যাও পাখি – ২০

॥ কুড়ি ॥

সোমেন বসেছিল চুপচাপ বাইরের ঘরে। দু-আঙুলের ফাঁকে পুড়ে যাচ্ছে সিগারেট। শীতের শুকনো বাতাসে সিগারেট তাড়াতাড়ি পোড়ে। উৎকর্ণ হয়ে সোমেন বড়দির কান্নার কারণটা বুঝতে চেষ্টা করছিল। কান্না সে একদম সইতে পারে না। মন খারাপ হয়ে যায়, মনে হয় কী জানি সর্বনাশ ঘটে গেল।

কান্না থেমে গেছে, অনুচ্চ স্বরে জামাইবাবু কী বোঝাচ্ছে দিদিকে। সোমেনের ভাল লাগছে না, রোদ মরে শীতের বিষণ্ণ সন্ধ্যা ঘুমিয়ে আসে। শীতকালে সোমেনের একরকম ভালই লাগে, কিন্তু এই ঋতুটা বড় গুরুভার, মন্থর, রহস্যময়। ও-ঘর থেকে আদরের নির্লজ্জ শব্দগুলো আসে ভেজানো দরজা ভেদ করে। লজ্জা করে সোমেনের। উঠে চলে যাবে, তাও হয় না। মনে মনে সে এ-বাড়িতে বসবাস করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে।

কী বিশাল এই কলকাতা শহর, তবু কোথাও নিরুপদ্রবে বাস করার একটু জায়গা নেই তার জন্য। পূর্বা বলেছে, তাদের তিন তলার এক-ঘরের ফ্ল্যাটটা সোমেনকে দেওয়া যায় কি না তা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করবে। হয়তো রাজিও করাবে পূর্বা। কিন্তু নেওয়া কি সম্ভব হবে? মাসে মাসে একশো পঁচিশ টাকা ভাড়া আসবে কোত্থেকে! চাকরিটা সম্বন্ধে এত নিশ্চিত ছিল সে যে রেলে ক্লার্কশিপের পরীক্ষাটা পর্যন্ত দেয়নি। দিলেই ভাল করত। রেলের চাকরি হলে ভালই হত। বদলির চাকরি, কলকাতা ছেড়ে দূরে দূরে থাকতে পারত।

ব্যাঙ্কের চাকরিটা কেন যে হল না! ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা ব্যথার মতো যন্ত্রণা হয়। অলক্ষে একটা কুকুর গর্‌-র শব্দ করে, একটা আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরার ঢাকনা-খোলা মস্ত লেন্স ঝিকিয়ে ওঠে। রিখিয়া বলেছিল—আবার আসবেন।

সোমেন কথা দিয়েছিল—আসব। মনে মনে ভেবেছিল, একদিন সুসময়ে তার সঙ্গে রিখিয়ার ভালবাসা হবে। কথা রাখেনি সোমেন। রিখিয়া তাকে ভুলে গেছে এতদিনে। কত চালাক-চতুর ছেলেরা চারদিকে রয়েছে, একজন বিষণ্ণ যুবককে ভুলে যেতে বেশিক্ষণ লাগে কি? মাঝে মাঝে সোমেনও ভাবে, ভুলে যাবে। কিন্তু ভোলে না। কত মেয়ের সঙ্গেই তো মিশেছে সোমেন, তবে কেন রিখিয়ার প্রতি এই অভিভূতি! ইচ্ছে করলেই অভিভূতি বা অবসেশনটা কাটিয়ে উঠতে পারে সে। কিছু শক্ত নয়। কিন্তু কাটিয়ে দিতে মায়া লাগে। মাঝে মাঝে মনে পড়ুক, ক্ষতি কী!

ভেজানো দরজা খুলে অজিত এসে সোফাটায় বসে। সিগারেট আর লাইটার তুলে নেয়। তার মুখ চিন্তান্বিত, ঠোঁটে রক্তহীন ফ্যাকাশে ভাব। সোমেন চেয়ে থাকে।

চোখে চোখ পড়তেই অজিত বলে—মেয়েরা কখনও কথা শোনে না। বুঝলে শালাবাবু?

—কী হয়েছে?

—এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। একটা পেইন হচ্ছে। বলে অজিত এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে চুলের ভিতরে আঙুল চালাতে চালাতে ধৈর্যহীন অস্থিরতার সঙ্গে বসে থাকে।

—ডাক্তার ডাকুন না! সোমেন বলে।

—কী লাভ? ডাক্তারের কোনও কথা কি শোনে! শুনলে এরকমটা হত না। লিভ ইট, এস অন্য বিষয়ে কথা বলি।

অজিতের মুখে চোখে একটা আশা ত্যাগের ভাব। তার সঙ্গে চাপা রাগ।

সোমেন উঠে বলল—দাঁড়ান, দেখে আসি।

সোমেন শোওয়ার ঘরে ঢুকতেই একটা হাহাকারে ভরা শ্বাস ফেলে বিছানায় পাশ ফিরল শীলা।

—বড়দি!

শীলা তার মস্ত চোখ দুখানা খুলে চেয়ে বলে—যাবি না সোমেন। রাতে খেয়ে যাবি।

—তোর শরীর কেমন লাগছে?

শীলার ঠোঁট দুটো কেঁপে যায়। সামলে বলে—এখন ভাল। বোস।

সোমেন বিছানায় বসে। শীলার শ্বাসে একটা মৃদু অ্যালকোহলের গন্ধ ছড়ায়। বোধ হয় একটু ব্রান্ডি খাইয়েছে অজিত।

—জামাইবাবু খুব আপসেট। সোমেন বলে।

শীলা উত্তর দিল না। ক্ষণকাল চোখ বুজে থেকে বলে—সারাদিন ঘরবন্দি থাকা যে কী অসহ্য!

—কোথায় গিয়েছিলি?

—স্কুলে। কী যে হল তারপর। বলেই বোধ হয় ভাইকে লজ্জা পায় শীলা। বলে—ওসব কিছু না। কিছু হয়নি। তুই নাকি তোর জামাইবাবুকে বলেছিস যে আমাদের বাসায় কদিন থাকবি!

সোমেন মাথা নাড়ে।

শীলার মুখখানা অন্তর্নিহিত যন্ত্রণায় সামান্য বিকৃত হয়ে গেল। চোখ বুজে একটু গভীর করে শ্বাস নেয় সে। তারপর বলে—বাসায় ঝগড়া করেছিস!

—না।

—বউদির সঙ্গে, না?

—না।

—তবে?

—ঝগড়া হয়নি। বাসায় আমার ভাল লাগছে না।

শীলা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে—লাগার কথা নয়।

শীলা আবার চোখ বুজে যন্ত্রণাটা সহ্য করে, বলে—শোন, তোর ইচ্ছে করলে এসে থাক, যতদিন খুশি। সারাটা দিন যা একা লাগে আমার! আর কতদিন যে ঘর থেকে বেরনো হবে না! থাকবি সোমেন? থাক না! মাকে কতবার বলেছি আমার কাছে এসে কদিন থাকার জন্য। কিছুতেই রাজি হল না। ও সংসারে কী যে মধু! উঠতে বসতে বউদি খোঁটা দেবে, কথা শোনাবে, তবু পড়ে থাকবে ওখানে।

—মারও দোষ আছে।

শীলা ধমক দিয়ে বলে —আহা! দোষ আবার কী! মুখে একটু-আধটু হয়তো বলে, কিন্তু মার মন সাদা। অমন শাশুড়ির সঙ্গে যে বনে খেতে পারে না…বলতে বলতে শীলা চোখ বোজে। যন্ত্রণা সহ্য করে।

মেয়েরা মায়ের দোষ কমই দেখে ভাজের ব্যাপারে। সোমেন তা জানে। সোমেন উঠতে উঠতে বলে—শোন বড়দি, আজ আমার নেমন্তন্নটা ক্যানসেল কর। তোর শরীর ভাল না। শুয়ে থাক চুপচাপ।

শীলা করুণ মুখ করে বলে—থাক না আর একটু।

সোমেন ঘড়ি দেখে বলে—টিউশনিটায় যেতে হবে। পরীক্ষার সময়।

শীলা চোখ বুজে বলে—যাকে পড়াস তার দিদি তোর সঙ্গে পড়ত না।

—হ্যাঁ।

—বেশি মিশবি-টিশবি না, বুঝলি!

সোমেন হাসে। বলে—মিশি না।

—খুব নাকি মেয়েদের সঙ্গে ঘুরিস আর আড্ডা দিস!

—কে বলল?

—পাশের বাড়ির মাধবী তোকে বঙ্গ-সংস্কৃতিতে দেখেছে।

—দেখেছে তাতে কী? ঘুরলে দোষ কী?

শীলা বড় চোখে চেয়ে বলে—তুই তো হাঁদা ছেলে! কোন খেঁদি পেঁচির পাল্লায় পড়ে যাবি।

—দূর! ওরা সব বড় ঘরের মেয়ে, পাত্তাই দেয় না বেকারকে।

—বেকার কি চিরকাল থাকবি নাকি! তোর মতো স্মার্ট আর চটপটে ছেলে কজন? দুম করে একটা ভাল চাকরি পেয়ে যাবি।

সোমেন হেসে ফেলে। বলে—এই যে বললি হাঁদা!

—হাঁদাই তো! মেয়েদের ব্যাপারে হাঁদা। বলে শীলা ভাইয়ের দিকে স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে হাসে। বলে—তোর বিয়ে আমি নিজে পছন্দ করে দেব। আমাদের সংসারে একটা লক্ষ্মী বউ দরকার।

—দিস। বলে সোমেন বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

—শোন। ওই আলমারির পাল্লাটা খুলে দেয়, মাঝখানের তাকে একটা প্যান্টের কাপড় আছে না?

—কেন?

শীলা ধমক দিয়ে বলে—খোল না!

সোমেন আলগা পাল্লাটা টেনে খোলে। বাদামির ওপর হালকা ছাইরঙা চেক দেওয়া সুন্দর টেরিউলের প্যান্ট লেংথ। দামি জিনিস।

—এখানে নিয়ে আয়। শীলা বলে।

সোমেন কাপড়টা নিয়ে কাছে আসে। শীলা ওর মুখের দিকে চেয়ে বলে—পছন্দ হয়?

—হলেই বা।

—তোর জামাইবাবুকে তার বন্ধু পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে। ওটা তোর জন্য রেখে দিয়েছে। নিয়ে যা।

—যাঃ! ভারী লজ্জা পায় সোমেন?

—পাকামি করবি না। আজকেই করাতে দিবি, দরজির খরচ আমি দিয়ে দেব।

—জামাইবাবুকে পাঠিয়েছে, আমি কেন নেব?

—তোর জামাইবাবু কত পরবে? প্রতি মাসেই এটা-ওটা রাজ্যের জিনিস পাঠাচ্ছে, পান্ট শার্ট সিগারেট ঘড়ি ক্যামেরা কলম। আমার জন্য শাড়ির মাপে কাপড় পাঠিয়েছে এ পর্যন্ত গোটা দশেক। এত দিয়ে কী হবে! তুই নিয়ে যা। ভাল দরজিকে দিয়ে করাস। খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে যা। আর ওঘর থেকে তোর জামাইবাবুকে একটু পাঠিয়ে দিস।

আচ্ছা, বলে সোমেন বেরিয়ে আসে। হাতে ধরা মোলায়েম ঈষদুষ্ণ কাপড়টা একটা আরামদায়ক আনন্দের মতো তার হাত ছুঁয়ে আছে। কিছু অপ্রত্যাশিতভাবে পেলে মনটা কেমন ভাল হয়ে যায়।

বাইরের ঘরে আলো-আঁধারির মধ্যে সিগারেট জ্বলছে। অজিত মৃদু গলায় বলে—কাপড়টা পছন্দ হয়েছে তো শালাবাবু?

—খুব। এমন সুন্দর জিনিসটা আমাকে দিয়ে দিলেন?

তোমার জন্যই রেখেছিলাম। বলে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে কয়েকটা সিগারেটও নিয়ে যাও।

—না, না।

—নাও হে নাও, ফ্রায়েড রাইস আর মুরগির মাংস খাওয়াতে পারলাম না, একটু কমপেনসেট করে দিই। পুরো প্যাকেটটাই নিয়ে যাও, গোটা আষ্টেক আছে।

সোমেন প্যাকেটটা পকেটে পোরে। বলে—আজ দারুণ বাণিজ্য হল।

আবছায়ায় অজিত একটু হাসে। আলো-আঁধারিতে ওর মুখটা তরল হয়ে মিশে হারিয়ে যাচ্ছে। মুখখানা অস্পষ্ট একটা চিহ্নের মতো। সিগারেটের একবিন্দু লাল আগুনের পাশে ওর হাসিটা ভৌতিক দেখায়। মুখে স্বেদ ঝিকিয়ে ওঠে। ভ্রূর ছায়ায় চোখ দুটো অন্ধকার। লম্বা নাকটা তর্জনীর মতো উঁচু হয়ে আছে।

শীলা পাশের ঘর থেকে ক্ষীণ গলায় ডাকে—ওগো!

—যাচ্ছি। উত্তর দেয় অজিত, কিন্তু নড়ে না। সিগারেটটা ধীরে টান দেয়।

—জামাইবাবু, যাই।

অজিত মাথা নাড়ে। তারপর বিষণ্ণ গলায় বলে—দি ওয়ার ইজ লস্ট ফর এ নেইল।

—কী বলছেন?

—কত তুচ্ছ কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল শালাবাবু!

সোমেন উত্তর খুঁজে পায় না।

অজিত বলে—আমার বয়স চল্লিশ, তোমার দিদিরও ত্রিশ-বত্রিশ। কত ধৈর্য, কত অপেক্ষা, কত কষ্টের পর এই ভরাডুবি। শালাবাবু, আজ বিকেল থেকে গোটা জীবনের রংটাই বোধ হয় ফিকে হয়ে গেল।

সিগারেটটা অ্যাসট্রের মধ্যে ছ্যাঁক করে ওঠে। অজিত মুখ তুলে দাঁড়িয়ে-থাকা সোমেনের দিকে তাকায়। আলো-আঁধারিতে মুখখানা ব্রোঞ্জের স্ট্যাচুর মুখের মতো দেখায়। সন্তানের জন্য সমস্ত মুখখানায় কী বুভুক্ষা আর পিপাসা কাতরতা ফুটে আছে।

সোমেন বিষণ্ণ গলায় বলে—ডাক্তার ডাকবেন না?

—ডাকব। তবু দি ওয়ার ইজ লস্ট। মানুষের ক্ষমতা বড় সীমাবদ্ধ। এই অবস্থা থেকে কে আমাদের বাঁচাতে পারে! ডাক্তার যা করার তা করেছে। এখন আর কী করার আছে তার! আমি আজকাল নিয়তি মানি। ভাগ্যে নেই।

—এ সব বোগাস। আপনি উঠুন তো, দিদির কাছে যান। ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি।

—যাচ্ছি। বলে অজিত অন্ধকারে বসে রইল। উঠল না। কেবল হাত বাড়িয়ে হাতড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজল। পেল না। সোমেন নিঃশব্দে প্যাকেটটা পকটে থেকে বের করে টেবিলে রেখে দিয়ে বেরিয়ে আসে। অজিত লক্ষ করল না।

সন্তানের জন্য বুভুক্ষা কেমনতর তা পুরোপুরি বোঝে না সোমেন। কিন্তু একটু একটু টের পায়। গোবিন্দপুরে সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অমনি এক তীব্র অসহায় ক্ষুধাকে প্রত্যক্ষ করেছে ব্রজগোপালের মুখে। সেই থেকে বাবার জন্য ক্ষীণ সুতোর টান সে টের পায়। যে ঘুড়িটা কেটে গিয়েছিল বলে ধরে নিয়েছে সে, আসলে তা কাটেনি। রক্তে রক্তে বুঝি টরেটা বেজে যায় ঠিকই। টান তেমন প্রবল নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে মন বড় কেমন করে, মনে হয়—আহা রে, লোকটা! বড় একা হয়ে হা-ভাতের মতো চেয়ে আছে ছেলেদের দিকে। মায়া হয়।

সিগারেটের দোকান থেকে একটা সস্তা সিগারেট কিনে দড়ির আগুনে ধরিয়ে নেয় সোমেন। ট্রামরাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। ভাবে, অণিমাদের বাড়ি থেকে রিখিয়াদের বাড়ি বেশি দূর নয় তো। তবে কেন সে একবারও শৈলীমাসি আর রিখিয়ার কাছে যায়নি এত দিন! আজ একবার গেলে হয়। প্যান্টের কাপড়টা অপ্রত্যাশিত পেয়ে গিয়ে মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে গিয়েছিল, জামাইবাবুর শেষ কথাগুলোয় আবার মন খারাপ হয়ে গেছে। গাব্বদের বাড়িতে যাওয়ার পথে একবার ওবাড়ি হয়ে যাবে।

আনোয়ার শা রোড দিয়ে আজকাল বাস যায় ঢাকুরিয়া পর্যন্ত। সেই আশায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে সোমেন হাঁটতে থাকে। প্যান্টের কাপড়টা বাড়িতে রেখে, হাতমুখ ধুয়ে, একটু ফরসা জামাকাপড় পরে বেরোবে।

মা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে-হ্যাঁরে, শৈলী চাকরির কথা কী বলল?

সোমেন ঝেঁঝেঁ বলে—চাকরি কি ছেলের হাতের মোয়া!

আসলে সে মাকে বোঝাবে কী করে, যে বাড়িতে সে বর হয়ে যাবে সে-বাড়ির দেওয়া চাকরি সে তো নিতে পারে না! একবার উমেদার হয়ে গেলে আর কি রহস্য থাকে মানুষের?

রিখিয়া কেন যে আজ মাথাটা দখল করে আছে, কে জানে! মাঝে-মধ্যে আপন মনে মৃদু হাসল সোমেন। মনে মনে বলল, আসব রিখিয়া। আসছি।

হাঁটতেই হাঁটতেই বাড়ি পৌঁছে গেল সে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে ঘরে ঢুকেই একটু অবাক হল। সোফার ওপর ব্রজগোপাল বসে আছেন। পাশে একটা চেয়ারে দাদা, মোড়ায় বসে। বউদি এঁটো চায়ের কাপ নিয়ে যাচ্ছে। একটি অপরূপ অসহনীয় সুন্দর সংসারের দৃশ্য।

॥ একুশ ॥

ঘরে ঢুকতেই তারদিকে তাকালেন ব্রজগোপাল। একটু বুঝি নড়ে উঠলেন। মুখখানায় কী একটা টান-বাঁধা উদ্বেগ ছিল সেটা সহজ হয়ে গেল। তাকিয়ে উৎসাহ-ভরে বললেন—এসো।

এ ঘর বাবার নয়। তবু যেন নিজের ঘরে ছেলেকে ডাকছেন, এমনই শোনাল গলা। সোমেনের সঙ্গে মাঝখানে অনেকদিন দেখা হয়নি। সে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল। বলল—বড়জামাইবাবুর কাছে শুনলাম, আপনি এসেছেন, আবার চলেও গেছেন।

ব্রজগোপাল সরে বসে জায়গা করে দিলেন সোমেনের জন্য। সোমেন একটু সংকোচের সঙ্গে বাবার পাশে বসে। ব্রজগোপাল বলেন—যাওয়ার কথাই ছিল। বহেরুর যে ছেলেটা জেলে ছিল সে মেয়াদের আগেই হঠাৎ ছাড়া পেয়েছে। দামাল ছেলে। বহেরু তাকে ভয় পায়। আজ তাই বাড়িতে আমার থাকার কথা। আমাকে কিছু মানে-গোণে, তাই বহেরুর ইচ্ছে ছিল এ সময়টায় থাকি। চলেই যাচ্ছিলাম, রণেন ধরে নিয়ে এল। এসে পড়ে ভাবলাম, একটু বসে যাই। তোমার সঙ্গে দেখা-টেখা হয় না, তো এই সুযোগে যদি এসে পড়ো।

এ বাড়িতে বেশিক্ষণ বসে থাকার জন্য যেন ব্রজগোপাল বড় লজ্জা পেয়েছেন, এমনভাবে কৈফিয়ত দেন। ঘরে ঢুকবার মুহূর্তে যে সুখী সংসারের ছবিটা দেখতে পেয়েছিল সোমেন তা কত ভঙ্গুর! নিকটতম আত্মীয় মানুষেরা নক্ষত্রের মতো পরস্পর থেকে বহু দূরে বসবাস করছে।

সোমেন হাসিমুখে বলে—আপনার শরীর কেমন আছে?

—মন্দ কী! মাটির সঙ্গে যোগ রেখে চলি, ভালই থাকি। তোমার চাকরিটা হল না।

না।

ব্রজগোপাল যেন খুশি হন শুনে। বলেন—পরের গোলামি যে করতেই হবে তারও কিছু মানে নেই। চাকরির উদ্দেশ্য তো ভাত-কাপড়, নাকি! তা সেটার বন্দোবস্ত করতে পারলে কোন আহাম্মক চাকরিবাকরিতে যায়। এই মোদ্দা কথাটা তোমরা বোঝো না কেন?

সোমেন অবাক হয়ে বলে—কীভাবে ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা হবে?

ব্রজগোপাল একবার ননীবালার দিকে চেয়ে নিলেন। ননীবালা একটু গম্ভীর, টুবাইটা কোলে আধশোয়া হয়ে কী একটা বায়না করছে। বিরক্ত হয়ে বললেন—বউমা, নিয়ে যাও তো একটু! কথা শুনতে দিচ্ছে না।

ব্রজগোপাল গলাখাঁকারি দেন। বলেন—দেশের অবস্থা তো দেখছই। চাকরির ভরসায় থাকাটা আর ঠিক নয়। এমন দিন আসতে পারে, যখন টাকার ক্রয়ক্ষমতা কিছু থাকবে না। তাই বলি, মাটির কাছে থাক। ফসল ফলানোর আনন্দও পাবে, ঘরে ভাতের জোর থাকবে। মরবে না।

সোমেন একটু হাসে। সেই পুরনো কথা। এর কোনও উত্তর হয় না। মৃদু স্বরে বলে—চাকরির সিকিউরিটি বেশি, ঝামেলা কম। চাষবাস বড় অনিশ্চিত।

ব্রজগোপাল রণেনের দিকে চেয়ে হেসে তাকে সাক্ষী মেনে বললেন—কথা শোনো। সবাই আজকাল বেশি সিকিউরিটি আর কম ঝামেলা খোঁজে। পাগল! চাকরির ঝামেলা কি কম! চাকরগিরি মানে তো মনিবকে খুশি করা। না কি?

রণেন আর সোমেনের চোখাচোখি হয়।

ব্রজগোপাল বলেন—চাকরিরও একটা মর্যাল আছে। সেটা মেনে যদি চাকরি করতে যাও, তা হলে ঝামেলা কমে না। অন্নদাতা মনিবের দায় যদি ঘাড়ে করে না নিলে, যদি সভাবে তাকে খুশি না করলে তো তুমি খারাপ চাকর। তোমার বাড়িতে যে ঠিকে-ঝি কাজ করে যায় সে যদি ফাঁকিবাজ বা আলসে হয়, যদি চোর হয়, যদি মুখে মুখে কথার জবাব করে তো তুমি কি তাকে ভাল বলো? তেমনি যদি চাকরগিরিই করো তো ষোলো আনা ভাল চাকর হতে হবে। ফাঁকিজুকি, চুরি-চামারি এ সব চলে না।

এই বলে ব্রজগোপাল রণেনের দিকে তাকান। রণেন যদিও তেমন বুদ্ধিমান নয়, তবু এই কথার ভিতরে ইঙ্গিতের ইশারাটি সে বোধ হয় বুঝতে পারে। চোখের পাতা ফেলে নীচের দিকে তাকায়।

বউমার হাতে টুবাইকে তুলে দিয়ে ননীবালা একটা শ্বাস ফেললেন। বললেন—ঝি-চাকরের সঙ্গে কি ভদ্রলোকদের তুলনা হয়? ঘোটলোকদের ধাত আলাদা। ওরা লেখাপড়া শিখেছে।

—লেখাপড়ার কথা না বলাই ভাল। এত শিখেও বিচি দেখে ফল চিনতে পারে না।

ননীবালার হঠাৎ সন্তানের প্রতি আদিম জৈব অধিকারবোধ বোধ হয় প্রবল হল। ঝংকার দিয়ে বললেন—ওদের চিনতে হবে না।

ব্রজগোপাল একটু উদাস গলায় বলেন—সব চাকরেরই একরকম ধাত। আমি কিছু তফাত দেখি না। যারা যারা চাকর তারা দেশময় কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, চুরি করছে, ফাঁকতালে মাইনে বাড়ানোর ধান্দা করছে, কাজ বন্ধ করে বসে থাকছে। মনিবরা ধরা পড়েছে চোর-দায়ে। এটা কেমন কথা? জমিদারের সেরেস্তায় আমার বাপ চাকরি করতেন, মনিবকে খুশি রাখতে তাঁর কালঘাম ছুটে যেত। আমি করতাম সরকারি চাকরি, তাও বুড়ো বয়সে। সেখানে দেখতাম মনিব বলে যে কেউ আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। তবু প্রাণপাত করেছি। কোথাও না কোথাও একজন মনিব তো আছে। কোথাও হয়তো ব্যক্তিবিশেষ, কোথাও প্রতিষ্ঠান, কোথাও বা দেশের মানুষ। খোরপোষের টাকা তো কারও না কারও তহবিল থেকেই আসছেই। সেটা খেটে শোধ না দিয়ে ভাত খাই কী করে? লজ্জা নেই?

ননীবালা অসন্তোষের গলায় বলেন—ওসব ভাবতে গেলে গন্ধমাদন। সবাই যেমনভাবে চাকরি করে ওরাও তাই করবে।

ব্রজগোপালের আজকাল রাগ-টাগ কমে গেছে। হাসলেন। বললেন—জানি। ময়না এমনিতে কত কথা বলে, কিন্তু বেড়ালে সে ট্যাঁ-ট্যাঁ। সংসার রগড়ালে কত বাবাজি ভেক ছেড়ে ‘জন’ খাটতে যায়। তোমার ছেলেরাও তাই হবে। তবু বলি, আমার ওই এক দোষ।

বলে একটু শ্বাস ছেড়ে সোমেনের দিকে তাকান ব্রজগোপাল। বলেন—আমার সঙ্গে কোনও কিছুর বনে না। বুঝলে? আমি যা বুঝি তাই বুঝি। বুড়ো হয়েছি বাবা, বেশি কথা বলে ফেলি।

বাবার গলায় চোরা-অভিমানটা খুব গোপনে, কিন্তু তীক্ষ্ণভাবে আঘাত করে সোমেনকে। চোখের দৃষ্টিতে একটা অসহায় ভাব। দুনিয়াজোড়া সবাই তাঁর প্রতিপক্ষ বুঝি। বনল না। দান ওলটাবে না, লড়াই ছেড়ে সরে যাওয়ার জন্যই বুঝি প্রস্তুত তিনি। বাণপ্রস্থও শুরু হয়েছে।

সোমেন তাড়াতাড়ি বলে—না বাবা। আপনার কথাগুলো তো ভালই।

ব্রজগোপাল ক্ষণেক নীরব রইলেন। আস্তে করে বললেন—হবে। আমি মনিব কথাটা বড় মানি। চাষবাস করতে গিয়ে দেখেছি অমন খেয়ালি মনিব আর হয় না। মাটির পিছনে যত খাটবে, যত তাকে পুষ্টি দেবে, সেবা দেবে তত ফসল ঘরে অসবে। সেখানে দাবি আদায় সেই, চুরি-জোচ্চুরি চলে না, ধর্মঘট না। সেখানে সার্ভিস মানে চাকরি নয়, সেবা। মানুষের এই বুঝটা সহজে হয় না। যে দেশের যত উন্নতি হয়েছে সে দেশের লোক তত মনিবকে মানে। সে চাকরিতেই হোক, আর স্বাধীন বৃত্তিতেই হোক। বেশি সিকিউরিটি আর কম ঝামেলা বলে কিছু নেই। দেশ কথাটাই এসেছে আদেশ থেকে। যে বৃত্তিতে থাকো তার আদেশ মানতেই হয়। যত ঝামেলাই আসুক। ডিউটিফুল ইজ বিউটিফুল।

ননীবালা চুপ করে ছিলেন এতক্ষণ। এখন বললেন—ওসব কথা ওদের বলছ কেন? তোমার ছেলেরা কি খারাপ?

ব্রজগোপাল সন্ত্রস্ত হয়ে ছেলেদের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলেন। তারপর খুব কুন্ঠার সঙ্গে প্রসঙ্গ পালটে বললেন—তা বলিনি। চাকরি পাওয়াও সোজা নয়। আর চাকরি পেলেই বা কী! বাঁধা মাইনে, গণ্ডীবদ্ধ জীবন, মানুষ ছোট হতে থাকে।

ননীবালা বাতাস শুকে কী একটা বিপদের গন্ধ পান। হঠাৎ ছোবল তুলে বলেন—তো তুমি ওকে কী করতে বলো?

ব্রজগোপাল যেন আক্রমণটা আশঙ্কা করছিলেন। একটু মিইয়ে যায় তাঁর গলা। বলেন—পেলে তো চাকরি করবেই। আমি তো ঠেকাতে পারব না। যতদিন না পাচ্ছে ততদিন আমার কাছে গিয়ে থাকতে পারে। যা আছে সব বুঝেসুঝে আসুক।

ননীবালা কুটিল সন্দেহে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে। গলায় সামান্য ধার এসে যায়। বলেন—ও সেখানে যাবে কেন চাষাভুষোর সঙ্গে করতে? বহেরুরা লোকও ভাল না। চাষার ধাতও ওর নয় যে, জলে কাদায় জেবড়ে চাষ করতে শিখবে। ও সব বলে লাভ নেই।

ননীবালার কথার ধরনেই একটা রুখেওঠার ভাব। যেন বা তাঁর সন্তানকে কেড়ে নিতে এসেছেন ব্রজগোপাল। তিনি পাখা ঝাপটে আড়াল দিচ্ছেন পক্ষিণীর মতো।

ব্রজগোপাল রণেনের দিকে চেয়ে বলেন—তুমিও কি তাই বলো?

রণেন মুখটা তুলে বলে—আমার কথায় কী হবে? সোমেনের ইচ্ছে হলে যাবে। আমার আপত্তি নেই।

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। কিন্তু সোমেনের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন না। ননীবালার দিকে চেয়ে বললেন—আমি বললেই কি আর ও যাবে? তোমার ভয় নেই। সংসারটা যেভাবে ভাগ হয়ে গেছে সেভাবটাই থেকে যাবে। একদিকে আমি একা, অন্যদিকে তোমরা।

ননীবালা কথাটার উত্তর দিলেন না।

সোমেনের একটা কিছু করা দরকার। হাতে খবরের কাগজে মোড়া প্যান্টের কাপড়টা তখনও ধরা আছে। ঘরের ভারী আবহাওয়াটা হালকা করার জন্যই সে মোড়কটা খুলে মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—প্যান্টের কাপড়টা বড়দি দিল। লক্ষ্মণদা পাঠিয়েছে কানাডা থেকে।

—ওমা! বলে হাত বাড়িয়ে ননীবালা কাপড়টা নিলেন—বা! কী সুন্দর রং-টা রে! তোকে বড় ভাল মানাবে। রণেন, দ্যাখ!

রণেন আগ্রহে এগিয়ে ঝুঁকে দেখে। টুবাইকে ঘরে শুইয়ে রেখে বউদি ঘরে পা দিয়েই এগিয়ে এসে বলে—বাঃ, ফাইন! ইংরেজিটা বলেই শ্বশুরের কথা মনে পড়ায় একটু লজ্জা পায়।

এই অন্যমনস্কতার ফাঁকে ব্রজগোপাল ধীরে ধীরে উঠলেন। একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ সোফার কোণ থেকে তুলে নিয়ে বললেন—চলি।

প্যান্টের কাপড়টা বউমার হাতে দিয়ে ননীবালা কষ্টে উঠে বললেন—যাবে?

—যাই। রাত হয়ে যাচ্ছে।

ননীবালা সোমেনের দিকে চেয়ে বললেন—তুইও বেরোবি?

—টিউশনিতে যাব।

—তা হলে সঙ্গে যা। বাসে তুলে দিয়ে যাবি। দুর্গা দুর্গা।

রাস্তায় ব্রজগোপাল দু-কদম আগে হাঁটছেন। অন্যমনস্ক, ভারাক্রান্ত। পিছনে সোমেন। বাবার সঙ্গে বহুকাল হাঁটেনি সোমেন। এই স্টেশন রোডেই ছেলেবেলায় সে সকালে খালিপেটে বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রাতঃভ্রমণে যেত। ফেরার সময় খিদে পেত না। ব্রজগোপাল তাকে ফেরার পথে মুড়ি আর বাতাসা কিনে দিতেন। আবছা মনে পড়ে। বাবার সঙ্গ সে খুব বেশি পায়নি।

লন্ড্রির সামনে কয়েকজন ছেলেছোকরা জটলা করছিল। তাদের পেরিয়ে যাওয়ার সময়ে একজন আর একজনকে একটা খিস্তি করল। একটু চমকে উঠল সোমেন। রাস্তাঘাটে আজকাল অনর্গল খিস্তি কানে আসে। বাপ-দাদার সঙ্গে বেরোতে তাই লজ্জা করে। একা থাকলে এ সব কানে লাগে না।

সে বাবাকে লক্ষ করল। শুনতে পাননি তো! না। ব্রজগোপাল আজ একটু অন্যমনস্ক। সোমেন বলে-বাবা, ব্যাগটা আমার হাতে দিন।

—উ! বলে ব্রজগোপাল মুখটা ঘুরিয়ে হাসলেন। বললেন, না, এ ভারী কিছু নয়।

—দিন না!

একটু লাজুকভাবে সংকুচিত ব্রজগোপাল বললেন—ক্যাম্বিসের ব্যাগ, এ তোমার নিতে লজ্জা করবে। মানায়ও না।

সোমেন একটু হেসে ব্যাগটা প্রায় কেড়েই নেয়। ব্রজগোপাল খালি হাতটা ব্যাপারের মধ্যে টেনে নেন। সোমেন টের পায়, বুড়োর মনটা ভাল নেই। ভরভরতি সংসারটা দুটো চোখে দেখে ফিরে যেতে হচ্ছে। সোমেনের মনটা কেমন করে। বলতে কী এই প্রথম বয়সকালে সে বাবাকে একটু একটু চিনছে।

ব্রজগোপাল দু-কদম পিছিয়ে তার পাশ ধরে বললেন—আমি আজ তোমার জন্যই বসেছিলাম। ভাবলাম দেখাটা করে যাই। নইলে সন্ধের গাড়িটা ধরতে পারতাম।

সোমেন একটু বিস্মিত হয়ে বলে—কোনও দরকার ছিল বাবা?

—না, না। তেমন কিছু নয়। এমনিই। ভাবলাম বসেটসেই তো আছে, অথচ ওদিকে এক-আধবার যাও-টাও না।

—হাতে একটা টিউশনি আছে।

—সে তো সন্ধেবেলা একটুখানি। বাদবাকি দিনটা তো ফাঁকা। ছুটিছাটার দিনও আছে।

সোমেন উত্তর দেয় না।

ব্রজগোপাল বলেন—টিউশনিটা করছ করো। কিন্তু বাড়ি বাড়ি ঘুরে পড়ানো অনেকটা ফিরিঅলার কাজ। ওটা অভ্যাসগত করে ফেললা না।

—পেয়েছি তাই করছি। বসেই তো থাকি।

—খারাপ বলছি না, ব্রজগোপাল নিজেকে সামলে নেন। বলেন—কিন্তু তোমরা মাঝেমধ্যে ওদিকে গেলে জমিজমার একটা বুঝ-সমঝ হয়। ব্রজগোপাল আবার আস্তে করে বলেন—অবশ্য আমি তোমাদের টেনে নিতে চাইছি না। তোমার মায়ের সেটা বড় ভয়ের ব্যাপার। আমি বলছিলাম, বসেই যখন আছ তখন—

কথাটা শেষ করতে পারে না ব্রজগোপাল। গলায় কী একটু আটকায় বোধ হয়।

সোমেন বলে—একা আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে ওখানে।

—না, না। একা বেশ আছি। বহুকালের অভ্যাস। কাউকেই দরকার হয় না তেমন। কিন্তু তোমার মায়ের সন্দেহ, আমি ছেলেদের কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। পাগল! তাই কি হয়!

হাঁটতে হাঁটতে তারা ব্রিজের তলার কাছে চলে আসে। একটা ট্রেন সাঁ করে বেরিয়ে গেল। ব্রিজের ওপরে মহাভার নিয়ে চলে যাচ্ছে ডবলডেকার, বিমগুলো কাঁপে। ব্রজগোপাল একবার ওপরের ছুটন্ত বাড়িঘরের মতো বাসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। থেমে ব্যাপারটা ভাল করে জড়িয়ে নিলেন গায়ে। বললেন—তোমার সঙ্গে দেখা করাটাই দরকার ছিল। ভাবছিলাম, হয়তো আজও দেখা হবে না। হয়ে গেল।

সোমেন বলল—কিছু দরকার থাকলে বলুন।

—দরকার! বলে ব্রজগোপাল সামান্য হাসেন—তেমন কিছু নয়। ছেলেকে যে বাপের কেন দরকার হয় তা বাবা না হলে কী বোঝা যায়!

ব্রজগোপাল একটু শ্বাস ফেললেন। সোমেন সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। ফাঁকা থেকে ক্রমে ভিড় আর আলোর মধ্যে এসে পড়ে। বাসস্টপ আর দূরে নয়। ব্রজগোপাল খুব আস্তে হাঁটেন। সামান্য রাস্তাটুকু যেন দীর্ঘ করে নেওয়ার জন্যই। বলেন—রণো কদিন আগে হঠাৎ গিয়ে হাজির। স্টেশনে দেখা হল, ও তখন ফিরছে। নানা কথার মধ্যে হঠাৎ বলে ফেলল- বাবা, সংসারে বড় অশান্তি। ভেঙে কিছু বলল না। সেই থেকে মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। চাপা ছেলে, সহজে কিছু বলে না। কীসের অশান্তি তা তো আর আমার বুঝবার কথা নয়। আমি বাইরের মানুষ। কিন্তু শুনলে পরে মন ভাল লাগে না।

সোমেন সতর্ক হয়ে গিয়ে বলে—ওসব কিছু নয়। একটু বোধ হয় মন কষাকষি হয়েছিল, মিটে গেছে।

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বুঝেছেন, বললেন—তাই হবে। তোমার মা কী কথায় যেন আজই বলছিলেন, তুমি নাকি আলাদা বাসা খুঁজছ!

মার মুখ বড় পলকা। কিছু চেপে-ঢেকে রাখতে পারে না। মনে মনে বড় রাগ হল সোমেনের। মুখে বলল—ও বাড়িতে জায়গা কম, লেখাপড়ার একটা ঘর দরকার। তাই ভাবছিলাম।

ব্রজগোপাল বুঝদারের মতো বললেন—ও।

কিন্তু কথাটা যে বিশ্বাস করলেন না তাঁর নিস্পৃহতা থেকে বোঝা গেল। একটা শ্বাস ফেললেন। এবং শ্বাসের সঙ্গে বললেন—মানুষের সওয়াবওয়া বড় কমে গেছে।

—বাবা, আপনি ষোলো নম্বর বাসে উঠে পড়ুন।

—তাই ভাল।

স্ট্যান্ডে বাস দাঁড়িয়ে আছে। বসার জায়গা নেই। ব্রজগোপাল বাসে উঠে রড ধরে দাঁড়ালেন। একা ব্রজগোপালই দাঁড়িয়ে আছেন, আর সবাই বসে। বাসের দরজা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে সোমেন। একা দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে বড় অদ্ভুত দেখাচ্ছে। বলল—বাবা, আপনি নেমে আসুন। পরের বাসে যাবেন।

—থাকগে, দেরি হয়ে যাবে।

—দাঁড়িয়ে যেতে আপনার কষ্ট হবে।

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বললেন—না, কষ্ট কী! পারব।

সোমেন ছাড়ল না, উঠে গিয়ে বাবার হাতের ব্যাগটা নিয়ে বলে—আসুন।

ব্রজগোপাল এই আদরটুকু বোধ হয় উপভোগ করে একটু হাসলেন। এই ছেলেটা তাঁর বড় মায়াবী হয়েছে। নেমে এলেন। পরের ষোলো নম্বর বাসটা ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে। স্টার্টারকে জিজ্ঞেস করে নিয়ে সোমেন বাবাকে ফাঁকা অন্ধকার বাসটায় তুলে দেয়। অবশ্য একেবারে ফাঁকা নয়। অন্ধকারে দুটো একটা বিড়ি বা সিগারেটের আগুন শিসিয়ে ওঠে। ব্রজগোপাল বসলেন। বললেন—আজকাল সব জায়গায় বড় ভিড়।

—হ্যাঁ।

—তবু মানুষ কত কম।

কথাটার মধ্যে একটা নিহিত অর্থ আছে। সোমেন বুঝল। কিছু বলল না। ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করলেন—তুমি কোথায় যাবে?

সোমেনের একটু বিপদ ঘটে। সে যাবে বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে। গাব্বুকে পড়াতে। সেখানে এই বাসেও যাওয়া যায়। কিন্তু বাবার সঙ্গে আর বেশিক্ষণ থাকতে তার এরকম অনভ্যাসজনিত অনিচ্ছা হতে থাকে। একটা সিগারেটও খাওয়া দরকার। সে বলল—এই কাছেই যাব।

—তা হলে রওনা হয়ে পড়ো। আমার জন্য দেরি করার দরকার নেই।

—যাচ্ছি। বলে একটু ইতস্তত করে বলে—আমাকে কোনও দরকার হলে—

ব্রজগোপাল অন্ধকারে একটু অবাক গলায় বললেন—দরকার! সে তেমন কিছু নয়।

সোমেন প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে লাজুক গলায় বললেন—তুমি ভেবো না। দরকারটা বাপ ছাড়া কেউ বোঝে না।

—কী দরকার বাবা?

—তোমার গায়ের গন্ধটুকু আমার দরকার ছিল। আর কিছু নয়।

॥ বাইশ ॥

ভাগচাষির কোর্ট থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে একজায়গায় দাঁড়িয়ে গেল বহেরু। রাস্তার ধার ঘেঁষে মাঠমতো জায়গায় খেলা জমেছে। রাজ্যের লোক ভিড় করে ঘিরে আছে, লাউডস্পিকার বাজছে। দু-ধারে দুটো মস্ত গাছে বিশ পঁচিশ ফুট উঁচুতে টানা দড়ি বাঁধা, দড়ির মাঝ বরাবর একটা মেটে হাঁড়ি ঝুলছে। হাঁড়ির গায়ে সুতোয় গাঁথা দশ টাকার নোট হাওয়ায় উড়ে উড়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে মানুষজনকে। কম নয়, এই দুর্দিনের বাজারে একশোটা টাকা। লাউডস্পিকারে হিন্দি গান থামিয়ে ঘোষণা হচ্ছে—বন্ধুগণ, এ হচ্ছে বুড়ির হাঁড়ি। হাঁড়ির গায়ে একশো টাকা গাঁথা আছে, যে ছুঁতে পারে তার। কিছু শক্ত নয়, খুব সোজা খেলা। দেখুন, এবার আসছেন সিমলেগড়ের যুবক সংঘ।

আবার হিন্দি গান শুরু হয়।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—দাঁড়ালি যে!

বহেরু একটু হেসে লাজুকভাবে বলে—বলে র’ন একটু দেখে যাই।

—তোর আর বয়স হল না।

বহেরু গায়ের চাদরখানা খুলে ঝেড়ে ভাঁজ করে। কাঁধে ফেলে বলে—দুনিয়ার হাজারো মজা। দেখে-টেখে যাই সব।

—তো তুই দাঁড়া। আমি এগুতে থাকি, তুই চোটে হেঁটে আসিস।

বহেরু তখন মজা দেখছে। একবার মাথা নাড়ল কেবল। দশজনের দল, চারজন গোল হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল, তাদের কাঁধে ভর দিয়ে উঠল তিনজন। নীচের চারজন টলোমলো। তাদের মাঝখানের ফোকর দিয়ে সাবধানে আর দুজন উঠছে। কাঁধে পা রাখতেই নীচের চারজন ঠেলাঠেলি শুরু করে দেয়।

লাউডস্পিকারে গান থামিয়ে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে—আপনারা পারবেন। চেষ্টা করুন, শক্ত হয়ে দাঁড়ান। বুড়ির হাঁড়ি আপনাদের নাগালের মধ্যেই এসে গেছে প্রায়। শক্ত হয়ে দাঁড়ান, ভরসা হারাবেন না…

লাউডস্পিকারে গান থামিয়ে এদের উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে-আপনারা পারবেন। চেষ্টা করুন, শক্ত হয়ে দাঁড়ান। বুড়ির হাঁড়ি আপনাদের নাগালের মধ্যেই এসে গেছে প্রায়। শক্ত হয়ে দাঁড়ান, ভরসা হারাবেন না…

কিন্তু মানুষের স্তম্ভটা ভেঙেই গেল। হুড়মুড় করে ওপরের ছোকরারা পড়ে গেল এ ওর ঘাড়ে। চারধারে একটা হাসির চিৎকার উঠল।

—যাঃ, পারল না! ব্রজগোপাল বললেন।

বহেরু মুগ্ধ হয়ে খেলাটা দেখছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে ব্রজগোপালকে দেখে বলল—যাননি?

—মজাটা মন্দ নয়, তাই দাঁড়িয়ে গেলাম।

—ভারী মজা। র’ন, একটু দেখে যাই।

লাউডস্পিকারে ঘোষণা হয়—এবার বুড়ির হাঁড়ি কারা ছোঁবেন চলে আসুন। কোনও প্রবেশমূল্য নেই, দশজনের যেকোনও দল চলে আসুন। বুড়ির হাঁড়ি আপনাদের চোখের সামনে ঝুলছে, হাতের নাগালের মধ্যেই। পুরস্কার নগদ একশো টাকা…নগদ একশো টাকা।

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি হতে থাকে। রোগা-রোগা কালো-কালো চাষিবাসি গোছের কয়েকজন মাঠের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। উপোসী চেহারা, গায়ে জোর বল নেই।

লাউডস্পিকার বলতে থাকে—এবার আসছেন বেলদার চাষিভাইরা। মনে হয়, এ-বছর এঁরাই বুড়ির হাঁড়ি জিতে নেবেন। এঁরা প্রস্তুত হচ্ছেন, আপনারাও এঁদের উৎসাহ দিতে প্রস্তুত থাকুন।

আবার হিন্দি গান বাজে।

ব্রজগোপাল বলেন—এরা কি পারবে?

বহেরু একটু হাসে—তাই পারে! শরীলে আছে কী? ভাল করে দম নিতে পারে না।

ব্রজগোপাল শ্বাস ফেলে বলেন—টাকা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। লোক হাসাতে নেমে গেছে।

—সেইটেই তো মজা।

রোগা, আধবুড়ো, মরকুটে চেহারার লোকগুলো হাঁড়ির নীচে দাঁড়াতেই চারদিকে হুল্লোড় পড়ে গেল। লোকগুলোও অপ্রতিভভাবে হাসে চারদিকে চেয়ে। তারা যে মজার পাত্র তা বুঝে গেছে। তবু চারটে লোক কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়, তিনজন আঁকুপাঁকু করতে করতে কাঁধের ওপর দাঁড়ায়। ভারী বেসামাল অবস্থা, চারজনের পিঠে তিনজন দাঁড়াতেই নীচের চারজনের পিঠ বেঁকে যাচ্ছে। মাটির দিকে নেমে যাচ্ছে মাথা। তবু ঠেলাঠেলি করে তারা সামাল দেয়। এখনও বুড়ির হাঁড়ি অনেক উঁচুতে। মাঝখানে অনেকটা শূন্যতা। বাতাসে ফুরফুর করে ওড়ে সুতোয় বাঁধা দশখানা নোট। বুড়ির হাঁড়ি দোল খাচ্ছে। চারজনের পিঠে তিনজন দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ দম নেয়। তারপর আর দুজন উঠতে থাকে চারজনের মাজায় পা। রেখে, পিঠ বেয়ে। ভারী কষ্টকর কসরত। তবু ধীরে ধীরে দুধার দিয়ে দুজন শেষ পর্যন্ত ওপরের তিনজনের কাঁধের ওপর গিয়ে খাড়া হয়। প্রবল চিৎকার ওঠে চারদিকে। লাউডস্পিকার বলতে থাকে—পেরেছেন, আপনারা পেরেছেন! আর মোটে একজন উঠে দাঁড়াতে পারলেই বুড়ির হাঁড়ি জিতে যাবেন। সাহস করুন, শক্ত হয়ে দাঁড়ান।

রোগা, জীর্ণ মানুষের তৈরি স্তম্ভটা অবিশ্বাস্যভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। পিঠগুলো বেঁকে যাচ্ছে, শ্বাস পড়ছে হপর হপর। টলছে, তবু দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ির হাঁড়ি আর মাত্র এক-মানুষ উঁচুতে। সর্বশেষ লোকটা হালকা-পলকা, অল্পবয়সি। জিব দিয়ে ঠোটটা একবার চেটে আস্তে পা তুলল নীচের চারজনের একজনের মাজায় ভর রেখে উঠল। হাত বাড়াল দ্বিতীয় স্তরটায় ওঠার জন্য। প্রচণ্ড হাততালি দিয়ে উঠল লোকজন, চেঁচাল—বাহবা! সাবাস! লাউডস্পিকারে ঘোষক বলতে থাকে—পারবেন। নিশ্চয়ই পারবেন। উঠে পড়ুন।

এত উৎসাহে আর চিৎকারেই বোধ হয় দিশাহারা হয়ে স্তম্ভটা হঠাৎ ভেঙে পড়ল। বুড়ির হাঁড়ির নীচে কালো, জীর্ণ মানুষের শরীর দলা পাকিয়ে গেল।

ব্রজগোপাল শ্বাস ছেড়ে বললেন—দূর! আগেই ভেবেছিলাম। বহেরু, এবার চল।

বহেরুর যেতে অনিচ্ছা। বলল—দেখে যাই। কেউ না কেউ তো পারবেই।

—পারলে পারবে। তা বলে কতক্ষণ দাঁড়াবি?

বহেরু আস্তে করে বলে—আমার দল থাকলে একবার দেখতাম কর্তা। হাঁড়িটা বড্ড উঁচুতে বেঁধেছে, কিন্তু পারা যায়। গা গতর থাকলে কিছু শক্ত কাজ নয়।

ব্রজগোপাল বললেন—জেদ করলে সব পারা যায়, লোভ করলেই কিছু হয় না।

বহেরু বলে—এ তাম্‌শাটা আমাদের ওখানে একবার দিলে হয়।

পরের দলটাও তিন থাক তৈরি করেছিল। শেষ লোকটাই পারল না। লোকজন চেঁচাচ্ছে লাউডস্পিকার আশ্বাস দিয়ে বলছে—কেউ না কেউ পারবেনই। এগিয়ে আসুন। হতাশ হবেন না।

এ খেলাটার মধ্যে ব্রজগোপাল লোভ দেখতে পান। বহেরু দেখে লড়াই। বুড়ির হাঁড়ির গায়ে মালার মতো পরানো নোটগুলোয় বাতাস এসে লাগে। মাটি থেকে হাঁড়ি, মাঝখানে নিশূন্য ফাঁকা জায়গাটা। সেটুকু জায়গার মাঝখানে কত কী খেলা করছে। খেলা, লোভ, লড়াই।

গোটা ছয়েক দল পর পর চেষ্টা করল। পারল না। বহেরু উত্তেজিত হয়ে বলে—কেউ পারল না! অ্যাাঁ। একটা দলে ঢুকে পড়ব নাকি কর্তা? এ বুড়ো কাঁধে এখনও যা জোর আছে তা এদের কারও নেই।

—দূর! শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকা! চল্‌। পিরামিডের খেলা অভ্যাস করতে হয়। শুধু ভার বইতে পারলেই হল না, ভারসাম্য রাখা চাই। সে বড় শক্ত।

বহেরু চমৎকার দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে—কথার কথা বলছিলাম আর কী! সব হা-ঘরে কোত্থেকে এসে জুটেছে টাকার গন্ধে। এদের কম্ম নয়। তবে বড় ভাল খেলা, গোবিন্দপুরে একবার খেলাটা দেব। দুশো টাকা বেঁধে দেব, কে লড়বি লড়ে যা। সে মজা হবে!

বহেরু চমৎকার দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে—কথার কথা বলছিলাম আর কী! সব হা-ঘরে কোত্থেকে এসে জুটেছে টাকার গন্ধে। এদের কম্ম নয়। তবে বড় ভাল খেলা, গোবিন্দপুরে একবার খেলাটা দেব। দুশো টাকা বেঁধে দেব, কে লড়বি লড়ে যা। সে মজা হবে!

এই সময়ে ডাকাবুকো হোঁতকা চেহারার একটা দল এসে নীরবে হাঁড়ির নীচে দাঁড়াল। তাদের সর্দার যে ছোকরা তার শরীর বিশাল। যেমন মাথায় উঁচু, তেমনি চওড়া কাঁধ। সে মাথা তুলে হাঁড়িটা একবার দেখে নিল। লাউডস্পিকারে ঘোষণা হতে থাকে—একবার বুড়ির হাঁড়ির দিকে হাত বাড়াবেন গোবিন্দপুরের কোঁড়ারপাড়া মিলন সমিতি ব্যায়ামাগারের যুবকবৃন্দ। এবার আমরা বেশ বুঝতে পারছি যে মিলন সমিতি বুড়ির হাঁড়ি প্রতিযোগিতা থেকে খালি হাতে ফিরে যাবেন না।

বহেরু হাঁ হয়ে সর্দারকে দেখছিল। মুখ ফিরিয়ে বলল—কর্তা, ওই কোকার দল এসে গেছে।

—কই?

—ওই দেখুন।

বহেরুর মাঝের ছেলে, সদ্য জেল-ফেরত কোকা এখন কোমরে হাত দিয়ে চারধারে চেয়ে দেখছিল। তার শরীরটা অঢেল। ভগবান ঢেলে দিয়েছে অস্থি-মজ্জা-মাংস। চোখ দুখানা ভয়ংকর। ব্রজগোপাল বহেরুকে বললেন—ডাকিস না। কী করে দেখি।

বহেরুনীরবে মাথা নাড়ল। চারদিকে প্রচণ্ড হাততালি। চেহারা দেখেই মানুষ বুঝে গেছে, এরা পারনেওয়ালা লোক।

কোকা দাঁড়াল নীচের থাকে। সেখানে চারজন সবচেয়ে মজবুত চেহারার ছোকরা। তাদের কাঁধে অনায়াসে নৈপুণ্যে উঠে গেল তিনজন। পা কাঁপল না, টলল না কেউ। মুহূর্ত পরে আর দুজন উঠে গেল তিজনের কাঁধে। সর্বশেষ একজন বানরের মতো চটুল হাত-পায়ে উঠে গেল ওপরে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুড়ির হাঁড়িটা দুলিয়ে দিল হাত দিয়ে। হাততালিতে তখন ফেটে পড়ছে চারদিক, চেঁচানিতে কান পাতা দায়। ভিড় এতক্ষণ গোল হয়ে ঘিরেছিল জায়গাটা, এখন হাঁড়ি-ছোঁওয়া হয়ে গেলে মাঠময় ছেলেপুলে লোকজন হুটোপাটি লাগিয়েছে।

এত সহজে, অনায়াসে ওরা হাঁড়িটা ছুঁল যে বিশ্বাসই হতে চায় না। ওদের হাঁড়ি-ছোঁওয়া দেখে মনে হয় যে কেউ পারে।

বহেরু বলে—ধুস্‌! এ তো দেখছি ফঙ্গবনে খেলা। আনাড়িগুলোই নাজেহাল হচ্ছিল এতক্ষণ।

ব্রজগোপাল হেসে বলেন—দূর বোকা! সহজ মনে হয় বলে কি সহজ! দক্ষতা জিনিসটা এমনি, শক্ত কাজটাও এমনভাবে করে যেন গা লাগাচ্ছে না বলে মনে হয়।

বহেরু ভারী খুশি। বুড়ির হাঁড়িটা তার ছেলের দল ছুঁয়েছে। ভিড়ের দিকে খোঁটা-ওপড়ানো গোরুর মতো বেগে ধেয়ে যেতে যেতে বহেরু বলে—দাঁড়ান, একবার কোকাকে দেখে আসি।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে একটা ধমক দেন—তোর দেখা করার কী? ছেলেছোকরারা এ-সময়ে নানারকম ফুর্তিফাৰ্তা করবে এ-সময়ে সেখানে বাপ-দাদা হাজির হলে কি খুশি হয়? চলে আয়।

বহেরু থমকে যায়। কথাটা বড় ঠিক। এইসব পরামর্শ ঠিক সময়মতো দেন বলেই ব্ৰজকর্তাকে তার এত প্রয়োজন।

পিছিয়ে এসে বহেরু বলে—যাব না?

—কেন যাবি?

—তা হলে চলুন বরং। বলে হাঁটতে হাঁটতে একটা শ্বাস ফেলে সে। তারপর গলাটা নামিয়ে বলে—ছাওয়ালটাকে কেমন বোঝেন?

—কেমন আর! হাঁকডাকের মানুষ হবে, তোর মতোই।

বহেরু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ে। বলে—তাই কি হয়? আমি বরাবর মানী লোকের মান দিই। ও দেয় না। দিনেকালে ও সবকিছু দখলে নেবে। দেখবেন।

ব্রজগোপাল আস্তে করে বলেন—দেখার জন্য আমরা কেউ থাকব না। নেয় তো নেবে আমাদের কী রে? আমাদের ডংকা বেজে গেছে। সংসার নিয়ে অত ভাবিস না।

—ভাবা ঠিকও নয়। বুঝি। তবু মনটা মানে না। কোকাটা এই বয়সেই খুন-খারাপি করে ফেলল!

—খুন-খারাপির কি বয়স আছে না কি! আজকাল কতটুকু কতটুকু সব ছেলে মানুষ মেরে বেড়ায়।

বহেরুর মুখে একটু উদ্বেগ দেখা যায়। বলে—আমিও তো কাটলাম ক’টা। সে-সব কর্মের দোষেই কি ছেলেটাও অমন হল! ওই একটাই একটু বেগোছ রকমের, অন্য ক’টা তো দেখছেন, ভালই।

ব্রজগোপাল অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়েন। মনের মধ্যে হঠাৎ একটা নিঃসঙ্গতা ঘনিয়ে আসে, মেঘলা দিনের মতো। ছোট ছেলেটাকে মনে পড়ে। মায়ের শ্রীই পেয়েছে ছেলেটা। লম্বা রোগাটে বুদ্ধিমান মুখশ্রী। সংসারের গাদ এখনও মনের মধ্যে কোনও তলানি ফেলেনি। ছেলেদের কাছে কিছুই চাওয়ার নেই ব্রজগোপালের। তবু বুক জুড়ে একটা দুর্ভিক্ষের চাওয়া রয়েছে। ভুলেই গিয়েছিলেন, কেন যে দেখলেন মুখখানা!

ব্রজগোপাল অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বলেন—ভাবিস না। যত মায়া করবি তত দুঃখ।

বহেরু তত্ত্বকথা বোঝে না। তবু সায় দিল। বলল—জেলখানার মেয়াদটা বড় টপ করে ফুরিয়ে গেল। আরও কিছুদিন ঘানি টানলে রস মজত।

ব্রজগোপাল অবাক হয়ে বলেন—কেন রে! কোকা তোর কোন পাকা ধানে মই দিল! দিব্যি ঘুরছে-টুরছে, ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে, তোকে ও পায় কীসে!

বহেরু একটু লজ্জা পায়। অপ্রস্তুত চোখ দু’খানা ব্রজকর্তার চোখ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলে—পায় না অবশ্য। কিন্তু ওর বড় দাপ্‌ কখন কী করে ফেলে বুঝে পাই না। ভয় লাগে।

—ছেলেদের ভয় পেতে শুরু করেছিস, তার মানে তোর বয়েসে পেয়েছে।

চিন্তিতভাবে বহরু আস্তে করে বলে—ওর মতলব ভাল নয়। আপনার ছাওয়ালরা যদি জমিটমি বুঝে না নেয় তো আমরা চোখ বুজলে ও সব হাতিয়ে নেবে। ভাবি, সৎ ব্রাহ্মণের সম্পত্তি খেয়ে শেষমেশ নির্বংশ হয়ে যাবে না তো! আপনাকে ও খুব মানে, কিন্তু বড় লোভ ছেলেটার।

ব্রজগোপাল উদাস গলায় বলেন—হাতানোর দরকার কী! তেমন বুঝলে আমি ওর নামে সব লেখাপড়া করে দেব।

—তাই কি হয়।

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—আমার ছেলেরা আসবে না কখনও। ওদের কলকাতায় পেয়েছে।

বহেরু একটু আগ্রহভরে বলে—তার চেয়ে কেন বেচে দেন না কর্তা! আমি কিনে নেব।

—বেচব! বলিস কী? মা’টি হল মাটি। রামকৃষ্ণদেবের কথা। মা কি বেচবার জিনিস! একসময়ে আমার ঠাকুর বলেছিলেন—বড় দুর্দিন আসছে, সব সোনা মাটি করে ফেল। সেই তখন হাতের পাতের যা ছিল, আর সোনাদানা বেচে মাটি কিনতে লাগলাম। সে মাটি বেচব কী বলে? ছেলেরা যদি না বোঝে না বুঝুক।

বহেরু একটা শ্বাস ফেলল মাত্র। তার প্রকাণ্ড শরীরটার কোথায় একটা দুর্বলতা আর ভয়ের পচন শুরু হয়েছে।

॥ তেইশ ॥

এখানে দিন শুরু হয় সূর্য উঠবার অনেক আগে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, চারদিকে ফ্যাকাসে কুয়াশার ভূত। কালো পাহাড়ের মতো শীত জমে থাকে। শিশিরে মাটি ভিজে থাকে এমন, যেন বৃষ্টি হয়েছে। দিগম্বরের খোলের প্রথম বোলটি ফোটে, ব্রজগোপালের বউলঅলা খড়মের শব্দটি পাওয়া যায়, আর তখনই বহেরুর বড় জামাই কালীপদর গান শোনা যায়—জাইগতে হবে, উইঠতে হবে, লাইগতে হবে কাজে…।

ঘড়ির অ্যালার্ম আর বাজে না। তবু উঠতে কোনও অসুবিধে হয় না। ঘুম বড় একটা আসে না তো। এপাশ-ওপাশ করে রাত কাটে। হারিকেনের পলতে কমানো থাকে, ঘরে একটা পোড়া কেরোসিনের গন্ধ জমে। টিনের চালের ওপর টুপটাপ শিশির খসে পড়ার শব্দ হয়। আসেপাশে শেয়াল ডাকে, হাঁসের ঘর থেকে ডানা ঝাপটানোর শব্দ আসে, ঘুমের মধ্যে মুরগি ভুল করে ডেকে ওঠে হঠাৎ। নিশুতি রাতে দূরের শব্দ সব শোনা যায়। গন্ধ বিশ্বেসের বহুমূত্র রোগ। অন্ধ-প্রায় মানুষ বলে ঘরে মেটে-হাঁড়ি রাখা থাকে। ঘুম-চোখে ঠাহর না পেয়ে মাঝেমধ্যে হাঁড়ি উলটে ফেলে ঘর ভাসায়। সেই পেচ্ছাপ কাচতে গিয়ে বিন্দুর মা বেহান বেলাটার বাপ-মা তুলে বকাঝকা করে বলে গন্ধ হাঁড়ি উলটে ফেলেই আর্তনাদ করে বেড়ালের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে চেঁচায়—হঃই শালা মেকুর, হঃই…অ্যা-অ্যা-অ্যা….। এভাবে সে সাক্ষী রাখার চেষ্টা করে। গোটা চারেক সড়াল কুকুর সারা রাত চেঁচিয়ে পাহারা দেয়। নমঃশুদ্র বৃন্দাবন লাঠি ঠুকে চৌকি দিয়ে ফেরে। ব্রজগোপাল প্রায় সারা রাত এসব শব্দ শোনেন। শরীরের তাপে বিছানাটা তেতে ওঠে। পাশ ফিরলেই একটা শীতভাব টের পান। আরাম লাগে। এ বয়সে শীতটা বেশ লাগার কথা। কিন্তু লাগে না। বোধ হয় রক্তের চাপ বেড়েছে। তাঁতি লোকটা এ ঘরে ঘুমোয়। ব্যবস্থাটা বহেরুর। সে বলে—বুড়ো মানুষ একা থাকেন, কখন কী হয়ে পড়ে, একটা লোক ঘরে থাকা ভাল। ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—তোর বয়সটা কি কম নাকি! বহেরু হাঁ হাঁ করে বলে—ভদ্রলোকের জান আর ছোটলোকের জান কি এক! তা ছাড়া আমার জন আছে, আপনারে দেখে কেডা?

কথাটা আজকাল লাগে। একটু ভয়ও হয়। মৃত্যুভয় নয়, এ অন্য রকমের এক ভয়।

এখান থেকে কলকাতার দূরত্বটা হিসেব করে দেখেন, খবর পেলে মুখাগ্নি করতে সময়মতো ছেলেরা কেউ এসে পড়তে পারবে তো!

—তাঁতি লোকটার মশারি নেই। চটের ভিতরে খড় ভরে একটা গদি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটার ওপর সটান মাটিতে পড়ে থাকে। মাথা পর্যন্ত কাঁথায় ঢাকা, তবু ফাঁকফোকর দিয়ে মশা ঢুকে কামড়ায়। ঘুমের মধ্যেই চটাস চটাস মারে। প্রায় রাতেই শোওয়ার সময় হারিকেনের টিপ খুলে কেরোসিন আধ কোষ তেলোয় ঢেলে সরষেতেলের মতো গায়ে মুখে মেখে নেয়। তবু ঠিক কামড়ায়। ক্রিমি আছে বোধ হয় ঘুমের মধ্যে দাঁত কড়মড় করে, স্বপ্নের মধ্যে কথা বলে। ব্রজগোপাল বিরক্ত হন! পাকা ঘুম তাঁতির, ডাকলে সহজে ওঠে না। আর এক চিন্তা ব্রজগোপালের, চৌকির তলায় স্যুটকেস আছে, টেবিলে ঘড়ি, দড়িতে কিছু জামাকাপড়, দামি একটা দশবাতির ল্যাম্প—একটা কিছু তুলে নিয়ে মাঝরাতে তাঁতি সটকায় যদি? এমন কিছু মহামূল্যবান দ্রব্য নয়, চোরের লাভ হবে না, কিন্তু গেরস্তর তো ক্ষতি! তাই সতর্ক থাকেন ব্রজগোপাল। কোথাকার সব উটকো লোকজন ধরে আনে বহেরু। এসব লোককে বিশ্বাস কী? এসব মিলেঝুলে আজকাল ঘুম কমে গেছে। বুড়ো বয়সে অবশ্য ঘুম কমে যায়। এ বয়সে শরীরের কল বড় আনমনা, নিজের ক্ষয়ক্ষতি আর পূরণ করে নিতে চায় না।

নিশুত রাতে পৃথিবীটা মস্ত বড় হয়ে ওঠে। ব্রজগোপাল শুলেই টের পান, চারধারে ঘুম, নিস্তব্ধতার ভিতরে মনটা নানা কথা কয়ে ওঠে। সে সব কথা ঢেউ-ঢেউ হয়ে চলতে চলতে কোথায় পৌঁছে যায়। আর ঠিক ওরকম সব ঢেউ যেন চারধার থেকে দূর-দূরান্ত পার হয়ে তাঁর দিকেও আসতে থাকে। যেমন নক্ষত্রের আলো, যেমন দূরদেশ থেকে আসা বাতাস, যেমন খঞ্জনা পাখি।

মনের বড় শত্রু নেই। এমনিতে বেশ থাকে, হঠাৎ কু-ডাক ডাকতে শুরু করে। কাজকর্মের মধ্যে থাকলে মনটা বেশ থাকে, কিন্তু একা হলেই মানুষ বোকা। রাতবিরেতে আজকাল ঘুম না হলে একটা ধন্দ ভাব চেপে ধরে ব্রজগোপালকে। বিষয়চিন্তা তাঁর অভ্যাস নয়। কিন্তু বহেরুর মাঝলা ছেলে কোকা জেল থেকে খালাস হওয়ার পর বিষয়-আশয়ের জন্য একটু উদ্বেগ হয়। ছেলেটা এই সেদিনও ছোট্টটি ছিল, পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে বেড়াত, ফাইফরমাস খাটত। ব্রজগোপালের ঠাকুর পুজোর প্রসাদ একটু বাতাসার কণা কচি হাতখানা পেতে ভক্তিভরে নিত। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত কিছু বোঝা যায়নি। তারপরই তেড়া বাঁশের মতো নিজের ইচ্ছেয় বাড়তে লাগল। এখনও তেইশ-চব্বিশ বয়স, তবু চোখে ইতরামি এসে গেছে। কাউকে বড় একটা মানে গোনে না। মাঝেমধ্যে ব্রজগোপালের ঘরে এসে ‘বামুনজ্যাঠা’ বলে ডাক দিয়ে মেঝেয় বসে। কথাবার্তা কয়। কিন্তু ব্রজগোপাল বুঝতে পারেন, ছেলেটার মধ্যে জন্মসূত্রে কোনও দোষ আছে। এ ছেলে যেখানে থাকবে সেখানেই একটা সামাল সামাল পড়ে যাবে। হাতের পাতের টাকা দিয়ে নিজের নামে কিছু জমি কিনেছেন ব্রজগোপাল, স্ত্রীর নামে আছে ছ’বিঘে, আর আছে বাস্তুজমি। ছেলেরা আসবে না এসব দেখতে। তাই কোকার দিকে তাকিয়ে একটু উদ্বেগ বোধ করেন। এই বয়সেই খুন-খারাপি করে ফেলেছে এবং সেজন্য কোনও পাপবোধও নেই। জেলখানা থেকে হাতি হয়ে ফিরেছে। কোকা যে-ছোকরাকে কেটেছিল তাকে চিনতেন ব্রজগোপাল। সোমেনের মতোই বয়স, তেজি চেহারা। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে এসে গোবিন্দপুরে এক আত্মীয়-বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিছু স্যাঙাৎ জুটিয়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াত। তার রাগ ছিল জোতদারদের ওপরে। কিন্তু এমন কিছু করেনি যে পালটি নিতে হবে। তবু কোকা তাকে কেটে ফেলেছিল। মশা-মাছি মারলেও জীবহত্যা হয়, মানুষ মারলেও তাই। তবু মানুষ যখন মানুষ মারে তখন বোধ হয় তার নিজের রক্তেই একটা বিরুদ্ধ ভাব ওঠে। তার নিজের গড়া আর একটা জীবকে মারলে কি তার ভিতরে একটা আত্মীয়বধের অনুতাপ কাজ করে? নাকি সে, ফাঁসির দড়ি যাবজ্জীবনের মেয়াদ—এসব ভেবে দিশেহারা হয়? ঠিক জানেন না ব্রজগোপাল। তবে মনে আছে, সেদিন রাতে ফিরে কোকা পুকুরে ঝাঁপ খেয়ে দাপাদাপি করেছিল অনেকক্ষণ। যখন তাকে তুলে আনা হয় তখন দুচোখ ঘোলাটে লাল, বেভুল সব বকছে। রাতে গা-গরম হয়ে জ্বর এল। বহেরু লক্ষণ দেখেই চিনেছিল, ব্রজগোপালকে আড়ালে ডেকে বলেছিল—শুয়োরটা নিশ্চয়ই মানুষ খেয়েছে কর্তা। রক্তেরই দোষ। রাত না পোয়াতে বিড়াল পার করতে হবে।

ভোর রাতে কোকাকে প্রথম ট্রেনে কলকাতায় রওনা করে দিয়ে আসতে গিয়েছিল বহেরু। কলকাতা মানুষের জঙ্গল, পালিয়ে থাকার এমন ভাল জায়গা আর নেই। কিন্তু কোকা স্টেশনেই ধরা পড়ে। ধরা পড়বার পর ব্রজগোপাল গিয়েছিলেন দেখা করতে, উকিল সঙ্গে নিয়ে। ছেলেটাকে তখন দেখেছেন, শিবনেত্র হয়ে লাতন বেচারার মতো বসে আছে। ঘন ঘন মাথা ধোয়, চুল তখনও সপসপে ভেজা, মুখটা পাঁশুটে কেমনধারা যেন। অনেককাল রোগভোগের পর মানুষের এমন চেহারা হয়। ছেলেটা সোমেনের বয়সি একটা তাজা ছেলেকে কেটে ফেলেছে, ভাবলে ওর ওপর রাগ ঘেন্না হওয়ার কথা। কিন্তু মুখ দেখলে তখন মায়া হত। ব্রজগোপাল একটু মায়াভরে বলতেন—কেন কাজটা করতে গেলি রে নিব্বংশার পো?

কোকা তখন দিশেহারার মতো চারদিকে চেয়ে গলা নামিয়ে বলত—কাঁধের ওপর দাঁড়িয়েছিল একা। স্যাঙাৎ জুটিয়ে আমাদের ওপর মাতব্বরী করত খুব। পেছুতে লাগত, তাই রাগ ছিল। সেদিন একা দেখে মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। এখন তো সবাই মানুষ-টানুষ মারে, কেউ কিছু বলে না। তাই ভাবলাম, একবার মেরেই দেখি না কী হয়। পালান, নেতাই ওরাও সব বললে—দে শালাকে চুপিয়ে। দিনকাল খারাপ বলে অস্তর সঙ্গে থাকত। হাতে অস্তর, মানুষটাও একা, মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল। হাঁকাড় ছেড়ে দৌড়ে যেয়ে চুপিয়ে দিলাম।

ব্রজগোপাল আতঙ্কিত হয়ে বলেছেন—ওরে চুপ চুপ। ওসব কথা কোস না আর ভুলে যা। উকিলবাবু যা শেখাবেন সেই মতো বলবি।

সন্দেহ ছিল, জেরার সময়ে মাথা ঠিক রাখতে পারবে কিনা। কারণ, দেখা করতে গেলেই খুব আগ্রহের সঙ্গে ঘটনাটার বিশদ বিবরণ দিতে শুরু করত কোকা। চোখ দুখানা বড় বড় হয়ে যেত, দম ফেলত ঘন ঘন। বলত—মাইরি, মানুষ যে এমনভাবে মরে কে জানত! আঁ-আঁ করে একটা চিৎকার ছেড়ে ছেলেটা যখন পড়ে যায় তখন রক্তটা এসে গায়ে লাগল। কী গরম রক্ত রে বাবা! পড়ে হি-হি করে কাঁপছিল ছেলেটা। সে কী ভয়ংকর দৃশ্য! কোকাকে তখন চুপ করানো ভারী মুশকিল ছিল।

প্রথম কদিন ঝিম হয়ে পড়ে থাক। কোর্টে জেরার সময়ে নানা উলটোপালটা জবাব দিয়েছিল। সুবিধে ছিল এই যে, যাকে মেরেছিল তার নামে পুলিশের হুলিয়া ছিল। সে নাকি ভারী ডাকাবুকো ছেলে, কলকাতায় পুলিশ মেরে এসেছে। ফলে, কোকা আর তার দলবলের বিরুদ্ধে পুলিশ কেসটা খুব সাজায়নি। উকিলও সুযোগ পেয়ে ‘আত্মরক্ষার জন্য হত্যা’ প্রমাণ করার চেষ্টা পায়। মোকদ্দমা ফেঁসে যাওয়ার মতো অবস্থা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চারজনের মেয়াদ হয়েছিল। তিনজন আগেই খালাস পেয়ে যায়। সবশেষে খালাস হল কোকা, মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই।

এই মামলায় রাজসাক্ষী ছিল গোবিন্দপুরের মেঘু ডাক্তার। সে মাতাল-চাতাল মানুষ। বেলদা-র শুঁড়িখানা থেকে বাঁধ ধরে ফিরছিল। সে ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে পায়। সে অবশ্য লোকজনদের ঠিক চিনতে পারেনি। উলটোপালটা সেও বলেছিল সাক্ষী দিতে গিয়ে। তবু সবচেয়ে জোরদার সাক্ষী ছিল সে-ই।

এ তল্লাটে মেঘুর মতো ডাক্তার নেই। পুরনো আমলের এল এম এফ। সে রুগির মুখে ওষুধ বলে জল ঢেলে দিলেও রুগি চাঙ্গা হয়ে যেত—মানুষের এমন বিশ্বাস ছিল তার ওপর বউ মরে গিয়ে ইস্তক সে ঘোর মাল। বাল-বিধবা এক বোন তার সংসার সামলায়, মেঘু সকাল থেকেই ঢুকু ঢুকু শুরু করে দেয়। রোজগারপাতি বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়, সংসার চলে না, রুগি দেখে যে পয়সা পায় তা শুড়িকে দিয়ে আসে। ইদানীং পাগলামিতে পেয়ে বসেছিল। এক মুসলমান বৃষ্টির সন্ধেবেলা এসে হাজির, সান্নিপাতিকে তার তখন যা-দশা! মেঘুর আলমারিতে ওষুধের নামগন্ধও ছিল না তখন। রুগি হাতছাড়া হয়ে দেখে ইঞ্জেকশনের দাম নিয়ে উঠে ভিতর বাড়িতে গিয়ে গোয়ালঘরের খোড়ো চালের লালচে জল সিরিঞ্জে ভরে এনে ঠেলে দিয়েছিল রুগির শরীরে। এ ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে বাল-বিধবা বোন চেঁচামেচি শুরু করাতে মেঘু গাঁ ছেড়ে পালাল ক’দিনের জন্য। তার তখন ধর্মভয় নেই, লোকলজ্জাও না, কেবল ছিল জীবজন্তুর মতো মারধরের ভয়। ফেরার অবস্থায় সে ভারী মজা করেছিল। বর্ধমানের এক বিখ্যাত তান্ত্রিকের নাম করে বহেরুকে চিঠি দিল একদিন। চিঠির ওপর সিদুরের ছাপ, লাল কালি দিয়ে ত্রিশূল আঁকা। তাতে লেখা—ক্ষীরোগ্রাম শ্মশানেশ্বরী শ্রীশ্রী১০৮ কালীমাতার আদেশক্রমে লিখি, বৎস বহেরু, গোবিন্দপুরের শ্রীমান মেঘনাধ ভট্টাচার্য আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া অতি অল্প দিনেই সর্বসাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। অতঃপর সে মেঘুতান্ত্রিক নামে লোকপ্রসিদ্ধ হইবে। তাহার আধার অতি উচ্চ। ক্ষীরোগ্রাম শ্মশানে মায়ের স্বপ্নদেশক্রমে একটি মন্দির নির্মাণকল্পে সে অর্থ সংগ্রহে তোমার নিকট যাইতেছে। তাহাকে সাহায্য করিলে শ্মশানেশ্বরী মাতার সিদ্ধ বর লাভ করিবে। বিমুখ করিলে শ্রীশ্রীমাতার কোপে পড়িবে ইত্যাদি। হাতের লেখা মেঘু ডাক্তারের নিজেরই, চিনতে কারও অসুবিধে হয় না। চিঠির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রক্তাম্বর রুদ্রাক্ষে সিঁদুর ত্রিশুলে সেজে মেঘুতান্ত্রিক এসে হাজির। লোকে হেসে বাঁচে না। বহু লোককেই ওরকম চিঠি দিয়েছিল মেঘুতান্ত্রিক। বাল-বিধবারা খর-ঝগড়ুটে হয়। মেঘুর বোন আরও এক ডিগ্রি বেশি। সে মেঘুর মালা রক্তাম্বর ছিঁড়েকুটে একশা করল। সেই থেকে মেঘুর মাথা বড় সাফ, সাহসীও বটে। গায়ে একরকম ঘা নিয়ে শেওড়াফুলি থেকে একজন লোক এসেছিল, বহু চিকিৎসায় সারেনি। মেঘু তার ডান হাত থেকে রক্ত সিরিঞ্জে টেনে নিয়ে বাঁ হাতে ভরে দিয়েছিল। লোকটা আশ্চর্যের বিষয়, ভাল হয়ে গিয়েছিল তাতে।

গোবিন্দপুরের যে কজন লোককে বহেরু পছন্দ করে তার মধ্যে মেঘু একজন। খামারবাড়িতে কারও অসুখ হলে মেঘুই এসেছে বরাবর। ব্রজগোপালের সঙ্গে তার ভাবসাব ছিল খুব। প্রায় বলত—ব্রজঠাকুর, দু-বেলা খাওয়ার পর চ্যাটকানো প্লেটে মধু খাবেন দু- চামচ। মধুটা ছড়িয়ে নেবেন, আস্তে ধীরে খাবেন। যত স্যালিভা মিশবে মধুর সঙ্গে, তত ভাল।

কথামতো খেয়ে দেখেছেন ব্রজগোপাল, উপকার হয়।

একদিন বলেছিল—ব্রজঠাকুর, একটা মুষ্টিযোগ দিয়ে রাখি। পাতিলেবুতে মেয়াদ বাড়ে। আর নিরামিষে।।

—মেয়াদটা কী বস্তু? ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করেছেন।

—দুনিয়ার গারদের মেয়াদ। লনজিভিটি।

পুদিনা, সুল্‌পো আর ধনেপাতা আমলকি দিয়ে বেটে খেলে আর অন্য ভিটামিন দরকার হয় না। ক্ষ্যাপাটে ডাক্তারটা এরকম হঠাৎ হঠাৎ বলত। অব্যর্থ সব কথা। কিছু কিছু ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন ব্রজগোপাল। ইচ্ছে ছিল ডাক্তারের পুরো জীবনটাই লিখবেন। কিন্তু মোদো-মাতালের কাণ্ডে তা হয়ে ওঠেনি। পয়সাকড়ি ফুরলে ডাক্তারটা পাগলের মতো হন্যে হয়ে যেত। কুমোরপাড়ার হরিচরণ এক সময়ে তাড়ি বানাত। পুলিশের রগড়ানিতে ছেড়ে দিয়ে একখানা ওষুধের দোকান দিল। গাঁ-ঘরের দোকান, তাতে কবরেজি, হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপাথি সবই কিছু কিছু জোগাড় করে রেখেছিল সে। মেঘু ডাক্তার একদিন মৌতাতের সময়ে বিছুটি-লাগা মানুষের মতো সেখানে হাজির। তাড়ির কারবার যে আর নেই তা খেয়ালই করল না। চারপাশটা ক্ষ্যাপা চোখে দেখে নিয়ে ‘শিশিতে তাড়ি বেচিস?’ এই বলে তাক থেকে এলোপাতাড়ি গোটা দুই বোতল তুলে নিয়ে ঢাকাঢ়ক মেরে দিতে লাগল। হরিচরণ হাঁ-হাঁ করে এসে ধরতে না ধরতে আধবোতল অ্যালক্যালাইন মিকশ্চার সাফ। অন্য বোতলটা ছিল ফিনাইলের, সেটা হরিচরণ সময়মতো কেড়ে না নিলে মুশকিল ছিল। পয়সা না পেলে এমন সব কাণ্ড করত মেঘু।

এই মেঘু যখন রাজসাক্ষী হয় তখন ব্রজগোপাল বহেরুকে বলেছিলেন—ওকে হাতে রাখ।

হাতে রাখা সোজা। মেঘুকে মদের পয়সাটা দিয়ে গেলেই চমৎকার। ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই। কিন্তু বহেরু কেমন একধারা চোখে ব্রজকর্তার দিকে চেয়ে বলেছিল—দেখি।

—দেখাদেখির কী? ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন—এ সময়টা আর তেসিয়ে নষ্ট করিস না। আগে থেকে টুইয়ে রাখ।

কিন্তু কেমন যেন গা করেনি বহেরু। আলগা দিয়ে বলল—মাতাল চাতাল মানুষ, হাত করলেও কী বলতে কী বলে ফেলবে!

কথাটা ঠিক, তবু বহেরুর হাবভাব খুব ভাল লাগেনি ব্রজগোপালের। সে ছেলের ব্যাপারে একটু গা-আলগা দিয়েছিল যেন। মেঘুকে হাত করার কোনও চেষ্টা করেনি। ব্রজগোপাল নিজেই গিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এসেছিলেন মেঘূকে। পাঁটা টাকা দিয়েছিলেন, যদিও মেঘুকে টাকা দেওয়া মানে পরোক্ষে শুড়িখানার ব্যবসাকে মদত দেওয়া। স্বভাববিরুদ্ধ কাজটা তবু করেছিলেন ব্রজগোপাল।

মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কোকা বেরিয়ে এসেছে। এতে বাপ হয়ে বহেরুর খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার মুখেচোখে একটা নিরানন্দ ভাব। আর, তারচেয়েও বড় একটা ব্যাপার দেখতে পান ব্রজগোপাল। বহেরুকে জীবনে ভয় পেতে দেখেননি তিনি। এখন মনে হয় বহেরুর চোখে একটু ভয় যেন সাপের মাথার মতো উকি মারছে।

ভাবতে ভাবতে এপাশ থেকে ওপাশ হন তিনি। কাঁথাটা গায়ে জড়ান। তাঁতি লোকটা কী একটু কথা বলে ঘুমের মধ্যে হাসে। ব্রজগোপাল অন্ধকারে চেয়ে থাকেন। হারিকেনের পলতেয় একবিন্দু নীলচে হলুদ আলো জ্বলছে। ব্রজগোপাল চেয়ে থাকেন।

গতকাল মেঘু ডাক্তার মারা গেছে। কোকা খালাস হয়েছে মোটে কদিন। মেঘুটা আবার রাজসাক্ষী ছিল।

॥ চব্বিশ ॥

সেদিন ভাগচাষির কোর্ট থেকে ফেরার পথে মেঘু ডাক্তারের সঙ্গে দেখা। বেলদা-র বাজারে দাঁড়িয়ে মাতলামি করছে। লোকজন ঘিরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। বেঁটেখাটো কালোপানা বুড়ো মানুষ, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, গালে বিজবিজ সাদা দাড়ি, কষে ফেনা, দুচোখে জলের ধারা। হাপুস কাঁদে মেঘু ডাক্তার। মাতালের যা স্বভাব, কোথাও কিছু না, হঠাৎ একটা পুরনো অনাত্মীয় দুঃখকে খুঁচিয়ে তোলে। মেঘু কাঁদছে তার বালবিধবা বোনের কথা মনে করে—আমার জনমদুখিনী বোনটা, আহা-হা, আমার বিধবা বোনটার যে কী দুঃখ! আমি তার দাদা হাঁ আলবত তার মায়ের পেটের দাদা! বলে হঠাৎ কান্না ভুলে বড় বড় ঠিকরানো চোখে চারদিকে চেয়ে দেখে মেঘু ডাক্তার। পরমুহূর্তে ক্যাঁ করে কেঁদে ফেলে ভাঙা গলায় বলতে থাকে-মায়ের পেটের দাদা! মরার খবর হলে বোনাই কাছে ডেকে বলেছিল হাত ধরে—দাদাগো, ব্যবস্থা তো কিছু করে যেতে পারলাম না, ওর কী হবে! সেই বোনটা আমার বাসন মেজে খায়, আর আমি শালা মাতাল…শালা মাতাল…জুতো মার, জুতো মার আমাকে…বলতে বলতে মেঘু এর-ওর তার পায়ের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে তেড়ে যায় জুতো ধরতে।

সাঁত সাঁত করে সবাই পা টেনে নিয়ে পালাতে থাকে। কেবল ধরা পড়ে যায় রেলের রাতকানা কুলি হরশঙ্কর। তার হাতে শিশিতে একটু কেরোসিন, দোকান থেকে ফিরছিল, মজা দেখতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার একখানা ঠ্যাঙ সাপটে ধরেছে মেঘু, হাঁটু গেড়ে বসে মুখ তুলে বলে—দে শালা জুতো আমার মুখে। দে! দিবি না? পয়সা জুটলে হরশঙ্কর নিজেও টানে, তাই খুব সমবেদনার সঙ্গে কী যেন বোঝাতে থাকে ডাক্তারকে।

গোবিন্দপুরের যে কজনকে একটু-আধটু পছন্দ করে বহেরু, তার মধ্যে মেঘু ডাক্তার একজন। কাণ্ড দেখে দাঁড়িয়ে গেল। বলল—খেয়েই ডাক্তারটা যাবে।

ব্রজগোপাল বলেন—দেখবি না কি!

—ও আর দেখার কী! চলে চলুন।

ব্রজগোপাল একটু ইতস্তত করে বলেন—কোথায় পড়েফড়ে থাকবে! হিম লেগে না রোগ বাধায়।

বহেরু বলে—পেটে ও থাকলে আর ঠান্ডা লাগে না।

ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ফেলেন। বলেন—গুণ ছিল রে!

বহেরু থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ কী মনে পড়তেই বলে—ডাক্তারটা বামুন হয়ে ছোটলোকের পা ধরছে!

ব্রজগোপাল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন—মাতালের আবার বামুন।

বহেরু সে কথায় কান না দিয়ে বলে—আপনি এগোন কর্তা, আমি দেখেই যাই।

ব্রজগোপাল হাসলেন। বহেরুর ওই এক দুর্বলতা। বামুন দেখলে সে অন্যরকম হয়ে যায়। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—দ্যাখ! একটা রিকশায় তুলে দিস বরং।

লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে বহেরু হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলে ডাক্তারকে, বলে—চলো ডাক্তার।

মেঘু কিছু বুঝতে পারে না কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলে, মারছিস? মার। বলে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদে। মুখের লালা, নাকের জল মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলে—মার আমাকে।

—তোমার ইজ্জত নেই। বামুন হয়ে দোসাদের পা চেপে ধরলে কোন আক্কেলে? চলো তোমাকে গোচোনা গেলাব আজ।

মেঘু সঙ্গে সঙ্গে কান্না ভুলে ফোঁস করে ওঠে—কেন শালা? আমাকে পেয়েছ কী? অ্যাঁ!

—ফের মাতলামি করবে না বলে দিচ্ছি। তোমাদের গাঁ হয়েছে এক নেশাখোরদের আচ্ছা।

—আমি মাতাল! ভারী অবাক হয় মেঘু—আমি! অ্যাাঁ?

—তুমি আজ বিস্তর গিলেছ। এত খাও কী করে হে! এই বলে বহেরু তাকে টানতে টানতে বটতলার রিকশার আড্ডায় নিয়ে যেতে থাকে। মেঘু চেঁচাতে থাকে—শালা, গোরু দেখেছিস? দেখেছিস গোরু সারাদিন খালি খায় আর খায়? সকালে জাবনা, বিকেলে জাবনা, তার ওপর দিনমানভর ঘাস ছিঁড়ছে আর খাচ্ছে! রাতেও শালা উগরে তুলে চিবোয়। গোরুর কখনও পেট ভরে, দেখেছিস? আমি হলুম মদের গোরু…।

লোকজন খ্যাল খ্যাল করে হাসছে। ছোকরা একটা রিকশাঅলা ঘন্টি মারে। রিকশাটা এগিয়ে আসতেই মেঘু তেড়িয়া হয়ে দাঁড়ায় রিকশায় যাব কেন, আমি কি মাতাল শালা? বহু কাপ্তান দেখেছি শুঁড়ির গায়ের ঘাম চাটলে শালাদের নেশা হয়ে যায়। আমি কি তেমন মাতাল নাকি। আমি হচ্ছি মদের গোরু, সারাদিন খাইয়ে যা, পেট ভরবে না। মেঘনাদ ভটচাষকে কেউ কখনও মাতাল দেখেনি। হটাও রিকশা…

বলে মেঘু রুখে দাঁড়ায়। তারপর বহেরু কিছু টানাটানি করতেই সটান শুয়ে পড়ে ধুলোয়। সে অবস্থা থেকে তাকে তোলা বড় সহজ হয় না।

ব্রজগোপাল সেই শেষবার দেখেছিলেন মেঘু ডাক্তাবকে বাজারের বটতলায় ধুলোমুঠো ধরে পড়ে আছে। মাতাল মানুষ। ইদানীং বোধবুদ্ধি খুব কমে যাচ্ছিল। কেমন ভ্যাবাগঙ্গারামের মতো চোখের নজর, দুটো ঠোঁট সবসময়ে ক্যাবলার মতো ফাঁক হয়ে থাকত। চোখের নীচে গদির মতো মাংস উচু হয়ে থাকত। চোখে আলো নিবে গেছে। ভিতরে ভিতরে বাঁচার ইচ্ছেটাও মরে গিয়েছিল বোধ হয়।

পরশু বুঝি পয়সার টান পড়ে। গোটা চারেক টাকার জোগাড় ছিল। দুপুরের দিকে বালবিধবা বোন তিনটে টাকা কেড়ে নেয়। না নিয়েও উপায় ছিল না, দু-চারদিন কুত্‌থি-কলাই সেদ্ধ অথবা গমের খিচুড়ি খেয়ে বাচ্চাদের পেট ছেড়েছে। কিছু ভদ্রলোকী খাবার না জোটালেই নয়। মেঘু ডাক্তার বোনকে মুখোমুখি বড় ডরায়। টাকাটা হাপিস হয়ে গেল দেখে নাকি সুস্থ মাথায় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করেছিল—আমার মালের দাম ভেঙে গেল, একটা টাকায় শুড়ির মুখখানাও দেখা যায় না। এখন আমার শরীরটা যদি পড়ে যায় তো তোদের দেখবে কে শুনি?

দায়িত্বশীল গেরস্তের মতো কথাবার্তা। মালের দামটা ভেঙে গেছে বলে যে আবার টপ করে জোগাড় করে নেবে সে সাধ্য মেঘুর ছিল না। তার গুডউইল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মেঘু মাতাল, আর মেঘু ডাক্তার দুটো মানুষ। মাতাল মেঘুর জন্য ডাক্তার মেঘু নষ্ট হয়ে গেছে। মাতাল অবস্থায় কী করেছে না করেছে ভেবে মেঘু ইদানীং বড় বিনয়ী হয়ে গিয়েছিল। যখন-তখন লোকের পা ধরত। তাতে শ্রদ্ধা আরও কমে যায়। ধারকর্জ দিয়ে দিয়ে লোকে হয়রান। দুপুর গড়িয়ে গেলেই ডাক্তারকে নিশি ডাকে। বাহ্যজ্ঞান থাকে না, পাপ-পুণ্য ভাল-মন্দর বোধ লুপ্ত হয়ে যায়। ধূর্তামিতে পায় তখন। সে সময়ে চেনা লোক তাকে দেখলেই গা-ঢাকা দেয়।

পরশু বিকেলে মেঘুকে যখন নিশিতে পেয়েছে, মালের দাম ভেঙে গিয়ে চূড়ান্ত দুঃখে মেঘুর চোখে জল, সে সময়ে গুটি গুটি একটি পাঁঠা নিজে হেঁটে এল হাঁড়িকাঠে গলা দিতে। সে একটু বোকাসোকা চাষি মানুষ, এক-আধবার মেঘর চিকিৎসা করিয়ে থাকবে। ‘কল’ দিতে এসেছিল। গোবিন্দপুর থেকে আরও মাইলখানেক উত্তরে তাদের গাঁয়ে। মেঘু তক্ষুনি রাজি। রুগি দেখার পর নাকি পয়সা না দিয়ে চাষি-বউ গুচ্ছের ধান, কলাই, দুটো বিচে-কলার মোচা, এসব দিয়েছিল। কিন্তু মেঘুর তখন হন্যে অবস্থা, ধান-কলাই-মোচা দেখে আরও মাথা খারাপ হয়ে গেল। চাষির ঘরে ঢুকে শিশিবোতল হাঁটকায়, ছিপি খুলে গন্ধ শোকে, আর বলে–তোর মাল খাস না? যা! মাল খাস না তো চাষবাস করার তাগদ পাস কীসে? মাল না খেলে শরীরে রক্ত হয় তোদের কী করে, অ্যাঁ! নগদা তিন চারটে টাকা থাকে না তোদের কাছে কেমন গেরস্তালী করিস তোরা! নাম ডোবালি।

ঠিক কী হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে মেঘু ডাক্তার চলে আসার পর নাকি চাষা দেখতে পায় তার ঘরের একটা জিনিস খোয়া গেছে। তার বড় ছেলে বর্ধমানের কলেজে পড়ে, একটা সস্তার হাতঘড়ি শখ করে কিনেছিল। দেয়ালে পেরেকে ঝোলানো ছিল। নেই। মেঘু চারশো বিশ ছিল বটে, কিন্তু কখনও লোকের ঘরে ঢুকে কিছু সরায়নি এ যাবৎ। বেলদার সেই ঘড়ি দশ টাকায় বেচে কোকার এক স্যাঙাতের কাছে, তারপর তাদের সঙ্গে বসেই একনম্বর টেনেছে। কাল সকালে বহেরুর হেফাজতে। তারা কোকার স্যাঙাতদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোকার খোঁজেও এসেছিল। কিন্তু দলে ছিল না বলে ধরে নিয়ে যায়নি। পালান চোরাই ঘড়িটা কিনেছিল, সেটা বাড়িতে ফেলে রেখে বোকার মতো ফেরার হয়েছে। পুলিশ চোরাই ঘড়ির জন্য খুঁজছে, নাকি খুন সন্দেহ করছে, কিছু বলা যায় না। ঘড়িটড়ি সস্তা ব্যাপার নিয়ে তারা এত মাথা ঘামায় না। তবে কি খুন?

ব্রজগোপাল ভেবে পান না। মোদোমাতাল অপদার্থটাকে মেরে লাভটা কী? বহেরু তবু কাল বিকেলের দিকে ব্রজগোপালের কাছে এসে বলেছে—ডাক্তারটা রাজসাক্ষী ছিল বলে খুন হল না তো কর্তা!

ব্রজগোপাল অবাক হয়ে বলেন—খুন বুঝলি কীসে? এমনিতেই শরীরটা ঝাঁঝরা হয়ে ছিল, পট করে মরে যেত যে কোনও সময়ে।

বহেরু ধন্ধভাবে মাথা নেড়ে বলে—গ্যাঁজ উঠছিল যে মুখ দিয়ে।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—ওসব খেলে তো ওরকম হবেই।

বহেরু হেসে বলেছিল—পুলিশ কিছু একটা গন্ধ পেয়েছে। কেলো শুঁড়ির দোকানে কাল নাকি মেঘুকে পালান ওরা শাসিয়েছে—তুমি রাজসাক্ষী দিয়ে আমাদের ঘানি ঘুরিয়েছ, তোমার গর্দান যাবে।

ব্রজগোপালের তবু বিশ্বাস হয় না। শুঁড়িখানায় বসে কত মশামাছির মতো মানুষ রাজা-উজির মারে। তিনি বললেন—লাশ তো তুই দেখেছিস। কিছু টের পেলি?

বহেরু মাথা নেড়ে বলল—না, শরীর দেখে কিছু বোঝা যায় না। তবে ডাক্তারটা মদের নেশায় মাথার ঠিক রাখতে পারত না। কেউ যদি সে সময়ে পোকামারার বিষ এগিয়ে দেয় তো তাই ঢাকাকে ঢেলে দেবে গলায়। এই বলে একটা শ্বাস ফেলে বহেরু বলল—কোকাটার জন্য ভারী চিন্তা হয় কর্তা।

ব্রজগোপাল চিন্তিত হয়ে বললেন—চিন্তা করিস না। ও তো দলে ছিল না। মাঠেঘাটে লাশ পাওয়া গেলে পুলিশ একটু নড়াচড়া করে। কাটাকুটি করে দেখবে। ওসব কিছু না।

—তা পালান পালিয়েছে কেন? সেটাও তো দেখতে হবে!

—দূর বোকা। ও পালিয়েছে ভয়ে। ঘরপোড়া গোরু, একবার পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা। তার ওপর চোরাই ঘড়িটা কিনেছে, ভয় থাকবে না?

বহেরু বুঝল। তবু একটু সন্দেহ প্রকাশ করে বলে—খুন যদি নাও হয়ে থাকে মেঘু, তবু কিন্তু মনে লয় কোকার স্যাঙাতরা সব খালাস হয়ে এসেছে, শাসাচ্ছে-টাসাচ্ছে দেখে ডাক্তারটা ভয় খেয়ে মরে গেল না তো। তেমন তেমন ভয়-ডরের বাতাস লাগলে মানুষ সিঁটিয়ে মরে যায়।

সেটাও ব্রজগোপালের বিশ্বাস হয় না। মেঘু বাস্তব জগৎ সম্পর্কে খুব খেয়াল করত না ইদানীং। এক-একটা বোধহীনতা মানুষকে পেয়ে বসে, যখন বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার তফাত করতে পারে না। বউ মরে যাওয়ার পর থেকে পরশু ইস্তক মেঘু ডাক্তারের আত্মবোধ ছিল বলে মনে হয় না। ‘আমি আছি’ এমনতর হুঁশ থাকলে তবে তো ভয়ডর? কেবল নেশায় বাধা দিত বলে বালবিধবা বোনটাকে সমঝে চলত। আর সুস্থ অবস্থায় মেঘু ডাক্তার ভয় খেত মাতাল মেঘুকে। কতবার মেঘু এসে ব্রজগোপালের পা চেপে ধরে বলেছে—দাদা, কাল সাঁঝের ঘোরে শীতলাতলায় আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, অবিহিত কিছু বলে ফেলেছি হয়তো, সম্মান রাখতে পারিনি। মাতাল-টাতাল মানুষ, ক্ষমা ঘেন্না করে নেবেন। মেঘুর তাই সমস্যা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, নিজের মধ্যে দুটো মানুষকে সামাল দেওয়া। একটার সঙ্গে অন্যটার দেখা হয় না। একটা জাগলে অন্যটা ঘুমোয়। একটা ঘুমোয় তো অন্যটা জাগে। কতদিন মেঘু তার বোনের পা চেপে ধরে চেঁচিয়েছে—বেঁধে রাখ, বেঁধে রাখ আমাকে গোশালে। ঢেঁকিতে লটকে রেখে দে। তখন অন্য মেঘুটা অশরীরী হয়ে এসে এই মেঘুটাকে ইশারা-ইঙ্গিত করত ভূতের মতো। ছাইগাদায় দাঁড়িয়ে, ঘের পাঁচিলের ওপর উঠে, মাদার গাছের ডালে বসে দাঁত কেলিয়ে হাসত মেদুর কাণ্ড দেখে। নিঃশব্দে মেঘুর কানে কানে বলত—দূর বাবু, রসের বানে দুনিয়া ভেসে যাচ্ছে, তুমি কেন গা শুকনো সন্নিসি হয়ি থাকবে? কোন কচুপোড়া হবে তাতে? এই দুনিয়া তোমার জন্য কোন সুখ-শান্তির বন্দোবস্ত রেখেছে শুনি! তাই যদি ভেবে থাকো তো থাকো বোনের পায়ে লটকে, কিন্তু কিছু হওয়ার নয়। দুনিয়া এখন তোমার কাছে বাওয়া ডিম বাবা, এ থেকে আর কিছু বেরোবে না। তখন মেঘু উঠে চোর-চোখে চারদিকে চাইত। বোন সে চাউনি চিনত। ঘরের বাসন-কোসন বা দামি জিনিস সব তালাচাবি বন্ধ, পয়সাকড়ি লুকনো। নিজেকে গালমন্দ করতে করতে মেঘু তখন খারাপ হওয়ার জন্য অন্য মেঘুর হাত ধরে বেরিয়ে পড়ত।

তাই ব্রজগোপাল ভাবেন মেঘুর কাছে দুনিয়ার ঘটনাবলির কোনও অর্থ ছিল না। দু-দুটো মেঘুর টানা-হ্যাঁচড়ায় সে তখন নিজের ঘায়ে কুকুর-পাগল। সে যে রাজসাক্ষী হয়েছিল, এ হুঁশই ছিল না।

তবু নানা চিন্তা এসে চেপে ধরে। পাপের এক হাওয়া-বাতাস এসে গেছে দুনিয়ায়। কিছু বিচিত্র নয়। কোকা সেই ছোকরাকে খুন করার পর যেমন বলেছিল—আজকাল তো সবাই মানুষ মারে, কারও কিছু হয় না। কোকা কেবলমাত্র সেই কারণেই ছোকরাকে মেরে দেখেছিল কেমন লাগে। এমন তুচ্ছ কৌতূহলে যদি মানুষ মারা যায় তা হলে বলতেই হয়, সবার ঘাড়ে ভূত চেপেছে।

আবার এও মনে হয় মেঘুটা এমনিতেই মরল। মরার সময় হয়েছিল, দুনিয়ার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন শুদ্ধ-মুক্ত হয়ে বউয়ের পাশটিতে বসেছে কলজে ঠান্ডা করে, একটা বউয়ের জন্য যে একটা মানুষ এমন শোক-পাগল হতে পারে তা আর দেখেননি ব্রজগোপাল।

গভীর রাতে তিনি একটা শ্বাস ফেলে পাশ ফিরলেন। গায়ের কাঁথাটা সরে গেল। ঠান্ডা ঢুকছে। হারিকেনের একবিন্দু নীল আগুন স্থির হয়ে আছে। নীলের ওপর একটু হলদে চুড়ো। ঘরময় কেরোসিনের গন্ধ। তাঁতি লোকটা ঘুমের মধ্যে একবার বলল—ডাঁড়াও না…আ্‌ তারপর চুপ করে ঘুমোত থাকে। ঘড়িটা বন্ধ, সময়টা ঠিক বুঝতে পারেন না ব্রজগোপাল।

এমনি সময়ে গন্ধ বিশ্বেস হা-হা করে চেঁচিয়ে উঠল। আজও মুতের হাঁড়ি উলটে ফেলেছে। বহেরুর বড়জামাইয়ের গলার স্বর আসে। গলায় সুরের নামগন্ধ নেই, তবু একরকম একঘেয়ে পাঁচালির মতো আবেগে গাইতে থাকে—জাইগতে হবে, উইঠতে হবে, লাইগতে হবে কাজে…

তারপর হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী চমকে উঠে চুপ করে যায়। দিগম্বরের খোলে প্রথম চাঁটিটি পড়ে গুম করে। তোপের আওয়াজের মতো ওই একটি ধ্বনিই সবাইকে জানিয়ে দেয়, শব্দে ভগবান আছেন। শব্দ নমস্য।

নিঃশব্দে ব্রজগোপাল ওঠেন। বাইরে এখনও নিশুত রাতের মতো অন্ধকার। কুয়াশায় আবছা হিম। বৃষ্টির মতো শিশিরে ভিজে আছে চারধার। তবু ভোরের অনেক আগেই এখানে দিন শুরু হয়। দিগম্বরের আনন্দিত খোল শব্দে মাতাল হয়ে লহরায় ভাসিয়ে নিচ্ছে জগৎসংসার।

হারিকেন হাতে, খড়মের শব্দ না করে ব্রজগোপাল পুকুরের ঘাটে পা দিয়ে একটু চমকে ওঠেন। পৈঠায় কে যেন বসে আছে, অন্ধকারে একা। এটা ব্রজগোপালের নিজস্ব ঘাট। ব্রাহ্মণের ঘাট কারও কোনও কাজ করার নিয়ম নেই। ব্রজগোপাল হারিকেনটা তুলে বললেন—কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *