যাও পাখি – ৪৫

॥ পঁয়তাল্লিশ ॥

খুব ভোরবেলা। এখনও আকাশে ঝিলমিল করছে নক্ষত্র। পুবের দিকে আকাশটা একটু ফিকে ফিরোজা। ভূতুড়ে সব গাছের ছায়া। ভোর ভোর বেলায় এখন একটু জুড়িয়ে যাওয়া মিঠে ভাব চারদিকে। বহেরুর খামার ছেড়ে ব্রজগোপাল টর্চের আলো ফেললেন আলের ওপর। এ রাস্তাটা ভাল নয়, তবু অনেক তাড়াতাড়ি হয় ইস্টিশন। কলকাতামুখো প্রথম গাড়িটা এতক্ষণে বর্ধমান ছেড়েছে। ঘুর পথে বড় রাস্তায় গেলে ধরা যাবে না।

পিছনে বহেরু দাঁড়িয়ে। উঁচু বাঁধের মতো ঢিবি, খামারের শেষ সীমানা। তার ওপর আলিসান ছায়ামূর্তি। আজকাল বড় সন্দেহের বাতিক। কাল থেকে ব্রজগোপালকে পাখি পড়া করে বলছে—চলে যাবেন না ঠাকুর, আসবেন কিন্তু।

চলে যাওয়ার কি তা তা ব্রজগোপাল বোঝেন না। চলে তিনি যাবেন কোথায়? কিন্তু বহেরুর ওই এক ভয় ঢুকেছে আজকাল। কর্তা বুঝি বউ-ছেলে সংসারের টানে এতটা ভাঁটেন বুঝি আবার উজিয়ে যান। পাগুলে কথা সব। গেলেই কি আটকাতে পারে বহেরু? পারে না, তর কাঙাল ভিখিরির মতো কেবলই হাত কচলে ওই কথা পাড়ে। ব্রজগোপাল বিরক্ত হন। তোর সঙ্গে আমার গূঢ় সম্পর্কটা কী, না কি দাসখত লিখে দেওয়া আছে! আবার ফেলতেও পারেন না বহেরকে। কদিন আগেই এ সংসারে ও ছিল কর্তাব্যক্তি, হাঁক ডাকে চারদিক কাঁপত। কিন্তু বয়সে পায় মানুষকে, ভাগ্যে পায়, গাছগাছালির পোকামাকড়ের মতো কর্মফলেরা এসে কুট কুট করে খায়। সেই ক্ষয়ে ধরেছে বহেরুকে। আমান মানুষটা তখনও খাড়া হয়ে দাঁড়ালে দশাসই, কিন্তু তার আগুনটা নিভে গেছে। ছেলেরা শকুনের মতো নজর রাখছে। কদিন বাদে গন্ধ বিশ্বেসে বহেরুতে তফাত থাকবে না।

টর্চ বাতিটা একবার ঘুরিয়ে ফেললেন ব্রজগোপাল। বহেরু এখনও দাঁড়িয়ে। একা। একটু কী যেন বুকে বেঁধে। ওবেলাই ফিরে আসবেন তবু মনে হয় এই যে যাচ্ছেন, আর হয়তো ফিরবেন না।

পরশু চিঠিটা এসেছে। জমি রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। ভিত পুজোও সারা। তবু কাজ আটকে আছে। ননীবালা লিখেছেন—তুমি একবার এস। রণোর বড় শরীর খারাপ। মাথাটার একটু গণ্ডগোল হয়েছে বুঝি। আমার মন ভাল নেই।

এমন কিছু একটা আন্দাজ করেই এসেছিলেন ব্রজগোপাল সেবার। মাঝখানে বহুকাল যাওয়া হয়নি। জোর একটা বর্ষা গেল। চারধারে চাষের উৎসব লেগে গিয়েছিল। সে উৎসব ছেড়ে কোথায় যাবেন?

ফ্যাকাশে আয়নার মতো জল জমা ক্ষেত পড়ে আছে চিত হয়ে। তাতে চিকচিকে অঙ্কুর। পায়ের নীচে আঠালো জমি, কাদা, জল। দুর্গম রাস্তা। ব্রজগোপাল টর্চের আলো ফেলে হাঁটেন। উঁচুতে তোলা কাপড়, পায়ে রবারের জুতো, বগলে ছাতা। চারদিকে ঘাস, ফসল জমির একটা নিবিড় উপস্থিতি। কাছেই হাতের নাগালে তারাভরা আকাশ। অন্ধকারে বাতাসের স্পর্শ মায়ের হাতখানার মতো। গভীর মায়া মাখানো এই বিশালতা। মনের মধ্যে একটা প্রণাম তৈরি হয়ে যায় আপনা থেকেই। বুড়ো বামুনের গায়ের গন্ধ যেন চারদিকে ছড়ানো। আয়ুর বেলা ফুরিয়ে এল। টের পান, অলক্ষ্যে বৈতরণীর কুলকুলু শব্দ ক্রমে কাছে এগিয়ে আসছে। যত এগিয়ে আসে শব্দ তত মায়া বাড়ে। তবু সেই আবছায়া নদীর শব্দ আসে, আসে। আর ততই মনে হয়, লতানে গাছ যেমন আঁকুশি দিয়ে যা পারে আঁকড়ে ধরে, তেমনি এই শরীর পৃথিবীর মাটি বাতাসে আবহের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছে আঁকুশি। বাপ- পিতামোর কাছ থেকে পাওয়া প্রাণ, এই ব্যক্ত জীবন, এ ছেড়ে কার যেতে ইচ্ছে করে?

হাঁটতে হাঁটতে পুবের আকাশ ফরসা হয়ে এল। নিবে যাচ্ছে নক্ষত্রেরা। বেলদার বাজারের কাছে ব্রজগোপাল টিউবওয়েলে জুতোজোড়া আর কাদা মাখা পা দুখানা ধুয়ে নেন। চায়ের দোকানের ঝাঁপ খুলেছে ভোরেই, দিন মজুর আর কামিনরা বসে ধোঁয়াটে চা খাচ্ছে, সঙ্গে সস্তা বিস্কুট। আসাম-চায়ের কড়া লিকারের গন্ধে জায়গাটা ম ম করে। মানুষজনের দিকে একটু চেয়ে থাকেন ব্রজগোপাল। বুকের মধ্যে বড় মায়া। মানুষেরা সব বেঁচে থাক।

অফিসের ভিড় শুরু হওয়ার আগেই কলকাতায় পৌছে গেলেন। বাসটাও ফাঁকা রাস্তায় চল্লিশ মিনিটে ঢাকুরিয়ায় নামিয়ে দিয়ে গেল। সংকুচিত ব্রজগোপাল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেন। একটু সকাল সকালই এসেছেন ইচ্ছে করে। বেলায় এলে দুই ছেলেকে পাওয়া যায় না।

দরজা খুলল বীণা। দেখে খুশি হল না বিরক্ত হল তা বোঝা গেল না। চেহারাটা কিছু রোগা হয়ে গেছে, হনুর হাড় উঁচু হয়ে আছে শ্রীহীনভাবে। মুখে হাসি ছিল না। একটু তাকিয়ে রইল, যেন চিনতে পারছে না। তারপর সরে গিয়ে বলল—আসুন।

ঘরে ঢুকতেই এক বদ্ধ চাপা ভ্যাপসা ভাব। বাসি ঘরদোরের গন্ধ। পরিষ্কার দেখতে পান পরদার ফাঁক দিয়ে এখনও বিছানায় মশারি ফেলা। সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি। ঠিকে ঝিয়ের বাসনমাজার শব্দ আসছে। বেলা পর্যন্ত ঘুমোয় সব। খারাপ অভ্যাস।

সোফার ওপর একটু হেলান দিয়ে বসলেন। কলকাতার এইসব বাক্স-বাড়িতে এরা দিনের পর দিন কি করে থাকে তা আজকাল ভাবতে বড় অবাক লাগে। এ শহরে যারা আছে, ব্যাপারি-ফড়ে-দালাল তারা চিবিয়ে চিবিয়ে রস নিংড়ে নিচ্ছে অহরহ। পড়ে আছে একটা ছিবড়ে শহর। কলকাতার প্রতি মানুষের মোহ আছে, মায়া নেই। মায়া জন্মায় বড় অদ্ভুতভাবে। যেখানে জনপদে মানুষ চাষ করে, গাছ লাগায়, গৃহপালিত পশু পাখিকে ভুক্তাবশিষ্ট দেয়, যেখানে মাটির সঙ্গে সহজ যোগ, মায়া সেখানে জন্মায়।।

ব্রজগোপাল বললেন—কেউ ওঠেনি এখনও?

বীণা বলে—মা উঠেছেন। জপ করতে বসলেন এইমাত্র। আর কেউ ওঠেনি, মোটে তো সাতটা বাজে।

গোবিন্দপুরের সকাল সাতটা মানে অনেক বেলা। ব্রজগোপাল গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলেন—রণো?

—ওঠেনি। ওষুধ খেয়ে ঘুমোয়। নিজে থেকে না উঠলে ডাক্তার ডাকতে বারণ করেছে।

—হয়েছে কী?

বীণার ভিতরের রাগ আর ক্ষোভ চাপা ছিল। হঠাৎ যেন এই প্রশ্নে সেটা আগুনের মতো উসকে উঠল। একটু চাপা গলায় বলে—হবে আর কী! বংশের রোগ।

ব্রজগোপাল একটু অবাক হন। মেয়েটা বলে কী? বংশের রোগ? তাঁদের বংশে কারও কোনও মানসিক রোগ ছিল বলে তিনি জানেন না। রণোরই প্রথম মানসিক ভারসাম্যের অভাব দেখা দিয়েছিল সেই ছেলেবেলায়, টাইফয়েডের পর। বীণার দিকে চেয়ে অন্যমনস্ক ব্রজগোপাল বললেন—বংশের রোগ। সে কীরকম?

বীণা উত্তর দিল না। বাথরুমের দরজায় গিয়ে ঝিকে ধমক দিল- কতদিন বলেছি সকালবেলাটায় বাথরুম বেশিক্ষণ আটকে রাখবে না!

ব্রজগোপাল অসহায়ভাবে একা বসে থাকেন। সবাই ঘুমোচ্ছে, কেবল ছোট নাতিটা বোধ হয় এইমাত্র উঠে ‘মা’ বলে কাঁদছে। বীণা পলকে দৌড়ে গেল। ব্রজগোপাল শুনলেন গুমুর গুমুর দুটো-তিনটে কিল ছেলের পিঠে বসিয়ে বীণা বলল—কতদিন বলেছি সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁদবে না। কোন মা মরা ছেলে যে কাঁদতে বসেছ? বাবা ঘুমোচ্ছে দেখছ না! ছেলেটা ভয়ে চুপ করে গেল।

ব্রজগোপাল শুনলেন। কিছু করার বা বলার নেই। চুপচাপ বসে থাকা। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে তা বোঝা যাচ্ছে না। বোধ হয় ওদের সময়ের অনুসারে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। এতটা সকালে না এলেই হত। বংশের রোগ। কথাটা মন থেকে তাড়াতে পারেন না তিনি। বউটা এ কথা বলল কেন? তাঁদের বংশে কার ওই রোগ ছিল?

বসে বসে ভাবছিলেন ব্রজগোপাল। বড় ছেলের ঘর থেকে একটা কোঁকানির শব্দ এল। বিকট ‘উফ’ করে কে যেন পাশ ফেরে। বোধ হয় রণোই। বীণা চাপা স্বরে বলে—উঠছ কেন? শুয়ে থাকো!

রণোর গলার স্বর পাওয়া গেল—উঠব না! ক’টা বাজে?

গলার স্বরটাই অন্যরকম। কেমন অবাকভাব, শিশুর মতো। ব্রজগোপাল নিবিষ্ট হয়ে শুনছিলেন।

বীণা বলে—বেশি বাজেনি। আর একটু ঘুমোও।

রণো বলল—ঘুম হবে না। বাথরুমে যাব।

বীণা ধমক দিয়ে বলে—আঃ এখন উঠবে না।।

আবার একটা ককিয়ে ওঠার শব্দ পান ব্রজগোপাল, তখন ব্রজগোপাল একটু কাশলেন। ইঙ্গিতবহ কাশি। রণো যদি শুনতে পায়, ঠিক বুঝবে যে বাবা এসেছে।

রণেন শুনল। জিজ্ঞেস করল—বাইরের ঘকে কে?

বীণা চাপা স্বরে কী যেন বলে।

রণার স্বর শোনা যায় বলোনি কেন এতক্ষণ?

একটা বড় শরীর বিছানা থেকে উঠল, শব্দ পেলেন ব্রজগোপাল। পর মুহুর্তেই নীল লুঙ্গিপরা খালি-গা রণো পরদা সরিয়ে চৌকাঠ জুড়ে দাঁড়াল।

—বাবা!

ব্রজগোপালের এ বয়সে বোধ হয় একটু ভুলভ্রান্তি স্বাভাবিক। হঠাৎ যেন বা আত্মবিস্মৃত ব্রজগোপাল চোখ তুলে তাঁর দিকে ছোট রণোকে দেখতে পান। যেভাবে শিশু পুত্রের দিকে হাত বাড়ায় বাপ তেমনি হাত বাড়িয়ে বললেন—আয়।

রণেন দৌড়ে এল না। কিন্তু এক-পা দু-পা করে কাছটিতে এসে পাশে বসল। ব্রজগোপালের মুখের দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে প্রবল উৎকণ্ঠাভরে বলল—কেমন আছো?

এটা নিছকমাত্র কুশল প্রশ্ন নয়, এর মধ্যে যেন-বা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। ব্রজগোপাল রণেনের মাথায় আলতো হাত রেখে বললেন—বাপকু সোনা, কেমন আছো বাবা?

বাপকু সোনা বলে সেই রণোর ছেলেবেলায় ডাকতেন তিনি। বহুকাল অব্যবহারে নামটা ভুলে গিয়েছিলেন। এক্ষুনি মনে পড়ল।

রণেনের ঠোঁট দুখানা একটু কাঁপে। পরমুহূর্তেই দুহাতের পাতায় মুখ ঢেকে মাথা নাড়ে প্রবলভাবে। অর্থাৎ ভাল নেই।

ব্রজগোপাল অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেন—তুমি বড় ভাল ছেলে বাবা, সংসার তোমার কাঁধে ফেলে রেখে আমি চলে গেছি, তুমি সব টেনেছ। বড় অপরাধী আছি তোমার কাছে বাবা।

রণেন নিস্তব্ধভাবে বসেছিল হাতের পাতায় মুখ ঢেকে। অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ সে একটু ফুপিয়ে ওঠে। ধরা গলায় বলে—এরা আমাকে আটকে রেখেছে।

ব্রজগোপাল ছেলের দিকে নিৰ্ণিমেষে তাকিয়ে ছিলেন, বললেন—তোমারই সংসার। আটকে কেন রাখবে? ওসব ভাবো কেন? কেউ আটকে রাখেনি।

বীণা ছেলে কোলে করে এ-ঘরে এল। দৃশ্যটা একপলকে তাকিয়ে দেখে বলল—বাথরুম খালি হয়ে গেছে। যাও।

রণেন মুখ তুলে বীণার দিকে তাকাল, চোখে ভয়। বলল—যাই।

—যাও। ব্রজগোপাল বললেন, হাত ধরে তুলে দিলেন ছেলেকে। বাথরুমের দিকে যতক্ষণ গেল ততক্ষণ চেয়ে রইলেন। রণেন খুব ধীরে ধীরে থপ থপ করে হেঁটে যাচ্ছিল, গায়ে যেন জোরবল নেই। প্রকাণ্ড শরীরের ভার যেন টানতে পারছে না।

কাল রাতে সোমেন যখন এল তখন তার সঙ্গে চুলদাড়িঅলা রাঙা এক সাহেব। বগুড়ার ছেলেবেলায় অনেক সাহেব দেখেছেন ননীবালা, কী সুন্দর সাজপোশাক কেমন ঝলমলে চেহারা। কিন্তু এ কি একটা সাহেবকে ধরে এনেছে সোমেন? রোগা, পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি, সারা গায়ে ধুলোময়লা, চোখে মুখে ভীতু-ভীতু ভাব।

এসেই বলল—মা, আজ রাত্রে ম্যাক্স আমার কাছে থাকবে।

শুনে কপালে চোখ তুলেছেন ননীবালা। সাহেব মানুষরা বাংলাটাংলা বোঝে না, তাই তার সামনেই ননীবালা বলে ফেলেছিলেন—ও মা! সে কিরে, ওরা খ্রিস্টান…

সোমেন গলা নামিয়ে বলে—ও কিন্তু বাংলা জানে।

ননীবালা সামলে গেছেন। কিন্তু ছেলের আক্কেল দেখে অবাক। হিন্দু বাড়ির অন্দরমহলে কেউ সাহেবসুবো ধরে আনে? আচারবিচারের কথা না হয় ছেড়েই দিলেন, ঘরদোর জায়গাও নেই তেমন, রণোর অসুখের পর খাওয়া-দাওয়ারও আয়োজন তেমন নেই, দু-বেলা দুটো ডালভাত কি একটু মাছের ঝোল মাত্র রান্না হয়। এ দিয়ে কি অতিথিকে খাওয়াতে আছে! বীণাও খুশি হয়নি সাহেব দেখে। কেবল নাতি-নাতনিরা খুব ঘুরেফিরে সাহেব দেখছিল।

সাহেব হলেও ছেলেটা ভালই। এ-বাড়ির কেউ যে তাকে দেখে খুশি হয়নি তা বুঝতে পেরেই বোধ হয় বাইরের ঘরে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। চোখেমুখে ভারি ভালমানুষি আর ভয় মাখানো। মা-বাবা ছেড়ে কতদূরে পড়তে এসেছে। দেখেশুনে বুকের ভিতরটা ‘আহা’ করে উঠল ননীবালার।

রান্নাঘরে তাকে আর ঢোকাননি ননীবালা, বাইরের ঘরেই সোমেনের পাশে ঠাঁই করে খেতে দিলেন। আসনপিঁড়ি হয়ে বসে বেশ খেল। ঝিঙেপোস্ত, মুগের ডাল আর ট্যাংরার ঝাল। কোনও আপত্তি করল না। মাঝে মাঝে নীল রঙের চোখটা যখন তুলে তাকাচ্ছিল তখনই টের পাওয়া যাচ্ছিল যে বাঙালি ঘরের ছেলে নয়, নইলে ভাবভঙ্গি সব বাঙালির মতো। এতক্ষণ কথা বলেনি, বোবার মতো চুপ করেছিল। খেতে বসে কথা বলল—মা, ঝিঙেপোস্ত খুব ভাল হয়েছে।

মা! ননীবালা বড় অবাক। সাহেব ছেলেটা তাকে মা বলে ডাকছে! ননীবালা বিস্ময়টা সামলে নিয়ে বলেন—মা বলে ডাকছ বাবা? কার কাছে শিখলে-

ছেলেটা হেসে বলল—এখানে সবাই ডাকে। মেয়ে মাত্রই মা। আমার দেশে এরকম ডাকে না। আমি এ দেশে শিখেছি।

ননীবালা নিবিষ্টভাবে রোগা ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকেন। ছেলেটা চেহারার যত্ন করে না, চুলদাড়িতে কেমন জঙ্গল হয়ে আছে মুখ। একটু যত্ন করলে গৌরাঙ্গের মতো চেহারাখানা চোখ জুড়িয়ে দিত।

ননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন—মা বলে ডেকোনা বাবা, তা হলে ছেড়ে দিতে কষ্ট হবে। বলে একটু চুপ করে থেকে বলেন—মা হওয়ার জ্বালাই কী কম! সামনের জন্মে ছেলে হয়ে জন্মব, তা হলে আর মা হতে হবে না।

ছেলেটা চোখ তুলে বলে আবার জন্ম হবে? ঠিক জানেন?

ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—জন্মব না? কর্মফল যতদিন না কাটে—

ম্যাক্স দুঃখিতভাবে বলে—আমরা খ্রিস্টানরা জন্মাই না, আমরা মাটির নীচে শুয়ে থাকি। টিল দ্য ডে অব জাজমেন্ট।

ননীবালা ফাঁপরে পড়ে বললেন—সাহেবরা জন্মায় না? তা হলে এত সাহেব জন্মাচ্ছে কোথা থেকে বাবা?

সোমেন বেদম হাসতে গিয়ে বিষম খেল। সঙ্গে বীণাও। ননীবালা বিরক্ত হয়ে বলেন—ওতে হাসার কী! সাহেবরা হয়তো জন্মায় না, কিন্তু আমরা হিন্দুরা ঠিক জন্মাই।

এইভাবে ছেলেটার সঙ্গে দিব্বি আলাপ-সালাপ হয়ে গেল। সাহেব হলেও নেইআঁকড়ে ভাব। দু-চোখে সব সময় কী যেন খুঁজছে, কী যেন দেখছে। সোমেন রণেন যেন অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়া সবজান্তা ভাব, চোখের আলো নিবে যাওয়া রকম, ও তেমন নয়। ওর মনের কোনও আলিস্যি নেই।

ননীবালা নিজের বিছানায় সোমেনকে শুতে দিলেন, সোমেনের বিছানায় ম্যাক্স। ওরা নাকি রাত জেগে গল্প করবে। ননীবালা তাই বাইরের ঘরের সোফা-কাম-বেড-এ বিছানা পেতে নিলেন। সোফা-কাম-বেড-এ বড় অস্বস্তি, মাঝখানের দাঁড়াটা বড় পিঠে লাগে। এক কাৎ-এ শুয়েছিলেন, হঠাৎ মাঝরাতে দেখেন, আধো অন্ধকারে রণেন আন্ডারপ্যান্ট পরা অবস্থায় রেডিয়োর সামনে বসে। আস্তে রেডিয়ো ছেড়ে গান শুনছে, ওইরকমই সব করে আজকাল। উঠে বসে ছেলেকে ডাকলেন। সাড়া দিল না। থাক শুনুক। কিন্তু ননীবালার আর ঘুম হল না।।

ননীবালার জপ সারতে একটু সময় লাগে। জপ করতে করতেই সংসারের নানান শব্দের দিকে কান রাখেন। রাখতে হয়। আজও শব্দ পেলেন। মানুষটা এসেছে। জপ তাই জমল না। সময়টা পার করে দিয়ে উঠেই প্রথমে ছোট ছেলেটাকে ঠেলে তুলে দিলেন—ওঠ, ওঠ, তোদের বাপ এসেছে।

সোমেন উঠল। বসে টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই আর অ্যাশট্রে সরিয়ে চৌকির তলায় ঠেলে দিতে দিতে বলল—এ ঘরে উঁকি দেননি তো?

ননীবালা লক্ষ করে বলেন—দিলেই কী! বয়সের ছেলে, বিড়িটা সিগারেটটা তো খাবেই! এতে লজ্জার কী! বাসি বিছানাটা বরং তুলে ফেলো তাড়াতাড়ি, বেলা পর্যন্ত ঘুমনো উনি পছন্দ করেন না।

এইটুকু বলে ননীবালা এ ঘরে এলেন। মুখটুখ ধুয়ে রণেন এসে আবার বাপের কাছে বসেছে। খুবই ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি। ব্রজগোপালের চোখমুখের ভাব কিছু দৃঢ়, কঠিন। একটু চাপা, তীব্র স্বরে বলছেন, বলো, আমি অক্রোধী, আমি অমানী, আমি নিরলস, কাম-লোভ-জিৎ বশী, আমি ইষ্টপ্রাণ, সেবাপটু, অতি-বৃদ্ধি-যাজন-জৈত্র পরমানন্দ, উদ্দীপ্ত শক্তি-সংবৃদ্ধ, তোমারই সন্তান, প্রেমপৃষ্ট, চিরচেতন, অজর, অমর, আমার গ্রহণ করো, আমার প্রণাম হও।

রণেন বলল। ব্রজগোপাল আবার বললেন। আবার রণেন বলল, ব্রজগোপাল ছেলের দিকে তীব্র চোখ চেয়ে বলেন—কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে নাও। রোজ সকালে নিজেকেই নিজে বলবে। সারাদিন বলবে। বলতে বলতে ওর একটা পলি পড়ে যাবে মনের ওপর। বুঝেছ?

রণেন মাথা নাড়ল। বুঝেছে।

ননীবালা স্বামীর দিকে চেয়েছিলেন। সেই পাগল। চোখে চোখ পড়তেই বললেন-ওটা শেখাচ্ছ ওকে?

ব্রজগোপাল স্ত্রীর দিকে চেয়ে একটু যেন সামলে গেলেন। দীপ্তিটা চোখ থেকে নিবে গেল। বললেন—ও হচ্ছে অটো সাজেশান। স্বতঃ অনুজ্ঞা। যখন মানুষের কেউ থাকে না তখন এই অনুভা থাকে। এই চালিয়ে নেয় মানুষকে।

ননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন—ওর কে নেই? আমরা ওকে বুক বুক করে রাখি।

ব্রজগোপাল একলহমায় উত্তর দিলেন না। একটু ভেবেচিন্তে বললেন—আছে। সবাই আছে।

—তবে?

—তবু কেউ নেই।

কথাটা ঠিক বুঝলেন না ননীবালা। তবু ইঙ্গিতটা ধরে নিলেন। এই সকালে ঝগড়া করতে ইচ্ছে যায় না। নইলে ক’টা কথা মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে এখন। বলা যেত। বলা যে যায় না তার আরও কারণ আছে। জমিটা কিনেও অনেক টাকা বেঁচে গেছে ননীবালার। বাড়ির ভিতটা উঠে যাবে। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ননীবালা অবাক হয়ে দেখেন, সাড়াশব্দে কখন নিঃশব্দে উঠে এসেছে সাহেব ছেলেটা। কোনও সংকোচ নেই, বেশ ব্রজগোপালের পাশটিতে বসেছে। ব্রজগোপাল তাকে অটো সাজেশান শেখাচ্ছেন।

বাণীর সঙ্গে ননীবালার একটা জায়গায় বড় মিল। ননীবালা জানেন যে এ হচ্ছে পাগলের বংশ। বংশের ধাত অনুযায়ী কম-বেশি পাগলামি এদের সবার। স্বামীর দিকে চেয়ে থেকে তার এই কথাটা আজ আমার মনে হল।

মাঝরাতেই ঠিক পলকা ঘুম ভেঙে যায় ব্রজগোপালের। ঝিঁঝি ডাকছে। চোরের পায়ের মতো হালকা পায়ে কে হেঁটে যায়, ব্রজগোপাল জানেন, শেয়াল। ঘুম ভাঙলেই মনের বিষণ্ণতা টের পান। ঘুমের মধ্যে কার একটা শ্বাস যেন মুখে এসে লেগেছিল। কেউ নয়। ঘুমের মধ্যে কত কী মনে হয়।

তাঁতি লোকটা আজকাল তাঁতঘরে জায়গা নিয়েছে। এখন এ-ঘরে বহেরু শোয়। ঘরে শোয়া কোনওকালে অভ্যাস নেই বহেরুর। শীতকালটা ছাড়া। বড় ভয়ে ধরেছে আজকাল ওকে। কেবলই বলে—কত পাপ করেছি, কতজনার কত সর্বনাশ! কে এসে ঘুমের মধ্যে কুপিয়ে রেখে যায়, কী নলিটা কুচ করে কেটে দেয়, কে জানে!

মেঝের উপর পোয়ালের গাদিভরা চটের গদি, তার ওপর শতরঞ্চি, বালিশ-টালিশ নেই। পড়ে আছে। ছেলেরা বড় হয়েছে, কোকা ছাড়া পেয়ে এসে জুটেছে। বহেরু আর শান্তিতে ঘুমোতে পারে না। কেবল এই ঘরে এসে ঘুমোয়। তার ভাবখানা—বামুনকর্তা তো সারারাত জেগেই থাকেন। চোখে চোখে রাখবেনখন।।

তা ঠিক। ব্রজগোপাল জেগেই থাকেন আজকাল। বড় ঘুমের সময় আসছে। একটা আবছায়া নদী, তার পারাপার দেখা যায় না, ঘোর কুয়াশার ঢাকা। সেই নদীর শব্দ পান। উঠে বসেন নিঃঝুম মাঝরাতে। মশারির বাইরে মশাদের বিপুল কীর্তন। শিরদাঁড়াটা সোজা করে বসেন। বীজমন্ত্রের ধারা নেমে উঠে সারা শরীর আর সত্তায় ছড়িয়ে পড়ে। নাসামূলে ইঞ্চিটাক গভীরে তেসরা তিল। সেখানে দয়াল দেশ। বুড়ো বামুনের মাভৈঃ মুখ।

ধ্যানের মধ্যেই ব্রজগোপাল হাসেন। হারিয়ে যান।

তবু হারিয়ে যাওয়াও যায় না। সে তো ধর্ম নয়।

॥ ছেচল্লিশ ॥

ম্যাক্সের পুরনো জুতোজোড়া ছিঁড়ে গেছে। পোঁটলা-পুঁটলিও ওর বেশি কিছু নেই। আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে যখন থাকত তখনও ওর কিছু শৌখিন জিনিস ছিল। ক্যামেরা, একটা টেপ রেকর্ডার, দামি কিছু স্যুট, ঘড়ি। তার বেশিরভাগই চুরি হয়ে গেছে। রাস্তায় ঘাটে পড়ে থাকত ছেলেটা কিংবা ধর্মশালায়, শ্মশানে। সেই সময়েই গেছে। বাকি যা ছিল তা বিলিয়ে দিয়েছে কাঙালদের। এখন ওর যা কিছু সম্পত্তি তা একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগে এঁটে যায়।

সোমেনের বাড়িতে দুরাত্তির কাটিয়ে সকালবেলায় ব্যাগটা গুছিয়ে নিল ম্যাক্স। সোমেন তাকিয়ে দেখছিল। একটা দাঁত মাজার ব্রাশ, একটা বাড়তি পায়জামা, একটা বাঁকুড়ার গামছা, একটা গেঞ্জি, একটা পাঞ্জাবি, দুটো ডায়েরি, আর তিনটে কি চারটে ডটপেন। বুকপকেটে পাশপোর্ট থাকে একটা প্ল্যাস্টিকের ফোল্ডারে, তাতেই গোঁজা আছে কিছু টাকা, গায়ের পাঞ্জাবির পকেটে একটা রুমাল, কিছু খুচরো পয়সা, দেশলাই আর কয়েক প্যাকেট সিগারেট, একপ্যাকেট সস্তা চুয়িং গাম। ব্যস। এত অল্পে একটা লোকের চলে কী করে! ম্যাক্স এত উঞ্ছবৃত্তি শিখল কোথায়?

মাকে বলল—মা, চললাম। বউদিকে বলল, বউদি, আসি। দাদার কাছ থেকেও বিদায় নিল। বাচ্চাদের কাছ থেকেও।

সোমেন ওকে খানিক দূরে এগিয়ে দেবে বলে সঙ্গে চলল। রাস্তায় নেমেই ম্যাক্স ছেঁড়া স্যামসন জুতোজোড়া পা থেকে খুলে সোমেনকে দেখিয়ে বলল—হোপলেস। বলে ফুটপাথে ছুঁড়ে ফেলে দিল।।

সোমেন বলল—আমার বাড়তি একজোড়া আছে, পরে যাও।।

ম্যাক্স মাথা নাড়ল, নো। এই ভাল, ভারতবর্ষের সঙ্গে এই শেষ ক’টা দিন আর্থ কন্ট্যাক্টে থাকি। ইয়োরস ইজ এ গুড কান্ট্রি।

সোমেন ভারতবর্ষ কী তা জানে না। শুনেছে, এ-এক মহান দেশ, সে- এক সমৃদ্ধ সভ্যতার উত্তরাধিকারী। কিন্তু সোমেনের কোনও ধারণা নেই, সে কিছু বোধ করে না। তবু ম্যাক্স যখন ওই কথা বলল তখন তার বুকের মধ্যে এক ঘুমিয়ে থাকা দেশপ্রেম যেন আধো জেগে উঠে একটু অস্পষ্ট কথা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

সোমেন বলল—কোথায় যাবে?

খালি পায়ে বেলা দশটার তড়পানো রোদে পিচের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ম্যাক্স একটু অন্যমনস্কভাবে বলে, কলকাতায় যখন প্রথম এলাম সোমেন, তখন এখানে ভিখিরি আর অভাগাদের দেখে আমি পাগল হয়ে যাই। প্রথম কয়েক মাস আমি লেখাপড়া করতে পারিনি; আমি খুব অবাক হয়ে যাই দেখে যে, এইরকম জঘন্য যেখানকার সামাজিক অবস্থা, সেখানে যুবক-যুবতীরা প্রেম করে বেড়ায়, সিনেমা দেখে, সাজপোশাক করে। বড়লোকেরা নির্বিকারভাবে বিদেশি গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়। আর কেউ কেউ দেশের অবস্থায় দুঃখিত হয়ে চায়ের দোকানে বসে মাথা গরম করা তর্ক করে। ওই অবস্থায় আমি পাগলের মতো খুঁজে বেড়াতাম, একজনও ভারতীয় আছে কি না যে সক্রিয়ভাবে দেশের জন্য কিছু ভাবছে বা করছে। অনেক খুঁজে আমি একজনকে পেয়েছিলাম। সত্যিকারের একজন ভারতীয় এবং দেশপ্রেমিক। মাদার টেরেসা। আমি আজকাল তোমাদের জন্মান্তরে বিশ্বাস করি সোমেন। আমার মনে হয় মাদার টেরেসাই হচ্ছেন মেরি ম্যাকডেলিন, আর আমরা যত হতভাগা আছি সবাই তাঁর খ্রিস্ট। আমি তক্ষুনি তাঁর দলে ভিড়ে যাই। সে সময়ে আমি তার জন্য কিছু টাকা তুলেছিলাম, আর কিছু নিজের স্কলারশিপ থেকে জমিয়েছিলাম। মাদারের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমার কিছুদিন পরে মনে হয়েছিল, সমস্যার উৎসমুখ খুলে রাখা আছে। তুমি যতই করো, অভাব বা দ্রারিদ্র ঘুচবার নয়, তখন সশস্ত্র বিপ্লবের কথা ভাবতাম। আই জয়েনড নক্সালাইটস। টাকাগুলো আর মাদারের হাতে দেওয়া হয়নি। আজকের দিনটা তাই মাদার টেরেসার জন্য টাকা তুলব।

—কীভাবে?

ম্যাক্স মৃদু হেসে বলে, ভিক্ষে করব। আমার অভ্যাস আছে। তা ছাড়া খারাপও লাগে না। আমি যতবার ভিক্ষে করেছি সব সময়েই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভারতবর্ষে ভিক্ষে করায় বাধা নেই। মস্ত সুবিধা। যখন তোমার কিছু থাকে না, ইউ মে অলওয়েজ বেগ। ভিক্ষের কোনও শেষ নেই এখানে। তা ছাড়া মাদার টেরেসাকে আমি ঠকাতে চাই না। তাকে দেখলেই মহত্বের কথা মনে হয়, চোখে জল আসে। আর মানুষ নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে মহৎ কিছুর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে।

ব্রিজের গোড়া পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল সোমেন। ম্যাক্স বাসে উঠল না। খালি পায়ে ব্রিজের চড়াই ভাঙতে ভাঙতে মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে বলল—আজ বড় ভাল দিন। না?

রেলিঙের ধার ঘেঁষে উঠে যাচ্ছিল ম্যাক্স। নীল আকাশের গায়ে ওর মাথা। সোনালি বড় বড় চুল হাওয়ায় উড়ছে। সোমেন সেদিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল একটুক্ষণ, হঠাৎ আবেগে চোখে জল আসে৷ গলা রুদ্ধ হয়ে যায়। সে নিজে ভারতবর্ষের জন্য কিছু করেনি।

রিখিয়ার জন্য ‘রেড’টা পকেটের মুখে রেখে দিল সোমেন। ফেলল না। স্ট্রাইকার ভুল জায়গায় লেগে ঘুরে চলে গেল অন্যদিকে।

রিখিয়া নিবিষ্ট মনোযোগে চেয়েছিল গুটিটার দিকে। সোমেন পারল না দেখে মুখ তুলে বলল—ইস, পারলেন না! বলে একটু হাসল।

সোমেন মাথা নাড়ল দুঃখিতভাবে। স্ট্রাইকার এগিয়ে দিয়ে দেখল রিখিয়ার মুখখানা। ও কি এখনও বালিকা! লাল গুটিটার জন্য কি শিশুর মতো লোভ ওর! বয়সকালের আগুনগুলি এখনও জ্বলে ওঠেনি ওর ভিতরে! শৈশবের তুষ ঢেকে রেখেছে সেই তাপে। বড় ছেলেমানুষ। পকেটের মুখে আলগা হয়ে বসে আছে গুটিটা, রিখিয়ার দিকে চেয়ে হাসছে, টোকা লাগলেই পড়ে যাবে।

রিখিয়া স্ট্রাইকার বসিয়ে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য স্থির করে।

সোমেন গম্ভীরভাবে বলল—দেখো, ডবল ফাইন কোরো না।

রিখিয়া টোকা দেওয়ার মুহূর্তে থেমে মুখ তুলল। ভ্রূ কোঁচকাল। স্ট্রাইকারটা সরিয়ে দিয়ে বলল—খেলব না আপনার সঙ্গে।

—কেন, কী হল?

—ডবল ফাইনের কথা বললেন কেন? এখন ঠিক আমার ডবল ফাইন হবে।

এই বলে গম্ভীর রিখিয়া নিজের হাতের নোখ দেখতে লাগল। মুখখানা কান্নার আগেকার গাম্ভীর্যে মাখা।

সোমেন খুব শান্ত গলায় বলে—হলেই বা কি! যখনই হোক রেডটা তুমি ঠিক ফেলতে পারবে।

রিখিয়া সতেজ গলায় বলে—আমার জন্য ‘রেড’ বসে থাকবে, না? আর একটা চান্স পেলেই তো আপনি ফেলে দেবেন।

সোমেন মাথা নেড়ে বলল—কোনওদিন পারিনি। আমার রেড অ্যালার্জি আছে, নার্ভাস হয়ে পড়ি।

লম্বা সোফার ওপর একটা মেয়ে শুয়ে এতক্ষণ জুনিয়র স্টেটসম্যান, ফেমিনা, ফিলম ফেয়ার আর ইলাস্ট্রেটেড উইকলি একগাদা নিয়ে ডুবেছিল। সে সোমেনকে ফিরেও দেখেনি এতক্ষণ। বোঝা যায়, ও বড় ঘরের মেয়ে। ফরসা আদুরি-আদুরি চেহারা, চোখে বিশাল ফ্রেমের চশমা, পরনে বেলবটম আর কামিজ, রিখিয়ারই বয়সি৷ ওর বন্ধুটন্ধু কেউ হবে। এবার সে মুখের সামনে থেকে পত্রিকাটা সরিয়ে বলল—অবজেকশনেবল। রেড অ্যালার্জি কথাটা ভীষণ অবজেকশনেবল।।

অবাক হয়ে সোমেন বলে-কেন?

মেয়েটা তার গোলপানা মুখটায় বিরক্তি ঘেন্নার ভাব ফুটিয়ে যেন বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলল—স্টিনকস উইথ ব্যাড পলিটিকস। আপনি রি-অ্যাকশনারি।

সোমেন অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখছিল। উত্তর দেবে কি দেবে না, তা ঠিক করতে পারছিল না। অতটুকু মেয়ে!

রিখিয়া তার ডান হাতটা ঝাড়ছিল, আঙুলগুলো টেনে ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল রেড ফেলার আগে। সোমেনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল—মধুমিতা না ভীষণ লেফটিস্ট, জানেন! ও কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ডেও ছিল। অ্যাকশনও করেছে।

সোমেন মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলে—ওঃ! আজকাল সবাই দেখছি পলিটিক্স করলেই আন্ডারগ্রাউন্ডে যায়। আন্ডারগ্রাউন্ডে কী আছে?

মেয়েটা হাতের ম্যাগাজিনটা সপাট করে টেবিলে রেখে স্প্রিংয়ের গদিতে উঠে বসে। শরীরটা উত্তেজনায় দোল খায়! বুকের ওপর থেকে বেণীটা পিঠের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে— মোটেই আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম না, অপরাজিতা। সবাই জানে সে সময়ে আমি বাপির সঙ্গে জয়পুরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ইটস এ স্টিংকিং লাই।

সোমেন বুঝল, মেয়েটা স্টিংক কথাটা ব্যবহার করতে ভালবাসে। ও বোধ হয় ওর চারদিকে একটা পচা পৃথিবীর দুর্গন্ধ পায় সব সময়ে। এতক্ষণ মেয়েটার গোলপানা মুখ আর আদুরি চেহারার মধ্যে তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু এখন হঠাৎ তার ফরসা মুখে রাগের একটা আগুনে রং যখন ফুটে উঠে, দুটো ভ্রূ যখন দুটি নিক্ষিপ্ত তীরের মতো মুখোমুখি পরস্পরকে চুম্বন করে আছে, কপালের মাঝখানে যখন রাজটিকার মতো একটি শিরা জেগে উঠেছে তখনই তার অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যটা ফুটে উঠল। মেয়েটা যে ঠিক ওর চেহারার মতোই নয়, তা চেহারা পালটে ফেলে বুঝতে দিল। সোমেন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রয়োজনের চেয়ে কয়েক পলক বেশি চেয়ে রইল সে।

তখন রিখিয়া হঠাৎ গম্ভীর মুখে স্ট্রাইকারটা বোর্ডে রেখে বলে ওঠে—’রেড’ ফেলছি কিন্তু।

সোমেন চোখ সরিয়ে এনে বলে—ওঃ হ্যাঁ!

রিখিয়া গম্ভীর মুখেই বলে—ডবল ফাইন হলে কী হবে?

সোমেন বলে—দুটো সাদা গুটি উঠবে, আর রেড।

ফের স্ট্রাইকার থেকে হাত সরিয়ে রিখিয়া বলে—মোটেই না।

—তবে?

—একটা সাদা গুটি, আর রেড।

—সোমেন মাথা নাড়ে—উঁহু, দুটো সাদা আর রেড।

রিখিয়া কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে—ইস, বললেই হল! এই মধুমিতা, তুই বল তো! রেড আর স্ট্রাইকার পড়লে….

মধুমিতা আবার শুয়ে পড়েছে, একটা হাঁটুর ওপর অন্য পা নির্লজ্জভাবে তোলা, মাথার নীচে একটা হাত, অন্য হাতে ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনের আড়াল থেকেই বলল—জানি না। ক্যারম নিয়ে কে মাথা ঘামায়!

ঘরে আর কেউ নেই। রিখিয়া আর কার কাছে নালিশ করবে! নীচের ঠোঁট দাঁতে চেপে সে অসহায়ভাবে সোমেনের দিকেই তাকাল। সোমেন মৃদ্যু হেসে বলল—আচ্ছা আচ্ছা। একটা সাদা, আর রেড।

রিখিয়া হাসল না, খুশিও হল না। থমথমে মুখ। স্ট্রাইকারটা ফের সরিয়ে দিয়ে বলে— আগে কেন বললেন না!

বলেই হঠাৎ মধুমিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে—তুই বুঝি অ্যাকশন করিসনি! স্কুলের ক্লাসরুমে মাও সে-তুঙের টেনসিলের ছাপ দিয়েছিল কে?

মধুমিতা একবার অবহেলাভরে তাকিয়ে বলে—তাতে কি! ওটা বুঝি অ্যাকশন! তা হলে ক্যারম খেলাটাও অ্যাকশন। ফুঃ!

রিখিয়া চুপ করে থাকে একটুক্ষণ। সোমেন অপেক্ষা করে। রিখিয়া কী ভেবে হঠাৎ নিচু হয়ে স্ট্রাইকারটা বসিয়ে পাকা ফলের মতো পকেটের মুখে ঝুলে থাকা রেডকে ফেলার জন্য টোকা দিল। সোমেন অবাক হয়ে দেখল, রিখিয়া ঠিক ডবল ফাইন করেছে। পটপট করে রেড আর স্ট্রাইকার চলে গেল পকেটে।

দুঃখিত সোমেন রিখিয়ার দিকে তাকাল না। রেড আর সাদা গুটি তুলে চমৎকার একটা চাপ সাজিয়ে দিল রিখিয়াকে। স্ট্রাইকার এগিয়ে দেওয়ার সময়ে সন্তর্পণে চেয়ে দেখল, রিখিয়া হাতের পিঠে চোখের জল মুছছে।

—এই, কী হল?

—আমি খেলব না। রিখিয়া মাথা নেড়ে বলে।

—কেন?

রিখিয়া রাগ আর ফেঁপানির গলায় বলে—আপনি ডবল ফাইনের কথা বললেন কেন?

বলে রিখিয়া স্ট্রাইকার ছুঁড়ে ফেলে দিল।

সোমেন মাথা নাড়ল আপনমনে। খেলা নয়, এ তো খেলা নয়। হেরে গেছ? কে বলে ও-কথা? বিজয়িনী, তুমি বিজয়িনী। এখনও তোমার বয়স কম। ছোট্ট খুকি, নইলে এক্ষুনি আমি কী যে করতাম!

ছোট্ট সোপায় গিয়ে বসল রিখিয়া। ক্যারম খেলার আগে সে অ্যালবাম থেকে সোমেনকে ছবি দেখিয়েছিল সেইটা আবার খুলে বসল গম্ভীরভাবে।

পকেট থেকে গুটিগুলো তুলে টুকটাক করে সাজাচ্ছিল সোমেন। আড়চোখে রিখিয়া একবার চেয়ে দেখল। পৃথিবী থেকে মেয়েমানুষ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, দুঃখ করে বলেছিল ম্যাক্স। কই? এই তো শতকরা একশো ভাগ একটা মেয়ে। ভীষণ মেয়ে। মেয়েমানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। ভাবতে ভাবতে সোমেন একটু হাসে।

রিখিয়া ছবি দেখছে। সোমেনের ছবি। একটা অন্ধ কুকুরের পিছনে চোখ বুজে হাঁটছে সোমেন, যুধিষ্ঠিরের মতো। কিংবা রাগী মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে রিখিয়া একটু হাসল। মুখ তুলে বলল—বোকা।

ছবিগুলো একটু আবছা হয়ে গেছে। ঠিকমতো ফোকাস করার সময় পায়নি। এর আগের. দিন যখন এসেছিল তখনই আবার পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে রেখেছিল। সেদিনই ক্যারমে উনত্রিশ-কুড়ি পয়েন্টে গেম খেয়েছিল সোমেন। প্রথমবার হারতে হয়।

ম্যাগাজিনটা ফেলে উঠে বসল মধুমিতা। চশমাটা বেঁকে গিয়েছিল, সোজা করে বসাল নাকে। আধুনিক ফ্যাশনের চশমা, চোখে এঁটে থাকে না, একটু নেমে আসে নাকের ওপর। শেয়াল-পণ্ডিতের মতো দেখায়। ঢিলা কামিজের তলায় বিদ্রোহী দুটি কিশোরী স্তন, কামিজটা টান হওয়ার পর ফুটে উঠল। কপালের চুল সরিয়ে মধুমিতা গম্ভীর মুখে একটু চাইল সোমেনের দিকে। দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য। একটা হাই তুলে বলল—অপরাজিতা, ম্যাগাজিনগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।

—যা।

—ক’টা বাজল, সাতটা? আটটায় আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। কবজির ঘড়িটা কানে তুলে একটু শব্দ শুনল মধুমিতা। আবার তাকাল সোমেনের দিকে। এবার চোখটা অন্য রকম। একটু যেন মেপে দেখল সোমেনকে। চোখে কোনও মায়া-মোহ বা রহস্য নেই। কেমন যেন পুরুষমানুষের মতো তাকায় মেয়েটা। বেশ লম্বা, অথচ নরম-সরম চেহারা। মুখে তেলতেলে একরকমের পেইন্ট, কপালে টিপ নেই, কানে দুল বা গলায় হার নেই, দুহাতে শুধু দুগাছা গালার চুড়ি, ডান হাতে ঘড়িটা। সব মিলিয়ে মেয়েটা নিজের অস্তিত্বকে চারধারে ছড়িয়ে দিয়েছে। রিখিয়াকে ওর পাশে অনেক লাজুক, ম্লান আর ছোট্ট লাগে।

মেয়েটা আর একটা হাই বাঁ-হাতের তিনটে আঙুলে চাপা দিল। চমৎকার আঙুল। নখগুলোর পালিশ ঝিকিয়ে উঠল। হাইটা চেপে দিয়ে বলল—আপনি কোথায় থাকেন?

সোমেন খানিকটা অবহেলার ভাব করে বলে—ঢাকুরিয়া।

মধুমিতা বলল—আমি যোধপুরে, আপনাকে একটা লিফট দিতে পারি। যাবেন। রিখিয়া ভ্রূ কুঁচকে অ্যালবামের দিকে চেয়ে আছে, সেখানে সোমেনের আবছা ছবি।

মধুমিতা উঠে বলল—আপনার রেড অ্যালার্জিটা সারানো দরকার।

সোমেন হেসে বলল—আমার অ্যালার্জিটা পলিটিক্যাল নয়।

—নয়? বলে একটু অবাক হওয়ার ভাব করল মধুমিতা। তারপরই হাসল। এই প্রথম ওর হাসি দেখল সোমেন। কি পরিষ্কার দাঁত, কেমন ভরপুর হাসি। তবু হাসিটাও ঠিক মেয়েমানুষের মতো নয়। পুরুষঘেঁষা। বলল—আপনার কালার কী?

সোমেন চোখটা সরিয়ে নিয়ে তার নিজস্ব ভুবনজয়ী হাসিটা হেসে বলল—হোয়াইট, এ কালার অফ সারেন্ডার।

॥ সাতচল্লিশ ॥

—সারেন্ডার! শুনে চোখ দুখানা ফের গোল করে একবার রিখিয়ার দিকে তাকাল, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল আবার সোমেনের মুখে। যেন কিছু একটা টের পেল এই মাত্র, সোমেন আর রিখিয়ার মধ্যবর্তী শূন্যতায়।

বোগেনভেলিয়ার লালচে পাপড়িগুলি অবিরল ঝরে পড়ছে নীচের চাতালে, একটা ইউক্যালিপটাসের চারাগাছ উঁকি মারছে জানালা দিয়ে, সারা গায়ের বাকল খসছে। রিখিয়াদের ছোট্ট বাগানের এই সব দৃশ্য একটু দেখল সোমেন।

মধুমিতা ম্যাগাজিনের একটা গোছা হাতে তুলে নিয়ে বলল—আপনি খুব সহজেই সারেন্ডার করেন, না?

সোমেন মুখ ফেরাল। রিখিয়া সেই রকমভাবেই মাথা নত করে বসে। কোলে খোলা অ্যালবাম। সোমেন মুখ টিপে হেসে বলল—করি।

মধুমিতা অখুশি হল বোধ হয় কথাটা শুনে। বলল—মোটেই ভাল নয় ওরকম। চলুন।

সোমেন রিখিয়ার নতমুখের দিকে চেয়ে একটু হালকা গলায় বলে—হবে নাকি আর এক গেম?

রিখিয়া মুখ না তুলেই মাথা নাড়ল। খেলবে না।

একটু ইতস্তত করে সোমেন। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য সে আসেনি। কিন্তু রিখিয়া থাকতে না বললে থাকে কী করে?

মধুমিতা ঘাড়টা একবার তুলেই ছেড়ে দিয়ে বলল—ক্যারাম আবার একটা খেলা। খুটখাট গুটি ফেলা দুচোক্ষে দেখতে পারি না। খেলা হল বাস্কেট।

একটা চাপা ঝগড়া পাকিয়ে উঠছে, সোমেন বাতাসে বারুদের গন্ধ পায়।

রিখিয়া মুখ তুলল। চোখে তীব্র চাউনি। বলল—আহা, ক্যারাম খেলা নয়, না। তোর তো সব ছেলেদের খেলা ভাল লাগে।

—লাগেই তো! অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক আর অ্যাগ্রেসিভনেস না থাকলে আবার খেলা কী! আই লাইক ম্যাসকুলিন গেমস।

রিখিয়া রেগে গিয়েছিল, কিন্তু তেমন স্মার্ট কথাবার্তা বোধ হয় ওর আসে না, রিফ্লেক্স কিছু কম, কেবল বলল—হ্যাঁ তোকে বলেছে!

মধুমিতা তার পাম্প-শু-র মতো দেখতে জুতোর একপাটি খুলে বোধ হয় একটা কাঁকর ঝেড়ে ফেলল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল—আমি সোমেনবাবুকে নিয়ে যাচ্ছি। ফর কম্প্যানি।

এটা জিজ্ঞাসা নয়, সিদ্ধান্ত। সোমেন অসহায়ভাবে একবার রিখিয়ার দিকে তাকাল। ও কি একবারও মুখ ফুটে সোমেনকে আর একটু থাকতে বলবে না! না বললে, সোমেন তেমন নির্লজ্জ নয় যে থাকবে।

মধুমিতা তার গোলগাল চশমার ভিতর দিয়ে গোল চোখ করে চেয়ে আছে। মুখখানাও গোল। সোমেন টেনশন টের পেল। তাকে নিয়ে একটু দড়ি টানাটানি চলছে। দড়িটা টেনেই নিয়েছে মধুমিতা। সোমেন ঘাড় নেড়ে বলে—চলুন।

বলে রিখিয়ার দিকে একপলক চাইল সোমেন, চাপা গলায় বলল—আজ তা হলে যাই রিখিয়া।

রিখিয়া উত্তর দিল না।

মধুমিতা বলল—অপরাজিতা ভীষণ সেন্টিমেন্টাল। একটুতেই ওর গাল ভারী হয়। ইস্কুলে সবাই ওকে তাই খ্যাপাই।

বলে হাসল মধুমিতা। চোখ ঠারল সোমেনকে। অর্থাৎ ইচ্ছে করে রিখিয়াকে রাগাতে চায়। চোখ ঠেরে সোমেনের সঙ্গে একটা সন্ধি করে নিল।

সোমেন একটু হাসল বটে, কিন্তু এ খেলায় সে নেই। ওই নতমুখী, একটু আনস্মার্ট মেয়েটিকে কেউ খ্যাপায় এটা সে চায় না। ইস্কুলে ওর বন্ধুরা ওকে খ্যাপায় জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। কেন, ওরা রিখিয়াকে খ্যাপাবে কেন?

মধুমিতা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলল—একটুতেই কেঁদে ফেলে অপরাজিতা। গতবার ডিবেটে ওর উলটোদিকের ডিবেটারদের মধ্যে কে যেন বলেছিল অপরাজিতা একটা ভুল কোটেশন দিয়েছে। সেটাকে ও পারসোনাল অ্যাটাক মনে করে…বলে মধুমিতা কোমরে হাত দিয়ে মুখ ছাদের দিকে তুলে ঠিক পুরুষ ছেলের মতো হাসল, তারপর মুখে হাতচাপা দিয়ে বলল—কেঁদে ভাসিয়েছিল।

বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল সোমেন। মধুমিতা নিশ্চয়ই খুব শক্ত প্রতিপক্ষ, বোধ হয় ভাল ডিবেট করে, রিখিয়াকে ইচ্ছা করলেই ও নাস্তানাবুদ করতে পারে। রিখিয়া পলকা মেয়ে। যদি রেগে যায় তা হলে হয়তো এখন এমন কিছু বলে ফেলবে যা মেয়েমানুষি রাগে ভরা। হয়তো নিতান্তই ছেলেমানুষি কিছু বলে ফেলতে পারে। তা হলে মধুমিতা ওকে আরও অপমান করবে। তাই মনে মনে সোমেন টেলিপ্যাথি পাঠাতে লাগল রিখিয়াকে—রেগো না রিখিয়া, মাথা স্থির রাখো। দোহাই প্লিজ, আমার সামনে যেন ও তোমাকে অপমান না করতে পারে। ওকে সুযোগ দিয়ো না।

আশ্চর্য এই রিখিয়াকে সেই তরঙ্গ স্পর্শ করল বোধ হয়। টেলিপ্যাথির বার্তা পৌঁছল নাকি!

রিখিয়া মধুমিতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তার অভিমানী মুখখানা তুলে সোমেনকে বলল—মাকে দেখে গেলেন না তো? মা কত আপনার কথা বলে!

এই তো! এরকমই কিছু শুনতে চাইছিল সোমেন। মধুমিতার কাছ থেকে তাকে কেড়ে রেখে দিক রিখিয়া। মধুমিতার হাতের দড়ি ঢিলে হয়ে গেল, রিখিয়া টানছে।

সোমেন গম্ভীর মুখে বলল—ওঃ তাই তো। একদম ভুলে গিয়েছিলাম।।

বলে একটু অসহায় মুখ করে তাকাল মধুমিতার দিকে।

মধুমিতা তার কবজির ঘড়িটা দেখল, মুখটায় সামান্য বিরক্তির ভাব করে বলল—আই ক্যান গিভ ইউ টেন মিনিটস।

রিখিয়া হঠাৎ ঝামরে উঠে বলে—তোর তাড়া থাকলে তুই যা না। ও পরে যাবে।

ও! সোমেনের হঠাৎ আন্তরিকভাবে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, ‘ও’ সর্বনামটি বোধ হয় সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। বিদ্যুৎবাহী।

মধুমিতা আর একবার কাঁধ ঝাঁকাল। সোফায় আবার ধপ করে বসে পড়ে বলল—না, আমি সোমেনবাবুর জন্য ওয়েট করব। বলে সোমেনের দিকে চেয়ে আর একবার চোখ ঠারল, মধুমিতা চাপা হাসি হেসে বলল—ডোন্ট মেক মি ওয়েট ফর এভার দেখা করে আসুন। একসঙ্গে যাব।

শৈলীমাসির ঘরের পরদাটা পার হয়েই রিখিয়া চাপা রাগের গলায় বলল—ভীষণ পুরুষচাটা মেয়ে। একদম পাত্তা দেবেন না।

সোমেনের হৃদয়ের স্তব্ধতার ভিতরে যেন এইমাত্র বোঁটা খসে একটা ফুল এসে পড়ল। সোমেন তার হৃদয়ের মধ্যেই কুড়িয়ে নিল সেই ফুল, সুঘ্রাণে ভরে গেল ভিতরটা।

বলল—পাত্তা! না, না, তাই কি হয়……

আসলে কথা হারিয়ে যাচ্ছিল সোমেনের। কত মেয়ের সঙ্গে কত অনায়াসে মিশেছে সোমেন, তবু এই একটা মেয়ের কাছে এখন কথা হারিয়ে যাচ্ছিল।

শৈলীমাসি বই রেখে আধশোয়া হলেন। পিঠের নীচে বালিশের ঠেকনো দিয়ে দিল রিখিয়া। তারপর খাটের মাথার দিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে একটু করুণ চোখে চেয়ে রইল। সোমেনের দিকে। ভারী অন্যরকম লাগছিল ওকে। বড়লোকের মেয়ে দামি ক্যামেরায় ছবি তোলে, গাড়ি চালায়, কত কী করে, তবু যেন ও সে নয়। যেন বা দুর্বল, সহানুভূতি পেতে ও ভালবাসে, কেউ ওকে দেখে ‘আহা’ বললে বুঝি খুশি হয়।

শৈলীমাসি উঠে বসে বললেন—ও ঘরে ক্যারম খেলা হচ্ছিল। খবর পেয়েছি। তখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। ননীর ছেলে কখন এ ঘরে আসবে, দুটো কথা বলে বাঁচব। এতক্ষণে এলে?

সোমেনের বড় লজ্জা করছিল, আর একটু হলেই সে চলে যাচ্ছিল মধুমিতার সঙ্গে। শৈলীমাসির অপেক্ষা শেষ হত না।

চওড়া জানালাগুলো আজ খোলা রয়েছে। এয়ারকুলার বন্ধ। শৈলীমাসি বাইরের আবছা অন্ধকারে একটু গুলঞ্চ গাছের ডালপালার দিকে চেয়ে থেকে বললেন—মানুষের সঙ্গে যে কত কথা বলতে ইচ্ছে করে! যেতে তো পারি না, তাই যে দু-চারজন আসে তাদের সঙ্গে সাধ মিটিয়ে বলে নিই, তুমি কিন্তু বড় মুখচোরা ছেলে, একটুও কথা বলো না। তোমাদের কত কথা জানতে ইচ্ছে করে।

সোমেন তার স্বভাবসিদ্ধ সুন্দর হাসিটা হাসে। উত্তর দেয় না। শৈলীমাসির মাথার পিছনে রিখিয়া দাঁড়িয়া আছে। দেখছে।

শৈলীমাসি মুখ না ফিরিয়েই বোধ হয় টের পেলেন যে রিখিয়া তাঁর মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে। তাই মাথাটা পিছনে একটু হেলিয়ে হাতটা একবার পিছনপানে বাড়িয়ে বললেন—এই মেয়েটা আমার, এও কথা বলার সময় পায় না আজকাল।

রিখিয়া বলল—উঃ, রোজ কত কথা বলি।

শৈলীমাসি স্নিগ্ধ হেসে মুখ ফিরিয়ে মেয়েকে দেখলেন। সোমেনের দিকে চেয়ে বললেন—আগে ওর যত কথা ছিল আমার সঙ্গে। কোনও কথা গোপন করত না। সব বলত, বন্ধুবান্ধবদের কথা, স্কুলের কথা, পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের কথাও। সব বলে দিত।

—এখন বুঝি বলি না। রিখিয়া চাপা গলায় বলে।

—কম বলিস। বলে শৈলীমাসি গেলাস তুলে একঢোক জল খেলেন। সোমেনকে বললেন—তোমার সম্বন্ধে কি বলেছে জানো?

রিখিয়া হঠাৎ বিড়বিড়িয়ে উঠে বলে—উঃ মাঃ বোলো না, বোলো না। তুমি ভীষণ খারাপ।

বলেই পিছন থেকে হাত চাপা দিল মায়ের মুখে। শৈলীমাসি হাতটা আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে স্মিতমুখে বলেন—বলব না। সোমেনের দিকে চেয়ে বললেন—তুমি বাবা, শুনতে চেয়ো না। ও লজ্জা পায়।

সোমেন তটস্থ হয়ে বলে—নিন্দে নয় তো!

রিখিয়া বলে—নিন্দে তো নিন্দে।

—না, নিন্দে নয়। শৈলীমাসি বলেন—ওকে খেতে দিয়েছিস রিখি?

—না।

—দে।

সোমেন আপত্তি করে বলে—না, কিছু খাব না, রোজই খেতে হবে নাকি!

—একটু খাও। বলেন শৈলীমাসি। বড় সুন্দর শান্তস্বরে বলেন। স্বরটা মিনতিতে ভরা। আবার বলান—তুমি খাওয়ার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে, না?

সোমেন হেসে বলে—একটু।

—তাই শরীরটা সারেনি। খাওয়ায় খুঁতখুঁতে হলে শরীর ভাল হয় না। আমার ছেলেটারও ওরকম ছিল। কালো মাছ খাবে না, আঁশ ছাড়া মাছ খাবে না, সবজি খাবে না, খাসির মাংস খাবে না, নেমন্তন্ন বাড়িতে গেলে ভারী মুশকিল ছিল ওকে নিয়ে। রোগা, রাগী আর অহংকারী ছিল খুব। তা এখন শুনি বিদেশে সব খায়।

বলতে বলতে একটা কান্নার মেঘ করে এল বুঝি ভিতরে। সেটা চাপা দেওয়ার জন্যই বললেন—বগুড়া স্টেশনের কাছে মুটে মজুররা কদমগাছের তলায় বসে ছাতু মেখে খেত। একটা প্রকাণ্ড ছাতুর দলা পেতলের কানা-উঁচু থালায়, শালপাতায় একটু চাটনি, ঘটিভর জল। কী তৃপ্তি করে যে খেত কাঁচা লঙ্কার কামড় দিয়ে। সেই সস্তাগণ্ডার দিনেও ওই সব খেত, আমরা দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখতুম। সেই খাওয়া দেখার মধ্যেই একটা ভীষণ সুখ ছিল। একবার একটা সাঁওতালকে দেখেছিলুম জুতোর বাক্সের ঢাকনায় একটা মাঝারি বড় আলুসেদ্ধ তেল ছাড়া কেবল নুন আর মরিচ দিয়ে খুব যত্ন করে মাখছে, পাশে জুতোর বাক্সে একবাক্স ভাত। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম সেই সাঁওতালটা ওই অনেক ভাত একটুখানি আলুসেদ্ধর টাকনা দিয়ে টাউ টাউ করে খেয়ে নিল। ঠান্ডা জল খেল পুকুর থেকে। ব্যস তৃপ্তি। ফের কাজে লেগে গেল। কী স্বাস্থ্য! আমরা গরিবের দুঃখের কথা ভেবে কত চেঁচামেচি করি বাবা, কিন্তু সে সব বুঝি মনগড়া কথা! ও খাওয়া দেখলেই বোঝা যায় কী সতেজ সুখী মানুষ সব। নিজেদের দুঃখের ধারণা ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দুঃখী ভাবলে কী হবে, আমাদের চেয়ে ঢের সুখী ওরা। বলে আবার একটু চুপ করে থাকেন শৈলীমাসি, ফের বলেন—আমি চাকর দারোয়ানদের মাঝে মাঝে সামনে বসে খেতে বলি, দেখব। তা তারা সব আমার সামনে লজ্জা পায়, ভাল করে খায় না। খুব ইচ্ছে করে রাস্তায় ঘাটে, স্টেশনে ঘুরে ঘুরে ওই সব মুটে মজুরদের খাওয়া দেখি। কত তুচ্ছ জিনিস কী যত্ন করে খায়। ফেলে না, ছড়ায় না, শেষ দানাটি পর্যন্ত খুঁটে খায়। কিন্তু যেতে তো পারি না। জেলখানায় আটকে আছি।

সোমেনের কিছু করুণার উদ্রেক হয়েছিল। বলল—কী অসুখ শৈলীমাসি?

—সে বলার নয়। মেয়েমানুষ হচ্ছে রোগের আধার। যখন বিয়ের সময় হবে তখন খুব দেখে বুঝে বিয়ে করো। বাঙালি মেয়েরা বড্ড রোগা রোগা। বলে নিজের ঠাট্টায় একটু হাসলেন। বললেন—অসুখ কখন হয় জানো। যখন মনের মধ্যে অসুখের ভাবটা আসে তখনই শরীরে অসুখ ভর করে। মনটা পরিষ্কার থাকলে, অসুখের ভাবনা না ভাবলে বড় একটা অসুখ হয় না। আমি সারাদিন রোগের ভাবনা ভেবে রোগ ডেকে এনেছি। এই শরীরটুকুর ওপর পাঁচবার ছুরি কাঁচি চালিয়েছে। কতক রোগ ধরা পড়েছে, কতক পড়েনি। আমি ভুগি সেই সব আর্নট্রেইসেবল ডিজিজে। রোগবন্দি। মেয়েমানুষ খাড়া না থাকলে সংসার ভেসে যায়। আমারটাও গেছে।

সোমেন কথা খুঁজে পায় না। উৎসারিত ওই বেদনা তাকে স্পর্শ করে না ঠিকই, কিন্ত অপ্রতিভ করে দেয়। হয়তো দু-চারটে সাত্ত্বনার কথা আছে যা খুঁজে পায় না সে। নিস্তব্ধ ঘরে সে যেন অস্পষট টের পায় শৈলীমাসির অস্তিত্ব থেকে বায়ুবাহী বিষন্নতার জীবাণুরা তার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেকে ধরেছে তাকে। একটা শ্বাসরোধকারী প্রতিক্রিয়া হতে থাকে তার মধ্যে। এইরকম অবিরল বিছানায় পড়ে থাকা কী ভয়ংকর, কী মারাত্মক, যখন বাইরে অসীম আকাশের প্রসার, শহর-বন্দর-মাঠ-ঘাটে বিস্তৃত জীবন, তখন এ কেমন কয়েদ? শৈলীমাসির অস্তিত্ব যেন তাকে অস্থির করে তোলে।

উনি বললেন—ছেলেটার রাশ ধরতে পারলাম না, রোগা মাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল। রোগের বাড়িতে আর ফিরে আসবে না। আর মেয়েটা এ লোনলি চায়ল্ড, ছেলেবেলা থেকে সঙ্গীসাথী নেই, মা রোগে পড়ে থাকে, বাবা ব্যস্ত। বড় একা। আপনমনে বড় হয়েছে মেয়েটা। কঁদত না, কাঁদলে কে থামাবে। হাসতও না তেমন, হাসবার মতো কিছু তো দেখত না। তাই মেলাংকলিক, অভিমানী। একটু বড় হয়ে যখন স্কুলে যায় তখনও ওর একাচোরা স্বভাব। তাই কারও সঙ্গে সহজে মিশতে পারত না। আজও ওর তেমন কোনও বন্ধু নেই। তাই আপনমনে ক্যামেরায় ছবি তোলে, গান গায়, গাড়ি চালানো শেখে, কিন্তু লোনলি, অসম্ভব একা। আমি তো মা, তাই বুঝি!

সোমেন মাথা নাড়ল। হঠাৎ বলল—আপনাল ইংরেজি উচ্চারণগুলি কী সুন্দর। কোথায় শিখলেন?

মুখের বিষন্নতা, লেবুর রস ফেললে যেমন গরম দুধ ছানা কেটে যায়, তেমনি কেটে গেল। হাসলেন, বললেন—বগুড়ায় ইংরেজি মিডিয়ামে বাড়িতে পড়তাম। বাড়িতে মেমসাহেব রেখে শিখিয়েছিলেন বাবা। তার কাছে শিখেছি। এখনকার সব ইংলিশ মিডিয়ামে যেমন নামকোবাস্তে ইংরেজি শেখায় তখন তেমন ছিল না। খাঁটি সাহেব মেমসাহেবরা খাঁটি ইংরেজি শেখাত।

শৈলীমাসির এই তৃপ্তিটুকু থাকতে থাকতেই সোমেন বেরিয়ে আসতে পারল সেদিন। রিখিয়া এসে ডাকল। পাশের আর একটা ঘরে রিখিয়ার মুখোমুখি বসে অনেক খেল সোমেন। রিখিয়া একটু গম্ভীর। সোমেনও তেমন কথা বলতে পারল না। যখন উঠল তখন মনে এক হর্ষ ও বিষাদ।

পরদার ওপাশে মধুমিতা বসে আছে এখনও। ও ঘরে পা দেওয়ার আগে রিখিয়া বলল—আবার আসবেন।

ঘরে পা দিতেই হাতের পত্রিকাটা ফেলে উঠে দাঁড়াল মূর্তিমতী উইমেনস লিব। মধুমিতা ঘড়ি দেখে বলল—দ্যাট ওয়াজ ওয়েটিং ফর গোডো।

॥ আটচল্লিশ ॥

বাইরে মেঘধ্বনি। পরদাটা ওড়ে হঠাৎ হাওয়ায়। উড়ে আসে খড়কুটো, ধুলো, গাছের পাতা, বোগেনভেলিয়ার পাপড়ি, বাতাসে ঠান্ডা জলগন্ধ। বৃষ্টির প্রথম একটা দুটি ফোঁটা গাছের পাতায় পড়ে। একটা আহত নীল বাঘ ঝাপিয়ে পড়ে মাটিতে, তীব্র গর্জনে কেঁপে ওঠে ঘরের মেঝে।

নীল আলোটা ঝলসাতেই কানে আঙুল দিয়েছিল রিখিয়া। চোখে ভয়।

মধুমিতার ভয় নেই। ব্যাগ খুলে সে মাথা ধরার বড়ির স্ট্রিপ থেকে একটা বড়ি ছিঁড়ে নিল। শুকনো বড়িটা মুখে ফেলে গিলে ফেলল। জল ছাড়াই। ভ্রূটা একটু কেঁচকানো।

বৃষ্টি এল। রিখিয়া কান থেকে হাত নামিয়ে বলে। মুখে একটু হাসি। সোমেনের দিকেই চেয়েছিল, বলল—যাওয়া হবে না।

মধুমিতার নিশ্চয়ই মাথা ধরার রোগ আছে। ডান হাতের বুড়ো আর মাঝের আঙুলে কপালের দুধার টিপে ধরে থেকে বলল-বৃষ্টি তো কী?

—কেমন ঝোড়ো বাতাস! রিখিয়া কুণ্ঠিতভাবে বলে।

জানালা দরজা তাড়াতাড়ি বন্ধ করছে চাকরেরা। দুর্যোগের আভাস পেয়ে কোথা থেকে কুকুরটা একবার ডাকল, সঙ্গে শেকলের ঠুন ঠুন শব্দ। আজ কুকুরটাকে বেঁধে রেখেছে। খর বৃষ্টির শব্দ উঠল চারধারে, ভাষাহীন কোলাহল। হামাল বাতাস বন্ধ কপাট নাড়া দিচ্ছে মুহুর্মুহু। আকাশের নীল বাঘেরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে মাটিতে।

মধুমিতা ঠোঁটটা একটু রাগের ভঙ্গিতে টিপে বলল—ব্রিজের নীচে ঠিক জল জমে যাবে। গাড়ি আটকে গেলে মুশকিল।

বলে সোমেনের দিকে তাকাল, কোমরে হাত রেখে একটু তেরছা চেয়ে বলল—আপনার জন্যই তো। যা দেরি করালেন!

সোমেন সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল—তোমার খুব মাথা ধরে?

মধুমিতা একটু অসহায়ের মতো বলল—খুব। যখন শুরু হয় তখন পাগল পাগল হয়ে যাই ব্যথায়। মুঠো মুঠো ট্যাবলেট খেতে হয়।

—তাই দেখছি। জল ছাড়া ট্যাবলেট খাও কী করে?

—সব সময়ে খাই তো, অভ্যেস হয়ে গেছে। রাস্তায় ঘাটে হরঘড়ি জল তো পাওয়া যায় না।

—এত ট্যাবলেট খাওয়া ভাল নয়।

মধুমিতা ধৈর্যহীন গলায় বলে—সবাই ওকথা বলে। কিন্তু ট্যাবলেট ছাড়া ব্যথা কী করে সারে তা কেউ বলতে পারে না। ডাক্তাররাও বলে—ট্যাবলেট খেয়ো না।

বলে যেন এক অসহায় তীব্র রাগে সোমেনের দিকে চেয়ে রইল। দাঁতে ঠোঁট টিপে বলল—কতবার মাথা এক্সরে করেছে ডাক্তাররা, রোগ পরীক্ষা করেছে। রোগ ধরতে পারে না। সামনের মাসে ভেলোরে যাচ্ছি।

—কেন?

তেমনি এক অসহায় রাগে, এবং বুঝি একটু অভিমানে বলল—ডাক্তাররা সন্দেহ করছে, ব্রেনে টিউমার, অপারেশন হবে। ভেলোরে ছাড়া ওসব অপারেশন হয় না।

বলে একটু হাসল। বড় করুণ হাসিটি। ওই গোল চশমা, ছটফটে ভাব, স্মার্ট পোশাক সব ভেদ করে একটা ব্যথা-বেদনা ফুটে উঠল। বলল-শক্ত অপারেশন। বাঁচে না। আজকাল মা আর বাপি আমাকে খুব আদর করে জানেন! বাঁচব না তো!

সোমেনের মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। এক পরদা মেঘ ঢেকে দিল মনটাকে। বলল— কে বলল বাঁচবে না? এটা বিজ্ঞানের যুগ, অত সহজে লোকে মরে না।

সান্ত্বনাটুকুর কোনও দরকার মধুমিতার নেই, এ-ওরদিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এ বয়সে মৃত্যুর ভয় বড় একটা থাকে না, ‘মরে যাব’ একথা ভাবতে একরকমের রোমহর্ষময় রহস্য জেগে ওঠে। সকলের করুণা, চোখের জল, শোক—এই সব পেতে ইচ্ছে করে, চারদিকের ওপর ঘনিয়ে ওঠে অভিমান। সোমেন জানে।

—এখন কে বেশি সেন্টিমেন্টাল শুনি। বলে রিখিয়া সোমেনের দিকে তাকায়—সব বোগাস, জানেন। আমারও কত মাথা ধরে।

মধুমিতা কারও কথারই উত্তর দিল না। গোল চশমার ভিতর দিয়ে চেয়ে রইল ক্যারামবোর্ডে সাজানো ঘুটিগুলোর দিকে। ঠোঁটে থমকানো হাসি লেগে আছে।

হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে রিখিয়ার দিকে চেয়ে বলল—অপরাজিতা, আমি বাড়িতে একটা ফোন করব।

—আয়।

—এক মিনিট। আসছি। বলে একটা চাউনি সোমেনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। মধুমিতা।

আরও জোর বাতাস এল। চারধারে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, লোহার বিম, কাচের শার্শি সব ভেঙে পড়ছে বৃষ্টিতে, কলকাতার সাজগোজ ধুয়ে গেল। অজ পাড়াগাঁর মতো অসহায়ভাবে কলকাতা ভিজছে।

একাকী সিঁড়ির মুখে দাড়িয়ে আছে রিখিয়া। দেখছে, মধুমিতা নিয়ে গেল সোমেনকে।

মধুমিতা সোমেনকে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এইভাবেই কি দৃশ্যটা দেখল রিখিয়া? সোমেন তা জানে না। তবু আর একবার টেলিপ্যাথি পাঠাল—আমি তো নিজের ইচ্ছেয় যাচ্ছি না, তুমি তো জানো।

সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে একবার ঘাড় ঘোরাল সোমেন। রিখিয়া তাকিয়ে আছে। কী করুণ চোখ! অন্ধ কুকুরটা ওর গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে, মুখটা ওপরে তোলা কি যেন গভীরভাবে বুঝবার চেষ্টা করছে, একটা গোঙানির শব্দ করল।

দেখে পা ফেলেনি সোমেন। শেষ ধাপে পা’টা ঘুরে পড়ল। আচমকা একটা ঝাঁকুনি খেল সোমেন।

তক্ষুনি হেসে ফেলল রিখিয়া, বলল—বেশ হয়েছে।

সোমেন ঠোঁট উলটে একটা অগ্রাহ্যের ভঙ্গি করে। একটু হাসে।

রিখিয়া রেলিং থেকে ঝুঁকে বলে—আপনার ফটোগুলো নিয়ে গেলেন না?

সোমেন ফটোগুলো ইচ্ছে করে নেয়নি, সব শোধবোধ হয়ে যাওয়া কি ভাল? কিছু থাক। তাই হেসে বলল—আর একদিন নিয়ে যাব।

—ফটোগুলো ভাল হয়নি, না? তাই নিলেন না। রিখিয়ার যে কতরকম কমপ্লেকস, মুখখানায় ফের অন্ধকার ঘনিয়ে এল।

সোমেন সিঁড়ির গোড়া থেকে মুখ তুলে বলে—ভাল হয়নি, কে বলল? আমি যেমন, ঠিক তেমনি হয়েছে। আবার আসব তো, তখন নিয়ে যাব।

রিখিয়া একটু হাসল, অন্ধকার মুখে সেই হাসিটুকু জোনাকির মতো একটু আলো ছড়িয়ে দিল।

ওই হাসিটুকু বুকের মধ্যে পদ্মপত্রে জলবৎ টলটল করছিল।

খোলা গেট দিয়ে মধুমিতার ছোট্ট গাড়িখানা ব্যাক করে এল গাড়িবারান্দার তলায়। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেছে গাড়িটা। হেডলাইটের আলোয় অজস্র কাজের নলের মতো বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে দেখা যায়, পিছনের দরজাটা ভিতর থেকেই খুলে দিল ড্রাইভার। একদৌড়ে মধুমিতা ঢুকে গেল, পিছনে সোমেন।

মধুমিতা তার চশমার কাচ কামিজের কোনা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল—এ গাড়িটা বাপি আমাকে অলমোস্ট দিয়ে দিয়েছে। যেখানে খুশি যাই, কেউ কিছু বলে না। কেন জানেন? ওই অসুখটার জন্য। অসুখবিসুখ হলে খুব ইম্পর্ট্যান্স পাওয়া যায়।

বলে হাসল, কয়েকটা গোল চাকতির মততা, আর গোটা দুই ছোট পাশবালিশের মতো গদি পড়েছিল সিটের ওপর। তার দুটো সোমেনের কোলের ওপর ফেলে দিয়ে মধুমিতা বলল—রিল্যাক্স প্লিজ। সিগারেটও খেতে পারেন।

মধুমিতা দুটো বালিশ তলপেটে চেপে ধরে কুঁজো হয়ে বসল। মুখখানা হাতের তেলোয় রেখে পাশ ফিরিয়ে চেয়ে রইল সোমেনের মুখের দিকে। গাড়ির ভিতরে অন্ধকার, কাজ বন্ধ বলে ভ্যাপসা গরম। কাচের গায়ে ভাপ লেগে আবছা। সেই আবছা কাচ দিয়ে বাইরে একটা ভূতুড়ে শহরের অস্পষ্ট আলো-আঁধার দেখা যায়।

সোমেন বালিশ দুটো ফেলে রেখে কনুইয়ের ভর দিয়ে বসল। যথেষ্ট আরামপ্রদ গাড়ি, গভীর বসবার গদি। তবু আবার বালিশের কী দরকার তা বোঝা মুশকিল। বড়লোকদের কত বায়নাক্কা থাকে। গাড়ির পিছনের আর সামনের কাছে ছোট ছোট পুতুল সুতোয় বাঁধা হয়ে ঝুলছে। টেডিবিয়ার, মিকিমাউস, জাপানি মহিলা, ব্যালেরিনা।

—এইমাত্র বাপিকে ফোন করলাম তো! মধুমিতা বলল—বাপি একটুও রাগ করল না, খুব অ্যাংশাস। অসুখ না হলে কিন্তু দেরি হওয়ার জন্য রাগ করত।

—তোমার অসুখ কবে থেকে?

—একবছর, আগে অল্প অল্প মাথা ধরত। পরে সেটা খুব বেড়ে গেল।

—ব্রেন টিউমার, ঠিক বলছ?

—কী জানি! ওসব থাক। আপনি আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করবেন?

সোমেন অবাক হয়ে বলে—কেন, কোনও দরকার আছে?

মধুমিতা মাথা নেড়ে বলে—না, লোকজনের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে ইচ্ছে করে। আমার অনেক পেন-ফ্রেন্ড আছে, আবার অনেক টেলিফোন ফ্রেন্ডও আছে। টেলিফোন গাইড খুঁজে যে নামটা ভাল লাগে তাকে ফোন করি। এভাবে আমার অনেক বন্ধু জুটে গেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বয়সে আমার অনেক বড়। কিন্তু তারা ঠিক ফ্রেন্ডশিপ রাখে। মাঝে মাঝে ফোন করে। অনেকে বাড়িতে আসে, প্রেজেন্টেশন বা বোকে দিয়ে যায়।

—তোমার তো এমনিতেই অনেক বন্ধু।

—আমি আরও বন্ধু চাই। অনেক বন্ধু। করবেন তো ফোন?

বলে হাসল মধুমিতা।

—করব।

মধুমিতা খুব খুশি হল। হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে সোমেনের পড়ে-থাকা হাতটা চেপে ধরে বলল—কমরেড।।

হাতটা ছাড়ল না। নিবিড় আঙুলগুলি জড়িয়ে ধরে রইল। সামনের ড্রাইভার নিবিষ্ট হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। কেউ দেখছে না। তবু একটু শিউরে উঠল সোমেন।

মধুমিতা যুবতী নয়। এখন কৈশোরকাল। শরীরের চেতনাগুলি এখনও লাজুক থাকে। মনে থাকে ভয় ও কুণ্ঠা। এখনকার মেয়েরা কিছু বেশি প্রগলভ। তবু প্রথম চেনায় এতটা করে না। মধুমিতার যে ভয় বা লজ্জা নেই তা বুঝি ওই অসুখের জন্য। এখন ওর লজ্জা করার মতো সময় নেই। এখন ওকে তাড়াতাড়ি সম্পর্ক তৈরি করে নিতে হয়। কিংবা এও হতে পারে যে, স্বভাব পুরুষের মতো, মেয়েদের স্বাভাবিক লজ্জাবোধ ওর নেই।

আঙুলগুলি, হাতের উষ্ণ প্রসারটি সোমেন টের পেল না। তার মনে হল, হাতটা বড় শীতল। মৃত্যুর হিম লেগে আছে। সেই শীতলতা গ্রাস করে নিচ্ছে শরীর। শৈলীমাসির ঘরে যেমনটা হয়েছিল এখনও সেরকমটা হচ্ছিল তার। যেন মধুমিতার শরীর থেকে মৃত্যুর জীবাণু সংক্রামিত হচ্ছে তার স্বাসের বাতাসে। এগিয়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। অধিকার করে নিচ্ছে তাকে। সে একটা অস্ফুট শ্বাসকষ্টজনিত শব্দ করল। বলল—জানালাটা খুলে দিই?

মধুমিতা বলল—ওমা! বৃষ্টি আসবে না!

তাই তো! অঝোর বৃষ্টি, সামনের উইন্ডস্ক্রিনে ক্রমান্বয়ে পাক খেয়ে খেয়ে জলস্রোত মুছে ফেলতে পারছে না ওয়াইপার। কাচের ভিতর দিয়ে এক ভঙ্গুর, বিমূর্ত শিল্পের মতো শহরকে দেখা যায়। তবু জানালাটা খোলা দরকার। কিছু পরিষ্কার বাতাসের একটু স্বাস বড় প্রয়োজন সোমেনের।

—আপনি খুব ঘামছেন। এই বলে মধুমিতা খুট করে সুইচ টিপতেই একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের খেলনা ফ্যান বোঁ বোঁ করে ঘুরে বাতাস দিতে লাগল। ও মুখখানা আবার সোমেনের দিকে ঘুরিয়ে চেয়ে থেকে বলল—অপরাজিতা বড্ড গুডি-গুডি। পৃথিবীর কোনও খবর রাখে না।

সোমেন একটু হাসে। উত্তর দেয় না।

মধুমিতা ফের বলে—আমি কিন্তু ওরকমই নই। আই লিভ আপ টু দি টুয়েন্টিয়েথ, সেঞ্চুরি। অপরাজিতার সঙ্গে আমার মেলে না। খুব ঝগড়া হয়। আবার ভাবও হয়ে যায়।

সেই পুরুষালি স্বভাবের ডঁটিয়াল মেয়েটি আর নেই। গাড়ির সিটে পা তুলে বসেছে এখন। তেলচোখে খুঁটে খুঁটে দেখছে সোমেনকে। আবছা আলোয় এই প্রথম ওর চোখে একটু মেয়েমানুষি কটাক্ষ দেখতে পেল সোমেন। তার অস্বস্তি হচ্ছিল।

মধুমিতা হাতটা সরিয়ে নিল হঠাৎ। হাঁটু দুটো দুহাতে জড়িয়ে ধরল বুকের সঙ্গে। ওই ভাবেই একটু দোল খেল।

সামনের দিকে চেয়ে বলল—আপনি কি এনগেজড?

সোমেন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। বলল—কী বলছ?

—আপনার কি কেউ আছে?

সোমেন এই প্রশ্নে হাসল। ভয়ও পেল। তার বয়স মাত্র চব্বিশ পূর্ণ হয়েছে। পঁচিশে পা। সদ্য যুবা পুরুষ। তবু মনে হয় তাদের যৌবনকালকে নস্যাৎ করে পরবর্তী যুবক-যুবতীরা দ্রুত জমি দখল করে নিয়েছে। মাঝখানে একটা যোগাযোগহীন শূন্যতা জেনারেশন গ্যাপ। তারা কখনও এত অল্প পরিচয়ে কাউকে এই প্রশ্ন এত অকপটে করতে পারেনি।

সোমেন মিথ্যে করে বলল—ন্‌নাঃ কেন?

—একটা কথা বলব? রাগ করবেন না?

—কী কথা?

—প্লিজ, রাগ করবেন না।

—না।

হাতটা আবার নরম বিসর্পিল আঙুলে চেপে ধরল মধুমিতা। নিবিড় উষ্ণ আঙুল, হাতের তেলোয় জ্বরাক্রান্তের তাপ। মৃত্যুর হিম আর নেই।

বলল—আই লাভ ইউ।

॥ উনপঞ্চাশ ॥

সেদিন শীলাকে সাধ দিলেন ননীবালা। সাধটুকু দিতেই কত না কষ্ট হল।

এখন এ সংসারে আর তেমন স্বচ্ছলতা নেই। রণেনের মনটা বড় ভাল, কোনও উদ্যোগ আয়োজন হলেই রাশিকৃত টাকা খরচ করে বাজার আনবে, জিনিস আনবে, হইচই করে হাট বাঁধিয়ে ফেলবে বাসায়। রান্নাঘরের চৌকাঠের ওপর উবু হয়ে বসে সবকিছু চাখবে। পালেপার্বণে বা নেমন্তন্নে যেদিন বাসায় ভালমন্দ হয় সেদিন ননীবালাকেই তাগাদা দেবে রণেন—ও মা, আজ তুমি হাতা-খুন্তি ধরো। তুমি হাতা ছুঁলেই রান্নার স্বাদ পালটে যায়।

রাঁধতে ননীবালার তেমন কষ্ট হয় না। প্রেশারটা বাড়লে একটু অসুবিধে হয়। ট্যাবলেট আর ট্রাংকুইলাইজার খেয়ে রাঁধতে বসেন গিয়ে। কিন্তু আজকাল সে সুখও গেছে। রণেনের অসুখটা হওয়ার পর থেকেই নেমন্তন্নের পাট গেল উঠে। রণেন আর মাকে রাঁধতে বলে না, কারণ রণেনও আর খাবারের স্বাদ পায় না। কোথায় যে ওর মনটা পড়ে দাপাচ্ছে তা কে জানে! ননীবালা জানেন না।

তবে এ নেমন্তন্নটা করতেই হয়। ছোট মেয়ে ইলারও ছেলে হল কিছুকাল আগে। ওরা মুম্বইতে থাকে বলে সাধ দিতে পারেননি, কেবল শতখানেক টাকা পাঠিয়েছিলেন একটা শাড়ি কেনার জন্য। বড় মেয়ের তো হবেই না ধরে নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত হচ্ছে। ভেবেছিলেন, খুর ঘটা করে সাধ দেবেন। রণোর এ-রকম না হলে দিতেনও।

ভয়ে ভয়ে কথা পেড়েছিলেন বীণার কাছে-বউমা, শীলুর একটা সাধ না দিলে কেমন দেখাবে?

—দিন। বীণা সংক্ষেপে উত্তর দিল।

—ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে খুব ভাল সাধ দিয়েছে শুনলাম। সাদা খোলের কেটের শাড়ি দিয়েছে, অনেক সধবা খাইয়েছে।

বীণা এ কথার উত্তর দিল না।

কিন্তু ননীবালা বুঝলেন। তিনি তো অবুঝ নন। ছেলের উপরি বন্ধ, সংসারটা মাইনের ক’টা টাকায় কেবলমাত্র চলে যায়। তার ওপর চিকিৎসার খরচও বড় কম নয়। বাড়িতে খরচ কোথা থেকে আসবে! তবু মনটা খুঁত খুঁত করে। শীলাকে ভালরকম একটা সাধই দেওয়ার কথা। এতকাল পরে সন্তান হচ্ছে, সেও বটে। আবার অন্যদিকটাও দেখার আছে। লুকিয়ে-চুরিয়ে শীলা ননীবালাকে চাটা-কে-টাকা, গুচ্ছের শাড়ি, একজোড়া সোনার বালা, ভাল চটি কত কী দিয়েছে! জামাই বোধ হয় এ-সব খুব একটা পছন্দ করে না, কিন্তু শীলা ঠিক চুপেচাপে নানা জিনিস পাঠিয়ে দেয়। বাড়িতে ভাল ঘি এল কী কোনও খাবার হল, কী বড় মাছের টুকরো এল, সঙ্গে সঙ্গে পাঠায়। এ সবের পালটি দিতে হয়, সে দেওয়ার ক্ষমতা তো ননীবালার নেই তাই সাধের সময় ভাল একটা কিছু দেবেন, ভেবেছিলেন।

হল না।

রণেনের কাছে এ সব কথা তুলতে চান না ননীবালা। ওর বোধ হয় কষ্ট হবে। কাউকে নেমন্তন্ন করে ভাল আয়োজন না করতে পারলে ও বড্ড খুঁত খুঁত করে। তাই বললে হয়তো দাপাবে মনে মনে। মনের কষ্ট বেড়ে যাবে। অথচ সাধের আগের দিনও বীণা তেমন গা করছিল না। জামাই মেয়েকে নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছে, অথচ উদ্যোগ আয়োজন নেই। মনে মনে ভয় পেলেন ননীবালা।।

দুপুরে সোমেন বাড়িতে খেতে এল। খাওয়ার পর যখন সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে বসল, তখন ননীবালা তার কাছেই নালিশটা করলেন—কী করি বলো তো, কাল ওরা সব আসবে, অথচ কোনও উদ্যোগ আয়োজন নেই।

ছেলেটা বড্ড রাগী। কোনও কাজ নেই, তাই প্রায় সময়ই সব আবোলতাবোল কী যেন ভাবতে বসে। সে সময় কেউ ডেকে কথা বললে বড় রেগে যায়। তেমনি রাগের ঝাঁঝ দিয়ে বলল—নেমন্তন্ন করতে গেলে কেন? যত সব সেকেলে সংস্কার। সাধ! সাধ আবার কী? ওসব উঠে গেছে।

ননীবালাও রেগে গিয়ে বলেন-কী বলছিস যা তা? এতকাল পর মেয়ে পোয়াতি হল, সাধ দেব না?

—দেবে তো দাও। আমাদের যা রান্না হবে তাই খেয়ে যাবে। সংসারের অবস্থা তো ওরাও জানে।

ননীবালা আহাম্মক ছেলেটির কথা শুনে গায়ের জ্বালা টের পেলেন। বলেন—সংসারের কোনও ব্যাপারেই থাকিস না, এ ভাল নয়। একটা শাড়ি-টাড়ি কিছু না দিলে কেমন দেখায়?

সোমেন বলল—দাদা পারবে না।

—তবে?

সোমেন তখন ননীবালার দিকে চেয়ে খুব ঠান্ডা কিন্তু কঠিন গলায় বলল—তোমার টাকা তো ব্যাঙ্কে পচছে। চেক কেটে দাও, তুলে এনে দিই।

ননীবালা সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে যান। জমি কেনার পরও হাজার সাতেক টাকা পড়ে আছে ব্যাঙ্কে। সকলেরই নজর ওইদিকে। অথচ জমির ভিত পত্তনের জন্য যে টাকা দরকার তার জোগাড় নেই। ওইটুকুই ভরসা।

ননীবালা অসহায়ের মতো বললেন—ও টাকা ভেঙে ফেললে তোদের বাড়ি কোন দিন উঠবে?

—ও টাকাতেও বাড়ি উঠবে না। কেন বাজে কথা বলছ মা? আমাদের বাড়ি-টাড়ি হবে বরং বেশি দামে জমিটা বেচে দিয়ে। আর টাকাটা যক্ষী বুড়ির মতো আগলে বসে থেকো।

কী কথা ছেলের! ননীবালার দু-চোখে জল এল। সংসারে এরকম শাস্তি পেটের শত্রু ছাড়া কে দিতে পারে? কার ওপর রাগ অভিমান করবেন, কার কাছেই বা নিজের নানা সুখ-দুঃখ সাধ আহ্লাদের কথা জানাবেন? শেষ পর্যন্ত বুঝি একটা মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে মেয়েদের আর কেউ থাকে না! কিন্তু ননীবালার সেই মানুষটা যদি মানুষের মতো হত।

অসহায়ের মতো ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। কী সুন্দর মুখখানা ছেলের। কাটা কাটা নাক মুখ, দিঘল চোখ, এক ঢল চুল, রোগার ওপর ভারী লক্ষ্মীমন্ত চেহারা। তবু ওর মনটা এত নির্দয় কেন? তবু তো এখনও বিয়ে করিসনি ছেলে, বিয়ে করলে আরও কত পর হয়ে যাবি!

অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন—হাতের পাতের দুটো টাকা। মানুষের কত বিপদ-আপদ আসে। দুর্দিনের জন্য রাখতে হয় না? হুট করে টাকা তুলে আনলেই হল?

সোমেন বিরক্তির সঙ্গে বলে—আর কত বিপদ আসবে? এটাই তো বিপদ। আসলে তুমি এ সংসারের জন্য নিজের টাকা খরচ করতে চাও না। তুমি ভীষণ সেলফিশ।

এই বলে সোমেন জামা-কাপড় পরে বেরিয়ে গেল গনগন করতে করতে। ভয়ে ননীবালা আর উত্তর করলেন না। কিন্তু ছেলেটা বেরিয়ে গেলে একা ঘরে কত কান্না যে কাঁদলেন! ভগবানকে কখনও দেখেননি, তবু ভগবানকে ডেকে কত কথা বললেন মনে মনে। এক সময়ে দেখেন ভগবানের বদলে সেই ব্রজগোপাল বলে মানুষটার মুখ মনের মধ্যে ভাসছে। সঙ্গে সঙ্গে মনটায় যেন রাগ-অভিমানের ঝড় এল। বললেন—তুমি যদি আমার মাথার ওপর থাকতে তা হলে ওরা আমাকে অত কথা বলার সাহস পায়? দেখো, আমাকে কি আঁস্তাকুড়ের বেড়ালছানার মতো ফেলে গেছ তুমি। পুরুষমানুষ হয়ে তোমার লজ্জা করে না?

এমনি সব কথা। কথার পর কথা। গভীর মেঘের স্তর যেমন বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে আর শেষ হতে চায় না, তেমনি, এত বছর ধরে শুধু রাগ আর অভিমান মনের মধ্যে স্তরের পর স্তর জমে থেকেছে। তাই অনেক সময় লাগল ননীবালার সামলাতে।

কালকে সাধ। একটা কিছু করতেই হয়। নইলে ছেলেদের কী, জামাই-মেয়ের সামনে তিনিই লজ্জায় বেরোতে পারবেন না। আবার শুধু সাধই তো নয়, প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময়ে মেয়েদের বাপের বাড়ি থাকার কথা। খরচপত্রও বাপের বাড়ির কিন্তু সে কথা কার কাছে তুলবে ননীবালা?

বীণা ছেলেমানুষ নয়, তিন ছেলেমেয়ের মা। কানে যখন কথাটা তুলেছে তখন বীণা একটা শাড়ি-টাড়ি কিনে আনবে ঠিকই। কিন্তু তাতেও ভয় পান ননীবালা। তেমন ভাল দেখনসই শাড়ি কি কিনবে? শীলুর কত দামি দামি শাড়ি, নিজে রোজগার করে কেনে, বরও ঢেকে দেয় শাড়িতে। কত দামি শাড়ি ঝিয়েদের বিলিয়ে দেয়। আজেবাজে শাড়ি দিলে পরবেই না হয়তো। জামাইও কী ভাববে?

এই সব চিন্তায় পাগল-পাগল হয়ে গেলেন তিনি। এ সব আর কেউ ভাববে না। দায়দায়িত্ব সবই যেন তার একার।

তখনও দুপুর যায়নি। গরমের দুপুর তো, অনেকটা বেলা পর্যন্ত তার আঁচ থাকে। বীণা একটু ঘর বার করে কী ভেবে একটু বেরলো। সাজ-গোজ করেনি বেশিদুর যাবে না। যাওয়ার সময় আজকাল সব সময়ে বলে যায় না। কখনও খেয়াল হলে, মেজাজ ভাল থাকলে বলে—মা একটু অমুক জায়গা থেকে ঘুরে আসছি। আজ বলল না। বোধ হয় শিলুর সাধ নিয়ে মনে মনে একটু আড় হয়ে আছে।

বীণা বেরিয়ে গেলে ফাঁক পেয়ে ননীবালা রণেনের ঘরে এলেন। আর, ঘরে ঢুকেই বড় করুণ দৃশ্যটা দেখলেন। মস্ত বিছানায় বাচ্চাগুলো যে যার মতো ছড়িয়ে শুয়ে আছে। অঘোরে ঘুম। তাদেরই মাঝখানে শুয়ে রণেন। গরমে গায়ে কাপড় রাখতে পারে না, তাই আন্ডারপ্যান্ট পরে শোয়। ননীবালা দেখলেন, আন্ডারপ্যান্ট পরা রণেনকে ঠিক তার ছেলেদের মতোই দেখাচ্ছে। ও রকমই শিশু যেন। শুধু চেহারাটাই যা একটু বড়। একটা হাত ভাঁজ করে তার ওপর মাথা রেখে শুয়েছে। পা দুটো ভাঁজ করা গুটিসুটি। পাখার তলাতেও ওর কপালে, থুতনিতে, পিঠে টোপা টোপা ঘামের ফোঁটা ফুটে আছে।

ননীবালা শুনলেন ঘুমের মধ্যেই রণেন একটা বড় কষ্টের, বড় কাতরতার শব্দ করল। যেন শ্বাস টানতে পারছে না। শরীরটা একবার কেঁপে উঠল। ননীবালা তাড়াতাড়ি গিয়ে আঁচলে ছেলেটার পিঠের ঘাম মুছতে লাগলেন। স্নেহভরে ডাকলেন—রণো! ও রণো!

রণেন দেখছিল একটা বাগান। কী সুন্দর বাগান। চারদিকে হিম কুয়াশায় ভেজা গাছপালা। কী নিস্তব্ধ! এরকম গাছপালা আর কখনও দেখেনি রণেন। মোচার মতো বড় বড় ফুল ফুটে আছে গাছে। একটা নিমগাছের মতো কিন্তু নিমের চেয়েও অনেক সরল ও সুন্দর গাছ দেখল রণেন। বড় বড় ঘাস হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। চারদিকে একটা গভীর সুঘ্রাণ। বেশ লাগছিল রণেনের। এমন বাগান সে জীবনে দেখেনি। মনটা জুড়িয়ে গেল। হাঁটু সমান ঘাস ভেদ করে আস্তে আস্তে ঘুরছিল সে ইতস্তত। হঠাৎ একবার আকাশের দিকে চোখ তুলে সে স্থির হয়ে গেল। ওইখানে, ওই আকাশে এতক্ষণ তারজন্যই একটা ষড়যন্ত্র তৈরি হয়ে ছিল। রণেন দেখে, আকাশের অনেকখানি জুড়ে এক মহা চাঁদ স্থির হয়ে আছে। এমন বিশাল অতিকায় চাঁদ সে আর কখনও দেখেনি। সেই চাঁদ তারদিকে গম্ভীর, নিস্তব্ধতাময় এক স্থির চাউনিতে চেয়ে আছে। কেবলমাত্র তারদিকেই, কারণ এ বাগানে বা আর কোথাও কেউ নেই। ভীষণ চমকে উঠল রণেন এবং হঠাৎ বুঝতে পারল, আকাশের ওই চাঁদটা চাঁদ নয়। ওই মহাকায় গোলকটিই পৃথিবী। মাধ্যাকর্ষণের কোন ফাঁকে সে পৃথিবী থেকে গলে পড়ে গেছে বহু দূরবর্তী এই বাগানে। যেখানে চেনা গাছ, চেনা ফুল, চেনা গন্ধ, কিংবা চেনা মানুষ কেউ নেই। আচমকা ভয় খেয়ে এক ভাষাহীন চিৎকার করে ‘আঁ—আঁ’ বলে ছুটতে লাগল রণেন। কিন্তু হাঁটু সমান উঁচু ঘাসগুলির ভিতরে ডুবে যায় পা, কিছুতেই সে নড়তে পারে না। আবার দৌড়োতে গিয়েই স্বপ্নটা পালটে যায়। দেখতে পায়, খুব নির্জন একটা মেঠো স্টেশন থেকে একটা ছোট্ট কালো রেলগাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। রেলগাড়ির জানালায় ব্রজগোপালের হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। রণেন মাঠের ভিতর দিয়ে প্রাণপণে দৌড়চ্ছে গাড়িটার উদ্দেশ্যে। পারছে না। কেমন যেন খিল ধরে আসছে হাতেপায়ে। যত জোরে দৌড়োয় তত আস্তে হয়ে যায় গতি। প্রাণপণে হাত উঁচু করে চেঁচিয়ে বলে—থামাও, থামাও, গাড়ি থামাও। বাবার সঙ্গে আমার কথা আছে। কিন্তু গলায় চিৎকার ফোটে না। এক অসহায় ফিসফিসানির শব্দ হয় কেবল। জরুরি কথাটা যে কী তা কিছুতেই মনে পড়ছে না। জনমানবহীন স্টেশনে কোন প্রেত ঢং ঢং করে গাড়ি ছাড়বার ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। ইঞ্জিনের শিস কানে আসে। দৌড়োতে দৌড়োতে দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে রণেনের। সে প্রচণ্ড কাঁদে, ছোটে। অন্তহীন মাঠটা আর পার হতে পারে না। ব্রজগোপাল আগ্রহভরে চেয়ে আছেন জানালা দিয়ে। জানতে চাইছেন, রণেন কী বলতে চায়। কিন্তু অত দূর! এত দূর থেকে কী করে বলবে রণেন? কথাগুলিও মনে পড়ে না। কেবল মনে হয়, বড় জরুরি কথা। বড় ভীষণ জরুরি কথা। এ স্বপ্ন থেকে পাশ ফিরতেই সে বড় ভয়াবহ আর একটা দেখল। কী সাংঘাতিক স্পষ্ট, কী বাস্তব দৃশ্য! ব্রজগোপালের মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, শববাহকদের সঙ্গে সেও। নদীর পাড়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে নামাল। চুল্লি সাজানো। শববাহকদের মধ্যে একজন বুড়ো লোক একটা নুড়ো জ্বেলে তার হাতে দিয়ে বলল—কেঁদে আর কী হবে বাবা! বৃষ্টি আসছে। মুখাগ্নিটা করে ফেলে। এবং রণেন মুখাগ্নি করল। চিতা ধীরে ধীরে জ্বলে উঠল তলা থেকে। আগুনের শিখাগুলি উঠে আসছে ওপরে। হলুদ সাপের মতো। কী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। কোথাও এতটুকু অস্পষ্টতা বা রহস্য নেই।

ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ভেঙে উঠে বসেই সে সামনে মাকে দেখতে পায়। দেখে অবাক হয়। এখনও কেন মায়ের হাতে শাঁখা, কেন চওড়া পাড়ের শাড়ি, কেন সিঁদুর? সে হাত বাড়িয়ে মার হাতটা ধরে বলে—মা, গয়ায় গিয়ে পিণ্ডিটা দিয়ে আসতে হবে। ভেবো না। বলে আবার মায়ের দিকে চায়। বড় বেভুল লাগে। স্পষ্টই একটু আগে চিতাটা জ্বলছিল। কোনও ভুল নেই।

ননীবালা বললেন—কার পিণ্ডি দিবি? কী বলছিস, ও রণো?

জাগ্রত রণেন তখন মার দিকে চেয়ে থেকে ভুলটা বুঝতে পারল। স্বপ্ন! অত স্পষ্ট স্বপ্ন কেউ দেখে? অত নিখুঁত? সে চারধারে চেয়ে দেখল, না এ তো স্বপ্ন নয়। এই তো সে জেগে আছে!

হঠাৎ দু-হাতে মুখ চাপা দিল রণেন। ননীবালা উঠে গিয়ে পাখাটা আরও বাড়িয়ে দিলেন।

রণেন জিজ্ঞেস সরল—বাবা কেমন আছে মা?

—কেমন আছে কী করে বলি! কতকাল তো আসে না।

—চিঠিপত্র পাওনি ইদানীং?

—কই! সে চিঠিপত্র দেওয়ার মানুষ কিনা।

রণেন বিছানা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে বলল—আমি বাবার কাছে যাব।

এমনভাবে বলল যেমন দু-বছরের ছেলে বায়না করে বলে।

—যাবি কি! আসবেখন সে নিজেই।

—না। মাথা নাড়ল রণেন। ঠোঁট কেঁপে গেল থরথর করে কান্নায় বিকৃত গলায় বলল—বাবা মরে গেছে মা। আমি এই মাত্র স্বপ্ন দেখলাম।

ননীবালা বড় চমকে গেলেন। স্বপ্ন! স্বপ্ন কী ফ্যালনা নাকি! কত কী হয়! ব্যগ্র হয়ে বললেন—কী দেখলি?

—ওঃ! বলে প্রকাণ্ড আন্ডারপ্যান্ট পরা চেহারাটা নিয়ে সামনে দাঁড়াল রণেন। দু-হাতে কচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল—আমি বাবার কাছে যাব। আমার সঙ্গে চলো মা।

সেই থেকে বুক কাঁপছে ননীবালার। সংসারে আর কত অশান্তি বাকি আছে, তার খেই পান না। জন্মাবার পর থেকেই বুঝি তাঁর হেন মেয়েমানুষের তপ্ত কড়াইতে বাস করা শুরু হয়। এ-ধারে পাশ ফিরলেও ছ্যাঁক, ও-ধারে পাশ ফিরলেও ছ্যাঁক।

বলেকয়ে রণেনকে শান্ত করলেন বটে। রাতটা কাটল ভয়ে-ভাবনায়, দুশ্চিন্তায় পরদিন সাধের রান্না বাঁধতে রাঁধতে অন্তত তিনবার উঠে গিয়ে ট্রাংকুইলাইজার খেলেন। সঙ্গে একখানা অ্যাডোলফেন বড়ি। প্রেশারটা বেড়েছে বোধ হয়।

রণেনও সারাদিন অস্থির। কেবলই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘ওঃ হোঃ হোঃ’ বলে চিৎকার করে। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে বলে ‘বাবা’! একবার ননীবালা শুনলেন রণেন ঘরে বসে ‘মধুবাতা ঋতায়তে…’ মন্ত্র বলছে। এত চমকে গিয়েছিলেন ননীবালা যে সেই সময়েই তাঁর স্ট্রোক হয়ে যেতে পারত। মাথাটা ঘুরে, বুক অস্থির করে, পেটে একটা গোঁতলান দিয়ে শরীরটা যেন হাতের বাইরে চলে গেল। একটু সময় দেয়ালে ঠেস দিয়ে সামলে গেলেন।

রণেন ঘুরে ঘুরে রান্নাঘরের দরজায় এসে মাকে দেখে যায়। চোখ দুটো করুণ ছলছলে।

শীলা ওরাও ব্যাপারটা আঁচ করছিল বোধ হয়। শীলা একবার চুপি চুপি এসে জিজ্ঞেস করল—দাদা আজ ওরকম করছে কেন মা?

ননীবালা মাথা নেড়ে বলেন—ওরকমই করে তো।

—আজ যেন বেশি অস্থির।

সব কথা পেটের মেয়েকেই কি বলা যায়? বিয়ের পর ও তো একটু পর হয়েও গেছে। কত কথাই চেপে রাখতে হয় ননীবালাকে। এই কথা চেপে চেপেই বুঝি একদিন দমবন্ধ হয়ে মারা যাবেন।

বললেন—শাড়িটা দেখেছিস?

—বউমা এনেছে। দাম-টাম জিজ্ঞেস করিনি। দেখাল, একবার দেখলাম।

শীলা একটু হেসে বলে—তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওই শাড়ির কিন্তু অনেক দাম। বউদি কম দামি জিনিস আনেনি। গড়িয়াহাটায় সেদিন একটা দাম করেছিলাম, একশো কুড়ি টাকা চাইল।

মনটা হঠাৎ তখন ঠান্ডা হল ননীবালার। মেয়েটার মুখের দিকে চাইলেন, উঁচু পেটটা হাঁটুতে একটু চেপে বসেছে। মুখটায় শ্রীহীন কর্কশ ভাব, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে। ঠোঁট শুকনো। ননীবালা নিরীক্ষণ করে বললেন—তোর তো ছেলে হবে।

—বলছ?

—বলছি। ও আমরা বুঝতে পারি।

ভালমন্দে সাধের দিনটা কেটে যেতেই রাতে তিনি বীণাকে ডেকে বললেন—বউমা, রণেনটা বড় অস্থির।।

—শুনেছি। কেবল বাবার কথা বলছেন।

—কী করবে? ননীবালা জিজ্ঞেস করলেন।

—আমি তো যেতে পারব না, বাচ্চাদের ইস্কুল। বরং আপনি ওঁকে নিয়ে যান, বাবার কাছ থেকে ঘুরে আসুন। বেড়ানোও হবে। আর ওখানে এক ফকির সাহেব আছেন শুনেছি, ওষুধ দেন।

সেই ঠিক হল। তারপরই মায়ে-পোয়ে চলে এসেছেন।

এসে ফাঁকা ঘর দেখে বুকটা সেই থেকে হু-হু খরার বাতাসে জ্বলে যাচ্ছে যেন।

ঘরের কী শ্রী! মাচানের বিছানাটা দেখলেই তো কান্না পায়। গুটিয়ে রাখা তোশকটা ফালা ফালা হয়ে ছিঁড়ে তুলোর চাপড়া বেরিয়ে আছে। মশারিটা কয়েক জায়গায় সেফটিপিন আটকানো, ননীবালার চোখ ছল ছল করে।

রামভক্ত হনুমানের মতো জোড়হাতে সামনে দাড়িয়ে বহেরু কেবল—মাঠান, মাঠান, করে যাচ্ছে। তারদিকে বড় বড় চোখে চেয়ে ননীবালা একবার বললেন—বহেরু, তুই বড় পাপী। বামুন মানুষটাকে এইভাবে রেখেছিস!

বহুকাল পরে যেন ননীবালার বুকের মধ্যে মায়া-মমতা মাথা-তোলা দিল।

বহেরু মাটিতে বসে পড়ে দুর্বল গলায় বলে—ওনারে আমি রাখব! কি বলেন। কারও কড়ি ধারেন নাকি! বরং উনিই আমাদের রেখেছেন।

থাকবেন, না ফিরে যাবেন তাই নিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন ননীবালা। কিন্তু বুকের মধ্যে কু-পাখি ডাকছে। তাই দোনামোনা করে থেকে গেলেন। বহেরুর লোকজন সব ভেঙে এল সেবা-যত্ন করতে। ঘরদোর সাফ করা হল নতুন করে, একটু সাজানো হল। তার ফাঁকে কাকে বহেরু বলছিল—কাউবে ঘকে ঢুকতে দেন না। জিনিসপত্র কেউ ধরলে ভারী চটে যান।

ননীবালা শোনেন। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে অবোলা ভয় শ্বাসযন্ত্রকে চেপে ধরে—লোকটা বেঁচে আছে তো! ফিরবে তো!

এই করেই কেটেছে অসহ্য দিনটা। কাটতে কি চায়! মনে মনে কত মানত, কত ঠাকুরদেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন ননীবালা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *