যব খলিল খাঁ ফাক্তা উড়াতে থে

যব খলিল খাঁ ফাক্তা উড়াতে থে

এখন ভরা জোয়ার৷ জোয়ারের জলে বাণী গাছের লাল-খয়েরি শুকনো পাতা, গরান ঝোপের ডাল, চিরুনি চিরুনি শুকনো গোল পাতা ভেসে আসছে৷ বোটের গায়ে সড়সড় সিরসির করে আওয়াজ হচ্ছে৷ জোরে জল ঢুকছে সূতী খালগুলোতে৷ মনে হচ্ছে সমস্ত সুন্দরবন একটি ভাসমান গাছগাছালির মেলা৷ পাখপাখালি এখন বড়ো একটা চোখে পড়ে না৷ দুটো-একটা তীক্ষ্মস্বর বাঁকা ঠোঁট কার্লু আর হরেক রকমের লাল নীল হলুদ সবুজ মাছরাঙা৷

বোটের কাছেই কতকগুলো স্বাস্থ্যবান লালচে বাঁদর হুপহাপ করে বেড়াচ্ছে৷ কিছুক্ষণ আগে যখন জোয়ার সম্পূর্ণ হয়নি, কেওড়া গাছের তলায় তলায় কাদার আস্তরণের উপর উঁচু উঁচু শুলোর মাঝে মাঝে পা ফেলে ফেলে তিনটি হরিণী এসে দাঁড়িয়েছিল৷ বড়ো বড়ো চোখ মেলে আমাদের নিরীক্ষণ করে একজনও হ্যান্ডসাম লোক দেখতে না পেয়ে আবার গুটিগুটি কেওড়া গাছের ছায়ায় ছায়ায় ফিরে গেছিল৷

এখন দুপুর বেলা৷ সুন্দরবনে দুপুরের মতো এমন নিরালা-সুরেলা দুপুর আর বুঝি কোথাও নেই৷ শুধু জল আর জল—জঙ্গল আর জঙ্গল৷ জল নিস্তরঙ্গ৷ কিন্তু জলে বড়ো টান৷ কখনো ভাটায় টানছে, কখনো জোয়ারে৷ কখনো-বা অস্থিরমতি হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে জল৷ ছোটো ছোটো বড়ো বড়ো আবর্তের সৃষ্টি হচ্ছে৷ তার মধ্যে জলে-ভাসা কাঠকুটো, ফল-পাতা তলিয়ে যাচ্ছে৷ ছোটো ছোটো মাছ টুপ টুপ করে চারপাশে ডুব দিয়ে বেড়াচ্ছে৷ একটা শোল মাছকে তাড়া করেছে ভেটকিতে৷ জলের উপর পিছলেপড়া রুপোলি-শরীর সোনালি রোদ্দুরে ঝিকমিক করছে৷ রোদ থেকে মাথা বাঁচানোর জন্যে একটি স্ট্র-হ্যাট মাথায় চাপিয়ে বোটের মাথায় বসে ছিপ ফেলেছি৷ এখানে সনি লিস্টনের সাইজের ভেটকি জলের তলায় আকছার ঘুরে বেড়াচ্ছে—বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নাক ঘষাঘষি করছে৷ একটা জীয়ন্ত মৌরলা মাছের টোপ গেঁথে বসে আছি—আর জলের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে, হাওয়ার সঙ্গে মনে মনে নিরুচ্চারে কথা বলছি৷

এমন সময় শুনতে পেলাম ওঁরা সকলে দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রাম শেষ করে উঠলেন৷ ভাঁটি দিলে তখন নেমে গিয়ে মাচায় বসা ছাড়া আপাতত কারোই কিছু করণীয় নেই৷ বুলা বাবুয়া স্টোভ ধরিয়ে কফি বানাবার চেষ্টা আরম্ভ করল৷ প্রশান্তকাকু একবার গলা খাঁকরে কাশলেন৷ বাগচিবাবু বললেন, ‘কী মশায় আপনিও কি একশো ফুট বাঘ মারলেন নাকি?’ দুর্গাকাকু শুধোলেন, ‘মানে?’ বাগচিবাবু বললেন, ‘জানেন না বুঝি সে গল্প?’ বলেই শুরু করলেন৷

‘আগেকার দিনের রাজা-মহারাজা মাত্রই শিকারি৷ তবে তাঁদের মধ্যেও কিছু কিছু কুলাঙ্গার ছিলেন৷ তবু তাঁদেরও শিকারি না হয়ে উপায় ছিল না৷ এখনও যেমন অনেক আছেন৷ তখনও তেমন ছিলেন—কেতাবি শিকারি৷ নবাব অথচ একশো-দুশো বাঘ মারেননি এমন বড়ো একটা দেখা যেত না৷ খেতের গেঁহু, বজরা কিতারির মতো জঙ্গলের বাঘও তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল৷ অতএব তাঁরা শয়ে শয়ে কেন, হাজারে হাজারে বাঘ মারলেও কারও কিছু বলার ছিল না৷ ওইরকম একজন নবাবের কাছে তদানীন্তন একজন ইংরেজ শাসক শিকারে গেছিলেন৷ সব বন্দোবস্ত নবাবের মাইনে করা শিকারিই করে রেখেছিলেন৷ নবাবের নিজেরও যেতে হবে না শিকারে৷ কিন্তু বিপদ হল, ডিনারের সময় নিশ্চয়ই শিকারের গল্পসল্প হবে—তখন নবাব কী করবেন? শিকারের যে তিনি শ-ও জানেন না! অতএব নবাব বললেন, দেখো শিকারি, আমি আর সাহেব যখন খানা খাব তুমি তখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং আমার কথাবার্তায় কোনোরকম বেচাল লক্ষ করলেই খুক খুক করে কাশবে৷ তখনই আমি বুঝতে পারব যে, নিজেকে শুধরে নেওয়া দরকার এবং সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নেব৷

‘যথাসময়ে সাহেব এবং নবাব ডিনারে বসলেন৷ উমদা উমদা সব খাবার৷ কলিজা, চৌরি, পায়া, লাব্বা, চাঁব ইত্যাদি ইত্যাদি৷ খেতে খেতে সাহেব বললেন যে তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড়ো বাঘ যা মেরেছেন তিনি, তা হচ্ছে দশ ফুট দু-ইঞ্চি (between the pegs)৷ তারপর প্রসঙ্গত জিজ্ঞেস করলেন, হিজ হাইনেসের মারা সবচেয়ে বড়ো বাঘ কত বড়ো? নবাব কিছুক্ষণ ভাবলেন৷ ভেবে দেখলেন যে, একজন মামুলি ইংরেজ সাহেব যদি দশ ফুট বাঘ মারে তো তাঁর অন্তত দু-শো ফুট বাঘ মারা উচিত৷ উনি বললেন, দু-শো ফুট৷ সাহেবের গলায় মুলিংগাটানি সুপ আটকে গেল৷ শিকারি পর্দার আড়াল থেকে খক খক করে আপ্রাণ কেশে উঠল৷ তখন নবাব বুঝলেন, কুছ গড়বড় হো গ্যায়া৷ তখন উনি রেশমি দাড়িতে নবরত্নের আংটি-পরা আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, আজ অনেকদিন হল, বোধ হয় ঠিক মনে পড়ছে না; বোধ হয় বাঘটা দেড়-শো ফুট ছিল৷ শিকারি আবার কেশে উঠল৷ এবার নবাব কিঞ্চিৎ বিব্রত হলেন৷ বললেন, কী জানি হয়তো-বা একশো ফুটও হতে পারে৷ মনে পড়ছে না, অনেক দিনের কথা তো!

‘শিকারি আবার কেশে উঠল ঘন ঘন, জোরে জোরে৷ নবাবের আর সহ্য হল না৷ বদতমিজির একটা সীমা থাকা দরকার৷ ফরাশ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মখমলে-মোড়া তাকিয়া ছুড়ে ফেলে দরজার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে শিকারিকে বললেন, কামবকত তু খাঁস খাঁসকে মরভি যাও গে, তব ভি হাম একশো ফুটসে কম কভি নেহি মারুংগা৷’

গল্প শুনে এমন হাসির ফোয়ারা উঠল যে, জলের উপর দিয়ে তা হাড়িয়া ভাঙা নদী অবধি গড়িয়ে গেল৷ জলের তলায় হাঙ্গরেরা পর্যন্ত খুদে খুদে দাঁত বের করে হেঁ হেঁ করে হাসতে লাগল৷

এমন সময় প্রশান্তকাকু বললেন, ‘এ তো গেল নবাবের গুলগল্প৷ আমি একটা সত্যি গল্প বলছি৷ সে শিকারি এখনও কলকাতাতেই আছেন এবং দিব্যি শিকারকীর্তন করে চলেছেন৷’ প্রশান্তকাকু বন্দুকের দোকানের মালিক৷ সারাদিন ইচ্ছা থাকুক কি না থাকুক তাঁকে অনেক শিকারির শিকারকীর্তন শুনতে হয়৷ উপায় নেই কোনো৷

‘ভদ্রলোক দোকানে প্রায়ই আসতেন একসময়৷ আজকাল একেবারেই আসেন না৷ তবে পথে-ঘাটে কখনো-সখনো দেখা হয়ে যায়৷ ভদ্রলোকের গল্প বলার এমন একটা সুন্দর সাবলীল ক্ষমতা ছিল যে, তিনি যদি সূর্যকে চাঁদ বলতেন তবুও লোকে মুখের উপর বলতে পারত না যে, আজ্ঞে ওটা চাঁদ নয়৷ ভদ্রলোক বিত্তবান, রূপবান, বিলিতি ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে একটি—সেটি নানারকম কাজে লেগেছে৷ নেমপ্লেটে, লেটারহেডে, ক্লাবে, পার্টিতে৷

‘একদিন আমার লক্ষ্মৌওয়ালা এক বন্ধুর সঙ্গে দোকানে বসে আছি—সেই ভদ্রলোক এলেন৷ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বহরমপুর থেকে এক ভদ্রলোক এলেন গুলি কিনতে৷

‘বহরমপুরের ভদ্রলোক বললেন, চার নম্বর গুলি দিন৷ বিলে শাল্টি নিয়ে কচুরিপানার পাশে চুপ মেরে বসে থাকি আর উড়ো পাখি মারি৷ আমার খালি চার নম্বর দরকার৷

‘উড়ো পাখি মারার কথা শুনেই আমাদের বড়ো শিকারি, ঠোঁটের কোণে কিংসাইজ বিলিতি সিগারেটটি চেপে একটু মিষ্টি হাসলেন৷ বড়ো মিষ্টি হাসি—একেবারে রমণীমোহন৷ তারপর বললেন, সেসব দিন ছিল, উড়ো পাখি মারার দিন৷

‘এমনভাবে কথাটা বললেন যে, যে ভদ্রলোক গুলি কিনতে এসেছিলেন তিনি গুলির কথা ভুলে গিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন৷ এবং একাগ্রতার সঙ্গে বড়ো শিকারির দিকে চেয়ে রইলেন৷ বড়ো শিকারির চোখে-মুখে এমন একটি তুরীয় জ্যোতি ফুটে উঠল যে আমরা বুঝতে পারলাম, এবার ফ্ল্যাশব্যাক হবে৷

‘উনি শুরু করলেন৷ সেবার চিল্কায় গেছি রাজহাঁস মারতে৷ সঙ্গে লাট্টুগড় এবং টিকাইতিয়ার কুমারসাহেবরা৷ প্রত্যেকের হাতে ওভার-আন্ডার ডাবল ব্যারেল শটগান৷ শুটিং জ্যাকেট পরে পাশাপাশি কিছুদূর অন্তর অন্তর দাঁড়িয়েছি আমরা৷ কী মার কী মার৷ গুলি খায় আর পাখি লদলদিয়ে পড়ে৷ ঝাঁকের পর ঝাঁক রাজহাঁস উড়ে উড়ে আসছে আর আমরা মারছি৷ তবে ওদের কাছে আমি কিছুই নয়৷ লাট্টুগড় এমন কুইকশট ছিল যে, হোয়েন দি টোয়েন্টিয়েথ বার্ড ওয়াজ স্টিল ইন দি স্কাই হি ইউজড টু শ্যুট দি টোয়েন্টি ফার্স্ট৷ অর্থাৎ কুড়ি নম্বর পাখি আকাশেই উড্ডীন অবস্থায় মরে গেছে—তখনও মাটিতে পড়তে সময় পায়নি—ইতিমধ্যে একুশে পাখিকেও লাট্টু মেরে দিয়েছে৷

‘আমরা একটু চাপা বিস্ময় প্রকাশ করতেই উনি আমাদের ঠান্ডা করে ভুরু কুঁচকে মুখে তাচ্ছিল্য এনে বললেন, তবে লাট্টুগড়ও কিছু নয়, মারত টিকাইতিয়া৷ হি উড হ্যাভ শ্যট দি ফর্টিয়েথ বার্ড হোয়েন দি থার্টি-নাইনথ ওয়াজ স্টিল ইন দি স্কাই৷

‘বহরমপুরের ভদ্রলোক প্রায় মূর্ছা যাবার স্বরে বলে উঠলেন, আরেঃ সর্বনাশ, কী বলছেন গো!

‘আমাদের আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি বললেন, তবে ওই শুটেই একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল৷ ওয়ালেস বলে একটা আর্মেনিয়ান ছোকরা আমাদের সঙ্গে ছিল—গাড্ডনের গেস্ট৷ ওর পজিশান ছিল আমার পরেই৷ একটা চামড়ার শুটিং জ্যাকেট পরে ছোকরা বারবার ওর নিজের ফায়ারিং লাইন ক্রস করে আমার দিকে ব্যারেল নীচু করে গুলি করছিল৷ ঝরঝর করে ছররা এসে আমার চারপাশে পড়ছিল৷

‘ওকে আমি বার তিনেক মানা করলাম৷ বললাম, লুক, ইউ ইয়ং পিগ৷ ইউ বেটার টেক কেয়ার অব ইয়োরসেলফ৷ কিন্তু নাথিং-ডুয়িং৷ হি কেপ্ট অন প্লেয়িং দি ন্যাস্টি ট্রিক৷ অ্যান্ড দেন হি হ্যাড ইট ফ্রম মি৷

‘আমরা আতঙ্কে শুধোলাম, মেরে ফেললেন? উনি একটু হাসলেন—জেমস বন্ড হাসি৷ তারপর চোখ নাচিয়ে বললেন, প্রায়৷

‘বন্দুক তুলে ব্যারেল অ্যালাইন করে—দুটো ব্যারেলই ছেড়ে দিলাম—ব্যাং ব্যাং৷ ট্রিগার টানার আগে চেঁচিয়ে বললাম, ওয়াচ আউট ওয়ালেস, তারপরই ব্যাং ব্যাং৷ বাট অ্যাজ লাক উড হ্যাভ ইট—ব্যাটার কিছুই হল না৷ লেদার জ্যাকেটের জন্যেই বেঁচে গেল৷ কয়েকটা স্কিনডিপ উন্ড হয়েছিল মাত্র৷ সেদিন থেকে গাড্ডন বা টিকাইতিয়া কারও সঙ্গেই আর যাই না শিকারে৷

‘এমন সময় আমার সেই লক্ষ্মৌওয়ালা বন্ধু বড়ো শিকারিকে বলল, ভাইসাব, উ জমানা চলা গয়া৷ বড়ো শিকারি একটু উদবিগ্ন স্বরে শুধোলেন, কৌন জমানা? দোস্ত বলল, উ জমানা চলা গ্যয়া যব খলিল খাঁ ফাকতা উড়াতে থে৷ অর্থাৎ ওসব দিন চলে গেছে, যখন খলিল খাঁরা পায়রা ওড়াতেন৷

‘বড়ো শিকারি হঠাৎ হাতঘড়ি দেখে বললেন, চলি, বড্ড দেরি হয়ে গেল৷ আমি শুধোলাম, অত তাড়া কীসের? উনি একটু হাসলেন, বললেন, যেতে হবে শেয়ালদায়৷ সেখানে বনগাঁ থেকে একদল শরণার্থী এয়েছে—তাদের খিচুড়ি পরিবেশন করতে হবে৷ বলেই থ্রিপিস সুট পরে খিচুড়ি পরিবেশন করতে চলে গেলেন৷’



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *