যাও পাখি – ৫

॥ পাঁচ ॥

যে চারজন সোমেনকে দেখছিল তাদের একজনের নাম মেকো।

চারজনের একজন মেকোকে বলে—মেকো, প্যাসেঞ্জার।

—আই বে। মেকোর উত্তর।

—ও ধারটায় বসি চল, হেভি খাওয়া হয়ে গেছে। বাবুর বাবাটা মাইরি এত খচরা কে জানত।

অন্য একজন বলে—মেকো, মনে দুখ লিস না। তোর কপালটা খারাপ।

মেকো লম্বা, কালো, পরনে নোংরা প্যান্ট, গায়ে একটা মেয়েদের খদ্দরের নকশাদার চাদর। মুখটা সরু, ভাঙা। সোমেনকে একবার স্থির, ক্রূর দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বলল—না গান্ডু, দুখ কীসের? তোমরা তো চুপকি মেরে ঢুকে খেয়ে এলে, আমার বেলায় হারামি বাবুর বাবা ঠিক আটকে দিল!

চারজন কামরার অন্য দিকে গিয়ে বসে। সোমেনের বয়সিই হবে। জামা প্যান্ট ময়লা, ফরসা কিংবা কালো, লম্বা কিংবা বেঁটে চারজনকে কিন্তু গড়পড়তা একই রকম দেখায়। মেকো এক ঠোঙা চিনাবাদাম বের করে বেঞ্চে নিজের পাশে রেখে বলে—বাবু বলেছিল বাটে ওর বাপটা হারামি আছে।

একজন বলে—বহুত হারামি। বাবু আমাকেও বুধবারে বলেছিল, ওর বোনের বিয়েতে আসতে পারলে একটা সিনেমা দেখাবে। আমি তো যেখানে বিয়েবাড়ি দেখি ঠিক ঢুকে যাই, আর এ তো বন্ধুর বোনের বিয়ে! বাবু তখনই বলল—শুয়োরের বাচ্চা, আমার বাপকে তো চেনো না। বলেছে আমার কোনও বন্ধু ঢুকলে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। আমিও বললাম, ঠিক আছে দেখে নেব।

—তোকে কী বলল?

—কী বলবে! প্যান্ডেলের গেট আটকে দাঁড়িয়েছিল উটকো লোক যদি ঢুকে যায় তো আটকাবে! আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করল—তুমি কোত্থেকে আসছ? বুদ্ধি করে বলে দিলাম, ছেলের তরফের। সন্দেহ করেছিল বটে, কিন্তু আটকায়নি৷

মেকো বেঁটে একজনকে জিজ্ঞেস করে, তোর তো শালা নেমন্তন্নই ছিল।

যাকে জিজ্ঞেস করা সেই হাই তুলে বলে—নেমন্তন্ন মানে! পুরো ফ্যামিলি কার্ড। আমাকেও আটকে ছিল, বাবার নাম বলতেই ছেড়ে দিল। প্রেজেন্টেশনের প্যাকেট-ফ্যাকেট হাতে না থাকলে সন্দেহ করবেই। তুইও আবার মেজাজ নিলি।

মেকো ঠ্যাংটা ছড়িয়ে বলল—দূর বে গাভু, মেজাজ নেব না তো কি ওর ইয়ে ধুয়ে জল খাব? খপ করে হাতটা চেপে ধরল যে! বলল—তোমাকে তো চেনা-চেনা লাগছে, তুমি বাবুর বন্ধু না? তখন আমি ভাঁট নিয়ে বললাম—হ্যাঁ বন্ধু তো কী হয়েছে! তখন বলে—কে নেমন্তন্ন করেছে তোমাকে? আমি তখন গরম খেয়ে বললাম—নেমন্তন্ন আপনি করেননি, বাবু করেছে। হারামিটা তখন বলে—বাবু তার কোনও বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেনি, করলে তার হাড় গুঁড়ো করে দেব। দেখি নেমন্তন্নের কার্ড! সে একটা ফ্যাসাদ মাইরি। আরও গরম খেতে যাচ্ছিলাম, লোকজন জুটিয়ে ঠিক একটা ভণ্ডুল করতাম, সে সময়ে বাবু এসে দূর থেকে চোখ টিপে সরে পড়তে বলল। নইলে—

চতুর্থজন সিগারেট ধরাল। বলল—আমাকে কিছু জিজ্ঞেসই করেনি। বাইরে একটু দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যুট করে ঢুকে গেলাম এক সময়ে।

মেকো বলে—বাবুকে ঝাড়ব একদিন। এত বিয়েবাড়ি ‘রেড’ করলাম, সন্দেহ করলেও ভদ্রলোকেরা বেশি কিছু বলে না, কিন্তু এরকম খচাই পার্টি কখনও দেখিনি।

মেকো দ্রুত চিনেবাদামের খোসা ভাঙে। তিনজন তার দিকে চেয়ে হাসে। মেকো হাসে না।

চতুর্থজন বলে—মেজাজটা না নিলে ঠিক ছেড়ে দিত তোকে।

মেকো তাকে একটা লাথি মারল! আচমকা। বলল—বেশ করেছি মেজাজ নিয়েছি।

লাথি খেয়ে চতুর্থজন বলে—তাতে লাভ কী হল? ভরপেট হাওয়া।

তিনজন হাসে।

দ্বিতীয়জন বলে—আসল কথাটা কী জানিস মেকো, তোর ড্রেসটা আজ সব মাটি করেছে। বিয়েবাড়ি ভদ্রলোকের জায়গা। আমাদের রাস্তা-ঘাটে দেখে তো বাবুর বাবা, ছোটোলোকের মতো দেখতে। তুই যদি একটু মেক-আপ নিয়ে যেতিস—

—খচাস না কেলো। ছোট ভাইটাকে বললাম পুলওভারটা রেখে যাস, এক জায়গায় যাব, বিকেলে দেখি সেটা নেই। মেজাজটা সেই থেকে বিলা হয়ে আছে।

তৃতীয়জন হঠাৎ বলে—মেকো, তোকে একটা জিনিস দিতে পারি।

—কী? নিস্পৃহ মেকো জিজ্ঞেস করে।

তৃতীয়জন তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডেলা বের করে আনে।

—কী রে? মেকো চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করে।

—ফ্রাই। হাতছিপ্পু করে একটা সরিয়েছিলাম।

—কার জন্য?

কার জন্য আবার! এমনি।

মেকো জোর হেসে ওঠে—সুধাকে দিতিস? আলু!

সবাই খ্যা-খ্যা করে হাসতে থাকে।

মেকো আর তার সঙ্গীদের পুরো গল্পটা শোনা হল না। ব্যান্ডেলে ওরা নেমে গেল। সোমেন পকেটে হাত দিয়ে দেখল তার ঘড়ি আংটি, কোমরে টাকা। কিছু বিশ্বাস নেই। এখনও অনেকটা পথ।

হাওড়ায় যখন গাড়ি ঢুকল তখন স্টেশন ফাঁকা। রেল পুলিশ স্টেশনের চত্বর থেকে ভবঘুরেদের সরিয়ে দিচ্ছে, তবু এমন ভাল শোওয়ার জায়গা পেয়ে কিছু লোক এধার-ওধার পড়ে আছে চাদরমুড়ি দিয়ে শবদেহের মতো। শীতের রাত দশটার পরই ঝিমিয়ে গেছে শহর। কয়েকজন মাত্র তোক নিয়ে স্টিমারের মতো প্রকাণ্ড পাঁচ নম্বর বাসটা ছেড়ে যাচ্ছিল, সোমেন দৌড়ে গিয়ে ধরল। হাওড়ার পোল পেরিয়ে শহর ভেদ করে যেতে যেতে কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না, একটু আগেই সে বহেরুর খামারবাড়িতে ছিল।

রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে এল সোমেন। সবাই তার অপেক্ষায় জেগে বসে আছে। কেউ খায়নি।

খেতে বসলে পর মা জিজ্ঞেস করে—কী বলল রে? দেবে?

—কী জানি। স্পষ্ট কথা বলল না।

মা শ্বাস ফেলে বলে—দেবে না। আমি জানতাম।

দাদা বিরক্ত মুখ তুলে বলে—জানতে যদি তবে আগ বাড়িয়ে চেয়ে পাঠালে কেন? আমি তো বারণই করেছিলাম।

—বুড়ো হয়েছে, এখন যদি মতিগতি পালটে থাকে—সেই আশায়।

দাদা ভাত মাখতে মাখতে বলে—যে লোকটার কোনওকালে মন বলে বস্তু ছিল না তার কাছ থেকে কিছু আশা করা বৃথা। তুমি কোন আক্কেলে যে চিঠিটাতে আমার নাম করে চাইলে! তোমার কি ধারণা, আমার নাম করে চাইলে বাবা গলে যাবে!

—তোকে তো ভালবাসত খুব। সংসারে একমাত্র তোর দিকেই টান ছিল।

—ওসব বাইরের টান, মায়া। সত্যিকারের ভালবাসা নয়…।

বলতে বলতে দাদা লাল হয়ে ওঠে রাগে, অপমানে।

মা দুঃখ করে বলে—অজিত বলছিল জমিটা আর ধরে রাখা যাবে না, ভাল ভাল দর দিচ্ছে লোক। ওর বন্ধুও দাদাকে দিয়ে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছে।

—বেচে দিক গে। দাদা প্রচণ্ড রাগের গলায় বলে।

মা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। দাদার রাগকে এ বাড়ির সবাই ভয় পায়। দীর্ঘকাল হয় দাদার রোজগারে সংসার চলছে। সাঁইত্রিশ বছর বয়সে দাদা সংসারের পরিপূর্ণ অভিভাবক।

মা হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে—তুই একটু দেখ না!

দাদা অবাক চোখ তুলে বলে—কী দেখব?

—একবার যা, তোর মুখ দেখলে যদি মায়া হয়।

দাদা স্থির দৃষ্টিতে মার মুখের দিকে চাইল। মাও তক্ষুনি কথাটার ভুল বুঝতে পারে। চোখ সরিয়ে নিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলে—না হলে দেখ যেমন করে পারিস, ধারধোর করেও যদি রাখা যায়। আমার একখানা গয়না থাকলেও আজ খুলে দিলাম। কিন্তু ওই রাক্ষস তো সবই খেয়েছে।

দাদা কোনও উত্তর দেয় না, খাওয়ার শেষে উঠে যায়।

সোমেন আর মা এক ঘরে দুটো চৌকিতে শোয়। মশারি ফেলা হয়ে গেছে, সোমেন শোওয়ার আগে সিগারেট খাচ্ছিল। মার সামনেই খায়। মা তার মশারির মধ্যে বসে মশা খুঁজল কিছুক্ষণ। চুলের জট ছাড়াল বসে। তারপর এক সময়ে বলল—কেমন সব দেখে এলি?

—কীসের কথা বলছ? বাবার কথা?

—হুঁ।

—ভালই তো।

—বহেরু মোটে চারশো টাকা পাঠাল, ধানের দর কি এবার কম?

—বলল তো দর ভালই। যা দিল নিয়ে এলাম।

—তুই তো ওরকমই, বাপের মতো ন্যালাক্ষ্যাপা। হিসেব বুঝে আসতে হয়। বহেরু কি সোজা লোক! তোর বাপের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আর হাতের-পাতের যা ছিল তা দিয়ে নাকি জমি-টমি কিনিয়েছে। শেষে সব ও নিজেই ভোগ করবে।

সোমেন একটু বিরক্ত হয়ে বলে—লোকটাকেই যখন ছেড়ে দিয়েছ তখন তার টাকার হিসেব দিয়ে কী হবে!

মা চুপ করে যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারে না, বলে—আমার দুঃখ তোরা তার কিছু পেলি না। দশভূতে লুটে খাচ্ছে।

—খাক গে। আমার ওসব দরকার নেই।

—ঠিক ঠিক কী বললে বল তো?

—একবার তো বললাম।

—আবার বল। খতিয়ে দেখি, কথার মধ্যে কোনও ফাঁক রেখেছে কিনা।

—কলকাতায় আমরা বাড়ি করি তা চান না। গোবিন্দপুরে গেলে বাড়ি করার টাকা দেবে।

—চাকরি-বাকরি ছেড়ে যাবে কী করে!

—সেটা কে বোঝাবে!

—তুই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আসতে পারলি না?

সোমেন নীরব উত্তেজনায় আর একটা সিগারেট ধরাল।

—কিরে? মা জিজ্ঞেস করে আবার।

—বাবার বয়স কত মা?

—কেন?

—বলো না!

—সে হিসেব কি জানি? সে আমলে বয়স-টয়স নিয়ে তো কেউ হিসেব বড় একটা করত না। মনে হয় পঁয়ষট্টি হবে। আমারই তো বোধ হয় ষাট-টাট। কী জানি, ঠিক জানি না।

—এই বয়সে একটা লোক অতদূরে একা পড়ে আছে। সে কেমন আছে তা একবারও জিজ্ঞেস করলে না?

—মা একটু অবাক হয়ে বলে—জিজ্ঞেস করলাম তো! তুই তো বললি ভালই। কেন, কিছু হয়েছে নাকি?

বলতে বলতে মা উদ্বেগে মশারি তুলে বেরিয়ে আসে। মার চুল এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। এলো চুলের ঢলটি এখনও পিছনে কালো প্রপাতের মতো ঝরে পড়ছে। সেই কালোর মধ্যে রোগা সাদা মুখখানা, তাতে বিস্ফারিত চোখ দেখে সোমেনের মায়া হয়।

মাথা নেড়ে বলল—কিছু হয়নি।

—তবে ওসব কী বলছিস। ভাঁড়াস না। ঠিক করে বল।

সোমেন হাসতে চেষ্টা করে। ঠিক ফোটে না হাসিটা। তার মনের মধ্যে একটা কথা বিঁধে আছে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কোন অসতর্ক মুহূর্তে নাকি মৃত্যুচিন্তায় নিজের ওই আর্তস্বর ডায়েরিতে লিখে রেখেছে বাবা!

মা চেয়ে আছে।

সোমেন বলে—ভেব না, ভালই আছে। টাকার কথাটা বেশি বলতে আমার লজ্জা করেছিল। গত পাঁচবছর আমরা কেউ বাবার খোঁজ নিতে যাইনি।

মার মুখে যেন জল শুকিয়ে যায়। শুকনো মুখে টাকরায় জিভ লাগার শব্দ হয় একটা। মা বলে—গেলে কি খুশি হত নাকি। রণেন যখন যেত-টেত তখন তো উলটে রাগ করেছে! রণেনের অপমান হয় না! ছেলে এখন বড় হয়েছে, ছেলেমেয়ের বাবা তার সঙ্গে কথা বলতে বাপকেও সাবধান হতে হয়। সে লোকটা কী তেমন বাপ। চিরকাল…

মা হাপরহাটি খুলে বলতে যাচ্ছিল। সোমেন বাধা দিয়ে বলে—থাকগে। ওসব শুনে শুনে তো মুখস্থ হয়ে গেছে।

মা রাগ করে বলে—আজ হঠাৎ তার দিকে টানছিস কেন? সে তোর জন্য কী করেছে?

কিছু করেননি। সোমেন তা জানে। কেবল দশবাতির আলোয় মুখ তুলে বাবা একবার তাঁর কনিষ্ঠ ছেলেটির সুকুমার মুখশ্রী বড় ক্ষ্‌ধাভরে দেখেছিলেন। কী পিপাসা ছিল সেই চোখে!

সোমেন হঠাৎ হালকা গলায় বলে—তোমরা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এবার একটা ফয়সালা করে নাও না।

—কীসের ফয়সালা?

—তুমি কি শুভদৃষ্টির সময়ে টেরছা করে চেয়েছিলে বাবার দিকে?

অন্য সময়ে মা হালকাভাবেই নেয় এসব কথা। এখন উদাস গলায় বলে—কে কাকে টেরছা চোখে চেয়েছে তা সেই জানে।

মা একটু চুপ করে ভাবে। তারপর বলে—আমি তো সবই করেছি। ঘরদোর আগলে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে, কোনওটাতেই তো ফাঁক রাখিনি। এখনও আমিই আছি সংসারে। কিন্তু তাকে বাউন্ডুলে হতে হয়েছে। কর্মফল কার ফলল? সে যদি ভালমানুষই হবে, তবে কেন এই সংসারের ঘরে পা দিতে সাহস পায় না? কেন ছেলেরা মেয়েরা জামাইরা তাকে বিষচক্ষে দেখে?

সোমেন মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলে—তোমার বড় গুমোর হয়েছে ননীবালা!

—গুমোর! কীসের গুমোর রে পাজি ছেলে?

—ছেলেমেয়েরা তোমাকে ভালবাসে, বাপকে বাসে না, তার গুমোর।

—গুমোর থাকলে আছে। মায়েদের তো ওই একটাই অহংকারের জায়গা। তাকে ভাল বলার জন্য বাইরের লোক আছে, আমাকে তো বাইরের লোকে জানে না, তোরা জানিস। আমিও তোদের জানি। সে বলুক তো বুকে হাত দিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য কী করেছে!

সোমেন সিগারেটটা পিষে নিবিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে গিয়ে বলে—বাদ দাও। রাত বারোটা বাজে।

মা তবু গুনগুন করতে থাকে—একদিনে তুই এমন কী চিনে এলি লোকটাকে! আমরা সারাজীবন জ্বলেপুড়ে গেলাম—

—আঃ। আলোটা নেবাও তো।

মা আলো নিবিয়ে দেয়, অন্ধকারেও কথা বলে—আমার বাচ্চারা জন্ম থেকে মাকে জানে, বাপ ছিল অতিথিসজ্জনের মতো। আজও তাই আছে। স্বার্থপর বারমুখো, পাগল একটা।

সোমেন ধমকায়, বকবক করো না তো। অনেক ধকল গেছে—

মা চুপ করে যায়। গলা এক পরদা নামিয়ে গুনগুন স্বরে বলে, আরজন্মে আর মেয়ে হয়ে জন্মাব ভেবেছিস? মেয়েজন্ম এবারই ঘুচিয়ে গেলাম। আর না। কী পাপ, কী পাপ!

ব্যাঙ্ক অফ বরোদা একদম মৌনীবাবা হয়ে আছে। চিঠিপত্র কিছু আসছে না। দিন যায়, সোমেন ভাবে চাকরিটা বোধ হয় হল না। ওদের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে ভয়-ভয় করে। ইদানীং যে কয়েকটা পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দিয়েছিল তার মধ্যে ব্যাঙ্ক অফ বরোদাই ছিল হট ফেবারিট। যদি না হয় তবে কী যে হবে।

অণিমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটির লন-এ অনেক বসেছে সোমেন। মেয়েটা বড় বুদ্ধিমতী। অনেক মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও, অণিমার সঙ্গে আলাদা বসতে ভাল লাগত। চোখা চেহারা, ভারী চশমা চোখে। দাঁত চমৎকার। মুখটা একটু ভাঙা আর লম্বা বটে, কিন্তু ফরসা রঙে, আর প্রচুর পড়াশুনো করার ফলে একরকমের গাম্ভীর্য এসে গিয়েছিল বলে ওর চেহারাটা ভালই লাগে সকলের। সোমেনের ভাল লাগা কিছু বেশি ছিল। অণিমাও তাকে পছন্দ করেছে বরাবর।

সেবার বউদির সঙ্গে মার ঝগড়াটা খুব চরমে উঠেছিল। বরাবরই ছিল ঝগড়া। মার একটা বিচ্ছিরি স্বভাব আছে, সংসার থেকে জিনিস সরানো। তেমন কোনও কাজে লাগে না, তবু মা একটু চিনি কী আটা, নিজস্ব একটু বাসনপত্র, ছেঁড়া ন্যাকড়াই হল কখনও, যা পাবে সব সরিয়ে লুকিয়ে রাখে। তার ওপর আড়াই ঘরের ফ্ল্যাট বাড়ির যে ঘরখানায় মা আর সোমেন থাকে, সেটা প্রায় সময়েই তালাবন্ধ করে রাখে মা। এই স্বার্থপরতা বউদি প্রথম থেকেই সহ্য করতে পারত না। প্রায় সময়েই বলত—ছেলেমেয়েগুলো জায়গা-বাসা পায় না, এমনিতেই জায়গা কম, তার ওপর আবার একখানা ঘর তালাবন্ধ। মা আবার সে কথার জবাব দিত—আমি বাপু নিজের হাতে ঘর পরিষ্কার করি, ছেলেপুলে নোংরা করলে, তোমরা তো সব পটের বিবি, মুখ ফিরিয়ে থাকবে। সারাদিন খেটেখুটে রাতে একটু পরিষ্কার বিছানা পাব না, তা হবে না।

এইভাবেই ক্রমে ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে দুই যুযুৎসব তৈরি হচ্ছিল। কারণটা কিছুই না, তবু ওই ঘরখানার অধিকারবোধ নিয়ে দুপক্ষের লড়াই। এই ঝগড়ায় বরাবর দাদা এসে মিটমাট করেছে, সোমেন বাড়ি ফিরে মাকে ধমকেছে। আবার পরদিন সব ঠিকও হয়ে গেছে।

কিন্তু সেবার ঝগড়াটা এতই চরমে উঠল যে, মা একটা বাটি ছুঁড়ে মেরেছিল বউদিকে। বউদির বদলে সেটা তার কোলের বাচ্চার হাঁটুতে লাগে। বউদি বাচ্চা ফেলে তেড়ে এসেছিল মাকে মারতে। ঝি আটকায়।

দাদা সেই প্রথম ঝগড়ার মিটমাট করার চেষ্টা করল না। অফিস থেকে ফিরে আসার পর বউদি পাশের ঘরে দাদার কাছে চেঁচিয়ে কেঁদে মার নামে নালিশ করল। অনেক রাত পর্যন্ত অশান্তি। অন্য ঘরে মা তখন ভয় পেয়ে কাঁদছে। সোমেন মাকে ধমকায়নি পর্যন্ত সেদিন। চুপ করে নিজের বিছানায় শুয়েছিল। সেই রাতে বউদি বা মার কারও ওপর তেমন নয়, কিন্তু দাদার ওপর কেমন একটু অবিশ্বাস এসেছিল তার। ছেলেবেলা থেকে যেমন সে দেখে এসেছে, মা-অন্ত প্রাণ দাদাকে, সেই দাদা যেন বা আর নেই। দাদার বিয়ের আগে পর্যন্ত তারা কত সুখী ছিল, এই কথা আলাদা থাকবে। সে রাতে সে মার পক্ষই যে সমর্থন করেছিল তা নয়। সে কেবল ভেবেছিল সংসারটার শান্তি বাঁচাতে ননীবালাকে আলাদা করা দরকার। দাদার রোজগারে যখন সংসার চলে তখন বউদির প্রাপ্য সম্মান তাকে দিতেই হবে। মা পুত্ৰঅন্ধ, অধিকারবোধ প্রবল, মা জানে রণেন তারই আছে সবটুকু।

কাউকে কিছু না জানিয়ে সে ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে পড়াশুনো আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়। পড়াশুনোর ক্ষতি হয় বলে দাদা তাকে টিউশনি করতে দেয়নি কখনও। ক্রমে সে টিউশনিও খুঁজতে থাকে।

সে সময়ে অণিমার সঙ্গে দেখা একদিন। চাকরির অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ক্যারেকটার সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে, দেখে অণিমা একা জলের ধারে ঘাসে বসে আছে রোদ্দুরে। কোলে খোলা বই। ওকে একা দেখে একটু কষ্ট হল সোমেনের। পাশে তার থাকার কথা এ-সময়ে। কত কথা হত তাদের। চুপ করে থাকাটাও একরকমের পূর্ণই ছিল। সেটা ভালবাসা নয়, বোধ হয় বন্ধুত্বই হবে।

তাকে দেখে চমকাল না অণিমা। আন্তরিক মুখখানা তুলে বলল—ভাবছিলাম, তোমার খোঁজ নিতে যাব। অসুখ-বিসুখ করেছিল?

—না। পড়া ছেড়ে দিচ্ছি।

অনিমা মৃদু হেসে বলে—ছেড়ে দেওয়াই উচিত। একে কি পড়াশুনো বলে!

—আমি ছাড়ছি পেটের ধান্ধায়।

—তাই নাকি? চাকরি পেয়েছ?

—কোথায় চাকরি! টিউশনিই পাচ্ছি না সুবিধা মতো।

অণিমা আন্তরিক উদ্বেগের সঙ্গে বলে—তোমার খুব দরকার টিউশনির?

—খুব।

—এতদিন কী করে চালাচ্ছিলে?

—দাদা দিত। দিত কেন, এখনও দেয়। আমার নিতে ইচ্ছে করে না। এম-এ পাশের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, খামোখা খরচা। ছমাস মাইনে দিইনি।

অণিমা অকপটে জিজ্ঞেস করল—তোমার কেউ বার্ডেন নেই তো?

—না, কেন?

—ভাবছিলাম, একশো টাকার একটা টিউশনি হলে তোমার চলে কি না।

—তোমার হাতে আছে?

—আছে। যদি প্রেস্টিজে না লাগে করতে পারো।

—প্রেস্টিজের কী ব্যাপার টিউশনিতে?

—আমার ভাইকে পড়াবে?

অণিমার ভাইকে কেন পড়াতে পারবে না, তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অণিমা তো বন্ধু, একই ক্লাসে পড়ে। ওর ভাইকে পড়ালে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সাম্যভাবটা নষ্ট হয়ে যাবে—শুধু এইটুকু খারাপ লেগেছিল সোমেনের। কিন্তু অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে হেসে সে বলল—পড়াব না কেন?

অণিমা নিশ্চিন্ত হয়ে বলে—তাহলে কাল থেকেই যেয়ো। ভাইটা সেন্ট লরেন্স-এ পড়ে। ক্লাস সিক্স। ইংরেজিতে বড্ড কাঁচা, ক্লাস ফলো করতে পারে না। স্কুল থেকে চিঠি দিয়েছে, পরের পরীক্ষায় ইংরেজিতে ভাল ফল না করলে নীচের ক্লাসে নামিয়ে দেবে। আমরা তাই একজন ভাল টিউটর খুঁজছি।

—আমি রাজি।

সেই থেকে সোমেন পড়ায় অণিমার ভাইকে। কিন্তু আশ্চর্য, এক’মাসের মধ্যে একদিনও ওদের বাড়িতে অণিমার সঙ্গে দেখা হয়নি। বোধ হয় লজ্জায় অণিমাই সামনে আসে না। সোমেনকে ওরা মাইনে দিয়ে রেখেছে, এটা বোধ হয় অণিমার কাছে সাধারণ ব্যাপার নয়। সোমেনও খোঁজ করে না। যতদিন টিউশনি না করত ততদিন সহজে দেখা হত বরং। এখন অণিমার বাড়িতে রোজ আসে বলে অণিমা রবিঠাকুরের সেই সোনার হরিণ হয়ে গেল বুঝি! পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়।

কিন্তু টিউশনি করে কিছু লাভ হয়নি। মাকে নিয়ে আলাদা বাসা করার সাময়িক চিন্তা সে ছেড়েও দিয়েছে। সংসারের সবটাই তো কেবল কুরুক্ষেত্র নয়, সেখানে আছে একটা অদৃশ্য নিউক্লিয়াস, অণু-পরমাণু সব মানুষ কেন্দ্রাভিগ আকর্ষণে একটা টানক্ষেত্র তৈরি করে নেয়। তাই সংসারের প্রতিদিনকার ভাঙচুরগুলো অলক্ষ্যে এক সারাইকর এসে কিছু কিছু মেরামত করে দিয়ে যায়, ঠুকে ঠুকে যেন বা বাসনপত্রের টোল-পড়া জায়গা তুলে দিয়ে যায়, জোড়া দেয় ফাটা-ভাঙা বাসন। সবটা মেরামত হয় না অবশ্য। নিখুঁতভাবে জোড়া লাগে না। তবুও অদৃশ্য নিউক্লিয়াস টানক্ষেত্রের ধর্ম রক্ষা করে চলে। তাই আবার মা আর বউদি ভাগাভাগি করে সংসারের কাজ করে এখনও। এ ছেলে রাখে তো ও রান্না করে। সোমেন তাই আর আলাদা বাসা করার কথা ভাবে না। কেবল বাবার কথা ভাবলেই সংসারের টানক্ষেত্রটার দুর্বলতা ধরা পড়ে। বাবা যে সত্যিই টানক্ষেত্রটা ছেড়ে গেছে তাও মনে হয় না আবার। সেই কথাটা বিধে থাকে সোমেনের মনে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।

টিউশনিটা তাই আর ভাল লাগে না সোমেনের। খামোখা। চাকরিটা পেলে বরং হয়। টিউশনিটা ছাড়লে অণিমাও সহজভাবে কথা বলতে পারে আবার। বড্ড আবেগপ্রবণ মেয়ে। আবার মাসের প্রথমে একশোটা টাকা পাওয়ার অভ্যাসই বা কেমন করে ছাড়ে সোমেন?

সন্ধ্যাবেলা সোমেন গাব্বুকে পড়িয়ে বেরোচ্ছে, হঠাৎ দেখে, অন্যমনে মাথা নিচু করে অণিমা অন্য দরজা দিয়ে বাসা থেকে বেরোচ্ছে। তেমনই আছে অণিমা। ভারী চশমার আড়ালে চোখ, পরনে ছাপা শাড়ি, গায়ে স্টোল, হাতে ব্যাগ, পায়ে চপ্পল। মুখে কোনও প্রসাধন কখনও মাখে না, চুল রুক্ষ।

—এই যে বস, কী খবর?

অণিমা চমকাল না। অণিমা কখনও চমকায় না। অণিমা কখনও চমকাবে না। আচমকা বোমা পড়লেও না। ওর ওই স্বভাব। গম্ভীর মুখখানা তুলে চমৎকার মুখে হাসল—কী খবর! ছাত্র কীরকম পড়ছে?

—ভালই। টার্মের ইনক্রিমেন্ট দেবে নাকি?

—ইনক্রিমেন্ট? ভারি অপ্রতিভ গলায় বলে অণিমা।

তেমনি ঠাট্টার স্বরে সোমেন বলে—ইনক্রিমেন্ট না দিলে ঘেরাও করব।

—একা কি কাউকে ঘেরাও করা যায়?

চোখ নাচিয়ে সোমেন বলে—যায় না?

—কীভাবে শুনি?

সোমেন শব্দহীন হাসি হেসে বলে—যায়। একজনের দুটো হাতে একদিন ঠিকই ঘেরাও হবে তুমি। জানো না?

অণিমা মাথা নেড়ে বলে—না তো! কে সে?

—ধরো, যদি বলি….

॥ ছয় ॥

অণিমা মুখ তুলে হাসে। হাসিটা দুষ্টুমিতে ভরা। অণিমা বলল—থাক, বোলো না।

—বলব না? সোমেন বিস্ময়ের ভান করে—তা হলে কথাটা কি টের পেয়ে গেছ?

—না তো! তবে শুনতে চাইছি না।

সোমেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—গরিব হওয়ার ওই একটা দোষ। বড়লোকের মেয়েরা পাত্তা দিতে চায় না।

—অ্যাই! তোমাকে আমি পাত্তা দিইনি?

—দিয়েছ? তা হলে শোনোই না কথাটা। ধরো, যদি বলি—

—আঃ। চুপ করো।

—চুপ করব? যদি তোমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আজ আমার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয় তা হলে কিন্তু কথাটা না বলাই থেকে যাবে। সারাজীবন তুমি ভাববে, সোমেন কী একটা বলতে চেয়েছিল—

বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আবার হেসে ফেলে অণিমা। বলে—গরিবের ছেলের অনেক দোষ। তার মধ্যে মৃত্যু নিয়ে রোমান্টিসিজম একটা।

অণিমাদের বাগানে চমৎকার ফুল ফুটেছে। বারান্দার ফ্লুরোসেন্ট আলোতে অজস্র ভৌতিক ফুল দেখা যাচ্ছে। আসল রং বোঝা যায় না রাতে, কেমন আলোর তৈরি ফুল সব আধো-অন্ধকার বাগানে নিস্তব্ধ হয়ে ফুটে আছে। সোমেন চলে যাবে বলে বারান্দার দুধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। বলল—চলি। বলা হল না কিন্তু।

—না হোক। শোনো, কোথায় যাচ্ছ?

—গড়িয়াহাটা।

—হাতে কোনও কাজ নেই তো!

—কী কাজ থাকবে? সারাদিন নৈকষ্যি বেকার। গড়িয়াহাটায় বুকস্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু লিটল ম্যাগাজিন দেখব, তারপর বাসায় ফিরব।

অণিমার বাইরে যাবার সাজ। সোমেনের পিছু পিছু নেমে আসতে আসতে বলল—একটা জায়গায় আমার সঙ্গে যাবে?

সোমেন দাঁড়ায়। হেসে বলে—যেতে পারি, যদি কথাটা শোনো—

অণিমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে—কথাটা আর একদিন বললে হয় না! যেদিন বেশ চাঁদটাঁদ উঠবে, ফুল-টুল ফুটবে, দূরে কোথাও যাব আমরা। সেদিন বোলো বাপু!

—সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে।

—যাকগে। এখন আমাকে পৌঁছে দাও। একা একা ট্যাক্সি চড়তে ভয় করে।

—তাই বলো! নইলে কি আর আমাকে সঙ্গে নিতে!

অণিমা কথা বলে না। ভ্রূকুটি করে।

প্রশস্ত পথটি ধরে ওরা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে আস্তে আস্তে হাঁটে। সোমেন সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলে—অত রাতে কোথায় যাচ্ছ একা?

অণিমা বলে—একা তো যাচ্ছি না।

—আমাকে না পেলে তো যেতে।

অণিমা হেসে বলে—তাই যদি যাব তবে গাব্বুর পড়ার ঘরের পাশের ঘরটায় বসে ঘণ্টাখানেক মশা তাড়ালাম কেন? বুঝলে মশাই, ঠিক তক্কে তক্কে ছিলাম কখন তোমার পড়ানো শেষ হবে।

সোমেন বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে—তাই বুঝি! তবে কী কথাটা তুমিই বলতে চাও অণিমা। তাই অপেক্ষা করেছিলে ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বলবে? নাকি কোথাও দুরের কোনও মাঠে পৌঁছে গিয়ে বলবে।

অণিমা ভয় পাওয়ার ভান করে বলে—না, না, আজ নয়। আজ অন্য জায়গায় যাচ্ছি।

সোমেন ম্লান মুখে হাঁটতে হাঁটতে বলে—কলকাতার কত লোকের কত জায়গা আছে যাওয়ার!

—তোমার নেই বুঝি?

সোমেন মাথা নাড়ে। আস্তে আস্তে আপন মনে বলে—ধরো, পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে নাচ-গান হুল্লোড় হয়, বড় রেস্টুরেন্টে হয় বিউটি কন্টেস্ট, কেনেল ক্লাবে ডগ শশা, সাউথ ক্লাবে টেনিস, গোপন আড্ডায় নেশাভাঙ। সব জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে। একটা শ্বাস ফেলে বলে—এমন গঙ্গার ঘাটেও যাই না, জাহাজ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। কোনওদিন বিদেশে যাব না, এই সত্যি কথাটা বড্ড মনে পড়ে।

—আচ্ছা ছিঁচকাঁদুনে ছেলে রে বাবা! আর কী কী ইচ্ছে করে তোমার, একটা লিস্ট করে দিও তো! খেয়াল রাখব।

—এই তো ইচ্ছে করছে একটা কথা বলি। ধরো, যদি বলি….

দু’হাতে কান চাপা দিয়ে অণিমা হেসে ওঠে—ওটা থাক।

—থাকবে?

—বললেই তো ফুরিয়ে গেল। থাক না।

—সময় চলে যাচ্ছে।

—যাকগে। তুমি ট্যাক্সি ধরো তো। এই রাস্তায় ট্যাক্সি বড় কম।

সন্ধে সাতটাও বাজেনি। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড এর মধ্যেই জনহীন, পরিত্যক্ত। হুড়হুড় করে কেবল কয়েকটা গাড়ি ওয়াশ-এর ছবির মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।

সোমেন রাস্তার দু’ধার দেখে হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলে—প্রাইভেট টিউটর হওয়ার কি গেরো রে বাবা।

—কী হল?

—চাকরি বজায় রাখতে কত ওভার-টাইম খাটতে হচ্ছে।

—ইস! কী যে অসহ্য হয়ে যাচ্ছ না দিনকে দিন!

—সেই জন্যই তো বলছিলাম, আরও অসহ্য হয়ে ওঠার আগেই কথাটা বলে ফেলার একটা চান্স দাও। এমন ফাঁকা রাস্তা, নিঝুম শীতের রাত, লোড শেডিং থাকলে চাঁদও দেখা যেত ঠিক। ধরো, যদি বলি…

—ওই যে ট্যাক্সি সোমেন। ধরো, দৌড়ে যাও…

সোমেন দৌড়োল, এবং চটির একটা স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ট্যাক্সিটা ধরতে পারল। অবশ্য আর কেউ ট্যাক্সি ধরার জন্য ওত পেতে ছিল না। যতদূর দেখা যায় রাস্তাটা অতিশয় নির্জন।

ট্যাক্সিতে সোমেন একটা সিগারেট ধরাল। হাঁফাচ্ছিল একটু। দুঃখিত স্বরে বলে—সব মুচি ঘরে আসে, সব চটি ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন—

—কী বলে রে পাগলা? অণিমার হাসি চলকায়।

—রাস্তায় এত রাতে মুচি নেই একটাও। তোমার ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে চটিটা ছিঁড়েছে মাইরি।

অণিমা শ্বাস ফলে বলে—কী যে কাণ্ড করো না!

—তুমি দৌড়োতে বললে যে! না দৌড়োলে যদি চাকরিটা খাও?

—ইচ্ছে করেই তো বললাম, নইলে তুমি বোকার মতো কথাটা বলে ফেলতে যে!

সোমেন সবিস্ময়ে বলে—কোন কথাটা?

—যেটা বলতে চাইছিলে!

—কী বলতে চাইছিলাম বলো তো!

—ওই যে! ধরো, যদি বলি—

সোমেন বিরসমুখে বলে—থাকগে। বোলো না।

—বলব না?

—অন্য দিন বোলো। সোমেন সিগারেটে টান দিয়ে বলে—যেদিন ফুলটুল ফুটবে, চাঁদ-টাঁদ উঠবে, লোড শেডিং থাকবে, দূরে কোথাও গিয়ে—

দুজনেই হেসে গড়ায়। পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালা ঘাড় না ঘুরিয়েই একটা অস্ফুট শব্দে রাস্তা জানতে চায়। অণিমা হাসি না থামিয়েই বলে—সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ।

অণিমা তার খোঁপা ঠিকঠাক করল, গা ঢাকা দিল, গাড়ির কাচটা তুলে দিল ভাল করে। বলল—শোন, কথাটা একজন বলে ফেলেছে।

—কোন কথা? সোমেন উদাসভাবে জিজ্ঞেস করে।

—সেই কথাটা।

—ও। সোমেন তেমনি নিরাসক্ত। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড পেরিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে ছুটছে গাড়ি। ডাইনে মোড় নিল একটা। কী চমৎকার সব মস্ত মস্ত ফ্ল্যাটবাড়ি, নিঝুম, অ্যারিস্টোক্র্যাট আর নরম সব আলোর রঙে রঙিন। মুগ্ধ হয়ে দেখে সোমেন।

—সত্যি বলছি। অণিমা বলল।

—কে বলেছে কথাটা।

—ম্যাক্স।

সোমেন একটু অবাক হয়ে বলে—কে বললে?

—ম্যাক্স।

—সে কে?

—একজন অস্ট্রেলিয়ান সাহেব।

—তাকে কোথায় পেলে?

—পেয়ে গেলাম। একটা সেমিনারে আলাপ। সেখান থেকেই পিছু নেয় কলকাতার গলিঘুঁজি দেখবে, বাঙাল রান্না খাবে, সেতার আর তবলা শিখবে। কিছুতেই ছাড়ে না। তাই তার গাইড হয়ে সঙ্গে নিয়ে কিছুদিন ঘুরলাম, নেমন্তন্ন করে খাওয়ালাম, গানের ইস্কুলে নিয়ে গেলাম। সেই থেকে কী যে হয়ে গেল ওর!

সোমেন চোখ মিট মিট করে ট্যাক্সির মধ্যেকার অন্ধকারে আবছা অণিমার মুখের দিকে চায়—বলেছে?

—তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। তিন-চারদিন আগে ওর সঙ্গে তারাপীঠ গিয়েছিলাম। মস্ত শ্মশান সেখানে, গাঁজার আড্ডা। ম্যাক্স গাঁজা খেতে গেল, আমি শ্যামলের সঙ্গে এধার-ওধার ঘুরে দেখছিলাম। ম্যাক্স ঘণ্টাখানেক গাঁজা-টাঁজা টেনে এসে সোজা আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল—

কথাটা শেষ না করে ট্যাক্সির ভিতরকার অন্ধকারে অণিমা ভারী রহস্যময়ী হয়ে বসে থাকে।

সোমেন বিরসমুখে বলে—তারাপীঠ জায়গাটাই খারাপ। আর কখনও যেও না—

অণিমা মুখ ফিরিয়ে নিবিষ্টমনে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। স্তিমিত গলায় বলল—কলকাতায় কত সুন্দর সুন্দর বাড়ি অণিমা। আমাদের যদি একটা বাড়ি হয়, আর ব্যাঙ্ক অফ বরোদার চাকরিটা তা হলে একদিন চলো তোমার সঙ্গে তারাপীঠে যাই।

—ওমা! কেন?

—তারাপীঠে না গেলে তুমি শুনবে না কথাটা!

—কোন কথা?

—সেই যে। ধরো, যদি বলি—

—বোলো না, বোলো না—

বলতে বলতে অণিমা হাসতে থাকে। সোমেন তেমনি স্তিমিত গলায় বলে—কতদিন ধরে বলতে চেষ্টা করছি। একবার তারাপীঠে না গেলে—

চিনে রেস্টুরেন্টটার দিনকাল শেষ হয়ে গেছে। তবু বহুকালের পুরনো নিয়মমাফিক আজও একজন আধবুড়ো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাঞ্জো বা ওই জাতীয় কোনও একটা তারের যন্ত্র বাজায় মিনমিন করে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দ্রুতগামী অটোমোবিলের শব্দে কিছু শোনা যায় না। লোকটা তবু প্রাণপণে বাজায়।

বাঁ ধারে শেষ কেবিনটায় ঢুকে সোমেন অবাক হয়। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর যাদের কোনওদিনই আর দেখবে না বলে ভেবেছিল তাদের কয়েকজন বসে আছে। একধারে অপালা আর পূর্বা। অন্যধারে অধ্যাপক অনিল রায়, শ্যামল আর একজন নীলচোখো, সোনালি চুলো, গোঁফদাড়িওলা অল্প বয়সি সাহেব। তার পরনে খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবি, তার ওপর কালো জহর কোট। সাহেব কী বলছিল, অপালা আর পূর্বা তার ইংরেজি কিছুমাত্র না বুঝে হেসে কুটিপাটি।

মুখ তুলেই পূর্বা লাফিয়ে ওঠে—সোমেন! কী রোগা হয়ে গেছিস! রোজ তোর কথা ভাবি। মাইরি!

—আমিও। সোমেন নিরুত্তাপ গলায় বলে।

অপালা বড় বড় চোখ করে চেয়েই হেসে ফেলে—সোমেন, তুই বেশ মোটা-সোটা হয়েছিস তো!

—তুইও।

ওরা সরে বসে জায়গা করে দেয়। অণিমা আর সোমেন বসে। বসেই টের পায়, উলটোদিকে তিন-তিনটে আধো মাতাল চেয়ে আছে।

অধ্যাপক অনিল রায় বলেন—আগন্তুকটি কে অণিমা?

—সোমেন স্যার।

—আমারও তাই মনে হচ্ছিল। মুখটা চেনা-চেনা।

শ্যামল সাহেবের কাঁধের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে সোজা হয়ে বলে—সোমেন, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। রিগার্ডিং—

বলে ভুলে যায়। হাতটা অসহায়ের মতো উলটে দিয়ে বলে—যাকগে।

সাহেব প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে—ম্যাক্স।

সোমেন হাতখানা ধরে নিয়ে বলে—সোমেন।

হাতটা নরম, একটু ঘেমো। আটলান্টিক নীল চোখ দুটোয় কিছু ভিতু ভাব, খরগোশের মতো, হাসিটি লাজুক। পেটরোগা বাঙালির মতোই চেহারা, কেবল রং-টা ফরসা। সোমেন হাতটা ছেড়ে দিল এবং সাবধানে নিজের হাতের চেটো প্যান্টে মুছে ফেলল।

পূর্বা ফিসফিস করে বলে—যা ভয় করছিল, তখন থেকে তিনটে মাতাল নিয়ে বসে আছি। তোরা কেন দেরি করলি?

সোমেন টের পায় তার পাঁজরে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে অণিমা কী একটা ইঙ্গিত করল। পরমুহূর্তেই অণিমা গলা নামিয়ে পূর্বাকে বলে—দেরি হবে না! বিকেলের মধ্যেই সাক্ষী সাবুদ জোগাড় করে রেজিস্ট্রারের কাছে যেতেই তো বেলা হয়ে গেল। সইটই করে এই দুজনে আসছি।

পূর্বা ভীষণ অবাক হলে বলে—কী বলছিস যা তা!

—মাইরি।

—সোমেনকে?

—আর কাকে?

—কী বলছে রে? বলে অপালা তার লাইমজুসের গেলাস সরিয়ে রেখে রেখে মুখ এগিয়ে আনে।

পূর্বা অসহায়ের মতো বলে—ওরা রেজিষ্ট্রি করে এল, জানিস! কি বদমাশ বলত?

—কে? কারা? ভারী অবাক হয় অপালা।

—অণিমা আর সোমেন।

—মাইরি? অপালার বড় চোখ বিশালতর হয়।

পূর্বা কাঁদোকাঁদো মুখে বলে—এ মা! শেষ পর্যন্ত সোমেনকে?

অণিমা ভারী চশমায় বেশ গম্ভীর মন-খারাপ গলায় বলে—সেই কবে থেকে জ্বালাচ্ছে। বিয়ে করো, বিয়ে করো, ধৈর্য থাকে? আজ তাই ঝামেলা মিটিয়ে দিলাম।

অপালা বড় বড় চোখ করে, নিশ্বাস চেপে শুনেটুনে হঠাৎ বলে—গুল!! ওদের দেখে মোটেই বোঝা যাচ্ছে না বিয়ে করেছে।

এই নাটকটায় নিজের ভূমিকা বুঝতে একটু সময় নিয়েছিল সোমেন। এবার হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে মুখ নিচু করে অপালার দিকে চেয়ে বলে—তোমার বুঝে কাজ নেই সোনা। তুমি তো পুতুল! পুতুলের সব বুঝতে নেই।

—মারব এক থাপ্পড়।

অনিল রায় হঠাৎ ওপাশ থেকে বললেন—কী হয়েছে মেয়েরা? রাগারাগি কীসের?

পূর্বা তেমনি কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে—দেখুন স্যার, ওরা দুজন বিয়ে করে এল।

—কারা?

—সোমেন আর অণিমা।

—অ্যাঁ! আমি যেন অন্যরকম শুনেছিলাম! দাঁড়াও, দাঁড়াও, খুব মাতাল হয়ে গেলাম নাকি!

অপালা গলা তুলে বলে—মোটেই বিয়ে করেনি স্যার। সোমেনকে দেখুন, তিনদিন দাড়ি কামায়নি, চোর-চোর চেহারা, ময়লা জামাকাপড়, ও মোটেই বিয়ে করেনি অণিমাকে।

অনিল রায় হাত তুলে অপালাকে থামান, গম্ভীর গলায় বলেন—ইজ ইট ফ্যাক্ট অণিমা? তোমার মুখ থেকে শুনি।

অণিমা ভীষণ লাজুক মুখভাব করে সোমেনের দিকে তাকায়—লক্ষ্মীটি, স্যারকে বলে দাও না।

সোমেন তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকে মাথাটাথা নিচু করে বলে—তুমিই বলো।

একদিন পূর্বার সঙ্গে উজ্জ্বলায় ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখে ফিরছিল সোমেন। কালীঘাট স্টপে ভিড়ের পাঁচ নম্বরে উঠতে গিয়ে সোমেন উঠল, পূর্ব উঠতে পারেনি। পূর্বার হাতব্যাগের ভিতরে ছোট্ট পয়সা রাখার ব্যাগে পাঁচটা টাকা ছিল, বাসের পাদানিতে সাফ হাতের কেউ সেটা তুলে নিয়েছিল। বাস ছেড়ে দিলে ভিতর থেকে সোমেন শুনেছিল, পূর্বা সর্বনাশের গলায় চেঁচাচ্ছে—সোমেন! সোমেন! ব্যাপারটা কিছুই না, পরের বাসে পূর্বা আসতে পারত, পয়সা না থাকলেও অসুবিধে ছিল না, কন্ডাকটরকে বললেই হত। কিন্তু পূর্বা ঘাবড়ে-টাবড়ে, দুঃখে কান্নাকাটি শুরু করে, বাসস্টপে কয়েকজন লোকও জুটে গিয়েছিল ওর চারপাশে। সোমেন রাসবিহারী বাসস্টপে নেমে ফিরে এসে পূর্বাকে ঘিরে ভিড়, ঘুনধুন করে কঁদছে পূর্বা, বলছে—আমার বন্ধু চলে গেছে, কী যে হবে! এমা! আমার টাকাও নেই, তুলে নিয়েছে। কী বিচ্ছিরি। বুড়ো একটা লোক ওকে একটা টাকা অফার করতেই পূর্বা ঝেঁঝে ওঠে—আমি কারও কাছে টাকা নেব না। তারপরেই আবার ঠোঁট কাঁপিয়ে চোখভরা জল রুমালে মুছে দিশাহারাভাবে বলতে থাকে—কী যে সব বিচ্ছিরি কাণ্ড না! যা তা! সোমেন যখন ভিড় ঠেলে গিয়ে ওর হাতটা ধরল তখন পূর্বার মুখে-চোখে সে কী আনন্দের রক্তিমাভা, যেন বাচ্চা মেয়ে মেলার ভিড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছিল, এইমাত্র ফিরে পেল।

এই হচ্ছে পূর্বা। যেখানে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, সেখানেও ওর দুশ্চিন্তা। যেখানে কাঁদবার মতো কিছু ঘটেনি সেখানেও ও কেঁদে ফেলে। আড়চোখে সোমেন দেখে পূর্বার মুখ লাল, ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পাতা ফেলছে ঘনঘন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। সোমেন ভারী ভয় পেয়ে যায়। পূর্বা ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলে—স্যার, বন্ধুকে কেউ বিয়ে করে? সেটা ট্রেচারি নয়। বলেই সোমেনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে—লজ্জা করে না। কী বিচ্ছিরি সব কাণ্ড করিস না!

সোমেন অবাক হয়ে বলে—কেন, আমি পাত্র খারাপ?

পূর্বা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে—সে কথা বলছি নাকি! কিন্তু অণিমা তোকে বর বলে ভাববে কী করে! তুই-ই বা কী করে ভাববি যে—ইস ভাবতেই গা কেমন করে!

অনিল রায় ভারী অবাক হয়ে পূর্বার কাণ্ডকারখানা দেখে বলেন—বন্ধুকে বিয়ে করতে নেই? কেন বলো তো!

—সোমেনকে কখনও স্বামী বলে ভাবতে পারবে অণিমা?

—কেন পারবে না?

—আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। স্বামী মানে তো বড় বড় মানুষ, যাকে শ্রদ্ধাভক্তি করতে হয়। সোমেনটা তো সমবয়সি, কেবল ইয়ারকি করে বেড়ায়, ও স্বামী হবে কী করে?

অনিল রায় তাঁর ছাত্রজীবনে মস্ত আধুনিক মানুষ ছিলেন। শোনা যায় প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে রংদার চকরা-বকরা জামা, ষাঁড় ক্ষ্যাপানো উৎকট রঙের প্যান্ট পরতেন, হিপ পকেটে থাকত মাউথ-অর্গান, করিডোরে মাউথ-অর্গান বাজিয়ে বিলেতি নাচ নাচতেন। অধ্যাপকরা চটে গিয়েছিলেন। তবু বি-এ আর এম-এ-তে ফাস্ট হতে আটকায়নি। আমেরিকায় ডক্টরেট করেন। এখনও এই উত্তর চল্লিশে প্রায় একই রকম আছেন অনিল রায়। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এখনও লনে বসে আড্ডা দেন। সিগারেট বিলোন। গায়ে কাউবয় রঙিন শার্ট, বড় জুলপি, ফাঁপানো চুল, নিম্নাঙ্গে নিশ্চিত বেলবটমও আছে, টেবিলে পা ঢাকা রয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে না। একটা শ্বাস ফেলে বললেন—আমাদের আমলে ক্লাসমেটকে বিয়ে করাটাই ফ্যাশন ছিল। ইন ফ্যাক্ট আমিও ইনভলভড ছিলাম। তোমাদের আমলটা কি খুব বেশি পালটে গেছে?

—না স্যার, মোটেই পালটায়নি। সোমেন হেসে ওঠে—পালটালে আমি আর অণিমা কেমন করে করলাম?

—করেছিস? অপালা হাত বাড়িয়ে বলে—দেখি সার্টিফিকেট।

—ওর হাতব্যাগে আছে। উদাস গলায় বলে সোমেন। তারপর সিগারেটের ধোঁয়ার আড়ালে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে। আর তক্ষুনি দেখতে পায়, ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে উলটোদিকে একজোড়া নীল ফসফরাস জ্বলছে। ম্যাক্স। এতক্ষণ ম্যাক্সকে হিসেবের মধ্যেই ধরেনি সোমেন। ও কি সত্যিই প্রোপোজ করেছিল অণিমাকে! করে থাকলে অণিমার এ কী রকম ব্যবহার। লাজুক, ভিতু, পেটরোগা চেহারার কোনও সাহেব এর আগে দেখেনি সোমেন। ম্যাক্সকে দেখে তাই কষ্ট হয়। ওর মুখে, কপালে রগ দেখা্‌ যাচ্ছে! শুষ্ক নেশার চিহ্ন। গাল বসা, চুল রুখু। শুধু চোখ দুখানার নীল আগুন জ্বলছে। কিছু বুঝতে পারছে, কিন্তু আন্দাজ করছে। কেবিন ঘরটা হালকা কথায় খিলখিল করছে, বাতাসে ইয়ারকি, তবু সে সব ছাপিয়ে একটা টানাপোড়েনও কি নেই!

—অপালা অণিমার হাতব্যাগ কেড়ে নিয়ে হাঁটকে দেখে বলে—না স্যার, নেই।

অনিল রায় লম্বা চুলে আঙুল চালিয়ে উত্তেজিতভাবে বলেন—ইয়ারকি! ইয়ারকি! মাই গড, তোমরা মোটেই বিয়ে করোনি! এমন ইয়ারকি তোমরা কোথা থেকে শিখলে?

পূর্বা হঠাৎ ভীষণ হাসতে থাকে। সোমেনের দিকে চায়। ভারী আদুরে স্বরে বলে—তুই যা পাজি না সোমেন! এমন চমকে দিয়েছিলি!

অণিমা অসহায় মুখ করে বলে—ছিল স্যার, বোধ হয় ট্যাক্সিতে পড়ে-ফড়ে গেছে, ভাড়া দেওয়ার সময়—

—ফের? অপালা ধমক দেয়।

—অণিমা, তুই আমার জায়গায় বোস, সোমেনের সঙ্গে আমার কথা আছে। এই বলে পূর্বা জায়গা বদল করে নেয়।

বেয়ারা বিয়ারের জগ রেখে গিয়েছিল। সোমেন ফেনাটা ফুঁ দিয়ে চুমুক দিতে যাচ্ছে, পূর্বা কানের কাছে মুখ এনে বলল—বেশি খাস না সোমেন, পায়ে পড়ি।

—কেন?

—আমি তোর সঙ্গে ফিরব যে। গড়িয়ার দিকে যাওয়ার আর কেউ নেই। মাতালের সঙ্গে ফেরার চেয়ে একা ফেরা ভাল। খাস না।

—আচ্ছা। তোর কাছে টাকা আছে?

—গোটা চারেক। কেন?

—ট্যাক্সি নিস। চটিটা ছিঁড়ে গেছে, হাঁটতে পারছি না।

—গড়িয়া পর্যন্ত ট্যাক্সি! কত উঠবে জানিস? তা দিয়ে একজোড়া নতুন চটি হয়।

অপালা চাপা ধমক দিয়ে বলে—তোর সঙ্গে ফিরবে কেন? আজ বিয়ের দিন, সোমেন ওর বউয়ের সঙ্গে ফিরবে।

চিলি-চিকেন আর এক চামচ ফ্রায়েড রাইস মুখে তুলেছিল সোমেন। একটু বিষম খেল। বউ কথাটা তার ভিতরে হঠাৎ বিদ্যুতের মতো খেলে যায় অলক্ষ্যে ঝিকিয়ে ওঠে একটা আসাহী পেনট্যাক্স ক্যামেরার নিষ্প্রাণ চোখ। গর্‌র শব্দ করে জেগে ওঠে একটা অন্ধ কুকুর। হঠাৎ এতক্ষণ বাদে একটা নিরুদ্ধ লজ্জায় সোমেনের মুখ লাল হয়ে যায়।

॥ সাত ॥

বিকেলের দিকে হাওড়ায় এসে নামলেন ব্রজগোপাল। ক্যাম্বিসের ব্যাগে কিছু তরিতরকারি, একটু খেজুর গুড়, আমসও্ব, কিছু গাছ-গাছড়া, ফকির সাহেবের দেওয়া বাতের ওষুধ। স্টেশনের চত্বরে নেমে ভারি বিশ্রী লাগছে তাঁর। কলকাতার বুকচাপা ভিড়, গরমি ভাব, গাড়িঘোড়া, যতবার আসেন ততবারই আরও বেশি খারাপ লাগে। খেই পান না, দিশাহারা লাগে। এই বিপজ্জনক শহরে এখনও কিছু নির্বোধ বাস করছে, প্রতিদিন কিছু নির্বোধ আসছে বাস করতে। মানুষের নিয়তিই টেনে আনছে তাদের। তাঁর ছেলেরা এই শহরে বাড়ি করবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ব্রজগোপাল। সংসারে অনেকদিন হয় তিনি বাতিল মানুষ। তাঁর কথা বা মতামতের কোনও মূল্য আর ওদের কাছে পাওয়া যাবে না। তবু ছেলেদের মুখের কাছে বিষের বাটি ধরতেই তিনি এসেছেন। বাড়ির জন্য দশ হাজার টাকা দিয়ে দেবেন। একেবারে পর হয়ে যাওয়ার ক্ষণকাল আগে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও যেন ওরা অন্তত একবার তাঁর দিকে আকর্ষণ বোধ করে। পুত্র-ক্ষুধা বড় মারাত্মক। সন্তানের বড় মায়া।

বাসে একটা জানালার ধারের সিট পেয়েছিলেন ব্রজগোপাল। খর চোখে চেয়ে কলকাতার দৃশ্যাবলি দেখতে থাকেন। বড়বাজার, ব্রাবোর্ন রোড, ডালহৌসি হয়ে ময়দান। এইটুকু রাস্তা জুড়ে বাণিজ্য আর বাণিজ্য। মানুষের লোভ-লালসার শেষ নেই। ময়দান থেকে বাকি রাস্তাটা চোখ বুজে কেবল ভাবেন আর ভাবেন। স্ত্রী আজ কেমন ব্যবহার করবে কে জানে? বোধ হয় ভাল ব্যবহার কিছু আশা করা যায় না। তবে টাকার খাতির সর্বত্র। হয়তো বসিয়ে চা জলখাবার খাওয়াতেও পারে। ভেবে একটু হাসেন ব্রজগোপাল। কিশোর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। নৌকোয় সে বহু দূরের রাস্তা। কত রোমাঞ্চ কত কল্পনা। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। সেই কিশোর বয়স ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। যদি পান ব্রজগোপাল, যদি এখনও কিশোর ব্রজগোপালকে কেউ জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীর এত মেয়ের মধ্যে কাকে বউ করতে চাও, তবে ব্রজগোপাল এখনও অম্লানবদনে বলবেন—ননীবালা। ননীবালার প্রতি তাঁর ভালবাসার এখনও যেন শেষ নেই। মুখখানার দিকে এখন আর ভাল করে তাকানো হয় না বটে, কিন্তু তাকালে এখনও সেই কিশোরকালের প্রণয়ের চিহ্নগুলি দেখতে পান যেন। আধো-ঢাকা কপাল, পিছনে অন্ধকারের মতো চুলের রাশি, থুঁতনির খাঁজে ঘামের মুক্তাবিন্দু। স্ত্রী শব্দটাই কী মারাত্মক! এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অভ্যাস, আশ্রয়, বিশ্রাম, শান্তি। ব্রজগোপাল তা পাননি। তবু এখনও যদি তাঁকে কেউ প্রেমভিক্ষা করতে পাঠায়, তিনি এসে দাঁড়াবেন ননীবালার দরজায়। কেন দাঁড়াবেন তা কেউ জানে না। সংস্কার।

রাস্তা ফুরিয়ে যায়। শীতের বেলাশেষে যোধপুর পার্কের পিছনে সূর্যাস্ত ঘটছে। ঢাকুরিয়ার প্রকাণ্ড জলাভূমিটায় কত কচুরিপানা, ঠিক মাঠের মতো দেখাচ্ছে। যোধপুরের ফাঁকা জমিগুলো ভরতি হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বাড়ি আর বাড়ি। পায়ের নীচে ভারবাহী কলকাতার নিঃশব্দ আর্তনাদ শোনেন ব্রজগোপাল। ওই জলাভূমিটাও ক্রমে গ্রাস করে নেবে মানুষের সর্বগ্রাসী বসত।

ঢাকুরিয়ার বাড়ির দোতলায় কুণ্ঠিত পায়ে উঠে এসে কড়া নাড়েন তিনি। খুবই সংকোচের সঙ্গে। যেন বা বেড়াতে এসেছেন, কর্তা বাড়ি নেই শুনলে ফিরে যাবেন। এ বাসার তিনি আর কেউ নন। যত রাতই হোক আজই তাঁকে ফিরে যেতে হবে।

রণেনের বউ দরজা খোলে। ভারি খর ঝগড়াটে চেহারা, তবু সুন্দরী। হাঁটু ধরে একটা ছেলে বায়না করছে। নাতি। সন্ধ্যা হয়েছে, তবু এখনও আলো জ্বালানো হয়নি বলে জায়গাটা অন্ধকার। রণেনের বউ দরজা খুলে বলে—কে?

ব্রজগোপাল গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন—আমি ব্রজগোপাল।

বউটি ঘোমটা টানার প্রয়োজন বোধ করে না। বলে—ও।

সুইচ টিপে আলো জ্বালে।

ব্রজগোপাল ঘরে যাবেন কিনা স্থির করতে না পেরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলেন—রণেন বাড়ি নেই?

—না, এখনও ফেরেননি।

—আর কে আছে?

—মা আছেন। আপনি ঘরে আসুন।

—থাক, এইখান থেকেই বরং কথা বলে চলে যাই।

বউটি গলায় যথেষ্ট ধার তুলে বলে—আপনি রোজ রোজ দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলে যান, পাঁচজন তাতে কী ভাবে! ঘরে আসুন।

ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ভিতরে সরে যায় বীণা। ব্রজগোপাল নিজের হৃৎস্পন্দন আকস্মাৎ টের পেতে থাকেন। বহুকাল বাদে ওদের ঘরদোরে ঢুকতে ইচ্ছে করে। ওরা কেমন যে আছে!

সামনের ঘরটা ঠিক ঘর নয়। একটুখানি প্যাসেজ। কলঘর রান্নাঘর আর শোওয়ার ঘরের দরজা চারদিকে। মাঝখানে বেতের চেয়ার আর টেবিল পেতে বসার ব্যবস্থা। তারই একধারে খাওয়া-দাওয়া হয়। বউটি ঘরের বাতি জ্বালল। আগে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বলত, এখন ফ্লরেসেন্ট বাতি। ঘরদোরের চেহারাও আগের মতো নেই। বেতের চেয়ারগুলো রং করা হয়েছে, তাতে ডানলোপিলোর কুশন পাতা। একটা ঝকঝকে নতুন সোফা-কাম-বেড। একধারে একটা মস্ত বড় রেডিয়োগ্রাম, তার ওপর ফুলদানি। দেয়ালে কাঠের চৌখুপিতে কেষ্টনগরের পুতুল, বাঁকুড়ার ঘোড়া, রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়ে একটা গ্যাস সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে। নিজের অবস্থাকে প্রাণপণে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে এরা।

রণেন ঘুষটুষ খায় না তো এখন! ফুড ইনস্পেকটরের ঘুষের ক্ষেত্র অঢেল। ইচ্ছে করলেই রণেন অবস্থা ফিরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু আকণ্ঠ সৎ মানুষ ব্রজগোপালের রক্তের ধাত খানিকটা আছে বলে রণেন এই সেদিনও ঘুষটুষ খেত না। এখন কি খায়? অবস্থার ফেরে পড়ে, বউ আর মায়ের গঞ্জনায়? বড় অস্বস্তি বোধ করেন ব্রজগোপাল। যদি ঘুষ না খাস তবে কেন নিজের অবস্থার চেয়ে ভাল থাকার চেষ্টা করিস? না কি পাঁচজনকে দেখাতে চাস যে তোরা ঠিক মধ্যবিত্ত নোস।

বীণা ভিতরের ঘর থেকে ঘুরে এসে বলল—বসুন, মা আসছেন।

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বীণার কোলের ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন—কী নাম রেখেছ ওর?

—কৌশিক। ডাকনাম টুবাই।

—দু-বছর বয়স হল, না?

—দু-বছর তিন মাস।

—মুখখানা রণোর মতোই।

বউটি ছেলেকে আদর করে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে—ছোনা একটা।

লজ্জায় ব্রজগোপাল মুখ ফিরিয়ে নেন। মা বাবা শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে নিজের ছেলেকে আদর করা বড় লজ্জার ব্যাপার ছিল একসময়ে। এরা কিছু জানে না, মানেও না।

ব্রজগোপাল হঠাৎ প্রশ্ন করেন—রণেনের কি প্রোমোশন হয়েছে?

—না। হওয়ার কথা চলছে, কিন্তু কীসব যেন গণ্ডগোল।

—এসব কবে হল?

—কীসের কথা বলছেন?

—এই যে সব জিনিসপত্র?

—কিস্তিবন্দিতে?

—বোধ হয়। আমি ঠিক জানি না।

ব্রজগোপাল হাসলেন। জানো না, তা কি হয়? সোফা-কাম-বেড, রেডিয়োগ্রাম কিংবা গ্যাসের উনুন কেনার মানুষ রণেন তো নয়। সে ঢিলাঢালা মানুষ, শখ-শৌখিনতার ধার ধারে না। এসব মানুষ কেনে স্ত্রীবুদ্ধিতে, স্ত্রীরই তাগিদে। মেয়েছেলের মতো এমন বিপজ্জনক প্রাণী আর নেই। সাধুকে চোর, সরলকে কুটিল বানানোর হাত তাদের খুব সাফ। সম্ভবত, রণো এখন ঘুষ খাচ্ছে। সংসারটাও বড়, হয়তো সামলাতে পারে না।

—বসুন, চা করে আনি। বীণা বলে।

ব্রজগোপাল হাত তুলে বলেন—না, চা আমি খাই না।

—ওমা! আগে তো খুব খেতেন।

—ছেড়ে দিয়েছি।

—খাবারটাবার কিছু দিই?

অভিমান, পুরনো অভিমানটাই বুকে ফেনিয়ে ওঠে আবার। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বললেন—না। মনে ভাবলেন, এরা জিজ্ঞেস করে কেন? জিজ্ঞেস করলে কেউ কি বলে, খাব?

ব্রজগোপাল বললেন—বরং তোমার শাশুড়িকে ডেকে দাও। ফিরে যাওয়ার গাড়ি আটটায়। দেরি হলে ওরা ভাববে।

বীণা অবাক হয়ে বলে—কারা?

—যাদের আশ্রয়ে আছি। আত্মীয়ের অধিক।

কথাটা বলার দরকার ছিল না। তবু বললেন ব্রজগোপাল। বীণা খারাপ বাবহার কিছু করছে না, কিন্তু একধরনের ভদ্রতাসূচক দূরত্ব বজায় রাখছে যা তিনি ঠিক সহ্য করতে পারেন না। বোঝাই যাচ্ছে, ননীবালারও এখানে সুখে থাকার কথা নয়।

বীণা মুখটা গম্ভীর করে থাকল।

ব্রজগোপাল সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুলটা ধরতে পারেন। কিন্তু কথাটা ফেরাবেন কী করে! তাই তাড়াতাড়ি নাতির দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন—এস দাদা।

বীণা ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে বলে—দাদুর কাছে যাও।

ছেলেটি দু-পা এগিয়ে আসে। একদম কাছে আসে না। ব্রজগোপাল তবু হাত দুটো বাড়িয়েই থাকেন। বলেন—খুব দুষ্ট হয়েছে?

—খুব। সেইজন্যই তো স্কুলে দিয়ে দিলাম।

খুব অবাক হয়ে ব্রজগোপাল বলেন—স্কুলে দিলে! দু-বছর মাত্র বয়স বললে না?

বীণা হেসে বলে—দু-বছর তিন মাস। আজকাল ওর বয়সে সবাই স্কুলে যায়।

—বলো কী! আমরা প্রথম স্কুলে যাই সাত আট বছর বয়সে, তাও খুব কান্নাকাটি করতাম।

—এখনকার ছেলেরা তো স্কুলে যাওয়ার জন্য অস্থির।

—কীরকম ইস্কুল?

—নার্সারি। ইংলিশ মিডিয়াম।

—ও। সে তো অনেক পয়সা লাগে।

—কুড়ি টাকা মাইনে, বাস পঁচিশ, তার ওপর আজ এটা কাল সেটা লেগেই আছে। মাসে পঞ্চাশ টাকার ধাক্কা।

ব্রজগোপাল মনে মনে ভারী বিরক্ত হন। কিন্তু মুখে নির্বিকার ভাবটা বজায় রেখে বলেন—বড়জনকেও কি ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়েছ? মেয়েটাকেও?

—হ্যাঁ একই স্কুলে।

—তা হলে সংসারের দেড়শো টাকা মাসে বেরিয়ে যাচ্ছে!

—হ্যাঁ । একটু কষ্ট করছি, ছেলেমেয়েগুলো যদি মানুষ হয়।

ব্রজগোপাল দীর্ঘশ্বাস চাপলেন। রণোর যা বেতন তাতে এত বড় সংসার চালিয়ে কষ্ট করেও বাড়তি দেড়শো টাকা বাচ্চাদের জন্য খরচ করা সম্ভব নয়। তবে কি রণো উপরি নিচ্ছে আজকাল? বুকের মধ্যে ভারী একটা কষ্ট হতে থাকে তাঁর। এ সংসারে কেউই ব্রজগোপালকে অনুসরণ করল না। তিনি সৎ ছিলেন, এবং সৎ-অসতের ব্যাপারে তাঁর কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। ছেলের ভিতরে অন্তত সেইটুকু থাকলে তার অহংকার থাকত।

তিনি প্রসঙ্গ পালটে বললেন—বড়জন কোথায়?

—কে, বুবাই? সে খেলতে গেছে।

—পড়াশুনোয় কেমন হয়েছে?

—ভাল, ফার্স্ট হয়। মাস্টারমশাইরা আন্টিরা মনোজিৎ বলতে অস্থির।

—মনোজিৎ? ভারী অবাক হলেন ব্রজগোপাল। বড় নাতির নাম তিনিই রেখেছিলেন সুপ্রসন্ন। তিনি যখন চলে যান তখনও এ নামই বহাল ছিল। সদ্য লিখতে শিখেছিল নাতিটি, একসারসাইজ বুক আর বইয়ের ওপরে কাঁচা হাতে অতি কষ্টে লিখত সুপ্রসন্ন লাহিড়ি। ব্রজগোপাল নিস্তেজ গলায় বলেন—নামটা কি বদলানো হয়েছে?

বীণা একটু লজ্জা পায়, বলে—সেকেলে নাম বলে পালটে রাখা হয়েছে। ওর বন্ধুদের সব আধুনিক নাম, ও তাই ভাল নামের জন্য বায়না করত।

—ও। একটু চুপ করে থেকে বলেন—মনোজিৎ বেশ নাম। ভাল। মেয়েটারও কি নতুন নাম রেখেছ?

—না, ওর সেই পুরনো নামই আছে। তবে ডাকনাম অনেক। কেউ ডাকে শানু, কেউ বেলকুঁড়ি, কেউ বুড়ি।

ভিতরের ঘরে ননীবালা পরনের নোংরা শাড়িটা ছেড়ে ধীরে আস্তে একটা ভাল শাড়ি পরলেন। জরির ধাক্কা দেওয়া লাল পাড়। বেখেয়ালেই পরছিলেন। পরার পর মনে হল লাল পেড়ে শাড়ি বড় পছন্দ ছিল মানুষটার।

শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনিটা হাতে নিলেন। সিঁথিতে সিঁদুরের ঘা। আজকাল সব সিঁদুরেই ভেজাল। বাসি বিয়ের দিন সকালে বাসি বিছানায় ব্রজগোপাল যে সিঁদুরের স্তূপ ঢেলে দিয়েছিলেন সিঁথি ভরে, তার কিছু আজও অবশিষ্ট আছে, গোপন কৌটোয় যত্নে তুলে রেখেছেন ননীবালা। ওই সিঁদুর একটু একটু করে কৃপণের মতো অন্য সিঁদুরের সঙ্গে মিশিয়ে আজও পরেন তিনি। নিয়ম। এখনকার সিঁদুর সে আমলের মতো নয়, সিঁথি চুলকে ঘা হয়ে যায়, তাই সচরাচর খুব সামান্য একটু সিঁদুর ছোয়ান আজকাল। কী ভেবে আজ ডগডগে করে সিঁদুর পরলেন। চুলের জট পছন্দ করতেন না ব্রজগোপাল। মাথার তেলের দাম বড্ড বেড়ে গেছে, ননীবালার একরাশি চুলে তেল দিতে সিকি শিশি তেল শেষ হয়ে যায়। রণেনের মুখ চেয়ে আজকাল তালুতে একটু তেল চেপে ননীবালা স্নান সারেন। তাই তেলহীন চুলে আঠা আর জট। চিরুনি চালাতে গিয়ে একটা শ্বাস ফেললেন। এই বিপুল চুলের রাশি তাঁর বোঝার মতো লাগে।

সাজগোজ কি একটু বেশি হয়ে গেল? বীণা বোধ হয় শাশুড়ির এই প্রসাধন দেখে মুচকি হাসবে। মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু। সব লক্ষ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শ্বশুরবাড়িতেই তিনি শিখেছিলেন যে স্বামী শ্বশুর ভাসুরের সামনে যেতে হলে পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। অবশ্য ব্রজগোপালের ব্যবহারে সেসব শিক্ষা তিনি ভুলেও গিয়েছিলেন। আজ সেই পুরনো নিয়মটা রক্ষা করার জন্য তাঁর আগ্রহ হয়। তিন-চারবছর তিনি স্বামীর মুখশ্রী দেখেননি, তার আগেও বছর দুই এক আধপলক দেখেছেন। আজ তাঁকে ওই লোকটার সামনে যেতে হবে, মেজাজ ঠিক রাখতে হবে, মিষ্টি কথায় বোঝাতে হবে, টালিগঞ্জের জমিটা কেনা তাদের একান্ত দরকার। ছেলেদের ব্রজগোপাল তো কিছুই দিলেন না, এটুকু অন্তত ছেলেদের জন্য ভিক্ষা করে নিতেই হবে তাঁকে। শরীর পরিচ্ছন্ন থাকলে মনটাও শান্ত রাখা যাবে। ব্রজগোপালেরও হয়তো তাঁকে দেখামাত্র খ্যাঁক করে উঠতে ইচ্ছে করবে না।

সাজগোজ করতে বেশ একটু বেশি সময় নিলেন ননীবালা। তাঁর হাত-পা যেন বশে নেই। প্রেসারটা বোধহয় ইদানীং বেড়েছে, বুকে ধপ ধপ হাতীর পা পড়ছে। মাথায় ঘোমটা সযত্নে টেনে ননীবালা ধীরপায়ে বাইরের ঘরের পরদা সরিয়ে চৌকাঠে দাঁড়ালেন। বাইরের মানুষের মতোই বসে আছেন ব্রজগোপাল। খয়েরি চাদর গায়ে, আধময়লা ধুতি, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, ধুলায় ধূসর চেহারা। ননীবালার দিকে চেয়েই মুখটা ফিরিয়ে নিলেন।

ননীবালা আজকাল বীণাকে কোনও কাজের কথা বলতে ভয় পান। সংসার খরচের টাকা আজকাল বীণার কাছেই থাকে। খরচ নিয়ে খিটিমিটি বাঁধত বলে ব্যবস্থাটা ননীবালাই করেছেন। সংসারের কর্তৃত্বও সেই সঙ্গেই চলে গেছে। বীণা এখন ওপরওয়ালা। সচরাচর ননীবালা তাকে কাজের কথা বলেন না। কিন্তু এখন অনুচ্চ কর্তৃত্বের সুরে বললেন—বউমা, চায়ের জল চাপাও। ও-বেলার রুটি করা আছে, একটু ঘিয়ে ভেজে দাও।

বীণা বাধ্য মেয়ের মতো ওঠে। দেখে ননীবালা খুশি হল। ব্রজগোপাল এদের সংসারে ননীবালার অবস্থাটা যেন টের না পান।

বীণা কাছে এসে বলে—উনি কিছু খাবেন না, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

ননীবালা সুর নামিয়ে বলেন—ওসব কি জিজ্ঞেস করতে হয়! সামনে ধরে দেবে। এস-জন বোসো-জন তো নয়। যাও।

বীণা চলে গেলে নাতি কোলে ননীবালা সোফা-কাম-বেডের একধারটায় বসেন। বলেন—ওদিককার খবর-টবর সব ভাল?

—ওই একরকম। ব্রজগোপাল অন্যদিকে চেয়ে বলেন।

ননীবালা বেশি কথাটথা জানেন না, দ্বিতীয় কথাতেই সরাসরি প্রশ্ন করলেন—কী ঠিক করলে?

—জমিটা কিনবেই তুমি?

ননীবালা শ্বাস ফেলে বললেন—আমি জমি দিয়ে কী করব? জমি তো আমার জন্য চাইছি না। ওদের জন্য। আমি আর কֹ’দিন?

—ওই হল।

—খুব সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। অজিতের বন্ধুর জমি, সেই সব ব্যবস্থা করে দেবে। তাকে ওকালতনামা দেওয়া আছে।

—শুনেছি। কিন্তু কথা তো তা নয়। রণো ওরা সব এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেলে গোবিন্দপুরে থাকবে কে?

—যেই থাকুক, ওরা থাকবে না। গ্রামে-গঞ্জে থাকার ধাত তো ওদের নয়।

ব্রজগোপাল উত্তর দেন না।

ননীবালা শান্ত গলায় বলেন—আমার ওপর রাগ আছে তো থাক। ছেলেরা তো কোনও দোষ করেনি বাপের কাছে! রণোর একার ওপর এত বড় সংসার, দশ-বিশ হাজার এক ডাকে বের করে দেবার ক্ষমতা নেই। তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ।

ব্রজগোপাল আস্তে করে বললেন—সচ্ছলতার মধ্যেই তোমরা আছ, দেখতে পাচ্ছি। নতুন নতুন সব জিনিসপত্র কেনা হচ্ছে, নিজের অবস্থাকে ডিঙিয়ে পাঁচজনের কাছে সচ্ছলতা দেখানো।

—ওমা! গরিবের সংসারেও দিনে দিনে টুকটাক করে কত জিনিস জমে যায় দেখতে দেখতে। গত পাঁচ-সাত বছর ধরে কত কষ্টে এইসব করেছে একে একে। তাও তো তেমন শৌখিন জিনিস না, সংসারের যা লাগে তাই। ছেলেদের সংসারের শ্রী দেখতে ইচ্ছে করে না?

ব্রজগোপাল ভ্রূকুটি করে বললেন—কিন্তু এত টাকা আসছে কোত্থেকে! রণোর যা মাইনে তাতে তো এসব হওয়ার কথা নয়। টাকার দাম কমছে বই বাড়ছে না। ঘুষটুষ খাচ্ছে নাকি!

—সেরকম ছেলে নয়। তবে কেউ হয়তো খাতির-টাতির করে সস্তায় কোনও জিনিস ধরে দেয়। সে তো আর দোষের নয়!

উদাস গলায় ব্রজগোপাল বলেন—তাই হবে। আমার সেসব না জানলেও চলবে।

ননীবালা মাথা ঠান্ডা রেখে বলেন—একটা বয়সের পর ছেলেদের হাঁড়ির খবর নেওয়া ঠিক নয়। ওরা বড় হয়েছে, দায়িত্ব নিয়েছে, ওদের ভালমন্দ ওদের বুঝতে দাও।

—আমি তো সব কিছু থেকেই দূরে আছি, তবে আর আমাকে সাবধান করা কেন! ঘুষটুষ যদি নেয় তো নিক, আমার কী! শুধু সমাজের একজন মানুষ হিসেবে অন্য এক মানুষকে বিচার করছি।

ননীবালা চঞ্চল হয়ে বলেন—রণো হয়তো এক্ষুনি চলে আসবে। এ সব কথা তার কাছে তুলো না।

ব্রজগোপাল ভ্রূ কুঁচকে সরাসরি স্ত্রীর দিকে তাকান। অল্প কঠিন স্বরে বলেন—ছেলের প্রতি তোমার এত টান, তবু তাকে অত ভয় কেন? তাকে যদি শাসন করা দরকার হয় তবে তা করাই উচিত।

—না না, তার দরকার নেই। রণো ওসব কিছু করে না।

—ভাল, জেনে গেলাম।

—রণোকে কী বলব জমিটার কথা?

—কিনুক।

—কিনবে?

—হ্যাঁ তো বলছি।

—ভাল মনে বলছ, না মনে রাগ রেখে?

—তাতে কী দরকার! টাকাটা আমি দেব। কর্তব্য হিসেবে।

—রণো বড় অভিমানী ছেলে, এরকম কথা শুনলে টাকা নেবে না।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—তবে কীরকম কথাবার্তা বলতে হবে?

—বিরক্ত হয়ো না। ছেলের মুখ চেয়ে খুশি মনে দাও। অনাদর অশ্রদ্ধার দান যে নেয় সে খুশি হয়ে নেয় না।

ব্রজগোপাল চুপ করে থাকেন। চোখে একটু উদাস ভাব। হঠাৎ বলেন—রণো খুব সৎ ছিল। ফুড ইনস্পেকটরের চাকরিতে অনেক উপরি। সে সব লোভে কখনও পা দেয়নি।

—তোমার অত সন্দেহের কী? ঘরে দুটো বাড়তি জিনিস দেখেই কি লোকটাকে বিচার করা যায়?

—যায়। আমার বড় দুশ্চিন্তা হয়।

—দুশ্চিন্তা কীসের?

—যারা ঘুষ নেয় তারা কখনও প্রকৃত শ্রদ্ধা পায় না, কেবল খাতির পায়।

—শ্রদ্ধা ধুয়ে জল খাবে! মা, ভাই, সংসার পালছে পুষছে, সে বড় কম কথা নাকি! আজকাল ক’টা ছেলে এই বয়সে এত দায়িত্ব ঘাড় পেতে নেয়? যার দায়িত্ব নেওয়ার কথা সেই নিল না কোনওদিন। রণোকে কেন অশ্রদ্ধা করবে লোকে?

ব্রজগোপাল ননীবালার দিকে তাকালেন। মধ্য যৌবনে স্ত্রীর প্রতি যে হিংস্র রাগ তাঁর দেখা যেত এখনও সেরকমই এক রাগে বুড়ো বয়সের দীপ্তিহীন চোখও একটু ঝলসে ওঠে। অথচ একথাও ঠিক, স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও প্রতি কখনও এমন তীব্র রাগ তিনি অনুভব করেননি। তার অর্থ কি এই যে, স্ত্রীর প্রতিই তিনি সবচেয়ে বেশি অধিকার সচেতন?

বীণা বুদ্ধিমতী। রান্নাঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ওপাশে কান পেতে আছে হয়তো। তাই ননীবালা ব্রজগোপালের চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। যদি লোকটা তেড়েফুঁড়ে কিছু বলে তো বউমার কাছে অপমান। বললেন—ভয় পেয়ো না। রণো তেমন কিছু করেনি। শত হলেও তোমারই ছেলে তো!

—আমার ছেলেই শুধু নয়। তোমার ধাতও তো কিছু তার মধ্যে আছে। তা ছাড়া আছে পারিপার্শ্বিকের প্রভাব, চারদিকের লোভ আর আকর্ষণ। মানুষ খুব মরিয়া না হলে এমন অবস্থায় সৎ থাকতে পারে না।

ননীবালা স্বামীকে চটাতে চাইলেন না। উত্তরে বলতে পারতেন—সৎ হয়ে কী ঘচু হবে। তা না বলে বললেন—তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। খেয়ে বিশ্রাম করো।

—ওসব দরকার নেই। রণোকে বোলো টাকা আমি দেব। এল-আই-সিতে গিয়ে যেন ও একটু খোঁজখবর করে। দরকার মতো আমাকে খবর দিলেই আমি এসে সইটই করে টাকা তুলে দিয়ে যাব।

—সব ব্যবস্থা অজিতই করছে। বসবে না?

না। আটটার কাছাকাছি সময়ে গাড়ি আছে। তাড়াতাড়ি না উঠলে গাড়িটা ধরতে পারব না।

—একটু বোসো, জলখাবারটুকু খেয়ে যাও, তা করতে হয়তো রণো এসে পড়বে।

ব্রজগোপাল খাওয়ার জন্য ব্যস্ত নন। কিন্তু এই সংসারের মাঝখানে আর একটু বসে বিশ্রাম নিতে তাঁর বড় সাধ হচ্ছিল। দূর এক একাকী নির্জন ঘরে ফিরে যেতেই তো হবে! বললেন—সোমেন বাড়িতে নেই?

—না। এ সময়ে কি ডাঁশা ছেলেরা ঘরে থাকে?

ব্রজগোপাল সেটা জানেন। ছোট ছেলেটি যখন বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েছে তখন তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। চেহারায় ভাঙচুর হয়ে ছেলেটি এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিমান এবং সুশ্রী মুখখানা আর একবার দেখবার জন্য তার বড় সাধ হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন—কখন ফেরে?

—তার কিছু ঠিক নেই।

—কী করেটরে আজকাল? স্বভাবটভাব কেমন?

ননীবালা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন—কাজকর্ম না থাকলে কী আর ভাল থাকে। এম. এ. পরীক্ষাটা দিল না, ব্যাঙ্কে একটা চাকরি পাওয়ার কথা হচ্ছিল তো তারও চিঠি এসেছে, চাকরি এখন হবে না।

জলখাবারের প্লেট আর চা নিয়ে বীণা আসে। ঘরে ঢোকার আগে গলা খাঁকারি দেয়। ব্রজগোপাল জলখাবারের প্লেটটা ছুঁলেন মাত্র, চায়ে গোটা দুই চুমুক দিলেন। তারপর অন্যমনস্কভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—চলি।

কিছু বলার নেই ননীবালার। কেবল বললেন—শরীরটরীর কেমন?

—ভাল, বেশ ভাল।

—আর একটু বসলেই রণো এসে পড়ত।

—দেখা করার জন্য তাড়া কী? হবে এখন।

—দুর্গা দুর্গা। ননীবালা বলেন।

ব্রজগোপাল দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে প্রশ্ন করলেন—বাড়িটা কার নামে হবে?

—রণোর ইচ্ছে আমার নামে হোক। আমি বলি দুই ছেলের নামে হলেই ভাল। তুমি কী বলো?

—আমি কী বলব? যেটা তোমাদের খুশি।

রাস্তায় এসে ব্রজগোপাল ইতস্তত তাকালেন। আরও শ্রীহীন, নোংরা ধুললাটে হয়ে গেছে কলকাতা। রাস্তায় জঞ্জালের স্তূপ জমে আছে। স্টেশন রোডে এই শীতেও কোথা থেকে জল জমে কাদা হয়ে আছে এখনও। ঘর-ছাড়া ছেলেরা জটলা করছে। যতদূর সতর্ক চোখে সম্ভব দেখলেন ব্রজগোপাল, সোমেনকে দেখা যায় কিনা কোথাও। নেই, থাকার কথাও নয়।

কলকাতায় বেড়েছে কেবল দোকান। এত দোকান, কেনে কে, তা ব্রজগোপাল ভেবে পান না। তবু ঠিকই সওদা বেচাকেনা চলে। মানুষকে লোভী করে তুলবার কত আয়োজন চারদিকে।

একটা ট্যাক্সি উলটোদিক থেকে এসে তাঁকে পেরিয়ে গেল। থামল। ব্রজগোপাল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, বাসার সামনেই থেমেছে। একটু দাঁড়ালেন। রণো না? রণোই। ঘাড় নিচু করে নেমে এল, হাতে বোধ হয় একটা দুধের কৌটো, দু-একটা প্যাকেট গোছের, একটা ফোলিও ব্যাগ। চশমা নিয়েছে আজকাল। বেশ মোটা হয়ে গেছে। সোয়েটারের ওপর দিয়ে পেটটা বেশ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, গালটাল পুরন্ত। চিনতে তবু অসুবিধে হয় না, ছেলে তো। মোটা হয়ে যাওয়ায় এই বয়সেই বেশ বয়স্ক দেখায়।

কয়েকটা মুহূর্ত তিনি দাঁড়ালেন, ট্যাক্সিতে চড়ার অবস্থা রণোর নয়। তবু কী করে ট্যাক্সি চড়ে ও? দিব্যি নির্লিপ্ত মুখে ভাড়া গুনে দিয়ে খুচরো ফেরত নিচ্ছে। ট্যাক্সির মিটার টুংটাং করে ঘুরে গেল। বোঝা যায় হামেশা ট্যাক্সিতে চড়ার অভ্যাস আছে। নামা থেকে ভাড়া দেওয়া অবধি ঘটনাটুকুর মধ্যে একটা অভ্যস্ত অবহেলার ভাব।

রণো বাড়িতে ঢুকে গেলে ব্রজগোপালের খেয়াল হয়, ছেলে এক্ষুনি শুনবে যে বাবা এসেছিল, এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। ফলে হয়তো বাপের সঙ্গে দেখা করতে তড়িঘড়ি নেমে আসবে। ভেবে ব্রজগোপাল দ্রুত হাঁটতে থাকেন। তাঁর অভ্যাসের পক্ষে খুবই দ্রুত। জোরে হাঁটা তাঁর বারণ।

বড় রাস্তা পর্যন্ত এসেই ব্রজগোপাল বুঝতে পারেন, কাজটা ঠিক হয়নি। বুকে প্রাণপাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। শ্বাসবায়ু উকট রকমের কমে আসছে। এ সময়টায় তাঁর আজকাল হাঁপির টান ওঠে। দু-চার কদম হেঁটে ব্রজগোপাল ব্রিজের পিলারের কাছে উবু হয়ে বসে পড়েন। ভগবান! এ যাত্রা সামলাতে দাও। এক বিশাল সমুদ্র যেন ক্লান্ত সাঁতারুকে বড় নয়-ছয় করে। ব্রজগোপাল বসে নিবিষ্টমনে শ্বাস টানতে চেষ্টা করেন। একবার এ সময়ে সোমেনটার মুখখানা যদি দেখে যেতে পারতেন। ওই ছেলেটির প্রতি বড় মায়া। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে আছে ছেলেটা! এ বয়সে কবে কখন প্রাণপাখি ছেড়ে যায় দেহের খাঁচা। আয় সোমেন আয়।

॥ আট ॥

কলকাতার ময়দানে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছেন। রেডিয়োতে রিলে হচ্ছে।

সন্ধেবেলা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিকতার সুরে বার বার জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, আরও ত্যাগ, আরও কষ্ট স্বীকার, আরও ধৈর্যের জন্য জনগণকে প্রস্তুত হতে হবে। ভারতের চতুর্দিকে কয়েকটি দেশ মিত্রভাবাপন্ন নয়। যে কোনও সময়ে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। বন্ধুগণ, আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু যুদ্ধে যদি আমাদের নামানো হয় তবে আমরা আদর্শের জন্য, অস্তিত্বের জন্য, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে চূর্ণ করার জন্য…

অজিত রেডিয়োটা বন্ধ করে দেয়। রেডিয়োর পাশে পোষা বেড়ালের মতো বেতের গোল চেয়ারে পা গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে শীলা। তার মুখশ্রী চমৎকার, রং একটু চাপা, ইদানীং সুখের কিছু মেদ জমছে গায়ে। তুঁতে রঙের উল দিয়ে একটা সোয়েটার বুনছিল, একটা ঘর গুনতে ভুল হয়েছে, মাথা নিচু করে দেখছিল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। রেডিয়োটা বন্ধ হয়ে যেতেই চমকে উঠে বলে—এই যাঃ, কী হল?

—বন্ধ করে দিলাম। তুমি তো শুনছ না। অজিত শান্ত গলায় বলে।

শুনছি না কে বলল? তুমি বন্ধ করে দিলে তাই বলে! প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা! ভারি বিস্ময়ভরে বলে শীলা।

—তোমার কি ধারণা, প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বরে ঘরদোর পবিত্র হবে? কেউ যখন শুনছি না তখন খামোখা ব্যাটারি নষ্ট করে লাভ কী! আজকাল ব্যাটারির লনজিভিটি অনেক কমে গেছে, যদি যুদ্ধ হয় তো নেকস্ট বাজেটে দামও বাড়বে।

—ভারী বিশ্রী স্বভাব তোমার। ভাল কথা সহ্যই করতে পারো না। কত লোক আজকের মিটিং অ্যাটেন্ড করছে জানো?

—খামোখা করছে। ফেরার সময়ে অধিকাংশ লোকই ট্রামে বাসে উঠতে পারবে না। লম্বা রাস্তা হেঁটে মরবে সবাই, আর তা করতেই ভাল ভাল কথা যা শুনছে সব ভুলে যাবে।

—ইউনিয়ন করতে করতে তোমার মনটাই হয়ে গেছে বাঁকা। যেহেতু পি-এম বলছে সেইজন্যই তার সব খারাপ। শুনছিলাম বেশ, দাও আবার রেডিয়োটা।

—থাক। তার চেয়ে এস একটু প্রেমট্রেম করা যাক। যুদ্ধফুদ্ধ লাগলে কবে যে কী হবে! মরেটরে যাওয়ার আগে—

—আহা, সারাদিনে যেটুকু সময় দেখা হয় সেটুকু সময়ও তো আমার দিকে তাকাও না। এখন প্রধানমন্ত্রীর ইমপর্ট্যান্ট বক্তৃতার সময়ে প্রেম উথলে উঠল। দাও না রেডিয়োটা, একটা ঘর পড়ে গেছে, তুলতে পারছি না। দাও না গো—

অজিত রেডিয়োটা আস্তে করে ছেড়ে দেয়। রেডিয়োর টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর রনসন গ্যাস লাইটারটা তুলে নিয়ে বারান্দায় আসে।

টালিগঞ্জের এ পাড়াটাকে খাটালের পাড়াও বলা যায়। বারান্দায় দাঁড়ালেই গোচোনা, শুকনো গোবর তার গরুর গায়ের গন্ধ এসে ধাক্কা দেয় নাকে। অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। ঝিম এক সন্ধ্যা নেমে আসছে মাঠে ময়দানে। তাল্প কুয়াশা, ভৌতিক আলো জ্বলছে অন্ধকারে। কুয়াশার ভিতরে পাখির ডিমের মতো। এখনও এ-দিকটায় ফাঁকা জমি দেখা যায়। অবশ্য ক্রমেই ফাঁকা জায়গা ভরে যাচ্ছে, নিত্য নতুন ভিত পত্তন হয়, বাঁশের ভারা ওঠে, তার সঙ্গে উঠতে থাকে ইটের গাথনি। লোহার গ্রিল শীতে চনচনে হয়ে আছে। গ্রিলের সঙ্গেই প্রায় গাল ঠেকিয়ে দাঁড়ায় অজিত। ঘরের ভিতর থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বর আসছে, চারদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বর আসছে। সব বাড়িতে রেডিয়ো খোলা। কর্তা গিন্নি, চাকর-বাকর, খাটালওয়ালা সবাই শুনছে, নির্বাচকমণ্ডলী, জনগণ।

কাঁচা রাস্তাটা বাঁ ধারে কিছুদূরে গিয়ে বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখেই একটা বাতিস্তম্ভ। হলুদ আলো নতমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে। ওই জমিটা লক্ষ্মণের। গতকালও একটা এয়ারোগ্রাম এসেছে লক্ষ্মণের। কানাডা থেকে ওরা স্বামী-স্ত্রী বেড়াতে বেরিয়েছে স্টেটসে। বড় শীত, খুব ফূর্তি। লক্ষ্মণ আর ফিরবে না। ইমিগ্রান্ট ভিসা পেয়ে গেছে। ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার লক্ষ্মণ কোনও দিনই খাটাল-ভরা এই এলাকায় বাড়ি করতে আসবে না। তার জমিটা বায়না করেছে রণেন। দু-একবছরের মধ্যেই ওখানে এক কি দেড়তলা দীন একটি বাড়ি উঠবে। শীলার খুব আনন্দ, বাপের বাড়ি উঠে আসছে কাছে।

রনসন গ্যাসলাইটারটার আগুন কেমন লেলিহান হয়ে লাফিয়ে ওঠে! চাকা ঘুরিয়ে দিলেই আবার কমে যায়। গ্যাসের সিলিন্ডার শেষ হয়ে এসেছে। লক্ষ্মণ আবার পাঠাবে, লিখেছে। কিন্তু লক্ষ্মণ আর ফিরবে না। বন্ধুর জন্য শখ করে কাছাকাছি জমি কিনেছিল। যখনই কিনেছিল তখনই বোধ হয় লক্ষ্মণ জানত যে সে সুখের পাখি হয়ে উড়ে গেছে। ফিরবে না। তবু অজিতকে খুশি করতেই কিনেছিল বোধ হয়। মেরেকেটে পৌনে দু-কাঠা জমি হবে। বেশি দামও নয়। লক্ষ্মণের কিছু যায় আসে না যদি অজিত খুব কম দামেও জমিটা ছেড়ে দেয়। লক্ষ্মণ বহু টাকা মাইনে পায়। কানাডায় বাড়িও করেছে। খাটালে ভরা, বন্ধুহীন এলাকায় অজিত পড়ে আছে একা। একাই। অজিত বড় একা।

ঘর থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার ওপরে গলা তুলে শীলা ডাকে—শুনছো, ঠান্ডা লাগিও না। বারান্দায় এখন কী? ঘরে এস।

অজিত উত্তর দিল না। কিং সাইজ ডানহিল সিগারেটের সুন্দর গন্ধটি ফুসফুস ভরে টেনে নিল। পাঁচ প্যাকেট পাঠিয়েছিল লক্ষ্মণ। আর মাত্র আড়াই প্যাকেট আছে। কৃপণের মতো খায় অজিত। একটুও ধোঁয়া নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। ফুরোলে আবার পাঠাবে। কত কী পাঠায় লক্ষ্মণ! কিন্তু সে নিজে ফিরবে না। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলো কুয়াশার একটা ধাঁধার মতো জ্বলছে। মাকড়সার জালের মতো সেই ভৌতিক আলোয় লক্ষ্মণের শূন্য জমিটা দেখা যায়। শীতে কিছু ছেলে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলে, বর্ষায় আগাছা জন্মায়। কোনওদিন লক্ষ্মণ ফিরবে, বাড়ি-টাড়ি করবে, এই আশায় এতকাল জমিটা ধরে রেখেছিল অজিত। শীলার তাগাদায়, শাশুড়িই আর রণেনের আগ্রহে ছেড়ে দিতে হল। ধরে রেখেও লাভ ছিল না অবিশ্যি। পৃথিবী ঠিক এক পুকুরের মতো, মাছের মতো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথায় কোথায়। বৃথা ছিপ ফেলে বসে থাকা, কোন দূরে হারিয়ে যাওয়া মাছটিকে ধরে আনবে কাছে, এমন সাধ্য কী!

লক্ষ্মণের পায়ে থাকত একটা বর্ণহীন ধুলোটে চপ্পল, একটু খাটো ধুতি, গায়ে একটা ফুলহাতা শার্ট—যার হাতে বোতাম খসে যাওয়ার পর হাতীর কানের মতো লটপট করত। শীত-গ্রীষ্মে ওই ছিল তার মার্কামারা পোশাক। কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া করত না লক্ষ্মণ, তর্কাতর্কিতে যেত না, কাউকে কখনও অবহেলা করেনি। বিশাল এক যৌথ পরিবারে মানুষ, মা-বাবা বর্জিত কাকা-জ্যাঠার সংসারে তার অনাদর ছিল না হয়তো। কিন্তু সে পরিবারের আদর জানাবার সাধ্যই ছিল কম। কাকা পলিটিকস করত—তৎকালীন সি পি আইয়ের নিয়তকর্মী। জ্যাঠা দোকান দিয়েছিল। বাসায় পড়ার ঘর ছিল না। বইপত্র ছিল না, শোওয়ার জায়গারও কিছু ঠিক ছিল না। লক্ষ্মণের বাসায় গিয়ে দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখেছে অজিত। লক্ষ্মণের তাই বেশি আপন ছিল ঘরের বাইরের জগৎ। সকলেই ভালবাসত লক্ষ্মণকে। সেবার প্রথম আই এস সি ক্লাসে বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে অজিত বস্তুবিশ্বের অণুময় অস্তিত্বের বিষয়ে জানতে গিয়ে ভারী অবাক হয়। বিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতি বা অঙ্কের বই খুলে বসে সে এক অবাক বিস্ময়ভরা তত্ত্বজ্ঞানের মুখোমুখি হত। বিশ্বের সব কিছুর অস্তিত্বের স্বরূপ বিশ্লেষণ জানতে গিয়ে তার বহুকালের পুরনো সব ধারণা ভেঙে যাচ্ছিল। বহু ছেলেই আই এস সি পড়ে, তাদের কারও এসব মনেই হয় না। কিন্তু অজিতের ভিতরে চাপা বিষাদরোগ বীজাণুর মতো ওত পেতে ছিল। বিজ্ঞান পড়তে গিয়েই সেই বীজাণুর আক্রমণ টের পায়। সারাদিন বসে ভাবত—এই যে আমি, আমি কতগুলি অণুর সমষ্টি মাত্র? একদিন ঠাট্টা করে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ক্লাসে বললেন—মানুষকে পুড়িয়ে ফেললে খানিকটা কার্বন পড়ে থাকে, খানিকটা জল হয়ে উড়ে যায়। আমাদের এত আদরের শরীরের ওই হচ্ছে পরিণতি। জল আর কার্বন নিয়ে খুবই ভাবতে শুরু করেছিল অজিত। খেতে পারত না, রাতে ঘুমও কমে যেতে থাকে। মাথা-ভরা ওলট-পালট বিজ্ঞানের তত্ত্বজ্ঞান। বস্তুবিশ্বের গঠন, অঙ্কের কাল্পনিক সংখ্যা এবং অসীম চিহ্নের ব্যবহার তাকে মনে মনে ভয়ংকর উত্তেজিত এবং বিষাদগ্রস্ত করে তুলত। ইনফিনিটি শব্দটা নিয়ে ভাবতে বসে সে কেবলই অসীমতার ধারণা করতে গিয়ে মাথা চেপে ধরত ভয়ে। পাগল হয়ে যাব না তো! অবস্থা কাউকে বলাও যায় না। একা সওয়াও যায় না। সব ছেলেরা যখন রসায়নের ক্লাসে বস্তুত মলিকিউলার ভ্যালেন্সি বুঝছে তখন অজিত নিউক্লিয়াস আর তার চারধারে ঘূর্ণমান পরমাণুকণার ধারণা করতে গিয়ে ভারী অন্যমনস্ক হয়ে যেত। বুঝতে পারত অন্যান্য ছেলেদের মতো সে স্বাভাবিক নয়। সে একা, সে আলাদা। তার মতো চিন্তা বা দুশ্চিন্তা অন্য কারও নেই। ঠিক সেই সময়ে একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে লক্ষ্মণকে সঙ্গী পায়। সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ থেকে ওয়েলেসলি হয়ে হেঁটে কালীঘাট ফিরবে লক্ষ্মণ। কারণ তার পয়সা নেই। অজিত বলল—চলো তোমার ট্রামভাড়া আমি দেব। লক্ষ্মণ রাজি হল তবু বলল—পরে উঠব, ময়দান পর্যন্ত হাঁটি চলো। এ সময়ে ফাঁকা জায়গায় হাঁটতে বেশ লাগে। সেই থেকে বন্ধুত্ব। সারা রাস্তা কত কথা বলে গেল লক্ষ্মণ। অজিত ভাল শ্রোতা পেয়ে মনোহরদাস তড়াগের কাছে ঘাসে মুখোমুখি বসে তার বিজ্ঞান-বিষয়ক বিপদের কথা ব্যক্ত করলে লক্ষ্মণ তার হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল—মাইরি, আমারও ওরকম হয়। ‘আকাশের কথা’ নামে একটা বই পড়ে আমার মাথা গোলমাল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মনে হচ্ছে সেই কথাটাই ঠিক, মানুষ হচ্ছে জন্মান্ধ, তাকে একটা অন্ধকার ঘরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একটা কালো বেড়ালকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার কাকা একবার বলেছিলেন—সৃষ্টির আদি রহস্য জানাবার চেষ্টা করা মূঢ়তা। যদি তা কউ করতে যায় তবে সেই অন্ধকার ঘরে ঢোকার আগে সে যেন তার বোধবুদ্ধি রেখে যায়, নইলে পাগল হয়ে যাবে। তার মতো আর একজনও আছে যে কিনা বিজ্ঞানের তত্ত্বজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামায়—এই কথা জেনে কী রোমহর্ষময় আনন্দ হয়েছিল অজিতের। আজও গায়ে কাঁটা দেয়।

মজ্জাগত বিষাদরোগ যদিও কোনওদিনই ছাড়েনি অজিতকে, তবু ওই বন্ধুত্ব তার মনে একটা, হাওয়া-বাতাসের জানালা খুলে দিল। বড় অকপট, বন্ধুবৎসল ছেলে লক্ষ্মণ। মন-খারপ হলেই অজিত চলে যেত তার কাছে। লক্ষ্মণ তার চিরাচরিত পোশাকে বেরিয়ে আসত। রাস্তায় হাঁটত দুজনে, কয়েক পয়সার চিনেবাদাম কিনে নিত। পার্ক বা লেকের ধারে বসত গিয়ে। সেই বয়সের তুলনায় কিছু বেশি পড়াশুনো ছিল লক্ষ্মণের। বিবেকানন্দের বই ইংরেজিতে পড়েছে, নাড়াচাড়া করেছে কিছু রাজনীতির বই, সবচেয়ে বেশি ছিল তার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস—পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, কীভাবে ঘটছে, কেন—সে সব ছিল তার নখদর্পণে। তার কাছে খুব একটা মানসিক আশ্রয় পেয়েছিল অজিত। ওই ভাবেই তারা বড় হয়। আই এসসি থেকে বি এসসি। তারপরও লক্ষ্মণ পড়ল এম টেক। অনার্স ছিল না বলে অজিত লেখাপড়া ছাড়ে। বরাতজোরে এক ছোট্ট জীবনবিমা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। লক্ষ্মণ এম টেক-এ ভাল রেজাল্ট করে কিছুদিন চাকরি করল এখানে-সেখানে, একটা প্রফেসারিও করল কিছুদিন। বলত—অজিত, এখানে বড় কূপমণ্ডুকের জীবন। পাসপোর্ট করছি, দেখি কী হয়। পাসপোর্ট করেও রিনিউ করাতে হল লক্ষ্মণকে। প্যাসেজ মানির সংকুলান হত না। ভিসা পচে যেত। অজিতের ছোট্ট কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে মাইনে-টাইনে বাড়তে লাগল। কাজ কমল। বউ এল ঘরে। এবং বউয়ের সঙ্গে মা বাবার বনিবনার অভাব ঘটাতে অজিত ভবানীপুরের বাসা ছেড়ে আলাদা হয়ে উঠে এল টালিগঞ্জের কাছে। একটু বেশি বয়সেই লক্ষ্মণ গেল কানাডায়। বড় একা হয়ে গেল অজিত। ঘরে বউ, তবু একা। মেয়েরা যে পুরুষের গভীরতার বন্ধু নয় সে সত্য অজিতের চেয়ে বেশি কে জানে! আজ যদি আবার সেই বিষাদরোগ ফিরে আসে তবে অজিত জানে, নিঃসঙ্গতার কাছে ছাড়া ঘরে তার কেউ নেই যাকে বলবে তত্ত্বকথা। কত প্রেমের গল্প লেখা হয়, একটা মেয়েকে নিয়ে কত টানাপোড়েন, কত দ্বন্দ্ব, কত আশা-নিরাশা, ব্যর্থতা ও মিলন, হায়, নারী প্রেম তবু জীবনের কতটুকু মাত্র জুড়ে আছে। মেয়েদের সাধ্য কী স্পর্শ করে ধীমান পুরুষের গভীর নিঃসঙ্গতা! মেয়েমানুষের প্রতি প্রেম তাই ফুরিয়ে যায়, জুড়িয়ে যায়। কিন্তু দূরের লক্ষ্মণের জন্য অজিতের পিপাসা ঠিক জেগে থাকে। বন্ধুর মতো বন্ধু পেলে পৃথিবীর কত বিষণ্ণতার অর্থ হয়ে যায় আনন্দ!

অজিতের ছেলেপুলে হল না। সরকার খেপে খেপে মাইনে বাড়িয়ে গেল। আগে ইউনিয়ন করত, শীলা বকে বকে ছাড়াল ইউনিয়ন। বছরখানেক আগে প্রোমোশন পেয়ে সেকশন ইনচার্জ হয়ে গেল অজিত। শীলাও একটা গার্লস স্কুলে চাকরি করছে। দুজনের রোজগার। ফলে হাতে টাকা জমে গেল কিছু। লক্ষ্মণকে লিখল কাছাকাছি দুটো প্লটে জমি আছে, লক্ষ্মণের জন্য একটা কিনবে নাকি? দুই বন্ধুতে পাশাপাশি থাকবে সারাজীবন। তত্ত্বজ্ঞানী সহৃদয় বন্ধু আর কে আছে! চিঠি পেয়েই লক্ষ্মণ টাকা পাঠিয়েছিল জমি কিনবার জন্য।

ল্যাম্পপোস্টের মাকড়সার জালের মতো ভৌতিক আলোটি লক্ষ্মণের জমির ওপর ময়লা জলের মতো পড়ে আছে। ব্যাডমিন্টন কোর্টের আশে-পাশে কাঁটাঝোপ। বর্ষাকালে পাগলা চেঁকি, ভাঁট আর আগাছায় ছেয়ে যায়। লক্ষ্মণ জার্মান এক মহিলাকে বিয়ে করেছে, পেয়েছে ইমিগ্রান্ট ভিসা, জমিটা বেচে দিতে লিখেছে।

প্রধানমন্ত্রীর বিষণ্ণ-গম্ভীর কণ্ঠস্বর ক্রমে উঁচুগ্রামে উঠছে। সেতারের ঝালার মতো। এবার থামবে। ঘোষক বলবে—এতক্ষণ তিনতালে প্রথমে বিলম্বিত এবং পরে দ্রুত রাগ শোনালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী…ইত্যাদি। অজিতের বিদেশি সিগারেট শেষ হয়ে আসে। ফিল্টারটায় আগুন ধরেছে, পোড়া একটা গন্ধ পাওয়া যায়। সেটা ফেলে দিয়ে আর একটা ধরায় অজিত। রনসন গ্যাসলাইটারটার চাকা ঘুরিয়ে হঠাৎ প্রায় আধফুট উঁচু একটা শিখা তৈরি করে। নিবিয়ে দেয়। লক্ষ্মণ কোনওদিনই ফিরবে না।

শীতের নির্জন রাস্তা দিয়ে কুয়াশায় ডুবন্ত একটা ছায়ার মতো মানুষ আসছে। সামনে এসে চিন্তামগ্ন মুখটা তুলল। অন্ধকার বারান্দায় সম্ভবত সিগারেটের আগুন দেখে জিজ্ঞেস করে—অজিত নাকি?

আরে রণেন!

—খবর আছে।

—কী?

—ভিতরে এস বলছি।

অজিত মন্থর পায়ে ভিতরে আসে। ঘর ভরতি প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর। শীলা বোনা অংশটুকু তুলে আলোয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নকশাটা দেখছে। অজিত দরজা খুলে এক বিপর্যস্ত রণেনকে দেখতে পায়। আজকাল রণেন একটু মোটাসোটা হয়েছে। ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়ায় এবং টাক পড়ছে বলে একটু বয়স্ক দেখায়। তবু আজকাল আগের তুলনায় অনেক বেশি রংদার, বাহারি পোশাক পরে সে। আজও পরনে নেভি ব্লু রঙের একটা স্যুট, গলায় টাই, কোটের তলায় দুধসাদা জামা। চুল বিন্যস্ত, দাড়িও কামানো। তবু বিপর্যয়ের চিহ্ন ফুটে আছে তার মুখে-চোখে। হা-ক্লান্ত এবং হতাশা মাখানো মুখ।

শীলা মুখ তুলেই হাতের বোনাটা রেখে দিল। বলল—কী রে দাদা?

সেই মুহূর্তেই প্রধানমন্ত্রী বলে উঠলেন—জয় হিন্দ। এবং জনতা তার প্রতিধ্বনি করল। শীলা নিজেই রেডিয়োটা বন্ধ করে দেয় এবার। উৎকণ্ঠায় রণেনের দিকে চেয়ে থাকে।

রণেন চেয়ারে বসে একটু এলিয়ে হাতের ফোলিও ব্যাগটা মেঝেয় রেখে হাতের চেটোয় মুখটা ঘষে নেয়। বলে—একটু চা কর তো।

—করছি। কী হয়েছে?

—গ্রহের ফের। বলে রণেন অজিতের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে—এল আই সি-তে চেকটায় খোঁজ নিয়েছিলে?

অজিত তার বিদেশি সিগারেটটার ফিল্টার পুড়িয়ে ফেলেছে আবার। সেটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে বলে—নিয়েছি। কাল-পরশুই ইস্যু হওয়ার কথা।

—কিন্তু বাবা আসতে পারছেন না। বহেরু লিখেছে বাবার শরীর ভাল নেই। কলকাতা থেকে ফিরে গিয়েই অসুস্থ। বাবাকে ছাড়া চেক তো ওরা আর কাউকে দেবে না!

—না

—ব্যাপারটা এত দূর ম্যাচিওর করেও ঝুলে গেল!

অজিত ভ্রূ কুঁচকে বলে—শ্বশুরমশাইয়ের কী হয়েছে?

—জানি না। বহেরু ভেঙে তো কিছু লেখেনি। লিখেছে, বুকে ব্যথা। তা থেকে কিছু আন্দাজ করা সম্ভব নয়। এদিকে আমি সিমেন্টের পারমিট বের করেছি। লোহালক্কড়ও পেয়ে যাচ্ছি সস্তায়। টাকা অ্যাডভান্স করা হয়েছে। এত দূর এগিয়ে আবার বসে থাকতে হবে। চেক-এর ভ্যালিডিটি কতদিন থাকে? তিন মাস?

—ওরকমই।

শীলার মুখটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। বলল—তুই একবার গিয়ে দেখে আয় না!

রণেন একটু চড়া গলায় বলে—যাব বললেই যাওয়া যায়! তোর বউদির বোধ হয় একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল।

—কী?

—কনসিভ করেছিল। তিন মাস। কাল থেকে ব্লিডিং —

—ইস! কী করে হল? পড়েটড়ে যায়নি তো!

—না। কিছু বলেনি সেরকম। আজ নার্সিং হোমে ভরতি করে দিতে হল। এক সঙ্গে এত ঝামেলা যে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি। জলের মতো কিছু টাকা বেরিয়ে যাবে।

কেউ কথা বলল না। রণেনই আবার বলে—অজিত, জমিটার ব্যাপারে তুমি কি আর সময় দিতে পারো না?

অজিত উত্তর দেয় না। হাতের রনসন লাইটারটার দিকে চেয়ে থাকে। শীলা উৎকণ্ঠিত মুখ তুলে স্বামীকে দেখে।

—পারো না? রণেন আবার প্রশ্ন করে।

অজিত ভ্রূ কুঁচকে বিপরীত দেয়ালে কাঠের চৌখুপিতে রাখা হরেক পুতুলগুলো দেখে। প্রধানমন্ত্রী চুপ করেছেন। দূর থেকে সম্ভবত পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর আসতে থাকে। অজিত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—মুশকিল হল, লক্ষ্মণের এক পিসেমশাই প্লটটার ব্যাপারে জানেন। লক্ষ্মণও লিখেছিল যেন তার পিসেমশাইকে প্লটটা আমি বিক্রি করে দিই। উনি আট হাজার টাকা অফার দিয়েছিলেন। আমি লক্ষ্মণকে লিখি যে জমি অলরেডি বায়না হয়ে গেছে, কয়েক দিনের মধ্যেই রেজিষ্ট্রি হয়ে যাবে। এদিকে সেই পিসেমশাই এখনও খোঁজখবর রাখছেন যদি বাই চান্স পার্টি পিছিয়ে যায়, তবে উনিই কিনবেন। ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখা খুবই দৃষ্টিকটু হবে। লক্ষ্মণ কোনও প্রশ্ন তুলবে না, কিন্তু মনে মনে অবাক হবে। তার খুবই ইচ্ছে ছিল পিসেমশাইকে প্লটটা বিক্রি করি।

শীলা ভ্রূ কুঁচকে বলে—তোমার তো খুব বন্ধু সে। তাকে একটু বুঝিয়ে লিখে দাও না।

—বোঝাবার কী আছে! সে তো তাগাদা দেয়নি। তাগাদা যা আমারই। তা ছাড়া ওই পিসেমশাই ভদ্রলোক রিটায়ার করে সামান্য কিছু টাকা পেয়েছেন। কলকাতায় ওই টাকায় জমি পাওয়া যে কী মুশকিল, তাই ভদ্রলোক খুব আশায় আশায় এসেছিলেন লক্ষ্মণের জমিটার জন্য। তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছি জমি বিক্রি হয়ে গেছে বলে। লক্ষ্মণকে আমি এখন কী লিখব?

—একটু সময় চাও।

অজিত অদ্ভুত চোখে শীলাকে দেখে। বলে—চাইব কেন? সে তো আমায় সময় বেঁধে দেয়নি। জমি বিক্রির টাকারও তার দরকার নেই। টাকাটা তার অ্যাকাউন্টে কলকাতার এক ব্যাঙ্কে জমা পড়বে। প্রবলেম তো সেখানে নয়।

—তা হলে আর প্রবলেম কী? তুমি চুপচাপ থাকো জমির ব্যাপারে। বাবা সুস্থ না হয়ে এলে তো রেজিস্ট্রি হবে না।

রণেন ম্লানমুখে বলে—শোনো অজিত, বাবা বুড়ো হয়েছেন, তাঁর অসুখকে বিশ্বাস নেই, গুরুতর কিছু হলে—বলে একটু চুপ করে থাকে রণেন। শীলা তার মুখের দিকে চেয়ে আছে, অজিতও। রণেন চোখটা নামায়, বলে—কাজেই তাঁর ভরসায় থাকাটা এবং তোমাকেও অসুবিধেয় ফেলাটা ঠিক নয়। আমি অন্য একটা ব্যাপার ভাবছি।

—বলো। অজিত নিস্পৃহ গলায় বলে।

—ধরো যদি টাকাটা আমিই জোগাড় করে দিই তা হলে কেমন হয়?

অজিত একটু বিস্মিত হয়ে বলে—তুমি দেবে? তা হলে এতদিন ওল্ডম্যানের ভরসায় ছিলে কেন?

—সেটা মার আইডিয়া। মার ধারণা বাবার টাকা বারোভূতে লুটে খাবে, তাই বাবার কিছু টাকা ছেলেদের জন্য আদায় করে দিতে চেয়েছিল মা। সেটা যখন আপাতত হচ্ছে না তখন জমিটা কেন হাতছাড়া হয়! বীণার সঙ্গে আমি পরামর্শ করেছি, সে তার কিছু গয়না দেবে, আমিও প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে লোন নিচ্ছি, আরও কিছু জোগাড় করেছি। সব মিলিয়ে জমির দামটা হয়ে যাবে।

শীলা তার বড় বড় চোখ পরিপূর্ণ মেলে রণেনকে দেখছিল। হঠাৎ বলল—জমিটা তা হলে কার নামে কেনা হবে?

রণেন তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নেয়। বলে—সেটা এখনও ঠিক করিনি! তবে, মার ইচ্ছে, আমার নামে হোক।

—তোর কী মত?

রণেন একটু ইতস্তত করে বলে—বীণার গয়নার অংশটাই বড়। মেজর টাকাটা ও-ই দিচ্ছে যখন, প্লটটা তখন ওর নামেই কেনা হোক। নইলে ওর বাপের বাড়ির লোকেদের চোখে ব্যাপারটা ভাল দেখাবে না।

শীলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে যায়।

রণেন মুখ তোলে।

—অজিত!

—বলো।

—আমি দিন-সাতেকের মধ্যেই পেমেন্ট করব।

—ভাল৷

—তা হলে উঠি!

—বোসো। শীলা তোমার চা করতে গেল।

রণেন বসে। কিন্তু তার মুখচোখে একটা রক্তাভা ফুটে থাকে। সে যে স্বস্তি বোধ করছে না, তা বোঝা যায়। অজিত চেয়ে থাকে। একসময়ে রণেনও তার বন্ধু ছিল, বেশি বয়সের বন্ধু। সেই সূত্রেই ওর বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অজিতের। কিন্তু লক্ষ্মণ যেমন বন্ধু তেমন বন্ধু রণেন নয়। এখন ওর দিকে চেয়ে একটু মায়া হয় অজিতের।

রাতে শুয়ে শীলা বলল—শুনছ?

—কী?

—বউদির নামে জমিটা দিও না। আমি অনেক ভাবলাম সারা সন্ধ্যা।

—কী ভাবলে?

—দাদা নানা ছুতোয় ইচ্ছে করেই বউদির নামে প্লটটা কিনছে।

—কিনুক না!

—তুমি কিছু বোঝে না। বউদির নামে বাড়ি হলে সেখানে সোমেন বা মার দাবি-দাওয়া থাকে না। আমরাও সেখানে বাপের বাড়ি বলে মাথা উঁচু করে যেতে পারব না। তুমি ওকে বেচো না।

অজিত সামান্য উম্মার সঙ্গে বলে—সেটা রণেন থাকতে-থাকতেই বলতে পারতে। ওকে কথা দিয়ে দিলাম, তা ছাড়া ও বউয়ের গয়নাটয়নাও বেচেছে বলল।

—ছাই। বউদি গয়না বেচতে দেওয়ার লোক কিনা! তা ছাড়া সবাই জানে দাদা দ’হাতে পয়সা রোজগার করছে। বিয়ের পর থেকেই ও যথেষ্ট পালটে গেছে। তোল্লা ঘুষ খায়। দশ-বিশ হাজার টাকার জন্য ওকে বউদির গয়না বেচতে হবে না। যদি বেচে তো সে লোক দেখানোর জন্য।

অজিত অন্ধকারে একটু হাসল। বলল—আমার কাছে সবাই সমান। পিসেমশাই কিনুক, কী রণেনের বউ কিনুক, কী শাশুড়িই কিনুক—আমার কিছু যায় আসে না।

শীলা ঝংকার দিয়ে বলে—কিন্তু আমার যায় আসে। তুমি দাদাকে বেচতে পারবে না।

—তা হলে কী করব?

—আমি কিনব। শীলা বলে।

—তুমি? তুমি কিনে কী করবে?

—ফেলে রাখব। যেদিন বাবা টাকা দিতে পারবেন সেদিন ছেড়ে দেব।

—তা হয় না।

—কেন?

—বড্ড দৃষ্টিকটু দেখায়। লক্ষ্মণ কী ভাববে? তা ছাড়া রণেন আর তার বউও চটে যাবে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেবে।

শীলা চুপ করে থাকে। ভাবে। বলে—তাহলে লক্ষ্মণবাবুর পিসেমশাইকেই বিক্রি করে দাও।

একটু স্তব্ধ থেকে অজিত বলে—রণেন কি তোমার শত্রু? সে কিনলেও জমিটা তোমার বাপের বাড়ির হাতেই থাকল।

শীলা একটু শ্বাস ফেলে বলে—পুরুষমানুষ তুমি, তোমাদের মন একরকম। মেয়েদের মনই কেবল কু-ডাক ডাকে।

—রণেনকে অত অবিশ্বাস কেন? সংসারটা তো এতকাল সে-ই টানছে। টানবেও। ছেলে হিসেবে রণেন তার সব কর্তব্যই করেছে। তোমার বাবা যখন টাকা তুলতে আসতে পারছেন না, অনিশ্চিত অবস্থায় জমিটা হাতছাড়া না করে রণেন যদি কেনেই তো তাতে দোষ কী! বউয়ের নামে কিনলেও দোষ নেই। নিজের বাড়ি বলে সে যে মা-ভাইকে বের করে দেবে, এমন তো মনে হয় না।

শীলা চুপ করে থাকে। কিছু বলার মতো যুক্তি খুঁজে পায় না বোধ হয়। এক সময়ে বলে—বাবার যে কেন এসময়ে অসুখ করল! চলো না একদিন বাবাকে দেখে আসি।

—তোমার বাবা আমাকে পছন্দ করেন না, জানোই তো!

—কাকেই বা করেন! বাবার ভালবাসা আমরাই পাইনি, যা একটু দাদা পেয়েছে। মার জীবনটা যে কীভাবে কাটল!

অনেকক্ষণ স্তব্ধ থাকে শীলা। তারপর অজিত টের পায়, শীলা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ভীষণ অসহায় বোধ করে অজিত। কান্নাকাটি তার সহ্য হয় না। উঠে একহাতে শীলাকে নিজের দিকে পাশ ফেরাবার চেষ্টা করতে করতে বলে—আচ্ছা বোকা তো! কাঁদো কেন? না হয় যাব শ্বশুরমশাইকে দেখতে, রণেনকেও না হয় প্লটটা না বেচলাম।

শীলা তবু কাঁদে। সাধাসাধি করে করে ক্লান্ত হয়ে গেল অজিত। ঘুমও হবে না। অগত্যা উঠে একটা ডানহিল ধরায়।

সেই শব্দে শীলা হঠাৎ ফোঁপানি বন্ধ করে বলে—তুমি চলে গেলে কেন? ভিতরে এস।

—যাচ্ছি। সিগারেটটা খেয়ে নিই।

—না। সিগারেট নেবাও।

—আঃ, একটু অপেক্ষা করো না।

—না, এক্ষুনি ভিতরে এস।

অজিত শ্বাস ফেলে বলে—কখন যে কী মনে হয় তোমার! একখানা হাত টেনে নেয় বুকের ওপর। অজিত আন্দাজে বালিশের তোয়ালে তুলে শীলার চোখ-মুখ মুছে দেয়। বলে—কেন কাঁদলে? বাবার জন্য, নাকি রণেন জমি বউয়ের নামে কিনছে বলে?

—ওসব কারণ নয়।

—তবে?

শীলা চুপ করে থেকে বলে—আমি একটা জিনিস টের পাই আজকাল।

—কী?

—তুমি আমাকে ভালবাস না।

॥ নয় ॥

খুব ভোরেই ঘুম ভাঙল রণেনের। বিছানা আজ ফাঁকা। শুধু বড় ছেলেটা একধারে কেৎরে লেপের তলায় শুয়ে আছে। মেয়ে আর ছোট ছেলে তাদের ঠাকুমার কোল কাড়াকাড়ি করে শুয়েছে, ওঘরে। বড় ছেলেটার মাথায় একটোকা চুল, মস্ত মাথাটা জেগে আছে লেপের ওপরে, মুখ নাক ঢাকা। বীণা আজ পাঁচদিন নার্সিং হোমে।

বুবাইয়ের মুখ থেকে লেপটা সাবধানে সরিয়ে দিল রণেন। ভারী হালকা আর ফুরফুরে আছে মনটা। সকাল থেকেই যে গাম্ভীর্য তাকে চেপে ধরে সেটা কদিন হল একদম নেই। বীণা নার্সিং হোমে যাবার পর থেকেই নেই। অন্যদিন লেপ ছেড়ে উঠতে কষ্ট হয়। আজ হল না। শিস দেওয়া তার আসে না। ছেলেবেলা থেকে অনেক চেষ্টা করে দেখেছে, ঠোঁট ছুঁচোল করে নানা কায়দায় বাতাস ছেড়েছে, বড় জোর একটা কুঁই কুঁই আওয়াজ তুলতে পারে। তবু মন খুশি থাকলে রণেন আড়ালে শিস দেয়। অর্থাৎ ওই আওয়াজটা বের করে। আওয়াজটা একটানা হয় না, বাতাসটা বেরিয়ে যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে একটু কুঁই শব্দ তুলে তার মান রেখে যায় মাত্র।

এক কাকভোরে রণেন উঠে গায়ে হাতঅলা একটা উলিকটের গেঞ্জি পরল, লুঙ্গিটা ঝেড়ে পরতে পরতে ড্রেসিং-টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজেকে দেখে তার খুব বেশি পছন্দ হল না। পেটটা বেশ বেড়ে গেছে, গলায় চর্বির গোটাকয়েক থাক। গাল দুটোও কি বেশ ভারী নয়? ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজেকে দেখল সে। হাত ভাঁজ করে বাইসেপ টিপে দেখল গেঞ্জির ওপর দিয়েই।

না, তেমন শক্ত হয় না আজকাল। অর্থাৎ অপরিহার্য মেদ জমছেই। লোকে বলে তার ব্যক্তিত্ব নেই। ব্যাপারটা সে ঠিক বোঝে না। চিরকালই সে কিছু ঢিলা-ঢালা রশি-আলগা মানুষ, একটু আয়েশি; টিপটপ থাকা তার আসে না। অনেক মানুষ যেমন কল-টেপা পুতুলের মতো ঘুম থেকে উঠে চট-জলদি হাতে নিখুঁত দাড়ি কামিয়ে, দাঁত মেজে, স্নান সেরে, এক্সিকিউটিভ-টি সেজে, ব্রেক-ফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসে—তার সেরকম হবেও না কোনওদিন। ফুড-ইনস্পেকটরের বেলা এগারোটার পরে বেরোলেও ক্ষতি নেই, অঢেল আউটডোরে ঘোরা আছে তারপর। কিন্তু বীণা সেরকম পছন্দ করে না। বীণা যে কী চায়!

কিন্তু বীণা আপাতত নার্সিং হোমে। পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল। তা যাক। রণেন সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। আপাতত সে ব্যক্তিত্ব কথাটা নিয়ে ভাবছিল। তার ব্যক্তিত্ব নেই এটা একটা চাউর ব্যাপার। আয়নায় সে তার ব্যক্তিত্বটা একটু খুঁটিয়ে দেখছিল। প্রথমে সে ছোট চোখে চাইল, তারপর বিস্ফারিত চোখে একবার মুখটা তোল্লা গভীর করল, একবার ছটাকী একটু হাসির বিজলি খেলিয়ে দেখল। বাঁধার এবং ডানধার থেকে দেখে অতঃপর সে ছোট হাত-আয়নাটা বড় আয়নার মুখে মুখে ফেলে নিজের সঠিক চেহারাটা লক্ষ করে। আয়নার উলটো ছায়া পড়ে আর একটা আয়নায় সেই উলটো ছায়াটাকে উলটে নিয়ে নিজের প্রকৃত চেহারাটা দেখা যায়। কিন্তু দেখেটেখে খুব একটা প্রভাবিত হয় না সে। কিংবদন্তীর খানিকটা সত্যিই। চর্বিওলা তুম্বো গাল দুটো আর ছোট চোখে কি ব্যক্তিত্ব ফোটানো যায়! কিন্তু চার্চিলের ছিল, বিবেকানন্দের ছিল। দুনিয়ার বিস্তর মোটাসোটা মানুষের এখনও ব্যক্তিত্ব আছে। কিন্তু সে যখন রোগা ছিল তখনও ছিল না, সে যখন মোটা হয়েছে তখনও নেই।

নেই, কিন্তু তাতে ধৈর্য হারায় না সে। নিরিবিলিতে একা একখানা আয়না হাতের কাছে পেলে সে নিজের দিকে চেয়ে বিস্তর খোঁজে। এবং নিজেকে বিরল ধমকধামকও দেয়। কিন্তু লোকের সামনে সে গম্ভীর মানুষ, কথা কম, ভারী দায়িত্বশীল কাজের মানুষ।

সোমেন বা মা কেউ এখনও ওঠেনি। শিস দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টাটা চালাতে চালাতে সে দাঁতটাঁত মেজে নিল, ইসবগুলের ভুষি খানিকটা জলে নেড়ে খেল। মোজা এবং একজোড়া ন্যাকড়ার জুতো পরে বেরিয়ে পড়ল। রোজই সে খানিক সকালে বেড়ায় আজকাল। বীণা তার মেদ কমানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

দরজা ভেজিয়ে শিস দেওয়ার চেষ্টার অবিরল শ্বাসবায়ুর উদ্ভট শব্দটা করতে করতে সে নিচতলার সদর খুলে রাস্তায় পড়ল। ধারেকাছে পার্ক নেই। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল যোধপুর পার্কে। ঝিলের ধারে অনেকটা ফাঁকা জমি পড়ে আছে। শোনা যাচ্ছে, একদিন এখানে পার্ক হবে। ফাঁকা জায়গায় পড়েই দ্রুতপায়ে চক্কর দিতে থাকে সে। লক্ষ করে, সে আজ বড্ড সকালেই চলে এসেছে। কাছেপিঠে কেউ নেই। শুধু দূরে দু-চারজন খাটালওলা লোটা হাতে ফাঁকা ঝিলপাড়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক কাজে। সে দ্রুত চারদিক দেখে নিয়ে লুঙ্গিটা কেচে নিয়ে ফটাস করে মালকোঁচার মতো এঁটে নিল। প্রকাণ্ড উরুত দুটো বেরিয়ে পড়েছে, উঁচু হয়ে আছে দাবনা। একটু লজ্জার ভাব ঝেড়ে ফেলে পাঁই পাঁই দৌড়োতে লাগল সে। মেদটা ঝরাতেই হবে। শরীর বা মনে একটা গভীর পরিবর্তন দরকার। রণেনের ঠিক রণেন হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। হঠাৎ নিজের সব ভেঙেচুরে ফেলে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে স্লিম ফিগারের একজন এক্সিকিউটিভ, কিংবা পারসোনালিটিঅলা ডাইরেকটর, কিংবা হেভি ফাঁটের একজন ডিপার্টমেন্টাল সেক্রেটারি। যাহোক কিছু একটা। শুধু ফুড ইনস্পেকটর রণেন লাহিড়ি বাদে।

দু-চক্কর ঘুরতেই জিব বেরিয়ে গেল। শুকনো টাকরায় লেগে জিবটা টকাস শব্দ করে। দু-চারজন বুড়োসুড়ো মানুষ রাস্তায় হাঁটছে, চেয়ে দেখছে তাকে, রণেন দাঁড়িয়ে লুঙ্গি নামায় প্রচণ্ড হাঁফাতে হাঁফাতে বুকে হাত চেপে হৃৎপিণ্ডকে সামাল দেয়—র’ বাবা র’!

যতদূর সম্ভব গম্ভীর হয়ে বাসায় ঢুকল সে। বাচ্চাগুলো এখনও ওঠেনি। মা নার্সিং হোমে বলে ঠাকুমার প্রশ্রয় পায় বড্ড বেশি। বীণা থাকলে ঠিক এই শীতভোরে তুলে দিত, ঠকঠকিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে দাঁতটাঁত মেজে সেগুলো পড়তে বসত এতক্ষণে। দেখে ভারী কষ্ট হয় রণেনের। ক’দিন ঘুমিয়ে নিক। বাচ্চাবেলায় শীতভভারের লেপঘুম যে কী আরামের! আহা, ঘুমোক।

সোমেন রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে হাই তুলছে। চা ওর প্রাণ। মা আঁচলে চেপে চায়ের কেটলি নামাল গ্যাস-উনুন থেকে। রণেন সাধারণত নিজের ঘরে বসে চা খায়, একা। রান্নাঘরের দরজায় বসে চা-খাওয়া যে কী মৌজের তা বীণার রাজত্বে সে টেরই পায় না। সংসারের কর্তা সকলের সঙ্গে মেঝেয় বসে হুইহাট চা খাবে, কী গল্প করবে—তাতে ওজন কমে যায়। আজকাল বীণা নেই। সোমেনের পাশেই মেঝের ওপর থপাস করে বসে সে। আরামের একটা শব্দ তোলে—ওঃ ও! মাজাটায় একটা খচাং টের পায়। বুড়ো হাড়ে দৌড়টা ঠিক হজম হয়নি। সোমেন তটস্থ হয়ে সরে জায়গা দেয়। মা কলকা ছাপের খদ্দরের চাদরের মোড়ক থেকে মাথা বের করে তাকে দেখে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বহীন একগাল হাসে রণেন। বলে—মেরে দিলাম একটা দৌড়।

সোমেন হাঁ করে তাকায়। মা বলে—কী বলছিস? কাকে মারলি?

রণেন ভারী আমুদে গলায় বলে—যোধপুর পার্কে বেড়াতে যাই তো রোজ, আজ দেখলাম ফাঁকা, কেউ নেই। লুঙ্গিটা কেঁচে নিয়ে মারলাম দৌড়। মাজাটা গেছে। ওঃ।

—ইস! ওসব দৌড়ঝাপ কি তোর সয়! মা দুঃখের গলায় বলে—তোর হচ্ছে আদুরে ধাত।

—ওই আদর দিয়ে দিয়েই তো খেয়েছ। এই বয়সে পোয়াতির মতো ভুঁড়ি, নাড়ুগোপাল নাড়ূগোপাল চেহারা! চা দাও তো।

মা একটা শ্বাস ফেলে বলে—আদর আর দিতে পারি কই? বউয়ের হাতে দিয়েছি, সে যা দিয়ে যা করে। আমাদের কি আর আদর দেওয়ার ক্ষমতা আছে।

কী কথার কী উত্তর! তবু গায়ে মাখে না রণেন। প্রায় চোদ্দো বছরের ছোট ভাইটার দিকে চায়। তারই ভাই, তবু চেহারায় প্রায় বিপরীত। লম্বা, রোগাটে, চোখা বুদ্ধিমানের চেহারা। অল্প বয়স, দাড়িকাড়িও ঠিকমতো কামায় না, নইলে ঠিকই বোঝা যায় যে ব্যক্তিত্বের চেহারা।

রণেন হঠাৎ বলে—বসে না থেকে আই এ এসটা দিয়ে দে না!

সোমেন অবাক হয়ে বলে—আই এ এস! আমি?

রণেন মাথা নাড়ে। বলে—আজকাল যেন কোথায় ট্রেনিং দেয়?

—ইউনিভার্সিটিতে।

—ভরতি হয়ে যা। আমি টাকা দেব। নিশ্চিত গলায় বলে রণেন।

সোমেন সামান্য হাসে, বলে—টাকাফাকার জন্য নয়। আমার ইচ্ছে করে না।

—কেন, ইচ্ছে করে না কেন?

—ওসব আমার হবে না। খামোখা চেষ্টা।

—দ্যাখ না। লেগে যেতে পারে। বলে খুব ভরসার হাসি হাসে রণেন। বহুকাল এমন সহজভাবে কথাবার্তা হয়নি তিনজনে। বীণা নার্সিং হোমে যাওয়ার পর থেকে হচ্ছে। ভাইয়ের দিকে একটু চেয়ে থাকে রণেন। ওই রকম তেইশ চব্বিশ বছর বয়সে তারও কি সোমেনের মতো চেহারা ছিল? অবিকল না হলেও ওরকমই অনেকটা ছিল সে। বহেরুর খামারবাড়িতে সে যেতটেত তখন। নয়নতারার সঙ্গে তখন তার একটা সম্পর্ক ছিল।

মনে পড়তেই ফুড়ুক ফুড়ুক একটু হেসে ফেলল সে, আপনমনেই। ব্যক্তিত্বের অভাব। হাসিটা চাপা উচিত ছিল। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল—বহেরুর ওখানে কাকে কাকে দেখলি?

সোমেন বলে—কাকে দেখব? হাজারটা লোক, কাউকে আলাদা করে দেখার উপায় কী? তবে গন্ধ বিশ্বেস, দিগম্বর…

বিরক্ত হয়ে রণেন বলে—ওরা নয়।

—তবে?

—বহেরুর ছেলেপুলেদের কাকে দেখলি?

—চারটে ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, আরও সব আছে। একটা মেয়েকে দেখলাম—বিন্দু, ডিভোর্সড।

—ডিভোর্সড আবার কী! ওরা ওইরকম, ছেড়ে চলে আসে, আবার বিয়েফিয়েও করে। আইনটাইন মানে না। আমি যখন যেতাম তখন নয়নতারা নামে একজন ছিল, সেও ওইরকম—

সোমেন মাথা নেড়ে বলে হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে একজন। আলাপ হয়নি। দূর থেকে আমাকে খুব দেখছিল।

রণেন আপনমনে হাসে। বহুকাল আগের কয়েকটা দিন মনে পড়ে। নয়নতারা খুব জমিয়েছিল তার সঙ্গে। বেশি কিছু নয় অবশ্য। এই একটু জড়িয়ে-উড়িয়ে ধরা। দু-চারটে চুমু, আনাড়ির কাজ সব। তবু ভোলা যায় না। সে সবের জন্য সে তার পৈতেয় পাওয়া একটা আংটি খুলে দিয়ে এসেছিল নয়নতারাকে। বাড়ি এসে একটা ছিনতাইয়ের গল্প বলেছিল। মা অনেকদিন আংটিটার কথা দুঃখ করে বলেছে। আংটিটা তার নামের দুটো আদ্য অক্ষর মিনা করা ছিল—আর এল। আংটিটা কি আজও আছে নয়নতারার আঙুলে, বা বাক্সে? ভারী বিহ্বল লাগছিল ভাবতে।

সুখের স্বপ্নটা ভেঙে হঠাৎ চমকে ওঠে রণেন। ভারী ভয়-ভয় করে হঠাৎ। আংটিটা কি এখনও রেখেছে নয়নতারা? সর্বনাশ ওই আংটি দিয়ে যে এখনও অনেক কিছু প্রমাণ করা যায়। রণেন মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকে—অবশ্য, বেশি কিছু নয়, বেশি কিছু নয়। সবই আনাড়ির কাজ, ছেলেমানুষি…ইত্যাদি।

চায়ের সুঘ্রাণ এবং তাদের তিনজনের এই কাছাকাছি বসে থাকা—বেশ ভাল লাগছিল রণেনের। বলল—সোমেন, কাল তুই বরং নার্সিং হোমে যাস, বউদিকে দেখে আসিস। আমি বরং কাল একবার বাবাকে দেখতে যাই।

সোমেন বলল—তোমার যাওয়ার কী দরকার? আমিই বরং—

—না, না। কাল রবিবার আছে। আমিই যাব’খন। অনেককাল যাই না। বাবাকে দেখে আসি, বহেরুটাও গড়বড় করছে

মা বলে—বউমাকে আর কদিন রাখবি ওখানে?

—আছে থাক না। রণেন অন্যমনস্কভাবে বলে—বেশ তো আছে। বলেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে কথা উলটে বলে—ডাক্তার ঠিক এখনই ছাড়তে চাইছে না।

মা একটু অনুযোগ করে—ততাদের সবটাতেই বাড়াবাড়ি। হুট বলতে ডাক্তার। হুট বলতে নার্সিং হোম। মেয়েরাও কেমনধারা হয়ে গেল, সজ্ঞান অবস্থায় একটা পরপুরুষ ডাক্তার মেয়েদের শরীরে হাত দেবে এ কেমন কথা! পেটে বাচ্চা এলে দশবার চেক-আপ, লজ্জা হায়া কোথায় যে গেল। তুই নিয়ে আয় তো, কিছু হবে না।

সোমেন এসব শুনে উঠে পড়ে। রণেন হাসে। বলে—ডাক্তারই ছাড়তে চাইছে না যে!

—কেন? স্রাব বন্ধ হয়ে গেছে, অপারেশনও যখন দরকার নেই, তখন আর গুচ্ছের টাকা গুনবি কেন?

—অপারেশন! বলে একটু চোখ বড় করে চায় রণেন। বলে—একটা মাইনর অপারেশন দরকার ছিল বটে।

—তা না হয় সেটাই করিয়ে আন।

—পাগল হয়েছ? ওখানকার ডাক্তার হচ্ছে সাহা। এমনিতে ডাক্তার ভালই। কিন্তু দিনরাত কেবল খাওয়ার গল্প। অমন ইলিশ-ভক্ত তোক দুটো নেই। আমাকে প্রায়ই বলে—পদ্মার ইলিশ! ও আর উনুনে চড়াতে হয় না, একটু তেল-সরষেবাটা মেখে বগলে চেপে রাখুন, বগলের ভাপেই সেদ্ধ হয়ে যাবে—এত নরম সুখী মাছ! বলতে বলতে বুঝলে মা, ডাক্তারের চোখ দুখানা স্রেফ কবির চোখ হয়ে গেল। উদাস, অন্যমনস্ক। হাত থেকে স্টেথেসকোপের চাকতিটা পড়ে গেল ঠকাস করে, চশমা খুলে বুঝি চোখের জলও মুছল। সেই থেকে অপারেশনের নামে আমি ভয় পাই। রুগির শরীরে ছুরি বসিয়ে যদি লোকটার হঠাৎ ইলিশের কথা মনে পড়ে, যদি ওরকম অন্যমনস্ক আর উদাস হয়ে যায়, তা হলে তোমার বউমার কী হবে!

সোমেন যেতে যেতেও শেষটুকু শুনে হেসে ফেলে। মা স্মিতমুখ ফিরিয়ে নেয়।

বেলায় অফিস বেরনোর সময়ে রণেনের মাজার ব্যথাটা যেমন খচাং করল একবার জুতোর ফিতে বাঁধার সময়ে, তেমনি তার মনেও একটা খচাং খিঁচ ধরল হঠাৎ। সে যে বউয়ের নামে জমিটা কিনতে চেয়েছে এটা মা জানে না তো! নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সে বেরোবার মুখে জিজ্ঞেস করল—ওরা কেউ এসেছিল নাকি মা?

—কারা?

—শীলা, কিংবা অজিত।

মা বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলে—আসবে কী! সেখানেও আদেখলাপনার চূড়ান্ত।

—কেন?

—মেয়ের নাকি পেটে বাচ্চা এসেছে। ডাক্তার বলেছে পাঁচ মাস পর্যন্ত নড়াচড়া বারণ। জামাই ডানলোপিলোর কুশন কিনে তিনরাত মেয়েকে শুয়ে থাকার কড়া আইন করেছে। পাশের বাড়িতে ফোন করে জামাই জানিয়ে দিয়েছে, মেয়ে এখন আসবে না।

—ওঃ। বলে রণেন নিশ্চিন্তমনে বেরোয়। পাঁচ মাসের জন্য নিশ্চিন্ত।

কিন্তু বাসরাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার হঠাৎ মনে পড়ে—নিশ্চিন্ত! দূর বোকা! নিশ্চিন্ত কীসের? শীলা না এলে মাও তো যেতে পারে ওদের বাড়িতে!

সমস্যাটা ভেবে সে একটু থমকায়। তারপরই আবার দার্শনিক হয়ে যায়। জানবেই তো, একদিন তো জানবেই!

যেমন সুন্দরভাবে দিনটা শুরু হয়েছিল সেভাবে শেষ হল না।

কলকাতায় আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো নার্সিং হোম গজিয়ে উঠেছে। দোকানঘরের ওপরে, কারখানার পাশে, অফিসবাড়িতে সর্বত্রই নার্সিং হোম। ভাল ব্যাবসা। বীণাকে যে নার্সিং হোমে ভরতি করেছে রণেন সেটাও একটা এরকমই জায়গা। মধ্য কলকাতার জরাজীর্ণ বাড়িতে ঝকঝকে সাইনবোর্ড লাগানো। নীচের তলায় সামনের দিকে কাপড়ের দোকান, পিছনের দিকে এক আমুদে অবাঙালি পরিবারের বাস; দোতলায় নার্সিং হোম, তিনতলায় বোধ হয় কোনও পাইকারের গুদাম। নীচের তলায় সবসময়েই হয় রেডিয়ো, নয়তো স্টিরিও কিংবা পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান রেওয়াজের শব্দ হচ্ছে। ওপরতলায় কুলীদের মালপত্র সরানোর শব্দ। সামনের রাস্তাতেও কোনও নৈঃশব্দ্য নেই। ট্রাম এইখানে বাঁক নেয় বলে প্রচণ্ড ক্যাঁচকোচ শব্দ তোলে। লরির হর্ন শোনা যায়। শীতের শুকনো বাতাসে পোড়া ডিজেল, ধুলো আর আবর্জনার গন্ধ আসে অবিরল। তবু নার্সিং হোম।

রক্ত বন্ধ হয়েছে। বীণাকে একটু ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, তবু সামলে উঠেছে অনেকটা। রণেনকে দেখে একটু কর্কশ স্বরে বলল—টুবাইকে আজও আনলে না?

রণেনের মেজাজ ভাল নেই। ভিতরে নানারকমের অস্থিরতা। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল—কেমন করে আনব? আমি সোজা অফিস থেকে আসছি।

—অফিস থেকে আসছি, অফিস থেকে আসছি—রোজ এক কথা। বীণা মুখ ঘুরিয়ে নিল।

—ট্রামবাসের অবস্থা তো জানোই। বাসায় ফিরে টুবাইকে নিয়ে আসতে আসতে ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যেত।

বীণা ঝেঁঝে ওঠে—ভিজিটিং আওয়ার্স না হাতি! সারাদিন রাজ্যের লোক আসছে যাচ্ছে! পরশু এক ছুঁড়ি ভরতি হয়েছে, তার কাছে সারাদিনই দু-তিনটি ছোঁড়া আসছে, ফুল, ক্যাডবেরি, সিনেমার কাগজ দিয়ে যাচ্ছে, গুজগুজ ফুসফুস করছে—তারা আসছে কী করে? আর তোমার অফিসটাই বা কোন জেলখানা? সারাদিন তো টো-টো করে বেড়ানোই তোমার চাকরি! একটু আগে বেরিয়ে টুবাইকে নিয়ে আসতে পারলে না?

এরকম ভাষাতেই বীণা আজকাল কথা বলে। রণেন চুপ করে থাকে। আসলে রাগটা তার সোমেন আর মার ওপর গিয়ে পড়ে। পরশু থেকেই সোমেনকে বলছে বুবাই, টুবাই আর শানুকে নিয়ে একবার নার্সিং হোমে তাদের মাকে দেখিয়ে যেতে। ট্যাক্সি ভাড়াও কবুল করা ছিল। সোমেন, তেমন উৎসাহ দেখায়নি। মাও আপত্তি করেছে—মোটে তো তিনদিন হল গেছে, এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের জন্য হেদিয়ে পড়ার কী! ওদের তো মায়ের জন্য কিছু আটকাচ্ছে না!

তা ঠিক। বীণাকে ছাড়াও ছেলেমেয়েদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। মা যক্ষীবুড়ির মতো সংসারের সব কিছু আগলে রেখেছে।

রণেন চুপ করে ছিল। বীণা মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে—ডাক্তার কী বলল?

—আরও কয়েকদিন এখানে রাখতে বলছে।

—আরও কয়েকদিন রাখতে বলার মানে জানো? টাকা মারার ধান্ধা। আমি থাকব না। তুমি ট্যাক্সি ডাকো, আমি আজই চলে যাব।

—ডাক্তারের অমতে কি যাওয়া ঠিক হবে?

—হবে। আমি ভাল আছি। ছেলেমেয়ে না দেখে আমি থাকতে পারি না। এখানকার অখাদ্য খাবারও মুখে দিতে পারি না, দু’দিন প্রায় উপোস যাচ্ছে। তুমি ট্যাক্সি ডাকো।

—ব্লিডিংটা মোটে কালই বন্ধ হয়েছে, দুটো দিন থেকে যাও।

—না। বলে বীণা মাথা নাড়ল। তারপর অভিমানভরে বলল—আমার তো এমন কেউ আপনজন নেই যে বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার দিয়ে যাবে রোজ। এখানে সকলের বাড়ি থেকে ভাত আসে, আমাকেই কেবল এদের হাতের অখাদ্য রান্না খেতে হচ্ছে।

রণেন একটা শ্বাস ফেলে বলে—পরশু নিয়ে যাব। কথা দিচ্ছি।

বীণা অবাক হয়ে বলে—পরশু? মাথা খারাপ! এই নরকে আর এক রাতও নয়। তুমি আমাকে এখানে রেখে কী করে নিশ্চিন্ত আছো? সুস্থ মানুষ এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি আজই চলে যাব।

রণেন মলিন মুখে ওঠে।

ইলিশের কবি ডাক্তার সাহা গাঁইগুঁই করল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেড়েও দিল।

ট্যাক্সিতে ওঠার পর, বীণার যেটুকু অসুস্থতা ছিল সেটুকুও ঝরে গেল। দিব্যি এলিয়ে বসে বাইরের দিকে চেয়ে রইল একটুক্ষণ, মুখ না ঘুরিয়েই বলল—অজিতবাবুর সঙ্গে কথা বলেছ?

—বলেছি।

—কী বলছে?

—কী আবার! ও তো রাজিই।

—শীলা কী বলল?

—কী বলবে?

—জমিটা আমার নামে কিনতে চাও শুনে কিছু বলল না?

—না। তবে আমি কাল একবার বাবার কাছে যাব।

বীণা মুখ চকিতে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে—কেন?

—বাবার শরীর খারাপ, একবার দেখে আসি।

—ও। বলে মুখ ফিরিয়ে নিল বীণা। তারপর একটু চুপ করে থেকে গলা আর একটু মৃদু, এবং আর একটু কঠিন করে বলল—শীলার কথায় হঠাৎ হুট করে বাবার কাছে যাওয়ার কথা বললে কেন?

রণেন এত সাংসারিক বুদ্ধি রাখে না। তর্কও তেমন আসে না তার। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল—বাবা যদি কলকাতায় আসতে পারেন তবে জমিটা বাবার টাকাতেই কেনা হবে, মার নামে।

—তাই বাবাকে দেখতে যাচ্ছ?

—হ্যাঁ।

বীণা তার চোখে চোখ রেখে তেমনি কঠিন গলায় বলে—সেজন্যই আমাকে আরও দু-দিন নার্সিং হোমে ফেলে রাখতে চেয়েছিলে, যাতে আমি জানতে না পারি যে তুমি বাবার কাছে গেছ?

কথাটা ঠিক। বীণার বুদ্ধির প্রশংসাই করতে হয়। তবু রণেন একটু রেগে গেল। বলল—কেন, তোমাকে ভয় করে চলি নাকি! বাবার কাছে যাওয়াটা কি দোষের কিছু?

—তা বলিনি।

—তবে?

—যা খুশি করো, কিন্তু আমার কাছে লুকচ্ছ কেন?

রণেন উত্তেজিত হয়। মুখে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু চঞ্চল হাতে একটা সিগারেট ধরায়। বীণা চেয়ে আছে মুখের দিকে, জবাব চাইছে।

রণেন গলা ঝেড়ে বলে—লুকোইনি। জমিটা মার নামে কেনা হবে বলে ঠিক হয়েছিল, এখন হঠাৎ তোমার নামে কেনা হলে খারাপ দেখায়।

—খারাপ লাগবে কেন? বাবা কলকাতায় আসতে পারছেন না, অজিতবাবুও জমি বিক্রির জন্য সময় দিচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে জমিটা আমি তোমার টাকা দিয়ে কিনে নিতে বলেছি। তাতে দোষের কী? আর তোমার টাকা দিয়ে যদি কেনা হয় তবে মার নামে কেনা হবে কেন? যদি আমার নামে নাও কেনো, তুমি নিজের নামে কিনবে।

—তাতে মা খুশি হবে না। মা চেয়েছিল, আমাদের দুই ভাইয়ের নামে কেনা হোক, আমি বলেছিলাম, মার নামে কেনা হোক।

—সে হত যদি শ্বশুরমশাই টাকা দিতেন। তিনি যদি না দেন তবে অমন সস্তার সুন্দর জমি তো হাতছাড়া করা যায় না!

—মার ইচ্ছে দুই ভাইয়ের অংশীদারি থাক।

বীণা অত্যন্ত বিদ্যুৎগর্ভ একটু হেসে বলে—তার মানে মা তোমাকে বিশ্বাস করেন না। তাঁর ধারণা, সোমেনকে তুমি আলাদা করে দেবে।

রণেন সেটা জানে। তাই উত্তর দেয় না।

বীণা বলল—একটা কথা বলি। যদি শ্বশুরমশাই শেষ পর্যন্ত টাকা দেন আর জমিটা যদি মা কিংবা তোমাদের দুই ভাইয়ের নামেই কেনা হয়, তা হলেই বা বাড়ি করার টাকা দিচ্ছে কে? ওই দশ হাজারে জমির দাম দিয়ে যা থাকবে তাতে তো ভিতটাও গাঁথা হবে না। যেমন-তেমন বাড়ি করতেও ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার ধাক্কা। জমি যদি মায়ের নামে হয়। বাড়িও তাঁর নামেই হবে, ভাগীদার তোমরা দুই ভাই। বাড়ির টাকার অর্ধেক তা হলে হয় মার দেওয়া উচিত, নইলে দেওয়া উচিত সোমেনের। তারা কি দেবে?

—কোত্থেকে দেবে?

—তা হলে তোমাকেই দিতে হয়। তুমি যদি বাড়ি তৈরির পুরো খরচ দাও তা হলেও পুরোটা কোনওদিন ভোগ করতে পারবে না। অর্ধেক দাবি সোমেনের। তা হলে ওই ভাগের জমিতে তুমি বাড়ি করার খরচ দেবে কেন?

রণেন যুক্তিটা বোঝে। কিন্তু মানতে চায় না। তার মাথায়, বোধ বুদ্ধিতে কেবলই একটা কথা খেলা করে যে, এই যুক্তিতে একটা মস্ত বড় অন্যায় রয়ে গেছে। কিন্তু সেটা ঠিক ধরতে পারে না রণেন। কিছু বলতেও পারে না। কিন্তু ছটফট করে। বীণা আর কয়েকদিন নার্সিং হোমে থাকলে সে ঠিকই অন্যায়টা বুঝতে পারত।

বাড়িতে ঢুকবার আগে রণেন তার কষ্টকর গাম্ভীর্যের মুখোশটা মুখে এঁটে দিল আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *