রিশ পাত পড়ত এক-এক বেলায়। বলতেন, বিয়ে হয়ে এসে যেন সংসার সমুদ্রে পড়ে গেলাম। পরের ঘরের মেয়ে, তাকে তো কেউ ছেড়ে কথা কইবে না। মা দেখলেন, বেশ প্রতিকূল অবস্থা। কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্রী ছিলেন না। কোমর বেঁধে সবাইকে খুশি করতে লেগে গেলেন। শ্বশুর কেমন রান্না ভালবাসে, ভাসুরের কোনটা পছন্দ, দেওরদের কোনদিকে ঝোঁক। এই করতে করতে নামডাক ছড়িয়ে পড়ল। ঝগড়া করে নয়, লোকের প্রীতি অর্জন করে করে বছর খানেকের মধ্যে দেখা গেল সেজ-বউ না হলে কারও চলে না। তিনদিন বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারেন না, শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক গিয়ে হাজির হয়। নিজেও পারতেন না থাকতে। এইভাবেই দুবছরের মাথায় শাশুড়িকে পর্যন্ত বশ করে ফেললেন। বড় জায়েদের চপকে সংসারের কর্ত্রী হয়ে গেলেন। তখন বাবা বিদেশে থাকতে মার দেখেছি সব সময়ে সেই মানুষের চিন্তা। আমরা মায়ের মুখেই বাবার কথা শুনে শুনে মানুষটাকে চিনেছিলাম। তাঁর স্বভাব, চরিত্র, পরোপকারিতা সব। বাবা রাগী মানুষ ছিলেন, রাগটাগ করতেন বটে কিন্তু মা রা কাটতেন না। বাবাকে ঘিরে তিনি সম্মোহিত থাকতেন বেশ। সেই বাবাও মায়ের প্রশংসা করে বেড়াতেন পাঁচজনের কাছে। আমাদের শরীর স্বাস্থ্য এ সবের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি কখনও। মা কতগুলো নিয়ম আমাদের মন-সই করে দিয়েছিলেন। নাকে, মুখে হাত দিলে হাত ধোয়া, হাত পা না ধুয়ে ঘরে না-ঢোকা, পরিষ্কার থাকা—এমনি অনেক। আজও মেনে চলি। অসুখবিসুখ হলে মা গিয়ে পাতাটাতা বেটে ওষুধ করে দিতেন। ছেলেপুলেদের জন্য সজাগ থেকে থেকে তাঁর স্বাভাবিক জ্ঞান অনেক বেড়ে যায়। পরে দেখেছি, তাঁর কাছে ওষুধ নিতে পাড়ার বউ-ঝিরা এসে ভিড় করে। এক কাজ করতেন সারাদিন, তবু কখনও তাঁকে অপরিচ্ছন্ন দেখিনি, মাথার ঘোমটাটি পর্যন্ত খসত না। আর কী করে যে একা হাতে অত কাজ করতেন সে এক রহস্য। আর সব কিছুর মধ্যেও তাঁর ছিল বাবার চিন্তা। একটা দোলন-চাঁপা গাছ বাবা রুয়ে গিয়েছিলেন, সারা বছর সেটাতে জল দিতেন মা, আর প্রতিদিন তাতে জল দিতে গিয়ে তাঁর একটা ফুস করে শ্বাস বেরিয়ে পড়ত। বুঝলে বাবা, সেই মাকে দেখে আমি মেয়েমানুষ চিনেছি। তাই আমার সহজে মন ভরে না। কিন্তু মেয়েমানুষ দেখলে আজও মাথাটা নুয়ে পড়ে। মনটা ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। মায়ের কথা শুরু করলে আর থামতে ইচ্ছে করে না। রেলগাড়ির মতো কেবল কথা বেরিয়ে আসতে থাকে গলার নল বেয়ে।
ব্রজগোপাল সামনের দিকে চেয়েছিলেন, সেখানে একটা তাজমহলের ছবিঅলা বাংলা ক্যালেন্ডার। কিন্তু সেই ক্যালেন্ডার ভেদ করে বহু দূরে মগ্ন হয়ে আছে চোখ। বললেন—বাবা, পৃথিবীজোড়া ভিড় দেখছ, কিন্তু লক্ষ করে দেখো মানুষ কত কমে গেছে। কাজের মানুষ, চরিত্রবান মানুষ, ব্রাহ্মী মানুষ আর চোখে পড়ে না। স্ত্রীর ভিতর দিয়ে স্বামীই প্রসূত হয়, তাই স্ত্রীকে বলে জায়া। স্ত্রী সন্তানকে মেপে দেয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর টান ও গুণগ্রহণমুখরতা যতটা এবং যেমন, ততটুকু ও তেমনই সে পারে সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করতে। এটাই হচ্ছে পরিমাপ। তেমন বিয়েও হয় না, তেমন ভালবাসাও দেখি না। তাই ‘শ্রদ্ধাহীন’ প্রবৃত্তিপরায়ণ, ক্ষীণ মস্তিষ্ক আর প্রতিভাহীন মানুষে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে।
ননীবালা চা করে নিয়ে এলেন। রণেনকে দিলেন, ব্রজগোপালকেও।
ব্রজগোপাল একটু ইতস্তত করছিলেন দেখে ননীবালা বলেন—চা খাও না?
ব্রজগোপাল হঠাৎ উদার হাসি হেসে বলেন—দাও, করেছ যখন।
দরজার কাছে কোকা এসে দাঁড়িয়ে আছে। বলল—দাদাবাবু, বেড়াতে যাবেন না?
রণেন মাথা নাড়ল—যাব।
—চলেন। খালপাড় থেকে ঘুরে আসি।
কোকার সঙ্গে রণেন বেরিয়ে গেলে ব্রজগোপাল আর ননীবালা একা হলেন বহুকাল এ-রকম একা ঘরে দুজনের দেখা হয়নি।
বাতিটা একটু কমিয়ে ননীবালা চৌকির একধারে বসে আছেন। ব্রজগোপাল এখনও অন্যমনস্কভাবে চেয়ে আছেন সুমুখে। বেড়াল ঢুকে রণেনের এঁটো কাপটা চেটে পায়ের ধাক্কায় টং করে ফেলে দিয়ে গেল। শব্দটা কেউ খেয়াল করলেন না।
ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করলেন—হঠাৎ সব আসা হল কেন? জমিজমা সব বিক্রি করে দিতে নাকি! না ধানের দায় বুঝতে!
—তোমার তো ওসবই মনে হবে। আমি স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝি না নাকি!
ব্রজগোপাল ক্ষণেক চুপ করে থেকে বলন—সেও খারাপ কথা নয়, কেউ যদি তোমরা না-ই আসতে পারো তো বরং বিক্রি করে দেওয়া ভাল। আমি আর কদিন। বিক্রি করতে চাইলে বহেরুই কিনে নেবে।
ননীবালা ঘোমটাটা তুলে দিয়ে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বলেন—সে সব ভাবনা ছিল না।রণো তোমার জন্য হঠাৎ অস্থির হল। কী সব কু স্বপ্ন দেখেছিল, মুখে আনা যায় না। একবার চোখের দেখা দেখতে আসা।
—ভাল। ব্রজগোপাল বললেন।
—শরীর তো ভাল দেখছি না।
শরীর তো পুষে রাখার জিনিস নয়, কাজে লাগাতে হয়। সব সময়ে তেল চুকচুকে কি রাখা যায়?
—কাজ তো জানি। পরের গোয়ালে ধোঁয়া দিয়ে বেড়ানো।
—সেইটেই আসল কাজ। নিজের গোয়াল যদি না থেকে। ধোঁয়া তো দিতে হবে।
ননীবালা এই চুরি ছিনতাইয়ের দিনেও মোটা বালা পরেন, ছগাছা করে চুড়ি রয়েছে হাতে, গলায় একটা বিছে হার। গয়নাগাটির একটু শব্দ হল, শাড়ির মাড় খস খস করল, শ্বাসপ্রশ্বাসের একটু টান শোনা গেল। অর্থাৎ ননীবালা আছেন। এই অস্তিত্বটুকু কতকাল টের পাননি ব্রজগোপাল।
অন্ধকারে একবার ঠাহর করে ননীবালাকে দেখে ব্রজগোপাল বললেন—ছেলেরা সব কে কেমন?
—তোমারই ছেলে।
—বনিবনা করে থাকতে পারবে?
—কে! আমি, না ছেলেরা?-সকলের কথাই জিজ্ঞেস করি।
—আমার আর থাকার কী! বাড়িটা তুলতে যদি পারি তো দুভাগে ভাগ করে দিয়ে যাব, দুই ছেলে থাকবে।
—ভাগাভাগির কথা আগেভাগেই ভেবে রেখেছ?
—সেইটেই তো বুদ্ধির কাজ। বলে ননীবালা উঠে পিক ফেলে এলেন বাইরে। বললেন—আগে থেকেই ভাগাভাগি করে দেওয়া ভাল।
ব্রজগোপাল বললেন—তার মানে, তোমার ছেলেরা মানুষ হয়নি।
ননীবালা পুত্রগতপ্রাণ। এ কথার একটা কড়া উত্তর দিতেন। কিন্তু এমন সময়ে নয়নতারা বাইরে দরজার কাছে এসে ডাকল৷ ভারী মিষ্টি ডাকটি—মা!
—কী রে? ননীবালা উঠলেন।
—বাবা মাছ পাঠিয়ে দিল। রান্নাঘরে রেখে যাব?
—দেখি। ননীবালা বাতিটা তুলে নিয়ে গিয়ে দেখেন—ওমা! এ কত মাছ রে! এত খাবে কে?
—এই তো কখানা।
—তোদের বাপু বড্ড গেঁয়ো ভাব। বলেন ননীবালা। তবু খুশি ঝরে পড়ে গলায়। কলকাতার বাড়িতে আজকাল আর বড় মাছের টুকরো আসে না। রণেনটা বড় মাছ ভালবাসে। কিন্তু সোমেন নয়। সে কেবল মুরগি মুরগি করে পাগল। বললেন—রান্নাঘরে রাখো। আসছি।
ননীবালা ঘরে আলোটা রেখে চলে গেলেন রান্নাঘরে। রান্নাঘরই আজকাল ভাল লাগে তাঁর। সেখানে বসে নয়নতারাকে ডেকে বললেন—তুইও বসে থাক না, কথা বলি। তোর স্বামীটা নাকি আবার বিয়ে করেছে শুনলাম!….
ঘরে বসে ব্রজগোপাল সেই কথার শব্দ শোনেন। অদ্ভুত লাগে। ননীবালা পাশের রান্নাঘরে বসে কথা বলছেন, এ যেন ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। এ কি সম্ভব? এ কি হয়?
রাত্রিবেলা শোওয়ার সময় ননীবালা বললেন—ও বাড়িতে কী হচ্ছে কে জানে! একা বীণার হাতে সংসার।
—কী করবে? ব্রজগোপাল মাচানের বিছানায় শুয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেন।
—কালই চলে যাব।
—যেয়ো, ব্রজগোপাল বলেন। একটা শ্বাস চেপে রাখেন কষ্টে।
॥ চুয়ান্ন ॥
তিন বিঘের ওপর বহেরু একখানা বাগান করেছে। চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা ইটের দেওয়াল ঘেরা। ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন ননীবালা। কাঁঠালের কী ফলন। আগাপাশতলা ছেয়ে আছে ফলে। গাছের গোড়ায় খেজুর কাঁটার বেড়।
বহেরু বলল—শেয়ালের জন্য নয় মাঠান, কাঁটা দিলে ফলন ভাল হয়। গাছ শিউরে ওঠে তো।
জামরুল দেখে অবাক মানেন ননীবালা। আমগাছে যত পাতা তত ফল বলে ভ্রম হয়। বললেন—তোর হাতে মন্ত্র আছে বহেরু। কী ফলন! চোখ জুড়িয়ে যায়। বহেরু হাসে। বলে—ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ।
গাছে ফল ফলে, এ বহুকাল দুচোখে দেখেননি ননীবালা। কলকাতায় সবই মেলে, কিন্তু সে শুধু ফলটুকু। গাছের ফল গাছে দেখার আনন্দই আলাদা। কলকাতায় আসার আগে পর্যন্ত গাছগাছালির সঙ্গে যাহোক সম্পর্ক ছিল। এখন পায়ের নীচে কদাচিৎ মাটির স্পর্শ পান।
ঘুরে ঘুরে ঘেমে গেছেন। মুখচোখ লাল। কোথা থেকে একটা ছাতা নিয়ে এসে নয়নতারা পাশে পাশে চলতে থাকে, ননীবালার মাথায় ছাতাখানা ধরে। ভারী লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা। মুখখানায় কি লাবণ্যের ঢল! বহেরুর ঘরে সবই বেশ ফলে।
হাঁটতে হাঁটতে ননীবালা বলেন—তুই কেন হুট করে বুড়ো হয়ে গেলি বহেরু? চেহারাটা কেমন দুলদুল করে।
বহেরু গম্ভীরভাবে বলে—সময় হল। খোলস পালটাবে।
বহেরু নিয়ে গিয়ে বাস্তুজমিটা দেখাল। বলল—এইখানে কর্তা বাড়ি করবেন বলে ঠিক ছিল।
বলে খুব প্রত্যাশা নিয়ে তাকাল ননীবালার মুখের দিকে।
ননীবালা ফস করে বললেন—এখানে জমির দাম কী?
বহেরু শ্বাস ফেলে বলে—গাঁ গঞ্জ জায়গা, দাম আর কী হবে!
তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গাটায় রোদ পড়েছে। একটা পাতকুয়া। কয়েকটা গাছ। ননীবালার চোখে বালি পড়ল বোধ হয়। চোখটা করকর করে ওঠে। মনটাকে শক্ত করে বললেন—জমির দাম তো সব জায়গায় বাড়ছে।
বহেরু একটু ভয়-ভয় চোখে তাকায় ননীবালার দিকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে-কর্তামশাইয়ের জমি, তিনি তো বেচবেন না। দাম যাইহোক।
ননীবালা বে-খেয়ালে বলে ফেললেন—চিরকাল কি সে-ই থাকবে। জমিটা ভোগ করবে কে?
বলেই ননীবালা অন্তরে শিউরে ওঠেন। কী কথাটা বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। মনটা কত বড় পাপী। সামলে নিয়ে বললেন—আমিও থাকব না, তুইও থাকবি না। তাই এখন ছেলেপুলেদের সুখ-সুবিধে বুঝে এসব জমি-জোত করতে হয়। দেখাশোনার কেউ না থাকলে, বাড়িঘর না হলে এ জমি ধুয়ে জলটা খাবে কে? বেচবে না বলে গোঁ ধরলে কি হয়?
বহেরু শুনে হঠাৎ তার বুড়ো মুখে যুবকের হাসি হেসে মাথা নাড়ল। বলল—কর্তারে বোঝায় কে?
—তুই বোঝাবি।
—উরে বাস রে। এসব বললে খেয়ে ফেলতে আসেন।
পাশ থেকে নয়নতারা হঠাৎ তার নরম গলায় বলে—মা, জমিটা ব্রজকর্তা ষষ্ঠীপদর নামে লিখে দিয়েছেন।
ঠিক বুঝতে পারেন না ননীবালা। হাঁ করে তাকিয়ে বললেন—কে? কার নামে লিখে দিযেছে বললি?
—ষষ্ঠীপদ। নিবারণী দিদির ছেলে। ওই যে যেটা সবসময়ে ব্রজকর্তার কাছে ঘুরঘুর করে আর ছড়া কাটে।
—ও। বলে স্তম্ভিত হয়ে থাকেন ননীবালা। বহুকষ্টে ভিতরের জ্বলুনিটা সামলে নিয়ে বলেন- কেন?
বহেরু একটা ধমক দিল নয়নকে। বলল—তোর এসব খোলসা করে বলার দরকার কি?
ননীবালা একটু কঠিন চোখে বহেরুর দিকে চেয়ে বলে—আমার কাছে লুকিয়ে কি হবে? লুকোস না। আর কী কী লিখে দিয়েছে বল।
উত্তরটা নয়নতারাই দিল—আর কিছু নয়। ষষ্ঠীপদর বাপ তো এখানেই ঘরজামাই থাকে। তার কিছু নেই। কপিলদাদা কোকাভাই সব ঠিক করেছে ওদের এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে। তাড়িয়ে দিলে আর যাবে কোথা, জায়গা তো নেই, পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াবে। ব্রজকর্তা বড় ভালবাসে ষষ্ঠীকে। তাই মায়া হল, লিখে দিলেন।
খোল বগলে দিগম্বর চলেছে। বাদামতলা থেকে ছেলেপুলেরা পিছু নিয়েছে, হাততালি দিয়ে খ্যাপাচ্ছে—খোল হরিবোল, খোল হরিবোল…
দিগম্বর গালমন্দ পাড়ে না। ভারী অসহায় বোধ করে, আর ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পৃথিবীতে আর এমন নির্জন জায়গা খুঁজে পায় না দিগম্বর যেখানে নিরিবিলিতে খোলখানা নিয়ে বসবে। আজকাল খোল নিয়ে বসলে গুরুর ছায়া এসে পড়ে খোলে। আশ্চর্য সব শব্দ ফোটে। হরি-হরি বলে খোল কাঁদে, খোল আহ্লাদে আটখানা হয়। কোন মহাজগৎ থেকে সব অজানা বোল ভেসে এসে খোলের শব্দের মধ্যে ফুটে ওঠে। দিগম্বরের বাহ্যজ্ঞান থাকে না। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসলীলা করেছিলেন, কুঞ্জবনে গোপিনীদের সঙ্গে খেলা করতে করতে কোথায় হঠাৎ মিলিয়ে গেলেন ঠাকুর। চারদিকে তখন কেবল আলো, আর স্বর্গীয় এক শব্দ। হা কৃষ্ণ কোথা -কৃষ্ণ বলে পাগল গোপিনীরা কৃষ্ণকে খোঁজে, পায় না, পাবে কী করে! কৃষ্ণ যে তখন শব্দব্রহ্মে মিলিয়ে আছেন। তাঁর অস্তিত্বের নাদ শুধু শব্দ হয়ে ঘিরে আছে তাদের। ব্রজবামুন বলেন—রাসলীলা মানে হল শব্দলীলা। দিগম্বর সেটা আগে বুঝত না,এখন বোঝে, শব্দ কখন ভগবান হয়ে ওঠে, শব্দ কখন যে দুনিয়াছাড়া করে দেয় দিগম্বরকে। বাবা রে, কোথা থেকে যে সব শব্দ এসে ভর করে খোলে। দিগম্বর তাই আজকাল মাঝে মাঝে খোলখানা জড়িয়ে ধরে, তার গায়ে মাথা ঘরে, কাঁদে আর বলে— আরবার যেন শব্দ হয়ে জন্মাই হরি হে।
ট্যাটন ছেলেগুলো পিছুতে লাগে। কোথাও বসতে দেয় না। যেখানেই গিয়ে খোল নিয়ে বসে দিগম্বর সেখানেই গিয়ে হাততালি দিয়ে নেচে নেচে চেঁচায়—খোল হরিবোল, খোল হরিবোল…। শব্দের যোগ ছিঁড়ে গেলে বড় যন্ত্রণা হয়। চারধারে একটা ময়লা পৃথিবী, তার মধ্যে যেন মুখ থুবড়ে ভাঙা হাঁড়ির মতো পড়ে আছে, এমন মনে হয়।
কতবার বহেরুকে ডেকে বলেছে—ভাইয়ের পো, তার গাঁয়ে এত লোক আলো কমনে? আগে তো দেখতাম না এতসব কাচ্চা বাচ্চা। বড় ঝঞ্ঝাট করে। আমারে শব্দ শুনতে দেয় না।
বহেরু বলে—গুষ্টি তো বাড়েই খুড়ামশাই, কবো কী? দেবোনে আপনারে একটা টংগী ঘর করে। মাচানের ওপর বসে বাজাবেন, কেউ নাগাল পাবে না।
সেই ঘরটা আর করে দেওয়া হয়নি।
পিছনে কাচ্চা-বাচ্চা লেগেছে, দিগম্বর খোল-বগলে ছুটে আসছিল বাদামতলা থেকে। ননীবালার মুখোমুখী পড়ে হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়াল পাশে। হাত দুখানা জোড় করে মহা অপরাধীর মতো বোকা মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠোঁট দুখানা কাঁপছে। দুনিয়াতে এই যে আছে দিগম্বর, এই যে শ্বাস টানে ছাড়ে, রাস্তায় পা ফেলে হাঁটে এ সবই তার নিজের কাছে মহা মহা আস্পদ্দার কাজ।
বাচ্চাকাচ্চাগুলো একটু পিছনে আসছিল, হাততালি দিয়ে মহানন্দে খোল হরিবোল বলতে বলতে। বহেরুরই নাতিপুতি জ্ঞাতিগুষ্টি সব। তবু বহেরু হঠাৎ হাঁকাড় ছেড়ে দৌড়ে যায়। বড় বড় মাটির ঢেলা আর চাঙড় তুলে দুই হাতে বাচ্চাগুলোর দিকে ছুঁড়তে থাকে। বাচ্চাগুলো ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে দৌড়য়। দুটো একটা পড়ে যায়। একটার ন্যাড়ামাথায় বহেরুর ঢেলা গিয়ে লেগে ভেঙে পড়ে। সেটা মাথায় হাতচাপা দিয়ে ‘বাপরে’ বলে ইঞ্জিনের মতো বেগে ছোটে। চারধারেই নানাজনের ঘর গেরস্তালি, গাছগাছালি, সেসবের মধ্যে পলকে মিলিয়ে যায় সব। দুটো একটা নেহাৎ পুঁটে পুঁটে শিশু পালাতে পারেনি, গুট গুট করে দৌড়চ্ছে। বহেরু তাদের ধাওয়া দিয়ে চেঁচায়—সুমুন্দির পো, খুন করে ফেলব। সেই হাঁক শুনে তারা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে।
বহেরু হাত ঝেড়ে ফিরে আসে, গামছায় মুখ মুছে দিগম্বরের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলে–যান খুড়োমশাই, বাগানের মধ্যে চলে যান, জামতলায় বেশ ছায়া আছে। বসে বাজান। সুমুন্দির পোয়েরা আপনার খোলের দাম কী বুঝবে। ওদের কানে গু-মুত ঢুকবে। আপনি যান।
—আহা রে! ননীবালা বলেন—বাচ্চাগুলোকে অমন ধাওয়া দিলি। তুই বড় পাষণ্ড বহেরু |
—ওগুলান মানুষের বাচ্চা নাকি মাঠান? সব কাউয়া। পাপীর বংশ তো। গুণী মানুষের মর্যাদা জানে না।
—তোর সব বাড়াবাড়ি। বাচ্চা মানুষ, ওরা কি ওসব বোঝে!
—বড় হলেও বুঝবে না। আমার ছেলেগুলান তো সব পাকাপোক্ত মানুষ এখন, তারাই কী বোঝে! আমি চোখ বুজলে খুড়োমশাইকে তাড়াবে, বামুনকর্তারে উচ্ছেদ করবে, যত সব আশ্রয় নিয়ে আছে তাদের হাঁকিয়ে দেবে। তারপর নিজেরা সুন্দ উপসুন্দের লড়াই করবে এখানে। আমার দাপে এখনও কিছু করতে পারে না।
ননীবালা হেসে বলেন—তোর এত জ্ঞাতিগুষ্টি, অতিথি-টতিথি, জোটে কোত্থেকে? সবাইকে খাওয়াস-ই বা কী করে?
—আমার গরজেই জোটে সব। মানুষের বড় শখ আমার। ব্রজকর্তাও কন-বহু পালক হও, বহু পোষক হও। তাই করি। গুণী মানুষ পাওয়া-ও চাট্টিখানি কথা নয়। কলের যুগ তো, গুণীরা সব মরে হেজে শেষ হয়ে যাচ্ছে। খুড়োমশাই বা ব্ৰজকর্তা গেলে আর তেমন মানুষ পাওয়া যাবে না। এই সেদিনও উজিরপুরের এক কামারকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। ওদের পূর্বপুরুষ নাকি এমন পোলাদ দিতে পারত যে বিলিতি ইস্পাতও হার মানে। এমন কামান বন্দুক তৈরি করতে যে শ’ শ’ বছরে জং ধরত না। বংশগত বৃত্তি, ব্যাটা কাজও জানে, কিন্তু সে এখন হাওয়ার ফ্যাক্টরিতে বাঁধা মাইনে পায়, এল না।
বলে বহেরু দুঃখমাখা মুখে তাকায়। ননীবালা বোঝেন, এসবই ব্রজগোপালের মাথার পোকা, এর মাথায় ভর করেছে।
বাস্তুজমিটা ষষ্ঠীচরণের নামে লিখে দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করবেন, ননীবালার এমন ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ব্রজগোপাল ঘরে ছিলেন না। দুপুরে ফিরলেন। স্নান করে খেতে বসলেন বাপ-ব্যাটায় পাশাপাশি। সে এক সুন্দর ছবি। বহুকাল মানুষটাকে নিজের হাতে খাওয়াননি ননীবালা। কথাটা বুকে ঠেলাঠেলি করছিল, অম্বলের ঢেঁকুরের মতো উঠে আসত জিভে, ননীবালা কষ্টে ঠেকিয়ে রাখলেন। ব্রাহ্মণ মানুষের দুপুরের খাওয়াটা নষ্ট হয় যদি।
খেয়ে উঠতে না উঠতেই এলেন ফকির সাহেব। মধ্যবয়সি, বেশ ভাল চেহারা, গালে ছাঁটা দাড়ি, চোখে সুরমা, মাথায় ফেজ। পরনে সাদা লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি। রণেনকে দেখতে এসেছেন।
কিন্তু রণেনকে দেখার ধার দিয়েই গেলেন না, ব্রজগোপালের দেখা পেয়েই গম্ভীর হয়ে বললেন—মোস্তাফা চরিত আর কোরাণে যে নূর আর আওয়াজের কথা আছে সে সম্বন্ধে আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আর ইমান মোফাচ্ছেলে আছে—আল্লাহ, তাঁহার ফেরেস্তাগণ, কেতাবসকল, প্রেরিত রসুলগণ, কেয়ামত তকদীয় এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন লাভ—এ সকলের ওপর আমি ইমান আনলাম। বিশ্বাস করলাম। কলেমায় একেশ্বরবাদের কথা বলা হচ্ছে। আর্যরাও তাই। ‘এরিয়া’ কথাটার মানে খুঁজে দেখলাম একেশ্বরবাদ। একেশ্বরবাদীরাই এরিয়ান। আল্লাহ নির্গুণ ঈশ্বর। রসুল ঈশ্বরের মূর্ত অভিব্যক্তি। আর্য হিন্দুদের পুরুষোত্তম। ইসলামে কলেমা তৈয়ব রসুল আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন। রসুল ভিন্ন আল্লাহ অব্যক্ত। গীতায় অব্যক্তের উপাসনার কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেকটি কলেমারই মর্মবাণী ঈশ্বরের ও ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ রসুলের প্রতি পূর্ণ আত্মনিবেদন, আর এই আত্মনিবেদনই ইসলাম। ইসলামের সঙ্গে আর্যধর্মের খুব মিল। আপনি বলছিলেন ইসলামই আর্যধর্ম—যা বেদে ও কোরাণে, বব্বর, তৌরাৎ, ইঞ্জিল এইসব ঐশী কেতাবেও প্রচারিত হয়েছে।
ব্রজগোপাল মুখোমুখি বসে খুব নিবিষ্টভাবে শুনছিলেন। একটা শ্বাস ফেলে বললেন— ইমান মোফাচ্ছেলে পুনর্জীবন লাভের কথা আছে না?
ফকিরসাহেব বলেন—প্রেরিত পরম্পরা আছে, ধর্মগ্রন্থ, অদৃষ্ট ফেরেস্তা, আর দেবদূতদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, এই হল ইমান মোফাচ্ছেল। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ হতে পারে কি! আর যদি রোজ কেয়ামতের কথা তোলেন-
এইভাবে নিবিষ্ট আলোচনা চলতে লাগল। ননীবালা পান খেলেন, রণেন বাইরে গিয়ে দুবার সিগারেট খেয়ে এল। আলোচনা তবু শেষ হয় না। দুজনেই একটা জায়গায় আটকে গেছেন, মিল হচ্ছে না। কিন্তু দুজনেই মিল বের করার জন্য নানা আলোচনা করছেন। পুনর্জীবন ও পুনরুত্থান এক কিনা, পোলশেরাৎ আর বৈতরণী কি অভিন্ন, এইসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেইসব কথার মাঝখানে ননীবালা বাধা দিয়ে বললেন—ফকির বাবা, আমার ছেলেটাকে দেখবেন না? আমরা সন্ধের ট্রেনে চলে যাব।
ফকিরসাহেব এই প্রথম হাসলেন। চমৎকার হাসিটি। বললেন—হ্যাঁ মা, দেখব। এই বামুনবাবার সঙ্গে আমার খুব জমে। দুই ফকির তো।
রণেনকে একঝলক দেখলেন ফকির সাহেব। মুখখানা গম্ভীর করে ফেলেছেন ফের। একটু গলা খাকারি দিয়ে বললেন—কী হল বাবা?
ননীবালা আগ বাড়িয়ে বলেন—ওর মাথার অসুখ।
—বটে! বলে হাসলেন ফকিরসাহেব। বলেন—মা, ও কি পাগলামি করে?
ননীবালা উত্তর দিতে পারেন না। কারণ রণেন তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। কী করে বলেন যে ও পাগল! রণেন তা হলে ভীষণ ঘাবড়ে যাবে।
তাঁকে সে-দায় থেকে উদ্ধার করে ফকিরসাহেব বলেন—কেউ কেউ পাগল সাজে মা।
—না বাবা, ও তা নয়,
ফকিরসাহেব হাত তুলে বলেন—সেও আমি জানি।
বলে কিছুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে চুপ করে রইলেন ফকিরসাহেব।
ননীবালা হাতপাখা নেড়ে তাঁকে বাতাস দিচ্ছিলেন। ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বললেন— কোনও কোনও মানুষের মধ্যে পাগল হওয়ার একটা ইচ্ছে থাকে। অবশ্য ঘুমন্ত ইচ্ছে। সে নিজেও হয়তো জানে না যে, মনের গভীরে ওরকম একটা ছোট্ট চাওয়া আছে। কখনও কখনও সেই ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দেখবেন মা, দুর্বল মনের লোকেরা অনেক সময়ে সংকটে পড়লে পাগল হয়ে যায়। এটা ঠিক রোগ নয়, গা-ঢাকা দেওয়ার উপায়। কিন্তু যখন পাগল হয় তখন খাঁটি পাগলই হয়। আমারও একবার হয়েছিল—
বলে ব্রজগোপালের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন—রঘুনাথপুরে এক পাগল ছিল। লোকে বলত সে নাকি গুপ্ত সন্ন্যাসী। যা বলে তা হয়। মাথায় একটা হাঁড়ি নিয়ে ঘুরত। লোকে সেই হাঁড়িতে চাল ডাল তরকারি মিষ্টি সব দিত। দিনের শেষে হাঁড়ির সব জিনিস একসঙ্গে সেদ্ধ করে খেত। তার পিছু পিছু খুব ঘুরলাম ক’দিন বিভুতি দেখব বলে, কিছু দেখি না। একদিন নদীর ধারে বসে আছি একা, মনটা খুব উদাস, কি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে ডেকে উঠল একটা ইচ্ছা—আচ্ছা, পাগল হলে কেমন লাগে। যদি পাগল হই তো কেমন হয়! সেই যে মাথায় ভূত চাপল তো চাপলই, ইচ্ছে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা কেমন ঘুলিয়ে উঠল, চারদিকটা কেমন ওলটপালট দেখতে লাগলাম। সবই অবাস্তব মনে হতে লাগল। আল্লা-রসুল ডাকতে ডাকতে মাথা চেপে ধরলাম, কিন্তু সে ইচ্ছে বান্দার বাচ্চার মতো মাথায় ভর করে আছে। তখন কেবল চিৎকার করে বলছি— না আমি পাগল হতে চাই না। চাইনা। সে বিকেলটা বেঁচে গেলাম, কিন্তু ইচ্ছেটাকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিয়েছি, তাই সহজে সে আমাকে আর ছাড়ে না। ঘুমোতো ঘুমোতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখি, পাগল হয়ে যা তা করে বেড়াচ্ছি। অমনি উঠে বসে ভয়ের কালঘাম ছাড়ি, জেগেও বুঝতে পারি মনের মধ্যে পাগলামির পোকা কিলবিল করছে। এইরকম ভাবখানা কিছুদিন চেপে থাকতে থাকতে একদিন আর পারলাম না, সকালে উঠে একদিন বেমক্কা পাগলামি শুরু করে দিলাম। বহু ওষুধপত্রে মাসখানেক বাদে সেটা সারে।
ননীবালা ধরিয়ে দিয়ে বললেন—ওর টাইফয়েডের পর ছেলেবেলায় একবার সত্যিকারের হয়েছিল।
ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বলেন—এটা সে রোগ নয়। ভাববেন না, ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেরে যাবে।
বলে রণেনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটু হাসলেন, হাসিটা যেন রণেনের সঙ্গে একটা গোপন বোঝাবুঝির হাসি। কী একটা অভিনয়, ষড়যন্ত্র কী একটা যোগসাজস হয়ে গেল কে জানে। রণেনও একটু হাসল। তারপর গম্ভীর হয়ে গেল।
যাওয়ার সময়ে ফকিরসাহেব ব্রজগোপালকে বললেন—আবার দেখব, রোজ কেয়ামতের মধ্যে পুনর্জন্মের একটা গন্ধ পাচ্ছি বটে।
কোরাণেও আছে। ব্রজগোপাল সোৎসাহে বলেন—একটু দেখবেন।
ফকিরসাহেব ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।
এতকিছুর পরও ননীবালার বুকের মধ্যে কথাটা কাঁটার মতো কুটকুট করে। বাস্তুজমির কথা ভোলেননি। কিন্তু রণেনের সামনে তুলতে ইচ্ছে করে না। বড় নরম মন ছেলেটার। মা-বাপের ঝগড়ায় ফের যদি মনটা বিগড়োয়। তার ওপর আজই চলে যাবেন। যাওয়ার আগে তেতো করে যেতে ইচ্ছে হয় না।
বুকে এই চাপ দুশ্চিন্তাটা নিয়েই দুপুরে একটু গড়িয়ে নিলেন ননীবালা।
দুপুর গড়িয়ে উঠেই টের পেলেন রোদের মুখে কালো ঠুলি পড়েছে। বাইরে এসে দেখেন, স্তরের পর স্তর কালো মেঘ জমেছে আকাশে। গুমোট ভেঙে একটা দমকা হাওয়া দিল। কুটোকাটা আর ধুলোবালি উড়ছে। প্রকাণ্ড মাঠের ওপর প্রকাণ্ড আকাশ। কত দূর পর্যন্ত কালি ঢালা ঘুটঘুটে মেঘের ছায়া পড়েছে। এতদূর পর্যন্ত, এত ব্যাপ্ত মেঘ বহুকাল দেখেননি। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন। নয়নতারা দৌড়ে এসে বাইরে মেলা জামাকাপড় তুলে দিয়ে গেল ঘরে। কাছে এসে হাসিমুখে বলল—আজ যাওয়া হবে না মা।
ননীবালা মুখ ফিরিয়ে নয়নের মুখে তাকিয়ে বললেন—না হোক গে। জলে পড়েছি নাকি?
—থেকে যান।
—থাকব।
বলে হাসলেন ননীবালা। বলে হাসলেন ননীবালা। ‘থাকব’ কথাটায় যেন তাঁর বুক হঠাৎ আজ হালকা হয়ে গেল।