যাও পাখি – ৩৫

॥ পঁয়ত্রিশ ॥

চুপ করে জেগে শুয়েছিল রণেন। পাশে বউ বীণা। ওপাশে বাচ্চারা। পাঁচ বাই সাত খাটে জায়গা হয় না বলে দেয়ালের দিকে একটা বেঞ্চ খাটের সঙ্গে জোড়া হয়েছে। বেঞ্চটার পায়ায় দোষ আছে। বাচ্চাদের কে একজন ঘুমের মধ্যে দাঁত কিড়মিড় করছে। কৃমি। পাশ ফিরতেই বেঞ্চটায় মচাং শব্দ হল। রাস্তায় ঘেয়ো কুকুররা ঝগড়া করছে। সোমেনের ঘরে পুরনো পাখার একটা খটাং খটাং শব্দ হয়। এ সব রণেন একা শোনে। বিশ্বসংসার ঘুমোয়।

রণেনের ঘুম এমনিতে ভালই। স্বপ্ন খুব কম দেখে। নেশারুর মতো ঘুম তার। আজ মনটা বড় খারাপ। সে একবার ঘুমন্ত বীণার গায়ে হাত রাখল। এই মেয়েমানুষটা তার। নিজস্ব। ঘাঁটাঘাঁটি খুব কম হয়নি, তবু কি সবটা চেনা হয়েছে! প্রতিদিন শ্বাসে শ্বাস মিলে যায়, উভয়ের মিলেমিশে তৈরি করা ওই সব সন্তান, তবু দু-জনের মাঝখানে সমুদ্রের ব্যবধান।

ঘুমন্ত বীণার শরীরের সর্বত্র তৃষিতের মতো হাত রাখে রণেন। ঘুমের মধ্যেই বিরক্তির শব্দ করে বীণা হাত সরিয়ে দেয়। একবার অস্ফুট স্বরে বলে—বড় গরম, উঃ!

অপ্রতিভ রণেন বলে—ঘুমোলে?

উত্তর পায় না। বাঁ-হাতের কবজির কাছটায় বড় যন্ত্রণা। ফুলে আছে, টাটাচ্ছে। একটু ডেটল বা কিছু লাগালে হত। পিনটা বের করার পর রক্ত পড়েছে অনেকটা। পেকে ফুলেটুলে ওঠে যদি! আঙুলগুলো কয়েকবার মুঠো করে রণেন। কবজি ঘোরায়, ব্যথা।

বীণা ঘুমন্ত অবস্থায় একবার পাশ ফেরে। তার একটা হাত এসে বুকের ওপর দিয়ে জড়িয়ে ধরে, একটা পা উঠে আসে তলপেটের ওপর। এই ঘুমন্ত আলিঙ্গনটা এখন বড় অস্বস্তিকর। রণেন চায়, এখন তার সঙ্গে কেউ জেগে থাকে। জেগে থেকে আদরে, ভালবাসায় তাকে ঘুম পাড়াক।

বাঁ-হাতির কবজির ওপরেই বীণার শরীরের ভার। হাতটা অবশ হয়ে আসছে। সরার জায়গা নেই। বীণা জেটির দড়ির মতো বেঁধে রেখেছে। ঘরে সবজে রঙের ঘুম-আলোটা জ্বালা আছে। সেই আলোয় একবার বীণার মুখটা দেখে রণেন। শরীর জুড়োলেই কি মেয়েমানুষের প্রয়োজন ফুরোয় পুরুষের কাছে! আর কি চাওয়ার আছে মেয়েমানুষের কাছে? বেশ দেখতে বীণা। মেয়েমানুষের যা যা থাকা দরকার সবই আছে। তবু যেন বেশি কিছু নেই।

রণেন একবার দুঃসাহসে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল—এই।

বীণা বলে—উঃ!

—সরে শোও।

বীণা পাশ ফিরে সরে যায়।

চারদিক থেকে রাতের শব্দ আসে। খাপছাড়া, হঠাৎ শব্দ সব। ইঁদুরের দৌড়-পায়ের আওয়াজ, ইঞ্জিনের ভোঁ, একটা ডাইনামোর আওয়াজ, কাশি, রাস্তায় পায়ের শব্দ, রিকশার ঘণ্টি, রাতচড়া মোটর চলে যাচ্ছে, বহুদূরে কোথায় লাউডস্পিকারে গান হচ্ছে। ঘুম হবে না।

রণেন উঠে মশারি থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরের ঘরে এসে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় সাবধানে। আলো জ্বেলে রেডিয়োগ্রামের খোপে নিবিষ্ট হয়ে খুঁজতে থাকে একটা রেকর্ড। গতবারে খামখেয়ালে কিনেছিল, আছে কিনা কে জানে!

আছে। রবিঠাকুরের নিজের গলায় গাওয়া গানের রেকর্ডটা চাপিয়ে দিয়ে আস্তে ছেড়ে দিল রেডিয়ো। একটু খোনাসুরে, রিক্ত বার্ধক্যের গলায় বৃদ্ধ কবির গান হতে থাকে—অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ…

দুর্বল গলা, সুরের ওপর স্থায়ী হতে পারছে না, দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। স্বাসবায়ুর শব্দ আসছে। তবু হাহাকার ভরা কেমন মরুভূমি ফুটে উঠছে চোখের সামনে। উদ্ভিদহীন এক রুক্ষ ধূসর পৃথিবীর ওপর হাঁটু গেড়ে বসেছে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, শোকে তাপে জর্জরিত অপমানিত, অসহায় মানুষ। তার পোশাক ধুলোয় লুটোচ্ছে। ক্ষীণদৃষ্টি সে-মানুষ অস্পষ্ট আকাশের দিকে চেয়ে দুহাত তুলে বলছে—অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে…

রেকর্ডটা আবার ফিরিয়ে দেয় রণেন। চোখের জল মুছে নেয়। মানুষ যা ছিল তাই আছে। অন্ধ ও মৃত। আকাশের দিকে নিরন্তর বাড়ানো আছে তার দুই হাত। রবিঠাকুর গাও। রবীন্দ্রনাথ গাইতে থাকেন, কাঁপা কাঁপা, বুড়োটে গলায়, অশ্রুহীন শুষ্ক ক্রন্দনের মতো—অন্ধজনে দেহ আলো…

আর সেই শব্দে মুচড়ে ওঠে বুক। ঝলকে ঝলকে নিঙড়ানো বুক থেকে উঠে আসে চোখের জল। টাগরা ব্যথা করে, কান্নার দলা ঠেলে ধরে টনসিলকে। বয়স ভুলে, সংসার ভুলে, হঠাৎ সব ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে ধুলোয় লুটনো শিশুর মতো অসহায়ভাবে ‘মা’ বলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে। কেন কাঁদবে তা তো জানে না রণেন। কেন কাঁদবে? কোনও কারণ নেই। কিংবা হয়তো খুবই তুচ্ছ সেই কারণ। কেবল কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে।

কয়েকবার রেকর্ডটা শুনল রণেন। আরও খারাপ হয়ে গেল। রাস্তায় কুকুরেরা ডাকছে। তাতে যেন আরও নির্জন লাগে কলকাতাকে। আরও ভয়াবহ। বৃশ্চিক রাশির শেষ জীবনটা নাকি ভাল কাটে না। কোষ্ঠীতে রণেনের রাশি বৃশ্চিক নয়, কিন্তু ইংরেজি একটা বইতে সে পড়েছিল, সায়ন মতে জন্মতারিখ অনুযায়ী তার রাশি বৃশ্চিক। শেষ জীবনে সে হয় পাগল হয়ে যাবে, অপঘাতে মারা যাবে। শেষ জীবনের এখনও অনেক দেরি। তবু কেন যে মনে পড়ে!

রাতে ভাল ঘুম হল না, রবিবার সকালটা বাজার করে এসে রণেন তার চার জোড়া জুতোর কালি লাগাল। বাথরুম ঘষল। গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার, টেরিলিন কাচল কয়েকটা। বাচ্চাদের সবকটাকে ধরে ধরে সাবান ঘষে স্নান করাল। কাজকর্মের মধ্যে মন-খারাপটাকে যদি ডুবিয়ে মারা যায়।

পাগল হয়ে যাব না তো! এই কথাটা সারাদিন ধরে মাঝে মাঝে মনে হয়। মরে যাব একদিন! ভেবে চমকে ওঠে সে। স্নানের ঘরে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে রণেন। উৎকট শিস দেওয়ার চেষ্টা করে। গান গায়—অন্ধজনে দেহ আলো…সুরটা লাগে না। মেঠো সুরহীন। গলায় রামপ্রসাদী গানের মতো হয়ে যায় রবীন্দ্রসংগীত।

স্নান করতে করতেই জলের শব্দের মধ্যেই শুনল, কে যেন এসেছে। বাইরের লোকই হবে। কড়া নাড়ার শব্দ। সোমেন ফিরল বোধ হয় আড়া সেরে। না, সোমেন নয়। সোমেন হলে চেঁচাত। বীণা উঁচু বিরক্তির গলায় জিজ্ঞেস করল—কে? না জিজ্ঞেস করে বীণা দরজা খোলে না। দিনকাল ভাল নয়। ছোট ছেলেটাকে বোধ হয় খাওয়াতে বসেছে। ছুটির দিনে আত্মীয়স্বজনরা আসে। বাদুড়বাগানের সম্বন্ধী, কিংবা গড়িয়ার পিসি। তাদেরই কেউ হবে। ছিটকিনি খোলার শব্দ পেল রণেন। নীরস গলায় বীণা আগন্তুককে বলল—ঘরে এসে বসুন। তারপর বাথরুমের দরজার কাছে এসে বলল—শুনছ, বাবা এসেছেন।

বাবা! বাবার কথা ভারী ভুল হয়ে যায় আজকাল। মনেই থাকে না যে বাবা আছেন। কাল একবার মনে হয়েছিল, ঘোষের কথায়। তাড়াতাড়ি জল ঢেলে স্নানটা সম্পূর্ণ করে রণেন। বুকের ভিতরে একটা আকুলি-বিকুলি। মনটা কেবলই বায়নাদার বাচ্চার মতো আপনজনের গন্ধ খুঁজছে। কোথায় আছে মায়ের কোল, বাপের গন্ধ, বউয়ের শরীর। কেউ যেন নেই। বাবা এসেছে শুনে বুকটা তাই কেমন করে উঠল।

গামছা-পরা অবস্থায় বেরিয়েই খানিকক্ষণ বাবার দিকে চেয়ে দেখল রণেন। গায়ে হাফ-হাতা সাদা ফতুয়া, একটু উঁচুতে তোলা ধুতি। শরীরটা বেশ রোগা। বেতের চেয়ারে বসে ধুতির খুঁটে মুখটা মুছছেন। রুমাল রাখেন না। চেয়ারের পাশে মেঝের ওপর রাখা সেই ক্যাম্বিসের ব্যাগ।

মুখ মুছে তাকালেন একটু। কথা বললেন না।

রণেন বলল—এই রোদে বেরিয়েছেন?

ব্রজগোপাল হাসলেন একটু। বললেন—আর সব কোথায়?

রণেন বুঝল, মার কথা বলছেন। বলল—মা তো শীলার কাছেই আছেন। ওর বাচ্চা হবে, কাছে থাকেন।

—ও। আর সোমেন?

—বেরিয়েছে। বসুন, এই সময়ে আসে।

বীণা রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করল—চা খাবেন তো!

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—বরং একটু জল দিয়ো। হাতের কাজ সেরে নিয়ে।

রণেনের কান-মুখ গরম হয়ে ওঠে। রাগে, লজ্জায়। অতিথি তো নয়, বাবা। ভরদুপুরে তাঁকে কেউ চায়ের কথা বলে। বলা উচিত—ভাত খেয়ে যাবেন। কিংবা বলারও দরকার। নেই। ভাত বেড়ে ডাকতে হয়।

লুঙ্গি পরে, চুল আঁচড়ে এসে বসে রণেন। বাবার কাছাকাছি বসতেই যেন একটা শস্য, ফুল আর যজ্ঞমাটির গন্ধ পাওয়া গেল। বীণা পাখাটা খুলে দিয়ে যেতে ভুলে গেছে, রণেন পাখা খুলল। বলল—অনেকদিন বাদে এলেন। শরীরটরীর ভাল তো!

—শরীর ভাল। তবে ওদিককার খবর ভাল না।

—কেন, কী হয়েছে?

ব্রজগোপাল স্পষ্ট কিছু বললে না। কেবল বললেন—কী আর হবে! বহেরুর বয়স হচ্ছে। আমারও। বুড়োরা এবার পা বাড়িয়ে রয়েছি। এই বেলা সব বুঝে না নিলে…

সেই পুরনো কথা। রণেন চুপ করে থাকে।

বীণা হাত ধুয়ে এক গ্লাস জল রেখে যায় টেবিলের ওপর। ব্রজগোপাল জলটার দিকে চেয়ে থাকেন। বলেন—সে যাকগে। আমার অ্যাকাউন্টে এল আই সি’র চেকটা ক্যাশ হয়ে এসেছে নাকি?

—সে তো কবে!

—তা হলে টাকাটা দিয়ে যাই। সেজন্যেই এসেছি। তোমাদেরও জমিটার ব্যাপারে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে খুঁজে খুঁজে হাঁতড়ে দোমড়ানো চেক বইটা বের করলেন বাবা। বুকপকেট থেকে ট্রেনের ফেরিঅলার কাছ থেকে কেনা সস্তা কলম বের করে বললেন—উনি দশ হাজার চেয়েছিলেন, না কি পলিসির পুরো টাকাটাই, তুমি জানো?

রণেন বিপদে পড়ে মাথা নেড়ে বলল—না।

—কার নামে লিখলে ভাল হয়?

—মার তো অ্যাকাউন্ট নেই।

—নেই? বলে একটু দ্বিধায় পড়লেন ব্রজগোপাল।

—আমার আছে।

—তোমার নামে লিখব? বলে ব্রজগোপাল রণেনের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন সংশয় ভরা। যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না।

ভারী অভিমান হল রণেনের। চুপ করে রইল।

ব্রজগোপাল কলম রেখে জলটা খেলেন। কোঁচার খুঁটে মুখ মুছে বললেন—তোমার তো ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা আছে। বরং তোমার মায়ের নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে নাও। বলে একটু চুপ থেকে বললেন—তোমার মাকেই টাকাটা দেওয়ার কথা আমার। তোমার নামে লিখলে কথা রাখা হল না। কাজের সুবিধে হলেও সেটা উচিত হবে না।

—তবে মার নামেই লিখুন।

ব্রজগোপাল তাই লিখলেন। সাবধানে চেকটা ক্রস করে অ্যাকাউন্ট পেয়ি করে দিলেন। রণেন দেখল, ব্রজগোপাল পলিসির পুরো টাকাটাই লিখে দিয়েছেন।

চেকটা হাতে দিয়ে বললেন—তোমার মায়ের হাতে দিতে পারলেই ভাল হত।

রণেন বলল—শীলার বাড়ি তো দূর নয়। খাওয়া-দাওয়া করে নিন, তারপর, একটা ট্যাক্সি করে চলে গেলেই হবে।

ব্রজগোপাল ভারী লাজুক একটু হেসে বলেন—ওখানে যাওয়ার কী দরকার? তুমি ওঁর নামে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিয়ো।

ব্রজগোপালের কাজ ফুরিয়েছে, এক্ষুনি বুঝি চলে যাবেন। ফলে রাতের সেই কান্নার দলাটা আজও ঠেলা দিয়ে উঠল রণেনের টনসিলের কাছে। বাবা চলে গেলেই বড় একা লাগবে। রণেন তাই তাড়াতাড়ি বলল—চলুন না। শীলা অজিতদেরও বহুদিন দেখেননি।

ব্রজগোপাল কী ভেবে চেয়ারে ঠেসান দিয়ে বললেন—তা হলে তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আমি বসছি।

—আপনি খাবেন না?

—আমি! ব্রজগোপাল ভারী অবাক হয়ে বললেন। মাথা নেড়ে বলেন—আমি তো স্বপাক খাই। নিরামিষ। খেয়েই এসেছি।

বীণা ভিতরের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। তাকে ঘিরে ছানাপোনা। সবাই অবাক হয়ে ব্রজগোপালকে দেখছে। বীণা বলল—কিছুই খাবেন না?

সংকোচের সঙ্গে ব্রজগোপাল বললেন—খাওয়ার দরকার নেই। ওই ডানদিকেরটি বুঝি সুপ্রসন্ন? না, কি যেন ওর নাম রেখেছ?

বীণা লজ্জা পেয়ে বলে—মনোজিৎ, ছেলেকে একটু ঠেলা দিয়ে বলে—যাও, দাদুর কাছে যাও।

—এস দাদা। বলে হাত বাড়ান ব্রজগোপাল। তাঁর দুই গর্তে ঢাকা চোখে কী একটা অন্তর্নিহিত পিপাসা ঝিকিয়ে ওঠে। আপনজন! রক্তের মানুষ! উত্তরাধিকার!

ভয়ে ভয়ে বুবাই এক-পা দু-পা করে এগিয়ে আসতে থাকে। এই বুড়ো মানুষটা তার দাদু, সে জানে। কিন্তু পবিচয়হীনতার দূরত্বটুকু পার হতে সময় লাগে তার।

ব্রজগোপাল নিচু হয়ে ক্যাম্বিসের ব্যাগ তোলপাড় করে কাগজে মোড়া এক ডেলা আমসত্ত বের করে আনেন, একটা ঠোঙায় কিছু শুকনো কুল, আমসি, প্লাস্টিকের ঠোঙায় কিছু ক্ষোয়া ক্ষীর। নাতির হাতে দিয়ে বলেন—সবাই খেয়ো।

নাতির পিঠে একবার হাত রাখলেন। কোলে নিলেন না। অভ্যাস ভাল নয়। ফিরে গিয়ে মনটা আবার গর্ত খুঁড়বে। পিঠে হাতটা রেখে বললেন—যাও, মায়ের কাছে যাও।

খেয়ে নিতে একটুও সময় নষ্ট করল না রণেন। ঘরের মধ্যে তার হাঁপ ধরে আসছে। একটা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এসে বলল—চলুন।

চেকটা টেবিলের ওপর পড়েছিল। ব্রজগোপাল সেটা সযত্নে ভাঁজ করে ভিতরের পকেটে রাখলেন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললেন—তোমাদের জমিটাও ওইখানেই?

—হ্যাঁ, জমিটাও দেখা হয়ে যাবে আপনার। রণেন বলে।

—আমি দেখে কী করব! তোমরা থাকবে, তোমাদের পছন্দ হলেই হল।

রণেন উত্তর দিল না।

বেরোবার মুখে দরজার কাছ বরাবর একটু দাঁড়ালেন ব্রজগোপাল। ইতস্তত করে বললেন—সোমেন এল না এখনও? রোজ এরকম বেলা করে নাকি!

বীণা হেসে বলে—কিছু ঠিক নেই।

—ভাল কথা নয়। অনিয়ম করে এ বয়সে শরীর ভাঙলে খুব বিপদ। চাকরিবাকরি কিছু হয়নি?

—না। বীণা উত্তর দেয়।

ট্যাক্সিতে বসে রণেন বলে—বাবা।

ব্ৰজগাপাল অন্যমনস্ক ছিলেন। উত্তর দিলেন না। কিন্তু হঠাৎ মুখটা ফিরিয়ে বললেন—ট্যাক্সিতে চড়ে পয়সা নষ্ট করো কেন? এ বয়সে আয়েশি হলে শরীর বসে যায়, মনটাও আলসে হয়।

—বাসে-ট্রামে চড়া যায় না। বড় ভিড়।

—তোমরাই ভিড় বাড়াচ্ছ। ভিড় তো তোমাদেরই। বলে আবার মুখটা বাইরের দিকে ফিরিয়ে বলেন—কলকাতায় যারা থাকে তারা ক্রমে মানুষকে ঘেন্না করতে শেখে। এ বড় পাপ।

রণেন আবার ডাকল—বাবা।

—উঁ! বলে ব্রজগোপাল মুখ ফেরালেন।

রণেনের তখন বড় লজ্জা করল। কী বলবে? বাবাকে তার কিছু বলার নেই। মুখে পান ছিল। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল—বাড়িটা যদি হয় তো আমাদের কাছেই এসে থাকুন।

ব্রজগোপালের ভিতর যে অভিমানী কঠিন মানুষটির বাস সেই মানুষটিই যেন ঈষৎ উষ্মভরে জবাব দেন—কেন?

ঠিকই তো। কেনো? বাবা কেনো থাকবেন তাদের সঙ্গে!

ব্রজগোপাল আরও কিছুক্ষণ আলগা চোখে বাইরের দিকে কলকাতার অপসৃয়মান বাড়িঘর দেখলেন। গাড়ি আনোয়ার শা রোড ধরে শীলাদের বাড়ির গলির কাছাকাছি এসে পড়ল। ট্যাক্সি থামলে ব্রজগোপাল হঠাৎ চমকে উঠে বললেন—এসে গেলাম নাকি!

—হুঁ। রণেন নেমে ভাড়া দিতে দিতে বলে। এবং টের পায়, বাবা এখনও মায়ের সাহচর্যে আসতে কত লাজুক ও অপ্রতিভ হয়ে যান। বাবা ও মার মধ্যে তবে কি ভালবাসা আছে আজও?

॥ ছত্রিশ ॥

অজিত দরজা খুলে ভারী অবাক হয়। শ্বশুরমশাইকে তার বাড়িতে সে একদম প্রত্যাশা করেনি। তারওপর দুপুরের কাঁচা ঘুম থেকে উঠে এসেছে, ভারী থতমত খেয়ে গেল। এ সময়টায়, বিশেষত ছুটির দুপুরে সবাই ঘুমোয়।

ব্রজগোপালের মুখে-চোখে একটু অপ্রসন্নতার ছাপ। বললেন—আছে সবাই?

—আসুন। বলে দরজার পাল্লা হাট করে দিয়ে বলে অজিত—ঘুমোচ্ছে। ডাকছি।

ব্রজগোপাল ঘরে এসে বসলেন। চারদিকে চেয়ে-টেয়ে বললেন—ভালই।

অজিত সেন্টার টেবিল থেকে সন্তর্পণে তার সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার সরিয়ে নিচ্ছিল। ব্রজগোপাল সেটা নিশ্চয়ই চোখে দেখলেন। অজিত তাঁকে অন্যমনস্ক করার জন্য বলল—কী ভাল? বাড়ি?

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বললেন—ঘরদোর তো বেশ বড় বড় দেখছি। কখানা?

—দুটো বেডরুম আছে দুদিকে। একটা প্যাসেজ, আর যা যা সব থাকে। বলে হাই তুলল।

রণেন একটু দূরে বসেছে। এতক্ষণে কথা খুঁজে পেয়ে বলল—ওরা দোতলা করে নীচের তলাটা ভাড়া দেবে।

ব্রজগোপাল উদাস গলায় বলেন—লাভ কী?

—বাড়ির কষ্টটা খানিকটা উঠে আসে।

—ভাড়াটেদের সঙ্গে থাকা সঙ্গত নয়। ব্রজগোপাল তেমনি নিশ্চিত স্বরে বলেন—বাড়ির বড় মায়া। পরমানুষ দেয়ালে পেরেক ঠুকলেও বুকে লাগে।

—আমিও ভাবছিলাম, বাড়িটা যদি হয় তো তিনতলার ভিত গেঁথে করব। একতলাটা ভাড়াটে, দোতলা আর তিনতলায় আমরা।

ব্রজগোপাল একবার ছেলের মুখ নিরীক্ষণ করলেন। তারপর মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন—তোমরাই থাকবে, তোমাদের যা ইচ্ছে।

অজিত ভিতরের ঘরে এসে দেখে শীলা এক কাত হয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছ। এ সময়টায় চেহারা রুক্ষ হয়ে যায়, মুখে মেচেতার মতো দাগ পড়ে। চোখ বসা, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে। কিছু পেটে রাখতে পারে না, সব উলটে বের করে দেয়। তা হোক। তবু পেটের বাচ্চাটিকে ধরে রাখতে পেরেছে। নষ্ট হয়নি শেষ পর্যন্ত। ঘুমন্ত শীলাকে ডাকতে বড় মায়া হয়। পাশেই শাশুড়ি ঠাকরুন গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমের মধ্যেও মাথায় ঘোমটা।

অজিত গলাখাঁকারি দিল। শাশুড়িকে মা বা শ্বশুরকে বাবা বলে ডাকার অভ্যাসটা তার এখনও হয়নি? শীলা সেজন্য রাগ করে। বলে—তোমার মা-বাবাকে আমি মা বাবা ডাকতে পারি, আর তুমি আমার মা-বাবাকে পারো না? অজিত অবশ্য ঝগড়া করে না, কিন্তু ডাকেও না।

অজিত গলাখাঁকারি দিতেই অবশ্য ননীবালা মুখখানা সন্তর্পণে তুলে বললেন—কে এসেছে? বাইরের ঘরে আওয়াজ পাচ্ছি।

অজিত ইতস্তত করে বলে—উনি।

ননীবালাকে আর বলতে হল না। বুঝলেন। যেন উনি বলতে বিশ্বসংসারে একজনই আছে। শীলাকে একটু ঠেলা দিয়ে বললেন—ওঠ্‌।

শীলা আদুরে ঘুম-গলায় বলে—উঁ।

—উনি এসেছেন। উঠতে হয়। তোর বাড়িতে প্রথম এলেন।

ঘুম থেকে উঠলেই একটা সিগারেটের তেষ্টা পায়। অজিত তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট টেনে নিতে থাকে দ্রুতবেগে। পরশুদিন একটু বৃষ্টি হয়েছিল। সামান্য বৃষ্টিতেই সামনের রাস্তার ধুলো ধুয়ে পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে। খাটালের জমানো গোবরের টাল থেকে পচাটে গন্ধ আসে। ওপরে ধুলোটে আকাশ। ফরসা রোদ। শুকনো গরম হাওয়া দিচ্ছে। বহু ওপরে আকাশের গায়ে দাগের মতো বড় পাখি চিল বা শকুন উড়ছে। ভারী নিরালা দুপুর। আকাশে চড়ানো ডানামেলা পাখি, রোদ, বিস্তার দেখে অজিতের মনটাও নিরালা হয়ে যায়। আত্মীয়স্বজন আজকাল তার ভাল লাগে না। আগেও লাগত না। মা বাবা ভবানীপুরের সংসার ছেড়ে এসে আরও নিষ্ঠুর হয়ে গেছে সে। বাড়িতে আত্মীয় এলে তার অকারণ উৎপাত মনে হয়। কথা বলতে হবে, সামনে গিয়ে বসে থাকতে হবে, সিগারেট লুকোতে হবে। কিংবা আবার ভদ্রতা রক্ষার জন্য কখনও-সখনও যেতে হবে তাদের বাড়িতেও। ভাবতেই ক্লান্তি লাগে। নিজের মতো নিরালা জীবন পাওয়াটাই সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার কাছে।

তাড়াতাড়ি জোরে টান দেওয়ায় সিগারেটটা তেতে গেছে, ধোঁয়া আসছে না। সেটা ফেলে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিল সে। যতক্ষণ সময় কাটানো যায়। জলের ঝাপটা চোখেমুখে দিতে গিয়ে এক কোষ জল নাকে ঢুকে দম আটকে দিল। অস্বস্তি। জলের গন্ধে কী যেন একরকম লাগে। বুকচাপা নিঃসঙ্গতা। অজিত জানে, পৃথিবীতে তার কেউ নেই। একদম কেউ না। ছিল লক্ষ্মণ। তাকে একা করার জন্যই ভগবান বুঝি তাকে দূরে নিয়ে গেলেন। অবশ্য ভগবান মানে না অজিত, ভাগ্যও না। তবু ওইরকম মাঝে মাঝে মনে হয়। কার অদৃশ্য হাত তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুটিকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। তাকে একাকীত্বে রেখে দেখার জন্যই বুঝি!

বাথরুমের দরজাটা ভেজানো ছিল। সেটা ধাক্কা দিয়ে অধৈর্য হাতে খুলে শীলা ঢুকল। বলল—ইস্‌, বাথরুমে এত দেরি কেন, মেয়েদের মতো? বাইরে যাও।

ধীরেসুস্থে অজিত তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে—তাড়া কীসের?

—ভীষণ পেয়েছে। তুমি যাও তো, বাবা বসে আছেন। মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে প্রথম এলেন, জামাইয়ের পাত্তা নেই। শীলার গলায় যথেষ্ট রাগ।

ডাক্তারের মত নিয়ে শীলা আজকাল ইস্কুলে যায়। রিকশায় করে। একবার বাইরের স্বাদ পেলে মেয়েরা আর ঘরবন্দি থাকতে চায় না। হাঁপিয়ে ওঠে। কদিন আগে সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে অজিত একটু অবাক হয়ে দেখে, বাইরের ঘরে একটা অপরিচিত ছেলে বসে আছে। ভারী সুন্দর চেহারা, আর ভীষণ স্মার্ট। শীলা পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম সুভদ্র। বলল—শোভনাদির লিভ ভ্যাকেন্সিতে চাকরি করছিল আমাদের স্কুলে। শোভনাদি ফিরে এসে জয়েন করেছেন, বেচারির চাকরি গেছে। এখন তোমার কাছে এসেছে, যদি তুমি ওকে এ আই সি’র একটা এজেন্সি পাইয়ে দাও।

একটু অবাক হয়েছিল অজিত। এল আই সি’র এজেন্সি পাওয়া কোনও শক্ত ব্যাপার নয়। ধরা করার দরকার হয় না। তা হলে তার কাছে আসা কেন। সে-রহস্যের ভেদ হল না বটে কিন্তু ছেলেটাকে বেশ ভাল লেগে গেল। এ ছেলেটা খুব সুন্দর বটে কিন্তু নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন নয়। গালে দাড়ি আছে, লালচে রকম গোঁফ আছে একটু। পোশাক-আশাকে সাধারণ। চমৎকার কথা বলে। ভীষণ হাসায়। টকটকে ফরসা রং, লম্বা এবং গোরাটে চেহারার মধ্যে আবার একটু বাচ্চাদের মতো লাজুকতাও আছে।

যতক্ষণ সুভদ্র ছিল ততক্ষণ শীলার চেহারাই অন্য রকম। চোখেমুখে একটা উত্তেজিত চকচকে ভাব। ঠোঁটে হাসি, মুখে অনর্গল কথা। বারোটা মিষ্টি সব যত্ন করে সাজিয়ে দিল। লম্বা সোফাটায় সুভদ্র বসেছিল, অন্য ধারে বসল শীলা। নিঃসংকোচে। কোনও হাসির কথা উঠলে ঝুঁকে সুভদ্রকে ঠেলা দিয়ে বলছিল—এই সুভদ্র, বলুন না সেই নক্সালাইটরা ইস্কুলে বোমা ফেললে অচলাদি আর দীপ্তিদি কেমন করে পায়খানায় ঢুকে গিয়েছিলেন, আর ঢুকেই দেখেন সেখানে পণ্ডিতমশাই…হি…হি….

রাত ন’টা পর্যন্ত সুভদ্র ছিল। ততক্ষণ শীলাকে মনে হচ্ছিল একটি কুমারী মেয়ে। শরীরে কোনও অস্বস্তি নেই। কোনও সম্পর্ক নেই অজিতের সঙ্গে।

সুভদ্র চলে গেলে এ বাড়ির ভূতটা নেমে এল। তখন শাশুড়ি ঠাকরুন ছিলেন না। শুধু অজিত আর শীলা থাকলে এ বাড়িতে ভূত নামে। সে ভূতটার নাম গাম্ভীর্য। কথার শব্দ নেই, হাসির শব্দ নেই, ফাঁকা নিঃসঙ্গতা শুধু। শীলার শরীর তখন খারাপ লাগতে লাগল বলে গিয়ে শুয়ে রইল ঘর অন্ধকার করে। পাশের ঘরে অজিত নতুন কেনা একটা ফাঁকা কাচের টিউব থেকে অন্তহীন রুমাল বের করতে থাকল। দর্শকহীন ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাজিকের প্যাটার মুখস্ত বলে যেতে যেতে একটা জাম্বো কার্ডের খেলা দেখাতে লাগল নিজেকে। ম্যাজিক মানেই হাত, চোখ, মুখ, ভঙ্গি আর কথার কৌশল। জীবন মানেও কি তাই নয়? কিন্তু সেইসব কৌশল অজিতের জানা নেই। তাই বাড়িতে ভূত নামে। অনেকক্ষণ ম্যাজিক করে ক্লান্ত অজিত সিগারেট ধরিয়ে একা বাইরের ঘরে এসে বসে থাকল। ঘরে আলো জ্বালেনি, পাশের ঘর থেকে আবছা আলো আসছে। বসে থেকে থেকে সে টের পেল, এ বাড়ির ভূতটা সে নিজেই। ভূত মানে, যে ছিল, এবং এখন আর নেই। অজিত তো তাই। সে ছিল, সে এখন আর নেই, নইলে ওই যে সুন্দর চেহারার ছেলেটা, সুভদ্র, ওর কারণে একটু হিংসে হতে পারত তার। একটু সন্দেহ। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। বরং অজিত ভাবছিল, শীলা আর কাউকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বড় ভাল হয়। সে নিজে আর একটু আলগা হতে পারে, আর একটু একা। একা হওয়া কী ভীষণ ভাল। আহা, শীলা ওই ছেলেটার সঙ্গে হালকা একটু প্রেম করুক না। ক্ষতি কী?

জীবন মানেও একরকম কৌশল। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা দুজনেই ভারী নিস্তেজ, পরস্পর সম্পর্কে কৌতুহলহীন। তাই মাঝে মাঝে নিজেকে একটু উসকে নেয় অজিত, শীলাকেও উসকে নেয়। এইভাবে অনুভব করার চেষ্টা করে যে, তারা সম্পর্কিত, তারা আছে।

বাথরুমের বাইরে যাওয়ার জন্য শীলা তাড়া দিচ্ছিল, অজিত র‍্যাকে তোয়ালেটা রেখে বেসিনের ওপর ছোট আয়নার দিকে চেয়ে আঙুলে চুল পাট করতে করতে বলল—লজ্জা কী, বসে পড়ো না। আমি দেখছি না।

—সে খালি বাড়িতে। এখন দেয়ালা কোরো না। বাইকে যাও তো শীগগির। কেউ এসে পড়লে…ছি ছি…

অজিত গম্ভীরভাবে বলল—শোনো, একটা কথা।

—পরে হবে। উঃ। বাবা বসে আছেন, দাদা মা…তুমি একটা কী বলো তো!

—কী?

—এখন যাও না।

—আমার কানে কয়েকটা উড়ো কথা এসেছে শীলা।

—পরে শুনব।

—না, এখনই। সুভদ্রর সম্পর্কে…

শীলা হঠাৎ যেন থমকে গেল। গলার স্বরটা হয়ে গেল অন্যরকম। বলল—কী কথা? কী শুনছ?

—তোমার সঙ্গে সুভদ্রর রিলেশনটা…

—কীরকম?

—লোকে বলে।

—কে লোক?

—আছে। তুমি চিনবে না।

বাথরুমের ঝুঁঝকো আলোয় শীলা কেমন ছাইরঙা হয়ে গেল। অবাক বড় চোখ, ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে, ক্ষতচিহ্নের মতো।

—তারা কী বলেছে? শীলা নরম গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে।

শীলার চেহারা দেখে অজিত ভয় পেয়ে গেল। ঠাট্টার এমন প্রতিক্রিয়া হবে, এতটা পালটে যাবে শীলা তা সে ভাবেনি। হাত বাড়িয়ে বলল—কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি!

—তুমি ও কথা বললে? শীলার গলায় মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কাঁদবে।

—কিছু না। কেউ কিছু বলেনি। বলল অজিত। কিন্তু গলায় কোনও আন্তরিকতা ফোটাতে পারল না। মাঝে মাঝে মানুষের বড় ভুল হয়ে যায়। গলা খাঁকারি দিয়ে অজিত বলে—ঠাট্টা করছিলাম। আমি যাচ্ছি।

ম্লান মনে বেরিয়ে এল অজিত। হঠাৎ বুঝতে পারল, সে যে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছে তী শীলাকে কোনওদিন বিশ্বাস করানো কঠিন হবে। কিন্তু ঠাট্টাটা কী? অজিতের মনেও কি কিছু ছিল না!

সম্পূর্ণ আনমনা অজিত বাইরের ঘরে এসে দেখল তার শ্বশুর ব্রজগোপাল লাহিড়ি তার শাশুড়ি ননীবালা লাহিড়ির হাতে মোটা টাকার চেক তুলে দিচ্ছেন। দৃশ্যটা অনেকটা খবরের কাগজের ছবির মতো, কোনও সংস্থার পক্ষ থেকে কেউ যখন বন্যাত্ৰাণ বা ওইরকম কিছুর জন্য রাজ্যপাল বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে চেক তুলে দেয়, স্রেফ পাবলিসিটির জন্য। বিজ্ঞাপন দেওয়ার চেয়ে সংবাদে নাম তোলা অনেক বড় বিজ্ঞাপন। আজকাল সবাই সংবাদ হতে চায়। পারিবারিক ক্ষেত্রে ব্রজগোপালও এখন সংবাদ। শেষ পর্যন্ত টাকা তিনি দেবেন এমন বিশ্বাস অনেকেরই ছিল না। কিন্তু এই মুহুর্তে চেকটা দেওয়ার সময়ে তাঁর ভাবমূর্তিটা বেশ বড়সড় হয়ে উঠল। ননীবালা বাঁ-হাতে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন—রণোর নামে দিলেই তো পারতে!

ব্রজগোপাল রক্তাভ লাজুক মুখে বললেন—তোমাকেই দেওয়ার কথা ছিল।

শ্বশুরকে বহুকাল বাদে একটু মন দিয়ে দেখল অজিত। ক্ষ্যাপাটে, বাতিকগ্রস্ত বুড়ো। তবু মুখের ওই রক্তাভাব যে লাজুকভাব, যে চাপা অস্থিরতা তার মধ্যে একটা গভীর মমতাময় হৃদয়ের চিহ্ন আছে। বুড়ো মানুষরা চিঠির শেষে পাঠ লেখে ইতি নিত্য শুভাকাঙ্ক্ষী অমুক। সেটা কথার কথা। কিন্তু এই লোকটার শরীরের মধ্যে যেন সেই কথাটা গোপনে ভোগবতীর মতো বয়ে যাচ্ছে—নিত্য শুভাকাঙ্ক্ষী।

ননীবালার চোখে বুঝি জল এল আবার। প্রায় রুদ্ধ গলায় বললেন—বাড়িটা যদি হয় তাহলে…

বলে একরকম প্রত্যাশায় তাকালেন স্বামীর দিকে। ঘোমটাটা আর একটু টেনে মুখখানা প্রায় ঢেকে বললেন—রণো বলছিল, বাড়ি করলে বাবার জন্য একটা আলাদা ঘর করব।

কথাটায় ইঙ্গিত ছিল। নিরুদ্দিষ্টের প্রতি আহ্বান।

ব্রজগোপাল একটু চেয়ে রইলেন ননীবালার দিকে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন—কতকাতায় আর না। তোমরা থাকো। গোবিন্দপুর ছেড়ে আসা হবে না। তা হলে সব দেখবে কে?

ননীবালা উত্তর দিলেন না। রণেন চুপ করে বসে আছে। কিংবা ঠিক চুপ করেও নেই। তার ঠোঁট নড়ছে নিঃশব্দে। আপনমনে কথা বলছে নাকি?

অজিত সকলের কাছ থেকে দূরে। ঘরের কোণে একটা গদি আঁটা শান্তিনিকেতনি মোড়ায় বসে রইল। ব্রজগোপালের দিকে চোখ। এ লোকটাকে তার বড় হিংসে হয়। সব থেকেও কেমন একা, আলগা। হৃদয়হীন বলে মনে হয়। মনে হয়, বুঝি সন্ন্যাসী।

সে যাইহোক, লোকটা সংসারকে লাথি মারতে পেরেছে। বুকের পাটা আছে এ বয়সেও।

উৎকর্ণ হয়ে বসেছিল অজিত। বাথরুমে শীলা অনেকক্ষণ সময় নিচ্ছে। বড় ভয় হয়। পাঁচ মাসের পেট নিয়ে, যদি পড়েটড়ে যায়। ঠাট্টাটা করা ঠিক হয়নি।

আবার অজিত ভাবে, ঠাট্টা! ঠাট্টাই কী! আর কিছু নয়? উৎকর্ণ হয়ে থাকে। এ বাড়ির নিঃসঙ্গতার ভূতটা কখন যে কার ঘাড়ে ভর করে কী অনর্থ ঘটায়! সেই নিঃসঙ্গতা ভাগিয়ে দেওয়ার জন্য একজন আসছে। উগ্র আগ্রহে অপেক্ষা করছে অজিত। শীলা, পড়েটড়ে যেয়ে না, সাবধান! মন খারাপ কোরো না, ওটা একটা ভূতুড়ে ইয়ারকি।

ব্রজগোপাল চেক-দান অনুষ্ঠানের ভাবগম্ভীরতা থেকে হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে চারদিকে চেয়ে বললেন—শীলুকে দেখছি না!

ননীবালা ডাকলেন—অ শীলা।

—বাথরুমে। জবাব দিল অজিত।

—ও। ব্রজগোপাল খানিক চুপ করে থেকে বললেন—শীলুর বাড়িতে এলাম, অথচ ওর জন্য হাতে করে কিছু আনিনি।

—কী আনবে! ননীবালা বলেন।

— বাচ্চাদের কাছে আসতে বাপের কিছু হাতে করে আনতে হয়। ব্রজগোপাল বলেন।

—ওরা কি বাচ্চা! ত্রিশের কাছে বয়স হল। বলেন ননীবালা। একটু হাসলেনও বুঝি।

বড় হয়েছে! বলে ভ্রূকুটি করেন ব্রজগোপাল। যেন বা তাঁর বাচ্চারা যে বড় হয়েছে এটা তাঁর বিশ্বাস হয় না। তিনি জানেন, ওরা এখনও ভুলে ভরা, বায়নাদার, অবুঝ শিশু তাঁর। বড় হয়নি, একদম বড় হয়নি।

বাচ্চা ঝিটা বাইরে থেকে মিষ্টি নিয়ে ঘরে এল। রান্নাঘর থেকে চায়ের জলের শিস শোনা যাচ্ছে। শীলার এবার বাথরুম থেকে বেরনো উচিত।

ব্রজগোপাল জামার ভিতরের পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে অজিতের দিকে চেয়ে বললেন—তোমরা মিষ্টি খেয়ো।

অজিত হাসল, বলল—না, না। সে কী!

রণেন দৃশ্যটা দেখে হাসল। ননীবালাও হেসে বললেন—ওরা কি আর সেই ছোটটি আছে যে বাপ মিষ্টি খেতে টাকা দেবে!

ব্রজগোপাল নিপাট গম্ভীর চোখে চেয়ে বললেন—নাও।

হাতটা বাড়িয়ে রইলেন। অজিত বাচ্চা ছেলের মতো লাজুক ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল। কিছু বলার নেই।

—উঠি। ব্রজগোপাল বলেন।

—বসুন! চা হচ্ছে। অজিত বলল।

—পরমানুষের মতো কেবল উঠি-উঠি ভাব কেন? শীলা আসুক। ননীবালা এই বলে মুখের পানের ছিবড়ে ফেলে এলেন জানালা দিয়ে।

অজিত উৎকর্ণ হয়ে আছে। শীলার কোনও শব্দ নেই। বড় দেরি করছে শীলা। এত দেরি হওয়ার কথা নয়।

॥ সাঁইত্রিশ ॥

ব্রজগোপাল আর ননীবালা কথা বলছেন। সেই ফাঁকে নিঃশব্দে উঠে গেল অজিত। নিঃশব্দ পায়ে বাথরুমের দরজার কাছে চলে এল। ভিতরে কলের জল বয়ে যাওয়ার শব্দ। খুব মৃদু দুটো টোকা দিল অজিত। সাড়া নেই। আর একটু জোরে টোকা দিতেই আটকানো কপাটের পাল্লা নরমভাবে একটু খুলে গেল। ভিতরে অন্ধকার। অজিত কাছেপিঠে কেউ নেই দেখে ঢুকে গেল ভিতরে।

শীলা বেসিনের ওপর উপুড় হয়ে আছে। বাড়ানো হাতে দেয়ালে ভর। হিক্কার মতো শব্দ করছে। গলায় আঙুল দিয়ে একঝলক বমি করল। পিছন থেকে অজিত পিঠে হাত রাখে। অন্য হাতে মাথাটা ধরে শীলার। বমির সময় কেউ মাথা চেপে ধরে রাখলে কষ্ট কম হয়।

কিন্তু বমি আর এল না। শীল জলের ছাঁটে চোখ মুখ ভিজিয়ে নিতে থাকে। অজিত মৃদু গলায় বলে—শ্বশুরমশাই বসে আছেন। তাড়াতাড়ি করো।

জলে ভেজা মুখটা ফেরাল শীলা। তীব্র, সজল, বড় বড় চোখ। একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে—আমি যাব না।

অজিত বুঝল, রেগেছে খুব। বলে—বিশ্রী দেখাচ্ছে কিন্তু। চলো। ওঁরা অপেক্ষা করছেন।

একটু ক্লান্তির স্বরে শীলা বলে—তুমি যাও।

অজিত বলে—যাচ্ছি। দেরি কোরো না, প্লিজ।

বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, ঠিক এ সময়ে শীলা নাটুকে ভঙ্গিতে হাতটা বাড়াল। বলল—ওগো!

অনেকটা আর্তস্বরের মতো ডাক। অজিত একটা শ্বাস ছাড়ল মাত্র। এটা দেয়াল। নইলে ও এমন কিছু অসুস্থ নয় যে, হেঁটে ঘরে যেতে পারবে না। এ অবস্থায় বমি কে না করে! গত চার মাস ধরে শীলাও করছে।

অজিত একটু কুণ্ঠিতভাবে বলে—কী?

—ধরো। পারছি না। শীলা হাত বাড়িয়ে চেয়ে আছে। অভিমান ঘনিয়ে আসছে চোখে।

অজিত বিরক্তি চেপে বলে—বাইরের ঘরে শ্বশুরমশাই। দেখতে পাবেন।

শীলা সেটা শুনল না। জীবনের শেষতম প্রশ্নের মতো গভীর গলায় বলে—ধরবে না?

আর একটা অসহায় শ্বাস ছেড়ে অজিত হাত বাড়িয়ে শীলার কোমর ধরল। শীলার ভেজা হাত বেষ্টন করে তার কাঁধ, খুবই ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি। এইভাবেই তারা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। পুরো নাটক। শীলা হঠাৎ মুখটা তুলে কাঁধে মুখ ঘষে কান্নায় ধরা গলায় বলে—তুমি কী নিষ্ঠুর!

সব স্ত্রীই স্বামীকে এই কথা বলে। কারণে, অকারণে। তবু শীলার এই কথাটা যত আলগাভাবে বলা ততটা মিথ্যে নয়। অজিত তো জানে, সে কত নিস্পৃহ! কত উদাস! এ বোধ হয় অর্থনীতির ক্রমহ্রাসমান উপযোগ বিধি! ডিমিনিশিং ইঊটিলিটি। না কি, তারা কেবলমাত্র যৌন অংশীদার? নাকি পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য একটা প্রাইভেট লিমিটেড? বিবাহ শব্দটির মধ্যে একটি বহ্‌ ধাতু আছে। তার মানে কি বহন করা? বহন করাই যদি হয়, তবে সে বড় কষ্টের। বহন কেন করবে? একদিন অফিস যাওয়ার আগে থেকে উঠে পোশাক পরছিল অজিত। হঠাৎ মাথার মধ্যে চিড়বিড়িয়ে উঠল একটা রগ। বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। সেরিব্রাল থ্রম্বসিস এভাবেই হঠাৎ হয়, জানা ছিল। সেই স্মৃতিই বোধ হয় আচমকা এসেছিল মাথায়। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে ‘এ কী। এ কী’ বলে বসে পড়েছিল অজিত। শীলার সায়া-ব্লাউজ পরা হয়ে গেছে, শাড়িটা ফেরত দিয়েছিল মাত্র, অজিতের কাণ্ড দেখে শাড়িটা দু-হাতে খামচে খুলে পক্ষিণীর মতো জাপটে ধরল তাকে, দু-হাতে মাথা বুকে নিয়ে ‘ঠাকুর! ঠাকুর! এ কী সর্বনাশ’। বলে চেঁচিয়ে উঠল। বলে চেঁচিয়ে উঠল। সেও জানে এইভাবে আজকাল আচমকা থ্রম্বসিস হয়, মানুষ চলে যায় বিনা নোটিশে। কিছুক্ষণ বসে থেকে সামলে নিল অজিত। কিছু না। তবু শীলা অফিস যেতে দিল না, নিজেও গেল না স্কুলে। সারা দিন আগলে বসে পাহারা দিল অজিতকে। কয়েক দিন চোখে চোখে রাখল। বিবর্ণতার মধ্যে সে ছিল উজ্জ্বল কয়েকটা দিন। প্রেমে পূর্ণ, নির্ভরতায় গদগদ। তবু অজিত ভাবে, কেন ওই পক্ষিণীর মতো ছুটে আসা, কেন আগলে ধরা! সে কি ভালবাসা! নাকি নিরাপত্তার জন্য? সে কি নান্দনিক! না কি অর্থনৈতিক। তবে কি দুটোই? ভেবে পায় না অজিত। শুধু বোঝে, মৃত্যুই মানুষকে কখনও কখনও মূল্যবান করে তোলে, নিতান্ত অপদার্থও হয়ে ওঠে নয়নের মণি। মৃত্যু নামে এক ভাবাবেগহীন, অবশ্যম্ভাবী শীতল ঘটনা মানুষের সব সময়ে মনে থাকে না, যখন মনে পড়ে, যখন মৃত্যুর কাছাকাছি এসে যায় কেউ, তখনই জাতিস্মরের মতো তার ভালবাসার কথা মনে আসে, বিরহ মনে পড়ে। জীবন বুঝি মৃত্যুর বিরুদ্ধে এক নিরন্তর লড়াই। নানাভাবে ভেবেছে অজিত। সিগারেট পুড়েছে কত! কোনও সিদ্ধান্তে আসেনি আজও।

বাইরের ঘরের পরদাটা উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। স্পষ্ট ব্রজগোপালকে দেখা যাচ্ছে। উনিও চেয়ে আছেন হয়তো। দেখছেন। তবু শীলাকে ওইরকম ঘনিষ্ঠভাবে ধরে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে আসে অজিত। বহন করা যাকে বলে।

শীলা বিছানায় বসে। সময়োচিত কয়েকটা ব্যথা বেদনার শব্দ করে। মেয়েরা বোঝে না পুরুষ কখন তাদের সম্পর্কে বিরক্ত বোধ করে। যেমন এখন। অজিত জানে শীলার কিছু হয়নি। তবু বড় বড় চোখে চেয়ে খাস টানছে শীলা, মুখে যথোচিত বেদনার ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে। সুভদ্রর প্রসঙ্গটার ওপর ওইভাবেই সে কি জয়ী হতে চায়? বড় বোকা। ও জানেও না সুভদ্রর প্রতি কোনও হিংসা বিন্দুমাত্র বোধ করে না অজিত। বরং মাঝে মাঝে ভাবে, ওইরকম করে যদি সময়টা ভালই কাটে শীলার, কাটুক। তবু কথাটা বেরিয়ে গেছে অজিতের মুখ থেকে। এখন তার প্রায়শ্চিত্ত।

—এখন কেমন? অজিত খুব আন্তরিকতা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে গলায়।

শীলা বোধ হয় বুঝতে পারে। যতই চেষ্টা করুক অজিত। আন্তরিকতা বোধ হয় ফোটে না। অজিতের ভাঙা, মেদহীন মুখে কয়েকটা অবশ্যম্ভাবী রাগ, বিরক্তি, হতাশার রেখা আছে, যা ফুটে ওঠে। সে লুকোতে পারে না। শীলা বোধ হয় সেটা টের পায়। অভিমানে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে—ভাল। তুমি যাও।

অজিত এসে আবার বাইরের ঘরে মোড়ায় বসে। একটু অন্যমনস্কভাবে শ্বশুরের দিকে তাকায়। একটা সিরাগেট খেতে বড় ইচ্ছে করছে। পায়জামার পকেটে একবার বে-খেয়ালে সিগারেটের প্যাকেটটার জন্য হাত ভরেছিল। মনে পড়ল শ্বশুর বসে আছে সামনে।

অবশ্য ব্রজগোপাল অজিতকে লক্ষ করছিলেন না। ওদিকের চেয়ারে রণেন এতক্ষণ নিঃশব্দে কথা বলছিল। ঠোঁট নড়ছে, হাতের আঙুল নাড়ছে। একটা মূক অভিনয় যেন। ব্রজগোপাল অবাক হয়ে সেদিকে চেয়েছিলেন। রণেন খেয়াল করেনি। হঠাৎ ব্রজগোপালের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল। খুব বিনীতভাবে বসে রইল, মাথা নামিয়ে দু-হাত কোলের ওপর জড়ো করে।

পুরো ব্যাপারটা নজরে এল অজিতের। ও কি করছিল রণেন? অদ্ভুত তো মাঝে মাঝে রাস্তায়-ঘাটে অজিত দেখেছে বটে একটু খ্যাপাটে ধরনের এক-আধজন লোক এ রকম একা-একা কথা বলতে বলতে যায়। হয়তো পাগল নয়, কিন্তু ওরকমই। রণেনের সেরকম কিছু হয় নাকি আজকাল!

ব্রজগোপাল থমথমে মুখটা ফিরিয়ে অজিতকে বলেন—শীলুটা! কী করছে? শরীর খারাপ নাকি?

একটু চমকে অজিত বলে না—। এই আসছে।

ব্রজগোপাল একটু গলা পরিষ্কার করলেন। বললেন—তোমার এ বাড়ি কদিনের?

বিনীতভাবে অজিত বলে—কয়েক বছর হয়ে গেল। আপনি তো দেখেননি?

—না। বলে একটু চুপ করে থাকেন ব্রজগোপাল, বলেন—আসতে ইচ্ছে হলেও কী আসা সোজা! কলকাতার রাস্তাঘাট আজকাল একটুও চিনতে পারি না। নতুন নতুন বাড়ি উঠে সব অচেনা হয়ে যাচ্ছে। এত ভিড়ে ঠিক দিশেও পাই না।

কলকাতার ওপর ব্রজগোপালের একটা জাতক্রোধ আছে, অজিত তা জানে। তাই একটু উদাস গলায় বলল—পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে, কলকাতায় তো বাড়বেই।

ব্রজগোপাল উত্তরটা আশা করেননি। একবার তাকালেন। মাথা নাড়লেন। বললেন—সবাই তাই বলে। জনসংখ্যা। আজকাল জন-টাকে কেউ পাত্তা দেয় না, সংখ্যাটা নিয়ে মাথা ঘামায়। মানুষকে কেবল সমষ্টিগত করে দেখা ভাল না।

অজিত এককালে বিস্তর পলিটক্সি করেছে। পথ-সভা, বিতর্ক, দাবি আদায়ের বৈঠক। তর্কের গন্ধ পেলে আজও চনমন হয়ে ওঠে। এই ছবির বিশ্বাসের মানুষটাকে যদিও কিছু বোঝানো যাবে না, তবু একটু ধাক্কা দেওয়ার জন্য সে বলে—সমষ্টিই তো আমাদের কাছে সব। সমষ্টিই শক্তির উৎস। তাকে নিয়ে তাই মাথা ঘামানোর দরকার। প্রতি জনকে নিয়ে মাথা ঘামানো সম্ভব নয়।

ব্রজগোপাল বুঝদারের মতো মাথা নাড়লেন। তারপর আস্তে করে বললেন—কোনও মানুষই নিজেকে ভিড়ের একজন বলে ভাবতে ভালবাসে না বাপু। এ হচ্ছে মিথ্যা কথা। বুকের মধ্যে সব মানুষই টের পায়, সে একজন আলাদা মানুষ, সবার মতো নয়। তিনশো কোটি মানুষের মধ্যে আমি একজনা বেনম্বরি মানুষ, গোবিন্দপুরের হেলে চাষাটাও এমন ভাবতে ভালবাসে না। বাসে, বলো?

—না বাসলেও কথাটা তো সত্যি!

—সত্যি কিনা কে জানে। তবে আজকাল যাকে রাষ্ট্র বলো, সেই রাষ্ট্র তোমাকে আমাকে মানুষের সমুদ্রে সত্তাহীন একফোঁটা জল যেমন, তেমন মনে করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে মানুষ পিণ্ডাকার একটা সমষ্টিসত্তা। কোথায় কোন মানুষ মরল, কোন মানুষ বেঁচে রইল, কে ঠ্যাং ভেঙে পড়ে থাকল, কে পাগল হয়ে গেল তাতে তার কিছু যায় আসে না। রাষ্ট্র তা টেরও পায় না, পৃথিবীর ভারও তাতে কমেও না বাড়েও না। মানুষ যখন এটা টের পেতে শুরু করে, তখনই তার মধ্যে হতাশা, ক্লান্তি আর নানারকম বিকৃতি আসতে থাকে। দু-চারজন যারা বড়টড় হয়, তাদের কথা ছেড়ে দাও। যারা গোলা মানুষ, অল্পবুদ্ধি, বা যারা তেমন বড়টড় হতে পারেনি, তারা নিজেদের নিয়ে পড়ে যায় বড় মুশকিলে। এই বিপুল রাষ্ট্রে তাদের স্থান কোথায়, কাজ কী, কেন তাকে পৃথিবীর দরকার, এ সব বুঝতে না পেরে সে ক্রমে নিজেকে ফালতু লোক বলে ভাবতে শুরু করে। কটা লোক ভাবতে সাহস পায় যে, তাকে ছাড়া পৃথিবী চলবে না? শহরে, গাঁয়েগঞ্জে, জনে জনে জিজ্ঞেস করে দেখো তো বাপু, এ রাষ্ট্রের তারা কে, পৃথিবীর তারা কে, এটা টের পায় কিনা?

ব্রজগোপাল একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান বুঝি। চোখটায় একটা ঘোর লাগা ভাব, মাথা নেড়ে বলেন—বেঁচে থাকার একটা জৈব তাগিদ আছে। মরতে কেউ চায় না। কেবল সেই তাগিদে যে যার মতো পৃথিবীর সঙ্গে সেঁটে আছে প্রাণপণে। নইলে সবাই জানে সে মরলে বা পড়লে পৃথিবীর কাঁচাকলা। এই কথা সার বুঝে গেছে বলেই আজ আর কেউ রাষ্ট্র বলো, দুনিয়া বলো, জনগণ বলো, কারও কাছে কোনও দায় আছে বলে মনে করে না। বুঝে গেছে, সার হচ্ছে নিজের দায়িত্বে বেঁচে থাকা। সে কেন, কোন দুঃখে রাষ্ট্র-ফাষ্ট্র, দুনিয়া-টুনিয়া, ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাবে! সে তো জনগণ, জনসংখ্যা, ভিড়ের একজন।

অজিত শ্বশুরের দিকে চেয়ে থাকে। একটু ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। বলে—কোনও মানুষই তো বিচ্ছিন্ন নয়। আলাদা ব্যষ্টি হয়ে যেমন, তেমনি আবার সে সমষ্টিরও একজন। কোনওটাই মিথ্যে নয়।

—মিথ্যে হওয়া উচিতও নয়। ঠিকই তো। মানুষ যেমন আলাদা আবার তারা গোষ্ঠীবদ্ধও। কে না স্বীকার করবে? কিন্তু এখনকার রীতিই হচ্ছে আগে সমষ্টিকে দেখা, ব্যক্তির কথা তারপরে। আগে সংখ্যা, তারপর জন। কিন্তু আবার তোমার বিজ্ঞানই বলছে, পৃথিবীর কোনও দুটো জিনিসই হুবহু একরকমের নয়। পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণা, প্রতি গাছ, প্রতি ফল, প্রতিটিই আলাদা রকমের। সে হিসেবে পৃথিবীতে ঠিক একরকমের জিনিস একাধিক নেই। তাই কারও সঙ্গে কাউকে যোগ করে এক-এ এক-এ দুই করাই যায় না। কারণ প্রতিটি একই আলাদা এক। তার কোনও দ্বিতীয় নেই। এটা আগে সবাই তোমরা বোঝো তার সমষ্টির কথা ভেব। জনগণ বা জনসখ্যা এ কথাগুলো অস্পষ্ট। প্রতিটি মানুষকে আগে বুঝতে দাও যে সে সমাজ সংসারের অপরিহার্য একজন। তাকে না হলে চলে না। নইলে মানুষ কেবলমাত্র সংখ্যাতত্ত্ব হয়ে যাবে, মানুষের ভিড় দেখে মানুষেরই ক্লান্তি আসবে। ভবিষ্যৎ বচনেরও দরকার নেই, এসে গেছে।

এই সব তত্ত্বকথা শুনেই বোধ হয় ননীবালা উঠে পড়লেন। বললেন—যাই দেখি গে।

ব্রজগোপাল নড়েচড়ে বললেন—আমিও উঠে পড়ি।

ননীবালা মাথা নেড়ে বললেন—উঠবে কী! বোসো। আসছি।

ননীবালা চলে গেলেন। রন্নাঘরের দিকেই বোধ হয়। সেদিক থেকে তাঁর গলা পাওয়া গেল, বাচ্চা ঝিটাকে বকছেন—তুই খাবার বেড়ে নিয়ে যাচ্ছিস কিরে! সবাইকে কী আর ঝি-চাকরে খাবার দিতে আছে! এ কী যে সে লোক। রাখ, আমি নিয়ে যাচ্ছি।

অজিত চুরি করে একটু হাসল। শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া অনেক হাজার টাকার চেক আঁচলে বেঁধে শাশুড়ি ঠাকুরুনের ভালবাসাটাসা সম্মানবোধ সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিয়ের সম্পর্কটা কি তবে অর্থনৈতিক। ভালবাসার জান কি টাকা আর নিরাপত্তার ভিতরে বীজাকারে নিহিত রয়েছে! সংসার থেকে প্রায় বহিষ্কৃত ব্রজগোপালের তো এত সম্মান প্রাপ্য নয়! সংসারের কারও ব্রজগোপালের প্রতি কোনও দরদ আছে বলে অজিত জানে না। সবাই বলে, এ লোক হচ্ছে একগুঁয়ে জেদি মানুষ, কারও সঙ্গে বনে না। কথাটা ঠিক। তবু অজিত মনে মনে এ-লোকটাকে হিংসে করে। এ লোককে দিনে দশবার বউয়ের অকারণ রাগ অভিমান ভাঙাতে হয় না, এ লোক বিবাহের বহন করার কষ্টকর কাজ থেকে কৌশলে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছে। এ সব তো বটেই। তার ওপর অজিত দেখেছে, এ লোকটার ভিতরে এখনও ভালবাসা মরে যায়নি। নইলে কেউ বয়স্ক জামাইয়ের হাতে মিষ্টি খাওয়ার টাকা দিতে পারে। অজিত হলে পারত না।

একটা চমৎকার মিঠে কমলা রঙের শাড়ি সদ্য পরে ঘর আলো করে শীলা ঘরে এল। চুলটুল আঁচড়ে এসেছে। চোখে এখনও কান্নার ফোলাভাব। কপালে সিঁথিতে সিঁদূর দগদগে। মুখে একটু পাইডারের ছোঁয়া। এ সবই মুখের ভাব, কান্নার চিহ্ন ঢাকার ছদ্মবেশ। কোনও কথা না বলে প্রণাম করল বাপকে। ব্রজগোপাল মাথায় হাত রাখলেন। একটু বেশিক্ষণ রাখলেন যেন। চোখটা বুজলেন। ইষ্ট স্মরণ করলেন বোধ হয়।

শীলা বাপের পাশ ঘেঁষে বসল। আঁচলটা কুড়িয়ে নিয়ে মুখে চাপা দিল একটু বলল—কেমন আছ বাবা?

ব্রজগোপাল উদাস স্বরে বললেন—আছি। আমাদের আর বিশেষ কী। তোরা কেমন?

শীলা মাথা নেড়ে বলে—ভাল।

ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ছেড়ে বলেন—সংসারের কাজটাজ সব করিস নিজের হাতে?

শীলা হাসল একটু। বিবাহিতা বয়স্ক মেয়ের উপযুক্ত প্রশ্ন নয়; তবু বলল—করি।

—করিস! বলে ব্রজগোপাল হালেন—কখন করিস? তুই তো চাকরি করছিস, শুনেছি।

—দুটোই করি।

—চাকরি করিস কেন? অজিতের আয়ে তোদের চলে না? ওর তো রোজগার ভালই।

—আজকাল সব মেয়েই করে।

—তাই করিস? নিজের ইচ্ছেয় নয়? প্রয়োজনও নেই?

শীলা একটু অপ্রস্তুত হয়। অনেকদিন পর বাপের সঙ্গে দেখা, তাই বোধ হয় মানুষটাকে ঠিক বুঝতে পারে না। একপলক বাবাকে দেখে নিয়ে বলে—টাকার দরকার তো আছেই। সময় কাটে না। লেখাপড়া শিখেছি, সেটাও তো কাজে লাগানো উচিত।

—ও। বলে ব্রজগোপাল বুড়োটে মুখে দুষ্টুমির হাসি হাসেন। যেন তাঁর এ-মেয়েটা নাবালিকা এবং তিনি তার সঙ্গে খুনসুটি করছেন। বলেন—মেয়েরা যেন এত টাকার ফিকির খোঁজে রে? পুরুষ যদি খাওয়াতে পরাতে না পারে তখন না হয় কিছু করলি। এমনি খামোকা চাকরি করবি কেন? এককাঁড়ি টাকার মধ্যে কি সুখ? বেশি বহির্মুখী হলে মেয়েদের মধ্যে ব্যাটাছেলের ভাব এসে যায়। সংসারেও বিরক্তি আসে। স্বামীর সঙ্গে পাল্লা টানে। ও ভাল নয়।

শীলা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। তর্ক করে লাভ কী!

ব্রজগোপাল তেমনি দুষ্টুমির হাসি হাসেন। আচমকা বলেন—ট্রামে বাসে পুরুষের বগলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে রোজ যাতায়াত। সেও বিশ্রী। পুরুষেরাও তো ভাল নয়। কত লোকের মনে কত বিকৃতি আছে। তারচেয়ে বরং হামলে সংসার করবি। নিজের হাতে রেঁধেবেড়ে দিবি। স্বামীর সেবা নিজের হাতে করলে ভালবাসা আসে। এ তো আর অংশীদারি কারবার নয় যে, যে-যার ভাগের টাকা ঢেলে সংসার চালালি।

ব্রজগোপাল ডান হাতে মেয়ের দীর্ঘ এলো চুলে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন—বাচ্চাকাচ্চা যখন হবে তখন দেখবি। মা-বাপ ছাড়া বাড়িতে কেমন অনাথ হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

ননীবালা খাবারের প্লেট আর চা হাতে এলেন।

ব্রজগোপাল একটু তাকালেন মাত্র সেদিকে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন—ও নিয়ে যাও।

—মেয়ের বাড়িতে এসেছ, একটু মুখে দিতে হয়।

—যখন-তখন খাই না আজকাল। অভ্যেসও নেই। ওদের সব দাও।

বলে ছেলের দিকে তাকালেন। অজিত লক্ষ করে, রণেনের ঠোঁট আবার নড়ছে। আঙুলে বাতাসের একটু শূন্য আঁকল রণেন। কাকে যেন উদ্দেশ করে নিঃশব্দে কী বলে যাচ্ছে।

॥ আটত্রিশ ॥

এই ছেলেটার বরাবরই বড় ঘাম হয়। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, তবু গলা বগল ভিজে গেছে। ননীবালা উঠে ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে বলেন—তুই অত ঘামিস কেন?

রণেন দু-হাতে মাথা চেপে বসেছিল। মুখ তুলে কেমন একরকম ভাবে তাকায়। পাঁজর কাঁপিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ে। হঠাৎ চোখের ডিম উলটে শিবনেত্র হয়ে বলে—মা! মাগো!

গর্ভধারিণীকে নয়, যেন জগজ্জননীকে ডাকছে। ডাকটা বেখাপ্পা শোনাল। এ ছেলেটা ননীবালার তেমন সুখী নয়। বউটা তেমন হয়নি, বড্ড খোঁড়ে। ছেলেটা বউয়ের তাল রাখতে পারে না। বোধ হয় ঝগড়াটগড়া হয়েছে আবার। এখন তো বাসায় ননীবালা নেই, রক্তারক্তি হলে চেঁচাবে কে, আটকাবে কে! ননীবালার বুকটা তাই কেঁপে ওঠে। কী করার আছে! বুড়ো হলে মানুষের আর সংসারে বিশেষ কিছু করার থাকে না। এখন তো আর কোলের সেই ন্যাংলা রণো নয়, এখন পুরোদস্তুর স্বামী-বাপ সংসারের ভিত। এই ছেলেকে ননীবালা আগলে রাখেন কী করে! তবু মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছায়া ফেলে। বড়বেশি দিন মেয়ের বাড়িতে থাকা হল। এবার একবার ওদিককার সংসারে একবার গা ফেলবেন।

বলেন—কবে নিয়ে যাবি আমাকে?

রণেন চোখ বুজে ছিল। বলল—যবে খুশি।

—আজই চল। বুবাই-টুবাই ঠাকুমা ছাড়া কেমন করে সব? মা তো জো পেয়ে খুব ঠ্যাঙায়। ঠ্যাঙাড়ে বাড়ির মেয়ে।

থাবারটাবার সব পড়ে আছে। কেউই ছোঁয়নি এখনও। শীলা বলল—বাবা, খাও।

ব্রজগোপাল প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলেন—তোরা খা। এ বয়সে যখন-তখন খাওয়া বড় অপয়া। যত কম খাই, তত ভাল থাকি।

—একটু শরবত দিই বাবা?

ব্রজগোপাল একটু ঘাড় নাড়লেন। মুখে দুশ্চিন্তার চিহ্ন। বললেন—সেটা বরং সহজে গলা দিয়ে নামবে। নিজের হাতে করে আনিস যদি।

—আনছি। বলে শীলা উঠে গেল।

ব্রজগোপাল চারদিকে একবার তাকালেন। কিন্তু কিছুই দেখলেন না। দৃষ্টিটা এসে স্থির হল ননীবালার চোখে। ননীবালাও চেয়ে আছেন। একদৃষ্টে। তাঁদের ভালবাসা ছিল। সে-আমল এখনকার মতো নয়। সারা দিন কেউ কারও দেখা পেতেন না। রাতে দেখা হত, কিন্তু কথা হত ফিসফিসিয়ে, যেন গহীন রাতের চোরেও না শুনতে পায়। এই যে এখন যেমন, মা-বাপের সামনে মেয়ে আর জামাই বসে থাকে, কিংবা ছেলে আর ছেলের বউ, এরকমটা ভাবা যেত না। নিজের বাবার সঙ্গে কখনও বসে কথা বলেননি ব্রজগোপাল, সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকতেন। ননীবালার সঙ্গে যৌবন বয়সে বেড়াতে বেরিয়েছেন জোড়ে, এমন মনে পড়ে না। বউ ছিল শুধু রাতটুকুর জন্য, বেহানেই সে হয়ে যেত সংসারের একজন, স্বামীর কেউ নয়। তুব ভালবাসা তো কিছু কম ছিল না। আর এখন স্বামী-স্ত্রী বড় বেশি পায় পরস্পরকে। এদের বিরহ কম। এদের বিবাহের পুরোহিত হচ্ছে কামস্পৃহা। মনে মনে তাই বড় তাড়াতাড়ি দূরের হয়ে যায়। কাছে কাছে থেকেও। কামটুকু ফুরোলেই আর থাকে কী! অবশ্য ব্রজগোপাল আর প্রমাণ করতে পারেন না যে, তাঁর এবং ননীবালার মধ্যে ভালবাসা ছিল। প্রমাণের দরকারই বা কী? মনে মনে তিনি তো জানেন, তাঁর হৃদয় ননীবালার নিরন্তর মঙ্গল প্রার্থনা করে। স্থির জানেন, পরজন্মেও তাঁর বউ হবে এই ননীবালাই। ছাড়ান কাটান নেই, এই এক সম্পর্ক। এসব কি প্রমাণ করা যায়।

ননীবালার চোখে চোখে আটকে গেল। ননীবালাই সামলালেন আগে। ঘোমটা ডান কানের পাশে দিয়ে একটু টেনে দিয়ে বলেন— বুকের ব্যথাটা কি আর হয়?

—না।

শরীর-টরীর খারাপ হলেও তো খবরবার্তা কেউ দেয় না যে গিয়ে পড়ব।

ব্রজগোপাল মুখটা ফিরিয়ে নেন। বলেন—ব্যস্ত হওয়ার মতো ব্যাপার কী! মেঘু ডাক্তার আমলকী আর মধু খেতে বলেছিল। সেই খেয়ে এখন ভালই আছি।

—রাতে বোবায়-টোবায় ধরলে কে ডেকে দেয়! বুড়ো বয়সে একা শোওয়া ভাল নয়, রাতটা ভয়ের।

ব্রজোগোপাল তাচ্ছিল্যের ভাব করে বলেন—শোয় একজন। উটকো লোক, পেল্লায় ঘুম তার। আর বোবায় ধরবে কাকে, ঘুমই নেই।

ননীবালা বলেন—মাটির ভিত্‌-এর ঘর। এই গ্রীষ্মকালটায় সাপখোপ সব ঘরেদোরে চলে আসে। বহেরু যেন ঘরের গর্তটৰ্ত সব বুজিয়ে দেয়।

ব্রজগোপাল উত্তর করলেন না। তবু ননীবালার এই উদ্বেগটুকু বহুকাল বাদে তাঁর বেশ লাগছিল। এটা টাকায় কেনা জিনিস নয়, স্বার্থত্যাগ মানুষকে কখনও-সখনও একটু বা মহৎ করে। ব্রজগোপালের মূর্তিটা বোধ হয় ননীবালার বুকের মধ্যে ঘষা-মাজা খেয়ে একটু স্পষ্ট হল।

কিন্তু মেয়েমানুষের দোষ হল, সে বেশিক্ষণ আলগা ভালবাসার কথা বলতে পারে না। তার মধ্যে হঠাৎ বিষয় সম্পর্কিত কিংবা সংসারের আর পাঁচটা কথা এনে ফেলে। বেসুর বাজতে থাকে।

যেমন ননীবালা এসব কথার পর হঠাৎ বলেন—এবারও বহেরু ধানের দাম কম দিল।

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বললেন—বহেরুর হাতে তো সব নয়। ছেলেরাই এখন সব করছে।

—কেন, বহেরুর কী হয়েছে?

ব্রজগোপাল হাসলেন। বললেন—কী আর হবে। বুড়ো হয়েছে। সে যতদিন দেখত ততদিন বুঝেসুঝে দিত। ছেলেরা দেবে কেন? তারা বর্গা ভাল জানে। যা দেবে, তাই নিতে হবে।

—তুমি তো আছো, তুমি দেখতে পারো।

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—ছড়ানো জমি, অত কি একটা মানুষ দেখতে পারে! তার ওপর মাঝেমধ্যে তো মানুষের মন বিষয় থেকে উঠে যায়। আমার ওসব আর ভাল লাগে না। নিজের হাতে গাছপালা যে এখনও করি সে ফুলপাকুড় খাব কী টাকা হবে বলে নয়। গাছ জন্মায়, ফল দেয়, ফুল ফোটে, সেটা চোখে দেখার একটা মায়া আছে, তাই।

ননীবালা রাগ করেন না, তবু অনুযোগের সুরে বলেন—সেটা কি কোনও কাজের কথা! ছেলেরা যেতে পারে না বলে তুমি রাগ করো। কিন্তু তারা কি তোমার মতো বিষয়বুদ্ধি রাখে! তুমি না দেখলে তো হবে না।

ব্রজগোপাল একটু চুপ করে থেকে বলেন—তারা না গেল, তা বলে আমাকে যক্ষবুড়ো হয়ে থাকতে হবে কেন? তোমার তো মোটে পাঁচ কী ছ-বিঘে, আমার তারচেয়ে ঢের বেশি। যা ফসল হয় তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ রাখি, বাকি, চার ভাগ খয়রাতিতে যায়।

—সে কেন?

—ওটা আমার একটা ব্রত।

—দেবত্র করলে নাকি?

—ওরকমই।

ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে ননীবালা প্রশ্ন করেন—সে কেন?

ব্রজগোপাল ননীবালার উদ্বেগটা টের পেয়ে হেসে মাথা নেড়ে বললেন—ভয়ের কিছু না। ঠাকুর দেবতার নামে লিখে দিইনি, আমার নামেই আছে, আমার ওয়ারিশ যারা তারাই পাবে। কিন্তু পেলেও আমার ব্রতটা যেন তারা না ভাঙে। ফসলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ নেবে, বাকি থেকে যা আয় হবে তা দিয়ে সম্পত্তি বাড়াবে। আর মানুষকে দেবেথোবে, অনাহারীকে খাওয়াবে, গরিব গুর্বোদের দেখবে, কাঙাল ফকিরকে সাহায্য করবে।

—সে তো ভূতভোজন হল। তবে ওরা খাবে কী?

ওদের খেতে বারণ নেই। খেয়েপরেও অনেকের খানিকটা থাকে। দেয় না।

—সে যাদের অনেক আছে তারা দিকগে। আমাদের তো জমিদারি নেই। বছরে সামান্য কটা টাকা। সেও ভূতভোজনে গেলে জমি লোকে করে কেন?

—নিজের জন্যেই করে। জমি, সম্পত্তি, চাকরি সবই নিজের জন্য। সে একশোবার। আবার গরিব গুর্বো, শিয়াল কুকুর, কাক শালিখকেও ভাত দেয়, সেও নিজের স্বার্থেই দেয়। জগৎসংসারে থাকতে হলে প্রতিকূলভাবে না থেকে অনুকূলভাবেই থাকা ভাল। আমি তৃপ্ত হই, আমার চারদিক তৃপ্ত হোক।

—ওসব ভাল কথার দিন কি আর আছে! শখের গয়না বেচে জমি কিনেছিলে, আমারটা খয়রাতি হতে দেব কেন?

ব্রজগোপাল ননীবালার দিকে একটু চেয়ে থাকেন। সামান্য বুঝি অভিমান ভরে বলেন— তোমার দুঃখ কী! সংসারে আটকা আছো, বুঝতে পারো না মানুষজন কীভাবে বেঁচে আছে। চারদিকে মানুষজন যত উপোসী থাকবে, যত অতৃপ্ত অশান্ত হবে তত তোমার সংসারে তাদের হাত এসে পড়বে। ছেলেদের ভালই যদি চাও তো তারা যে সমাজ সংসারে আছে তার আগে ভাল করো। শুধু আলাদা করে রণেন সোমেনের ভাল চাইলেই কি ভাল হয়?

ননীবালা ধৈর্য রাখতে পারেন না। আঁচলে বাঁধা চেকটার কথা ভুলে গিয়েই বুঝি তেড়ে ওঠেন—ওসব আমি বুঝি না। ব্ৰতট্রত ওরা মানতে পারবে না। পুরো ফসলের হিসেব যদি না পাই তো জমি বেচে দেব।

অজিত এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। একটু বিষণ্ণ, একটু অনুতপ্ত, শীলার জন্যই। এখন হঠাৎ বলল—উনি বোধ হয় ওইভাবে একটা ব্যালান্স অফ ইকনমির চেষ্টা করছেন।

ননীবালা জামাইয়ের দিকে একটু ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। জামাইটা বড় ট্যাটন। লঘুজন-গুরুজন মানে না, পট পট কথা বলে। একটু আগে বুড়ো শ্বশুরের মুখে মুখে জবাব করছিল। বললেন—কী বললে?

অজিত হেসে বলে—গরিবকে দিয়েথুয়ে খুশি রাখলে বড়লোকদের এরকম সুবিধেই হয়। ধর্মও হয়, শোষণের সুবিধে হয়।

ননীবালা কথাটা বুঝলেন না। মানলেনও না। গম্ভীরভাবে বললেন—বড়লোকরা যা খুশি করুক। আমরা করতে যাব কেন?

শীলা চমৎকার কাচের গ্লাসে ঠান্ডা শরবত এনে রাখলে টেবিলে। মুখখানা একটু ভার, একটু নত। বাপের কাছে বসে মুখ তুলে মাকে বলল—চুপ করো তো মা। বাবার জমি যা খুশি করুক, তোমার কী!

—আহা, বড় বাপসোহাগী হলেন! ননীবালা এই ঢঙে কথা বলে রাগের মাঝখানেও হেসে ফেললেন একটু। পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বললেন—ওঁর জমি মানে ছেলেদেরও। ছেলেরা তো আকাশ থেকে পড়েনি, ওঁরই জন। পর নয়।

ব্রজগোপাল মলিন একটু হাসলেন। বললেন—ছেলেরা বাপের পর হবে কেন, তারা শ্রাদ্ধের অধিকারী।

কথাটার মধ্যে একটু ব্যঙ্গ ছিল, আর বুঝি নিজের মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা। ননীবালা দমলেন না, বললেন—শ্রাদ্ধের কথা ওঠে কেন? বেঁচে থাকতে কি অধিকার থাকে না নাকি?

মাথাটা দু-হাতে কঠিনভাবে চেপে ধরে বসেছিল রণেন। হঠাৎ উত্তেজিত মুখ তুলে বলে—মা!

এবার জগজ্জননীকে নয়, নিজের নাকেই বলা। বরাবর এ ছেলেটা বাপের পক্ষ হয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। শেষমেষ বাপের উপরেও বিরক্তি এসেছিল। তবু বুঝি এখনও কিছু পক্ষপাত রয়ে গেছে। ননীবালা ঝাঁকি দিয়ে বললেন—কী, বলবি কী? বাপের সম্পত্তিতে তোর দরকার নেই এই তো! তোর না থাকে, সোমেনের আছে। আমি ছাড়ব না।

ব্রজগোপাল খানিকটা হতভম্বের মতো চেয়ে থাকলেন। শীলা শরবতের গ্লাসটা তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলে—বাবা খেয়ে নাও তো। ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে এনেছি, আবার গরম হয়ে যাবে।

ব্রজগোপাল গ্লাসটা ধরলেন না। ননীবালার দিকে চেয়ে বললেন—বরাবর দেখে আসছি তুমি সংসারের দুটো পক্ষ তৈরি করে নিয়েছ। আমি একদিকে, ছেলেরা আর তুমি অন্যদিকে।

শীলা মাকে একটু চোখ টিপে বলে—মা, তুমি একটু রান্নাঘরে যাও তো। ঝি মেয়েটাকে দুধ জাল দিতে বলে এসেছি, ও গ্যাসের উনুন নেবাতে পারে না। যাও।

ননীবালা নড়লেন না। এর একটা বিহিত করতে হবে বলে বসে রইলেন। বললেন—ওঁর কথাটা শুনিছিস। আমি দুপক্ষকে পর করেছি। ঝগড়া লাগিয়েছি।

—তা নয়। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বললেন—তা নয়। দু’পক্ষকে বুঝতে দিলে না। তাদের সম্পর্কে কী। কথাটা বোঝানো শক্ত। তর্ক করে বোঝানো যাবে না। তবু তোমাকে একটা জিনিস বুঝতে বলি, আমিও ছেলেদের ভাল চাই।

—ভাল চাইলে আর দেবত্র করে দেবে কেন?

অজিত আবার আস্তে করে বলে—ব্যালান্স অফ ইকনমি।

ঠাট্টা! ব্রজগোপাল জামাইয়ের দিকে তাকালেন। তারপর নিজের ক্যাম্বিসের ব্যাগটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন—না বাবা, ব্যালান্স অফ ইকনমি আমি বুঝি না। আমি বড় স্বার্থপর। সার বুঝি, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে সেইজন্যই ভয় খাই। আমার সন্তানের দুধ ভাত একদিন নিরন্ন, বর্বর মানুষ যদি কেড়ে নেয়! তাই এই ত্যক্তেন ভূঞ্জীথাঃ। তবে একজন অ্যাকচুয়ারির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। বিজ্ঞ লোক। সে ওই ব্ৰতর কথা শুনে বলেছিল—এ ভারী আশ্চর্য জিনিস, ব্রজদা, ঘরে ঘরে সবাই এমন করলে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের দুর্দিন, অভাব কষ্ট সব লোপাট হয়ে যাবে। আমি তো অত বুঝি না। বুড়ো বামুন যেমন বলে গেছে তেমন করি। আমার বুঝটা বড় সাদামাটা।

কেউ কোনও কথা বলার আগেই ব্রজগোপাল উঠে দাঁড়ালেন। ভারী ক্লান্ত দেখাছিল। শীলা উদ্বিগ্ন মুখে বলে—শরবতটা খেলে না বাবা!

ব্রজগোপাল সে কথায় কান না দিয়ে বললেন—ভূতভোজনের কথা বলছ, ভয় বোধ হয় হ্যাঙালি ক্যাঙালিরা এসে রোজ ভাগাড়ের শকুনের মতো পড়বে। কিন্তু এ কাঙালি ভোজনের ব্যবস্থা নয়, দরিদ্র নারায়ণ সেবাও নয়। বসিয়ে খাওয়ালে মানুষের গতরে মরচে পড়ে যায়, আর নড়ে না। এ কে না জানে! অযোগ্য অপাত্রে দান, দাতা গ্রহীতা দুই-ই ম্লান। কিন্তু সেবাবুদ্ধি থাকলে মানুষের ঠিক অভাবের জায়গায় হাত বাড়ানো যায়। কত বড়মানুষেরও কত অভাব আছে। আমি যেমন বলছি তেমন করলে নিজের মধ্যেও সেবাবুদ্ধি জাগে, পাঁচজনেও দেখে শেখে। তা এসব কথা তো তোমাদের কাছে অবান্তর।

ননীবালা কী বলতে যাচ্ছিলেন, রণেন আবার বলল—মা!

ননীবালা ছেলের দিকে চেয়ে সামলে গেলেন। রণেনের মুখ লাল। চোখ দুটো বড় ঘোলাটে লাগল। ননীবালা একটা দীর্ঘশ্বাস, ফেললেন। ব্রজগোপালের দিকে চেয়ে বললেন—উঠলে নাকি?

—উঠি। অনেক দূর যেতে হবে।

ননীবালা বাধা দিলেন না। বললেন—দুর্গা, দুর্গা। জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে শীলার দিকে চেয়ে বলেন—আজ আমি একবার ও-বাড়ি যাব। ছাদ থেকে আমার জামাকাপড়গুলো আনতে বল তো!

রণেন রয়ে গেল, মাকে নিয়ে বাসায় ফিরবে। ব্রজগোপাল একাই বেরিয়ে এলেন। রাস্তায় পা দিয়ে হঠাৎ টের পেলেন, তিনি বড় বেশি একা। ভয়ংকর একা। বুকের ভিতরটা যেন এক চৈত্রের ফুটি-ফাটা মাঠ, সেখানে এক ন্যাড়া গাছে বসে দাঁড়কাক ডাকছে—খা, খা।

উত্তজনা বীজমন্ত্রের খেই হারিয়ে গিয়েছিল। ছেঁড়া সুতোটা মনের মধ্যে কাটা ঘুড়ির সুতোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। বীজনাম অতিদ্রুত স্পন্দিত হতে থাকল শরীরে, রক্তে, হৃৎস্পন্দনে। নির্ঝরের মতো। অবগাহন হতে থাকে। তবু মনটা ভাল না। ছেলেটা ভাল নেই, মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে একটা কেমনতর ভাব! আর ননীবালা! এখনও এই আয়ুর সাঁঝবেলায় দু-হাতে ছেলেদের স্বার্থ আগলাচ্ছে। ব্রজগোপাল তাই এই মস্ত জগৎসংসারে বড় একা।

নির্জন পাড়াটা পার হয়ে বড় রাস্তায় লোকজনের মাঝখানে চলে এলেন ব্রজগোপাল। তখনও মনটা ওইরকম খাঁ-খাঁ করছে। আপন মনে বলেন—দূর বেটা, তুই যে নেংটে নেই নেংটে। একা আবার কী? একটা শ্বাস ছেড়ে ব্রজগোপাল বাস-স্টপে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। চারদিকে ফুলিয়ে ওঠা কলকাতার ভিড়, ট্রামে-বাসে লাদাই ভিড়, ধুলোটে আকাশ। তারই মাঝখানে হঠাৎ যেন বহুদূরের এক চিত্র ভেসে ওঠে। যজ্ঞস্থলীতে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। যজ্ঞধূমের গন্ধ ভেসে আসে। কী পবিত্র পৃথিবী! কী পরিষ্কার এর বাতাস! ব্রজগোপাল তাঁর পরিবারের কথা ভুলে গেলেন। বুড়ো বামুনের মুখটা ভেসে ভেসে ওঠে নাসামূলের আজ্ঞাচক্রে।

ননীবালা যখন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে পা দিলেন তখন সন্ধে হয়ে গেছে। নাতি-নাতনিরা মাস্টারের কাছে পড়ছিল, ঠাকুমাকে দেখে দৌড়ে এসে সাপটে ধরল। ঠাকুমা, ঠাকুমা ডাকে অস্থির। বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে আর বাড়ি কী! শালির বাড়িতে এ ক’দিন যেন হানাবাড়িতে কেটেছে। হাঁফ ধরে গিয়েছিল।

ছোট নাতিকে ট্যাঁকে গুঁজে নিজের ঘরের তক্তপোশে এসে বসলেন। ভারী একটা নিশ্চিন্তভাব। বীণা একবার উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে গেল—চা খাবেন তো! হচ্ছে।

—দিয়ো, বললেন ননীবালা। নাতিটা ধামসাচ্ছে। বললেন—বড় ডাকাত হয়েছিস দাদা।

চারদিকে চেয়ে দেখলেন। সোমেনের টেবিলে ছাইদানিটা উপচে পড়ছে পোড়া সিগারেট, দেশলাই কাঠি আর ছাইতে। বিছানার চাদর নোংরার হদ্দ। মশারিটা আগে খুলে ভাঁজ করে রাখা হয়, এখন চালি করে রাখা, তাতে ময়লা হয়েছে। বিছানায় ছাড়া জামাকাপড় পড়ে আছে।

এসব সারতে থাকেন ননীবালা, আর আপনমনে বক বক করেন। পরোক্ষে বউকেই শোনান।

ঘরদোর সেরে পরনের কাপড়টা পালটে নিলেন। ভাঁজ করে তুলে রাখতে যাবেন এমন সময়ে আঁচলের গেরোটা চোখে পড়ল। সাবধানে পেট আঁচলে বেঁধে এনেছেন। সেই চেকটা খুলে শত ভাঁজের দাগ ধরা চেকটা আলোয় দেখলেন একটু। চোখে জল এল। অনেকগুলো টাকা। এত টাকা ও-মানুষ জন্মে কখনও দেননি ননীবালাকে। এতকাল গরিবেরই ঘর করেছেন ননীবালা, টাকার মুখ বড় একটা দেখেননি। লোকটা যে শেষ পর্যন্ত দেবে এমন বিশ্বাস ছিল না। তবু দিল তো!

ননীবালা চেক হাতে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখে জল। বুকে বৃষ্টিপাত। নাতিটা অন্যধারে বসে চিড়ের মোয়া খায় টুক-টুক করে। ননীবালার মনটা উদাস হয়ে যায়। লোকটা অনেক টাকা এককথায় দিয়ে দিল। বিষয় সম্পত্তিও সব দেবত্র না কী যেন মাথামুণ্ডু করছে। হল কী মানুষটার! চিরকালই ঘর-জ্বলানি, পর-ভুলানি ছিল বটে, কিন্তু এখনকার রকমসকম বুঝি কিছু আলাদা। সংসারের ওপর থেকে মায়া তুলে নিচ্ছে না তো! দুম করে একদিন ননীবালাকে রেখে চলে যাবে না তো! বুকটা কেঁপে ওঠে। গভীর শ্বাস পড়ে।

ও-ঘরে বীণার খর গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কী যেন হল। একটু কান পাতলেন ননীবালা। কিছু বুঝতে পারলেন না।

বীণা এসে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলে—মা, একবার ও-ঘরে আসুন।

—কী হল?

—আপনার ছেলে কেমন করছে।

বীণার মুখটা থমথমে। ননীবালা উঠলেন, বললেন—ওকে সবাই বড় জ্বালায়।

শোওয়ার ঘরে রণেন বসে আছে চেয়ারে। কপালে একটা জায়গায় থেঁতলে যাওয়ার ক্ষতচিহ্ন, রক্ত।

ননীবালা গিয়ে ছেলেকে ধরলেন—কী হল?

বীণা বাইরের ঘরের দিকের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলে—ওঁকে আমি বলেছিলাম হাতমুখ ধুয়ে এসে চা খাও। উনি গেলেন না। তারপর আমি রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে দেখি। ড্রেসিং টেবিলের কোনায় মাথা ঠুকছেন।

—কে কী? ননীবালা রণেনের দু-কাঁধ ধরে মুখ নিচু করে বড় ছেলের মুখ দেখলেন ঠিক যেমন করে মা শিশু-ছেলের মুখ দেখে—কী হয়েছে তোর, ও রণো! মাথা খুঁড়ছিলি কেন?

রণেন তার তীব্র ঘোলাটে চোখ তুলে একবার অদ্ভুতভাবে তাকাল। গভীর শ্বাসের মতো শব্দ করে বলল—মা!

॥ উনচল্লিশ ॥

মানুষ কত অসুখী! এরা জানেই না কী করে জীবনযাপন করতে হয়। ব্রজগোপালের মন বড় কু-ডাক ডাকে। সবাইকে ছেড়ে আলগা আছেন তবু সমস্ত মনপ্রাণটা ওদের দিকে চেয়ে। বসে থাকে। ঠাকুর ওদের সুখে রাখো।

হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরলেন ব্রজগোপাল। অফিস-ভাঙা-ভিড়। আজকাল বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পা-দুটো রসস্থ হয়। ওপরে ঝোলানো হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল, তাই হাতটাও ভেরে আসে। ক্যাম্বিসের ব্যাগটা ধরে রাখতে কষ্ট হয়। চারধারে মানুষের শরীরের ভাপ, গরম, ঘাম, দুর্গন্ধ। মাথার ওপর পাখা নেই। হাওয়ার জন্য দরজার হাতলে বিপজ্জনকভাবে মানুষ ঝুলছে। বদ্ধ, চাপা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে ব্রজগোপালের মাথাটা দুবার চক্কর খেল। মাথাঘোরার রোগটা তাঁর যৌবন বয়স থেকেই। তালুতে তিল তিল চেপে ঠান্ডা জলে মাথা ধুলে একটু আরাম লাগে। দাঁড়িয়ে ব্রজগোপাল বারবার বীজমন্ত্র জপ করার চেষ্টা করেন। বারবার সুতো ছিঁড়ে যায়। কাটা ঘুড়ির মতো বনটা ভেসে বেড়াচ্ছে। একবার রণেনের মুখটা মনে পড়ে, একবার ননীবালার, মেয়ে-জামাই, ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি সকলের কথাই ভাবেন। বীজমন্ত্র ধরে রাখতে পারেন না। শরীরটা আজ বড় বেগোছ। এই দমচাপা অবস্থায় কারা ভিতরের দিকে ফুটবলের ব্যাপার নিয়ে চেঁচামেচি করছে। সেই গোলমালটা অসহ্য লাগে, আর সিগারেটের ধোঁয়া।

পরপর কয়েকটা স্টেশন পার হতেই ভিড় পাতলা হয়ে গেল। উত্তরপাড়া পার হয়ে বসার জায়গা পেলেন ব্রজগোপাল। ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে বসলেন। হালকা জিনিসপত্র কখনও ব্যাঙ্কের ওপর রাখেন না তিনি। যদি চুরি যায়! চুরি যাওয়া ভাল নয়। যার চুরি যায় তার চরিত্রের মধ্যে কোথাও ঢিলেমি আছে, অসংলগ্নতা আছে। যত সামান্য জিনিসও হোক, ব্রজগোপাল সদাসতর্ক থেকে পাহারা দেন!

একটা মোটামতো পশ্চিমা লোক সরে বসে ব্রজগোপালকে জায়গা করে দিয়েছিল, লোকটার গায়ে খয়েরি রঙের এরটা পাঞ্জাবি, পরনে পরিষ্কার ধুতি, মাথায় একটু টিকি আছে, হাতে ভোলা একটা ছোট বই। খুব মন দিয়ে বইটা পড়ছে। ব্রজগোপাল একটু উঁকি দিয়ে দেখেন, বইটার পাতা জুড়ে দেবনাগরী অক্ষরে কেবল একটা কথাই ছাপা আছে, সীতারাম, সীতারাম, সীতারাম। প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারলেন না তিনি। পশ্চিমা লোকটা পাতা ওলটাল। আবার দেখেন, ওই একই কথা লেখা সারা পাতায়, সীতারাম, সীতারাম, সীতারাম। বুঝলেন, সারা বই জুড়ে ওই একটি কথাই আছে। গল্প না, প্রবন্ধ না, ধর্মকথা না।

ব্রজগোপাল একটু ঝুঁকে বললেন—এটা কীসের বই ভাই?

লোকটা মুখ তুলে একটু হাসল। পাকানো মোচের নীচে বেশ ঝকঝকে হাসি। মাঝবয়সি মানুষ। দেখে মনে হয় কোথাও বেশ ভাল বেতনের দায়োরান-টারোয়ানের চাকরি করে বলল—রামসীতার নাম আছে বুড়াবাবা, আর কুছু নাই।

—সে তো মনে মনে জপ করলেও হয়।

—এ ভি জপ আছে। পড়তে পড়তে জপ হয়ে যায়।

তাই তো! ব্রজগোপাল ভারী মুগ্ধ হয়ে যান। এই হচ্ছে এৎফাঁকি বুদ্ধি। দুনিয়ার টানাপোড়েন, গণ্ডগোলে অস্থির মন যখন জপ করে রাখতে পারে না তখন এইভাবে নিজেকে জপে বদ্ধ করা যায় বটে। লোকটার ওপর ভারী শ্রদ্ধা হয় ব্রজগোপালের। কেমন নিবিষ্ট মনে নিজেকে রামসীতার নামের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে! লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে তাঁর। কিন্তু ইষ্টনাম জপে বাধা হবে বলে বলেন না। কিন্তু মানুষের মধ্যে আন্তরিক ভক্তিভাব দেখলে তাঁর চোখে জল আসে।

গ্রীষ্মকালে হাওড়া স্টেশনে বেশ সস্তায় নাগপুর না কানপুর কোথাকার যেন কমলালেবু বিক্রি হয়। কদমার মতো ছোট ছোট লেবু, ভারী মিষ্টি। বোঁটার কাছে কিছু পচা-পচা ভাব থাকে, সেটুকু চেঁছে ফেলে বেশ খাওয়া যায়। হাওড়া স্টেশনে গাড়ি ছাড়বার আগে এক বুড়ো মানুষকে লেবু কিনতে দেখেছিলেন। সঙ্গে পোঁটলা-পুঁটলি আছে, বৃদ্ধা স্ত্রীও আছেন সঙ্গে। এই ভিড়ে ‘আমি বুড়ো মানুষ বাবা, সঙ্গে মেয়েছেলে আছে বাবা’ এইসব বলতে বলতে ঠেলেঠুলে গাড়িতে উঠে পড়তেও দেখেছিলেন। এখন ভিড় পাতলা হওয়াতে দেখা গেল, সেই বুড়ো মানুষটি বেশ গুছিয়ে বসেছেন উলটোদিকের দূরের জানালার ধারে। জানালার ধারের জায়গা দখল করা এই গরমকালে বেশ মুশকিল। কিন্তু ঘোড়েল গোছের লোকটা দিব্যি জায়গাটা বন্দোবস্ত করেছেন। এও এৎফাঁকি বুদ্ধি। বুড়োর উলটোদিকে কয়েকটা চ্যাংড়া ছেলে বসেছে, ইয়ারবাজ। তাদের সঙ্গে জমিয়ে তুলেছেন বেশ। পাশে আধ-ঘোমটায় গিন্নি মানুষটির মুখ বেশ প্রসন্ন। দেখলেই বোঝা যায়, এরা বেশ সুখী লোক। বিষয় সম্পত্তি আছে, ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত, তেমন কোনও দুশ্চিন্তা নেই। চপাচপ লেবু খাচ্ছেন, মুখে হাসি।

চ্যাংড়াদের একজন বলে—জায়গাটা যে ছেড়ে দিলাম দাদু, তার বদলে কী দেবেন?

—কী দেব বাবা, বুড়ো মানুষ আমরা, পরের ভরসায় রাস্তায় বেরোই। তোমরা জায়গা ছাড়বে না তো কে ছাড়বে! ইয়ং ম্যান সব, স্পিরিটেড।

—ওসব গ্যাস ছাড়ুন। বর্ধমানে কিন্তু মিহিদানা খাওয়াতে হবে।

—আর মিহিদানা! সে বস্তু কী আর আছে। এখন কেবল বেসম আর চিনির রস। ও আমরা খাই না। আবার লেবু মুখে দিয়ে কোয়ার ফ্যাঁকড়া মুখ থেকে টেনে বের করতে করতে বলেন—তোমাদের বয়সে বুড়ো মানুষ আর মেয়েছেলে দেখলেই আমরা জায়গা ছেড়ে দিতুম।

—আমরাও তো দিলাম। আর একজন চ্যাংড়া বলে—আরও কিছু করতে হবে নাকি বলুন না। আর খুব পরোপকারী। বয়সের নাতনি-টাতনি থাকলে বলুন, দায় উদ্ধার করে দেব।

লোকটা খুব ঘোড়েল। একটুও ঘাবড়ায় না। হাতের আধখানা লেবু গিন্নির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—ধরো! গিন্নি মুখটা ফিরিয়ে নেন, হাতের একটা ঝাপটা দিয়ে সরিয়ে দেন হাত। বুড়ো লেবুটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে—না ভাই, নাতনি-টাতনি নেই। দুই ছেলে। ছোটটির জন্যই, মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতায়।

একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে—পছন্দ হল?

—না বাবা। বড্ড রোগা। মুখখানা আছে একরকম, কিন্তু হাওয়ায় হেলেপড়া চেহারা। ও আমার পছন্দ নয়।

—তা ওখানে খ্যাঁটটা কেমন হল দাদু?

বুড়ো হাসে। মাথা নেড়ে বলে—খাইয়েছে ভাল। এই দুর্দিনে বেশ বড় বড় রাজভোগ পায়েস, ফলটল।

—বছরে কবার মেয়ে দেখেন দাদু? দু-তিনবার করে হলে তো বেশ ভালই ম্যানেজ হয়, কী বলেন? আচ্ছা ম্যানেজার বাবা!

অন্য একটা চ্যাংড়া বলে—বুড়ো ভাম।

বুড়ো সবই শোনে। একটু হাসিমুখে লেবু খায়, আর বলে—তা ছেলের বিয়ে দিতে হলে মেয়ে তো দেখতেই হবে।

—হুঁ! ওদের চোখকে বিশ্বাস কী? বয়সের ছেলে, কটা চামড়া কী ভাসা ভাসা চোখ, কী একটু পাতলা হাসি দেখে মাথা ঘুরে যাবে। আমাদের চোখ অন্যরকম।

—দুরকম চোখ দাদু? ছুঁচে সুতো পরাতে পারেন?

বুড়ো হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলে—চোখ দুখানা এখনও আছে, বুঝলে! ঘরে লক্ষ্মীনারায়ণের সেবা হয়। রোজ সকালে নিজের হাতে মালা গেঁথে পরাই। লক্ষ্মীনারায়ণকে বলে রেখেছি, যেদিন চোখের দোষ হবে সেদিন থেকেই মালা বন্ধ।

বলে ঘোড়েল মানুষটা মাথা নেড়ে হেসে বলে—বুঝলে তো! চোখে আজ তাই পষ্ট দেখি। লক্ষ্মীনারায়ণের প্রাণে ভয় আছে না, মালা বন্ধ হয়ে যাবে যে!

ব্রজগোপাল মুখটা ফিরিয়ে নেন। পশ্চিমা লোকটা সীতারামের নাম পড়ে যাচ্ছে নীরবে। জপ করছে। অন্তরের গভীরতম প্রার্থনা সংসার থেকে সুতো বেয়ে চলে যাচ্ছে কী তাঁর কাছে! ব্রজগোপাল চোখ বুজে একটা গভীর শ্বাস ফেলেন। রণেনের কথা কেন যে এতবার মনে হচ্ছে! ভাবতে ভাবতে একটু শিউরে ওঠেন বুঝি! ছেলেটা শীলার বাসায় বসে একা-একা কথা বলছিল। সংসারে বোধ হয় ন্যাজে-গোবরে হচ্ছে একটু অল্প বুদ্ধির ছেলেটা। ছেলেবেলায় টাইফয়েডের পর মাথার দোষ হয়েছিল। মাথাটা কমজোরি। তেমন ভাবনা-চিন্তার চাপ পড়লে কী হয় না হয়। সংসারের আত্মীয়রা বড় স্বার্থপর, মন বুঝে, অবস্থা বুঝে চলে না। রণেনের মনে ব্যথা দিয়ে কারও কিছু করা উচিত নয়। কিন্তু সে কি ওর বউ বোঝে! না কি ননীবালাই বোঝেন? না কি বাচ্চাকাচ্চা বা ভাই-ই বোঝে! সংসার এত মন বুঝে চললে তো স্বর্গ হয়ে যেত। রণেনের জন্য ব্রজগোপালের মনটা তাই ভাল লাগে না। ওকে বোধ হয় সবাই অতিষ্ঠ করে, অপমান করে। কিছুকাল আগে একবার দৌড়ে গিয়েছিল গোবিন্দপুরে। স্টেশনে দেখা হতে বলেছিল—সংসারে যত অশান্তি। আজকেও একবার ট্যাক্সিতে হঠাৎ ‘বাবা’ বলে ডেকেছিল, কিন্তু কিছু বলেনি। কিছু যেন বলার ছিল। লজ্জায় পারেনি।

ব্রজগোপাল চোখ বুজে চাপ ধরা বুকের ভারটা আর একটা দীর্ঘশ্বাসে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। মনের মধ্যে বলে রাখলেন—সব ভাল রেখো। ওদের সুখে রেখো।

সংসারে ওই যে লেবু খাচ্ছে ঘোড়েল লোকটা, মান অপমান জ্ঞান কিছু কম, লোভী ওই সব মানুষেরা একরকম সুখেই আছে। ঠাকুরদেবতার সঙ্গে পর্যন্ত চুক্তি করে কাজ করে। ব্রজগোপাল আবার একটা শ্বাস ছাড়লেন। পাশের লোকটা আপনমনে সীতারামের নাম পড়ে যাচ্ছে। ওটা বুঝি বুড়ো বামুনেরই ইঙ্গিত। ব্রজগোপাল ছিঁড়ে-যাওয়া জপের সুতোটা আবার চেপে ধরলেন। জপ চলতে থাকল।

স্টেশনে যখন নামলেন তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। এদিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মের মোরম ভেজা। বাতাসে ভেজা মাটির আঁশটে গন্ধ। গাছপালার হাওয়া-বাতাসের পাগল শব্দ। আকাশে হালকা মেঘ রেলগাড়ির মতো চলে যাচ্ছে, অন্ধকারেও বোঝা যায়। প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়াতেই ওই বাতাস, ওই গাছ-মাটির গন্ধ, পৃথিবী-জোড়া অন্ধকার ব্রজগোপালের মন থেকে ধুলোবালি ঝরিয়ে দিল। মনখারাপটা ভুল পড়ল একটু।

প্ল্যাটফর্মের গাছতলায় কাঠের বেঞ্চ-এ একজন লোক গা মাথা একটা গামছায় ঢেকে বসে আছে। বেঞ্চের নীচে, পায়ের কাছে হারিকেন। আলোটা বাতাসে দাপাচ্ছে। নিববে। লোকটার পাশে রাখা একটা ছাতা, খোলেনি, প্রকাণ্ড অন্ধকার চেহারাটা দেখেই চিনতে পারেন ব্রজগোপাল।

একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন—বহেরু।

লোকটা নড়েচড়ে উঠে বসে, বলে—আলেন?

—হুঁ।

—ভয় লাগতে ছিল, ভাবলাম বুঝি আজ আর আলেন না। ঠাকরোন আর ছানা-পোনারা সব ভাল?

—হুঁ, তুই কখন থেকে বসে আছিস?

—অনেকক্ষণ। তখন বেলা ছিল।

বহেরু উঠে দাঁড়ায়। বলে—আজকাল আপনি না থাকলি ভাল লাগে না।

ব্রজগোপাল চুপ করে থাকেন। একটু কষ্ট হয়। বহেরুটা এবার বুড়ো হল এই সত্তর বাহাত্তর বছর বয়সে। বলেন—তা তুই কেন বসে আছিস দুপুর থেকে, আমার তো রাতেই ফেরার কথা, তখন না হয় কালীপদ বা কোকা আসতে পারত!

—তাদের বড় গরজ! বামুনকর্তার মহিমা তারা কী বুঝবে!

—তা না হয় আমি একাই যেতাম। অভ্যেস তো আছে। দুপুর-দুপুর এসে বসে আছিস, বাদলায় ভিজেছিস নাকি!

স্টেশনের বেড়া পার হয়ে রাস্তায় পড়ে বহেরু ডান ধার বাঁ ধার তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলে—না। স্টেশনের ঘরে গিয়ে বসলাম তখন। বাদলা তেমন হয়ওনি। ছিটে-ফোঁটা। হারিকেনটা তুলে একবার দেখল বহেরু। আগুনটা দাপাচ্ছে। বলল—এটা নিবে গেলেই চিত্তির।

—টর্চ তো ছিল।

—সে কোন বাবু নিয়ে বেরিয়েছে কী হারিয়ে এসেছে কে তার খোঁজ রাখে। রাবণের গুষ্টি। বলে বহেরু খুব বিরক্তির গলায় বলে—বেরুনোর সময়ে খুঁজে পেলাম না। আপনারও তো একটা ছিল।

ব্রজগোপাল থেমে ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতড়ে ছোট্ট টর্চবাতি বের করে দেখেন বোতাম টিপতে একটা অত্যন্ত মলিন লাল আলো ধীরে জ্বলে উঠল। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—এটারও ব্যাটারি ফুরিয়েছে। আজ আনব বলে ঠিক করেছিলাম, তাড়াহুড়োয় ভুলে গেলাম।

—নলিনীর দোকানে পাওয়া যায়।

—দূর! ও ব্যাটা চোর। তিন আনার জিনিস আট আনা হাঁকে। কলকাতায় কিছু সস্তা হয়। গায়ে গায়ে সব দোকান গজিয়েছে, রেষারেষি করে বিক্রি করে। তাই সস্তা।

বহেরু বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। বলল—ভারী শহর। বহুকাল যাই না। বহেরু একটু থেমে গিয়ে ব্রজগোপালের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলে—আপনি একটু আগু হোন। আলো পেছনে থাকলিই ভাল।

ব্রজগোপাল এগোন। বহেরু পিছনে বোধ হয় ফস করে বিড়ি ধরাল। অলোতে সামনে ছায়াটা লম্বা হয়ে দিগন্তের অন্ধকারে মিশে গেছে। ব্রজগোপাল ঠাহর করে হাঁটেন। বহেরু বলে—সেই দুপুর থেকে বসে বসে মাছি মশা তাড়াচ্ছি। কত ট্রেন গেল।

ব্রজগোপাল শুধু বিরক্তিসূচকভাবে বললেন—হুঁ।

—বাসায় বসে দিন কাটে না।

—তোর তো কত কাজ। ব্রজগোপাল বলেন।

একঝলক বিড়ির গন্ধ আসে পিছনে থেকে। বহেরু নিরাসক্ত গলায় বলে—করতে গেলে কাজ ফুরোয় না, সে ঠিক। কিন্তু এখন মনে করি, আর কাজ কী কাজে! কাজ করে মেলা কাজি হয়েছি। সংসার বেশি দেখতে গেলে কাজিয়া লেগে যায়। ছেলেগুলো সব হারামি, জানেন তো।

ব্রজগোপাল একটু ভেবেচিন্তে বলেন—তোরই রক্তের ধাত তো। পাজি তুই কি কিছু কম ছিলি?

বহেরু একটু হাসল। বলল—বুড়োও তো হলাম।

—বুড়ো মনে করলেই বুড়ো। মনে যদি বয়স না ধরিস তো বুড়ো আবার কী! বুড়োটে ভাবটাই ভাল না।

বহেরু একটু চুপ করে থাকে। বলে—এক পাঞ্জাবি জ্যোতিষকে ধরে এনেছিলাম পরশুদিন। বললাম থাকার জায়গা দেবো, ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করব, থাকো। রাজি হল না। তা সে হাতটাত দেখে বলল, আমার কপাল নাকি খুব ভাল। তীর্থে মরব।

ব্রজগোপাল মরার কথা সহ্য করতে পারেন না। একটু এঁটেল মতো পিছল জায়গা পার। হচ্ছিলেন সাবধানে। একটু ঝাঁকি মেরে বললেন—তীর্তে মরলে কি আর দুটো করে হাত পা গজাবে নাকি! যত ইল্লুতে কথা! বেঁচে থেকে কী কী করতে পারবি তাই ভাব।

—আর কী করব! আপনি কথা কবেন, পায়ের কাছে বসে শুনব। পাপ তাপ কেটে যাবে। কত কুকর্ম করেছি।

—কর্মের পাপ কর্ম দিয়ে কাটাতে হয়। তত্ত্ব শুনলে কাটে না।

—আপনার কেবল ওই কথা। কাজ তো অনেক হল।

—তবে কি তোর পছন্দমতো কথা বলতে হবে নাকি! কাজকে তোর এত ভয় কীসের?

বহেরু একটু চুপ করে থাকে। বিড়ির ধোঁয়া বুকে চেপে রাখতে গিয়ে দু-দমক কাশি আসে। বলে কাজকে ভয় নেই। ছেলেগুলো বড় ব্যাদড়া। সামলাতে পারি না। এই সেদিনও রক্তের দলা ছিল সব, এখন ডাকাত হয়ে উঠেছে।

—হলই বা। বিশ্বসংসারের কাজ বলতে কী কেবল নিজেব সংসারের কলকাঠি নাড়া? অন্য কিছু নেই?

—কিছুতেই মন লাগে না। মেধু ডাক্তারের ভূত নয়নতারাকে ভর করে রাতবিরেতে কত কথা বলে?

—কী বলে? ব্রজগোপাল ধমক দিয়ে বলেন।

পুরনো একটা সাঁকো পার হয়ে ব্রজগোপাল বড় রাস্তা ছেড়ে আল ধরার জন্য নেমে পড়লেন। বহেরু রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল, লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরে বলল—দুর্যোগে ফুলতলার রাস্তা দিয়ে যাবেন নাকি!

—ভারী তো দুর্যোগ! ক’ফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে, সেইজন্য আধ মাইল ঘুরপথে যাব নাকি!

বহেরু ইতস্তত করে বলে—রাস্তাটা ভাল নয়। রাম রাম।

ব্রজগোপালের মায়া হল। বহেরুর কোনওকালে ভয়ডর বলে বস্তু ছিল না। এখন কেমন কোলঘেঁষা ছেলের মতো ভয় পায়। ব্রজগোপাল নীচে থেকে রাস্তার ওপর ওর বিশাল ছায়াটা দেখলেন। হারিকেনের খুব নিবন্ত আলোয় চোখমুখ অসুরের মতো দেখায়। এখন লোকে ওকে দেখলে ভয় খেয়ে যাবে। কিন্তু আদতে বহেরু ডাকাতের নিজের প্রাণেই এখন নানা ভয়ভীতির বাসা। ব্রজগোপাল বললেন—ভয়টা কীসের? বলে আবার রাস্তায় উঠে এলেন, যেখানে জেদি কুকুরের মতো পা জড়িয়ে আছে বহেরু। এখন ওকে টেনেও নেওয়া যাবে না।

আবার আগে আগে হাঁটেন ব্রজগোপাল, পিছনে বহেরু। বহেরু পিছনে গলা খাঁকারি দেয়। বলে—ঘরে বসেই সব শুনতে পাই। রাতবিরেতে নয়নতারা কাঁদে। ঘুমোয় না মেয়েটা। কেবল বোনাসুরে বলে-রক্ত বৃষ্টি হবে, মাটির তলায় বসে যাবে গ্রামগঞ্জ। আর আমার নাম ধরে ডেকে বলে—তুই মরবি শেয়াল কুকুরের মতো, ধাঙড়ে পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে ভাগাড়ে। গতিমুক্তি হবে না, অন্ধকারে হাতড়ে মরবি চিরকাল, জন্ম হবে না। এই সব বলে।

ছাতাটা একটু মাটিতে ঠুকল বহেরু। গলাখাঁকারি দিল। আলোটা তুলে কল ঘুরিয়ে তেজি-কমী করল। ব্রজগোপাল ফিরে তাকালেন একটু। মুখের কাছে আলোটা তুলেছে তাই মুখটা দেখতে পেলেন। আর কিছু নয়, কেবল মুখে একটা আলগা বুড়োটে ছাপ পড়েছে। ব্রজগোপাল একটু চিন্তিতভাবে হাঁটেন। অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ একটু ফুর্তির সুরে বলেন— দূর ব্যাটা! দলমাদল কামান দাগায়ে দে, সব ভয়ভীতি খসে পড়বে।

বহেরু পিছন থেকে তাড়াতাড়ি দু-কদম এগিয়ে আসে—কী বলেন কর্তা?

—কী কী! জয়গুরু জগন্নাথ। তুই ছিলি কাজের কাজি, এখন হয়েছিস ভাবন কাজি। এত ভাবিস ক্যান? চাষাভুষো মানুষকে কি ভাবনাচিন্তা সয়? মনের মুখে নাড়া জ্বেলে দে। দুনিয়া কি তোর? এত ভাবনা কেন?

তত্ত্বকথার গন্ধ পেয়ে বহেরু কান খাড়া করে। ব্রজগোপালের ঘাড়ে শ্বাস ফেলে পিছু পিছু হাঁটে গৃহপালিতের মতো। বলে—ঠাকুর থাকবেন তত আমার কাছে? ছাড়ে যাবেন না তো!

দূর ব্যাটা।

বহেরু একটা শ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে বলে—ঠাকুর, থাকেন। থাকেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *