যদ্দৃষ্টং
যদ্দৃষ্টং মানে যা দেখেছি। পুরো বাক্যটি হল, ‘যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতম্।’
মানে হল, ‘যা দেখেছি, তাই লিখেছি।’
যেমন লিখতেন কোম্পানির আমলের কলকাতায় বাঙালি কেরানিরা। ইংরেজি-না-জানা ওই বাবুরা ইংরেজিতে লেখা নথি থেকে নকল করতেন, ফলে নথির মধ্যে একটা মাছি মরে থাকলে সেটার পর্যন্ত হুবহু নকল পরের নথিতে ঢুকে যেত। সেই জন্যেই ‘মাছিমারা কেরানি’ কথাটা উদ্ভূত হয়।
‘যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতম্’ আমার সম্পর্কে সমানভাবে প্রযোজ্য। আমিও তো সারাজীবন ধরে এত যে লিখে গেলাম এর প্রায় সবই তো যা দেখেছি, যা পড়েছি সেই সব থেকে খুঁটে খুঁটে টুকে টুকে।
একটি ইস্কুলের ছেলের কথা মনে পড়ছে। তখন তার ইস্কুলে অ্যানুয়াল পরীক্ষা চলছে, সেদিন তার বাংলা পরীক্ষা। চিরকাল যেমন হয়, যথারীতি বাংলা পরীক্ষায় গোরুর বিষয়ে রচনা এসেছে।
ছেলেটি, ধরা যাক তার নাম রাম, তার সিট জানলার পাশে। সে প্রথমেই গোরুর বিষয়ে রচনায় হাত দিয়েছে। খুব মন দিয়ে লিখছে, মাঝে মধ্যে মাথা তুলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে, আবার মাথা গুঁজে লিখছে।
রামের ঠিক পিছনের বেঞ্চে সিট পড়েছে শ্যামের। সে আবার রামের চিরশত্রু।
সহসা পরীক্ষাকক্ষের নীরবতা বিদীর্ণ করে শ্যামের বীভৎস কণ্ঠ শোনা গেল, ‘টুকছে, স্যার, রাম টুকছে।’
শিক্ষক মহোদয় যিনি পরীক্ষাকক্ষে গার্ড দিচ্ছিলেন, তিনি অকুস্থলে ছুটে এলেন। তিনি রামের খাতা উলটিয়ে দেখলেন, তার জামাপ্যান্টের পকেট তল্লাশি করলেন এবং শালীন-অশালীন আরও যা যা করা সম্ভব সবই করলেন, কিন্তু সন্দেহজনক কোনও কাগজ পেলেন না।
ইতিমধ্যে শ্যাম চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘স্যার ওখানে নয়, ওখানে নয়, বাইরে দেখুন।’
বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। শীতকালের প্যাঁচালো হাওয়া, বেশ ঠান্ডা। তারই মধ্যে স্যার বেরলেন র্যাপার দিয়ে কান ঢেকে। তিনি ভেবেছিলেন, রাম বুঝি নকলের কাগজ জানলা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সেখানে কিছুই নেই, একদম ফাঁকা। শুধু একটু দূরে একটা কাঁঠালগাছের নীচে একটা গোরু চোখ বুজে শীতে কুঁকড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্যার ফিরে এলেন। শ্যামকে ধমকাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই শ্যাম বলল, ‘স্যার আপনি বুঝতে পেরেছেন তো?’
স্যার খেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী বুঝতে পেরেছি?’
শ্যাম বলল, ‘গাছতলায় ওই যে গোরুটা। ওই গোরুটা দেখে টুকে টুকে রাম গোরুর রচনা লিখছে।’
এ হল ‘যা দেখেছি তাই লিখেছি’ অর্থাৎ যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতমের চূড়ান্ত উদাহরণ। ওর মধ্যে কোনও দোষ নেই। বড় লেখক, বড় শিল্পী সবাই এ কাজ করেন। জীবনের আনাচে-কানাচে যেখানে যেমন দেখতে পান, তাঁদের রচনা, ছবিতে কুশলী তুলি বা কলমের টানে ফুটিয়ে তোলেন, তার সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিলায়ে সানন্দে স্বীকার করেন, ‘যা দেখেছি তুলনা তার নাই।’
সবাই অবশ্য নিজে দেখে লিখতে পারেন না। তাঁরা টুকে লেখেন। ওই যাঁরা দেখে লিখেছিলেন, তাঁদের লেখা দেখে টুকে লেখেন।
অন্নদাশঙ্কর একদা লিখেছিলেন,
শ্রীমান সমরেশ সেন,
পড়েছি যা লিখেছেন,
লিখেছেন যা পড়েছেন।’
কেউ কেউ বলেন, এখানে কবি সমর সেনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাতে কী? কল্লোলের প্রধান লেখকেরা প্রায় সবাই, শিবরাম, মুজতবা এমনকী পরশুরাম পর্যন্ত এ গুণে গুণী।
কিন্তু কেউ আমার মতো নয়। আমিই সেই হতভাগ্য লেখক যে অন্য লেখকদের লেখাই শুধু নয় নিজের পুরনো লেখাও টোকে।
সম্পাদকেরা জানেন, পাঠকেরা বোঝেন—কিন্তু কেউ কিছু বলেন না, এই রক্ষা।