যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল
রচনাকাল : প্রাকপূজা ’94
[শারদীয়া ‘প্রতিদিন’-এ 1994 এ প্রকাশিত]
পুস্তাকারে প্রকাশ : বইমেলা ’95
গ্রন্থক্রমিক : 98
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা : খালেদ চৌধুরী
প্রচ্ছদ-আলোকচিত্র : প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
অলঙ্করণ : সন্দীপন ভট্টাচার্য, অলকানন্দা সেনগুপ্ত
উৎসর্গ : তারাপ্রসাদ শিকদার এবং সুস্মিতা শিকদার, বাঁকুড়া
কৈফিয়ৎ
‘নাগচম্পা’র ট্রায়াল বলটিকে ‘এলেবেলে’ বলে ধরে নিলে এটি কাঁটা-সিরিজের ষোড়শতম কণ্টক! এই গোয়েন্দা গল্পগুলির গোমুখে কী আছে সে-কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। শরদিন্দুর অনুসরণে বলা যায় এগুলি : ‘হিন্দের বন্দী’!
ইতিপূর্বেই বলেছি, আবারও বলি : কাঁটা-সিরিজের আদালত হুবহু বাস্তবানুগ নয়। এ দেশে আদালতের কাজকর্ম যে বিলম্বিত হারে ‘ধীরে রজনী ধীরে’ মন্ত্রে চল, তাতে তার হুবহু বর্ণনা দিলে পাঠক তো বটেই, পাঠিকাও ঘুমিয়ে পড়বেন। তাই কাঁটা-সিরিজের আদালত কথাশিল্পের আঙিনায় বাস্তবের ছায়া-দিয়ে-গড়া গল্পের আদালত। এখানে হত্যা মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে না। এখানে খুনী আসামী কোন্ রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট মস্তান— সে প্রশ্নটাই ওঠে না। দু-চার দিনেই বিচারক মামলার ফয়সালা করে দেন। সারা পৃথিবীর আদালতে সাক্ষী দিতে উঠলে মঞ্চে একটা বসবার চেয়ার পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে সেটা পাওয়া যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাক্ষী দিতে হয়। বোধকরি জাতির জনক স্বাধীনতার প্রাক্কালে আমাদের অনাড়ম্বর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাতেই এই ব্যয়সঙ্কোচ। কাঁটা-সিরিজের কল্পিত আদালতে সাক্ষী একখানা বসবার চেয়ার পায়। এটাকে যদি আদালত অবমাননা বলে ধরে না নেওয়া হয়, তাহলে বলতে পারি : এ ব্যবস্থা কথাশিল্পীর একটি তির্যক সাজেশান — ভারতকে আর পাঁচটা সভ্যদেশের সমশ্রেণীতে উত্তরণের প্রয়াস।
কাহিনীতে দু-একটি প্লেন সন্ধ্যার পরে বাগডোগরায় ‘ল্যান্ড’ করেছে। এটাও কট্টর বাস্তবানুগ নয়। বাগডোগরা এয়ার-স্ট্রিপে জোরালো বাতির ব্যবস্থা এখনো হয়ে ওঠেনি- সন্ধ্যার পর সেখানে কোনও আকাশযান ওড়ে না বা নামে না। এটাও কাহিনীকারের সজ্ঞান বিচ্যুতি – গল্প-গোমাতার বৃক্ষারোহণ প্রয়াস বলে ধরে নিতে পারেন।
যাঁরা প্রুফ দেখছেন, কম্পোজ করছেন, প্রচ্ছদ এঁকেছেন, তাঁদের পরিচয় অন্যত্র দেওয়া হয়েছে। পাণ্ডুলিপি অবস্থায় কাহিনীটি পাঠ করে শ্রীমতী চিত্রা সান্যাল ও শ্রীমান প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত আমাকে কিছু মূল্যবান সাজেশান দিয়েছেন। তাতে তথ্যগত কিছু বিচ্যুতি সংশোধনের সুযোগ পেয়েছি। ওদের একটি আপত্তি কিন্তু আমি মানতে রাজি হইনি : গল্পের নামকরণ।
কাহিনীতে দু-দুটি ভাই-বোনের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই ভগ্নীর শুভকামনা ব্যর্থ হয়ে গেছে। যম দুয়ারে কাঁটা পড়েনি। তাহলে এ নামকরণের সার্থকতা কোথায়? সে-কথার জবাবদিহি করার আগে আমি কিন্তু একটা প্রতি প্রশ্ন তুলব :
‘ভাইফোঁটা’ দিনটির জন্য যে অনবদ্য গ্রাম্য ছড়াটি সর্বজনবিদিত সেটার ভাবমূলে প্রবেশের প্রচেষ্টা কখনও করেছেন? কোন্ বিস্মৃত অতীতে কোন এক অখ্যাত পল্লীপ্রান্তে ভাইটিকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তোলার শুভকামনায় যে অজ্ঞাত মহিলা কবি এই ছড়াটি রচনা করেছিলেন তিনি অপরিচিতা। সহজ-সরল গ্রাম্য ছড়ার ছন্দ। প্রথম দুটি পংক্তিতে নিতান্ত কাঁচা মিল— ‘ফোঁটার’ সঙ্গে কাঁটা’। পরের দুটি পংক্তিতে মিলের বালাইই নেই— মানে, ‘পুনরুক্তি দোষকে’ যদি ‘অস্তমিল’ বলে ধরে না নেন। কিন্তু ভাই সোহাগী বোনটির আন্তরিকতায় কোনও ঘাটতি ছিল না। থাকলে, শতাব্দীর পর শতাব্দী, বাঙলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে, লক্ষ লক্ষ বোন এটাকে ‘মন্ত্র’ বলে মেনে নিত না। দীপাবলীর দু-তিথি পাড়ি দিয়ে ভোর-ভোর শিশির সঞ্চয় করে, চন্দন বেটে, দূর্বা সংগ্রহ করে আর এ-ম্যা, একটুকরো গোবর কুড়িয়ে নিয়ে, তৈরী হত না। ফুলকাটা আসনে ভাই বা দাদাকে বসিয়ে দু-চোখ বুজে ভক্তিভরে তার কপালে অনামিকার মৃদু স্পর্শে ভ্রাতৃপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে বলতো না :
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা। / যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা।।
যমুনা দেয় যমের কপালে ফোঁটা। / আমি দিই আমার ভাইয়ের কপালে ফোঁটা।।
সহজ-সরল বিশ্বাসে উচ্চারিত কী অপূর্ব মন্ত্র। সংস্কৃত নয়, শাদা বাঙলায়। অবন ঠাকুর তাঁর ‘বাঙলার ব্রত’ পুস্তকে এই ব্রতের উল্লেখ করেননি। অথচ এটি লৌকিক ব্রতই। রবিঠাকুর তাঁর ‘ছড়া’ প্রবন্ধে এটির উল্লেখ করেননি। অথচ এটি গ্রাম্য ছড়াও বটে।
প্রথম দুটি পংক্তি পড়ে মনে হয় : মহিলা কবির ধ্যান-ধারণায় যমরাজ হচ্ছেন তাঁর ভাইয়ের শত্রুপক্ষ। যম যাতে ভাইয়ের ত্রি-সীমানায় না ভিড়তে পারে তাই তো ভাইয়ের কপালে ফোঁটা, তাই তো যমদুয়ারে কাঁটা দেওয়ার আয়োজন।
কিন্তু ঠিক তার পরের দুটি পংক্তি?
মহিলা কবির হঠাৎ মনে পড়ে গেল : আহা! যমেরও যে একটা চুন্নুমুন্নু বোন আছে : যমুনা আবাগী! ঘরে ঘরে সবাই ভাইকে ফোঁটা দেবে আর সেই ছোট্ট মেয়েটি ম্লানমুখে বসে থাকবে? না, তা হয় না! আয় ভাই যমুনা, তুইও তোর দাদার কপালে একটা ফোঁটা দে। দাদাকে ফোঁটার জোরে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তোল।
কিন্তু এটা কী হল?
যম যদি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়, তবে তার নিজের ভাই ‘নচিকেতা’র কী হাল হবে? বোকা মেয়েটা সে কথা একবারও ভেবে দেখল না!
কিংবা কে জানে হয়তো সেই গ্রাম্য মহিলা কবি নির্বোধ ছিলেন না আদৌ! এই মরণশীল দুনিয়ার অস্তিম সত্যটা সম্বন্ধে তিনি ঠিকমতোই অবহিত ছিলেন। তিনি শুধু কবি নন, তিনি দার্শনিক। জানতেন, বোনদের আন্তরিক শুভকামনা সত্ত্বেও ঐ শিশিরের ফোঁটা ক্রমে শুকিয়ে যাবে, চন্দনের ফোঁটাও রেণু রেণু হয়ে ঝরে পড়বে ভাইয়ের ফাটা কপাল থেকে। অথচ যমুনার ঐ ভাইটি মৃত্যুঞ্জয়ী— এ সত্যটা অনস্বীকার্য! উপায় নেই! তা হোক, বৎসরান্তে ফিরে ফিরে ভগ্নীর ঐ আন্তরিক শুভকামনার মন্ত্রোচ্চারণও মৃত্যুঞ্জয়ী— যুগ থেকে যুগে, কাল থেকে কালে!
তাই যমের বোন যমুনার সঙ্গে সহাবস্থানে, যমুনার সঙ্গে ‘গঙ্গাজল’ পাতাতে সেই নচিকেতার দিদির কোনও আপত্তি নেই।
আর তাই যদি সত্য হয়, তাহলে কে-আমি ইরিদাস পাল যে, নামকরণের জন্য বেহুদ্দো কৈফিয়ৎ দেবার চেষ্টা করব?
নারায়ণ সান্যাল
4.9.94