যাও পাখি – ১৫

॥ পনেরো ॥

বাসে ট্রামে আজকাল অজিত উঠতে পারে না। বড় কষ্ট হয়। অফিসের পরই তাই তার বাসায় ফেরা বড় একটা হয় না। এক সময়ে যখন ইউনিয়ন করত তখন প্রায়দিনই অফিসের পর ইউনিয়নের কিছু না কিছু কাজ থাকত, নয়তো কো-পারেটিবের। এখন সে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। ওভারটাইম থাকলে অফিসের পর সময়টা একরকম কাটে। নইলে বিকেলটা ফাঁকা এবং শূন্য।

অজিত যখন বেরোয় তার বহু আগেই অফিসের লোকজন চলে যেতে শুরু কর। সরকারি অফিস, তাই কেউ সময়টময় মানে না। অজিত যায় না, গিয়ে কী হবে! সাড়ে পাঁচটা ছটা পর্যন্ত কাজ করে সে সময় কাটায়। তারপরও বাসায় ফেরার নামে গায়ে জ্বর আসে। শীলা বেলা থাকতেই স্কুল থেকে ফেরে, কিন্তু অজিত ফেরে না। কার কাছে ফিরবে? একটা বাচ্চাও যদি থাকত!

মুশকিল হয়েছে এই যে, অফিসে তার বন্ধু-টন্ধু বড় একটা নেই। যখন ইউনিয়ন করত তখন বন্ধু ছিল সঙ্গীও ছিল। ইউনিয়ন ছেড়ে দিয়েছে বহুকাল, সেকশন ইনচার্জ হওয়ার পর আর কোনও সম্পর্কও রইল না। যাদের সঙ্গে এক সাথে কাজ করে তাদের সঙ্গে আজও ঠাট্টা মস্করা বা আড্ডার সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তারাও কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে, সংসার-চিন্তায় কিছুটা বা আত্মকেন্দ্রিক। হাসি-ঠাট্টা আজও হয় কিন্তু সেও জলের ওপর ভেসে থাকা বিচ্ছিন্ন কুটোকাটার মতো, তাতে স্রোত নেই, টান নেই, গভীরতা নেই।

কলকাতার ভিড় দিনে দিনে কোন অসম্ভাব্যতার দিকে যাচ্ছে তা ভেবে পায় না অজিত। শহরটার আগাপাশতলা দেখলে মনে হয় না এত মানুষ আঁটার জায়গা এখানে আছে। তবু কী করে যেন ঠিক এঁটেও যায়। ট্রামে বাসে ঝুলন্ত মানুষ দেখে অজিত, রাস্তাঘাটে মানুষের শরীর আগেপিছু কেবলই ঠেলে, ধাক্কায়। বিরক্তি, রাগ, ভয় নিয়ে মানুষ চলেছে, ঘুরে মরছে, কোথাও পৌঁছোয় না শেষ পর্যন্ত।

ভিড় একটু কম থাকলেও, এবং অফিসের পর বাসে ট্রামে ওঠা গেলেও অবশ্য অজিত বাসায় ফিরত না। ফিরে গিয়ে কী হবে? শীলা সন্ধে থেকে রেডিয়ো খুলে রাখে, উল বোনে, সিনেমার কাগজ দেখে। অজিত তাড়াতাড়ি ফিরলে অবশ্য খুশি হয়। কিন্তু সেটা কেবল বাড়িতে একজন লোক আসার জন্য যেটুকু খুশি তাই। কথা প্রায়ই বলার থাকে না। শীলা ঝির নিন্দে করতে থাকে, আশেপাশের বাড়ির নানা খবরাখবরের কথা বলে, বড়জোর স্কুলের গল্প করে। ওদের স্কুলে নতুন এক ছোকরা মাস্টার এসেছে, সে নাকি বোকা তাই তাকে নিয়ে অনেক কাণ্ড হয় স্কুলে। সেই সব গল্প বলে শীলা। অজিতের হাই ওঠে।

অফিসের পর একা-একাই কিছুটা হাঁটে অজিত। কিন্তু হাঁটার মতো তেমন জায়গা নেই। ময়দানের অন্ধকারেও দুর্বৃত্তের মতো কিছু মানুষ মুখ লুকিয়ে চুপিসাড়ে ঘোরে পুলিশ নজর রাখে, ভাড়াটে মেয়েছেলেরা গা ঘেঁষে যায়। রেস্টুরেন্টে খুব বেশিক্ষণ একা বসে থাকা যায় না। আসলে এই চল্লিশের কাছাকাছি বয়সেও তার সেই বয়ঃসন্ধির সময়কার পিপাসা জেগে আছে লক্ষ্মণের জন্য। লক্ষ্মণ আর কোনওদিনই ফিরবে না। একটা কভার ফাইল কিনে তার মধ্যে লক্ষ্মণের সব চিঠি জমিয়ে রাখে অজিত। অবসরমতো সেইসব চিঠি খুলে পড়ে। পিপাসা তাতে বেড়েই যায়।

অবশেষে খুব রাত হওয়ার আগেই অফুরণ সময় ফুরিয়ে না পেরে সে বাসার দিকেই ফেরে। মাঝে মাঝে ভবানীপুরে নেমে নিজেদের বাড়িতেও ঢুঁ মারে। কিছুই আগের মতো নেই। ভাইপো-ভাইঝিরা কত বড় সব হয়ে গেল। মা এখন কত বুড়োটে মেরে গেছে। খুব ডেকে, ভালবেসে কথা বলার কেউ নেই। দাদা বউদি আলগা আলগা কথা বলে, চাকর চা খাবার দিয়ে যায়। ইদানীং অজিত ম্যাজিক দেখায় বলে ভাইপো-ভাইঝিরা ঘিরে ধরে। অন্যমনস্কভাবে কয়েকটা ম্যাজিক দেখায় সে। জমে না।

অজিতকে তাই বাসায় ফিরতেই হয়। নিস্তব্ধ বাড়ি। শিশুর কণ্ঠস্বর নেই। কেবল রেডিয়োটা বাজে। বেজে যায়। কেউ শোনে না।

শীলা দরজা খোলে। কথা বলে না।

অজিত ঘরে ঢোকে। কথা বলে না।

আবার বলেও। খাওয়ার টেবিলে, বিছানায় শুয়ে এক-একদিন কথা হয় অনেক। ডাক্তার মিত্রকে কম টাকা আজ পর্যন্ত দেয়নি অজিত। কম করেও তিন-চার হাজার টাকা বেরিয়ে গেছে। একবার নার্সিং হোমে শীলার একটা অপারেশনও হয়েছে। শীলার কোনও তেমন মারাত্মক খুঁত না পেয়ে ডাক্তার মিত্র অজিতেরও কিছু চিকিৎসা করেছেন। তবু লাভ হয়নি। শীলার পেটে বাচ্চা আসেনি।

—কী আর হবে, ছেড়ে দাও। অজিত হতাশ হয়ে বলেছে।

শীলা কেঁদেছে, বলেছে—তোমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিসটাই দিতে পারলাম না।

—দূর দূর! অজিত সান্ত্বনা দিয়েছে—বাচ্চাকাচ্চা হলে ঝামেলাও কম নাকি। হল হয়তো, বাঁচল না। তখন বাচ্চা না হওয়ার চেয়েও বেশি কষ্ট। ছেলেপুলে বড় করা কি সোজা কথা!

এ কোনও সান্ত্বনার কথাই নয়। তবু আশ্চর্য যে শীলা সান্ত্বনা পায়।

মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ হেসে বলে—যা বলেছ! ছেলেপুলে হওয়া মানেই তো সারাদিন দুশ্চিন্তা। বাড়িঘর নোংরা করবে, কাঁদবে, চেঁচাবে। অশান্তি বড় কম নাকি! এই পড়ে গেল, এই ছড়ে গেল, এই এটা ভাঙল, সেটা ছিঁড়ল!

অজিত মাথা নেড়ে বলে—তবে?

শীলা শ্বাস ছেড়ে আবার তার বেদনার কাঁটা তুলে নিয়ে বলে—বাচ্চাকাচ্চা তো নয়, যেন অভিশাপ। না গো?

—হুঁ।

—এই বেশ আছি। শান্তিতে, নিরিবিলিতে। হুট করে যেখানে খুশি যেতে পারি। দুশ্চিন্তা নেই, ঝঞ্ঝাট নেই!

অজিত সায় দিয়ে যায়।

এবং এইরকমভাবেই দুটি শিশুর মতো তারা পরস্পরকে স্তোক দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। পারেও।

কিন্তু দুজনের মাঝখানে একটা পরদা নেমে আসে ধীরে। যবনিকার মতো। তাদের দাম্পত্য জীবন যেন এই মধ্যযৌবনেই শেষ হয়ে আসে।

অজিত প্রথম ম্যাজিক শেখে রাস্তার এক ম্যাজিকঅলার কাছে। তিনটে টাকা নিয়ে সে অজিতকে বল অ্যান্ড কাপ, দড়িকাটা আর একটা তাসের খেলা শিখিয়েছিল। সেই তিনটে খেলা দেখিয়ে অজিত চমকে দেয় শীলাকে।

শীলা ভারী আবাক হয়ে বলেছিল—ভারী ভাল খেলা তো! তুমি তো বেশ খেলা দেখাও!

তারপর নানা সূত্রে সে সত্যিকারের ম্যাজিসিয়ানদের কাছে যাওয়া-আসা শুরু করে। বেশ কয়েকটা স্টেজ ম্যাজিক শিখে যায়, টেবিল ম্যাজিক অনেকগুলো টপাটপ শিখে নেয়। ফলে অফিসে, পাড়ায় ম্যাজিসিয়ান হিসেবে লোক তাকে চিনে গেছে। সে পয়সার খেলা দেখায়, জ্বলন্ত সিগারেট লুকিয়ে ফেলে কোথায়, হাতের আঙুলের ফাঁকে শূন্য থেকে নিয়ে আসে পিংপং বল। একটা দুটো তিনটে। এখন তার ভাণ্ডারে ম্যাজিকের মজুদ বড় কম নয়। ম্যাজিকের দোকান ঘুরে, ম্যাজিসিয়ানদের কাছ থেকেও সে সাজসরঞ্জাম কিনেছিল অনেক। ঘণ্টাখানেক স্টেজে দেখানোর মতো স্টক তার আছে।

মাঝেমধ্যে রাত জেগে সে আয়নার সামনে বসে পামিং আর পাসিং অভ্যাস করে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনে পকেটে হাত দিয়ে কয়েন কনজিওরিং অভ্যাস করে। ভাবে, ম্যাজিকওয়ালা হয়ে গেলে কেমন হয়!

শীলা আজকাল মাঝে মাঝে বলে—তুমি আমাকে ভালবাস না।

—বাসি। নিস্পৃহ উত্তর দেয় অজিত।

—ছাই বাসো!

—কীসে বুঝলে?

শীলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—সবচেয়ে চাওয়ার জিনিসটা তোমার, তাই দিতে পারলাম না। নিস্ফলা গাছকে কে ভালবাসে বলো!

—হবে। সময় যায়নি।

—কবে আর হবে?

—মিত্র বলেছে, হবে মিত্র এশিয়ার সবচেয়ে বড় গায়নোকলজিস্টদের একজন।

—মিত্রর কথা ছাড়ো, ঘোরাচ্ছে আর টাকা বের করে নিচ্ছে। ওর দ্বারা হবে না। আমারই কোথাও দোষ আছে।

—না। কিছু দোষ নেই।

—ঠিক বলছ?

—বলছি।

অবশেষে একদিন ঋতু বন্ধ হয়ে যায় শীলার। বুক ধুকপুক করতে থাকে। একদিন দুদিন করে দিন যায়। শীলার চোখেমুখে একটা অপার্থিব আলো কোথা থেকে এসে পড়ে।

শীলা বলে—বড় ভয় করে গো!

—কেন?

—কী জানি কী হয়। আমার এমনিতেই একটু লেট ছিল।

—না, না, এ সে লেট নয়। তুমি শরীরের কোনও পরিবর্তন বুঝছ না?

—একটু একটু কিন্তু সেটা মানসিক ব্যাপারও হতে পারে।

—না, না। কাল একবার ডাক্তারের কাছে যাব।

মিত্র দেখেটেখে পরদিন বলেন—মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্সি। তবে ইউটেরস একটু বাঁকা হয়ে আছে। নড়াচড়া একদম করবেন না। নরম, খুব নরম বিছানায় দিনরাত শুয়ে থাকবেন।

আজকাল তাই থাকে শীলা। অজিত একটা চমৎকার রবারের গদি কিনে এনেছে। অনেক টাকা দাম। স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে শীলা। অজিতও অফিস কামাই করে খুব। বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসে থাকে। চোখেমুখে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।

শীলা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। নরম গদিতে সুখের শরীর ডুবিয়ে, মুখখানা অজিতের দিকে ফিরিয়ে ড্যাবা-ড্যাবা চোখে চেয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে অর্থপূর্ণ হাসি হাসে, বলে—কী গো!

অজিত বলে—কী?

—অফিস যাওনা যে বড়!

—ছুটি জমে গেছে অনেক, নিয়ে নিচ্ছি।

—কেন শুনি। কোনওদিন ছুটি নিতে দেখি না। অফিস তো তোমার প্রাণ।

—প্রাণ-ট্রাণ নয়। কাজ থাকে।

—কাজ কী তা তো জানি।

—কী?

—ফিস খেলা, আড্ডা আর ম্যাজিক।

—না, না, প্রোমোশনের পর থেকে আর ওসব হয় না।

শীলা স্বামীর প্রতি গভীর ভালবাসায় একরকম সম্মোহিত হাসি হাসে, বলে বউয়ের গন্ধ শুঁকে এত বাড়িতে বসে থাকার কী?

—গন্ধটা বেশ লাগছে আজকাল।

—বউয়ের গন্ধ? না কি অন্য কিছু?

—বউয়ের গন্ধই।

—বুঝি গো, বুঝি!

—কী বোঝো?

—বউয়ের গন্ধ নয়। অন্য একজনের গন্ধ।

অজিত নিঃশব্দে হাসে। একটু লম্বাটে মুখ অজিতের। গায়ের রং ফরসার দিকে, সাননের। দাঁত সামন্য বড়। তবু হাসলে তাকে ভারী ভাল দেখায়। মূর্ণ হয়ে চেয়ে থাকে শীলা। স্বামীকে এত ভাল বহুকাল লাগেনি।

শীলা একটা শ্বাস ফেলে বলে—বউ তো পরের মেয়ে, তার জন্য কোনও মানুষটারই বা দরদ উথলে ওঠে! আসল দরদ তো তোমার নিজের জন্য, নিজের রক্তের জন আসছে। তাই অত ছুটি নিয়ে বসে থাকা। বুঝি না বুঝি?

—তোমার জন্য দরদ নেই, এটা বুঝে গেছ? কী বুদ্ধি তোমার!

—ওসব বুঝতে বুদ্ধির দরকার হয় না। হাবাগোবাও ভালবাসাটা বোঝে।

—হবে।

শীলা মৃদু হাসতেই থাকে। বালিশে মুখ ঘষে, গদিটায় একটু দোলায় শরীর, ঠ্যাং নড়ে।

অজিত সতর্ক হয়ে ধমক দেয়—আঃ! অত নড়ো কেন? আচ্ছা চঞ্চল মেয়ে যা হোক।

শীলা গুরগুর করে হাসে, বলে—কী দরদ!

অজিত ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থাকে।

শীলা ফের বলে—কার জন্য গো, এত দরদ? এতদিন তো দেখিনি।

—বারবার এক কথা! অজিত বিরক্তির ভান করে। কিন্তু তার ভিতরে একটা টলটলে আনন্দ। নিঃশব্দে যেমন কলের তলায় চৌবাচ্চা ভরে ওঠে জলে, উপচে পড়ে—ঠিক তেমনি এক অনুভূতি, গলার কাছে একটা আবেগের দলা ঠেলা মেরে ওঠে।

শীলা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ করে বলে—সে এখন পেটের মধ্যে একটুখানি রক্তের দলা মাত্র, তবু তার কথা মনে করেই দামি গদি এল, কাজের মানুষ ছুটি নিয়ে বসে থাকল, চোয়াড়ে মুখটায় মাঝে মাঝে হাসিও ফুটছে আজকাল গোঁফের ফাঁক দিয়ে। কী ভাগ্যি আমাদের!

—একটু চুপ করে থাকবে?

শীলা নিঃশব্দে হাসে, চোখেমুখে ঝিকরিমিকরি দুষ্টুমি। একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে—পরের মেয়ের কপাল খুলল এতদিনে।

শীলাকে প্রায়দিনই স্নান করতে দেয় না অজিত। ওঠা-হাঁটা প্রায় বন্ধ। এক-আধদিন শীলা বায়না করে—আর পারি না, শুয়ে থেকে থেকে কোমর ধরে গেল। স্নান না করে শরীর জ্বর-জ্বর। একটু স্নান করতে দাও না।

অজিত আপত্তি করে। শেষ অবধি আবার নিজেই সাবধানে ধরে তোলে শীলাকে। বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বলে—আমি স্নান করব।

—এ মা! লোকে কী বলবে?

—কে দেখতে আসছে?

—রেণু রয়েছে না! ঝি হলে কী হয় সব বোঝে।

—ও বাচ্চা মেয়ে, কিছু বুঝবে না।

—না গো, বোঝে।

—বুঝুকগে, অত মাথা ঘামানোর সময় নেই। একা বাথরুমে তুমি একটা কাণ্ড বাঁধাবে, আমি জানি।

বলে বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয় অজিত। শীলা আতঙ্কে বলে—না, না, ভারী বিশ্রী দেখায়। বড্ড লজ্জা করে।

অজিতও শোনে না। শীলা তখন অগত্যা চোখ বুজে দাঁড়িয়ে লজ্জায় হাসে। অজিত তার কাপড় ছাড়িয়ে দেয়। একটু আদর করে। খুব সন্দিগ্ধের মতো শীলার পেটটা স্পর্শ করে বলে—এখনও তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না! একদম ফ্ল্যাট বেলি।

শীলা চোখ বড় বড় করে বলে—ও বাবাঃ, কী তাড়া! এখনই কী? পাঁচ-ছমাসের আগে। কিছু বুঝি বোঝা যায়।

অজিত বলে—কদিন হল যেন?

—প্রায় দেড়মাস।

অজিত শ্বাস ফেলে বলে—মাত্র!

শীলা হাসতে থাকে, বলে—তোমার বাচ্চা কি মেল ট্রেনে আসবে! সবার যেমন করে আসে তেমনই আসবে। বুঝলে?

অজিত বোঝে। যত্নে স্নান করিয়ে দেয় শীলাকে। ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে শীলার গায়ের জলে নিজেও স্নান করে। ঘরে এনে চুল আঁচড়ে দেয়। বিছানায় বসিয়ে চামচ দিয়ে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দেয়। একই পাতে খায় দুজনে। শীলা ভাজা বা মাছের টুকরো তুলে দেয় অজিতের মুখে। দুজনে পরস্পরের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসে। বড় সুখ।

রাতে শীলা ঘুমোয়। অজিতের ঘুম বড় অনিশ্চিত। তার স্নায়ুর একটা গণ্ডগোল আছে, মাঝে মাঝে সহজে ঘুম আসে না। মাথা গরম লাগে।

অন্ধকারেই উঠে টেবিল থেকে হাতড়ে রনসন গ্যাসলাইটারটা তুলে নেয়। সিগারেট ধরায়। দপ করে লাফিয়ে ওঠে চমৎকার নীলচে আগুনের শিখা। অমনি লক্ষ্মণের কথা মনে পড়ে। সেই সহৃদয় আর বুদ্ধির শ্রী মাখানো সরল মুখ। একটা ছবি পাঠিয়েছে লক্ষ্মণ। একটা প্রকাণ্ড স্ট্রিমলাইনড গাড়ি—খুব হালফ্যাশানের জিনিস, তার সামনে ওরা স্বামী-স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। বউটি ভালই দেখতে, তবে বয়সটা একটু বেশি—লক্ষ্মণেরই কাছাকাছি হবে। আর খুব লম্বা-লক্ষ্মণের সমান। লক্ষ্মণকে চেনাই যায় না ছবিতে। মোটা গোঁফ রেখেছে, বড় জুলপি, চুলও ঘাড়ের কাছে নেমে এসেছে। পরনে চেক প্যান্ট, গায়ে কোট, চোখে। রোদ-চশমা। মানাচ্ছে না লক্ষ্মণকে। মুখে খুশির হাসি। লক্ষ্মণকে কি আর চেনা যাবে না? পুরনো লক্ষ্মণ কি হারিয়েই গেল চিরকালের মতো? এরপর লক্ষ্মণের ছেলেমেয়েরা হবে, চাকরি আরও বড় হবে, কানাডায় শিকড় গেড়ে যাবে ওর। দেশে ফেরা হবে না। এবং লক্ষ্মণের পর ওর বংশধররাও হয়ে যাবে কানাডার মানুষ। তারা বাংলায় কথা বলবে না, আচরণ করবে না বাঙালির মতো, তারাও হবে ভিনদেশি। কেবল বহুকাল আগে প্রবাসে ছিটকে আসা লক্ষ্মণের পদবিটুকু স্মৃতিচিহ্নের মতো লেগে থাকবে তাদের নামের সঙ্গে। এরকম মুছে যাওয়া, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটা মানুষের পক্ষে কতখানি দুঃখের তা কি লক্ষ্মণ বোঝে না? কলকাতার লক্ষ্মণ কেন অমন বিশ্বজনীন আর আন্তর্জাতিক হয়ে গেল? কোনও চিহ্ন রেখে গেল না স্বদেশে!

বাজে চিন্তা। মাথা থেকে চিন্তাটা বের করে দেয় অজিত। দরজির আঙুলের মাথায় যে ধাতুর টুপি পরানো থাকে হাত-সেলাই করার সময়ে, তাই দিয়ে নতুন একটা খেলা শিখেছে অজিত। পাশের ঘরে আলো জ্বেলে আয়নার সামনে বসে খেলাটা অভ্যাস করতে থাকে সে। ডান হাতের আঙুল থেকে চোখের পলকে বাঁ হাতের আঙুলে নিয়ে যায় বিদ্যুৎগতিতে লুকিয়ে ফেলে হাতের তেলোয়। আবার আঙুলে তুলে আনে। আঙুলের ডগায় ডগায় মুহুর্মুহু দেখা দেয় টুপিটা। হারিয়ে যায়, আবার দেখা দেয়। দ্রুত হাতে আঙুলে বিভ্রম সৃষ্টি করে চলে অজিত। বাচ্চাটা বড় হলে হাঁ করে দেখবে বাবার কাণ্ডকারখানা। ভাবতেই চকিত একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায় মুখে। ‘বাবা’ শব্দটা কী ভয়ংকর! কী সাঙ্ঘাতিক! দু-হাতের আঙুলে নৃত্যপর ধাতুর টুপির দ্রুত ও মায়াবী বিভ্রমটি তৈরি করতে করতে সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকে একটু।

শীলা ডাকে—ওগো কোথায় গেলে?

অজিত উঠে ও-ঘরে যায়—কী হল?

—কী করছ রাত জেগে? ম্যাজিক?

—হুঁ।

—পাগলা। ঘুমোবে না?

—ঘুম আসছে না। অজিত বলে।

—কাছে এস। তোমাকে ছাড়া ভাল লাগে না। এসো শিগগির, ও ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে এস।

অজিত তাই করে।

বিছানায় এসে শীলা ঘন হয়ে লেগে থাকে গায়ের সঙ্গে। লেপের ভিতরে ওম, দুজনের শরীরের তাপ জমে ওঠে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে শীলা। আবার আলগা হয়ে উন্মুখ মুখখানা তুলে বলে—অনেক আদর করো।

অজিত আবছায়ায় স্ত্রীর মুখখানা দেখে। তার শ্বাস ঘন হয়ে আসে। দু-হাতে শীলার জলের মতো নরম শরীর চেপে ধরে। বলে—আদরখাকি!

—উসস। শীলা শব্দ করে।

—আদর খেয়ে শখ আর মেটে না তোর বউ?

শীলা করতলে চেপে ধরে তার মুখ, বলে—কথা নয়। আদর।

মুখটা সরিয়ে নিয়ে অজিত হাসে, বললে—আমি যে হাঁফিয়ে যাই! তুই যে বড় বেশি আদরখাকি!

তুমি বুড়ো।

—তুমি কচি খুকি!

শীলা আদর খেতে খেতে বলে—না না, আমাদের সবকিছু মাপমতো। বয়স-টয়স সব।

—মেড ফর ইচ আদার?

উম্‌ম্‌।

রতিক্রিয়ার পর যখন তারা তৃপ্ত ও ক্লান্ত তখন একটা সিগারেটের জন্য বুকটা বড় ফাঁকা লাগে অজিতের। বেরোতে যাচ্ছিল, শীলা জামা টেনে ধরে—কোথায় যাচ্ছ? সিগারেট?

—আগে বাথরুম। তারপর একটা সিগারেট।

উঁহু।

অজিতের সিগারেটের পিপাসা নিয়ে বসে থাকে। মেয়েদের এই বড় দোষ। স্বামীর কীসে ভাল হবে তা সময়মতো সঠিক বুঝতে পারে না, নিজের ধারণামতো চালায়। বিরক্তির সৃষ্টি করে। রতিক্রিয়ার পর এখন শীলার আকর্ষণ কিছুক্ষণের জন্য আর নেই। কেবল সিগারেটের জন্য বুকটা শূন্য। পিপাসা।

তবু অজিত মশারির বাইরে গেল না। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের ছোট টেবিল থেকে জগ এনে জল খায়, শীলাকে খাওয়ায়। এক সময়ে আস্তে করে বলে—মাকে বলে আসব। কাঁথাটাঁথা সেলাই করতে।

শীলা আঁতকে উঠে বলে—এখনই কেন?

—বুড়ো মানুষ, এখন থেকে শুরু না করলে সময়মতো হবে না।

—না, না! শীলা বলে বাচ্চা হওয়ার আগে ওসব করতে নেই।

—কেন?

—ওসব তুকতাক তুমি বুঝবে না। বেশি সাধ করলে যদি খারাপ কিছু হয়! দূর, যত সব মেয়েলি সংস্কার।

—বাচ্চা হওয়ার আগে বাচ্চার জন্য কিছু করা বারণ। ও সব করবে না। বেশি আদেখলাপানা ভাল নয়।

অজিত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—আচ্ছা।

॥ ষোলো ॥

অফিসে ফিস্ খেলা হয় রানিং জোকারে। তাস বাঁটার পর যে তাসটা চিত হয় তার পরের নম্বরটা হয় জোকার, টেক্কা পড়লে দুরি, দুরি পড়লে তিন। অজিতের কপাল ভাল। প্রতিবার সে ঠিক দুটো তিনটে জোকার পেয়ে যায়। প্রচণ্ড জেতে। প্রতি কার্ডে দশ পয়সা হিসেবে এক-একদিন আট দশ টাকা পর্যন্ত জিতে নেয়।

মাঝখানে খেলত না, আবার ইদানীং খেলে অজিত। মনটা একরকম ফুর্তিতে থাকে আজকাল। মেশিন ডিপার্টমেন্টের কুমুদ বোস বয়স্ক লোক। চেহারাখানা বিশাল, এক সময়ে গোবরবাবুর আখড়ায় বিস্তর মাটি মেখেছে। চুলে কলপ-টলপ দিয়ে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রইসবাবুর মতো থাকে সব সময়ে। বুদ্ধি কিছুটা ভোঁতা কথায় ভরপুর আদিরস। হেরে গিয়ে প্রায় দিনই বলে—ভাদুড়ি, তুমি তো শালা ম্যাজিসিয়ান।

অজিত বলে—তাতে কী?

—ম্যাজিসিয়ান মানেই হচ্ছে শাফলার।

অজিত হেসে বলে—একা আমিই তো প্রতিবার শাফল করছি না! সবাই করছে।

—তবু তুমি শালা তুকতাক জানো ঠিকই। নইলে রোজ জেতো কী করে?

—কপাল। অজিত বলে।

—কপাল না কচু। বলে গজগজ করে বোস—মুফত বসে বসে অতগুলো টাকা মাইনে পিটছ, দোহাত্তা জিতছ তাসে, তোমারটা খাবে কে হে? অ্যাঁ! এতদিনে একটা ছেলেপুলে করতে পারলে না!

—সেটাও কপাল।

—কপাল-টপাল নয়। ও সব করতে পুরুষকার চাই। তোমার সেটা নেই। কতবার তো বলেছি, যদি নিজে না পারো তো বউকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।

উলটোদিক থেকে অরুণ দত্ত ধমক দেয়—বোসদা, চুপ!

বোস বলে—ও শালা জিতবে কেন রোজ?

গোপাল মুখার্জি সিগারেটসুদ্ধ ঠোঁটে বলে—ও রোজ সেফটি রেজার দিয়ে কপাল কামায়।

বোস থমথমে মুখ করে বলে কামায়? তাই হবে। ও শালা সবই কামিয়ে ফেলেছে বোধ হয়। পুরুষকার টুরুষকার সব।

একটা হাসি ওঠে।

অজিত সিগারেটের ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে চেয়ে বলে—বোসদা, এবার আপনাদের দেখাব।

—দেখাবে মানে?

—দেখবেন। সময় হোক।

—কিছু বাঁধিয়েছ নাকি এতদিনে?

অজিত উত্তর না দিয়ে হাসে।

বোস শ্বাস ছেড়ে বলে—বুঝেছি। কিন্তু এতদিন লাগল? আমার পাঁচ-ছ’টা নেমে গেছে, গোপালের ক’টা যেন! তিনটে না? ছবছরের বিয়েতে ভাল প্রগ্রেস! অরুণ, তোর? তুই তো নিরুদ্ধবাবু, সেই কবে একটা বানিয়ে বসে আছিস, পাঁচ বছরের মধ্যে আর মুখেভাতের নেমন্তন্ন পেলুম না! করিস কী তোরা, অ্যাঁ?

—সরকারের বারণ আছে। অরুণ দত্ত জবাব দেয়।

কী একটা অশ্লীল কথা বলতে যাচ্ছিল বোস, অজিত সিগারেট ধরিয়ে লাইটারটা বোসের মুখের কাছে ধরে বলল—ফের কোনও খারাপ কথা বেরোলে ছ্যাঁকা দিয়ে দেব। চুপ!

লাইটারটা পট করে কেড়ে নেয় বোস। নেড়েচেড়ে দেখে। বলে—মাইরি কী জিনিস যে বানায় সাহেবরা! আমি সিগারেট খেলে ঠিক এটা মেরে দিতুম।

তাস বাঁটা হয়েছে। সবাই হাতের তাস সাজাচ্ছে। চিতিয়ে পড়েছে টেক্কা, অর্থাৎ রানিং জোকার হচ্ছে দুরি। এবার অজিতের প্রথম টান। সে প্যাকের তাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে, ঠোঁটে সিগারেট, চোখ কোঁচকানো, মাথার ভিতরকার যন্ত্র অটোমেশনের মতো হিসেব করে যাচ্ছে।

একটা অচেনা স্বরে কে ডাকল—অজিত!

অজিত উত্তর দিল—উঁ, কিন্তু ফিরে তাকাল না। ডাকটা তার ভিতরে পৌঁছয়নি।

অরুণ দত্ত ঠেলা দিয়ে বলে—কে ডাকছে দ্যাখ।

অজিত বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকায়। টিফিনের সময় শেষ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি করলে এখনও আর দুই রাউন্ড খেলা হতে পারে। এর মধ্যে কে আপদ জ্বালাতে এল!

অজিতের ঠোঁটে সিগারেট, তার ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা, জল। স্পষ্ট কিছু দেখতে পায় না অজিত। ঘাড়টা ঘুরিয়ে একপলক আগন্তুকের দিকে চায়। নস্যি রঙের ব্যাপার গায়ে বুড়ো একটা লোক। গ্রাম্য চেহারা। লোকটা তার চোখে একটি বিস্ময়ভরে চেয়ে আছে।

—কী চাই? অজিত জিজ্ঞেস করে।

লোকটা তার চোখে চোখ রেখে একটু স্তম্ভিতভাবে চেয়েই থাকে। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে—আমার পলিসিটার ব্যাপারে এসেছিলাম। তুমি ব্যস্ত থাকলে…

অজিত হঠাৎ লোকটাকে চিনতে পারে। ব্রজগোপাল লাহিড়ি, তার শ্বশুর। সিগারেটটা টপ করে নামায় সে।

—ওঃ! বলে শশ্যব্যস্তে উঠে পড়ে। আশেপাশে চেয়ার টেনে বসে যারা খেলা দেখছিল তাদের একজনের হাতে নিজের তাসটা ধরিয়ে দিয়ে আসর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

শ্বশুরমশাই এই অবস্থায় তাকে দেখে ফেলেছেন বলে অজিতের একটু লজ্জা করে। অফিসে বসে তাসটাস খেলা এ নোক যে ভাল চোখে দেখে না, এ তো জানা কথাই। তার ওপর পয়সার খেলা। ভাগ্যিস নগদ পয়সার খেলা হয় না! খাতায় হিসেব লেখা থাকে, মাসের শেষে পেমেন্ট হয়। তবু অস্বস্তি বোধ করে অজিত। এ লোকটার সামনে সে বরাবর এক অনির্দিষ্ট কারণে অস্বস্তি বোধ করেছে।

বহু দিন পর দেখা, একটা প্রণাম করা উচিত হবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিল না অজিত। অফিসের মধ্যে অবশ্য লজ্জাও করে।

দুধারে সার বেঁধে আই-বি-এম মেশিনগুলি চলছে। অনুচ্চ মৃদু শব্দ, কিন্তু অনেকগুলো মেশিনের শব্দ একসঙ্গে হচ্ছে বলে ঘর ভরে আছে শব্দে। তাসের মতো কার্ডুগুলি রোলালের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে অনায়াসে, পড়ছে বিভিন্ন খোপে৷ ঠিক তাদের মতোই মেশিনগুলি তাস শাফল করছে, বাঁটছে। টিফিনের সময়ে মেশিন চলে না। কিন্তু এখন কমিশনের সময় বলে চলছে। কিছু লোক কাজ এগিয়ে রাখে। বিস্ময়ভরে ব্রজগোপাল যন্ত্রগুলির দিকে চেয়ে থাকেন একটু। ব্রজগোপালের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রণেন। পরনে চমৎকার কাঠকয়লা রঙের স্যুট, চওড়া মেরুন টাই, গালে পানের ঢিবি। হাবাগঙ্গারাম! শ্বশুরমশাইকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে রণেনই এসে ডেকে নিতে পারত অজিতকে, তা হলে আর অজিতকে ওই অবস্থায় দেখতেন না উনি।

রণেন এগিয়ে এসে বলে—অজিত, চেকটা?

বিরক্তি চেপে অজিত বলে—ডিসচার্জ ফর্মটা জমা দিয়েছ কবে?

—একমাস তো হবেই।

অজিত চিন্তিতভাবে বলে—এতদিনে চেক তো রেজিস্টার্ড পোস্টে চলে যাওয়ার কথা তোমাদের বাড়িতে।

—যায়নি।

অজিত একটু হেসে বলে—সরকারের ঘর থেকে টাকা বের করার কিছু পেরাসনী তো আছেই। সাধারণত ফর্ম জমা দেওয়ার মাস দুই তিন পর চেক যায়। আমি বলে রেখেছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।

ব্রজগোপাল আই-বি-এম মেশিনের কার্ড বিলির চমৎকার নিপুণতা লক্ষ করে মেশিন থেকে চোখ তুলে তাঁর বড় জামাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন—একটু খোঁজ নিও। কোনও জায়গায় আজকাল আর কাজকর্ম তাড়াতাড়ি হয় না।

—আজই খোঁজ নিচ্ছি। হয়তো আজকালের মধ্যেই চেক চলে যাবে। আপনি এখন কয়েকদিন কলকাতায় থেকে যান।

ব্রজগোপাল তার দিকে চেয়ে থাকেন একটু। তাঁর চোখের বিস্ময় ভাবটা এখনও যায়নি। বললেন—আমি তো কলকাতায় থাকতে পারব না। তবে যদি বলো তো আবার কাল-পরশু আসতে পারি।

—অত ছোটাছুটির দরকার নেই। অজিত সহানুভূতির সঙ্গে বলে—রেজিষ্ট্রি চিঠির খবর পেলে আপনি পরে এসে রিসিভ করে চেক ব্যাঙ্কে জমা দিলেই চলবে। রেজিষ্ট্রি চিঠি পোস্ট অফিসে দিন-সাতেক ধরে রাখবে।

ব্যাপারটা অত সহজ তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না ব্রজগোপালের। বলেন—আর কোনও সইসাবুদ বা সাক্ষির দরকার নেই তো?

—না, না।

ব্রজগোপাল রণেনের দিকে চেয়ে বললেন—তা হলে তো হয়েই গেল। চিঠি এলে তোমরা আমাকে খবর দিয়ে।

বলে ব্রজগোপাল দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন—তোমরা সব ভাল আছ তো?

প্রশ্নটা অজিতকে করা। সে পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলে—ভালই। আপনার শরীর খারাপ শুনেছিলাম।

—শরীরমুখী চিন্তা কখনও করি না। কাজকর্ম নিয়ে থাকি, ভালই আছি।

—কী একটা বুকের ব্যথার কথা শুনেছিলাম।

—হয় বটে মাঝেমধ্যে একটা। সেরেও যায়। আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠি ক্ষেতখামার করি।

—এই বয়সে একটু বিশ্রাম দরকার।

—বিশ্রাম মানে তো শুয়ে বসে থাকা নয়। বিশ্রাম হচ্ছে এক বিশেষ রকমের শ্রম। কোনও কোনও কাজই আছে যা ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।

অজিত এ বাবদে আর কথা বলতে ভরসা পান না।

সিঁড়ি বেয়ে ব্রজগোপাল লবিতে আসেন। রণেন বাধ্য ছেলের মতো ব্রজগোপালের পায়ে পায়ে হাঁটছে। তার মুখে অন্যমনস্কতা, আর বিষাদ, জমিটার ব্যাপারে আর কোনও কথা বলতে আসেনি রণেন। কথা ছিল, ও বউয়ের নামে জমিটা কিনবে। এখনকার নামে যে লক্ষ্মণের জমিটা কেনা হবে তা সঠিক বুঝতে পারছে না অজিত।

ব্রজগোপাল লবি পার হয়ে পেভমেন্টে নেমে দাঁড়ালেন। বললেন—অজিত, তুমি ফিরে যাও বরং। কাজের ক্ষতি হচ্ছে।

কাজ বলতে ব্রজগোপাল কী বোঝাচ্ছেন তা বুঝতে পারে না অজিত। উনি তাকে তাস খেলতে দেখেছেন। বলা যায় না, কুমুদ বোসের দু-একটা রসিকতাও হয়তো কানে গিয়ে থাকবে। তাস খেলাটাকেই ‘কাজ’ বলে ঠাট্টা করছেন নাকি? অবশ্য ঠাট্টা করার লোক নন।

অজিত বলে—না, ক্ষতি হবে না। এইটুকুতে কী আর ক্ষতি?

—তবু তুমি তো ইনচার্জ। তুমি ফাঁকি দিলে কর্মচারীরাও ফাঁকিই শিখবে।

অজিত হেসে বলে—টিফিন শেষ হতে এখনও কিছু বাকি আছে।

—ও।

অজিত কবজির ঘড়িটা আড়চোখে দেখে নেয়। টিফিনের টাইমটা হড়কে গেল। শেষ কয়েকটা ডিল খেলা গেল না। খুব জমেছিল আজ। শ্বশুরের দিকে চেয়ে বলল—আমাদের বাসায় তো আসেন না।

—দূরে থাকি। সময় পাই না। দুর্বল অজুহাত দেন ব্রজগোপাল।

—আপনার মেয়ে আপনার কথা খুব বলে।

—হুঁ! বলে ব্রজগোপাল একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান। ছেলেমেয়েরা তাঁর কথা বলে এটা যেন ঠিক তার বিশ্বাস হতে চায় না।

—একদিন যাব গোবিন্দপুরে। অজিত বলল।

ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ফেলে জামাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। বিশ্বাস করেন না, তিনি কলকাতার লোকের মুখের কথা বিশ্বাস করেন না। তবু মাথা নেড়ে বললেন—যেয়ো। জায়গাটা ভালই লাগবে।

একটু অন্যমনস্ক রইলেন ব্রজগোপাল। পেভমেন্টে গা ঘেঁষে অচেনা লোকেরা চলে যাচ্ছে। হাজার লোকের ভিড়ে এক অদ্ভুত অন্যমনস্কতাবশত তিনি বললেন—শীলার মুখটা ভুলেই গেছি। কতকাল দেখি না।

—আজই তো যেতে পারেন বাসায়, শীলা ভীষণ খুশি হবে।

ব্রজগোপাল জামাইয়ের মুখে মেয়ের নাম শুনে বোধ হয় একটু বিরক্ত হন। অজিত লক্ষ করে। ব্রজগোপাল বললেন—আগে প্রথা ছিল ছেলেপুলে না হলে মেয়ের বাড়িতে তার বাপ-মা যায় না।

অজিত সামান্য হাসে। ছেলেপুলে না হলে—কথা লক্ষ্য করেই হাস্য। বলল—ওসব তো প্রাচীন সংস্কার। না মানলেই হল।

ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—সংস্কারটা ভাল না মন্দ তা না জেনে ভাঙতে আমার ইচ্ছে করে না। তার দরকারই বা কী! আমরা বুড়ো হয়েছি, সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব না হতে পারে। তোমরা যেয়ো।

—যাব।

রণেন একটু এগিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। একটা খালি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ডাকল—বাবা, আসুন।

ব্রজগোপাল বিরক্তির স্বরে বললেন—ট্যাক্সি নিলে নাকি?

—হ্যাঁ। রণেন কুণ্ঠিত ভাব দেখায়।

—কেন?

—এ সময়টায় বড্ড ভিড়। ট্রামে বাসে ওঠা যায় না।

—ভিড় হলেও তো লোকে যাচ্ছে আসছে! আমাদের বাবুগিরির কী দরকার?

ট্যাক্সিটা ছেড়ে যেতে অজিত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আজ টিফিন খায়নি। খিদে পেয়েছে।

কিছু খাবে বলে ফুটপাথের হরেক টিফিনওয়ালাদের দিকে কয়েক কদম এগিয়েও গিয়েছিল সে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, শীলা বলেছিল ভাল চকোলেট নিয়ে যেতে। আর ঝাল আচার। আর চানাচুর। এই প্রথম শীলা এসব খেতে চাইছে। তার অর্থ, প্রেগন্যান্সির কোনও গোলমাল নেই।

ছোরার মারের মতো একটা তীক্ষ্ণ ও তীব্র আনন্দ বুক ছুঁড়ে দেয় হঠাৎ। এত তীব্র সেই আনন্দের অনুভূতি যে অজিতের শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, হাত পায়ে রিমঝিম করে একটা ঝিঁঝি ছাড়ার মতো হতে থাকে।

অজিত অফিসের সিঁড়ি ভেঙে উঠে যায়।

আই-বি-এম মেশিনগুলি সঙ্গমকালীন সুখের শব্দ তুলে চলছে। মেশিনগুলির পাশ দিয়ে হালকা পায়ে চলে যায় অজিত। অফিসার সেনগুপ্তর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

—সেনদা!

উঁ। বলে সেনগুপ্ত মুখটা তোলেন। হাসেন।

—আজ চলে যাচ্ছি।

—কী একটা খবর শুনছি!

—কী?

কুমুদ বোস বলে গেল। বউমার নাকি—

অজিত দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলে—একদিন বোসটাকে ঠ্যাঙাব সেনদা।

—মুখটা খারাপ, নইলে লোকটা খারাপ না। বলছিল—

—কী বলছিল?

—বলছিল, ম্যাজিসিয়ানের সব বিফলে যাচ্ছিল, আসল ম্যাজিকটা এতদিন দেখাতে পারছিল না। বউয়ের পেটে দুনিয়ার সবচেয়ে আশ্চর্য ম্যাজিকটা দেখাতে না পারলে নাকি সব বৃথা। বলে সেনগুপ্ত মোটা শরীরে দুলে দুলে হাসেন—সেটা এতদিনে দেখিয়েছে ম্যাজিসিয়ান।

—এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। সেনদা, আজ যাচ্ছি।

—যাও। কিন্তু আমার পড়ার স্কুলে একটা চ্যারিটি শো দিতে হবে, মনে থাকে যেন। বিনা পয়সায়।

—আমার তো টেবিল-ম্যাজিক। শো দিতে অ্যাপারেটাস লাগে।

—ওসব শুনছি না। আমি কথা দিয়ে রেখেছি। ফান্ডের অভাবে স্কুলটা উঠে যাবে হে৷ আমি সেক্রেটারি হয়ে বসে বসে দেখব?

—আচ্ছা।

অজিত অফিস থেকে বেরোবার আগে আর একবার আই-বি-এম মেশিনগুলির সামনে দাঁড়ায়। কতকাল ধরে এই সব মেশিন সে ঘাঁটছে। একঘেয়ে সব শব্দ। কিন্তু আজ শব্দটা অন্য রকম শোনায়। রতিক্রিয়াকালে শ্বাসবায়ুর মুখের শব্দ, দাঁত ঘষার শব্দ, চুম্বনের শব্দ—সব মিলেমিশে একটা তীব্র কম্পন উঠছে। অজিতের বুক এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে একটা আনন্দ ছোরা মারে আবার। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শরীর চমকায়।

প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসে অজিত। ক্যাডবেরি কেনে, আচার কেনে, চানাচুর কেনে। গ্র্যান্ট স্ট্রিট থেকে কিছু না ভেবে একটা শাড়িও কিনে ফেলে হঠাৎ। টাকা উড়িয়ে দেয়।

এই দুপুরের নির্জনে সে বাড়ি ফিরে কী লিপ্সায়, কী কাতরতায় শীলাকে মিশিয়ে ফেলবে নিজের সঙ্গে। তীব্রতায় সে প্রবেশ করবে শীলার অভ্যন্তরে! শীলা ভীষণ—ভীষণ—ভীষণ—সুখে, লজ্জায়, হাসিতে একাকার হয়ে যাবে তার সঙ্গে!

শীলা হারিয়ে গিয়েছিল। কতকাল অজিতের জীবনে শীলা প্রায় ছিলই না। আবার হঠাৎ কবে শীলা পরিপূর্ণ বউ হয়ে গেল!

ধৈর্যহারা অজিত অস্থির হয়ে ধর্মতলা থেকে ট্যাক্সি ধরল। বলল—জোরে চালান ভাই! জোরে—

॥ সতেরো ॥

ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা। সারাটা দিন যখন শীলা একা, তখনই ভূতে ধরে তাকে। ভূতের ঢিল এসে পড়ে মাথার ভিতরের নিথরতায়। সারাদিন শুয়ে আর বসে সময় কাটে না। দিনটা কেবলই লম্বা হতে থাকে। মাঝে মাঝে অজিত অফিস কামাই করলে তবু এরকম কেটে যায় সময়। কিন্তু আদর ভালবাসা যখন শেষ হয় রতিক্রিয়ায়, তারপর ক্লান্তি আসে, কথা ফুরোয়, টান করে বাঁধা তার হঠাৎ ঢিলে হয়ে বেসুর বাজতে থাকে। বহুদিন শীলা এমন ভালবাসা পায়নি অজিতের কাছ থেকে। আবার বহুকাল ধরে সে নিজেও ভালবাসেনি এত অজিতকে। তবু দিনটা কাটতে চায় না। একা বা দুজন।

একা থাকাটা আরও ভয়ংকর। এখন ইস্কুলে পরীক্ষার সময়। এ সময়ে দু-একটা বেশি ক্লাস নিতে হয়, কোচিং থাকে। মেয়েদের ইস্কুলের নিয়মে বড় কড়াকড়ি। সাড়ে চারটে পর্যন্ত দম ফেলার সময় থাকে না। কিন্তু সেই ব্যস্ততা শীলার বড় ভাল লাগে। নিজেকে ভারী গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে মনে হয়। ফাঁকে ফাঁকে টিচার্স রুমের আড্ডাটি! খুব ব্যস্ততার মধ্যে দু-পাঁচ মিনিটের চুরি করা আড্ডা যা ঝলমলে করে দেয় মনটাকে।

ইস্কুলের জন্য মনটা বড় উন্মুখ হয়ে থাকে শীলার। কলকাতার শীতের দুপুরের মতো এমন সুন্দর সময় আর কি হয়! এমন দুপুরে ঘরে পড়ে থাকার মতো শাস্তি আর কী হতে পারে? নির্জনতা জিনিসটা কোনওদিনই সইতে পারে না সে। তার ভাল লাগে রাস্তাঘাট, মানুষজন, আলো ঝলমলে চারধার। ভাল লাগে ক্লাসভরতি ছাত্রী, টিচার্স রুমের জমজমাট কথার শব্দ। আর ভাল লাগে কাজ। সংসারের কাজ তার দুচোখের বিষ। কোনও কোনও মেয়ে থাকে যারা সংসারে ঢুকে, মধুর মধ্যে যেমন মাছি আটকে যায়, তেমনি আটকে থাকে। যেমন মা। ঘরসংসারে অমন আকণ্ঠ ডুবে-থাকা মানুষ কমই দেখেছে শীলা। সারা দুপুর মা জেগে থেকে টুকটাক কাজ করছে তো করছেই। কোনও কাজ না পেলে ঝিয়ের মেজে যাওয়া বাসনে কোন কোণে একটু ছাইয়ের দাগ লেগে আছে ব্লেড দিয়ে ঘষে ঘষে তাই তুলবে, আর আপনমনে বকতে থাকবে—ইস, কী নোংরা কাজ! বাপের জন্মে এমন নোংরা কাজ করতে কাউকে দেখিনি। সারা দুপুর রেশনের গম ঝাড়বে কুলোয়, চাল বাছবে, নইলে ফেরিঅলা ডেকে সংসারের জিনিস কিনবে দরদস্তুর করে। ওরকম জীবনের কথা শীলা ভাবতেও পারে না। তার নিজের সংসারটা পড়ে থাকে বাচ্চা ঝিয়ের হাতে। ছাড়া শাড়িটাও শীলাকে ধুতে হয় না, রান্নাবান্না থেকে যাবতীয় কাজ করে দেয় ঝিটা। রান্নায় কখনও কখনও গোলমাল করে। ঘরদোর খুব পরিষ্কার রাখে না, কাজ ফাঁকি দিয়ে পড়ে ঘুমোয়, কিন্তু তবু সংসারটা চলে ঠিকই। কিছু তেমন অসুবিধে বোধ হয় না।

অবশ্য এই ইস্কুল করা বা বাপের বাড়ি মাঝে মাঝে যাওয়া বা একটু দোকান পশার করা—এ ছাড়া শীলাও কি ঘরবন্দি নয়? অজিতের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার ধাতই নেই। বড় ঘরকুনো লোক। প্রচণ্ড আলসে। সারাদিন ঘর আর বারান্দা করে, সিগারেট খেয়ে কাটিয়ে দেবে, ছুটির দিনে রাস্তাঘাটে হাঁটতেও চায় না, বলে—যা ভিড়, আর রাস্তাঘাটের যা বিচ্ছিরি অবস্থা! এই লোকটার সঙ্গে থেকে শীলার বেড়ানোর শখ-আহ্লাদ চুলোয় গেছে।

যে যেমন চায় সে তেমন পায় না কখনও। যেমন তার ছোট বোন ইলা। ঠিক মায়ের স্বভাব পেয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই ঘরের কোণে বসে একমনে বিভোর হয়ে পুতুল খেলত, ছাদে যেত না, সঙ্গী-সাথীর সঙ্গে খেলতে তেমন ভালবাসত না। বড় হয়ে মার সঙ্গে ঘুরঘুর করে ঘরের কাজ করত। বিছানা তোলা বা পাড়া, টুকটাক একটু রান্না নামানো চড়ানো, শুকনো কাপড় গুছিয়ে রাখা, ধোপার হিসেব, সংসারের হিসেব রাখা। বিয়ে হল একটা উজ্জ্বল স্মার্ট ছেলের সঙ্গে। মুম্বইতে চাকরি করে। হুল্লোড়বাজ ছেলে। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে ভাল লাগে না বলে কলকাতার সরকারি চাকরি ছেড়ে মুম্বইতে একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি নিয়ে চলে গেল। সেখানে খুব আউটডোরে যায়। দিল্লি মাদ্রাজ করে প্রায়ই। সব সময়ে ঝুঁকি নিতে ভালবাসে। ঘরের জীবনের চেয়ে বাইরের জীবনটা ওর বড় প্রিয়। ইলাকে প্রায়ই ধমকায়, বলে—রোজ রান্নাবান্নার কী দরকার? সপ্তাহে দু-তিন দিন হোটেলে খেলেই হয়!

অমল আর ইলা বছর তিনেক আগে একবার এসেছিল। তখনই অমল দুঃখ করে বলেছিল শীলাকে—শীলাদি, আপনার বোনটি একদম ইনডোর গেম।

—কেন?

—বেরোতেই চায় না মোটে। সারাদিন কেবল ঘর সাজাবে আর গুচ্ছের খাবার-দাবার তৈরি করবে। আমাদের মতো ছেলে-ছোকরার কি ঘরে এসে বসে খুনসুটি ভাল লাগে! বলুন! আমি ওকে প্রায়ই বলি, চলো দুজনে মিলে হিপি হয়ে যাই। শুনেই ও ভয় খায়।

শীলা দীর্ঘশ্বাস চেপে হেসে বলেছে—আর আমার শিবঠাকুরটি হচ্ছে উলটো। ব্যোম বাবা ভোলানাথ হয়ে ঘরে অধিষ্ঠান করবেন। কলকাতা শহরের বারো আনা জায়গাই এখনও চেনেন না। কেবল অফিসের পরে আড্ডাটি আছে, আর কোনও শখ আহ্লাদ নেই। আমার যে বাইরে বেরোতে কী ভাল লাগে!

অমল বড় মুখ-পলকা ছেলে, দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে কথা বলে না। ফস করে বলে বসেছিল—ইস শীলাদি, ইলার বদলে আপনার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হত!

শীলা মুখ লুকোতে পথ পায় না। বুকের মধ্যে গুরুগুরুনি উঠে গেল তখনই। সবশেষে খুব হেসেছিল।

ইলা ধমক দিয়ে বলল—দিদি গুরুজন না! ও কী রকম কথা!

অমল অবাক হয়ে বলে—তাতে কী হল! সম্পর্ক তো ঠাট্টারই।

কথাটা ঘোরানোর জন্য শীলা বলে—তা তুই-ই বা ওর সঙ্গে বেরোস না কেন?

—আমি অত ঘুরতে পারি না। গাড়ি-ঘোড়ায় বেশিক্ষণ কাটাতে বিশ্রি লাগে। হোটেলে আমি বড্ড আনইজি ফিল করি। তা ছাড়া নতুন নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে, সেখানে পা দিয়ে বিশ্রামটুকুও করতে দেবে না। চলো, সমুদ্রে স্নান করে আসি। চলো পাহাড়ে উঠি। জায়গাটা দেখে আসি চলো। আমার দমে কুলোয় না।

—তোমার লাইফ সোর্স কম। শীলাদিকে দেখো, চোখেমুখে আর শরীরে টগবগ করছে জীবনীশক্তি। শুনে শীলা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। বলেই অমল শীলার দিকে ফিরে বলে—জানেন শীলাদি, ঘুরব বেড়াব ফুর্তি করব বলে বাচ্চাকাচ্চা হতে দিইনি এতকাল। কোম্পানি থেকে ইয়োরোপের মার্কেট যাচাই করতে পাঠাবে বলছে, ভাবছিলাম ইলার ভিসাটাও করিয়ে নেব। কিন্তু এই আলুসেদ্ধ মার্কা মহিলাকে নিয়ে গিয়ে ঝামেলা ছাড়া কিছু হবে না, সাহেবসুবোর জায়গা—আমি চোখের আড়াল হলেই হয়তো ভয়ে কাঁদতে বসবে।

ইলা মুখ ঝামড়ে বলে—যেতে আমার বয়ে গেছে!

অমল শীলার দিকেই চেয়ে ছিল, দুঃখ করে বলল—ভেবে দেখলাম, বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করতেই ওর জন্ম হয়েছে। তাই ভাবছি এবার মুম্বই গিয়েই বাচ্চার ব্যবস্থা করে ফেলব।

সে কী লজ্জা পেয়েছিল শীলা! অমলের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলার ওই হচ্ছে মুশকিল। গনগনে অ্যাগ্রেসিভ চঞ্চল, প্রাণপ্রাচুর্য ভরা ছেলে। কোনও কথাই বলতে মুখে আটকায় না। কিন্তু ওকে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। বুক গুর গুর করে। দমকা বাতাসের মতো মনের দরজা জানালার খিল নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

সংসারে ঠিক এরকমই হয়। যা চাওয়া যায় তার উলটোটি বরাতে জোটে।

মনের ভিতরে কত পাপের বাসা। বলতে নেই, শীলার এক-এক সময়ে মনে হয়েছে, অমলের সঙ্গে তার বিয়ে হলে মন্দ হত না। দমকা বাতাসের সঙ্গে খড়কুটোর মতো উড়ে বেড়াতে পারত। কলকাতা ছাড়া আর কোথায়ই বা তেমন গেছে শীলা। অনেক বলেকয়ে একবার পুরী গিয়েছিল একবার দার্জিলিং আর কাছেপিঠে দু-একটা জায়গায়। ইস্কুলের স্টাফ সবাই মিলে বছরে দুবছরে এক-আধবার ডায়মন্ডহারবার বা কল্যাণীতে গেছে পিকনিক করতে, একবার স্টিমার পার্টিতেও গিয়েছিল অজিতের অফিস স্টাফের সঙ্গে। কিন্তু বিশাল ব্যাপ্ত পৃথিবীতে এ তো চৌকাঠ পেরনোও নয়। আর ইয়োরোপ ওদিকে হাত বাড়িয়ে আছে ইলার দরজায়, ইলা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গতবার ওর ছেলে হল, কলকাতা থেকে ওর শ্বশুর গিয়ে ইলাকে আগলাচ্ছে। অমল গত সেপ্টেম্বরে চলে গেছে ইয়োরোপে। বড় কষ্ট হয় শীলার। ইলুটা বড্ড বোকা।

ঘরবন্দি থাকা মানে একরকম মরে যাওয়া। সে তাই বিয়ের পরই চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ওঠে। তার শ্বশুরবাড়ি বড্ড সেকেলে, মেয়ে-বউদের চাকরি কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু ওই বড় সংসারে জবরজং আটকে থাকার হাত থেকে মুক্তি পেতেই শীলা চাকরিটা জোগাড় করেছিল অতি কষ্টে। ওই চাকরিই তার শ্বশুরবাড়ির বদ্ধ সংসারে হাওয়া বাতাসের কাজ করেছে। নইলে সে মনে মনে মরে থাকত এতদিনে। সেই চাকরি থেকেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে গণ্ডগোলের সূত্রপাত। কিন্তু চাকরি ছাড়েনি শীলা। তার জেদ বড় মারাত্মক।

তার চাকরির টাকা জমে জমেই জমির দামটা হয়ে গেল, তার সঙ্গে অজিতের সঞ্চয়, আর কিছু ধারকর্জ করে বাড়িটা উঠে গেল অনায়াসে। অজিতের একার রোজগার হলে হত নাকি এত সহজে? তাই শীলার একটা চাপা অহংকার আছে বাড়িটা নিয়ে। একটা মস্ত অভাব ছিল, সন্তান। তাও বোধ হয়… না, বলতে নেই। আগে হোক। কত দুষ্ট লোক নজর দেয়, বাণ মারে, ওষুধ করে।

শরীরের ভিতরে একটা প্রাণ, একটা শরীর। এখনও হয়তো একটা রক্তের দলা মাত্র। সেই দলাটা শীলার শরীর শুষে নেয় ধীরে ধীরে, টেনে নেয়, অস্থি-মজ্জা-মাংস। কে এক রহস্যময় কারিগর তৈরি করে চলেছে এক আশ্চর্য পুতুল তার শরীরের ভিতরে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়, কুলপ্লাবী এক অসহ্য আনন্দের ঢেউঁ গলা পর্যন্ত উঠে এসে দম বন্ধ করে দেয়। ডাক্তার বার বার সাবধান করে দিয়েছে—নড়াচাড়া একদম বারণ, একটু দোষ আছে শরীরে। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পাঁচ মাস ধৈর্য ধরে থাকতেই হবে। তারপর তার তেমন ভয় নেই।

কিন্তু পাঁচটা মাস কি শীলার কাছে কম। এই সুন্দর শীতের দুপুর বয়ে যায় নিরর্থক। সে ঘরের বাইরে পা দিতে পারে না। উল বুনতে বুনতে চোখ ব্যথা করে, দুহাতের আঙুল অসাড় হয়ে আসে। সকালের খবরের কাগজটা কতবার যে উলটোলটে পড়ে সে! মোটা মোটা গল্পের বই শেষ করে। সিনেমার মাসিক কাগজ উলটেপালটে দেখে। তবু সময় ফুরোয় না। বই পড়তে একনাগাড়ে ভালও লাগে না। কিন্তু শরীরের ভিতরে আর একটা শরীরের কথা ভেবে সয়ে যায়। কী নাম হবে রে তোর, ও দুষ্ট ছেলে? খুব জ্বালাবি মাকে? নাম কামড়ে ধরবি, চুল টেনে ধরবি, মাঝরাতে কেঁদে উঠে খুজবি মাকে?…না, না, ভাবতে নেই। আগে হোক। ভালয় ভালয় আগে আসুক কোলজুড়ে।…হতে গিয়ে খুব কষ্ট দিবি না তো মাকে? লক্ষ্মী সোনা ছেলে, কষ্ট হয় হোক আমার, তোর যেন ব্যথাটি না লাগে। কেমন ঝামরে আদর করব! মুখে মুখ দিয়ে পড়ে থাকব সারাদিন। নিজের পেটে আলতো হাত দুখানা রেখে শীলা শুয়ে থাকে। বুক ভরে যায়।

কিন্তু তবু, ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।

এই শীতকালে দুপুরেই রোদে একটা ধানি রং ধরে যায়। কোমল ঠান্ডা বাতাস দেয় টেনে। গায়ে একটা স্টোল বা স্কার্ফ জড়িয়ে ধীরে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে এখন বড় ভাল লাগে। শীত তার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। তার দিনে রাতে, তার কুয়াশায় ঢাকা মায়াবী আবহে, তার ফুলে ও ফসলে একটা দারিদ্র ঘুচে যাওয়া প্রাচুর্যের চেহারা আছে। আর থাকে রহস্য, ওম্‌। পরীক্ষা শেষ হলে শীতকালে ইস্কুলের বারান্দায় কখনও কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে মিষ্টি গন্ধে বুক ভরে ওঠে। খাতা দেখার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা। মেয়েরা যখন কথা বলে তখন সবাই একসঙ্গে বলে, কেউ কারও কথা শোনে না। একজন তার ঝিয়ের গল্প শুরু করতেই অন্যজনও তার ঝিয়ের গল্প শুরু করে দেয়, একজন নিজের ভাইয়ের বিয়ের গল্প ফেঁদে বসতেই অন্যজন তার কথার মাঝখানেই নিজের ননদের প্রসঙ্গ এনে ফেলে। আর ঠিক কথার মাঝখানে তুচ্ছ কারণে সবাই কেবল হাসতে থাকে। এক-এক সময়ে মেয়েরা নিজেরাও ভাবে—ইস্‌, আমরা কী সব ছোট্টখাট্ট বিষয় নিয়ে কথা বলি—ঝি, গয়না, শাড়ি, বিয়ে! ভাবে আবার বলেও আর কেবলই হাসতে থাকে। তুচ্ছ তুচ্ছ সব কারণে, বহুবার শোনা কথা আবার শুনে, কিংবা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাসি পায় বলে কেবলই হেসে যায় তারা।

শীতের দুপুরটার জন্য মন বড় ছটফট করে শীলার, ঘরে বসে থেকে থেকে সে কেবলই দেখে, দিন পুড়ে কালো হয়ে অন্ধকার নেমে আসছে। ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল কোথায়, ছেলেদের হল্লা কানে আসে। মনটা একটা ছবিহীন শূন্য চৌকো ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকে। সামান্য এই কারণে চোখে জল এসে যায়।

তাই ঠিক দুক্কুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা।

আজকাল অবশ্য অজিত মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। কোনওদিন বা অফিস কামাইও করে। কিন্তু বড্ড নির্জীব পুরুষ। হঠাৎ উত্তেজনা বশত প্রচণ্ড আদর করতে থাকে, হাঁটকে-মাটকে একশা করে শীলাকে। এবং তারপর তারা পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। তারপরই অজিত অন্যরকম হয়ে যেতে থাকে। একটু বুঝি দূরের মানুষ হয়ে যায়। কথা বলে, আদরও করে, কিন্তু জোয়ারটা থাকে না। হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে, সিগারেট ধরিয়ে ছাদে বারান্দায় যায়। কিংবা আপনমনে ম্যাজিকের স্যুটকেস খুলে সরঞ্জাম বের করে আনে। আপনমনে পাসিং আর পাসিং অভ্যেস করে। করে কয়েন কনজিওরিং, কাপস অ্যান্ড বলসের খেলা অভ্যেস করতে থাকে। দু-চারটে স্কুল শোতেও আজকাল ম্যাজিক দেখায় অজিত। কিন্তু যাই করুক শীলা যে একা সেই একা। যেদিন অজিত থাকে না সেদিন শীলার বুকের ওপর সময়ের ভার হাতির পায়ের মতো চেপে থাকে। পাঁচ মাস! ওমা গো! ভাবাই যায় না।

কখনও কখনও আবার পেটের ওপর হাত দুখানা রাখে শীলা। কিছুই টের পাওয়া যায় ওপর থেকে। তবু শীলার হাত যেন ঠিক সেই রক্তের দলার ভিতরে অশ্রুত হৃৎস্পন্দন শুনতে পায়। সেই রক্তের পিণ্ডের ভিতরে বান ডাকে, অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসে স্পন্দন। শীলা টের পায়। ও ছেলে, কেমন হবে রে তোর মুখখানা? কার মতো?…না, না, থাক, ভাবতে নেই। শীলা ফের হাত সরিয়ে নেয়।

কিন্তু ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।

ইস্কুলটা খুব বেশি দূরে নয়। বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যেতে লাগে, অজিতের সাত মিনিট, শীলার দশ মিনিট। সেখান থেকে উলটোবাগের ট্রাম ধরলে ঠিক দুটো স্টপ। স্টপ থেকে মোটে তিন-চার মিনিটের রাস্তা। তবে গলিঘুজি দিয়ে একটা শর্টকাট আছে। সে রাস্তাটা ভাল নয়, কিন্তু রিকশা যায়। এক-এক দিন শীলার খুব ইচ্ছে করে, অজিত বেরিয়ে গেলে, চুপি চুপি উঠে সামান্য একটু প্রসাধন করে বেরিয়ে পড়ে। রিকশাঅলাকে বলবে—ভাই খুব ধীরে ধীরে যাবে। বারো আনা ভাড়ার জায়গায় আমি তোমাকে না হয় একটা টাকা দেব। গর্তটর্ত বাঁচিয়ে যেয়ো, যেন ঝাঁকুনি না লাগে।

আবার তখন একটা ভয়ও করে।

ডাক্তাররা যা বলে তার অবশ্য সব সত্যি হয় না। রুগিকে বেশি ভয় দেখিয়ে অনেক সময়েই ওরা একটা বাড়াবাড়ি চিকিৎসা চালায়। ডাক্তারদের সব কথা শুনতে নেই। অন্য কিছু হলে অবশ্য শুনতও না শীলা। কিন্তু সন্তান বলে কথা। বিয়ের পর এতকাল তারা দুজনে যার পদধ্বনির জন্য কান পেতে ছিল সেই রাজাধিরাজ আসছে। সোজা লোক তো নয় সে। দুষ্টু ছেলে, মাকে যে কী কষ্টে ফেলেছিস! তোর জন্য দ্যাখতো কেমন ঘরবন্দি আমি! হোক, তবু তোর যেন কিছু না হয়।

কিন্তু ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।

দুপুরবেলায় শীলা তার সেলাই রেখে একটা শ্বাস ফেলে উঠল। আজ একবার যাবে ইস্কুলে। কিছু হবে না। ডাক্তারদের সবতাতেই বাড়াবাড়ি।

॥ আঠারো ॥

কিন্তু ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারল ঢেলা।

ভূতের ঢেলাগুলোই ঘরে টিকতে দিল না শীলাকে। অতিষ্ঠ। মাথার ভিতরে একটা পুকুরে যেন ঢিলের ঝড় বয়ে যায়। বিছানায় সর্বক্ষণ পেতে রাখা শরীরের খাঁজে খাঁজে কেবলই ধৈর্যহীনতার ভূতের ঢেলা এসে পড়ে টুপটাপ। শরীর এপাশ ফিরিয়ে শোয়, ওপাশ ফিরিয়ে শোয়। ভাল লাগে না, বই তুলে নেয় হাতে। সেখানেও টুপটাপ ভূতের ঢিল এসে যেন পড়তে থাকে, মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। রেকর্ড-প্লেয়ার একটা সম্প্রতি কেনা হয়েছে সময় কাটানোর জন্য। কিছুক্ষণ রেকর্ড শুনল সে, ইস্কুলে যাবে বলে উঠেও এইভাবে কিছুক্ষণ সময় কাটায় শীলা। যাবে না যাবে না করে। কিন্তু জানালার বাইরে ওই যে রোদে ধানিরং ধরে গেল, বাতাস মৃদু শ্বাস ফেলে বয়ে যায় হাহাকারের মতো। বাইরের পৃথিবীটা আলোর ইশারা হয়ে দক্ষিণের খোলা দরজার কাছে চৌকো পাপোশের মতো পড়ে আছে। ওই রোদে চপ্পল পায়ে গলিয়ে একবার একটুক্ষণের জন্য ঘুরে আসতে বড় ইচ্ছা করে। কী করবে শীলা! এতকাল এতদিন ধরে ঘরবন্দি থাকার অভ্যাস তো নেই।

কী রে ছেলে, যেতে দিবি একবার মাকে? একটুক্ষণের জন্য? সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার, আর যে পারি না রে! একটু যাব? লক্ষ্মী সোনা, ভয় দেখাস না। তোর জন্য সারাজীবন কত কষ্ট সহ্য করব দেখিস। একটুও বিরক্ত হব না, রাগ করব না। যেতে দিবি? বাবা আমার, ছেলে আমার…

এ-ঘর গেল, ও-ঘর গেল শীলা, ঘড়িতে মোটে দেড়টা, এখনও লম্বা দুপুর পড়ে আছে। রেকর্ডে গান হচ্ছিল, কী গান তা শোনেওনি সে। রেকর্ড শেষ হয়ে ঘস-স্ আওয়াজ হচ্ছে, সেটা বন্ধ করে দিল। তারপর যেন বা সম্মোহিতের মতোই বেখেয়ালে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল সে। সামান্য একটু পাউডার, একটু লিপস্টিক ছুঁইয়ে নেয়। আলমারি থেকে শাড়ি বের করে দ্রুত হাতে পরতে থাকে, মনে মনে সময়ের হিসেবটা কষতে থাকে ঝড়ের মতো। যদি চারটেতেও ফেরে অজিত তা হলেও আড়াই ঘণ্টা সময় হাতে থাকে। রিকশায় বড় জোর শর্টকাট করে গেলে পনেরো কুড়ি মিনিট লাগবে। যাতায়াতে চল্লিশ মিনিট বাদ দিলেও প্রায় দেড় পৌনে দুই ঘণ্টা সে ইস্কুলে থাকতে পারে। কাজকর্ম করবে না কিছু। কেবল একটু অভ্যাস বজায় রেখে আসবে। একটু কথা, একটু হাসি, একটু চেনা মুখ দেখা, চেনা ইস্কুলবাড়িটার একটা ধুলোটে মৃদু গন্ধ আছে, সেই গন্ধটা একটু বুক ভরে নেওয়া। অজিত টের পেলে ভয়ংকর রাগ করবে, বকবে ভীষণ, সেই ভয়ে বুকটা একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে। পুরুষ মানুষের সন্তানক্ষুধা বড় প্রবল। সন্তান মানে পুরুষের নিজেরই পুনর্জন্ম। অজিতের নির্বিরোধী জীবনে ওই একটি প্রবল তীব্র ব্যাপার আছে। শীলা তা টের পায় ভীষণ, তার শরীরের এই বিপজ্জনক অবস্থায় সে যদিও বা দু-একটা বেচাল বেভুল কাজ করে ফেলে, হয়তো একটু জোরে ওঠে বা পাশ ফেরে, কিংবা হয়তো রান্নাঘরে যায় তরকারি পাড়তে কিন্তু অজিতের চোখে পড়লে আর রক্ষা থাকে না জোর করে আবার শুইয়ে দেবে, পাহারা দিয়ে বসে থাকবে। অজিতকে তাই বড় ভয়।

দ্রুত একটা একবেণী বেঁধে নেয় শীলা, ঝি মেয়েটাকে ঘুম থেকে ডেকে বলে—ঘোরদোর দেখে রাখিস।

—তুমি বেরোবে বউদি? তোমার না বারণ!

—এক্ষুনি আসব।

—দাদাবাবু যদি চলে আসে!

—বলিস, পাশের বাড়িতে একটু গেছি। একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আয় তো।

রিকশায় ওঠার সময়ে যেন অনেকদিন বাদে আকাশ আর পৃথিবীর খোলামেলা কোলটিতে এসে যায় শীলা। কী ভীষণ ভাল লাগে তার।

—ভাই রিকশাঅলা, আস্তে যেয়ো, খুব আস্তে।

—হ্যাঁ।

রিকশা আস্তেই যায়। কখনও একটু জোর হলে শীলা সাবধান করে দেয়। রাস্তাটা খারাপ, এখানে-সেখানে গর্ত। একটু একটু টাল খায়। ওরে ছেলে, ভুল করলাম না তো! সর্বনাশ করিস না, তোর পায়ে পড়ি। না না, ছি ছি, তোর পাপ হবে, পায়ের কথা কেন বলতে গেলাম! চুপ করে থাকিস ছেলে, মাকে ধরে চুপ থাকিস।

দুহাতে দুপাশের হাতল ধরে শক্ত হয়ে বসে থাকে সে। শরীরকে যতদূর সম্ভব আলগা করে রাখে সিট থেকে। শরীরের মধ্যে যে রাজার শরীর সে যেন থাকে ভগবান। শরীরের মধ্যে যে দেবতা সে যেন ছেড়ে না যায়।

শরীরের কোন আবল্যি টের পায় না শীলা। রিকশাটা একটু দুলে দুলে, ধীরে ধীরে রাস্তা পার হয়ে যায়। দূর থেকে ইস্কুলের বাড়িটা দেখতে পায়, শীলা, ইস্কুলের ছাদে শীতের সূর্য আটকে আছে।

স্টাফ-রুমটা ভাগ্যিস একতলায়। শীলা দুধাপ সিঁড়ি, বারান্দা পার হয়ে স্টাফরুমে আসতেই একটা চাপা আনন্দ আর অভ্যর্থনা ছুটে আসে।

—কী খবর!

—আরে, শীলা!

—শুনেছি, শুনেছি, মিষ্টি-টিস্টি খাওয়াও বাবা।

—বেশ সুন্দর হয়েছেন শীলাদি।

—কংগ্র্যাচুলেশনস।

এইরকম সব কথা। বহুকাল পরে স্টাফ-রুমে পা দিয়ে একটা গভীর তৃপ্তি তাকে ধরে থাকে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে, চোখ ঝলমল করে। দাঁতে ঠোঁট চেপে একরকম হাসতে থাকে সে। লজ্জার হাসি। সে আর চিরকালের সেই একা শীলাটি নেই। তার শরীরের মধ্যে এখন অন্য এক শরীর। হয়তো এক রাজার হয়তো এক দেবতার। অহংকার পাখির মতো তার দুকান ভরে ডাকে।

সে ঘুরে ঘুরে হেড-মিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করে, ক্লার্কদের সঙ্গে কথা বলে, ছাত্রীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায়, স্টাফ-রুমে বসে আড্ডা দেয়। কী ভাল যে লাগে তার! বারবার ঘড়ি দেখে। চারটের এখনও ঢের দেরি আছে।

মীনাক্ষী বলে—শীলা, সুভদ্রর মন খারাপ। দেখছিস না, কথা বলছে না।

সুভদ্র মেয়েদের থেকে দূরে আলাদা চেয়ারে বসেছিল, এ স্কুলে ছেলে স্টাফ খুব অল্প। পণ্ডিতমশাই ছাড়া একজন পুরনো আমলের বিএসসি আছে কেবল। সুভদ্র ঢুকেছিল কমিটির প্রেসিডেন্টের সুপারিশে, একজনের লিভ ভেকান্সিতে। খুবই সুন্দর দেখতে সুভদ্র। ফরসা টকটকে রং, লম্বা, একটু রোগা হলেও মুখশ্রী মায়াবী কিশোরের মতো। অল্প দাড়ি রাখে সে, মোটা গোঁফ, গায়ে খুব কমদামি কিন্তু সুন্দর রঙিন খদ্দরের শার্ট পরে সে, টেরিকটের গাঢ় রঙের প্যান্ট পরে। সুভদ্র একটু বোকা। কিন্তু আবার এও হতে পারে যে, বোকামির ভান করে। কারণ তার ধারাল মুখে, বা চোখের তীক্ষ চাউনিতে বোকামির লেশমাত্র নেই। তবু স্কুলের চটুল স্বভাবের শিক্ষিকাদের মধ্যে সুভদ্রর বোকামির গল্প চাউর আছে। সেটা সুভদ্র জানে, কিন্তু রাগ করে না। বরং হাসে।

শীলার সঙ্গে সুভদ্রর পরিচয় কিছু গাঢ়। বলতে নেই, স্কুলে শীলার মতো সুন্দরী কমই আছে। একটু সুখের মেদ জমেছে সম্প্রতি, নইলে শীলার আর কোনও খুঁত নজরে পড়ে না, দিঘল চোখ দুখানায় এখনও অনেক কথার, ইঙ্গিতের রহস্যের খেলা দেখায় শীলা, সিঁথেয় সিঁদুর যাদের আছে তারা ছেলেদের সঙ্গে সহজেই প্রথম আলাপের সংকোচটা কাটিয়ে উঠতে পারে। এই সুন্দর কিশোরপ্রতিম চেহারার যুবকটির সঙ্গে আড্ডা দিতে বরাবরই ভাল লেগেছে শীলার। সে মায়া বোধ করে।

শীলা সুভদ্রকে ডেকে জিজ্ঞেস করে—সুভদ্র, কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?

—কে বলে মন খারাপ! সুভদ্র নিরুত্তাপ গলায় বলে।

মীনাক্ষী চাপা গলায় বলে—শোভনাদি ফিরে আসছে, তাই সুভদ্রর চাকরি থাকছে না।

শীলা অবাক হয়ে বলে—শোভনাদি ফিরে আসছে! সে কী! উনি তো বরের সঙ্গে মাদ্রাজ গেলেন এই সেদিন। চাকরি বলে করবেন না?

—সেইটেই তো গোলমাল হল। ওঁর বর আরও প্রমোশন পেয়ে কোম্পানির ডাইরেক্টর হয়ে কলকাতায় ফিরছেন। শোভনাদি জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে জয়েন করবেন বলে চিঠি দিয়েছেন।

শীলার মন খারাপ হয়ে যায়।

মীনাক্ষী বলে—অবশ্য শুধু সে কারণেই যে সুভদ্রর মন খারাপ, তা নয়।

—আর কী কারণ? শীলা জিজ্ঞেস করে।

—সে তো তুই জানিসই বাবা।

—কী জানব?

—আহা, তুই যে ছুটি নিয়ে ঘরে বসে রইলি, সুভদ্র বেচারা এখন কোন আকর্ষণে স্কুলে আসবে?

শীলার কানটান একটু লাল হয়ে ওঠে। আবার মুখে সে হাসেও। সুভদ্র দূর থেকে একবার এদিকে তাকিয়েই উঠে বারান্দায় চলে যায়।

বয়স্কা মাধুরীদি ধমক দিয়ে বলেন—তোর ইতর রসিকতাগুলো একটু বন্ধ করবি মিনু?

—আহা! কে না দেখতে পাচ্ছে বাবা, শীলা ছুটি নেওয়ার পর থেকেই সুভদ্র কেমন মন খারাপ করে ঘুরছে!

মাধুরী হাসেন। অবিবাহিতা এবং বয়স্কা অচলা মুখখানা গাঢ় গাম্ভীর্যে মেখে রাখেন। মেয়েদের প্রেগন্যান্সি তাঁর সহ্য হয় না। গর্ভবতী মেয়েদের দেখলে রাগ করেন। তবু শীলার পক্ষ হয়ে বললেন—মীনাক্ষী, সব ধোঁয়াই কিন্তু আগুনের ইঙ্গিত করে না।

ঠাট্টা। কিন্তু শীলা একটু অস্বস্তি বোধ করে। সুভদ্র আর ঘরে আসে না।

স্কুল চারটের অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেল আজ। পরীক্ষার প্রিপ্যারেশনের জন্য মেয়েরা ছুটি চেয়ে অ্যাপ্লিকেশন করেছিল। শুধু উঁচু ক্লাসগুলোর কয়েকটায় ক্লাস চলছে।

তিনটে নাগাদ শীলা বেরিয়ে আসে ফেরার জন্য। বেয়ারাকে রিকশা ডাকতে পাঠিয়েছিল। দীর্ঘ বারান্দার থামের আড়াল থেকে সুভদ্র বেরিয়ে এসে ডাকে—শীলাদি!

—কী খবর? পালিয়ে এলেন যে! কথাটা বলতে বলতেই শীলা হঠাৎ টের পায় তার বুকের মধ্যে কী একটা নড়ে গেল। একটা শ্বাস অর্ধেক কেটে গেল। সঙ্গে একটা শ্বাস কষ্ট। শরীরটা ভার লাগে। ভাল লাগছে না।

—মীনাক্ষীটা বড্ড স্ট্রেট।

—আপনার মন খারাপ কেন?

সুভদ্র একটা শ্বাস ফেলে বলে—শীলাদি, একটা কথার জবাব দেবেন?

—কী?

—আপনি চাকরি করেন কেন?

—কেন করব না?

—দরকার থাকলে নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু আপনার কি চাকরি করা খুব দরকার?

শীলা ক্ষীণ হেসে বলে—না হলে করব কেন?

সুভদ্র মাথা নেড়ে বলে—আমি জানি আপনার হাজব্যান্ড হাজার টাকার ওপর মাইনে পান, কলকাতায় আপনাদের নিজেদের বাড়ি, ফ্যামিলি মেম্বার মোটে দুজন। তবু কেন চাকরি করা দরকার বলুন তো!

শীলা একটু শ্বাস ফেলে কপট গাম্ভীর্য এনে বলে—দরকার যার যার নিজের কাছে। কারও খাওয়া-পরার প্রবলেম, কারও সময়ের প্রবলেম, ধরুন যদি বলি, আমার সময় কাটে বলে চাকরি করি!

সুভদ্র তার বোকামির মুখোশটা পরে নিয়ে একটু বোকা হাসি হাসে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে বলে—শীলাদি, আপনি সত্যিই সত্যবাদী।

—কেন?

—ঢাকবার চেষ্টা করেননি। কিন্তু আপনার মতো একজন ভাল চাকুরের বউ বা শোভনাদির মতো একজন ডাইরেক্টরের স্ত্রীর কেবলমাত্র সময়ের প্রবলেমের জন্য কি চাকরি করা উচিত? অঢেল সময় যদি থাকে তো আপনারা মহিলা সমিতি করুন, গান শিখুন বা সিনেমা থিয়েটার দেখুন। চাকরি কেন?

—কষ্ট করে লেখাপড়া শিখব, কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে গেলেই কেন দোষ হবে?

—তাতে যে আমার মতো বেকাররা মারা পড়ি! শোভনাদি কলকাতায় ফিরে আসছেন বলেই চাকরিটা আবার নেবেন, নইলে তার দরকার ছিল না। অথচ তিনি জয়েন না করলে একজন অভাবী লোকের উপকার হয়। এ কথাটা আপনারা বোঝেন না কেন!

—কথাটা সত্যি হতে পারে, কিন্তু ওর যুক্তি নেই সুভদ্র।

সুভদ্র মাথা নেড়ে বলে, আছে শীলাদি। যার স্বামী ভাল রোজগার করে সে চাকরি করলে সমাজে ইকনমির ব্যালান্স থাকে না। নকশালাইটরা যে কয়েকটি ভাল কাজ করতে চেয়েছিল তার মধ্যে একটি হল স্বামী-স্ত্রীর দ্বৈত রোজগার বন্ধ করা।

শীলা হাসল। বলল—সুভদ্র, আমার একটু দুঃখ হচ্ছে শোভনাদি ফিরে আসছে বলে।

সুভদ্র ম্লান হেসে বলে—আমি চলে যাচ্ছি বলে নয়?

শীলার অকারণেই আবার কান মুখ লাল হয়ে ওঠে। বলে—সেজন্যও।

ইস্কুল বাড়ি প্রায় ফাঁকা। দুজন হাঁটতে হাঁটতে মাঠটুকু পার হয়ে গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। সুভদ্র একটা সস্তা সিগারেট ধরিয়ে বলে—আমার চাকরিটা খুব দরকার ছিল।

শীলা একটা শ্বাস ফেলে বলে—পেয়ে যাবেন। একটু খুঁজুন।

সুভদ্রর সাহস আছে। হঠাৎ মুখখানা উদাস করে বলে—চাকরি হয়তো পেতেও পারি, কিন্তু সেখানে আপনার মতো বুদ্ধিমতী সহকর্মী কি পাওয়া যাবে?

শীলা চারধারে চেয়ে দেখে একটু। কেউ নেই, কেউ তাদের লক্ষ করছে না। করলেও দোষের কিছু নেই। সুভদ্র ইস্কুলে ঢোকার পর থেকে দিনের পর দিন শীলা আর সুভদ্র ইস্কুল থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে গল্প করতে করতে গিয়ে ট্রাম ধরেছে। ছাড়াছাড়ি হয়েছে শীলার নির্দিষ্ট স্টপে। আবার কখনও সুভদ্র নেমে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়েও দিয়ে গেছে। আবার শীলা কখনও বা স্টপে না নেমে কেনাকেটা করার জন্য চলে গেছে সুভদ্রর সঙ্গেই এসপ্লানেডে বা গড়িয়াহাটা। কিন্তু শরীরের অন্য এক রাজাধিরাজের আগমনবার্তা পাওয়ার পর থেকেই শীলা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। কারও কথাই বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না, কেবল শরীরের ভিতরকার সেই শরীর মনে পড়ে। সুভদ্রকে তাই তেমন করে ভেবেছে কি সে এ কয়দিন?

শীলা মুচকি হেসে বলে—শুধু বুদ্ধিমতী?

—সুন্দরীও। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় সুভদ্র।

শীলা মৃদু হাসে। এই স্তাবকতাটুকুর লোভ সে ছাড়ে কী করে?

আজ আর হাঁটে না শীলা। রিকশা আসবে তাই দাঁড়িয়ে থাকে। সুভদ্র পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে বলে—সত্যি আপনাদের ছেড়ে চলে যেতে খুব কষ্ট হবে। চাকরি পাওয়া সোজা নয়।

শীলা চুপ করে থাকে।

সুভদ্র নিজেই বলে আবার—আমি কোনওকালে পলিটিক্স করতাম না। কিন্তু এখন দেখছি পলিটিক্স করলেই আখেরে লাভ হয়।

—কীরকম?

চাকরি জোটে, বা ব্যবসার লাইসেন্স পাওয়া যায়। ভাবছি, পলিটিক্সে নেমে যাব কিনা।

শীলা পাশ থেকে সুভদ্রর মুখখানা দেখে। কী সুন্দর চেহারা! চাকরি দেওয়ার হাত থাকলে শীলা শুদ্ধমাত্র ওর চেহারা দেখেই একটা চাকরি দিয়ে দিত।

এই মুগ্ধতাটুকু পিনের আগার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে লাগে শীলার বুকে। সুভদ্র চলে গেলে স্কুলটা অনেক বিবর্ণ হয়ে যাবে তার কাছে। সে তবু একটু ঠাট্টা করে বলে—বরং সিনেমায় নেমে পড়ুন।

—অ্যাঁ।

—আপনাকে লুফে নেবে।

সুভদ্র হাসল, বলে—অত সোজা নয়। তবে যা পাই তাই করব। কিছুতেই আর আপত্তি নেই। আপনারা যখন আমাদের রাস্তা আটকে রাখবেনই, তখন আমাদের রাস্তা তৈরি করে নিতে হবে।

—শুনুন, শোভনাদির সঙ্গে আমার তুলনা চলে না। আমার চাকরির টাকা সংসারে অনেক হেলপ করে। শোভনাদির তা নয়, ওঁরটা নিতান্তই শখ।

সুভদ্র হেসে বলে—আমার কিন্তু কারও ওপরেই রাগ নেই। যা আছে তা কেবলমাত্র অনুরাগ।

—খুব মুখ হয়েছে দেখছি। বলে শীলা গাঢ় শ্বাস ফেলে মায়াবী যুবকটির মুখখানা দেখে।

—আপনার ঠিকানা জানি। কোনওদিন হুট করে চলে যাব। আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আলাপও করে আসব।

—নিশ্চয়ই।

—এলআইসির একটা এজেন্সি নিয়ে রাখি৷

—আমি বলে রাখব। কবে আসবেন?

—আসব যে কোনওদিন।

রিকশা এল। শীলা খুব সুন্দর একটু হেসে উঠে বসল। সুভদ্র নিঃসংকোচে তার মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল। চোখ সরাল না শীলা। রিকশা কয়েক পা এগোলে শীলা মুখ ঘুরিয়ে হাসিমুখে চেয়ে রইল। গোপনে এই রকম তারা মাঝে মাঝেই চেয়ে থেকেছে পরস্পরের দিকে। যখনই তারা দুজন একা হয়েছে তখনই।

পাপ? কে জানে? কিন্তু ওই একরকম শিহরন, গোপনতা, রহস্য—যা না থাকলে বেঁচে আছে বলে মনে হয় না। শীলা যে কত ঝুঁকি নিয়ে আজ ইস্কুলে এসেছে তা কি আকারটাই সুভদ্রার জন্য নয়? মনের ভিতরে কত কী থাকে, ভাগ্যিস তা অন্যে জানতে পারে না!

সুভদ্রর কথা ভাবতে ভাবতে রিকশাওয়ালাকে আস্তে চালানোর কথা বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। রিকশাটা পর পর দুটি ঝাঁকুনি খেল। আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে শীলা—আস্তে।

তেমন কিছু টের পেল না শীলা। কেবল বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামার সময়ে হেঁট হতে তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যথা টের পেল।

॥ উনিশ ॥

বাসের দোতলায় তিন-চারটে মার্কামারা ছেলে উঠেছে। হাতে বইখাতা, পরনে কারও কলারঅলা গেঞ্জি, কারও রংচঙা সস্তা শার্ট। এই শীতেও গায়ে গরম জামা নেই। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স। দুজনের সিট তিনজন ঠেসে বসেছে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় গরিব ঘরের ছেলে, বাজে ইস্কুলে পড়ে, যে ইস্কুলে ইউনিফর্ম পরার বালাই নেই। কলকাতার বিস্তৃত বস্তি অঞ্চল থেকে এরকম চেহারার বহু ছেলে সস্তা বাজে ইস্কুলে লেখাপড়া শিখতে যায়।

একটা ছেলে চেঁচিয়ে বলে—কিস, কিস, এই টুবু, একটা কিস দিবি?

বলতে বলতে ছেলেটা তার পাশের ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে।

ছেলেটা মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে—যাঃ। পাবলিক রয়েছে।

—তোর পাবলিকের ‘ইয়ে’ করি।

ছনম্বর বাসের দোতলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে পিছনে দাঁড়িয়ে সোমেন দৃশ্যটা দেখে। সাদা আর ঘন নীল ইউনিফর্ম পরা তিন চারজন মেয়ে বসে আছে ডান দিকের দু-তিনটে সিটে, ফরসা ফরসা, গোলগাল অবাঙালি মেয়ে কজন, হাতে ছোট সুটকেস, কাঁধে প্লাস্টিকের জলের বোতল ঝুলছে। সম্ভবত ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে পড়ে, ছেলেগুলো ওদের দিকে তাকায়ে ওই সব করে যাচ্ছে। ইংরেজি শব্দগুলো ওই কারণেই বলা।

রাগে হাত-পা রি-রি করে সোমেনের। বাসসুদ্ধ লোকের একজনও রুখে উঠলে পুরো দৃশ্যটা পালটে যায়। কিন্তু কেউ কোনও রা’ কাড়ে না। বরং না শুনবার ভান করে অন্যদিকে চেয়ে থাকে।

মেয়েগুলোর ফরসা মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে। বাচ্চা একটা মেয়ে হঠাৎ মুখ ফেরাতে সোমেন দেখল, মেয়েটার চোখে স্পষ্ট কান্নার চিহ্ন।

—হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? অন্যদিকে চেয়ে একটা ছেলে জিজ্ঞেস করে।

বন্ধুদের একজন বলে—মাই নেম ইজ—বলে মুম্বইয়ের একজন ফিলমস্টারের নাম করে। তাকে ধমকে দেয় প্রথম ছেলেটা, খিস্তি করে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করতে থাকে—হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?

মেয়েগুলো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।

সোমেনের পিছন থেকে একজন ফিসফিস করে বলে—কী সব ছেলে!

ব্যস। আর কোনও প্রতিবাদ হয় না। সোমেনের সামনে দু-চারজন দাঁড়িয়ে আছে। বাসের ঝাঁকুনিতে দোতলায় দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে। বাস ব্রেক কষে, আবার চলে। এ-ওর গায়ে ধাক্কা খায় আগে পিছে। টলে ঢলে পড়ে যেতে যেতে আবার দাঁড়ায়।

বাসটা কোথায় এসেছে বোঝা যাচ্ছিল না ভিড়ের জন্য। ছেলেদের একজন চেঁচিয়ে ওঠে—ওই যে, নিরোধের বিজ্ঞাপন। নিরোধ ব্যবহার করুন, পনেরো পয়সায় তিনটে…

কোথায় এসেছে তা না বুঝেও সোমেন ভিড় ঠেলে নামতে থাকে। বেশিক্ষণ তার এসব সহ্য হয় না। হয়তো মাথা গরম হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করা যাবে না। কেবল নিজের ভিতরে এক অন্ধ রাগ বেড়ে বেড়ে ফুসে উঠে নিজেকেই ছুবলে মারবে। সেই বিষও আবার হজম করতে হবে নিজেকেই। ক্লান্তি আসবে। আসবে ব্যর্থতার বোধ। কলকাতার নির্বিকার জনগণ সকলেই এই ক্লান্তিতে ও ব্যর্থতায় ভুগে জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে না কি?

নেমে সসামেন দেখে, সে খুব বেশি দূরে নামেনি। এখান থেকে বড়দির বাড়ি আর মোটে দুটো স্টপ। খোলা আলো-হাওয়ায় এটুকু হেঁটে যেতে ভালই লাগবে। সে সিগারেট কিনে ধরায়। পৃথিবীর কোথাও কোনও শান্তি নেই। না ঘরে, না বাইরে। সোমেনের মাঝে মাঝে বড্ড মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিংবা পালাতে ইচ্ছে করে বিদেশে। কিন্তু জানে, শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হবে না। এই নোংরা শহরে কিংবা এই নিস্তেজ, ভাবলেশহীন দেশে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে একদিন।

অন্যমনস্কভাবে সোমেন হাঁটছিল। একটা ট্যাক্সি পাশ দিয়ে যেতে যেতে এগিয়েই থামল। মুখ বাড়িয়ে কে যেন ডাকল—শালাবাবু!

জামাইবাবু! সোমেন তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দেয়।

এগিয়ে গিয়ে বলে—আপনাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।

—উঠে পড়ো। বলে দরজা খুলে ধরে অজিত।

সোমেন উঠলে অজিত সরে বসে বলে—এতকাল পরে আমাদের মনে পড়ল।

সোমেন একটু লাজুক হাসি হেসে বলে—কেন, আসি না নাকি?

—আসো? সে বোধ হয় সূক্ষ্ম শরীরে, আমাদের সাদামাটা চোখে দেখতে পাই না।

—সময় পাই না।

—সময়? তোমার আবার সময়ের টানাটানি কবে থেকে? একটা তো মোটে টিউশনি করো শুনেছি। আর কী করো? প্রেম নয়তো? তা হলে অবশ্য সময়ের অভাব হওয়ারই কথা।

—না, না। প্রেম-ট্রেম কোথায়?

—লাস্ট বোধ হয় ভাইফোঁটায় এসেছিলে। তারপর টিকিটি দেখিনি।

—এবার খুব বেশি দেখবেন।

—সে দেখব যখন নিজেদের বাড়ি করে উঠে আসবে। তার এখনও ঢের দেরি, শ্বশুরমশাই একটু আগে অফিসে এসেছিলেন চেকটার খোঁজ করতে।

—বাবা এসেছেন?

—এসেছেন মানে? এতক্ষণে হয়তো চলেও গেছেন হাওড়ায়। বাসায় যাননি বোধ হয়?

—কী জানি! আমি তো বাসায় ছিলাম না।

অজিত একটা শ্বাস ফেলে বলে-তুমি ওঁর কাছে যাওটাও না?

—খুব কম।

—যেয়ো। সন্তানের টান বড় টান। আমার তো এখনও কিছু হয়নি, কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা দেখেই মনটা উসখুস করে।

কোটের বাঁ দিকের পকেট থেকে ডানহিলের সুন্দর প্যাকেটটা বের করে অজিত, আর রনসন লাইটারটা।

—কী সিগারেট জামাইবাবু? সোমেন জিজ্ঞেস করে—বেশ প্যাকেটটা তো!

—বিলিতি। একটা চলবে না কি?

—না, না। লজ্জার হাসি হাসে সোমেন।

—লজ্জার কী! ধরিয়ে ফেলো একটা। খাও তো!

—আপনার সামনে নয়।

—এই যে ভাই, সামনের বাঁ দিকের রাস্তা। বলে ট্যাক্সিওলাকে নির্দেশ দেয় অজিত। ডানহিলের প্যাকেটটা সোমেনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে—শালাবাবুরা সামনে সিগারেট না খেলে ভগ্নীপতিদের বড় অসুবিধে। দরকার হলে শালাদের ঘাড় ভেঙে সিগারেট খেতে পারে না।

—আমি আপনাকে আর কী খাওয়াব বলুন। বেকার শালার সাধ্য কী? একটা চাকরি-বাকরি দিতেন যদি!

—তোমার এক্ষুনি চাকরির কী হল? এম এ-টা দাও না।

—ও হবে না।

—একটা প্রফেসরি হয়তো জুটে যেত। নাও, ধরিয়ে ফেল।

সোমেন লম্বা সিগারেট একটা টেনে নেয়। ধরায়। খুব লজ্জা করে তারা।

অজিত বলে—আরে জামাইবাবু আবার গুরুজন নাকি! ঠাট্টার সম্পর্ক, লজ্জার কিছু নেই।

বাসার সামনে ট্যাক্সি থেকে নামে দুজনে।

কড়া নাড়তে বাচ্চা ঝিটা এসে ঘুমচোখে দরজা খোলে।

—শীলা, দেখ কে এসেছে! বলে হাঁক ছাড়ে অজিত।

বাচ্চা ঝিটা ভয়ার্ত মুখে বলে—বউদি নেই।

অজিত যেন বুঝতে পারে না কথাটা। একটু অবাক হয়ে বলে কী বলছিস?

—বউদি বেরিয়ে গেল একটু আগে। রিকশায়।

—কোথায় গেছে?

—পাশের বাড়িতে।

—পাশের বাড়িতে রিকশা করে। ভারী অবাক হয়ে বলে অজিত—কোন বাসায়?

—ঝি-মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখে বলে—ওই দিকের রাস্তা দিয়ে গেল। কোথায় তা জানি না। বলে গেছে পাশের বাড়িতে।

অজিত একটুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে রাগে, উত্তেজনায়। তারপর জুতোমোজা ছাড়ে, কোট হ্যাঙারে টাঙায়।

রহস্যটা ধরতে না পেরে সোমেন জিজ্ঞেস করে—কী হল জামাইবাবু?

অজিত গম্ভীর স্বরে বলে—কিছু না।

ঝিকে ডেকে চা করতে বলে অজিত। কিছুক্ষণ মুখখানা দুহাতের পাতায় ঢেকে বসে থাকে। সামলে নেয় নিজেকে। মুখ তুলে বলে—তোমার দিদি আজকাল আমাকে লুকিয়ে পালাতে শিখেছে।

সোমেন হাসে—পালায়?

—ওর একটি প্রেমিক আছে যে!

—কে?

—ওর ইস্কুল। ইস্কুলটাই ওর সর্বস্ব। আমরা কিছু না। বুঝলে শালাবাবু, তোমার দিদি এবার একটা সর্বনাশ ঘটাবে। রিকশা করে গেছে, ঝাঁকুনিতে না পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়!

এ সব কথায় সোমেনের একটু লজ্জা করে। ডানহিলটা ঠোঁটে চেপে সে চমৎকার ধোঁয়াটা টানে। রিকশার ঝাঁকুনিতে পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে—ব্যাপারটা তার বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়।

সোমেন একটুক্ষণ বসে থেকে তারপর হঠাৎ বলে—জামাইবাবু।

—উঁ। অন্যমনস্ক অজিত উত্তর দেয়।

—আমার একটা উপকার করবেন?

—উপকার! নিশ্চয়ই।

—আমাকে কিছুদিন আপনার বাড়িতে থাকতে দিন।

অজিত একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। বলে—থাকবে? সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু কেন?

—এমনিই।

—বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করোনি তো?

—না, সেসব কিছু নয়।

অজিত একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। বলে—থাকবে? সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু কেন?

—এমনিই।

—বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করোনি তো?

—না, সেসব কিছু নয়।

অজিত একটু উদাস হয়ে বলে—কদিন আগে শাশুড়িঠাকরুন এসেছিলেন। তিনি তোমার বড়দিকে বলে গেছেন, তোমাদের বাসায় কী সব অশান্তি চলছে।

সোমেন মাথা নাড়ে।

অজিত একটু হেসে—তুমি বড় সেন্টিমেন্টাল হে শালাবাবু, সংসারে একটু-আধটু খটাখটি তো থাকবেই। আমি নিজে মা বাপ-অন্ত-প্রাণ ছেলে ছিলাম, সেই আমাকেই আলাদা হয়ে চলে আসতে হল! এখন তো তবু সংসারের কিছুই টের পাওনি, যখন বিয়ে করবে তখন বউ এসে রাত জেগে তোমাকে দুদিনে সংসারের সার সত্য সব শেখাতে থাকবে। তখন দেখবে মা-বাপ সম্পর্কে তোমার আজন্মের ধারণা পালটে যাচ্ছে, ভাই-দাদা, ভাইপো-ভাইঝি সকলেরই গুপ্ত খবর পেয়ে যাবে। বিয়ে করো, বুঝবে।

—বিয়ে! বলে একটু ঠাট্টার হাসি হাসে সোমেন।

—কেন, বিয়ে নয় কেন?

—আমাদের জেনারেশন বিয়ে-টিয়ে বোধ হয় উঠে যাবে।

—ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো, বাঁধো, বাঁধো বুক। বিয়েটাকে টারগেট করে যা করার করে যাও। তুমি যদি সংসার ছাড়ো তবে তোমার মা দাদার কী অবস্থা হবে জানো?

—কী হবে! আমার জন্য কিছু ঠেকে থাকবে না।

—থাকবে। তবে কিছুদিনের জন্য যদি আমার বাড়িতে এসে থাকো তো ভালই হয়। তোমার দিদিটিকে একটু পাহারা দিতে পারবে। চোখে চোখে না রাখলে ও ঠিক চুপি চুপি প্রায়ই পালিয়ে যাবে ওর প্রেমিকটির কাছে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ। তবু ও শোনে না। আমি অবশ্য অন্য কোনওদিন ধরতে পারিনি। আজই হঠাৎ তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি বলে বুঝতে পারছি।

চা শেষ করে আর একটা ডানহিল অজিতের প্যাকেট থেকে নিয়ে ধরায় সোমেন। বাইরে একটা রিকশা থামে। শব্দ হয়।

অজিত মুখখানা গম্ভীর করে বসে থাকে।

সদর দরজা খোলাই ছিল। শীলা ঘরে এসে একটু থতমত খেয়ে দাঁড়ায়। বলে—ওমা! কখন এলে? সোমেন, হঠাৎ যে দিদিকে মনে পড়ল?

সোমেন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। হাসে। উত্তর দেয় না কেউ।

শীলা ভ্রূ কুঁচকে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে—খুব যে উন্নতি দেখছি! গুরুজনদের সামনে সিগারেট খাওয়া!

শীলা ভ্রূ কুঁচকে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে—খুব যে উন্নতি দেখছি! গুরুজনদের সামনে সিগারেট খাওয়া!

—জামাইবাবু জোর খাওয়ালেন, কী করব!

—কত জামাইবাবুর বাধ্য শালা! আবার ধোঁয়া ছাড়ার কায়দা হচ্ছে!

অজিত ভ্রূ কুঁচকে নিজের হাতের দিকে চেয়েছিল।

শীলা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে—একটা জরুরি কাজ ছিল, বুঝলে! রাগ করেছ নাকি!

অজিত শ্বাস ফেলে মাত্র। উত্তর দেয় না।

দাঁড়িয়ে থাকতে শীলার বোধ হয় কষ্ট হয়। মুখখানা সামান্য বিকৃত করে বলে—যা রাস্তাঘাট! এত হাঁফিয়ে পড়েছি!

বলে সোফায় বসে শীলা। হাতের ব্যাগ মেঝেয় ফেলে রেখে ঝি-মেয়েটাকে ডেকে চা করতে বলে দেয়। কপাল থেকে চুলের কুচি সরাতে সরাতে বলে—সোমেন, রাতে খেয়ে তবে যাবি। আজ ফ্রায়েড রাইস করব, আর মুরগি।

সোমেন হেসে বলে—আগে বাড়ির আবহাওয়াটা স্বাভাবিক হোক, তবে বলতে পারি খাব কিনা। এখন তো বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছি।

—আহা! এরকম আমাদের রোজ হয়! জামাইবাবুটিকে তো চেনো না। রাগের হোলসেলার।

অজিত তীক্ষ্ণ চোখে শীলাকে একটু দেখে নেয়।

—কী দেখছ? শীলা জিজ্ঞেস করে।

অজিত নিস্পৃহ গলায় বলে—তোমার মুখ সাদা দেখাচ্ছে।

—ও কিছু না। রোদে এলাম তো।

—রোদে মুখ লাল হওয়ার কথা, সাদা হবে কেন?

—তোমার বড্ড বাড়াবাড়ি।

—শীলা, আমাকে লুকিয়ে লাভ নেই। তোমার কোনও কষ্ট হচ্ছে শরীরে।

শীলা হাসতে চেষ্টা করল। বিবর্ণ হাসি। চোখ দুটো একটু ঘোলাটে, মুখ সাদা, ঠোঁট দুটোর মধ্যে ফড়িংয়ের পাখনার মতো কী একটু কেঁপে গেল। বলল—না, কিছু নয়।

অজিত একটু শ্বাস ফেলে বলে—না হলেই ভাল। তবু বলি, সামান্য ধৈর্য রাখতে পারলে ভাল করতে। একটা পেরেকের জন্য না একটা সাম্রাজ্য চলে যায়।

শীলা একটুক্ষণ বসে থাকে। তারপর ক্ষীণ গলায় বলে—তোমরা বোসো, আমি ও-ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে থাকি।

শীলা ধীরে ধীরে উঠে ও-ঘরে চলে গেল। অজিত আর একটু ধৈর্য ধরে বসে থাকল সোমেনের মুখোমুখী। তারপর বলল—বোসো শালাবাবু, আমাদের দুজনের ভাগ্যটা কেমন তা দেখে আসি। এ যাত্রাটা যদি রক্ষা হয়।

অজিত ও-ঘরে গেল। সোমেন বসে থাকে একা। শুনতে পায় ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে বড়দির ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে। চাপা, আবেগপূর্ণ কথার শব্দ ভেসে আসে। একটা অস্ফুট চুম্বনের শব্দ আসে।

গায়ে কাঁটা দেয় সোমেনের। অনেকদিন বাদে হঠাৎ আবার তার মনের মধ্যে ঝিকিয়ে ওঠে একটা আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরার ঢাকনা-খোলা ঝকঝকে চোখ, গর্‌-র শব্দে ডেকে ওঠে একটা অন্ধ কুকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *