যযাতির পরাজয় – মায়া বসু
নিখিল বঙ্গ ওয়েট লিফটিং, বডিবিল্ডিং, হাইজাম্প, দেহসৌষ্ঠব ও পেশি প্রদর্শন ইত্যাদি নানা ধরনের জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী শ্রীমান অতনু সেন প্রচুর হাততালি ও উৎসাহব্যঞ্জক প্রশংসাধ্বনির মধ্যে তার রুপোর মেডেল, কাপ ইত্যাদি তৃতীয় পুরস্কারগুলি নিয়ে ভিড়-ভরতি জিমনাসিয়াম থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।
ব্যায়াম প্রতিযোগিতা শেষ হতে তখনও অনেক দেরি। আরও কিছুক্ষণ ওখানে থাকা ওর উচিত ছিল। কিন্তু কিছুতেই ও আর ওখানে থাকতে পারল না। অতনুর সমস্ত মনটা এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ও বেদনায় ভরে উঠেছিল। বারবার মনে পড়ছিল বাবা আর মায়ের কথা।
আজ যদি অতনুর বাবা বেঁচে থাকতেন, আজ যদি ওর স্নেহমমতাময়ী মা বেঁচে থাকতেন, অতনুকে তাঁরা হৃদয়ভরা স্নেহ-যত্ন-সেবা-উৎসাহ দিয়ে, প্রেরণা দিয়ে আরও শক্তিমান ও উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারতেন, তা হলে আজ এই নিখিল বঙ্গ ব্যায়াম প্রতিযোগিতায় তাঁদের একমাত্র সন্তান অতনুকে তৃতীয় স্থান অধিকার করে তৃতীয় পুরস্কার হাতে নিয়ে মন খারাপ করে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে আসতে হত না। অনায়াসেই আজ অতনু এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করতে পারত। প্রথম পুরস্কারটা অতনুরই প্রাপ্য হত।
আর সবচেয়ে বড় কথা ‘দেহসৌষ্ঠব’ প্রতিযোগিতায় যে-ছেলেটি প্রথম হয়ে ‘বঙ্গশ্রী’ হয়েছে, সেই প্রথম পুরস্কারটা ও-ই পেতে পারত। কেননা, অতনু আরও বেশি সুদর্শন, সুদেহী ও স্বাস্থ্যবান।
মা-বাবা, দুজনে মারা যাওয়ার পর থেকেই তার দুর্ভাগ্যের আর দুর্দশার শুরু।
দূরসম্পর্কের জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে অযত্নে, অবহেলায় কোনওক্রমে আশ্রিত হয়ে থেকে, উপযুক্ত পরিমাণে ভিটামিনের অভাবে দিনের পর দিন কাটিয়ে, নিত্য নিয়মিত দেহচর্চা করে প্রতিযোগিতায় ‘প্রথম স্থান’ অধিকার করার কল্পনাটা শুধু অভাবনীয় নয়, অচিন্ত্যনীয়ও বটে।
সত্যি কথা বলতে কী, শরীর ঠিক রাখার মতো এমন কী খাবার তার জোটে? পেস্তা বাদাম-ছোলা-দুধ-ডিম-মাছ-মাংস দূরে থাক, দু-বেলা পেট ভরে ভাতও তার যথাসময়ে যথানিয়মে জোটে না।
ঘাড়ে পড়া দূর-সম্পর্কের ভাইপোকে কোন জ্যাঠামশাই-জ্যাঠাইমাই-বা সুচক্ষে দেখে থাকেন?
বিশেষ করে, অতনুর জন্য যদি তার বাবা কিছু ব্যাঙ্ক ব্যালান্স রেখে যেতে পারতেন, তা হলেও বা এক কথা ছিল।
বিষণ্ণ মনে ম্লান মুখে হাঁটছিল অতনু, হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ভাঙা ফ্যাঁসফেঁসে জড়ানো অস্পষ্ট গলায় তার নাম ধরে ডেকে উঠল, অতনু—অতনু সেন, একটু দাঁড়াও।
আত্মচিন্তায় নিমগ্ন অন্যমনস্ক অতনু সচকিতভাবে পথের একপাশে থমকে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পিছন ফিরে আহ্বানকারীর দিকে তাকিয়ে ও বেশ একটু অবাক হয়ে গেল।
সেই বুড়ো ভদ্রলোকটি!
দামি সুটে-বুটে-টাইয়ে আপাদমস্তক টিপটপ। শুধু বয়েসই হয়নি তাঁর, জরা ভদ্রলোকের দেহটিকে পরিপূর্ণভাবে করায়ত্ত করে নিয়েছে। জিমনাসিয়াম থেকে এতটুকু রাস্তা অতনুর পিছন-পিছন হেঁটে আসতেই বুড়োমানুষটি হাঁপিয়ে উঠেছেন।
অতনুর মনে পড়ল, তাদের জিমন্যাস্টিক ক্লাবেও এই বুড়োমানুষটিকে ও অনেকবার দেখেছে।
হয়তো ছেলেদের দেহচর্চা-ব্যায়ামচর্চা দেখতে উনি ভালোবাসেন, এই কথাটাই বেশি করে মনে হল অতনুর।
মুখচেনা হলেও, ব্যায়ামের আখড়ায় ওঁকে দেখলেও, একজন বয়স্ক ও সম্পূর্ণ অপরিচিত বৃদ্ধের মুখ থেকে অতি পরিচিতের মতো তার নাম ধরে ডাকাডাকিতে বেশ একটু বিব্রত ও লজ্জিতভাবে অতনু সাড়া দিল, আপনি কি আমায় ডাকছিলেন?
হ্যাঁ, তোমাকেই ডাকছি। একটু দাঁড়াও। ভীষণ হাঁপিয়ে গেছি।
বুড়োমানুষটি এবার মন্থর পদক্ষেপে অতনুর কাছাকাছি এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে ঘাড়, চোখ-মুখ, কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন।
অতনু বিস্মিতভাবে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে খর্বাকৃতি, কুৎসিত, পাকানো দড়ির মতো চেহারার বুড়ো লোকটির নিষ্প্রভ ঘোলাটে চোখের দিকে, অসম্ভব কোঁচকানো-তোবড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে বুড়ো লোকটি তেমনই ফ্যাঁসফেঁসে ভাঙা জড়ানো গলায় বললেন, অতনু, আমি সমানে তোমাকে লক্ষ করে বসেছিলাম। তুমি প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়ে কাপ-মেডেল নিয়ে বেরিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই আমিও তোমাকে ফলো করেছিলাম। কিন্তু কী জানো, যৌবন আর জরা এ-দুটোর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। তুমি যতটা এগিয়ে গিয়েছ, আমি ততটাই পিছিয়ে পড়েছিলাম।
আমাকে কি আপনার কোনও দরকার আছে?
অতনুর বিস্মিত প্রশ্নের জবাবে তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, দরকার না থাকলে কি তোমার পেছন-পেছন আমি এমনভাবে ছুটে আসি? তোমাকে আমার ভীষণ দরকার, অতনু সেন।
আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। মাঝে-মাঝে আপনাকে আমাদের ব্যায়ামের আখড়ায় দেখেছি—চুপচাপ বসে আছেন। আপনি আমাকে চিনলেন কেমন করে?
বিস্মিত অতনুর সকৌতূহল প্রশ্নের উত্তরে রুগ্ন, জীর্ণ, প্রাচীন মানুষটির মুখে এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসির আভাস ফুটে উঠল।
সেইসঙ্গে ওঁর ঘোলাটে ঝাপসা চোখের দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য দপ করে জ্বলে উঠল। অতনুর খুব কাছে এগিয়ে এসে বললেন, আমাকে চেনার প্রয়োজন তোমার নেই, অতনু। আমার মতো অনেকেই তোমাদের মতো তরুণদের ব্যায়ামচর্চা দেখতে ওখানে প্রায়ই গিয়ে থাকেন। আমি কিন্তু আমার একটা মস্তবড় প্রয়োজনেই তোমাকে চিনে নিয়েছি। শুধু চিনেই নিইনি, সবক’টি ছেলের মধ্যে তোমাকেই বেছে নিয়েছি, আমার প্রয়োজন সিদ্ধ হওয়ার উপকরণ হিসেবে। কিন্তু যাক এখন ওসব কথা। তোমার মনটা ভালো নেই বলে আমার মনে হচ্ছে। তৃতীয় স্থান অধিকার করেছ বলে তুমি মনে-মনে খুবই দুঃখ পেয়েছ, এ-কথা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু অতনু, তোমার খেলা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যদি বিচারক হতাম, তাহলে এই ব্যায়াম প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে তুমিই প্রথম হতে। প্রতিযোগিতায় যারা নাম দিয়েছিল, সকলের ভেতর তুমিই সবচেয়ে সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান, সুদেহী।
এই অপরিচিত বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির আন্তরিকতায়, সহানুভূতিপূর্ণ কথাবার্তায় অভিভূত অতনুর চোখের পাতা ভিজে উঠল। কয়েকমিনিট নিজের আবেগ দমন করার জন্য ও কোনও কথা বলতে পারল না।
বুড়োমানুষটি তীক্ষ্ন চোখে ওর ভাবান্তর লক্ষ করতে-করতে আবার বলতে লাগলেন, আমি তোমাকে চিনি, অতনু। পৃথিবীতে আপনজন বলতে তোমার কেউ নেই। তুমি মহেশপুর থেকে এখানে এসে তোমার দূরসম্পর্কের জ্যাঠামশায়ের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করছ। লেখাপড়া আর শরীরচর্চা ছাড়া আর কোনওদিকেই তোমার মন নেই। তোমার ওই জ্যাঠামশায়ের স্ত্রীটি তোমাকে মোটেই পছন্দ করেন না, সে-খবরও আমি রাখি। তোমার মা-বাবা মারা গেছেন মহেশপুরেই। তোমার সম্পর্কে এসব কথা জানার পর, তোমার মতো দরিদ্র অথচ সুদর্শন স্বাস্থ্যবান ছেলের দুঃখ-দুর্দশা দেখে আমি ভয়ানক বিচলিত হয়ে পড়েছি।
অতনু ক্রমশই বিহ্বল হয়ে পড়ছিল! বিমূঢ়ের মতো প্রশ্ন করল, কিন্তু…কেন আপনি—।
এখানে এই রাস্তার দাঁড়িয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার একেবারেই ইচ্ছে করছে না। দেখতেই তো পাচ্ছ আমার শরীরের অবস্থা! বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেও আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। তুমি বরং আমার সঙ্গে এসো।
অত্যন্ত দামি পোশাক পরা ক্ষীণ, খর্বকায়, কুৎসিত চেহারার মানুষটির কথাবার্তায় কী ছিল, অতনু প্রতিবাদ করতে পারল না। সম্মোহিতের মতোই ওঁর পিছন-পিছন চলতে লাগল। অন্ধকার গাছতলায় একখানা খুব দামি নতুন গাড়ি পার্ক করা ছিল। বুড়ো অতনুর হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভারকে পার্ক স্ট্রিটের একটা বিখ্যাত হোটেলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
বুড়োমানুষটি বলতে লাগলেন, সত্যি কথা বলতে কী, তোমার আর আমার জীবনে একদিক দিয়ে আশ্চর্য রকম বিপরীত মিল আছে। আর সেই কারণটার জন্যেই আমি তোমার ওপর ভয়ঙ্কর আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। তুমি বি-এ পরীক্ষা দিয়েছ। প্রতিযোগিতাও শেষ হয়ে গেছে। এইবার আমি আমার একটা অপূর্ণ সাধ পূর্ণ করার সুযোগ পাব।
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝবে। বোঝাব বলেই হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তোমার খুব খিদে পেয়েছে। দুজনে বসে একটু চা খেতে-খেতে সব কথা খুলে বলব। না, না, লজ্জা পাচ্ছ কেন, অতনু? তোমার মতো একজন স্বাস্থ্যবান ইয়াংম্যানের খিদে পাওয়াটা মোটেই লজ্জার ব্যাপার নয়। ওই যে হোটেল এসে গেছে।
হোটেলে ঢুকে যেন দিশেহারা হয়ে গেল অতনু। সে একেবারে গ্রামের ছেলে। বছর দুয়েক মাত্র কলকাতায় এসেছে। বয়কে ডেকে বুড়ো যে-সমস্ত দামি-দামি খাবারের অর্ডার দিলেন, অত্যন্ত দরিদ্র প্রাইমারি স্কুলমাস্টারের ছেলে অতনু সে-সমস্ত খাবার খাওয়া দূরে থাক, নামও শোনেনি কখনও।
সমস্ত খাবারগুলো শুধু অতনুর জন্য। নিজের জন্য দু-চামচ স্যুপ ছাড়া উনি আর কিছুই নিলেন না।
অতনু প্রথমে সংকুচিতভাবে ‘না, না—এত খেতে পারব না,’ ইত্যাদি দু-চারবার প্রতিবাদ জানালেও খেতে শুরু করল। আর শুরু করার পর সেসব কথা ভুলে গেল। সুস্বাদু আহার্যগুলো দেখতে-দেখতে ওর প্লেট থেকে নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগল।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি স্যুপ খেতে-খেতে অতনুর খাওয়া দেখছিলেন। অতনু লক্ষ করল, বৃদ্ধের মুখের রেখাগুলো কী বিশ্রীভাবে কোঁচকানো। মাথার চুল একেবারে সাদা। চোখের চামড়া ঝুলে পড়ে চোখ দুটোকে খুব ছোট্ট দেখাচ্ছে। কিন্তু তারই মধ্যে ওঁর দৃষ্টি ঠিক যেন সাপের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। নকল দাঁতের পাটির ওপর, শুকনো কালো ঠোঁটের ওপর, লোভীর মতন উনি ওঁর জিভ বুলোচ্ছেন। আর অতনুর খাওয়া দেখছেন।
অতনু ওঁর স্যুপের বাটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি তো কিছুই খেলেন না?
ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, তোমার বয়েস কত? উনিশ-কুড়ি নয় কি? আর আমার সত্তর পেরিয়ে গেছে। ইচ্ছে থাকলেও লোভ থাকলেও কিছু খেতে পারি না। তোমার এখন খাওয়ার বয়েস। তুমি ভালো করে খাও।
লজ্জা-সঙ্কোচ কমে গিয়ে অতনু স্বাভাবিক সহজ হয়ে উঠছিল। এবার সরলভাবে জিগ্যেস করল, আপনি আমাকে কী বলবেন বলছিলেন?
হ্যাঁ, এইবার বলব। তার আগে আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম হয়তো তুমি শুনে থাকবে। ডক্টর নবকিশোর সরখেল।
আপনিই তাহলে সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর নবকিশোর সরখেল!—সুগভীর বিস্ময়ে অতনু যেন কয়েক মুহূর্ত আর কোনও কথা খুঁজে পেল না।
বিখ্যাত কি না জানি না, তবে একেবারে অখ্যাত নই।—এক অদ্ভুত হাসি দেখা দিল বৃদ্ধের রেখাসংকুল মুখে : কিন্তু এই খ্যাতি-যশ-অর্থ-প্রতিপত্তি আয়ত্ত করতে গিয়ে আমার সমস্ত জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে। তুমি যখন ভূমিষ্ঠ হওনি, তারও অনেক বছর আগে আমি বিজ্ঞান-কলেজে গবেষক ছিলাম। তারপর বহু দেশ ঘুরেছি। মিশর, পারস্য, আমেরিকা, জার্মানি, রাশিয়া—আরও নানা দেশ। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এমন সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছি, যা তুমি আর্টসের ছাত্র, কিছুই বুঝতে পারবে না। তবে তুমি এইটুকু জেনে রেখো, আমার সমস্ত জীবনটা বিজ্ঞান-সাধনাতেই কেটেছে।
একসঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে বৃদ্ধ হাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একটু জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে আবার বলতে লাগলেন, তোমাকে আগেই বলেছি, তোমার আর আমার জীবনে কতকগুলো অদ্ভুত বিপরীত মিল আছে। সংসারে আপন বলতে তোমার কেউ নেই। টাকাপয়সার অভাবে তুমি কষ্ট পাচ্ছ। আমার অবস্থা একেবারে উলটো। অবশ্য, আপনজন বলতে এই পৃথিবীতে আমারও কেউ কোথাও নেই। আমি একা মানুষ। অথচ প্রচুর টাকাকড়ি-গাড়ি-বাড়ি-অগাধ সম্পত্তির মালিক আমি। আমার অবর্তমানে আমার এই বিষয়-সম্পত্তি কাকে যে দিয়ে যাব, সেই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। তুমি হয়তো বলতে পারো, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি, হাসপাতাল এগুলো তো আছে, কিন্তু অতনু, আমার সারা জীবনের রক্ত-জল-করা পরিশ্রমের এই অর্থসম্পদ আমি ওখানে দিতে চাই না। আমি দত্তক নিতে চাই।
দত্তক? মানে পোষ্যপুত্র?—অতনু বুঝেও যেন ওঁর কথা বুঝতে পারল না কিন্তু এ-কথা আমাকে বলছেন কেন? ইচ্ছে করলেই আপনি এ জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। অনাথ আশ্রমে খোঁজ নিতে পারেন। অথবা হাসপাতালের শিশু-বিভাগে—।
তুমি একেবারে ছেলেমানুষ, অতনু।—ডক্টর সরখেল হেসে উঠলেন : এই বাহাত্তর বছর বয়েসে আমি একটা কচি বাচ্চা পুষ্যি নিয়ে তাকে মানুষ করব, এমন সময় আমার কোথায়! আর ক’দিনই-বা বাঁচব? তোমাকে দেখার পর আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে, যদি তোমার অমত না থাকে তাহলে তোমাকেই আমি পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করব। আপত্তি করার মতো কোনও অভিভাবকও তোমার নেই, এ-কথা জেনেই তোমার কাছে এই প্রস্তাব করছি। আমার গাড়ি-বাড়ি-ব্যাঙ্কের অগাধ টাকাপয়সার মালিক হবে একমাত্র তুমি।
আবেগে, উত্তেজনায় ডক্টর সরখেলের কণ্ঠস্বর আরও বিকৃত ও জড়ানো হয়ে উঠেছিল। কথা শেষ করেই উনি অতনুর বাঁ-হাতখানা মিনতিভরে জড়িয়ে ধরলেন।
অতনুর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।
সে কি জেগে? না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে?
ভিখিরি থেকে এ যে রাজা হওয়া! বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর নবকিশোর সরখেল তাকে দত্তক নেবেন! এতবড় একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা তার জীবনে সম্ভব হবে?
এই চিন্তাধারার সঙ্গে-সঙ্গেই হঠাৎ আরও একটা সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনা বিদ্যুৎচমকের মতো ওর মস্তিষ্কের কোষে-কোষে ঝলসে উঠল।
শহরের আদবকায়দা, জটিল জীবনধারায় ও অভ্যস্ত নয়। অনেক কুটিল ষড়যন্ত্র, অনেক শয়তানের ফাঁদ পাতা আছে এই কলকাতা শহরে। নির্বোধ গ্রাম্য অতনু শেষ পর্যন্ত এইরকম একটা ভয়ঙ্কর ফাঁদের জটিল জালে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে না কি?
ডক্টর নবকিশোর সরখেলের মতো স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ইচ্ছে করলেই তো অতনুর চেয়ে শতগুণে ভালো অনেক ছেলেকেই পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন? কিন্তু তাঁর অগাধ সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে উনি সহায়-সম্বলহীন অনাথ অতনুকেই বা মনোনীত করলেন কেন?
আমি জানি, তুমি কী ভাবছ।
তীক্ষ্ন সর্পচক্ষুর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে অতনুকে বিদ্ধ করলেন ডক্টর সরখেল। ওর মনের প্রতিটি কথা তিনি যেন পড়ে ফেলেছিলেন।
অতনু, ইচ্ছে করলেই আমি অনেক বড়লোকের ছেলেকেই, ভালো জুয়েল রত্নকেই সন্তান হিসেবে পেতে পারি। সত্যি কথা বলতে কী খুঁজেছিও অনেক। কিন্তু তোমার মতো পবিত্র, সরল-স্বভাব, অসহায় কোনও লোককেই আমি পাইনি। তোমার সুন্দর চেহারা, অদ্ভুত স্বাস্থ্য, বয়েস—সব মিলিয়ে আমি যা চেয়েছিলাম ঠিক-ঠিক মিলে গেছে। আমাকে যে বাবার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করবে, যে আমার বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করবে, যার সন্তান আমার বংশধারা বজায় রাখবে, তাকে বেছে নেওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে। যাক। তোমাকে আমি তিনদিন সময় দিচ্ছি এ-বিষয়ে একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্যে। যদি আমার প্রস্তাব সম্বন্ধে তোমার বিন্দুমাত্রও আপত্তি থাকে, তাহলে তুমি আজকের, আমার সঙ্গে তোমার এই দেখা-সাক্ষাতের ঘটনাটা, কথাবার্তা সবকিছু মন থেকে মুছে ফেলে দিয়ো। আর আমার একান্ত অনুরোধ, আমার এই প্রস্তাবের কথা তুমি দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির কাছে প্রকাশ কোরো না। আর যদি আমার প্রস্তাবে তোমার আপত্তি না থাকে, তাহলে তুমি আমার এই কার্ডটা রাখো। তিনদিন ভালো-মন্দ, তোমার বর্তমান-ভবিষ্যত, সবকিছু চিন্তা করে এই ঠিকানায় তুমি আমার সঙ্গে দেখা কোরো।
ডক্টর সরখেলের ইশারায় বয় বিল নিয়ে এসে দাঁড়াল। অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে তিনি তাঁর পেট-মোটা মানিব্যাগ থেকে খানকয়েক দশটাকার নোট তার টের ওপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে বিভ্রান্ত বিচলিত অতনুও উঠে পড়ল।
তিনদিনও পুরো কাটল না।
এক প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে অতনু যেন আত্মসর্ম্পণ করতে বাধ্য হল। তার জীবনের এই অতি বিচিত্র অবিশ্বাস্য ঘটনা সম্বন্ধে চিন্তা করতে-করতে, দুর্নিবার লোভ-উচ্চাশা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে লড়াই করতে-করতে ও সহজেই পরাজিত হয়ে পড়ল।
তারপর দুটো দিন কোনওক্রমে কাটিয়ে ডক্টর সরখেলের দেওয়া সেই কার্ডখানার ঠিকানা খুঁজে-খুঁজে ডায়মন্ড হারবার রোডের অতি নির্জন, বিরাট, প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, নিস্তব্ধ, অতি সুদৃশ্য বাড়িটার গেটের কাছে এসে উপস্থিত হল।
বাড়িটা ভালো করে দেখে একেবারে মোহিত হয়ে গেল অতনু।
আগাগোড়া মার্বেল পাথরের আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি। টেনিস লন, পাথরের মূর্তি, দুষ্প্রাপ্য অর্কিড, বটল পাম, হিমালয়ান ফার্ন, ফোয়ারা, আউটহাউস, গ্যারাজ—যেখানে যেটি প্রয়োজন, সব কিছু দিয়ে বাড়িটা সাজানো।
এমন একটি অপূর্ব রম্য প্রাসাদের মতো বাড়িতে ডক্টর সরখেল একা বাস করেন! আর সে? মধু মিস্ত্রি লেনের একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘুপসি ঘর—ছেঁড়া ময়লা তোশক-বালিশ-চাদর!
সহসা মাটি ফুঁড়ে উঠে আসার মতো একটা গুণ্ডা চেহারার শেয়ালমুখো লোক তার সামনে এসে দাঁড়াল। ও কোনও কথা বলার আগেই বলে উঠল, আসুন, আপনিই তো অতনু সেন। ডক্টর সরখেল আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছেন।
অতনুকে দেখে ডক্টর সরখেল মোটেই বিস্মিত হলেন না। তিনি সুনিশ্চিত ছিলেন, ওকে আসতেই হবে। সাদরে ওকে নিয়ে তাঁর নিজের সুদৃশ্য বিলাসবহুল ঘরে বসালেন। নানারকম সুখাদ্য খাওয়ালেন। তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বিরাট বাড়িটা দেখালেন। আলমারি খুলে তাঁর প্রচুর বিত্তের নমুনা—কোম্পানির কাগজ, শেয়ার, থাকে-থাকে সাজানো নোট ইত্যাদি অনেক কিছু দেখালেন। আর অনেক কিছু বোঝালেনও।
তারপর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে করুণ কণ্ঠে বললেন, এইবার বুঝতে পেরেছ তো, আমি কেন দত্তক নিতে চাই? আমার এই সম্পত্তি আমার মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে পরহস্তগত হয়ে যাবে, আমি তা চাই না।
আমি রাজি—আমি রাজি।—অতনুর অবস্থা তখন একটা পরাজিত বিধ্বস্ত সৈনিকের মতো। জালে-পড়া মাছের মতো।
কোনও আপত্তি কোনওরকম দ্বিধা নেই তো তোমার?
না-না—একেবারেই না।—অতনু নেশাচ্ছন্নের মতো জবাব দিল।
আমি উইল করে সমস্ত সম্পত্তি তোমার নামে লিখে দেব। আমার সবকিছু তুমি পাবে। আমার নাম, উপাধি। তুমি শুধু ভোগ করে যাবে। পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর জিনিস তুমি ইচ্ছেমতো ভোগ করবে। সুন্দরী যুবতী স্ত্রীলোক, দামী সুরা—যা মন চায়, তুমি প্রাণপণে ভোগ করবে। ভোগ উপভোগই হবে তোমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। সারাজীবন আমি যা ভুল করেছি, তুমি সে-ভুল সংশোধন করবে দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে।
ডক্টর সরখেলের চোখ দুটো তীব্র উত্তেজনায় জ্বলতে লাগল।
বৃদ্ধের এই উত্তেজনা দেখে বিস্মিত হল অতনু।
তুমি কি আমার এখানে আসার কথা বাড়ির কাউকে বলে এসেছ?
আজ্ঞে না। আপনি বারণ করেছিলেন, আর তা ছাড়া কাকেই বা বলে আসব, বলুন?
বেশ করেছ। এবার আমার সঙ্গে এসো। তুমি দেখেছ, এ-বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ড্রাইভার, বাটলার আর কেয়ারটেকার সবাই বাইরের ওই আউটহাউসে থাকে। আমি টেলিফোনে ডাকলে তবেই তারা আমার এখানে আসবে। তারা প্রচুর টাকা মাইনে পায়। ঠিক সময়ে আসে, যে যার কাজ করে চলে যায়। তোমাকে এসব কথা বলছি, কেননা, আমার অবর্তমানে তুমিই ওদের কর্তা হবে। মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যেই তুমি ওদের মালিক হয়ে যাবে।
মাত্র কয়েকঘণ্টা মানে?—রুদ্ধশ্বাস কৌতূহলে অতনু ওঁকে প্রশ্ন করল।
আমি আর দেরি করতে চাই না। এসো আমার ল্যাবরেটারিতে। দেখে যাও, আমি সমস্ত কাগজপত্র রেডি করে রেখেছি। এমনকী উইলও, যে-উইলে তুমি আমার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হবে। লেখাপড়ার কাজটা শুধু বাকি আছে। সে-কাজ আমি কালকের মধ্যেই শেষ করে ফেলব।
আলাদিনের প্রদীপ হাতে পাওয়ার মতো বিমূঢ়, বিহ্বল অবস্থায় অতনু ডক্টর সরখেলের সঙ্গে ওঁর ল্যাবরেটারিতে ঢুকল, চারিদিকে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে গেল ও। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য নানারকম যন্ত্রপাতি, টেস্টটিউব ইত্যাদি দিয়ে বিরাট ঘরখানা সুষ্ঠুভাবে সাজানো।
কিন্তু ঘরখানা কী ঠান্ডা!
হঠাৎ অতনুর মনে হল, ও যেন একটা লাশকাটা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। এক সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে ও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। এই মুহূর্তে এই ল্যাবরেটারি থেকে, ডক্টর সরখেলের সান্নিধ্য থেকে, এই বাড়ি থেকে পালিয়ে না গেলে তার সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।
কতকগুলো কাচের শিশি-বোতল, ওষুধপত্র, নিয়ে ডক্টর সরখেল পিছন ফিরে কী যেন নাড়াচাড়া করছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, তুমি কি ভয় পেয়েছ, অতনু? পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছ?
অন্যমনস্ক অতনু ভয়ঙ্করভাবে চমকে উঠল।
লোকটা কি অন্তর্যামী? অতনুর মনের কথা কেমন করে জানতে পারল? আশ্চর্য ব্যাপার তো! কিন্তু ওই বুড়োমানুষটাকে ও ভয় করবে কেন? তার মতো একটা কুড়ি বছরের শক্তিমান যুবকের হাতের এক ঠেলাতেই ওই রুগ্ন জরাগ্রস্ত বুড়ো উলটে পড়ে মরে যাবে।
তাড়াতাড়ি ও বলে উঠল, ভয় পাব কেন? আর পালাবই বা কেন? আপনি তো আমাকে ডেকেও আনেননি, জোর করে ধরেও রাখেননি। আমি আপনার কাছে নিজের থেকেই এসেছি।
স্বাভাবিক বুদ্ধি ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে অতনু একখানা চেয়ারে বসে পড়ল নিশ্চিন্ত মনে।
ডক্টর সরখেল এবার ওর মুখোমুখি চেয়ারখানায় বসে পড়লেন। তাঁর হাতে ধরা দুটি কাচের গ্লাস। নীল রঙের তরল পদার্থ ভরা। অতনুর মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা-কাঁপা ভাঙা গলায় তিনি বললেন, অতনু, আমার দত্তক পুত্র হতে যদি তোমার কোনও আপত্তি না থাকে, তাহলে এসো, আমরা দুজনে দুজনের স্বাস্থ্য পান করি।
এটা কি কোনও ওষুধ?—অতনু ইতস্তত করে প্রশ্ন করল।
না, না, ভয় পেয়ো না। এটা কোনও খারাপ জিনিস নয়। আমার সারা জীবনের সাধনার ফলও বলতে পারো। এই ওষুধটি স্নায়ুমণ্ডলীর ওপর অসাধারণ ক্রিয়া করে। নার্ভ-সেল ও মেরুদণ্ডের সূক্ষ্মতম অংশে এর অতি চমৎকার। এই ওষুধ আবিষ্কার করে নানা জীবজন্তুর ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে আমি সফল হয়েছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, অতনু, তোমার কোনও ক্ষতি আমি করব না।
একটি গ্লাস তুলে তিনি নিজে চুমুক দিলেন, অন্যটি একেবারে অতনুর মুখের কাছে তুলে ধরলেন। বাধ্য হয়েই—কতকটা নিরুপায় হয়েই—অতনু সেই তরল পদার্থে ঠোঁট ছোঁয়াল। চুমুক দিল। অপূর্ব স্বাদ।
একবার—দুবার—তিনবার।
অতনু বুঝতে পারল, ওষুধের ক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বুঝতে পারল, তার পায়ের আঙুল থেকে শুরু করে মাথার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত সমস্ত শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরার মধ্যে এক প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। শুধু শরীরের মধ্যেই নয়, অতনু তার মস্তিষ্কের মধ্যেও যেন এক উন্মত্ত রক্তস্রোতের তাণ্ডব অনুভব করল। তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে অবিশ্বাস্য একটা কিছু পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়েছে, এ-কথাও টের পেল ও। ক্রমশ এক আচ্ছন্নকারী সর্বনাশা মাদকতা যেন ওকে ধীরে-ধীরে অচেতন করে দিতে লাগল।
অতনু ঠোঁট ফাঁক করল, প্রাণপণ চেষ্টায় কিছু বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু ওর জিভ অসাড়। শুধু জিভটাই বা কেন? অবশ অসাড় ওর সুগঠিত শক্তিমান শরীরের ওপর ওর আর কোনও কর্তৃত্বই ছিল না। ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ডক্টর সরখেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
যতটুকু অনুভব শক্তি তখনও ছিল, তাতেই ও চেয়ে-চেয়ে দেখল, ডক্টর সরখেলের চোখে সেই ক্রুর বিষধর সাপের হিমশীতল দৃষ্টি। শাণিত ছুরিকার মতো নির্মম অনুসন্ধিৎসু চোখে তিনি যেন অতনুর সর্বশরীর চিরে-চিরে কেটে কী যেন লক্ষ করছেন।
শুকনো কালো ঠোটের ওপর জিভ বুলিয়ে খসখসে কর্কশ গলায় উনি আত্মগতভাবে বললেন, চমৎকার।
একটু থেমে, অতনুর শরীরের অবস্থা আরও ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে যেন একটা খরগোশ অথবা গিনিপিগের ওপর কোনও এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছেন, এমনভাবে উনি আবার বললেন, খুব চমৎকার! অতনু, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তুমি—একমাত্র তুমিই আমার সমস্ত কিছুর একছত্র অধীশ্বর হয়ে সবকিছু ভোগ করবে।
অতনুর মাথার ভেতর তখন উত্তাল তরঙ্গময় সমুদ্রের অশান্ত গর্জন। অতি ক্ষীণ, অবশিষ্ট চেতনাটুকুও হারিয়ে ও যেন এখনই সম্পূর্ণভাবে অচেতন হয়ে পড়বে, এমনই ওর অবস্থা। ও যেন ধীরে-ধীরে সব ভুলে যাচ্ছে। ওর নামধাম, পরিচয়, ওর সত্তা। সমস্ত পৃথিবীটাই যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
লোলচর্ম, শীর্ণদেহ, বিকৃতদর্শন, খর্বকায়, কুটিল, সর্পচক্ষু ডক্টর সরখেল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
তোমার এখন বিশ্রামের দরকার, এসো আমার সঙ্গে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে।
নেশাচ্ছন্ন, আত্মরক্ষায় অক্ষম অতনুর হাত ধরে তিনি ল্যাবরেটারি থেকে নিয়ে এলেন তাঁর শোওয়ার ঘরের মধ্যে। ওষুধের মারাত্মক প্রতিক্রিয়ায় প্রায় চেতনাহীন দেহটাকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
সারাটা দিন কীভাবে কেটে গেছে, অতনুর কোনও হুঁশ ছিল না। রাতের দিকে মাঝে-মাঝে সচেতন হচ্ছিল অতনু। এক বিচিত্র দুর্বোধ্য অনুভূতি ওর সমস্ত সত্তায় সঞ্চারিত হচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল, ও যেন অতনু সেন নয়, অন্য কেউ। মনে হচ্ছিল, এতদিন ধরে ও দেহচর্চা করেনি, শুধু বিজ্ঞানচর্চাই করে এসেছে। ওকে যেন বেশ কয়েকটা জরুরি এক্সপেরিমেন্টের কাজ করতে হবে। আবার মনে হল, ও যেন কোথায় বেড়াতে গেছে। কোনও এক সবুজ উপত্যকায়। সেখানে শ্বেতমর্মরের এক বিরাট রহস্যময় প্রাসাদে ও ঢুকে পড়েছে পথ ভুলে। বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
পাগলের মতো ও সেই প্রাসাদের মধ্যে ছুটোছুটি শুরু করল। বন্ধ দরজায় আঘাত করতে লাগল।
কিন্তু দরজা খুলল না। ভয়ে আতঙ্কে ও অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
আবার দেখল, একটা শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ থেকে স্লাইড ছাড়িয়ে ও দেখছে। একটা কাচের আধারে নীল তরল পদার্থ। চারিদিকে ধুলো-ময়লা, মাটির পুরোনো পাত্র, সীসের পাত্র, আবার অন্ধকার—ঘন গাঢ় অন্ধকার। আবার মস্তিষ্কের কোষে বিদ্যুৎচমক।
অতনু এক বিরাট সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ফাইল, কাগজপত্র। ও লেকচার দিচ্ছে।
গ্রহ-নক্ষত্র, নানারকম জীবজন্তু, ছুরি, সাপ—নানারকম ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখতে-দেখতে একসময় অতনুর আচ্ছন্ন, ঘোর ভাবটা তরল হয়ে এল।
অতিকষ্টে ভারী চোখের পাতা খুলল অতনু।
সমস্ত শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, তীব্র ব্যথা। সমস্ত শরীরের চামড়াগুলো কেমন যেন ঢিলে-ঢিলে ঝলঝলে। ঘরটা প্রায়ান্ধকার। সব কিছুই অচেনা অপরিচিত। সব কিছুই যেন অস্পষ্ট….ঝাপসা-ঝাপসা…..!
কিন্তু সেই জটিল অবস্থার মধ্যেও অতনু বুঝতে পারল, ও সেই মধু মিস্ত্রি লেনের একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরখানার মধ্যে নোংরা তেলচিটে বিছানায় শুয়ে নেই।
ওর চারিদিকে দামি নেটের মশারি টাঙানো। ডানলোপিলোর নরম গদির ওপর নরম বালিশ-বিছানায় ও শুয়ে আছে!
কিন্তু ওর শরীরটা—দিব্যকান্তিময় সতেজ শ্যামল সুদীর্ঘ দেবদারুর মতো দেহটা এমন দুর্বল, বিশ্রীরকমের টলমলে মনে হচ্ছে কেন!
গ্যাস বেরিয়ে যাওয়া চোপসানো বেলুনের মতো শরীরটাকে কোনওমতে টেনে হিঁচড়ে ও বিছানার ওপর উঠে বসল। ভোরের আলো আসছে জানলা দিয়ে। একটা নড়বড়ে রোগজীর্ণ দুর্বল মানুষের মতো ও মশারিটা সরিয়ে খাট থেকে নেমেই ভীষণভাবে চমকে উঠল।
কী সুন্দর! কী বিলাসবহুল আরামদায়ক একটা মস্তবড় শয়নকক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ও! দামি-দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো এমন ঘর ও জীবনেও চোখে দেখেনি, থাকা-শোওয়া তো দূরের কথা!
তবে কি সত্যি-সত্যিই ডক্টর সরখেল দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে অতনুকে তাঁর বাড়িতেই রেখেছেন? তাঁর বিপুল ঐশ্বর্যের, গাড়ি-বাড়ি সবকিছুর মালিক কি তবে অতনুই?
কিন্তু তিনি কোথায়?
ডক্টর সরখেল, আপনি কোথায়? ডক্টর সরখেল—।
যতটা শক্তি শরীরে অবশিষ্ট ছিল, সবটুকু কণ্ঠস্বরে উজাড় করে দিয়ে অতনু চিৎকার করে উঠল।
কিন্তু ওর সেই কণ্ঠস্বর নিজের কানে প্রতিধ্বনিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ভয়ে, আতঙ্কে অতনুর যেন শ্বাসরোধ হয়ে এল।
এ কার কণ্ঠস্বর! এ কার কণ্ঠস্বর শুনছে অতনু!
জিহ্বার জড়তায়, ভাঙা ফ্যাঁসফেঁসে কর্কশ উচ্চারণে, দন্তহীন গালের গহ্বর থেকে এ কার কথা বেরিয়ে এল?
আমি কে? আমি কে—?
বিভ্রান্ত, ভূতগ্রস্তের মতো অতনু শ্লথ কম্পিত পায়ে ঘরের দামি ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। আয়নার ভেতর ফুটে-ওঠা প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে ও বজ্রাহতের মতো স্তম্ভিত, জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল।
ওর আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে, আয়নায় প্রতিবিম্বিত যাকে ও দেখতে পেল, সে সত্তর পার হওয়া লোলচর্ম, বার্ধক্য-কবলিত, জরাগ্রস্ত, জীর্ণ-শীর্ণ, খর্বকায় ডক্টর নবকিশোর সরখেল ছাড়া আর কেউ নয়।
একি স্বপ্ন! না সত্যি!
পাগলের মতো অতনু নিজের মাথার পাকা চুলগুলো টানতে লাগল। ঝুলে পড়া শিথিল চামড়ায় হাত বুলোল। হাঁ করে দন্তহীন মাড়ি, তোবড়ানো গাল, শুকনো কালো ঠোঁট দেখল।
না। সেই সুদর্শন ব্যায়ামবীর কুড়ি বছরের শক্তিমান তরুণ যুবক অতনু নয়। ও এখন কুৎসিত, বীভৎস-দর্শন, খর্বকায়, জরাগ্রস্ত। ও এখন ডক্টর নবকিশোর সরখেল।
থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে অতনু হতাশায়, নৈরাশ্যে, অবসাদে, বিছানার ওপর বসে পড়ল।
এতক্ষণে অতনু সব বুঝতে পারল।
এক উন্মাদ শক্তিশালী দানবের নিষ্ঠুর পৈশাচিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় অতনু ওর অনবদ্য তারুণ্য থেকে, উচ্ছল প্রাণচঞ্চল যৌবন থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
অতনুর সমস্ত জীবন, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভোগ করার অপরিসীম ক্ষমতা, এমনকী ওর অপরূপ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, দীর্ঘ যুবক-শরীরটাকে পর্যন্ত ওই শয়তান নরপিশাচ ডক্টর সরখেল নিয়ে নিয়েছে।
আর তার বদলে সেই কুৎসিত, জরাগ্রস্ত, স্থবির বৃদ্ধের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছে অতনুর আত্মা!
এই মর্মান্তিক উপলব্ধির মরণাধিক যন্ত্রণায় পাগলের মতো কাঁদতে লাগল অতনু। শয়তান! একটা রাক্ষস! দানব! কী শয়তানি মতলব নিয়েই না অতনুর কাছে গিয়েছিল! অতনুর অপরূপ ব্যায়ামপুষ্ট, কুড়ি বছরের যুবক-শরীর নিয়ে এখন থেকে ওই লোকটা সমাজে বিচরণ করবে। লোকে জানবে, ডক্টর নবকিশোর সরখেলের দত্তক পুত্র অতনু সরখেল তাঁরই উইলের বলে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হয়েছে। দু-হাতে টাকা খরচ করবে, ইচ্ছেমতো ভোগ করবে—যেমনটি বলেছিল ও অতনুকে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহও করবে না যে, অতনুর ছদ্মবেশে আসলে ওই লোকটাই ডক্টর সরখেল।
ক্রমশ এই চিন্তা অতনুর মস্তিষ্কে আগুন জ্বালিয়ে দিল। প্রাণপণে ও দরজায় আঘাত করতে লাগল।
সঙ্গে-সঙ্গে সেই ষণ্ডামার্কা শেয়ালমুখো ধূর্ত চেহারার লোকটা দরজা একটু ফাঁক করে নিরীহ গলায় প্রশ্ন করল, ডক্টর সরখেল, আমাকে কি আপনি ডাকছিলেন?
অতনুর কানের কাছে যেন বিস্ফোরণ ঘটাল লোকটা।
আগ্নেয়গিরির প্রচণ্ডতায় ফেটে পড়ল অতনু, আমি ডক্টর সরখেল নই। আমি অতনু সেন। তিন নম্বর মধু মিস্ত্রি লেনের অহিভূষণ সেনের ভাইপো আমি। ডক্টর সরখেল কোথায়? তারই জন্যে আমার শরীরের আজ এই অবস্থা। আমি পুলিশে খবর দেব—আমি সব্বাইকে বলে দেব তার এই শয়তানির কথা! আমি সেই শয়তান, চোর, ভণ্ড, বিজ্ঞানীটার মুখোশ খুলে দেব—পুলিশের কাছে সব খুলে বলব।
আপনার মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে, ডক্টর সরখেল।
শেয়ালমুখো ষণ্ডামার্কা গুণ্ডাটা ধূর্ত শেয়ালের হাসি হাসল অতনুর দিকে তাকিয়ে, পুলিশের চেয়েও আপনার এখন পাগলের ডাক্তারের প্রয়োজন অনেক বেশি। আমি সেই ডাক্তারবাবুকেই ডাকতে চললাম, ডক্টর সরখেল।
বাইরে থেকে দরজাটাকে ভালো করে লক করে দিয়ে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটা উন্মাদ মানুষের মতোই এবার অতনু তার বার্ধক্য-জীর্ণ, জরাগ্রস্ত শরীরটা নিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে, হাঁপাতে-হাঁপাতে ঘরের ভেতরকার যাবতীয় শৌখিন জিনিসপত্র ছুড়ে-ছুড়ে ফেলতে লাগল। দামি-দামি পোশাকগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করতে লাগল। তারপর একসময় ক্লান্তিতে, অবসাদে ধপ করে চেয়ারের ওপর বসে পড়ল।
কেন অতনু লোভ করতে গিয়েছিল?
শুধু লোভের বশেই ও আজ এই সাংঘাতিক ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনও উপায়ই নেই। ডক্টর সরখেল এক নম্বরের শয়তান। আর ওই শেয়ালমুখো ষণ্ডাটা তার অনুচর। দুজনের শলাপরামর্শের আজ অতনুর এই অবস্থা।
এইবার নিশ্চয় ওরা দুজনে মিলে অতনুকে বহু দূরদেশে কোনও পাগলাগারদে পাঠাবে। তারপর অতনুর শরীর আর ডক্টর সরখেলের শয়তানবুদ্ধি পরিপূর্ণ ব্রেন নিয়ে শয়তানটা এই শহরে, তার এই বাড়িতেই মনের সাধ মিটিয়ে ভোগ-সুখ করে যাবে। ওর সারা জীবনের অপূর্ণ সাধ-আহ্লাদ পূর্ণ করবে।
আর অতনু?
কুড়ি বছরের তরুণ মন নিয়ে আর বাহাত্তর বছরের জরা-ব্যাধিগ্রস্ত দেহ নিয়ে বিকৃতমস্তিষ্ক ডক্টর নবকিশোর সরখেল সেজে, তার পরিচয়ে, বাদবাকি জীবনটা কাটবে পাগলাগারদের বন্দি হিসেবে। কেউ বিশ্বাস করবে না ওর কোনও কথা। ওদের দেহের অবিশ্বাস্য এই পরিবর্তনের কথা।
তাহলে ও এখন কী করবে? ভাগ্যের হাতেই অসহায় নিশ্চেষ্টর মতো আত্মসর্ম্পণ করবে?
কিন্তু একবার শেষ চেষ্টা করতে দোষ কী!
অতনু প্রাণপণে নিজেকে সংযত রেখে উঠে দাঁড়াল। ঘরের ভেতর সবকিছু হাতড়ে-হাতড়ে খুঁজতে লাগল, যদি কোনও সূত্র মেলে। কোনও ওষুধ, কোনও ফরমুলা। ড্রয়ারগুলো হাঁটকাতে লাগল। রাশি-রাশি কাগজপত্র। কিছুই বুঝতে পারা যায় না। অতনুর সামান্য বিদ্যাবুদ্ধির বাইরে। ড্রেসিংটেবিলের একটা ড্রয়ারে কতকগুলো ওষুধের শিশি পাওয়া গেল। কিন্তু সেগুলো অতনুর কোনও কাজে লাগবে না। ডক্টর সরখেল এত বোকা নন যে, অতনুর আগের চেহারা ফিরে পাওয়ার মতো কোনও ওষুধ এ-ঘরে রেখে চলে যাবেন।
হঠাৎ একশিশি বড়ি ওর নজরে পড়ল। পয়জন! লেবেলের ওপর বড়-বড় অক্ষরে লেখা আছে। মারাত্মক ধরনের ঘুমের ওষুধ। ডক্টর সরখেলের বোধহয় রাত্রে ভালো ঘুম হত না। শোওয়ার আগে মাত্র একটা বড়ি খাওয়ার নির্দেশ আছে।
কাঁপা হাতে অতনু ঘুমের ওষুধের শিশিটা তুলে নিল। নাঃ, আর কিছুই ভাববার নেই। ওর নিয়তি ওকে ক্রমশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অমোঘ পরিণতির দিকে।
বেঁচে থেকে লাভ কিছু আছে কি?
এই বাড়ি-গাড়ি, টাকাপয়সা কিছুই তার নয়। ডক্টর সরখেল অর্থাৎ তারই উইলের বলে ওই শয়তানটাই এখন ওর দেহ নিয়ে সবকিছু ভোগ করবে। ওই ষণ্ডামার্কা শেয়ালমুখো ডক্টর সরখেলের অনুচরটা এখনই তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে এ-ঘরে আসবে। তারপর অতনুকে পাগল প্রমাণিত করে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে কোনও অ্যাসাইলামে বন্দি করে রাখতে ওদের মাত্র কয়েকঘণ্টা লাগবে।
যা কিছু করার তার আগেই করতে হবে।
হতে পারে ডক্টর সরখেল একজন মস্তবড় বিজ্ঞানী। আর অতনু সামান্য আর্টসের গ্র্যাজুয়েট। তবু অতনু মনে-প্রাণে অনুভব করতে পারছে, তার চেতনা, অনুভবশক্তি এখনও পরিষ্কার আছে। অতনু যদি ওর এই জীর্ণ দেহটার মৃত্যু ঘটায়, তাহলে কি ডক্টর সরখেলের কোনও ক্ষতিই হবে না?
নিশ্চয় হবে। কেননা, এখন ডক্টর সরখেল আর অতনুর দেহ-মন-প্রাণ একসূত্রে বাঁধা। তার নির্মম পরিণতিও এখন অতনুর হাতের মুঠোর মধ্যে—এই বিষের শিশিটার মধ্যে।
দৃঢ় সঙ্কল্পে মরিয়া অতনু টেবিলে এসে বসল। কাগজ-কলম টেনে নিয়ে তার চরম অভিজ্ঞতার কাহিনি লিখতে লাগল।
…জানি, আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না, তবু মৃত্যুর মুহূর্তে আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলে যাচ্ছি, আমি যা লিখছি তার প্রতিটি অক্ষর সত্যি। সত্যি। সত্যি।
বিশ্বাস করুন, আমি বিকৃতমস্তিষ্ক কি অপ্রকৃতিস্থ মানুষ নই। আমি পাগলও হইনি। আমার বোধশক্তি, অনুভূতি এতটুকুও লোপ পায়নি। যে-অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা আমি এই কয়েকঘণ্টা ভোগ করেছি, পৃথিবীর কোনও মানুষই তা কল্পনা করতে পারবে না। আমি যদি পাগল হতাম, তবে এই অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করতে পারতাম না। আর এই অচেনা, অপরিচিত, পরিবেশে অন্যের চেয়ার-টেবিলে বসে এই অবিশ্বাস্য, অবাস্তব, অকল্পনীয় কাহিনি লিখতেও পারতাম না।
সম্পূর্ণ অপরিচিত বিজ্ঞানী ডক্টর নবকিশোর সরখেলের শোওয়ার ঘরের মধ্যে আমি শ্রী অতনু সেন বন্দি হয়ে বসে আছি। মাত্র চারদিন আগে আমি নিখিল বঙ্গ ব্যায়াম প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান গ্রহণ করে তৃতীয় পুরস্কার লাভ করেছিলাম। তা ছাড়াও, সুদর্শন শক্তিমান শরীরের জন্যেও আমাকে বিশেষ একটা পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। আমার বয়স কুড়ি। আমি ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট।
আমার যৌবনদীপ্ত স্বাস্থ্যবান শরীরটা ডক্টর নবকিশোর সরখেল তার বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ কী একটা ওষুধের সাহায্যে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। তার জরাগ্রস্ত, বার্ধক্যে জীর্ণ শরীরটার মধ্যে আমি অতনু সেন, আমার আত্মা, সত্তা, চেতনা, অনুভব-শক্তি নিয়ে বন্দি হয়ে আছি, তারই শয়তানিতে। আর সেই শয়তানটা আমার সুস্থ, সুন্দর, কুড়ি বছরের যুবক-শরীরটা চুরি করে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন তার অধিকারে প্রচুর অর্থসম্পদ। সেই সম্পদের বিনিময়ে সে পৃথিবীর সবকিছু সুন্দর বস্তুকে করায়ত্ত করে ভোগ করবে।
আর আমি! একটা স্থবির, জরাগ্রস্ত, কুৎসিত চেহারার বুড়োর শরীরের মধ্যে আমার কুড়ি বছরের তরুণ মনকে বন্দি রেখে তিলে-তিলে মরে যাব। ওই শয়তানটা আমার রূপ, যৌবনশক্তি, পৌরুষ নিয়ে বহুকাল বেঁচে থাকবে। তারপর যখন ও অশক্ত, স্থবির হয়ে পড়বে, তখন আবার সেই সাংঘাতিক বৈজ্ঞানিক ওষুধটার সাহায্যে আমার মতো কোনও সরল, নির্বোধ তরুণকে এইভাবে ফাঁদে ফেলে তার যৌবন ও শক্তিমান দেহটাকে চুরি করবে, নিজের জরাজীর্ণ দেহটাকে বদলে নেবে।
এতবড় একটা পাপিষ্ঠ, শয়তান-নরপিশাচ বিজ্ঞানীর মুখোশ খুলে দিয়ে আমি আত্মহত্যা করছি। আমার মৃত্যুর জন্যে দায়ী, আমার চেহারা নিয়ে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই ডক্টর নবকিশোর সরখেল।
আর আমি লিখতে পারছি না। ক্লান্তিতে, অবসাদে আমার হাত অসাড় হয়ে আসছে। আমি সব ক’টি বড়ি খেলাম….এইবার বিছানায় শুতে যাচ্ছি…।
অতনু সেন
এই চিঠিখানা বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর নবকিশোর সরখেলের শোওয়ার ঘরের টেবিলে পাওয়া গিয়েছিল। পাওয়া যেত না, যদি এটা ডক্টর সরখেলের কোনও অনুচরের হাতে পড়ত। রাশিয়া থেকে একটা অত্যন্ত জরুরি টেলিগ্রাম আসায় বাধ্য হয়ে তাঁর শোওয়ার ঘরের বন্ধ দরজা ধাক্কাধাক্কি করে (বাইরে থেকেও লক করা ছিল) খোলা হয়, পিওনের সামনেই। ডক্টর সরখেলকে মৃত দেখে তৎক্ষণাৎ সে পুলিশে টেলিফোন করে। লোকজন এসে পড়ে। সেইজন্যই এই চিঠিখানা পুলিশ অফিসারের হাতে পড়ে।
চিঠির বক্তব্যের মাথামুন্ডু তিনি কিছুই বুঝতে না পেরে পুলিশ কমিশনারকে সব জানান। তিনি এই মৃত্যু-রহস্য ভেদ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি নিজেও বিশেষ কৌতূহলী হয়ে সক্রিয় সহযোগিতাও করেছিলেন।
কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং আশ্চর্যের আরও একটা ব্যাপার তখনও তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কুড়ি বছরের অতি সুশ্রী, সুদেহী, ব্যায়ামবীর শ্রীমান অতনু সেনকে মৃত অবস্থায় ডক্টর সরখেলের ল্যাবরেটারির মধ্যেই আবিষ্কার করা হয়। হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওর মৃত্যু হয়েছিল।
সবচেয়ে অলৌকিক এবং রহস্যময় ব্যাপার, ঠিক যে-সময় ডক্টর নবকিশোর সরখেল তাঁর শয়নকক্ষে বিষ খেয়ে মারা গিয়েছিলেন, পোস্টমর্টেম করার পর জানা যায় যে, অতনু সেনও ঠিক সেইসময়ে হার্টফেল করে মারা যায়। ওর মতো অমন অসীম শক্তিমান, স্বাস্থ্যবান যুবক, জীবনে যে নাকি কখনও কোনও রোগে ভোগেনি, কেমন করে বিনা কারণে তার হার্টের ক্রিয়া অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেল, ডাক্তাররা কিছুতেই তা ধরতে পারেননি।
সুতরাং, এই রহস্যময় অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা এক ঘন গাঢ় কুয়াশাময় অন্ধকারের মধ্যেই চিরদিনের জন্য অজানা হয়ে রইল সকলের কাছে।
শেষ সংকেত
নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯৭৩