যাও পাখি – ৩০

॥ ত্রিশ ॥

অণিমার সান্নিধ্য কোনওদিনই খারাপ লাগেনি সোমেনের। ওকে ভয় পাওয়ারও কিছু ছিল না। খুব ঠান্ডা মাথার মেয়ে অণিমা। সব সময়ে মুখখানা সিরিয়াস করে বিচ্ছুর মতো ইয়ারকি দেয়।

কিন্তু এ অণিমা যেন সে নয়।

অণিমা ফিরে তাকাল। আবছা অন্ধকারে ওর মুখচোখ দেখা যায় না। কিন্তু শ্বাসের শব্দ আসে। অণিমা খুব নার্ভাস আজ! যেন বা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, এমনভাবে নাক টানল। বলল—বললে না?

সোমেনের গলার স্বর অন্যরকম হয়ে গেল। সে প্রায় ধরা গলায় বলে—কোন কথাটা? অণিমা জানালার দিকে পিছন ফিরে জানালার গ্রিল-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো তুলে পিছনে মুড়ে জানালার গ্রিল ধরে আছে। ভঙ্গিটা শিথিল, কেমন যেন। বলল সেই কথাটা। যেদিন চাঁদ উঠবে, ফুল ফুটবে, লোডশেডিং থাকবে, সেদিন আমরা দুজন দূরে কোথাও গিয়ে

—ও। বলে হাসল সোমেন। প্রাণহীন হাসি।

— কথাটা কিন্তু কোনওদিনই বলোনি।

—আজ কি বলব অণিমা?

—বলো। কেন, শুনে কী হবে?

—শুনতে ইচ্ছে করছে। কেউ তো কোনওদিন বলেনি।

—যাঃ। তোমাকে অনেকে বলেছে।

অণিমা একটু হাসল, বলল—বললেই বা। তুমি তো বললানি।

—ভয় পেতাম অণিমা। যা মেয়ে তুমি, শুনেই হেসে উঠবে হয়তো।

—নইলে সিরিয়াসলি বলতে?

সোমেন উত্তর দিল না।

একটা ফোঁপানির মতো কাঁপা শ্বাস ফেলে অণিমা বলে—আমি খুব ইয়ারকি করি, না?

আর তৎক্ষণাৎ ঘটনাটা ঘটল বজ্রপাতের মতো। সোমেন জানত না, এতটা হবে।

ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়েছিল সোমেন, প্রতিরোধহীন। জানালার চৌকো আলোর পরদায় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল অণিমা। হঠাৎ অণিমার ছায়া খসে পড়ল। নিঃশব্দ, নরম পায়ে অণিমা ছুটে এসে হঠাৎ দুটো জোরালো হাতে সোমেনের দু-কাঁধ খামচে ধরল আশ্লেষে, টেনে আনল নিজের দিকে। অন্ধকারে একটু বুঝি সময় লাগল অণিমার। সোমেনের ঠোঁট দু-খানা খুঁজতে। তারপরই সোমেন দু-খানা তুলোর চেয়েও নরম, উত্তপ্ত, আঠালো ঠোঁটের স্বাদ পেল নিজের ঠোঁটে।

বিশ্বাস হয় না। তবু ঘটনাটা ঘটছে। এমন নয় যে, সোমেন কাউকে কখনও চুমু খায়নি। কিন্তু অণিমা এত অন্যরকম। কী করে হয়! ভেবে কাঠের মতো হয়ে গেল সোমেন। শরীরে থরথরানি, কিন্তু আড়ষ্ট, ভীত। কী গভীর ঝড়ের মতো শ্বাস ফেলল অণিমা তার মুখে। সেই শ্বাসের বাতাস এত গরম যেন চামড়া পুড়ে যায় সোমেনের। অণিমার শরীরের ভিতরে বুঝি জ্বর? ভয়ংকর এক জ্বর! দুই হাতে সোমেন অণিমাকে ধরতে যাচ্ছিল বুঝি। অণিমা তখন সরে গেল আচমকা।

জানালায় ঠিক আগের মতো হয়ে দাঁড়াল। সোমেনের দিকে পিঠ। আস্তে করে বলল—এটা কিন্তু ইয়ারকি নয়।

অণিমার গলাটা ধরা-ধরা। প্রবল শ্বাস। হাঁফাচ্ছে। সোমেন হাতের পিঠে ঠেটি মুছে নেয়। কিছু বলার নেই। জীবনে এরকম কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যার কোনও অর্থ হয় না। আর কি কোনওদিন সোমেন ইয়ারকি করতে পারবে অণিমাকে নিয়ে? কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল সোমেনের। বলল—তুমি পাগল আছ, মাইরি!

অন্ধকারেই অণিমা একবার ফিরে তাকাল তারদিকে। একবার নাক টানল। তারপর খুব সহজ হয়ে একবার বলল—ও ঘরে যাও সোমেন। গাব্বু আজ পড়বে না।

করিডোরটা পার হয়ে সামনের ঘরে আসবার পথটুকুতে সোমেন তার শরীরে অণিমার গন্ধ পাচ্ছিল। অণিমার গায়ে কোনও দামি সুগন্ধী ছিল, মুখে ছিল রূপটান। এসব অণিমা বড় একটা মাখে না। আজ কেন মেখেছিল কে বলবে? সবচেয়ে বেশি সজাগ হয়ে আছে সোমেনের ঠোঁটে অণিমার মুখের স্বাদ। সেই সঙ্গে একটা অনিচ্ছুক, কিন্তু তীব্র কামবোধ। শরীর তো মনের বশ নয়। সোমেনের বুকের মধ্যে একটা ধুকধুকুনি উঠেছে, চোখেমুখে রক্তোচ্ছাস। বাইরের ঘরের আলো আর অনেক চোখের চাউনির মধ্যে এসে দাঁড়াতেই তার বড্ড লজ্জা হতে লাগল।

ঘরের মাঝখানে ম্যাক্স দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা চোথা কাগজ। চোখ দুটোয় নীল আগুন। ওই আগুনের রহস্য আজও ভেদ হয়নি সোমেনের কাছে। ওই নিরীহ রোগা সাহেব লোকটার চোখ ওরকম জ্বলে কেন? কাগজ হাতে ম্যাক্স দাঁড়িয়ে চারধারটা ওই আগুনে-চোখে দেখে নিচ্ছিল।

ঘরের কোণে একটা প্রকাণ্ড গোল টেবিলের ওপর বসেছিল অপালা। ঝুটো হারের লকেটটা মুখে পুরে চুষছে। সোমেনকে বড় বড় চোখের দৃষ্টিতে প্রায় ছ্যাঁদা করে দিল। ঝামরে বলল—কোথায় গিয়েছিলি?

পূর্বা সোফায় অনিল রায়ের পাশে বসে আছে। মুখ ফিরিয়ে বলল—ও তো প্রাইভেট টিউটর এ বাড়ির, জানিস না?

সে কথার কোনও উত্তর দিল না অপালা। বড় স্থির চোখের চাউনিতে তাকিয়ে থেকে বলল—এখানে এসে চুপ করে বোস। ম্যাক্স একটা কবিতা পড়বে।

অনিল রায় হাত তুলে বললেন—চুপ। হাশ্‌ সায়লেন্স।

গোলটেবিলের ওপর অপালার পাশে উঠে বসে সোমেন। ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করে ম্যাক্স কবিতা লেখে? জানতাম না তো।

অপালা মাথা নেড়ে বলে—লেখে। আরও কত কী করে!

বাঙালির চেয়ে কয়েক পরদা গম্ভীর বাজ ডাকার মতো গুরগুরে গলায় ম্যাক্স কবিতা পড়তে শুরু করে। কবিতার নাম—গ্র্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ইংরেজি কবিতাটার অর্থ এরকম—আমি একদিন গ্র্যান্ড রেস্টুরেন্টে যাই। তখন সকালবেলা। রেস্টুরেন্টে লোকজন ছিল না। কী চমৎকার সেই দোকানঘর! দেয়ালে দেয়ালে সুরেলা রং। কাচের তৈরি সব জানালা দরজা। মেঝেতে পুরু কার্পেট। একধারে নাচের জায়গা। টেবিল-চেয়ারগুলি কী চমৎকার। সেই সকালেও ব্যান্ড বাজছে রেস্টুরেন্টে। সেই সুর শুনে মনে হয়, পৃথিবীর সব দুঃখ বুঝি ঘুচে গেছে। আমি সেখানে বসে রইলাম অনেকক্ষণ, মনটা বড় ভাল হয়ে যাচ্ছিল। তারপর আমার একবার ল্যাভেটারিতে যাওয়ার দরকার হলে আমি বেয়ারাকে ডেকে বললাম—তোমাদের ল্যাভেটারি কোনদিকে? লোকটা খুব বিনীতভাবে আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল ল্যাভেটারিটা, দূর থেকে। আমি ল্যাভেটারির দরজা খুলে ঢুকেই কিন্তু শিউরে উঠলাম। এ কী নরক চারদিকে! মেঝের ওপর পড়ে আছে শেষ রাতের মাতালের বমি, বেসিনের গায়ে ফাটা আর ময়লার দাগ। মেঝেয় জল জমে আছে। আয়নাটা নোংরা। তেমন নোংরা ওদের কমোড। আমি দৌড়ে ফিরে এলাম, সোজা গিয়ে ম্যানেজারের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম—কেন তোমার সামনের দোকানটা এত ঝকমকে? আর কেনই বা তোমার ল্যাভেটারি এত নোংরা? কেন তোমার ল্যাভেটারিটাও নয় তোমার রেস্টুরেতে মতোই পরিষ্কার? আমি এই কথা চিৎকার করে যত বলি, লোকটা তত অসহায়ের মতো বলে—আমি কী করব, তামার কী করার আছে?

কয়েকজন ক্ষীণ হাততালি দিল। বোঝা গেল যে, কেউ কিছু বোঝেনি।

অপালা সোমেনের কানে কানে বলে—কী সব পড়ল রে? বাথরুমটা নোংরা বলে অত রাগ কেন?

সোমেন খানিকটা স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে বলল—ওটা আসলে বাথরুম নয়।

—তবে কী?

—সভ্যতার অভ্যন্তর। সভ্যতার বাইরের দিকটাই চকচকে, ভিতরটায় নোংরা জমে যাচ্ছে।

অপালা চোখ বড় বড় করে বলে—বাঃ, তুই তো বেশ কবিতা বুঝিস।

সোমেন মাথা নেড়ে বলে—আমি বেশি বুঝি না, তবে তোরা কিছু কম বুঝিস।

—আমরাও কিছু কম বুঝি না। বলে অপালা বড় বড় চোখে একবার সোমেনের দিকে দেখে নিয়ে মুখটা ফিরিয়ে বলে—মেয়েদের কাছে তোর এখনও ঢের শেখার আছে।

কবিতার মাঝখানে কখন যেন অণিমা ঘরে এসেছে। একটু ঘুরল এদিক-ওদিক। ম্যাক্স যে মোড়ায় বসে আছে তারই পাশে মেঝের ওপর বসল দীনদরিদ্রের মতো। মুখখানা এখনও বুঝি একটু লাল। আর কিছুটা অন্যমনস্ক। সোমেনের চোখে চোখ পড়ল একবার। একটু ক্ষীণ হাসল। চোখ সরিয়ে নিল আস্তে আস্তে। কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই ওর কি কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল? লজ্জা করছিল সোমেনের।

চায়ের আর বিস্কুটের ট্রে নিয়ে চাকর এল ঘরে। সবাই চা নিচ্ছে, ঘরের মাঝখানে একটু হুড়োহুড়ি। কেবল সোমেন চা নিতে উঠল না, অণিমাও নয়। সোমেন ভাবে—আমরা অন্যরকম হয়ে গেলাম। এরকমই কি হওয়া উচিত ছিল? এটা কি স্বাভাবিক! ভাবতে গেলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বয়সের ছেলেমেয়ে, হলে দোষ কী? কিন্তু মনটা কখনও প্রস্তুত ছিল না তো সোমেনের! প্রেম নিয়ে কত ঠাট্টা করেছে তারা। বিপজ্জনক সব ঠাট্টা। মনে কিছু থাকলে কি ওরকম ঠাট্টা করা যায়!

চায়ের পর রিহার্সাল শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু হুল্লোড়ে তা আর হল না। এখন নিছক আড্ডা চলবে। সোমেনের কিছুক্ষণ একা হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। সকলের অন্যমনস্কতায় সে টুপ করে উঠে পড়ল একসময়। দরজার কাছ বরাবর গিয়ে একবার চোর-চোখে ফিরে তাকাল। দেখল আর কেউ নয়, কিন্তু অণিমা ঠিক অপলক চোখে চেয়ে আছে।

সোমেন মুখটা ফিরিয়ে নিল। বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই অণিমার ডাক শুনতে পেল—শোনো।

সোমেন দাঁড়ায়—কী?

—গাব্বুকে এরপর পড়াবে তো?

সোমেন যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে—পড়াব না কেন?

অণিমা একটু হেসে বলল—ভয় ছিল, তুমি—তোমার খুব রাগ হয়নি তো!

সোমেন মাথা নেড়ে বলে—না তো! তবে কেমন অন্যরকম লাগল অণিমা।

—বোকা, অন্যরকম আবার কী! তুমি ভারী উলটোপালটা মনের ছেলে।

—এতকাল টের পাইনি তো কিছু।

—সে তোমার বোঝার দোষ। কিছু ভুল হয়নি সোমেন। আমি তোমাকে জানাতে চাইছিলাম। হয়তো কাজটা নির্লজ্জ হয়েছে।

সোমেন মুখ তুলে অণিমাকে দেখল। বেশ সুন্দরীই অণিমা। বয়স সোমেনেরই মতো। তাদের ভালবাসা হতে কিছু আটকায় না। তবু কেন যে সোমেনের মনটা দোমড়ানো কাগজের মতো হয়ে আছে! তাতে অনেক ভাঁজ, অনেক আলো অন্ধকারের ইকড়ি-মিকড়ি। কোথায় যেন আটকাচ্ছে।

—চলি। সোমেন বলল।

অণিমা বুঝি কিছু আকুলতাভরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে বলে—শোনো, আর একটা কথা।

—কী?

—তোমার কোনও ভয় নেই। আমি ভূতের মতো তোমার ঘাড়ে ভর করব না।

—বুঝলাম না আণিমা।

— বলছি। আজ যা করেছি তা একটা স্মৃতিচিহ্নের মতো রইল।

সোমেন অবাক হয়ে বলে—তার মানে?

অণিমা হাসল। আকাশে জ্যোৎস্না রয়েছে। সেই জ্যোৎস্নায় বড় ম্লান দেখাল হাসিটি। বলল—আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বৈশাখে। কাউকে এখনও জানাইনি। তোমাকে জানালাম প্রথম।

সোমেনের শরীরে একটা বিদ্যুৎ স্পর্শ করল হঠাৎ। বাতুলের মতো চেয়ে থেকে সে বলে—কী বলছ অণিমা?

—সত্যি সোমেন। গাড়ি-বাড়িঅলা এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে।

সোমেনের বুকটা হঠাৎ বায়ুশূন্য হয়ে যায়। দম নিতে কষ্ট হয় তার। বড় আশ্চর্য ব্যাপার। একটু আগে অণিমা যখন চুমু খেয়েছিল তখন থেকে এই সময়টুকুর মধ্যে তার মনে মনে একটা প্রত্যাশা তেরি হয়েছিল। তার ভিতরে যেন সর্বদাই বাস করে অন্য এক সোমেনের যার সঙ্গে এই সোমেনের ইচ্ছের মিল নেই। সেই অন্য সোমেন বুঝি এই ক্ষণেক সময়টুকুতেই অণিমাকে নিজের বলে চিহ্নিত করে রেখে দিয়েছিল। ভিতরের সেই সোমেনটাই এখন মার খেয়ে মুষড়ে ওঠে।

—তা হলে আজকের ব্যাপারটা কেন করলে অণিমা?

অণিমা ঘন গভীর শ্বাস ফেলে একটা। বলে—তোমাকে জানিয়ে দিলাম যে, জীবনে আমি কত অসুখী হব। ওরকম না করলে তুমি বুঝতে না সোমেন। এখন বুঝবে। মনে রাখবে।

হঠাৎ সোমেন তার ভুবনজয়ী হাসিটা হাসে। বলে—ধ্যাৎ। তুমি ভারি ইমোশনাল, এমন তো ছিলে না?

অণিমাও হাসে। হঠাৎ ডান হাতখানা বাড়িয়ে পাকা জুয়াড়ির মতো গলায় বলে—কুইটস।

সোমেন হাতটা ধরে। বলে—শোধবোধ।

অণিমা হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে—এসো সোমেন। গাব্বুকে পড়িও। লজ্জার কিছু নেই। সোমেন মাথা নাড়ল।

নির্জন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোমেন ভাবে—অণিমার হাতটা কেন অত ঠান্ডা?

সোমেন বড় অস্থির বোধ করে। অনেক দূর রাস্তা আপনমনে হাঁটতে থাকে। মাথাটা গরম হয়। একবার নিজের থেকেই হেসে উঠল সে। একবার মাথা নেড়ে বলল—আহা রে। এবং প্রথম বুঝতে পারল, অণিমার বিয়ে হয়ে গেলে তার মন খুব খারাপ লাগবে। বড্ড একা লাগবে তার।

কয়েক দিন ধরে মনটা খারাপ রইল সোমেনের। একটি মুহূর্তের ঘটনাটুকুকে কিছুতেই ব্যাখ্যা করা গেল না। বার বার ম্লান জ্যোৎস্নায় অণিমার প্রেত হাসিটুকু মনে পড়ে। বুকটা বায়ুশূন্য হয়ে যায়।

কয়েকদিন গাব্বুকে পড়াতে গেল না সোমেন। খুব আড্ডা দিয়ে বেড়াল এদিক-ওদিক। কিন্তু মনের মধ্যে কেবলই বুকচাপা দম আটকানো কষ্ট হয়। এই বয়সের মধ্যে সোমেন কখনও এমন গভীর কষ্ট ভোগ করেনি। বার বার ভাবে, একটা সিদ্ধান্তে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু হয় না। কষ্টটা থেকে যায়। ঘুমের মধ্যেও ছটফট করে সোমেন। যখন জেগে থাকে তখন বড় আনমনা হয়ে থাকে। অণিমা সবই স্পষ্ট করে বলেছে তাকে। তবু সসামেনের বড় ঝাপসা লাগে। মাঝে মাঝে তার পাগলামি করতে ইচ্ছে করে।

আবার একদিন গাব্বুকে পড়াতে গেল সোমেন। যতক্ষণ পড়াল ততক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে রইল, বারবার ফিরে তাকাল দরজার দিকে। অণিমার দেখা পাওয়া গেল না। গাব্বুকে অণিমার কথা জিজ্ঞেস করতে তার ভয় হচ্ছিল, যদি গাব্বু কিছু টের পেয়ে যায়!

দু-চারদিন পড়ানোর পর একদিন ধৈর্য হারিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল সোমেন—তোমার দিদিভাই কোথায়?

মোটাসোটা ফরসা আর খুব স্মার্ট ছেলে গাব্বু। চোখে কথা খেলাতে পারে। মিচকি হেসে বলে—আপনি জানেন না! দিল্লি গেছে পিসির বাড়ি বেড়াতে।

সোমেনের আর কিছু বলার থাকে না। সে কেবল ক্ৰমে একজন দুঃখী যুবকের রূপ ধরতে থাকে। একটা চুমু কি ভীষণ ট্র্যাজিক হতে পারে!

এই দুঃখের দিনে আচমকা একটা ঘটনা ঘটে গেল একদিন।

॥ একত্রিশ ॥

আজকাল কেমন বিকেলবেলার মতো বিষয় হয়ে থাকে সোমেনের মন। মনের মধ্যে যেন এক বাসাবদল চলছে। নিজের ঠাঁই ছেড়ে মন চলল কোথায়! চৈত্রের বুক-শুকনো করা গরম বাতাস বয় এখন। সারা গায়ে ধুলো মেখে পিঙ্গল হয়ে থাকে কলকাতা। গাছপালাহীন শানবাঁধানো শহরের আবহে জ্বোরো রুগির গায়ের তাপ৷ দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল আসছে। ঋতুর এই পরিবর্তন তেমন লক্ষ করে না সোমেন। অন্যমনস্কতাই তার সঙ্গী আজকাল। একটি চুম্বনে তাকে বিদীর্ণ করে দিয়ে গেছে অণিমা।

মাঝে মাঝে শীত করার মতো শিউরে ওঠে গা। মাঝে মাঝে তাকে চাবুক মারে স্মৃতি। মনে পড়ে সেই পাগল চুমু-খাওয়া। কোনও মানে হয় না। এও কি অণিমার কোনও ইয়ারকি। এক-একবার ইয়ারকি বলে মনে হয়। তখন বুকে একরকমের কষ্ট টের পায়। যখন ভাবে, ইয়ারকি নয়, তখন একরকমের রহস্যের ঘন গন্ধ ভরে ওঠে বুক।

মানুষের ভিতরে এক অনন্ত জগৎ রয়েছে। নিজের ভিতরে ডুবুরির মতো নেমে যেতে সারলে দেখা যায়, এক ক্ষ্যাপা সেখানে আজব শহর-বন্দর তৈরি করে রেখেছে। অকল্পনীয় সব রঙের বুরুশ ঘষে চারদিক রঙিন করে রেখেছে সে। সেখানে অদ্ভুত সব মানুষের আনাগোনা—যাদের আর কোনওদিন পাওয়া যাবে না। সেখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। নাটকের মতো, বায়োস্কোপের মতো। একটা চুমু-খাওয়া তেমন কিছু আণবিক বিস্ফোরণ নয়, তবু বজ্রপাতের মতো মাঝে মাঝে গর্জে ওঠে সেই চুম্বনের স্মৃতি। মাথার মধ্যে ঝলসে ওঠে নীল ফসফরাস। অণিমা কি তাকে ভালবাসত? নাকি ইয়ারকি করে গেল? তার চব্বিশ পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনে ও কীরকম উপহার অণিমার, ক্ষতচিহ্নের মতো চিরস্থায়ী? মনের সেই অলীক ক্ষ্যাপা জগতে অণিমার উষ্ণ শ্বস কুসুমগন্ধের মতো ছড়িয়ে থাকে। নাড়া-খাওয়া গাছের মতো কেঁপে ওঠে সোমেন। শীত করে ওঠে গায়ে কাঁটা দিয়ে এই চৈত্রেও।

অণিমাকে ভালবাসার কথা কখনও তেমন ভাবেনি সোমেন ইদানীং। এখন নাগালের বাইরে গিয়েই কি শতগুণে ফিরে এল অণিমা।

গাব্বুকে পড়াতে যায় ঠিকই। মাস—মাইনে হাত পেতে নেয়, অবিকল টিউটরের মতো। অণিমা থাকলে এই হীনমন্যতাটুকু আসত না। মাসে একশো টাকা না পেলেও চলে যাচ্ছিল একদিন। এখন ওই একশো টাকার একটা বাজেট তৈরি হয়ে গেছে মাসে। মায়ের একপো দুধের দাম, নিজের সিগারেট-দেশলাই, লন্ড্রি কিংবা রেস্টুরেন্ট, কিছু পত্র-পত্রিকা। এই দুর্দিনে একশো টাকার টিউশনি ভাবাই যায় না। স্কুল-কলেজ ছেড়ে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। কৃষিবিপ্লবের জন্য গ্রামীণ ভারতে ডাক দেওয়া হচ্ছে ছেলেদের। কলকাতার ছেলেরাও দেয়ালে দেয়ালে সেইসব কথা লিখল ঠিকই, কিন্তু স্কুল-কলেজ ছাড়ল না। পরীক্ষাটাকেই আরও সহজ করে নিল তারা। আগুন বোমা, গুলি আর ছুরি ঝলসে ওঠে চারদিকে। স্কুল-কলেজে ছাত্ররা বই খুলে পরীক্ষায় বসে। এ অবস্থায় প্রাইভেট পড়বে কে, কোন দুঃখে! পাস করা অনেক সহজ হয়ে গেছে এখন। অণিমার দেওয়া টিউশনিটা তাই বড় দুর্লভ বলে মনে হয়।

অন্যমনস্কতার মধ্যেই সেদিন গাব্বুকে পড়িয়ে ফিরছিল সোমেন। এই সব ভাল পাড়ার ভিতরে আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। খুব নির্জন। গাছপালার ছায়ায় ঘনায়মান রহস্য। একলা হাঁটতে একটু ভয় করে। কখন নিরালা ফুঁড়ে প্রেতের মতো কয়েকজন এসে ঘিরে ধরবে চারদিক থেকে, ওরা চলে গেলে পড়ে থাকবে সোমেনের লাশ। চারদিক দেখে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে সোমেন আবার মনের মধ্যে ডুবে হাঁটছিল। মনের মধ্যে এক ক্ষ্যাপার তৈরি জগৎ। দুঃখের বা পিপাসার কোনও রং নেই। কিন্তু মনের মধ্যে সেইসব অলীক রঙের আভা ঠিকই ধরা পড়ে। কত কথা ভাবে সোমেন! বুড়োমানুষদের এরকম হয়, আর কিছুই ঘটবে না, তাই তারা অতীতের স্মৃতি নিয়ে থাকে। সোমেনেরও সেই দশা আজকাল। যেন বা, যা ঘটার ঘটে গেছে জীবনে। এখন আছে শুধু তার স্মৃতি। সোমেন আজকাল বড় ভাবে।

সামনেই রাস্তার আলোর স্তম্ভ। তার নীচে গাছের ঘন এবড়ো-খেবড়ো ছেঁড়া ছায়া। সেই ছায়ায় একটা মস্ত লম্বা গাড়ি এসে ধীর হয়ে থামল। পিছনের দরজা খুলে কে যেন নামছে। লক্ষ করার মতোই দামি বিদেশি গাড়ি, অঢেল কালো টাকায় কেনা। সোমেন অবহেলাভরে একবার মুখ তুলে দেখল। গাড়ির পিছনে দামি জড়োয়া গয়নার মতো লাল আলোর অলংকার একবার উজ্জ্বল হয়ে নিল।

আধো অন্ধকারে সোমেন পেরিয়ে যাচ্ছিল গাড়িটা। যে মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমেছে সে ঝুঁকে গাড়ির সিট থেকে তার ব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে সোজা হতেই সোমেনের মুখোমুখি দেখা। এত আবছায়ায় চিনবার কথা নয়। তবু বলল—আরে! আপনি!

রিখিয়া! সচেতন হয়ে সোমেন চেয়ে দেখল, এই তো রিখিয়াদের বাড়ি। সে অন্য মনস্কতায় পেরিয়ে যাচ্ছিল। কোনও ভুল নেই। রাস্তার আলো পড়েছে রিখিয়াদের ঘের-দেয়ালের গায়ে। তাতে আলকাতরা দিয়ে লেখা—প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড। এই কথাটা রিখিয়াদের দেয়ালে সে তো দেখছে।

চুমকি বসানো কী একরকম শাড়ি পরেছে রিখিয়া, অন্ধকারেও চমকাচ্ছিল।

ভারি অপ্রস্তুত লাগছিল সোমেনের। সে কদিন দাড়ি কামায়নি। পরনে যদিও সেই বড়দির দেওয়া দামি প্যান্ট, আর বউদির দেওয়া শার্ট, তবু দুটোই চৈত্রের ধুলোয় বড় ময়লা হয়ে গেছে। বুকটায় পাখি ঝাপটাল। গলার স্বর হয়ে গেল অন্যরকম। বলল—যাচ্ছিলাম।

এটা কোনও জবাব হল না। রিখিয়া অন্যরকম বুঝল। বলল—কোথায় যাচ্ছিলেন? আমাদের বাড়ি?

যদি সোমেন ‘হ্যাঁ’ বলে এখন তবে হয়তো ভাববে—হ্যাংলা সেধে সেধে বাড়ি আসে। আর যদি ‘না’ বলে, তবে হয়তো ভাববে—ইস্‌, আমাদের জন্য একটুও ভাবে না তো!

সুসময়ে তো আসতই সোমেন। কিন্তু সুসময় তো আসে না।

সোমেন উত্তর না দিয়ে হাসল। তার সেই বিখ্যাত ভুবনজয়ী হাসিটি। দাড়ির জন্য চিন্তিত ছিল সোমেন। কিন্তু এও জানে, অল্প দাড়ি থাকলে তাকে যুবা বয়সের রবীন্দ্রনাথের মতো দেখায়।

রিখিয়ার কথা বলার সময়ে একটু মাথা নাড়ার রোগ আছে। তাতে ওকে খারাপ লাগে না। এখন মাথা নাড়ল, কানের ঝুটা ঝুমকো ঝিকিয়ে ওঠে। বলে—যাচ্ছিলেন না আর কিছু। আপনি প্রায় সময়েই তো এদিক দিয়ে হেঁটে যান। আসেন না।

—তুমি দেখেছ?

—না দেখলে বললাম কী করে?

—ডাকোনি তো!

—আমি ডাকব কেন? যার আসবার আসবে।

এমন অভিমানের গলায় বলল! ছেলেমানুষ। নইলে অমনভাবে বলে? বুকের মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে যে!

সোমেন কবজির ঘড়ি দেখে বলল—সাড়ে সাতটা বাজে। আর একদিন আসব।

—মায়ের খুব অসুখ।

—কী হয়েছে?

রিখিয়া কিন্তু হাসল। বলল—খুব কিছু নয়। মার তো নানারকম। এখন শ্বাসকষ্ট হয়। আর চোখে নাকি ভাল দেখছে না। ডাক্তার বলেছে, রেটিন্যাল হেমারেজ। সব্বাইকে দেখার জন্য পাগল। আপনার মাকে নিয়ে আসার কথা ছিল না? প্রায় সময়েই ননীবালার চুলের গল্প শুনি।

সোমেনের গলার স্বর তীব্র শ্বাসবায়ুর প্রভাবে কেঁপে গেল। বলল—আর একদিন—

রিখিয়া মাথা নাড়ে, বলে—তা কেন? এই তো দু-পা। মা এখনও ঘুমোয়নি।

সোমেনের চোখে পড়ল আবার সেই লেখাটা। কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড। দারোয়ান গেটটা খুলে দিল। গাড়িটা আলো জ্বেলে বাঁক নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে গ্যারেজে। একটা কুকুর ডেকে উঠল দোতলায়। সোমেন সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল—চলো৷ শৈলীমাসির কথা আমিও খুব ভাবি।

শান-বাঁধানো বাগানের একটুখানি রাস্তায় আগে হেঁটে যেতে যেতে রিখিয়া বলল—আহা! ভেবে ভেবে ঘুম হয় না বেচারির!

শৈলীমাসির ঘরে তেমনি কোমল অন্ধকার। সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা বাতিদান। ওষুধের গন্ধ, অডিকোলনের গন্ধ। খুব মৃদু শব্দ করে চলেছে এয়ারকুলার। সামান্য ঠান্ডা ঘর। নাইলনের সাদা মশারি ফেলা। বিছানার পাশে আজ একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে। সিলিন্ডারের পাশে একটু মোটা মতো, লম্বা লোক গম্ভীরভাবে চেয়ারে বসে আছে।

ঘরে ঢুকে তাকে ডেকে রিখিয়া বলে—বাপি, এই হচ্ছে ননীমাসির ছেলে।

ভদ্রলোক একবার সোমেনের দিকে চাইলেন। চেনার কথা নয়। তার ওপর উনি উদ্বিগ্ন। বললেন—রাখু, উনি কিন্তু ট্র্যাংকুইলাইজারটা খেলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন।

সোমেন প্রণাম করবার জন্য উপুড় হয়ে ভদ্রলোকের পা খুঁজে পাচ্ছিল না মেঝের অন্ধকারে। একটা পা পেল, অন্যটা না পেয়ে চেয়ারের পায়ার হাত ছুঁইয়ে মাথায় ঠেকাল। উনি গ্রাহ্য করলেন না। স্ত্রীর জন্য বোধ হয় খুবই উদ্বিগ্ন। একবার তাকিয়ে বললেন—কে বললি?

রিখিয়া বোধ হয় বাপকে তেমন আমল দেয় না। আদুরে মেয়েরা এরকমই হয়। হঠাৎ একটা ঝাঁঝের গলায় বলল—বললাম তো। ননীমাসির ছেলে। চুলঅলা ননীবালার গল্প শোনোনি!

—ও। বলে উনি খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ সোমেনের দিকে চেয়ে নালিশ করার মতো বললেন—অক্সিজেন নেওয়াটা ওর এক বাতিক। নাকে নল নিয়ে নিয়ে ঘায়ের মতো হয়ে গেছে—

সোমেন কী বলবে। চুপ করে রইল। যখন প্রণাম করছিল তখন ভদ্রলোক পা দুটো এগিয়ে দেননি। সেই রাগটা সোমেনকে খানিকটা উত্তপ্ত রেখেছে।

উনি রিখিয়াকে বললেন—রাতের খাওয়াটা আজ ঠিক খেয়েছেন। অন্য দিনের মতো গোলমাল করেননি।

রিখিয়া তার বাবার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল কেবল। বলল—এখানে বসে অত কথা বোলো না। ডিস্টার্ব হয়।

উনি কিন্তু বসে রইলেন। কেমন একটু ঘোর-লাগা ভাব। পরনে একটা গোলাপি। পায়জামা, একই রঙের টিলা কোটের মতো জামা গায়ে। দেখে মনে হয় না যে লোকটার রুচি বা বুদ্ধি-সুদ্ধি আছে। অথচ কত টাকা করেছে। সোমেনের ভারী হিংসে হয়। বোধবুদ্ধিহীন এরকম কত মানুষ লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছে বাতাস থেকে। ভদ্রলোকের কোনও ব্যক্তিত্বও নেই। মেয়ে তার সঙ্গে কেমন ঝাঁঝিয়ে কথা বলে! হয়তো বা ভদ্রলোক কিছুটা স্ত্রৈণও। অন্ধ কুকুরের মতো বসে আছে বশংবদ। মনে মনে নিজের বাবার সঙ্গে তুলনা করে দেখে সোমেন। বাবাকে অনেক মহৎ মানুষ বলে মনে হয়। সৎ, চরিত্রবান, শুভ্র মানুষ। মায়ের দেওয়া ছোট্ট চিরকুটটা যখন ব্যগ্রভাবে খুঁজে দেখছিলেন সেদিন তখনই সোমেন টের পেয়েছিল, মায়ের প্রতি বাবার মমতা এখনও কী গভীর। তবু ব্রজগোপালের চরিত্রে একটুও স্ত্রৈণতা নেই। অসফল মানুষ, তবু সোজা গনগনে মানুষ। শরীর শক্ত হাড়গোড় আছে।

সামান্য অ্যালকোহলের একঝলক গন্ধ আজও পেল সোমেন। অন্ধ কুকুরটা টলতে টলতে এল ঘরে। মুখ তুলে চাইল রিখিয়ার দিকে। না, চাইবে কী করে! ও তো দেখে না। কেবল শ্রবণ উৎকর্ণ করে বাতাস শু^কছে। রিখিয়ার বাবা হাত বাড়ালেন কুকুরটার দিকে। মৃদু গলায় বললেন—আয়!

কুকুরটা মাথা নামিয়ে লুটিয়ে পড়ল পায়ের কাছে। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। সামনের দুটো পা নুলোর মতো বুকের ওপর জড়ো করে, পিঁছনের পা দুটো ছড়িয়ে অদ্ভুত আদরখেকো ভঙ্গিতে পড়ে আছে। রিখিয়ার বাবা চটিসুদ্ধ পা তুলে ওর গলার কাছটা রগড়াতে রগড়াতে বললেন—আজও খুব রিন্টুর কথা বলছিলেন। সে আসছে না কেন। দোষটা যেন আমার। সে যদি তার মা-বাবার কথা না ভাবে—

বলে উনি চাইলেন রিখিয়ার দিকে। রিখিয়া বুঝি চোখ দিয়ে একটু শাসন করল। বাইরের লোকের সামনে ঘরের কথা বলা ঠিক নয়। উনি তাই কথাটা শেষ করলেন না।

রিখিয়া সোমেনের দিকে চেয়ে বলল—মা তো ঘুমিয়েছে। আপনি এ ঘরে এসে বসুন।

কুকুরের ওপরে আদুরে পা রেখে ভদ্রলোক বসে থাকলেন অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশে। ফিরে ও দেখলেন না, সোমেন আর রিখিয়া কোথায় গেল। কিন্তু এই প্রথম সোমেনের কষ্ট হল লোকটার জন্য। মনে হল, সংসার থেকে লোকটা খুব বেশি কিছু পায়নি। ছেলে বিলেতে, স্ত্রী শয্যাশায়ী, মেয়ে আমল দেয় না। টাকা ছাড়া ওই লোকটার আছে কি? টাকা আর একা। আর বোধ হয় আদর করার জন্য একটা অন্ধ কুকুর।

রিখিয়ার বসবার ঘরে উজ্জ্বল আলো। টক টক করছে লাল উলের মস্ত পা-পোশ। উজ্জ্বল আলোয় এসেই সোমেনের লজ্জা করছিল। বলল—আমি আজ যাই—

—ও মা! কেন?

—রাত হয়ে গেছে।

—ইস্‌। কী লক্ষ্মী ছেলে! রাত আটটায় রোজ বাড়ি ফেরা হয় বুঝি!

—তা নয়। তোমাদেরও অসুবিধে।

—সেটা আমরা বুঝব। বসুন।

আসলে সোমেনের কেমন একরকম হচ্ছে। এ মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে, আজ বাদে কাল যে কোনও দিন। প্রথমদিন যেমন একরকমের ভালবাসা বোধ করেছিল, আজ তেমনি একটা হতাশা মাখানো হিংসে হচ্ছে কেবল। মন বলছে—কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড।

আজও একই জায়গায় পড়ে আছে অবহেলাভরে সেই পেনট্যাক্স ক্যামেরা। আজ শুধু লেনসের ওপর ঠুলি পরানো।

রিখিয়া হঠাৎ বলে—বাবা একটু ওইরকম।

সোমেন অবাক হয়ে বলে—কীরকম?

—সন্ধের পর বলে—কথাটা শেষ করল না রিখিয়া! আবার বলল—দাদার জন্যই।

মুখোমুখি বসল রিখিয়া। চুমকির শাড়ি আলো পেয়ে এখন আগুন হয়ে ঝলসাচ্ছে। মুখে আজ কিছু প্রসাধন। খোঁপাটা দোকানে বাঁধা, দেখলেই বোঝা যায়। চওড়া ব্যান্ডে বাঁধা বড় ঘড়ি বাঁ হাতে। হাতের তেলোয় একটু বুঝি মেহেদির রং। কী জীবন্ত চোখ। সোমেন চোখ সরিয়ে নেয়। মেয়েদের চোখের দিকে সে এখনও তেমন করে চাইতে শেখেনি।

—যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ ওই কুকুরটাকে নিয়ে থাকে।

সোমেন বুঝতে না পেরে বলে—কে? বলেই বুঝতে পারে, রিখিয়া তার বাবার কথা বলছে। মুখটা কিছু ভারাক্রান্ত রিখিয়ার।

সোমেন টপ করে বলে—তুমি কী নিয়ে থাকো সারাদিন? ক্যামেরা?

রিখিয়া বিষণ্ণতা থেকে নিজেকে তুলে আনে। একটু হেসে বলে—হ্যাঁ। খুব ছবি তুলি।

—পারো?

—ও মা! পারব না কেন?

—ও সব ক্যামেরায় তো অনেক গ্যাজেট থাকে।

—খুব সোজা। বলে রিখিয়া লাফিয়ে উঠে বলে—দাঁড়ান, আপনার একটা তুলে রাখি। ফ্ল্যাশটা চার্জ করতে দিয়েছি প্লাগে। আনছি।

রিখিয়া চলে যেতে ফাঁকা ঘরে এতক্ষণে যেন একটু হাঁফ ছাড়ে সোমেন। বুকটা কাঁফছিল ভীষণ। শ্বাস টানতেই একটা সুগন্ধ পেল। রিখিয়া ফেলে গেছে তার গায়ের ঘ্রাণ। এই গন্ধটুকু কি চিরকাল থেকে যাবে সোমেনের জীবনে, যেমন থেকে যাবে অণিমার সেই চুম্বনের স্মৃতি?

॥ বত্রিশ ॥

একা ঘরে সোমেন বসে আছে। এ ঘরে এয়ারকুলার নেই, মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। বাতাসে শিস টানার শব্দ। ওই শব্দটুকু ছাড়া সারা বাড়িটা নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। কেবল ঘুরে যাচ্ছে পাখা। অক্লান্ত যান্ত্রিক।

শৈলীমাসির ঘরের দরজাটা আটকানো। দরজা খোলা থাকলে ঠান্ডাভাব বেরিয়ে যাবে বলে দরজায় যন্ত্র লাগানো আছে। আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। ওই ঠান্ডা ঘরে শুয়ে আছে শৈলীমাসি, পাশে বশংবদ স্বামী। এই সময়টায় লোকটা একটু নেশা করে নিশ্চয়ই, মুখে কেমন ভ্যাবলা ভাব, রিখিয়ার বাবা বা শৈলীমাসির স্বামী বলে মোটেই মনে হয় না। এদের চেয়ে অনেক ভোঁতা চেহারা। লোকটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সোমেন। এত টাকার ওপরে বসে আছে, তবু কেমন লক্ষ্মীছাড়া চেহারা। শোকাতাপা, সংসারে যেন কেউ নেই। অভিমানী কী! তার বাবা ব্রজোগোপালও অভিমানী।

বন্ধ দরজাটায় নখের আঁচড় আর কুঁই কুঁই একটা শব্দ আসছে। পাল্লাটা খুব হালকা নয়। সোমেন তাকিয়ে থাকে। দরজাটা দুলছে অল্প। নখে আঁচড়াচ্ছে কুকুরটা। দরজাটা ঠেল আসবার চেষ্টা করছে। দরজাটা খুলে কুকুরটাকে আসতে দেবে কিনা ভাবছিল সোমেন। তার দরকার হল না। কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে দরজাটার দুলুনি বাড়িয়ে পাল্লার একটু ফাঁক দিয়ে ঘষটে কুকুরটা এ ঘরে এল। একটু ধীর গতি, সাবধানী। ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে। কান দুটো খাড়া হয়ে আছে, ঘ্রাণ সজাগ, মুখ ওপর দিকে তুলে কিছু বুঝবার চেষ্টা করছে। কী যেন টের পেয়েছে! চেনা ঘরে অচেনা মানুষের গন্ধ। সোমেন একটু ভয় খায়। কামড়াবে না তো! অন্ধ মানুষেরা বড় ভাল লোক হয়। আজ পর্যন্ত কোনও অন্ধ মানুষকে খারাপ লোক হতে দেখেনি সোমেন। যত অন্ধকে সে দেখেছে তারা সবাই ভদ্র, বিনয়ী, নরম ও সহনশীল মানুষ। চোখ থাকলে তারা কে কীরকম হত, বলা শক্ত। কিন্তু অন্ধ হলে মানুষের মধ্যে ওই গুণগুলো জন্ম নেয় বোধ হয়। এই অন্ধ কুকুরটার মধ্যে সেই নিয়ম অনুসারেই হয়তো হিংস্রতা নেই।

জীবনে আর কোনও অন্ধ কুকুর দেখেনি সোমেন। দুটি চোখে গভীর ক্ষতচিহ্ন। চোখে জল গড়িয়ে পড়বার দাগ। যখন ছোট ছিল তখন কোনও নিষ্ঠুর ছেলে ওর চোখ দুটো গেলে দিয়েছে বোধ হয়। তাই হবে, নইলে কুকুর কখনও অন্ধ হয় না তো!

সোমেন সাবধানে ডাকে—আ—তু—

বনগাঁর ক্যাম্পে তারা কিছুকাল ছিল। বাবা তখনও চাকরি পাননি। সে সময়ে সংসারে নির্মম অভাব ছিল, কিন্তু ছেলেবেলাটা এমন যে কিছুই গায়ে লাগে না। নতুন পৃথিবীর শব্দ গন্ধ বর্ণ সব দুঃখ ভুলিয়ে রাখে। কষ্টে ভাত জুটত তখন। তবু সেই ভাতের শেষ গ্রাসটা কখনও খায়নি সোমেন। মুঠ করে নিয়ে দৌড়ে ঘাটলার দিকে যেতে যেতে হাঁক পাড়ত —আ—তু—। কোথাও কিছু নেই, সেই ডাকের জাদুতে ঠিক আঁদাড়-পাঁদাড় ভেঙে কচুবন মাড়িয়ে ভাঙা বেড়ার ফোকর দিয়ে দুটো দিশি কুকুর ছুটে আসত। খাড়া কান, ল্যাজ নড়ছে, চোখে নিবিড় লোভ।

এ কুকুরটা তেমন নয়। লোভ নেই। কিন্তু ডাক শুনে ল্যাজ নাড়ল প্রবলভাবে। এক-পা দু-পা করে কাছে আসতে থাকে। আসে ঠিক, ভুল দিকে যায় না। মাটি শুঁকে শুঁকে এসে মুখ তোলে কোলের কাছে। খুব আদরখেকো কুকুর। তেজ-টেজ নেই। সোমেন ওর মাথায় হাত রাখতেই ‘কুঁ কুঁ’ একটা শব্দ গলায় তুলে আদুরে ভাবে ভেজা নাকটা সোমেনের হাতে ঘষে দেয়, পায়ের কাছে বসে মুখটা তুলে রাখে ওপরে। সোমেন আর একবার মাথায় হাত দিতেই কুকুরটা চিত হয়ে শুয়ে পিছনের ঠ্যাং ছড়িয়ে দেয়, সামনের পা দুটো বুকের ওপর নুলো করে রেখে ঘাড় কাত করে শরীর ছেড়ে দেয়। এই হল ওর আদর খাওয়ার ভঙ্গি। সবই ঠিক আছে, কেবল চোখ দুটো নেই। তবু সবই বুঝি টের পায়। সোমেন নিচু হয়ে ওর গলার কোমল কম্বলে আঙুল দিয়ে খানিক আদর করল, তারপর বলল—যাঃ।

কুকুরটা গেল না। পায়ের ওপরে মাথা ঘষছে। বিরক্তি। সোমেন উঠে অন্য চেয়ারে গিয়ে বসে। কুকুরটা টের পায় ঠিক। গন্ধে গন্ধে কাছে আসে ফের। আদুরে শব্দ করে ভিখিরির মতো মুখ তুলে থাকে। সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে—জানিস না তো, আমি এ বাড়ির কেউ নই, হতে পারতাম—

আচমকা কথা ফাঁকা ঘরে বলে ফেলেই চারদিকে চায় সোমেন। কেউ নেই। সোমেন কুকুরটার কাছ থেকে সরে বসে। ফের কাছে আসে কুকুরটা। জ্বালাতন।

বাইরের দিকে একটা ঝুলবারান্দা, অন্ধকার মতো। সোমেন সেখানে এসে দাঁড়ায়। হাতের নাগালে একটা নিবিড় আমগাছ। বৌলে ছেয়ে আছে। মাতলা গন্ধ। গাছ থেকে আধোঘুমে পাখিপক্ষীর ডানার শব্দ আসে। বাতাস বয়ে যাচ্ছে সাপের মতো হিলহিল করে। তার পায়ে নাক ঠেকিয়ে প্রণাম করে কুকুরটা ঊর্ধ্বমুখে প্রত্যাশায় লেজ নাড়ে।

সোমেন শ্বাস ছাড়ে। বলে—পেয়ে বসলি যে!

অন্ধদের নিয়ে তোলা একটা ডকুমেন্টারি ছবিতে সে দেখেছিল, অন্ধ মানুষকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে চলেছে পোষা কুকুর। ট্রাফিকের আলো দেখে থামছে, গাড়িঘোড়ার ব্যস্ত রাস্তা পার করে দিচ্ছে সাবধানে। আর এ কুকুরটা নিজেই অন্ধ।

হঠাৎ সোমেন নিচু হয়ে ওর গলার বকলশটা ধরল। তারপর চোখ বুজে থেকে ঠোঁট টিপে হেসে বলল—দেখি কেমন পারিস! চল।

কুকুরটা কী বুঝল কে জানে! কিন্তু হঠাৎ শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠল। লেজ নাড়ছে, প্রবল কুঁই কুঁই শব্দ করছে। কিন্তু আস্তে আস্তে টেনে নিতে লাগল সোমেনকে। সোমেন চোখ খুলল না, কুঁজো হয়ে কুকুরটার টানে টানে হাঁটতে লাগল। যে ঘরে সোমেন বসেছিল সে ঘরে নয়, করিডোর দিয়ে অন্য কোনও ঘরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কোথায়! রিখিয়ার ঘরে?

অচেনা বাড়ি। খেলাটা বিপজ্জনক। তবু চোখ খোলে না সোমেন। দেখা যাক না!

—ও কী! বলে চেঁচিয়ে উঠল রিখিয়া। আর সেই মুহূর্তেই ঝলসে উঠল ফ্ল্যাশগান-এর আলো।

চমকে সোমেন চোখ খোলে। রিখিয়ার ঘরের দরজায় সে দাঁড়িয়ে। অপ্রস্তুত অবস্থা। ভিতরে রিখিয়া, ঘরের ঠিক মাঝখানে। অবাক চোখ, হাতে ক্যামেরা।

সোমেন বলে—কুকুরটার কাছে ট্রেনিং নিচ্ছিলাম।

রিখিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলে—কেন? ড্যাবা ড্যাবা দুটো চোখ তো রয়েছে।

—এমনি।

—এমনি না। মাথায় ছিট। যা চমকে গিয়েছিলাম না! বলে রিখিয়া হাসে। স্নিগ্ধ এক রকমের রাগহীন হাসি। বলে—কম্পোজিশনটা কিন্তু দারুণ হয়েছিল। প্রিন্ট করি, দেখবেন।

—ছবি তুললে?

—হুঁ। দাঁড়ান, আর একটা তুলি।

—এ ঘরে?

—হুঁ। বলে অন্যমনস্ক রিখিয়া তার ক্যামেরায় মুখ নিচু করে কী সব কলকব্‌জা নাড়াচাড়া করে।

তখন সোমেন মনে মনে বলে—তোমার শোওয়ার ঘরে আমার ছবি উঠবে? তা কি ভাল হয় রিখিয়া? ছবি তো দলিল হয়ে থাকবে। চিরকালের জন্য। সে ভাল নয়। আমি তো আসিনি তোমার ঘরে, কুকুরটা নিয়ে এসেছে। কেন, কে জানে!

ক্যামেরা ঠিক করতে করতে রিখিয়া বলে—বোকা লোকেরা ক্যামেরা দেখলেই কেমন ক্যাবলা হয়ে যায়। অমন চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন দরজায়? ওই বুককেশটার উপর হাতের ভর রেখে দাঁড়ান। পিছনে পরদা, পাশে ফুলদানি, ফ্রেমটা দারুণ হবে।

সম্পূর্ণ ক্যামেরামগ্ন চোখে চেয়ে রিখিয়া কপালের ওপর থেকে চুলের ঘুরলি সরিয়ে ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখে।

—আমার ছবি দিয়ে কি হবে? সোমেন তখন বলে। মনে মনে বলে—আমার ছবি রাখবে কেন? আমি কে?

—কী আবার হবে! ছবি ভেজে খাব। রিখিয়া ঝাঁঝ দিয়ে বলে। আদুরে মেয়েদের এরকম রাগী স্বভাব হয় বটে। পরক্ষণেই রিখিয়া হেসে ফেলে বলে—আমি ভীষণ ছবি তুলি, সব জিনিসের। দাঁড়ান না!

ছেলেমানুষি একরকমের অভিমান বুকে মেঘলা ঘনিয়ে তুলল সোমেনের। সে মাথা! নেড়ে বলে—না। ছবি নয়।

—কেন?

—আমার ছবি ভাল ওঠে না।

—আচ্ছা দেখবেন, আমি কীরকম ভাল তুলে দিই!

সোমেন মাথা নাড়ল। আমি কি শুধু ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখবার! আমি কি কেবলই ছবি! শুধু পটে লিখা। আর কিছু নই! রিখিয়া! সোমেন মুখ ফিরিয়ে নিল।

সেই মুখ-ফেরানো অভিমানী মুখের ভঙ্গিমা দেখে রিখিয়ার ক্যামেরাটা আর একবার চমকায়। একটু হাসে রিখিয়া। বলে—রাগী বোকা মুখ তুলে রাখলাম।

সোমেন রাগে মুখ ফিরিয়ে বলে—তুমি বড় পাকা মেয়ে।

রিখিয়া রাগে না। ক্যামেরাটা তার বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অবশ্য ক্যামেরাটা চোট পায় না। ফোম রবারের গদির বিছানায় নিঃশব্দে লাফিয়ে উঠে কাত হয়ে থাকে। মস্ত একটা নিথর চোখ চেয়ে থাকে সোমেনের দিকে।

রিখিয়া মৃদু হেসে বলে—পাকাই তো। সবাই বলে।

সোমেন কী করবে বুঝতে পারে না।

রিখিয়া তখন বলে—বসুন। চা আসছে।

—এ ঘরে?

রিখিয়া অবাক হয়ে বলে—বারবার এ-ঘরে এ-ঘরে করছেন কেন? এ ঘরটা আমার, অন্য কারও নয়। বসুন। বিছানাতেই বসুন।

এটা রিখিয়ার শোওয়ার ঘর। এ কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারে না সোমেন।

—শোওয়ার ঘরে কেউ বাইরের উটকো লোককে বসতে বলে! আপনজন হলে অন্য কথা। সোমেন মুখ ফেরানো অবস্থাতেই বলে। বুকে অকারণ অভিমান।

রিখিয়া অধৈর্যের গলায় বলে—বাব্বাঃ, আমার অত শুচিবাই নেই।

—থাকা ভাল। সোমেন জ্যাঠামশাইয়ের মতো মাতব্বরী গলায় বলে—বিয়ে হচ্ছে, এখন বালিকাবুদ্ধি থাকা ভাল নয়।

—কার বিয়ে হচ্ছে? বলে রিখিয়া ভ্ৰূ কোঁচকায়।

করিডোর দিয়ে বসার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে সোমেন। তার পায়ের শব্দ শুনে আসে কুকুরটা, পিছনে রিখিয়া।

সোমেন মুখ না ফিরিয়ে বলে—সব শুনেছি।

—কী? রিখিয়ার প্রশ্ন আসে।

—বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা।

—ও! বলে রিখিয়া চুপ করে যায়।

সোমেন ফিরে তাকিয়ে বলে—খুব ভাল খবর।

রিখিয়ার মুখটা ছুটে পড়ছে। কিছু রাগে, কিছু বুঝি অপমানে।

বসবার ঘরে এসে বলল—বসুন। চা আসছে। ক্যামেরাটা কুড়িয়ে এনেছে। রাগ দেখানোর জন্যই শব্দ করে বুককেসের ওপর রাখল।

মুখোমুখি বসল। গলায় হারের লকেটটা তুলে দুই ঠোঁট চেপে ধরল। অন্যমনস্ক।

কিছু বলার নেই। সোমেন ভাবল, বিয়ের কথা শুনে খুশি হয়নি রিখিয়া। কথাটা ঘোরানোর জন্য সোমেন বলে—আমার ছবি সত্যিই ভাল ওঠে না, বুঝলে রিখিয়া!

—ওঠে না-ই তো।

রাগের কথা। সোমেন হাসল। কিছু বলার নেই, তাই বলল—ভাল ক্যামেরায় ছবি তোলা খুব শক্ত। তুমি তোলো কী করে?

এক চটকায় উত্তর দিল না। অন্যমনস্ক মুখটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল। আচমকা একটু হাসল সে। বোঝা গেল, ক্যামেরা ওর ভীষণ প্রিয়। বলল—ডেভেলপ আর প্রিন্ট করা আরও শক্ত। আমি সব নিজে করি। আমাদের ডার্করুম আছে।

শোওয়ার ঘরে গিয়ে কখন যেন চুমকি বসানো শাড়িটা ছেড়ে একটা গাঢ় কালচে লাল শাড়ি পরেছে সে৷ শাড়ি পালটানোর সময়ে ভাগ্যিস গিয়ে হাজির হয়নি সোমেন। ব্যাপারটা ভাবতেই লজ্জা করছিল তার। লাল শাড়িটাতেও কেমন মানিয়েছে! একদম বালিকা বয়স, অহংকারে ডগোমগো মুখ, হাঁসের মতো গলা উঁচু করে বসে আছে কিশোরী-দেমাকে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, বুকের ভিতরে মায়া জন্মায়।

সোমেন অবাক হওয়ার ভান করে বলে—তাই নাকি! এইটুকু বয়সে!

রিখিয়া লকেটটা দাঁতে চেপে রেখেছিল। ছেড়ে দিয়ে বলল—বয়স কী কম! লকেটটা গড়িয়ে পড়ল ওর বুকের ওপর, ঢাকা দুটি কোমল স্তনের মাঝখানে।

সোমেন চোখ তুলে নেয়। বলে—এরকম আর কী কী জানো তুমি? গাড়ি চালাতে?

—ওমা! সোজা। অবশ্য লাইসেন্স নেই। ময়দানে গিয়ে চালাই। স্কুটারও পারি। বলে হাসল।

সোমেন সিগারেট ধরাল। কত কী জানো তুমি! আমি কিচ্ছু পারি না। ভারী লজ্জার কথা। তুমি এত জানো কেন? প্রিসিসন ক্যামেরায় অঙ্ক কষে ছবি তোলো, বড় গাড়ি চালাও, স্কুটার জানো। বড় পাকা মেয়ে। দূর, তোমার সঙ্গে আমাকে মানাত না।

—কে বলেছে শুনি! রিখিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করে।

সোমেন চমকে ওঠে। মনে মনে বলা কথা সব শুনতে পেল নাকি ও?

—কে কী বলেছে? বোকার মতো জিজ্ঞেস করে সোমেন।

—ওই কথাটা! রিখিয়া নিজের হাতের পাতার দিকে চেয়ে বলে।

সোমেন একটু হাসে। বলে—বিয়ের কথা তো?

—তাই তো বলছিলেন।

সোমেন মাথা নেড়ে বলে—বাজে লোক বলেনি। শৈলীমাসি।

রিখিয়া কথা বলল না।

ফরসা কাপড়পরা চাকর ট্রে রেখে যায়। অনেক খাবার। ভারী ভাল চায়ের গন্ধ। খেতে ইচ্ছে করছিল না সোমেনের। তার ভিতর অনেক রকম ভাবনা চিন্তার চোরাস্রোত। ক্ষিদে মরে গেছে।

সোমেন চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলে—তোমার বিয়ের দিন এসে খাবার খাব। আজ নয়।

রিখিয়া একরকম ধমক-চোখে তাকায়। পরমুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে—খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু।

হঠাৎ কি একটা আশা আকাঙক্ষা মায়া ভালবাসা অন্ধের মতো নড়ে ওঠে সোমেনের মধ্যে। আবহাওয়ার বার্তায় যেমন বলে, বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ, ঝড় উঠবে।

সোমেনের চা চলকে যায়, একটুখানি, নামিয়ে রাখে কাপ।

বলে—আচ্ছা খাচ্ছি।

॥ তেত্রিশ ॥

কেমন এক অভিমানী মুখ নিয়ে বসেছিল রিখিয়া। পায়ের কাছে কুকুর, আর বুক-কেসের ওপর সেই ঝকঝকে আসাহি পেন্ট্যাক্স ক্যামেরা, কখন আবার কুড়িয়ে এনে রেখেছে। দৃশ্যটা ছবি হয়ে আছে। ওই অভিমানী ভঙ্গিতে এক ভিন্ন রকমের সৌন্দর্য ছিল। যেন ওই নতমুখ তুলে জলভারে আক্রান্ত তীব্র চোখে সোমেনকে দায়ী করে বলবে—কে বলল অন্য কোথাও আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! তা কি হয়! তুমি বলো!

তা অবশ্য বলেনি রিখিয়া। কেন বলবে? সোমেনের ছেলেমানুষি মন কত কী ভেবে নেয়। এমনকী সোমেন বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি ওই অভিমানী সুন্দর ভঙ্গির দিকে। মেয়েদের দিকে সোজাসুজি তাকাতে তার ভয় করে। সেই অবশ্যম্ভাবী ভিটামিনের অভাব তার মধ্যে আজও। রাস্তায়-ঘাটে অনেক পুরুষকে দেখেছে সোমেন, যারা মেয়েছেলে দেখলেই আত্মহারা হয়ে যায়। চোখের পলক না ফেলে, চারদিককে ভুলে গিয়ে হাঁ করে দেখে। দেখতে দেখতে আত্মজ্ঞান, চক্ষুলজ্জা, লোকভয় লুপ্ত হয়। তখন চিমটি কাটলেও টের পাবে না, অপমান করলেও গায়ে মাখবে না। মেয়েটা কী ভাবছে তাও ভেবে দেখে না। সোমেনের বন্ধু হেমন্তর সেবার চোখ খারাপ হল, তো অ্যাট্রোফিন চোখে দিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার সময়ে সোমেনকে সঙ্গে নিয়েছিল, পাছে আবছাচোখে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু দুর্ঘটনা একটা ছোট রকমের ঘটল ডাক্তারের চেম্বারেই। একটি অবাঙালি বিবাহিতা সুন্দরী তেজি মহিলা বসেছিলেন সেখানে। হেমন্তর কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল। অ্যাট্রোফিন দেওয়া চোখে এমন ডেলা পাকিয়ে চেয়ে রইল যে মহিলার ভারী অস্বস্তি। বাঙালি মেয়েরা সাধারণত এমন অবস্থায় ভ্রূ কোঁচকায়, বিরক্তির ভাব করে। কিন্তু সরাসরি কিছু করে না। কিন্তু এ মহিলার ধাত অন্যরকম। কিছুক্ষণ হেমন্তর তাকানোটা লক্ষ্য করে হঠাৎ উঠে তেড়ে এল—আপনি ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লজ্জা নেই, বেশরম? ঘর ভরতি লোকের সামনে কী যে বে-ইজ্জতী তা বলার নয়, হেমন্ত অবশ্য খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল—আমার চোখে অ্যাট্রোফিন, কিছু দেখছি না। এ কথা শুনে দু-চারজন হাসতে থাকে, মহিলাও একটু থমকে যান। সেই ফাঁকে দুঃসাহসী হেমন্ত গলা একটু নিচু করে জোরাল শ্বাসধ্বনির শব্দে বলল—আপনি ভীষণ সুন্দর।

এ সবই হচ্ছে ভিটামিনের কাজ। মেয়েদের দিকে তাকানো, চালাক, চতুর কথাবার্তা, সংকোচহীন মেলামেশা। সেখানে সোমেনের কিছু খাঁকতি আছে। নইলে কিশোরী রিখিয়ার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা যেত, প্রশ্ন করা যেত—তোমার বিয়ে কি সত্যিই ঠিক হয়ে নেই?

সে প্রশ্ন করা হল না। রহস্য রয়ে গেল। বিয়ের কথায় কেন রেগে গিয়েছিল রিখিয়া? কেন ওই অভিমান? হয়তো তা টের পেয়েছিল অন্ধ কুকুরটা, দু-পায়ে কোলের ওপর শরীর তুলে মুখটা বাড়িয়ে শুনছিল রিখিয়ার কম্পিত শ্বাসের শব্দ। অস্পষ্ট সান্ত্বনার আওয়াজ করেছিল। অবোলা জীব, হয়তো বলতে চেয়েছিল—দুঃখ কোরো না রিখিয়ার মনের মতো বর আসবে। বুক-কেসের ওপর থেকে করুণ একটি চোখ মেলে ক্যামেরাটা দেখেছিল রিখিয়াকে। বলেছিল—কেঁদো না রিখিয়া, সব ছবি আমার তোলা রয়েছে। কোথায় পালাবে তোমার প্রেমিক। তাকে বন্দি করে এনে দেব তোমার কাছে।

তাই আবার অন্ধ কুকুরটার কথা মনে পড়ে সোমেনের। মনে পড়ে, আসাহি পেন্ট্যাক্স ক্যামেরার একটিমাত্র চোখ। সে ঘরে আর একটু বসে থাকতে পারত সোমেন, হাতে কোনও কাজ ছিল না, রিখিয়াদের বাড়ির কেউ কিছু মনে করত না, তেমন রাতও হয়ে যায়নি। তবু সোমেনের মনে হতে লাগল, সে বড় বেশিক্ষণ আছে এদের বাড়িতে। দৃষ্টিকটু হচ্ছে কিশোরী রিখিয়ার সঙ্গে এতক্ষণ বসে থাকা। এবার তার চলে যাওয়া উচিত। সে এমনও ভাবল— এরা বড়লোক, এদের বাড়িতে থাকা ভাল নয় বেশিক্ষণ।

শুকনো সন্দেশ জল দিয়ে গিলে ফেলে সোমেন, সন্দেশের তেমন কোনও স্বাদ পায় না সে। দামি চায়ে চুমুক দিয়ে তার মনে হল, ভারী বিস্বাদ। খাবার খাওয়ার শাস্তিটুকু ভোগ করে সে খুব ব্যস্ততার ভাব দেখিয়ে উঠে গেল। যেন খুব তাড়া আছে এমনভাবে বলে—চলি।

রিখিয়া নতমুখে চেয়ে একখানা আদরের হাত রেখেছে কুকুরটার মাথায়। অন্য হাতে মাথার একগুচ্ছি চুল টেনে এনে আঙুলে ঘুরলি পাকাচ্ছে। ভঙ্গিতে একটা আভিজাত্য ফুটে আছে। একটু অহংকারও। সোমেনের গলা শুনে চোখ তুলল।

সেই তাকানোতে কী ছিল কে জানে! কিন্তু সোমেন কত কী ভেবে নিল। ভাবল, বুঝি রিখিয়ার চোখে বিতৃষ্ণা, বিরক্তি। রিখিয়া তাকে বুঝি পছন্দ করে না।

রিখিয়া তার কিশোরীসুলভ উঁচু স্বরে বলল—সবাই জেনে গেছে, না?

—কী?

—বিয়ের কথা?

—জানবে না কেন? ভাল খবর।

রিখিয়া আবার মাথা নত করে রইল। আর সোমেনের মনে হল, রিখিয়ার ভঙ্গিতে অবহেলা। উপেক্ষা। একটু দূরের মানুষ হয়ে যাওয়া।

সোমেন আবার বলল—চলি।

রিখিয়া মাথা নেড়ে বলে—আচ্ছা।

বলল না আবার আসবেন। একটু হতাশ হল সোমেন। ওটুকু অন্তত না বললে সোমেন। আসে কী করে! যদি রিখিয়া ডাকত, তবে আসত কোনওদিন। না ডাকলে কি বড়লোকদের বাড়িতে আসা যায় ঘন ঘন?

ব্যস্ততার ভান করে নেমে এল সোমেন। আলোছায়াময় রাস্তায় পা দিয়ে দেখে, গ্রীষ্মের বিকেলে কলকাতার সুন্দর হাওয়াটি বয়ে যাচ্ছে। কী নিবিড় ঝিরঝির স্রোতস্বিনীর মতো শব্দ উঠেছে গাছে গাছে। অবিরল বয়ে চলেছে সেই ঘুমপাড়ানি শব্দ। দূর থেকে রিখিয়ার কুকুরটা একবার ডাকল। পিয়ানোর মতো হর্নের শব্দ করে বিশাল এক গাড়ি সোমেনকে সতর্ক করে দিয়ে পাশ ঘেঁষে চলে যায়। চলন্ত গাড়ি থেকে রেডিয়োর গানের শব্দ এল। গাড়ির আলোয় দেয়ালের লিখনটি স্পষ্ট হল একবার। তারপর মিলিয়ে গেল। প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড।

রাস্তায় এসে সে মেনের যেন আর সময় কাটে না। রাস্তা ফুরোয় না। রিখিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলে যেন আর কোথায় যাওয়ার থাকে না।

বহুদিন বাদে অণিমাকে আবার দেখল সোমেন, নাটকের দিন, মুক্ত অঙ্গনে। অবশ্য দূর থেকে দেখা। একটা দৃশ্যে অল্পক্ষণের জন্য মঞ্চে এল অণিমা। বয়স্কা প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় তার অল্পক্ষণের অভিনয়। এই দৃশ্যে বিভ্রম সৃষ্টি করার জন্য মঞ্চে খুব মৃদু আলো। ঘোর সবুজ সেই ম্লান আলোয় অণিমাকে চেনাই যাচ্ছিল না। শুধু দেখা গেল সে এক সাদা-খোলের শাড়ি পরেছে আর ডানদিকের মাথার চুলে একগুছি পাকা চুল। যে লোকটা চাঁদ গিলে ফেলেছিল তার কাছে কৈফিয়ত চাইছেন প্রধানমন্ত্রী, বিধিভঙ্গের দায়ে দায়ী করছেন।

মঞ্চে সেই আবছায়া মূর্তির দিকে চেয়ে নিথর হয়ে থাকে সোমেন। বুকের মধ্যে একটা কেমন কষ্ট হয়। প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চে আবির্ভাবমাত্র দর্শকরা হাততালি দিচ্ছিল। যদিও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নন, তাঁর ভূমিকায় অন্যজন। তবু জনগণ খুশি, এটা বোঝা গেল। সোমেন প্রধানমন্ত্রীকে দেখছিল না। দেখছিল অণিমাকে।

পাশে বসে ম্যাক্স দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছিল। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলে— সোমেন, কোনও দেশেই প্রধানমন্ত্রীরা এত ইম্পর্ট্যান্ট নন।

সোমেন ঘাড়টা নাড়ল কেবল।

ম্যাক্স ভারী হতাশ গলায় মৃদুস্বরে স্বগতোক্তির মতো বলে—নিউজপেপার খুলেই হেডিং দেখি, প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এরকম উপদেশ দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন বা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রেডিয়ো খুলেই নিউজ-এ শুনি, কি প্রাইমমিনিস্টার হ্যাজ স্টেটেড দ্যাট…। তোমরা এত প্রধানমন্ত্রীর ভক্ত কেন?

সোমেন কী উত্তর দেবে? একবার আবছায়ায় ম্যাক্সের মুখটা দেখল। মুখে একটু কৌতুক। সোমেন বলল—আমরা ওইরকম।

ম্যাক্স মাথা নেড়ে বলল—আইডোল্যাট্রি! আমি তোমাদের দুর্গাপুজো, কালীপুজো, গণেশপুজো সব দেখেছি। কিন্তু তোমাদের গ্রেটেস্ট গড হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী। অল অ্যালং তোমরা তোমাদের সব প্রধানমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি পুজো করে এসেছ। বাচ্চারা যেমন মা-বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না, তোমরা সেরকম প্রধানমন্ত্রী বোঝো। হোয়াই?

পিছন থেকে কে যেন বলল—আস্তে।

ম্যাক্স চুপ করে আবার নখ খুঁটতে থাকে দাঁতে। তার মুখে ভ্রূকুটি চোখে নীলচে ফসফরাস জ্বলছে।

সোমেনের ডানপাশে কয়েকজন অচেনা লোক, তার ওপাশে পূর্বা বসেছিল আর দুটি মেয়ের সঙ্গে। সারাক্ষণ নিচু স্বরে বক বক করছিল আর হাসছিল। ওদের আশপাশের লোক বিরক্ত। নাটকের মাঝামাঝি হঠাৎ উঠে এসে সোমেনের পাশের লোকটাকে কী বলল। লোকটা উঠে গেল পূর্বার জায়গায়। পূর্বা সোমেনের পাশে বসেই হাসতে থাকে—বুঝতে পারছিস?

সোমেন মুখটায় বিরক্তভাব করে বলে—জ্বালাতে এলি।

—আহা, আমি বুঝি সব সময়ে জ্বালাই।

—জ্বালাস না? সেবার লাইটহাউস থেকে তোর জন্য উঠে আসতে হয়েছিল মাঝপথে, মনে নেই?

—আহা। সে তো ড্রাকুলার ছবি দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিলাম বলে!

—ব্যাপারটা একই। হয় ভয় পাবি, নয়তো হাসবি, নাহলে কেবল বক বক করবি। চুপ করে থাকতে পারিস না কেন?

—পেট ফুলে ওঠে যে! দু-তিনঘণ্টা চুপ করে থাকা সোজা কথা?

পিছন থেকে কে আবার বলে—আস্তে। একটু আস্তে হোক।

সোমেন পুর্বার দিকে চেয়ে বলে—ওই শোন।

পূর্বা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসতে থাকে। সোমেন চাপা স্বরে বলে—পেট ফুলে উঠলে অ্যান্টাসিড খাস।

পূর্বা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মঞ্চের একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে আলো। আলোতে নায়িকার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে অপালা। অন্ধকারে আবছা দেখা যাচ্ছে মিহির বোসকে, সে নায়ক। নায়িকা দায়ী করছে নায়ককে, পৃথিবী থেকে সবচেয়ে সুন্দর জিনিস জ্যোৎস্নাকে হরণ করার জন্য। বলছে, সে নাকি আত্মহত্যা করবে। কারণ জ্যোৎস্নার অভাবে তার ভিতরকার ভালবাসা মরে যাচ্ছে।

পূর্বা হঠাৎ চাপা স্বরে বলল—পিছনের লোকটা কী বলছিল রে? আস্তে, একটু আস্তে হোক। কী হওয়ার কথা বলছিল?

—জিজ্ঞেস করে আসব?

—ধ্যুৎ। তুই বুঝি জানিস না?

অন্ধকারেই সোমেন পূর্বার দিকে একটু তাকায়। বলে—খুব পেকেছ খুকি!

মঞ্চে হঠাৎ মাকবেথ নাটকের একটা সংলাপের অনুকরণে হাহাকার করে ওঠে অপালার তীব্র গলা—তুমি চাঁদকে হত্যা করেছ, তাই তুমি কোনওদিন কারও ভালবাসা পাবে না।

অন্ধকারে মঞ্চের অন্য ধারে মিহির বোস একথা শুনে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে—ভালবাসা! ভালবাসা নিয়ে কী হবে। আমার গলায় মহামূল্য চাঁদ। কে ভালবাসা চায়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী-সমস্যা ম্যাক্সের এখনও মেটেনি। সে আবার তার নীল ফসফরাস জ্বালা চোখে চেয়ে বলল—অল অফ ইউ আর ইটিং আউট অফ পি-এম’স হ্যান্ড, ইজনট ইট? ভারতে যদি পি এম না থাকে কোনওদিন, তা হলে তোমাদের কী হবে সোমেন?

ডান কানে ঝুঁকে পূর্বা তখন বলল—পেকেছিই তো। বড়দের দেখে ছোটরা শেখে। তোমাদের সব ব্যাপার-স্যাপার জানি মশাই।

গুল। পূর্বা কিছু জানে না। জানলে কেঁদে ভাসাত। তবু একটু চমকে ওঠে সোমেন, মঞ্চে নায়িকার ভালবাসার সংকট, বাঁ পাশে ম্যাক্সের প্রধানমন্ত্রী ধাঁধাঁ থেকে সরে এসে সে পূর্বার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে—কী জানিস?

পূর্বা ঠ্যাং নাচিয়ে নিরুদ্বেগ মুখে বলে—এভরিথিং।

সোমেনের বিশ্বাস হয় না। অণিমা যেদিন তাকে চুমু খায় সেদিন ঘরটা অন্ধকার ছিল এবং কেউ তাদের অনুসরণ করেনি। তবু বুকটা কেঁপে ওঠে। দরজাটা বন্ধ করেনি অণিমা, সে কি ইচ্ছে করে?

সোমেন প্রসঙ্গটা পাশে সরিয়ে হঠাৎ বলল—আমরা বুঝি তোর চেয়ে বয়সে বড়! আর তোমার বুঝি এখনও দাঁত ওঠেনি!

পূর্বার ঠ্যাং নাচানো বন্ধ হয়, চোখ ফিরিয়ে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে—কে, বলেছে আমি ছোট?

—এই যে বললি বড়দের দেখে ছোটরা শেখে! তুই কি ছোট?

পূর্বা সঙ্গে সঙ্গে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে—কখন বললাম! এ মা! যাঃ!

—বলেছিস।

একটা হাত কাঁধে এসে পড়ে পিছন থেকে, একটা স্বর বলে—দাদা, কাইন্ডলি একটু আস্তে।

একটা চিনেবাদামের খোলা ভাঙার শব্দ হয়, কাছেই। আর তখনই হঠাৎ অপালা মঞ্চ থেকে চেঁচিয়ে বলে—হায় চাঁদ! হায় প্রেম!

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে টানাটানি করে কারা পরবর্তী দৃশ্যের দৃশ্যপট সাজাচ্ছে।

পূর্বা হঠাৎ মনে-পড়ায় ব্যগ্র কণ্ঠে বলে—বলেছি তো, কিন্তু সে তুই আমাকে খুকি বলেছিস বলে।

—ও। সোমেন উদাস গলায় বলে।

—রাগ করলি? পূর্বা অন্ধকারেই চেয়ে থাকে তার দিকে।

—না।

—করেছিস। মাইরি, রাগ করিস না। জানিস তো, কেউ আমার ওপর রাগ করলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।

—করিনি।

তৃতীয় দৃশ্যের মাঝ বরাবর সোমেন বেরিয়ে এল।

গ্রিনরুমের গলিতে ঢুকেই চমকে ওঠে সোমেন। অণিমা দাঁড়িয়ে আছে। চুলে এখনও সাদা মেক-আপ লেগে আছে। সাদা খোলের শাড়িটাও পরনে। দিল্লির জলহাওয়ায় শরীরে একটা ঢল এসেছে। এত শ্ৰী ওর আগে কখনও দেখেনি সোমেন। রং-ও বোধ হয় ফরসা হয়েছে, মেক-আপের জন্য ভাল বোঝা যাচ্ছে না।

চোখে চোখ পড়তেই মুখটা কেমন অপরাধী লজ্জায় মাখা হয়ে গেল অণিমার। চোখটা নামিয়ে নিয়ে আবার তুলল। ভারী চশমার ভিতরে ওর চোখ বরাবরই ছোট দেখাত। সে-চোখ দুটির দিকে অনেকবার অলস মন নিয়ে তাকিয়ে দেখেছে সোমেন। আজকের দেখার মধ্যে একটু অনুসন্ধিৎসা ছিল। ছিল রহস্যমোচন।

ভারী মিষ্টি একটা লাজুক হাসি হাসল অণিমা। অণিমার সর্বাঙ্গে আর কোথাও এতটুকু ইয়ারকির ভাব নেই। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল—চলে যাচ্ছ?

সোমেন থমকে বলল—তুমিও যাবে নাকি!

অণিমা তার চোখে চোখ না রেখে একটু অপ্রস্তুত হেসে বলল—কী করে যাই! এই দৃশ্যেও পাট রয়েছে। শেষটা দেখে যাবে না?

সোমেন একটু হেসে বলে—তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছি। গাব্বুর টার্মিনাল, একবার যাব বলেছিলাম। আর বেশি দেরি করলে রাত হয়ে যাবে।

—ও! ভারী নরম বিস্ময় প্রকাশ করে অণিমা।

—কবে ফিরেছ?

—এই তো কদিন।

—খুব বেড়ালে?

—উঁ! বলে একটু চুপ করে থাকে অণিমা, তারপর আস্তে দু-দিকে মাথা নেড়ে বলে—না। বেড়াইনি খুব একটা। ভাল লাগত না। ঘরে বসে থাকতাম। রেকর্ড শুনতাম।

—তবে গেলে কেন?

অণিমা তেমনি সুন্দর হেসে মৃদু গলায় বলল—বিয়ের আগে শরীর সারাতে।

সোমেন সিগারেট ধরিয়ে বলে—তোমার শরীর সেরেছে অণিমা।

অণিমা লজ্জা পেল। মুখ নামিয়ে নিল।

তারপর বলল—কিন্তু তুমি রোগা হয়ে গেছ সোমেন। কেন?

—কী জানি! সোমেন উত্তর দিল।

ভিতর থেকে কে এসে ডাকল—অণিমা!—যাচ্ছি। অণিমা তাকে বলল। তারপর সোমেনের দিকে চেয়ে বলল—যাই সোমেন।

—আচ্ছা। বলে হাসে সোমেন—দেখা হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!

অণিমা মৃদু হাসল। কী লাজুক, সুন্দর হাসি। সেই ইয়ারবাজ মেয়েটার চিহ্ন আর নেই ওর কোথাও।

ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা শেষ করল সোমেন। হাঁটতে হাঁটতে আজও যেন আবার সোমেনের রাস্তা ফুরোয় না। সময় কাটে না।

একটা লাইন আজকাল প্রায়ই অকারণে মনে পড়ে সোমেনের। প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড।

রিখিয়াদের দেয়ালে কে এই লাইনটা লিখেছিল কে জানে! যে লিখেছিল সে কি বেঁচে আছে! না কি মুক্তি সংগ্রামের হাওয়ায় ছেঁড়া পোস্টারের কাগজের মতো উড়ে গেছে দুনিয়া ছেড়ে! ওই স্লোগান এখন কেউ আর লক্ষও করে না দেয়ালটায়। কিন্তু লাইনটা বড় আশ্চর্যভাবে বেঁচে থাকে সোমেনের মধ্যে। অকারণে মনে পড়ে। চারদিকে গতিময়, ক্ষিপ্র কলকাতা বয়ে যায়। কর্মহীন সোমেনের অলসভাবে চলতে-ফিরতে হঠাৎ ওই লাইনটা মনে পড়ে যায়।

জীবনের সুখী সুন্দর দিনগুলি বুঝি শেষ হয়ে এল!

॥ চৌত্রিশ ॥

ব্যাঙ্কের লকারের জন্য বহুদিন আগে দরখাস্ত করে রেখেছিল রণেন। তিন-চারটে ব্যাঙ্কে। আজ ব্রাবোর্ন রোডের একটা ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জানল, বীণা লাহিড়ির নামে একটা লকার পাওয়া যাবে সামনের মাসে। লকার নিয়ে আজকাল বড় কাড়াকাড়ি। সকলেরই কিছু না কিছু লুকনো টাকা, সোনাদানা বা গয়নাগাটি আছে।

আজ শনিবার। অফিসে কাজ ছিল না। একটা ইনস্পেকশন রিপোর্ট দিয়ে আসবার সময়ে বুড়ো রামসদয় ঘোষকে খবরটা দিল। ফাঁকা অফিস। সবাই চলে গেছে। কেবল ঘোষ বসে বসে একটা আন-অফিসিয়াল অঙ্ক কষছিল। মুখ তুলে বলল—ছেলেটা কাল রাতে টেস্টপেপার থেকে অঙ্কটা কষতে গিয়ে পারেনি। তাই আমি অফিসে নিয়ে এসেছি। কেউ পারল না সবাইকে দেখিয়েছি। আমি সারাদিন ধরে বার দশেক করলাম।

ঘোষকে প্রায়ই এরকম আফিসে বসে অঙ্ক কষতে দেখেছে রণেন। ওটা ঘোষের নেশা। রণেন হেসে বলে—তাই বলুন। আমি ভাবছিলাম অফিসের কাজকর্ম।

—নাঃ। অফিস আবার কী! এ বছরই রিটায়ারমেন্ট, ডিসেম্বরে। ত্রিশ বছর ঢের কাজ করেছি। এবার ছোট ছেলেটাকে দাঁড় করাতে পারলে নিজের কাজ হবে।

টেরিলিনের জামাকাপড় পরলে বড় ঘাম হয়। এ গরমে সবচেয়ে আরামের হল ধুতি পাঞ্জাবি, নয়তো সুতির জামাকাপড়। বীণা সে সব পাট চুকিয়ে দিয়েছে। টেরিলিনের জন্যই পাখার তলায় বসেও রণেন ঘামে। একটা পাতলা ফাইল তুলে হাওয়া খেতে খেতে বলল—লকারটা পেয়ে গেছি।

—লকার? ব্যাঙ্কের নাকি? বলে অন্যমনস্ক ঘোষ মাথা নাড়ে—সে তো বড়লোকি ব্যাপার।

মনে মনে রণেন বলে—তাই তো, সেটা বুঝতে দেরি হয় কেন রে শালা? মুখে বলল—না না। আজকাল যা চুরি-ছিনতাই গেরস্থরাও লকার রাখে। সেফ।

—সেফ আবার কী! একটা চাবি তো ম্যানেজারের কাছে থাকে শুনেছি।

—তা থাকে। তাও সেফ।

মাথা নেড়ে ঘোষ বলে—ধরুন, লকারে গিয়ে যদি একদিন দেখেন যে, টাকাপয়সা সোনাদানা সব হাওয়া, তখন কী হবে? ব্যাঙ্ক ক্ষতিপূরণ দেবে?

—না, তেমন নিয়ম নেই।

—তবে! সে আবার কী! চাবি যখন ওদের কাছে থাকে তখন একটা ডুপ্লিকেট করে রাখলে আটকাচ্ছে কে! চাবি-দাওয়া যখন চলবে না তখন সিকিউরিটি কী থাকল! তার ওপর পুলিশ এসে জোর করে খেলে আজকাল, সেও ফ্যাসাদ।

রণেন একটু দ্বিধায় পড়ে।

ঘোষ অঙ্কটা কষতে কষতে না তাকিয়েই বলে—সবচেয়ে ভাল হল লোহার সিন্দুক। লকার কি বউমার নামে নিলেন নাকি?

—হুঁ।

—ভাল। স্ত্রী কৈবল্যদায়িনী। এ যুগটা বউদেরই যুগ। সবাই বউয়ের নামে সব করে। আমার বউটা বেঁচে থাকলে আমিও তার নামে কিছু না কিছু করতাম।

রণেন অবাক হয়ে বলে—কিছু করেননি?

—কী করব? তিলজলায় খানিকটা জমি কিনেছিলাম বউয়ের তাগিদে, যেদিন ভিত পুজো সেদিনই সুট করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল। অলক্ষণ দেখে জমি বেচে দিই, আর কিছু করিনি।

—রিটায়ারমেন্টের পর?

—ছেলেরা আছে। তবে বল-ভরসা কেউ নয়। বড় দুজন বিয়ে শাদি করে বউ চিনেছে। ভরসা ছোটটা, তা এও বড় হয়ে হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা তাই মুঠো করে বসে থাকব, সেই টাকার জোরে যা সেবাযত্ন পাই পাব। বুড় বয়েস বউ না থাকলে ভারী মুশকিল। জোর খাটানো, রাগ দেখানোর মানুষ থাকে না। অথচ কেরানি-টেরানির তো এই বুড়ো বয়সটাই খিটকেল মেজাজের বয়স। তখন মনের মধ্যে নতুন রাগ অভিমানের দাঁত গজায়, কিন্তু বউ না থাকলে কামড়ানোর কিছু থাকে না। ভারী মুশকিল।

লকার পাওয়ার যে আনন্দটা ছিল তা যেন হঠাৎ নিবে গেল রণেনের। মানুষের মুশকিল, নানুষ মরণশীল। দূর ভবিষ্যতের একটা অচেনা, অজানা, একাকীত্বের ছবি ভেবে কেন যে শিউরে উঠল রণেন। হঠাৎ মনে হল, লকার-টকার এ-সব মিথ্যে প্রয়োজন। সিকিউরিটি কোথাও নেই।

উঠতে যাচ্ছিল, ঘোষ অঙ্কটা কষতে কষতেই বলল—বউয়ের নামে সর্বস্ব উচ্ছুগ্যু করবেন, তাতে মাগিদের বড় তেল হয়। এদিক-ওদিক নিজের নামেও কিছু রাখবেন।

—নিজের নামে? কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স…

ঘোষ মুখ না তুলেই বলে—ইনকাম ট্যাক্স, অ্যান্টি করাপশ্যান, আর বউ, এ তিনের মধ্যে বউ সবচেয়ে ডেঞ্জারাস। পুরুষমানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু।

রণেনের ঘেমো শরীরে গরম ছুঁড়ে একটা শীত এসে লাগে। কথাটা মনের মতো। সে বলল—আমার বউ…

ঘোষ কথাটা শেষ করতে দিল না, তেমনি ছোট ছেলের আঁক কষতে কষতে বলল—ও জানি। সব্বার বউয়ের গল্পই একরকম। নারীরাই এখন লড়ছে ভাল৷ পুরুষসিংহের বড় অভাব।

রণেন উঠতে উঠতে বলে—কিন্তু লকারের ব্যাপারে একটা ভাবনায় ফেলে দিলেন ঘোষদা। এখন মনে হচ্ছে, লকার তেমন সেফ নয়।

ঘোষ হাসল। এই বয়সেও ভাল চেহারা, লম্বা—ফরসা। একহারা। চোখেমুখে ভাল বংশ এবং বুদ্ধির ছাপ আছে। সেই সঙ্গে একটু ক্লান্তিও। লাল ঠোঁট চিরে একটু হাসল, বলল— মানুষকে ভয় দেখানোটা আমার হবি, যেমন হচ্ছে ছেলের অঙ্ক কষা। ওসব কিছু নয়। সবাই রাখছে, আপনিও রাখবেন। বউয়ের নামে যে এককাঁড়ি নিন্দেমন্দ করলাম সেও কি সব সত্যি? ভড়কে দেওয়ার জন্য বলি। এই যে অফিস ছুটির পর বসে অঙ্ক কষছি, বউ থাকলে পারতাম? বুড়োগুড়ো, কালো-কুচ্ছিৎ যাইহোক, বউ বেঁচে থাকলে ঠিকই সংসারের দিকে, বাসার দিকে একটা টান থাকত। ওই টানটুকুর জন্যই সংসারী, নইলে সব ব্যাটা সন্ন্যাসী।

ঘোষ আবার কিছুক্ষণ নীরবে অঙ্ক কষে। বিরক্তিকর। রণেন বুকের বোতাম খুলে গেঞ্জি ফাঁক করে ভিতরে হাওয়া ঢোকানোর চেষ্টা করে। বড্ড গরম।

ঘোষ বলে—কিন্তু মেয়েছেলেদের উলটো। বউ মরলে পুরুষে যেমন একাবোকা হয়ে যায় আমার মতো, মেয়েদের তা হয় না। বুক চাপড়ে কাঁদেটাঁদে প্রথমটায় ঠিকই, তারপর আবার হামলে সংসার করে, ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি টানে। ভুলে-টুলে যায় তাড়াতাড়ি।

—আজ উঠি।

—বাজে বকছি, না? টাকা-পয়সা কেমন করেছেন?

—দূর! কই? বলে রণেন লাজুক হাসে।

ঘোষ একপলক তাকিয়ে দেখে নেয়। মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলে—খবরটবর সব পাই। করুন না দোষের কিছু তো নয়। লোকের হাতে আজকাল অঢেল টাকা। বাজারে কোনও জিনিস পড়ে থাকে না, তা সে যত দামই হোক। দোকান-পসারও কত বেড়ে গেছে দেখেছেন? কত বাহারি শোকেস? লুকনো টাকা ধরার ফাঁদ। তবু কেন যে লোকে দেশের দুরবস্থার কথা বলে! ওপর ওপর কিছু ফালতু লোক না খেয়ে মরছে, কিন্তু মোটের ওপর মানুষ সুখেই আছে। নাকি! বলে ফের অঙ্কটা একটু করেই বলে ওঠে—ওই যাঃ!

—কী হল?

ঘোষ খুব হতাশার সুরে বলে—অঙ্কটা মিলে গেল।

—ভালই তো।

ঘোষ খুব বিমর্ষভাবে মাথা নেড়ে বলে—হুঁ।

তার ভ্রূ কোঁচকানো মুখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ঘোষ খুশি হয়নি। অঙ্কর সঙ্গে আর কিছুক্ষণ লড়ালড়ির ইচ্ছে ছিল বোধ হয়। টেবিলের টানা খুলে একটা ছেঁড়া-খোঁড়া পুরনো টেস্ট পেপার বের করে পাতা উলটে আবার অঙ্ক খোঁজে ঘোষ।

রণেন বলে—আপনি তো এখন অঙ্ক কষবেন। আমি উঠি।

—আরে কেবল উঠি-উঠি করছেন কেন? বসুন না। ঘোষ বলে।

—একটু খোলা হাওয়ায় যাই, এখানে বড় গরম। বলে রণেন মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটার দিকে চেয়ে বলে—আজকাল যে কেন ফ্যানগুলোর হাওয়া হয় না?

—ফ্যানের দোষ নেই, ওটা টাকার গরম। বলে ঘোষ হাসল।

ঠাট্টা বিদ্রূপ করলেও এই ঘোষ লোকটাই বরাবর রণেনকে বুদ্ধিটুদ্ধি দেয়। ভারী ঠান্ডা মাথা। রিটায়ারমেন্টের কাছাকাছি এসে এখন একটু নিস্পৃহ হয়ে গেছে। মনের মতো একটা অঙ্ক বুঝি খুঁজে পেল ঘোষ। কাগজে সেটা টুকতে টুকতে বলল—জমি জায়গা করেছেন?

রণেন বিমর্ষভাবে বলে—এখনও নয়। তবে টালিগঞ্জে খানিকটা জমি মায়ের নামে।

ঘোষ সবিস্ময়ে চোখ তুলে বলে—মায়ের নামে! আপনি তো দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ! আজকাল কেউ মায়ের নামে জমি করে?

রণেন বাধা দিয়ে বলে—না না। বাবা টাকা দিচ্ছেন।

—বাবা বেঁচে আছেন এখনও? বলে লাল ঠোঁট চিরে এরকম গা-জ্বালানো হাসি হেসে ঘোষ বলে—ভারী অন্যায়।

ঘোষ ব্রজগোপালকে চেনে। এক ডিপার্টমেন্টে কিছুকাল একসঙ্গে কাজ করেছে। ব্রজগোপালকে যারা চেনে তাদের সামনে রণেন একটু অস্বস্তি বোধ করে।

ঘোষ অঙ্কের দিকে চেয়েই বলে—উনি টাকা পেলেন কোথায়?

—পলিসির টাকা।

ঘোষ একটা নিশ্চিন্ত হওয়ার শ্বাস ছেড়ে বলে—তাই বলুন। হঠাৎ ব্রজগোপালদার টাকার কথা শুনে চমকে গিয়েছিলাম। ওরকম মানুষের তো বাড়তি টাকা থাকার কথা নয়। সারাজীবন অন্যের ফাইফরমাস খাটতেন, এটা-ওটা কিনে এনে দিতেন কলিগদের, কিন্তু কখনও কারও টাকা নিজের বা অন্য কারও টাকার সঙ্গে মেশাতেন না, সব আলাদা রাখতেন। বলতেন মেশালে সূক্ষ্মভাবে গো-বিটউইন হয়। মনে নাকি একটা দ্বন্দ্বীবৃত্তি আসে। বলে ঘোষ নিঃশ্বাস ফেলে হাসল—এ টোটাল মিসফিট। তবু ওরকম দু-চারজন লোক বেঁচে আছেন বলেই এখনও চন্দ্রসূর্য ওঠে।

রণেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। একটু অস্বস্তি হতে থাকে। একটা ঘুমন্ত আবেগ হঠাৎ বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে জেগে উঠতে চায়। যার বাবা সৎ সে কত ভাগ্যবান। ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়ায়।

—চললেন? ঘোষ জিজ্ঞেস করে।

—চলি। আপনি যাবেন না?

ঘোষ উদাসভাবে বলে—কোথায় যাব? বসে বসে অঙ্কটা কষি। একটু বাদে দারোয়ানরা বন্ধ করতে আসবে, তখন উঠে পড়ব।

ঘোষ আবার অঙ্কের মধ্যে ডুবে যায়।

বড় ঘরটা পার হয়ে দরজার কাছ বরাবর এসে একটু তাকিয়ে দেখে রণেন। সারি সারি খালি টেবিল। ফাঁকা ঘরে একা ঘোষ বসে আছে এতটুকুন হয়ে। অঙ্ক কষছে। হঠাৎ ভিতরটায় একটু চমকা ভয় জেগে ওঠে। মনে পড়ে বুড়োবয়েস, একাকীত্ব। মনে পড়ে মৃত্যু। মাথাটা একটা টাল খায়। ভারী ব্যাগটা একহাতে ধরে রেখেই কষ্টে একটা সিগারেট জ্বালে রণেন। ঘোষের সামনে খায় না, বাবার কলিগ ছিল। সিগারেটের ধোঁয়া ভিতরে যেতেই একটু অন্যরকম লাগে।

ছটা বাজে। বাইরে এখনও বেশ রোদ। বাইরে এসে বুক ভরে শ্বাস নেয় রণেন, কিন্তু তবু একটা শ্বাসরোধকারী কী যেন কাজ করছে ভিতরে! ভয়? নিরাপত্তার অভাব? মৃত্যু?

মনটা ভারী খারাপ লাগতে থাকে। শরীরটাকে কয়েকবার ঝাঁকি দেয় রণেন, হাতের ব্যাগটা দোলায়। মনটাকে হালকা করে দেওয়ার জন্য মুখ ছুঁচলো করে শিস্ দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। উৎকট শ্বাসবায়ুর শব্দ বের হয়। লম্বা লম্বা সব বাড়ির ছায়ায় হাঁটে। ধুলোটে গরম হাওয়া দিচ্ছে, নাকে ধুলোর গন্ধ। উদ্ভিদহীন, শান বাঁধানো কলকাতা নির্মম তাপ বিকীরণ করছে। একটা পাম্পসেটের দোকানের শো-কেসের সামনে দাঁড়াল রণেন। কাচে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। গায়ে কলকা ছাপ, টেরিকটনের বুশ শার্ট, পরনে চেক প্যান্ট, পায়ে দামি জুতো। তবু চেহারাটা লোকাল ট্রেনের ফেরিঅলার মতো কেন যে লাগে!

মনটা খারাপ। মনটা বড্ড খারাপ। কেবলই মনে পড়ে, মলিন অফিস ঘরে ছুটির পর নিরালায় বসে ঘোষ আঁক কষছে। একটা সময় আসে যখন আয়ুটাকে ফালতু সময় বলে মনে হয়। না? আর আসে একাকীত্ব! মৃত্যু!

অনেকে আছে, মন খারাপ থাকলে একা থাকতে ভালবাসে। নিরালায় ছাদে-টাদে গিয়ে চুপচাপ থাকে। রণেন সেরকম নয়। তার উলটো। মন খারাপ থাকলে তার খুব ইচ্ছে করে কোনও আপনার জনের কাছে গিয়ে বসে, আদর খায়, ভরভর করে অনেক কথা বলে।

সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে এল রণেন। মা নেই। গত তিন মাসে মা এই নিয়ে বারচারেক শীলার বাড়িতে গিয়ে থাকছে। এই সময়টায় সোমেন থাকে না। বড় ছেলেমেয়ে দুজন বাইরের ঘরে ছোকরা মাস্টারের কাছে পড়ছে। নতুন রাখা হয়েছে টিউটরটিকে, ফালতু পঞ্চাশ টাকা চলে যাচ্ছে মাসে মাসে। সোমেনই পড়াতে পারে, পড়ায় না। সংসারের সবাই বড় উদাসীন রণেনের প্রতি, এমন মনে হয়।

টুবাই সন্ধেয় ঘুমোয়। শোওয়ার ঘরে মশারি ফেলা। রণেন ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালতেই নাইলেক্সের মশারির ভিতর থেকে বীণা ঘুম চোখে আলো লাগাতে চোখ পিট পিট করে বলে—আঃ নেবাও না। ছেলেটা এইমাত্র ঘুমিয়েছে, উঠে পড়বে।

ভারী অপমান বোধ করে রণেন। বড় সহজেই বীণা আজকাল তাকে ধমকায়। মনটা ভাল নেই বলে অভিমানটা যেন আরও গাঢ় হয়ে মেঘলা করে দিল মনটা। রণেন সবুজ রঙের ঘুম-আলোটা জ্বেলে বড় আলো নিবিয়ে দিল। লুঙ্গি পরতে পরতেই অভিমানটা খসে গেল খানিক। ডাকল—বীণা।

—উঁ।

—শুয়ে কেন? বেরিয়ে এস।

—চা চাই নাকি!

—সে পরে হবে। এখন তোমাকে চাই।

—হঠাৎ এত প্রেম?

এটাও অপমান। রণেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসে আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে একটা সিগারেট ধরাল। এই কায়দায় অশোককুমার সিগারেট ধরাত একসময়ে। বিছানায় বীণার শাড়ির আর গয়নার শব্দ উঠল। বসে খোঁপাটা বেঁধে নিল। অনেকখানি আঁচল বিছানায় রেখে বেরিয়ে এল, তারপর শ্লথ হাতে অফুরান আচলটা টেনে আনতে থাকল বিছানা থেকে।

রণেন বাইরের ঘরের দিককার দরজাটা বন্ধ করে দিল উঠে।

বীণা বলল—ও কী! বাইরের লোক রয়েছে, কী ভাববে?

কাম নয়, একটা তীব্র সঙ্গলিপ্সায় আকুল রণেন দু-হাতে জাপটে ধরল বীণাকে, প্রথম প্রেমিকের মতো কাঁপা গলায় পুরনো বউকে ডাকল—বীণা!

—ইস্‌! কী যে করো না! বীণা রোগাটে হলেও গায়ে জোর কম নয়। দু-হাতে ঝটাপটি করে ছাড়িয়ে নিল।

—তোমাকে আমার ভীষণ দরকার। রণেন হাঁফসানো গলায় বলে।

—রাতে হবে। বীণা নিস্পৃহ গলায় বলে।

—সে সব নয়। এমনি এসো, কাছাকাছি জড়াজড়ি করে বসে থাকি। কথা বলি।

বিরক্ত হয়ে বীণা বলে—কিছু খেয়েছ নাকি!

বলে কাছে এসে মুখটুখ শুঁকে বলে—না তো! তবে হল কী?

আকুল দু-হাতে আবার ভালুকের মতো তাকে চেপে ধরে রণেন—শোনো। আমার কোনও কথা তুমি আজকাল শুনতে চাও না। বড় সংসারী হয়ে গেছ বীণা। আজ একটু বোসো।

বীণা বলে—ধ্যেৎ। বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে—দরজাটা খুলে দাও। খুব বিশ্রী দেখাচ্ছে। ছেলেটা কি না জানি ভাবছে! তুমি একটা কী বলো তো!

বীণা দরজাটা খুলে দেয়। বাইরের ঘরের স্টিক লাইটের আলো পরদার ফাঁক দিয়ে ঘরে এসে পড়ল। বীণা গেল রান্নাঘরে। আয়নার সামনে বসে রইল রণেন। অ্যাশট্রের ওপর রেখে দেওয়া সিগারেটটার কথা ভুলে গিয়ে নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। অন্য সিগারেটটা ধূপ কাঠির মতো জ্বলতে থাকল একা-একা।

ঘোর সবুজ আলোয় ঘরটা কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে এখন। প্রাচীন অরণ্যের অন্ধকারে একটা ধ্বংসস্তূপ। পাখার হাওয়ায় মশারি কাঁপছে। ঢেউ দিচ্ছে। আয়নায় তার আবছা প্রতিবিম্ব। কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে সব কিছু। কেমন যেন রোজকার মতো নয়। বুকটা ফাঁকা। গায়ে ঘাম। সিগারেটের ধোঁয়ার কর্কশ গন্ধ। রণেনের মাথার ভিতরটা ক্রমে পাগল-পাগল হয়ে যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি উঠে বড় আলোটা জ্বালল রণেন। জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে বাইরের বাতাস টানল। অস্থিরতা। তার নিজের মানুষ যেন কেউ নেই পৃথিবীতে। এমন কেন লাগছে। উজ্জ্বল আলোয় নিজের হোঁৎকা শরীরের প্রতিবিম্বের দিকে আয়নায় চেয়ে থাকে রণেন। তীব্র একটা ঘেন্না হয় লোকটাকে।

একটা সেফটিপিন পড়ে আছে টেবিলের ওপর। কিছু না ভেবে সেটা তুলে নিল রণেন। এবং দাঁতে দাঁত ঘষে আচমকা খোলা সেফটিপিনটা বসিয়ে দিল বাঁ হাতের কবজির ওপর। ক্যাঁচ করে ঢুকে গেল সেটা। প্রথম একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা, তারপর হাতটার একটা অবশ ভাব। গাঁথা সেফটিপিনটা তুলল না রণেন। একটু পরে দুই বিন্দু রক্ত উপচে এল। চেয়ে রইল সে, একা ফাঁকা অফিসঘরে ঘোষ বসে আঁক কষছে, ছুটির পর কিছু করার নেই…কোথাও যাওয়ার নেই! মানুষ এরকম অবস্থা সহ্য করে কী করে? মাথাটা ঘুলিয়ে ওঠে আবার। মৃত্যু! একা! কেউ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *