যাও পাখি – ১

॥ এক ॥

সোমেন জানে, প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন।

ব্যাপারটা সে টের পেল শনিবার সকালে, বৈঁচী স্টেশন থেকে আড়াই মাইল উত্তরে গোবিন্দপুর গাঁয়ে বহেরুর কিচেন গার্ডেনে বসে। কিচেন গার্ডেন বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। বহেরু তার বিশাল পরিবারের সবজিটা এই ক্ষেতে ফলিয়ে নেয়। আড়েদিঘে ক্ষেতটা চার-পাঁচ বিঘে হেসেখেলে হবে। বহেরু আদ্যিকালের চাষা নয়, কেমিক্যাল সার, ইনসেকটিসাইডসের সব বৃত্তান্ত জানে। জানে ব্যাঙ্কের সুদের হার, রাইটার্স বিল্ডিংস বা বি-ডি-ও অফিসে গিয়ে মুখচোরা জোড়হাত চাষার মতো ঈশ্বর ভরসায় বসে থাকে না চোটেপাটে কথা বলে কাজ আদায় করে আসে। বহেরু যে উন্নতি করেছে তা তার এই সবজিক্ষেতের উন্নত সতেজ সবুজ রং সংকেতে জানিয়ে দিচ্ছে। একটু দূরেই চলছে পাঁচ-ঘোড়ার পাম্পসেট। ডিজেলের গন্ধ আর ফটফট শব্দ। বছরে বার-দুই সে ভাড়া করে ট্যাক্টর। বহেরুর পরিবারের নামে বা বেনামে কত জমি আছে তার হিসেব সোমেন জানে না। আন্দাজ করে দেড় দুশো বিঘে হবে। অনেক আগে যখন এখানে আসত সোমেন তখন অত বাড়বাড়ন্ত দেখেনি। মাঠের ধান উঠে গেছে। পড়ে আছে ন্যাড়া মাথায় সদ্য গজানো চুলের মতো কাঁটা কাঁটা ধানের গোড়া। তবু সেই ক্ষেত সারা সকাল ধরে দেখিয়েছে তাকে বহেরু। দু-চার জায়গায় আগুনের চিহ্ন পড়ে আছে মাটিতে। এ জায়গায় আখের চাষ হয়। বহেরু মোটা সুতির একটা ভাগলপুরী চাদর গায়ে, পরনে ধুতি আর পায়ে বাটা কোম্পানির মজবুত একজোড়া খাকি রঙের হকিবুট পরে ঘুরে ঘুরে তাকে খানিকটা জমিজিরেত দেখাল। একবার দাঁড়িয়ে পড়ে সখেদে একটা ঢেলা বুটের ডগায় উলটে দিয়ে বলল—মাটির কি আর নিজের দুধ আছে।

—কি বল বহেরু? সোমেন জিজ্ঞেস করল।

—মাটির নিজের রস হল মায়ের বুকের দুধের মতো। কেমিক্যাল সার হচ্ছে গুঁড়ো দুধ, সেই নকল দুধ মায়ের বুকে ভরে দেওয়া। ছেলেবেলা যেমন স্বাদ পেতেন সবজিতে, এখন আর পান?

সোমেন মুশকিলে পড়ে যায়। শাকসবজির স্বাদ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না, পাতে দিলে সে মটর শাকের সঙ্গে খেসারির শাকের তফাত বুঝতে পারে না। চুপ করে রইল।

—এ মাটি হচ্ছে এখন ওষুধের জোরে বেঁচে থাকা রুগি। নিজের জোর বল নেই। ওষুধ পড়লে বছর-বিয়োনী বাঁজা বনে যাবে।

খালধার পর্যন্ত যেতে যেতে রোদ চড়ে গেল। বহেরু ভাগলপুরী চাদরখানা খুলে ফেলল গা থেকে। গায়ে একটা ফতুয়া। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস কে বলবে? হাতে বুকে ঢিলে চামড়ার তলা থেকে ডিম-ডিম পেশি পিছলোচ্ছে। গর্দানখানা ভাল খাঁড়া দিয়েও এক কোপে নামানো যাবে না, এত নিরেট। চুলে পাক ধরেছে কিন্তু চোখ দুখানা এখনও রোদে ঝিকোয়। বিশাল লম্বা বহেরু। চাদরখানা খুলে মাটির বাঁধের ওপর যখন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়াল তখনই অস্পষ্টভাবে সোমেন ভিটামিনের কার্যকারিতা বুঝতে পেরেছিল। ঢালুতে দাঁড়িয়ে সোমেন দেখে বাঁধের ওপরে শীতের ফিরোজা আকাশের গায়ে বিশাল স্তম্ভের মতো উঠে গেছে বহেরুর শরীর। এখানে রোদে বাতাসেও ভিটামিন ভেসে বেড়ায় নাকি? সেই সঙ্গে ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিনও? কতকাল ধরে বহেরু প্রায় একরকমের আছে। নিমের দাঁতনে মাজা স্টেনলেস স্টিলের মতো শক্ত দাঁত দেখিয়ে হেসে বহেরু হাত তুলে খালধারে একটা অনির্দিষ্ট এলাকা দেখিয়ে বলল—এই হচ্ছে আপনাদের জমি, একলপ্তে পাঁচ বিঘে। পোটাক উজিয়ে গেলে আরও এক বিঘে আছে আপনাদের, সে কিন্তু অনাবাদি, মরা জমি। ঠাকরুনকে বলবেন, সে জমিতে চাষ দিতে এখনও দু-তিন বর্ষা লাগবে।

গতকাল তাড়াতাড়ি কিট ব্যাগ গুছিয়ে দুপুরের বর্ধমান লোকাল ধরেছে সোমেন। তাড়াহুড়োয় ভুলভ্রান্তি হয়। আজ সকালে দেখে টুথব্রাশ আনেনি। বহেরুর ছেলে শক্ত দেখে নিমডাল কেটে দিয়েছিল, সকালে সেটা আধঘণ্টা চিবিয়ে মাড়ি ছড়ে গেছে, মুখে বিদঘুটে স্বাদ। বহেরুর সত্তর বছরের পুরনো আসল দাঁতগুলোর দিকে চেয়ে সোমেন মুগ্ধ হয়ে গেল। ক্লোরোফিলের কাজ।

কাল রাতে তার সম্মানে বহেরু মুরগি মেরেছিল। এরা ব্রাহ্মণের পাতে নিজেদের হাতের রান্না দেয় না। সোমেনকে নিজে বেঁধে নিতে হয়েছে। খুব তেল-ঘি-রসুন-পেঁয়াজ-লংকা দিয়েছিল বটে, কিন্তু তেমন কষায়নি বলে মাংসটা জমেনি তেমন। খিদের মুখে একপেট সেই ঝোলভাত খেয়েছে। এগারো ঘণ্টা পর আজ সকালে সেই মাংসের একটা ঢেকুর উঠল। সোমেন হাতের পাতায় চোখের রোদ আড়াল করে ধু-ধু মাঠ ময়দান দেখে।

ফেরার পথে সোমেন জিজ্ঞেস করল—বাবা এখানে এসে করে কী?

বহেরু সামনে হাঁটছে। লাঠিয়াল চেহারা। কাঁধে চাদর ফেলা। উত্তরে বাতাস দিচ্ছে টেনে। রোদ ফুঁড়ে বাতাসের কামড় বসে যাচ্ছে শরীরে। বহেরুর ভ্রূক্ষেপ নেই। লং ক্লথের ফতুয়ার আড়ালে চওড়া কাঁধ। অহংকারী চেহারা। খুলনা জেলার গাঁয়ে সে ছিল কখনও কামলা, কখনও ডাকাত, কখনও দাঙ্গাবাজ, আবার কিছু কিছু ভাগের চাষও করত, শীতের নদীতে মাছ ধরতে যেত, আবার সোমেনদের দেশের বাড়িতে ঘরামি বা মুনিশও খেটে গেছে। দেশ ভাগাভাগির সময়ে সে একটা সুযোগ নেয়। যশোর আর খুলনার রাস্তায় ঘরছাড়া মানুষদের ওপর হামলা করে সে কিছু কাঁচা পয়সার মুখ দেখে। শোনা যায়, নিজের দলের গোটা চারেক লোককে কেটে সে ভাগীদার কমিয়ে ফেলে। গোবিন্দপুরে এসে এক মুসলমান চাষির সঙ্গে দেশের জমি বদলাবার অছিলায় তাকে উচ্ছেদ করে জমির দখল নেয়। তারপর এই উন্নতি। সেই উন্নতিটাই কঠিন এবং সহজ শরীরের অহংকারে ফুটে উঠেছে এখন।

মুখটা না ফিরিয়েই জবাব দিল বহেরু—কী আর করবেন! বুড়ো মানুষ। এমনভাবে ‘বুড়োমানুষ’ কথাটা বলল যেন বা সে নিজে তেমন বুড়োমানুষ নয়। একটু ভেবেচিন্তে সাবধানে বলে—সারাদিন পুঁথুপত্রই নাড়াচাড়া করেন, খুড়োমশাইয়ের কাছে সাঁঝ সকাল খোলের বোল তোলেন, কচি-কাঁচাগুলোকে লেখাপড়াও করান একটু-আধটু, রোগেভোগে ওষুধপত্র দেন। মাঝে মাঝে বাই চাপলে এধার-ওধার চলে যান। যেমন এখন গেছেন।

—কোথায় গেছে কিছু বলে যায়নি?

বহেরু মাথা নাড়ল—কথাবার্তা তো বলেন না বেশি। বলাকওয়ার ধার ধারেন না। আমরা ভাবলাম বুঝি কলকাতাতেই গেলেন, ঠাকরুন আর ছানাপোনাকে দেখা দিয়ে আসবেন। গেছেন তো মোটে চারদিন।

—না বহেরু, একমাস হয় আমরা কোনও খবরবার্তা পাইনি!

বহেরু দুশ্চিন্তাহীন গলায় বলে—আছেন কোথাও। উদাসী মানুষ। যেদিন মন হবে ফিরে আসবেনখন। ভাববেন না।

বহেরুর কথাটায় একটু তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। বাবার প্রতি নয়, তার প্রতি বা তাদের প্রতি। যেন বা বাবা কোথায় আছে তা জেনেও বলার চাড় নেই বহেরুর। বহেরু কি বুঝে গেছে যে বাবার খোঁজে সোমেনদের আর সত্যিই দরকার নেই? খোঁজখবর করাটা বাহুল্য মাত্র?

মাঠটা পার হয়ে এল তারা। বড় রাস্তাটা অন্তত পঁচিশ ত্রিশ বছরের পুরনো, পাথরকুচির রাস্তা। কোনওকালে বোধ হয় মেরামত হয়নি, গোরুর গাড়ির চাকায় আর গত বর্ষার জলে চষা জমির মতো এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে, তারই পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে বহেরুর খামারবাড়ি। আশেপাশে আর গাঁ-ঘর নেই। গোবিন্দপুরের বসত আরও কিছু উত্তরে। বহেরুর খামারবাড়িতে আটচালা, চারচালা, দোচালা মিশিয়ে দশ-বারোখানা ঘর। আর আছে গোশালা, ঘানিঘর, ঢেঁকিঘর, কাঠের মাচানের ওপর জাল দেওয়া একটা হাঁস-মুরগির পোলট্রিও। প্রায় স্বয়ম্ভর ব্যবস্থা। জামাকাপড় আর শৌখিন জিনিসপত্র ছাড়া বহেরুদের প্রায় কিছুই কিনতে হয় না।

বাড়ির হাতায় পা দিয়ে বহেরু হাত তুলে উত্তর দিকটা দেখিয়ে বলল—ওই গোবিন্দপুরের লোকগুলো খচ্চর। আমি এখানে নিজের মতো একখানা গাঁ করব। বহেরু গাঁ।

চোখ দুটো আবার রোদে ঝিকলো। ঠাট্টার কথা নয়, বহেরু হয়তো বা পারে। সে ভাগচাষি বা বরগাদার নয়। সে নিজস্ব জোতের মালিক, পয়সায় সোমেনদের কেনাবেচা করার মতো ধনী। তবু যে সে সোমেনদের জমি চষে দেয়, ফসলের দাম দেয়, সে তার দয়া। একসময়ে সে সোমেনদের বাপ-দাদুর নুন খেয়েছে। বাড়ির চাকরবাকরের মতো ছিল। দান উলটে গেছে এখন। সোমেনের বাবা বোধ হয় এখন বহেরুরই একজন কর্মচারী মাত্র, বাচ্চাদের পড়ায়, তার অর্থ প্রাইভেট টিউটর, হিসেবনিকেশও বোধ হয় কিছু করে দেয়। তার মানে, বাবা এখন বহেরুর ম্যানেজার কিংবা নায়েব। এ পর্যন্ত যখন বহেরু পেরেছে, নিজের নামে একখানা গাঁয়ের প্রতিষ্ঠা করতেও পারবে। জ্ঞাতিগুষ্টি মিলিয়ে বহেরুর পরিবারেই প্রায় এক গাঁ লোকজন।

উঠোন থেকে খোলের শব্দ আসছে। কাল সন্ধেবেলাও শুনেছিল খোলের শব্দ, আবার খুব ভোরে। বহেরুর নব্বই বছর বয়সি জ্ঞাতি খুড়ো দিগম্বরের ওই এক শখ। এ বাড়িতে বোধ হয় ওই লোকটিই স্বার্থশূন্য এক বাতিক নিয়ে আছে। ক্ষেতখামার, বিষয়-আশয় বোঝে না। বোঝে কেবল খোলের শব্দ। তাতেই মাতাল হয়ে আছে। ভোররাতে সোমেন ঘুম ভেঙে প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শব্দটা আটকাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। কিন্তু দূরাগত মেঘের গুরু গুরু ধ্বনির মতো শব্দটা খুব সহজেই তার বুকে ঘা মারতে থাকে। চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে ওই শব্দটা যেন ওই নিস্তব্ধতারই একটা স্পষ্ট রূপ। বাজনার কিছুই জানে না সোমেন। কিন্তু ক্রমে ওই শব্দ তাকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য সব শব্দের প্রতি বধির করে দিল। না-টানা সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে ঝুলে থাকে। সে অনুভব করে তার হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ডুবডাব শব্দ আস্তে আস্তে বদলে যায়। বহেরুর বুড়ো খুড়োর আঙুলের টোকায় টোকায় নাচে তার আনন্দিত হৃৎপিণ্ড।

সকালে উঠেই সে তাই প্রথমে বুড়ো লোকটাকে খুঁজে বের করে।

—বড় ভাল বাজান তো আপনি!

ঘোলাটে ছোট ছোট দুই চোখ, বেঁটেখাটো চেহারা এ বয়সেও মজবুত, আঙুলগুলোর ডগায় কড়া, ঝুপ্‌পুস এক নোংরা তুলোর কম্বল মুড়ি দিয়ে রোদে বসেছিল মহানিম গাছটার তলায়। হাতে কাঁসার গ্লাসে চা। সোমেনের কথা শুনে কেঁপে ওঠে বুড়ো, হাতের চা চলকে যায়। বলে—আমি?

আপনিই তো বাজালেন।

বুড়ো থরথরিয়ে কেঁপে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। হাত বাড়িয়ে সোমেনের হাত দুটো সাপটে ধরে ককিয়ে ওঠে—আমি না বাবু, আমি না। গুরু বাজাইছে। মাঝেমইধ্যে গুরু ভর করে শরীলে…

কথার টান শুনে বোঝা যায় দিগম্বর ঢাকা বা ওদিককার পুব দেশের লোক। যশোর বা খুলনার নয়। তবু কেন যে তাকে জ্ঞাতি বা খুড়ো বলে চালাচ্ছে বহেরু তা কে জানে! সোমেন শুনেছে, বহেরু নানা জায়গার সব গুণী, কিম্ভূত বা অস্বাভাবিক লোক এনে তার নিজের কাছে রাখে। এটাই ওর বাতিক। কী পরিষ্কার টনটনে আওয়াজে ওই খোল বাজছে এখন। কী একটা কথা ফুটি-ফুটি হয়ে উঠছে। ঠিক বোঝা যায় না। আবার বোঝাও যায়। বহেরুর বিশাল সংসারের নানা বিষয়কর্মের শব্দ উঠছে। কুয়োয় বালতি ফেলার শব্দ, পাম্পসেটের আওয়াজ, শিশুদের চিৎকার, বাসনের শব্দ। কিন্তু সব শব্দের ওপরে খোলের আওয়াজ বধির করে দিচ্ছে পৃথিবীকে।

হলুদ কুঞ্জলতায় ছেয়ে আছে কাঁটাঝোপের বেড়া। সোনা রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার পাশে বহেরু দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে শোনে একটু। তারপর হঠাৎ ফিরে বলে—খুলোমশাইয়ের খোল কি বলছে বুঝছেন?

সোমেন অবাক হয়ে বলে—না তো! কী?

—ভাল করে শুনুন।

সোমেন শোনে। বলছে বটে, কিন্তু ঠিক বোঝা যায় না।

বহেরুর বিযয়ী চোখ দুটো হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তাতে একটা বৈরাগ্যও এসে যায় বুঝি। মাথা নেড়ে বলে—ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া…

হাসে বহেরু।

কিন্তু সোমেন আবাক হয়ে শোনে। সত্যিই পরিষ্কার ভাষাটা বুঝতে পারে সে। ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া…

আবার পালটে যায় বোল। বহেরু হাঁটতে হাঁটতে বলে—এখন বলছে চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন…. পরমুহূর্তেই আবার পালটে যায় বোল। বাঙ্ময় খোলে বহেরুর খুড়ো আর একটা কী কথা বলে যেতে থাকে।

বহেরু হাঁটতে হাঁটতে ধুঁধুল লতায় অন্ধকার শুঁড়িপথ ধরে বলে—এবার বলছে মাখিজুখি, মাখিজুখি, মাখিজুখি…

দু-তিনটে সনের শব্দ ওঠে। খোল বোল পালটাচ্ছে।

বহেরু শ্বাস ছেড়ে বলে, শুনুন, বলছে—দে দই, দে দই, দে দই…

সোমেন দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর হাঁটে আবার। খোল ততক্ষণে ফিরে ধরেছে প্রথম বোল৷ ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া…

একটু হতাশায় ম্লান হাসি হেসে বহেরু মাথা নেড়ে বলে—সারাদিনই শুনবেন ওই আওয়াজ। যান আপনি বিশ্রাম করেন।

মটরশাকের ক্ষেতে সাদা ফুল প্রজাপতির মতো আলগোছে ফুটে আছে। বহেরু যখন ক্ষেতটা পার হচ্ছে, তখন গাছগুলি শুঁড় বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করতে চাইছে, এই দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে দেখল সোমেন।

বিশ্রাম করার কিছু ছিল না। বহেরু বয়স্ক লোক, তার ওপর দেশের মানুষ। সিগারেটটা এতক্ষণ ইচ্ছে করেই খায়নি সে। একটা সিগারেট খাবে বলে ঘরে ঢুকল। বাবার ঘর। এই ঘরটায় রাত কাটিয়েছে সোমেন। বড় কষ্ট গেছে।

সরগাছের বেড়ার ওপর মাটি লেপা, ওপরে টিনের চাল। সারা রাত ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস ঢুকেছে, আর শব্দ উঠেছে টিনের চালে। একধারে বাঁশের মাচানে বিছানা। গদির বদলে চটের ভিতরে খড় ভরে গদি বানানো হয়েছে, তার ওপর শতরঞ্জি আর পাতলা তোশকের বিছানা। গায়ে দেওয়ার জন্য একটা মোটা কাঁথা। একটা শক্ত বালিশ।

একটা হলদি কাঠের সেলফে কিছু কাচের জার, শিশি, বোতল। কৃষি বিজ্ঞানের কয়েকটা বই। একটা ছোট টেবিল, লোহার চেয়ার। দুটো ঝাঁপের জানালা খুলে আলো হাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। তবু ঘরটা আবছা। দীর্ঘ বৃষ্টির দিনে যেমন ঘরের আসবাবে, বিছানায় একটা সোঁদা গন্ধ জমে ওঠে, এ ঘরে তেমনই এক গন্ধ। মাটির মেঝেয় ইঁদুরের গর্ত, বাঁশের খুঁটির নীচে ঘুণপোকায় কাটা বাঁশের গুঁড়ো। উইয়ের লাইন গেছে কাঠের তক্তার পাটাতন পর্যন্ত। বাবার বউল-ওলা খড়ম জোড়া আর একটা পিতলের গাড়ু মাচানের নীচে। তার পাশে বড় একটা টিনের, আর একটা চামড়ার স্যুটকেশ। দুটোই বিবর্ণ। মশারিটা চালি করে রেখে গেছে কে, ঘরটা ঝাঁটপাটও দিয়েছে, কিন্তু কিছুমাত্র উজ্জ্বলতা ফোটেনি। এই ঘরে তার বাবা থাকে। দিনের পর দিন। এবং প্রায় অকারণে। ভাবতে, বহুকাল বাদে বাবার জন্য একটু করুণা বোধ করে সোমেন।

চেয়ারটায় বসতেই টিনের চেয়ারের কনকনে ঠান্ডা শরীরের নানা জায়গায় ছ্যাঁকা দেয়। তবু বসে থাকে সোমেন। একটা সিগারেট ধরায়।

গত এক মাসে বাবাকে দুটো চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটারও জবাব পায়নি। বাবা চিঠি দেবে না, এ তাদের জানাই ছিল। কিছু লোক থাকে যারা ঘর-জ্বালানি কিন্তু পর-ভুলানি। নিম্পর লোকেরা নাম শুনলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বলে সাক্ষাৎ দেবতা। অমন পরোপকারী মানুষ হয় না। কিন্তু ঘরের লোক জানে, ওরকম খেয়ালি, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর মানুষ আর নেই। এরকমই একজন ঘরজ্বালানি লোক হচ্ছে বাবা, যাকে বাড়ির লোক বাদে আর সবাই সম্মান করে। পরোপকারী? হবেও বা। বাবার খুব বেশি রহস্য জানা নেই সোমেনের। সে মার কাছে শুনেছে, ভরা যৌবনে স্ত্রীকে রাতে-বিরেতে পাড়াপড়শির ভরসায় ফেলে রেখে বাবা যাত্রা-থিয়েটারে যেত। যাত্রা-থিয়েটারে পার্টও করত না, দেখতেও যেত না। যেত, স্টেজ বাঁধতে যাত্রাদলের সুখসুবিধের ব্যবস্থা করতে। ফুটবল খেলতে না জানলেও গাঁয়ের ম্যাচ-এ বাবা ছিল প্রধান জোগাড়ে মানুষ। গ্রাম দেশে প্রথা আছে, গোলপোস্টের পিছনে একজন কোনও নিষ্কর্মাকে গোলজাজ হিসেবে বসিয়ে দেওয়ার। বাবার কোনও যোগ্যতা ছিল না বলে ‘গোলজাজ’ হত বরাবর। এরকম কোনওখানে কিছু একটা হচ্ছে জানলেই সেখানে ছুটে যেত মহা ব্যস্ততায়, দরকার থাক না থাক, সামান্য যে কোনও দায়িত্ব নিয়ে সাংঘাতিক ডাক হাঁক পাড়ত। পাড়াপড়শিদের ফাইফরমাশ খাটত বিনা দ্বিধায়। আশপাশের বিশ গাঁয়ের লোকের কাছে ব্রজগোপাল ছিল অপরিহার্য লোক। ব্রিজ খেলার কারও পার্টনার না জুটলে ব্রজগোপাল তিনক্রোশ বর্ষার গেঁয়ো রাস্তা ঠেঙিয়ে যেত। খেলতে পারত না তেমন, ভুলভাল ডাক দিত। পার্টনার রাগারাগি করলে অমায়িক হাসত। সবাই জানে, এমন নিরীহ লোক হয় না। কিন্তু বাড়িতে সে লোকের অন্য চেহারা। পুরুষ সিংহ যাকে বলে। সোমেনরা মার কাছে শুনেছে, বারোটা রাতে দেড়সের মাংস আর তিনজন উটকো অতিথি জুটিয়ে এনে মাকে দিয়ে সেই রাতেই রাঁধিয়ে ভোর রাতে খেয়ে বিছানায় গেছে। তিথি-না-মানা অতিথির জ্বালায় মা অতিষ্ঠ, বাড়ির লোকজন জ্বালাতন। সারা যৌবন বয়সটা বাবাকে রোজগার করতে কেউ দেখেনি। দাদুর জমিজিরেত আর সেরেস্তার চাকরির আয়ে সংসার চলত। নেশাভাঙ ছিল না বটে, কিন্তু বাড়ির জিনিসপত্র, এমনকী নিজের বিয়ের শাল, আংটি, ঘড়ি পরকে বিলিয়ে দিতে বাধেনি।

সোমেনরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছে বাবা বাড়ি ফিরলেই মার সঙ্গে ঝগড়া লাগে। প্রথম প্রথম সে ঝগড়ার মধ্যে মান-অভিমান ছিল। মানভঞ্জনও তারা লুকিয়ে দেখে হেসে কুটিপাটি হয়েছে। বাবা মার পায়ে মাথা কুটেছে, আর মা খুশিয়ালি মুখে ভয়-পাওয়া-ভাব ফুটিয়ে বলছে, পায়ে হাত দিয়ে আমায় পাপের তলায় ফেলছ, আমি যে কুষ্ঠ হয়ে মরব! কিন্তু ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখেছে ঝগড়ার রকম পালটাচ্ছে। তখন দাদু বেঁচে নেই, দেশ ভাগ হয়েছে। অপদার্থ বাবা কোনওখানে জমি দখল করতে পারল না। ভাড়াটে বাড়িতে সংসার পেতেছে। তবু ধাত পালটায়নি। দু-তিনরকমের চাকরি করেছে বাবা সে সময়ে। প্রথমে ভলান্টিয়ার, তারপর রেশনের দোকান, কাপড়ের ব্যাবসা। কোনওটাই সুবিধে হয়নি। তবে প্রচুর লোকের সঙ্গে পরিচয় থাকার সূত্রে, সবশেষে বেশি বয়সে একটা সরকারি কেরানিগিরি জুটিয়ে নেয়। কিন্তু বার-ছুট নেশা ছিল সমান। সোমেন মনে করতে পারে, তারা শিশু বয়সে দেখেছে দিনের পর দিন বাবা বাড়ি নেই। বনগাঁ থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বাবা যেত উদ্বাস্তুদের তদারক করতে কিংবা কোনও মচ্ছবের ব্যবস্থায়, সংকীর্তনের দলে। কোনওটাই কাজের কাজ নয়। বাড়িতে মা আর চারটি শিশু-সন্তান একা। তখন মা আর বাবার ঝগড়ায় মান-অভিমান মরে যেতে লাগল। এল গালাগালি। মা বলত শয়তান, বেইমান, বাবা বলত নিমকহারাম, ছোটলোক। তখন বাবা বাড়িতে না এলেই তারা ভাল থাকে। পরস্পরের প্রতি আক্রোশ দেখে তাদের মনে হত, মা-বাবার এবার মারামারি লাগবে। মারামারি লাগত না। কিন্তু বাবা আরও বারমুখে হয়ে যেতে লাগল। পাঁচজনে বলত, ব্রজগোপালের মতো সচ্চরিত্র লোক হয় না, অমন নিরীহ আর মহৎ দেখা যায় না। সোমেনরাও সেটা অবিশ্বাস করত না। বাইরে লোকটা তাই ছিল। নেশাভাঙ বা মেয়েমানুষের দোষ নেই, ঝগড়া কাজিয়া মেটায়, পাঁচজনের দায়ে-দফায় গিয়ে পড়ে। অমায়িক, মিষ্টভাষী, অক্রোধী। তাকে ভালবাসে না এমন লোক নেই। মা ছিল একটিমাত্র মানুষ যার সংস্পর্শে এলেই বাবার চেহারা যেত পালটে। এবং ভাইস ভার্সা।

বড় হয়ে তারা ভাই-বোনেরা বাবা-মায়ের স্থায়ী ঝগড়াটা মিটিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করেছে। বাবা কিংবা মা আলাদাভাবে কেউই লোক খারাপ ছিল না। দাদা একবার মা-বাবাকে টাকা-পয়সা দিয়ে বুড়ো বয়সে লেট হানিমুন করতে পাঠালে পুরীতে। বিশ্বাস ছিল, সমুদ্রের বিশাল বিস্তারের সামনে, আর তীর্থের গুণে যদি দুজনের মধ্যে একটা টান জন্মায়। কিন্তু মা বাবা খড়্গপুর পার হতে পারেনি। সেখান থেকে ফিরতি ট্রেনে দুই আলাদা কামরায় চড়ে দুজনে ফিরে এল। বাসায় ফিরল আলাদা ট্যাক্সিতে। কথা বন্ধ।

বাবা রিটায়ার করার পর অবস্থা উঠল চরমে। তখন বাবা কিছু বেশি সময় বাসায় থাকত। তখন ঝগড়াটা দাঁড়াল, মা বাবাকে বলত, তুমি মরো, বাবা মাকে বলত—আমি মরলে বুঝবে, দুনিয়াটা হাতের মোয়া নয়। লজ্জার কথা এই, ততদিনে দাদার বউ এসেছে, তাদের ছেলেপুলে হয়েছে। দিদিদের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, জামাইরা আসাযাওয়া করে। তখন মা-বাবা দুজনেই ছেলেমেয়েদের নিজের নিজের দিকে সাক্ষী মানতে শুরু করেছে। বুড়ো বয়সের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় সবচেয়ে বড় দরকার হয় সাবালক ছেলেমেয়েদের সমর্থন। মার পাল্লাই ছিল ভারী। বাবা অভিমানে বাড়ি ছাড়ল। বাবার বাড়ি ছাড়াটা তখন নিতান্তই প্রয়োজন।

একথা সত্যি যে, একমাত্র দাদা ছাড়া বাবার প্রতি তাদের আর কোনও ভাইবোনেরই তেমন টান নেই। ছেলেবেলা থেকেই তারা মাকে জানে। বাবার সঙ্গ তারা কদাচিৎ পেয়েছে। কাজেই, বাবা বাড়ি ছাড়ায় কেউ তেমন দুঃখ পায়নি। দাদাও না।

বাবা লোকটা বাউণ্ডুলে হলেও তার একটা খুব বড় শখ ছিল। জমি। দেশ গাঁয়ের লোকের জমির টান থাকেই। বাবার কিছু বেশি ছিল। মার গায়ের কিছু গয়না বেচে বহেরুর হাতে দিয়েছিল সেই দেশ ভাগাভাগির কিছু পরেই। বহেরু মার নামে ছ’বিঘে চাষের জমি কিনেছিল। আর নিজের খামারবাড়ির পাশে একটু বাস্তুজমিও। সেই জমিটা তারের বেড়ায় ঘেরা হয়ে পড়ে আছে। রিটায়ারমেন্টের সময়ে বাবা প্রায়ই ছেলেমেয়েদের এবং মাকেও বলত গোবিন্দপুরে বাড়ি করে সকলে মিলে থাকার কথা। কিন্তু ততদিনে তার ছেলেরা কলকাতার জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছে। কেউ এল না। বাবা গৃহত্যাগ করে এল একা। মাঝে মাঝে যায়। দু’মাসে ছ’মাসে একবার। চিঠিপত্র দেয় মাঝে মাঝে। দাদা কয়েকবার দেখা করে গেছে। কেউ এলে বাবা অভিমান করে রাগ করে বলে—কেন এসেছ? আমি বেশ আছি।

সোমেন জানে, সংসারের প্রতি, পরিবারের প্রতি বাবার কোনও টান আর নেই। তারাও বাবার কথা ভাবে না বড় একটা। আর পাঁচজন নিষ্পর লোকের মতো বাবাও একজন। কোনও টান ভালবাসা, দেখার ইচ্ছে কখনও বোধ করেনি সোমেন। গত পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে সে বাবাকে দেখেছে এক-আধবার। বুড়ো মতো, টান-টান চেহারার একজন গ্রাম্য লোক, ঢোলহাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা, সদর থেকে বউদি বা দাদার ছেলেমেয়ে, কিংবা ঝি-চাকরের কাছে বাড়ির লোকের কুশল জিজ্ঞাসা করে চলে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকত না, বাড়ির জলটলও খেত না। কিন্তু ফিরে আসবার সময় সিঁড়ি ভাঙত আস্তে আস্তে। দু-একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাত। জোরে গলা খাঁকারি দিত। এ দৃশ্য সোমেন নিজেই দেখেছে। কিন্তু কাচালে বুড়োর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি।

বলতে কী, বাবার চেহারাটা ভুলেও গেছে সোমেন। দেখা হলে হয়তো চট করে চিনতেই পারবে না। সোমেনের জামার বুকপকেটে বাবাকে লেখা মার একটা ছোট্ট চিরকুট আছে। তাতে লেখা—তোমার কাছে কোনওদিন কিছু চাইনি। আমাকেও কিছু দিলে না তুমি। তোমার ইন্সিওরেন্সের পলিসিটা পেকেছে। আমার ইচ্ছা, ওই দশ হাজার টাকায় এখানে একটু জমি কিনি, আমাকে না দাও, রণেনকে অন্তত দাও। ভাড়া বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছা করে না। ইতি প্রণতা ননী।

বোধ হয় বাবাকে লেখা মার এই প্রথম চিঠি। শেষ বয়সে। খোলা চিঠি, পড়তে কোনও বাধা নেই। আদর ভালবাসার কোনও কথা না থাক, তবু কেমন চমকে উঠতে হয় ‘প্রণতা ননী’ কথাটা দেখে। ‘প্রণতা’ কথাটাকে বড় আন্তরিক বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সোমেনের। এই চিরকুটটা বাবার হাতে দিতে সোমেনের বড় লজ্জা করবে। আবার একটু ভালও লাগবে। ভাল লাগবে ওই ‘প্রণতা’ টুকুর জন্য। লজ্জা করবে টাকার প্রসঙ্গ আছে বলে। বাবা প্রভিডেন্ড ফান্ডের এক পয়সাও কাউকে দেয়নি। ইন্সিওরেন্সের টাকাটা কি দেবে? দাদাও আপত্তি করেছিল। কিন্তু মা শুনল না। বলল—আমাকে যখন নমিনি’ করেছে তখন ও টাকা আমাদেরই প্রাপ্য, কোনওদিন তো কিছু দেয়নি। প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাটা বহেরুই পাবে শেষ পর্যন্ত, তোরা বাপেরটা কিচ্ছু পাবি না। বাপের সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে কেন? ও পাগলের কাছ থেকে টাকা নিলেই মঙ্গল। নইলে পাঁচ ভূতে লুটে খাবে।

তাই মার চিঠি নিয়ে আসা সোমেনের।

টেবিলের ওপর কাগজপত্র পড়ে আছে, একটা স্বর্ণসিন্দুর খাওয়ার খল-নুড়ি, একটা দশবাতির ল্যাম্প, কিছু চিঠিপত্র, একটা সস্তা টাইমপিস টক টক বিকট শব্দ করে চলছে। চিঠিপত্রগুলো একটু ঘেঁটে দেখল সোমেন। কলকাতার কয়েকটা নার্সারির চিঠির সঙ্গে তাদের দেওয়া চিঠিও আছে। আর আছে আজেবাজে ক্যাটালগ, ক্যাশমেমো, কয়েকটা একসারসাইজ বুকের পৃষ্ঠায় সাঁটা কিছু গাছের পাতা, পাশে নামগোত্র লেখা। পুরনো মোটা একটা বাঁধানো খাতা। তার পাতা খুলে দেখল, প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা—ডায়েরি। তার পরের পৃষ্ঠায় লেখা—পতিত জমিটায় ভেষজ লাগাইব। তার পরের পৃষ্ঠাগুলিতে পর পর কুলেখাড়া, ঘৃতকুমারী, কালমেঘ ও পুরাতন চালকুমড়ার গুণাগুণ। একটা পৃষ্ঠায় লেখা—‘বুড়োনিমের শিকড় হইতে ন্যাবার ওষুধ হইতে পারে, ফকির সাহেব বলেছেন। তার পরেই লেখা—‘তাণ্ডবস্তোত্র জপ করিলে অ্যাজমা সারে।’ অন্য এক পৃষ্ঠায়—‘ইজরায়েলের এক জ্যোতিষী বলিয়াছেন অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী শাসন করিবে কিছু শুভ্রবসন পরিহিত, দণ্ডধারী যোগীপুরুষ।’

এরকম কথা সর্বত্র। বোঝা যায়, বাবা কৃষি, ডাক্তারি, জ্যোতিষী, অকাল্ট ইত্যাদি সব কিছুরই চর্চা করে। ছেলেমানুষি ডায়েরির কোনও একটা পৃষ্ঠায় চিঠিটা গুঁজে রাখবে বলে শেষদিকের পাতা ওলটাতেই সোমেন দেখে একটা প্রায় সাদা পৃষ্ঠা। ঠিক তার মাঝখানে গোটা অক্ষরে লেখা—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।

খাতাটা বন্ধ করে চুপ করে ভাবে একটু। ঘরভরতি একটি আবছায়ার চৌখুপি। সোঁদা গন্ধ। হঠাৎ ওই গন্ধ আর ওই অন্ধকারটা সোমেনকে চেপে ধরতে থাকে। দমফোট লাগে তার।

বাইরের রোদে এসে সে বুকভরে শ্বাস নেয়। কী সবুজ, কী ধারাল রং প্রকৃতির। কী নিস্তব্ধতা। দিগম্বরের খোলের আওয়াজ এখন আর নেই। দূরে পাম্পসেটটা অবিরল চলেছে।

এইখানে মানুষেরা বেশ আছে। মটর শাকের ক্ষেত পার হতে হতে এই বোধ লাভ করে সোমেন। বড় বড় শুঁটি ঝুলে আছে। একটা-দুটো তুলে দানা বের করে মুখে দেয় সে। মিষ্টি। ভুরভুরে বেলেমাটির একটা ক্ষেত তছনছ হয়ে আছে। আলু ছিল বোধ হয়, উঠে গেছে। মাচানের পর মাচান চলেছে, ধুঁদুল, সিম, বিন! যেন বা কেউ শালিমারের সবুজ এনামেল রঙে গাঢ় পোঁচ দিয়ে গেছে চারধারে। হাতের মুঠোয় ধরা যায় না, বিশাল বড় গাঁদা ফুল জঙ্গলের মতো একটা জায়গাকে গাঢ় হলুদ করে রেখেছে।

মহানিমের তলায় বসে আছে দিগম্বর। গাছের গুঁড়িতে ঠেস। মাথা বুকের দিকে ঝুলে পড়েছে। ঘুম। পাশে বশংবদ খোল। রঙিন সুতোর জাল দিয়ে খোলের গায়ে জামা পরানো হয়েছে। লাল-সাদা পুঁতির গয়না খোলের গায়ে। কয়েকটা গাঁদা ফুল গোঁজা আছে। দিগম্বরের নত মুখ থেকে সুতোর মতো লালা ঝুলে আছে।

শীতের মিঠে রোদ পড়ে আছে গায়ে। ঘুম থেকে উঠে আবার বাজাবে। ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া।

আমের বোল এসে গেছে। পোকামাকড় ঝেঁপে ধরেছে গাছটাকে। ঝনঝন শব্দ বাজছে। একটা দোচালার নীচে একপাল বাচ্চা বসেছে বইখাতা শেলেট নিয়ে। বুড়োমতো একজন পড়াচ্ছে। পোড়োরা তাকে ছোট ছোট বেলের মতো মাথা ঘুরিয়ে দেখল। সোমেন জায়গাটা পার হয়ে আসে। কুলগাছের তলায় দুটো সাঁওতাল মেয়ে বসে আছে। জায়গাটায় ম ম করছে পাকা কুলের গন্ধ। একটা মেয়ে মুখ থেকে একটা সাদা বিচি ফুড়ুক করে ছুঁড়ে দিল, আর একটা কুল মুখে পুরল। বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষের মেজো মেয়েটাকে কাল রাতে একঝলক দেখেছিল। তখন গায়ে ছিল একটা খদ্দরের চাদর। গোলপানা মুখ, শ্যামলা রং, বেশ লম্বা, এছাড়া বেশি কিছু বোঝা যায়নি। সৌন্দর্য ছিল তার চোখে। বিশাল চোখ, মণিদুটো এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত অনেক সময় নিয়ে ঢলে পড়ে। দশবাতির আলোয় চোখ থেকে এক কণা আগুন ঠিকরে এসেছিল সোমেনের হৃৎপিণ্ডে। সেই মেয়েটিকে এই সকালের রোদে আবার দেখা গেল। গায়ে চাদর নেই। সতেজ লাউডগার মতো লম্বাটে শরীর। একটা ঝুড়ি বয়ে এনে উপুড় করে দিল সাঁওতাল মেয়েদুটোর একটার কোঁচড়ে।

সোমেন দেখল, মরা ইঁদুর।

মেয়েদের একজন সন্দিহান চোখ তুলে বলে—বিষ দিয়ে মারোনি তো দিদি?

মেয়েটি কপালের চুলের গুছি সরিয়ে অবহেলা আর অহংকারভরে বলল—বিষ দিয়ে মারব কেন? আছড়ে আছড়ে মেরেছি।

এই কথা বলে সে চোখ তুলে সোমেনকে লক্ষ করে। কিন্তু তেমন ভ্রূক্ষেপ করে না। বহেরুর খামারবাড়িতে সর্বত্র ভিটামিনের কাজ দেখতে পায় সোমেন। লাউডগার মতো ওই মেয়েটির অস্তিত্বের ভিটামিনও কিছু কম নয়। এ যে বহেরুর মেয়ে তা একনজরেই বোঝা যায়। চোখা নাক, দুরন্ত ঠোঁট, আর চোখ দুটোতে নিষ্ঠুরতা। জ্যান্ত ইঁদুর হাতে ধরে আছড়ে মারা ওর পক্ষে তেমন শক্ত নয়।

সাঁওতাল মেয়েদুটো উঠে দাঁড়িয়েছিল। লম্বাজনের পেট-কেঁচড়ে ইঁদুরের স্তূপ। সোমেন কয়েকপা গিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল—খাবে?

অবাক চোখে অচেনা লোকের দিয়ে চায় মেয়েটি। ঘাড় নাড়ল। খাবে।

—কীভাবে খাও? পুড়িয়ে?

সাঁওতাল বলতে যেমন সুঠাম শরীর বোঝায় এ মেয়েটির তা নয়। একটু ঢিলে শরীর, বহু সন্তান ধারণের চিহ্ন, বয়সের মেচেতা, আর ধুলোময়লা-বসা ম্লানভাব। প্রশ্ন শুনে দুধ-সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসে। বলে—আগে পুড়িয়ে নিই, তারপর কেটেকুটে রাঁধি, যেমন সবাই রাঁধে।

দাঁড়াল না। বহেরুর বাগান এখানে শেষ, ঢালু একটা পায়ে-হাঁটা-পথ মাঠে নেমে গেছে। সেইদিকে নেমে গেল দুজন। সোমেন মুখ ফিরিয়ে বহেরুর মেয়েকে দেখল। দাঁড়িয়ে আছে এখনও। ব্লাউজের হাতা ফেটে হাতের স্বাস্থ্য ফুটে আছে, ডগবগে শরীরে আঁট করে শাড়ি জড়িয়েছে বলে ধারাল শরীর ছোবল তুলে আছে। পিছনে একটি কামিনী ঝোপের চালচিত্র, পায়ের কাছে কলাবতী ফুলের গাছ।

॥ দুই ॥

বহেরুর চার-পাঁচটা মেয়ের সব কজনারই বিয়ে হয়ে গেছে। তার মধ্যে দুজন স্বামীর ঘর করে, একজনের বর ঘরজামাই, আর দুটো মেয়েকে তাদের স্বামী নেয় না। এ সবই সোমেন জানে। এ মেয়েটা ফেরতদের একজন, বিন্দু। বহেরুর কাছ থেকে ধানের দাম বুঝে নিতে কয়েকবার এসেছে সোমেন। তখন এইসব মেয়েরা ছোট ছিল। ধুলোময়লা মাখা গেঁয়ো গরিব চেহারা। ভিটামিনের প্রভাবে লকলকিয়ে উঠেছে। সিঁথিতে সিঁদুর আছে এখনও। বাকি সিঁদুর, অস্পষ্ট।

মেয়েটা সোমেনকে দেখে একটু ইতস্তত করে। সর্দি হয়েছে বোধ হয়, বাঁ হাতে একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা কালোজিরের পুঁটুলি। সেটা তুলে বারকয় শুঁকল। অন্যদিকে চেয়ে বলে— আপনার চা হচ্ছে। ঘরে দিয়ে আসব?

—চা?

—খাবেন না? আপনার জন্যই হচ্ছে।

—দিতে পারো।

—অতদূর নিয়ে যেতে ঠান্ডা মেরে যাবে। আমাদের ঘরে আসুন না, বসবেন।

সোমেন মাথা নাড়ে। একা ঘরে মন টেকে না। এদের ঘরে দু-দণ্ড বসা যেতে পারে। আগেও এসেছে সোমেন, গন্ধ বিশ্বেসের কাছে কত গল্প শুনেছে বসে। বহুকাল আর আসা নেই বলে একটু নতুন নতুন লাগে। বহেরুর তখন এত জ্ঞাতিগুষ্টি ছিল না। একা-বোকা হেলে-চাষা গোছের ছিল তখন। এখন তার উন্নতির সংবাদ ছড়িয়ে গেছে চারধারে। নিষ্কর্মা, ভবঘুরে আত্মীয়রা এসে জুটেছে। সংসার বেড়ে গেছে অনেক। বহেরুও বোধ হয় তাই চায়। ভবিষ্যতের বহেরু গাঁয়ে থাকবে তারই রক্তের মানুষ সব।

পুরো চত্বরটাই বহেরুর বসত, তবু তার মধ্যেও ঘের-বেড়া দিয়ে আলাদা আলাদা বাড়ির মতো বন্দোবস্ত। কামিনী ঝোপটা ডান হাতে ফেলে ধান-সেদ্ধ-করার গন্ধে ভরা একখানা উঠোনে চলে আসে সোমেন, মেয়েটির পিছু পিছু। জিজ্ঞেস করে—গন্ধ বিশ্বেস নেই?

মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, চোখ ছোট করে বলে—থাকে। তবে পাগলমানুষ।

—কোথায় সে? তার কাছে কত গল্প শুনেছি!

মেয়েটা হাসে—এখনও গল্প বলে। সব আগডুম বাগডুম গল্প। ওই বসে আছে।

হাত তুলে বড় উঠোনের একটা প্রান্ত দেখিয়ে দিল।

কটকটে রোদে সাদা মাটির উঠোনটা ঝলসাচ্ছে। চাটাই পাতা, ধান শুকোচ্ছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। তারই একপ্রান্তে বসে আছে বুড়ো-সুড়ো এক মানুষ। বহেরু গাঁয়ে মানুষের আয়ুর যেন শেষ নেই। গন্ধ বিশ্বেস মরে গেছে বুঝি। যখন দাদা বা বাবার সঙ্গে এক-আধদিনের জন্য আসত সোমেন তখন সে হাফপ্যান্ট পরে, গন্ধ বিশ্বেস তখনই ছিল বুড়ো। এক সময়ে ডাকাবুকো শিকারি ছিল, সাহেবদের সঙ্গে বনে-জঙ্গলে ঘুরেছে কম নয়। গারো পাহাড়, সিলেট, চাটগাঁ—কত জায়গায় ঘুরে ঘুরে ব্যাবসা করেছে। সে সব জায়গার গল্প করত সোমেনের কাছে। উসকে দেওয়ার দরকার হত না, নিজে থেকেই বলত। কবেকার কথা সব। সোমেনের মনে হত, বুঝি বা ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে গন্ধ। এখনও সেই লোকটা বসে কাক শালিক তাড়িয়ে ধান বাঁচাচ্ছে। হাতে একটা তলতা বাঁশের লগি। আশপাশে গোটা চোদ্দো-পনেরো সাদা সাদা বেড়াল তুলোর পুঁটলির মতো পড়ে রোদ পোয়াচ্ছে। তিন-চারটে দিশি কুকুরও রয়েছে বেড়ালদের গা ঘেঁষে বসে। পাশে একটা শূন্য কলাই-করা বাটি। মুড়ি খেয়েছিল বোধ হয়।

নাম গন্ধ, পদবি বিশ্বাস। কিন্তু সবাই বরাবর ডেকে এসেছে ‘গন্ধ বিশ্বেস’ বলে, যেন বা নামটা ওর পদবিরই অঙ্গ। শোনা যায়, বুড়ো বয়সে একটা ছুঁড়িকে বিয়ে করে এনেছিল! সে গন্ধর সঙ্গে থাকতে চাইত না। কারণ, গন্ধর বিছানায় বিড়ালের মুত, কুকুরের লোম, বালিশে নাল শুকিয়ে দুর্গন্ধ। কিন্তু বউয়ের মনস্তুষ্টির জন্য কিছু ছাড়ান-কাটান দেবে, এমন মানুষ গন্ধ নয়। বউ তাই এক রাতে সরাসরি গিয়ে দেওর বহেরুর দরজায় ধাক্কা দিল—শুতে দাও দিকিনি বাপু। না ঘুমিয়ে গতর কালি হয়ে গেল। সেই থেকে সে হয়ে গেল বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষ।

ঝগড়া-কাজিয়া তেমন কিছু হয়নি। বেড়াল-অন্ত প্রাণ গন্ধ, কুকুর তার ভারী আদরের। বউ তাদের বেশি কিছু নয়। বিয়ে করলেই আবার একটা বউ হয়। কিন্তু গন্ধ বখেরায় যায়নি। একই সংসারে একটু আলাদা হয়ে থেকে গেছে। সেই বউ-ই এখনও ভাত বেড়ে দেয়, বাতের ব্যথায় রসুন-তেল গরম করে দেয়, বকাঝকাও করে। ওদিকে বহেরুর সন্তান ধারণ করে। কিন্তু সিঁদুর পরে গন্ধর নামে।

এরকম যে একটা গোলমেলে সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে গন্ধ, তাকে দেখলে মনে হয় না। বৈরাগীর মতো বসে আছে। মুখময় বিজবিজে দাড়ি। ছানি কাটা হয়নি, দু-চোখে স্পষ্ট মুসুরির ডালের মতো ছানি দুটো দেখা যায়। শীতে কাহিল হয়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে বসে, গায়ে বহু পুরনো মিলিটারি পুলওভার, নিম্নাঙ্গে ময়লা ধুতি। ধুতিতে ঢাকা আছে ফুটবলের সাইজের হাইড্রোসিল। চলাফেরায় ভারী কষ্ট তার। এই নিয়ে কত হাসাহাসি করেছে সোমেন।

সামনে সামনে বসতেই বেড়ালগুলো মিটমিটে চোখে একটু চেয়েই চোখের ফসফরাস ঢেকে ফেলল। কুকুরগুলো একটু গর-র শব্দ করে শুয়ে-শুয়েই লেজ নাড়ে।

—গন্ধ, চিনতে পারো?

গন্ধ স্থবিরতা থেকে একটু জাগে। রোদ থেকে হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে বলে—কিছু দেখি না।

—আমি সোমেন, ব্ৰজকর্তার ছেলে।

—বড়জন?

—না। ছোট।

হাসে গন্ধ। বুঝদারের হাসি। হাত তুলে একটা মাপ দেখিয়ে বলে—এইটুকুন ছিলেন। আসেন না তো! বাপের জন্য প্রাণ টানে না?

—কলকাতা ছেড়ে আসা হয় না।

একটা শ্বাস ছাড়ে গন্ধ, বলে—সবাই তাই কয়।

—কী কয়?

—কলকাতা ছেড়ে আসা যায় না। সিগারেট নাই?

—আছে। খাবে?

—খাই।

হাত বাড়ায় গন্ধ। সোমেন সিগারেট দেয়। দন্তহীন মুখে সিগারেট বসিয়ে বড় আগ্রহে টানে গন্ধ। কাশে।

—কাশছ তো, খেয়ো না। সোমেন বলে।

হাঁপির টান তুলে কাশে গন্ধ, চোখে জল এসে যায়। হাতের উলটো পিঠে চোখের জল মুছে বলে—যত কষ্ট তত আরাম। এ কাশি আরামের। কতকাল খাই না কেউ দেয় না।

সিগারেটের গোড়া লালায় ভিজে গেছে। থুঃ করে জিভ থেকে তামাকের আঁশ ছিটিয়ে গন্ধ চোখ বুজে টানে। ঝপাস করে ধানের ওপর নেমে আসে কাক। গন্ধ হাত তুলে তাড়ায়—হেঃ ই।

—কেমন আছ গন্ধ?

—ভালই। বহেরু কষ্ট দেয় না।

—চোখটা কাটাও না কেন?

—দেখার কিছু নাই। কাটায়ে হবেটা কী? হাতায়ে হাতায়ে সব বুঝতে পারি। বেলাও ঠাহর পাই ধুয়া ধুয়া। খামোখা কাটায়ে হবেটা কী? খরচ।

—বিনা পয়সায়ও কাটে। সোমেন বলে—ক্যাম্প করে কাটে।

—ঝাঞ্ঝাট।

সিগারেটে প্রাণভরে টান মারে গন্ধ। কাশে। বড় আরাম পায়। সামলে নিয়ে বলে—বহেরুর খুব বাড়বাড়ন্ত দেখলেন সব?

—হুঁ।

—হাতের গুণ। গাছ ওরে ভালবাসে। আমারে ভালবাসে কুত্তা বিড়াল।

বহেরুর মেয়ে বিন্দু পেয়ালা-পিরিচে চা নিয়ে আসে। পিরিচে চা চলকে পড়েছিল, সেটুকু ঢেলে ফেলে দিয়ে পেয়ালা বসিয়ে যত্নে চা দিল। দুটো বিস্কুট।

শব্দে ঠাহর পেয়ে গন্ধ চেয়ে বলে, বিন্দু নাকি? কী দিলি ব্রজকর্তার ছেলেরে? চা?

—কেন? তুমি খাবা?

—খাই।

—দেব।

—ব্রজকর্তার ছেলেরে একটু রস খাওয়াবি না?

—ও রস তো শীতে হিম হয়ে আছে, খেলে ঠান্ডা লাগবে না!

—একটু আমারে দে।

—দেবো।

বলে বিন্দু চলে যায়। আর আসে না।

সোমেনের চা যখন শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, তখন গন্ধ বলে, তলানি থাকলে একটু দিবেন।

—এঁটো খাবে?

—সব খাই।

সংকোচের সঙ্গে কাপটা একটু চা সুদ্ধ এগিয়ে দেয় সোমেন। বড় শীত। গন্ধ কাপটা গালে চেপে ধরে তাপটা নেয়। আস্তে আস্তে টুকে টুকে খায়। বলে—বহেরু কষ্ট দেয় না। এরা দেয়। মাগিগুলি বজ্জাত। সব মাগি বজ্জাত। দেবে বলে কিছু দেয় না। উপোস থাকি।

বলে নিবিষ্ট মনে চা খায় গন্ধ। অল্প একটু তলানি, টপ করে ফুরিয়ে যায়। গন্ধ আঙুল দিয়ে কাপের তলার তলানির চিনি খোঁজে। গাঁ ঘরের চা, চিনি একটু বেশিই দেয় ওরা। সবটা গলে না। গন্ধ আঙুলের ডগায় ভেজা চিনি তুলে এনে আঙুল চোষে। একটা বেড়াল নির্দ্বিধায় তার কোলে উঠে আসে, কাপটা শোঁকে। মুখ থেকে আঙুলটা বের করে বেড়ালের মুখে ধরে গন্ধ। বেড়ালটা দু-একবার চাটন দেয়। তারপর নির্জীব হয়ে কোলেই বসে ঘুমোয়।

—ব্রজকর্তার খোঁজে আলেন নাকি?

—হ্যাঁ। কিন্তু বাবা তো নেই।

গন্ধ চুপ করে থাকে একটু। মাঝে মাঝে মাথাটা বোধ হয় ঝিম মেরে যায়। ধানের ওপর শালিখের হুড়াহুড়ি শুনে হাত বাড়িয়ে লগিটা নেয়। বলে—হেঃ ই।

তারপর বলে—আসে যাবেন যে-কোনও দিন। ব্ৰজকর্তার পায়ের নীচে সুপারি, আছেন ক’দিন?

—আজই চলে যাব। বাড়িতে ভাববে।

—বহেরুর কাণ্ডকারখানা দেখে যাবেন না? কত জমি জোত, ধান-পান, বিশ-তিরিশ মুনিশ খাটে। বহুত পয়সা বহেরুর।

—জানি।

গন্ধ হাত বাড়িয়ে বলে—দেন একটা।

—কী?

গন্ধ হাসে, চোখ ছোট করে বলে—সাদা কাঠি।

সোমেন বুঝতে পেরে একটা সিগারেট দেয়।

গন্ধ সিগারেটটা নাকের কাছে নিয়ে কাঁচা সিগারেটের গন্ধ নেয়। হাত বাড়িয়ে বলে—দেশলাইটা রেখে যান, পরে খাব।

সোমেন দেশলাই দিয়ে দেয়। খালি কাপটা নিয়ে বেড়ালের খেলা শুরু হয়ে গেছে। শক্ত ঝুনো উঠোনে টঙাস করে কাপটা ঢলে পড়ে। গন্ধ মুখ তুলে বলে—ব্রজকর্তারে বুঝয়ে-সুঝায়ে নিয়ে যান বাড়ি। বুড়ো বয়সে কখন কী হয়।

সোমেন চুপ করে থাকে। মনে পড়ে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।

গন্ধ নিচু গলায় বলে—এখানে সব শালা পাজি। বহেরু ভাল। কষ্ট দিতে চায় না। কিন্তু মাগিগুলো—এগারো হাতে কাছা নাই যার—ওই গুলান খচ্চর।

—কত গল্প শোনাতে গন্ধ, সব ভুলে গেছ?

—গল্প?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, পরস্তাব।

গন্ধ ফোকলা মুখে হাসে হঠাৎ।

—মনে থাকে না কিছু।

মানুষের বুড়ো বয়সের কথা ভেবে ভারী একটু দুঃখ হয় সোমেনের। তার বাপ দাদা গন্ধ বিশ্বেসের কাঁধে চড়েছে। সেই আমান মানুষটা কেমন লাতন হয়ে বসে গেছে এখন।

—যাই গন্ধ। বলে সোমেন ওঠে।

পুবের মাঠ রবিশস্যের চাষ পড়ে গেছে। সেই চৈতি ফসলের জমি চৌরস করছে বহেরুর লোকজন। দিগম্বরের খোলের শব্দ ওঠে হঠাৎ। পৃথিবীকে আনন্দিত করে বয়ে যেতে থাকে শব্দ। গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায় রোদের চিকরি-মিকরি। বুনো গন্ধ, মাটির সুবাস।

বেলায় বিন্দু এল তার রান্নার জোগাড় নিয়ে। ঘরের পাশেই বাবার ছোট্ট পাকশাল। কাঠের জ্বালে রান্না হয়। স্তূপ করে কাটা আছে কাঠ, পাঁকাঠি। কাঠের জ্বালে অনভ্যস্ত রান্না রাঁধতে কাল তার চোখ জ্বলে ফুলে গিয়েছিল। বিন্দুকে বলল—আজ তুমিই বেঁধে দিয়ে যাও। আমার ইচ্ছে করছে না।

বিন্দু চোখ বড় করে বলে—আমি রাঁধব? কাকা তা হলে কেটে ফেলবে।

—কাকা? কাকা আবার কে?

বিন্দু মাথাটি নামিয়ে প্যাঁকাটির আগুনে কাঠের জাল তুলতে তুলতে বলে—কে আবার! বহেরু বিশ্বেস।

ভারী অবাক হয় সোমেন। বহেরু ওর কাকা হয় কী করে? সবাই জানে, বিন্দুর মা বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষ। বিন্দুও কি জানে না যে ওই বুড়ো, অক্ষম গন্ধ বিশ্বেসের বিকৃত অঙ্গ থেকে ও জন্মায়নি?

বিন্দু মুখ তুলে বলে—চাল ধুয়ে দিয়েছি, তরকারি মাছ সব কোটা আছে, মশলা বেটে দিয়েছি, আমি সব দেখিয়ে দেব, বেঁধেবেড়ে নিন।

—কলকাতায় হোটেলে রেস্টুরেন্টে আমরা বারো জাতের ছোঁয়া খাই।

—সে কলকাতায়। এখানে নয়।

অগত্যা উঠতে হয় সোমেনকে।

গনগনিয়ে আঁচ ওঠে। বড় তাপ, ধোঁয়া। বিন্দু এটা-ওটা এগিয়ে দেয়, উপদেশ দেয়, হাসেও। এত কাছাকাছি এমন ডগবগে মেয়ে থাকলে কোন পুরুষের না শরীর আনচান করে! সোমেনের কিন্তু—আশ্চর্যের বিষয়—করল না। বরং সে কেমন নিবু নিবু বোধ করে মেয়েটার সামনে। কেন যে! সে কি ওই প্রচণ্ড শরীর, প্রচুর ভিটামিন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্লোরোফিলে ভরা অতিরিক্ত উগ্রতার জন্য? হতে পারে। অত যৌবন সোমেনের সহ্য হয় না। ওই উগ্র শরীরের সঙ্গে টোক্কর দেওয়ার মতো ভিটামিন তার নেই। মেয়েটা কিন্তু টোক্কর দিতেই চায়। ছলবল করে কাছে আসে, যেন বা ছুঁয়ে দেবে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ফুলকপিটা আরও সাঁতলান, নইলে স্বাদ হবে না। তার শ্বাস সোমেনের ঘাড়ে লাগে। সোমের সরে বসে, মেয়েটা অমনি জিভ কেটে বলে—ছুঁয়ে দিচ্ছিলাম আর কী! তারপর হাসে। সোমেন নপুংসকের মতো ভীত বোধ করে মেয়েটির কাছে। বহেরুকে ও কাকা ডাকে কেন তা কিছুতেই ভেবে পায় না। গা-টা একটু ঘিন ঘিন করে তার।

নিজের ভিতরে ভিটামিনের বা প্রোটিনের, বা ওইরকম একটা কিছুর অভাব সে চিরকাল বোধ করে এসেছে। বহেরুর খামারবাড়িতে এই যৌবন বয়সে সেটা তার কাছে আর একটু স্পষ্ট হয়।

সোমেন একটু আলগোছে, সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করে—শ্বশুরবাড়ি কতদূর?

মেয়েটার মুখভাব পালটায় না, হাসিখুশি ভাবটা বজায় রেখেই বলে—কাছেই। বর্ধমান।

—যাও-টাও না?

—না।

—কেন?

—বনে না।

সোমেনের আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না।

মেয়েটা নিজে থেকেই আবার বলে—আমারই দোষ কিন্তু। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ দেওর কেউ খারাপ না।

—তবে?

—যে-মানুষটাকে নয়ে শ্বশুরবাড়ি সেই লোকটাকেই আমার পছন্দ নয়। এমনি মানুষটা মন্দ না, দেহতত্ত্বটত্ত্ব গেয়ে বেড়ায়, এক বোষ্টমের কাছে নাম নিয়েছে। নিরীহ মানুষ। তবে তার কোনও সাধ আহ্লাদ নেই। মেড়া। সে আমার পা চাটত, এমন বাধুক ছিল।

—তবে?

—সেই জন্যই তো বনে না। আমি লাঠেল মানুষ পছন্দ করি।

সাদা দাঁতে চূড়ান্ত একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। সোমেন ভিতরে ভিতরে আরও মিইয়ে যায়।

—সে কীরকম? সোমেন জিজ্ঞেস করে।

—ধামসানো আদর সোহাগ যেমন করবে, তেমনি আবার দরকার মতো চুলের মুঠ ধরবে।

বাঁ হাতের কালোজিরের পুঁটলিটা নাকের কাছে ধরে শ্বাস টানে বিন্দু। চোখে চোখ রাখে। সোমেন চোখটা সরিয়ে নেয়। মেয়েটা পুরুষচাটা। বুকের ভিতরটা গুর গুর করে ওঠে সোমেনের, অস্বস্তি লাগে। একবার ভেবেছিল, আজ রাতটা কাটিয়ে কাল ফিরে যাবে কলকাতায়। বাবার সঙ্গে যদি দেখাটা হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটাকে তার ভাল লাগছে না। রাতবিরেতে এসে যদি ঠেলে তোলে! কিছু বিচিত্র নয়। বহেরুর মেয়ে, নিজের পছন্দমতো জিনিস দখল পেতেই শিখে থাকবে। মনে মনে ঠিক করে ফেলে সোমেন, আজ রাতেই ফিরবে। আটটার কিছু পরে বোধ হয় একটা শনিবারের স্পেশাল ট্রেন যায় হাওড়ায়। বিকেল পর্যন্ত বাবার জন্য দেখে ওই ট্রেনটা ধরতে সুবিধে।

ভিটামিনের অভাব তাকে কতটা ভিতু করেছে তা ভাবতে ভাবতে নেয়েখেয়ে দুপুরে ঘুমলো সোমেন।

বিকেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল, পোষা বেজি কাঁধে বহেরু এল সে সময়ে। বলল—চলে যাবেন?

—হ্যাঁ।

—একটা কথা বলি।

—কী?

—ব্রজকর্তা এখানে থাকে থাক। অযত্ন হবে না। এখানে বামুন মানুষ নেই। ব্রজকর্তাকে তাই ছাড়তে চাই না। আরামেই আছে। সোমেন উত্তর দিল না। উত্তর জানা নেই।

একগোছা টাকা হাতে ধরিয়ে দিল বহেরু। বলল—কোমরে আন্ডারপ্যান্টে গুঁজে নেবেন। ঠাকরুনকে বলবেন এবার ধানের দর ভাল। আপনি না এলে মানি-অর্ডার করে দিতাম। আজ কী কাল।

তিন-চাররকমের ডাল, কিছু আনাজপত্র, এক বোতল ঘানির তেল—এই সব গুছিয়ে দিয়ে যায় বিন্দু। বহেরুর লোক স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বড় একটা চটের থলিতে ভরে দিয়েছে। বেশ ভারী, তবু বোধ হয় বওয়া যায়। হাত তুলে থলির ওজনটা পরখ করছিল সোমেন, বিন্দু হেসে আঁচল চাপা দেয় মুখে। মেয়েটার সাহস বেড়েছে। বলল—খুব মরদ।

সোমেন বোকা বনে যায় একটু। মনে পাপ। ইচ্ছে হল, থেকে গেলেও হত আজ রাতে। সে এখনও তেমন করে মেয়েমানুষের গা ঘেঁয়নি।

পরক্ষণেই ভাবে, সে ধরেই নিচ্ছে কেন যে বিন্দু তার সঙ্গে আজ রাতেই একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে চায়?

চা খেয়ে সে গেল বিন্দুর সঙ্গে ময়ুরের ঘর দেখতে। বহেরুর বড় শখ, একটা চিড়িয়াখানা করে তার বহেরু গাঁয়ে। আপাতত গোটাকয় পাখি, একটা ময়ূর, দুটো হনুমান নিয়ে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। পরে আরও হবে। উত্তরের সবজিক্ষেতের শেষে বহেরুর সেই সাধের চিড়িয়াখানা। জালে ঘেরা ঘর, উপরে অ্যাসবেস্টাসের ছাউনি। কিছু দেখার নেই। ময়ূর ঝিমোচ্ছে, হনুমান দুটো বিরক্ত। বিচিত্র কয়েকটা পাখি ঠোঁটে নখে নিরর্থক জাল কাটার চেষ্টা করছে। দু’মিনিটেই দেখা হয়ে যায়।

বিন্দু চিড়িয়াখানার পিছনে একটা মখমলের মতো ঘাসজমি দেখিয়ে বলল—মন খারাপ হলে আমি এইখানে এসে বসে থাকি। ভারী নিরিবিলি জায়গা। কেউ টেরই পায় না।

জায়গাটায় দু-চার পা হাঁটে দুজনে। সোমেন ভাবে, প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন। এই ডগবগে মেয়েটার কাছে এখন ইচ্ছে করলেই প্রেম নিবেদন করা যায়। মেয়েটাও মুখিয়ে আছে। অবশ্য এখানে প্রেম বলতে শরীর ছাড়া কী! মেয়েটাও কথার প্রেম বুঝবার মতো মানুষ নয়। কিন্তু ভিটামিনের অভাবে সোমেন শরীরে জ্বর বোধ করে, ভয় পায়, নিজেকে অভিশাপ দেয়।

হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বিন্দুর মুখের দিকে চায়। মাথার চুলে অ্যামিনো অ্যাসিডের কাজ। ঘন গহীন চুলে সূক্ষ্ম সিঁথি। মেটে সিঁদুরটুকু ঠিক আছে। গায়ে খদ্দরের হলুদ চাদর, পায়ে হাওয়াই। মুখের গোলভাবটুকুর মধ্যে বেড়ালের কমনীয়তা, এবং বেড়ালেরই হিংস্রতা ফুটে আছে। খর চোখ। সোমেন বলতে যাচ্ছিল—ধরো বিন্দু, যদি আজকের দিনটা থেকেই যাই!

বিন্দু দূরের দিকে অকারণ তাকায় মাঝে মাঝে। এখনও তাকিয়ে ছিল। সোমেন কিছু বলার আগেই তার দিকে চেয়ে বিন্দু বলল—ব্রজকর্তা আসছে।

—কই? ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করে সোমেন। টালিগঞ্জের জমিটা তাদের দরকার। বড্ড দরকার।

—ওই যে, মাঠের মাঝ দিয়ে আসছে।

॥ তিন ॥

বিন্দুবৎ একটা মানুষ বহেরুর চৈতালি ফসলের ক্ষেত ধরে আসছে। কাছে এলে তার মন্থরগতি এবং ক্লান্তি বোঝা যায়। কালচে জমি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তাতে রঙিন আলো, একটু কুয়াশার ভাপ জমে ঝুলে আছে মাথার ওপরে। একটা বিস্তৃতি পিছনে ফেলে আসছে বলেই লোকটাকে ছোট দেখায়। গায়ে র‍্যাপার, ধুতি, হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। গেঁয়ো হাটুরে মানুষ একটা। বাবা বলে মনে করতে কষ্ট হয়।

সোমেন বলল—তোমার চোখ সাংঘাতিক! এতদূর থেকে চিনলে কী করে?

—চিনব না কেন! নিজেদের লোক। ওঁর চলন-বলন সবই চেনা।

সোমেনের ভিতরে একটা ছ্যাঁকা লাগে। নিজেদের লোক। তবু, ঠিক কথাই, বাবা আর তাদের লোক তো নয়।

একটু সময় নিয়ে মাঠ পার হয়ে আসেন ব্রজগোপাল। খামারে ঢোকার রাস্তা কিছু উত্তরে। সেই দিকে আড়ালে পড়ে যান।

বিন্দু মুখ ফিরিয়ে বলে—যাই, খবর দিই গে।

বিন্দু চলে যাওয়ার পরও ঘাসজমিটায় কিছুক্ষণ একা একা সিগারেট টানে সোমেন। বাবা জামাকাপড় বদলে স্থিতু হোক, তারপর দেখা করবে। আসলে, তার একটু লজ্জাও করছে। গত কয়েক বছর তারা চিঠিপত্র ছাড়া বাবার খবর নিতে কেউ আগ্রহ বোধ করেনি। বাবাই বরং কয়েকবার গেছে। এতকাল পরে সোমেন এসেছে বটে, কিন্তু সেও খবর নিতে নয়, স্বার্থসিদ্ধি করতে। টালিগঞ্জের জমির প্লটটার সমস্যা দেখা না দিলে সে কোনওদিনই এখানে আর আসত না বোধ হয়।

সিগারেট শেষ করে আস্তে ধীরে ঘরে আসতে আসতে শীতের বেলা ফুরিয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, ব্রজগোপাল মেঝেয় উবু হয়ে বসে ল্যাম্প জ্বালাচ্ছেন।

শব্দ পেয়ে ঘাড়টা ঘোরালেন। জ্বলন্ত ল্যাম্পটা রাখলেন টেবিলের উপর। বললেন—এস।

বাবার চেহারাটা বোধ হয় আগের মতোই আছে। মুখে চোখে একটা মেদহীন রুক্ষ ভাব। গালে কয়েকদিনের দাড়ি। গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, তাম্রাভ। শীতটা চেপে পড়েছে বলে এর মধ্যেই মাথা কান ঢেকে একটা খয়েরি কম্ফার্টার জড়িয়ে নিয়েছেন। সোমেনের চেয়ে বাবা লম্বায় কিছু খাটো। সোমেন একটা প্রণাম করল।

—শরীর-টরীর ভাল? জিজ্ঞেস করে সোমেন। লজ্জা করে।

—আছে একরকম—প্রেসারটা একটু উৎপাত করে। বাড়ির সবাই কেমন আছে?

—আছে ভালই।

যেন বা দুই পরিচিত লোকের কথাবার্তা। মাঝখানে একটু দূরত্ব কাঁটা ঝোপের বেড়ার মতো।

—আজই চলে যাবে?

সোমেন মুখ নামিয়ে বলে—আজই। নইলে সবাই ভাববে।

—থাকতে বলছি না। যাওয়ার হলে যাবে। বলে বাবা খানিকটা বিহ্বল চোখে সোমেনের দিকে চেয়ে থাকেন। সব পুরুষেরই বোধ হয় একটা পুত্ৰক্ষুধা থাকে। বাবার চোখে এখন সেই রকমই একটা জলুস। পরক্ষণেই নিবে গেল চোখ, বললেন—কিছু দরকারে এসেছিলে?

—মা একটা চিঠি দিয়েছে ওই ডায়েরিতে গোঁজা আছে।

বাবা একটু তটস্থ হন। হাতড়ে চিঠিটা খোঁজেন। খুবই ব্যগ্র ভাব। সোমেন এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা ডায়েরির পাতা থেকে বের করে দেয়।

গলা খাঁকারি দিতে দিতে বাবা চিঠিটা নিবিষ্টমনে পড়েন। ছোট্ট চিঠি, তবু অনেকক্ষণ সময় লাগে। সোমেনের বুকে একটু চাপ কষ্ট হয়। চিঠিটাতে ব্যগ্রভাবে বাবা যা খুঁজছেন তা কি পাবেন? বিষয়ী কথা ছাড়া ওতে কিছু নেই। না, আছে, ‘প্রণতা ননী’—এই কথাটুকু আছে। ওইটুকু বাবা লক্ষ্য করবেন কি?

চিঠিটা হাতে নিয়ে বাবা টিনের চেয়ারে বসলেন। মুখের রেখার কোনও পরিবর্তন হল না তেমন। মুখ তুলে বললেন—কলকাতায় বাড়ি করতে চাও?

—মার খুব ইচ্ছে।

দুহাতের পাতায় মুখখানা ঘষে নিলেন বাবা।

—বাড়ি করার জমি তো এখানেই কেনা আছে।

—এ জায়গা তো দূরে। কলকাতাতেই চাকরি-বাকরি সব।

—চাকরি তো চিরকাল করবে না, কিন্তু বসতবাড়ি চিরকাল থাকে। বংশপরম্পরায় ভোগ করে লোক। চাকরির শেষে যখন নিরিবিলি হবে তখন বিশ্রাম নিতে বাড়িতে আসবে।

সোমেন চুপ করে থাকে।

বাবা আস্তে করে বললেন—বাড়ি তো কেবল ইট কাঠ নয়। মনের শান্তি, দেহের বিশ্রাম—এসব নিয়ে বাড়ি। কলকাতায় কি সেসব হবে?

সোমেন এ কথারও উত্তর খুঁজে পায় না।

—কোথায় জমি দেখেছ?

—টালিগঞ্জে।

—কতটা?

—দেড় দুই কাঠা হবে। আমি ঠিক জানি না। বড় জামাইবাবুর এক বন্ধুর জমি। সেই বন্ধু কানাডায় সেটল করেছে। সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে জমিটা।

—সস্তা মানে কত?

—হাজার দশেক হবে বোধ হয়।

—কীরকম জমি?

—কর্নার প্লট। দক্ষিণ-পূর্ব খোলা। বড় জামাইবাবুর বাড়ির পাশেই।

বাবা বড় চোখ করে বললেন—অজিতের বাড়ির পাশে? সেখানে কেন বাড়ি করবে তোমরা? আত্মীয়দের কাছাকাছি থাকা ভাল না, বিশেষ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পাশে তো নয়ই। এ বুদ্ধি কার, তোমার মায়ের?

—আপনার অমত থাকলে অবশ্য—সোমেন কথাটা শেষ করে না।

বাবা তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। কথাটা সোমেন শেষ করল না দেখে বললেন—আমার মতামতের কি কোনও দাম তোমার মা দেবেন? তিনি যদি মনে করে থাকেন তবে আমার অমত থাকলেও ওই জমি কিনবেনই। তবু অমতটা জানিয়ে রাখা ভাল বলে রাখলাম।

—এত সস্তায় আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বড় জামাইবাবুই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

বাবা চিন্তিত মুখে বললেন—আমি টাকা না দিলেও ও জমি তোমরা কিনবেই। ধার-কর্জ করা হলেও, এ আমি জানি। কিন্তু তা হলে এখানকার জমিটার কী হবে?

—এটাও থাকুক।

—তাই থাকে! পৃথিবীতে যত মানুষ বাড়ছে তত জমি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ছে। দখল যার, জমি তার। বহেরু যতদিন আছে ততদিন চিন্তা নেই, সে আমাদের বাধ্যের লোক। কিন্তু চিরকাল তো সে থাকবে না। তার জ্ঞাতিগুষ্টি অনেক, ছেলেপুলেরা সাবালক। তোমরা দখল না নিলে তারা ক্রমে সব এনক্রোচ করে নেবে। তখন? আমি যক্ষীর মতো আগলে আছি জমিটা, তোমাদের জন্যই। দেখেছ জমিটা ভাল করে? পশ্চিম দিকে সবটা আমাদের। প্রায় দুই বিঘে।

—দেখেছি?

—পছন্দ নয়?

—ভালই তো। কিন্তু বড় দূরের জায়গা।

বাবা মাথা নাড়লেন। বুঝলেন। একটা শ্বাস ফেললেন জোরে।

তারপর আস্তে আস্তে বললেন—কলকাতাতেও পাটিশানের পরে খানিকটা জমি ধরে রেখেছিলাম। জবর দখল। হাতে-পায়ে ধরে দেশের লোক নীলকান্ত সেখানে থাকতে চায়। দিয়েছিলাম থাকতে, সময়মতো জমি পেলে সে উঠে যাবে—এরকম কথা ছিল। কিন্তু যাদবপুরের ওই এলাকার জমি পাওয়া ভাগ্যের কথা। নীলকান্ত আর ছাড়ল না সেটা। আমি মামলা মকদ্দমা করিনি। কলকাতায় আমার কোনও লোভ নেই। জানি তো, ও শহরটা শিগ্‌গিরই শেষ হয়ে আসছে।

একটু বিস্মিত হয়ে সোমেন বলে—কেন?

—ও শহর শেষ হবেই। অত বাড়িঘর নিয়ে হয় একদিন ডুবে যাবে মাটির মধ্যে, নয়তো মহামারী লাগবে, না হয় ভূমিকম্প। একটা কিছু হবেই। যার বুদ্ধি আছে সে ওখানে থাকে কখনও?

সোমেন মুখ লুকিয়ে হাসে একটু। এতক্ষণ বেশ ছিলেন বাবা, এইবার ভিতরকার চাপা পাগলামিটা ঠেলা দিয়ে উঠছে।

—তুমি বিশ্বাস করো না?

—কী?

—কলকাতায় একটা অপঘাত যে হবেই? আমি যতদিন ছিলাম ততদিন আমার ওই একটা টেনশন ছিল। এত লোক, এত বাড়ি-ঘর, এত অশান্তি আর পাপ—এ ঠিক সইবে না। মানুষের নিঃশ্বাসে বাতাস বিষাক্ত। ডিফর্মড, ইমমর‍্যাল একটা জায়গা। ওখানে চিরকাল বাস করার কথা ভাবতেই আমার ভয় করত। নিশুতরাতে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতাম, মাটির নীচে থেকে যেন একটা গুড় গুড় শব্দ উঠে আসছে।

—কীসের শব্দ?

—কী করে বলব? মনে হত। পাতালের জল বুঝি ক্ষয় করে দিচ্ছে শহরের ভিত। যেন ভোগবতী বয়ে যাচ্ছে।

সোমেন চুপ করে থাকে।

বাবা মুখ নিচু করে আত্মগত চিন্তায় ডুবে থাকেন একটুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে বলেন—মোটে দেড় দুই কাঠা জমি?

—হ্যাঁ।

—ইচ্ছে করলে একটু শাকপাতা কি দুটো কলাগাছও লাগাতে পারবে না! বাক্সের মতো সব ঘর হবে, গাদাগাদি করে থাকবে, সেটাই পছন্দ তা হলে?

—মায়ের ইচ্ছে, বাড়িওয়ালারা বড্ড ঝামেলা করছে।

—কেন?

—ছেলেরা বিয়েটিয়ে করেছে, ওদের ঘর দরকার। বার বার তাগাদা দেয়, নতুন বাসাও পাওয়া যায় না সুবিধে মতো। মা বলে, কষ্ট করে একটু নিজেদের ব্যবস্থা করে নেওয়া যায়, জমিটা যখন সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে—

—টাকা না দিলেও তো তোমরা জমিটা কিনবেই?

সোমেন উত্তর দেয় না। বাবা উৎসুক চোখে চেয়ে থাকেন।

তারপর বললেন—সময় থাকতে যদি ও জায়গা ছেড়ে পালিয়ে আসতে পারতে তবে ভাল হত। একদিন দেখবে কলকাতায় দিন-দুপুরে শেয়াল ডাকছে, মড়ার মাথা পড়ে আছে এখানে-সেখানে, জনমনুষ্য কেউ থাকবে না। একটু ভেবে দেখ।

—আপনি মাকে যা লেখার লিখে দিন।

—এসব কথা চিঠিতে লেখার নয়, তোমার মাকে মুখের সামনে কিছু বলাও মুশকিল। ওঁর সবসময়ে একটাই ভাব ‘এই পেয়েছি ঝগড়ার গোড়া, আর যাব না বালি-ওতরপাড়া।’

—তবে আমি মাকে গিয়ে কী বলব?

এই প্রথম বাবা একটু হাসলেন। বললেন—তোমরা তবু কিছুতেই এদিকে চলে আসবে না?

—আমার কোনও মত নেই।

—তোমরা বড় হয়েছ, মত নেই কেন? এই বয়সে নিজস্ব মতামত তৈরি না হলে আর কবে হবে? তোমাদের যদি এদিকে থাকার মত হয় তবে তোমার মায়েরও হবে। মেয়েরা স্বামীর বিরুদ্ধে যত শক্ত হয়েই দাঁড়াক না কেন, ছেলের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পায় না। ওখানে মেয়েরা বড় কাবু।

সোমেন কথাটার সত্যতা বুঝতে পারে। জীবন থেকেই মানুষ কিছু সহজ দার্শনিকতা লাভ করে। বাবার কথাটা মিথ্যে নয়। সে একটু স্মিত হাসল।

বাবা একটু শ্বাস ফেলে বললেন—বুঝেছি। রণেনই চায় কলকাতায় বাড়ি হোক। তোমারও হয়তো তাই ইচ্ছে। বলে বাবা আবার একটু হেসে মাথা নেড়ে বললেন—তোমাদের চেহারায় কলকাতার ছাপ বড় স্পষ্ট। তোমরা আর দেশ গাঁয়ে থাকতে পারবে না। আমার ইচ্ছে করে তোমাদের জন্য কলকাতা থেকে দূরে একটা নকল কলকাতা তৈরি করে দিই। তা হলেও হয়তো বাঁচাতে পারতুম তোমাদের।

বাবা উঠে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন—ক’টার গাড়িতে যাবে?

—যেটা পাই। রাত আটটার গাড়িটা—

পরে ঘড়ি দেখে বললেন—রাত আটটার পর শনিবার গাড়ি খুব ফাঁকা যায়। দিনকাল ভাল নয়, অত রাতের গাড়িতে যাবে কেন? যেতে হলে একটু আর্লি যাও। ভাল হয়, আজ রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে গেলে।

—দেরি হলে মা ভাববে। আমার আজই ফেরার কথা।

বাবা চিন্তিতভাবে বললেন—সাড়ে পাঁচটা বাজে, এখন রওনা হলেও রাত আটটার আগে গাড়ি পাবে না।

—কিছু হবে না। ঠিক চলে যাব।

বাবা আবার হাসলেন। গাড়ু-গামছা নিয়ে বৌলওলা খড়মের শব্দ তুলে দরজার কাছে যেতে যেতে বললেন—তোমাদের জন্য আমিও কিছু কম চিন্তা করি না, বুঝলে?

বাবা খড়মের শব্দ তুলে বাইরে বেরিয়ে যান। কুয়োতলার দিকেই যান বুঝি। অদূরে জলের শব্দ হয়। দশবাতির ল্যাম্প-এর নীচে খাতাটা পড়ে আছে, তারই একটা পৃষ্ঠায় লেখা আছে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কথাটা ভুলতে পারছে না সোমেন। বার বারই মনে পড়ে। কেমন যেন অস্থির লাগে।

বাবা ঘরে নেই, সেই ফাঁকে বিন্দু এল। নিঃশব্দে। খানিকটা চুপি চুপি ভাব ছিল আসায়। একটু আগে যেমন পোশাক ছিল, তেমন আর নেই। একটু সেজেছে বুঝি। দশবাতির আলোয় ভাল বোঝা যায় না, তবু মনে হয়, চোখে কাজল টেনেছে, কপালে সবুজ টিপ, গায়ে একটা রঙিন উলের স্টোল। একটু অবাক হয় সোমেন, স্টোলটা দেখে। তারপর ভাবে, বহেরু তো আর সত্যিই সাধারণ চাষা নয়, তার মেয়ের ফ্যাশন করতে বাধা কী?

গলা নিচু করে বিন্দু বলে—জিনিসপত্র গুছিয়ে দেব?

—গোছানোর কিছু নেই।

—আজ থাকবেন না?

—না

—ব্রজকর্তার সঙ্গে সব কথা হয়ে গেল?

সোমেন একটু হাসে, ম্লান হাসি।

বিন্দু গলাটা বিষণ্ণ করে বলে—ব্রজকর্তা একা একা পড়ে থাকে। আগে রণেনবাবু আসত, আজকাল কেউ আসে না।

সোমেন নীরবে শুনে যায়। কথা বলে না।

—খেয়ে যাবেন না?

—কী খাব?

—ভাত।

—না, দেরি হয়ে যাবে।

—মাঝে মাঝে আসবেন।

সোমেন চোখ তোলে। বিন্দু চেয়ে আছে। চোখে পিপাসা।

সোমেন বলে—কেন?

ব্ৰজকর্তাকে দেখতে। আবার কেন? বলে হাসে।

সোমেন চোখ নামিয়ে নয়। বুকটার মধ্যে কী একটা মাতামাতি করে।

বিন্দু দু-পা এগিয়ে এসে বলে—ব্ৰজকর্তার খুব অসুখ করেছিল। সোমেন চমকে উঠে বলে—কী অসুখ?

—বুকের। হার্টের।

—কেউ জানায়নি তো!

—বাবা ভয়ে জানায়নি, যদি আপনারা ব্রজকর্তাকে নিয়ে যান এখান থেকে। বাবা ওঁকে ছাড়তে চায় না।

—অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল?

—হয়েছিল। বৈঁচীর হাসপাতাল, তারপর বর্ধমানেও নিয়ে যেতে হয়েছিল ডাক্তার দেখাতে।

—সসামেন চুপ করে থাকে।

—মাঝে মাঝে আসবেন। আপনাদের জন্য ভেবে ভেবে বুড়োমানুষের বুক ঝাঁঝরা।

একটা শ্বাস ফেলে সোমেন বলে—আচ্ছা, আসব।

—আসবেন কিন্তু।

—রিকশা পাওয়া যাবে না বিন্দু? আমি এবার রওনা হই।

—রিকশা আনতে লোক চলে গেছে গোবিন্দপুর। এসে যাবে যখন-তখন।

খড়মের শব্দটা বাইরে শুনেই বিন্দু পালিয়ে গেল।

বাবা ঘরে আসেন। নিঃশব্দে জামাকাপড় ছাড়েন৷ কোণের দড়িতে আলগা হলদে রঙের শুদ্ধবস্ত্র আছে, সেটা পরে নিয়ে খুঁটটা গায়ে জড়ান। খালি গা, ধপধপ করছে পৈতেখানা।

—কিছু খেয়েছ-টেয়েছ?

—খেয়েছি।

—কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

—না। বহেরু খুব যত্ন করেছে।

—বিছানাপত্র ভাল নয়, রাতে কষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়ই?

—তেমন কিছু না। আপনার কি অসুখ হয়েছিল?

—অসুখ?

—শুনলাম হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আমাদের জানাননি কেন?

বাবা গম্ভীর মুখে বলেন—তোমাদের জানাব কেন? কলকাতায় ভাল আছ, এত দূরে টেনে এনে কষ্ট দেওয়া।

—কষ্ট কীসের?

—কষ্টই তো! অভিমান করে বাবা বলেন। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন—বেশ আছি, অসুখ-টসুখ কিছু নেই। এরা আত্মীয়ের চেয়ে বেশি দেখাশোনা করে। তা ছাড়া, আমিও খাড়া আছি এখনও, বসে যাইনি।

—আমি বরং মাঝে মাঝে আসব।

—কী দরকার! বলে বাবা একটা তিক্ত উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যান। বোধ হয় সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত তাঁর ছোট ছেলেটির মুখের সুকুমার ডৌলটুকু দশবাতির আলোয় হঠাৎ তাঁর বড় ভাল লাগে। যখন সংসার ছেড়ে এসেছিলেন তখন ছেলেটা পালটে গেছে। সেই পরিবর্তনটুকু বোধ হয় তাঁর ভাল লাগে। পুত্ৰক্ষুধা টের পান বক্ষ জুড়ে। গলাটা হঠাৎ নরম হয়ে আসে। বলেন—এস। ইচ্ছে হলে এস।

সোমেন এই অভিমান দেখে স্মিত হাসে।

বাবা জিজ্ঞেস করেন—চাকরিবাকরি করছ?

—না। এখনও পাইনি। চেষ্টা করছি। ব্যাঙ্ক অব বরোদায় একটা হতে পারে।

—ভাল।

সোমেন একটু ইতস্তত করে। তাকে কেউ কথাটা বলতে বলেনি। তবু তার বলতে ইচ্ছে করে।

—বাবা, কিছুদিনের জন্য চলুন আমাদের কাছে।

বাবা একটু অবাক হন—তোমাদের কাছে?

—হ্যাঁ।

বাবা একটু হাসেন। বলেন—বরং তুমি চাকরিবাকরি পেয়ে আলাদা বাসা-টাসা করলে ডেকো। যাব।

—আপনি যে আমাদের কাছে থাকেন না সেটা বড় খারাপ দেখায়।

—থাকলে আরও খারাপ দেখাবে। বাসায় কাক-শালিক বসতে পারবে না অশান্তির চোটে। সব দিক ভেবেই আমি চলে এসেছি। যখন আমি আসি তখন তুমি নাবালক ছিলে, তাই তোমার কথা ওঠে না। কিন্তু রণেন আমাকে আটকাতে পারত। সে আটকায়নি।

বাবা গলা খাঁকারি দেন। মুখে চোখে রক্তোচ্ছাস এসে যায় বুঝি! বাবা গলাটা প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলেন—সায়ংকালটা পার হয়ে যাচ্ছে। আমি একটু জপে বসি। তোমার সময় হলে চলে যেও।

সোমেন ঘাড় নাড়ল। উঠে প্রণাম করে নিল।

বিছানায় কম্বলের আসন পেতে বাবা গায়ের খুঁটটায় মাথা মুখ ঢেকে শিরদাঁড়া সোজা করে বসেন। সোমেন চেয়ে থাকে। কঠোর হওয়ার কত চেষ্টা করে লোকটা। পারে না। ঢাকা শরীরটা একটু একটু কাঁপে। শীতে, না নিরুদ্ধ ক্রন্দনে?

সেই প্রথম যৌবনকালের অভিমান আর ভাঙেনি। অভিমানে অভিমানে নষ্ট হয়ে গেছে ভালবাসা। কেউ কাউকে বইতে পারে না, সইতে পারে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিমানই হয়েছে আরও কঠিন। যত দিন গেছে তত তা আরও কঠিন হয়েছে। বুকের গভীরে চৈত্রের কুয়োর তলানি জলের মতো কিছু ভালবাসা এখনও পড়ে আছে হয়তো। কিন্তু ওই দুস্তর অভিমান পার হয়ে সেইটুকু স্পর্শ করবে কে? ননীবালা না, রণেন না, সোমেন না। ওই অভিমানটুকুই ব্রজগোপালের অস্তিত্ব বোধ হয়। তার সঙ্গে নিরন্তর চলে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এই কঠিন পাথরের অভিমান ভাঙবার জন্য কেউ আসুক, সবাই আসুক।

মৃত্যু ছাড়া ব্রজগোপালের এই বৃথা অভিমান থেকে মুক্তি নেই। এই কথা ভেবে রিকশায় বসে উত্তুরে বাতাসে কেঁপে ওঠে সোমেন। পাশে-বসা মুনিশ লোকটা একটা বিড়ি ধরায়।

রাতের ট্রেনটা এল। ইলেকট্রিক ট্রেন নয়। কয়লার ইঞ্জিন, কাঠের বগি। আগাপাশতলা গাড়িটা ফাঁকা। দু-একটা কামরায় দু-চারজন আছে। বেশির ভাগ কামরাই জনশূন্য। বাছাবাছির সময় নেই বলে সামনের কামরাতেই মুনিশ লোকটা ব্যাগট্যাগ সুদু তুলে দেয় সোমেনকে।

সোমেন গাড়ি ছাড়লে টের পায় তার কামরাটায় সে একদম একা।

॥ চার ॥

ফাঁকা গাড়ির কামরায় সোমেনের একা বড় ভয়-ভয় করে। কোমরে আন্ডারওয়্যারের দড়ির খোপে কয়েকশো টাকা রয়েছে, বহেরুর দেওয়া। দাদা বিয়েতে নতুন ঘড়ি পেয়ে তার পুরনো ঘড়িটা দিয়ে দিয়েছে সোমেনকে। পুরনো হলেও ভাল ঘড়ি, টিসো। সেই ঘড়িটা সোমেনের কবজিতে বাঁধা। বউদির বড্ড ভুলো মন, স্নানের সময়ে সাবান মাখতে অসুবিধে হয় বলে আংটি খুলে রাখে। তারপর প্রায়দিনই ভুলে ফেলে আসে বাথরুমে। কতবার বাড়ির লোক পেয়ে ফেরত দিয়েছে। সোমেন কয়েকবার আংটি লুকিয়ে রেখে সিনেমার বা সিগারেটের পয়সা আদায় করেছে। অবশেষে বউদি জ্বালাতন হয়ে একদিন বলে—ও আংটি হাতে রাখা মানে হাতি পোষার খরচ। রোজ হারাবে আর রোজ তোমার কাছ থেকে বন্ধকি জিনিস ছাড়াতে হবে। তার চেয়ে ওটা তুমিই আঙুলে পরে থাকে। তাই পরে সোমেন। বউদির মধ্যের আঙুলের আংটি তার কড়ে আঙুলে হয়।

ঘড়ি আংটি দুটোই খুলে পকেটে রাখল সোমেন। দরজা দুটোর লক লাগাতে গিয়ে দেখল, ছিটকিনি ভাঙা। গোটা দুই টিমটিমে আলো জ্বলছে, মাঝে মাঝে উসকে উঠছে আলো, আবার নিবু-নিবু হয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা, রহস্যময়, ভৌতিক কামরা। শনিবার রাতের ট্রেন ফাঁকা যায়, বাবা বলেছিলেন। কিন্তু এতটা ফাঁকা, সোমেন ভাবতে পারেনি। আশপাশের কামরাতেও লোক নেই, সোমেন বৈঁচী স্টেশনে গাড়িতে উঠবার সময়ে লক্ষ করেছে, লোক থাকলেও অবশ্য লাভ ছিল না। ডাকাতি ভরাভরতি কামরাতেও হয়। সে সাবধানে কোমরে হাত দিয়ে ফোলা জায়গাটা দেখল। বহেরুর দেওয়া টাকা, একবার ভাবল, পরের স্টেশনে নেমে কামরা পালটে নেবে। কিন্তু বৈঁচীগ্রাম স্টেশনে গাড়ি থামলে দরজা খুলে নামতে গিয়েও সে দমে যায়। এমন ফাঁকা, শূন্য হাহাকার স্টেশন সে কদাচিৎ দেখেছে। দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মে জনমানুষের চিহ্নও নেই, শুধু শীতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। অনেক দূরে স্টেশন-ঘরটা ঝিম মেরে আছে আধো অন্ধকারে। কুয়াশায় আবছা। খোলা মাঠে জমে আছে অন্ধকার, ঘুমন্ত, নির্জীব। সোমেন নামবার সময়ও পেল না। ট্রেন ছেড়ে দিল। প্ল্যাটফর্মটা পার হওয়ার সময় সে কেবল একজন বুড়ো কুলিগোছের লোককে দেখল রেলের কম্বুলে কোট গায়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একা একটা মানুষ, পিছনে প্ল্যাটফর্মের বিশাল নির্জনতা। সোমেন তৃষিতের মতো লোকাকে দেখল। মানুষ যে মানুষের মত আপন তা ওই একা লোকটাকে দেখে সোমেন বুঝতে পারে হঠাৎ।

একটু কাঁপা বুক আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সে দরজা থেকে ফিরে এসে বেঞ্চে বসে। কামরা বদলেও লাভ যখন নেই, লোকভরতি কামরাতেও যখন ডাকাতি হয়, আর তাকে যখন এই ট্রেনে ফিরতেই হবে তখন আর কী করার আছে?

পুরনো আমলের গাড়ি। বয়সের জীর্ণতা দেখা যাচ্ছে চারধারে। রঙের ওপর বিবর্ণ রং দিয়ে কামরাটার ব্রিটিশ আমলের জরার চিহ্ন ঢাকা পড়েনি। চলার সময়ে একটা ক্লান্তির ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলছে। অ্যালার্মের শেকল দুলে দুলে টংটঙাস শব্দ তোলে। বাতি নিবু-নিবু হয়ে আসে, আবার জ্বলে। পরের স্টেশনও পার হয়ে গেল গাড়ি। লোকজনের কোনও শব্দ হল না। ফাঁকা ট্রেন একটা বাঁশি দিয়ে আবার ছাড়ল।

সোমেন বসে থাকে। মনে মনে প্রার্থনা করে, পরের স্টেশনে যেন দু-চারজন লোক ওঠে কামরায়। এত ফাঁকা সে সহ্য করতে পারে না। ভিড়ের কামরা কত বিরক্তিকর, ফাঁকা কামরাও কী অসহ্য! মানুষ যে কোন অবস্থায় সুখী হয়!

চিনেবাদাম, কমলার খোসা পড়ে আছে। দোমড়ানো ঠোঙা, সিগারেট আর বিড়ির টুকরো, দেশলাইয়ের বাক্স ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ মেঝেটা দেখলে হঠাৎ ভয় করে। কত মানুষ ছিল, তারা কেউ নেই। এ কথাটা হঠাৎ চমকে ওঠে বুকের মধ্যে। কলকাতার ভিড়-ভাট্টায়-গা-ঘেঁষা মানুষকে মানুষ কত অপছন্দ করে! আবার কখনও এরকম নির্জনতায় মানুষের বুকে মানুষের জন্যই পিপাসা জেগে ওঠে। সোমেন একটা সিগারেট ধরায়। জানালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বাতাস আসে, ছিটকিনিহীন দরজা বাতাসের দমকায় দড়াম করে খুলে আবার ধীরে ধীরে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ভূতুড়ে বাতিগুলো জ্বলে আর নেবে। একটা কালভার্ট বাঁয়ার শব্দের মতো শব্দ তুলে পার হয় গাড়ি। সোমেনের বড্ড শীত করতে থাকে। দাঁতে দাঁতে শব্দ হয়। কোটের কলারটা সে তুলে দেয়, জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য সে সুন্দর কিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করে। আর ট্রেনটা অবিরল ‘দিনকাল ভাল নয়, দিনকাল ভাল নয়’, শব্দ তুলে ছুটতে থাকে।

চোখ বুজে এখন একটা বাক্য ভাবছিল সোমেন—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কখন, কোন একাকীত্ব বা সহায়তার সময়ে বাবা ওই কথাটা তাঁর ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছিলেন কে জানে। সোমেনের আর কিছু মনে পড়ে না, কেবল ওই বাক্য মনে পড়ে। বাবার জন্য একটু কষ্ট হয়। তাঁর অভিমান যে কত কঠিন হয়ে গেছে তা বাবাও জানেন না। আয়ুর সময় আর বেশি দিন নয়, ততদিন উদ্‌গ্রীব অপেক্ষা করবে বাবা। কেমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে মার চিরকুটটুকু পড়ছিল বাবা। হায়, তার মধ্যে বেশি কিছু ছিল না, ছিল ‘প্রণতা ননী’। কিন্তু ওই প্রণামটুকু বাবা কি নিয়েছে? নেবে কী করে? চিঠির মধ্যে বড় স্বার্থপর কথা ছিল যে! দশ হাজার টাকা নিজের ছেলেদের বাড়ি করবার জন্য চেয়ে নেওয়া, প্রণামটুকু তার মধ্যেই হারিয়ে গেছে। ওটা শব্দমাত্র, আর কিছু নয়। সোমেন জানে।

সোমেনের বড় ইচ্ছে করে, বাবাকে আবার ফিরিয়ে আনতে। তা হয় না যদিও। ফিরে এলে আবার কাক-শালিক তাড়ানো ঝগড়া হবে। সে ভারী অশান্তি। বাবা বলেছিলেন, সোমেনের আলাদা বাসা হলে আসবেন। আলাদা বাসার কথা সোমেন কল্পনা করতে পারে না। মা আর দাদাকে ছেড়ে আলাদা বাসা করে থাকবে—তা কি হয়?

বাবার কথা ভাবতে ভাবতে তার কলকাতার কথা মনে হয়। কলকাতার ওপর বাবার ভারী রাগ। কলকাতা সম্বন্ধে বাবার মতামত শুনলে হাসি পায় ঠিকই। কিন্তু সোমেনের মাঝে মাঝে মনে হয়, কলকাতার যেন আর কিছু হওয়ার নেই। তার বুকে যতটুকু জায়গা ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষজন আর ইমারত ঠেসে দিচ্ছে চারপাশ থেকে। এ ভার সে আর বইতে পারছে না। রাস্তায় রাস্তায় আজকাল হোর্ডিং লাগিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়—কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। কিংবা—ক্যালকাটা ইজ ফর এভার, কিপ ক্যালকাটা ক্লিন…ইত্যাদি। পাশে আঁকা রক্তবর্ণ গোলাপের ছবি। কিন্তু তার মনে হয়, কলকাতার যতটুকু হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন কেবল অপটিমাম প্রেসারে টান টান টেনশনের ওপর রয়েছে কলকাতা। চারধারে কী একটা যেন ছিঁড়বে, ভাঙবে, তখন হুড়মুড় করে নগরপতনের ভয়াবহ শব্দ উঠবে। কলকাতার প্রতিটি লোকই বোধ হয় কোনও না কোনও বিহ্বল মুহূর্তে এই কথা ভাবে। কী সেটা তা বোঝা যায় না, অনুভব করা যায়।

আবার একটা নির্জন স্টেশন এল, চলে গেল। শীতের বাতাসে গা-শিরশির করা বাঁশি দিয়ে গাড়িটা নড়ে ওঠে। বুড়ো শরীরের জীর্ণতার শব্দ তুলে চলে। সোমেন সুন্দর কিছু ভাবতে চেষ্টা করে। সুন্দর কিছু মনে পড়ে না। এক হতে পারে বাড়ি গিয়ে সে দেখবে ব্যাঙ্ক অব বরোদার চিঠিটা এসেছে। পরীক্ষা ভাল দিয়েছিল, প্যানেলের উঁচুর দিকেই তার নাম থাকার কথা। চিঠিটা যদি আসে!

ভাবতেই কেমন একটা আনন্দের ধড়ফড়ানি ওঠে বুকে, আর সেই সঙ্গে রিখিয়ার মুখ মনে পড়বেই, পাভলভের থিয়োরিতে কুকুরের ঘটনার মতো, কন্ডিশন রিফ্লেকস। কিন্তু ভেবে দেখলে তার চাকরির সঙ্গে রিখিয়াকে কিছুতেই এক সুতোতে বাঁধা যায় না। এ এক রকমের স্বপ্ন দেখা সোমেনের, তেইশ বছর বয়সে এখনকার ছেলেরা আর এরকম স্বপ্ন দেখে না। সোমেন বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে রিখিয়াদের বাড়িটা প্রায় সময়েই মনশ্চক্ষে দেখে। একদম হালফিল কায়দার বাড়ি, যার ডিজাইনটায় অনেকগুলো অসমান কিউবিক প্রকোষ্ঠ। দোতলার বারান্দায় অ্যালুমিনিয়ামের রেলিং। সবুজ খানিকটা জমির ওপর বাড়িটা বিদেশের গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে। ঘরে ঘরে অদ্ভুত সব গন্ধ।

মাকে বলেছিল—তুমি সঙ্গে চলো। মা রাজি হয়নি। বলেছিল, আমার বড় লজ্জা করে। তুই একা যা। সোমেন তবু চাপাচাপি করেছিল—তোমার ছেলেবেলার সই, তার কাছে লজ্জা কী? মা বিষণ্ণ মুখে বলেছে—সংসারের কী অবস্থা, দেখিস তো? মনের এসব অশান্তি নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছেই করে না। ছেলেবেলার সই, তোর বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলব কী? কোন কথায় কোন কথা উঠে পড়ে, আমি আবার সাজিয়ে বানিয়ে দুটো মিথ্যে কথা বললে তাল রাখতে পারি না। সব গোলমাল হয়ে যায়, তার ওপর এ চেহারা শৈলী কি আর চিনবে, দেখে আঁতকে উঠবে হয়তো। কী যে এক ঢল চুল ছিল আমার, রংটাও ছিল ফুটফুটে। চেহারা দেখেই সংসারের অশান্তি বুঝে ফেলবে। তুই একা যা। আমার খুব বন্ধ ছিল শৈলী। তোকে আদর-টাদর করবে। সংসারের কথা যদি জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে তো রেখেঢেকে বলিস।

সেই যাওয়া, পকেটে একটা চিঠি ছিল মায়ের দেওয়া, তাতে লেখা—শৈলী, এই আমার ছোট ছেলে, সোমেন, তোর কাছে পাঠালুম। ওর যাতে একটা চাকরি- বাকরি হয় দেখিস…. ।

দোতলার ঘরে মার সেই শৈলী শুয়ে আছে। পিয়ানোর রিডের মতো চমৎকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার ঘরটিতে ঢুকে দৃশ্যটা দেখে থমকে গিয়েছিল সোমেন। পড়ন্ত বেলার আলো থেকে বাঁচানোর জন্য শ্যাওলা রঙের শেড টানা ছিল জানালায়, একটা মস্ত নিচু ইংলিশ খাটের উপর উনি শুয়ে, বুক পর্যন্ত টানা একটা পাতলা লেপ। চেহারাটা রোগজীর্ণ, সাদা, রোগা। উঠে বসতে বসতে বললেন—কোন ননী, বগুড়ার ননী? তুমি তার ছেলে? ওমা!

ঘরটায় তেমন কিছু ছিল না। শেড থেকে একটা সবজে আভা ছড়িয়ে আছে আলোর মতোই। পরিষ্কার সাদা শ্বেতপাথরের মতো মেঝে। শিয়রের কাছে একটা ট্রলি, তাতে ওষুধের শিশি, কাটগ্লাসের জগে স্বচ্ছ জল, ভাঁজ করা ন্যাপকিন। একধারে একটা সাদা রেফ্রিজারেটার, ছোট্ট। একটা ড্রেসিং টেবিল। বালিশের পাশে কয়েকটা বই, একটা মহার্ঘ চশমা। একটা বই খোলা এবং উপুড় করা।

—বোসো বাবা। তোমরা কলকাতায় থাকো? কোথায়? বলে উনি ঝুঁকে বসলেন, কোলের ওপর হাত। ঢাকুরিয়া শুনে চোখ বড় বড় করে বললেন, এত কাছে! তবু ননী একদিনও এল না? সেই খুলনায় থাকতে চিঠি দিত মাঝে মাঝে। কতকাল তাকে দেখি না। খুব বুড়ো হয়ে যায়নি তো ননী? আমি যেমন হয়ে গেছি?

সোমেন অস্বস্তির হাসি হেসেছিল। মা-ও বুড়ো হয়ে গেছে ঠিকই। বয়স তো আছেই, আর আছে সংসারের কত তাপ, ব্যথা বেদনা। সেসব কে বোঝে?

অত বড়লোক, তবু শৈলীমাসির কোনও দেমাক দেখেনি সোমেন, বরং বললেন—কতকাল ধরে রোগে পড়ে আছি। সারে না। বড় মানুষজন দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এই রোগা-ভোগার কাছে কে এসে বসে থাকবে! ননী এলে কত খুশি হতাম, তবু ননীর বদলে তুমি তো এসেছ! তোমার মুখখানা ননীর মতো, মাতৃমুখী ছেলেরা সুখী হয়।

এ সময়ে রিখিয়া এল। বোধ হয় ইস্কুলের উঁচু বা কলেজের নিচুর দিকে পড়ে। কিশোরী, চঞ্চল, সদ্য শাড়ি ধরেছে। ইস্কুল বা কলেজ থেকে ফিরল বোধ হয়, মুখখানায় রোদ-লাগা লালচে আভা। এলো চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে ঘরে এল, মায়ের বিছানার কাছে এসে অন্যমনে উঠে-আসা আলগা চুল আঙুলে জড়িয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে বলে—ইস, রোজ কতটা করে চুল উঠে যাচ্ছে?

শৈলীমাসির মুখখানার রেখাগুলি নরম হয়ে গেল, বললেন—এই আমার একটামাত্র মেয়ে রিখিয়া। আমি ডাকি রিখি, ওর বাপ ডাকে রাখু। তোমার ভাল নাম কি বললে, সোমেন্দ্রনাথ?

সোমেন মাথা নাড়ে।

শৈলীমাসি হেসে বলেন—পুরনো আমলের নাম। আজকাল আর নামের মাঝখানে নাথ-টাথ কেউ লেখে না। সোজা নাম-টাম লেখে। এখন দেখি ডাকনামের মতো সব ছোট ছোট নামের রেওয়াজ। সেদিন এক বারোয়ারি পুজোর স্যুভেনির দিয়ে গেল, মেম্বারদের নামের মধ্যে দেখি কত মিন্টু ঘোষ, পন্টু রায়, বাবলু সান্যাল—বলতে বলতে মুখ তুলে মেয়ের দিকে চেয়ে বলেন—তাই না রিখি?

রিখিয়া উত্তর না দিয়ে মুখ টিপে অর্থপূর্ণ হাসে। হাসতেই থাকে। বোঝা যায় নামের ব্যাপারটা নিয়ে এ বাড়িতে একটা রসিকতা চালু আছে।

রিখিয়া বলল—রিখিয়া নামটা বিচ্ছিরি।

শৈলীমাসি হাসেন, সোমেন বলেন—রিখিয়ার বড় মামার ছিল বিদঘুটে পেটের ব্যামো, কত ডাক্তার-বদ্যি করেও সারে না, সেবার গেল সাঁওতাল পরগনার রিখিয়াতে হাওয়া বদলাতে। সেখানে সারল, ফিরে এসে দেখে ভাগনি হয়েছে, তাই নাম রাখল রিখিয়া, বলল—শৈলী, তোর মেয়ের যা নাম রাখলাম দেখিস, রোগবালাই সব রুখে দিলাম।

বলে সস্নেহে মেয়ের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে মুখ সরিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলেন—বলতে নেই, শরীর নিয়ে রিখি আমাকে একটুও জ্বালায়নি, আমি তো কবে থেকে রোগ-বালাই নিয়ে পড়ে আছি, রিখি শিশুবেলায় যদি ভুগত তো ওকে দেখত কে? বড্ড লক্ষ্মী ছিল রিখিয়া সেই বয়স থেকেই। রিখি, সোমেনকে কিছু খেতে দিবি না? ফ্রিজিডেয়ারে সন্দেশ আছে, দে। এ ঘরে নয়, পাশের ঘরে নিয়ে যাস। রুগির ঘরে খেতে নেই।

সোমেন কয়েক পলকের বেশি রিখিয়াকে তখন দেখেনি। খুব সুন্দরী নয়, তবু হালকা পলকা শরীরে একটা তেলতেলে লাবণ্য পিছলে যাচ্ছে। শ্যামলা রং, মুখখানায় সংসারের টানাপোড়েনের ছাপ পড়েনি বলে ভারী কমনীয়। একটু দুষ্টু ভাব আছে, আছে বেশি হাসার রোগ। একটু জেদ-এর ভাবও নেই কি! তবু সব মিলিয়ে রিখিয়া বড় জীবন্ত।

শৈলীমাসি বলেন—রিখি আমার চুলের গোছ ধরে বলে—মা, তোমার এখনও কত চুল। আমি তখন ননীর কথা ভাবি। ইস্কুলে ননীর নাম ছিল চুলঅলা ননীবালা, দিদিমণিরা পর্যন্ত ওর খোঁপা খুলে চুলের গোছ দেখত। আমরা কত হিংসে করতাম। দড়িদড়া দিয়ে কতবার চুল কত লম্বা তা মেপে দেখেছি, ভারী লক্ষ্মী ছিল ননী, আমরা যতবার ওর চুল মাপতাম ততবার চুপটি করে দাঁড়াত, হাসত, কখনও আপত্তি করত না। দাঁড়াও, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। রিখি, আমার অ্যালবামটা দে তো—

অ্যালবাম এলে শৈলীমাসি সোমেনকে কাছে ডাকলেন। একটা পাতায় গ্রুপ ছবি। হলদে হয়ে গেছে প্রায়। তিন সারি মেয়ে। দাঁড়িয়ে এক সারি, চেয়ারে বসে এক সারি, মাটিতে এক সারি। কারও হাতে এমব্রয়ডারির ফ্রেম—সেলাই করছে, কারও বা হাতে কুরুশকাঠি, চেয়ারে বসা দুজন মেয়ের সামনে সেলাই মেশিন। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন মেয়ে ছবিতে রয়েছে।

শৈলীমাসি বলেন—ইস্কুলে হাতের কাজের ক্লাসে তোলা ছবি। এর মধ্যে ননী কে বলো তো?

সোমেন মুখ টিপে হাসল। বাঁ ধারে সেলাই মেশিনের পিছনে মা বসে আছে। রোগা, খুব এক ঢাল চুল, নতমুখে, বড় হাতার ব্লাউজ, শাড়ির আঁচল ব্লাউজের কাঁধে পিন করা। এক নজরেই চেনা যায়। তবু বড় অবাক লাগে। তাদের বাড়িতে মার ওই বয়সের কোনও ছবি নেই। কিশোরী মাকে কখনও দেখেনি সোমেন। দেখে অবাক মানে। এই ছিল আমার মা?

শৈলীমাসি মুখের দিকে চেয়েছিল সকৌতুকে। সোমেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে—এই তো আমার মা।

—ও বাবা! নিজের মাকে চিনতে দেখি একটুও ভুল হয়নি! এখন বলো তো, আমি কোন জন?

ভারী মুশকিলে পড়ে যায় সোমেন। মুহূর্তেই ত্রিশজন মেয়ের ছবি একাকার হয়ে যেতে থাকে। শৈলীমাসির মুখটা কিছুতেই খুঁজে পায় না। তখন টের পায় তার কাঁধে সুগন্ধী এলোচুলের একটা গুছি এসে স্পর্শ করেছে। পরিষ্কার শরীরের সতেজ স্বাস ফেলে রিখিয়া ঝুঁকে পড়ে কাঁধের ওপর দিয়ে, আঙুল বাড়িয়ে বলে—এই তো আমার মা।

সোমেন দেখে, শৈলীমাসিই তো! নীচের সারিতে এমব্রয়ডারির কাঠের ফ্রেম হাতে বসে। ঢলঢলে শরীর, আহ্লাদী মুখ।

শৈলীমাসি বুক পর্যন্ত লেপটা টেনে আবার আধশোয়া হয়ে বলেন—চিনবে কী করে? তখন তো এমন হইনি। তুই ওকে খাবার দিলি না রিখি? দে, ভুলে যাবি পরে। কতদিন পর ননীর খবর পেলাম। বড় দেখতে ইচ্ছে করে। কে কে আছে তোমাদের সংসারে, বলো তো সব, শুনি। ক’ভাই-বোন তোমরা?

সোমেন সতর্ক হয়ে যায়। বাবাকে নিয়েই তাদের যত ভয়। সংসারের কথা একটুআধটু বলল সোমেন। তার দাদা রণেন্দ্রনাথ ফুড ইনস্পেকটর, দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, সে ছোট, বাবা রিটায়ার করে জমিজমা দেখছেন।

শৈলীমাসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—ননীকে আসতে বোলো। খুব ভাল লাগবে। আমার ছেলেটা কতকাল ধরে বিলেতে পড়ে আছে। আসে না। আসবেও না লিখেছে। ওখানেই বিয়ে করবে। মেয়েটাই সম্বল। কিন্তু মেয়ে তো নিজের না, পরের ঘরে যাবে। আমার মাত্র দুটি। ননীকে বোলো যা দেখে গেলে।

—বলব।

—রিখি, ওকে খাবার দে। তুমি ওর সঙ্গে যাও সোমেন, যাওয়ার সময় আমাকে বলে যেও। আমি একটু ঘুমোই।

শৈলীমাসি পাশ ফিরে শুলে সোমেন রিখিয়ার পিছু নিয়ে পাশের ঘরটায় আসে। বসার ঘর। গভীর সব গদিওলা সোফা, একধারে বুক-কেস কালো কাঠের। চার রঙের চারটে দেয়ালে তেলতেলে পালিশ। বুক-কেসের ওপর একটা আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা হেলাফেলায় পড়ে আছে।

কোথা থেকে এই সুন্দর বড়লোকি ঘরের কোন কোনা থেকে একটা কুকুর উঠে এল। দিশি কুকুর। তার হাঁটাটুকুর মধ্যে যেন আত্মবিশ্বাস নেই। এই ঘরে একটা দিশি হলদে কুকুর দেখবে। এমনটা আশা করেনি সোমেন। সে এসে রিখিয়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখটা তোলে। রিখিয়া ঝুঁকে একটু আদর করে ওকে। মুখ ফিরিয়ে সোমেনকে বলে—বসুন।

সোমেন খুব অবাক হয়ে কুকুরটাকে দেখছিল। প্রথমে লক্ষ করেনি। এখন দেখল, কুকুরটা অন্ধ। সোমেন এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি।

সন্দেশ আনতে রিখিয়ার অনেক সময় লাগল। কুকুরটাকে আদর করল অনেকক্ষণ। তারপর প্লেট ভরতি ঠান্ডা সাদা সন্দেশ সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে বলল—আমার ভাল নামটাও বিচ্ছিরি।

—কী সেটা?

—অপরাজিতা। কিন্তু ওই নামে কেউ ডাকে না।

—রিখিয়া বেশ নাম।

—ছাই, জায়গার নামে মানুষের নাম বুঝি ভাল?

—আমার নামও ভাল নয়। আমার ছোড়দির নাম বুড়ি…

এইভাবে কথা শুরু হয়েছিল। ঠান্ডা, হিম সন্দেশের ডেলা সোমেনের গলা দিয়ে নামছিল না। মেজের ওপর কার্পেট নেই, সোফার সামনে মস্ত মস্ত লাল নীল উলের নরম পাপোশ। পা রাখলে ডুবে যায়। তারই একটাতে রিখিয়ার পায়ের কাছে অন্ধ কুকুরটা শুয়ে আছে।

—কুকুরটা চোখে দেখে না?

—না। অন্ধ।

—কী করে হল?

—জানি না তো, আমরা ওকে এরকমই পেয়েছিলাম। তখন গড়পারের বাড়িতে থাকতাম আমরা। বেশ গরিব ছিলাম। সে সময়ে এটা কোথা থেকে এসে জুটল। রয়ে গেল। এখন বুড়ো হয়ে গেছে।

—ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে?

—একটু একটু অভ্যাস আছে, তবে প্রায়ই এখানে-ওখানে ধাক্কা খায়।

‘তুমি’ না ‘আপনি’ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না সোমেন। অন্ধ কুকুরটা থেকে চোখ তুলে সে আবার বুক-কেসের ওপর আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরাটা দেখে। কী চকচকে, ঝকঝকে ক্যামেরাটা। মস্ত লেন্স। নিষ্প্রাণ একটি চোখ মেলে চেয়ে আছে সোমেনের দিকে। ঠিক যেন পাহারা দিচ্ছে। বার বার ওই অন্ধ কুকুর থেকে ক্যামেরার একটিমাত্র নিষ্প্রাণ চোখ পর্যন্ত দেখছিল সোমেন। সন্দেশের ডেলাটা গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। জল খেতে গিয়ে বিষম খেল। ওই হেলাফেলায় পড়ে থাকা দামি ক্যামেরা তার সঙ্গে দিশি কুকুরটা কেমন যেন বেমানান। ঘরের মধ্যে ওই দুটি জিনিসই সবচেয়ে বেশি লক্ষ করছিল সোমেন।

রিখিয়াকেও কি লক্ষ করেনি? করেছে। তবে তার তেমন কোনও দুর্বলতা নেই মেয়েদের সম্পর্কে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কত মেয়ের সঙ্গে তার তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল, আড্ডা দিয়েছে লন-এ বা রেস্টুরেন্টে, ফাঁকা ক্লাসঘরেও। তাই বুক কাঁপছিল না সোমেনের। কিন্তু সেই অপরাহ্নকালে বসবার ঘরে রিখিয়াকে দেখতে তার ভাল লেগেছিল বড়। লাল কার্পেটের ওপর পা রেখে রিখিয়া বসে। একটু ঝুঁকে কুকুরটাকে আদর করছে। বড় মহার্ঘ মনে হয়েছিল তাকে। পাহারা দিচ্ছে অন্ধ কুকুর, ক্যামেরার চোখ। একটু ভয় ভয় করেছিল সোমেনের।

রিখিয়া বলে—আপনি এম-এ পরীক্ষা দেননি?

—না।

—কেন?

—কী হবে পড়ে! চাকরি করা বরং ভাল।

—চাকরি? বলে সকৌতুকে রিখিয়া চেয়ে থাকে। ভাবখানা—ইস, এইটুকু ছেলের আবার চাকরি।

পকেটের চিঠিটা পকেটেই রয়ে গেল সোমেনের। দেওয়া হল না শৈলীমাসিকে। মুখে সে পরিচয় দিয়েছিল—আমি ননীবালার ছেলে, আপনার সই ননীবালা। ব্যস ওইটুকুর জোরেই ওরা গ্রহণ করেছিল তাকে। প্রমাণপত্র চায়নি। চিঠিটা হাতে দিতে বড় লজ্জা করেছিল সোমেনের।

যখন শৈলীমাসির কাছে বিদায় নিয়ে আসে তখনও বুকপকেটের চিঠিটার কথা মনে হয়েছিল। শৈলীমাসি বলেন—আবার এসো। ননীকে আসতে বোলো। আমি তো কোথাও যেতে পারি না।

—আসব মাসিমা। বলেছিল সোমেন।

চমৎকার সিঁড়িটা বেয়ে নেমে আসার সময়ে হঠাৎ শুনল রিখিয়ার স্বর—আবার আসবেন।

মুখ তুলে দেখে, রিখিয়া রেলিং ধরে ঝুঁকে দোতলা থেকে চেয়ে আছে। তার চলে যাওয়া দেখছে।

সোমেন ঘাড় নাড়ল। আসবে। মনে মনে বলল—তোমার কাছেও আসব রিখিয়া। একা তোমার কাছেই। এ তো স্পষ্টই বোঝা যায় যে একদিন সুসময়ে তোমার সঙ্গেই আমার ভালবাসা হবে!

সেই অন্ধ কুকুর, সেই আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা বড় মনে পড়ে সোমেনের। ব্যাঙ্ক অফ বরোদার চাকরির কথা মনে হলে রিখিয়ার কথা কেন যে মনে পড়বেই!

গাড়িটা চলেছে তো চলেছেই। একটু ঢিমে গতি, নড়বড় করা শরীরের শব্দ। পাঁচটা স্টেশন গেল। কেউ উঠল না, নামল না। সোমেনের কোমরে গোঁজা টাকা, পকেটে আংটি, ঘড়ি, দিনকাল ভাল নয়, দিনকাল ভাল নয়, বলতে বলতে ট্রেনটা ছুটছে।

একটু ঢুলুনি এসেছিল বুঝি। বেঞ্চের ওপর পা তুলে, ছারপোকার কামড় খেতে খেতে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ফাঁকে ট্রেনটা থেমেছিল কোথাও।

হঠাৎ আবার চলতেই ঝাঁকুনিতে জেগে যায় সোমেন। এবং চমকে দেখতে পায়, সামনে চারটে ছেলে দাঁড়িয়ে। চারজোড়া চোখ তার মুখের ওপর স্থির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *