যাও পাখি – ১০

॥ দশ ॥

ট্যাক্সি থেকে নেমে বীণা একবারও পিছু ফিরে না চেয়ে বাসার সদরে ঢুকল এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠবার চেষ্টা করতে লাগল। একটু থেমে থেমে, রেলিঙে ভর রেখে, খুব ধীরে ধীরে উঠছিল সে। পিছনে রণেন, তার এক হাতে ফোলিও ব্যাগ, অন্য হাতে প্লাস্টিকের ঝোলায় বীণার জিনিসপত্র। দুটো ব্যাগ একহাতে নিয়ে অন্য হাতটা বাড়িয়ে বীণার হাত ধরল সে, সাহায্য করতে চেষ্টা করল। বীণা হাতটা ঝাঁকিয়ে তিব্র স্বরে বলে—আঃ, ছাড়ো! লাগছে!

লাগার মতো জোরে ধরেনি রণেন, তবু অপ্রস্তুত হয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে—একা উঠতে পারবে? কষ্ট হচ্ছে তো!

—হোক। অনেক উপকার করেছ, আর করতে হবে না। বীণা বলে।

ট্যাক্সিতে শেষ দিকে তাদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বীণা চুপচাপ বাইরের দিকে চেয়ে বসেছিল। রণেনকে দরকার মতো উপেক্ষা করার একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে বীণার। মুখটায় একটু দুঃখী ভাব করে ছলছলে চোখে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। মনে হয় বুঝি অভিমান। তা নয়! তখন সেই অভিমান ভাঙতে গেলেই অনর্থ ঘটে। ভঙ্গিটা দেখেই রণেন মনে মনে বিপদের গন্ধ পেয়েছিল তখনই।

থেমে থেমে অনেকক্ষণ ধরে সিঁড়ি ভাঙে বীণা। মাঝে মাঝে কাতর ব্যথা-বেদনার শব্দ করে—উঃ বাবা! রণেন ধৈর্য ধরে পিছনে অপেক্ষা করে। বীণাকে ধরে তুলবে তার উপায় নেই। ছুঁতে গেলেই ও নির্দয় অপমান করবে।

দরজা খুলে ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—চলে এলে?

বীণা উত্তর দিল না। দরজার চৌকাঠে হাতের ভর রেখে দাঁড়াল একটু। ননীবালা সরে গিয়ে বলেন—ঘরে এস।

বাচ্চারা ঠাকুমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। টুবাই মাকে দেখে ভারী খুশি হয়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করে দু’কদম এগিয়ে গিয়েছিল, ননীবালা তাকে টেনে রেখে বলেন—ছুঁস না, অশৌচ। তারপর রণেনের দিকে চেয়ে বলেন—বউমাকে ঘরে নিয়ে আয়। আমি গরম জল করে দিচ্ছি, তুই স্নান করে ফেলিস।

বীণা কোনও কথা না বলে তার ঘরে চলে গেল, আর ঠাস করে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। অপ্রস্তুত অবস্থা। ননীবালা অপমানটা হজম করতে পারছিলেন না। ছেলের দিকে চেয়ে বলেন—কি জানি বাবা, আমরা তো এ অবস্থায় আঁতুড়-অশৌচ দুই-ই মানি। এতে রাগের কথা কী হল?

রণেন ব্যাগট্যাগ বাইরের ঘরের টেবিলেই রাখে। জামাকাপড় ছাড়তে পারে না, কারণ ঘরের দরজা বন্ধ। অগত্যা একটা গামছা জড়িয়ে সোফা-কাম-বেডটার ওপর বসে থাকে। ননীবালা চা করতে করতে রান্নাঘর থেকে ডেকে বলেন—বউমাকে জিজ্ঞেস কর তো চা খাবে নাকি!

রণেন অবশ্য সে চেষ্টা করে না। তখন বুবাই উদ্যোগী হয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়—মা, ও মা, চা খাবে? ঠানু জিজ্ঞেস করছে! মা, ও মা, খাবে? খাবে না?

বাচ্চাদের যা স্বভাব, মা দরজা খুলছে না, মা দরজা খুলছে না, কাজেই বুবাই ক্রমান্বয়ে দরজা ধাক্কায়, আর ডাকে। তার সঙ্গে জুটে যায় টুবাই আর শানুও। তিনজনে তুলকালাম করাঘাত করে দরজায়। তারস্বরে ডাকে। টুবাই দৌড়ে এসে বাপকে বড় বড় চোখ করে বলে যায়—দরজা খুলছে না, মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। গত লক্ষ্মীপুজোয় সারাদিন উপোসের পর ভোগ-টোগ বেঁধে, পিত্ত আর অম্বলে কাহিল হয়ে ননীবালা অজ্ঞান হয়ে যান। সেই অভিজ্ঞতা থেকে টুবাইয়ের ধারণা, কেউ বন্ধ ঘর থেকে সাড়া না দিলে, বা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে সহজে চোখ না মেললে সে নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে গেছে।

তিনজনের ওই ধাক্কাধাক্কি আর ডাকাডাকির বাড়াবাড়ি দেখে ননীবালা উঠে এসে ধমকান—ও-রকম করিস না, মেজাজ ভাল নেই, উঠে আবার মারধর করবে।

ঠিক তখনই বীণা দরজা খোলে। ক্লান্ত চেহারা, দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে, ডান হাতে পাখার ডাঁটটা তুলে এলোপাথাড়ি কয়েক ঘা কসায় বাচ্চাগুলোর মাথায়, গায়ে, শ্বাসের সঙ্গে চাপা চিৎকারে বলে—যাঃ যাঃ, আপদ কোথাকার। জন্মে কখনও শুনিনি পাঁচ মাসের আগে বাচ্চা নষ্ট হলে কেউ আঁতুড় বা অশৌচ মানে। আমার বেলা যত নিয়ম! যাঃ যাঃ, ছুঁবি না আমাকে, ধারেকাছেও আসবি না।

বীণার মূর্তি দেখে ননীবালার কথা জোগায় না। রণেন চায়ের কাপে চোখ রেখে বসে থাকে। বীণা দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, তখন ননীবালা বললেন—তা আমি কি জানি ক’মাস! আমাকে কি তোমরা কিছু বলো?

বীণা তীব্র চোখে বলে—পাঁচ মাসে পঞ্চামৃত হলে আপনি তা জানতে পারতেন না? কচি খুকি তো নন। ঢের বয়স হয়েছে।

রণেন বুঝতে পারে, মা একটা ভুল করেছে কোথাও। এ সব মেয়েলি ব্যাপার তার মাথায় ঢোকে না, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারে হয় ননীবালা ভুল করে কিংবা ইচ্ছে করেই আঁতুড় আর অশৌচের কথাটা তুলেছেন। সম্ভবত ননীবালার ধারণা ছিল যে, বীণা একালের মেয়ে, এত সব খুঁটিনাটি সে জানে না। কিন্তু ইচ্ছে না ভুল তার বিচার হবে কী করে? সংসারের কত সত্য কথা কোনওদিনই জানা যায় না!

ননীবালা এক পরদা গলা নামিয়ে বলেন—অশৌচ না মানলেও হাসপাতালের ছোঁয়াটোয়া তো মানবে! না কি তাতেও দোষ?

তীব্র কণ্ঠে বীণা উত্তর দেয়—দোষ কিনা তা আপনিই জানেন! আমার বেলায় হাজার দোষ, হাজার নিয়মনিষ্ঠা। কিন্তু কারো দরদ তো দেখি না! নার্সিং হোমে বুবাইয়ের বাপ ছাড়া কেউ একদিন উকি দিয়েও দেখে আসেনি, এক বেলা কেউ ঘরের ভাত পৌঁছে দিয়ে আসেনি! আর দুর্বল শরীরে ঘরে পা দিতে না দিতেই আচার-বিচার শুরু হয়ে গেল!

রণেন এইটুকু শুনেছিল। চায়ের কাপ রেখে সে দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ঢুকে পড়ে। ননীবালা গরম জল করে দেওয়ার সময় পাননি, কাজেই শীতে হিম হয়ে থাকা জল তুলে রণেন তার উত্তপ্ত মাথায় ঢালতে থাকে। স্নানের দরকার ছিল না। জলের শব্দে ঝগড়ার শব্দটা ডুবিয়ে দিল কেবল।

ননীবালা অবশ্য পিছিয়ে গিয়েছিলেন। ঝগড়াটা তাই বেশি দূর গড়ায়নি। স্নানটান করে এসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রণেন দেখে, বীণা মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে, বুকের কাছে টুবাই। টুবাই ছোট, তার অপমান জ্ঞান নেই, কিন্তু বড় দুজন মার খেয়ে ঠাকুমার ঘরে ঢুকে গেছে, সেখান থেকেই তাদের গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।

চুল পাট করতে করতে রণেন তার ব্যক্তিত্বের ঘাটতিঅলা মুখখানা দেখছিল। কিছু ব্যক্তিত্ব যদি এই মুখশ্রীতে থাকত তবে এই সংসারটাকে আঙুলের ডগার সঞ্চালনে শাসন করতে পারত সে। বাপের বড় ছেলে বোকা হয়—এটা একটা প্রচলিত কথা। তার নিজের ক্ষেত্রে কথাটার ব্যত্যয় হয়নি। সে বোকাই। এবং বোকা বলেই ব্যক্তিত্বহীন। এ সবই বুঝতে পারে রণেন। ব্রজগোপালের উপেক্ষিত সংসারটি সে টানছে আজ বহুদিন। বিনা প্রশ্নে এবং বিনা দ্বিধায়। মা-বাপ-ভাই মিলে এ সংসার তো তারই নিজস্ব সংসার ছিল এতকাল। শুধু সংসার নয়, এ ছিল তার অস্তিত্ব, তার বেঁচে থাকা। মায়ের জন্য মঠ-মন্দির গাড়ি-বাড়ি সবই সে করে দিতে চেয়েছিল মনে মনে, এতকাল। কোনও দ্বিধা ছিল না, সংশয় ছিল না। সকলে বলত—রণেনের মতো এমন মাতৃভক্তি দেখা যায় না। সেই ভক্তিটা এখন আর তেমন টের পায় না রণেন। সংসার টানতে আজকাল তার কষ্ট হয়। কত ব্যয়কে মনে হয় অপব্যয়। বাবার টাকায় মায়ের নামে কেনা জমিতে নিজের টাকায় বাড়ি করা যে কত বড় মূর্খতা তা অনায়াসে বুঝতে পারছে। তাই বীণার পরামর্শে চোরের মতো সে গিয়েছিল অজিতের কাছে, জমিটা বীণার নামে কেনার জন্য। সেই গ্লানিটাও তাকে চেপে ধরে। ব্যক্তিত্বহীনদের এই রকমই সব হয়। ভাল বা মন্দের বোধ নষ্ট হয়ে যায়। কী যে করবে, কী যে করা উচিত তা সে ভেবে পায় না।

অনেকক্ষণ বে-খেয়ালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার পুরনো স্বভাব। আয়না পেলে প্রায়ই তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না।

বিরক্ত হয়ে বীণা বলল—আলোটা নিবিয়ে দাও, চোখে লাগছে।

অপ্রস্তুত হয়ে সে আলো নেবায়, আর অন্ধকারে বীণার বাঁকা গলার স্বরটা আসে—দিনরাত মুখ দেখা, তাও যদি দেখার মতো মুখ হত।

এ সবই উপেক্ষা করতে পারে রণেন। তার স্বভাব শান্ত, রেগে গেলেও সহজে প্রকাশ পায় না তার রাগ। কথা কম বলে। সে বীণাকে অন্ধকারে শুয়ে থাকতে দিয়ে বাইরের ঘরের সোফা-কাম-বেডটায় একটু কেতরে বসে থাকে। রেডিয়োটা চালিয়ে দেয়। খবর হচ্ছে। একটা যুদ্ধ-টুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা। চারদিকে টেনশন, কিন্তু দেশের খবর তাকে বিন্দুমাত্র চিন্তান্বিত করে না। সে নিজেকে নিয়ে ভাবে। ভাবতে ভাবতে ঘুম-ভাব এসে যায়, রেডিয়োটা চলতেই থাকে।

হঠাৎ চমকে উঠে শোনে পুরুষ-হাতে রেডিয়োটা বন্ধ করে দিল বীণা। ঝাঁঝ-গলায় বলে—এই কপাল-কুষ্ঠিটা খুলে রেখে ঘুমচ্ছো কেন? ব্যাটারি নষ্ট হয় না!

রণেন চোখ চায়। বীণার ক্লান্তির ভাবটা কি কেটে গেল। ঘরের আসবাবপত্র টেনে টেনে সরাচ্ছে আর আপনমনে বলছে—কদিন ছিলাম না, নোংরার হদ্দ হয়ে আছে ঘরদোর। ঝুল-কালি-ধুলো, বিছানাপত্র গু হয়ে আছে…বলতে বলতে আবার ও ঘরে যায়, আলনা হাঁটকে জামা-কাপড় ছুঁড়ে ফেলে মেঝেয়—আন্ডারওয়্যার, গেঞ্জি কী কালেকুষ্টি হয়ে আছে! আমাকে আবার আচার-বিচার শেখাতে আসে সব। নোংরার হদ্দ, বস্তিবাড়িতে গিয়ে থাকা উচিত।

রণেন বুঝতে পারে, এসব কথা শোনানোর জন্যই তাকে জাগিয়ে নিয়েছে বীণা। এখন সে যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। সহজে ছাড়বে না। বিষণ্ণ মনে রণেন বসে শোনে, বীণা ও-ঘরে ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে বলছে—কী সব চেহারা হয়েছে এ ক’দিনে। খাস না নাকি তোরা? হাড় জিরজির করছে! কনুইতে ময়লা, ঘাড়ে ময়লা, চোখে পিচুটি, দাঁতে ছ্যাতলা—কেউ এসব দেখে না নাকি! এই শীতে গায়ে গরম জামাও কেউ পরায়নি!

ননীবালা গ্যাসের উনুনের সামনে বসে আছেন নিশ্চুপে। কিন্তু সেটা তাঁর পরাজয়-মেনে-নেওয়া মনে করলে ভুল হবে। মনে মনে তিনিও তৈরি হচ্ছেন, লেগে যাবে। রণেন উঠে বসল এবং বীণার উদ্দেশে একটা দুর্বল ধমক দিয়ে বলল—আঃ কী হচ্ছে! চুপ করে শুয়েটুয়ে থাকো না।

বীণা প্রায় ঝাঁপিয়ে আসে—কেন চুপ করে থাকব? এই ঘর-সংসারে আমি কি ফ্যালনা? আমার বলার কথা কিছু থাকতে পারে না?

—এই দুর্বল শরীরে অত চেঁচিও না। ডাক্তার তোমার ওঠা-হাঁটা বেশি বারণ করেছেন।

—থাক, অত দরদে কাজ নেই। মুখের দরদ অনেক দেখা আছে।

এইভাবে শুরু হয়েছিল। ননীবালা কেন যেন উত্তর দিচ্ছেন না। চুপচাপ আছেন। বীণা গনগন করে যেতে লাগল একা একা। দু-চার ঘা বাচ্চাদের মারধরও করল শোওয়ার ঘরে। বোঝা যায়, সে ননীবালাকে উত্তেজিত করে ঝগড়ায় নামাতে চাইছে। একটা হেস্ত-নেস্ত করাই তার উদ্দেশ্য। ক্রমে ক্রমে তার কথাবার্তায় মরিয়া ভাব ফুটে উঠতে লাগল, রণেন শুনতে পায় শোওয়ার ঘরের ভেজানো দরজার ওপাশে বীণা চাপা গলায় বলছে—পাগলের গুষ্ঠি। দ-পড়া কপাল না হলে কারও এরকম শ্বশুরবাড়ি হয়।

বহুকাল আগে রণেনের একবার কড়া ধাতের টাইফয়েড হয়েছিল। তখন টাইফয়েডের চিকিৎসা ছিল না। গ্রামে-গঞ্জে ডাক্তার-কবিরাজও ছিল না সুবিধের। প্রায় বাহান্ন দিনে তার জ্বর কমেছিল বটে, কিন্তু কিছুকাল তার বিকারের অবস্থা হয়েছিল। জ্বরের পরও প্রায় মাস তিনেক সে মস্তিষ্কবিকারে ভুগেছে। লোকে বলে টাইফয়েডের পর ওই পাগলামির সময়ে সে মা-বাপকে চিনতে পারত না, নিজের বাড়ি কোথায় বলতে পারত না। সেই পাগলামি সেরে যাওয়ার পর রণেন খুব ঠান্ডা আর ভালমানুষ হয়ে যায়। কিন্তু সে যে একদা পাগল হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনাটা সে কোনওদিনই ভুলতে পারে না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় পাগলামিটা ছাই চাপা হয়ে আছে তার অভ্যন্তরে। সেই কারণেই বোধ হয় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে আজও এই বয়সেও সে নানা অঙ্গভঙ্গি করে, ব্যক্তিত্ব খোঁজে, ফাঁকা মাঠ পেলে ছেলেমানুষের মতো দু-চক্কর দৌড়ে নেয়, কিংবা একাবোকা অবস্থায় সে এরকম অনেক কিছুই করে। ‘পাগল’ কথাটা শুনলেই বরাবর একটু চমকে ওঠে। তার বুকের ভিতরে একটা ভয় যেন হনুমানের মতো এ-ডালে ও-ডালে লাফিয়ে বেড়ায়।

সে উঠে শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে বলল—শোনো, এত অশান্তি কোরো না। যদি বাড়াবাড়ি করো, তা হলে আমি বেরিয়ে যাব।

বীণা টুবাইকে হাত-মুখ ধুইয়ে এনে গরম পোশাক পরাচ্ছিল হাঁটু গেড়ে বসে। মুখ না ফিরিয়েই বলে—তুমি বেরিয়ে যাবে বলে ভয় দেখাচ্ছ কাকে? তুমি কবে ঘরে থাকো, কতক্ষণই বা থাকো? ঘরের কোনও খবর কি তোমার কানে যায়? যেতে হয় যাও, আমাকে চোখ রাঙাতে এস না। আমি আর ও-সব গ্রাহ্য করি না।

অগত্যা বেরিয়েই গেল রণেন। শীতের রাস্তায় রাস্তায় খানিক হাঁটল। মাথাটা গরম। মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেল। দু-চারজন চেনা পাড়ায় লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। সোমেন তার আড্ডা সেরে ফিরছিল। রাত হয়েছে। রণেনকে রাস্তায় দেখে সিগারেট লুকিয়ে নতমুখে পেরিয়ে যাচ্ছিল, রণেন তাকে ডাকল। এত রাত করে ফেরে, একটু শাসন করা দরকার। দিনকাল ভাল নয়।

—এত রাত করে ফিরিস কেন? লোকের চিন্তা হয় না?

সোমেন তার কমনীয় সুন্দর মুখটি তুলে হাসল। হাসিটি ভুবন-ভোলানো। রণেন শাসন করতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। সোমেন বলে—একটা পিকনিকে যাব কাল, তার সব জোগাড়যন্ত্র করছিলাম, তাই দেরি হয়ে গেল।

রণেন গলাখাঁকারি দেয়। ভাইটাকে সে কোনওদিনই কড়া কথা বলতে পারে না। বড্ড মায়াবী। আজকালকার এই বয়সের ছেলেদের যেমন ডোন্টপরোয়া ভাব তেমন নয়। তাই রণেন বলে—ও। গায়ে গরম জামা নেই কেন? ওই পাতলা সোয়েটারে কি শীত মানে? একটা পুল-ওভার কিনে নিস।

—তেমন শীত কই? আমার তো ঠান্ডা লাগেই না।

—পিকনিকে বাইরে যাচ্ছিস তো! সেখানে শীত লাগবে। বরং আমার কোটটা নিয়ে যাস।

—তোমারও তো কাল বাইরে যাওয়ার কথা। কোট তোমারও তো লাগবে!

বাইরে যাওয়ার কথা! তাই তো! গোলমালে খেয়াল ছিল না। বাবার কাছে কাল তার একবার যাওয়া উচিত। ওই অভিশপ্ত জমিটার হাত থেকে তো রেহাই নেই।

রণেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বলল—হুঁ, আচ্ছা যা।

গোলমালটা বাঁধল রাত্রে।

খাওয়া-দাওয়ার পর দরজা দিয়েছে তারা। রণেন দেখল বীণা কাগজ জ্বেলে ঘরের মেঝেয় একবাটি দুধ গরম করছে।

—ও কী করছ? রণেন জিজ্ঞেস করে।

বীণা উত্তর দিল—দেখতেই পাচ্ছ।

—ঘরে কাগজ জ্বালছ কেন, রান্নাঘর থাকতে?

—রান্নাঘরে আমি যাব না, কারও শুচিবাইয়ে লাগতে পারে।

—মাকে বললে মা নিজেই গরম করে দিত। কী করবে দুধ দিয়ে এত রাতে?

বীণা উত্তর দিল না। দুধ গরম করে ঘুমন্ত টুবাইকে টেনেহিঁচড়ে আনল বিছানা থেকে। টুবাই ঘুমের মধ্যে কাঁদে, হাত পা ছোড়ে। তাকে গোটাকয় চড়-চাপড় দিয়ে, গলায় আঁচল চেপে ঝিনুকে দুধ খাওয়াতে থাকে বীমা।

একটু অবাক হয় রণেন। একটু আগে টুবাই দুধ-ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছে। এখনই আবার খাওয়ার কথা নয়। বলল—একটু আগেই তো খেলো, এখন আবার খাওয়ানোর কী দরকার? কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে কষ্ট দেওয়া শুধু শুধু।

বীণা হঠাৎ দু’খানা ঝকঝকে চোখের ছোরা মারে রণেনকে। একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে—কেন, টুবাই বেশি খাচ্ছে বলে চোখে লাগছে নাকি? লাগলে অমন চোখ কানা করে রাখো?

রণেন চুপ করে থাকে। বীণা নিজেই বলে—বাচ্চাদের খাওয়াই, এটাকে সকলেরই চোখ কেন যে কটকট করে!

রণেন একটু উত্তপ্ত হয়ে বলে—একে খাওয়ানো বলে না। এ হচ্ছে তোমার বাতিক। অত খাওয়া কি সহ্য হবে?

বীণা খুব অবাক চোখ তুলে বলে—দু’ঝিনুক দুধ বাচ্চারা খাবে না? এ কদিন ভাল করে দুধ গেছে নাকি পেটে? তোমরা পাগল না কি! ‘অত খাওয়া’ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও?

—বলছি, পেটে অত সইবে না।

—সে আমি বুঝব। পেটে কী সয় না সয় তা আমি মা হয়ে জানি না! তুমি জানবে?

—তোমার মাথায় ছিট-পড়া।

—তা হবে। পাগলদের সঙ্গে থাকলে লোকে পাগলই হয়।

রণেন শ্বাস ফেলে চুপ করে থাকে। কিন্তু বীণার আক্রোশ তাতে কমে না। সে বলে—পাগলের গুষ্ঠি। যেমন পাগল ছিল বাপ, বাউন্ডুলে হয়ে বেরিয়ে গেছে, তেমনি ছেলে পাগল।

হঠাৎ সেই পুরনো ক্ষতে হাত পড়ে। ঠান্ডা, ভালমানুষ রণেন একটা ঝাকুনি খেয়ে জেগে ওঠে যেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে—চুপ করো বলছি!

বীণা চমকে ওঠে। টুবাই বিষম খায়। দুধ গড়িয়ে নামে গাল বেয়ে। বীণা তার শান্তস্বভাব, উত্তাপহীন স্বামিটিকে হঠাৎ উত্তেজিত হতে দেখে একটু অবাক হয়। তাকায়। এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে যায় সে তার স্বামীর একটি অতিশয় দুর্বলতার স্থান খুঁজে পেয়েছে। এতকাল এই দুর্বলতার কথা তার জানা ছিল না। মানুষ আর একটা মানুষের কত কিছু জানতে পারে না, কাছাকাছি থেকেও।

মেয়েদের নিষ্ঠুরতার বুঝি শেষ নেই। যে মুহূর্তে বীণা বুঝতে পারে যে ‘পাগল’ কথাটাই রণেনকে উত্তেজিত করেছে সেই মুহূর্তেই সে দুর্বল জায়গাটায় প্রবল নাড়া দিতে থাকে। এবং খেলাটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বীণা বলে—কেন, চুপ করব কেন? তোমাদের মধ্যে পাগলামির বীজ নেই? তোমার বাবাকে লোকে পাগল বলে না? তোমারও ছেলেবেলায় অসুখের পর একবার পাগলামি দেখা দেয়নি? আমি কি ভুল বলছি? যা সত্যি তা বলব না কেন?

ঠান্ডা এবং শান্তস্বভাবের রণেনের ভিতরে সেই হনুমানের হাঁচোড় পাঁচোড় তার ভিতরটাকে নয়-ছয় করে দেয়, রাগে চিন্তাশক্তি লুপ্ত হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে বীণা তাকে পাগল করে দিতে চাইছে। তার মনে নিভৃতে লুকিয়ে রাখা বড় গোপন ও লজ্জার স্থানটিতে এই প্রথম হানা দেয় মানুষ। সে মাথা চেপে ধরে। সে আর একবার চেঁচায়, কিন্তু কোনও কথা ফোটে না, একটা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসে। এবং সেই মুহূর্তে তার মনের যাবতীয় মানবিক চিন্তাশক্তি লুপ্ত হয়ে যায়।

বীণা তার দিকে আঙুল তুলে বলে—তুমি পাগল নও? আগে এসব জানলে তোমার সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিত? পাগলের বংশে কেউ জেনেশুনে মেয়ে দেয়?

রণেন মশারি সরিয়ে বিছানার ধারে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটটা পড়ে গেল। শূন্য এবং ভয়ার্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে রণেন। এখন থেকে এই মেয়েমানুষটার চেয়ে বড় শত্রু তার আর কেউ নেই। ওই ভঙ্গি থেকেই সে হঠাৎ পা বাড়িয়ে লাথিটা কষাল বীণার বুকে। টুবাই ছিটকে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসে। বীণা পড়ে গিয়ে ফের উঠতে যাচ্ছিল। রণেন ঝুঁকে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে তাকে হেঁচড়ে তোলে, অস্ফুট গলায় বলে—হারামজাদি, আমাকে জামাই পেয়ে তোর চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার হয়ে গেছে…বলতে বলতে সে তার ডান হাতে গোটাকয় প্রচণ্ড চড় মারে বীণার গালে। দেয়ালের কাছে নিয়ে মাথা ঠুকে দেয়, মুখ ঘষে দেয় দেয়ালে, আর বলে—পাগল! পাগল! বল, বল, পাগল? পাগল…

বদ্ধ দরজায় তখন প্রবল ধাক্কা দিয়ে বাইরে থেকে সোমেন চিৎকার করছে—দাদা, দাদা, কী করছ কী! দাদা, দরজা খোলো! মায়ের চিৎকারও কানে আসে রণেনের।

মা বলে—সর্বনাশ করিস না, ওরে সর্বনাশ করিস না!

ছেলেমেয়েরা ঘুম ভেঙে প্রথমটায় চিৎকার করে উঠেছিল। রণেন তার ক্ষ্যাপা চোখে তাদের দিকে চাইতেই তারা নিথর হয়ে গেল।

অনেকক্ষণ বাদে দরজা খুলেছিল রণেন। তখন বীণা মেঝেয় পড়ে আছে বটে, কিন্তু জ্ঞান হারায়নি। কেবল বড় বড় শ্বাস টানছিল। সোমেন গিয়ে বউদিকে ওঠায়, মা ধরে রণেনকে। রণেন ননীবালার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে। সিগারেট ধরায়। জীবনে সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতায় তার মনটা তখন অস্পষ্ট। আচ্ছন্ন। এই প্রথম সে মেয়েছেলের গায়ে হাত তুলল।

ঘরে সে আর যায়নি। সোমেন আর মা যা করার করেছিল রাতে। সম্পূর্ণ ভূতগ্রস্তের মতো সোফায় বসে রইল রণেন। ননীবালা এসে এক সময়ে বললেন—ঘরে যা রণো।

রণেন মাথা নাড়ল। সোমেন মাকে টেনে নিয়ে গেল ঘরে।

সারা রাত পরিত্যক্ত এবং আচ্ছন্ন রণেন বসে রইল সোফায়। মশার কামড় খেল, টের পেল না তেমন। সিগারেট খেল অনেক। মাথার ভিতর দিয়ে কত চিন্তার ঘূর্ণি বয়ে গেল।

মা বাবার কত ঝগড়া হয়েছে, কত আকথা কুকথা মা বলেছে বাবাকে। বাবা কোনওদিন হাত তোলেননি। স্ত্রীলোকের জন্য একটা আলাদা সম্মানবোধ ব্রজগোপালের বরাবর। এখনকার দিনে যখন আর ট্রামেবাসে পুরুষরা মেয়েদের বসার জায়গা ছেড়ে দেয় না, লেডিস সিটে জায়গা না থাকলে মেয়েরা যখন দাঁড়িয়েই যায় তখনও ব্রজগোপাল নিজের সিটটি ছেড়ে দেন। স্ত্রীলোকরা দাঁড়িয়ে থাকবেন আর আমি পুরুষ হয়ে বসে থাকব—বাবার পৌরুষে সেটা আজও লাগে। এখনও অনাত্মীয়া, অপরিচিতা মেয়েছেলের মুখের দিকে ব্রজগোপাল তাকান না, স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন, অধিকাংশ মেয়েকেই সম্বোধন করেন ‘মা’ বলে।

রণেনের মন তিক্ততা আর আত্মগ্লানিতে ভরে যায়। সারা রাত ধরে সে কত কী ভাবে। ভোরবেলা কেউ জেগে ওঠার আগেই সে পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। গড়ের মাঠের কাছে ট্রাম থেকে নেমে কুয়াশায় আচ্ছন্ন মাঠঘাটের সবুজ সৌন্দর্য দেখে। দেখতে দেখতে এক সময়ে বহেরুর খামারবাড়িটার কথা মনে পড়ে যায়। নির্বাসিত, বৃদ্ধ ব্রজগোপালকে মনশ্চক্ষে সে দেখতে পায়। নাতিদীর্ঘ সচ্চরিত্র একজন বাতিল মানুষ। হঠাৎ বাবার জন্য একটা আকুলতা বোধ করে সে।

খিদে পেয়েছিল। রেস্টুরেন্টে খেয়ে, সেলুনে দাড়ি কামিয়ে নিয়ে একটু বেলায় সে হাওড়ায় গিয়ে ট্রেন ধরে।

॥ এগারো ॥

বর্ধমানের বাজারে বহেরু একজন ভবঘুরে চেহারার লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। ডাল শস্যবীজের পাইকার পরান সাহার চেনা লোক। রোগা, কালো, লিকলিকে চেহারা, গালে আর থুতনিতে খামচা-খামচা কয়েক গাছা লোমের মতো দাড়ি—মাকুন্দই বলা যায়। দুটো গর্ত চোখে ভিতুভাব। এক চালান মাল গস্ত করে পরান সাহা তার দোকানঘরের বাইরে বলে কোঁচা নেড়ে হাওয়া খাচ্ছে—মোটা মানুষ, শীতেও ঘাম হয়। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলে—নিয়ে গিয়েই দেখ না। চোর ছ্যাঁচোড় নয়, দোষের মধ্যে কোনও একঠাঁই থাকতে পারে না! চোখে চোখে রেখো। তুমি তাঁতির কথা বলেছিলে, তাই আটকে রেখেছি।

বহেরু মাথা নাড়ল। পরান সাহা তার পুরনো খদ্দের। কাজেই খারাপ লোক দেবে না। কিন্তু ব্রজকর্তার সঙ্গে পরামর্শ না করে কথা দেয় কী করে? বলল—রও বাপু, আমি টপ করে ঘুরে আসছি। পালিও না যেন।

লোকটা সঙ্গে ধরে বলল—যদি নেন আপনার কাছে থাকব। বর্ধমানের বাজার ভাল, শানা-মাকু সব এখান থেকেই কিনে নিলে হয়।

—রাখো বাপু, আগে কর্তার মতামত দেখি। শানা-মাকু কিনতে হবে না, আমার তঁতঘর আছে।

—ও! লোকটা বিস্ময়ভরে বলে—তা কর্তা কে?

—ব্রাহ্মণ। আমার ব্রাহ্মণ। কথাটা অহংকারের সঙ্গে বলে বহেরু।

—আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তবে!

—থাকো, বিড়িটিড়ি খাও, আমি এসে যাচ্ছি। লোকটা তখন হঠাৎ আপনমনে বলে—বড় খিদে পেয়েছিল। চাড্ডি মুড়িটুড়ি—সে কথায় কান না দিয়ে বহেরু বাজারের ভিড় ভেঙে এগোয়। মশলাপট্টি পার হয়ে বড় রাস্তা ধরে খানিক এগোলে ঘড়ির দোকান। ব্রজকর্তা বসে আছে ঠায় একটা পিঠ-উঁচু চেয়ারে।

—কর্তা, হল?

ব্রজগোপাল বহেরুর দিকে চেয়ে মাথা নাড়েন। হয়নি। বহেরু একটু হাসল। বলল—ও ঘড়ি তো চোদ্দোবার সারাই হয়েছে, যন্ত্রপাতি আর কি কিছু আছে? ফেলে দ্যান।

ব্রজগোপাল বিমর্ষভাবে বলেন—পুরনো জিনিস, মায়া পড়ে গেছে। বড় ছেলে প্রথম চাকরি পেয়ে দিয়েছিল, তা চোদ্দো পনেরো বছরের বেশি ছাড়া কম না।

—একটু কথা ছিল, আবডালে আসেন।

ব্রজগোপাল নেমে আসেন—কী বলবি?

—একটা তাঁতি পেয়েছি। দুশো সুতোর কাপড় বুনতে পারে।

ব্রজগোপাল অবাক হয়ে বলেন—দুশো সুতো? সে তো শৌখিন ব্যাপার। তোর সে কাপড় কী দরকার?

বহেরুর বড়সড় শরীরটা একটু ঝুঁকে পড়ে আহ্লাদে, একটু মৌজের হাসি হেসে বলে—দুশো সুতোর কাপড় বোন যার-তার কর্ম নয়। ও কাপড় পরলে টেরই পাওয়া যাবে না যে কিছু পরে আছি। মনে হবে ন্যাংটা আছি।

ব্রজগোপাল বড় চোখে চেয়ে বলেন—ও কাপড় পরে রাজা-জমিদার, তুই চাষিবাসি মানুষ, ও পরে কি আরাম পাবি?

—দেখি কীরকম করে। পাঁচজনকে দেখানোও যাবে। আশেপাশে ঘরে কেউ তো বোনে না। একটা গুণী লোক, আটকে রাখি। কি বলেন?

—নিবি তো নে। তবে দেখেশুনে নিস, একপেট ভাতের জন্য বহু হাঘরে নিষ্কর্মা গুণী সেজে ঘুরে বেড়ায়। ব্রজগোপালের মুখে অবশ্য কোনও উৎসাহ দেখা যায় না।

বহেরু উৎসাহে বলে—তো নিই? পরান সাহার চেনা লোক।

—কত লোক তো আনলি। সেই যে সুন্দরবনের এক রাইচাষা এল আনারসের ক্ষেত করতে, তারপর চৌপরদিন পড়ে ঘুমতো—সেরকম না হয়।

—হলে বের করে দেব। একটু দোষ আছে অবিশ্যি, মাঝেমধ্যে পালিয়ে যায়। তবে হাতটান নেই। পরান সাহা তো জামিন রইল। আপনি আসুন না, দেখবেন। যদি মত দেন তো কথা পাকা করে ফেলি।

ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—দাঁড়া, ঘড়ির মেরামতিটা হোক। চোখের আড়াল হলেই ওরা যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলে। ঘড়ি বলে জিনিস।

বহেরু গুরগুরিয়ে হাসে—পুরনো যন্ত্র, ও নিয়ে কী করবে?

—তুই বড় বুঝিস। সব সারাইকর ঘড়ির পার্টস চুরি করে। বহেরু বোঝে বড় কর্তাকে এখন নড়ান যাবে না। আগাগোড়া মেরামতির সময়টা উনি ঠায় বসে থাকবেন অপলক চেয়ে। বড় সাবধানী লোক।

দোকানদার পুরনো চেনা লোক, ব্রজগোপালের টেবিল-ঘড়িটা না হোক বার ছয়-সাত সারিয়ে দিয়েছে। বুড়োসুড়ো লোক, হাত কাঁপে, মাথা নড়ে, তাই দোকানে বড় একটা খদ্দের হয় না। লোকটা, ব্রজগোপালকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বলল—ব্রজদা, এ হবে না।

ব্রজগোপাল চমকে দোকানে উঠে যান। ঝুঁকে ঘড়িটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলেন—হবে না?

বুড়ো লোকটা ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে মাথা নাড়ে—না, এর জান শেষ হয়ে গেছে। জং-ফং লেগে একাক্কার। এ-কদিন চলল কী করে সেইটাই ভারী বিস্ময়ের কথা।

—আর একটু নেড়েচেড়ে দেখুন না, বহু বছর ধরে সঙ্গে রয়েছে, বাতিল করতে মায়া লাগে।

—সারানো যায়। তবে তাতে নতুন কেনার খরচ। তেমন ভাল চলবেও না।

হতাশ হয়ে ব্রজগোপাল ঘড়িটা হাতে নিয়ে বলেন—বড় ছেলে দিয়েছিল।

—নতুন একটা কিনে নিন।

—দূর! ব্রজগোপাল ‘নতুন’ শব্দটা সহ্য করতে পারেন না বোধ হয়। বলেন—পুরনো আমলের জিনিসের মতো জিনিস হয়!

ব্রজগোপাল চাদরের তলায় ঘড়িটা নিয়ে নেমে আসেন। হাঁটতে হাঁটতে বলেন—লোকটা বুড়ো মেরে গেছে রে বহেরু, ও-পাশে একটা দোকান দেখেছি, চল তো দেখিয়ে যাই। বলে কি না চলবে না!

—আবার ঘড়ির দোকানে বসবেন! তবে আর কোকাকে দেখতে যাওয়া হবে না।

আমারও মালপত্র কেনার আছে। টাইম কটা হল?

হাতে ঘড়ি, তবু টাইম কটা হল তা দেখার উপায় নেই। ভারী রেগে গিয়ে ব্রজগোপাল বলেন—কী করে বলি?

টাইম জানতে বহেরু একজন চলতি ভদ্রলোককে দেখে এগিয়ে যায়। পিছিয়ে আবার ব্রজগোপালের পাশটি ধরে বলে—আজ আর হবে না। জেলখানার ফটক বন্ধ হয়ে যাবে যেতে যেতে।

শীতের বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাজারের ভিড়ে পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে। রাঙা ধুলো। একটা জলহীন শুকনো বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে শীতটা টের পাওয়া যাচ্ছে না, ফাঁকায় পড়লে আজ ঠান্ডা কামড়াবে খুব। বুড়ো হাড়ে শীতটা আজকাল লাগে। ব্রজগোপাল ঘড়িটা একবার ঝাঁকিয়ে কানে লাগান। কোনও শব্দ না পেয়ে বলেন—নষ্ট হবে না! তোর রাজ্যের সব লোকের ঘণ্টায় ঘণ্টায় সময় জানা চাই, যেন অফিস টাইম সবার। উত্তরের বেড়ার দিকটা ফাঁক করে বাচ্চাকাচ্চারা ঘরে ঢোকে। আমি না থাকলে ঘড়ির অ্যালার্ম বাজিয়ে মজা মারে।

বহেরু গম্ভীরভাবে বলে—হুঁ। ছাওয়াল পাওয়ালগুলান বড় খচ্চর হয়েছে। সবকটাকে কানে ধরে ওঠাবসা করাব।

গুণী লোকটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পরান সাহার দোকানের সামনে, আকাশমুখো চেয়ে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জির ওপর পড়ে পাওয়া একটা ছেড়া সোয়েটার। পেটটা খাল হয়ে পড়ে আছে, কতকাল বুঝি পেটপুরে খায়নি। পেটের খোঁদলটাকে আরও ভিতর ঢুকিয়ে শীতে কুঁজো হয়ে লোকটা আকাশের দিকে চেয়েছিল। বহেরু সামনে দাঁড়াতেও খানিকক্ষণ যেন চিনতে পারল না, তারপর সম্বিৎ পেয়ে শুকনো ঠোঁটে বড় বড় দাঁতগুলো ঢাকার চেষ্টা করল।

—কী? লোকটা বলে।

—দুশো সুতোর কাপড়? পরলে মনে হবে কিছু পরি নাই, ন্যাংটা আছি!

লোকটা ঘাড় নাড়ল। বলল—আমাদের বহু পুরুষে বুনে আসছি। ইদানীং সব গোলমাল হয়ে গেল। দাদন না পেয়ে আমার বাবা তাঁত বেচে দেয়। সে অনেক ইতিহাস। আমি তো শেষ অবদি বিষ্ণুপুর গিয়েলাম রেশমের কাজ শিখতে। ওরা শেখাতে গা করে না। সেই থেকে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তাঁত আর দাদন পেলে এখনও—

বহেরু বাধা দিয়ে বলে—মালপত্র সব পাবে। এখন কিছুদিন পেটভাতে কাজ করো তো বাপু! তোমার কাজ তো দেখি।

লোকটা রাজি। বহেরু ব্রজগোপালকে দেখিয়ে বলে—ইনি ব্রাহ্মণ। একটা নমো ঠুকে দাও, শুভকাজে ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলো—

লোকটা কথাটা ধরতে পারে না, যেন বা পায়ের ধুলো নেওয়ার অভ্যাস নেই। সে তেমনি খুব আপনমনে বলে—বড্ড খিদে পেয়েছিল। চাড্ডি মুড়িটুড়ি হলে—

ব্রজগোপাল বলেন—থাক থাক। লোকটাকে দেখে তাঁর মনে হয় লোকটার আত্মবিশ্বাস নেই। তবে তাঁতের কথায় তার চোখ দুখানা যেমন ঝলসে উঠল, তাতে বোঝা যায় ওই একটা ব্যাপার ভালই জানে। বহেরুকে বলেন—যা, ওকে কিছু মিষ্টিটিষ্টি খাইয়ে আন, পেটটা খাল হয়ে আছে।

বহেরু মিষ্টি বা শৌখিন খাবারে বিশ্বাসী নয়। সে ভাতে বিশ্বাসী। চারবেলা সে নিজে ভাত মারে। ভাত ছাড়া সে কিছু ভাবতে পারে না। বহেরু হাসল—মিষ্টির কর্ম নয়। রামহরিদার হোটেল থেকে পেট চুক্তিতে ভাত খাইয়ে আনি। অতটা রাস্তা যাবে।

—তুই যা। আমি পরানের গদিতে আছি। বলে ব্রজগোপাল ঘড়িটা আবার কানে তোলেন।

রামহরি লোকটাকে দেখেই বেগড়বাঁই করতে থাকে। বলে—না বাপু, পেট চুক্তিতে হবে না।

বহেরু ঝেঁকে বলে—হবে না মানে? তোমার এখানে তো সবাই তাই খায়!

—সবাই না। লোক বুঝে আমাদের আলাদা আলাদা চুক্তি।

—কেন?

রামহরি লোকটার দিকে আর এক ঝলক চেয়ে বলে—এ বাপু গাঁ-ঘরের লোক, তার ওপর উপোসী, দেকেই মনে হয়। আমরা লোক চিনি। পাইস সিস্টেমে খেতে পারে, যত ভাত তত পয়সা।

বহেরু রেগে উঠতে গিয়ে হাসে। বলে—বর্ধমানের লোকের মুখে কী কথা! এ জেলা হচ্ছে লক্ষ্মীর বাথান, তুমি এখানের লোক হয়ে দুমুঠো ভাতের মায়া করলে! তো খাওয়াও তোমার পাইস সিস্টেমে। কুছ পরোয়া নেহি। লোকটা গুণী বুঝলে রামহরিদা, দুশো সুতোর কাপড় বুনতে পারে।

রামহরি তাতে কৌতূহল দেখায় না। বেল টিপে বেয়ারা ডাকে।

লোকটি কিন্তু খেতে পারল না। মরা পেট, তার ওপর তার খাওয়া নিয়ে এত গবেষণা শুনে লজ্জাও হয়ে থাকবে। লোকটা আঁচাতে উঠে গেল। সে সময়ে পাণ্ডুয়ার ঘিয়ের কারবারি গন্ধবণিক হরিপদ চা খেতে ঢুকে বলে—বহেরু যে।

দু-চারটে কথা হয়। হরিপদ বলে—আমাদের হাটে সেদিন এক বামন বীর এসেছিল, একুনে আড়াই ফুট উঁচু হবে। এত ছোট বামন বীর দেখিনি।

সঙ্গে সঙ্গে বহেরু কৌতূহল দেখায়—কতটুকু বললে? আড়াই ফুট! তাতে কতটা উঁচু হয়?

হরিপদ মেঝে থেকে বোধ হয় ছ-ইঞ্চি উঁচু একটা মাপ দেখায় হাত দিয়ে। বহেরু বলে—আরে বাপ্‌স! লোকটাকে পাওয়া যায়?

—দুই হাটবারে এসেছিল। আবারও আসবে। যা ভিড় লেগে গেল দেখতে! দাড়িগোঁফ আছে বিশ্বাস হয় না না-দেখলে। তোমার ঠেঁয়ে নেবে নাকি?

বহেরু মাথা নাড়ল—নিলে হয়। সামনের হাটবারে যাবখন। কিম্ভুত মানুষের বড় শখ আমার। ঠিক মাপ বলছ? বামন বীর আবার একটু লম্বাটে হয়ে গেলে তেমন কিম্ভূত থাকে না।

হরিপদ চোখ বড় করে বলে—ঠিক মাপ মানে! শ্রীমন্তর দরজিঘরে গজফিতে দিয়ে মাপা হয়নি নাকি। তা বামন বীর নিয়ে কি পালবে পুষবে?

—ওই একরকম। বলে বহেরু, একটু হাসে।

—তুমি বাপ নিজেই কিম্ভূত আছে।

তাঁতি লোকটা লুঙ্গিতে হাতমুখ মুছে দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে। বহেরু উঠে পড়ল। খাবারের পয়সা দিতে দিতে মুখ ঘুরিয়ে হরিপদকে আবার মনে করিয়ে দিল—সামনের হাটবারে যাচ্ছি।

রাস্তায় এসে পিছু-পিছু আসা লোকটার দিকে একবার ফিরে চেয়ে কী ভেবে বহেরু বলে—রাতেরবেলা আবার খেওখন। এ শালারা ব্যাবসাদার, লোকের পেট বোঝে না।

লোকটা এতটুকুন হয়ে বলে—আমি বেশি খাই না। ঘুরে ঘুরে বেড়াই, খাওয়ার বেশি বায়নাক্কা থাকলে চলে?

বহেরু একটু শ্বাস ফেলে বলে—কিন্তু দুশো সুতোর কাপড় বুনতে হবে—মনে থাকে যেন। আমার ইজ্জত রেখো।

পরানের গদিতে ব্রজগোপাল ক্যাশবাক্সের পিছনে বসে নিবিষ্টমনে তখনও ঘড়িটা ঝাঁকাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কানে তুলে শব্দটা শুনবার চেষ্টা করছেন। বহেরুকে দেখতে পেয়ে বললেন—ঘরে থাকতে যাও বা একটু-আধটু চলছিল, এ ব্যাটা খুলেটুলে একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। একটুও টকটক শব্দ শুনছি না। পার্টস-ফার্টস খুলে নিয়েছে নির্ঘাত।

বহেরু হাসে। তার বলতে ইচ্ছে করে—নতুন ঘড়ি আপনাকে একটা কিনে দেব, ওটা ফেলে দ্যান। তা দিতেও পারে বহেরু। এবার ফসলে ভাল টাকা এসেছে। ঘেরপুলিশকে মাঠে কিছু ফসল দিতে হয়েছে। তা হলেও সে আর কতটুকু? ব্রাহ্মণকে একটা ঘড়ি দান করতে আটকায় না। কিন্তু ব্রজগোপালকে সেকথা বলতে সাহস পায় না বহেরু ডাকাত। ব্রজকর্তা কখনও কারও থেকে কিছু নেন না। ওই নষ্ট ঘড়িটা ধরে বসে থাকবেন, ঝাঁকাবেন, দুঃখ করবেন, কিন্তু অনাত্মীয় কারও কাছ থেকে নতুন একটা ঘড়ি নেবেন না হাত পেতে। এজন্যেই লোকটাকে বড় ভালবাসে বহেরু।

ব্রজগোপাল মুখ তুলে বলেন—সায়ংকালটা পার হয়ে গেল রে! আর কত দেরি করবি? আমার আহ্নিক হল না।

—এই আসি। বলে বহেরু বেরিয়ে যায়।

দোকানপাট সেরে গাড়ি ধরবার জন্য স্টেশনে যখন তিনজন পোঁছাল তখন চারধার অন্ধকার হয়ে গেছে। গাড়ি ছাড়তেই দৌড়ঝাঁপ-করা শরীরে যে ঘাম জমেছিল তা শিরশিরিয়ে ওঠে শীতের বাতাসে। বুড়ো হাড়ে শীত বড় লাগে। ব্রজগোপাল কানমুখ ঢেকে বসেন। বহেরু একটু আবডালে গিয়ে পকেট থেকে ছোট কলকে আর গাঁজা বের করে। তাঁতি লোকটা ব্রজগোপালের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ে ভাতঘুমে।

বহেরু গাঁজাটা উপভোগ করে। গাড়িতে লোকজন আছে, দেখছে তাকে গাঁজা খেতে। কিন্তু তার দিকে চেয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। বহেরু সেটা জানে। নিজেকে তাই মাঝেমধ্যে রাজা-জমিদারের মতো লাগে তার। সুখ এরেই কয়। কোকা গত তিন বছর জেলে পচছে, আরও বছর-দুই ঘানি টানবে। ছেলেটাকে একবার চোখের দেখা দেখে আসবে ইচ্ছে ছিল। হল না। মাঝলা সন্তান ভাল হয় না বড় একটা, আর বড় ছেলে হয় বোকা। কোকা তার মেজো ছেলে। ছেলেবেলা থেকেই খারাপ, গোবিন্দপুর ইস্কুলের মাস্টাররা মেরে মেরে হয়রান। তারপর ধরল ডন-বৈঠক, আখড়ায় যেত। পাহাড় সমান শরীর নিয়ে বজ্জাতি করত। সেবার বেদরকারে খামোক একটা ছোকরাকে কেটে ফেলল খালধারে। ছোকরাটা পার্টি করতে এসেছিল, একটু-আধটু বিষ ছড়িয়েছিল বটে, কিন্তু সে তেমন কিছু না। গাঁ ঘরে শহুরে কথা বুঝবার মতো বুঝদার কজন? তবু তার সঙ্গে কোকার কী একটা শত্রুতা তৈরি হল। ছোকরাকে পুলিশও ভাল চোখে দেখত না, নইলে কোকাকে আরও ঝোলাত কঠিন মামলায়। অল্পের ওপর দিয়ে বেঁচে গেছে কোকা। খুনটা ঠিক প্রমাণ হয়নি। শুধু জানা গেছে যে, খুনের দলে ছিল। কিন্তু নিজের ছেলেটাকে ঠিক বুঝতে পারে না বহেরু। ও শালা অনেকটা তার নিজের মতোই। দাপ আছে। কিন্তু হিসেবি-বুদ্ধি নেই। ছেলেটাকে ভালও বাসে বহেরু, আবার একটু ভয়ও পায়। গত মাসে গিয়ে দেখা করেছে। শরীর মজবুত হয়েছে আরও, পাথরটাথর ভাঙে, যাঁতা ঘোরায়, ঘানি টানে। কিছু খারাপ নেই। বহেরুর তাই দুঃখ হয় না। তার আরও ছেলে আছে, এক-আধজন কম থাকলেও কিছু অভাব বোধ হয় না।

বৈঁচীতে যখন নামল তারা তখন চারধারে বেশ রাত ঘনিয়ে এসেছে। দুজন মুনিশ হাজির ছিল স্টেশনে, সঙ্গে বহেরুর দুই ছেলে। তাদের সঙ্গে আর একজন লোকও দাঁড়িয়ে আছে, মোটাসোটা চেহারা, কোটপ্যান্ট পরা। ব্রজগোপাল নামতেই লোকটা এগিয়ে এসে প্রণাম করে।

আলো-আঁধারে ঠিক চিনতে পারেননি ব্রজগোপাল। ঠাহর করে দেখেই চমকে ওঠেন। বুকের ভিতরটা ধক ধক করে। বহেরু ঝুঁকে দেখে বলে—রণেনবাবু না?

ব্রজগোপাল সর্বদাই দুঃসংবাদের অপেক্ষা করেন। বয়সটা ভাল না। ননীবালার বা তাঁর নিজের। গলাটা সাফ করে নিয়ে বলেন—তুমি?

রণেনের গলার স্বরটা ভারী মৃদু, বলে—দুপুরে এসেছি, তখন থেকে বসে আছি।

—ও। তা খবর কী? খারাপ খবর নাকি?

—না না। আপনার শরীর খারাপ খবর পেয়ে এলাম।

—চিঠি দিয়ে আসতে পারতে, তা হলে আর যেতাম না বর্ধমান। আমিও দুপুরের দিকেই গেছি। কিছু বলবে?

—কেমন আছেন এখন?

—ভাল। একটু বুকে ব্যথা হয়। বোধ হয় হার্টটার জন্যই। তা এই বয়সে আদিব্যাধি তো হবেই। চিন্তা কী?

—কলকাতা শীগগীর যাবেন-টাবেন না?

—যাব-যাব তো রোজই করি। হচ্ছিল না। শরীরটার জন্যই। দু-চারদিনের মধ্যেই যাব।

—সেই জমিটার ব্যাপারে—

ব্রজগোপাল থমকে যান। পুরনো অভিমানটা বুকের ব্যথার মতোই ঘনিয়ে ওঠে। এরা কেবল দশটি হাজার টাকা চায়, তার জন্যই এত যাওয়া-আসা, এত খোঁজখবর!

ব্রজগোপাল গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন—জমিটা তোমরা কিনা। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই গিয়ে টাকা দিয়ে আসব।

বড় ছেলের চেহারায় ঘরগৃহস্থালির ছাপ পড়ে গেছে। কচি-ভাবটি আর নেই। বরাবরই ছেলেটা মা-বাপ ন্যাওটা, শান্ত প্রকৃতির, আর একটু বোকাসোকা ছিল। এখনও প্রায় তাই আছে, তবে বোধ হয় এখন মা-বাপের জায়গায় বউয়ের ন্যাওটা হয়ে পড়েছে।

বহেরু ওদিকে মালপত্র ভাগাভাগি করে মুনিশদের মাথায় তুলে দিয়েছে। টর্চ আর লম্বা লাঠি হাতে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। ব্রজগোপাল আদেশ করলে রওনা হতে পারে সবাই। বহেরু দুকদম এগিয়ে এসে বলে—ওদের রওনা করে দিই কর্তা। আপনি ছেলের সঙ্গে কথা বলুন, আমি মাস্টারবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি, তিনি পুরনো তেঁতুল চেয়ে রেখেছিলেন। একসঙ্গে যাবখন।

ব্রজগোপাল ঘাড় নাড়েন। প্ল্যাটফর্মের ফাঁকা কংক্রিটের বেঞ্চে বসেন দুজন। শিশির ভিজে সেঁতে আছে সিমেন্ট। হাওয়া দিচ্ছে, খুব শীত। রণেন বলে—আপনি বেশি দেরি করবেন না, ঠান্ডা পড়েছে, রওনা হয়ে পড়ুন।

—তুমি একা বসে থাকবে? আর বোধ হয় আধ ঘণ্টার মধ্যে গাড়ি নেই।

—তাতে কী? ঘোরাফেরা করব, তা করতেই সময় কেটে যাবে।

—আচ্ছা যাচ্ছি। ছুটির দিনে-টিনে এদিকে চলেও আসতে পারো তো, বহেরুর খামারের দক্ষিণে একটা চমৎকার জায়গা আছে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এসে চড়ুইভাতি করে যেতে পারো।

রণেন একটু অবাক হয়। বাবা এসব কথা এতকাল বলেননি। বরং রণেন এলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সে চুপ করে থাকে।

ব্রজগোপাল বলেন—কলকাতা শহর আর ইংরেজি স্কুলে কোনও শিক্ষা হয় না। বাচ্চা-কাচ্চাদের নানা জায়গায় নিয়ে যেতে হয়, লোকের সঙ্গে মিশতে দিতে হয়, নইলে মাথায় গাদ জমে যায়।

রণেন বলে—সারা সপ্তাহ খেটেখুটে ওই একটা ছুটির দিনে আর বেরোতে ইচ্ছে করে না।

ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ছাড়েন। একটু চুপ থেকে বলেন—আমার ঘরের বিশ্রামের চেয়ে বাইরের শ্রমটাই ভাল লাগত বরাবর। তোমার মা অবশ্য পছন্দ করতেন না। কিন্তু বাইরেটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

রণেন মাথা নাড়ে। কথা খুঁজে পায় না।

ব্রজগোপাল বলেন—আমার কথা বাদ দাও। আমার জীবনের দশা দেখে লোকে হাসে হয়তো। তবু বলি, মাঝেমধ্যে সংসার থেকে পালানো ভাল, নইলে সংসারের মাঝখানে সারাক্ষণ থাকলে কেবলই খিটিমিটি বাঁধে, সম্পর্কগুলো বিষ হয়ে যায়, একঘেয়েমি থেকে পরস্পরের প্রতি বিতৃষ্ণা আসে।

কথাগুলো খুব গভীর থেকে উঠে আসছে মনে হয় রণেনের। এবং বাবার এই অতি সাধারণ কথাগুলো তার ভিতরে যেন ছ্যাঁকার মতো লাগে। আত্মসংবরণ রণেনের আসে না। সে হঠাৎ বলে ওঠে—সংসারে বড় অশান্তি।

ব্রজগোপাল মুখ ফিরিয়ে বলেন—কীরকম?

রণেন নিজেকে সংযত করে নেয়, বলে—ওসব শুনে আপনার দরকার নেই।

ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বোঝেন। বলেন—কলকাতা শহরটাকে লক্ষ কোরো। চারদিকে মানুষকে লোভানী দেখাচ্ছে, স্বার্থপর করে তুলছে। ও হয়েছে মানুষ পচানোর জায়গা, সাধুকেও অসৎ করে ফেলে। সেই জন্যই আমি ভেবেছিলাম এদিকটায় বসত গড়ে তুলব—

রণেন গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার খুব ইচ্ছে করে সংসারের বাতিল এই মানুষটির কাছে থেকে যেতে। কাল রাত থেকে এক প্রবল অস্থিরতা, ভয়ংকর এক পাপবোধ তাকে তাড়া করে ফিরছে। তার বলতে ইচ্ছে করে—তাই হোক বাবা, এইখানেই বসত গড়ে তুলি।

কিন্তু বলে না। বহেরুর বিশাল শরীর চরাচর ঢেকে সামনে এসে দাঁড়ায়। হেসে সে বলে—আধ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতার গাড়ি আছে।

রণেন মুখ তুলে বলে—বাবা, আপনি রওনা হয়ে পড়ুন। খুব ঠান্ডা।

ব্রজগোপাল গা করেন না, বলেন—তুমি একা বসে থাকবে। আমিও থাকি, দেখতে দেখতে আধ ঘণ্টা কেটে যাবে।

—না, আপনি উঠুন। রণেন জোর করে।

অগত্যা ব্রজগোপাল ওঠেন।

ওরা প্ল্যাটফর্মের গেট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ব্রজগোপাল সেখান থেকে পিছু ফিরে চান। কুয়াশা আর ঝুঁঝকো আঁধারে কিছু দেখতে পান না বোধ হয় ভাল করে। তবু অন্ধকারে চেয়ে থাকেন।

বহেরু ডাক দিয়ে বলে—কর্তা, রিশকা নিয়ে নেব নাকি!

ব্রজগোপাল বলেন—না রে, ও-সব বাবুগিরির কী দরকার? চল্‌। হেঁটে মেরে দিই।

দীর্ঘ রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে বহেরু বলে—কর্তা, এক বামন বীরের খবর পেয়েছি। আর একটা লোক আছে গুসকরায়, তার দুহাতে চোদ্দোটি আঙুল। ছ-আঙুলে অনেকে আছে, ও সাত আঙুলে। ছনম্বর আঙুল থেকে নাকি আবার একটা আঙুল বেরিয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার। এনে ফেলব দুজনকে বহেরু গাঁয়ে।

অন্য সময় হলে ব্রজগোপাল তাকে তার বাতিকের জন্য ধমকাতেন, এখন শুধু অন্যমনে একটা ‘হুঁ’ দিলেন। তিনি বহেরুর কথা শুনতেই পাননি। ছেলেটা হঠাৎ ওই কথা বলল কেন—সংসারে বড় অশান্তি।

এক ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের ঠান্ডা বেঞ্চটায় বসে আছে রণেন। সিগারেট খায়। মনটা বড় অস্থির। কারণ রাতে সে বীণাকে মেরেছে খুব। এই প্রথম সে এই কাজ করল। হাত দুখানা আবছায়ায় চোখের সামনে তুলে ধরে সে। দেখে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা। মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলেছে! হায়! আত্মগ্লানিতে ভিতরটা ভরে ওঠে। তার বাবা ব্রজগোপাল এত ঝগড়া সত্ত্বেও কোনওদিন মার গায়ে হাত দেননি। এখনও ভিড়ের ট্রামে বাসে মেয়েছেলেকে সিট ছেড়ে দেন বাবা। মেয়েমানুষকে এখনও সম্মান করতে বাবা জানেন। সে তবে এ কী করল?

হলদে আলোয় উদ্ভাসিত কুয়াশার ভিতর দিয়ে ট্রেনটা আসছে। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। রণেন হঠাৎ সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়ায়, তাই তো! এই গ্লানি থেকে এখনই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে! সে উঠে ধীর পায়ে প্ল্যাটফর্মের ধারটায় চলে আসে। ঝুঁকে দাঁড়ায়। গাড়িটা আসছে। সব স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে লাইনের ওপর চোখ বুজে লাফিয়ে পড়া।

রণেন ঘোর-লাগা চোখে গাড়িটা দেখে। লাফানোর জন্য পা তোলে।

॥ বারো ॥

প্ল্যাটফর্মের লোকজন দেখতে পায়, রেলগাড়ির আলোয় একটা মোটামতো বোকা লোক লাইনের ওপর ঝুঁকে বোধ হয় পানের পিক ফেলতে, কী নাক ঝাড়তে, কী থুথু ফেলতে দাঁড়িয়েছে। তারা চেঁচিয়ে ওঠে—গাড়ি আসছে, গাড়ি আসছে, ও মশাই…

সময় মতোই রণেন পিছিয়ে দাঁড়ায়। ভারী বিরক্ত হয়। পৃথিবীতে এত লোক বেড়ে গেছে যে কারও চোখের আড়ালে কিছু করার উপায় নেই। তার ধারণা হল, লোকগুলো না ডাকলে সে ঠিকই অন্তিম লাফটা দিতে পারত।

গাড়ি এলে রণেন উঠে পড়ে। বেশ ভিড়। সপ্তাহান্তে যারা মফঃস্বলের বাড়িতে গিয়েছিল কিংবা বেড়াতে, তারা সোমবার থেকে ফের কলকাতার জোয়াল ঠেলতে ফিরছে। গাড়ির মেঝেয় থিক থিক করছে আধবুড়ি আর কচিকাঁচা ননএন্টিটি সব ভারতীয়। বোঁচকায়, পোঁটলায়, কোমরে, গেঁজেয় বর্ধমানের সস্তা চাল রয়েছে, কলকাতার দামি বাজারে ছাড়বে। তাদের কাঁউ-মাউ চিৎকারে কামরা গরম। তিনজন বসতে পারে এমন সিটে একটা ঠেলাঠেলি করে রণেন বসে পড়ে। মোটা শরীর, ঠিক যুৎ পায় না বসে। কিন্তু তিনজনের জায়গায় চারজনের বসার নিয়ম আছে বলে কেউ আপত্তিও করে না। ঢেউ খেলানো কাঠের সিট। দুটো সিটের জোড়ের অংশটা উঁচু হয়ে আছে, পাছায় ফুটছে। তবু সেই অবস্থাতেও হা-ক্লান্ত রণেন বসে বসে ঢুলতে থাকে। নয়নতারা আজ বড় যত্ন করেছে। কতকাল পরে দেখা। বামুনের পাতে ওরা বেঁধে ভাত দেয় না বটে, কিন্তু কাছে বসে যত্ন করে খাওয়ানো, দেখাশুনো করা—সে বড় কম নাকি!

নয়নতারা তার মুখ-চোখ দেখে, আর হাবভাব লক্ষ করে প্রথমেই বলে দিয়েছিল—বউদির সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছেন তো!

নয়নতারার সঙ্গে যখন সে-সব হয়েছিল তখন কোথায় ছিল বীণা! বহুকালের কথা সব। বহেরুর খামারবাড়িতে প্রেমট্রেম বলতে গায়ে-হাত। সে সব না হলে সরু চালের ভাত যেমন পানসে মতো লাগে চাষার মুখে তেমনি হয়। হয়েওছিল তাই, তা বলে কি নয়নতারা সে সব স্মৃতি বুকে করে বসে আছে? মোটেই না। ভুলে গেছে কবে। রণেনকে দেখে অবাক, খুশি সবই হয়েছিল, কিন্তু কোনও গুপ্ত স্মৃতির পাপবোধ ছিল না। পুকুরে আজ বেড়াজাল ফেলেছে বহেরুর লোকজন, মাছগুলো নাড়াচাড়া পড়বে। জাল তুলে হাজার মাছ তুলে আবার জাল ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল, নয়নতারা হাঁটুভর জলে নেমে গিয়ে বাছাই একটা রুই তুলে আনল প্রায় দু-সেরি। উঠে এসে বলল—এর পুরোটা আজ না খাইয়ে ছাড়ব না।

খুব খাইয়েছে। ও-বেলা মুড়ো-সুদ্ধু বারোখানা টুকরো গেছে পেটে। এ-বেলাও সাঁঝ লাগার পরই আবার গরম ভাত, মাছের ঝাল আর দুধ খেতে হয়েছে। ঘুম তো আসবেই। ঘুমোতে ঘুমোতে স্বপ্নও আসে। নয়নতারার। বীণার কাছে যেমন বাঁধা-পড়া জীবন, বহেরুর খামারে নয়নতারার কাছে তেমন নয়। কীরকম হাওয়া-বাতাস, খোলা-মেলার মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে জেনেছিল নয়নতারা! সেই জন্যই কি ওর স্বামীটা ওকে নিতে পারল না শেষ পর্যন্ত? তা বলে নয়নতারাকে কেউ আবার যেন দুঃখী বলে না ভাবে। ও সব দুঃখ-টুঃখ তার আসে না। আজ দুপুরে মাথার কাছে বসে সুপুরি কাটছিল। জাঁতিটা ভারী শৌখিন। রুপোর মতো। রণেন হাত বাড়িয়ে জাঁতিটা টেনে নিয়ে বলল—কী জিনিস দিয়ে তৈরি বলো তো! এমন দেখিনি।

নয়নতারার একটা হাসি-রোগ আছে। মুখে আঁচল চেপে বলল—এখনও মানুষটার দোষ যায়নি দেখছি?

শোওয়া অবস্থা থেকে ঘাড় তুলে রণেন বলে—কী দোষ দেখলে?

—বয়সের।

—যাঃ! রণেন বলল।

—তবে জাঁতির নাম করে হাত ছুঁলেন যে বড়!

রণেন বলে—ওকে ছোঁয়া বলে না।

—খাবলকেও ছোঁয়া বলে না তো বাপু, ছোঁয়ার আবার আলাদা রকম আছে নাকি!

—মনে পাপ না থাকলেই হল। রণেন বলে।

নয়নতারা ছেনাল সন্দেহ নেই। কিন্তু বড় একটা শ্বাস ফেলে বলে—মনের পাপের কথা বলছেন! সে বড় জটিল কথা!

—জটিল কেন হবে?

নয়নতারা মাথা নেড়ে বলে—একটা পুরুষ আর একটা মেয়েমানুষ একঠাঁই হলেই মনে পাপ জাগে। এ প্রকৃতির নিয়ম।

ঘরটা ছিল নয়নতারার। পাকা ঘর, ওপরে টিন। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দক্ষিণায়নের সূর্যরশ্মি ঠ্যাং বাড়িয়েছে। কেউ নয়নতারাকে কিছু বলতে সাহস পায় না, তাই তার বিছানাতেই এলিয়ে পড়েছিল রণেন। অবশ্য বাচ্চা একটা ঝিউড়ি মেয়েকে কাছে রেখেছিল সে, নলচে আড়াল দিয়ে তামাক খাওয়ার জন্য। সে মেয়েটা খানিক কড়ি খেলে মেঝেয় পড়ে ঘুমাচ্ছে। বালিশের অড়ে রোদের গন্ধ, নরম। লেপখানা যেন বা পালকের তৈরি। তার ওপর হাতের কাছে নয়ন নিজে। এমনতরো বিলাস জীবনে কমই ভোগ করেছে রণেন। সেই চিন্তাহীন আরামের মধ্যে হঠাৎ একটা দার্শনিকতা ঢুকিয়ে দিল নয়নতারা। রণেন নাড়া খেয়ে বলে—পাপ জাগে? সে কীরকম?

এতক্ষণ আপনি-আজ্ঞে করছিল, হঠাৎ গলা নামিয়ে নয়নতারা বলে—বলো তো, একটা বয়সের ছেলে আর একটা বয়সের মেয়ের দিকে যখন তাকায় তখনই সব সময়ে একটা কিছু পাপ ইচ্ছে জাগে কিনা? যেখানেই হোক, যখনই হোক, চেনা বা অচেনা যা-ই হোক, হয় কিনা-ওরকম? আমার তো মনে হয়, না হয়ে যায় না।

ভারী বিস্ময় বোধ করে রণেন শুয়ে থাকে। ভাবে। এবং আশ্চর্য হয়ে বোধ করে, ঠিক তাই। চোখে চোখে যৌনতার বীজ ছড়ায় বটে। নিজেকে দিয়েই সে বুঝতে পারে। যখন ভিড়ের মধ্যে, যখনই নিঃসঙ্গতায়, যখনই কখনও বয়সের মেয়ের দিকে চেয়েছে তখনই মনে হয়নি কি—ওই ওটা হচ্ছে মেয়েছেলে! হাঁ হাঁ বাবা, মেয়েছেলে। আর মেয়েছেলের মানে কী? মানে তো একটাই—পুরুষের কাছে মেয়েছেলের যা মানে হতে পারে। এই রকমই যৌনতার বীজাণুযুক্ত চোখ বটে আমাদের। এইজন্যই কী রামকৃষ্ণদেব বলেছেন—মাতৃভাব হৃদয়ে না এলে মেয়েদের ছুঁতে নেই। এমনকী মুখ দর্শন না করাই ভাল!

রণেন লজ্জা-টজ্জা পেল না, সে বয়স পেরিয়ে এসেছে। তা ছাড়া নয়নতারার কাছে লজ্জাই বা কী? বলল—মাইরি, কেবল জাঁতিটার দিকেই চোখ ছিল আমার!

নয়নতারা বিছানায় পড়ে-থাকা জাঁতিটা তুলে তার হাতে ফের ধরিয়ে দিয়ে বলল—তা হলে জাঁতিটাই দেখ। ভাল জিনিস। মুরগিহাটা থেকে বাবা কিনে এনেছিল, স্টেনলেস ইস্টিলের। অনেক দাম।

তখন জাঁতিটা ফেলে নয়নতারার হাত ধরতে কোনও বাধা হল না আর। তখন মনে মনে রণেন বলল—মেয়েছেলে, হাঁ হাঁ বাবা মেয়েছেলে! মেয়েছেলের মানে তো একটাই হয় পুরুষের কাছে।

চোখে চোখ রেখে নয়নতারা বলে—ঠিক বলিনি?

—ঠিকই বলেছ। ভেবেটেবে দেখলাম, জীবনের কোনও মানেই হয় না। এক-আধটা যা মানে করা যায় তার একটা হচ্ছে টাকা, অন্যটা মেয়েছেলে।

নয়নতারা ফের আপনি-আজ্ঞেয় ফিরে গেল। বলল—আমি মোটেই সে-কথা বলিনি আপনাকে।

—বলোনি?

—না, কেন বলব? টাকা আর মেয়েছেলে ছাড়া জীবনে আর কিছু থাকে না নাকি? সে আবার কীরকম? কত কিছু আছে!

—আমি তো খুঁজে পাই না।

নয়নতারা হাসল, বলল—আপনি আচ্ছা একটা লোক। অনেক ভেবেচিন্তে একটা কঠিন কথা বের করেছিলাম মাথা থেকে, সেটা জল করে দিলেন। জটিল কথা অত সহজে বোঝা যায় না।

নয়নতারারও বয়স হল, রণেনের চেয়ে বড়জোর এক-দুবছরের ছোট হতে পারে। বহেরুর প্রথম পক্ষের মেয়ে। গাঁ ঘরের তুলনায় ফরসা, মুখটায় সর্বদা একটা হাসি-মাখানো সহৃদয় ভাব, সকলের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে, রাগ নেই। সেই ব্যবহারটাই আবার প্রেম-ট্রেম বলে ভুল করে লোকে। চোখ দু’খানা বড়, নাক-টাক, ঠোঁটের কায়দা সব মিলিয়ে একরকম চটক আছে। বুদ্ধি বোধ হয় বেশি রাখে না, হাসিখুশি মেয়েদের বুদ্ধি কম হবেই, কিন্তু এক-আধটা কথা বলে বড় মারাত্মক। যেমন এই পাপ-ইচ্ছের কথাটা।

বিকেল পর্যন্ত নয়নতারার হাতখানা মাঝে মাঝে ধরে রইল রণেন। হাতটা থেমে গেল, গলে গেল, কিন্তু সহৃদয়া নয়নতারা তা ফেরত নিল না। ভাগ্যিস শীতের বিকেল কিছু তাড়াতাড়ি আসে! অবশ্য রণেন হাতের বেশি এগোবার উৎসাহও পাচ্ছিল না। মেয়েমানুষ কথাটা তার মধ্যে মাঝে মাঝে বজ্রাঘাত করছিল তখন। মেয়েমানুষের গায়ে কাল রাতে জীবনে প্রথম হাত তুলেছিল রণেন। এ পাপ কি স্খালন হওয়ার?

নয়নতারা মুখের ওপর একটু ঝুঁকে বলে—বাবা একটা মানুষের চিড়িয়াখানা বানাচ্ছে, শুনেছেন?

—সে কীরকম? বিষণ্ণ রণেন জিজ্ঞেস করে।

—সে চিড়িয়াখানায় থাকবে অদ্ভুত সব মানুষ। খুব বেঁটে, খুব লম্বা, খুব সুন্দর, খুব কচ্ছিৎ, হিজড়েও থাকবে। আরও থাকবে নানারকম। সাহেব থেকে সাঁওতাল। যত আজব মানুষ হতে পারে সব এনে জড়ো করবে। যদি বলেন তো বাবাকে আপনার কথা বলে দিই।

—কেন?

—বাবা ঠিক চিড়িয়াখানায় ভরতি করে নেবে আপনাকে।

হাতটা তখন ছেড়ে দিল রণেন।

নয়নতারা তখন দুঃখের গলায় বলে—আপনি পালটে গেছেন।

—একটু মোটা হয়ে গেছি বলে বলছ?

—তাই হবে বোধ হয়। একটা সময়ে আপনি খুব ভিতু ছিলেন, মেয়েমানুষকে বড় ভয় ছিল আপনার।

রণেন সনিঃশ্বাসে বলে—এখনও আছে।

নয়নতারা হাসে, বলে—সে মেয়েমানুষের ভয় নয়, এ বয়সের পুরুষ ডরায় কেবল বউকে, মেয়েমানুষকে নয়।

আবার চমকায় রণেন। ঠিক কথা, হক কথা। বলে—তুমি বেড়ে কথা বলছ আজ।

নয়নতারা জাঁতিটা ফের তুলে নিয়ে বলল—তখন আমাকে বড় ভয় ছিল আপনার, আজ আর নেই।

—সেটা ভাল, না খারাপ?

—খারাপ।

—কেন?

—ভয়ডর থাকাই ভাল।

—বউ কি মেয়েমানুষ নয়? তাকে তো ডরাই ঠিকই।

—দূর! বউ বিয়ের পর আর মেয়েমানুষ থাকে নাকি? পাশবালিশ হয়ে যায়।

কথাটা কতদূর অশ্লীল ও সত্য তা চোখ কপালে তুলে ভাবে রণেন। তারপর বলে—শুধু পাশবালিশ?

সে কথার উত্তরে নয়নতারা বলে—তা নয় অবশ্য, রাতের পাশবালিশ আর দিনের দারোগা-পুলিশ।

তারপর সে কী হাসি হেসেছিল সে। সারাটা দিনে কাল রাতের পাপবোধ অনেকটাই ধুয়ে মুছে দিয়েছিল। আংটিটা চাইবে বলে ভেবে রেখেছিল রণেন, তা আর চাইতে ভুলে গেল।

নয়নতারা বলে—আমাদেরও একটু একটু ভয় খাওয়া ভাল।

—কেন?

—স্বামী নেয় না বলে আমাকে সবাই কুমড়োলতা ভাবে, মাচান দিতে চায়। সে সব লোক আমার ভাল লাগে না। আমি লতানে গাছ নই, লতার মতো দেখতে যে জীব তাই। বিষ-দাঁত আছে।

—তোমার মনে পাপ। রণেন চোখ বুজে বলেছিল।

—হবে। যাই, ঠাকুরদা ডাকছে।

—কে ডাকছে বললে? রণেন চোখ খুলে জিজ্ঞেস করে।

—ঠাকুরদা, দিগম্বর। খোল-কপালে লোক।

রণেন অবাক হয়ে বলে—খোল-কপালে লোক কথাটার মানে কী?

নয়নতারা তার বিশুদ্ধ দাঁতে হেসে বলে—কোন যৌবন বয়সে ঠাকুরদার কপালে কেবল জুটেছিল ওই খোলটা, আর কিছু নাই। লোকে বলে গণেশের কলা-বউ যেমন, ঠাকুরদার খোলও তেমনি।

—বুঝলাম, তা ডাকল কোথায়, শুনতে পেলাম না তো!

—খোলের আওয়াজ হচ্ছে, শুনছেন?

রণেন কান পেতে শোনে। আগেও শুনেছে, দিগম্বরের খোল কথা কয়। এখনও কইছে।

নয়নতারা বলে—খিদের বোল তুলছে ঠাকুরদা। চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন, দে দই, দে দই। আমরা সব বুঝতে পারি। এই বাজনার জন্যই বাবা তার খুড়োকে আটকে রেখেছে এতকাল।

—বহেরু আবার এসবেরও সমঝদার না কি?

—তা নয়। মানুষের চিড়িয়াখানার কথা বলছিলাম যে আপনাকে? তাতে সব রকম মানুষ লাগে যে!

নয়নতারা উঠে গেলে ভারী একা লেগেছিল রণেনের। উঠে ঘুরে ঘুরে বহেরুর খামারবাড়ি দেখছিল। দেখে দিগম্বর পুকুরের ঘাটলায় বসে আছে, হাতে বড় কাঁসার গ্লাসে চা, চায়ের ওপর মুড়ির স্তূপ ঢেলে দিয়েছে, আর সেই মুড়ির তলা দিয়ে সুড়ুক সুড়ুক টেনে দিচ্ছে চা। চায়ে সিটনো মুড়ি চিবচ্ছে আরামে। চারদিকের দুনিয়া সম্পর্কে কোনও বোধই নেই।

একা একা ঘুরেছিল রণেন। বহেরুর খামার থেকে কয়েক কদম তফাতে তাদের জন্য বাস্তুজমি কিনে রেখেছিলেন বাবা। সেই জমি খুব সাবধানে ও যত্নে তারকাঁটা দিয়ে ঘিরেছে, জায়গা মতো আম-কাঁঠাল-নিম-নারকোল গাছ লাগিয়ে রেখেছে—এ-সব গাছ বাড়তে সময় নেয়। তাই আগেভাগে লাগিয়ে রেখেছেন বাবা। যখন ছেলেরা বসত করতে আসবে, তখন যেন ফসল দেয়। তারকাঁটার গায়ে গায়ে অমরি গাছ—এ গাছ জীবাণু মারে। সামনের দিকে শীতের গাঁদা ফুটে আছে। একটা কুয়ো কাটা ছিল। এখনও সেটা মজে যায়নি। রণেন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কুয়োর ধারে দাঁড়াল। বড় কুয়ো। গভীরে কিছু জল আছে। বোধ হয় জলটা ব্যবহার হয়, এখনও আবর্জনা পড়েনি। ঝুঁকে দেখতে দেখতে মনে হল, ভিতরের জলে মাছ ফুট কাটছে। শীতের গভীর কুয়োয় রণেনের ছায়া, তার পিছনের ধূসর শীতের আকাশের ছায়া। রণেনের তখন একবার বজ্রাঘাতের মতো ‘মেয়েমানুয’ কথাটা মনে হয়েছিল। আর লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল কুয়োর জলে। বড় শীত, তাই পারেনি।

কিন্তু একথা ঠিক, আজ বার-বারই তার মরতে ইচ্ছে হয়েছে। মেয়েমানুষের সম্মান যে রাখতে জানে না, তার মরাই উচিত। কথাটা ভাবতে ভাবতেই সে পিছু ফিরে ভূত দেখতে পায়। খুব লম্বা অপ্রাকৃত রকমের একটা লোক বেড়া ডিঙিয়ে জমির মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাঁশের একটা লাঠি, তাতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে না দাঁড়ালে আরও লম্বা ঠেকত। তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল, মুখে কথা নেই। তবে চোখের ভাষায় কথা কিছু ছিলই। চমকে উঠেও সামলে গেল রণেন। কারণ, বহেরু যে মানুষের চিড়িয়াখানা বানাচ্ছে একথাটা ভোলেনি সে। এই অস্বাভাবিক লম্বা লোকটা বহেরুর সেই চিড়িয়াখানারই একজন কেউ হবে। পিটুইটারি গ্লান্ডের দোষেই এরকমটা হয়ে থাকবে, লম্বায় অন্তত সাত ফুটের কাছাকাছি। চেহারা দেখে মনে হয় সাঁওতাল। তবে ভারী অসুস্থ, জীর্ণ চেহারা, শরীরের দৈর্ঘ্যকে দাঁড় করিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই। লোকটা দ্রুত এসেছিল বোধ হয়, হাঁফাচ্ছে। রণেন লক্ষ করে, কাঁটাতারের ওপাশে বহেরুর জ্ঞাতিগুষ্টির রাজ্যের ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের হাতে ঢিল, চোখেমুখে শয়তানি মাখানো। লোকটাকে তাড়া করেছিল বোধ হয়, রণেনকে দেখে একটু থমকে গেছে।

লোকটা হাত তুলে ডাকে, বাবু।

রণেন একটু এগোতেই লোকটা হাত তুলে ছেলেগুলোকে দেখিয়ে বলে, মারে।

রণেন ছেলেগুলোকে একটু তাড়া করে—যা, যা।

ছেলেগুলো অল্প একটু দূরে সরে যায়। লম্বা লোকটা ঘাসে বসে হাঁফায়। সভয়ে চেয়ে থাকে ছেলেদের দিকে। কাঁটাতারের বেড়া ফাঁক করে আবার সাবধানে বেরিয়ে আসে। একটু দূরে এসেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়, ছেলেগুলো কাঁটাতারের বেড়ার কাছে ঘেঁষে গিয়ে লোকটার দিকে ঢিল ছুঁড়ছে। লোকটা কুয়োর আড়ালে সরে গেল। তারপর সেও ঢিল কুড়িয়ে উলটে ছুঁড়তে থাকে। লোকটাকে ছেলেগুলোর হাত থেকে বাঁচানোর কোনও ইচ্ছেই বোধ করে না সে। পৃথিবীতে যে যার মতো বেঁচে থাকার লড়াই করুক। তার কী?

এখন রেলগাড়ির সিটের জোড়ের ওপর অস্বস্তির সঙ্গে বসে ঢুলতে ঢুলতে পুরো ব্যাপারটাকেই অবাস্তব মনে হতে থাকে তার। দেখে লম্বা লোকটা কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে দীর্ঘ হাতে বিষ মেশাচ্ছে তাদের পানীয় জলে। চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সে জেগে যায়। মেশায় যদি বিষ, মেশাগগে। তারা কোনওকালে ওই জল খেতে আসবে না তো। তারা কলকাতাতেই পার্মানেন্ট হয়ে গেল। টালিগঞ্জের বাড়িটা যদি হয়! ভারী ফাঁদে পড়ে গেছে রণেন। সিমেন্ট আর লোহালক্কড়ের জন্য আগাম দিয়েছে। বাড়িটা তাকেই করতে হবে। জমি হবে হয় মার নামে, নয়তো দু-ভাইয়ের নামে। বীণার কঠিন মুখখানা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ। বজ্রাঘাত হয় বুকে। কাল রাতে সে বীণাকে মেরেছে। একে মেয়েমানুষ, তার ওপর রোগা শরীর। কী করে বাসায় ফিরে সে বীণার মুখোমুখি হবে। এক বিছানায় শোবেই বা কী করে, ফের কথাটথাই বা বলা যাবে কি কোনওদিন? হয়তো ফিরে গিয়ে দেখবে বীণা তার বনগাঁয়ের বাপের বাড়িতেই চলে গেছে। আর হয়তো আসবে না। …না যদি আসে তবে কি খুব মন্দ হয়? যদি চিরকালের মতো বীণা ছেড়ে চলে যায় তবে কি খুব খারাপ হবে রণেনের? হবে একটু অসুবিধে, বিয়ের পরের অভ্যেসগুলো যাবে কোথায়? তবু বোধ হয় মা-ভাই নিয়ে এরকম ব্যক্তিত্বহীন আনন্দের জীবনও আবার ফিরে পাবে রণেন। তখন মাঝে মাঝে নয়নতারার কাছে আসবে। আনাড়ি পুরুষের মতো।…লম্বা লোকটার কথা আবার ভাবে রণেন…নয়নতারার কথা…বীণার কথা…বাবার কথা…সব মিলেমিশে একটা তালগোল স্বপ্ন হয়ে যেতে থাকে।

কেষ্টনগরের দিককার দুটো লোক বসেছে সামনের সিটে। ও-দিকের লোক কথার ওস্তাদ। সারাক্ষণ রঙ্গরস করছিল। গাড়িটা হঠাৎ বেমক্কা থেমে যেতে তাদের একজন। অন্যজনকে ঠিক বীরভূম বা বাঁকুড়া জেলার কথা নকল করে বলে—গাড়িটা কোথায় থামা করাল রে?

অন্যজন বলে—এ হচ্ছে হালুয়া ইস্টিশান।

—সে কীরকম?

—হাওড়াও নয়, লিলুয়াও নয়, মাঝামাঝি। হাওড়ার হা আর লিলুয়ার লুয়া নিলে যা হয়। এ হচ্ছে বাবা কার শেড। রাজধানী এক্সপ্রেসও হাওড়ায় ঢোকার আগে এখানে থামে। হালুয়া ইস্টিশানে।

রণেন চমকে ওঠে। কার শেড! তার মানে হাওড়া এসে গেল প্রায়। একটু পরে সে বাসায় পৌঁছবে।

খুব ভয়ে রণেন বাসায় ঢুকল। ভারি লজ্জা করছিল তার। মা দরজা খুলে সরে যায়।

ছেলেমেয়েরা তাদের ঠাকুমার ঘরে হল্লাচিল্লা করছে। তার ঘর অন্ধকার। বীণা ঘরেই বিছানায় শুয়ে আছে, আন্দাজ করে সে। বাতি না জ্বেলে জামাকাপড় ছাড়ে নিঃশব্দে। লুঙ্গিটা আলনার অভ্যস্ত জায়গা থেকে টেনে পরে নেয়। খবরের কাগজটা নিয়ে বসে বাইরের ঘরের সোফায়। কাগজ ভরা যুদ্ধ লাগতে পারে, এই আশঙ্কা, দুর্দিনের সংকেত। সে সব পড়ে না রণেন। চোখ চেয়ে বসে থাকে।

সোমেন ফেরেনি। বলে গেছে, ফিরতে রাত হবে। রাতে খাবে না। বীণার আর বাচ্চাদের খাওয়া হয়ে গেছে। রণেন খেয়ে এসেছে। ননীবালা খাননি। ঘটনাটা কতদূর গুরুতর হয়েছে তা এখনও বুঝতে পারে না রণেন, ছেলেমেয়েরা কাছে ঘেঁষছে না, মা কথাটথা বলছে না। ভারি বিষন্ন বোধ করে সে।

বড় ছেলেমেয়ে দুটো ঠাকুমার কাছে শোয় এখনও, তাদের মা হাসপাতালে যাবার পর থেকেই। শুধু টুবাই শোয় বীণার কাছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ার পরও রণেন অনেকক্ষণ বসে থাকে বাইরের ঘরে। তারপর এক সময়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় নিয়ে উঠে আসে। বিছানার মশারি তুলে ভিতরে ঢুকে শুয়ে থাকে চুপচাপ। বীণার গায়ে লেপ, লেপের অর্ধাংশ রণেনের প্রাপ্য। কিন্তু লেপটা টেনে নিতে তার সাহস হয় না। বিনা লেপে শুয়ে থাকে সে। বীণার গা থেকে একটা সুন্দর পাউডার বা সেন্টের গন্ধ আসে।

হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে বীণা নড়েচড়ে ওঠে। পাশও ফেরে বুঝি। এবং হঠাৎ লেপটা তুলে তার গা ঢেকে দেয় বীণা। রণেনের বুকখানা মুচড়ে ওঠে হঠাৎ। কান্না আসে চোখ ভরে। বুক ভরে। সে পাশ ফেরে।

—বীণা।

উত্তর নেই।

—ক্ষমা করো। রণেন বলে।

তারপর আঁকড়ে ধরে বীণাকে। প্রথমটায় শরীর একটু কঠিন করে রাখে বীণা। তারপর কেঁপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শরীরটা হঠাৎ নরম হয়ে যায়।

॥ তেরো ॥

সোমেন ভোরের গাড়িটা ধরতে পারেনি। অনেক রাত পর্যন্ত কাল বউদিকে নিয়ে ঝামেলা গেছে। তারপর শুয়ে শুয়ে গভীর রাত অবধি জেগে থেকেছে সে। টের পেয়েছে মাও ঘুমোয়নি। বাইরের ঘরে বসে মশা তাড়াচ্ছে। সে এক অসহনীয় অবস্থা। দাদা যে কেন বউদিকে মারল, কী করেই বা মারতে পারল, তা অনেক রাত অবধি ভেবে ভেবে তার মাথা গরম হয়েছে।

এপাশ ওপাশ করতে করতে মা এক সময়ে বলল—তোর দাদার কাছে একবার যা না।

—কেন? ক্লান্ত সোমেন জিজ্ঞেস করেছে।

—কী করছে দেখে আয়। ঝোঁকের মাথায় কী একটা করে ফেলল, এখন যদি আবার লজ্জায় ঘেন্নায় বেরিয়ে যায়—

—যাকগে। সোমেন রেগে উত্তর দিয়েছে—যাওয়াই উচিত। ভদ্রলোকের মতো দেখাবে লোকের কাছে, আর ছোটলোকের মতো সব কাণ্ড করবে।

মা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—মানুষ রেগে গেলে কত অনর্থ করে। তখন কি আর মানুষ মানুষের মতো থাকে। বউমার বড্ড মুখ হয়েছে আজকাল, বিকেলে বাড়িতে পা দেওয়া থেকে ইস্তক কী না বলছে!

সোমেন সিগারেট ধরিয়ে বলল—তোমাদের জ্বালায় আমাকে একদিন বাড়ি ছাড়তে হবে।

মা চুপ করেছিল। সোমেন বাথরুম যাওয়ার নাম করে উঠে গিয়ে দাদাকে অবশ্য দেখেও এসেছে দুবার। সোফার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, মাতালের মতো। ডাকেনি সোমেন। থাক পড়ে। মশা কামড়ে খাক। বউদির অবশ্য তেমন কিছু লাগেনি। দুর্বল শরীর বলে আর ঘটনার বিস্ময়করতায় বোধ হয় কেমন হয়ে গিয়েছিল। গালে অবশ্য আঙুলের দাগ দগদগে হয়ে ফুটেছিল, কয়েক গুচ্ছি চুল ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু দাদার ওপর এই প্রথম একটা তীব্র ঘৃণা মেশানো রাগ অনুভবও করে সোমেন। হতে পারে, দাদাকে দিনের পর দিন গোপনে উত্তেজিত ও বিরক্ত করেছে বউদি, তবু দাদা কেন অমানুষ হয়ে যাবে!

এই সব কারণেই সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। বেরোবার সময়ে দেখে সদর দরজা ভেজানো রয়েছে, দাদা নেই। বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল তার। দাদা বড় ভাবপ্রবণ ছেলে, রাগীও। অনুতাপে লজ্জায় যদি দুম করে নিজের ওপর প্রতিবোশ নিতে গিয়ে ভালমন্দ কিছু একটা করে ফেলে?

কিন্তু ভাববার সময় ছিল না। শিয়ালদা থেকে ব্যারাকপুরের গাড়ি ছাড়তে তখন আর কুড়ি মিনিট বাকি। ঢাকুরিয়া স্টেশনে এসে তাকে অপেক্ষা করতে হল কিছুক্ষণ শিয়ালদার গাড়ির জন্য। দেরি হয়ে গেল। কথা ছিল ভোরের গাড়িতে হাঁড়ি-কড়াই নিয়ে সে আর শ্যামল গিয়ে গঙ্গার ধারে একটা পিকনিকের জায়গা খুঁজে বের করবে, তারপর স্টেশনে এসে নটার গাড়ি দেখবে। পূর্বা, অপালা, আর সব দূরের বন্ধুরা ওই গাড়িতে আসবে, তাদের নিয়ে যাবে জায়গা মতো। সেটা হল না। শ্যামল নিশ্চয়ই গাল দিচ্ছে সোমেনকে।

কুয়াশা আর শীতের ভিতর দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন তাকে কখন যে ব্যারাকপুরে এনে ফেলল তা অন্যমনস্ক সসামেন টেরও পেল না। নেমে ঘড়ি দেখল, নটা বাজতে আর অল্পই দেরি। মন ভাল ছিল না বলে তার খেয়াল হয়নি যে এই গাড়িটাতেই ওরাও আসতে পারে। সে আপন মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে স্টেশনের গেট পেরিয়ে বাইরে পা দিতে যাচ্ছে তখন পেছন থেকে শুনতে পেল—ও মা! সোমেন, আমাদের নিতে এসে ফিরে যাচ্ছিস যে বড়?

সোমেনের তখন খেয়াল হয়। ফিরে পূর্বাকে দেখে একটু হাসে।

পূর্বা চোখ বড় বড় করে তাকে দেখে, বলে কোথায় চলে যাচ্ছিলি আমাদের না নিয়ে?

সোমেন বলে—ওরা কোথায়?

—ওই তো! দেখিয়ে দেয় পূর্বা। একটু পিছনে অণিমা, অপালা, ম্যাক্স, অনিল রায়—সবাইকেই দেখা যায়। ওরা গেটের কাছে এগিয়ে আসে। অপালা তাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলে—যা খিদে পেয়েছে না রে! ব্রেকফাস্ট রেডি আছে তো!

সোমেন সিগারেট ধরাল। মানুষের স্রোত বেরিয়ে আসছে। সে সেই স্রোতের মুখে থেকে একটু সরে দাঁড়ায়! অপেক্ষা করে। অপালা বোধ হয় হাতব্যাগে টিকিট খুঁজছে। পাচ্ছে না। ভ্রূ কুঁচকে অধৈর্য হাতে হাঁটকাচ্ছে, তোলপাড় করছে ব্যাগ। পাচ্ছে না। বেড়ার ওপাশে দলটা একটু সরে দাঁড়িয়েছে তোকজনকে পথ দেওয়ার জন্য। পূর্বার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে, সে বলল—ভাল লাগে না। কী যে সব কাণ্ড করিস না!

অপালা বলে—আহা, কাণ্ড আবার কী? ব্যাগ খুলে টিকিটগুলো ভিতরে ফেলে দিয়েছিলাম, বেশ মনে আছে।

অনিল রায় পাইপ খাওয়ার অভ্যাস করছেন। সেটা ধরাতে ধরাতে বেশ নিরুদ্বেগ রসিক গলায় বলেন—ভিতরেই ফেলেছিলে তো! না কি ব্যাগটা খুলতে ভুলে গিয়ে টিকিটগুলো বাইরে ফেলে দিয়েছ!

—না স্যার, স্পষ্ট মনে আছে। বলে অকারণে হাসে অপালা। অণিমাও। কারো কোনও উদ্বেগ দেখা যায় না।

কেবল পূর্বার চোখ ছলছল করে—ইস্‌ কী ইনসাল্ট স্যার! কী বিচ্ছিরি কাণ্ড! এই সোমেন চলে যাস না।

সোমেন দুপা এগিয়ে যায়, বলে—কী হল, টিকিট পাচ্ছিস না?

—নারে! অপালার ভ্রূ কুঁচকে আসে, চোখ ছোট আর তীক্ষ্ণ হয়। ব্যাগটা তুলে কাত করে ভিতরে খোঁজে।

সোমেন নিরুদ্বেগ গলায় বলে—কী আর করবি, মামাকে বলেকয়ে চলে আয়।

অপালা চোখ তুলে অবাক হয়ে বলে—মামা! মামা আবার কে?

সোমেন চোখের ইশারায় টিকিট চেকারকে দেখিয়ে দেয়। অপালা আর অণিমা অমনি ইয়ারকির গন্ধ পেয়ে টিকিটচেকারের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে থাকে। অনিল রায় ধমকে দেন—কী হচ্ছে কী?

—স্যার, সোমেন বলছে ইনি নাকি আমাদের মামা, ছি—ছি—

এ লাইনে সবাই চেকারকে মামা বলে। কেন বলে খোদায় মালুম। অল্পবয়সি চেকারটি গা ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন হঠাৎ সোজা হল। একবার বিরক্তির একটু দৃষ্টিক্ষেপ করে সোমেনের দিকে। ততক্ষণে পূর্বা রুমালে চোখ মুছছে। অনিল রায় বললেন—কোথাও বোধ হয় পড়েটড়ে গেছে তাহলে। দেন উই হ্যাভ টু পে দি ফেয়ার। বলতে বলতে হিপ পকেটের ওয়ালেটে হাত দেন।

তৎক্ষণাৎ টিকিট খুঁজে পায় অপালা। চেঁচিয়ে বলে—পেয়েছি স্যার, ব্যাগের লাইনিঙের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।

ওরা বেরিয়ে আসে। অনিল রায় বলেন—স্পটটা কি খুব দূরে সোমেন?

—জানি না স্যার।

—জানো না? অবাক হল অনিল রায়।

—না স্যার, আমিও এই গাড়িতে এলাম।

অণিমা কাছেই ছিল, বলল—সে কী? তোমার তো শ্যামলের সঙ্গে আসার কথা।

—আসিনি।

পূর্বা বলে—এ মা! কী হবে তা হলে?

অপালা রেগে গিয়ে বলে—ঠিক জানি, একটা ভণ্ডুল হবেই! এখন গঙ্গার ঘাটময় ঢ্যাঙস ঢ্যাঙস করে শ্যামলকে খোঁজো, ততক্ষণে নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাবে।

অনিল রায় নিরুদ্বেগ গলায় বললেন—তাতে কী! ব্যারাকপুর তো আর নিউইয়র্ক নয়। ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে আমি অনেক এসেছি এক সময়ে। চেনা জায়গা।

অপালা বাতাস শুঁকে বলে—স্যার, জিলিপির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

সবাই জিলিপির গন্ধ পায়। গন্ধে গন্ধে তারা দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। মুহূর্তেই সকালের শান্ত দোকানঘরটা সচকিত হয়ে ওঠে কলকাতার হাউড়ে ছেলেমেয়ের কলকলানো কথার শব্দে। জিলিপির পাহাড় ধ্বসে পড়তে থাকে।

সকাল নটাতেও রোদ ফোটেনি। কুয়াশায় আবছা গঙ্গার ধার বড় নিস্তব্ধ। এ অঞ্চলটায় বাগানঘেরা বাড়ি একের পর এক। লোকজন নেই। পাহাড়ি জায়গার মতো কুয়াশায় হিম হয়ে আছে এক প্রাচীন নিস্তব্ধতা। বাগানের মধ্যে কেবল মাথা উঁচু করে আছে কিছু মানুষের চেহারা। সত্যিকারের মানুষ নয়, পাথরের মূর্তি। কলকাতার রাস্তাঘাটে এক সময়ে যেসব সাহেবদের স্ট্যাচু ছিল তা তুলে এনে রাখা হয়েছে।

অনিল রায় পাইপের ডাঁটি তুলে ম্যাক্সকে দেখান, ইংরেজিতে বলেন—ওই হচ্ছে সত্যিকারের ব্রিটিশ স্কাল্পচার। আউট্রামের মূর্তিটা এখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রেখে দিয়েছে। সে মূর্তি ভোলা যায় না। টুপি পড়ে গেছে, আউট্রাম ঘোড়ার পিঠ থেকে ঘুরে দেখছে—এমন ডাইনামিক স্ট্যাচু খুব কম দেখা যায়। জীবন্ত পাথর। পার্ক স্ট্রিটে ওর পেডেস্টলে এখন গান্ধীর মূর্তি বসানো আছে—সেটাও মন্দ নয়। কিন্তু তার গ্র্যাঞ্জারই আলাদা।

কুয়াশার ভিতরে দেখা যায় আরও কয়েকজন পাথরের মানুষকে। ব্রিটিশ আমলের কলকাতার সব স্মৃতি। অনিল রায়ের বোধ হয় সেই সব মূর্তি দেখে যৌবন বয়সের কলকাতার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে একটু পিছিয়ে চলতে থাকেন। এবং একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্পই বলতে থাকেন বোধ হয়।

অন্যমনস্ক সোমেন এগিয়ে হাঁটছিল। পিছনে মেয়েরা। পূর্বা একটু এগিয়ে এসে বলে—কী কাণ্ড করলি বল তো!

—কী?

—এখন যদি শ্যামলকে খুঁজে না পাই আমরা?

সোমেন কথাটায় কান না দিয়ে বলে—পূর্বা, তোদের বাড়ির ওপরতলায় একটা এক-ঘরের ফ্ল্যাট খালি আছে বলছিলি না?

—হ্যাঁ। বাথরুম, কিচেন নিয়ে কমপ্লিট ফ্ল্যাট, বড় ঘর, চারধার খোলা। কেন?

—আমাকে থাকতে দিবি?

অণিমা এগিয়ে আসে—কী বলছে রে পাজিটা?

পূর্বা ঘাড় না ঘুরিয়ে বলে—আমাদের বাড়িতে থাকতে চাইছে।

—থাকবে মানে? ঘরজামাই হয়ে নাকি? বলে হাসে অণিমা।

পূর্বা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলে—যাঃ। আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটটার কথা বলছে, তোরা যা মুখ পলকা না!

অপালা অণিমার বেণী ধরে টেনে বলে—ঘরজামাই হবে কিরে, ও তোর বর না? সেই যে বিয়ে করে এলি সেদিন, ভুলে গেছিস?

সোমেন ‘আঃ’ বলে ধমক দেয়। তারপর পূর্বাকে বলে—সত্যিই আমার বড় দরকার। একমাস আমাকে থাকতে দিবি?

অপালা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে—বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? না কি কোনও পরীক্ষা—ফরীক্ষা দিবি?

সসামেন বলে—তা দিয়ে তোর কী দরকার? আমি তো পূর্বার কাছে ঘরটা ভাড়া চাইছি। মাগনা নয়।

অপালা উত্তর দেয়—তোকে দেবে কেন? পূর্বা ওটা একজন প্রসপেকটিভ ব্যাচেলরকে ভাড়া দেবে, সব ঠিক হয়ে আছে। আই-এ-এস বা ইঞ্জিনিয়ার। ডাক্তার যদিও আমি দুচোখে দেখতে পারি না, তবু তাও চলবে। তোকে দেবে কেন? বেকার, এম-এ’র মতো সোজা পরীক্ষাটাও পাশ করিসনি। তোকে দিয়ে পূর্বার ভবিষ্যৎ কী? বরং ধারকর্জ দিতে দিতে ফতুর হতে হবে।

কথাটা পূর্বার লাগে, গম্ভীর মুখখানা ফিরিয়ে বলে—কেন, ব্যাচেলারকে ভাড়া দেব কেন, আমার বুঝি বর জুটছে না?

অপালা ধমক দিয়ে বলে—কোথায় জুটছে? ধুমসি হয়ে যাচ্ছিস!

—তোরই বা কোন বর জুটছে শুনি!

সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে—তোদের কারো জুটবে না। এত ইয়ারবাজ হলে কারো বর জোটে! ছেলেপক্ষ যদি দেখতে আসে তো তাদের সঙ্গেও তোরা ইয়ারকি দিবি, পার্টি কেটে যাবে।

—মাইরি, মাইরি! অপালা লাফিয়ে উঠে বলে—আমাকে একটা পার্টি দেখতে এসেছিল কিছুদিন আগে, পাত্রের জ্যাঠামশাই আর একজন ভগ্নীপতি। আমি খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বসলাম। কিন্তু মাইরি জ্যাঠামশাইটা যা বাটকুল না, দেখেই হাসি এসে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে হাসি চেপেচুপে বসে রয়েছি। হঠাৎ শুনি ফঁক-ফঁ ফঁক-ফঁ একটা শব্দ। প্রথমে বুঝতে পারিনি শব্দটা কোথা থেকে আসছে। এদিক ওদিক চাইছি। পাত্রপক্ষকে খাবার-টাবার দেওয়া হয়েছে, তারা খাচ্ছিল আর আমার দিকে মাঝে মাঝে দেখছিল। হঠাৎ টের পেলাম, শব্দটা জ্যাঠামশাইয়ের নাক থেকে আসছে। যখনই খাবার মুখে দেয় লোকটা তখনই মুখবন্ধ অবস্থায় নাক দিয়ে শব্দটা হয়। নাকে পলিপাস থাকলে ও-রকম হয় অনেকের, মুখ দিয়ে শ্বাস টানে, কিন্তু মুখ বন্ধ করলেই বিপদ। আমি মাইরি, আর চাপতে পারলাম না, ফুড়ুক ফুড়ুক করে হেসে ফেললাম।

অণিমা জোরে হেসে ওঠে, বলে—সত্যি?

—মাইরি। কয়েকদিন পর ওরা রিগ্রেট লেটার দিল। বাবার সে কী বকা আমাকে—কিন্তু কী করব বল তো!

গঙ্গার উন্মুক্ত বিস্তারের সামনে এসে পড়তেই কনকন করে ওঠে ঠান্ডা বাতাস। সোমেন বলে—তোদের কারও জুটবে না, আমি বলে দিচ্ছি।

—ঠিক বলেছিস। অপালা দুঃখের গলায় বলে—কেবল আমাদের মধ্যে অণিমাটাই যা লাকি। ওর জুটে গেল বোধ হয়।

—কে? সোমেন অবাক হয়ে বলে।

—দুজন তো দেখতে পাচ্ছি। তুই আর ম্যাক্স। ম্যাক্স তো রোজ প্রোপোজ করছে, একটু আগে গাড়িতেও করছিল। অপালা বলে।

—যাঃ! অণিমা লজ্জার ভাণ করে—আজ করেনি।

—এই মিথ্যুক, তোরা যে ও-পাশের সিটে গিয়ে আলাদা হয়ে বসলি, তখন স্পষ্ট দেখলাম ম্যাক্স, তোকে কী বলল, আর তুই খুব মিষ্টি হেসে মাথা নিচু করলি!

—না, না, সে অন্য কথা।

—কী কথা শুনি? অপালা চোখ পাকায়।

—বলছিল কলকাতায় কলার দাম নাকি বড্ড বেশি। ও কলা ছাড়া থাকতে পারে না।

—যাঃ।

—মাইরি। আমি বলেছি, সস্তায় ওকে কলা কিনে দেব।

‘মিথুক, মিথুক’ বলে অপালা হাসতে থাকে। শীতের নদীর ধারটা বড় নিস্তব্ধ, জলের শব্দ নেই। ওরা ঢালু বেয়ে নামতে নামতেই দেখতে পেল, ডান ধারে একটু গাছপালার জড়াজড়ি, তার ওধারে দু-চারজন লোক। উনুনের ধোঁয়া উঠছে।

ভারী খুশি হয়ে পূর্বা চেঁচায়—ওই যে!

দূর থেকে তাদের দেখেই শ্যামল রাগারাগি করতে থাকে। কিন্তু কেউ চটে না। কারণ, শ্যামল চমৎকার ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখেছে, রুটি-মাখন, ডিমসেদ্ধ, কলা, চায়ের জল ফুটছে ইটের উনুনে। রান্নার দুজন লোক এনেছে শ্যামল, আর একজন নিরীহ চেহারার বন্ধু। বলেছিল বটে, একজন বন্ধুকে আনবে, তাহলে এ-ই। সোমেন লক্ষ করে, লোকটার চেহারা নাদুসনুদুস, মুখে ভালমানুষি আর বোকামি, পরনে খুব দামি স্যুট, হাতে এক ঠোঙা আঙুর।

শ্যামল যথেষ্ট মিহি ও মিষ্টি গলায় পরিচয় করিয়ে দেয়। লোকটার নাম মিহির বোস। শ্যামলের স্কুলফ্রেন্ড, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বড় ফার্মে চাকরি করে। পরিচয়ের পর হাতজোড় করে রেখেই অপালার দিকে চেয়ে বলে—সবাই বুঝি আপনারা এম-এ দিয়েছেন!

তার চেহারার ভালমানুষি আর বোকা ভাব সবাই লক্ষ করেছে। অপালার মুখে হাসি খেলে গেল বিদ্যুতের মতো। একটু চাপা গলায় বলে—দূর শালা, তা দিয়ে তোর কী হবে! বলেই নিপাট ভালমানুষের মতো গলা তুলে বলে—হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন তো!

মিহির বোস পরিষ্কার আগের কথাটা শুনতে পেয়েছে, বুঝতে পেরে সোমেন বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরায়। কিন্তু মিহির বোস শুনলেও রাগ করে না, বলে—ভারী সুন্দর স্পষ্ট কিন্তু এটা। সারাদিন এই জায়গাটায় আপনাদের সঙ্গে কাটাতে পারব ভাবতেই ভাল লাগছে।

—হরি-হরি! চাপা গলায় অণিমা শ্বাস ফেলে বলে।

—কী বললেন? মিহির একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

অণিমা অমায়িক হেসে বলে—কিছু না, হরির নাম…

অপালা হু-হু করে হাসছে। শ্যামল গাছতলায় শতরঞ্চি পাতছে, কী একটু আন্দাজ করে ধমক দিল—এই, কী হচ্ছে? আয় না তোরা, বোস এসে।

অপালা হাসি চাপতে চাপতেই চাপা গলায় বলে—এই মিহির, বোস, বোস। তারপর গলা তুলে বলে—আয় রে সবাই বসি।

থতমত খাওয়া মিহির বোস হাসতে চেষ্টা করে। অপালার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অণিমার দিকে চায়। অণিমা সঙ্গে সঙ্গে হৃ দুটো নাচাতে থাকে। অপ্রস্তুত মিহির বোস চোখ সরিয়ে নেয়। অপালা, অণিমা আর পূর্বা গা টেপাটেপি করে হাসতেই থাকে।

শতরঞ্চিতে বসে অপালা খুব দুঃখের গলায় মিহির বোসকে বলে—বাড়ি ফিরে গিয়ে আজ আপনি নিশ্চয়ই আমাদের খুব নিন্দে করবেন?

ভালমানুষ মিহির বোস তটস্থ হয়ে বলে—না, না, সে কী!

অপালা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে—করবে না রে অণি?

—হ্যাঁ করবে রে অপা। জানেন মিহিরবাবু, আমরা না খুব খারাপ। অণিমা মুখখানা চুন করে বলে।

—না, না। মিহির বোস ঠিক থই পায় না।

অপালা হাতজোড় করে বলে—আমরা সত্যিই ভীষণ খারাপ। সেইজন্য কেউ আমাদের ভালবাসে না, না রে পূর্বা?

পূর্বা মাথা নাড়ে। আঁচলে হাসি চাপতে গিয়ে কাশতে থাকে।

—আমাদের তাই বিয়েও হবে না। অণিমা করুণ স্বরে বলে।

অপালা তাকে একটা ঝাপটা মেরে বলে—না, না জানেন, আমাদের মধ্যে একমাত্র এই অণিমারই হবে। হত না কিন্তু। ভাগ্যিস লোকটা বাংলা তেমন জানে না। এই যে গঙ্গার ধারে উলোঝুলো সাহেবটা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্যারের সঙ্গে—ওর সঙ্গে অণিমার ভাব। সাহেব বলেই করছে, বাঙালি হলে কিছুতেই—

অণিমা উৎকণ্ঠিতভাবে বলে—ও বাংলা শিখে গেছে অনেকটা। তাই আর একদম প্রোপোজ করছে না আজকাল। আপনার হাতে ওটা কীসের ঠোঙা মিহিরবাবু?

মিহির বোস এতক্ষণে কথা খুঁজে পেয়ে বলল—আঙুর। তারপর শ্বাস ফেলে বলে—খাবেন?

অপালা হাত বাড়িয়ে ঠোঙাটা নিঃসংকোচে নিয়ে নেয়। বলে—পেটুক ভাববেন না তো?

—না, না। বলে হঠাৎ মিহির বোস খুব হাসতে থাকে। সবাই তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিহির বোস বলে—আমার খুব ভাল লাগছে।

বলে চকচকে চোখে সে অপালার দিকে চেয়ে থাকে।

অণিমা শ্বাস ফেলে বলে—তোরও ব্যবস্থা হয়ে গেল অপা।

পাইপ মুখে অনিল রায়, আর চোখে নীলচে ফসফরাস নিয়ে রোগা সাহেব এগিয়ে আসে। অনিল রায় বলেন—কী হচ্ছে?

পূর্বা এতক্ষণে একটা রসিকতা করে—ম্যাট্রিমণি স্যার।

—ম্যাটিনি? অনিল রায় অবাক হন।

—না স্যার, ম্যাট্রিমণি।

সবাই এত জোরে হাসে, কেউ কিছু বুঝতে পারে না।

ম্যাক্স কথা বলে খুব কম। কদিন দাড়ি কামায়নি, সাদা দাড়িগোঁফে মুখটা আচ্ছন্ন। সবুজ পাঞ্জাবির ওপর জহরকোট, নীচে পায়জামা, উলোঝুলো চুল, ন্যালাক্ষ্যাপার মতো দেখাচ্ছে। সোমেনের পাশে এসে বসে পড়ল।

সোমেন দুঃখ করে বলল—তুমি পুরো ভেতো বনে গেছ সাহেব।

ম্যাক্স হাসল। দীন এবং মলিন একরকম হাসি। বাংলা বোঝে আজকাল। বলল—হুঁ, হুঁ, ঠিক কথা।

—এবার গরমকালে তোমাকে বাঁদিপোতার গামছা পরিয়ে আম আর কাঁঠাল খাওয়াব। আমার গ্র্যান্ডফাদার আর ফাদার ওইভাবে খেত। কনুই পর্যন্ত রস গড়াবে, আর চেটে চেটে খাবে।

অপালা হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে—যাঃ! গরমকাল পর্যন্ত ও থাকবে নাকি? সেদিন ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল, দেখলি না? ও চলে যাচ্ছে।

—যাচ্ছে কোথায়! কবে থেকে তো শুনছি যাবে-যাবে!

—যাবে। অণিমা আজও পাকা কথা দেয়নি যে।

অণিমা ফের লজ্জার ভাণ করে বলে—ও প্রোপোজ করে না আজকাল, মাইরি। বাংলা শিখে যাওয়ার পর থেকে—

॥ চোদ্দো ॥

এদের দঙ্গলে সোমেন বড় একটা আসে না। ভাল লাগে না। একসঙ্গে পড়ত, কিন্তু এখন ওরা এগিয়ে রইল, সোমেন পড়া ছেড়ে দিয়েছে। পিকনিকেও আসত না, কিন্তু কাল গাব্বুর পড়ার ঘরে এসে অণিমা খুব ধরল—আমরা চার-চারটে মেয়ে যাচ্ছি, পুরুষ মোটে তিনজন—ম্যাক্স, অনিল রায় আর শ্যামলের কে এক বন্ধু। তাই ব্যালান্স অফ পাওয়ার থাকছে না। তুমি চলো সোমেন। সোমেন অবাক হয়ে বলেছে—কেন, শ্যামল যাবে না? অণিমা অবাক হয়ে বলে—শ্যামলকে ধরেই তো চারজন মেয়ে! সোমেন হেসে ফেলে বলেছে—তাই বলল।

কথাটা মিথ্যে নয়। মেয়েদের সঙ্গ ছাড়া শ্যামল কখনও থাকতে পারে না। পুরুষ-বন্ধু শ্যামলের আছে কি নেই। থাকলেও তাদের সঙ্গ ও খুব পছন্দ করে না বোধ হয়। আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েদের সঙ্গে মিশে ওর গলার স্বর আজকাল মিহি হয়ে গেছে। মিষ্টি করে হাসে, চোখের চাউনিতে কটাক্ষ দেখা যায়। অণিমা একটা শ্বাস ফেলে বলেছিল—জানো না তো, শ্যামল আজকাল পুরুষ মানুষ দেখলে বুক ঢাকার চেষ্টা করে।

সোমেনের মন ভাল নেই। কাল রাতে দাদার কাণ্ডটা সারাক্ষণ মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে শীতে কেঁপে উঠছে সে। এতকাল সংসারের ভিতরের গণ্ডগোলটা এমনভাবে তাকে স্পর্শ করেনি। দাদা এত নীচে নেমে যায়নি কখনও। বড়দি মাকে ইনল্যান্ডে একটা চিঠি দিয়েছে, দাদা নাকি টালিগঞ্জের জমিটা বউদির নামে কিনবার চেষ্টা করছে। কেনে কিনুক, সোমেনের কিছু যায় আসে না। কিন্তু সেটা দাদা, বা সোমেনকে জানাতে পারত। জানায়নি। এটা নিয়েও হয়তো কথা তুলবে মা। সংসারে আর একটা অশান্তি লেগে যাবে। পিকনিকে এসে সোমেনের তাই মন ভাল নেই।

একা একা একটু ঘুরবে বলে দঙ্গল ছেড়ে বেরোচ্ছিল, এ সময়ে অণিমা সঙ্গ ধরে বলে—কোথায় যাচ্ছ?

—বসে থেকে কী হবে! আমার আজ ইয়ারকি ভাল লাগছে না। তোমরা মিহির বোসকে যা বাঁদরনাচ নাচাচ্ছ!

—বা রে, আমাদের দোষটা কী? লোকটা অত বোকা কেন?

সোমেন ক্ষীণ হাসে, বলে—অবশ্য লোকটারও খুব খারাপ লাগছে না। বোধ হয় অপালার প্রেমে পড়ে গেছে।

—পড়েছেই তো! তোমার মতো হার্টলেস নাকি!

সোমেন একটা ঢিল কুড়িয়ে দূরের একটা ল্যাম্পপোস্টের দিকে ছুঁড়ল। লাগল না। বলল—অণিমা, তুমি এবার একটা প্রেমে পড়ে যাও, নয়তো বাড়ি থেকে পছন্দ-করা ছেলেকে বিয়ে করে ফেল।

—কেন?

—এমন সুন্দর বয়সটা পেরিয়ে যাচ্ছে।

খিলখিল করে ইয়ারকির হাসি হাসে অণিমা, বলে—ভীষণ ফ্রাস্টেটেডরা ওই সব কথা বলে। নিজের হচ্ছে না, তাই অন্যকে উপদেশ দেওয়া।

—পুরুষের বয়স আর মেয়েদের বয়স কি এক? বলে আর একবার ল্যাম্পপোস্টটা লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে সে। লাগে না।

অণিমা হাত ধরে হঠাৎ তাকে থামিয়ে বলে—ব্যস, আর এগিয়ো না, এখান থেকেই ল্যাম্পপোস্টটায় লাগাও দেখি, ক’বারে পারো দেখব!

সোমেন দাঁড়ায়। একটু হেসে ঢিল কুড়িয়ে নেয়। ছোঁড়ে। অনেক দূর দিয়ে সেটা চলে যায়। অণিমা তখন মুখ ফিরিয়ে বলে—সসামেন, তোমার ঢিল ছোঁড়া দেখেই বোঝা যায় আজ তোমার মন খারাপ।

—না না, কে বলল?

—ঢিলটা ল্যাম্পপোস্টে লাগাতে বললাম কেন জানো? ওটা একটা সাইকোলজিক্যাল টেস্ট। খুব গম্ভীরমুখে অণিমা বলে।

সোমেন জানে, এটা ইয়ারকি। তবু বলে—ঠিক আছে, দাঁড়াও লাগাচ্ছি।

একটার পর একটা ঢিল ছুঁড়ল সোমেন। একটাও লাগল না। অনেক দূর দূর দিয়ে চলে গেল। অণিমা হাসে, বলে—আর ছুঁড়ে কাজ নেই, আমার যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে। এখন চলো তো, কফি হচ্ছে।

সোমেন একটা সিগারেট ধরায়, চারপাশে চেয়ে দেখে। কুয়াশা এখনও কাটেনি, তবু এই বেলা সাড়ে দশটায় ভোরের সূর্যের মতো এক রক্তিম কুয়াশায় ঢাকা সূর্য গঙ্গার জলে কী অপরূপ আলো ঝরিয়ে দিয়েছে। শ্রীরামপুর এখনও আবছা, তবু এক বিমূর্ত ছবির মতো ফুটে উঠছে নদীর ওপারে। জলে নৌকা, শীতের শান্ত নদীতে চিত্রার্পিত হয়ে আছে। এ পারে ব্রিটিশ আমলের গন্ধমাখা নির্জনতা, বাংলোবাড়ি, ভাঙা পাড়। শ্রীরামপুরের পশ্চাৎপট নিয়ে অণিমা দাঁড়িয়ে। অণিমার মুখশ্রীর কোথাও কোনও বড় রকমের খুঁত নেই। ভোরের আলোয় তাকে ভালই দেখাচ্ছে। একটু হাসিমুখ, চোখে করুণা। সোমেন মাথা নেড়ে বলে—তুমি ঠিকই ধরেছ, মন ভাল নেই।

—কেন সোমেন?

—কিছু না। বলে সোমেন ঢিল কুড়িয়ে নেয়। আবার ছোঁড়ে।

অণিমা বলে—আজ লাগবে না। যতই চেষ্টা করো।

—লাগবে।

—অত সোজা নয় মশাই।

—আচ্ছা দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।

তারপর আরও অনেকগুলো ঢিল ছোঁড়ে সোমেন। এক-আধটা খুব কাছ দিয়ে যায়। কিন্তু লাগে না। অণিমা বলে—ইস, আর একটু হলে লেগে গিয়েছিল।

—লাগবে, দাঁড়াও না।

আবার ছোঁড়ে সোমেন। যত মনঃসংযোগ করে ততই ল্যাম্পপোস্টটা আরও দূরের বস্তু, অলীক কল্পনা, ছায়াশরীর হয়ে যায়। ঢিল লাগবার বাস্তব টং শব্দটা শোনা যায় না।

—অমন ডেসপারেটভাবে ছুঁড়ো না। অণিমা সাবধান করে দেয়—কার গায়ে লাগবে।

হতাশ হয়ে সোমেন বলে—এক-একদিন এ-রকম হয়। সেদিন যে কাজেই হাত দাও সব পণ্ড হবে। এক-একটা দুষ্ট দিন আসে।

অণিমা হাসে, বলে—তুমি যতক্ষণ ল্যাম্পপোস্টটাকে ভুলে না যাবে ততক্ষণ ঢিল লাগবে। না।

—লাগবে না? দেখি!

শ্যামল দূর থেকে তাদের নাম ধরে ডাকছে। অণিমা সাড়া দিয়ে সোমেনকে বলে—চলো, চলো, কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

সোমেন মাথা নেড়ে বলে—না, যতক্ষণ না লাগাতে পারি ততক্ষণ যাচ্ছি না।

—আচ্ছা পাগল। ছেলেমানুষ একটা।

সোমেন হেসে আরও কয়েকটা ঢিল কুড়িয়ে বাঁ হাতে জড়ো করে।

—লক্ষভেদ করে কোন দ্রৌপদীকে পাবে বাবা! ঠান্ডা কফি আমি দু-চোখে দেখতে পারি না—বলে অণিমা চলে যায় রাগ করে।

সোমেন একা নিরর্থক ল্যাম্পপোস্টে ঢিল লাগানোর খেলাটা খেলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য স্থির থাকে না। কত কথা ভাবে, আর আন্দাজে ক্লান্ত হাতে ঢিল ছোঁড়ে। অনভ্যাসে হাত ব্যথিয়ে ওঠে, শীতের বাতাসে নিষ্পলক চোখে জল আসে। তবু আক্রোশে, হতাশায় ঢিল ছুঁড়তে থাকে সসামেন। ফ্রাস্টেশন? তাই হবে।

টং করে অবশেষে একটা ঢিল লাগল। সোমেন একা একা হাসল। সফলতার একটা ক্ষীণ আনন্দ টের পায় সে, এত তুচ্ছ ব্যাপার থেকেও। পরমুহূর্তেই ভাবে, কত নিরর্থক। হাত ব্যথা করছে, ক্লান্তি লাগছে। তারপর একা সোমেন বহুদূর পর্যন্ত হেঁটে চলে গেল।

একটু দূরে একটা গাছের তলায় অনিল রায় হুইস্কির বোতল খুলে বসেছেন, তাঁর সামনে গেলাস হাতে ম্যাক্স আর মিহির বোস। শ্যামল রান্নার তদারকিতে ব্যস্ত, তার কোমরে গামছা, পূর্বা তার পেঁয়াজ কুচিয়ে দিচ্ছে। গাছের ডালে একটা খাটো দোলনা বেঁধে দুলছে অপালা। অণিমার হাতে বই, হাঁটু মুড়ে গাছতলায় বসে আছে।

—কী করছিলি এতক্ষণ? একটা ধমক দেয় অপালা।

সোমেন বলে—ধুমসি কোথাকার, দোলনা ছিঁড়লে বুঝবি মজা। এখনও বয়স বসে আছে ভেবেছিস?

—তোর ঢিল ছুঁড়বার বয়স থাকলে আমারও দোলনার বয়স আছে।

অণিমা মুখ তুলে গম্ভীর গলায় বলে—শোনো।

—কী?

—শেষ পর্যন্ত তুমি ল্যাম্পপোস্টটায় ঢিল লাগিয়েছিলে?

—হুঁ।

—কবারে?

—খেয়াল করিনি। কেন?

—ভাবছিলাম। জানিস অপা, সোমেনের খুব ডিটারমিনেশন, ও দেখিস, উন্নতি করবে।

—কীসে বুঝলি? অপালা দোলনা থেকে নেমে কাছে আসতে আসতে বলে।

—ঢিল ছোঁড়া দেখে।

অপালা শ্বাস ছেড়ে বলে—ঠিকই, ও খুব বীর।

অণিমা বিচ্ছুর মতো মুখ করে বলে—না, না, ওকে এতকাল যা ভেবেছিল ও কিন্তু তা নয়। ঢিলটা লাগানো খুব শক্ত ছিল, ও কিন্তু পেয়েছে।

সোমেন রেগে গিয়ে বলে—তুমিই তো ঢিলটা লাগাতে বললে।

অণিমা হঠাৎ চোখ বড় করে তাকায়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সোমেনের দিকে, তারপর যেন সম্মোহন থেকে জেগে উঠতে উঠতে বলে—তুমি সেজন্যই অত সিরিয়াস হয়ে গেলে? না হয় আমার মুখ থেকে একটা কথা বেরিয়েই গেছে! বলে আবার বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে অণিমা। আস্তে করে বলে—ভেবেও সুখ যে একজনের কাছে আমার কথার এত দাম। সোমেন! তুমি কী তবে বলে থেমে চেয়ে থাকে অণিমা।

সোমেন মাথা নাড়ে। বড় বড় চোখে অণিমার দিকে তাকায়। আস্তে করে গাঢ় স্বরে বলে—তবে আজ বলি?

অণিমা মাথা নেড়ে কানে হাত চাপা দেয়, ভয়ার্ত গলায় বলে—না, না, এখন নয়। যেদিন ফুল-টুল ফুটবে, চাঁদ-টাঁদ উঠবে, লোডশেডিং থাকবে, সেদিন দূরে কোথাও গিয়ে—

অপালা ব্যাপারটা দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে হঠাৎ শ্বাস ছেড়ে বলল—মাইরি, পারিস তোরা! কিন্তু ও কথাটা কী। সোমেন কী বলতে চাইছিল, আর তুই-ই বা চাঁদ-ফুল-লোডশেডিং কী বললি ও-সব?

—ও একটা গোপন কথা। অণিমা বলে।

—আমার সঙ্গে কেউ গোপন কথা বলে না, মাইরি! অপালা দুঃখের গলায় বলল—বলবি। না, এই সোমেন? কিরে?

—ওটা কেবল আমার আর অণিমার একটা ডায়লগ। তুই বুঝবি না। সিক্রেট।

—ইস, সিক্রেট! মারব থাপ্পড়। বল শিগগির!

—না।

—এই সোমেন!

অপালা রেগে সোমেনের হাত খামচে ধরে। অন্য হাতে একটা থাপ্পড় কষায় পিঠে।

সোমেন বলে—ইস, হাতে কী জোর! একদম ব্যাটাছেলে।

—বলবি না?

—তোর বিয়ে হবে না, বুঝলি! সোমেন বলে—হলেও বর ফেরত দিয়ে যাবে। এমন ব্যাটাছেলে মার্কা মেয়ে জন্মে দেখিনি।

—ছেলেগুলো মেনিমুখো হলে আমাদের ব্যাটাছেলে হতেই হয়।

সোমেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলে—সেজন্যই ছেলে আর মেয়েতে ফ্রি মিক্সিং ভাল নয়। দুপক্ষেই ভেজাল মিশে যায়।

অণিমা গম্ভীর হয়ে বলে—সেই জন্যই বুঝি তুমি আমাদের সঙ্গে সহজে মিশতে চাও না সোমেন! ছোঁয়াচ বাঁচাচ্ছ?

—বটেই তো। আমার বউ হবে একটা আস্ত মেয়েমানুষ, তার মধ্যে ব্যাটাছেলের যেমন ভেজাল চলবে না, তেমনি আমার মধ্যে মেয়েছেলের ভেজাল থাকলে সে-ই বা খুশি হবে কেন?

—ইস! অপালা ঠোঁট ওলটায়—বউ! কোন বউ তোর জন্য ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে? ততাদের জেনারেশন বিয়ে হবে ভেবেছিস? বউ! মারব থাপ্পড়।

—তুই ঠিক পূর্বার মতো হয়ে যাচ্ছিস। আমার বউয়ের কথা শুনে তোর চটবার কী? সোমেন দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বলে—আমার একটা বউ হতে নেই? ভিখিরিরও আর কিছু না হোক একটা বউ হয়।

—কিন্তু তোর হবে না। বলে অপালা আঙুল তুলে তেড়ে আসে—তোর কিছুতেই হবে না।

সোমেন তেমনি তটস্থ ভাব দেখিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলে—কিন্তু প্রায় হয়ে গেছে যে!

অপালা থমকে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়, বলে—কে?

সোমেন তখন গালগলা চুলকোয়, চোখমুখ বিকৃত করে নানারকম, তারপর হঠাৎ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে—দেখছিও তো কবো না, লম্বা ঘুঁষি মারেগা, হা রে মনোপাগলা—

—ও কিরে? অপালা চেঁচিয়ে হেসে ওঠে।

—মনোপাগলা নামে একটা পাগল আসত আমাদের বাড়িতে। সে বলত।

অণিমা আর একটা কপট শ্বাস ফেলে বলে—তুই বুঝিসনি অপা।

—কী বুঝিনি?

—সোমেন প্রেমে পড়েছে। কিন্তু তার কথা আমাদের কাছে বলবে না। ওই ছড়াটার মধ্যে সেটাই বলে দিল। দেখেছে, বলবে না। না, সোমেন?

—মাইরি! অপালা চোখ বড় করে বলে—পড়েছিস?

—হুঁ

—কেমন দেখতে রে?

—দেখছিও তো কবো না!

—আবার?

সোমেন সিগারেট ধরায়, বলে—কী করে বলি কেমন দেখতে! তাকে এখনও ঠিক চোখে দেখিনি, তবে বাঁশি শুনেছি।

—বল না! বল না!

সোমেন অণিমার দিকে তাকায়, হঠাৎ গাঢ় স্বরে বলে—এই অনি, বলে দাও না সোনা! আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী?

অণিমা ইয়ারকিটা লুফে নেয়। লাজুক নতমুখে বলে—যাঃ, আমার ভারী লজ্জা করে। তুমিই বলো।

বলে অণিমা আঙুল কামড়ায়।

ধুস! অপলা ভারী হতাশ হয়ে বলে—সেই পুরনো ইয়ারকি। যা ফাজিল হয়েছিস না তোরা। সোমেন, বলবি না তো?

—দেখছিও তো কবো না—সোমেন সুর দিয়ে বলে—লম্বা ঘুঁষি মারেগা, হা রে মনোপাগলা

ভেদ হয় না, কিছুতেই ভেদ হয় না বলে অপালা হঠাৎ দু-পা এগিয়ে এসে সোমেনের সোয়েটারটা বুকের কাছে খিমচে ধরে বলে—বলবি না? বল শিগগির!

সোমেন বলে—ছাড় ছাড়, মোটে একটাই সোয়েটার আমার, বেকার মানুষ।

—বল তা হলে!

—বলছি, বলছি, পূর্বা।

সোয়েটারটা মুঠো করে মোচড়ায় অপালা—বল শিগগির ঠিক করে।

—বলতেই হবে?

—ছিঁড়লাম কিন্তু।

—তুই।

অপালা একটা ধাক্কা দিয়ে ঘন শ্বাস ফেলে বলে—ইস, সাহস কত!

পিকনিক থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বলে গিয়েছিল, রাতে খাবে না। তার কারণ, এ বাড়িতে অনুগ্রহণ করতে তার অরুচি।

জামাকাপড় ছেড়ে অনেকটা ঠান্ডা জল খেয়ে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে। ননীবালা এসে বলেন—দুটো ভাত খাবি না?

—না।

—রাতে না খেলে হাতি শুকিয়ে যায়, যা হোক দুটো খা।

সোমেন একটু রেগে গিয়ে বলে—না, খিদে নেই। খাওয়া নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো, ভাল লাগে না।

ননীবালা হাল ছাড়েন না। মুখে কিছু না বলে পান আর জরদার কৌটো খুলে বসেন। বলেন—কখন থেকে ভাত তরকারি গরম করে বসে আছি। গরম কি থাকে। শীতকাল, টপ করে জুড়িয়ে যায়।

—তুমি খাওনি?

ননীবালা ছেলের চোখের দিকে চেয়ে একটু তাচ্ছিল্যের মতো করে বলেন—খাব। তাড়া কী? তুইও দুটো মুখে দিতিস!

সোমেন একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—সহজে ছাড়বে না, না বুড়ি?

—ছেলেরা না খেলে মা যে বড় জব্দ হয়ে যায়।

—দাদা ফিরেছে?

—হুঁ। কখন শুয়ে পড়েছে। একটু আগে শুনছিলাম ও-ঘরে কথাবার্তা চলছে। ভাব হয়ে গেছে বুঝি।

—আবার ওদের দরজায় কান পেতেছিলে? সোমেন মার দিকে কটমট করে তাকায়।

ননীবালা বিরসমুখে বলেন—তুই কেবল আমার কান-পাতা দেখিস। কান পাতব কেন? জোরেই বলছিল, শুনেছি।

সোমেন হতাশ হয়ে বলে—তোমাকে নিয়ে পারি না। যত গণ্ডগোলের মূলে তুমি ঠিক থাকবে। ছেলে আর ছেলের বউ ঘরে কী বলে না বলে তা শুনতে তোমার লজ্জা করে না?

ননীবালা অন্য সময় হলে এ কথায় রেগে যেতেন। কিন্তু এখন তাঁকে খুবই ভীতু আর হতাশ দেখাচ্ছিল। বললেন—সংসারের সব কি তুই বুঝিস? ছেলেদের ভালমন্দের জন্য মাকে অনেক অন্যায় করতে হয়। লজ্জা-ঘেন্না থাকলে চলে না।

সোমেন স্থির দৃষ্টিতে ননীবালার চোখের দিকে চেয়ে বলে—তার মানে তুমি আড়ি পেতে ওদের কথা শুনেছ।

—তুই দুটি খেয়ে আমাকে ছেড়ে দে তো! শীতের রাত, তাও অনেক বেজে গেছে। বলে সোজা পানটা মুখে না দিয়ে রেখে দেন ননীবালা। ছেলের দিকে চেয়ে বলেন—চল।

সোমেন কথা বলে না। কিন্তু খেতে যায়।

কয়েক দিন হল, রান্নাঘরের এক ধারে টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলটা ভালই। শ’চারেক খরচ করে দাদা বানাল। ওপরে কালচে রঙের সানমাইকা লাগানো, পায়ায় পেতলের শু। চেয়ারগুলোও চমৎকার। রান্নাঘরটা বেশ বড়, তবু টেবিল চেয়ার পাতার পর আর বেশি জায়গা নেই। ননীবালা টেবিলে খান না, তাঁর এঁটো বাতিক। টেবিলে খেলে সর্বস্ব এঁটো হয়। সোমেন টেবিলে খেতে বসলে মা তার পায়ের কাছটিতে একটা ছোট্ট কাঁসার বাটিতে নিজের জন্য একটু ভাত আর মাছের ঝোল নিয়ে বসেন। ভাল করে খেতে পারেন না। অনিচ্ছায় মুখে গ্রাস তুলে অনেকক্ষণ ধরে চিবোন।

সোমেন জিজ্ঞেস করে—আর কোনও হাঙ্গামা হয়নি তো?

—না, কী হবে! আমে দুধে মিশে গেছে বাবা। আঁটিটা পড়ে আছে।

সোমেন চাপা ধমক দিয়ে বলে—কেন, তাতে তোমার গা জ্বালা করছে? ওদের মিলমিশ হলে তোমার ক্ষতিটা কী হল?

—ক্ষতির কথা বলেছি? মিলমিশ হয়েছে ভালই তো।

—তবে বলছ কেন?

ননীবালা চুপচাপ ভাতের গ্রাস চিবোতে থাকেন। হঠাৎ বলেন—তোর চাকরিটা হল না কেন?

—হল না, এমনিই। সোমেন বিরক্ত হয়ে গেল—কেন, আমার চাকরি দিয়ে কী হবে?

—মাঝে মাঝে ভাবি, তোর একটা কিছু হলে বরং একটু আলাদা বাসা-টাসা করলে হয়।

সোমেন উঠে পড়ে।

ননীবালা খুব সম্প্রতি পান আর জরদার নেশা ধরেছেন। শোওয়ার আগে পান না হলে আজকাল চলে না। পানের বাটা নিয়ে বসতে যাবেন, জাঁতিটা মেঝেয় পড়ে শব্দ হল।

সোমেন শুয়েছিল, বলল—আঃ।

—জেগে আছিস?

—না ঘুমোচ্ছি। বিরক্ত হয়ে সোমেন বলে।

ননীবালা শ্বাস ফেলেন।

সোমেন পাশ ফিরে বলে—ইচ্ছে করে জাঁতিটার শব্দ করলে না?

—না, পড়ে গেল।

ও-সব চালাকি আমি জানি। আমাকে জাগিয়ে এখন ওদের নিন্দেমন্দ করতে বসবে তো!

—সংসারে থাকতে হলে অমন উদোর মতো থাকবি কেন? সব জেনেবুঝে থাকতে হয়।

—জেনেবুঝে আমার দরকার নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড, শুয়ে পড়ো, বিরক্ত কোরো না।

ননীবালা কথা বলেন না। পান খেয়ে ডাবরে পিক ফেলেন। বাতি নিবিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে যান। কিন্তু নানারকম শ্বাসের শব্দ আসে। একবার অস্ফুট কণ্ঠে বলেন—যা মশা! তারপর আবার খানিকক্ষণ চুপ থেকে সোমেন জেগে আছে কি না বুঝবার চেষ্টা করেন। আপন মনেই বলেন—আজ বাচ্চা দুটোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেল। ওরা যেতে চায়নি। আমার কাছে তো বড় একটা শুতে পায় না।

—বেশ করেছে নিয়ে গেছে। সোমেন বালিশে কান চেপে রেখে বলে—ওদের বাচ্চা ওরা নিয়ে যাবে না কেন? তা ছাড়া তুমিই তো বলো যে ওরা তোমার ঘর নোংরা করে, ওদের পায়ের ধুলোবালিতে তোমার বিছানা কিচকিচ করে!

—সে তো সত্যি। তোরা চারটে ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পর থেকে বাচ্চাকাচ্চা বড় একটা টানি না তো!

—তা হলে আর দুঃখ কীসের?

ননীবালা হঠাৎ একটু চড়া গলায় বলেন—সব না শুনে অত রাগ-রাগ করছিস কেন?

—শুনতে চাই না। ঘুমোও।

ননীবালা মিইয়ে গিয়ে বলেন—হুঁ! ঘুম কি আর হুট বলতেই আসে! আজ বায়ুটা চড়ে গেছে। ঘুম আর হবে না।

—তা হলে আমাকে ঘুমোতে দাও।

—ওখানে কী কী খাওয়াল আজ? ননীবালা প্রসঙ্গ পালটান খুব কৌশলে।

—রণোটা সারাদিন কোথায় কী খেল কে জানে! বহেরুর ওখানে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানেই গিয়েছিল বুঝতে পারলাম না। কথা বলতে সাহস পেলাম না। রাতে কিছু খেল না। মুখখানা শুকনো দেখাচ্ছিল। খায়নি বুঝি সারাদিন।

—না খাওয়াই উচিত। যে বউয়ের গায়ে হাত তোলে তার আবার খাওয়া!

—সেটা অন্যায় করে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু রণো তো অত রাগ করার ছেলে না। বউমা কিছু একটা অন্যায় বলেছে নিশ্চয়ই। কাল বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকেই তো টিক-টিক করছিল।

সোমেন কেঁকে উঠে বলে—যা খুশি করুক, তা বলে গায়ে হাত তুলবে!

—বলছি তো সেটা অন্যায় করে ফেলেছে। মানুষ কি সব সময়ে নিজের বশে থাকে?

—দাদার পক্ষ হয়ে একটাও কথা আর বলবে না তুমি।

—কেন বলব না? রণাকে আমি এইটুকুবেলা থেকে বড় করেছি, ওর ধাত আমার চেয়ে ভাল কে জানে! ও ঠান্ডা মানুষ, ওকে রাগালে কেমনতর হয়ে যায়। সেই জন্যই ওকে কেউ কখনও শাসন করেনি। তবে দরকারও হত না, ও তেমন কিছু দুষ্টুমি করতই না। কদিন হল দেখছি ও যেন কেমনধারা হয়ে যাচ্ছে!

—যাচ্ছে যাক। তুমি ওদের মধ্যে বেশি নাক গলিয়ো না।

ননীবালা আবার একটু চুপ থেকে সোমেনের মন বুঝবার চেষ্টা করেন।

তারপর বলেন—শীলার চিঠিটা পড়লি তো! আমি কিছু মাথামুণ্ডু বুঝলাম না। কী বলতে চেয়েছে বল তো! একটু বুঝিয়ে দে।

—আঃ! বলে ভীষণ বিরক্তিতে সোমেন উঠে বসে। বলে—কিছুতেই ঘুমোতে দেবে না?

—ঘুমোস। সকালেবেলা পর্যন্ত ঘুমোস, না হয় ডাকব না। এখন একটু বুঝিয়ে বল তো। বলে ননীবালা মশারি তুলে বাইরে বেরিয়ে বসেন।

ঘর অন্ধকার হলেও বাইরের আলো আবছাভাবে ঘরে আসে। ননীবালার ছায়ামূর্তিটার দিকে আক্রোশভরে একটু চেয়ে থাকে সোমেন। তারপর বলে—তুমি বড়দির চিঠিটা ঠিকই বুঝেছ।

—যা বুঝেছি তা কি হতে পারে?

—হবে না কেন? বাবা তো টাকা দিতে এলেন না। জমিটা হাতছাড়া হয়ে যাক—তাই চাও?

—তাই কি বলেছি? কিন্তু লোকটা এল না কেন, কেমন তার বুকের ব্যথা, এটা তো তোরা। দু-ভাইয়ের একজন গিয়ে খোঁজ নিতে পারতিস!

সোমেন বলে—বাবা তোমার কেউ হয় না? বহেরুর চিঠি পেয়ে তুমিও তো চলে যেতে পারতে!

ননীবালা কথা খুঁজে পান না। তারপর অনেকক্ষণ বাদে ক্ষীণকণ্ঠে বলেন—আমি তো চোখের বিষ। আমাকে দেখলে ব্যথা বেড়েই যাবে হয়তো।

সোমেন বালিশে উত্তপ্ত মাথাটা আবার রাখে। কথা বলে না। ননীবালাও কিছু বলেন না অনেকক্ষণ। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলেন—তাই বলছিলাম, তোর যদি একটা চাকরি-বাকরি হত তা হলে আলাদা একটু বাসা-টাসা করে মায়ে-পোয়ে থাকতাম।

বড় রাগ হয় সোমেনের। সে বলে—দাদার মতো লোকের সঙ্গে থাকতে পারছ না, দাদা কত ভালবাসে তোমাকে!

—কী করব। দেখছিস তো! সব দোষ কি আমার?

—তোমারই। তোমাকে নিয়ে আমি থাকতে পারব না।

ননীবালা স্তব্ধ হয়ে থাকেন। হাতের ব্রোঞ্জের কয়েকগাছা চুড়ির একটু শব্দ হয়। শ্বাস ফেলেন। খুব বিষণ্ণ ক্ষীণ গলায় বলেন—জবাব দিলি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *