যশোহর – অমৃতবাজার সিঙ্গিয়া

যশোহর

অমৃতবাজার

নিজের গ্রাম সম্পর্কে কিছু বলতে হলে প্রথমেই কী মনে আসে আপনার? মাটি আর মানুষ দুই-ই। দেশের মাটিতে ফলে ফসল, আর সে-ফসলের অংশীদার মানুষ গড়ে তোলে গ্রামের সম্মান ও সমৃদ্ধি। আজ নিজের গ্রামকে বিশেষভাবে লক্ষজনের সানুরাগ দৃষ্টির সম্মুখে তুলে ধরবার এই প্রচেষ্টা উত্তর-কাল কীভাবে গ্রহণ করবে কে জানে? ছেড়ে এসেছি যে গ্রাম, এ কি তার জন্যে অশ্রুবিসর্জন? না কি ছায়াসুনিবিড় সেই জন্মভূমির প্রিয় সযত্নলালিত স্মৃতি নিয়ে এ এক ঐতিহ্যবিলাস? এ প্রশ্নের জবাব আজ নাই-বা দেওয়া হল। তবু গ্রামের কথা বলতে বসে প্রথমেই মনে পড়ছে, দেশব্দলের পালায় শরণার্থীর অশ্রু দিয়ে জন্মভূমির এ অর্ঘ্য হয়তো একেবারে ব্যর্থ হবে না। হয়তো গ্রামের মানুষ আবার তার গ্রামকে গভীরতর মমতায় ফিরে পাবে শান্তি ও মৈত্রীর মধ্য দিয়ে।

কলকাতা-খুলনা রেললাইনে যশোহর জেলার ঝিকরগাছা স্টেশন কোনোদিন দেখেছেন? ঝিকরগাছা এ অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ স্টেশন। সুদীর্ঘ সুরকির প্ল্যাটফর্ম, সন্ধ্যার নরম অন্ধকারে ট্রেনটি গিয়ে পৌঁছেলেই গ্রামের গন্ধ পাওয়া যায়। পাশেই স্বচ্ছসলিল কপোতাক্ষ নদ। ঝিকরগাছা থেকে চার মাইল দূরে এনদের এপারে আমার গ্রাম অমৃতবাজার। অমৃতবাজারের পূর্বনাম পলুয়া-মাগুরা। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে নদিয়া জেলার হাঁসখালি গ্রাম থেকে মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষের পূর্বপুরুষরা এ গ্রামে চলে আসেন বসবাস করবার জন্যে।

বাংলায় তখন ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য। এই সুযোগে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে যশোহর জেলায় নীলকুঠিয়াল সাহেবদের অবাধ অত্যাচারে বাংলার চাষি সম্প্রদায় মুমূর্ষুপ্রায়। কুঠিয়ালদের এই অত্যাচারের নিখুঁত চিত্র সাহিত্যে রূপায়িত করলেন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র তাঁর নীলদর্পণ-এ। চাঞ্চল্য জাগল সারাদেশে। বাংলার অত্যাচারিত কৃষক-জনসাধারণের দুঃখদুর্দশার কথা স্মরণ করে তাদের দাবি জানাবার ভার গ্রহণ করলেন শিশিরকুমার। তিনি নিজের গ্রামের ক্ষুদ্র কুটির থেকে অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। পলুয়া-মাগুরার নূতন নামকরণ হল ‘অমৃতবাজার’! আমার জন্মভূমি অমৃতবাজার। জনসাধারণের মুখপত্ররূপে অমৃতবাজার পত্রিকার সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটিকে জাতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় স্থানান্তরিত করতে হল। কিন্তু বাংলার এক নিভৃত কোণে এই গ্রামে আজকের বিশ্ববিশ্রুত অমৃতবাজার পত্রিকার সূতিকাগৃহের প্রাচীন স্মৃতির সাক্ষ্য এখনও বর্তমান।

গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবহমান কপোতাক্ষ, তারই হাত ধরাধরি করে চলেছে চৌগাছা রোড। নদীর সমান্তরালে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে শিশিরকুমার দাঁতব্য চিকিৎসালয়, শ্ৰীশ্ৰীসিদ্ধেশ্বরী বাড়ি, হরিসভা-ভবন ইত্যাদি। মহাত্মা শিশিরকুমারের কৃতী সন্তান তুষারকান্তি ঘোষের প্রচেষ্টায় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এই দাঁতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয় আর্ত দরিদ্র জনসাধারণের সেবার জন্যে। চিকিৎসালয়ের অনতিদূরেই পথিকদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে ‘পীযূষ পয়োধি। সকাল, সন্ধ্যায় সে সরোবরের ঘাটে গ্রামবাসীদের ভিড় জমে।

প্রকৃতির মায়া-মালঞ্চ অমৃতবাজার গ্রাম। কপোতাক্ষের বুকে দেশ-বিদেশের পণ্যসম্ভার নিয়ে মাঝিমাল্লারা সারি গেয়ে চলেছে ‘হেইয়ে হেরো, হেইয়ে হেয়োলগি ঠেলে গুড় বোঝাই দু-হাজার মনি নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। সুরটা কানে এসে বাজছে। চৌগাছা সড়ক দিয়ে গোরুর গাড়ি চলেছে ক্যাঁচক্যাঁচ। রাস্তার দু-ধারে শাল, সেগুন, তাল, কৃষ্ণচূড়া, নিম, নিশুন্দি গাছের সারি। পীযূষ-পয়োধির তীরে গন্ধরাজ, চামেলি, হেনা আর ভাঁটফুলের গন্ধে বিভোর হাওয়া-বাতাস।

দক্ষিণে ধু-ধু করে ধান-কড়াইয়ের খেত। দূরে দেখা যায় দেওয়ানগঞ্জ, ঝিকরগাছা বন্দর আর তার ঝুলন-সেতু। পূর্ব দিকে বিশাল বিল ‘ডাইয়া’। ডাইয়া’ বিল সত্য সত্যই দর্শনীয়। তার গভীর জলে মৎস্যকন্যার রূপকথার দেশ। যশুরে কইমাছও মেলে প্রচুর। শিকারিদের প্রমোদস্থান এ বিল। ধান পাকার প্রাক্কালে অসংখ্য পাহাড় আর সামুদ্রিক পাখি আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। কলকাতা থেকে ফিরিঙ্গি শিকারিরা ও পক্ষী ব্যাবসায়ীরা বন্দুক ও ফাঁদ নিয়ে আসে শিকারে। সাদা-কালো-ধূসর তাঁবুতে ছেয়ে যায় গাঁয়ের আশপাশ। সাহেব শিকারিরা খুবই দিলদরিয়া। শিকার সন্ধানে এসে বেশ দু-পয়সা খরচা করে যায় তারা। গ্রামবাসীদেরও কিছু অর্থাগম হয় এই মরশুমে।

গ্রামের মধ্যে শ্রীশ্রীকালীমাতার একটি বিগ্রহ আছে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস তিনি নাকি জাগ্রত। জাতিধর্মনির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান সকলকেই এই কালীমাতার কাছে পুজো দিতে দেখেছি। আগে নাকি এই পীঠস্থান কপোতাক্ষের কূলে অবস্থিত ছিল। কালের গতিতে ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তনের ফলে এই নদী বর্তমানে অনেকখানি পশ্চিম দিকে সরে গেছে।

বহু জাতের বাস এই গ্রামে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, কবিরাজ, কবিয়াল, লাঠিয়াল, কীর্তনীয়া, মৌলবি, পটুয়া, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। গ্রামটি বহু পাড়ায় বিভক্ত। হিন্দু পল্লিতে মজুমদার, বিশ্বাস, সেন, মিত্র, ঘোষ ইত্যাদি; বহু পাড়ার মতন মুসলমান পল্লিতেও কাজী, বেহারা, সর্দার, মোল্লা, পাঠান ইত্যাদি পাড়া রয়েছে। হিন্দু মুসলমানে কোনোদিন বিদ্বেষের ভাব ছিল না। হিন্দুর পুজো-পার্বণে, তার দুর্গোৎসবে, চড়ক পুজোয় মুসলমান ভাইরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ভাই-ভাই রূপেই বাস করেছে তারা। একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে হিন্দু-মুসলমান সকলেই গ্রামের উন্নতির জন্যে আত্মনিয়োগ করে এসেছে। হিন্দু চাষি ছিল মুসলমান চাষির দরদি ভাই, মুসলমানেরাও সুখে দুঃখে হিন্দুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গ্রামবাসী হিন্দু-মুসলমান দৃঢ়কণ্ঠে একটি সত্যই ঘোষণা করে এসেছে–

রাম রহিম না জুদা কর ভাই
দিলটা সাচ্চা রাখো জী।

কালচক্রে আজ রাম রহিম কী করে যে জুদা হয়ে গেল তাই ভাবি। মাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত ছিল যে মানুষ, যে চাষি, তারা আজ কোথায়, কোন দেশে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়েছে কে জানে? এই গ্রামেরই কৃষাণ-বধূদের গান গাইতে শুনেছি–

মাটি আমার স্বামী-পুত,
মাটি আমার প্রাণ;
মাটির দৌলতে এবার
গড়িয়ে নিব কান।

এই চাষিদের জন্যে ধান বিলিয়ে দিতেন মহাজন মহেশ কুন্ডু। হিন্দু-মুসলমান কৃষক। সকলেই তাঁকে ডাকত ‘ধানিদাদা বলে।

পাশের গ্রাম ছুটিপুরে পুজোর সময় বসত মেলা। দূর-দূরান্তর থেকে গ্রামবাসীরা আসত এই মেলায়। বিজয়ার দিন নদীতে নৌকাবাইচ দেখতেও বহু দর্শনার্থীর সমাবেশ হত।

গ্রামে শখের যাত্রার দল ও নাট্য-সমিতি গঠিত হয়েছিল। পুজো-পার্বণে গ্রামবাসীদের আনন্দানুষ্ঠানের সময় এদের ডাক পড়ত।

গ্রামের উত্তরে পলুয়া মহম্মদপুর, মুসলমানপ্রধান গ্রাম। ধীরে ধীরে সে-গ্রামের অনেকেই এসে অমৃতবাজারে বসতি স্থাপন করেছিল। নদীর ওপারে ‘বোধখানা’ ও ‘গঙ্গানন্দপুর’। গঙ্গানন্দপুর একটি শিক্ষিত উন্নতিশীল গ্রাম। এ গ্রামের মদনমোহনের মন্দির বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সব কিছু মিলিয়েই একটি সুন্দর গ্রাম অমৃতবাজার। এ গ্রামের নামাঙ্কিত সংবাদপত্র আজ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। তুলসীতলার প্রদীপের মৃদু আলোয় ঘেরা সেই গ্রাম তেমনই নীরবে নিভৃতে তার অধিবাসীদের মনে শান্তি ও আশা সঞ্চার করে আসছিল। গ্রাম নিয়েই তাদের সুখ, দুঃখের দিনে গ্রামই ছিল তাদের সান্ত্বনা। আমিও সেই হাজার হাজার গ্রামবাসীরই একজন। রাজনীতির পাকচক্রে কেমন করে যে সে-গ্রামকে ছেড়ে আসতে হল জানি না, জানলেও সে মর্মন্তুদ কাহিনি বর্ণনার ভাষা আমার নেই। গ্রাম ছাড়ব, একথা ভাবতে মন চায়নি। তবু ছেড়ে আসতে হল। বিদায়ের দিন তুলসীতলায়, ঠাকুরঘরে, এমনকী গোয়ালদোরে শেষপ্রণাম জানাল সবাই। বৃদ্ধা পিসিমা ঠাকুরঘরের দোর ছাড়তে চাইলেন না, পিসিমার চোখের জলে সজল ও করুণ মুহূর্তে আমারও মন ভিজে গেল। পূর্বপুরুষদের বহুস্মৃতিবিজড়িত যে গ্রাম আমার কাছে তীর্থস্বরূপ, সেই গ্রামজননীর উদ্দেশ্যে শেষসন্ধ্যায় একটি সশ্রদ্ধ প্রণাম রেখে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হলাম। পায়ে-হাঁটা পথে এগিয়ে চলেছি, মন পড়ে রয়েছে পেছনে। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তবু জন্মভূমির আশা লোপ পায়নি। মন বলছে, এ মেঘের অন্তরালেই রয়েছে সূর্যকরোজ্জ্বল উদার নীলাকাশ। কিন্তু সে-দিগন্ত আর কতদূর?

.

সিঙ্গিয়া

ছায়াচ্ছন্ন সমুদ্রের মতোই সীমান্ত-ছোঁয়া রাত্রির মায়া ঘনিয়ে আসে নিঃশব্দে। নিঃসীম নিস্তব্ধতা চারিদিকে–সৃষ্টি যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে অনাগতের অবগুণ্ঠন উন্মোচনের ব্যাকুলতা নিয়ে। প্রতীক্ষা-ক্লান্ত মুহূর্তগুলি আপনা হতেই ভারী হয়ে ওঠে। দিগন্তপ্রসারী এই অচঞ্চল স্তব্ধতার মাঝে, অন্ধকারের বুক চিরে পুরী এক্সপ্রেস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে তীর্যক গতিতে–গোটা পৃথিবীর জীবন-শক্তিকে যেন ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে সে।

ধূলি ধূসর কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরে–কত গ্রাম, কত প্রান্তর, কত বনছায়া একে একে সরে যায় চোখের সমুখ দিয়ে, কিছুই দাগ কাটে না মনে। অজানা শঙ্কায়, দুর্নিবার সংশয়ে মন আন্দোলিত হতে থাকে। আজন্মের চেনা পরিবেশ ছেড়ে গৃহহারা আমরা বেরিয়েছি পথে–নতুন ঘরের সন্ধানে, ঠাঁই খুঁজে নিতে দেশ-দেশান্তরে। বাস্তুহারা জীবনে সুদূরের আহ্বান, চোখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া–দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।

সহসা আলোর শিখায় কাঁপন লাগে। স্টেশন অতিক্রমের সাংকেতিক ধ্বনি মুখর হয়ে ওঠে –শূন্য মন্দিরে বাঁশির তীক্ষ্ণ সুর বড়ো বেসুরে বাজে। গতির আনন্দ ভুলে যাই। পুঞ্জীভূত চিন্তারাশির জটলা জটিল হয়ে ওঠে। ভীরু মন পিছনপানে ফিরে চায় নিতান্তই অসহায়ের মতো।

বনানীর অন্তরালে অপসৃয়মান অচেনা গ্রামগুলির মতোই ফেলে-আসা জীবনের বিস্মৃত কাহিনি ছায়া ফেলে মনের পাতায়, সুখ-দুঃখের স্মৃতিবিজড়িত ছিন্ন-বন্ধন গ্রামখানি তাজা ফুলের হাসির মতোই ভেসে ওঠে চোখের তারায়। অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ ম্লান হয়ে আসে, একটা অনিশ্চয়তা মিয়মাণ করে তোলে মনকে–জীবনের জয় প্রতিষ্ঠার অহংকার নিষ্প্রভ হয়ে আসে।

আমাদের নতুন পরিচয়–এপারে শরণার্থী, ওপারে পরবাসী। স্বাধীনতার সৈনিকদের জীবনে এ এক মর্মান্তিক পরিহাস। শরণার্থী হিসাবে অনুকম্পার পাত্র হতে ঘৃণা জাগে, ব্যথা ঘনায় মনে। আর পরবাসী? সে-কথা ভাবতেও মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে–নিষ্ফল আক্রোশে গুমরে গুমরে মরে। স্বার্থোদ্ধত অবিচার বেদনাকে পরিহাস করে। প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হয়?

সেদিনও তো দ্বন্দ্ব ছিল, কলহ ছিল, বিরোধ ছিল, কিন্তু পুঞ্জীভূত মালিন্য তো আবহাওয়াকে এমন বিষিয়ে তোলেনি, এমন অব্যক্ত বেদনার সৃষ্টি করেনি। স্বার্থে স্বার্থে অপরিহার্য সংঘাত কোনোদিন যৌথ পরিবারের পারিপার্শ্বিকতা অতিক্রম করেনি। বিরোধ বিসংবাদে আত্মীয়তার সীমা লঙ্ঘিত হয়নি। বাংলার আর পাঁচখানা গ্রামের মতোই আমাদের গ্রামেও হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে আপন জেনে সদ্ভাবে বসবাস করেছে। শরতের স্বচ্ছ আকাশে কাজলকালো মেঘের আবিলতা স্থায়ী হতে পারে নি–ক্ষণিকের বর্ষণেই মলিনতা ধুয়ে গেছে।

খরস্রোতা ‘চিত্রা’ ও ‘নবগঙ্গা’র মোহনায় যশোহরের বিশিষ্ট ব্যাবসাকেন্দ্র নলদির প্রান্তবর্তী আমাদের এই ছায়া-ঢাকা গ্রামখানি, প্রকৃতির মায়া-মালঞ্চ যেন। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না –ঘরবাড়ি আছে, রাস্তাঘাট আছে, না হাজার লোকের বসতি আছে। কবে কোন এক অজ্ঞাত প্রভাতে কে যে এর নাম দিয়েছিল ‘সিঙ্গা’ সে-কথা কেউ মনে করতে পারে না। ব্রিটিশ আমলে ডাকঘর প্রতিষ্ঠাকালে গ্রামের নতুন নামকরণ হল ‘সিঙ্গিয়া’, এই কথাই শুধু মনে পড়ে।

সবুজ স্নিগ্ধ গ্রামখানির সারাঅঙ্গে অপূর্ব শ্যামলিমা। নিত্যকালের অতিথির মতোই ‘বারোমাসে তেরো পার্বণ’ এই পল্লিরও মধুর আকর্ষণ।

এইসব উৎসবে আনন্দে হিন্দু-মুসলমান সমভাবেই অংশগ্রহণ করেছে–মেলায়, নৌকাবাইচে, ঘোড়-দৌড়ে, গোরু-দৌড়ের তীব্র প্রতিযোগিতায় সে কী উদ্দীপনা! সেই আনন্দ গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনকে সাময়িকভাবে হলেও মুখর করে তুলেছে। আবার কখন গভীর রাতে ধানখেতের কিনারে দেখা গেছে অসংখ্য টিমটিমে আলো–আলেয়ার আলোর মতো কখনো স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে, কখনো-বা ধানের শিষের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখতে হয়, হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কোঁচ দিয়ে মাছ মেরে চলেছে। আলোয় মাছ মারার এই মরশুমেও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কত নিবিড় তারই পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে। অনেক উঁচু ওই আকাশ, চাঁদ-সূর্য হাত ধরাধরি করে সেদিন সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে।

এই সেদিনের কথা। চারজন মুসলমান আসামি, নারী নিগ্রহের দায়ে অভিযুক্ত। মিত্রবাবুদের সদর কাছারিতে বিচার শুরু হয়েছে। গ্রামের লোক ভেঙে এসে কাছারি বাড়ির বিস্তীর্ণ অঙ্গনে ভিড় জমিয়েছে। হিন্দুর কাছারিবাড়িতে বিচার, বিচারকদের মধ্যে আছেন বাবুরা ছাড়া কয়েকজন সম্ভ্রান্ত মাতব্বর মুসলমান। কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হল। আসামিরা নির্বিবাদে শাস্তি মাথা পেতে নিলে। পুলিশ নেই, আদালত নেই, দন্ডাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই, নেই। কোনো কেলাহল। সুস্থ পরিবেশে সুষ্ঠু ব্যবস্থা। কঠোর দন্ডাজ্ঞার মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর পরিস্ফুট হয়ে উঠল। অপরাধীর শাস্তি দিতে উভয় সমাজকেই একযোগে এগিয়ে আসতে দেখেছি সেদিন।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই গো-হত্যার ব্যাপারেও অনুরূপ ব্যবস্থায় বিচারসভা বসতে এবং গ্রাম্য পঞ্চায়েতের কঠোর সিদ্ধান্ত নির্মমভাবে প্রযুক্ত হতেও দেখেছি। তথাপি ধর্মের জিগির ওঠেনি, ধর্মের নামে জোট-পাকানোর কথা কেউ ভাবেনি। স্বাভাবিক জীবনধারায় ব্যতিক্রম সৃষ্টি শাস্তিবিধানের যোগ্য বলেই বিবেচিত হয়েছে।

মাস্টার সাহেবের পাঠশালাতেই বা না পড়েছে কে? পরবর্তী জীবনে যাঁরা প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন, বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার হতে আহরণ করে যাঁরা সমাজে মর্যাদার আসন লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে এমন কে আছেন যিনি মৌলবি আব্দুল বিশ্বাসের পাঠশালায় হাতে খড়ি দেননি এবং মাস্টার সাহেবের শাসানি, চোখরাঙানি ও চাবুক সহ্য করেননি। শণের মতো সাদা একগাল দাড়ি, দারিদ্র্যের কুঞ্চিত রেখা সর্ব অবয়বে, সৌম্য মূর্তি মাস্টার সাহেব। বড়ো ঘরের ছেলেদেরও তাঁর কাছে পাঠ নিতে আটকায়নি, শাস্তি গ্রহণেও অমর্যাদা হয়নি। একটানা জীবনস্রোতে কখনো বিস্ময়কর ছন্দপতন ঘটেনি।

‘ছুটি বঁটি দিয়ে কুটি’ হাঁক দিতে দিতে ছেলের দল ছুটির পর মাঠে এসে নেমেছে। ‘হাডুডু’, ‘বুড়ি-ছোঁয়া’, ‘কানামাছি’ প্রভৃতি নিভাঁজ গ্রাম্য খেলাধুলোর মধ্যে কিশোর জীবনে যে অনাবিল আনন্দের সঞ্চার হয়েছে, সে-আনন্দের অংশ থেকে মিনু, হারান, ভোলাদার সঙ্গে আজিজ, করিমও বাদ পড়েনি। খেলার মাঝে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ দেখিনি, বিত্তশালী ও বিত্তহীনের প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু কখনোই কি কোনো গোলযোগ বাধেনি? খেলায় হারজিত নিয়ে মারপিট পর্যন্ত হতেও দেখেছি, কিন্তু মাস্টার সাহেবকে ডিঙিয়ে অভিযোগ অভিভাবকের কানে কোনোদিন পৌঁছাতে পারেনি। আজও তো সেই গ্রামই আছে।

এই তো সেই গ্রাম, যেখানে একটি পল্লি-পাঠাগারকে কেন্দ্র করে একদিন রাজনৈতিক চেতনা গ্রাম হতে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

কলেজের ছাত্র ‘কালোদা’ সেবার পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে সকলকে কাছে ডেকে বোঝালেন, ক্লাসের পড়াই সব নয় রে, জীবনে বড়ো হতে হলে চাই মনীষা, চাই জ্ঞানার্জনের নেশা। এই লক্ষ্যের পথে গ্রন্থাগার যে অপরিহার্য, সে-সম্বন্ধে তাঁর কথায় নিঃসংশয় হয়ে ছেলের দল আমরা মেতে উঠলাম লাইব্রেরি গড়ে তুলতে। ‘বিবেক লাইব্রেরি’ ভূমিষ্ঠ হল। মুখ্যত স্বামীজির গ্রন্থাবলি আর স্মরণীয় যাঁরা তাঁদের কয়েকজনের জীবনী নিয়ে গ্রন্থাগারের উদবোধন হল। কিশলয় অঙ্কুরিত হল, ক্রমে ক্রমে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে যেদিন পা দিল সেদিন থেকে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে অবলম্বন করে রাজনৈতিক চক্র গড়ে উঠতে লাগল। মহাত্মাজির অসহযোগ আন্দোলন কিংবা অগ্নিযুগের আত্মাহুতির আহ্বান কোনোটাই বাদ পড়েনি গ্রাম্য জীবনে প্রতিফলিত হতে–প্রান্তবর্তী এই গ্রামখানির সঙ্গে আশপাশের গ্রামগুলিকেও আলোড়িত করতে। সেদিনের সেই জাতীয় আন্দোলনকে পুষ্ট করতে, প্রেরণা দিতে এই পল্লি-পাঠাগারের অবদান যে কতখানি, তার হিসাব আজ আর কে করবে?

পুলিশ সাহেব এলিসন ও পূর্ণ দারোগা নির্বিচারে তল্লাশি, গ্রেপ্তার, গৃহদাহ ও লুণ্ঠন চালিয়েও জনতার কণ্ঠ রুদ্ধ করতে পারেনি, কংগ্রেস ভবনটিকে পুড়িয়ে দিয়েও গ্রামের মানুষের মন থেকে কংগ্রেসকে নির্বাসিত করতে পারেনি। বিপ্লবী সন্দেহে এগারো জন যুবককে যেদিন একসঙ্গে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সকলে সেদিন রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ভিতর বাড়ির অঙ্গন ও নদীর ঘাটের বাইরে যাদের কোনো পরিচয় নেই, সেইসব পুরললনারাও সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিলেন ধৃত তরুণদের অভিনন্দন জানাতে। স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে মুসলমান সমাজও যোগ দিতে এগিয়ে এসেছিল। নারী-পুরুষের মিলিত কণ্ঠে বন্দেমাতরম ধ্বনির মধ্যে বন্দিদের নিয়ে পুলিশ সাহেবের লঞ্চ ছেড়ে গেল। জাতীয় ধ্বনির মধ্যে জনতার প্রতিবাদ ও রুদ্ধ আক্রোশ ফেটে পড়তে লাগল। লঞ্চ চলে গেল। নদীর এপারে-ওপারে তখনও গাঁয়ের লোকের ভিড়, চোখে তাদের প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ।

গ্রন্থাগারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যায়ামাগারও গড়ে উঠতে থাকে। শরীরচর্চায় এমনই অনুকূল আবহাওয়ার সৃষ্টি হয় যে, খেলার মাঠে লোক-অভাব বিস্ময়ের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। যে-খেলা তরঙ্গ তোলে মনে, সেই ফুটবল, ক্রিকেট থেকে লাঠিখেলা, ছোরাখেলার আকর্ষণ প্রবল হয়ে ওঠে। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে লাগে। জোয়ান ছেলে জোর কদমে চলে অটুট সংকল্প নিয়ে।

প্রবীণদের ও মধ্যবয়স্কদের আড্ডা বসে বসুবাটিতে, রাজকাছারিতে, আর মিত্রবাবুদের বৈঠকখানা ঘরে। দু-মাইল দীর্ঘ গ্রামখানির অধিকাংশ লোক জমাজমির ওপর নির্ভরশীল, অভাবের তাড়না নেই তেমন। তা ছাড়া সম্পন্ন পরিবারের যারা, আড্ডা জমাতে তাদেরই উৎসাহ বেশি। তাস, পাশা ও দাবাকে ভর করে নৈশ আড্ডা জমে ওঠে। এই আড্ডার আনুষঙ্গিক পান-তামাক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চা। রাত্রি আটটায় গ্রাম যখন ঘুমোয়, এদের খেলার আসর সবে তখন জমে ওঠে। রাত্রি বারোটায় সুপ্তিমগ্ন গ্রামের জনবিরল পথে যে যার গৃহের পানে চলে। ডরে আশঙ্কায় কেউ বা হাততালি দেয়, কেউ বা লাঠি ঠক-ঠক করে চলে। আর বলে দস্যি ছেলেদের হাতের কোদাল পড়ে বর্ষা-বোয়া গ্রামের দুর্গম পথও এমনই সুগম হয়েছে যে, চোখ বুজে চলতেও বাধা নেই আর। সোয়াস্তিতে চলে আর আশীর্বাদ করে মনে মনে।

পথের প্রান্তে চালাঘরের মধ্যে লণ্ঠন জ্বালিয়ে শখের যাত্রার মহড়া চলে। নারীকন্ঠের ব্যর্থ অনুকরণে পুরুষের কর্কশ স্বর, অন্ধকারের বুকে আছড়ে পড়তে থাকে। হারমোনিয়ামের চড়া আওয়াজ নিশুতি রাতের স্তব্ধতাকে ব্যঙ্গ করে মাঝে মাঝে, আকাশে তারার মালা তখনও মিটমিট করে।

গ্রামের ছেলেরা প্রতিবছর দলে দলে পড়তে যায় পার্শ্ববর্তী শহরের স্কুলে। লজিং-এর অথবা বোর্ডিং-এ আশ্রয় খুঁজে নিতে হয়। তবু গ্রামে হাই স্কুল গড়ে ওঠে না। চাষি প্রজারা ইংরেজি লেখা পড়া শিখলে বাবুদের মান্য করবে না, এই আশঙ্কাতেই নাকি গ্রামের কর্তারা গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠায় বাদী হন–সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকেও হার মানিয়ে ছাড়েন। কেরানির অভাব পূরণের জন্যে একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্রিটিশকে একদিন বাধ্য হয়েই ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন করতে হয়েছিল। এঁদের তো সে বালাই নেই। উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যা হলেই নায়েব গোমস্তার কাজ আটকায় না। তাই স্কুল স্থাপনের প্রয়াস কয়েকবারই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কৃতী ছেলেরা সেবার ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি সামনে রেখে কাজে নেমে গেল। প্রধানশিক্ষক বাইরে থেকে এলেন, বহুজনের সমবেত চেষ্টায় স্কুল গড়ে উঠল। যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনও পাওয়া গেল। দুই শতাধিক ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির পাকা ভিত গড়ে তুলল। চালু প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক নিয়মেই চলতে লাগল। কর্তারা বললেন, এইবার গ্রাম গেল, মানীর মান সম্ভ্রম বিপন্ন হল। কিন্তু সেদিনও গ্রাম যায়নি। বিদ্যাপীঠ পল্লবিত হয়ে জীবন্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল। সম্ভম কিন্তু তখনও বিপন্ন হয়নি, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র রচিত হয়ে জীবনের জয় সূচিত হল। নীল আকাশের আস্তরণের নীচে আজও স্কুল ভবনটি তেমনই আছে। সেইসব শিক্ষক আজ আর নেই, যাঁরা ত্যাগের আদর্শকে ছাত্রদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, আর সেইসব ছাত্রও নেই যাঁরা আর্তের সেবায় বিপদের ঝুঁকি নিতে অকুণ্ঠিত ছিলেন। আর সবই আছে, নেই শুধু প্রাণের স্পন্দন।

জেলাবোর্ডের রাস্তাটি আজও এইভাবে গ্রাম ও বিলের স্বতন্ত্র সত্তার সাক্ষ্য হয়ে আছে। আজও এই পথে দেশ-দেশান্তরের লোক যাতায়াত করে; গ্রামের লোক বাজারে যায়, ডাকঘরে যায়, স্টিমার ঘাটে যায় এই পথে। কিন্তু সংকীর্তনের দল আর বেরোয় না, শিবের গাজন এ পথে চলে না।

শারদোৎসবে, চড়ক মেলায়, কালীপুজোয় ও হোলিখেলায় যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ-বন্যা গ্রামখানাকে প্লাবিত করে দিত, বাজি-বাজনায়, সাজে-সজ্জায়, আমন্ত্রণে-নিমন্ত্রণে যে প্রাণের পরিচয় প্রত্যক্ষ হয়ে উঠত, আজ তা অলীক কাহিনি।

ছেড়ে-আসা গ্রামের ছায়াশীতল ঘরের মায়া নিত্যপিছন টানে, তবু চলতে হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয়। পারিপার্শ্বিক ভুলে যাই, মনের গভীরে জাগে–মাটি চাই, ঠাঁই চাই, জীবনের বিকাশের পথ উন্মুক্ত পেতে চাই।

ট্রেনের গতি আবার স্তব্ধ হয়ে আসে। চোখ-ঝলসানো আলো এসে চোখে লাগে। বড়ো স্টেশন–বালেশ্বর। অগ্নিযুগের রোমাঞ্চময় স্মৃতি বিজড়িত এর সাথে। বিপ্লবের পূজারির ঐতিহাসিক বীরগাথা সহসাই প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে–চলচ্চিত্রের মতোই ছায়া ফেলে যায় মনে। অমাবস্যার অন্ধকারের পারে একফালি চাঁদ চিকচিক করে ওঠে। বাঙালি বীরের বিপ্লবসাধনার তীর্থপীঠ বালেশ্বরে দাঁড়িয়ে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন জাগে চোখে। ভরসা জাগে, অনাগত ভবিষ্যতে পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে মানুষের শবদেহের সারে অঙ্কুরিত হবে নবীন শস্য। বিপ্লবের বহ্নিশিখায় পূর্ণ হবে আবর্তন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *