যাও পাখি – ২৫

॥ পঁচিশ ॥

গার্ড সাহেবের মতো লণ্ঠন উঁচুতে তুলে ধরে ব্রজগোপাল ঠাহর করে দেখলেন। খেজুর গাছ চেঁছে, খোঁটা পুঁতে মজবুত ঘাট তৈরি করে দিয়েছে বহেরু। সবাই বলে, বামুনকর্তার ঘাট, এ ঘাটে আর কেউ ধোয়া পাখলা করে না। অন্য মানুষ তাঁর ঘাটে বসে আছে দেখে ব্রজগোপাল অসন্তুষ্ট হন। আচার-বিচার সহবত সব কমে আসছে নাকি!

কুয়াশা আর লণ্ঠনের হলুদ আলোয় রহস্যের মাখামাখি। লোকটা মুখ ফিরিয়ে বলল—বামুনজ্যাঠা।।

ব্রজগোপালের চোখ আজকাল কমজোরি। লণ্ঠনের আলো থেকে চোখ আড়াল করে ঠাহর পেলেন, কোকা। তার কান মাথা ঢেকে একটা কমফর্টার জড়ানো, গায়ে চাদর। অলিসান চেহারা নিয়ে বসেছিল, ব্রজগোপালকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। গালে একটা দাঁতনকাঠি গোঁজা।

ব্রজগোপাল একটু অবাক হয়ে বলেন—কী রে!

কোকা নিঃশব্দে একটু হাসল। বলল—রাতে একদম ঘুম হল না। তাই উঠে ঠান্ডায় একটু বসে আছি।

ব্রজগোপাল খড়ম ছেড়ে লণ্ঠন হাতে জলের কাছে নামলেন। জল হিম হয়ে আছে। চবাক করে বড় মাছ ঘাই দেয়। ব্রজগোপাল কানে গোঁজা দাঁতনটা ধুয়ে নিয়ে বলেন—কাঁচা বয়সে ঘুম আসবে না কেন? সারাদিন দত্যিপানা করে বেড়াস, ঢলে ঘুমনোর কথা।

—মাথাটা গরম লাগে।

—কেন রে?

মেঘুখুড়ো ঝাঁৎ করে মরে গেল, পুলিশ ডাক খোঁজ করতে লেগেছে। আবার না পেছুতে লাগে।

ছেলেটা যে খুব স্বাভাবিক নেই, তা ব্রজগোপাল বাতাস শুঁকে বুঝতে পারলেন। অসম্ভব নয় যে ছোকরা সারা রাত ঘরে ছিল না। বোধ হয় ভোর ভোর গুঁড়িখানা থেকে ফিরেছে। তবে একেবারে বেহেড নয়।

ব্রজগোপাল বললেন—বৃত্তান্তটা কী, কিছু খবর পেয়েছিস?

—কে জানে! তবে বাবা কাল রাতে ডেকে বলল, তুই পালিয়ে যা।

—বহেরু বলেছে? ব্রজগোপাল অবাক হন।

—হ্যাঁ। তাই ভাবছি, পালাব কোথায়।

—পালাবি কেন! পালালে আরও লোকের সন্দেহ বাড়ে।

—পালান পালিয়েছে, আরও সব গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমার ওরকম ভাল লাগে না। এই তো অ্যাদ্দিন মেয়াদ খেটে এলাম। ঘরের ভাত পেটে পড়তে না পড়তেই আবার সবাই হুড়ো দিতে লেগেছে। বেড়াল কুকুর হয়ে গেলাম নাকি!

ব্রজগোপাল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারেন না। তাঁর ছোট ছেলেটারও এই বয়স। এই বয়সে অভিজ্ঞতার বা বোধবুদ্ধির পাকা রং লাগে না। দাঁতনটার তিতকুটে স্বাদ মুখে ছড়িয়ে যেতে থাকে। একটু ভেবে ব্রজগোপাল বলেন—পুলিশের পাকা খাতায় নাম উঠিয়ে ফেললি। এখন তো একটু ভয়ে ভয়ে থাকতে হবেই।

কোকা একটু অভিমানভরে বলে—যা করেছি তার তো সাজা হয়েই গেল। লাথি গুঁতো কিছু কম দিয়েছে নাকি! আমার বড়সড় শরীলটা দেখে ওদের আরও যেন মারধরের রোখ চাপত। তার ওপর বেগার দিয়ে তো পাপের শোধ করেছি। কিন্তু তবু এখন এলাকায় কিছু ভালমন্দ হলেই যদি পুলিশ পেছুতে লাগে তো বড় ঝঞ্ঝাটের কথা!

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বুঝেছেন। একটু তেতো হাসি হাসলেন, বললেন—পাপের। শোধ কি মেয়াদ খেটে হয়! কত চোর-জোচ্চোর-খুনে জেল খাটছে, তারা সব জেলখানায় থেকে ভাল হয়ে যাচ্ছে নাকি! লাথি গুঁতো দেয়, আটকে রাখে, আর ভাবে যে খুব সাজা হচ্ছে। মানুষ ওতে আরও ক্ষ্যাপাটে হয়ে যায়। কর্তারা সব সাজা দিয়ে খালাস, মানুষ শোধরানোর দায় নেবে কে? নিজেকে নিয়েই ভেবে দ্যাখ, জেলখানায় তোর কোনও শিক্ষা হয়েছে? শোধরানোর চেষ্টা করেছে তোকে?

মাথাটা নেড়ে গুম হয়ে থাকে কোকা। বোধ হয় জেলখানার স্মৃতি মনে আসে। মুখটায় একটু কঠিন ভাব ফোটে। বলে—তো আশ্চিত্তির হয় কীসে? তার কী করা লাগবে?

ব্রজগোপাল বলেন—প্রায়শ্চিত্ত হল চিত্তে গমন। অত শক্ত কথা তুই বুঝবি না।

কোকা ব্রজগোপালের দিকে চেয়ে দাঁতনটা অন্যমনস্কভাবে চিবোয়। তারপর হঠাৎ বলে—আমি সেই ছেলেটার গায়ে হাত না দিলেও কিন্তু পুলিশ ওকে পেলে মেরে দিত। কাজটা তো একই।

ব্রজগোপাল স্লান হাসলেন। পুলিশ যে আইনসঙ্গত খুনি, এ সত্য কে না জানে বললেন- তোর সে সব কথায় দরকার কী? তুই নিজের কথা মনে রাখলেই হল। একটা পাতক করে ফেলেছিস, এখন হাত ধুয়ে ফ্যাল। আর কখনও ওসব দিকে মন দিস না। বেঁচে থাকাটা সকলেরই দরকার।

দিগম্বরের খোল তার বোল পালটেছে। বুড়ো হাতে খোলের চামড়ায় এক অলৌকিক ডেকে আনছে সে। ধ্বনি ওঠে, প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে, যতদূর যায় ততদূর বধির করে দেয় সব কিছুকে। কথার মাঝখানে ব্রজগোপাল উৎকর্ণ হয়ে শোনেন। তাঁর আজ্ঞাচক্রের জপ, তাঁর গোপন বীজধ্বনি যেন ওই শব্দের তালে তালে ধ্বনিত হয়।

কোকা বলে—বামুনজ্যাঠা।

অন্যমনস্ক ব্রজগোপাল একটা ‘হুঁ’ দেন কেবল।

—আপনাকে একটা কথা কয়ে রাখি।

—কী কথা!

—আমি যদি এখান থেকে না পালাই তো বাবা ফের আমাকে ধরিয়ে দেবে।

ব্রজগোপাল কথাটা বুঝতে পারলেন না। বললেন—কোথায় ধরিয়ে দেবে?

—পুলিশে।

কোকা মুখখানা এমনধারা করল যেন কাউকে ভ্যাঙাচ্ছে। বলল-বাবাই তো ধরিয়ে দিয়েছিল সেবার, যখন খুনটা হয়ে গেল হাত দিয়ে…বলে কোকা তার দুখানা অপরাধী হাত চাদরের তলা থেকে বের করে সামনে বাড়িয়ে দেখাল।

—বহেরু ধরাবে কেন? তোর যত বিদ্‌ঘুটে কথা!

—তবে আর ক’লাম কী! খুনটা হয়ে যেতে মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল। সে রাতে জ্বরও এসেছিল খুব। বিকারের অবস্থা। চারদিকের কিছু ঠাহর পাচ্ছিলাম না। যেন ভূতে ধরেছে। ভোর রাতে বাবা ঠেলে তুলে দিল, একটা কম্বল চাপা দিয়ে বলল—চল। তখন কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম, বাবা লাঠেল লোক আছে, ঠিক বাঁচিয়ে দেবে। কেবল ‘বাবা বাবা’ করছি। বাবা যেমন ভগবান। বাবা আর বড় বোনাই সঙ্গে নিয়ে স্টেশনে গেল, গাড়িতে তুলে দেবে। স্টেশনঘর থেকে দূরে গাছতলায় বেঞ্চের ওপর বসিয়ে রেখে দিল, গাড়ির তখন দেরি আছে। বড়বোনাই আমার হাতখানা ধরে রেখে ঠাকুর দেবতার নাম করছে, বাবা গেল গাড়ির খোঁজখবর করতে কি টিকিট কাটতে কে জানে। স্টেশন একদম হা-হা শূন্য, জনমানুষ নেই। আমি কম্বলমুড়ি দিয়ে বসে ভয়ে ডরে আর জ্বরের ঘোরে কাঁপছি। সময়ের জ্ঞান ছিল না। কতক্ষণ পরে হঠাৎ আঁধার ফুঁড়ে দুটো পুলিশ এসে সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বড়বোনাই তখন ভিরমি খায় আর কি! আমিও কোনও কথা মনে করতে পারি না। পুলিশ নাম জিজ্ঞেস করল, নিজের নামটা পর্যন্ত তখন মনে আনতে পারছি না।

—বহেরু কোথায় ছিল?

কোকা তাচ্ছিল্যের ঠোঁট উলটে বলে—কে জানে? কিন্তু পুলিশের একটু পরেই বাবা হাজির হয়ে গেল। কী কথাবার্তা বলল পুলিশের সঙ্গে কিছু বুঝতে পারলাম না। আমাকে ধরে নিয়ে গেল। পরে বড়বোনাই আমাকে ইশারায় বলেছে, পুলিশ বাবাই ডাকিয়েছিল। ওই রাতে স্টেশনে আমি কে, বা কী বৃত্তান্ত তা পুলিশ টের পায় কী করে? তখন অবশ্য কিছু টের পাইনি। পুলিশ যখন টেনে নিচ্ছে তখনও বাবাকে চেঁচিয়ে ডাকিয়ে ডাকাডাকি করছিলাম—ও বাবা, বাবা গো…

ব্রজগোপাল দাঁতনটা ফেলে দিলেন। বুকের মধ্যে একটা ভাব খামচে ধরে। চিরকালের একটা বাপের বাস বুকের মধ্যে। সেখানে একটা কাঁটা পট করে বিঁধে যায়।

মুখে ব্রজগোপাল বললেন—তখন কি আর তোর হুঁশ ছিল! জ্বরের ঘোরে, আর ভয়ে ডরে কী দেখতে কী দেখেছিস, ভুলভাল ভেবেছিস। কালীপদ কি আর মানুষের মতো মানুষ নাকি! আবোলতাবোল বুঝিয়েছে।

কোকার মুখে হাসি নেই। গম্ভীর মুখেই সে বলে-বাবা আমাকে দু-চোখে বিষ দেখে।

—দূর!

পাখিরা এ-ওকে ডাকে। ক্রমে বড় গোলমাল বাধিয়ে তোলে চারদিকে। পুবের আকাশে ফ্যাকাশে রং লাগে। চারদিকে মানুষের, পাখির, জন্তুজানোয়ারের জেগে ওঠার শব্দ হয়। আর তখন দিগম্বরের খোল মিহি শব্দের গুঁড়ো ছড়ায়।

ব্রজগোপাল জলের কাছে উবু হয়ে গাডু ভরতে থাকেন। জলভরার গুব গুব শব্দ হতে থাকে। পিছনে পৈঠায় কোকা দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়ের মতো নিশ্চল। কানে পৈতে জড়িয়ে ব্রজগোপাল ঘাট ছেড়ে উঠে আসেন। একবার তাকান কোকার দিকে।

কোকা হারিকেনটা তুলে কল ঘুরিয়ে নিবিয়ে দিয়ে বলে—আপনি মাঠের দিকে যান, আমি হারিকেন ঘরে রেখে আসছি।

ব্রজগোপাল বললেন—মনটাই মানুষের শত্রু। কাজকর্ম নিয়ে লেগে থাকবি মনটা বেশ থাকবে।

ব্রজগোপাল মাঠের দিকে হাঁটতে থাকেন। কোকা সঙ্গে সঙ্গে আসতে আসতে বলে—খুনখারাপি বাবাও কিছু কম করেনি। তবে আমাকে ভয় পায় কেন?

—ওসব তোর মাথাগরমের কথা।

কোকা একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ একটু হতাশার সুরে বলে—বামুনজ্যাঠা, আমাকে কিছু মন্ত্রতন্ত্র দেন।

—কেন?

—কিছু নিয়ে লেগে পড়ে থাকি। বলে কোকা হাসে।

তখন আবার হঠাৎ ভুরভুরে মদের গন্ধ আসে ওর শ্বাস থেকে। ছেলেটা স্বাভাবিক নেই। ব্রজগোপাল শ্বাস ফেলে বললেন—মনকে যা ত্রাণ করে তাই মন্ত্র। কিন্তু তোরা কি ত্রাণ পেতে চাস?

তাঁতিটা তাঁতঘরে বসে সারাদিন শানা মাকু নিয়ে খুটখাট করছে। সুতো ছিড়ে রাস করেছে। পেটের খোঁদলটা এখনও টোপো হয়ে ফুলে ওঠেনি বটে, তবে বহেরুর ভাতের গুণে শরীর সেরেছে একটু। দেঁতো মুখে একটু অপ্রতিভ হাসি। বহেরু তাঁতঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাঘের মতো গুল্লু গুল্লু চোখে কাণ্ডটা চেয়ে দেখে। বাঘের মতোই হাঁক ছাড়ে মাঝে মাঝে—হচ্ছে তো তাঁতির পো?

তাঁতি তার দশ আঙুলে ছেড়া সুতো গোলা পাকাতে পাকাতে বলে—হয়ে যাবে।

দুশো সুতোর কাপড় শুনে সবাই হাসে। বহেরু হাল ছাড়ে না। লেগে থাকে। এখনও চন্দ্র-সূর্য ওঠে, সংসারের আনাচে-কানাচে ভগবান বাতাস ভর করে ঘুরে বেড়ান, মানুষ তাই এখনও পুরোটা পদার্থ ফেরেব্বাজ হয়ে যায়নি। লোকটা যদি দুশো সুতোর কাপড় বুনে দেখাতে পারে তবে বহেরুর এই বিশ্বাসটা পাকা হয়। তাঁতির এলেমে আর কেউ বিশ্বাস করে না, বহেরু করে। তাই সে মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে বলে—পারবে, তাঁতিটা পারবে।

আজকাল প্রায় সারাদিনই বহেরু নানা কথা বিড় বিড় করে বকে। তে-ঠেঙে লম্বা সাঁওতালটা কদিন পড়ে পড়ে ধুঁকছে। অতখানি লম্বা বলেই তাকে আদর করে ঠাঁই দিয়েছিল বহেরু, দেখার মতো জিনিস। কিন্তু রুগ্ন-রোগা। লোকটা তার শরীরের ভার আর বইতে পারে না। লক্ষণ ভাল নয়। মেঘু ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়েছিল, কাজ হয়নি। লোকটা ঘোরের মধ্যে পড়ে আছে, খেতে চায় না, ওঠে না, হাঁটে না। চিড়িয়াখানার ধার ঘেঁষে একখানা ঘর তুলে দিয়েছিল বহেরু। মস্ত লম্বা মাচান করে দিয়েছে। সেইখানে শুয়ে আছে লোকটা। দরজায় দাঁড়িয়ে বহেরু তাকে দেখে। বুঝতে পারে লোকটার কাল হয়ে এল। শরীরের লম্বা কাঠামোখানা কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে। চোয়াল আর খুলির হাড় চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে ক্রমে। এত বড় শরীরটা কোনও কাজে লাগাতে পারল না হতভাগা। প্রায় ভাগাড় থেকেই লোকটাকে টেনে এনেছিল সে। নলহাটি স্টেশনে বিনা টিকিটে গাড়িতে উঠে পড়েছিল। পেটে খাবার নেই, গাড়ির কামরায় পড়ে ধুঁকছিল। সেই অবস্থায় বর্ধমানে তাকে রেলের বাবুরা ঢেলে দিয়ে যায়। বহেরু সেখান থেকে নিয়ে আসে। তিন মাসও টিকল না।

বহেরু একটা শ্বাস ফেলে। কী একটু বিড় বিড় করে। তার চিড়িয়াখানার বাঁদরটা চুপ করে বসে ঠিক মনিষ্যির মতো পেট চুলকোয়। বহেরুকে দেখে একটা কুক ছেড়ে ঝাঁপ খেয়ে আসে। দরজাটা তার দিয়ে বাঁধা। বহেরু তার খুলে বাঁদরটাকে কাঁধে নেয়। মানুষজন আর জীবজন্তুর প্রতি ইদানীং একটা মায়া এসে যাচ্ছে। বাঁদরটা বহেরুর মাথা দু-হাতে ধরে কাঁধে ঠ্যাং ঝুলিয়ে শিশুর মতো বসে থাকে। মাঝে মাঝে নিজের থেকেই কাঁধ বদল করে অন্য কাঁধে চলে যায়। ভারী একটা আদুরে ভাব। বহেরু বাঁদরটাকে খানিক আদর করে। গালে গাল ঘষে দেয়। একটা চিমসে গন্ধ হয়েছে গায়ে। বহেরু বাঁদরটার লোম উলটে পোকাটোকা খুঁজে দেখল গায়ে নেই। চোখ পিট পিট করে জানোয়ারটা আদর খায়। মুখখানা উল্লুকের মতো হলে কী হয়, কোথায় যেন একটু বাঁদুরে হাসি লুকিয়ে আছে ভ্যাংচানো মুখে। ‘খচ্চর’ বলে গাল দেয় বহেরু।

জাড়ের সময় প্রায় শেষ হয়ে এল। উত্তরে কাঁটাঝোপের জঙ্গলে একটিও পাতা নেই। গাছের কঙ্কাল কাঁটা আর ডালপালা মেলে সুভুঙ্গে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকটায় শ্মশান দেবে বলে ঠিক করে রেখেছে, তাই চাষ দেয়নি। সাপখোপ আর শেয়ালের আড্ডা হয়ে আছে। বহেরুগাঁয়ে এ পর্যন্ত মরেনি কেউ। তাই শ্মশানটা কাজে লাগেনি। কাকে দিয়ে বউনি হবে তা বহেরু ভেবে পায়নি। আজ একবার উদাস চোখে চেয়ে দেখল জঙ্গলটার দিকে। সাঁওতাল লোকটা আর কদিনের মধ্যেই যাবে।

সন্ধের মুখে পশ্চিম দিকের আকাশে এক পোঁচড়া সাদাটে কুয়াসা আলোটাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। দুনিয়াটা কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। শুকনো মাঠঘাট থেকে একটা ধুলোটে হাওয়া উঠে চারপাশের রং মেরে দিল। আর সেই ফ্যাকাশে আলোয় কাঁটাঝোপের মধ্যিখানে একটা মেয়েছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বহেরু। প্রথমে ভাবল কাঠকুটো কুড়োতে এসেছে কেউ। কত আসে! পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে, মস্ত চুলের রাশি এলো করে দাঁড়িয়ে আছে কে এক এলোকেশী! পশ্চিম দিকে মুখ ফেরানো। কয়েক কদম এগিয়ে বহেরু ভারী চমকে যায়। মেয়েছেলেটা ল্যাংটা। বুক পর্যন্ত গাছপালায় আড়াল থাকায় এতক্ষণ ঠাহর হয়নি। অচেনা মানুষ নয়, তা হলে কুকুরগুলো খ্যাঁকাত।

—কোন শালি রে! বলে দাঁত কড়মড় করে বহেরু। বাঁদরটাকে নিঃশব্দে ছেড়ে দিয়ে গায়ের চাদরটা কোমরে পেঁচিয়ে নেয় সে। সত্তর বছরের ঋজু শরীরটায় রাগ যেন যৌবনকাল এনে দেয়। মড় মড়াৎ করে আগাছা ভেঙে বহেরু চোটেপটে এগোয়। একটা হাতের থাবা চুলের মুঠিটা ধরার জন্য উদ্যত হয়ে আছে।

সাড়া পেয়ে মেয়েটা হেলা ভরে ফিরে তাকায়। আর তৎক্ষণাৎ ভেড়া হয়ে যায় বহেরু। এ যে তার মেয়ে, নয়নতারা!

ঘোলাটে দুখানা চক্ষু। তাতে আঁজি আঁজি সোনালি আভা। কপালে মস্ত তেল-সিঁদুরের টিপ। মোটা দু-খানা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। মানুষখেকো পেতনির মতো খোনাসুরে বলল—খবর্দার, কাঁছে আসবি না। আমি বামুন জাঁনিস।

বহেরু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে। ওপরে ঘোলা ময়লা একটা আকাশ, চারধারে কুয়াশার আস্তরণ পড়ে যাচ্ছে। আলো, রংমরা এক বিটকেল বেলা। কাঁটাঝোপের ফাঁকে আঁকাবাঁকা অন্ধকার। নয়নতারা ভিন-জগতের জিনপরির মতো দাঁড়িয়ে।

বহেরু জিজ্ঞেস করে—কে তুই? নয়নতারা?

—নয়নতারাকে খাঁব। আমি মেঘু ডাক্তার।

রাগে মাথাটা হঠাৎ বাজপড়া তালগাছের ডগার মতো জ্বলে ওঠে। দুই লাফ দিয়ে এগিয়ে যায় বহেরু—হারামজাদি, দুই চটকানে তোর ভূত যদি না ভাগাই তো…

—খবর্দার! বলে একটা বুকফাটা চিকার দেয় নয়নতারা। তারপর হঠাৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। যম-নখের মতো কাঁটা ওঁত পেতে আছে চারধারে। কাঁটায় যেমন কাপড় ফেঁসে যায় ফ্যাঁস করে, তেমন ছিঁড়ে ফেঁসে যাচ্ছে গায়ের চামড়া। বুক ছিঁড়ে হাপর হাপর শ্বাস। নয়নতারা তবু লঘু পায়ে দৌড়োয়, চেঁচিয়ে বলে—ধরবি তো মেয়েটাকে শেষ করে ফেলব!

বহেরু কাঁটাগাছ চেনে। তার গায়ে পিরান, কোমরে চাদর, পরেনে ধুতি। কাঁটায় কাঁটায় সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে থাকে। কাঁটা খিমচে নিচ্ছে চামড়া, মাংস। বহেরু দৃকপাত করে না। দাঁতের ভিতর দিয়ে কেবল একটা রাগি সাপের শিসানীর শব্দ তুলে সে এগোয়।

মাঝখানে কয়েকটা বুড়ো খেজুর গাছ। তার চারপাশে একটু খোলা জমি। ভাঙা ইট, পাথর আর সাপের খোলস পড়ে আছে। একটা মজা ডোবা, তার গায়ে শেয়ালের গর্ত। মেঠো ছুঁচো কয়েকটা দৌড়ে গেল। জায়গাটা গহীন, বাইরের কিছু নজরে আসে না। নয়নতারা সেখানে পৌঁছে গেল প্রথমে।

বহেরু গাছগাছালি ভেঙে সেখানটায় পা দিতে না দিতেই নয়নতারা আধখানা ইট তুলে ছুঁড়ে মারে বহেরুর দিকে। চেঁচিয়ে বলে—তোঁকে নির্বংশ করব হারামজাদা।

ইট লাগে না। কিন্তু তেজে উড়ে বেরিয়ে যায়। নয়নতারার গায়ে আলাদা শক্তি ভর করেছে। বহেরু থমকে ঠাকুর-দেবতার নাম নেয়। তারপরই বেড়ালের মতো পায়ে কোলকুঁজো হয়ে, তীব্র চোখে চেয়ে এগোতে থাকে।

—গু খা, গু খা, গু খা, মড়া খা, মড়া খা…চিৎকার করতে থাকে নয়নতারা। দু-হাতে মাটি খামচে তুলে বুকে মাখে, থুথু ছিটায় চারদিকে—থু…থুঃ..থুঃ…

—হারামজাদি দণ্ডী কাটছে! এই বলে বহেরু একখানা ইট তুলে নেয়। বিশাল হাতে আস্ত ইটটা উঁচু করে লক্ষ্য স্থির করে।

॥ ছাব্বিশ ॥

নয়নতারা চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। শেষ বেলার রক্ত-আলো কুয়াশা আর মেঘ ছিঁড়ে তিরের মতো এসে বিঁধেছে ওর মুখে। দুটো পদ্মপাপড়ির মতো চোখ এখন ঝলসাচ্ছে টাঙ্গির ফলার মতো। ন্যাংটো, ভয়ংকরী চামুণ্ডা এলোচুল কালসাপের মতো ফণা তুলে আছে ওর পিছনে।

নয়নতারা রক্তমাখা থুথু ছিটোয়। বলে—থুঃ থুঃ…মর, মর সব মরে যা…

ইট ধরা ডানহাতখানা তুলে ধরে তাকিয়ে আছে বহেরু। মারবে! কিন্তু সে নিজেই টের পায়, তার ভিতরে আগুনটা সেঁতিয়ে গেছে। সামনে ওই ন্যাঙটা উদোম যুবতী, তার তেজি মেয়েটা ও যেন-বা বহেরুর কেউ নয়। দুনিয়ার মানুষের পাপ বেনো বর্ষার জলের মতো কুল ছাপিয়ে উঠেছে। এই কালসন্ধ্যায় বহেরুর মেয়ের শরীরে নেমে এসেছে কলকি-অবতার। নাকি মেঘু? ঠিক বুঝতে পারে না বহেরু। তবে তার শরীর কেটে ইঁদুরের মতো একটা ভয় ভিতরে ঢুকে গেছে ইদানীং। সেই ভয়ের ইঁদুরটা নড়াচড়া করে ভিতরে।

নয়নতারা মুঠো করে ধুলো তুলে চারদিকে ছিটিয়ে দিতে থাকে। বলে—থুঃ, থুঃ…সব অন্ধকার হয়ে যা, সব শ্মশান হয়ে যা…

অবাক ভাবটা আর নেই। তার বদলে শরীরে একটা থরথরানি উঠে আসে বহেরুর। শীতটা জোর লাগে। সে একবার তার বাঘা গলায় ডাক ছাড়ে—তারা! ভাল হবে না বলে দিচ্ছি!

শুনে খলখল করে হেসে ওঠে নয়নতারা, বলে—শ্মশান হয়ে যাবে, বুঝলি! সব বসে যাবে মাটির নীচে। রক্তবৃষ্টি হবে।

ফ্যাকাশে বেলাটা যাই-যাই করেও দাঁড়িয়ে আছে। চারধারে পাতাঝরা গাছের কঙ্কাল দুর্ভিক্ষের মানুষের মতো রোগা হাত-পা ছড়িয়ে ঘিরে আছে। রং নেই, সৌন্দর্য নেই। একটা দাঁড়কাক ডাকছে খা-খা করে।

বহেরু চোখের জল মুছে নিল। জীবনে তার চোখ বেয়ে জল নেমেছে বলে মনে পড়ে না। এই বোধ হয় প্রথম। পাথর থেকে জল বেরিয়ে এল। চারধারে বড় অলক্ষণ। বহেরু ধরা গলায় ডাকল—মা! মাগো!

নয়নতারা আকাশের দিকে দু-হাত তুলে কাকে যেন ডাকতে থাকে—আয়! আয়!

শরীর শিউরে ওঠে বহেরু। কোন পিশাচ, ভূতপ্রেত, কোন ভবিতব্যকে ডাকে মেয়েটা! নাকি মরণ ডাকছে প্রাণভরে!

বহেরু আর ভাবল না। ইটটা তুলল ফের। তার প্রকাণ্ড হাত, হাতে অসুরের জোর। দু-পা এগিয়ে ‘মা’ বলে একটা হাঁফ ছেড়ে ইট-টা সই করে দিল সে।

লাগল বাঁ-ধারে স্তনের ওপরে। পাখি যেমন জোরালো গুড়ুল খেয়ে গুড়ুলের গতির সঙ্গে ছিটকে যায়, তেমনি নয়নতারাকে নিয়ে ইটটা ছিটকে গেল। ব্যথা-বেদনার কোনও চিৎকার দিল না নয়নতারা। কেবল মাটিতে পড়ে খিঁচুতে থাকে। তার হাত পায়ের ঘষটানিতে ধুলো ওড়ে!

একটু দূরে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে বহেরু দৃশ্যটা দেখতে থাকে। ফাঁকা জায়গা দিয়ে একটা হলদে শেয়াল দৌড়ে গেল চোর-পায়ে। পিছনের শিমুল গাছে একটা বড় পাখি নামল ঝুপ করে। কিছুক্ষণ নড়েচড়ে নয়নতারা স্থির হয়ে পড়ে থাকে। চারধারে বেঁটে বেঁটে আগাছা, ন্যাড়া জমি।

এইখানে শান্তিরামের ভিটে ছিল একসময়। বংশটা মরে হেজে গেছে। জমিটার দক্ষিণ অংশটা বহুকাল দখল করে আছে বহেরু। বাকিটা পড়ে আছে, দাবিদার নেই। সন্ধ্যা ঘুলিয়ে উঠছে চারধারে। প্রেতছায়া ঘনিয়ে আসে। কঙ্কালসার গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে শেয়ালের চোখ। মগডাল থেকে নজর দিচ্ছে বড় কালো পাখি। শান্তিরামের পোড়ো ভিটেয় অশরীরীরা হাওয়া বাতাসে ফিসফাস করে।

বহেরু নয়নতারার ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখে, মেয়েটা গলাটানা দিয়ে পড়ে আছে। গোরুর ঝিমুনিরোগ হলে এরকম পড়ে থাকে। শিবনেত্র, মুখে গ্যাঁজলা। শ্বাস বইছে, তবে কাঁপা-কাঁপা দীর্ঘশ্বাসের মতো, ফোঁপানির মতো, হিক্কার মতো। ডানকাত হয়ে আছে। বহেরু তাকে আস্তে উলটে চিৎ করে শেয়াল। নিজের যুবতী মেয়ের নগ্ন শরীরটা এতক্ষণ মানুষের মতো চেয়ে দেখেনি বহেরু। রাগে অন্ধ হয়েছিল। এইবার দৃশ্যটা দেখে লজ্জায় চোখ বুজে জিভ কাটল। কোমর থেকে চাদরটা খুলে ঢাকা দিল শরীর। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিল যত্নে। আগেই মেয়েটা পড়ে গিয়েছিল কোথাও, ঠোঁটটা কেটে ফুলে আছে। রক্ত গড়াচ্ছে। চোখের জল মুছে, মুখের লালা জড়ানো ঠোঁটে একবার অস্ফুট ডাকল—মা! মাগো!

তারপর পাঁজাকোলে শরীরটা তুলে নিল সে।

চারধারে বড় অলক্ষণ দেখা যাচ্ছে আজকাল। কলির শেষ হয়ে এল নাকি!

পরের দিন। মেঘুর মড়া পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। তার শরীরে বিষক্রিয়া পাওয়া যায়নি, চোট একটু-আধটু যা ছিল তা আলের ওপর থেকে পড়ে গিয়েও হতে পারে। অতিরিক্ত কড়া মদেই কমজোরি কলজেটা গেছে। পেটে বিদঘুটে আলসার ছিল। হার্টের রোগ ছিল, কিডনি ভাল ছিল না। সব মিলেজুলে গ্রহদোষে খণ্ডে গেছে। শুদ্ধ মুক্ত মেঘু কি এখন অন্তরীক্ষে তার বউয়ের পাশটিতে গিয়ে বসেছে! কলজেটা কি এবার ঠান্ডা হয়েছে তার? বউ মরার শোকেই না অমন পাগল হয়েছিল মেঘু! মরার পর ক্ষ্যাপা লোকটার সব শান্তি হয়েছে কি!

ব্রজগোপাল মেঘুর উঠোনের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে এসব ভাবেন। পাশে কালীপদ উবু হয়ে বসে হাতের পাতার আড়াল দিয়ে বিড়ি টানছে। গাঁয়ের ছেলেরা গেছে মেঘুর মড়া আনতে। যখন-তখন এসে পড়বে।

বারান্দায় ঠেসান দিয়ে মেঘুর বাল-বিধবা বোনটা বসে আছে। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পাড়া-প্রতিবেশীরা কিছু এসেছিল। আজ মড়া আসবে শুনে দু-চারজন এসেছে। একটা কুপি জ্বলছে দাউ দাউ করে, তার আগুনে দু-একজন ভূতুড়ে চেহারার সাদাটে বিধবাকে দেখা যায়। ছেলেপুলেরা কেউ তেমন কচিটি নয় মেঘুর, সবচেয়ে ছোট ছেলেটার বয়সই হবে সাত-আট বছর। বড় জনের বছর বারো বয়স। গোবিন্দপুরের হাটে তাকে বখে-যাওয়া ছেলেদের সঙ্গে বিড়ি খেতে ব্রজগোপাল নিজের চোখে দেখেছেন। কাপড় জড়িয়ে সেই ছেলেদুটো এখন শীতে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে। দুটি মেয়ে মেঘুর। অভাব দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তাদের বাড় বিস্ময়কর। আট-দশ বছরের মধ্যেই দু-জনের বয়স হবে। মাথায় বেশ লম্বা, শরীরও কিছু খারাপ না। ঘরের মধ্যে মাদুরে শুয়ে দু-জন কাঁদছিল। একবার উঠে এসে উঠোনের দরজা দিয়ে রাস্তার দিকে দেখে আসছে।

সবচেয়ে বেশি শোকটা লেগেছে বাল-বিধবা বোনটারই। ছেলেমেয়েগুলোর বয়স কম, এ বয়সের শোক গভীর হয় না, জলের দাগের মতো, বিস্মৃতির ভাপ এসে মুছে দেয়। কিন্তু বোনটার আলো নিবে গেছে। পৃথিবীটা এখন বিশাল, দিকহারা, অনিশ্চয়। কদিন এত কেঁদেছে যে আর কাঁদার মতো দম নেই। চুপ করে বসে আছে। ব্রজগোপাল কুড়িটা টাকা দিয়েছিলেন হাতে। দুটো দশ টাকার নোট এখনও দুমড়ে পড়ে আছে পাশে। আঁচলে বাঁধার কথাও খেয়াল হয়নি।

একজন বিধবা দাওয়ায় একটা ছোট্ট মাদুরের আসন পেতে কাছে এসে বলল- ঠাকুরমশাই, আপনি বসুন গিয়ে।

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বসবেন না।

বিধবাটি বলে—কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন! ওদের আসতে দেরি আছে।

শোকের বাড়িতে একটা অদ্ভুত হবিষ্যির ঘি ঘি গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। এটা বহুবার লক্ষ করেছেন ব্রজগোপাল। আর বাতাসে একটা মৃদু সূক্ষ্ম জীবাণু সংক্রমণের মতো অশুচিতার স্পর্শ।

মেঘুর ছেলেরা পিসির পাশে গিয়ে বসল খানিক। বড়জনকে ব্রজগোপাল বলতে শুনলেন—ও পিসি, শ্মশানে আমাকে দিয়ে কী করবে? বাবার মুখে আমি আগুন দিতে পারব না।

পিসি উত্তর দেয় না। মেয়ে দুজন হুড়মুড় করে উঠে আসে বাইরে। অস্ফুট রামনাম করে। শ্মশান আর বাবার কথা শুনে ভয় পেয়েছে। বেঁচে থাকতে মানুষ আপন, মরে গেলেই ভূতকে ভয়।

ব্রজগোপাল জরিপ করে দেখেন। মেঘু এই ছেলেপুলে, বিধবা বোন, দুটো তক্তপোষ, ভাঙা বাড়ি, গোটা দুই অকেজো আলমারি এইসবই রেখে গেছে। এই দুর্দিনে মেঘু ডঙ্কা মেরে চলে গেল। গেছে খারাপ না। ভোগেনি, কাউকে ভোগায়নি। পড়েছে, আর মরেছে। কিন্তু এ দৃশ্যটা মেঘু যদি দেখত! দাউ দাউ কুপির আগুন আবছায়া তার রক্তের সন্তান, তার শোকাতাপা বোনটা কেমন শীতবাতাসে, সামনের দীর্ঘ অভাবগ্রস্ত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে ভয়ে-ভাবনায় মোয়া বেঁধে বসে আছে মানুষের পিণ্ডের মতো! মেঘুটার আক্কেল ছিল না। এতকটা প্রাণীকে সে কখনও গ্রাহ্য করেনি। ভালবাসার বউ মরে গিয়ে ভগবান ভবিতব্য সব কিছুর ওপর ক্ষেপে গিয়ে একটা পরিবার লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল।

অবশ্য মানুষ তার সন্তান-সন্ততির জন্য কীই বা রেখে যেতে পারে! ব্রজগোপাল তাঁর মামাবাড়ির কথা মনে করেন। দাদামশাই তাঁর এগারোটি সন্তানের জন্য যথেষ্ট রেখে গিয়েছিলেন। ঢাকা শহরে বাড়ি, বঙ্গলক্ষ্মীর শেয়ার, আটাচাক্কি, বগুড়ার লোনব্যাঙ্কে টাকা, নগদ আর সোনাদানায় আরও লাখ দেড় দুই; সে আমলের টাকার দামে এখনকার আরও বেশি। বড় দুই মামা কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো সম্পত্তিটা ফুঁকে দিল। বাপ মরার পর তাদের বড়লোকি চালচলন বেড়ে গিয়েছিল হাজার গুণ। মেজোজন রেলের চাকরি ছেড়ে বাপের টাকায় ব্যাবসা দিল। ব্যাবসার বারফাট্টাই ছিল খুব, পিছনে না ছিল নিষ্ঠা, না পরিশ্রম অন্য মামা মাসিরা তখন নাবালক! বড় হয়ে তারা দেখে, চারদিকে দুঃখের সংসার। সেই যে ভাইয়ে ভাইয়ে বখেরা লেগে গেল তা শেষজীবনতক মেটেনি।

ব্রজগোপাল ভাবেন, মানুষ কী রেখে যেতে পারে সন্তানের জন্য? এমনকী আছে যা নষ্ট পায় না, ঠকবাজে ঠকিয়ে নিতে পারে না, যা স্থায়ী হয় এবং বর্মের মতো ঘিরে রক্ষা করে মানুষের সন্তানকে?

কালীপদ লুকিয়ে বিড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। একটু কেশে বলে—ঠাকুরমশাই, এখন মেলা করবেন নাকি?

ব্রজগোপাল চিন্তিত মুখে বলেন—দেরি যখন হচ্ছে তখন আর কতক্ষণ দাঁড়াব! চল।

এই বলে টর্চটা একটু জ্বালেন ব্রজগোপাল। অন্ধকারের মধ্যে চারপাশটা একটু দেখে নেন। পৃথিবীটা ঘোর অন্ধকার হয়ে আসছে ক্ৰমে। ছেলেপুলের কথা বড্ড মনে পড়ে। ছোট মেয়েটা বহুকাল দেখেন না। মেয়েটা বড় বাপভক্ত ছিল।

এ সব কথা মনে হলে পৃথিবীটা অন্ধকার লাগে। টর্চবাতিটা জ্বেলে অন্ধকারটা তাড়ানোর চেষ্টা করেন ব্রজগোপাল। কেশে নিয়ে কমফর্টারটা খুলে আবার গলায় জড়িয়ে নেন। মেঘুর বোন উঠে আসে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুখটা ঘোমটায় আড়াল করে কী যেন বলে। ওর গলা ভেঙে বসে গেছে, আওয়াজ হচ্ছে না। ব্রজগোপাল দু-পা এগিয়ে বলেন—কিছু বলছ মা?

মেঘুর বোন মাথা নেড়ে কষ্টে স্বর বের করে বলে—দাদা বড় পাপী ছিল। আপনাকে কেবল দেবতার মতো দেখত। শ্রাদ্ধটা আপনি করবেন।

—শ্রাদ্ধ! ব্রজগোপাল অবাক হন। ইতস্তত করে বলেন, ওসব তো আমি করিই না মা।। আচ্ছা, দেখব। শরীর গতিক যদি ভাল বুঝি তো…

—দাদার খুব ইচ্ছে ছিল কোনও সৎ ব্রাহ্মণ যাতে শ্রাদ্ধ করে। বউদি সতীলক্ষ্মী ছিল। তার কাছে পৌছুতে হলে পুণ্যি লাগে। দাদা বড় পাপী ছিল।

পাপী ছিল। ছিল বই কী। ঠাকুরের একটা কথা আছে, রক্ষা থেকে যা পাতিত করে তাই পাপ। জীবনধর্মের বিরুদ্ধে চলা যদি পাপ হয় তো মেঘু পাপী নিশ্চয়ই। সঠিক ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাটা ধর্ম বলো ধর্ম, পুণ্য বলো পুণ্য। ব্রজগোপাল এই শোকের বাড়িতে দাঁড়িয়েও মনে মনে হাসেন। সৎ বিপ্রের হাতে কি চাবিকাঠি আছে যে এ-পাড় থেকে কল টিপে ওপাড়ের আত্মাদের একের সঙ্গে অন্যকে মিলিয়ে দেবে? একটু দীর্ঘশ্বাসও ফেলেন ব্রজগোপাল। মেঘুটা তার বউকে সত্যি ভালবাসত। সবাই চায়, মরার পর মেঘু তার বউয়ের সঙ্গে মিলেজুলে থাক।

ব্রজগোপাল আর কালীপদ গোবিন্দপুর ছেড়ে বরাবর খামারবাড়ির দিকে হাঁটা দেওয়ার পর মাঝ রাস্তায় হরিধ্বনি কানে আসে। উলটোদিক থেকে হারিকেন আসছে। সামনে মাচানের ওপর মেঘুর শরীরটা। ব্রজগোপাল রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ান। চোখের সামনে দিয়ে ভাসতে ভাসতে মেঘু চলে যায়। কালীপদ জোড়হাত কপালে ঠেকায়। হারিকেন কোকার হাতে। সে একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে লণ্ঠন তুলে বলে—বামুনজ্যাঠা!

—হুঁ।

—আমি শ্মশানে যাচ্ছি।

—যা।

ভক করে মদের গন্ধ ভেসে আসে। ব্রজগোপাল উদ্বিগ্ন বোধ করেন।

আবার হাঁটতে হাঁটতে কালীপদ পিছন থেকে হঠাৎ বলে, ঠাকুরমশাই, মেঘু ডাক্তারের গতিমুক্তি হল না তা হলে?

—কেন?

—এই যে নয়নতারার ওপর ভর করল! গাঁ গঞ্জে সবাই বলাবলি করছে।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হন। উত্তর দেন না। কালীপদটা কিছু বোকা। বোকা না হলে কেউ ঘরজামাই থাকে। জামাই হয়েও বহেরুর বন্ধু লোক, একসঙ্গে বসে গাঁজাটাজা খায়। এখানেই গেঁথে গেছে।

কালীপদ আবার বলে—চুরির দায়টা ঘাড়ে নিয়ে গেল, তার ওপর অপঘাত!

ব্রজগোপাল একটা গম্ভীর ‘হুঁ’ দিয়ে হাঁটতে থাকেন।

কালীপদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর হঠাৎ গুণ গুণ করে গান ধরে—কে হে বট, বাঁশের দোলাতে চইড়ে যাইচ্ছ চইলে শ্মশান ঘাটে! তোমার পোটলাপাটলি রইল পইড়ে, জুড়ি গাড়ি কে হাঁকাবে…

তুলসী গঙ্গাজলের ছিটে গায়ে দিয়ে ব্রজগোপাল ঘরে এসে ল্যাম্পটা জ্বালেন। জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়বেন। রাতে খই আর দুধ খান, আজ সেটাও খেতে ইচ্ছে করছে না। বাচ্চাকাচ্চা কাউকে ডেকে দুধটা দিয়ে দেবেন বলে উঠতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আঁধার ফুড়ে বহেরু এসে দরজায় দাঁড়াল। উদ্‌ভ্রান্ত চেহারা। বলল—কর্তা!

—কী রে?

বহেরু মেঝের ওপর বসে মুখ তুলে বলে—কলিকালের কি শেষ হয়ে আসছে?

ব্রজগোপাল বহেরুর দিকে চিন্তিতভাবে চেয়ে থাকেন।

বহেরু বলে—যদি রক্তবৃষ্টি হয়! যদি পৃথিবী ডেবে যায় মাটির ভিতরে!

॥ সাতাশ ॥

অবশেষে একদিন দুপুরে কড়া নড়ে উঠল।

বীণা ভিতরের ঘরে এ সময়টায় দরজা বন্ধ করে ঘুমোয়। ননীবালা খুটুর-খাটুর করে কাজকর্ম করেন। একটু শুয়ে চোখ বুজবেন তার উপায় নেই, ঝিম হয়ে পড়ে থাকলেই নানা অঘটনের চিন্তা আসে মাথায়। ঘুম যদি আসে তো সেই সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখা দেয়।

কদিন হল শরীরটা ভাল না। মাঝে মাঝে মাথাটা পাক দেয়। প্রেসারটা বেড়েছে বোধ হয়। পাড়ার চেনা ডাক্তারের কাছে সময়মতো গেলেই প্রেসার দেখে দেয়। আলিস্যিতে যাওয়া হয় না, এ বয়সে ভালমন্দ যদি কিছু হয়ে যায় তো হোক। তাতে তাঁর আক্ষেপ নেই। বেঁচে থাকা একরকমের শেষ হয়েছে। দেখতে না দেখতেই একটা জীবন কেমন শেষ হয়ে গেল। তেমন করে কিছু বুঝতেই পারলেন না ননীবালা। এই তো সেদিনও শিশুটি ছিলেন, বগুড়ায় রেলস্টেশনের ধারে তাঁদের পাড়ার রাস্তায় ঘাটে খেলে বেড়িয়েছেন, ধারে-কাছের কথা তেমন মনে পড়ে না, কিন্তু শিশু বয়সের কথা মনে পড়ে ঠিকই। স্পষ্ট, যেন বায়স্কোপের ছবি। বিন্দি, কাতু, শৈলী—সব মিলেমিশে সে এক পরির রাজ্য। বৃষ্টি পড়ত, শীতের কুয়াশা ঘিরে থাকত, রোদ উঠত—সবই কেমন অদ্ভুত গন্ধমাখা, নতুন বুক-কেমন-করা। সে আমলে মেয়েদের লেখাপড়ার চাপ ছিল না। কেবল সারাদিন শিশু ভাই বা বোন টানতে হত। সে তেমন খারাপ লাগত না। নাজিরের বারান্দায় থুবা করে বসিয়ে রেখে চুলে আলগা হাতে বড় খোঁপা বেঁধে এক্কা-দোক্কার কোর্টে ঝাঁপিয়ে পড়া তারপর কিছু মনে থাকত না। ঘামে ভিজে যেত অঙ্গ, গায়ে ধুলোবালি লাগত, নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠত দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসে, তবু খেলার কী যে নেশা ছিল! একদিন দেড়-বছরের বোকা ভাইটা বারান্দা থেকে গড়িয়ে পড়ে কপাল ফাটাল, মা মেরেছিল খুব চিরুনি দিয়ে। এখনও যেন কনুইয়ের হাড়ে ব্যথাটা চিনচিন করে। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা সব। শৈলী নাকি বুড়ো হয়ে গেছে! হায়রে! কতটুকু ছিল শৈলী। ঢলঢলে চেহারা, ফরসা ঠোঁটদুটো একটু বোকাটে ভাবে ফাঁক হয়ে থাকত সব সময়ে, সামনের দাঁতে একটা ফাঁক ছিল মাঝখানটিতে। সাহেবি সব নাম ছিল ওদের। চার বোন ছিল মাইথলী, মেয়রা, পিকলি আর বিউটি, দুই ভাই ছিল শচীন আর বুয়া। শৈলীর ইস্কুলের নাম ছিল বিউটি। বিলিতি ফ্রক পরত, বিলিতি সাবান মাখত, বিলিতি বিস্কুট খেত, ওদের বাড়িতে আসত সব সাহেব মেম। জজের বাড়ি, না হবেই বা কেন! যে কোনও মেয়ের সঙ্গে শৈলীরা মিশত না। কেবল ননীবালার চুল দেখে ইস্কুলে সেধে ভাব করেছিল শৈলী। সেই ভাব থেকে সই। এসব কি গতজন্মের কথা! নৌকোর মতো দেখতে ঝকঝকে পালিশওয়ালা একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে শৈলী আর পিকলি তাঁদের বাড়িতে এসে কতবার একটা বেলাই কাটিয়ে গেছে হয়তো। আবার ননীবালাও গেছেন। ভারী চপচাপ বাড়িটা ছিল ওদের, সে বাড়িতে কুকুর পর্যন্ত গম্ভীর। জজ নাকি হাসে না। তা হবে। শৈলীর বাবাকে কখনও হাসতে দেখেননি ননীবালা। কিন্তু সেই জজসাহেবও একবার ননীবালার খোলা চুল দেখে বলেছিলেন—বাঃ, এ তো অরণ্য! মনে আছে। সব স্পষ্ট মনে আছে, গলার স্বরটা পর্যন্ত কানে বাজে এখনও। সেই স্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে এক হ্যাঁচকা টানে কোনও অচেনা, অকূল পাথারে রওনা হলেন একদিন। তখনও তাঁর শরীরটুকু ঘিরে শিশুরই গন্ধ, ভাল করে ভাবতে শেখেননি, বুঝতে শেখেননি। খুলনা থেকে বর এল, টোপর পরে। সে কি ভয়াবহ হুলুধ্বনি, শঙ্খনাদ! বুকের ভিতরে ভূমিকম্প, ভেঙে পড়ছে পুতুলের ঘর, ফাটল ধরে গেল এক্কা-দোক্কার কোর্টে, ছিঁড়ে গেল জন্মাবধি মা-বাপের ভাই-বোনের শক্ত বাঁধন। যেন রশি ছিঁড়ে স্টিমার পড়ল দরিয়ায়। অচেনা একদল লোক লুটেরার মতো ঘিরে নিয়ে চলল তাঁকে, আঁচল বাঁধা একটা অচেনা লোকের আঁচলে, কত কান্নাই কেঁদেছিলেন ননীবালা! সে কান্না যেন ফুরোবার নয়। হিক্কার মতো উঠতে লাগল অবশেষে। ব্রজগোপাল চোরের মতো অপরাধী চোখে চেয়ে দেখছিলেন তাঁকে গোপনে। অবশেষে ননীবালা ভারী অবাক হয়ে দেখেছিলেন, তাঁর অচেনা স্বামীটি উড়নির প্রান্ত দিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুছছে। সেই দেখে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছিলেন। ননীবালা, যা হোক একেবারে পাষণ্ডের হাতে পড়েননি। মনটা নরম-সরম আছে। ফুলশয্যার রাতে কথাটা উঠতে ব্রজগোপাল প্রথমে স্বীকার করেননি, পরে অনেক ঝুলোঝুলি করলে লাজুক মুখে বলেছিলেন—কী জানো, কান্না দেখলে আমার কান্না পায়। কথাটা ঠিক নয়। ননীবালা জানেন, ব্রজগোপাল কান্না দেখে কাঁদেননি। ননীবালার জন্যই কেঁদেছিলেন। এসব কি বহুদিনের কথা!

আজকাল বড় ভুল হয়ে যায়। নাতি-নাতনির নাম ঠিকঠাক মনে থাকে না। সোমেনকে শতবার রণো বলে ডাকেন, চাবির গোছা কোথায় রেখেছেন মনে থাকে না। তবু শিশুবেলার কথা কেন স্পষ্ট মনে থাকে!

একেই কি বুড়োবয়েস বলে!

আজকাল একা থাকলে এই বুড়োবয়সটাই জ্বালায়। তাই দুপুরে ঘুমান না বড় একটা। শরীর খারাপ থাকলে পড়ে থাকেন বটে, কিন্তু বড় শাস্তি। ক্ষণে ক্ষণে উঠে জল খান, পান মুখে দেন, বেলা ঠাহর করেন জানালায় দাঁড়িয়ে। ছেলেপুলেরা ইস্কুল থেকে ফেরে দুপুরে। বীণার কড়া নিয়ম, বেলায় খেয়ে বাচ্চারা ঘুমোবে, যাতে সন্ধেবেলায় পড়ার সময়ে কারও ঢুলুনি না পায়। সবাই ঘুমোয় বলে নিঃঝুম বাড়িটা ফাঁকা আর বড় হয়ে যায়।

এমনি এক দুপুরে কড়া নড়ল। কত কেউ আসতে পারে। ননীবালা ঝিমুনি ভেঙে উঠে বসতেই পেটে অম্বলের চাকা নড়ে উঠল। বুকটা ধড়াস ধড়াস করে।

—কে? বলে উঠে এলেন কষ্টে।

বাইরে থেকে সাড়া এল—পিওন। রেজিষ্ট্রি চিঠি আছে।

ব্রজগোপালের টাকা এল বোধ হয়। বুকটা খামচে ওঠে হঠাৎ। আনন্দে না দুঃখে ঠিক বুঝতে পারেন না তিনি। দরজা খুলে অল্পবয়সি পিওনকে বললেন—কার চিঠি?

—ব্রজগোপাল লাহিড়ি।

—উনি তো নেই এখানে, দূরে থাকেন। আমি সই করে নিলে হবে? উনি আমার স্বামী।

পিওন একটু ভাবে। তারপর একরকম অনিচ্ছের সঙ্গে বলে—নিন।

উত্তেজনায় কলম খুঁজতে ঘরে ঢুকে খুঁজে পান না ননীবালা। ভীতকণ্ঠে বলেন—দাঁড়াও বাবা, কলম-টলম খুঁজে পাচ্ছি না, একটু দাঁড়াও।

পিওন হেসে বলে—কলম নিন না, আমার কাছেই রয়েছে।

পিওন ছেলেটা সই করার জায়গা দেখিয়ে দেয়, ননীবালা গোটা গোটা বাংলা হরফে দস্তখৎ করার চেষ্টা করেন। অক্ষরগুলো কেঁপে যাচ্ছে, জ্যাবড়া হয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা এল হাতে। ব্রজগোপালের টাকা। বিশ্বাস হতে চায় না।

পিওন ছেলেটা চিঠি দিয়ে ক্ষণকাল বোধ হয় বকশিশের জন্য অপেক্ষা করে। তারপর চলে যায়। ননীবালা দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে আসেন। শরীরটা বড় খারাপ করেছে আজ। বুকটা বশ মানছে না। বুকের ধুকধুকুনিটা যেন হঠাৎ একটু থেমে আবার হঠাৎ আছড়ে পড়ছে বুকের ভিতর।

অনেক টাকা। অনেক। খামটা খুলে চেকটার দিকে চেয়ে থাকেন। টানা হাতের লেখাটা বুঝতে পারেন না। একটা খোপের মধ্যে সংখ্যাটা লেখা। দশ হাজারের চেয়ে অনেক বেশি। একটা বাড়ি উঠে যাবে না এতে? খুশি হবে না সবাই?

বোধ হয় হবে। তবু বুকের ভিতরটা কী একরকম যেন লাগে। এতকাল এই টাকা ক’টার পথ চেয়ে বসেছিলেন ননীবালা। টাকা তুলে ব্রজগোপাল তাঁর হাতে দেবেন তিনি ছেলেদের হাতে। জমিটা রেজিষ্ট্রি হবে। ছেলেদের আর ছেলের বউয়ের কাছে ননীবালার মুখরক্ষা হবে। এই সংসারে তিনি আর একটু জোরের সঙ্গে ভারের সঙ্গে থাকতে পারবেন।

কিন্তু তাই কি হয়! হয় না। বীণা খুশি হবে না, রণোটাও কি খুশি হবে!

ননীবালা চেকটা পিকদানির নীচে চাপা রেখে শুলেন একটু। শরীর ভাল না, মন ভাল না। চোখে হঠাৎ জল আসে কেন যে! মনে হয়, সংসারে কেউই আসলে কারও নয়, এই যে একা দুপুরে মন-খারাপ হয়ে পড়ে থাকা, দিনের পর দিন, কাছের কেউ থাকলে এ দশা হবে কেন তাঁর। কেন এমন ভার লাগে দিন! সময়ের চাকা ঘোরেই না যেন।

একেই কি বুড়োবয়েস বলে!

চেকটা আর একবারও হাতে নিলেন না তিনি। পিকদানির নীচে সেটা চাপা রইল। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে, তাতে ফরফর করে পাখা নেড়ে চেকটা জানান দিতে লাগল সে আছে। ননীবালা একটু বেশি সময় ধরে কাঁদলেন আজ। ঘুম হল না। ঠিকে ঝি কড়া নাড়তে চোখ মুছে উঠলেন।

সন্ধেবেলা রণেন এলে তাকে ডেকে চেকটা হাতে দিলেন ননীবালা, কেবল বললেন—দুপুরে এসেছে।

রণেন খুশি হবে না, এমনটাই আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু রণেন খুশি হল, চেকটা টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে, জুতো মোজা খুলতে খুলতে সত্যিকারের খুশি হয়ে বলে—এসেছে! যাক, বাঁচা গেল। কালই অজিতকে খবর দেব। লক্ষ্মণের কোন পিসেমশাই খুব ঘুরঘুর করছেন জমির জন্য।

ননীবালা কথা বললেন না, শরীরটা বশ নেই। এ-বেলা বীণা রান্নাঘর সামলাচ্ছে, তিনি ছুটি নিয়েছেন। বীণা কৌতূহল দেখাল না। রান্নাঘরেই বসে রইল। তার এই চুপ করে থাকা, ওই গা-আলগা ভাব দেখে মনে মনে বড় কাহিল লাগে ননীবালার। শ্বশুরের টাকায় তার কোনও আগ্রহ নেই। গ্রাহ্য করে না।

গা ঘেঁষে ক্ষুদে নাতিটা দাঁড়িয়ে আছে। বলল—ঠানু, মশা কামড়াচ্ছে। কোলে নাও।

তাকে কোলে নিলেন ননীবালা। আঁচলে পা ঢেকে শিশু শরীরটায় গায়ের ওম্ দিতে দিতে মনটা হালকা হল। সংসারে এই বিচ্ছুগুলোকে ভগবান পাঠিয়ে দেন মানুষের মনের ধুলোময়লা ভাসিয়ে নিতেই বোধ হয়।

সোমেন আজকাল অনেক রাতে ফেরে। কোলের ছেলেটা ধাঁ করে ভিন্‌মানুষ হয়ে উঠেছে আজকাল। কথা বলেই না। কারও সঙ্গেই না। কেবল ভাইপো-ভাইঝির সঙ্গে একটু-আধটু। ননীবালা জানেন, ও অন্য জায়গায় বাসা খুঁজছে। শীলার বাড়িতে গিয়ে একদিন জানতে পেরেছেন। কাউকে বলেননি কিছু। কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, তাঁর আঁচলে বাঁধা ছেলেটা এ সংসার থেকে বার হতে চাইছে।

সেদিন ব্রজগোপাল এসেছিলেন, যাওয়ার সময়ে সোমেন গেল সঙ্গে। টিউশনি সেরে রাতে ফিরে এসে সে কী চোটপাট ননীবালাকে—তুমি কেন বাবাকে বলেছ যে আমি আলাদা বাসা খুঁজছি। তুমি জানলে কোত্থেকে?

ননীবালা ভয় পেয়ে বলেন—আমাকে শীলা বলেছে তুই নাকি ওদের বাসায় কদিন থাকতে চেয়েছিস!

—তার মানে কি বাসা খোঁজা! দিদির বাড়িতে ভাই গিয়ে থাকলে ভিন্ন বাসা হয় নাকি।

—না হয় ভুল বুঝেছি, রাগিস কেন?

রাগব না! বাবাকে সংসারের সব কেলেঙ্কারি জানানোর দরকার কী? বাবার না জানলেও চলত।

ননীবালা একটু কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে বলেন—তাকে জানাব না কেন? সে কি তোদের পর?

রাগী ছেলেটা ফুঁসে উঠে বলে তখন—পর কি না সেকথা জিজ্ঞেস করতে তোমার লজ্জা হয় না?

এ কথার উত্তরে কিছু বলার নেই, ছেলেরা বড় হলে আলাদা বোধ বুদ্ধি হয়। মায়ের শেখানো কথা তোতা পাখির মতো বলেছে এক সময়ে এই ছেলেই। এখন সংসারের নানা দাঁড়ে বসে নানা কথা শিখেছে। বোধ হয়, বাপের ওই দূরে দূরে থাকা ছেলেটার ভাল লাগে না। বোধ হয় ছেলেটা বাপের জন্য খোঁড়ে মনে মনে আর সেজন্য দায়ী করে রেখেছে ননীবালা আর রণেনকে।

তবু সেজন্য ছেলেটার ওপর রাগ হয় না ননীবালার। বরং আলাদা একটা গভীর মায়া জন্মায়। সে লোকটাকে ভালবাসার কেউ তো নেই আর। ছেলেমেয়েরা পর, বউ চোখের বিষ। যদি এই ছেলেটার টান থাকে তবে ব্রজগোপালের ওইটুকুই আছে। ছেলের ভিতর দিয়ে তার বাপের প্রতি একরকম আবছা কী যেন ভাব টের পান ননীবালা। বোধ হয় বুড়োবয়সের জন্যই।

একেই কি বুড়োবয়েস বলে!

আজ ননীবালা রাতে শোওয়ার সময়ে একটু সেধে কথা বলেন ছেলেটার সঙ্গে। বলেন—হ্যাঁরে, চাকরির কিছু হল না?

—কী হবে!

—শৈলীর কাছে আর একবার গেলি না! মুখচোরা ছেলে, নিজে না পারিস আমাকে একদিন নিয়ে যাস। কতকাল দেখি না।

—গিয়েছিলাম আর একদিন। সোমেন নরম গলায় বলে।

—গিয়েছিলি? কী বলল?

সোমেন বড্ড সিগারেট খায় আজকাল। একটার আগুন থেকে আর একটা ধরিয়ে নিয়ে বলল—বলার অবস্থা নয়।

—কেন?

—ওরা খুব ব্যস্ত।

—কীসে ব্যস্ত? শৈলীর শরীর খারাপ নাকি!

—না, শুনলাম মেয়ের বিয়ের ঠিকঠাক হচ্ছে। তাই নিয়ে ব্যস্ত। বলে সিগারেটটা পুরো খেয়ে ফেলে দেয় সোমেন।

॥ আঠাশ ॥

ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—ও মা! সে তো গুয়ের গ্যাংলা মেয়ে শুনেছি! ওইটুকু মেয়ের বিয়ে দেবে!

কেমন নিরাসক্ত গলায় সোমেন বলে—ওইটুকু আবার কী! তোমার কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল?

ননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন—সে তখন জ্ঞানবুদ্ধি হয়নি। কিন্তু আমাদের আমলে যা হত তা কি আজকাল হয়? তার ওপর বড়লোকের মেয়ে, আদুরে, এত তাড়াতাড়ি তাকে বিদায় করবে কেন শৈলী!

—সে তোমার শৈলীই জানে!

এই বলে সোমেন আবার সিগারেটের জন্য হাত বাড়ায়।

ননীবালা বলেন—এক্ষুনি তো খেলি? বুকটা শেষ করবি নাকি! ওসব বেশি খেলে কী। যেন সব রোগ বালাই হয়, লোকে বলে।

—কিছু হবে না। এই বলে অস্থির হাতে আবার দেশলাই জ্বালে সোমেন।

আর তখনই ননীবালা ছেলের মধ্যে একটু গোলমালের গন্ধ পান। কী যেন হিসেবে মিলছে না।

সময়ের একটু ফাঁক রাখেন ননীবালা, তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করেন—হ্যাঁ রে, শৈলীর মেয়ে দেখতে-শুনতে কেমন?

—কেন?

—এমনিই জিজ্ঞেস করছি, শৈলী দেখতে বেশ ছিল, একটু হাবা মতন ছিল অবিশ্যি। মেয়েটা কেমন?

—কালো।

—চোখমুখ?

—ভালই। আলগা চটক আছে।

—তোর সঙ্গে কথাটথা বলল না?

—বলবে না কেন? এ কী তোমাদের আমলের মেয়ে পুরুষের সম্পর্ক নাকি?

ননীবালা বললেন—তা নয়। বলছিলাম, বড়লোকের মেয়ে বলে দেমাক নেই তো!

—থাকলেই বা, কে পরোয়া করে!

এটা উত্তর নয়। রাগ। ননীবালা বুঝলেন। একটু ছায়া মনের মধ্যে খেলা করে গেল। বুড়ো বয়সে সব মনে পড়ে। ছেলেবেলায় তিনি কতবার শৈলীর পুতুলের সঙ্গে নিজের পুতুলের বিয়ে দিয়েছেন। এখন যদি বুড়োবয়সে পুতুল খেলার ইচ্ছে হয়? ভাবতেই একটু শ্বাস বেরিয়ে যায় বুক থেকে। তাই কি হয়! শৈলীরা কত বড়লোক। জজের বাড়িতে জন্মেছে, বিয়েও হয়েছে আর এক মস্ত বড় ঘরে। সুখ ছাড়া আর কিছু কি ওরা জানে! ননীবালার ঘরে কী আছে? ওই তো ছেলে, চেহারাটি কেমন রোগার মধ্যে তিরতিরে সুন্দর। বলতে নেই। থুঃ থু! অমন সুন্দর ছেলেটা তাঁর সারাদিন ছন্নছাড়ার মতো ঘোরে। কোন বাড়িতে বুঝি একটু পড়ায়। ব্যস। এ ছাড়া কোনও কাজ নেই। এই ছেলে কবে দাঁড়াবে, কবে তার বিয়ের কথা ভাববেন তা বুঝতে পারেন না তিনি। বড় রাগী আর অভিমানী ছেলে। শৈলীর মেয়ে ওকে আবার তেমন কিছু বলেনি তো!

ননীবালা হঠাৎ একটু আদুরে গলায় বলেন—ওরে ছেলে, আমাকে একবার শৈলীর বাড়ি নিয়ে যাবি? সে যে খুব দেখতে চেয়েছিল আমাকে!

—বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর যেয়ো। এখন ওই ঝঞ্ঝাটের মধ্যে গিয়ে লাভ কি? কথাবার্তা বলতে পারবে না, সবাই ব্যস্ত।

—বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে?

সোমেন একটু ঝাঁঝ দিয়ে ওঠে—অত জানি না।

রাগ দেখে ননীবালা দমেন না, সুর খুব নরম করে বলে—ধমকাস না বাবা। মরে যদি তোর ঘরে জন্মাই ফের, তবে তো শাসনের চোটে দম বের করে দিবি। মা হয়ে বকা খাচ্ছি, মেয়ে হয়ে তো খাবই।

সোমেন হাসে হঠাৎ। বলে—মরতে বলেছে কে?

—বলতে হয় না, হঠাৎ কার কখন মেয়াদ শেষ হয়। তা শৈলী তোকে বিয়ের কথা কী বলল?

—বলবে আবার কী! বাবাকে বাসে তুলে দিয়ে সেদিন হাতে সময় ছিল। গিয়েছিলাম। দেখি, বাড়িতে বেশ কিছু লোকজন। সবাই ব্যস্ত। শৈলীমাসির ঘরেও কয়েকজন বসে আছে। আমাকে দেখে খুব আদর করে বসাল, অনেক মিষ্টি খাওয়াল। বলল—বাবা, রিখির বিয়ে দিচ্ছি। ফাল্গুনে, নয়তো বৈশাখে। তোমাকে বলা রইল কিন্তু।

—আর কিছু বলল না?

—হুঁ। ছেলে বিলেতে মেম বিয়ে করেছে, আর আসবে না, সেজন্য খুব দুঃখ করল। বলল—ছেলে তো আপন হল না, এখন দেখি জামাই যদি আপন হয়। ছেলে লিখেছে, ভারতবর্ষ ভিখিরির দেশ, ওখানে মানুষ থাকতে পারে না। লন্ডনে ষাট হাজার পাউন্ডে বাড়ি কিনেছে। গাড়িটাড়ি তো কিনেছেই।

—ও আবার কেমন ছেলে! ননীবালা দুঃখ পেয়ে বলেন।

মিটমিটে হেসে সোমেন বলে—আমি যেমন!

—তোর সঙ্গে কীসের তুলনা? ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—তুই আমার কোলপোঁছা ছেলে। এখনও বিপাকে পড়লে কেমন মা-মা করিস!

—সে সবাই করে। আবার সুযোগ পেলে কেটেও পড়ে। আমিও তো বাসা ছাড়ার প্ল্যান করছি, তুমি তো জানোই। একই ব্যাপার।

ননীবালা অবহেলা ভরে, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন—হুঁ! তুই আবার যাবি!

—যাবই তো। সোমেন তেমনি হাসিমুখে বলে—শুধু যে বাসা ছাড়ব তা নয়, দেশও ছাড়তে পারি।

—তার মানে?

আমার এক বন্ধু জার্মানিতে চাকরি করে। সে লিখেছে, আমাকে ওখানে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

—গিয়ে কী করবি?

সোমেন আধশোয়া হয়ে বলে—চাকরি করব আর তোমাকে টাকা পাঠাব।

—অমন টাকায় আমার দরকার নেই। ননীবালা বলেন—আগে শুনতাম লোকে পড়াশুনো করতে বিলেত-টিলেত যায়। আজকাল দেখি সবাই যায় চাকরি করতে।

সোমেন চিত হয়ে শুয়ে ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে বলে—তো এদেশে চাকরি না পেলে কী করবে?

ননীবালা বেশি কথা বলেন না। কেবল গলায় একটা ক্ষীণ নিরুদ্বেগের ভাব ফুটিয়ে বলেন—বেশ, যাবি তো যা না! বিদেশে গেলে ছেড়ে তো দিতেই হবে। যতদিন এদিকে আছিস ততদিন বাইরে কোথাও না থাকলেই হয়।

সোমেন উত্তর দিল না। সিগারেট টানতে টানতে কী যেন ভাবে।

ছেলেটাকে ভয় পান ননীবালা। দুই ছেলের মধ্যে, বলতে নেই, এই ছেলেটার প্রতিই ননীবালার পক্ষপাতিত্ব একটু বেশি। কোলের ছেলে, একটু বেশি বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খেয়েছে, সংসারে আছে একটু কম জোরে। দেওয়া-থোওয়া করতে পারে না তো। সংসারে দেওয়া-থোওয়া করতে না পারলে আদর হয় না। সেই জন্যই অসহায় ছেলেটার দিকে তাঁর টান বেশি। কিন্তু এ ছেলেটাই তাঁকে একদম পাত্তা দেয় না। ডাকখোঁজ করে বটে, কিন্তু দড়ি-আলগা ভাব। জাহাজ যেন জেটিতে ঠিকমতো বাঁধা নেই। জলের ঢেউয়ে নড়েচড়ে দোল খায়। বুঝিবা যে কোনও সময়ে ভেসে চলে যাবে। ওর মনটা কি একটু শক্ত? মায়াদয়া একটু কি কম! চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে ননীবালা ভাবেন। সংসারে কেউ তো কারও নয়। বুড়ো বয়সে এইসব টের পাওয়া যায়।

আজকাল চলে-যাওয়ার একটা বাতাস এসেছে দুনিয়ায়। হুটহাট শুনতে পান, তরতাজা ছেলেরা সব বিলেত বিদেশে চলে যাচ্ছে। ছেলেধরা যেমন খেলনা বা লজেঞ্চুস দেখিয়ে ছেলে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, এও তেমনি। গুণী ছেলেদের টেনে নেয় সাহেবরা। বড়জামাই অজিতের বন্ধু লক্ষ্মণকেও টেনে নিয়েছে ওইরকম। সে আর আসবে না। জমিটা তাই সস্তায় পাওয়া গেল। কিন্তু জমির কথা আর ভাবেন না ননীবালা। মাথার মধ্যে শৈলী, শৈলীর মেয়ে, বিলেত বিদেশ, সোমেন, সব জট পাকিয়ে যায়। আর মনে হয়, পৃথিবীটা মস্ত বড়, কূলহারা অথৈ, ছেলেবেলায় মনে হত যতদূর দেখা যাচ্ছে ততদূর পর্যন্ত পৃথিবীটা সত্যিকারের। তার পরের পৃথিবীটা ভূতপ্রেত দত্যি-দানোর রাজত্ব। বুড়ো বয়সে সেটাই আবার মনে হয়। চেনাজানার বাইরে পৃথিবীটা জিনপরি দত্যি-দানোর হাতে। ঘরের ছেলেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ডেকে নিয়ে যাবে।

ননীবালা শ্বাস ছাড়েন, থাক সবাই নিজেদের মনে সুখে থাক। যেখানে খুশি থাক।

—বাতি নেবাব মা? সোমেন জিজ্ঞেস করে।

—হুঁ। বলে ননীবালা শুয়ে পড়েন। শরীরটা আজ বড্ড খারাপ। রক্তের চাপ খুব বেড়েছে। সকালে একবার ডাক্তারের কাছে যাবেন কাল।

কলকাতার শৌখিন শীত শেষ হয়ে এল। বাতাসে চোরা গরম টের পাওয়া যায়। খবরের কাগজে মহামারীর কথা লেখে। খুব ধুলো ওড়ে চারদিকে। এ শহরে কেন যে তেমন শীত পড়ে না ননীবালা বোঝেন না। মানুষ বেশি বলে সকলের গায়ের ভাপে শীত কমে যায় না কি! কিংবা সেই যে অ্যাটম বোমা ফাটিয়েছিল, তাইতেই শীত পালিয়ে গেছে। কথাটা একদিন সোমেনকে বলেছিলেন, সোমেন ধমকেছিল। ছেলেটা বড্ড বকে তাঁকে। শীতের। জন্য একরকম দুঃখ হয়। শ্বশুরবাড়িতে সেই কোন ভোরে উঠে কাঠের জ্বালে রোগা ছেলের জন্য কালোজিরে চালের ভাত বসাতেন। চারধারে পৃথিবীটা কী হিম, কী কনকনে ঠান্ডা! নাকে চোখে জল আসত, হাড়ের ভিতরে ব্যথিয়ে উঠ শীত। বাগানে কপির পরতে, পালংয়ের পাতায় কুয়াশা জমে থাকত। জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামত টিনের চাল থেকে। বাচ্চাদের গায়ে গরম জামাটামা জুটত না, খাটো খাটো মোটা সুতির চাদর জড়িয়ে ঘাড়ের পিছনে গিট বেঁধে দেওয়া হত, দেখতে হত ছোট ছোট পা-অলা পাশ বালিশের মতো, সারা উঠোন দৌড়ে বেড়াত। রোদ যতক্ষণ না উঠত ততক্ষণ সিঁটিয়ে থাকত হাত পা, আঙুল অবশ হয়ে বেঁকে যেতে চাইত। গরমে গরম হবে, বর্ষায় বৃষ্টি, শীতে শীত এই জেনে এসেছেন এতকাল। কিন্তু কলকাতার ধারা আলাদা। এখানে সারা বছরই কেমন একরকমের ভ্যাপসা গরমি ভাব। মানুষের গায়ের তাপ, কিংবা অ্যাটম বোমা কিছু একটা কারণ আছেই। ছেলেরা বোঝে না। বহুকাল হয়ে গেল এ শহরে, তবু ঠিক আপন করতে পারলেন না জায়গাটাকে। মায়া জন্মাল না। কেবলই মনে হয়, আমার দেশ আছে দূরে, এখানে প্রবাসে আছি। অথচ তা তো নয়। কলকাতাতেই সবচেয়ে বেশি সময়টা কাটল জীবনের, ভগবান করলে এখানেই বাড়িঘর হবে, এখানেই গঙ্গা পেয়ে যাবেন। তবু কেন যে এটাকে নিজের জায়গা বলে ভাবতে পারেন না!

একদিন সকালে বড়জামাই এসে হাজির। বলল—মা, আমাদের বাড়িতে চলুন।

বুকটা কেঁপে ওঠে, হাত-পা ঝিম ঝিম করে। কষ্টে ননীবালা বললেন—কেন বাবা, কী হয়েছে?

অজিত মুখটা গম্ভীর রেখেই বলে—চলুন নিজেই দেখবেন।

গলা আটকে আসে ননীবালার। শীলুর চোট লেগেছিল পেটে, কোনও অঘটন হয়নি তো! কষ্টে জিজ্ঞেস করেন—শীলুর কিছু হয়েছে?

জামাই লজ্জা পায়। চোখ নামিয়ে বলে—আপনার একবার যাওয়া দরকার। আপনার মেয়ে আপনার জন্য অস্থির।

বীণা নন্দাইকে চা করে খাওয়ায়, খাবার দেয়, দু-একটা ঠাট্টার কথাও বলে। ওদের কারও দুশ্চিন্তা নেই। কেবল ননীবালারই হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে আসে। কতকাল ধরে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেছে ওরা। প্রায় বুড়ো বয়সেই হতে চলেছে সন্তান, যদি কিছু ঘটে তো মেয়েটা জামাইটা শয্যা নেবে। সংসারের সুখ নিবে যাবে।

ননীবালা কথা বাড়ান না। সোমেনের একটা কিটব্যাগে কাপড়চোপড় গোছাতে থাকেন। ছেলেরা কেউ বাড়ি নেই। কাউকে বলে যাওয়া হল না। জামাই তাড়া দিচ্ছে, ঘরদোর কিছু সিজিল-মিছিল করে যাবেন তার উপায় নেই। ননীবালা বাড়ির বার হলেই বীণা ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র হাঁটকে দেখে। কী এক শত্রুতা তৈরি হয়েছে বউটার সঙ্গে! তার ওপর চেক ভাঙিয়ে টাকা তুলতে যে কোনওদিন গোবিন্দপুর থেকে শনিঠাকুরটি আসবেন। আর এক শত্রু। কিন্তু শত্রু হোক আর যাইহোক, তার একটা মর্যাদা আছে। ননীবালা মানুষটাকে যতই মুখ করুন, এ সংসারের আর কেউ তাকে অমর্যাদা করলে ননীবালার বড় লাগে। ননীবালা থাকবেন না, তখন যদি আসে তো ছেলের বউ হয়তো বসতেও বলবে না, আদর আপ্যায়ন করবে না দাঁড়ানোর ওপর বিদায় দেবে। সে লোকও বড় অভিমানী, একটু অনাদর দেখলে নিজেকে সে জায়গা থেকে সরিয়ে নেয়। আর সোমেনের চিন্তা তো আছেই। বাপের মতোই স্বভাব, একটুতে রেগে যায়। মুখ ফুটে কারও কাছে একগ্লাস জল পর্যন্ত চায় না। ননীবালার কাছেই যত আবদার। বয়স্ক খোকা একটি।

এইসব দুশ্চিন্তা করেন ননীবালা, আর ব্যাগ গুছিয়ে নেন। সংসারে শত দড়িদড়া দিয়ে বাঁধা জীবন। কত মায়া, কত চিন্তা, কত নিজেকে দরকারি মানুষ বলে ভাবা! তবু তো সব ছেড়ে একদিন রওনা হতে হয়! কিছু আটকে থাকে না। এসব বুনো বয়সের চিন্তা। আঁচলটায় চোখ মুছে নেন তিনি।

এই যে শীলু আর জামাই ছেলে-ছেলে করে পাগল, তার তো কোনও মানে নেই। হচ্ছে না, সে একরকম। কিন্তু হলেই কি সুখ নাকি? মুখখানা দেখলেই মায়া এসে গেল তো গেলই। আর একটা জীবন ছাড়ান-কাটান নেই। মুখ দেখে সুখ যেমন, আবার জীবনভর দুঃখও কম নাকি! পেটের শত্রুর চেয়ে শত্রু নেই, লোকে বলে—সে মিছে কথা নয়। বাপ-পা যত ভালবাসে ছেলেমেয়েকে ছেলেমেয়ে কোনওকালে উলটে ভালবাসে না তত। নিজেকে দিয়েই জানেন। রণেন, শীলু হওয়ার পর জগৎসংসার যেন ওদের মধ্যেই বাসা বাঁধল, ভালবাসা নিঙড়ে নিল। আবার এখন রণেনকে দেখেন, ছেলেপুলে নিয়ে কত চিন্তা, কত ভালবাসা!

ননীবালা বীণাকে ডেকে বললেন—যাই।

—আসুন। বলে বীণা প্রণাম করল।

বড় ভাল লাগল ননীবালার। পিঠে হাত রেখে গভীর মনে আশীর্বাদ করলেন। এরা ভালবাসা নিতে জানে না, জানলে, ননীবালা যে কত ভালবাসতে পারেন তা দেখতে পেত।

॥ উনত্রিশ ॥

ননী, ছেলেকে পাঠিয়েছিলি, কিন্তু নিজে তো কই একদিনও এলি না। বগুড়ার কথা বলব এমন মানুষ পাই না। সেই আমাদের বগুড়ার ছেলেবেলার সাক্ষী কেই বা আছে! একা পড়ে আছি কতকাল। তোকে পেলে কত কথা যে বলব! তোর ছেলেটা বড় লাজুক, আজকাল আসে না তো! ওকে সঙ্গে নিয়ে আসবি। কবে মরে যাই কে জানে? সকলের জন্য বড় মায়া হয় আজকাল। আসিস….

মার চৌকিটা ন্যাড়া হয়ে পড়ে আছে। বিছানাটা গোটানো, তার ওপরে শতরঞ্চির বেড়। চৌকির ওপর ধুলোর আস্তরণ পড়েছে। তোশকের নীচে গুঁজে রাখা অনেক টুকিটাকি কাগজ, লন্ড্রির বিল, পুরনো চিঠি তার মধ্যে শৈলীমাসির দেওয়া চিঠিটাও পড়ে আছে। মা এখনও বড়দির বাড়ি থেকে আসেনি। দুদিন ধরে পড়ে আছে চিঠিটা, মার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসা হয়নি। থাকগে। এমন কিছু জরুরি চিঠি নয়।

কেমন একটা বিষন্ন ঋতু এসেছে এখন। শীতের টান শেষ হয়ে বাতাস ভেপে উঠেছে ক্রমে। সাঁঝ সকালে অন্ধ কুয়াশা আর ধুলো ঢেকে রাখে চারধার। কলকাতার পচনের ভ্যাপসা গন্ধ চাপ হয়ে বসে থাকে শহরের বুকে। মন বড় আনমনা। ভাল লাগে না। কিছু ভাল লাগে না।

গতকালও অণিমার সঙ্গে দেখা, মুক্ত অঙ্গনে ওরা নাটক করবে। মিহির বোস নাটক লিখেছে, পরিচালনাও তার। নাটকের দল তৈরি হয়ে গেছে, দলের নাম হইচই। সোমেনকে একটা পার্ট নেওয়ানোর জন্য ঝুলোঝুলি। সবশেষে বলল—বড্ড অহংকারি তুমি। অহংকার সবাইকে মানায় না সোমেন।

একটু কি রেগে গিয়েছিল অণিমা! কিন্তু সোমেনের ওসব ছেলেমানুষি আর ভাল লাগে না। বয়স বাড়ছে। গেস্ট কিন উইলিয়ামসে ঢুকে গেল চিত্তপ্রিয়। আই সি আইতে ডি গ্রেড কেরানির চাকরি পেয়ে গেছে হেমন্ত। সত্যেন তার বাড়িতে টিউটোরিয়াল খুলে পয়সা করছে। সোমেনেরও একটা কিছু করা দরকার। কিছু করার জন্য হাত-পা নিশপিশ করে। কিন্তু শূন্য কাজে বেলা কেটে যায়।

দুপুরে ঘুমিয়ে উঠে নতুন প্যান্টটা পরে বেরোতে যাচ্ছিল সোমেন, বউদি ডেকে বলল—চা করছি, খেয়ে যাবে নাকি!

বউদির সঙ্গে খুব একটা কথাবার্তা হয় না আজকাল। সোমেন কথা বলতে আলসেমি বোধ করে। চুপচাপ থাকতেই ভাল লাগে। যেন বা হঠাৎ তার অভিজ্ঞতা বেড়েছে, বয়স হয়েছে, ধীর-স্থির বিবেচক গম্ভীর মানুষ একজন।

চায়ের কথায় বেরোতে গিয়েও ঘুরে এসে সোফায় বসে বলল—দাও।

গ্যাস উনুন থেকে কেটলি নামিয়ে, চা ভিজতে দিয়ে বউদি উঠে এসে বলল—এই প্যান্ট করালে?

—হুঁ।

—বেলবটম করালে না কেন?

সোমেন একটু হাসে। দাদাকে আজকাল বউদি খুব আধুনিক পোশাক পরায়। দাদা স্টাইল বোঝে না। মোটাসোটা মানুষ বলে মানায়ও না কিছু। তবু নির্বিকার মানুষের মতো বউদি যা পরায় তাই পরে।

সোমেন বলল—বেলটম আমার ভাল লাগে না। পায়ের গোড়ালির কাছে একগোছ বাড়তি কাপড় হাতির কানের মতো লটরপটর করবে, সে ভারী বিশ্রি। বোকা-বোকা।

বউদি বলে—দাঁড়াও তো, দেখি।

সোমেন দাঁড়ায়। বউদি চারধারে ঘুরে প্যান্টের ফিটিং দেখে মুখ টিপে হেসে বলে—খারাপ হয়নি। তা অমন সুন্দর বিলিতি কাপড়ের প্যান্টের সঙ্গে কি ওই অখন্দে তিলেপড়া নীল শার্টটা পরে বেরোবে নাকি?

সোমেন পা নাচাতে নাচাতে বলে—এইটাই আমার সবচেয়ে ভাল শার্ট।

—উদো একটা। টাকা দিচ্ছি, আজই একটা সাদা রঙের ইজিপসিয়ান বা টেরিকটন শার্ট করতে দেবে…

সোমেন বাধা দেওয়ার আগেই বউদি ভিতরের ঘরে তোশকের তলা থেকে মুহূর্তের মধ্যে পঞ্চাশটা টাকা এনে প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে বলে—রেডিমেড ভাল পেলে তাও। কিনতে পারো।

সোমেন একটু চুপ করে থাকে। বউদি চা এনে দেয়। চুমুক দিতে দিতে বলে—তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে…

বউদি হেসে ফেলে, বলে—তার মানে?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে সোমেন বলে—দয়া ছাড়া গতি কী বলে?

—দয়া নয় ঠাকুরদা, তুমি তো বড্ড বেশি বোঝো?

—দয়া নয়? তবে কী! জয় তোমার করুণা…

—আজ তোমার জন্মদিন।

সোমেন একটু অবাক হয়। বলে—আজ দোসরা ফাল্গুন নাকি?

—হ্যাঁ। কিছুই তো খেয়াল রাখো না। রাতে তোমার দাদা মাংস আনবে, আর ফ্রায়েড রাইস করব। তোমার নিজের এসব খেয়াল না থাকলেও আমাদের থাকে মশাই।

—কত বয়স হল বলো তো?

—পঁচিশে পা দিলে। চব্বিশ পূর্ণ হয়ে গেল।

—পঁচিশ! বলে হঠাৎ বিড়বিড়িয়ে ওঠে সোমেন, কবজি উলটে ঘড়ি দেখে বলে— পঁচিশ! তা হলে তো একদম সময় নেই।

বউদি অবাক হয়ে বলে—কীসের সময় নেই?

সোমেন বউদির মুখের দিকে চেয়ে বলে—খুব তাড়াতাড়ি একটা কিছু করা দরকার বুঝেছ! বয়স বাড়ছে।

বউদি বড় বড় চোখ চেয়ে বলে—বুঝেছি। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে সেলুন থেকে দাড়িটা কেটে নেওয়ার যেন সময় হয়। ওই প্যান্টটার সঙ্গে তোমার একদম ম্যাচিং হচ্ছে না। লোকে দেখলে ভাববে কার প্যান্ট চুরি করে এনে পরেছ।

সোমেন গাল চুলকোয়, থুতনিতে হাত দিয়ে হাসে। ঘরে ঘুমন্ত বাচ্চাদের মধ্যে কে যেন কেঁদে উঠল। বউদি ও-ঘরে যাওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে বলল—ফের যেন শোকতাপ পাওয়া বুড়ো ঠাকুরদার মতো চেহারায় না দেখি। মা এসে দেখলে ভাববে তার ছেলেকে খেতে দিইনি কদিন।

সেলুনে দাড়ি কামিয়ে নিল সোমেন। গড়িয়াহাটার ভাল দোকান থেকে দুধসাদা একটা টেরিকটনের শার্ট কিনে নিল। দোকানের ট্রায়াল রুমে ঢুকে পরে নিল শার্টটা। ট্রায়াল রুমটা অদ্ভুত। অন্ধকার ছিল, ভিতরে পা দিতেই পায়ের তলায় চৌকো পাটাতন দুলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পাখা ঘুরতে থাকে মাথার ওপর। আলো জ্বলে ওঠে। সবই অটোমেটিক। এই সব কায়দার জন্যই বোধ হয় বড় দোকানটায় শার্টটার দাম টাকা দশেক বেশি পড়ল। ফুটপাত থেকে কিনলেই হত।

নিজেকে আয়নায় দেখে খুশি হচ্ছিল না সোমেন। পঁচিশ বছর বয়সের ছাপ পড়ল নাকি মুখে! কোন বয়সের পর যেন মানুষ আর বাড়ে না। কোন বয়স থেকে যেন ক্ষয় শুরু হয়! একটা আবছা ভয় হঠাৎ বুক শুকিয়ে দেয়। যৌবন বয়স তো চিরকাল থাকে না। কিন্তু কত দিন থাকে?

অণিমাদের বাড়িতে গাব্বুর পড়ার ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয় সোমেন। সবাই হাজির। অপালা, পূর্বা, অণিমা, শ্যামল, মিহির বোস ছাড়াও ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ছেলেমেয়ে, দু-চারজন অচেনাও রয়েছে। একটা চেয়ারের ওপর এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মিহির বোস, হাতে নাটকের পাণ্ডুলিপি, মুখচোখ খুব সিরিয়াস। যেমন বোকা বোকা লেগেছিল তাকে প্রথম দিন। এখন আর তেমন লাগছে না। আত্মবিশ্বাসী উচ্চাকাঙক্ষাসম্পন্ন একজন চালাক-চতুর লোকের মতোই দেখাচ্ছিল। অপালা তার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে।

সে ঘরের দরজায় পরদা সরিয়ে দাঁড়ায়। পূর্বা অণিমাকে ঠেলা দিয়ে অবহেলার সঙ্গে। বলে—তোদের প্রাইভেট টিউটারটা এসেছে, দ্যাখ, অণি!

অণিমা মুখ ফিরিয়ে হাসল। বলল—প্রাইভেট টিউটার ছাড়া আর কী! ওর কোনও উচ্চাকাঙক্ষা নেই।

অপালা মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল।

মিহির বোস একটু নিরস গলায় বলল—আসুন সোমেনবাবু।

সোমেন বুঝতে পারে সবাই তার ওপর রেগে আছে। সোমেনের মৃদু একটু বোকা-হাসি আছে, যা দেখে সবাই ওকে ক্ষমা করে। সেই হাসিটা সে হাসল এখন। ঘরে ঢুকে অণিমার পাশে সোফায় বসে বলে—গাব্বু পড়বে না?

—কী জানি! ও ওদিককার একটা ঘরে শিফট করেছে। এ ঘরটা আপাতত হইচই দলের। এখানে তোমার ভাল না লাগলে গাব্বুর ঘরে যেতে পারো।

সোমেন উত্তর দিল না, বসে রইল। মিহির বোস তার প্রতীক নাটকের থিম বোঝাচ্ছিল। একটু থেমে আবার শুরু করল এখন।

পূর্বা চেয়ারে বসেছিল। উঠে এসে সোমেনের পাশে সোফায় বসে ফিসফিস করে বলল—নাটকটা কিছু বুঝতে পারছি না মাইরি। একটা লোক একদিন মাথা ধরার ট্যাবলেট মনে করে নাকি চাঁদটাকে গিলে ফেলেছিল। সেই থেকে প্রবলেম শুরু তারপর থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ইউ এন ও সবাই লোকটার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে পাঠায়। লোকটার প্রেমিকা আত্মহত্যা করতে চাইছে, আর লোকটা তাকে বিরাট বিরাট বক্তৃতা দিয়ে কী যেন বোঝাচ্ছে। সবাই বলছে, দারুণ নাটক। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

সোমেন সমবেদনার স্বরে বলে—ততার মাথাটা নিয়ে আমারও চিন্তায় রাতে ঘুম হয় ড়া।

—যাঃ। বলে পূর্বা হেসে ওঠে।

মিহির বোস নাটকের থিম বোঝাতে বোঝাতে ব্যথিত চোখে তাকায়। পরদা সরিয়ে অনিল রায় উঁকি দেন—আসতে পারি?

সবাই সমস্বরে বলে ওঠে—আসুন স্যার।

অনিল রায়ের হাঁটা দেখেই বোঝা যায়, পেটে ঈষৎ মদ আছে। চোখ দুটো চকচকে লাল; মুখে বেসামাল একটা হাসি। তাঁর সঙ্গে ম্যাক্স! সেও টেনে এসেছে তবে অনেক স্টেডি, আর কিছু গম্ভীর। অনিল রায় সোমেনের কাছে এলে সোমেন উঠে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বলে—বসুন স্যার।

—সোমেন না?

—হ্যাঁ স্যার। আপনি আমাকে কেবল ভুলে যান।

অনিল রায় বসে হাসলেন। বললেন—বয়সে পেয়েছে, বুঝলে! সেদিন নিজের ছেলেটার সঙ্গে দেখা এক বিয়েবাড়িতে, প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল আচমকা, চিনতেই পারলাম না। অবশ্য আমাদের ডিভোর্সের সময়ে ওর বয়স কম ছিল। এখন বেশ লম্বা চওড়া হয়েছে। সাত বছর সময় তো কম নয়! তবু চেনা উচিত ছিল। আফটার অল নিজেরই তো ছেলে। শেষে অদিতিই এগিয়ে এসে বলল—অনিল, বাণ্টিকে চিনতে পারছ না! অনিল রায় হাসলেন—কী কাণ্ড বলো!

পূর্বা হিহি করে হাসছিল। অনিল রায় ধমকালেন—কী হল? ও ছুঁড়ি হাসছে কেন? মিহিরের নাটকটা কি খুব হিউমারাস?

অণিমা বলে—না স্যার, হাসিই ওর রোগ। হাসতে হাসতে একদম বেহেড হয়ে যায়।

—না না, ও আমার ছেলের কথা শুনে হাসছে। আজকাল প্যাথেটিক কথাতেও লোকে হাসে। সোমেন, একটা সিগারেট দাও তো।

—নেই স্যার, এনে দিচ্ছি। বলে সোমেন উঠতে যাচ্ছিল। মিহির বোস নিজের সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে আসে।

—আমার কাছে আছে, নিন।

পূর্বা মুখ তুলে বলে—আজ সারা বিকেল ধরে হাসিটা চেপেছিলাম। এতক্ষণে বেরিয়ে গেল।

অনিল রায় অবাক হয়ে বলেন—কেন?

—নাটকটা স্যার কিছু বুঝতে পারছি না। কেবল হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু অপালা যা গম্ভীর হয়েছিল, হাসতে সাহস হয়নি।

অপালা তার প্রতিমার মতো বড় বড় চোখ ফিরিয়ে তাকিয়ে বলল—মারব থাপ্পড়। বাথরুমে যাওয়ার নাম করে অন্তত বার দশেক হাসবার জন্য উঠে গেছিস, আমি বুঝে টের পায়নি।

আবার হিহি করে হেসে ওঠে পূর্বা। তার হাসি দেখে সবাই হাসে। অপ্রস্তুত মিহির বোসও হাসতে থাকে সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অকপটে। পূর্বা বলে—তোর হাসি পায়নি অপা?

—পেলেই যেখানে-সেখানে হাসতে হবে নাকি? হাসলে মিহিরবাবু বুঝি আর ফিরে তাকাতেন আমাদের দিকে? নিজের ভবিষ্যৎ কেউ হেসে নষ্ট করে, বলুন স্যার?

সোমেন চাপা স্বরে বলে—জঘন্য।

অনিমা শুনতে পেয়ে বড় বড় চোখে তারদিকে চেয়ে বলে—কী জঘন্য সোমেন?

—তোমরা?

—ওমা! কেন?

—তোমরা জীবনেও কাউকে ভালবাসতে পারবে না। কেবল ইয়ারকি। ঘরে ঢুকে অপালার ভাসবাস দেখে মনে হয়েছিল, মিহির বোসের প্রেমে পড়েছে বুঝি। এ তো দেখছি, এখনও বাঁদরনাচ নাচাচ্ছে।

একটু পা নাচিয়ে অণিমা বলে—ভালবাসার লোককে নিয়ে বুঝি ইয়ারকি করতে নেই! তোমাকে নিয়ে আমি ঠাট্টা করি না?

—ফের? বলে তাকায় সোমেন।

—আচ্ছা বাবা, ঠাট্টা করব না আর। কান ধরছি। সত্যিই অণিমা কান ধরে।

—ও কী রে? চেঁচিয়ে ওঠে অপালা।

—অণিমা ম্লান মুখে বলে—ও ধরতে বলল যে।

—কে?

—ও। বলে ভারী লাজুক ভঙ্গিতে সোমেনকে দেখিয়ে দিয়েই মাথা নত করে অণিমা। সকলে উচ্চকিত হয়ে হাসতে থাকে। সোমেনের কান মুখ গরম হয়ে যায়। পূর্বা দাঁতে ঠোঁট টিপে বলে—তোর বাড়ির টিউটরটার তো ভারী সাহস অণি!

—তুমি আর কেলিও না। বলে পূর্বাকে ধমক দেয় সোমেন।

পূর্বা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে—দেখেছেন স্যার! ওকে আমি সবচেয়ে বেশি ফেবার করি, আর ও সব সময়ে আমাকে ইনসাল্ট করে।

গোলমালটা একটু থিতিয়ে আসে। মিহির বোস তার কভার ফাইল খুলে নাটকের পাণ্ডুলিপি বের করে।

সোমেন উঠে বলে—আমি গাব্বুর ঘরে যাচ্ছি।

কেউ তারদিকে মনোযোগ দিল না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে সোমেন প্যাসেজে পা দিল। নীচের তলায় অনেকগুলো ঘর। কেউ থাকে না। ফাঁকা নিঝুম। পায়ে পায়ে এঘর-ওঘর ঘুরে দেখছিল সোমেন। গাব্বু কোনও ঘরেই নেই।

ভিতর দিকে একটা ঢাকা বারান্দার মতো। আলো নেই। প্যাসেজের আলোর ক্ষীণ আভা আসছে। পিছন দিকেও ওদের বাগান আছে। মৃদু গোলাপের গন্ধ আসছে, আর গাছগাছালির বুনো গন্ধ। সোমেন ডাকল—গাব্বু।

কেউ সাড়া দিল না।

পিছন ফিরতেই চমকে গেল সোমেন। পিছনে মৃদু আলো, আবছায়ায় ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে অণিমা। সোমেন হেসে ফেলে বলে—চমকে গিয়েছিলাম। শব্দ করোনি তো।

অণিমা উত্তর দিল না। নড়লও না। কেবল তাকিয়ে থাকল।

সোমেনের বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। অজানা একটা ভয়। একটা অনিশ্চয়তা। সে সহজ হওয়ার জন্য বলল—গাব্বু কোথায় কোথায় বললে?

—এসো। বলে হাত বাড়াল অণিমা। সোমেনের হাতখানা ধরল। বলল—এস, দেখিয়ে দিচ্ছি।

সোমেন এত ভয় কখনও পায়নি। অণিমা হাত ধরেছে বলে নয়, অণিমা কাছ ঘেঁষে রয়েছে বলেও নয়। সোমেন লক্ষ করেছে, ওর গলার স্বর বসা, আবেগরুদ্ধ। এসব সময়ে মানুষ গলার স্বর লুকোতে পারে না।

অন্ধকার একটা ঘরে এনে তার হাত ছাড়ল অণিমা। আলো জ্বালল না। বাগানের দিকে একটা মস্ত খোলা জানালা। জানালার ওপাশে হয়তো জ্যোৎস্না, কিংবা ফ্লুরোসেন্ট আলো। সেই আলোয় ছায়ামূর্তির মতো পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অণিমা ডাকল—সোমেন।

—কী?

—এখন সেই কথাটা বলো।

সোমেন কেঁপে ওঠে। বোঝে যে অণিমা ঠাট্টা করছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *