যমালয়ের ফেরতা মানুষ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ
সে
খ নসিরুদ্দিন এখন ভবানীপুরের একজন মধ্যবিত্ত প্রজা। গত তিন বৎসর হইতে কন্ট্রাক্টের কর্ম করিয়া, যেমন করিয়া হউক, তিনি দশ টাকার সংস্থান করিয়াছেন। তিনি বিশেষরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া থানায় আসিয়া যেরূপ এজাহার দিতেছেন, তাহার সারমর্ম এই স্থানে পাঠকগণকে অবগত করাইব। নসিরুদ্দিন বলিতেছেন, ‘প্রায় তিন মাস অতীত হইল, আমি একজন পোদ্দারকে প্রায় ছয় সাত শত টাকা মূল্যের কতকগুলি সোনার অলঙ্কার নির্মাণ করিতে দিয়াছিলাম; অনেকবার তাগাদা করিয়াও সেই সকল গহনা আমি আর পাই নাই। কিন্তু অদ্য দিবা ১০টার সময় যখন আমি আফিস-অঞ্চলে যাইতেছিলাম, সেই সময়ে পোদ্দার আমাকে ডাকিল ও তাহার দোকান হইতে সমস্ত গহনাগুলি আমাকে প্রদান করিয়া বলিয়া দিল যে, “বিশেষ কার্যোপলক্ষে অদ্য আমি দেশে যাইতেছি, প্রায় দুই তিন মাস ভিন্ন ফিরিয়া আসিতে পারিব না, এখন আপনি গহনাগুলি লইয়া যান; আমি ফিরিয়া আসিয়া হিসাব-পত্র করিয়া দেনাপাওনা স্থির করিব।” পোদ্দারের এই কথা শুনিয়া আমি গহনাগুলি গ্ৰহণ করিলাম ও কিয়ৎক্ষণ সেই স্থানে দাঁড়াইয়া ভাবিতে লাগিলাম যে, ‘গহনাগুলি সঙ্গে করিয়া আফিস-অঞ্চলে যাই, কি আবার বাটী ফিরিয়া গিয়া উহা রাখিয়া আসি।’ আমি এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় গোলাম হোসেনের পুত্র কাছেম আলিকে আসিতে দেখিতে পাইলাম। উহাকে অনেক দিবস হইতে ভাল লোক বলিয়া জানিতাম; বিশেষত আমার বাড়ীর নিকটেই উহার বাসস্থান। আমি কাছেম আলিকে ডাকিলাম; সে নিকটে আসিল। আমি গহনাগুলি তাহার হস্তে প্রদান করিয়া বলিয়া দিলাম, “তুমি ইহা লইয়া আমার বাটীতে গিয়া আমার ভ্রাতার নিকটে দিও।” সে সম্মত হইল ও গহনাগুলি লইয়া সেই স্থান হইতে আমাদিগের গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল। আমিও আফিস-অভিমুখে গমন করিলাম। সন্ধ্যার সময় বাটীতে ফিরিয়া আসিয়া গহনার কথা জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, কাছেম আলি কোন গহনা আনিয়া বাড়িতে দেয় নাই। পরে কাছেম আলির অনুসন্ধান করিলাম এবং তাহার বৃদ্ধ পিতা গোলাম হোসেনের নিকট হইতে অবগত হইলাম যে,সে গুরুদর্শন অভিলাষে কল্য বাটী হইতে গমন করিয়াছে। গহনার কথা জিজ্ঞাসা করায় বৃদ্ধ গোলাম হোসেন তাহার কিছুই বলিতে পারিল না। তাহার গুরুদেব যে কে এবং কোথায় থাকেন, তাহাও আমরা কেহই অবগত নহি। এখন মহাশয়েরা একটু অনুগ্রহ না করিলে আর আমার কোনরূপ উপায় হইবার সম্ভাবনা নাই। যদি আপনারা সন্ধান করিয়া উহাকে না ধরেন, তাহা হইলে আমার ছয় শত টাকা একেবারে লোকসান হইয়া যাইবে এবং দোষী ব্যক্তিরও উপযুক্ত দণ্ড হইবে না। আমি উহার উপর বিশ্বাসঘাতকতা-দোষ আরোপ করিয়া নালিশ করিতেছি, এখন আপনাদিগের যাহা কর্তব্য হয়, করুন।’
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পুলিশ-কর্মচারী তদারকে নিযুক্ত হইলেন। ক্রমে কাছেম আলির বাটীতেও গমন করিয়া তাহার বৃদ্ধ পিতা গোলাম হোসেনের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। গোলাম হোসেনকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কোন কথারই পরিষ্কার উত্তর দিতে পারিলেন না; তবে এইমাত্র বলিলেন যে, কাছেম আলির একজন গুরু (ফকির) আছেন, সে তাঁহারই সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত কল্য এই স্থান হইতে গমন করিয়াছে। সে ফকির কে, কোথায় থাকেন বৃদ্ধ তাহার কিছুই বলিতে না পারায় পুলিশ-কর্মচারীর মনে নানারূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। যে ব্যক্তি গুরু-দর্শনাভিলাষে কল্য গমন করিয়াছে, সে অদ্য কিরূপে নসিরুদ্দিনের নিকট হইতে অলঙ্কার-সকল লইয়া গমন করিতে সমর্থ হইল? ইহা নিতান্ত অসম্ভব। সম্ভবত বৃদ্ধও ইহার কিছু না কিছু ব্যাপার অবগত আছে। এই ভাবিয়া তিনি গোলাম হোসেনের গৃহ অনুসন্ধান করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। বৃদ্ধ প্রথমে অসম্মত হইল; কিন্তু তাহার আপত্তি টিকিল না দেখিয়া, কাজেই তাহাকে সম্মত হইতে হইল। পাড়ার দুই তিন জন ভদ্রলোককে ডাকাইয়া পুলিশকর্মচারী তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন এবং বৃদ্ধকে কহিলেন, ‘তোমার নিজের ও পরিবারবর্গের যে সকল অলঙ্কারাদি আছে, তাহা প্রথমে আমাদিগের সম্মুখে লইয়া আইস। তাহার পর বিবেচনামত কার্য করা যাইবে।’ এই কথা শুনিয়া বৃদ্ধ তাহার পরিবারবর্গের অলঙ্কারগুলি আনিবার মানসে, যে সিন্দুকের ভিতর উক্ত দ্রব্য সকল রক্ষিত ছিল, তাহার নিকট গমন করিল। সেই স্থানে গিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে বৃদ্ধের মস্তক ঘুরিয়া গেল, চতুর্দিক অন্ধকার দেখিয়া সে সেই স্থানেই বসিয়া পড়িল। পুলিশ-কর্মচারী বৃদ্ধের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন ও জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হঠাৎ তোমার এরূপ অবস্থা হইল কেন?’ তখন গোলাম হোসেন ধীরে ধীরে কহিতে লাগিল, ‘আর বলিব কি মহাশয়! আমারও সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে; দেখুন, আমার এই সিন্দুকের তালা খোলা রহিয়াছে এবং কাছেম আলির বৃদ্ধ মাতা ও তাহার স্ত্রীর গহনার বাক্সও নাই।’ এই বলিয়া বৃদ্ধ অধীর বালকের ন্যায় রোদন করিতে লাগিল; কপালে করাঘাত ও আর্তনাদ করিতে করিতে কহিল, ‘এখন বোধ হইতেছে, কাছেম আলি আমারও সর্বনাশ করিয়াছে। সেই আমার সিন্দুক ভাঙ্গিয়া আমার এত দিবসের সঞ্চিত যাহা কিছু ছিল, তাহা লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। এখন বোধ হইতেছে, কাছেম আমার পুত্র নহে। এত দিবস হইতে সে আমার সর্বনাশ-সাধন করিবার মানসেই আমাকে ছলনা করিয়া আমার পুত্র-পরিচয়ে আমার নিকটে অবস্থিতি করিতেছিল। আজ দেখিতেছি যে, সে আমার সর্বনাশ সাধন করিয়া তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সক্ষম হইয়াছে। আজ বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, আমারই সর্বনাশ-সাধনের নিমিত্ত মায়াজাল বিস্তার করিয়া সে আমাকে মোহজালে আবদ্ধ করিয়া ছিল; তাহার সেই মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি প্রভৃতি এখন দেখিতেছি, ছলনা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’
পুলিশ-কর্মচারী ইহা শুনিয়া আরও বিস্মিত হইলেন ও বার বার কহিলেন, ‘কাছেম আলি যে তোমার পুত্র নহে বলিতেছ, ইহার অর্থ কি?’ এই কথায় বৃদ্ধ যাহা বলিল, তাহা শুনিলে চমকিত হইতে হয়; তাহা বড়ই অদ্ভুত কথা। বৃদ্ধ বলিল, ‘এখন আমার বয়ঃক্রম ৬০ বৎসর হইয়াছে। যখন আমার বয়ঃক্রম ৪০ বৎসর, সেই সময়ে অনেক ঈশ্বরাধনার পর আমি একটি মাত্র পুত্র-সন্তান লাভ করিয়াছিলাম, ভাবিয়াছিলাম, এত দিবস পরে ঈশ্বরের কৃপায় আমার যাহা কিছু বিষয়াদি আছে, তাহা উপভোগ করিবার উপযুক্ত পাত্র পাইলাম। কিন্তু আমার সে আশা অতি অল্পদিন মধ্যেই নির্মূল হইল। উহার বয়ঃক্রম ছয়মাস উত্তীর্ণ হইতে না হইতেই আমাদিগের সকল ভরসার স্থল সেই একমাত্র পুত্র শমন-সদনে প্রস্থান করিল। আমরা অতিশয় মর্মাহত হইয়া রোদন করিতে করিতে আমাদিগের ধর্মানুযায়ী উহার সমাধি-কার্য সমাধা করিলাম ও হৃদয়ের স্তরে স্তরে অঙ্কিত দুঃখের প্রতিকৃতি দর্শন করিতে করিতে আরও প্রায় পনের-ষোল বৎসর যাপন করিলাম। প্রায় চারি বৎসর হইল, একদিন আমি সন্ধ্যার সময় আমি আমার ‘দলিজে’ বসিয়া ঈশ্বরের নাম করিতেছি, এমন সময় উক্ত কাছেম আলি, যাহার বয়স তখন ষোল বৎসর, ধীরে ধীরে আমার নিকট আসিল এবং ভক্তিভাবে প্রণামপূর্বক আমাকে পিতৃ-সম্বোধন করিয়া বলিল, ‘পিতঃ! আমি আসিয়াছি।’
আমি উহার কথা শুনিয়া অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘বাপু, তুমি কে, আমাকে পিতৃ-সম্বোধন করিলে?’ তাহাতে কাছেম আলি বলিল, ‘পিতা! আমার নাম কাছেম আলি, আমি আপনার পুত্র। আপনার বোধ হয় মনে আছে যে প্রায় ষোল বৎসর উত্তীর্ণ হইল, আপনার একটি পুত্র-সন্তান জন্মগ্রহণ করে; আমি আপনার সেই সন্তান। আমার মাতাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন, তিনি আমার নাম কাছেম আলি রাখিতে মনে মনে সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। এক দিবস তাঁহার ক্রোড় হইতে আমি পড়িয়া যাওয়াতে, আমার কপালের এক স্থান কাটিয়া গিয়াছিল। দেখুন, আমার কপালের সেই দাগ অদ্যাপিও বর্তমান আছে।’ এই কথা শুনিয়া আমি ঈশ্বরের নাম ভুলিয়া গেলাম; তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলাম। সে পুনরায় বলিতে লাগিল, ‘পিতা! যখন আমার বয়ঃক্রম কেবল ছয় মাস মাত্র হইয়াছিল, সেই সময় আমার অতিশয় পীড়া হয়; তাহাতে সকলেই মনে করেন যে, আমি মরিয়া গিয়াছিলাম। কিন্তু বাস্তবিক আমি মরি নাই। মৃত মনে করিয়া আপনারা আমাকে কবরে প্রোথিত করেন। কিন্তু সেই সময় একজন ফকির সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই, সকল অবস্থা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। আপনারা সেই স্থান পরিত্যাগ করিলে, তিনি আমাকে কবর হইতে উঠাইয়া লইয়া চলিয়া যান ও বহুযত্নে আমাকে রোগ হইতে মুক্ত করেন। আর ইহাও আপনার বোধ হয় বেশ মনে আছে যে, পরদিবস প্রাতঃকালে আপনি কবর দেখিতে গিয়া পুনঃখনিত অবস্থায় দেখিতে পান। তাহাতে শৃগাল কর্তৃক এইরূপ অবস্থা হইয়াছে বিবেচনা করিয়া, আপনি স্বহস্তে উহা ঠিক করিয়া দেন। গত যোল বৎসর পর্যন্ত সেই ফকিরের যত্নে আমি প্রতিপালিত হইয়া এত বড় হইয়াছি, নানা দেশ-দেশান্তরে তাঁহার সহিত ভ্রমণ করিয়াছি এবং এই সকল গূঢ় রহস্যও তাঁহার নিকট অবগত হইয়াছি। প্রায় একমাস অতীত হইল, ফকির সাহেব এলাহাবাদের নিকট একটি পর্বতে গমন করিয়াছেন। তিনি সেই স্থানে ঈশ্বরের ধ্যানে নিমগ্ন থাকিয়া তাঁহার জীবনের অবশিষ্ট কাল অতিবাহিত করিবেন মনস্থ করিয়াছেন এবং আমাকে আপনার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। আমাকে বলিয়া দিয়াছেন, —তুমি যদিও এখন সংসারে প্রবেশ করিতে চলিলে, কিন্তু একবারে সংসারের মায়ায় অভিভূত হইও না, মধ্যে মধ্যে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও। আর তোমার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকেও বলিও যে, কোন না কোন সময়ে আমি যাইয়া তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সকল কথা বলিয়া আসিব।’
এই সকল কথা শুনিয়া আমার চক্ষু দিয়া দরদর বেগে জল পড়িতে লাগিল। আমার অন্তরের সহিত সমস্ত কথা মিলিল দেখিয়া, আমি আমার স্ত্রীকে ডাকিলাম। সেও বাহিরে আসিয়া সকল শুনিয়া তাহার কথা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিল এবং কাছেম আলির মুখ-চুম্বন করিয়া যত্নের সহিত তাহাকে বাটীর ভিতর লইয়া গেল। আমিও ঈশ্বরের এই অনুগ্রহে হৃদয়ের সহিত তাঁহাকে ধন্যবাদ দিতে লাগিলাম। ক্ৰমে পাড়ার লোকজন আসিয়া তাহাকে দেখিল ও সকলেই তাহার কথায় একান্ত বিশ্বাস করিল। সেই দিবস হইতেই আমি উহাকে আমার পুত্র জানিয়া অন্তরের সহিত যত্ন ও এত দিবস ভরণপোষণ করিয়া আসিতেছিলাম; সদ্বংশজাত সুপাত্রীর সহিত উহার বিবাহও দিয়াছিলাম। এই তাহার স্ত্রী; এই তাহার দুইটি পুত্র। সে প্রায়ই দুই চারি মাস অন্তর সেই ফকিরকে দর্শন করিবার নিমিত্ত বিশ-পঞ্চাশ টাকা লইয়া এলাহাবাদের নিকট কোন পর্বতে গমন করে এবং দশ পনের দিবস তথায় থাকিয়া পুনরায় প্রত্যাগমন করে। গত কল্য সেইরূপই গিয়াছে, কিন্তু এবার স্ত্রী ও মাতার গহনাগুলি লইয়া গিয়াছে, বোধ হইতেছে।’
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পুলিশ-কর্মচারী এই সকল কথা শুনিয়া অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হইলেন। একবার ভাবিলেন, বৃদ্ধ গোলাম হোসেন মিথ্যা কথা বলিতেছে। কিন্তু পরে গোলাম হোসেনের স্ত্রী ও প্রতিবেশীবর্গের নিকট সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া তাঁহার সে বিশ্বাস দূর হইল। তিনি আবশ্যক অনুযায়ী অন্যান্য সমস্ত অনুসন্ধান শেষ করিলেন এবং আসামী কাছেম আলির অনুসন্ধান করিতেও চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না।
এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া অপর কতকগুলি অভূতপূর্ব বিষয় বাহির হইয়া পড়িল। এক মোকদ্দমার স্থানে দুইটি মোকদ্দমা কাছেম আলির বিরুদ্ধে উপস্থিত করিতে হইল। পুলিশ-কর্মচারী একাদিক্রমে দুই তিন দিন কাছেম আলির অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন সন্ধান না পাইয়া আসামীর গ্রেপ্তারী ওয়ারেন্ট বাহির করাইবার প্রত্যাশায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট আবেদন করিলেন; মোকদ্দমার সমস্ত ঘটনা সবিশেষ বিবৃত করা হইল; ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুর সমস্ত শুনিয়া আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী ওয়ারেন্ট বাহির করিতে আদেশ প্রদান করিলেন। ওয়ারেন্ট বাহির হইল। তখন সেই ওয়ারেন্ট ডাক যোগে এলাহাবাদে প্রেরিত হইল; কিন্তু সেই স্থানে কাছেম আলির কোন সন্ধান না হওয়ায় ওয়ারেন্ট ফেরৎ আসিল।
এই সময় একদিবস সাহেব আমাকে ডাকাইলেন। উক্ত মোকদ্দমার সমস্ত অবস্থা আমাকে বলিয়া দিলেন ও সেই আসামীকে ধরিবার নিমিত্ত সেই ওয়ারেন্ট আমাকেই প্রদান করিলেন। আমি ভাবিতে ভাবিতে ওয়ারেন্ট হস্তে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। দুই তিন দিন নানাস্থানে তাহার সন্ধান করিলাম, কিন্তু কেহই তাহার কোন সন্ধান বলিতে পারিল না। ভবানীপুরেও তাহার সন্ধানের ত্রুটি হইল না। যখন দেখিলাম, তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গেল না, তখন তাহার সন্ধান পরিত্যাগ পূর্বক তাহার সমবয়স্ক বন্ধুবর্গের অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। পরিশেষে আবদুল নামক এক ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহার নিকট অবগত হইলাম যে, কাছেম আলি প্রায়ই কলিকাতার ভিতর মেছুয়াবাজার নামক স্থানে গমন করিত, আবদুলও পাঁচ সাত দিবস তাহার সহিত গমন করিয়াছিল। মেছুয়াবাজারে তাহার অনেক পরিচিত লোক আছে; সে সেই স্থানে গমন করিলে কত লোক আসিয়া তাহার সহিত আলাপ করিত এবং কোন কোন ব্যক্তি তাহার সহিত গোপনেও নানারূপ কথাবার্তা বলিত।
এই সংবাদ পাইয়া আবদুলকে সঙ্গে লইয়া সেই দিবস সন্ধ্যার সময় মেছুয়াবাজারে গিয়া কাফিখানায় বসিলাম। বসিয়া বসিয়া কাফিখানার অবস্থা দেখিতে লাগিলাম। মেছুয়াবাজারের “কাফিখানা” ও “খন্চা” অতি অদ্ভুত স্থান। ভারতবর্ষের ভিতর এরূপ যে আর কোন স্থান আছে, তাহা বোধ হয় না। সেই স্থানের প্রকৃত বর্ণনা করিতে হইলে বৃদ্ধ বাল্মীকিকে ডাকিতে হয়, নতুবা তাহার যথার্থ বর্ণনা আর কাহারও দ্বারা সম্ভবে না, আমার তো কথাই নাই। কারণ, সত্যকে মিথ্যা করিয়া যে লোক উদরামের সংস্থান করে, তাহার সাধ্য কি যে, সে ইহার চিত্র আঁকিতে পারে? তবে যখন লিখিতে বসিয়াছি, আর আপনারাও পয়সা দিয়াছেন, তখন পারি বা না পারি, কতক না বলিলে আপনারা ছাড়েন কই?
মেছুয়াবাজারের মধ্যে এক স্থানে কতকগুলি বড় বড় খোলার ঘর। উহার ভিতর স্থানে স্থানে চীনদেশীয় মৃত্তিকা-নির্মিত কতকগুলি বাসন রহিয়াছে; আর সেই সকল ঘরের ভিতর চতুর্দিকে সারি সারি কাষ্ঠ-নির্মিত বেঞ্চ সকল সাজান রহিয়াছে। কেবলমাত্র ঘরের মধ্যস্থলে কিয়ৎপরিমাণ স্থান খালি আছে। সেই বেঞ্চের উপর নানাদেশীয় মুসলমানগণ সারি সারি বসিয়া রহিয়াছেন। প্রত্যেকের হস্তে একখানি পিত্তলের চামচ ও সম্মুখে কাফি-পরিপূর্ণ পূর্বোক্ত চীনের এক একটি বাসন। ইহাদের মধ্যে শিক্ষিত বা সভ্য লোক দেখিতে পাওয়া যায় না। আরব, ইরান, পারস্য বলুন, আফ্রিকা বলুন, পঞ্জাব বলুন, বা কলিকাতা বলুন, যে স্থানের মুসলমানগণ স্বদেশে আপন বদমাইসীর চরম সীমা দেখাইয়া দেশ হইতে তাড়িত হইয়াছে, এই সকল তাহাদিগের আমোদের জন্যই স্থাপিত,—এই কাফি তাহাদের জন্যই প্রস্তুত। নতুবা যে দ্রব্যের যথার্থ মূল্য কেবল দুই আনা মাত্র, তাহার মূল্য আট আনা কে দিতে পারে? যাহাদের পয়সা উপার্জনে কোন কষ্ট নাই, যাহারা হাসিতে হাসিতে নানা কারণে লোকের মস্তকে লাঠি মারিতে পারে, কোন জমিদারে জমিদারে দাঙ্গা-হাঙ্গামা উপস্থিত হইলে যাহাদের কদর বাড়ে, যাহারা যে কোন ভদ্রলোককে অপমান করিবার নিমিত্ত তাঁহার বিপক্ষপঞ্জীয়ের নিকট হইতে টাকার বন্দোবস্ত করিয়া লয়, যাহারা চুরিকে ঘৃণা করে না, চোরাই দ্রব্য লইতে সঙ্কুচিত হয় না, যাহারা পুলিশের বা জেলের ভয় করে না এবং যাহাদিগের নিমিত্ত জেলের ভিতর আহারীয় দ্রব্য সততই প্রস্তুত থাকে এ তাহাদিগেরই স্থান। তাহারাই এই স্থানে কাফি পান করিতেছে, আর সম্মুখের স্ত্রীলোকটির দিকে একদৃষ্টিতে লক্ষ্য করিতেছে, বাহবা দিতেছে ও মধ্যে মধ্যে পকেট হইতে সিকিটা, দুয়ানিটা বাহির করিয়া তাহাকে অর্পণ করিতেছে।
এই স্ত্রীলেটি কে? ইনি একজন মুসলমানী বেশ্যা। কাফিখানার ভিতরই ইহার আড্ডা, ইনিই কাফিখানার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কাফিখানার অধ্যক্ষ অনেক যত্ন করিয়া, অনেক তোষামোদ করিয়া ইহাকে রাখিয়াছে। নতুবা কাফিখানা জমে না, কেহ আসে না; সুতরাং কফি অনেক কম বিক্রীত হইয়া তাহার উপার্জনের বিশেষ অনিষ্ট হয়। ঘরের ভিতর যে খালি স্থানটির কথা বলিয়াছি, সেই স্থানে দাঁড়াইয়া এই স্ত্রীলোকটি নৃত্য করিতেছে, হাত পা নাড়িতেছে, ওড়না দুলাইতেছে ও মধ্যে মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া কাহারও মুখের নিকট গিয়া তাল দিতেছে। ইহাদের সঙ্গে বাদ্যকরদ্বয়ও সেইরূপে নানা তালে বাজাইতেছে, দর্শকগণ একদৃষ্টিতে সেই স্ত্রীলোকটির মুখের দিকে তাকাইয়া বাহবা দিতেছে। রাস্তাতেও লোকে লোকারণ্য হইতেছে, পাহারাওয়ালা সেই ভিড় ক্রমাগত হাঁকাইতেছে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
একটি মাত্র লোকের কথা বলিলাম; কিন্তু পাঠক, আবার দেখুন, কাফিখানার ভিতর প্রবেশ করিতেই বামে ও দক্ষিণে দুইটি অলকা-তিলকা মৃর্তি পানের দোকান সাজাইয়া বসিয়া রহিয়াছে। পার্শ্বে দুই দুইখানা বড় বড় আয়না। তাহার ভিতর পানের দোকানের সহিত শাড়ি, ওড়না ও গহনামণ্ডিত মনোহারিণী মুসলমানী-মূর্তির প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। তাহাদের চক্ষু নড়িতেছে, মাথা হেলিতেছে, কানফুল, ঈষৎ দুলিতেছে।
পাঠকগণের ভিতর যদি কোন মুসলমান থাকেন, তাহা হইলে লেখকের অনুরোধ, তিনি যেন এ সুযোগ পরিত্যাগ না করেন। এরূপ পান আর পাইবেন না, এ পানের প্রথমে দাম লাগে না। নগদ পয়সায় এ পান খরিদ করিতে হয় না, দেনায় পাওয়া যায়। কিন্তু সময়ক্রমে সেই দেনা সুদ সমেত (তোবা তোবা–মুসলমানের পক্ষে সুদের কথা আমি ভুলক্রমে বলিয়াছি) কমিশন সমেত শশাধ করিতে হয়। সুতরাং এ সুযোগ পরিত্যাগ করা সম্পূর্ণ অন্যায়।
আর হিন্দু পাঠকগণ! আপনাদিগের ভাগ্য আর আমার ভাগ্য, উভয়েই সমান। মনে মনে ইচ্ছা থাকিলেও আমাদিগের হতভাগ্য সমাজের ভয়ে তাহা করিতে পারি কই? তবে লুকাইয়া চোরাইয়া যদি কেহ কিছু করিতে চাহেন, করুন, তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু আমার মত মুখ আল্গা লোকে ইহা জানিতে পারিলে সকলকেই বলিয়া দিবে।
ইহারা পানের দোকান করিয়া বসিয়া আছে। কিন্তু কই? কাহাকেও তো পান বেচিতে দেখিতেছি না; অথচ কাফিখানায় সকলকেই পান দিতে ত্রুটি করিতেছে না। তবে মধ্যে মধ্যে একজন উঠিয়া ইহাদিগের কাহারও সহিত কোথায় গমন করিতেছে এবং কিয়ৎক্ষণ পরে পুনরায় প্রত্যাগমন করিতেছে। ইহারা যে কোথায় যাইতেছে, তাহা যদিও প্রথমে আমি জানিতে পারি নাই, কিন্তু পরে শুনিয়াছিলাম। তাহা বলিয়াই যে আমি সকল কথা পাঠকগণকে বলিব, তাহা নহে। যিনি যাহা বিবেচনা করেন, তিনি তাহা মনে মনে ভাবুন; আমি কিন্তু বলিব না। আর যদি একান্তই জানিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমাকে জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন নাই, এক দিবস ইহাদের কাহারও সহিত গমন করিয়া স্বচক্ষে দেখিয়া আসুন। তাহা হইলেই চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হইবে।
আমি একটি কাফিখানার কতক অংশ বলিলাম, কিন্তু সেই স্থানে যতগুলি কাফিখানা আছে, তাহা একই প্রকারের, একই ধরনের।
আবদুলের সহিত আমিও মুসলমানবেশে কাফিখানায় গিয়া উপবেশন করিলাম। পানওয়ালী পান দিয়া গেল। আমি উহা হস্তে করিয়া লইলাম, কিন্তু সকলের অদৃশ্যে সেই পান আবদুলকে দিয়া আমার নিকট যে পান ছিল, তাহাই সেই স্থানে বসিয়া চিবাইতে লাগিলাম। কাফিখানার অধ্যক্ষ কাফি আনিয়া আমার সম্মুখে রাখিয়া দিল। আবদুল উভয় অংশই পান করিল। এমন সময় কাছেম আলির পরিচিত একজন লোকের সঙ্গে দেখা হইল। সে আসিয়া আমাদিগের নিকটেই বসিল, তাহার সহিত নানা প্রকার গল্প আরম্ভ করিলাম। ক্রমে কথা-প্রসঙ্গে কাছেম আলির কথা আসিয়া পড়িল। তখন তাহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, উহার প্রকৃত নাম কাছেম আলি নহে, উহার নাম গোলাম আলি। কানপুরের প্রসিদ্ধ জুয়াচার মহম্মদ আলির পুত্র। মহম্মদ আলি মেছুয়াবাজারের আর একটি কাফিখানায় আসিয়া প্রায় মাসাবধি ছিল, এখন পিতা-পুত্রে উভয়েই দেশে গমন করিয়াছে।
এই কথা শুনিয়া নাচওয়ালীকে কিছু বক্শিশ দিয়া কাফির দাম মিটাইয়া দিলাম, এবং ‘কাল আসিব’ পানওয়ালীকে এই কথা বলিয়া সেই স্থান হইতে আমরা উভয়ে বহির্গত হইলাম। পরে পরামর্শ করিয়া অনতিদূরস্থিত ‘খন্চায়’ গিয়া উপস্থিত হইলাম।
মেছুয়াবাজারে ‘খন্চার’ সংখ্যা যে কত, তাহার অনুমানই হয় না। ‘খন্চা’ যে কি পদার্থ, তাহা বোধ হয়, অনেক পাঠকই জানেন না। ‘খন্চা’ আর কিছুই নহে, উহা কেবল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্ৰ চণ্ডুখানা মাত্র। ইহার ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখি, সেই ঘরের ভিতর ঘর-ঘোড়া একটি অতিশয় ময়লা বিছানা। তাহার উপর কতকগুলি মনুষ্য শুইয়া রহিয়াছে। কিন্তু সে শয়নের শৃঙ্খলা নাই, কাহারও পায়ের নিকট কাহারও মাথা, কাহারও পেটের নিকট কাহারও মাথা, কাহারও মাথার নিকট কাহারও ঊরুদেশ ইত্যাদি। ইহার ভিতর স্ত্রীলোক আছে, মুসলমান আছে, হিন্দু আছে, বৃদ্ধ আছে, যুবক আছে, বালক আছে। স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নাই, হিন্দু মুসলমান জ্ঞান নাই। প্রত্যেকেরই মুখের সহিত একটি পিত্তলের নল, একটি একটি প্রজ্বলিত ও কাচপাত্রে আবৃত প্রদীপের সহিত সংলগ্ন। সকলেই চোখ বুজিয়া আছে, চোখ বুজিয়া বুজিয়া এক একজন এক একটি মজার গল্প বলিতেছেন।
উহার ভিতরস্থিত একটি লোককে লক্ষ্য করিয়া আবদুল কহিল, ‘রহমান ভাই, কাছেম আলি কোথায় বলিতে পার?’
রহমান চক্ষু না খুলিয়া বলিল, ‘সে এবার বড় মাল মারিয়া দেশে গিয়াছে। আমাকে এবার কিছুই দিয়া যায় নাই।’
আবদুল বলিল, ‘আমাকেও ভাই ফাঁকি দিয়া গিয়াছে। তাহার বাটীর ঠিকানা আমি জানি না, জানিলে সেই স্থানে যাইতাম। বেল কানপুর, এইমাত্র জানি। কিন্তু কানপুরের কোথায় যে থাকে, তাহা আমি অবগত নহি।’
রহমান পুনরায় সেইরূপ ভাবেই কহিল, ‘কানপুরের মহম্মদ আলির বাড়ি আর কে না জানে? বাজারের নিকটে তাহার বাড়ি। যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবে, সেই বলিয়া দিবে।’
এই কথা শুনিয়া তাহাকে আর কিছু না বলিয়া উভয়েই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
কাছেম আলি ওরফে গোলাম আলির ঠিকানা পাইয়া আর সময় নষ্ট করিলাম না; কর্তৃপক্ষের আদেশ লইয়া সেই রাত্রিতেই রেলযোগে কানপুর-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। নিয়মিত সময়ে কানপুর গিয়া পৌঁছিলাম। সেই স্থানের স্থানীয় পুলিশের সাহায্যে বাজারের নিকট অনুসন্ধান করায় মহম্মদ আলির বাড়ি পাইলাম। তাহার ঘরে গিয়া দেখি, গোলাম আলি বসিয়া রহিয়াছে। তাহাকে তখনই ধরিলাম ও যে কারণে তাহাকে ধরা গেল, তাহার কারণ তাহাকে স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দিলাম। সে শুনিয়া কিছুমাত্র ভয় করিল না, বরং একটু হাসিল। তাহার বাড়ি উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; ঘরের মেজে প্রভৃতি সমস্তই খুড়িয়া ফেলিলাম, কিন্তু কোন স্থানে চোরা দ্রব্যের কোন সন্ধানই প্রাপ্ত হইলাম না। পরিশেষে ঘরের দেওয়াল খুড়িতে খুঁড়িতে উহার ভিতর এক স্থান হইতে নসিরুদ্দিন ও গোলাম হোসেনের প্রায় সমস্ত অলঙ্কারই বাহির হইয়া পড়িল।
অনুসন্ধানে আরও জানিতে পারিলাম যে, কাছেম আলি, ওরফে গোলাম আলির পিতা-মাতা, স্ত্রী ও একটি পুত্র সেই স্থানে আছে; চুরি জুয়াচুরিই ইহাদিগের ব্যবসা। ইহারা দলে দলে বিভক্ত হইয়া ভারতবর্ষের নানা স্থান পর্যটন পূর্বক নানারূপ জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া আপন আপন জীবিকা নির্বাহ ও পরিবারবর্গকে প্রতিপালন করিয়া থাকে। এলাহাবাদের নিকটস্থিত পর্বতে ফকির থাকার সমস্ত কথাই মিথ্যা। কাছেম আলি মধ্যে মধ্যে ফকির-দর্শনের ভান করিয়া গোলাম হোসেনকে প্রতারণাপূর্বক কানপুরে গমন করিত ও যাহা কিছু লইয়া যাইত, তাহা বাড়িতে প্রদান করিয়া পুনরায় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিত।
মহম্মদ আলির অনুসন্ধান করিলাম। সে তখন সেই বাড়িতে ছিল না, কোথায় যে গমন করিয়াছে, তাহাও কেহ বলিল না। সুতরাং তাহাকে না পাইয়া কাছেম আলি ওরফে গোলাম আলিকে লইয়াই কলিকাতায় আগমন করিলাম। বৃদ্ধ, গোলাম হোসেন ও তাঁহার স্ত্রী এই সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া ও অলঙ্কারগুলি দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন। পাড়ায় সমস্ত লোক একে একে সেই স্থানে আসিতে লাগিল। কাছেম আলির কার্যকলাপ শুনিয়া, তাহার এই ভয়ানক জুয়াচুরি ব্যাপার অবগত হইয়া, সকলেই তাহাকে সুমধুর বাক্যে সম্বোধন করিতে আরম্ভ করিল। কেহ্ কেহ্ বা তাহাকে প্রহার করিবার ইচ্ছাও প্রকাশ করিতে লাগিল; কিন্তু পুলিশ সেই স্থানে উপস্থিত ছিল বলিয়া তাহাদের সেই আশা কার্যে পরিণত করিতে সমর্থ হইল না। গোলাম হোসেনের সেই পুত্রবধূ এত দিবস পর্যন্ত কাছেম আলিকে প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় দেখিয়া আসিতেছিল, যাহার সামান্য অসুখ হইলেও সে চতুর্দিক অন্ধকার দেখিত; আজ সে যখন জানিতে পারিল যে, তাহার স্বামী জুয়াচোর, তাহার সপত্নী ও সপত্নীপুত্র বর্তমান আছে, তখন সে যেন হৃদয়ে দারুণ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া চতুর্দিক অন্ধকার দেখিল এবং সেই স্থানে বসিয়া পড়িল। মোকদ্দমা আদালতে প্রেরিত হইল। এই মোকদ্দমা দেখিবার জন্য আদালতে লোকের স্থান হইল না। যে শুনিল, সেই ‘যমালয়ের ফের মানুষ’ দেখিতে আসিল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আদালতে মোকদ্দমার বিচার হইতেছে, এমন সময় আদালতের বাহিরে একটা বৃক্ষের নিচে অতিশয় গোলযোগ উপস্থিত হইল। সেই গোলযোগ দেখিবার নিমিত্ত সকলে আদালত হইতে বহির্গত হইয়া সেই দিকে দুটিল। দেখিল, একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক আর্তনাদ করিয়া রোদন করিতেছে। তাহার আর্তনাদে হাকিমের আসন টলিল। তিনি চাপরাসী পাঠাইয়া উহাকে আপন এজলাসে ডাকাইলেন ও তাহার আর্তনাদের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। বৃদ্ধা আসামীর প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, ‘মহাশয়, এই-ই আমার সর্বনাশ করিয়াছে। এই-ই আমাকে পথের ভিখারী করিয়াছে। আমি পূর্বে জানিতে না পারিয়া ইহার কথায় বিশ্বাস করিয়াছিলাম বলিয়াই আমার এই দশা ঘটিয়াছে।’
হাকিম ইহাতে আরও বিস্মিত হইলেন। যে মোকদ্দমার বিচার করিতেছিলেন, তাহা স্থগিত করিয়া বৃদ্ধার কথা শুনিতে লাগিলেন। বৃদ্ধা বলিল, ‘ধর্মাবতার! এ জগতে আমাকে আপন বলে, এখন এমন কেহই নাই। যখন আমার স্বামী পরলোক গমন করেন, সেই সময় আমার নিকট সোনা, রূপা ও নগদ প্রায় দুই সহস্র টাকা রাখিয়া যান। আমার আত্মীয়-স্বজন কেহই ছিল না; কেবল আমার দশ বৎসর বয়স্ক একমাত্র বংশধর পুত্র শ্রীমান্ রামধনিয়ারই মুখের দিকে তাকাইয়া সকল দুঃখ ও কষ্ট নিবারণ করিয়া আসিতেছিলাম। তাহাকে স্কুলে বিদ্যাশিক্ষাৰ্থ দিয়াছিলাম। সে প্রত্যহই স্কুলে গমন করিত এবং নিয়মিত সময়ে ফিরিয়া আসিত। এক দিবস সে স্কুলে গেল, কিন্তু আর ফিরিল না। তাহার অনেক সন্ধান করিলাম, থানা-পুলিশে সংবাদ দিলাম, কত স্থানে যে তল্লাস করিলাম, তাহা আর কি বলিব? কিন্তু কোন স্থানেই আমার মনের ‘ধনের’ আর সন্ধান পাইলাম না। তখন আর কোনরূপ উপায় না দেখিয়া কেবল আপন ঘরে শুইয়া রোদন করিয়া দিন কাটাইতে লাগিলাম।
এক বৎসর পরে একদিন অতি প্রত্যুষে আমি আমার বিছানায় শুইয়া রোদন করিতেছি, এমন সময়ে বাহির হইতে এই আমাকে মা মা! বলিয়া ডাকিতে লাগিল। বলিল,-‘মা, আমি রামধনিয়া আসিয়াছি!’ আমি তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিলাম, আসিয়াই উহাকে দেখিলাম। তখন উহার বয়স ১১ বৎসরের অধিক নহে, উহার চেহারাও কতক অংশে আমার রামধনিয়ার মত। এই-ই আমাকে বলিল, ‘মা, আমাকে ভুলাইয়া কুলি-অফিসে লইয়া গিয়া, আমাকে চা’র মুলুকে পাঠাইয়া দেয়। পরে সেই স্থান হইতে পলাইয়া একটি ভদ্রলোকের সাহায্যে পুনরায় আপনার চরণ দেখিতে সমর্থ হইলাম।’ রামধনিয়াকে দেখিয়া ও উহার কথা শুনিয়া অধিক আর কিছু ভাবিবার সময় পাইলাম না। আনন্দে মন শিহরিয়া উঠিল; উহাকে ক্রোড়ে লইয়া মুখচুম্বন করিলাম। আমার এত দিবসের দুঃখ ও কষ্ট দূর হইল। উহাকে পুত্ৰ-নির্বিশেষে পালন করিতে লাগিলাম।
এক দিবস আমাদিগের বাটীতে একটি অতিথি আসিল; সে আমাদিগের দেশস্থ লোক বলিয়া পরিচয় দিল। আমি তাহাকে যত্নের সহিত আহারাদি করাইয়া বাহিরে বারান্দায় শয়ন করিতে স্থান দিলাম। আমি ও আমার পুত্র আমাদিগের ঘরে গিয়া শয়ন করিয়া রহিলাম। কিন্তু প্রাতঃকালে যখন আমার নিদ্রা ভাঙ্গিল, তখন দেখিলাম, ঘরে আমার পুত্র নাই; বাহিরে অতিথিও নাই। দরজা ও বাক্সের চাবি খোলা। দ্রব্যাদিও কিছুই নাই, আমাকে পথের ভিখারী করিয়া উহারা চলিয়া গিয়াছে। তখন আমার মনে সন্দেহ হইল, থানায় সংবাদ দিলাম। তদারক হইল, কিন্তু কিছুই হইল না। উহাদিগকে আর পাওয়া গেল না। দ্রব্যাদিরও কোন সন্ধান হইল না। সেই অবধি আমি পাগলের মত হইয়াছি, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া জীবনধারণ করিতেছি। কল্য শুনিলাম যে, সে ধরা পড়িয়াছে। এ কেবল মাত্র আমার দ্রব্যাদি চুরি করিয়া আমার সর্বনাশ করে নাই; আমার জাতি-ধর্ম সকলই নষ্ট করিয়াছে; মুসলমান হইয়া হিন্দু-পরিচয়ে আমার সর্বনাশ করিয়াছে। এ আমার পুত্র নহে। এখন ধর্মাবতার, আপনি ইহার বিচার করুন। আমার আর কেহই নাই। এখন আমার ধন, ধর্ম ও পুত্র তিনই গিয়াছে। আরও, এখন আমার স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, উহারাই ষড়যন্ত্র করিয়া আমার পুত্রকে কোনরূপে বিপদগ্রস্ত করিয়াছে।’
সপ্তম পরিচ্ছেদ
বৃদ্ধার কথায় হাকিমের মনে অতিশয় দুঃখ ও দয়ার উদ্রেক হইল। তিনি উপস্থিত মোকদ্দমা পনের দিবসের নিমিত্ত স্থগিত রাখিয়া আমার হস্তে পুনরায় উহাকে অর্পণ করিলেন এবং বলিয়া দিলেন, যাহাতে বৃদ্ধার পুত্রের অনুসন্ধান হইতে পারে, সেই বিষয়ে যত্ন করিয়া অনুসন্ধান করা আবশ্যক। আমি উহাকে লইয়া ভাবিতে ভাবিতে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। কাছেম আলি, ওরফে গোলাম আলি, ওরফে রামধনিয়াকে লইয়া পুনরায় অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। উহাকে বার বার জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু উহার নিকট হইতে আর কোন কথা বাহির করিতে পারিলাম না। সে আর কিছু বলিল না। তখন পুনরায় সেই আবদুলের সাহায্য গ্রহণ করিলাম। তাহার সাহায্যে সেই অতিথির অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। মেছুয়াবাজারের প্রত্যেক কাফিখানায়, প্রত্যেক ‘খনচা’য় মুসলমানবেশে পরিভ্রমণ করিতে লাগিলাম, কিন্তু আর তাহার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন আমার মনে মনে সন্দেহ হইল যে, তাহার পিতা মহম্মদ আলিই সেই অতিথি হইবে। পুনরায় মহম্মদ আলির অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম, পুনরায় কানপুরে গমন করিলাম। পুনরায় তাহার বাড়িতে গিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু এবারও তাহাকে তাহার বাড়িতে পাইলাম না। গুপ্ত ‘অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে, সাহাবাদ জেলার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে সে আছে। এ সংবাদ পাইয়া সেই স্থানে গমন করিলাম। মহম্মদ আলিকে তো সেই স্থানে পাইলামই, তদ্ব্যতীত অন্য আর এক ব্যক্তিকেও সেই স্থানে পাইলাম। উহারা সমস্ত কথা অস্বীকার করিল এবং আমাকে প্রথমে এরূপ ভাবে ভয় দেখাইতে আরম্ভ করিল যে, তাহা বলা বাহুল্য। আমি তাহাদের উপর মিথ্যা মোকদ্দমা আনিয়া তাহাদিগকে ধৃত করিলাম, সুতরাং আমাকে তাহার যথেষ্ট প্রতিফল পরে পাইতে হইবে। ‘নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরিলে, বিনা দোষে চোর বলিয়া মিথ্যা অপবাদ দিলে, তাহার মোকদ্দমার যে কি ফল হয়, তাহা দেখিতে পাইবে’, প্রভৃতি নানারূপ কথায় আমাকে ভয় প্রদর্শন পূর্বক, যাহাতে আমি তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিই, তাহার উপায় করিতে লাগিল। আমি কিন্তু সেই ভয়ে ভীত না হইয়া, তাহাদের কথার উপর কর্ণপাতও না করিয়া সেই বাটীতে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোন দ্রব্যাদি পাওয়া গেল না। কেবলমাত্র কতকগুলি পুরাতন জীর্ণ কাগজ পাওয়া গেল। তাহার কতক অংশ পড়িতে পারা যায় না; কোন স্থান একেবারে নাই, পোকায় কাটিয়া ফেলিয়াছে। তাহার একখানির শেষ অংশ যাহা নষ্ট হয় নাই, তাহা এই স্থানে প্রকাশিত হইল। প্রথমাংশ একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহার চিহ্নমাত্রও নাই। তাহার শেষ অংশ এই: —
“আমার মনে অতিশয় কষ্ট হওয়াতে আমি লিখিতেছি। আমি যাহা লিখিলাম, ইহা যদি প্রকৃত হয়, তবে হয় তুমি আমার নিকট আসিবা; না হয় অন্য লোককে পাঠাইয়া দিবা। কিন্তু আমার এই পত্র তাহাকে দিবা, তাহা হইলে আমি জানিতে পারি যে, সে তোমারই লোক। আমি তোমার অপেক্ষায় এখানে পনের দিবস অপেক্ষা করিব মাত্র। কিন্তু তাহার পর যে কোথায় যাইব, তাহা এখন বলিতে পারিতেছি না।
শ্রীরামচন্দ্র দাস,
মোকাম বৃন্দাবনধাম,—মহাবীরপ্রসাদ বাবাজীর কুঞ্জ।”
এই পত্র পাঠ করিয়া আমার মনে অতিশয় সন্দেহ হইল। সেই অতিথিকে উক্ত পত্রের কথা জিজ্ঞাসা করায় সে যে প্রকার উত্তর করিল, তাহা শুনিয়া আরও বিস্মিত হইলাম। ভাবিলাম—, ‘এ সামান্য লোক নহে।’ সে বলিল, ‘আমি এখন তোমার নিকটে আসামী-শ্রেণীতে কয়েদ অবস্থায় আছি। এখন আইনমত আমার মুখ বন্ধ, আমার কিছু বলিবার অধিকার নাই; থাকিলেও আমি বলিব না। কারণ, তোমার কর্ম অনুসন্ধান করা; তুমি ইহার রহস্য অনুসন্ধান করিয়া বাহির কর। আমি কিছু বলিব না।’
এই কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ আরও বাড়িল। আমি আর কিছু না ভাবিয়া বৃন্দাবনধাম অভিমুখে যাত্রা করিলাম। পরে সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া মহাবীরপ্রসাদের সন্ধান পাইলাম; কিন্তু রামচন্দ্র দাসের আর সাক্ষাৎ পাইলাম না। শুনিলাম, তিনি হরিদ্বার-অভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন। আমিও সেই দিকে গমন করিলাম। পরে অনেক অনুসন্ধানের পর রামচন্দ্র দাসের সাক্ষাৎ পাইয়া তাঁহাকে সেই পত্র দেখাইলাম। তাঁহার নিকট হইতে যে সকল বিষয় অবগত হইলাম, তাহা শুনিয়া স্তম্ভিত হইলাম; ভাবিতে লাগিলাম, দুরাচারদিগের অসাধ্য এ জগতে কিছুই নাই বা তাহারা না করিতে পারে, এরূপ কার্য ভাবিয়াও স্থির করা সুকঠিন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
রামচন্দ্র দাস বলিতে লাগিলেন, ‘মহাশয়! আমার বাসস্থান ঢাকা জেলার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র পল্লীগ্রামে। সেই স্থানে আমি পুত্ৰকলত্র সহিত মহাসুখে বাস করিয়া আমার জীবনের প্রায় ষষ্টি বৎসর অতিক্রম করিয়াছি। কিন্তু শেষে বৃদ্ধাবস্থায় আমাকে সকল সুখে জলাঞ্জলি দিতে হইয়াছে। আমার উপর জগদীশ্বরের মহা কোপ পড়িয়াছে, তিন মাসের মধ্যে আমার যে যেখানে ছিল, সকলেই কালের মহা-কবলে পতিত হইয়াছে। কেবল আমি ও আমার স্ত্রী যে কি মহাপাতকের ফলে জীবিত আছি, তাহা বলিতে পারি না। এই কারণে আমাদিগের যাহা কিছু বিষয়সম্পত্তি ছিল, সমস্ত বিক্রয় করিয়া, জীবনের অবশিষ্ট অংশ তীর্থ-পর্যটন করিয়া অতিবাহিত করিবার মানসে পাঁচ বৎসর হইল আমরা দুই জনে বাটী হইতে বহির্গত হইয়াছি। প্রথমে পূর্ব অঞ্চলের কয়েকটি তীর্থস্থান দর্শন করি, ক্রমে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হই এবং কালীঘাটে তিন দিবস অতিবাহিত করিয়া মহামায়া দর্শন পূর্বক পশ্চিম যাত্রা করিবার মানসে হাবড়ার রেলওয়ে স্টেশনে আসিয়া একখানি গাড়িতে আরোহণ করি। সেই গাড়িতে আমি ও আমার স্ত্রী ভিন্ন আর কেহ প্রথমে উঠেন নাই। কিন্তু গাড়ি ছাড়িবার অব্যবহিত পূর্বেই একজন পশ্চিমদেশীয় মধ্যমবয়স্ক ষণ্ডাকৃতি মুসলমান পুরুষ, প্রায় দুই হস্ত পরিমাণ লম্বা একটি টিনের বাক্স সঙ্গে করিয়া, আমরা যে গাড়িতে ছিলাম, তাহাতে উঠিল। সে বাক্সটি বেঞ্চের নিচে রাখিতে না রাখিতে গাড়ি ছাড়িয়া দিল। দেখিতে দেখিতে গাড়ি আসিয়া বালি স্টেশনে থামিল। গাড়ি থামিবামাত্র সেই পশ্চিমদেশীয় ব্যক্তি গাড়ি হইতে নামিল, কিন্তু উহাকে আর পুনরায় উঠিতে দেখিলাম না। পুনরায় গাড়ি চলিল।
ক্রমে গাড়ি বর্ধমান অতিক্রম করিল। তখন সেই বেঞ্চের নিচে যে টিনের বাক্স ছিল, তাহার ভিতর হইতে এক প্রকার শব্দ বাহির হইতে লাগিল। তাহাতে উহার প্রতি আমাদিগের লক্ষ্য পড়িল। আমরা দেখিলাম, বাক্স ক্রমে নড়িতে লাগিল এবং উহার ভিতর যে একপ্রকার শব্দ হইতেছিল, তাহা ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। ইহাতে আমাদিগের অতিশয় কৌতূহল উপস্থিত হওয়ায় বাক্সটি বেঞ্চের নিচে হইতে বাহির করিয়া বলপূর্বক উহার ডালা খুলিয়া ফেলিলাম। তাহাতে যাহা দেখিলাম, মহাশয়, তাহা স্বপ্নের অগোচর! দেখিলাম, উহার ভিতর একটি একাদশ-বৎসর-বয়স্ক বালক, জড়সড় হইয়া শুইয়া গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছে এবং উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু কিছুতেই উঠিতে পারিতেছে না। অধিকন্তু তাহার জ্ঞানের অল্প ব্যতিক্রম হইয়াছে। তখন আমি তাড়াতাড়ি উহাকে বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করিয়া বেঞ্চের উপর শোয়াইলাম, আমার স্ত্রী উহাকে বাতাস করিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে উহার সম্পূর্ণ জ্ঞান হইল, উঠিয়া বসিল এবং কথা কহিতে লাগিল। তখন আমরাও উহার নিকট সকল কথা জানিতে পারিলাম। সেই অবধি এই বালক আমাদিগের সহিত নানা তীর্থস্থান ভ্রমণ করিতেছে। উহারই কথা মত আমি কলিকাতায় চারি পাঁচখানি পত্র লিখিয়াছিলাম, কিন্তু তাহার একখানিরও উত্তর পাই নাই। আর সেই পত্রের একখানির শেষ অংশই আপনি অদ্য আমাকে দেখাইয়াছেন।’
এই বলিয়া তিনি রামধনিয়াকে ডাকাইলেন, রামধনিয়া আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তখন আমি সাহাবাদ জেলা হইতে যে দুই ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহাদিগকেও সেই স্থানে আনাইলাম। রামচন্দ্র দাস তাহার মধ্যে একজনকে সেই টিনের বাক্সবাহী মুসলমান বলিয়া চিনিলেন; প্রকৃত রামধনিয়া উভয়কেই চিনিতে পারিল।
নবম পরিচ্ছেদ
রামধনিয়া বলিল, ‘মহাশয়, আমার বর্তমান বাসস্থান কলিকাতায়। সেই স্থানে আমার একমাত্র বৃদ্ধ মাতা ভিন্ন আর কেহই নাই। আমি প্রায়ই স্কুলে যাইবার সময়, কোন দিন বা স্কুল হইতে আসিবার সময় ইহাকে রাস্তায় দেখিতে পাইতাম। এই ব্যক্তি আমাকে দেখিলেই অতিশয় যত্ন করিত, মিষ্ট কথা বলিত, কলম পেন্সিল কিনিয়া দিত এবং নানাপ্রকার নূতন নূতন খেলানা আনিয়া আমাকে দিত। আমি ভাবিতাম, এ আমার কোন আত্মীয় হইবে। এক দিবস আমি স্কুলে যাইতেছি, সেই সময়ে আমি উহাকে স্কুলের সম্মুখেই দেখিতে পাইলাম; দেখিয়াই আমি উহার নিকট যাইলাম। সে দিবস আমাকে বলিল, ‘গড়ের মাঠে ঘোড়ার নাচ হইতেছে, দেখিতে যাইবে?’ আমি আহাদের সহিত উহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম এবং উহার সহিত ঘোড়ার নাচ দেখিবার প্রত্যাশায় প্রস্থান করিলাম। কতক দূর গমন করিলেই এই ব্যক্তি একখানি গাড়ি লইল, আমরা উভয়েই সেই গাড়িতে উঠিলাম। অনেকক্ষণ পরে গাড়ি আসিয়া এক স্থানে থামিল। তখন গাড়ির ভাড়া মিটাইয়া দিয়া আমাকে লইয়া একখানি খোলার বাটীতে উপস্থিত হইল এবং বলিল, ‘এখন ঘোড়ার নাচের বিলম্ব আছে। এখন আমরা এই স্থানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। পরে সময়মত গমন করিয়া ঘোড়ার নাচ দেখিয়া তোমাকে বাটীতে রাখিয়া আসিব।’ আমি সম্মত হইলাম এবং সেই বাটীতেই অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
‘ক্রমে সন্ধ্যা হইল। তখন আরও দুই তিন জন লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাদিগের সহিত একটি বালককেও দেখিতে পাইলাম। সকলে কতক্ষণ কি পরামর্শ করিতে লাগিল। ঘোড়ার নাচ দেখাইতে আমাকে আর লইয়া গেল না। আমি জিজ্ঞাসা করায় বলিল, “অদ্য নাচ হইবে না। এখন রাত্রি হইয়াছে, তুমি এখানে থাক, কল্য নাচ দেখাইয়া তোমাকে বাটীতে রাখিয়া আসিব।” অগত্যা আমি তাহাতেই সম্মত হইলাম। রাত্রি সেই স্থানেই অতিবাহিত করিলাম, কিন্তু নিদ্রা আসিল না; মনে যেন কেমন এক প্রকার দুর্ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইল। উহারা সকলে একত্র হইয়া পুনরায় কি পরামর্শ করিতে লাগিল। পরে দেখিতে দেখিতে এক ব্যক্তি একটি টিনের বাক্স উপস্থিত করিল। তখন এই ব্যক্তি বলিল, “চল, ঘোড়ার নাচ দেখিতে যাই।” আমি সম্মত হইলাম।
কাপড় লইয়া বহির্গত হইতেছি, এমন সময় এই ব্যক্তি বলিল, “ঘোড়ার নাচ দেখিয়া ফিরিয়া আসিতে অধিক বিলম্ব হইবে, একটু জল খাইয়া লও।” এই বলিয়া চারিটি সন্দেশ আমাকে দিল। আমি ভক্ষণ করিলাম এবং একটু জল পান করিলাম। সেই সময়ে আমার মাথা যেন ঘুরিয়া উঠিল। আমি বসিয়া পড়িলাম। পরে যে আর কি হইল, তাহা বলিতে পারি না। তবে যখন জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, আমি রেলওয়ে গাড়ির ভিতরে শয়ন করিয়া আছি। আমার ধর্ম-মাতা বাতাস করিতেছেন এবং ধর্ম-পিতা নিকটে বসিয়া আছেন। আমি সমস্ত ব্যাপার উহাদিগের নিকট বলিলাম। উহারা সেই দিবস হইতে আমাকে পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেছেন এবং সঙ্গে লইয়া আমাকে দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করিতেছেন। আমার ধর্ম-পিতা সেই সময়ে কলিকাতায় চারি-পাঁচখানি পত্র লিখিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার একখানিরও কোন উত্তর পান নাই। বোধ হয়, আমার বৃদ্ধ মাতা জীবিত নাই; নতুবা এত দিবস তিনি অবশ্যই আমার সন্ধান লইতেন।”—এই বলিয়া বালক রোদন করিতে লাগিল। তখন আমি তাহাকে উত্তমরূপে সান্ত্বনা করিলাম এবং তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম যে, তাহার মাতা এখনও জীবিত আছেন এবং এখন পর্যন্তও তাহার সন্ধান করিয়া বেড়াইতেছেন।
রামচন্দ্র দাস এবং রামধনিয়ার নিকট এই সকল অভূতপূর্ব কথা শ্রবণে যে কতদূর আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। তখন পূর্বোক্ত দুই ব্যক্তিকে আমি ইহার ব্যাপার জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু তাহাদের নিকট হইতে একমাত্র উত্তর, ‘আমরা কিছু জানি না’ ভিন্ন আর কিছুই পাইলাম না।
দশম পরিচ্ছেদ
কাছেম আলি বা যমালয়ের ফেরতা মানুষ পরিশেষে যেরূপ জবানবন্দি দিয়াছিল, তাহার স্থূল মর্ম এই:—
“আমার নাম কাছেম আলি নহে বা রামধনিয়া নহে; আমার নাম গোলাম আলি। আমার পিতার নাম মহম্মদ আলি; বাসস্থান নিজ কানপুর শহর। আমার বয়স যখন এগার বৎসর, সেই সময় আমার পিতা আমাকে কলিকাতায় লইয়া আসে এবং শহরের ভিতর একহানে একখানি খোলার ঘরে আমরা বাস করিতে থাকি। সে বাটীতে আর কেহ থাকিত না। আমরা দুইজন আমার চাচা উমরাও খাঁর সঙ্গে সেই স্থানে থাকিতাম। চাচার বাসস্থান সাহাবাদ জেলার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র গ্রামে। উহারা যে কি ব্যবসা করিতেন, তাহা আমি এ পর্যন্ত বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। তবে আমাকে যে প্রকার শিক্ষা ও উপদেশ দিতেন, আমি তদনুসারেই চলিতাম। এক দিবস দেখিলাম, আমার চাচা উমরাও খাঁ একটি বালককে আমাদিগের বাসার মধ্যে আনিলেন ও পর দিবস একটি টিনের বাক্সে তাহাকে বন্ধ করিয়া কোথায় লইয়া গেলেন। তাহার পর তাঁহাদিগের উপদেশমত আমি রামধনিয়া নাম অবলম্বন করিয়া হিন্দু পরিচয় দিয়া একটি বৃদ্ধার পুত্র সাজিয়া সেই বৃদ্ধার বাটীতে থাকিতে লাগিলাম। সেই সময়ে সেই বৃদ্ধার নামে ডাকে চারি পাঁচখানি পত্ৰ আসিয়াছিল, কিন্তু আমার চাচার পরামর্শমত সেই পত্রগুলি বৃদ্ধাকে না দিয়া চাচাকে আনিয়া দিয়াছিলাম। পরে এক দিবস আমার পিতা অতিথিরূপে সেই বাটীতে উপস্থিত হইলেন। রাত্রিকালে তিনি সেই বাটীতে শয়ন করিয়া রহিলেন। পরে সকলে নিদ্রিত হইলে, সেই রাত্রিতেই সেই বৃদ্ধার যথাসর্ব চুরি করিয়া, আমাকে সঙ্গে করিয়া পলায়ন করিলেন। ইহার কিছু দিবস পরেই আমি পিতার পরামর্শমত কাছেম আলি নাম পরিচয় দিয়া ভবানীপুরে উপস্থিত হইলাম এবং বৃদ্ধ গোলাম হোসেনের নিকট তাহার ‘যমালয়ের ফেরতা পুত্র’ বলিয়া পরিচয় দিয়া কয়েক বৎসর অতিবাহিত করিলাম। তিনি আমার বিবাহ দিলেন, পুত্ৰও হইল। মধ্যে মধ্যে তাঁহার নিকট হইতে কিছু কিছু টাকা লইয়া ফকির গুরুকে দেখিতে যাইবার ভানে বাটীতে যাইতাম। কিন্তু পরিশেষে আমার পিতার পরামর্শে তাঁহারও যথাসর্ব চুরি করিয়া এবং নসিরুদ্দিনের গহনা প্রভৃতি লইয়া পলায়ন করিয়াছিলাম কিন্তু এবার আর পরিত্রাণ পাইলাম না—ধরা পড়িয়াছি। যাই হোক, আপনার নিকট এখন সমস্ত প্রকৃত কথা বলিলাম। ইহাতে আপনার যাহা ভাল হয়, তাহাই করুন।”—এই বলিয়া সে নীরব হইল।
পরে আমি সকলকে আনিয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট উপস্থিত করিলাম ও সমস্ত কথা উহাকে বলিলাম। মোকদ্দমায় যাহা হইল, তাহা আর বলিবার আবশ্যক নাই। তবে এই মোকদ্দমার আসামীগণের মধ্যে একজন সেই ‘যমালয়ের ফেরতা মানুষ’ সেই প্রকৃত রামধনিয়া এবং অপর আর একজন ‘যমের জ্বালায় দেশ পরিত্যাগকারী’ সেই রামচন্দ্র দাস এবং তদারককারী ও ‘যমের পরিত্যজ্য’ সেই আমি। যাহাই হোক, এই আশ্চর্য কাণ্ড দেখিবার নিমিত্ত আদালত লোকে লোকারণ্য হইয়াছিল।