যমদূত
ধানের শহর। মতিনগর।
শহরতলীর রাস্তার পাশে সারি সারি রাইসমিলের গুদাম ঘর। দশ বছর আগে যখন রাইসমিলগুলো চালু ছিল, তখন সারারাত এই গুদাম ঘরগুলো লোকে লোকারণ্য থাকত। এখন অন্ধকারে গুদামঘরগুলোকে দেখলে পোড়োবাড়ি বলে মনে হয়। যেন অনেক আগেই এই গুদামঘরগুলো মরে গিয়েছে।
রাইসমিলগুলোর ভেতরের জগতটার মৃত্যু হয়নি।
এই গুদামঘরের লাশগুলোর ভেতরে এক অন্য জগৎ এখনও টিকে আছে। রাত যত গভীর হতে থাকে, নিশাচর মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে এখানে। আঁধারে বাস করা শীতল রক্তের প্রাণীর মত নিশাচর মানুষগুলো এক নৃশংসতায় মেতে ওঠে।
আন্ডারগ্রাউন্ড বক্সিং।
মানসিকভাবে ক্ষত বিক্ষত মানুষ, যাদেরকে সমাজ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, তারাই এখানে ভিড় জমায় নিশাচর মানুষগুলোর বিনোদনের খোরাক হতে।
এই বক্সিং-এ উঁচু লোহার গ্রিলে ঘেরা একটা বক্সিং রিং-এ দুইজন মানুষ মুষ্টিযুদ্ধে লিপ্ত হয়। নামেই মুষ্টিযুদ্ধ। এখানে কোন রেফারি নেই। নেই কোন নির্দিষ্ট নিয়ম। কোন শাস্তির বিধান নেই। ক্ষ্যাপা কুকুরের মত দুইজন দুইজনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুইজনের ভেতরে যতক্ষণ একজনের রক্তাক্ত দেহটা আর উঠে দাঁড়াতে না পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই চলে। লাল রক্তে ভেসে যায় রিং-এর সাদা ফ্লোর। ঠিক যেন মধ্যযুগের গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াইয়ের মত।
লড়াইরত মানুষদুটোর ওপরে বাজি ধরে আশেপাশের নিশাচর মানুষগুলো। যারা এই নৃশংস লড়াই দেখে মাতালের মত চিৎকার করে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আর দালালেরা টাকা তোলে। একজন একাউন্টেন্ট থাকে যে সব টাকার লেনদেনের হিসাব রাখে। তার মুখে একটা সাদা মুখোশ পরা থাকে। যেন দিনের বেলা ওকে কেউ চিনতে না পারে। পয়সাকড়ির ব্যাপারে একটা নিরাপত্তা আরকি। রোজ যত টাকার লেনদেন হয়, তার থেকে কিছু টাকা যায় স্থানীয় পুলিশের পকেটে, আর কিছু যায় স্থানীয় নেতাদের পকেটে। বাকিটা জয়ী খেলোয়াড় পায়। কেউ বেকায়দায় মার খেয়ে খুন হয়ে গেলেও পুলিশ এখানে কিছুই করতে আসে না। কারণ গরীব দেশে স্বেচ্ছামৃত্যু কোন বিলাসিতা না, আবশ্যিকতা। যে খেলোয়াড় যত বেশি জিতবে, তার ওপরে ধরা বাজির পরিমাণও বাড়বে। পরপর তিনবার জিতলে প্রতিটা বাজির দর বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়।
রিং থেকে বের হওয়ার দুটো উপায়। এক, হয় মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যাও। তোমার রক্তাক্ত দেহটাকে অন্যরা তুলে নিয়ে যাবে রিং-এর বাইরে। নয়ত অপেক্ষা কর, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আর তোমার সাথে লড়াই করার সাহস না করে।
প্রথম উপায়েই বেশিরভাগ মানুষ রিং থেকে বিদায় নেয়। দ্বিতীয় উপায়ে রিং থেকে বিদায় নেওয়া কিংবদন্তী শুধু একজনই আছে। বাকেরুল ইসলাম। যিনি এই খাঁচার ভেতরে একটার পর একটা মানুষকে লড়াইয়ে হারাতেন। সবাই একটা সময় রিং-এর ফ্লোরে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারত না। বাকেরুল প্রতিবার উঠে দাঁড়াতেন। প্রতিবার ক্ষত বিক্ষত হাত দিয়ে আবার লড়াই শুরু করতেন। একটা পর্যায়ে এসে তার দণ্ডায়মান রক্তাক্ত শরীরের সামনে আর কেউ দাঁড়ানোর সাহস করত না। একমাত্র ইনিই একজন, যিনি নিজ পায়ে ভর দিয়ে এই লোহার খাঁচা থেকে বের হয়েছেন প্রতিবার। ইনিই খাইরুল সাহেবের ছোট চাচা। আজ থেকে দশ বছর আগে রেলওয়ের চাকরি হারিয়ে এখানে নাম লেখান। প্রতিদিন তার নামের পাশে লেখা হত, অপরাজিত। সব থেকে বড় সংখ্যার বাজি ধরা হত তার নামেই। এক বছরের ভেতরে বাকেরুল হয়ে যান লাখপতি। নিজের রক্ত ঝরানো টাকা দিয়ে দুটো ট্রাকও কিনে ফেলেন। আস্তে আস্তে বাকেরুলের রিং-এ আসা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। তার সাথে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে পুলিশ আর স্থানীয় নেতাদের ইনকাম। বাকেরুলের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়াটা কেউ মেনে নিতে পারছিল না। বাকেরুলের শরীরের অনেক ছোটখাট সমস্যা দেখা দিতে লাগল। তারপরও সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ঝামেলা বাঁধল তখন, যখন সংবাদপত্রে বাকেরুলের এই উন্নতির গল্প ছাপা হতে লাগল। তার সাক্ষাৎকার ছাপা হতে লাগল কয়েকটা পত্রিকায়। এই নৃশংস খেলার আদ্যপান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে একদিন সাদা পোষাকে পুলিশ হানা দিল বাকেরুলের বাসায়। স্থানীয় নেতাদের নাম করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বাকেরুল আর ফিরে আসেনি।
খাইরুল গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকা গুদামঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজ থেকে দশ বছর আগে তার চাচা এইখানেই নিজের রক্ত ঝরিয়ে টাকা রোজগার করতে আসত। আজ খাইরুল এসেছে। টাকা রোজগার করতে না। নিজের মনের জ্বালা মেটাতে। খাইরুল সাহেবের আবার মনে পড়ে গেল, মেরিলিনা তার গল্পের মাঝখানেই প্লেট নিয়ে উঠে গিয়েছিল। সেই গল্পের শুরুর জায়গাতেই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। ইস্তফাপত্র তিনি আজ সকালেই জমা দিয়ে এসেছেন। আর কোন পিছুটান নেই তার। সব কিছু পেছনে ফেলে এসেছেন তিনি।
গুদামঘরগুলোর দিকে পা বাড়ালেন খাইরুল। তাকে অনুসরণ করল একটা ছায়া। মৃত্যুর ছায়া।
গুদামের কাছে যেতেই দুজন লোক বেরিয়ে এলো অন্ধকারের ভেতর থেকে। তাদের একজন খাইরুলকে বলল, “দ্যাকপেন? না খ্যালবেন?” খাইরুল অন্ধকারে লোকদুইটার চেহারা দেখতে পেলেন না। বললেন, “খেলতে এসেছি।”
“আমার সঙ্গে আসেন।” বাম পাশের লোকটা বলল। খাইরুল লোকটাকে অনুসরণ করে গুদামঘরগুলোর পেছনে আসলেন। একটা ছোট্ট দরজা। দরজার ওপরে একটা পঁচিশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। একটা শুকনামত লোক বসে আছে দরজার সামনে। পরনে লুঙ্গি আর শার্ট। খাইরুল দরজার কাছে যেতেই লোকটা খাইরুল সাহেবেকে তল্লাশি করল। যে লোকটাকে অনুসরণ করে খাইরুল আসলেন, সেই লোকটা আবার অন্ধকারেই ফিরে গেল। লুঙ্গি পরা লোকটা খাইরুলকে ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর দুটো মোটামোটা ব্যান্ডেজের কাপড় বের করে দিয়ে বলল, “রেডি হন। এর পরে একজন যাবে। তারপর আপনি। নাম কি?”
খাইরুল বললেন, “মাহতাব বিশ্বাস।” লোকটা মাথা নেড়ে বাইরে চলে গেল। খাইরুল আশেপাশটা দেখলেন। একটা ছোট ঘর। স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। তার সাথে একটা চাপা বিশ্রী গন্ধ মিশে আছে। মদের গন্ধ। মাথার ওপরে টিমটিম করে একটা অল্প পাওয়ায়ের বাল্ব জ্বলছে। ঘরের কোণায় ভাঙা চেয়ার টেবিলের স্তুপ। খাইরুল দেখলেন, ডান দিকের দেয়ালে একটা লোহার দরজা। তিনি দরজাটা খোলার চেষ্টা করলেন। বাইরে থেকে লাগানো। দেয়ালের ওপাশ থেকে একটা চাপা শব্দ ভেসে আসছে। খাইরুল দেয়ালে কান পাতলেন। চাপা কোলাহল শুনতে পেলেন তিনি। লোহার খাঁচায় আছড়ে পড়ার শব্দটা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। আজ মনের গভীরে যত রাগ আছে সব উগরে দেবেন।
কিছুক্ষণ পরে পাশের লোহার গেটটা খুলে এক লোক আসল। আবছায়াতে লোকটার মুখ দেখতে পেলেন না খাইরুল। লোকটা বলল, “নাম কি?”
খাইরুল আবার নিজের বানানো নামটা বললেন, “মাহাতাব বিশ্বাস।”
লোকটা বলল, “দেখে তো ভদ্রঘরের বলে মনে হয়। এইখানে ক্যান? টাকার জন্য তো আপনি এইখানে আসেন নাই। বিষয়টা কী?”
খাইরুল কোন উত্তর দিলেন না।”
লোকটা বলল, “যাই হউক। বডি নামানো হয়ে গেলেই উঠ্যা পড়বেন।
খাইরুল বললেন, “আমার আগে না একজন ছিল?”
লোকটা বিশ্রীভাবে হেসে বলল, “মুইতা ভরছে শালায়। বাপের জন্মে এই পোথম আসছে এইখানে। অভাবে কী না করে মাইনষ্যে বলেন?” লোকটা সমর্থনের আশায় খাইরুলের দিকে তাকালো।
খাইরুল গুরুত্ব দিলেন না। যত সময় যেতে লাগল, তার পা শিরশির করতে লাগল। এতদিন গরাদের ভেতরে কত মানুষকে পিটিয়েছেন খাইরুল। নিজের পেশার একটা অংশ বলেই মনে করেছেন সেটাকে। আজ লোহার খাঁচার ভেতরেও তিনি পেটাবেন। পার্থক্য এই, এটা তার পেশার অংশ না আর তাকেও একটা মানুষরূপী জন্তুর পিটুনি খেতে হবে। লোকটা আবার বলল, “আজ নতুন এক মরদ আইছে। দুইটারে ছিঁড়ে ফেলে দিছে এক্কেবারে। আপনি তিন নাম্বার।”
খুব তীক্ষ্ণ একটা ঘণ্টার শব্দ হল। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলল, “আসেন।”
খাইরুল এই প্রথম এক অন্য রকম ভয়ের স্বাদ অনুভব করলেন। এরকম ভয় তিনি আগে কখনও পাননি। পারটেক্স বোর্ড দিয়ে ঘেরা লম্বা একটা করিডোর পেরিয়ে হলঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। অন্ধকার হলরুম লোকে লোকারণ্য। কিন্তু কোলাহল শুনলে মনে হয়, অন্ধকারে যেন কয়েকশ শ্বাপদ গর্জন করছে। এলোমেলো গালি আর অশ্লীল কথা ভেসে এলো ভিড়ের ভেতর থেকে। খাইরুল আলোকিত রিংটার দিকে তাকালেন। এই রিং-এই কি তার ছোট চাচা একসময় খেলতেন? চাচার রক্ত কি এখনও লেগে আছে রিং-এর ফ্লোরে? পেছন থেকে লোকটা বলল, “আগান আগান। চালু করেন।”
আলোকিত রিংটার দিকে হেঁটে যেতে শুরু করলেন। একটা মাঝারী আকৃতির মানুষ রিং-এর পাকানো দড়িতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে শুধু একটা জিন্স ছাড়া আর কিছুই নেই। খাইরুল রিং-এর কাছে যেতেই একটা অল্পবয়স্ক ছেলে খাঁচার দরজা খুলে দিল। ছেলেটার শরীরে বিকট হেরোইনের গন্ধ।
পরনের শার্টটা খুলে খাইরুল খাঁচায় ঢুকে পড়লেন। পেছনে চিৎকাররত নিশাচর জনতা। প্রতিপক্ষকে একবার দেখে নিলেন খাইরুল। লোকটার পিঠ আর কাঁধের পেশি ঘাম আর রক্তে ভিজে চিক চিক করছে। লোকটা দড়ি ধরে জানোয়ারের মত হাঁপাচ্ছে। এই মানুষটাই দুইজনকে হারিয়েছে! খাইরুল কী করবেন বুঝতে পারলেন না। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। কুস্তিগীররা যেমন রিং-এ উঠে দুই হাত উঁচু করে হুংকার দেয়, সেরকম কি কিছু করা উচিত তার? হঠাৎ লাউড স্পিকারে কে যেন বলে উঠল, “এখন রিং-এ আছে দুই সিংহ। হ্যাঁ ভাই, দুই শের। এক পাশে মাহাতাব আলী। আরেক পাশে জয়নাল বিশ্বাস। শেরে শেরে লড়াই ভাই। শেরের লড়াই। দর ডাকেন। জয়নাল আলী এখন তিন নম্বরে। দর ডাকতে থাকেন ভাইয়েরা।” লোকজনের ভেতরে যেন এক ভয়ানক উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল। সবাই উন্মত্তের মত চিৎকার করে উঠল। একটা সাদা মুখোশ পরা লোক ভিড়ের ভেতরে টাকা নিয়ে রশিদ দিতে শুরু করল দালালদেরকে। রশিদের সিরিয়াল নম্বরগুলো টুকে রাখল একটা টালি বইয়ে।
খাইরুল খেয়াল করলেন না, লাউডস্পিকারে তার বানানো নামটা ভুল বলা হয়েছে। তিনি প্রতিপক্ষ মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে তার। ইচ্ছে পুরণ হল একটু পরেই। টং করে একটা স্কুল ঘণ্টা বাজালো কেউ। লোকটা খাইরুলের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। পুরো মুখটা খুব বাজে ভাবে থেঁতলে গিয়েছে। বাম চোখটা ফুলে বেগুনি রঙ ধারণ করেছে। পেটানো শরীর। পেট এবং বুকের পেশীগুলো পাকানো দড়ির মত। শরীরের এখানে সেখানে কালশিটে পড়ে গিয়েছে। ঠোঁটের বাম কোণা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। লোকটা সেই ফাটা জায়গাটা বারবার জীভ দিয়ে চাটছে আর থুথু ফেলছে। খাইরুলের গা গুলিয়ে উঠল। মনে হল, এমন আহত একটা মানুষকে হারানো তার জন্য কোন ব্যাপার না। কিন্তু এমন একটা মানুষের গায়ে হাত দিতেই কেমন যেন লাগল তার।
লোকটা পেশাদার বক্সারদের মত দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে খাইরুলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। প্রথমেই ডান হাত দিয়ে একটা ঘুষি ছুঁড়ল লোকটা। খাইরুলের ভেতরে কে যেন বলে উঠল, আসল পুরুষ মানেই সহিংসতা। আজ তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি আসল পুরুষ। খাইরুল মাথা নিচু করে ঘুষিটা এড়িয়ে গেলেন। এটাই যেন চাচ্ছিল লোকটা। বাম হাত দিয়ে সপাটে একটা ঘুষি চালালো নিচু হয়ে থাকা খাইরুলের বাম চোয়াল বরাবর। এমনটা আশা করেননি খাইরুল। ছিটকে পড়লেন লোহার গ্রিলে। তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না, তাকে কেউ এভাবে ঘুষি মেরেছে। তার কাছে মনে হতে শুরু করল তিনি স্বপ্ন দেখছেন। হাতে নিচে কি একটা পড়ল তার। মানুষের দাঁত।
খাইরুল উঠে দাঁড়ালেন। নোনতা স্বাদ পেলেন মুখে। মুখের ভেতরে কোথাও কেটে গিয়েছে। উঠে দাঁড়ালেন। যতটুকু সময়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, লোকটা সেই সময়ের ভেতরেই তাকে আরও কয়েকটা ঘুষি দিতে পারত, দিল না। অপেক্ষা করল খাইরুলের উঠে দাঁড়ানোর। খাইরুল উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে লোকটা আবার খাইরুলের দিকে এগিয়ে এলো। ডান দিকে সরে গিয়ে খাইরুল সাহেবের ডান উরু বরাবর একটা লাথি ছুঁড়ে দিলেন। এবার আর খাইরুল ভুল করলেন না। লাফিয়ে পড়লেন ডান দিকে। লাথিটা বাতাসে আঘাত করল। খাইরুল ফ্লোরে গড়িয়ে পড়লেন। মুহূর্তের ভেতরে সামলে নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালেন।
প্রতিপক্ষ ও খাইরুলের দূরত্ব এখন অনেক। দুজনে রিঙের দুই কোণায় প্রায়। লোকটা আবার রক্তাক্ত থু থু ফেলল রিং-এর ফ্লোরে। প্রতিপক্ষ ক্ষ্যাপা বাঘের মত খাইরুলের দিকে দৌড়ে এলেন। খাইরুলকে নিয়ে আছড়ে পড়লেন ফ্লোরে। উপস্থিত উত্তেজিত জনতা গর্জন করে উঠল “মার কুত্তার বাচ্চাটাকে। মেরে হাগিয়ে দে শালাকে একদম। মার। মাইরে মুখ দিয়ে কইলজে বাইর কইরে দে।”
লোকটা খাইরুলের পেটের ওপরে বসে দুই হাঁটু দিয়ে খাইরুলের হাত দুটো ফ্লোরের সাথে চেপে ধরল। খাইরুল শত চেষ্টাতেও হাত দুটো ব্যবহার করতে পারলেন না। অসহায়ের মত প্রতিপক্ষের ঘুষি খেয়ে গেলেন। কয়টা ঘুষি খেতেই খাইরুল নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। চোখের দৃষ্টি অন্ধকার হতে শুরু করল তার। নাহ কোনভাবেই চেতনা হারানো যাবে না। খাইরুল হা করে শ্বাস নিতে গিয়ে বুঝলেন, চোয়ালের হাড় সরে গিয়েছে। হা করতে পারছেন না। তিনি বুঝতে পারলেন কেউ এসে লোকটাকে খাইরুলের ওপর থেকে টেনে সরিয়ে দিচ্ছে। খাইরুল একপাশে গড়িয়ে সরে গেলেন। বুকের ভেতরে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। ঝাপসা চোখে খাইরুল দেখতে পেলেন লোকটা এগিয়ে এসে খাইরুলের পেটে একটা শক্ত লাথি কষল। মুখ দিয়ে কাশির সঙ্গে অনেকখানি রক্ত উঠে এলো। ফ্লোর হয়ে গেল লাল। আশেপাশের কোলাহল ফিকে হতে শুরু করল খাইরুলের।
হঠাৎ তার কানে এলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে- “ছার। ছার এইখানে ক্যান!? ছার উঠেন। ছার বেরোয়ে আসেন ছার।” ছোট চাচা ডাকছে নাকি? খাইরুল সাহেবের মনে হল, তিনি মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর ওপারে যাওয়ার জন্য ডাক আসছে। কিন্তু ছোট চাচা তাকে স্যার বলে কেন ডাকবে?
প্রতিপক্ষ লোকটার চাহনিতে ঘৃণা। এই মানুষটাকে মারতে পারলে তার জীবন বেঁচে যাবে। এই মানুষটা এখন তার শিকার। এই রিং-এ কেউ মারা গেলে কেউ কিচ্ছু বলবে না। মানুষটা উঠে দাঁড়ালেই সোলার প্লেক্সাস বরাবর একটা লাথি আর একটা আপার কাট। তারপর ঘাড়ের ওপরে একটা রদ্দা। নিউরো-কানেকশান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দেবে। লোকটা আরেকবার ঠোঁটের ফাঁকা জায়গাটা চেটে নিল।
ঝাপসা দৃষ্টিতে খাইরুল ভিড়ের দিকে তাকালেন। একটা সাদা মুখোশ পরা লোক তাকে হাত নেড়ে ডাকছে। ওটা কে? যমদূত? তাকে নিতে এসেছে নাকি? হঠাৎ প্রতিপক্ষকে দেখলেন তার দিকে এগিয়ে আসতে। খাইরুল আর বাঁধা দিলেন না। তার বাঁধা দেওয়ার শক্তি নেই। নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলেন ফ্লোরের ওপরে।
প্রতিপক্ষ দুইহাতে খাইরুলের মুখটা তুলে ধরলেন। খাইরুল অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলেন প্রতিপক্ষ লোকটা বলছে, “আপনি খাইরুল? খাইরুল ইসলাম? তারাগাছির কেসটা নিয়ে আপনিই কাজ করছিলেন?” খাইরুল হ্যাঁ বলতে গেলেন। তার বদলে মুখ দিয়ে শুধু অর্থহীন শব্দ বের হল। দেখলেন, কয়েকজন লোক তাকে ধরে লোহার খাঁচার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে।
খাইরুল জ্ঞান হারালেন।