যাও পাখি – ৪০

॥ চল্লিশ ॥

মাথায় ধপধপে সাদা পাগড়ি বাঁধা, ছোটখাটো কালো-কোলো, গোপাল-গোপাল চেহারার একটি বছর তেইশ-চব্বিশের ছোকরা সেদিন সকালে এ গাঁয়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। সঙ্গে পাঁচ-সাতজন লোক। সঙ্গীরা সব বয়সে বড়, কিন্তু হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল ওই ছোকরাই ওদের সর্দার, সঙ্গে সাপের ঝাঁপি।

রাতটা ভাল কাটেনি বহেরুর। গন্ধ বিশ্বেস এখনও বেঁচে আছে; আশি কি নব্বুই পার হয়ে গেল বুঝি। এই সব বয়সে সে মানুষ বড় জ্বালাতন করে। বোধ-বুদ্ধি সব জল হয়ে যায়। গন্ধ বিশ্বেস তার ওপর আবার চোখে দেখে না। দিনরাত লোকজনকে হাঁকডাক পাড়ে। সবচেয়ে বেশি জ্বালায় খাওয়া আর হাগা-মোতা নিয়ে। তার ওপর আছে মিথ্যে কথা। খেয়ে বলে খাইনি। বিছানায় হেগে-মুতে ফেললে বেড়াল কুকুরের ঘাড়ে দোষ চাপায়। নিপাট ভালমানুষের মতো এইসব করে। কাছেপিঠে ছেলেপুলেদের হাতে মোয়াটা নাড়ুটা আছে টের পেলে কেড়ে খেয়ে ফেলে। অশ্রাব্য গালাগাল দেয় আজকাল রেগে গেলে। ভয় পায় বহেরুকে।

বহেরু আজকাল কেমন চুপসে গেছে। এই গরমকালটায় উঠোনে কি দাওয়ায় তাড়ির ওপর এক ছিলিম গাঁজা চড়িয়ে গামছার ওপর পড়ে থাকত। বড়জোর একটা খাটিয়ায় একটু শক্ত একটা বালিশ। তাতেই খুব বড়মানুষি। খুবই অথৈ ঘুম তার। তবু একটু-আধটু শব্দ হলেই কুকুরের মতো উঠে বসে। নেশা-টেশা ঘুম-টুম কোথায় কেটে যায়। হাঁক ছেড়ে বৃন্দাবনকে ডাকে। বৃন্দাবন এক সময়ে দোস্তো-মানুষ ছিল বহেরুর। জাতে নমঃশূদ্র। এখন সে বহেরুকে মনিব বলে মানে। বহেরু গাঁ রাত-বিরেতে পাহারা দেয়। হাঁক ছাড়তেই দুটো চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই এসে যায় বৃন্দাবন। গহীন রাতে আর চাকর-মনিবের সম্পর্ক থাকে না বটে, তবু লাঠি-গাছটা আর লালটেম নামিয়ে রেখে একটু দূরে বসে সে। গাঁজা সাজে। প্রথমটায় বহেরু টানে, পরে বৃন্দাবন। বিষয়ী কথাবার্তা হয় দু-চারটে। বন্দাবন কম কথার মানুষ। এই রাতবিরেতেই যা তার পেট থেকে কিছু কথা বেরোয়। বহেরুর গোটা দুই খুনের সে জলজ্যান্ত সাক্ষী আছে। কিন্তু ‘রা’ কাড়ে না কখনও। এমনকী কখনও বহেরুর চোখে চোখও রাখে না। ওই এক ধারার মানুষ। বিশ্বাসী, কর্মঠ, কিন্তু একটু আবছামতো। দুনিয়ায় সে কী জন্য আছে, কী তার ভবিষ্যৎ, কার জন্য করছে কম্মাচ্ছে তা বোঝাই যায় না। মুখে টিকিট আঁটা আছে। সারাদিন তার দেখা পায় না বহেরু। শুধু এই রাতে দু-একবার। দু-একবারই ওঠে বহেরু। আবার ঘুমোয়। ভোরবেলা, আলো ফোটার অনেক আগে প্রথম জাগে খুড়োমশাইয়ের পবিত্র খোল। কালীপদর প্রভাতী শোনা যায়—জাইগতে হবে, উইঠতে হবে, লাইগতে হবে কাজে…। পেছুতে তিনটে লাথি কষাতে হয় জামাই শালার। কোনওকালে বহেরুর কোনও কম্মে লাগেনি। মাগ-ছেলের টানে পড়ে আছে। তিনটে লাথি ওর বহুকাল ধরে পাওনা হয়ে আছে, দিনক্ষণ দেখে একদিন সেই তিনটে ঝাড়বে বহেরু, বিদেয় করে দেবে বহেরু গাঁ থেকে। কালীপদর পর বা আগে ওঠেন ব্রজকর্তা। ততক্ষণে ভোরের জানান পড়ে যায়।

এইরকমই ছিল নিয়ম। কিন্তু বহেরুর ঘুমটাকে পেঁচোয় পেয়েছে আজকাল। তাড়ি-গাঁজার চাপান সত্ত্বেও পয়লা প্রহরটায় শেয়ালের হুড়ড়া শুনে কাটে। তারপর ঝিমুনি আসে। কিন্তু সে কতক্ষণ? হঠাৎ যেন বুকের মধ্যে ধড়াধ্বড় ধাক্কা খেয়ে উঠে বসে। চারদিকে কোনও রাতে জ্যোৎস্নার দুধ চলকে ভেসে যায়। কোনও রাতে বা শ্যামা মায়ের এলোকেশ। বহেরু সেই নিশুত রাতের মধ্যে জেগে উঠেই কেমন একা-বোকা বোধ করে। ভয় হয় হঠাৎ সব মরেটরে গেল নাকি! এত নিঝুম কেন চারদিক! নাকি আমিই মরে এলাম পরকালের রাজ্যে! হাঁক পাড়লে বৃন্দাবন আসে ঠিকই, গাঁজার চাপানও হয়। কিন্তু গা বড় ছমছম করে আজকাল, গুণীন এসে খুব কষে ঝাঁটাপেটা করে গেছে নয়নতারার ভূতকে। আজকাল নয়ন খুব নিঃসাড়ে পড়ে থাকে সারাদিন। কথাবার্তা কয় না, খেতে চায় না, উঠতে চায় না, চুল বাঁধে না। মেঘুর ভূত যদি ছেড়েও থাকে তবু অন্য কোন্‌ ভূত আবার চেপে বসেছে কে জানে! ছলছলে চোখে চেয়ে থাকে, কাঁদে মাঝে মাঝে। বিপদ বুঝে জামাইয়ের সন্ধানে একদিন গিয়েছিল বহেরু। আগের দিনে পেয়াদারা বাবু হত না কোনওদিন। আজকাল হয়। বিষড়ের এক কেমিক্যাল কোম্পানিতে লোকটা পিওন ছিল, এখন কেরানি। কী ভেবে সে শ্বশুরকে তুমি-তুমি করে বলতে লাগল। মেয়েকে ফিরে নেওয়ার কথা বলতেই খুব রাগ, বলে—ওকে ঠান্ডা করা আমার কর্ম নয় বাপু। তোমাদের ঘরের ধাত আলাদা। আমাদের সঙ্গে মেলে না।

সুমুন্দির পো। নিল না। ফিরে বিয়ে করেছে, নেওয়ার জো-ও নেই। তবু নয়নতারা যে কাঁদে তা বোধ হয় সেই লোকটার কথা ভেবেই। যৌবন বয়সে অনেক ছটফটানি ছিল। এখন সে সব মরে টান এসেছে বুঝি। রাতে ঘুম ভেঙে সেই কান্নার গোঙানি মাঝেমধ্যে শোনে বহেরু। দুঃখ বড় একটা হয় না, কেবল নিশুতরাতে ওই কান্না শুনে কেমন একটা ধন্ধভরা ভয় লাগে।

কদিন হল আর একা শোয় না সে। দোকা লাগে। কিন্তু দোকা পাওয়াই মুশকিল। বড় বড় ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে শোয়, বয়সের মানুষ, তার কথা ওঠে না। বিন্দুর মাও লজ্জা পায় বোধ হয়। রাজি হয় না। লোকলজ্জা বলে কথা আছে। ব্রজ বামুন থাকেন গাঁয়ে। বলবেন। কী! অগত্যা বড় ছেলে কপিল বাপের কাছে-পিঠে বিছানা ফেলে শোয়। এরা বাবু মানুষ। গদি ছাড়া ঘুম হয় না। তোষক বালিশ কত কী লাগে, বউ এসে মশারি গুঁজে দিয়ে যায়। তার ওপর রাতবিরেতে উঠে উঁকি মেরে দেখো, বাবু হাওয়া। কখন গিয়ে বউয়ের পাশবালিশ হয়ে পড়ে আছে। এখন এই দোকা পাওয়াটাই একটা সমস্যা। নিশুত রাতটা বড় নটখটে জিনিস। চাষার দুর্বল মাথায় কত আকাশ-পাতাল ঢুকিয়ে দেয়! হাঁক পাড়লে বৃন্দাবন আসে ঠিকই, কিন্তু সে তো ওই রকম বিটকেল মানুষ। রসকষ নেই। তা ছাড়া আপনজনা কেউ তো নয়। দূরের মানুষ দূর হয়ে বসে থাকে। বহেরুর বড় দোকা হতে ইচ্ছে করে আজকাল। মাঝলা ছেলে কোকাকে বললে সে এসে শোয়। কিন্তু বড় ভয় বহেরুর গায়ে খুনের রক্ত, বাপকেও ভাল চোখে দেখে না। টুঁটি টিপে ধরে যদি ঘুমের মধ্যে। যদি কৈফিয়ত চায়?

রাতে উঠে তাই আজকাল বহেরু ছমছম করা চারধারের মধ্যে বসে বসে ভাবে। কাল রাতেও ভাবছিল, দোকা ছাড়া পৃথিবীতে বাঁচা যায় না। এই যে এত জমি-জোত, ধান-পান, কার জন্য! দশভূতে খাচ্ছে। সে খাক, একা খাওয়ারও তো মানে হয় না, সে খাওয়ার আনন্দ নেই। কিন্তু কেবলই মনে হয়, একজন বুকের কাছের আপনজন হলে তার জন্য সব-কিছুর একটা আলাদা আনন্দ থাকত। কত ফিসফিসানো কথা জমে আছে বুকের মধ্যে! বলত। সে থাকলে এই রাতের ভয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারত। কিন্তু সে মনিষ্যিটা কে! মেয়েমানুষ কোনও? নাকি ছেলেপুলে? নাকি নাতিপুতি? কে? কার জন্য এত সব করেও কিছুই নেই বলে তিন প্রহর রাতে উঠে বসে থাকে বহেরু? বুকের ফাঁকা জায়গা থেকে শ্বাসবায়ু বেরিয়ে এলে মনে হয় ফের বুঝি বাতাস টানতে পারবে না। গেল দম ফুরিয়ে কলের পুতুলের। নয়নতারার ঘাড়ে ভর করে মেঘু যে শাপশাপান্ত করেছিল তা কি ফলে গেল নাকি! এত ফাঁকা ফাঁকা তো লাগত না কখনও!

পাঁচ রবিবারে এবারের বোশেখ মাস গেছে। ঝড়া কিংবা খরায় যাবে। ঝড়ার লক্ষণ নেই। খরায় ধরেছে বছরকে। সে সবও ভাবে বহেরু। জোত-জমি ধান-পান, গরু-ছাগল ছেলে-পুলে, বউ-নাতি। সব ভেবেও একটা জায়গায় এসে থেমে যায়। জীবনের একটু বৃত্তান্ত জানা হল না। কার জন্য? কে সেই আপনজনা!

কাল রাতে ঘুমটা এসেছিল সময়মতো। একটু আফিং দিয়েছিল বৃন্দাবন। সেইটে খাওয়াতে ঠিক যেমন চেনা লোক মজা করতে পিছন থেকে থেকে চোখ টিপে ধরে, বিন্দুর মায়ের সঙ্গে যখন দেওর-বউঠান সম্পর্ক ছিল তখন বিন্দুর মাও এসে ও-রকম ধরত পিছন থেকে, ঠিক তেমনি ঘুমটা এসে পিছন থেকে চোখ টিপে ধরল। মাইরি-ঘুম একেবারে। সেই সময়ে একঝাঁক শিয়াল চেঁচিয়ে উঠেছিল, আর সেই সঙ্গে গন্ধ বিশ্বেস। কোথাও কিছু না, ‘চোর, চোর বলে চেঁচাল খানিক। লাঠি ঠুকে ঠুকে কেসে বুকের গয়ের তুলে ফেলল ঘরের মেঝেয়। পেচ্ছাপের হাঁড়ি ওলটাল একটু বাদে। বেড়াল কুকুরদের শ্রাদ্ধ করতে লাগল। হাঁড়িটা যে বেড়ালে উলটিয়েছে সেটা প্রমাণ করার জন্যই বোধ হয় লাঠি দিয়ে ঘা-কতক বসাল ওদিকে। বেড়ালে, কুকুরে, গন্ধ বিশ্বেসে সে এক তুলকালাম কাণ্ড। বেড়ালরাই বা ছাড়বে কেন, কার লেজ মাড়িয়েছে, সেও ফ্যাঁস করে দিয়েছে আঁচড়ে, মাঝরাতে গন্ধর তখন হাপুস নয়নে কান্না। বহেরু তখন উঠে গিয়ে ইঞ্জিনের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গন্ধর ঘরের ঝাঁপের দড়ি খুলে ঢুকেছে। গন্ধ চোখে দেখে না বলে হারিকেনের রেওয়াজ নেই। অন্ধকারে মাটির ভিটেয় তরল পদার্থ গড়িয়ে পিছল, তার মধ্যে পা হড়কাল বহেরুর। দাঁতে দাঁত কড়মড় করে বহেরু গিয়ে গন্ধ বিশ্বেসকে টেনে তুলল মেঝে থেকে। বসাতে যাচ্ছিল ঘা কতক। প্রথম থাবড়াটা মেরেই খেয়াল গেল, আরে, এ লোকটাও যে একা! সারাদিন খাই-খাই করে, হাগে-মোতে, কাঁদে, যাই করে, সেও তো দোকা নয় বলেই। গন্ধ তখন ভয়ে কাঁপছে, আর ধরা গলায় বলে—আমি কিছু জানি না বাবা, আমি কিছু জানি না বাবা…

বুড়ো বয়সে বাপ ভাইয়ের তফাত গুলিয়ে ফেলেছে ভয়ে। গন্ধকে তাই মায়াবশে ছেড়ে দিল বহেরু। বেড়ালগুলোকে অন্ধকারেই সাঁত সাঁত করে কয়েকটা লাথি কষাল। বড় রাগ। চারধারে পৃথিবীটার ওপরেই বড় রাগ তখন বহেরুর। দুর্গন্ধের চোটে গন্ধর ঘরে টেকা যায় না, তবু অন্ধকারে খানিক দাঁড়াল বহেরু। গন্ধর বুড়ো হাতটা এসে তার হাত ধরল। নাকের জলে চোখের জলে ফঁত ফঁত শব্দ করতে করতে গন্ধ বলে—তুমি মা-বাপ বাবা, মেরো না গো। কাঁকালের হাড়টায় মটাং করে বড় লেগেছে।

বহেরু হাতটা ধরে বিছানায় তুলে দিল। বলল—ফের চেঁচাবে না। পড়ে থাকো মটকা মেরে।

তারপর বৃন্দাবনকে ডেকে গাঁজা টেনে আবার পড়ে থেকেছে বহেরু। ঘুম আসেনি। দাদার গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হল না। ভাবল। আবার ভাবে, ওই রকমভাবে সেও বেঁচে থাকবে নাকি! পাগল! বয়সে যখন ভাঁটি বুঝবে তখনই পোকামারা বিষ তাড়ির সঙ্গে গুলে খেয়ে রাখবে একদিন। ব্রহ্মময়ী, মরণটা যেন সুন্দর হয়।

কথাটা ছ্যাঁৎ করে নিজেকেই লাগে। মরণ! ও কথাটা এতকাল ভাবার ফুরসত হয়নি তো!

রাতটা ভাল গেল না। হিজিবিজি হয়ে কেটে গেল। সকাল ইস্তক দাওয়া গরম করে উঠে পড়া বহেরু। সাঁওতালটা কদিন ধরে শ্বাস টেনে যাচ্ছে। মরেনি। কমাস ধরেই পড়ে আছে। যাই-যাচ্ছি করে এখনও ঠেকিয়ে রেখেছে অন্তিমকাল। সময় মাপা আছে, সেটা ফুরনোর ওয়াস্তা। ইচ্ছে করলেই তো মরা যায় না। তার ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বহেরু। বিড়-বিড় করে বলে—বেঁচে থাকো বাপু, টিঁকে থাকো। একটা বেঁটে বক্কেশ্বরকে আনাচ্ছি, দুজনে মিলে বাহার হয়ে ঘুরবে।

আলো ফুটতে না ফুটতেই ছোকরাটাকে দেখা গেল, বহেরুর খামারবাড়ির আশে-পাশে ঘুরঘুর করছে। ঝোপঝাড়ে উঁকিঝুঁকি মারছে, গোয়ালঘরের পেছুতে গিয়ে কি খুঁজছে। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ছুটে গেছে, কাচ্চা বাচ্চারাও মুখের এড়ানি, চোখের পিঁচুটি ধোয়ার সময় পায়নি, মজা দেখে জুটে গেছে।

গোয়ালঘরের সামনেটায় এসে দাঁড়িয়েছিল বহেরু, লোকটা সে সময়ে এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে একটু সম্মান দেখাল। বলল—এ হচ্ছে নাগভিটে। বাস্তু আমরা ধরি না। অন্য সাপ থাকলে ধরব?

বহেরু লোকটার দিকে চেয়েই বুঝতে পারে, গুণি লোক। তার চোখ চকচক করে। বলে—ধরো। দেখি।

এক গ্লাস জল আর একটা তুলসিপাতা চেয়ে নিল লোকটা। পোঁটলা থেকে একটা এতটুকুন মা কামরূপ কামাখ্যার ছবি বের করে ধরল গ্লাসটার ওপর। রেলগাড়ির মতো মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। স্যাঙাতরা সব ঘিরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ কামাখ্যার ছবির দর্পণে কী দেখে চেঁচিয়ে বলল—গোয়ালের পিছনে, খড়ের গাদায়। যাঃ।

স্যাঙাতদের হাতে একটা শুকনো শিকড়। তারই টুকরো-টাকরা ভেঙে গোয়াল ঘরের চারধারে ছিটোতে থাকে। ছানাপোনারা ভিড় করে সঙ্গে সঙ্গে এগোয়। বহেরু হাঁক ছাড়ে— তফাত যা।

ওদের কজনা গোয়ালের ভিতরে ঢুকে যায়। একজন গোয়ালঘরের পিছন দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। ভিতরে খড়ের গাদায় একটা সর-সর শব্দ ওঠে, ফোঁসানি শোনা যায়। গায়ে কাঁটা দেয় বহেরুর। আজকাল বড় একটা ভয়-ভয় ভাব ধরেছে তাকে। গোয়ালে খড়ের গাদায় সাপখোপ, বিছে তো থাকবেই। জানা কথা। না ঘাঁটালে ওরা ওদের মতো থাকে। তবু এখন কেমন ভয় খায় সে। নিত্যি তিরিশ দিন দোবেলা গোয়াল ঘাঁটে সে, যদি কোনওদিন দিত। ঠুকে! ভাবতেই গা হিম।

পিছনের বেড়ায় একটা টিন আলগা লাগানো। বাইরে দাঁড়ানো লোকটা সটান সেই টিনটা টেনে খুলে ফেলল মড়াত করে। সাঁত করে হাত ঢুকিয়ে দিল ফোকর দিয়ে। একটা হ্যাঁচকা টানে হাতটা বের করে আনতেই সবাই দেখে, মাঝারি লম্বা একটা গোখরো। লেজের দিকটা ধরে আছে, মাথাটা শূন্যে ঝুলছে, একটু একটু তোলার চেষ্টা করছে মাত্র। ঝাঁপি নিয়ে একজন এগিয়ে আসে। পাগড়ি বাঁধা লোকটা সাপের গায়ে মন্ত্র পড়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সাপটা ঝাঁপিতে পড়ে থাকে।

বহেরুর গা কাঁটা দেয়। মাগো! সাক্ষাৎ যমদূত।

আবার তুলসিপাতা আর জলের ওপর কামরূপ কামাখ্যার ছবি রেখে লোকটা কি যেন দেখতে পায়। দক্ষিণের কলাবাগানের দিকে হাত তুলে বলে—এই মোটা, মস্ত একটা ওখানে রয়েছে। কতগুলো ডাঁড়াশ সাপ আছে, আশে-পাশে, তাড়িয়ে দিস। বড়টাকে ধরবি।

লোকগুলো ঠিক জায়গায় চলে যায়। ঘিরে ধরে শিকড় ছিটিয়ে ছিটিয়ে এগোতে থাকে। বহেরু দেখে, ঠিকই কতগুলো ডাঁড়াশ সাপ পালাচ্ছে। তারপরই ফোঁসানি শোনা যায়। মাটি ফুঁড়ে মাথা তোলা দেয় এক গোক্ষুরো। মা গো! কী তার চেহারা। তেল-পিছল গায়ে বাদামি আলো ঠিকরোচ্ছে। ধাঁই করে বেরিয়ে পালাচ্ছে, বেঁটে মতো কালো একটা লোক লেজটা নিচু হয়ে ধরে তুলে ফেলল। হাত উঁচু করে ধরেছে, তবু মাথাটা মাটি ছুঁই-ছুঁই। বাচ্চাগুলো, মানুষজন সব ঘিরে ধরেছে লোকটাকে। বড্ড কাছাকাছি চলে গেছে। বহেরু হাঁক ছেড়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়—তফাত যা, তফাত যা।

পাগড়ি মাথায় ওস্তাদ ছেলেটা হেসে বলে ভয় নাই, ভয় নাই বাবু, আমি তো আছি। সুনীল নাগা জুহুরি আজ্ঞে, সাতপুরুষের পেশা।

বহেরু ধাতস্থ হয়ে তাকে ডেকে দাওয়ায় বসাল। বিড়ি দিলে লোকটা হাত তুলে বলল— এখন নয়।

—সাপ খেলাও নাকি? বহেরু জিজ্ঞেস করে।

লোকটা মাথা নেড়ে বলে—না। চাষবাস, আছে। এ পৈতৃক পেশা। বছরে এক-দুবার বেরোই। আসাম পর্যন্ত চলে যাই আমরা সাপ ধরতে। খেলাই না।

—ধরে করো কী?

—বেচে দিই। সরকার কেনে। এক ভরি বিষ তিনশো আশি টাকা। যোলোটা সাপে এক ভরি হয়।

লোকটার বয়স ভারী কম বলে মনে হয়। গোঁফদাড়ি এখনও ওঠেনি তেমন। লাউয়ের গায়ের রোঁয়ার মতো নরম কিছু রোঁয়া উঠেছে গালে। গোঁফের কাছে আবছা রেখা দেখা যায়। সেখানে ঘাম জমেছে। মুখের ডৌলটুকু বড় মিঠে। বহেরু তার কাছ ঘেঁষে বসে, বলে—বাড়ি কোথা?

—বহরমপুর। এই বলে লোকটা উঠে যায়। তার স্যাঙাতরা চারধারে ঘুরছে। এখান-সেখান থেকে মাটি খুঁটে হাতে নিয়ে শুঁকছে। সতর্ক চোখ।

বহেরু উঠে গিয়ে নাগা জহুরির সঙ্গ ধরল, বলল—শোঁকো কী?

নাগা জহুরির মুখে হাজির হাসি। বলে—এ হচ্ছে নাগভিটে। বাস্তু সাপ-টাপ থাকতে পারে। তাই দেখছে সব।

—শুঁকে কী বোঝে সব?

—বাস্তু সাপ যেখানে থাকে সেখানকার মাটিতে সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়। যে সে অবশ্য বোঝে না। গুণিন ঠিক পায়। আর এমনি বিষের সাপ যেখানে থাকে সেখানে পচাটে গন্ধ।

—বাস্তু সাপ আছে নাকি? দেখিনি তো কখনও।

নাগা জহুরি মাথা নাড়ল। একটু বিমর্ষভাব দেখিয়ে বলল—ছিল। বড় পবিত্র প্রাণী। একটা জোড়া ছিল। কখনও এঁটো জলটল কিছু ছিটে লেগেছিল বোধ হয়, তাই জোড়া ভেঙে চলে গেছে।

বহেরু চেয়ে থাকে। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলে—কবে গেল?

তুলসির জলের ওপর কামাখ্যার কালীর ছবি ধরে থেকে নাগা জহুরি বলে— বছরখানেক হবে।

—গেলে হয়টা কী?

—সংসারে নানা অশান্তি লাগে।

বহেরু নীরবে মাথা নাড়ল। বুঝেছে। একটা শ্বাস ফেলে বলল—তোমরা সব দুপুরে এখানেই খেওখন। বুঝলে! এখন চা খাও।

বলে বিন্দুকে ডাকাডাকি করতে থাকে বহেরু। হেলেদুলে বিন্দু আসে, মুখে একটু হাসির আভা ছড়ানো! টস্‌ টস্ করছে লোভি ঠোঁট। একটা চোখ হানল নাগা জহুরিকে। বহেরু একবার চোর-চোখে দেখে নিল, নাগা জহুরির কলজেটা কেমন। দেখল, খুব মজবুত নয়। বাচ্চা ছেলে, রোঁয়া ওঠেনি। একটু ভ্যাবলা বনে গেছে মেয়েটাকে দেখে। বহেরু এসব খুব উপভোগ করে। মেয়েটা তারই ঔরসের। তেজি আছে। বহেরু অন্যদিকে চেয়ে বলে—চা করে নিয়ে আয়।

বিন্দু মাথা নেড়ে চলে গেল। সেই দিক পানে চেয়ে আছে নাগা জহুরি। বহেরু সুযোগটা ছাড়ল না। বলল—এখানে থাকবে নাকি?

নাগা জহুরি মুখ ফিরিয়ে বলে—থাকবে মানে?

—জমিটমি দেব। ঘর করে দেব। বলে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে—বিয়েশাদিও করতে পারো, এখানেই। বলে আবছা ইঙ্গিতটা হজম করতে দিল জহুরিকে। বিড়ি ধরিয়ে মিটমিট করে চেয়ে চেয়ে দেখছিল জহুরির মুখে কেমন ভাব খেলা করে।

তা অনেক ভাব খেলল। বিন্দু হারামজাদি জানে বটে রঙ্গরস। একেবারে কাম্‌নী ডোম। বহেরুর মনটা হে-হে করে হাসছিল। পাণ্ডুয়ার বামনবীরটা আসতে চাইছে না। চিড়িয়াখানাটা জমছে না তেমন। সাঁওতালটাও টেঁসে যাবেই। এ লোকটা যদি থাকতে রাজি হয় তো বেশ হবে। কিন্তু বেশি ঝোলাঝুলি করলে টানের সুতো ছিঁড়ে যায়। তাই প্রস্তাবটা দিয়েই বহেরু কিছুক্ষণ পরে অন্য কথা পাড়ে। লোকটা বাঁ হাতের তেলোয় এক ডেলা শিকড়। সেটা দেখিয়ে বলে—ওটা কী বস্তু?

জহুরি অদূরে উবু হয়ে বসে পড়ে। পরনের ফেরত দেওয়া কাপড়ের কোনাটা তুলে মুখ মুছে নেয়। বলে—এ হচ্ছে বিদ্যাসুন্দর গাছের শিকড়। দুর্লভ বস্তু কিছু নয়। জঙ্গল-পঙ্গলে একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়।

—দেখি। বলে হাত বাড়াল বহেরু।

লোকটা নির্দ্বিধায় দিয়ে দিল, বলল—শুঁকে দেখুন।

দেখল বহেরু। ভারী মিষ্টি ধূপের গন্ধের মতো মৃদু গন্ধ।

জহুরি বলে বেশ গন্ধটা না। কিন্তু সাপ ও গন্ধ সইতে পারে না। গন্ধ পেলেই গর্ত থেকে বেরিয়ে পালায়। তখন আমরা ধরি।

—তা হলে এ জিনিস সঙ্গে থাকলে সাপে ঠুকবে না বলো।

জহুরি মাথা নেড়ে বলে—তার ঠিক নেই। কথায় বলে সাপের লেখা বাঘের দেখা। শিকড় ছিটোলে পালায় জানি। তা বলে সঙ্গে রাখলে কামড়াবে না তা নয়। তবে ও বস্তুর আরও গুণ আছে। গায়ে রাখলে বাত, অম্বল আর হাঁপানির বড় উপকার।

বহেরু একটা শ্বাস ফেলে বলে—এ দিয়ে কী হবে! তুমি থাকলে বরং বল ভরসার কথা।

লোকটা উত্তর দিল না। চেয়ে রইল।

সারাদিন কেরামতি দেখাল অনেক। বুড়ো আঙুলের নখে কখনও সিঁদুর কখনও কালি লাগিয়ে নখদর্পণ দেখাল। ফণা তোলা দাঁতাল সাপের মুখের কাছে মুঠো করে হাত এগিয়ে দিয়ে দেখাল সাপটি কেমন মিইয়ে যায়। একটা পয়সাও নিল না। তার স্যাঙাতরা অবশ্য গোটা কুড়ি সাপ ধরে নিয়ে গেল। এইটুকু জায়গায় এত সাপ ছিল কে জানত!

ব্রজগোপাল সবটাই লক্ষ করেছেন। রাতের বেলা বসে সাপ ধরার বৃত্তান্তটা লিখে রাখছিলেন ডায়েরিতে। লিখতে লিখতে একটা শ্বাস পড়ল। কার জন্য লিখছেন? কাকে দিয়ে যাবেন এইসব কুড়িয়ে পাওয়া মণিমুক্তা? ছেলেরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করে। এ সব দেখলে হাসবে।

এ সময়ে বহেরু এসে বসল পায়ের কাছে মাটিতে। মুখখানা তুলে দুঃখের স্বরে বলে—জহুরি চলে গেল কর্তা। রাখা গেল না।

ব্রজগোপাল বললেন—হুঁ।

—রাখতে পারলে হত। বুকটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

ফের ব্রজগোপাল বলেন—হুঁ।

বহেরু বুক কাঁপিয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—মানুষজন সব যেন দূরে দূরে হেঁটে চলে যাচ্ছে বহেরু গাঁ থেকে। কবে আসবে সব! কাতারে কাতারে!

॥ একচল্লিশ ॥

আকাশে ছমছম করছে মেঘ। গম্ভীর মেঘধ্বনি। ঘন কালো ছায়ায় দুপুরেই ডুবে গেল কলকাতা। যেন বা প্রলয় হবে। ঠান্ডা একটা বাতাস এল, তাতে ভেজা মাটির গন্ধ।

রাস্তা পার হবে বলে রণেন দাঁড়িয়েছিল ফুটপাথে। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সরু ফুটপাথ, দাঁড়ানোর পক্ষে সুবিধের নয়। ক্রমান্বয়ে চলমান মানুষ গা ঘেঁষে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় গায়ে গায়ে গাড়ি, ট্রাম, ঠেলা সব দাঁড়িয়ে। জ্যাম। চিনেদের জুতোর দোকান থেকে চামড়ার কটু গন্ধ আসছে। একঝলক হাওয়া রাস্তার ধুলো কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারল মুখেচোখে। জীবাণুতে ভরতি কলকাতার বিষাক্ত ধুলো।

রণেন আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখল। বাড়ির চূড়ায় চূড়ায় বিঁধে আছে সরু একফালি আকাশ। কিংবা আকাশের গলি। তার মধ্যে মুশ্‌কো কালো শরীর বাড়িয়ে দিয়েছে প্রলয়ংকর মেঘখানা। রণেন ঘাম মুছল রুমানে। হাতের ভারী ব্যাগটা হাত বদল করল একবার। শরীরটা ভাল নেই। মেঘ করলে মাথার মধ্যে কেমন যেন করে।

নীল একটা ঝলক চাবুকের মতো খেলে গেল চারধারে। তারপরই কানের কাছ বরাবর সর্বনাশের শব্দ হয়। রণেনের বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে হৃৎযন্ত্র নড়ে ওঠে। শরীর অবশ লাগে। ঘাম হয়। প্রেসারটা বেড়েছে। কদিন আগে ডাক্তার ডেকেছিল বীণা। ডাক্তার প্রেসার দেখল, বুক দেখল, পেচ্ছাব পরীক্ষা করাল। কটা দিন বাড়িতে আটকে রেখেছিল বীণা। সে এক অসহ্য যন্ত্রণা। ঘরের মধ্যে আজকাল রণেন থাকতেই পারে না। রাতে যখন সদরদরজা বন্ধ হয়, তখনই রণেন ভারী ভয় পেয়ে যায়। কেবলই মনে হয়, রাতে ঘুমোলে যদি ভূমিকম্প হয় কি, আগুন লাগে, তা হলে বেরোবো কি করে তাড়াতাড়ি? বীণা যখন শোয়ার ঘরের দরজা দেয় রাত্তিরে, তখনও একটা বোবা ভয় তাকে ভালুকের মতো এসে ধরে। ঘরের ভিতর থেকে যেন বা সে আর কোনওদিন বেরোতে পারবে না। ভিতরকার চৌখুপির বাতাস বড় কম। বুক ভরে কবার দম নিলেই তা ফুরিয়ে যায়। তারপর আসবে দমবন্ধ করা এক অস্বস্তি, শ্বাসকষ্ট। মৃত্যু? হ্যাঁ। তাই।

সে ককিয়ে উঠে বলে—দরজা খুলে দাও।

বীণা দাঁতে ঠোঁট চেপে বলে—কেন?

—আমার অস্থির লাগে। দরজা জানালা সব খুলে দাও।

বীণার একটু ঠান্ডার বাই আছে। এই ঘোর গ্রীষ্মেও নাকি শেষ রাত্রে হিম পড়ে। বাচ্চাদের ঠান্ডা লাগে যদি! বীণার নিজেরও ইসিনোফেলিয়া শতকরা নয়। ভাগ। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস। বীণা দরজা খুলে দেয়, কিন্তু জানালা সব খুলতে রাজি হয় না। কেবল ড্রেসিং টেবিলের ধারের জানালার একটা পাট খুলে রাখে। বিছানার ধারের জানালা খোলে না। ঘরে সবজে একটা ঘুম-আলো জ্বলে। সেই ঘোর সবুজ রঙের মধ্যে শুয়ে থেকে রণেন সেই এক-পাট খোলা জানালার দিকে চেয়ে থাকে। ওই একটু এক চিলতে ফাঁক—ওইটুকু যেন তার প্রাণ, তার পরমায়ু, তার শ্বাসের বাতাস। রাতে ঘুম হয় না। প্রেসারের বড়ি আর ট্রাংকুলাইজার খায়। তাতে হয়তো প্রেসার কমে, টেনশনও কমতে পারে। কিন্তু শরীরটা বড় দুর্বল লাগে। সারাদিন অবসাদ। মা এসে বুকে হাত বুলিয়ে দেয়, মাথার তালুতে তেল চাপড়ে দেয়। দিতে দিতে চোখের জল ফেলে বলে— আজকাল কচিবয়সেই এ-সব তোদের কী রোগ হয় রে?

কচি বয়স? মায়ের কাছে অবশ্য ছেলের বয়স বাড়ে না। কিন্তু বয়স কথাটা আজকাল বড় ধাক্কা দেয় রণেনকে। তার বোধ হয় আটত্রিশ পেরিয়ে উনচল্লিশ চলছে। আর একটা বছর ত্রিশের কোঠায়। তারপরই চল্লিশ। মধ্যবয়স, প্রৌঢ়ত্ব। সে ধাপটা পেরোলেই বুড়ো। বড় সাংঘাতিক। বয়স যত ঘনায় তত একে একে প্রিয়জন খসে পড়তে থাকে। বাবা যাবে, মা যাবে, বয়স্করা যাবে। একদিন তারও যাওয়ার সময় এসে পড়বে।

কেমন হবে সেই দিনটা? মেঘলা? নাকি রৌদ্রোজ্জ্বল? শীত? না কি গ্রীষ্ণকাল? বর্ষা হবে না তো! দিন, না রাত্রি? ভাবতে ভাবতে বিছানায় উঠে বসে রণেন। খুব কাছে কে যেন বলে ওঠে—সব মরে যাবে। চমকে ওঠে রণেন। কে বলল ও কথা? পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে যে, সে নিজেই বলেছে। তার ঠোঁট নড়ে উঠল এইমাত্র। আবার বলল—উঃ, মা গো!

নিজের ঠোঁটে হাত রাখে রণেন। সে এই একা-একা কথা বলাকে বড় ভয় পায়। সন্দেহ করে। কিন্তু ঠেকাতেও পারে না। আজকাল মাঝে মাঝে সে টের পায়, তার ঠোঁট নড়ে, জিব নড়ে, কথা উঠে আসে বুক থেকে। আপনিই চমকে ওঠে রণেন। ঠোঁট চাপা দেয়, নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। আর তখনই আবার বলে ওঠে—ক্যাডাভ্যারাস, ক্যাডাভ্যারাস, ইউ…ইউ…ইউ…

কথাগুলোর অর্থ কী! তবু বুক থেকে, মাথা থেকে ওইরকম সব অর্থহীন শব্দ উঠে আসছে আজকাল। কী হয়েছে তার? খুব শক্ত অসুখ? ঘোর সবুজ আবছা আলোয় সে আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাঙচার। হাসে। ওই মৃদু আলোতেও বুঝতে পারে, তার চোখে না ঘুমোনোর ক্লান্তি। একটু ঝুঁকে গেছে মোটা শরীর। ঘুম ভেঙে কখনও বীণা উঠে ধমক দেয়—কি হচ্ছে কি পাগলামি? বিছানায় এস। ঘুমোও।

রণেন বিছানায় যায়। শুয়ে থাকে। ঘুমোয় না। বিড়বিড় করে বলেচছক্যাডাভ্যারাস, ক্যাডাভ্যারাস, ইউ..ইউ…ইউ…

কদিন ঘরবন্দি রেখেছিল বীণা আর মা। এখন আবার বেরোয় রণেন। জোর করেই বেরোয়। শরীর খারাপ বলে আজকাল আর তাকে বাইরে ঘুরতে হয় না। অফিসেরই একটা সেকশনে বসে থাকে চুপচাপ। কিন্তু অফিসের লোকজন আজকাল তাকে বড় বেশি লক্ষ্য করে। হঠাৎ হঠাৎ কথা বলে ওঠে রণেন। সবাই তার দিকে ফিরে তাকায়। এও এক জ্বালাতন। তাই আবার আজকাল বাইরে বেরোয় সে। শরীর খারাপ লাগলেও মনটা একরকম থাকে।

একদিন অফিসে ঘোষের কাছে গিয়ে হাক্লান্ত রণেন বলেছিল—ঘোষদা, একটা কথা বলতে পারেন?

ঘোষ অফিসের ফাইল আজকাল প্রায় ছোঁয় না। ডিসেম্বরে রিটায়ারমেন্ট, কাজ করে হবে কী? বসে বসে পুরনো টেস্ট পেপার থেকে খুঁজে পেতে অঙ্ক কষছিল অফিসের কাগজে। অঙ্কটা কষতে কষতেই বলল কী?

—মানুষ মরার পর কি হয় বলুন তো, আত্মা-টাত্মা বলে কিছু আছে নাকি সত্যিই?

ঘোষ চোখ তুলে তাকে একবার দেখে নিয়ে মিচকে হাসে। বলে—বাঃ। বেড়ে প্রশ্ন। আজকাল এ-সব নিয়ে কেউ ভাবে নাকি আপনার বয়সে?

ঘোষ জানে অনেক। ভারী স্থির বুদ্ধি। তবে কথাবার্তায় সবসময়ে একটু বাঁকাভাব থাকে।

রণেন বলেছিল—বলুন না ঘোষদা।

ঘোষ কাগজপত্র সরিয়ে রেখে চেয়ারে পা তুলে বসল, বলল—মশাই, আপনি যে আছেন, এটা কি সত্যি?

রণেন মাথা নাড়ে—সে তো আছিই।

ঘোষ তখন মৃদু হেসে বলে—আপনার থাকাটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে আপনি যে ছিলেন, এও সত্যি। আর, আপনি যে থাকবেন, তাও সত্যি। এটা লজিক্যালি প্রুভড। আপনি ছিলেন না, আপনি থাকবেন না, অথচ আপনি আছেন—তা হয় কী করে? যুক্তিতে আসে না। সুতরাং জন্মের আগেও আপনি ছিলেন, মৃত্যুর পরেও আপনি থাকবেন। এটা থিয়োরেটিক্যালি প্রমাণ করা যায়।

রণেন কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে বলে—কিন্তু কীভাবে থাকব, কীভাবে ছিলাম।

ঘোষ অন্যমনস্ক ও গম্ভীরভাবে বলে—বলা মুশকিল। তবে শুনেছি, অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ আত্মা একটা ভাবভূমিতে অবস্থান করে। তার অঙ্গও থাকে, বোধও থাকে তবে সে মর্ত্যের মতো নয়। অন্যরকম।

রণেন একটু কেঁপে উঠে বলেছিল—সে জায়গা কেমন?

ঘোষ একটু হেসে বলে—কী করে বলি? না মরলে তো জানতে পারা যাবে না। তবে শুনেছি, সেখানে আলো-অন্ধকার নেই, শীত-গ্রীষ্ম নেই।

তবে সে কি অনন্ত গোধূলির দেশ? চিরবসন্ত? ঠিক বিশ্বাস হয় না, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পরমুহূর্তেই ঘোষের দিকে চেয়ে থেকে তার আবার সেই একাকীত্বের কথা মনে পড়ে। লোকটার বউ নেই, ছেলেরা আত্মসর্বস্ব। এ লোকটা চাকরি শেষ হওয়ার পর একদম একা হয়ে যাবে। প্রাণের কথা বলা মানুষ না থাকলে মানুষ বড় কষ্ট পায়। তার গভীর মনের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীটার কোনও সম্পর্ক থাকে না। ঘোষের দিকে চেয়ে তাই একরকম ভয় পায় রণেন। বলে—ঘোষদা, রিটায়ার করে কী করবেন?

ঘোষ প্রশ্ন শুনে হাসল। চেয়ার থেকে ঠ্যাং নামিয়ে ঝুঁকে অঙ্ক কষার কাগজপত্র টেনে নিল আবার। বলল—বসে থাকব, যতদিন না মরি।

কথাটা বড় ন্যাংটো, কড় কঠিন সত্য। বসে থাকব, যতদিন না মরি। রণেন বড় অস্থির বোধ করেছিল। উঠে আসছিল, ঘোষ পিছন থেকে ডেকে বলল—ব্রজদা আছেন কেমন?

—ক্ষেত খামার নিয়ে থাকেন! ভালই আছেন।

ঘোষ বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। হঠাৎ বলল—মাঝেমধ্যে শ্মশানে গিয়ে বসে থাকবেন। দেখবেন তাতে মৃত্যু সম্পর্কে জড়তা কেটে যায়। আমি এখনও সময় পেলে নিমতলার গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে থাকি। সন্ধেবেলাটায় বেশ লাগে।

তাও গিয়েছিল রণেন। কেওড়াতলাটা কাছে হয়। দুপুর-দুপুর একদিন চলে গেল। দেয়ালঘেরা বদ্ধ জায়গা, রোদের তাপ, চিতার আগুন, সব মিলিয়ে বীভৎস গরম। ছাই, ধোঁয়া চারদিক অন্ধকার করে রেখেছে। পোড়া ঘিয়ের কটু গন্ধ। মানুষের পোড়া-আধপোড়া-না পোড়া শরীর চারধারে। মাথার মধ্যে একটা ভয়-ভাবনা ঘুলিয়ে উঠল। একধারে একটা টিনের টুকরো চাপা গাদির মড়া পড়ে আছে। টিনের তলা থেকে সিঁটোনো দুজোড়া সাদা পা বেরিয়ে আছে। ঠিক তার পাশেই সাদা পাকানো গোঁফঅলা একটা পশ্চিমা লোকের মাথা। সবগুলো রাতে এত চিতায় দাহ হবে। রণেন পালিয়ে এল। সে-রাতে জেগে থেকে অনেক রকম শব্দ করেছিল সে। মনে হচ্ছিল, ওরকম আগুনে পুড়ে যেতে সে কোনওদিন পারবে না।

রাতের বেলাটা একা ভয় করে জেগে থাকতে। কিন্তু সঙ্গে জেগে থাকার কেউ তো নেই। বীণা মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে উঠে ধমক দেয়, শুয়ে পড়তে বলে। কখনও-কখনও একটু আদরও করে কাছে ডেকে। তারপরই বীণার কাজ ফুরোয়। পুরনো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর কিই বা কথাবার্তা থাকবে। রণেন জানে, তার কেউ নেই।

রাস্তাটা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে রণেন। পার হতে পারছে না। দুদিকের দুমুখো গাড়ির আঁটো জ্যাম। আকাশে মুখ তুলে দেখে, বৃষ্টি এল বলে। কালো মেঘ নিচু হয়ে ঢলে যাচ্ছে রেলগাড়ির মতো। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। খড়কুটো, ধুলোবালি উড়ে ঝাপটা মারছে। ফুটপাথের দোকানিরা দ্রুত মালপত্র তুলে নিচ্ছে। কলকাতার ড্রাইভারদের মনুষত্ববোধ কিছু কম। রাস্তা ফাঁকা পেলে মানুষজন মানে না। রণেন রাস্তা পার হওয়ার সময়ে যদি সামনের গাড়ি দুহাত এগোয় তবে পিছনের গাড়িও হয়তো রণেনকে উপেক্ষা করে দুহাত এগোবে। ড্রাইভারদের ঠিক বিশ্বাস করে না রণেন। এমনিতে তারা হয়তো তোক সবাই খারাপ না। কিন্তু কলকাতার জ্যাম, লক্ষ গাড়ি আর কোটি মানুষের ভিড়ে ভরা সরু অকল্পনীয় রাস্তা, পদে পদে থেমে থাকা—এসব থেকে মানুষ খ্যাপাটে হয়ে যায়—আসে রাগ বিরক্তি, অধৈর্য ক্লান্তি। তখন আর স্বত্ব স্বত্ত্ব জ্ঞান থাকে না। শুধু ড্রাইভার কেন, কলকাতার সব মানুষই কি তাই নয়? বিরক্ত, রাগী, উদাসীন ও নিষ্ঠুর। রণেনের চারদিকটা তাই ভয়ে ভরা।

রাস্তা পার হতে না পেরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রণেন। মেঘ ডাকছে সিংহের মতো। জোর বাড়ছে হাওয়ার। টপাস করে একটা ফোঁটা এসে ফাটল রণেনের ডান গালে। কী ঠান্ডা ফোঁটা! রণেন ব্যাগটা হাতবদল করে নিয়ে ফুটপাথ ধরে আস্তে আস্তে হাঁটে। যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত রাস্তা আটকে সারা সার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ রাস্তাটা পার হওয়া দরকার।

পান খাওয়া ডাক্তার বারণ করে গেছে। রণেন তবু খায়। কালাপাতি, পিলাপাতি আর মোহিনী দেওয়া কড়া পান। প্রথম প্রথম মুখ জ্বলে যেত, গলায় ধক্ লেগে মাথা ঘুরত। আজকাল সয়ে গেছে। সকাল থেকে আজ পান খায়নি। চড়বড় করে বৃষ্টির ফোঁটা হেঁটে যাচ্ছে চারধারে। এখনও মুষলধারে নামেনি। কিন্তু প্যারেডের সৈন্যর মতো তারা এগিয়ে আসছে। আরও কবার নীল চাবুক ঝলসে গেল চারধারে। মেঘলা আর বৃষ্টির দিনে রণেনের মাথা বড় ভার হয়। বুকের ভিতরটা অন্ধকার লাগে।

পানের দোকানের অল্প একটু ছাউনির ভিতরে মাথাটা গুঁজে রণেন দেখল, বিশুষ্ক সব দেয়ালে বৃষ্টির প্রথম কয়েকটি ফোঁটা অনেকগুলো তেরচা দাগ টেনেছে। ভেজা দেয়ালের চুণ-চুণ একরকম গন্ধ। পানের প্রথম ঢোঁকটা গিলে ফেলল রণেন। কড়া জর্দার পান। মাথাটা একবার পাক খেল। সামলে গেল। পিক ফেলে দিয়ে গলাটা ঝাড়ল একটু। প্রেসারটা বেড়েছে, রক্তে চিনি আছে, হার্টও ভাল না। কী হবে? মাথাটা নাড়ল রণেন। বলল-দূর ফোসকা পড়বে। বলেই চমকে উঠল। এখনও সে চিতার আগুনের কথা ভাবছে।

থেমে থাকা ট্রাম থেকে অধৈর্য কয়েকজন মানুষ নেমে পড়ল। তাদের মধ্যে একটি কিশোরী মেয়ে। কিশোরী? না, ঠিক কিশোরী নয়, তবে রোগা বলে ওইরকম দেখাল বোধ হয়। বাঁ হাতে খাতা উঁচু করে মুখ আড়াল দিয়ে নামল। সামনেই বাটার রিডাকশান সেল-এর দোকান। এক দৌড়ে উঠে গেল দোকানে, যেখানে মাথা বাঁচাতে ইতিমধ্যে জড়ো হয়েছে কিছু লোক।

হেঁটে আসছে বৃষ্টি। দেয়ালে দ্রুত ফোঁটার দাগ মিলিয়ে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে ময়লা দেয়াল। বিবর্ণতা। পানের দোকান থেকে রণেন সরে আসে। বাটার দোকানে উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টি দেখে। কী গভীর বৃষ্টিপাত!

মেয়েটা হাতের খাতা বুকে চেপে দাঁড়িয়ে আছে। খুব দূরে নয়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লম্বা, রোগাটে চেহারা। কিন্তু চামড়ায় কচি বয়সের চিকণতা। বয়সের দাগধরা, ছোপধরা নয়। মুখখানায় বয়সের অহংকার। পাতলা নাক, একটু মোটা ঠোঁট, দুখানা চোখ চঞ্চল, মাথায় তেলহীন নরম চুল, তাতে এখনও কয়েক ফোঁটা জল লেগে আছে। ডানধারে ঠোঁটের ওপরে একটা আঁচিল। ফরসা মুখে আঁচিল পাগল করে দেয় না, যদি জায়গা মতো হয়?

রণেনের দোষ সে যখন কোনও মেয়েকে দেখে তখন আর বাহ্যজ্ঞান থাকে না, ভদ্রতাবোধ লোপ পায়। তাই চেয়ে ছিল রণেন। সময়ের জ্ঞান ছিল না। ওই রকম লাগাতার চেয়ে থাকার জন্যই বোধ হয় মেয়েটা তার দিকে তাকাল। একবার স্বাভাবিক কৌতূহলে, পরেরবার ভ্রূ কুঁচকে। গহীন চুলের মধ্যে পথরেখার মতো সিঁথি ডুবে গেছে। মুখখানা লম্বাটে, থুতনির খাঁজ গভীর। কাপড় বা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে অনেকটা এরকম মুখের ছবি ছাপা হয়। বাঙালি মুখ, তবু যেন বিদেশি কাটছাঁটে তৈরি।

রণেনকে পছন্দ হয়নি মেয়েটির। ভ্রু কোঁচকানো মুখ ফিরিয়ে নিল ঝামড়ে। তাতে অবশ্য রণেনের কিছু যায় আসে না। মেয়েদের মনের মতো চেহারা তার নয়, সে জানে না কি! তবু একটা শ্বাস ফেলে রণেন। এখনকার দিনকাল বড় ভাল। সোমেনের কথা একবার মনে এল। কেমন শ্রীমান চেহারা ভাইটার! ওদের সময়টাও ভালো, মেয়েদের সঙ্গে হুল্লোড় করে বেড়ায়, বকবক করে। রণেনের কলেজ জীবন কেটেছে নন কো-এডুকেশনে, ইউনিভার্সিটিতে যায়নি। বরাবরই তার চরিত্রের খ্যাতি ছিল। সে নাকি মেয়েদের দিকে তাকায় না। সারা যৌবনকালটা সেই খ্যাতি রক্ষা করে গেছে রণেন। মেয়েদের উপেক্ষা করেছে। তাকায়নি। কেবল বহেরুর খামারবাড়িতে এক-আধবার নয়নতারার সঙ্গে…। কিন্তু সেও কিছু নয়। যৌবন বয়সের ভাল ছেলে রণেন আজও একরকম বাঁধা আছে নিয়তির কাছে। বয়স ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবী জুড়ে এখনও নেমে আসছে সুন্দর, কচি, হৃদয়বতী মেয়েরা।

রণেন দুপা পিছিয়ে গেল। ছাঁট আসছে। চশমা ভিজে গেছে। রুমালে কাচ দুটো মুছে নিয়ে ভাল করে তাকাল। মেয়েটা ঘাড় ঈষৎ সামনের দিকে বাঁকিয়ে বড় বড় অন্যমনস্ক চোখে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক উত্তেজক।

নিজের শ্বাসের ঝোড়ো শব্দে চমকে ওঠে রণেন। ভিতরে ভিতরে এক তীব্র কামবোধ আনন্দম্পৃহা জেগে ওঠে। চামড়ার তলায় শরীরের ভিতরকার অন্ধকারে ঝিঁঝি করে লুকনো বীজ। মাথার সব চিন্তা লোপাট হয়ে যায়। চোখের পাতা নড়ে না। ভিতরে ভিতরে ভালো ছেলে রণেন কি নারীধর্ষণকারী নয়? যেদিন বীণাকে মেরেছিল সেদিন সোমেন আর মা না চেঁচালে বীণা খুন হয়ে যেত তার হাতে। তা হলে, ভিতরে ভিতরে সে কি খুনিও?

রণেন নিজের মনে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, সে যেমন খুন করতে পারে তেমনি নারীধর্ষণ করতে পারে। আরও পারে বহু কিছু। মানুষের অস্পৃশ্য অনেক পাপ। ভয়ে বা লজ্জায় বা অনভ্যাসে করে না। কিন্তু পারে।

মেয়েটা তাকাচ্ছে না, কিন্তু লক্ষ্য করেছে ঠিকই যে একজন মধ্যবয়সি মোটা লোক তাকে নজর দিচ্ছে। কচি বয়স, এ বয়সে যে কোনও পুরুষেরই চোখে নিজেকে জরিপ করে নিতে ইচ্ছে যায়। মেয়েটা তাই রণেনের উদ্দেশ্যেই বোধ হয় আঁচল টেনে টান করে দিল কিছুটা। স্পষ্ট ফুটে ওঠে বুকের ডৌল। নাভির নীচে কাপড়, খাটো ব্লাউজ। পেটের অনেকখানি দেখা যায় নীলচে একটা জার্মানি জর্জেটের শাড়ি পরনে। ভাবা যায়?

বৃথা গেল বয়স। বৃথা গেল সময়, মাথা খুঁড়লেও ফিরে আসবে না।

রণেন তাই নিজের মনের কাছে বলে রাখল—আমি কিছুই পাইনি জীবনে।

মেয়েটি বৃষ্টির দিকে চেয়েছিল। চুল নড়ছে হাওয়ায়। মোটা বেণী। নীরবে সেই যেন উত্তর দিয়ে দিল রণেনকে—আহা।

—আমি মোটা মানুষ, ব্যক্তিত্বহীন, হাবা।

—একটু বয়সের পুরুষই ভাল। তারা হৃদয়বান হয়, চঞ্চলতা থাকে না। তুমি ভাল।

রণেন মাথা নাড়ে, বলে—সবাই তাই বলে। কিন্তু আমি আর ভাল থাকতে চাই না। ভাল থাকা বড় একঘেয়ে ক্লান্তিকর। একটু খারাপ হয়ে দেখি না! আমাকে খারাপ করবে? প্লিজ!

মেয়েটা মৃদু হাসল। সৌরভময় শ্বাস ফেলে বলে—মোটা তো কী! কেমন ফরসা তোমার রং, কেমন ঠান্ডা মাথা। চাকরিও ভাল।

—কেমন লাগছে আমাকে? ভাল?

মেয়েটা চোখ তুলে তাকাল, শুভদৃষ্টির সময়কার মতো চোখ। কী লজ্জা ও শিহরনে ভরা বিদ্যুৎ! কথা বলল না।

রণেন বলে—আমি আর একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করব।

—তার মানে কি দুটো জীবন?

রণেন মাথা নাড়ল—শুধু বউ হলে আনতাম। কিন্তু বাচ্চাগুলো রয়েছে যে। বড় মায়া।

মেয়েটি বুঝেছে। মাথা নাড়ল। তৎক্ষণাৎ একটা নাম দিল রণেন—লীনা। এই নামের একটা মেয়েকে বালকবয়সে ভালবেসে ছিল রণেন, যার সঙ্গে কোনওদিন কথাবার্তা হয়নি। লীনা করুণ চোখে চেয়ে মাথা নয়াল। বলল—তাই হবে।।

হবে! বাঃ! চমৎকার! সব সমস্যার কেমন সমাধান হয়ে গেল। সবাই থাকবে। বাচ্চারা, বীণা, আলাদা ফ্ল্যাটে লীনাও! বাঃ।

ভারী খুশি হয়ে ওঠে রণেন।

দুঘণ্টার বৃষ্টি কলকাতাকে লণ্ডভণ্ড করে গিয়ে গেল। ট্রাম বন্ধ, বাসে লাদাই ভিড়, ট্যাক্সির মিটার সব লাল কাপড়ে ঢাকা। বৃষ্টির পর কলকাতা থেমে যায়, কিংবা খুব আস্তে চলে। রথের মেলার মতো মানুষ জমে আছে সর্বত্র। থিকথিক করছে জীবাণুর মতো মানুষ।

রণেন অফিসের হলঘরে তার ভেজা জামা আর গেঞ্জি ফ্যানের তলায় চেয়ারের পিঠে মেলে দিয়েছে। বসে আছে চুপচাপ। অফিসে এখনও কিছু লোকজন আছে। জনা ছয়েক লোক একধারে ফিস খেলছে। অন্যধারে ব্রিজের আড্ডা বসেছে। শুধু মুখোমুখি ঘোষ বসে নীরবে অঙ্ক কষছে। রণেন চোখ বুজে ছিল। ভাবছিল সবাইকে ডেকে বলে দেবে, মরবার পর যেন তাকে না পুড়িয়ে কবর দেওয়া হয়: পোড়ানোটা বড় বীভৎস ব্যাপার। আবার পরক্ষণেই মনে হল,কবর! ওরেব্বাস, সেও তো মাটি চাপা হয়ে দমবন্ধ হবে। হাঁসফাঁস করতে হবে কেবলই।

ভেবেই সে হঠাৎ জোরে বলল—না না।

বলেই চমকে ওঠে। ঘোষ একবার মুখ তুলেই চোখ নামিয়ে নিল। কিছু জিজ্ঞেস করল না।রণেন লজ্জা পেল বটে, কিন্তু ঘোষ বড় বিবেচক মানুষ বলে লজ্জাটাকে সামলে গেল।

সাতটা বেজে গেছে। ফিসের আড্ডা থেকে দুজন বেরিয়ে গেল। একজন চেঁচিয়ে বলল—ঘোষদা, এই বৃষ্টিতে কি ভাল জমে বলুন তো?

ঘোষ উত্তর দিল না। ব্রিজের আড্ডা থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল—ভূতের গল্প, খিচুড়ি আর মেয়েছেলে।

—দূর। ঘোষদাকে বলতে দিন।

ঘোষ উত্তর দিল না। একটু হাসল কেবল, অঙ্ক কষতে লাগল।

আর একজন বলে—ইলিশ।

—কত করে কেজি জানিস? ওই লাহিড়ি জানে, জিজ্ঞেস কর।

কে একজন চেঁচিয়ে ডাকে—লাহিড়ি, ও লাহিড়ি।

রণেন তাকাল। অ্যাকাউন্টসের বিপুল সেন। ভ্রূ কুঁচকে রণেন বলে—কী?

—ইলিশ মাছ কত করে যাচ্ছে?

—কী জানি!

—আমাদের মধ্যে তো এক আপনাকেই দেখছি যিনি ইলিশটিলিশ খান। আমরা তো আঁশটাও চোখে দেখি না। ইন্সপেক্টর না হলে সুখ কী!

রণেন মুখটা ফিরিয়ে নেয়। ব্যক্তিত্ব না থাকলে এরকম হয়। যে-সে যা খুশি বলে সারতে পারে।

কে একজন বলল—ইলিশ খেয়ে পয়সা নষ্ট করবে কেন! লাহিড়ি লকারে রাখছে। টালিগঞ্জে বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে, সব খবর রাখি।

হলঘরের দরজাটা খোলা। কে একজন ছাতা মুড়ে, গা থেকে বর্ষাতি খুলতে খুলতে দরজা দিয়ে ঢুকে এল। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে চারধারে চাইছে।

রণেন চিনতে পারল৷ সোমেন। বুকটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। সোমেন অফিসে কেন? কোনও খারাপ খবর নেই তো! বাবা, মা, বীণা, বুবাই, টুবাই, খুকি, শীলা, অজিত—কত প্রিয়জনের নাম ঘাই মারে বুকের মধ্যে।

রণেন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।

সোমেন তাকে দেখে এগিয়ে আসে।

॥ বিয়াল্লিশ ॥

মা আর বউদি দুজনে ঠেলে পাঠিয়েছে সোমেনকে দাদার ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন তা দেখে আসতে। বৃষ্টি বাদলায় মানুষের দেরি হয়, কিন্তু কে বুঝবে সে কথা। সোমেন তাই খুব বিরক্তির সঙ্গে এসেছে।

মনটা ভাল নেই। গতকাল অণিমা এসেছিল বাসায়। সাদাখোলের শাড়ি পরা, চেহারাটা অনেক ভাল হয়েছে আজকাল। অনেক ধীরস্থির আগের চেয়ে। একটা চমৎকার হ্যান্ডমেড কাগজের কার্ডে ছাপা বিয়ের চিঠি দিয়ে বলল—যেও না সোমেন। সব নিমন্ত্রণে যেতে নেই।

এরকম কথা কখনও শোনেনি সোমেন। কেউ নেমন্তন্ন করতে এসে বারণ করে যায় নাকি!

ঘরে বসে কথা বলার সুবিধে নেই। তাই অণিমার সঙ্গে বেরিয়ে এল সোমেন। কোনও দিন নিজেদের গাড়িতে চড়ে কোথাও অণিমাকে যেতে দেখেনি সোমেন। অণিমার রুচিবোধ বড় প্রবল। গাড়ি আছে—এটা কাউকে দেখাতে চায়নি কখনও। কাল কিন্তু গাড়ি করে এসেছিল। সাদা অ্যামবাসাডার। অণিমার সঙ্গে পিছনের সিটে উঠে বসল। সামনে ড্রাইভার।

কথা হচ্ছিল না। একটা লালরঙা নাইলনের খাপে-ভরা নিমন্ত্রণের চিঠিগুলি সোমেন আর অণিমার মাঝখানে পড়েছিল। অণিমা দরজার কাছে অনেকটা সরে বসেছে। আলগা দূরের মানুষ, প্রায় পরস্ত্রী। সোমেন বলে—আমাকে গড়িয়াহাটায় নামিয়ে দিয়ো অণিমা।।

অণিমা উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ বাদে বলল—পরীক্ষাটা দেবে না?

সোমেন হাসল, বলল—তুমি বড় বেরসিক। পরীক্ষাটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। দিলেও যা, না দিলেও তাই। একজন গ্র্যাজুয়েট বেকার আছি, তখন না হয় এম-এ পাস বেকার হবো।।

—তা কেন? প্রফেসারির জন্য অ্যাপ্লাই করতে পারবে।

সোমেন হাসল। গড়িয়াহাটা ব্রিজের ঢালু বেয়ে গাড়িটা গড়িয়ে নামছে তখন। অণিমা বাইরের দিকেই চেয়েছিল। যেন অন্যমনস্ক। আসলে তা নয়। চেহারা ভাল হলেও অণিমার মুখে একটা খড়ি-ওঠা বিষন্নতার গুঁড়ো মাখানো। সোমেনের বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড নেচে ওঠে। একই সঙ্গে একটা জয়ের আনন্দ ও হারানোর দুঃখ তাকে মুহূর্তের জন্য পাগল করে দেয়। একটু ঝুঁকে সে প্রশ্ন করে—বিয়ের পর কোথায় অণিমা?

অণিমা ভারী চশমার ভিতরে তার ছোট হয়ে আসা চোখে তাকাল সোমেনের দিকে। বলল—সিন্ধ্রি।

—অনেক দূর।

—দূর! বলে একটু ভাবে অণিমা। পরে হেসে বলে—তেমন দূর নয়। তবে দূরত্বটা রাখাই ভাল।

ব্যগ্র, লোভী সোমেন বলল—কেন অণিমা?

—গড়িয়াহাটা এসে গেল, সোমেন নামবে না?

—আর একটু যাই।

অণিমা শ্বাস ফেলে বলে—চলো।

গাড়ি চলে। খুব মৃদু ইন্টিমেট সুগন্ধীর একটা বাসি গন্ধ গাড়ির ভিতরে। স্নো-পাউডার কখনও মাখত না অনিমা। এখন কি মাখে? মৃদু সুবাস তার চারদিকে। মহীয়সীর মতো দেখাচ্ছে সাদা খোলের শাড়িতে। চওড়া পেটা জরির পাড়। এত দুর্লভ কখনও অণিমাকে দেখাত না। ঠাট্টা-ইয়ারকি একদম কি ভুলে গেল অনিমা?

—অনিমা, তোমার কাছে টাকা আছে?

অনিমা অবাক হয়ে বলে—কেন?

—ধার দেবে? একটা জিনিস কিনব?

সোমেন কোনওদিন ধার চায় না। অনিমা ব্যাগ খুলে দেখেটেখে বলে—কত বলল তো!

—জানি না। জিনিসটা শো-কেশে দেখলাম একটা দোকানে, ফেলে এসেছি পিছনে। গাড়িটা ঘোরাতে বলো।

গাড়ি ঘুরল। গড়িয়াহাটার দিকে ফিরে আসতে একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল সোমেন। শো-কেসে একটা চওড়া লালপেড়ে বিষ্ণুপুরী শাড়ি। সোমেন নেমে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করল। দেড়শো টাকা।

গাড়ির কাছে ফিরে এসে বলল—দেড়শো টাকা দেবে?

কী একটা সন্দেহ করে অনিমা। একটু ইতস্তত করে টাকা বের করে দিয়ে বলল—মাঝে মাঝে পাগলামির ভূত চাপে, না?

সোমেন তার ভুবনজয়ী মিষ্টি হাসি হেসে বলল—পাগলই তো।

শাড়িটা কিনে এনে প্যাকেটটা গাড়ির সিটে রেখে উঠে বসল গাড়িতে। বলল—তোমাকে সাদা খোলের শাড়িতে বড় মহীয়সী মনে হয়।

—তাই নাকি?

বিয়ের দিন ওই কারণেই তোমাকে না দেখা ভাল। ওইদিন তো তোমাকে রঙিন বেনারসি পরাবে, ফুলের সাজ, চন্দন—এ সব তোমাকে মানায় না।

অনিমা সত্যিকারের হাসি হাসল একটু। বলল—সেটা দৃষ্টিভঙ্গির তফাত বলে। তোমার সঙ্গে যদি হতো তা হলে কী করতে? শুভদৃষ্টির সময়ে তাকাতে না সোমেন?

এ কথাটায় ঠাট্টা ছিল হয়তো। তারা হাসলও। কিন্তু হাসি কারও ঠোঁটের গভীরে গেল না।

দেশপ্রিয় পার্কের কাছে সোমেন নেমে গেল। অনিমা পিছন থেকে বলল—এই শাড়ির বাক্স পড়ে রইল যে!

সোমেন দরজাটা দড়াম করে ঠেলে দিয়ে বলল—তোমার জন্য। বিয়েতে তো যাওয়া। বারণ, তাই আজ দিয়ে রাখলাম।

—যাঃ। এই সোমেন, শোনো, শোননা…

সোমেন শোনেনি। চলে এসেছে।

কাল থেকে সারাক্ষণ মনটা তাই খারাপ। কেমন যেন। পিপাসা পায়, বুক খালি-খালি লাগে। আবার একটা ভূতুড়ে আনন্দে রক্তে আগুন ধরে যায়। মনের এই অবস্থায় একা বসে ভাবতে ভাল লাগে, আর কিছু ভাল লাগে না। কালকেও বিকেলে পড়াতে গিয়েছিল গাব্বুকে। অণিমা বাড়িতে ছিল না। গাব্বর কাছে একটা সাঁটা খাম রেখে গেছে। বাড়িতে ফিরে সেটা খুলে দেখেছে সোমেন। প্যাডের একটা কাগজের ঠিক মাঝখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—নিলাম। মনে থাকবে। ভুলে যেয়ো। অ।

বাড়িতে একটা টেনশন চলছে আজকাল। সারাদিন সোমেন থাকে না। দুপুরে একটু থাকে, আর রাতে। প্রায় রাতেই মা আজকাল ঘুমনোর আগে দাদার কথা বলে। দাদার শরীর ভাল নেই। বউদির সঙ্গে গোলমাল হয়ে থাকবে, মনটাও তাই বোধ হয় ভাল থাকে না। বউদি মানুষটা খারাপ নয়, দাদা তো ভালই। কিন্তু দুজন ভালর জাত আলাদা। মা কিন্তু বরাবর দাদার পক্ষে। সোমেনকে রাত জাগিয়ে রেখে মা এক কাঁড়ি কথার হাঁড়ি খুলে বসে। সোমেন বিরক্ত হয়। সংসারের এত সব কথার মধ্যে বরাবর ডুবে মরে মন। তখন মনে হয়, অনিমা কিংবা রিখিয়ার কথা কত অবাস্তব! সংসারটা এত রোমাঞ্চহীন!

আজ বিকেল থেকে আকাশ কুঁসছে। বৃষ্টি এল। সোমেন বেরোতে পারেনি। সন্ধেবেলা প্রথমে মা, তারপর বউদি এসে ধরল। দাদা কেন ফিরছে না! সোমেন একটা কবিতার খসড়া তৈরি করছিল, এ সময়ে এই ঝামেলা। অত বড় লোকটা, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, সে যাবে কোথায়, তার হবেটাই বা কী! কিন্তু কেউ বুঝল না। বৃষ্টির ধারাটা কমতেই তাই সোমেনকে বেরোতে হয়েছে। বউদি ট্যাক্সির ভাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ট্যাক্সি পাওয়া যায়নি। গড়িয়াহাটা থেকে ট্রাম ধরে এসেছে। মনে বিরক্তি রাগ।

কিন্তু এখন অফিসের দরজা পার হয়ে যখন দাদাকে দেখতে পেল সোমেন তখনই বড় চমকে উঠল। খালি গায়ে দাদা দাঁড়িয়ে, পরনে শুধু আধভেজা ফুলপ্যান্ট, আড়া-আড়ি বুকের ওপর ময়লা পৈতে। মোটা গোল গণেশ মুখ। ভুঁড়িটা ঠেলে বেরিয়ে আছে। শরীরটা ঢিলেঢালা, চামড়ার ভাঁজ। মুখেচোখে একটা ভ্যাবলা বোবা ভাব। বড় বড় চোখে সোমেনের দিকে চেয়ে আছে। চাউনিতে একটা নির্বোধ ভয়। দাদার এমন চেহারা কখনও দেখেনি সোমেন। সোমেন কাছে যেতেই বলল—কী হয়েছে? অ্যাঁ! কী হয়েছে?

সোমেন ভ্রূ তুলে বলে কী হবে!

—কার অসুখ? না কি অ্যাকসিডেন্ট?

সোমেন বুঝতে পারল না দাদা কী বলতে চাইছে। একটু অবাক হল। বলল—কী বলছে দাদা! আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

—নিয়ে যাবি?

—মা বউদি সব ভাবছে দেরি দেখে।

এতক্ষণে যেন বা একটু স্বাভাবিক হল চোখ। দু-পা ফাঁক করে গম্বুজের মতো দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ অবসন্নের মতো বসে পড়ে বলল—ও।

—চলল। প্রায় আটটা বাজে।

রণেন মাথা নাড়ল। তারপর ভেজা জামা গেঞ্জি তুলে পরতে লাগল। হাত অল্প অল্প কাঁপছে। দৃশ্যটা দেখে সোমেনের সমস্ত হৃদয় বহুকাল বাদে দাদার দিকে ধাবিত হল একবার। কী হয়েছে দাদার? বহুদিন হয় এই লোকটাকে সে লক্ষই করেনি। লক্ষ করেনি, তার কারণ, রণেন কখনও লক্ষ করায়নি। বরাবর দাদা একটু গম্ভীর মানুষ, একটু চুপচাপ। নীরবে সে সংসারের দায়িত্ব বহন করে। সোমেন একটু বড় হওয়ার পর থেকেই দেখেছে, এই লোকটা সংসারের অভিভাবক। দু-ভাইতে কথা হয় খুব কম। কিন্তু আজও নিজের কোটটা প্যান্টটা, সাধ-আহ্লাদের নানা জিনিস সোমেনকে নিঃশব্দে দিয়ে দেয়। দাদা কখনও কাউকে খারাপ জিনিস দেয় না। বাজার থেকে কখনও সস্তা জিনিস আনে না। সোমেনের ফিরতে রাত হলে চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই দাদা। শান্ত, উদার, স্নেহশীল। দাদাকে কেন এতকাল লক্ষ করেনি সোমেন? দাদার কী হয়েছে?

হাওয়াই শার্টের বোতাম এঁটে রণেন ব্যাগটা তুলে নিল। বলল—ঘোষদা, যাই।

ঘোষ মুখ তুলে বলে—এটি কে? ভাই?

—হ্যাঁ।

ঘোষ মাথা নাড়ল। বলল—যান। বাড়ির সবাই ভাবছে। বলে একটু ব্যাঙ্গের হাসি হাসল যেন। আবার মাথা নেড়ে বলে—আমাদেরই ভাবাভাবির কেউ নেই। বাঁচা গেছে।

বৃষ্টির কলকাতায় জীবাণুর মতো থিকথিক করছ মানুষ, এখনও এই রাত আটটায়। বৃষ্টি কমে গেছে, তবু ঝিরঝির চলছে এখনও। গাড়িবারান্দার তলায় তলায় ভিড় জমে আছে। মানুষের পিণ্ড।

রণেন চারদিকে চেয়ে বলে—কী করে যাবি?

—দাঁড়াও একটা ট্যাক্সি যদি ধরতে পারি।

রণেন মাথা নেড়ে বলল—পাবি না।

—তা হলে? মা আর বউদি ভাববে।

রণেন উদাস গলায় বলে—ভাবুক। আয় কিছু খাই। খিদে পেয়েছে।

—খাবে?

দাদার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার কোনও অভিজ্ঞতা সোমেনের নেই। তার বড় লজ্জা করছিল। রণেনের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। গদাই লস্করের মতো হেঁটে বৃষ্টি ছাঁট উপেক্ষা করে সে ঢুকে গেল একটা রেস্টুরেন্টে। পিছু পিছু সোমেন। কিন্তু সেখানেও ভিড়। টেবিল খালি নেই। চারদিকে হতাশভাবে চেয়ে রণেন সোমেনের দিকে চেয়ে যেন নালিশ করল—খিদে পেয়েছে।

—বাড়িতে গিয়ে খেয়ো।

অধৈর্যের সঙ্গে রণেন বলে—সে তো অনেক দেরি। বলে সোমেনের দিকে রাগ আর নালিশভরা একরকম চোখে চেয়ে থাকে।

এ-কদিনেই দাদার ভিতরে একটা ওলটপালট হয়ে গেছে। সেটা সোমেন এই টের পেল। স্বাভাবিক রণেন এভাবে কথা বলে না তাকায় না। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে সোমেন বলে— শেয়ারের ট্যাক্সি মেট্রোর উলটোদিকে দাঁড়ায়। চলো, যদি পেয়ে যাই।

রণেন কিছু বলল না। কিন্তু সোমেনের সঙ্গে হাঁটতে লাগল।।

দুদিন বৃষ্টির পর কলকাতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। এখানে-সেখানে কিছু জল দাঁড়িয়ে আছে। তবু রোদ উঠেছে। আকাশ গভীর নীল। দুদিন সাংঘাতিক বৃষ্টি হয়ে গেল। সবাই ঘরবন্দি। এই দুদিন সোমেন কেবলই শুনেছে দাদার ঘর থেকে দাদা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে বলছে—দরজা খুলে দাও। জানালা খোলা রাখো।

—বৃষ্টির ছাঁটে ঘর ভিজে যাচ্ছে। বউদি রাগ করে বলে।

দাদা তখন ভীষণ হতাশভাবে বলে—ওঃ হোঃ হোঃ। ইস কী অন্ধকার। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

মা প্রায় সারাক্ষণ ওই ঘরে। এ ঘরে একা সোমেন। বুকের মধ্যে দুশ্চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দাদার কী হয়েছে? মাঝে মাঝে ও ঘরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে। দাদা নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে কিংবা মাথা হাঁটুর ফাঁকে রেখে বসে। ছেলে-মেয়েদের মুখ করুণ, শুষ্ক। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে বাবার কাণ্ড দেখে হেসে ফেলে। বেশির ভাগ সময়েই বাইরের ঘরে খেলা করে। বউদি ভাল করে খায় না। রাতেও বোধ হয় ঘুম নেই। শরীর এ-কদিনেই শুকিয়ে গেছে। একটা বিপদের আশঙ্কায় থমথম করে ঘরের আবহাওয়া। ঘরে তাই সোমেনের মন টেকে না।

সোমেন এ কয়দিন খুব সিগারেট খেল। ভাবল। কেমন যেন মনে হয় এবার সংসারে একটা পরিবর্তন আসবে, ছক পালটাবে। সেই আগের মতো নিশ্চিন্ত জীবন আর থাকবে না।

গভীর রাতে একদিন ঘুম ভেঙে শুনল কলের গান বাজছে। খুব আস্তে বাজছে, আর সেই সঙ্গে বাইরের ঘরে কার যেন নড়াচড়ার শব্দ, গভীর শ্বাস আর ‘আঃ উঃ শব্দ’।

দরজা খুলে সোমেন অবাক হয়ে দেখে, অদ্ভুত দৃশ্য। আলো জ্বালা হয়নি, তবু জানালা সব খোলা বলে বাইরের আলো এসে পড়েছে। রেডিয়োগ্রামের চৌকো ব্যান্ডে আলো জ্বলছে, স্থির হয়ে আছে সবুজ ম্যাজিক আই। আর রেডিয়োর সেই আলো চৌখুপির কাছে একটা মাথা অনড় হয়ে আছে। প্রথমটায় আবছায়ায় বুঝতে পারেনি সোমেন। তারপর দেখে, দাদা একটা আন্ডারওয়ার মাত্র পরে মেঝের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। রেডিয়োর স্পিকারটা নিচুতে। স্পিকারের সঙ্গে কান লাগিয়ে শুনছে রবিঠাকুরের গলায় গাওয়া গানের রেকর্ড—‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহে প্রাণ…’

সোমেন আস্তে করে ডাকল—দাদা!

রণেন মুখটা ঘুরিয়ে তাকে দেখল, তর্জনী ঠোঁটের কাছে তুলে বলল—চুপ।

আবার গান শুনতে লাগল। রেকর্ড ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে চালিয়ে দিল। সোমেনের দিকে ফিরেও তাকাল না। বোধ হয় ভুলে গেল যে কেউ তাকে দেখছে। দীর্ঘকাল সে যেন গান শোনেনি। আকণ্ঠ পান করে নিচ্ছে। যেন চৈত্রের মাঠ শুষে নেয় বৈশাখের বৃষ্টি। এখন ওর আর কেউ নেই, ওই গানটুকু, ওই কাঁপা কাঁপা রিক্ত কণ্ঠস্বর ছাড়া।

বহুকাল কাঁদে না সোমেন। কোনওকালে তার চোখে জল আসে না সহজে। এখন হঠাৎ হাতের পিঠে চোখ মুছল। গলা, কণ্ঠা অবরোধ করে কান্না উঠে আসে। সোমেন ঘরে এসে অন্ধকার হাতড়ে সিগারেট ধরায়। বসে থাকে। ঘুম হয় না।

দুদিন বৃষ্টির পর রোদ উঠতেই সে বেরিয়ে পড়ল সকালে। খাওয়ার জায়গা অনেক আছে। কিন্তু ঠিক কোথায় যে যেতে ইচ্ছে করছে তা বুঝতে পারছিল না। বুকের মধ্যে টনটন করে গুপ্ত ব্যথা। একা থাকতে ইচ্ছে করে। মেঘভাঙা রোদে ভ্যাপসা গরম। বাতাস নেই। এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ হেঁটে সোমেন যখন আবার বাড়ির রাস্তায় ঢুকতে যাচ্ছিল তখনই দেখে পূর্বা আগে আগে যাচ্ছে।

সোমেন ডাকল—এই।

পূর্বা চমকে ফিরে তাকিয়েই হেসে ফেলল—ইস, এমন ভয় পাইয়ে দিস না!

—ভয়ের কী?

—রাস্তায় কেউ আচমকা ডাকলে ভয় করে না? তোর কাছেই যাচ্ছিলাম।

—সে বুঝেছি, নইলে এ পাড়ায় তোর আর কে লাভার আছে!

—গাঁট্টা খাবি। ছ্যাবলা কোথাকার!

—সংবাদ কী শুনি বৃন্দেদূতী।

পূর্বা মুখ ভ্যাঙাল। বলল—জানি না। অনিল রায় তোকে ডেকেছেন।

—কেন?

—বললেন, সোমেনের নাকি চাকরি দরকার! আমার ডিপার্টমেন্টে একটা পোস্ট খালি আছে, ওকে দেখা করতে বলো।

সোমেন ভ্রূ কুঁচকে বলে—আমার চাকরি দরকার সে কথা ওকে বলল কে?

পূর্বা উদাস গলায় বলে—কে জানে! তোমার তো হিতৈষী আর হিতৈষিণীর অভাব নেই। আমাদের জন্যই কেউ ভাবে না।

সোমেন খুব নাক উঁচু গলায় বলে—কি চাকরি জানিস?

—না। তবে প্রফেসারি নয় এটুকু বলতে পারি।

—এম এ পরীক্ষা দিইনি বলে ঠেস দেওয়া হচ্ছে?

—আহা, কী এমন বালিশটা যে ঠেস দেবো?

সোমেন হাসল। বলল—চা খাবি?

—তোর বাসায়? না বাবা, রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়ে ভাল হল। একদিন তোর বাড়ি গিয়েছিলাম, অনেক দিন আগে, তুই ছিলি না। তোর মা সেদিন আমার জাত গোত্র জিজ্ঞেস করে অস্থির করে তুলেছিল। পালিয়ে বাঁচি। আজও ভয়ে ভয়ে যাচ্ছিলাম, নেহাত চাকরির খবর না দিলে নয়।

—আমার চাকরির খবরে তোর অত ইন্টারেস্ট কেন? সোমেন মিচকে হেসে বলে।

—আহা! বেকার বসে আছিস না!

—থাকলেই কী?

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাসস্টপে চলে এল। রবিবার। বাস ফাঁকা যাচ্ছে। সোমেন একটা আটের বি থামতে দেখে বলল—ওঠ!

অবাক হয়ে পূর্বা বলে—কোথায় যাবি?

—হাওড়া। তারপর ট্রেন ধরব।

—ওমা। কেন?

—তোকে নিয়ে আজ পালিয়ে যাচ্ছি।

॥ তেতাল্লিশ ॥

আটের বি বাসটা ছেড়ে গেল। পূর্বা উঠল না। একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে হেসে বলল— পালাব কেন? বাড়িতে বলেকয়ে এলেই তো হয়। কেউ আটকাবে না।

সোমেন ভ্রূ কুঁচকে একটু তাকায় পূর্বার দিকে। গম্ভীর হয়ে বলে—চান্সটা মিস করলি৷

—বয়ে গেল।

দুজনে আস্তে আস্তে হেঁটে ব্রিজের ওপর উঠতে থাকে। কোথায় যাওয়া নয়, কেবলমাত্র হাঁটা। বৃষ্টির পর রোদ বড় তেজি। ভ্যাপসা গরম। ব্রিজের ঢালু বেয়ে ওপরে উঠতে একটু হাওয়া লাগল। রেলিঙের ধার ঘেঁষে দুজনে দাঁড়ায়। সোমেন বলে—লোকে আমাদের কী ভাবছে বলতো!

—যা খুশি ভাবুক গে। কত হাজার হাজার জোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে কলকাতায়, লোকের ভাবতে বয়ে গেছে।

—তোর বাবা যদি এখন বাসে যেতে যেতে আমাদের দেখে ফেলে? সোমেন একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে।

পূর্বা চোখ বড় বড় করে বলে—দেখেনি নাকি? কতবার কত ছেলের সঙ্গে দেখেছে। প্রথম প্রথম মার ওপর রাগারাগি করত। এখন ভাবেই না।

একটা ইলেকট্রিক ট্রেন তলা দিয়ে চলে গেল শিস টেনে। রেললাইনের ধারে বস্তি। আপ-লাইনের ওপর কাঁথা কাপড় শুকোচ্ছে রোদে, বাচ্চা-কাচ্চারা খেলছে, রোগা রোগা কালো চেহারর কজন মেয়েছেলে বসে আছে লাইনের ওপর, খুব নিশ্চিন্ত। ট্রেন এলে একটু সরে বসবে, ট্রেন চলে গেলে আবার লাইনের ওপর হামা টানবে দুধের শিশু, কাঁথা কাপড় শুকোবে।

দৃশ্যটা দেখিয়ে পূর্বা বলে—ভেবেছিস, কী সাহস! আমার হাত-পা শিরশির করছে।

—ওদের কিছু হয় না। রেললাইন ওদের উঠোন।

পূর্বা চুপ করে দৃশ্যটা দেখে একটু। ঠিক মুখের ওপর রোদ পড়ছে। হাতের মুঠোয় এক কণা রূমাল দিয়ে মুখটা মুছে বলল—অণিমার বিয়েতে কি দেওয়া যায় বলত। আমরা সবাই একসঙ্গে দেবো, শ্যামল বলেছে পারহেড কুড়ি টাকা। বড্ড বেশি না?

সোমেনের বুকের মধ্যে সেই কাঁপুনিটা ওঠে। একটা ব্যথা, একটা আনন্দ। মুখটা পূর্বার চোখের আড়াল করার জন্যই ঘুরিয়ে নিয়ে বলল—বেশি আর কী?

পূর্বা রাগের গলায় বলে—বেশ বেশি।

কথাটা কাউকে বলার নয়। চিরকাল এক বুক অন্ধকারে চাপা থাকবে অনিমার ভালবাসার কথা। সোমেন আর অণিমা ছাড়া আর কেউ জানবে না। কিন্তু সেটা সহ্য করা যায় কি? অণিমা যে তাকে ভালবাসত এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে তার নিজের জয়। কাউকে না বলে থাকে কী করে সোমেন? বুকের ভার একা বওয়া যায় না। বলবে না বলে বার বার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সোমেন। তবু মনটা তরল হয়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে বলল—অণিমাটা না একটা পাগল? জানিস?

পূর্বা মুখ তুলে বলল—কেন?

‘বোলো না, বোলো না পূর্বা সবাইকে বলে দেবে।’ এই বলে নিজেকে মনে মনে ধমকাল সোমেন। কিন্তু সামলাতে পারল না। ভাবল, অণিমা তো বলতে বারণ করেনি!

মুখে সে পূর্বাকে বলল—কাউকে বলবি না? গা ছুঁয়ে বল।

পূর্বা তার হাত ছুঁয়ে বলল—প্রমিস।

—একদিন না…

বলে ফেলল সোমেন। অনর্গল বুক থেকে কথা বেরিয়ে গেল। আটকানো গেল না। পূর্বা অবাক হয়ে চেয়েছিল। কিন্তু পূর্বাকে নয়, গোটা পৃথিবীকেই যেন জানানোর দরকার ছিল।

বলে ফেলেই হঠাৎ যেন নিবে গেল সোমেন। গভীর এক ক্লান্তি মনের ভিতরে। বলা উচিত হল না, বলা উচিত হল না। সবাই জেনে যাবে। অণিমার কানেও উঠবে কোনওদিন। ভাববে, সোমেন কেমন পুরুষ? হায় ঈশ্বর, ওকে আমি কেন ভালবেসে ছিলাম!

সোমেনের বড় ভয় করল! অণিমার বিয়ে হয়ে যাক, ভিন্ন পুরুষের ঘর করুক, তবু চিরকাল মনে মনে সোমেনকে ভালবাসুক—এই কি চায় না সোমেন? যদি সে কোনওদিন জানতে পারে যে অনিমার সেই গোপন ভালবাসা ফুরিয়েছে, তা হলে কি গভীরভাবে হতাশ হবে সোমেন?

পূর্বাকে বাসে তুলে দিয়ে ফিরে এল সোমেন। সারাটা দুপুর কেবল ভাবল। সে এত দুর্বল কেন? কেন বলে দিল পূর্বাকে। নিজেকে বড় ছোট মানুষ বলে মনে হয়।

নিজের ওপর বিরক্তিটাই ইদানীং বড় প্রবল। বড় রেগে থাকে সোমেন। বাড়ির লোকেরা কথা বলতে সাহসই পায় না। বউদি এসে একদিন বলল—টুবাইটার ট্রিপল অ্যান্ডজেন-এর শেষ ডোজটা বাকি আছে, চারু ডাক্তারের দোকান থেকে দিইয়ে আনবে সোমেন?

—পারব না। বলে রেগে উঠে গেল সোমেন। একটু বাদে ফিরে এসে দেখল বউদি রান্নাঘরে উবু বয়ে বসে আছে, দু-হাঁটুর ভিতরে গোঁজা মাথা, চোখের জল মুছছে। বড় মায়া হল। নিঃশব্দে টুবাইকে কোলে নিয়ে চারু ডাক্তারের ডিসপেন্সারিতে গেল সোমেন।।

এই রকম হয়েছে তার আজকাল। হঠাৎ রাগ উঠে পড়ে, হঠাৎ বড় মায়া হয়। বাসায় সবসময়ে এক শোকের মতো স্তব্ধতা। দাদা অফিসে যায় না। বড় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখে ওষুধ দিয়েছে। চেঁচামেচিটা একটু কম করে। কিন্তু ভ্যাবলা ভাবটা যায়নি এখনও। তেমন গুরুতর কিছু নয় বোধ হয়। কিন্তু মা আর বউদি অনেকটা রোগা হয়ে গেছে। সারাদিন তাদের মুখ শুকনো। এই গুমোট, কথাশূন্য, মন-খারাপ বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। এখনও রোগ, শোক, দুঃখ-টুঃখ ঠিক নিতে পারে না সোমেন। পালিয়ে বেড়ায়। কিন্তু যাওয়ার তেমন কোনও জায়গা নেই। বন্ধুরা অধিকাংশই চাকরি করে। আড্ডা দেয় সন্ধের পর। কিন্তু সারাদিনটা সোমেন করে কী! এক-আধদিন বন্ধুদের অফিসে গিয়ে হানা দেয়। বেশি যেতে লজ্জা করে। অহংকারে লাগে।

ম্যাক্স এখনও কলকাতায় আছে। মাসখানেকের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। কয়েকদিন বেনারসে কাটিয়ে এল। মুখচোখ খুব উদাস। আরও একটু রোগা হয়ে গেছে। পেটে ফাংগাস হয়েছে। সোমেনকে একদিন বুঝিয়ে বলল—আই হ্যাভ এ গার্ডেন ইন মাই স্টমাক। পেটের মধ্যে শ্যাওলা পড়েছে। লাল রিংঅলা দুটো সিগারেট দিল একদিন, বলল—পিওর টোবাকো নয়। একটু গাঁজা আছে কিন্তু।

সোমেনের তাতে কিছু যায় আসে না। গাঁজা খেলেই কী! দুটো সিগারেট একঘণ্টায় শেষ করে দিল সোমেন। দেখে একটু হাসল ম্যাক্স। কিছু বলল না। অনেকক্ষণ হালকা ওজনশূন্য শরীর আর ভাসন্ত মাথার এক অদ্ভুত নেশা রইল সোমেনের। মনটা টল টল করে। আরও দুটো সিগারেট চেয়ে রেখে দিল সোমেন, বদলে পাঁচ প্যাকেট দিশি সিগারেট কিনে দিল ম্যাক্সকে। গঙ্গার ধার ধরে দুজনে বিস্তর হাঁটল।

—ম্যাক্স।

—উঁ।

—তুমি অণিমাকে ভালবাসো?

ম্যাক্সের মাথায় পাখির বাসার মতো চুলের ঝোপড়া। গঙ্গার দিক থেকে মুখ ফেরাল ম্যাক্স। অমনি দুরন্ত বাতাসের ঝাপটায় চুলের রাশি এসে পড়ল গালে। কপালে। একটু পিঙ্গল দাড়ি গোঁফের ভিতরে আচ্ছন্ন মুখ। চোখের ফসফরাস আজও জ্বলে ওঠে। কিন্তু ওকে বিপজ্জনক মানুষ বলে মনে হয় না।

ম্যাক্স একটু হাসল, বলল —বাঙালি মেয়েরা বিদেশিকে ভয় পায়।

—তুমি প্রোপোজ করেছিলে?

ম্যাক্স মাথা নাড়ল। বলল—হুঁ—হুঁ। কিন্তু ও রাজি হয়নি, আমিও সেজন্য দুঃখিত নই। অণিমা ভাল মেয়ে, কিন্তু বড় মর্যালিস্ট।

—তোমার ওকে ভাল লাগে না?

—লাগে। সো হোআট? বলে আবার একটু হাসে ম্যাক্স, বলে—আই হ্যাভ স্লেপট উইথ ওভার টু হ্যান্ড্রেড গার্লস। নো অ্যাটাচমেন্ট। আই অ্যাম অলমোস্ট এ সেইন্ট।

এই রোগা সাহেবটা দুশো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে? ভারী অবাক হয়ে তাকায় সোমেন, বলে—লায়ার!

—ওঃ নো। বলে ম্যাক্স হাসে, বলে—আমার একটা নোটবই আছে। প্রত্যেকটা মেয়ের নাম আর ডেট তাতে লিখে রেখেছি। ইট ওয়াজ এ হবি। অবশ্য এসব বেশিরভাগই ঘটেছিল অস্ট্রেলিয়ায়।

ফুচকাওলার সামনে দাঁড়িয়ে গেল তারা। গঙ্গার বাতাসে জলের ছলাৎছল ভেজা শব্দ আসে। বাজে জাহাজের ভোঁ, ডাক দিয়ে যায় দশদিকে ছড়ানো মহাবিশ্বের অপার বিস্তারে। গাঁজার নেশা আর ফুচকার ঝাল-টক স্বাদ ভেদ করে মর্মমূলে একটা গুপ্ত পেরেকের যন্ত্রণা নড়েচড়ে ওঠে।

—আর, ইন্ডিয়ায়? সোমেন প্রশ্ন করে।

—এ ফিউ। বেশির ভাগই প্রস্টিটিউটস। মেয়ে মাত্র কয়েকজন।

হঠাৎ বিষম খায় সোমেন। কয়েকজন! কে সেই কয়েকজন? বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। ম্যাক্সের একটা হাত ধরে বলে—কারা? আমাদের চেনা মেয়ে?

ম্যাক্স শালপাতার ঠোঙা উলটে ফুচকার জল খাচ্ছিল। প্রচণ্ড ঝাল। নীলচে চোখ ভরে জল এসেছে, ঝালের চোটে কাশল খানিক। মুখ ছুঁচলো করে শিসাতে শিসাতে বলে-ওঃ লিভ দ্যাট। মেয়েছেলের ব্যাপারে আমি খুব ক্লান্ত। এখন একটু মজা পাই নেশায়, অন্য কিছুতে নয়। গার্লস উইল বি, গার্লস। দে অলওয়েজ টিজ ইউ।।

ম্যাক্সের হাতটা আরও শক্ত করে ধরল সোমেন। বলল—বলো ম্যাক্স। আমি জানতে চাই।

—কেন?

—সোমেন হাসল, বলল-মেয়েগুলোকে চিনে রাখব?

—কেন?

—চিনে রাখা ভাল, যদি ওদের কারও সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে যায়।

ম্যাক্স সোমেনের হাতটা ছাড়িয়ে দিল। মুখটা কিছু গম্ভীর, বিষন্ন। বলল—তুমি বড় অর্থডক্স সোমেন।

এই বলে ম্যাক্স আবার ফুচকা নেয়। দ্রুত খেতে থাকে। ঝালের জন্য জিভে রাখতে পারে না, গিলে ফেলে কোঁত করে। বলে—তোমাকে বলি, আমি এখন রক্ষণশীল মানুষদেরই বেশি পছন্দ করি।

সোমেন হাতের শালপাতা ফেলে দিয়ে রুমালে হাত মুছতে মুছতে বলে—পূর্বা নয়তো!

—ওঃ নো।

—অপালা?

—গুডনেস, নো।

একটু ইতস্তত করে সোমেন। বড় ভয় করে। বুক কাঁপে। অবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে বলে—অণিমা?

আকাশের দিকে মুখ তুলে ম্যাক্স ফুচকাটা মুখের মধ্যে ফেলে দেয়। গলা ঝাড়ে। উত্তর দেয় না। সোমেন চেয়ে থাকে। নেশাটা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। হাতে পায়ে ঝিমঝিমিনি ভাব। একটু দুর্বল লাগে।।

ম্যাক্স তারদিকে তাকায়। গম্ভীর চোখে। সোমেন সেই চোখ দুটোর দিকে চেয়ে থাকে।

তারপর আস্তে আস্তে, দুর্বলভাবে ঘাসের ওপর বসে পড়ে সোমেন, ফুচকাঅলার পায়ের কাছে। এবং বসে বসে যেন রসাতলে নেমে যাচ্ছিল সে।

গঙ্গার ধার ঘেঁষে ঘাসজমির ওপর চুপচাপ কিছুক্ষণ পড়ে রইল দুজন। নেশা কাটছে।

অনেকক্ষণ বাদে সোমেন মাথা তুলে বলে-ও আমাকে ভালবাসত।

ম্যাক্স পাশ ফিরে একটু দেখল সোমেনকে। চোখে কৌতুক ঝিলিক দেয় বলল—তাই নাকি? তারপর আবার উদাসী চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে—তুমি ভাগ্যবান।।

—তুমি ওকে কী করছ সাহেব?

ম্যাক্স চিত হয়ে শুয়ে আছে, মাথার নীচে দুই হাতের তেলো, আকাশে চোখ। উদাস গলায় বলে—নাথিং।

—লায়ার।

ম্যাক্স হাসল। মিষ্টি, বিষন্ন হাসি। বলল—তোমার খুব নেশা হয়েছে।

—আলবত হবে! বলে উঠে বসে সোমেন। আর একটা লাফ রিংঅলা সিগারেট বের করে ধরাতে যাচ্ছিল, ম্যাক্স হাত বাড়িয়ে ঠোঁট থেকে কেড়ে নিল, বলল—আর নয়। তা হলে মুশকিলে পড়বে।

সোমেন হামাগুড়ি দিয়ে সাহেবের কাছে আসে। বলে—সত্যি কথা বলে।

ম্যাক্স একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল—আমার লুকনোর কিছু নেই সোমেন। আমি নক্সালাইটদের সঙ্গে দু-তিনমাস আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম অ্যান্ড আই হ্যাড ট্রাবল উইথ দি পলিস। কিছুদিন আমাকে জেলেও রাখা হয়েছিল। আমার সময় ছিল না যে কিছু করি।।

তবু সোমেনের মনে হচ্ছিল, ম্যাক্স মিথ্যে কথা বলছে। বললেই বা কী! অণিমার জন্য সোমেনের আর কী আসে যায়! সে তো ভালবাসত না অণিমাকে? এই তো কদিন পরে অণিমা এক সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সঙ্গে বাস করবে, তখনই বা কী করার থাকবে সোমেনের?

তবু সোমেন ম্যাক্সের গলার কাছে জামাটা আলগা হাতে মুঠো করে ধরে বলে—সত্যি কথা বলো ম্যাক্স। আমি জানতে চাই।

ম্যাক্স জিভ দিয়ে চুক চুক একটা শব্দ করল। মাথা নেড়ে বলল—ইউ আর এ চাইল্ড। আমি বিদেশি বলেই তুমি আমাকে সন্দেহ করো সোমেন। তুমি ভাবো, যৌনতার ব্যাপারে আমাদের কোনও বাছবিচার নেই। সেটা সত্যিও বটে।

বলতে বলতে উঠে কনুইয়ের ওপর ভর রেখে একটু কাত হয়ে সোমেনের মুখের দিকে তাকায় ম্যাক্স। বলে—এর আগের বার বেনারসে স্যানক্রিট শেখার জন্য আমি এক পণ্ডিতের কাছে যেতাম। সে লোকটা বুড়ো, কিন্তু খুব স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ। সে লোকটা আমাকে একটা শ্লোক শিখিয়েছিল। তোমাদের যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণে আছে, স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনের আগে স্বামী-স্ত্রীর নাভিতে হাত রেখে বলবে প্রসীদ জগজ্জননী। হে জগতের মা, তুমি প্রসন্ন হও। আমাকে তোমার ভিতরে গ্রহণ করো। আমি যেন তোমার ভিতর দিয়ে পুত্ররূপে আবার জীবন লাভ করি। ওইভাবে আমার সত্তা অনন্ত ও অখণ্ড হোক। ওই হচ্ছে গর্ভধারণের মন্ত্র, প্রসীদ জগজ্জননী। তুমি জানো?

সোমেন মাথা নাড়ল। জানে না।

ম্যাক্স আবার তেমনি চিত হয়ে শোয়। উদায় হয়ে যায় বুঝিবা। গঙ্গার বানডাকা বাতাস বয়ে যায় বুকের ওপর দিয়ে। অনন্ত আকাশ ঝুঁকে আছে মুখের ওপরে উদাসীন ভাবে। সেখানে ফিরোজা রং ধীরে মুছে দিচ্ছে গোধূলির বেলা। নক্ষত্রের জগৎ ভেসে উঠতে থাকে। ম্যাক্স বলে—আমরা সৃষ্টিকর্তা নই সোমেন। আমাদের ভিতর দিয়ে যে পুত্র কন্যারা আসে আমরা তাদের সৃষ্টি করি না। আমরা কেবল প্রজননের উপলক্ষ। যৌনতা আমাদের যে আনন্দ দেয় তা একটা প্রলোভন মাত্র, ওই প্রলোভনে আমরা নারীর সঙ্গে মিলিত হই, কিন্তু আসলে ওই ভাবে প্রলুব্ধ করে প্রকৃতি আমাদের দিয়ে তার কাজ করিয়ে নেয়। উই রিপ্রোডিউস। এ হচ্ছে বায়োলজি। আমি বায়োলজি জানি। কিন্তু যৌনতার কোনও দর্শন আমার ছিল না। দুশো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি, কিন্তু তারা আমাকে শেখায়নি। একটা ছোট্ট শ্লোকে আমি তা শিখে গেছি।

সোমেন অধৈর্যের সঙ্গে বলে—তুমি এত জানো কেন ম্যাক্স?

ম্যাক্স তেমনি উদাসীনভাবে শুয়ে রইল। চোখ বোজা। বলল—তোমাদের জানবার জন্য আমি মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়িয়েছি, গ্রামে-গঞ্জে হাটে-বাজারে পড়ে থেকেছি, ভিখিরিদের সঙ্গে থেকেছি। খুঁজেছি, যতভাবে খোঁজা যায়। বেনারসে একবার একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছি। দুপুরবেলা। আমার টেবিলে একটা ছেলে আর মেয়ে এসে বসল। হিপি টাইপ। ছেলেটির চুল দাড়ি আছে, বিশাল চেহারা। মেয়েটার ভারী কম বয়স। একটু রোগা, সারা গায়ে ময়লা। সে একটা লম্বা ঝুলের ফ্রক পরেছিল। তার ফ্রকের নীচে কাঁচুলি ছিল না, স্তনের বোঁটা ফুটে আছে জামার ওপর। আমেরিকান। তারা ব্যাগ থেকে জ্যাম-এর কৌটো বের করে রুটিতে মাখিয়ে খাচ্ছিল। আমার সঙ্গে কয়েকটা কলা ছিল, আমি তাদের দিলাম। তারা আমার রুটিতে তাদের জ্যাম মাখিয়ে দিল। ওইভাবে পরিচয়। আমাদের কোনও পিছুটান নেই, তাই তক্ষুনি দল বেঁধে ফেললাম। সেই রাতে আমি আমার ধর্মশালা ছেড়ে ওদের ধর্মশালায় গিয়ে উঠলাম। একটু বেশি রাতে মেয়েটা আমার বিছানায় চলে এল। আমি তখন খুব উত্তেজিত ছিলাম, কারণ ওই মন্ত্র তখন আমার ভিতরে ঘুরছে। একটি মেয়ের ওপর ওই মন্ত্রটার প্রভাব লক্ষ করা আমার দরকার ছিল। তখন নিশুতিরাত। মেয়েটি নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে, আমি বসে তার নাভিতে হাত রেখে বললাম—প্রসীদ জগজ্জননী। সে জিজ্ঞেস করল এর অর্থ কী! বুঝিয়ে বললাম। মেয়েটা অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। যৌন মিলনের আগে এ রকম ভারী কথা শুনে সে কেমন হয়ে গেল। নিশুত রাত, এক বিছানায় আমরা দুটি নরনারী, ন্যাংটো। তবু আমরা মিলিত হতে পারছিলাম না। আমি বার বার জিজ্ঞেস করছিলাম—ডু ইউ ফিল লাইক জগজ্জননী? তুমি কি প্রসন্ন হয়েছ? সে বার বার মাথা নেড়ে বলে—ওঃ নো। আই ফিল রেস্টলেস। অবশেষে আমি তাকে বললাম- তা হলে তোমার সঙ্গীর কাছে যাও। ও তোমাকে তৃপ্ত করুক। মেয়েটা আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল—ও লোকটা ইম্পোটেন্ট। আমি ওর কাছে যাব না। অবাক হয়ে বলি—ইম্পোটেন্ট হয়ে থাকলে ওর কাছে আছ কেন? আমেরিকানরা সহজে কাঁদে না। মেয়েটাও কাঁদল না, কিন্তু ওর গলার স্বরে শুকনো কান্না ছিল। বলল—হোয়েন আই ফিল লো অ্যান্ড ডাউন, যখন আমি ভয়ংকর ভাবে ভেঙে পড়ি, তখন ও আমাকে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলে—সোয়ালো ওয়ান, অ্যান্ড ইউ ফিল ডিভাইন। সেই ট্যাবলেট খেলে আমি সত্যিই স্বর্গে পৌঁছে যাই। বুঝলাম, ও ড্রাগ খায়। এল-এস-ডি, ককেইন বা ওইরকম কিছু। আইওয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিল, একদিন হঠাৎ ওর মনে হয়েছিল, বেঁচে থাকাটা বড় একঘেয়ে। মাত্র আঠারো কি উনিশ বছর বয়সে সব রকম যৌন মিলনের আনন্দ সে পেয়েছে, ভাল পোশাক, ভাল গাড়ি, গান, শিল্প, সাহিত্য-সবরকমের আনন্দ উপভোগ করেছে। নেচেছে, সাঁতার কেটেছে, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেছে, দেশ ভ্রমণ করেছে। মৃত্যুশোক পায়নি, প্রেমে ব্যর্থ হয়নি, তবু জীবনটা বড় একঘেয়ে। একদিন মনে হল, জীবনে কিছু নেই। মাথার ওপর পুরনো আকাশ, নদীর ওপর শীতের একঘেয়ে কুয়াশা জমে থাকে, তুষারপাতে ঢেকে যায় সবকিছু, আবার বসন্ত আসে, আসে গ্রীষ্মকাল। একই রকম ভাবে। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চলে অবিরল, স্থির হয়ে থাকে মাথা উঁচু বাড়িঘর। নিত্য নতুন সঙ্গী জোটে, কিন্তু সেই একই রকম লাগে। কিছুতেই বুঝতে পারে না পৃথিবীতে সে জন্মগ্রহণ করেছে কেন! রাত জেগে কখনও-সখ- নও পুঁথির পাতায় খুঁজে হাজারো জবাব পেয়েছে, গেছে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। অবশেষে একদিন এই ছেলেটির কাছ থেকে পেয়ে গেল জবাব। একটা সাদা ইনোসেন্ট ট্যাবলেট। খাও, স্বর্গে পৌঁছে যাবে। কিন্তু মুশকিল এই যে, একবার ট্যাবলেটের স্বর্গে পৌঁছলে আর পৃথিবীকে কিছুতেই অন্য অবস্থায় সহ্য করা যায় না। সেই নেশা কেটে যায় তখনই মনে হয়, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মধ্যে কোনও সুখ নেই; সে বড় দুঃখী। ফালতু মানুষ। নানা দুঃখের হাওয়া এসে বুকে ধাক্কা দেয়। মনে হয় জীবন এক এমন নৌকো যা মৃত্যুনদী ভেদ করে চলেছে। চারদিকে মৃত্যুর বাতাস, মৃত্যুর গন্ধ। বেঁচে থাকা এক প্রগম্ভতা মাত্র। তাই আবার ট্যাবলেট খাও, পৌছে যাও তুরীয় আনন্দে, কুঁদ হয়ে থাকো। সিগারেট, কফি বা মদ কোনও নেশাই এর ধারেকাছে আসতে পারে না। এ নেশা যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ। নেশা কেটে গেলেই দিন দিন পৃথিবী আরও বীভৎস হতে থাকে। মেয়েটা তাই ওর সঙ্গীকে ছাড়তে পারে না। তারা মৃত্যুর চুক্তিতে আবদ্ধ। পৃথিবী জুড়ে মানুষ নানাভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার অস্তিত্ব, তার প্রয়োজনীয়তা, তার জন্মের কারণ। সে চার্চে যায়, শুঁড়িখানায় যায়, মেয়েমানুষের কাছে যায়, সে পৃথিবী লোপাট করে টাকা কুড়িয়ে আনে। সে অসুরের মতো খাটে, নাচে, সাঁতার কাটে। বিপ্লব করে, যুদ্ধে যায়, চাঁদের মাটি কুড়িয়ে আনে। তবু তার নিজের ভিতরে অনড় হয়ে থাকে কুয়াশায় ঢাকা একটু রহস্য—সে কে? সে কেন? এই রাতে ছোট্ট কম্বলের বিছানায় আমরা দুই অনাবৃত নারী-পুরুষ বসে রইলাম। আমাদের মাঝখানে ওই কুয়াশা, ওই রহস্য। আমি তাকে বার বার জিজ্ঞেস করলাম—তুমি কি বুঝতে পারছ তোমার মধ্যেই সৃষ্টির নিহিত রহস্য? তোমার ভিতর দিয়েই আসে প্রাণ? তুমি জগতের জননী? সে মাথা নেড়ে ততবার বলে—না, আই ডোন্ট ফিল লাইক মাদার মেরি। আই ফিল রেস্টলেস। আমি হতাশ হয়ে অবশেষে তাকে জিজ্ঞেস করলাম—তুমি মেয়েমানুষ, এটা অনুভব করো কি? ওইভাবেই রাত কেটে গেল। একটা রাত, হয়তো বা একটা যৌন ব্যর্থতার রাত। পরদিন আমি মেয়েটাকে নিয়ে ধর্মশালা থেকে চলে এলাম, ওর সঙ্গী বাধা দিল না। তাকিয়ে একটু দেখল কেবল। আর একটা বিশ্রি গালাগাল দিল। মেয়েটাকে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। ধর্মশালায়, হোটেলে, রাস্তায়। আমাদের যৌন মিলন হয়নি যে তা নয়। না হলে মেয়েটাকে নিয়ে আমার এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব হত না। বড় রেস্টলেস ছিল মেয়েটি। বেনারসে থাকবার সময়ে সে প্রায়ই আমাকে ফাঁকি দিয়ে তার পুরুষ সঙ্গীর কাছে চলে যেত, ট্যাবলেট খেয়ে আসত। কিন্তু থাকত আমার সঙ্গেই। প্রতি রাতেই আমি তার নাভিতে হাত রেখে বলতাম—প্রসীদ জগজ্জননী। সে মাথা নাড়ত। না। সে কিছু অনুভব করছে না। ড্রাগের নেশাডুদের যে সব দোষ থাকে সবই তার ছিল। মাঝে মাঝে সে আমাকে প্রচণ্ড গালাগাল করত, চিৎকার করত। আবার ট্যাবলেট খেলে তার মুখে চোখে অদ্ভুত তৃপ্তি আর আনন্দ ফুটে উঠত। সে আমাকে প্রায়ই বলত—ম্যাক্স, তুমিও খাবে ট্যাবলেট? খাও, ইউ ফিল ডিভাইন। সে আমাকে ট্যাবলেট দিত।

ম্যাক্স উঠে বসে কেতরে প্যান্টের পকেট থেকে একটা নাইনলের ফোল্ডার বের করে আনে। হাতের তেলায় ঢালে কয়েকটা ট্যাবলেট। আতঙ্কিত সোমেন চেয়ে থাকে।

ম্যাক্স আবার ফোল্ডার রেখে দিয়ে বলে—বয়ে বেড়াচ্ছি। স্মৃতিচিহ্ন। মেয়েটাকে শেষবার দিল্লির হাউজ খাস-এ একটা বাড়িতে গাড়িবারান্দার তলায় ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে চলে আসছিলাম। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ভোরের আবছা আলোয় কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। উওম্যান, মেয়েছেলে। সমস্ত অবয়বে কোনও ঘাটতি নেই। মেয়েমানুষের সব অঙ্গই অটুট। তবু ও ঠিক মেয়েমানুষ নয়। যুদ্ধের সময়ে সোলজারদের একরকম রবারের পুতুল দেওয়া হয়, উইথ ফেমিনিন অর্গানস। ও অনেকটা সে রকম। তবু ও পুতুলও নয়। ও চেঁচায়, গাল দেয়, ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তাই পুরুষেরা ওকে ওই রকমভাবে ফেলে ফেলে যায়। অন্য কেউ এসে ফের তুলে নেয়। কেবল সেই পুরুষ সঙ্গীটি, যে ইম্পোটেন্ট তার সঙ্গেই ও বাঁধা আছে। মৃত্যুচুক্তি। সুইসাইডাল প্যাক্ট। যেখানেই থাকুক, ঠিক তার কাছে ছুটে যায়। কোথায় তার মধ্যে জগজ্জননী! কোথায় প্রসন্নতা! এরপরও অনেকবার অনেক বেশ্যাকে ওই মন্ত্র বলেছি, দু-একজন ভারতীয় মহিলাকেও। তারা হেসেছে। না, তারাও জানে না ওই মন্ত্র। কখনও শোনেনি। বরং আমি ভারতবর্ষে ঘুরে দেখেছি উইমেনস লিবারেশন আন্দোলন চলছে। ইয়োরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েছেলে বলতে আর কেউই প্রায় নেই, যারা আছে অল আর মেন উইথ ফিমেল অর্গানস। মহিলার অঙ্গলক্ষ্মণযুক্ত পুরুষ, তাদের লিবারেশন ঘটে গেছে। তাই পুরুষেরা আর মেয়েছেলে খুঁজে পায় না। পায় যৌন অঙ্গ, আর পার্টনার। সেই হাওয়া আসছে এ দেশেও। পৃথিবী থেকে মেয়েমানুষ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সোমেন। একদিন একটা বাঙালি মেয়েকে টেনিস খেলতে দেখে আমি সোজা গিয়ে তাকে বললাম—তুমি টেনিস খেল কেন? এ তো তোমাদের খেলা নয়। মেয়েটা অবাক। বলে—কী করে বুঝলে যে এ আমাদের খেলা নয়! আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয়, কোথায় যেন ভুল হচ্ছে। ভীষণ ভুল হচ্ছে। মেয়েরা দুনিয়া জুড়ে কী একটা ভুল করছে, তাই এই অবস্থা। একদিন অণিমা বলেছিল—ম্যাক্স, তুমি সমাজপতিদের মতো কথা বললো কেন? মেয়েদের লিবারেশন তোমার ভাল না লাগতে পারে, কিন্তু জেনো মেয়েরা যে বেহায়া হয়ে উঠছে তা পুরুষেরা তাদের ওইরকম চায় বলেই। এখনও মেয়েরা পুরুষদেরই ক্রীতদাসী। তারা যেমন চায় তেমনই হয়ে ওঠে মেয়েরা। তোমরা যদি জগজ্জননী চাও তো মেয়েরা একদিন তাই হবে। একথা শুনে আমি অণিমার প্রেমে পড়েছিলাম। ও যে আমাকে রিফিউজ করেছে তাতেও আমি খুশি। শি ওয়াজ অর্থডক্স। আর, রক্ষণশীল মানুষ আমি খুব পছন্দ করি সোমেন।

সোমেন তর্ক করল না। কেবল শুনল। মাথাটা টালমাটাল। হাওয়ায় শুয়ে থাকতে বড় ভাল লাগছিল। ঠান্ডা বাতাসে একটু জলীয় গন্ধ। বয়ার গায়ে জলের শব্দ। মাঝগাঙ থেকে মাল্লাদের সুর ভেসে আসে কখনও। দেয়ালের মতো উঁচু একটা জাহাজ দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলে যায়।

॥ চুয়াল্লিশ ॥

কাল অণিমার বিয়ে। শাড়ির দামটা এখনও অণিমাকে দেওয়া হয়নি। ভাবলেই লজ্জা করে সোমেনের। পাগলামিটা না করলেও চলত। দেড়শোটা টাকা হুট করে খরচ করা কি তার উচিত? হাতে টাকা নেই বহুদিন। মাসের প্রথমে অণিমাদেরই বাসা থেকে খামে করা একশো টাকা পেয়ে যায় সে, তারপর সারা মাস অনাবৃষ্টি। কী ভীষণ খরচ করতে ইচ্ছে করে সোমেনের, হাত পা নিশপিশ করে খরচ করার জন্য। টাকা থাকলে কত কী করত সে। দাদা, বউদি, মা আর ভাইপো-ভাইঝিদের জন্য রাজ্যের জিনিস কিনত। দিত বাবাকেও, এক আধ প্যাকেট গোল্ডফ্লেক কিনতে ইচ্ছে করে, কিছু বই মাঝে মাঝে ট্রামবাসের ভিড় ছেড়ে ট্যাক্সি করতে। সামান্য ইচ্ছে। কত লোকের কত বেশি টাকা আছে। কিনে শেষ করতে পারে না। কালো টাকা। যাদের নেই তারা আক্রোশে আক্ষেপে গভর্নমেন্টকে গালাগাল দেয় ট্রামে বাসে আড্ডায়। প্রতি বছর বাজেটের খবর বেরোলে হতাশায় দেখে, আবার সিগারেটের দাম বাড়ল, জামাকাপড় মহার্ঘ হয়ে গেল, সিলিং ফ্যান আর কেনা যাবে না। পূর্ব এসপ্ল্যানেডে অবরোধ জোরদার হয়, মিছিল বাড়ে, ছায়াময়ী হতাশার মেঘ গুমোট করে রাখে সারা দেশকে। লাথি মারতে ইচ্ছে করে সোমেনের। লাথিতে লাথিতে ভেঙে ফ্যালে কলকাতা, বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ।

বউদির খোঁজে একবার দাদার ঘরে উঁকি দিল সোমেন। বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। খেয়াল ছিল না, এ সময়ে বউদি টুবাইকে ইস্কুল-বাস থেকে নামিয়ে আনবার জন্য রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় দুজন আরও পরে ফেরে। ফাঁকা ঘরে একা দাদা বসে আছে বিছানায়। উঁকি দিতেই চোখে চোখ পড়ে গেল। দাদার চোখ দুটো কিছু অস্বাভাবিক, ঘোলা এবং উজ্জ্বল লালচে আভাযুক্ত। তাকিয়ে বলল—কে রে? সোমেন?

—সোমেন পরদা সরিয়ে একটু হেসে বলে—কেমন আছো দাদা?

রণেন যেন অবাক হয় প্রশ্ন শুনে। বলে—কেমন থাকব! ভালই আছি। আমার হয়েছেটা কী যে, জিজ্ঞেস করছিস কেমন আছি?

ভুলটা বুঝতে পারে সোমেন। প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। বলল—শরীর খারাপ শুনেছিলাম।

রণেন মাথা নেড়ে বলে—না। বেশ আছি। এরা সব কোথায় গেল? আমাকে এখনও সকালের চা দেয়নি।

সোমেন অবাক হয়ে বলে—তুমি এই ঘুম থেকে উঠলে নাকি?

রণেন ভ্রূ কুঁচকে বলে হ্যাঁ। কেন, খুব বেলা হয়ে গেছে নাকি! বলে টেবিলের ওপর ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে—তাই তো! কেউ ডেকে দেয়নি, অনেক বেলা হয়ে গেছে। ওরা কোথায় গেল?

—বউদি বাচ্চাদের আনতে গেছে। মা পুজো করছে।

রণেন একটু বিরক্তির সঙ্গে চেয়ে থাকে সোমেনের দিকে। তারপর মুখটা বিকৃত করে বলে—বাচ্চাদের ইস্কুলে পাঠাতে বারণ করেছি, তবু পাঠিয়েছে?

সোমেন ঠিক বুঝতে না পেরে বলে—বারণ করেছিলে কেন?

রণেন একটু উত্তেজিতভাবে বলে—রাস্তাঘাটে আজকাল বাচ্চাদের বেরোতে আছে! কলকাতায় কীরকম অ্যাকসিডেন্ট দেখিস না। বলে রণেন পাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে বলে—দ্যাখ, সব দাগিয়ে রেখেছি। কাছে আয়।

সোমেন কাছে গিয়ে দেখে খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় দুর্ঘটনার খবরগুলিতে লাল পেন্সিলের দাগ।

রণেন মুখ তুলে বলে—দেখেছিস?

সোমেন মাথা নাড়ল।

রণেন উত্তেজিতভাবে বলে—কীরকম ভাবে মানুষ মরে যাচ্ছে! আর তোর বউদি কোন সাহসে বাচ্চাদের ঘরের বার করে? যদি কিছু হয়?

সোমেন মৃদু স্বরে বলে—কিছু হবে না। ওরা তো বাস-এ যায়।।

রণেন মাথা নেড়ে সেই ঈষৎ উঁচু গলায় বলে—বাস অ্যাকসিডেন্ট করে না? কে গ্যারান্টি দিয়েছে? বলতে বলতে উঠে ঘরময় পায়চারি করে রণেন। বিড়বিড় করে বলে—আমি ঘুমোচ্ছিলাম, সেই ফাঁকে বাচ্চাদের বের করেছে। কোনওদিন সর্বনাশ ঘটে যাবে। একটাও ফিরবে না।

বলতে বলতে যেন দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখে একটা ঝাঁকি খায় রণেন। দাঁড়িয়ে পড়ে। আবার পায়চারি করে।

সোমেন বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চা-এর কথা মনে পড়তেই বলে—দাঁড়াও, মাকে তোমার চা-এর কথা বলে আসি।

জপের সময় কথা বলেন না ননীবালা। সোমেন পিছনে থেকে বার দুই ডাকল, ননীবালা হাতের ইশারায় ডাকতে বারণ করলেন।

সোমেন একটু ইতস্তত করে। দাদার জন্য সে বহুকাল কিছু করেনি। দাদাকে সে লক্ষই করে না আজকাল। আজ তাই একটু কিছু করতে ইচ্ছে হল।

চা চিনি দুধের ঠিকানা জানে না সোমেন। কেটলিটা রান্নাঘরের ট্যাপ-এর কাছে খুঁজে পেল। গ্যাস উনুন কখনও জ্বালেনি। একটু ভয়-ভয় করছিল, তবু কল ঘুরিয়ে গ্যাস ছেড়ে দেশলাই জ্বেলে দিল।

কেটলি বসিয়ে অনেক কৌটোটৌটো নেড়ে চা-পাতা আর চিনি খুঁজে পেল, দুধের ডেকচিটা মিটসেফ থেকে বের করছিল, এ সময়ে রণেন এসে দাঁড়ায়, বলে—কী করছিস?

—একটু চমকে উঠেছিল সোমেন, হেসে বলল—তুমি ঘরে গিয়ে বসো, আমি চা করে আনছি।।

—তুই করবি! রণেন অবাক হয়ে বলে—গ্যাস ফেটে কত লোক মরে যায় জানিস? বলে মুখ ফিরিয়ে নিল। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে আপনমনে বলল—সিকিউরিটি! সিকিউরিটি! মানুষ তার বেশি আর কিছু চায় না।

এই বলে ঘরে চলে গেল রণেন। ঘরে বসে ভাববে। একা একা কত কথা আর বলবে।

চা-পাতা বেশি পড়ে গেছে, লিকারটা হয়েছে ঘন কাথের মতো। ননীবালা উঠে এসে দেখে বললেন—এই কি পুরুষমানুষের কাজ! বউমা তো চৌপর দিন চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরসংসার ভেসে যায় তো যাক।

চা নিয়ে রণেনের ঘরে ঢুকে সোমেন দেখে দাদা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে। খুব সজাগ ভাব, যেন দূরের কোনও শব্দ শুনবার চেষ্টা করছে কিংবা অস্পষ্ট কোনও গন্ধ শুঁকছে বাতাসে।

চা দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে—ইচ্ছে করছে না। নিয়ে যা।

সোমেন হেসে বলে—তোমার জন্য কত কষ্ট করে করে আনলাম, নাও।

ভ্রূ কুঁচকে আবার রণেন সোমেনের দিকে চায়, বলে—বাসায় কেউ নেই?

—কাকে চাইছ?

—মা।

এমনভাবে মা কথাটা উচ্চারণ করল যেমনভাবে টুবাই ঘুম থেকে উঠে করে। রান্নাঘর থেকে ননীবালার স্বর শোনা যাচ্ছিল, একা-একা বউমাকে বকছিল। সেই স্বরটাই বোধ হয় উৎকর্ণ হয়ে শুনল রণেন। প্রাণে জল এসেছে এমন হঠাৎ-পাওয়ার মতো বলল—ওই তো মা!

—মাকে পাঠিয়ে দেব? সোমেন জিজ্ঞেস করে।

রণেন চায়ের কাপ তুলে চুমুক দেয়। ভ্রূ কোঁচকানো। বলে—মার কত বয়স হয়ে গেল! আর কতদিন বাঁচবে? অ্যাঁ! যদি মরে যায় তা হলে থাকব কি করে মা ছাড়া!

সোমেন বিছানার ওপর বসে দাদার দিকে চেয়ে থাকে। দাদাকে এক প্রকাণ্ড শিশুর মতো লাগে। বলে—ওসব ভাববা কেন?

—ভাবব না? বলিস কী! চা খেয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বলে—সবাই থাকবে আমি চলে যাব, সেটাই ভাল। কারও মরা আমি সহ্য করতে পারব না সোমেন।।

—দাদা।

—যদি মার মরার সময় হয় তো তার আগে মরে যাব।

দাদা একটা সিগারেট ধরায়। নিজের হাতের তালুর দিকে নিবিষ্টভাবে চেয়ে থেকে বলে—মা ম্রিয়স্ব, মা জহি, শক্যতে চেৎ মৃত্যুমবলোপয়।

শ্লোকটা সোমেন বাবার কাছে কতবার শুনেছে। মেরো না, মোরো না, পারো তো মৃত্যুকে অবলুপ্ত করো। পরের দুর্দশা দেখে, মৃত্যু দেখে নিজের দুর্দশা ও মৃত্যুর কথা মানুষের মনে পড়ে। সেটাই দুর্বলতা। যার হৃদয় সবল সে তা ভাবে না, বরং ওই সব অবস্থায় যেন আর কেউ বিক্ষিপ্ত না হয়, তারই উপায় চিন্তা করে। ওই হচ্ছে সবল হৃদয়ের দৃষ্টান্ত, বুদ্ধদেবের যেমন হয়েছিল। বাবা বলতেন। বাবার কথা আজকাল সোমেনেরও বড় মনে হয়। সেদিন যখন ম্যাক্স তার জগজ্জননীর গল্প বলছিল তখনও অস্পষ্টভাবে কেবলই বাবার কথা ভেবেছিল সোমেন। ওই সব মন্ত্র-তন্ত্র ওই সব প্রাচীন ভারতীয় মনোভাবের সঙ্গে যেন বাবার নাড়ির যোগ। বংশধারা বেয়ে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যধারা যেন বা ব্রজগোপাল পর্যন্ত আসতে পেরেছিল বহু কষ্টে। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভারতবর্ষ আর নেই। যে দেশটা পড়ে আছে সে দেশকে লাথি মেরে রসাতলে পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করে কেবল। মনে হয়, লক্ষ্মণদা আমেরিকায় কত মজায় আছে। এরকম পালিয়ে যেতে পারলে বেশ হত। কে চায় ভিখিরি ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব, কে চায় এ দেশের আজন্মমৃত্যু বন্দিদশা?

বউদি ফিরতেই সোমেন আড়ালে ডেকে টাকাটা চাইল৷ ক্ষণকাল বউদি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ রোদে দাঁড়িয়েছিল বীণা। মুখটায় তাই তামাটে রক্তাভা, কপালে ঘাম, ঠোঁটে বিশুষ্ক ভাব। একটু অস্বস্তির সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল—হঠাৎ এত টাকার আবার কী দরকার পড়ল?

—একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। খুব আটকে গেছি। দেবে?

বউদি মুখটা নত করে বলে—তোমার দাদা যদি নর্মাল থাকত তবে কি ভাবতাম ভাই? ও বেরোলেই টাকা। মাইনের টাকা আর কদিন! কিন্তু সে সব তো বন্ধ। আমার লুকনো-চুরনো কিছু থাকতে পারে, কিন্তু বেশি নেই আর, খরচ তো হচ্ছে। দেখি।

মনটা খারাপ হয়ে গেল আবার।

সোমেন একটু ভেবে বলল—আচ্ছা থাক। দেখি, যদি অন্য কোথাও পাই।

বউদি ঘরে চলে যেতে যেতেই হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলল—মার কাছে চাও না। মার তো ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে টাকা পড়ে আছে।

তাই তো! মনে পড়ে গেল সোমেনের। জমির টাকাটা পড়ে আছে এখনও। দাদার অসুখের জন্য পিছিয়ে যাচ্ছে তারিখ। এ ক’টা টাকা মাও দিয়ে দিতে পারে। মায়ের ঘরের দিকে ফিরেও থেমে গেল সোমেন। মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা বাধা। চাইলেই যে মা দেবে তা নয়, অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করবে, সন্দেহজনক সব প্রশ্ন করবে। তারপর সোমেন রেগে গেলে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সুড়সুড় করে চেক কেটে দেবে সেটা সোমেন জানে। কিন্তু বাধা অন্য জায়গায়। টাকাটার ইতিহাস মনে করলে আর চাইতে ইচ্ছে করে না। বাবার কত কষ্টের টাকা! কত বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া। টালিগঞ্জের জমিটুকু ঘিরে কত সুখের স্বপ্ন মায়ের।

সোমেন টাকা চাইল না। বেরিয়ে পড়ল সন্ধেবেলায়। দেড়শো টাকার সমস্যাটা তেমন কঠিন হওয়া উচিত নয়। টাকাটা বাইরে কোথাও থেকে ঠিক পেয়ে যাবে সোমেন।

অনিল রায় স্থলিত গলায় গান গাইছিলেন। অথবা গান গাওয়া এ নয়। গলা সাধাই হবে হয়তো। চাকর দরজা খুলে দিতেই শব্দটা কানে এল। শ্লেষ্ম কিংবা কান্নায় আবিষ্ট গলা, সঙ্গে তানপুরার আওয়াজ, সুর মিলছে না। তিনশো টাকা ভাড়ার চমৎকার সরকারি ফ্ল্যাট, প্রচুর জায়গা। খোলামেলা। প্রথম ঘরটায় একটা গোদরেজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর ডাঁই করা বই, আলমারি ঠাসা কেবল বই। দ্বিতীয় ঘরটা শোওয়ার। সেখানে একটা বেতের চৌকিতে তুচ্ছ বিছানা। মেঝেয় কার্পেটের ওপর তানপুরা হাতে বসে আছেন অনিল রায়, পিঠে কাঁধে প্রচুর লোম, কানের লম্বা লোমগুলো ছেটে ফেলেন অনিল রায়। পাশে মদের বোতল, গেলাস, সোডা, কিছু চিজ লাগানো নোনতা বিস্কুট।

সোমেনকে দেখে তানপুরা শোয়ালেন, গেলাস তুলে নিয়ে বললেন—খাও, ঢেলে নিয়ে খাও। ষষ্ঠী, আর একটা গেলাস দিয়ে যা।

—না স্যার, মা টের পেলে বকাবকি করবে।

অনিল রায় উত্তর দিলেন না। ষষ্ঠী বিনা শব্দে এসে গেলাস রেখে গেল। বাড়িটা অসম্ভব স্তব্ধ। কানে তালা লেগে যায়। নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাওয়া যায়।

অনিল রায় বসে বসেই টলছিলেন। বললেন, তা হলে কফি?

—তা একটু খেতে পারি।

কিন্তু কফির কথা ষষ্ঠীকে বলতে ভুলে গেলেন অনিল রায়। কার্পেটের ওপর এক ধারে একটা পাশবালিশ পড়ে আছে, সেইটাতে ঠেসান দিয়ে বসে বললেন—গান কাকে বলে জানো? অ্যাটমসফেরিক ডান্স অব দি ভয়েস, বুঝলে?

—না স্যার।

—বাংলায় কী বলে! বাংলা নিয়ে আমার বড় মুশকিল। ও ভাষাটা বড় আদুরে বাবু ভাষা। এক্সপ্রেশন হয় না। বলা যায়, কণ্ঠস্বরের আবহনৃত্য। সুরের পাখিরা বেরিয়ে এসে চারদিকে নেচে নেচে বেড়ায়।

সোমেন একটু হাসল।

অনিল রায় হাতের পিঠে ঠোঁট মুছে নিয়ে বলেন—একটু নেশা করে গাইতে বসলে ঠিক টের পাই, পাখিগুলো চারদিকে উড়ে উড়ে নাচছে, নামছে, আনন্দে চিৎকার করছে। তারপর পাখিগুলো ঠোকরাতে শুরু করে। ঠুকরে ঠুকরে খায়। আমাকে খায়। খেয়েটেয়ে কিছুক্ষণ পরে বোধ হয় ভাল লাগে না, আধ-খাওয়া করে ফেলে রেখে যায়। তখন ভারী মুশকিল। আধ-খাওয়া হয়ে পড়ে থাকি, বড় ভয় করে তখন। ষষ্ঠীচরণ ঘুমোয়, আর বাড়িটা খাঁ-খাঁ করতে থাকে। নিজেকে মনে হয় কেবলমাত্র মাতাল, বলে অনিল রায় গেলাস শেষ করেন। আবার সোডার আর মদের মিশ্রণ তৈরি করে নিয়ে বলেন—শালা মাতাল। বাস্টার্ড।

টাকার কথাটা আর ভোলা যাবেনা, সোমেন বুঝল। মাতালদের একটা অন্য চোখে দেখে সোমেন। যেমন সবাই দেখে। মাতাল অবস্থায় কারও কাছ থেকে কিছু চাইতে বা নিতে সংকোচ হয়। মনে হয়, লোকটাকে ঠকাচ্ছি, ওর তো মনে থাকবে না।

অনিল রায় একটু ঝুঁকে বললেন—দেরি করে এলে। চাকরিটায় অন্য লোক নেওয়া হয়ে গেছে। অবশ্য তেমন কিছু নয়, একটা ক্ল্যারিক্যাল জব।

সংবাদ শুনে সোমেন দুঃখিত হল না। ছোটখাটো চাকরির জন্য তার মাথাব্যথা নেই। সে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে চায়, অনেক বেশি খরচ করতে চায়। এ চাকরি না হলেই কী? বলল—ঠিক আছে।

অনিল রায় গেলাস তুলে চোখের সামনে ধরে আছেন। গেলাসের স্বচ্ছ কাচে একটু হলুদ মদ। তার ভিতর দিয়ে সোমেনকে দেখলেন একটু। বললেন দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমার প্রোফাইলটা তো অদ্ভুত। বায়রনের মতো। দাঁড়াও, তোমার একটা ছবি তুলে রাখি।

বলে টলতে টলতে উঠলেন অনিল রায়। বিছানার বালিশের খাঁজ থেকে একটা চামড়ার খাপ টেনে বের করলেন। সোমেন চমকে উঠে বলে—স্যার, ওটা রিভলবার।

অনিল রায় স্তম্ভিত হয়ে হাতের খাপসুদ্ধ রিভলভারটার দিকে চেয়ে থাকেন একটু। একটু ম্লান হেসে মাথা নেড়ে বলেন—তাই তো। দাঁড়াও, ক্যামেরাটাও এখানেই আছে। এ অবস্থায় নত্বসত্ব জ্ঞান থাকে না, বুঝলে।

খুঁজে পেতে খাপসুদ্ধ ক্যামেরাটা বার করেন অনিল রায়। দুর্ধর্ষ জাপানি মিনোল্টা ক্যামেরা। ঝকঝক করছে। ফ্ল্যাশ গান লাগানো, ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে অনিল রায় তাক করছেন। হাত টলছে, শরীর টলছে।

সোমেনেরও বুক টলে হঠাৎ। শেষ বেলায় সবুজ ক্ষেতের ওপর দিয়ে সূর্যাস্তের রং মেখে একটা একা পাখি যেন বহু দূর পাড়ি দিয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘরে। আধো অন্ধকার জমে ওঠা খড়কুটোর বাসা। ওম্‌, নিরাপত্তা, বিশ্রাম। পাখি ফেরে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা আসাহি পেন্টাক্স ক্যামেরার নিপ্রাণ চোখ। অলক্ষ্যে ডেকে ওঠে একটা অন্ধ কুকুর।

অনিল রায় স্থলিত গলায় বলেন—তোমার মুখটা কোথায়? অ্যাঁ! খুঁজে পাচ্ছি না।

সোমেন ম্লান একটু হাসে।

অনিল রায় বলেন—ওঃ, এই তো।…তোমার দুটো মুখ, অ্যাঁ! দুটো!…ডাবল ফেসেড বাস্টার্ড! না না, তোমাকে নয়। নিজেকেই বলছি। এ ডাবল ফেসেড বাস্টার্ড।

দুঃখিত চিত্তে সোমেন ওঠে, অনিল রায় ঝুঁকে পড়ে যেতে যেতে সামলে নেন। ক্যামেরায় চোখ। বলেন—হ্যাঁ। ঠিক আছে। বাঃ!

সোমেন ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। বড় সদর দরজাটা খোলা। চৌকাঠে পা দিয়ে শুনতে পেল, একা ফাঁকা ঘরে অনিল রায়ের গলার স্বর—হ্যাঁ, তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তুমি ফাঁকা, তুমি শূন্য, এ বায়রনিক ভ্যাকুয়াম। ঘাড় ঘুরিও না। ঠিক আছে।

একটা অস্পষ্ট আলোর ঝিলিক ঘরের মধ্যে চমকে উঠল। টের পেল সোমেন। ফাঁকা ঘরে অনিল রায় তার ছবি তুললেন। সোমেন সিড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে এল। রাত হয়ে যাচ্ছে। সময় নেই। মুহুর্মুহু ডাকে এক অন্ধ কুকুর। আসাহি পেন্টাক্স ক্যামেরার একটিমাত্র চোখ চেয়ে আছে প্রতীক্ষায়।

সোমেন যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *