যস্মিন দেশে

যস্মিন্ দেশে

বোম্বাই শহরটি যে প্রকৃতপক্ষে একটি দ্বীপ, একথা অবশ্য সকলেই জানেন। কিন্তু এই দ্বীপকে অতিক্রম করিয়া একটি বৃহত্তর বোম্বাই আছে, পীনাঙ্গী রমণীর আঁটসাঁট পোশাক ছাপাইয়া উদ্বৃত্ত দেহভাগের মতো যাহা বাহিরে প্রসারিত হইয়া পড়িয়াছে।

বৈদ্যুতিক রেলের লাইন ও মোটর রাস্তা দুই-ই পাশাপাশি বোম্বাই হইতে বাহির হইয়া সমুদ্রের খাঁড়ি উত্তীর্ণ হইয়া উত্তর দিকে অনেকদূর পর্যন্ত গিয়াছে। এই পথের ধারে ধারে এক মাইল আধ-মাইল অন্তর ছোট ছোট জনপদ—বোম্বাইয়ের তুলনায় তাহাদের আয়তন সিকি-দুয়ানির মতো। এখানে যাঁহারা বাস করেন, প্রভাত হইতে না হইতেই তাঁহারা খাদ্যান্বেষী পাখির মতো ঝাঁক বাঁধিয়া বোম্বাই অভিমুখে যাত্রা করেন, আবার সন্ধ্যাবেলা কলরব করিতে করিতে বাসায় ফিরিয়া আসেন। মেয়েরা বৈকাল বেলা বাহারে থলি হাতে করিয়া বাজার করিতে বাহির হন, উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন নাই, সব মেয়েরাই সবজি বাজারে গিয়া আলু শাক কাঁকুড় কফি ক্রয় করেন, তারপর তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা তরুণী, তাঁহারা ক্ষুদ্র রেলওয়ে স্টেশনে গিয়া বেঞ্চিতে বসিয়া নিজ নিজ ‘শেঠ’এর জন্য প্রতীক্ষা করেন। শেঠ আসিলে দু’জনে গল্প করিতে করিতে গৃহে ফিরিয়া যান।

তারপর সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে দেখা যায়, পথের দুই ধারে বাড়ির সম্মুখস্থ অন্ধকার বারান্দায় কাঠের পিঁড়িযুক্ত দোলা দুলিতেছে; অদৃশ্য মিথুনের হাসি-গল্পের মৃদু আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছে, ক্কচিৎ কোমল কণ্ঠের গান অন্ধকারকে মধুর করিয়া তুলিতেছে। নিবিড় ঘনীভূত জীবনের স্পন্দন—আজ আমাদের এই দোলাতেই দু’জন কুলাবে।

কিন্তু বৃহত্তর বোম্বাইয়ের এই দৈনন্দিন জীবন-যাত্রার সহিত আমার গল্পের কোনও সম্বন্ধ নাই।

বোম্বাইয়ের সমুদ্রকূল বহুদূর পর্যন্ত অসংখ্য ভাঙা পোর্তুগীজ ঘাঁটি দ্বারা কীর্ণ; এককালে তাহারা যে এই উপকূল বাহুবলে দখল করিয়া বসিয়াছিল, তাহার প্রচুর চিহ্ন এখনও সমুদ্রের ধারে ধারে ছড়ানো রহিয়াছে। প্রত্ন-জিজ্ঞাসুর পক্ষে এই ভগ্ন ইঁট-পাথরের স্তুপগুলি বিশেষ কৌতূহলের বস্তু।

বৈদ্যুতিক রেললাইনের প্রায় শেষ প্রান্তে ঐরূপ একটা বড় পোর্তুগীজ দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখিতে গিয়াছিলাম। অতি ক্ষুদ্র স্থান, দিনের বেলাও একান্ত জনবিরল। দুই চারিটি দোকান, এক-আধটি ইরাণী হোটেল, পোস্ট অফিস—এই লইয়া একটি লোকালয়; পোর্তুগীজ শক্তির গলিত শবদেহ জীবন্ত লোকালয়ের পাশে পড়িয়া যেন তাহার উপরেও মুমুর্ষার ছায়া ফেলিয়াছে।

শুনা যায় রাত্রি গভীর হইলে এই ভাঙা দুর্গের চারিপাশে নানা বিচিত্র ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করে। জীবন্ত মানুষ সে-সময় কেহ ঘরের বাহির হয় না; যদি কেহ একান্ত প্রয়োজনের তাড়নায় ঐ দিকে যায়, অকস্মাৎ বহু ঘোড়ার সমবেত খুরধ্বনি তাহাকে উচ্চকিত করিয়া তোলে, যেন একদল ঘোড়সওয়ার ফৌজ পাশ দিয়া চলিয়া গেল। দৈবক্রমে দুর্গের আরও নিকটে গিয়া পড়িলে সহসা অন্ধকার স্তম্ভশীর্ষ হইতে পোর্তুগীজ সান্ত্রীর কড়া হুকুম আসে—“Halt! Quem vai la!’’

কিন্তু ভাঙা পোর্তুগীজ দুর্গের ভৌতিক ভয়াবহতার সহিত আমার কাহিনীর কোনও সম্বন্ধ নাই।

দুপুরবেলা বোম্বাই হইতে যাত্রা করিয়াছিলাম। সঙ্গী বা দিগ্‌দর্শক লইবার প্রয়োজন হয় নাই, যে মারাঠী বন্ধুর গৃহে কয়েকদিনের অতিথিরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলাম তিনি ট্রেনে তুলিয়া দিয়া রাস্তা-ঘাটের বিবরণ বলিয়া দিয়াছিলেন।

দ্বিপ্রহরের পূর্বেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়াছিলাম কিন্তু দুর্গ পরিক্রমণ শেষ করিতে অপরাহ্ন হইয়া গেল। চায়ের তৃষ্ণা যথাসময়ে আবির্ভূত হইয়া মনটাকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল; একটু ক্ষুধাও যে পায় নাই, এমন নয়। তাড়াতাড়ি স্টেশনের দিকে ফিরিতে ফিরিতে ভাবিতেছিলাম, মনের মতো খাদ্য পানীয় এই নগণ্য স্থানে পাওয়া যাইবে কি না, হয়তো বোম্বাই না পৌঁছানো পর্যন্ত কৃচ্ছ্রসাধন করিতে হইবে। এমন সময় চোখে পড়িল রাস্তার ধারে ক্ষুদ্র একটি ঘরের মাথায় প্রকাণ্ড সাইন-বোর্ড টাঙানো রহিয়াছে—ইস্ট ইন্ডিয়া হোটেল।

আমিও ইস্ট ইন্ডিয়ার লোক, অর্থাৎ ভারতবর্ষের পূর্ব কোণে থাকি, তাই বোধ হয় নামটা ভিতরে ভিতরে আমাকে আকর্ষণ করিল। অজ্ঞাত স্থানে নিম্নশ্রেণীর হোটেলের খাদ্য পানীয় উদরস্থ করা হয়তো সমীচীন হইবে না; তবু মনে মনে একটু কৌতুক অনুভব করিয়া ভাবিলাম,—দেখাই যাক না; চা যদি উপাদেয় নাও হয় গরম জলে নেশার পিত্তরক্ষা হইবে।

ছোট্ট ঘরে কয়েকটি টিনের টেবিল চেয়ার সাজানো; লোকজন কেহ নাই। পিছনের ঘর হইতে দুইটি স্ত্রী-পুরুষের কণ্ঠস্বর আসিতেছিল, আমার সাড়া পাইয়া পুরুষটি বাহির হইয়া আসিল।

বেঁটে দোহারা মজবুত গোছের লোকটি, রঙ ময়লা তামাটে ধরনের; পার্শী ও ইরাণী ছাড়া ভারতবর্ষের যে কোনও জাতি হইতে পারে। বয়স আন্দাজ বত্রিশ-তেত্রিশ। আমার সম্মুখে আসিয়া দুর্বোধ্য অথচ বিনীত ভাষায় কি একটা প্রশ্ন করিল।

ইংরেজীর আশ্রয় লইতে হইল। এ দেশের পনেরো আনা লোক ইংরেজী বুঝিতে পারে এবং দায়ে ঠেকিলে কষ্টেসৃষ্টে ইংরেজী বলিয়া বক্তব্য প্রকাশ করিতেও পারে।

বলিলাম—‘চা চাই।’

লোকটি ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় নাড়িল—অর্থাৎ ভাল কথা। তারপর মোটের উপর শুদ্ধ ইংরেজীতে বলিল—‘কত চা চাই?’

বুঝিতে না পারিয়া তাহার মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম। সেও বোধ হয় বুঝিল আমি এ-অঞ্চলে নূতন লোক, তাই ব্যাপারটা বুঝাইয়া দিল—এখানে এক পয়সায় সিকি পেয়ালা, দুই পয়সায় আধ পেয়ালা, তিন পয়সায় তিন পোয়া এবং চার পয়সায় পরিপূর্ণ এক পেয়ালা চা পাওয়া যায়; আমি যেটা ইচ্ছা ফরমাস করিতে পারি। তারপর আমার বিলাতি বেশভূষার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল—‘যদি কফি চান ভাল কফি দিতে পারি।’

এ দেশের লোক চায়ের চেয়ে কফি বেশী পছন্দ করে তাহা জানিতাম; কিন্তু চায়ের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ, কফি কদাচিৎ এক-আধ পেয়ালা খাইয়াছি। বলিলাম—‘না, চা আনো।’

লোকটি পূর্ববৎ ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়িয়া পিছনের ঘরে প্রবেশ করিল; আমি একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম। নেপথ্যস্থিত ঘরটা বোধহয় হোটেলের রান্নাঘর; সেখান হইতে অবোধ্য ভাষায় স্ত্রী-পুরুষের কথাবার্তা ও হাসির আওয়াজ আসিতে লাগিল।

অচিরাৎ চা আসিয়া পড়িল। ধূমায়িত পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়া বলিলাম—‘আঃ!’ চায়ে দুধের অংশ বেশী এবং চায়ের পাতার সঙ্গে অন্যান্য সুগন্ধি মশলাও আছে। তবু স্বাদ ভালই লাগিল।’

এই সময়, কেমন করিয়া জানি না, লোকটি আমাকে চিনিয়া ফেলিল। গরম চা পেটে পড়ার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বোধ হয় গুন্ গুন্ করিয়া একটি খাঁটি বাংলা সুর ভাঁজিয়া ফেলিয়াছিলাম; লোকটি উত্তেজনা-প্রখর চক্ষে আমার পানে চাহিল। তারপর টেবিলের উপর দুই হাত রাখিয়া পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলিল—‘আপনি বাঙালী?’

উভয়ে পরস্পর মুখের পানে পরম উদ্বেগভরে তাকাইয়া রহিলাম। বিস্ময়কর ব্যাপার! বাঙালীর ছেলে এতদূরে আসিয়া হোটেল খুলিয়া বসিয়াছে! দুর্বোধ্য ভাষায় অনর্গল কথা বলিতেছে! ‘হাঁ’ বলিতে ডাহিনে বাঁয়ে শিরঃসঞ্চালন করিতেছে!

কিংবা—বাঙালী বটে তো?

বলিলাম—‘হ্যাঁ।—আপনি?’

লোকটি একগাল হাসিয়া সম্মুখের চেয়ারে বসিয়া পড়িল, তাহার আহ্লাদ ও বিস্ময়ের অবধি নাই। আনন্দোচ্ছল কণ্ঠে এক গঙ্গা কথা বলিয়া গেল—‘হ্যাঁ, আমিও বাঙালী মশায়। কিন্তু কি রকম চিনেছি তা বলুন!—আচ্ছা, এদিকে নতুন এসেছেন—না? বুঝেছি, রুইন্‌স দেখতে এসেছিলেন! উঃ—কদ্দিন যে বাঙালীর মুখ দেখিনি!—বম্বেতে বাঙালী আছে বটে—কিন্তু! আপনার নিবাস কলকাতাতেই তো? আমিও কলকাতার তোক মশায়—আদি বাসিন্দা—’

সে হঠাৎ লাফাইয়া উঠিল।

‘দাঁড়ান—শুধু চা খাবেন না। খাবার আছে—বাংলা খাবার। (একটু লজ্জিতভাবে) বড় খেতে ইচ্ছে হয়েছিল, সিঙাড়া আর চম্‌চম্‌ নিজেই তৈরি করেছিলুম। এদিকে তো আর ওসব—

বলিতে বলিতে দ্রুত পিছনের ঘরে প্রবেশ করিল।

অপেক্ষাকৃত প্রকৃতিস্থ হইবার পর তাহার মোটামুটি পরিচয় জানিতে পারিলাম। নাম তপেশচন্দ্র বিশ্বাস; গত সাত বৎসর এইখানেই আছে। দোকানের আয় হইতে সংসার নির্বাহ হইয়া যায়; সুখে দুঃখে জীবন চলিতেছে, কোনও অভাব নাই। হঠাৎ এতদিন পরে একজন টাট্‌কা স্বজাতীয় লোকের সাক্ষাৎ পাইয়া সানন্দ উত্তেজনায় অস্থির হইয়া উঠিয়াছে।

তপেশ জাতিতে কায়স্থ কিংবা ময়রা জানিতে পারা গেল না—জিজ্ঞাসা করিতে সঙ্কোচ বোধ হইল—কিন্তু চম্‌চম্‌ ও সিঙাড়া খাসা তৈয়ার করিয়াছে।

আমাদের চায়ের আসর বেশ জমিয়া উঠিয়াছে এমন সময় বহির্দ্বারের কাছে গুটি তিনেক যুবতীর আবির্ভাব হইল। এদেশীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়ে, তাহাদের মধ্যে একটি মেমেদের মতো স্কার্ট পরিয়াছে, বাকি দুইটির কাছা দিয়া কাপড় পরা। সকলের হাতেই বাজার করিবার থলি; তাহারা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া কলকণ্ঠে ডাকাডাকি শুরু করিল। তপেশ গলা বাড়াইয়া দেখিয়া হাসিমুখে কি একটা বলিল; সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের ঘর হইতেও সাড়া আসিল।

ঘরের ভিতর যে মেয়েটির সহিত তপেশকে কথা কহিতে শুনিয়াছিলাম তাহাকে এতক্ষণে দেখিলাম। সে থলে হাতে করিয়া হাসিতে হাসিতে কথা কহিতে কহিতে বাহির হইয়া আসিল, আমার প্রতি স-কৌতূহল নাতিদীর্ঘ কটাক্ষপাত করিল, তারপর তপেশকে দ্রুতকণ্ঠে কি একটা বলিয়া সখীদের সঙ্গে বাহির হইয়া গেল।

মেয়েটির বয়স কুড়ি বাইশ—নিটোল সুঠাম শরীর; তাহার উপর বস্ত্রাদির বাহুল্য নাই। এ অঞ্চলে ঘাটি বলিয়া একটি জাতি আছে, তাহারা পশ্চিম ঘাটের আদিম অধিবাসী। এই জাতীয় মেয়েদের মতো এমন অপূর্ব সুন্দর দেহ-গঠন খুব কম দেখা যায়। ইহারা হাঁটু পর্যন্ত আঁট-সাঁট কাছা দেওয়া রঙীন শাড়ি পরে, শাড়ির কিন্তু কোমরের ঊর্ধ্বে উঠিবার অধিকার নাই; ঊর্ধ্বাঙ্গের যৌবনোচ্ছলতাকে কেবলমাত্র একটি সস্তা ছিটের কাপড়ের আঙ্‌রাখার দ্বারা অযত্নভরে সংবৃত করিয়া রাখে। মাথার পরিপাটি কবরীতে ফুলের ‘বেণী’ জড়াইয়া ইহারা যখন উৎফুল্ল হাসিমুখে পথে ঘাটে ঘুরিয়া বেড়ায়, অথবা তরিতরকারি বা কাঠের বোঝা মাথায় করিয়া হাটে বিক্রয় করিতে যায়, তখন নবাগতের চোখে তাহাদের এই সহজ ভ্রুক্ষেপহীন প্রগল্‌ভতা একটু বেহায়া মনে হইলেও রসজ্ঞ ব্যক্তির চোখে মাধুর্য বৃষ্টি না করিয়া পারে না।

এই মেয়েটি ঠিক ঐ ঘাটি-জাতীয় কি না জানি না; তবে তাহার ভাব-সাব বেশবাস দেখিয়া সেইরূপই মনে হয়। একটি কালো চকিতনয়না হরিণীর মতো ঘরে প্রবেশ করিয়া আবার ক্ষিপ্র চরণে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

তপেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম—‘এটি কে?’

টেবিলের উপর চোখ নত করিয়া তপেশ একটু অপ্রস্তুত ভাবে বলিল—‘ও আমার স্ত্রী।’

নিজের স্ত্রীর দৈহিক আব্রু সম্বন্ধে বাঙালী অতিশয় সতর্ক; মনে হইল আমার সম্মুখে স্ত্রীর এই স্বল্প-বাস আবির্ভাবে তপেশ মনে মনে ক্ষুব্ধ হইয়াছে—কারণ আমিও বাঙালী। মনে মনে হাসিয়া প্রশ্ন করিলাম—‘এখানে বিবাহাদিও করেছেন তাহলে?’

‘হ্যাঁ, বছর তিনেক হল—’ তারপর যেন বিদ্রোহের ভঙ্গিতে একটু বেশী জোর দিয়াই বলিয়া উঠিল—‘এরা বড় ভাল—এমন মেয়ে হয় না। এদের মতো এমন—।’ বাকি কথাটা সমুচিত ভাষার অভাবে উহ্য রহিয়া গেল। বুঝিলাম, বহুবচনটা বাহুল্য মাত্র, তপেশ স্ত্রীকে ভালবাসে; এবং পাছে আমি তাহার স্ত্রীর সম্বন্ধে কোনরূপ বিপরীত ধারণা করিয়া বসি তাই তাহার মন পূর্ব হইতেই যুদ্ধোদ্যত হইয়া উঠিয়াছে। আমি কথা পাল্টাইয়া দিলাম।

‘এতদিন দেশছাড়া; দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তুলেই দিয়েছেন বলুন?’

বাহিরের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তপেশ বলিল—‘হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কি? সাত বছর ওমুখো হইনি, আর বোধ হয় কখনও হবও না। কি দরকার বলুন।’

আমি বলিলাম—‘তা বটে। আপনার জন কিংবা বাড়ি-ঘর-দোর থাকলে তবু দেশে ফেরবার একটা টান থাকে। আপনার বোধ হয়—?’

তপেশ একটু চুপ করিয়া রহিল; তারপর টেবিলের উপর আঙুল দিয়া দাগ কাটিতে কাটিতে বলিল—‘বাড়ি-ঘর-দোর আপনার জন—সবই ছিল। তবু একদিন হঠাৎ সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে চলে এলুম—’ বলিয়া ঈষৎ ভূকুটি করিয়া টেবিলের দিকে তাকাইয়া রহিল।

হয়তো তাহার দেশত্যাগের পশ্চাতে একটা করুণ গার্হস্থ্য ট্র্যাজেডি লুকাইয়া আছে; এমন তো কতই দেখা যায়, স্ত্রী-বিয়োগ বা ঐ রকম কোনও নিদারুণ শোকের আঘাতে মানুষ ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া পড়ে; তারপর কালক্রমে বৈরাগ্য ও শোক প্রশমিত হইলে আবার দেশে ফিরিয়া যায় অথবা অন্য কোথাও নূতন করিয়া সংসার পাতে। তপেশেরও সম্ভবত ঐ রকম কিছু হইয়া থাকিবে; তারপর ঐ হরিণনয়না বিদেশিনী মেয়েটির আকর্ষণ-জালে জড়াইয়া পড়িয়া দেশের মায়া ভুলিয়াছে।

প্রকৃত তথ্যটা জানিবার কৌতুহল হইতেছিল অথচ সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করিতেও কুণ্ঠা বোধ করিতেছিলাম। তাই চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঘুরাইয়া প্রশ্ন করিলাম—‘দেশে বিয়ে-থা করেননি বোধ হয়? এখানেই প্রথম?’

তপেশ আমার পানে চোখ তুলিল; চোখ দুটিতে বিরাগ ও অসন্তোষ ভরা। প্রথমটা ভাবিলাম, আমার গায়ে-পড়া কৌতুহলের ফলেই সে বিরক্ত হইয়াছে; কিন্তু যখন কথা কহিল তখন বুঝিলাম, তাহা নয়; তাহার মুখের উপর যে ছায়া পড়িয়াছে তাহা অতীতের ছায়া। মুখ শক্ত করিয়া সে বলিল—‘দেশেও বিয়ে করেছিলাম। তিনি হয়তো এখনো বেঁচেই আছেন—মরবার তো কোনও কারণ দেখি না! শুনবেন কেন দেশ ছেড়েছি? শোনেন তো বলতে পারি। কিন্তু আগে আর এক পেয়ালা চা এনে দিই, আর গোটা দুই মিষ্টি। কি বলেন?’

তপেশের কাহিনীটা সংক্ষেপে নিজের ভাষায় বলিতেছি; কারণ তাহার কথায় বলিতে গেলে শুধু যে অযথা দীর্ঘ হইয়া পড়িবে তাই নয়, নানা অবান্তর কথার মিশ্রণে এলোমেলো হইয়া পড়িবে। তবে তপেশের মনে যে একটু অবচেতনার গোপন গ্লানি ছিল, গল্প বলিতে বলিতে সে যে নিজেই সাফাই গাহিয়া অবচেতনাকে ধাক্কা দিবার চেষ্টা করিতেছিল, এ কথাটা পাঠকের জানা দরকার, নচেৎ তাহার চরিত্রটা অস্বাভাবিক ও অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ভ্রম হইতে পারে। তপেশ যে একজন অতি সাধারণ সহজ প্রকৃতিস্থ মানুষ একথা অবিশ্বাস করিলে চলিবে না।

কলিকাতারই কোনও অঞ্চলে তাহার বাস। ছোট্ট একটি নিজস্ব বাড়ি ছিল। বাপ তাহার বিবাহ দিয়াই মারা গিয়াছিলেন, আর কেহ ছিল না। তপেশ আই. এ. পর্যন্ত পড়িয়া কোনও মার্চেন্ট অফিসে কেরানীর চাকরিতে ঢুকিয়াছিল।

স্বামী-স্ত্রী মাত্র দুইটি প্রাণী; আর্থিক অভাব ছিল না। কলিকাতার বাসিন্দা, বাড়িভাড়া দিতে না হইলে অতি অল্প খরচে স্বচ্ছন্দে সংসার চালাইয়া লইতে পারে। স্ত্রীটি দেখিতে শুনিতে ভাল। চারি বৎসরের দাম্পত্য জীবনে দুইজনের মধ্যে গুরুতর অসদ্ভাব কিছু হয় নাই। ছেলেপুলে হয় নাই বটে, কিন্তু সেজন্য কাহারও মনে দুঃখ ছিল না।

সকালবেলা দৈনিক বাজার করিয়া তারপর যথাসময়ে আহারাদি সারিয়া তপেশ অফিসে বাহির হইত। সে বাহির হইয়া যাইবার ঘণ্টাখানেক পরে শুকো ঝি কাজকর্ম সারিয়া চলিয়া যাইত। অতঃপর তপেশের স্ত্রী পাড়া বেড়াইতে বাহির হইত। গায়ে একটা সিল্কের চাদর জড়াইয়া আধ-ঘোমটা দিয়া রাস্তায় নামিত। তারপর এ বাড়িতে গল্প করিয়া, ও বাড়িতে তাস খেলিয়া, বৈকালে তপেশ বাড়ি ফিরিবার কিছুক্ষণ আগে ফিরিয়া আসিত। তপেশ কিছু জানিতে পারিত না।

এমন কিছু দুষণীয় আচরণ নয়। একটি অল্পবয়স্কা স্ত্রীলোক সারাটা দ্বিপ্রহর একাকিনী ঘরের মধ্যে আবদ্ধ না থাকিতে পারিয়া যদি পাড়ার অন্যান্য গৃহস্থের বাড়িতে গিয়া অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে খেলা-গল্পে সময় কাটাইয়া আসে, তাহাকে মারাত্মক অপরাধী বলা যায় না। কিন্তু তপেশ যখন একজন প্রতিবেশী বন্ধুর মুখে কথাটা শুনিল তখন তাহার ভাল লাগিল না। ঘরের বৌ রোজ পাড়া বেড়াইতে বাহির হইবে কেন? তাছাড়া, তাহাকে লুকাইয়া এমন কাজ করা যাহা বাহিরের লোকে জানিবে, এ কেমন স্বভাব?

তপেশ বাড়ি আসিয়া বৌকে খুব ধমক-চমক করিল। বৌ মুখ বুজিয়া শুনিল, অস্বীকার করিল না, কোনও কথার জবাব দিল না।

কিন্তু তাহার পাড়া-বেড়ানো বন্ধও হইল না। কিছুদিন পরে তপেশ আবার খবর পাইল; একটি বন্ধু এই লইয়া একটু মিঠেকড়া রসিকতাও করিলেন। তপেশের বড় রাগ হইল। এ কি কদর্য নির্লজ্জতা। ঘরের বৌ দু’-দণ্ড ঘরে থাকিতে পারে না। অবশ্য স্ত্রীর নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে কোনও সন্দেহই তপেশের হয় নাই, পাড়ার লোকেও কেহ এরূপ অপবাদ দিতে পারে নাই। কিন্তু তবু তপেশ বৌকে যাহা মুখে আসিল তাহাই বলিয়া চিৎকার ও রাগারাগি করিল। বৌ পূর্ববৎ মুখ বুজিয়া শুনিল।

এমনি ভাবে ভিতরে ভিতরে একটা দারুণ অশান্তি দিন দিন বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। তপেশ বৌকে অনেক বই মাসিক-পত্রিকা আনিয়া দেয়, যাহাতে দুপুরবেলাটা তাহার গল্পাদি পড়িয়া কাটিয়া যায়, বৌও দু’একদিন বাড়িতে থাকে, তারপর আবার কোন্ দুর্নিবার আকর্ষণের টানে গায়ে চাদর জড়াইয়া পাড়া বেড়াইতে বাহির হইয়া পড়ে। আবার ঝগড়া হয়, তপেশ ঘরে তালা বন্ধ করিয়া রাখিয়া যাইবার ভয় দেখায়, তাহাতেও কিছু ফল হয় না।

পাড়ায় এটা একটা হাসির ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল। বন্ধুরা তামাসা করে—‘কি রে, তোর সেপাই আজ রোঁদে বেরিয়েছিল?’ তপেশ হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না—দাঁত কিশ্‌ কিশ্‌ করিতে করিতে ঘরে ফিরিয়া যায়। তাহার মনে হয়, বৌ তাহাকে ইচ্ছা করিয়া পৃথিবীর কাছে হাস্যাস্পদ করিতেছে, তাহার আব্রু ইজ্জত কিছুই আর রহিল না।

শেষে নাচার হইয়া তপেশ বৌকে অতি কঠিন দিব্য দিয়াছিল—‘আর যদি অমন করে বাড়ি থেকে বেরোও, আমার মাথা খাবে, মরা মুখ দেখবে।’ বৌ কাঠ হইয়া গিয়াছিল, তারপর তাহার পাড়া বেড়ানো বন্ধ হইয়াছিল।

তপেশ মনে একটু শান্তি অনুভব করিতেছিল। বৌয়ের শরীরে আর তো কোনও দোষ নাই। এটা একটা বদ্‌-অভ্যাস মাত্র, একবার ছাড়াইতে পারিলে আর ভাবনা নাই।

মাসখানেক পরে একদিন অফিসে মাহিনা পাইয়া তপেশ সকাল সকাল বাড়ি ফিরিল। বাহিরের দরজা ভেজানো; বাড়িতে বৌ নাই।—তাহার মাথার মধ্যে যেন চিড়িক মারিয়া উঠিল, সে শয়ন-ঘরে গিয়া ঢুকিল, সাবেক আমলের একটা বড় মজবুত তালা ঘরে ছিল; সেটা লইয়া সদর দরজায় চাবি দিয়া তপেশ বাহির হইয়া পড়িল। হাওড়া স্টেশনে আসিয়া বম্বের টিকিট কিনিয়া গাড়িতে চাপিয়া বসিল।

সেই অবধি সে দেশছাড়া; বাড়ি অথবা বৌ-এর কি হইল তাহা সে জানে না, জানিবার ঔৎসুক্যও নাই। পূর্ব জীবনের সহিত সমস্ত সম্পর্ক চুকাইয়া দিয়া সে নূতন করিয়া সংসার পাতিয়াছে।

তপেশের গল্প শেষ হইতে হইতে বেলাও শেষ হইয়া গিয়াছিল। আমি উঠিয়া পড়িলাম। তাহাকে চা-জলখাবারের দাম দিতে গেলাম, সে কিছুতেই লইল না। বলিল—‘ও কি কথা—আপনি দেশস্থ লোক—| যদি সুবিধে হয় আর একবার আসবেন কিন্তু।’

দরজার কাছ পর্যন্ত পৌছিয়া বলিলাম—‘কৈ তোমার স্ত্রী তো এখনো ফিরে এলেন না?’

তপেশ বলিল—‘তাড়া তো কিছু নেই, বাজার করে একটু বেড়িয়ে-চেড়িয়ে ফিরবে—’ বলিয়াই সচকিতে আমার মুখের পানে চাহিল।

আমি অবশ্য কিছু ভাবিয়া বলি নাই, কিন্তু নিরীহ প্রশ্নের আড়ালে কোনও অজ্ঞাত খোঁচা খাইয়া তপেশ প্রথমটা একটু থতমত হইল, তারপর গলায় একটু জোর দিয়া বলিল—‘এদেশের এই রেওয়াজ—কেউ কিছু মনে করে না।—আচ্ছা নমস্কার।’

২০ অগ্রহায়ণ ১৩৪৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *