যদ্যপি আমার গুরু

যদ্যপি আমার গুরু

অল্প কিছুদিনের মধ্যে কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর নানান পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা পড়েছি। উনার জন্মশতবার্ষিকী এক বছর আগেই শেষ হয়েছে। তার পরেও একটি পত্রিকা ঘটা করে জন্মশতবার্ষিকী পালন করল। তাতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। একজন বড় লেখককে সম্মান দেখানো হচ্ছে এটাই বড় কথা। আমাদের মধ্যে সম্মান করা এবং অসম্মান করার দুটি প্রবণতাই প্রবলভাবে আছে। কাউকে পায়ের নিচে চেপে ধরতে আমাদের ভালো লাগে, আবার মাথায় নিয়ে নাচানাচি করতেও ভালো লাগে।

একটা সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নানান অসম্মানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাকে ‘বাকবাকুম’ কবি বলা হয়েছে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এমএ পরীক্ষায় তাঁর রচনার অংশবিশেষ তুলে ধরে বলা হয়েছে–শুদ্ধ বাংলায় লিখ।

ভাগ্যিস উনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাঙালিকে তিনি মাথায় ভোলার সুযোগ করে দিয়েছেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বিশেষ বক্তৃতামালা দেবার আমন্ত্রণ জানিয়ে ধন্য হয়েছে।

পশ্চিমা দেশেও (যাদের আমরা সভ্য বলে আনন্দ পাই) এরকম প্রবণতা আছে। তরুণ আইনস্টাইন চাকরি চেয়ে নানন বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আবেদনের জবাব পর্যন্ত দেয় নি। আইনস্টাইন অতি বিখ্যাত হবার পর তার চাকরির আবেদনগুলি বাঁধিয়ে অহঙ্কারের সঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে। অহঙ্কারের বিষয় হলো, আইনস্টাইনের মতো লোক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আবেদন করেছিলেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ফিরে যাই। তাঁকে সম্মান দেখানোর আতিশয্যে এক প্রবন্ধকার লিখেছেন, সস্তাধারার জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রকে পেছনে ফেলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে গেছেন কত দূর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মানেই পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি।

সমস্যা হচ্ছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের স্বীকারোক্তি আছে তিনি শরৎচন্দ্রকে কতটা শ্রদ্ধার চোখে সারাজীবন দেখেছেন। গবেষক সরোজ মোহন মিত্র তাঁর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থে বলেছেন, মানিকের জীবনে শরৎচন্দ্রের প্রভাব ছিল অসীম।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শরশ্চন্দ্রের চরিত্রহীন পড়ে অভিভূত ও বিচলিত হয়েছেন, তা লিখে গেছেন সাহিত্য করার আগে নামের প্রবন্ধে।

বেচারা শরৎচন্দ্রের সমস্যা, তাঁর রচনা সব বাঙালি মেয়েরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে পড়ে। আমাদের ধারণা বহুলোক যা পছন্দ করে তা মধ্যম মাত্রার হবে। কারণ বেশির ভাগ মানুষের মেধা মধ্যম মাত্রার।

বাংলা ভাষার ঔপন্যাসিকদের প্রচুর ইন্টারভিউ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একটি প্রশ্ন বেশির ভাগ সময়ই থাকে আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক কে? প্রশ্নের উত্তরে কেউ কখনো শরৎচন্দ্রের নাম দেন না। হয়তো ভয় করেন এই নাম দিলে নিজে মিডিওকার খাতায় নাম উঠাবেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কঠিন গলায় শরৎচন্দ্রের নাম বলতে দ্বিধা বোধ করেন। নি। কারণ তিনি ভালোমতোই জানতেন তিনি যাই বলেন না কেন তাকে মিডিওকার ভাবার কোনো কারণ নেই।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আমি একটা লেখা শুরু করেছিলাম। কিছুটা লিখে থমকে গেছি। শুরুটা এরকম

সেটেলমেন্ট বিভাগের দরিদ্র কানুনগো হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বমোট ১৪টি সন্তান। পঞ্চমটির নাম প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছেলেটি পড়াশোনায় ভালো। প্রবেশিকা পরীক্ষায় গণিতে ডিসটিংশন নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ দিয়েছে। আইএসসিতে প্রথম বিভাগে পাশ করে অংকে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজে।

হরিহর বাবু এবং তাঁর স্ত্রী নীরদা সুন্দরী দেবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন এই ভেবে যে, পঞ্চমটির একটি গতি হয়ে গেল।

সমস্যা বাঁধাল প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু বন্ধু। একদিন ক্লাসের ফাঁকে তুমুল তর্ক। তর্কের বিষয় বড় কোনো কাগজে নবীন লেখকদের লেখা ছাপা নিয়ে। তারা বলছে, নবীন লেখকদের লেখা সম্পাদকরা পড়েনই না।

প্রবোধ একা বলছে, নবীনদের কোনো ভালো গল্প পায় না বলেই ছাপা হয় না। ভালো গল্প পেলেই ছাপবে।

অসম্ভব কথা।

আয় আমার সঙ্গে বাজি রাখ। আমি একটা গল্প লিখে পাঠাব। কোলকাতার সবচেয়ে ভালো পত্রিকা বিচিত্রা। বিচিত্রাতেই পাঠাব। তারা অবশ্যই ছাপবে।

তুই গল্প লিখবি?

বাজি জেতার জন্যে লিখব। আজ রাতেই লিখব।

.

অঙ্কের বই সরিয়ে রেখে রাত জেগে গল্প লেখা হলো। গল্পের নাম ‘অতসী মামী’। লেখক হিসেবে প্রবোধ তাঁর ভালো নাম না দিয়ে মা তাঁকে যে নামে ডাকতেন সেই নাম দিলেন মানিক।

পৌষ সংখ্যা বিচিত্রয় (ডিসেম্বর ১৯২৮) ‘অতসী মামী’ প্রকাশিত হলো। লেখকের নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাংলা কথাসাহিত্যের দিবাকর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাত্রা শুরু ‘অতসী মামী’র হাত ধরে।

বিচিত্রা পত্রিকাতেই তাঁর আরো দুটি গল্প প্রকাশিত হয়। তিনি অঙ্কের বই পুরোপুরি শেলফে তুলে লিখতে শুরু করেন প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য।

সেবছরই তাকে কঠিন মৃগী রোগ কজা করে ফেলে। লেখার সময় Epilepsy র আক্রমণ বেশি হয়। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন। একসময় জ্ঞান ফিরে, আবার লেখা শুরু করেন। ১৯৩৫ সনে মাত্র ২৭ বছর বয়সে লিখেন, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ দিয়ে। পরিচয়ের ঘটনা বলা যেতে পারে। আমার বাবার পোস্টিং তখন বগুড়ায়। আমি বগুড়া জিলা স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ি। সেখানকার পাবলিক লাইব্রেরির নাম উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরির অবৈতনিক সেক্রেটারি একজন উকিল। অল্পবয়েসীরা লাইব্রেরি থেকে কী বই নিচ্ছে না নিচ্ছে সেই দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। আমার হাত থেকে পুতুলনাচের ইতিকথা তিনি কেড়ে নিয়ে বলেলন, এই বয়সে মানিক না পড়াই ভালো। বইটা কঠিন। অশ্লীলতাও আছে।

আমি বললাম, বইটা আমি আমার পড়ার জন্যে নিচ্ছি না। বইটা বাবা পড়তে চেয়েছেন। তাঁর জন্যে নিচ্ছি। আমার জন্যে নিয়েছি সুন্দরবনের আর্জান সরদার।

বই নিয়ে বাসায় ফিরলাম। সঙ্গে সঙ্গেই পড়তে শুরু করলাম। উপন্যাসের শুরুটা কী অদ্ভুত!

খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।

এই শুরুটা পড়ে আমি কিন্তু বুঝতে পারি নি যে হারু ঘোষের ওপর বজ্রপাত হয়েছে। সে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। উপন্যাসের কী আশ্চর্য শুরু এবং কী আশ্চর্য লেখা।

‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মোটামুটি কঠিন সমালোচনার মধ্যে পড়েন। কমিউনিস্টরা বললেন, মানিক বাবু মানুষকে পুতুল হিসেবে দেখছেন। নিয়তির হাতের পুতুল। তা হতে পারে না। মানুষই তার নিয়তির স্রষ্টা। একজন লেখক সেই সত্যই লিখবেন। নিয়তির হাতে সব ছেড়ে দেবেন না।

যে যা বলে বলুক, আমার ধারণী বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে এটি একটি। উপন্যাসটি আমাকে কতটুক আচ্ছন্ন করেছে তার প্রমাণ দেই। আমার উপন্যাস শ্রাবণ মেঘের দিনের প্রধান চরিত্র কুসুম। এই কুসুম এসেছে পুতুলনাচের ইতিকথা থেকে। শশী ডাক্তারের প্রণয়িনী। স্ত্রী শাওনকে আমি ডাকি কুসুম নামে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমি তখন নিজেকে শশী ডাক্তার যে ভাবি না তা কে বলবে!

আমার মেজো মেয়ের নাম শীলা। এই নামটিও নিয়েছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘শৈলজ শিলা’ থেকে। গল্পের শেষে তিনি বলছেন–শৈলে যাহার জন্ম, শিলা যাহার নাম সে শিলার মতো শক্ত হইবে জানি কিন্তু রসে ডুবাইয়া রাখিলেও শিলা কেন গলিবে না ভাবিয়া মাথা গরম হইয়া উঠে।

.

তাঁর কোন লেখা কেমন, কোন গ্রন্থে জাদুবাস্তবতা আছে, কোনটিতে নেই, এইসব তাত্ত্বিক আলোচনায় যাব না। সাহিত্যের সিরিয়াস অধ্যাপকদের হাতে এই দায়িত্ব থাকুক। আমি ব্যক্তি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছি।

নিঃসঙ্গ মানুষটার কোনো বন্ধু ছিল না। এতগুলি বই লিখেছেন, কাউকে কোনো বই উৎসর্গ করেন নি।

.

এই পর্যন্ত লিখে আমি থমকে গেলাম। অন্যদের মতো আমিও কি মানুষটাকে গ্ল্যামারাইজড করার চেষ্টা করছি না? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো বন্ধু নেই। একজন কাউকে পান নি বই উৎসর্গ করার জন্যে, এটা তো তার ব্যর্থতা। কোনো অর্জন না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াশোনা বাদ দিয়ে সাহিত্যে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেন।–এই বাক্যটাতেও তাঁকে বড় করার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা থাকে। মূল ঘটনা সেরকম। না। তিনি দু’বার B.Sc.পরীক্ষা দিয়ে ফেল করার পরই তার ডাক্তার ভাই পড়াশোনার খরচ দেয়া বন্ধ করেন। বাধ্য হয়েই তাকে পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়।

তাঁর কঠিন মৃগী রোগের চিকিৎসায় সেই সময়কার সবচেয়ে বড় চিকিৎসক এগিয়ে এসেছিলেন–ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। তিনি তখন শুরু করেন মদ্যপান। এই সময় অতুল চন্দ্র সেনগুপ্তকে এক চিঠিতে লেখেন—

ডাক্তারের সব উপদেশ মেনে চলা সব অষুধ নিয়মিত খাওয়া সম্ভব হয় নি। কারণ অর্থাভাব এবং অতিরিক্ত খাটুনি। আজ এখন অষুধ খেয়ে ঘুমোলে কাল হাঁড়ি চড়বে না। খানিকটা এলকোহল গিললে কিছুক্ষণের জন্যে তাজা হয়ে হাতের কাজটা শেষ করতে পারব। এ অবস্থায় এলকোহলের আশ্রয় নেয়া ছাড়া গতি কি?

খোঁড়া যুক্তি। যারা মদ্যপান করেন তারা জানেন এই জিনিস কাউকে তাজা করে না। আচ্ছন্ন করে। বোধশক্তি নামিয়ে দেয়।

আমার খুবই কষ্ট লাগে যখন দেখি এতবড় একজন যুক্তিবাদী লেখক নিজের জীবনকে পরিচালিত করেছেন ভুল যুক্তিতে।

তাঁর শেষ সময়ের চিত্র শরৎচন্দ্রের চরিত্রের চিত্রের মতো। তাঁর নিজের লেখা চরিত্রের মতো না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আশ্রয় নিয়েছেন বস্তিতে। তাঁকে ঝাপ্টে ধরেছে চরম দারিদ্র্য, মদ্যপানে চরম আসক্তি এবং চরম হতাশা। তাঁকে দেখতে গেলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অবস্থা দেখে তিনি গভীর বেদনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে বললেন, এমন অবস্থা! আগে টেলিফোন করেন নি কেন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী অস্ফুট গলায় বললেন, তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।

১৯৫৬ সনের ডিসেম্বর মাসে বাংলা কথাসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র মারা যান। তার বয়স তখন মাত্র ৪৮।

যদ্যপি আমার গুরু শুড়ি বাড়ি যায়
তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

[এই লেখাটির জন্যে প্রতীক ও অবসর প্রকাশনার আলমগীর রহমান নানান বইপত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *