যদু ডাক্তারের পেশেন্ট – পরশুরাম
ক্যালকাটা ফিজিসার্জিক ক্লাবের সাপ্তাহিক সান্ধ্য বৈঠক বসেছে। আজ বক্তৃতা দিলেন ডাক্তার হরিশ চাকলাদার, এম ডি, এল আর সি পি, এম আর সি এস। মৃত্যুর লক্ষণ সম্বন্ধে তিনি অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বললেন। চার-পাঁচ ঘণ্টা শ্বাস-রোধের পরেও আবার নিশ্বাস পড়ে, ফাঁসির পরেও কিছুক্ষণ হৃৎস্পন্দন চলতে থাকে, দুই হাত দুই পা কাটা গেলেও এবং দেহের অর্ধেক রক্ত বেরিয়ে গেলেও মানুষ বাঁচতে পারে, ইত্যাদি। অতএব রাইগার মর্টিস না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রলালের ভাষায় কুঁকড়ে আড়ষ্ট হয়ে না গেলে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না।
বক্তৃতা শেষ হলে যথারীতি ধন্যবাদ দেওয়া হল, কেউ কেউ নানা রকম মন্তব্যও করলেন। বক্তার সহপাঠী ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, ওহে হরিশ, তুমি বড় হাতে রেখে বলেছ। আসল কথা হচ্ছে, ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা না হলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। শিবপুরের দশরথ কুণ্ডুর কথা শোন নি বুঝি? বুড়ো হাড়কঞ্জুস, অগাধ টাকা, মরবার নামটি নেই। ছেলে রামচাঁদ হতাশ হয়ে পড়ল। অবশেষে একদিন বুড়ো মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, নিশ্বাস বন্ধ হল, নাড়ী থামল, শরীর হিম হয়ে সিটকে গেল। ডাক্তার বললে, আর ভাবনা নেই রামচাঁদ, তোমার বাবা নিতান্তই মরেছেন। রামচাঁদ ঘটা করে বাপকে ঘাটে নিয়ে গেল, বিস্তর চন্দন কাঠ দিয়ে চিতা সাজালে, তার পর যেমন খড়ের নুড়া জ্বেলে মুখাগ্নি করতে যাবে অমনি বুড়ো উঠে বসল। অ্যাঁ, এসব কি? —বলেই ছেলের গালে এক চড়।
সবাই ভয়ে পালাল। বুড়ো গটগট করে বাড়ি ফিরে এসে ঘটককে ডাকিয়ে এনে বললে, রেশমাকে ত্যাজ্যপুত্তুর করলুম, আমার জন্যে একটা পাত্রী দেখ।
সভাপতি ডাক্তার যদুনন্দন গড়গড়ি একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। এঁর বয়স এখন নব্বই, শরীর ভালই আছে, তবে কানে একটু কম শোনেন আর মাঝে মাঝে খেয়াল দেখে আবোল-তাবোল বকেন। ইনি কোথায় ডাক্তারি শিখেছিলেন, কলকাতায় কি বোম্বাই-এ কি রেঙ্গুনে, তা লোকে জানে না। কেউ বলে, ইনি সেকেলে ভি এল এম এস। কেউ বলে, ওসব কিছু নন, ইনি হচ্ছেন খাঁটি হ্যামার-ব্র্যান্ড, অথাৎ হাতুড়ে। নিন্দুকরা যাই বলুক, এককালে এঁর অসংখ্য পেশেন্ট ছিল, সাধারণ লোকে এঁকে খুব বড় সার্জেন মনে করত। প্রায় পঁচিশ বৎসর প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে ইনি এখন ধর্মকর্ম সাধুসঙ্গ আর শাস্ত্রচর্চা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ক্লাবের বাড়িটি ইনিই করে দিয়েছেন, সেজন্য কৃতজ্ঞ সদস্যগণ এঁকে আজীবন সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। সকলেই একে শ্রদ্ধা করেন, আবার আড়ালে ঠাট্টাও করেন।
হাসির শব্দে ডাক্তার যদু গড়গড়ির ঘুম ভেঙে গেল। মিটমিট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপারটা কি?
হরিশ চাকলাদার বললেন, আজ্ঞে বেণী বলছে, ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা না হলে মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না।
যদু ডাক্তার বললেন, এই বেণীটা চিরকেলে মুখ্খু। বিলেত থেকে ফিরে এসে মনে করেছে ও সবজান্তা হয়ে গেছে। জীবনমৃত্যুর তুমি কতটুকু জান হে ছোকরা?
ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত ছোকরা নন, বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। হাতজোড় করে বললেন, কিছুই জানি না সার, আমি তামাশা করে বলেছিলুম।
—তামাশা! মরণ-বাঁচন নিয়ে তামাশা!
যদু ডাক্তার চিরকালই দুর্মুখ, তাঁর অত পসার হওয়ার এও একটা কারণ। লোকে মনে করত, রোগী আর তার আত্মীয়দের যে ডাক্তার বেপরোয়া ধমক দেয় সে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। বয়স বৃদ্ধির ফলে তাঁর মেজাজ আরও খিটখিটে হয়েছে, কিন্তু তাঁর কটুবাক্যে কেউ রাগ করে না। তাঁকে শান্ত করবার জন্য ডাক্তার অশ্বিনীকুমার সেন এম বি বি এস, কবিরত্ন, বৈদ্যশাস্ত্রী বললেন, সার, আজকের সাবজেক্ট সম্বন্ধে আপনি কিছু বলুন।
যদু ডাক্তার বললেন, আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করবে কেন, আমার তো এখন ডোটেজ, যাকে বলে ভীমরতি।
অশ্বিনী সেন বললেন, সে তো মহা ভাগ্যের কথা। সাতাত্তর বৎসরের সপ্তম মাসের সপ্তম রাত্রির নাম ভীমরথী। আপনি তা বহুকাল পার হয়েছেন। আমাদের শাস্ত্রে বলে, এই দুস্তরা রাত্রি অতিক্রম করে যিনি বেঁচে থাকেন তাঁর প্রতিদিনই যজ্ঞ, তাঁর চলা-ফেরা বিষ্ণুপ্রদক্ষিণের সমান, তাঁর বাক্যই মন্ত্র, নিদ্রাই ধ্যান, যে অন্ন খান তাই সুধা। আপনার কথা বিশ্বাস করব না—সে কি একটা কথা হল?
—কিন্তু ওই বেণী কাপ্তেন? ও বিশ্বাস করবে?
বেণী দত্ত আবার হাতজোড় করে বললেন, নিশ্চয় করব সার, যা বলবেন তা বেদবাক্য বলে মেনে নেব।
যদু ডাক্তার প্রসন্ন হয়ে বললেন, নেহাত যদি শুনতে চাও তো শোন। কিন্তু তোমরা হয়তো ভয় পাবে।
বেণী দত্ত বললেন, যদি ভুতুড়ে কাণ্ড না হয় তবে ভয় পাব কেন সার?
—না না, ভুতুড়ে নয়। কিন্তু যে কেস-হিস্টরি বলছি, তা অতি ভীষণ; অথচ এতে শুধু সার্জারির ক্লাইম্যাক্স নয়, প্রেমেরও পরাকাষ্ঠা পাবে।
—বাঃ, বিভীষিকা সার্জারি আর প্রেম, এর চাইতে ভাল কম্বিনেশন হতেই পারে না। আপনি আরম্ভ করুন সার, আমরা শোনবার জন্য ছটফট করছি।
ডাক্তার যদুনন্দম গড়গড়ি বলতে লাগলেন। —প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর আগেকার কথা। তখন তোমাদের সালফা পেনিসিলিন আর স্ট্রেপ্টো ক্লোরো না টেরা কি বলে গিয়ে—এ সব রেওয়াজ হয় নি। কারও বাড়িতে অপারেশন হলে আয়োডোফর্মের খোশবায়ে পাড়া সুদ্ধ মাত হয়ে যেত, লোকে বুঝত, হাঁ, চিকিৎসা হচ্ছে বটে। আমি তখন কালীঘাটে বাস করতুম। আমার বাড়ির কাছে এক তান্ত্রিক সিদ্ধপুরুষ থাকতেন, নাম বিছোরানন্দ, তিনি কামরূপ-কামাখ্যায় আর তিব্বতে বহু বৎসর সাধনা করেছিলেন। ভক্তরা তাঁকে বিঘোর বাবা বা শুধু বাবাঠাকুর বলত। বয়স ষাট-পয়ষট্টি, লম্বা চওড়া চেহারা, ঘোর কাল রং, একমুখ দাড়ি-গোঁফ দেখলেই ভক্তিতে মাথা নিচু হয়ে আসে। আমি তাঁর কার্বংকল অপারেশন করেছিলুম। একটু চাঙ্গা হবার পর একগোছা নোট আমার হাতে দেবার চেষ্টা করলেন। হাত টেনে নিয়ে আমি বললুম, করেন কি, আপনার কাছে কি আমি ফী নিতে পারি। বিঘোর বাবা একটু হেসে বললেন, তুমি না নিলেও ও টাকা তোমার হয়ে গেছে। কথাটার মানে তখন বুঝতে পারি নি, তাঁকে নমস্কার করে বিদায় নিলুম।
বাড়ি ফিরে এসে পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটা ভূর্জপত্রের মোড়কে দশটা গিনি রয়েছে। বুঝলুম বিঘোর বাবার দান তাঁর অলৌকিক শক্তিতে আমার পকেটে চলে এসেছে। তার পর থেকে মাঝে মাঝে তাঁর কাছে যেতুম, নানা রকম আশ্চর্য তত্ত্বকথা শুনতুম। বছর খানিক পরে তিনি কালীঘাট থেকে চলে গেলেন, তাঁর একজন বড়লোক ভক্ত ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গার ধারে একটি আশ্রম বানিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানেই গিয়ে রইলেন। একাই থাকতেন, তবে ভক্তরা মাঝে মাঝে তাঁকে দেখতে যেত।
তার পর দু বৎসর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, খবরও কিছু পাই নি। একদিন বেলা বারোটায় বাড়ি ফিরে এসেছি, একটা হার্নিয়া, দুটো অ্যাপেনডিক্স, তিনটে টিউমার, চারটে টনসিল, আর গোটা পাঁচেক হাইড্রোসিল অপারেশন করে অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছি। নাওয়া খাওয়ার পর স্ত্রীকে বললুম, আমি বিকেল চারটে পর্যন্ত ঘুমুব, খবরদার কেউ যেন না ডাকে। কিন্তু ঘুমুবার জো কি। ঘণ্টা খানিক পরেই ঠেলা দিয়ে গিন্নি বললেন, ওগো শুনছ, জরুরী তার এসেছে। বললুম ছিঁড়ে ফেলে দাও। গিন্নী বললেন, এ যে বিঘোর বাবার তার। অগত্যা টেলিগ্রামটা পড়তে হয়, লিখছেন—এখনই চলে এস, মোস্ট আর্জেন্ট কেস।
তখনই মোটরে রওনা হলুম। ব্যাগটা সঙ্গে নিলুম, তাতে শুধু মামুলী সরঞ্জাম ছিল, কি রকম কেস কিছুই জানা নেই, সেই জন্য বিশেষ কোনও ওষুধপত্র নিতে পারলুম না! শীতকাল, পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিহোর বাবার আশ্রমটি ত্রিবেণীর কাছে কাগমারি গ্রামের গঙ্গার ধারে। খুব নির্জন স্থান, কাছাকাছি লোকালয় নেই। গাড়ি থেকে নেমে আশ্রমের আগড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বিঘোর বাবার সঙ্গে দেখা। পরনে লাল চেলির জোড়, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, পায়ে খড়ম, হুকো হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাক খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, এস ডাক্তার। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, এর কোনও ফ্যাসাদ হয় নি। প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলুম, পেশেন্ট কে? কি হয়েছে? বললেন, ঘরের ভেতর এস, স্বচক্ষে দেখলেই বুঝবে।
ঘরটি বেশ বড়, কিন্তু আলো অতি কম, এক কোণে পিলসুজের মাথায় পিদিম জ্বলছে, তাতে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে দৃষ্টি খুললে নজরে পড়ল—ঘরের এক পাশে একটা তক্তপোশ, বোধ হয় বিঘোর বাবা তাতেই শোন। আর এ পাশে মেঝেতে একটা মাদুরের ওপর দুজন পাশাপাশি চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে, একখানা কম্বল দিয়ে সমস্ত শরীর ঢাকা, শুধু মুখ দুটো বেরিয়ে আছে। একজন পুরুষ, জোয়ান বয়স, বোধ হয় পঁচিশ, মুখে দাড়ি গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আর একজন মেয়ে, বয়স আন্দাজ কুড়ি, কালো কিন্তু সুশ্রী, ঝুঁটি-বাঁধা খোঁপা, সিঁথিতে সিঁদুর। জিজ্ঞাসা করলুম, স্বামী-স্ত্রী?
বিঘোর বাবা উত্তর দিলেন, উঁহু, প্রেমিক-প্রেমিকা।
—কি হয়েছে?
—নিজেই দেখ না।
স্টেথোস্কোপটি গলায় ঝুলিয়ে হেঁট হয়ে কম্বলখানা আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেললুম। তার পরেই এক লাফে পিছনে ছিটকে এলুম। কম্বলের নিচে কিছু নেই শুধু দুটো মুণ্ডু পাশাপাশি পড়ে আছে।
ভয়ও হল রাগও হল। বিঘোর বাবাকে বললুম, আমাকে এরকম বিভীষিকা দেখাবার মানে কি? এ তো ক্রিমিন্যাল কেস, যা করতে হয় পুলিশ করবে, আমার কিছু করবার নেই। কিন্তু আপনি যে মহাবিপদে পড়বেন। বাবা শুধু একটু হাসলেন। তারপর দেখলুম, পুরুষ-মুণ্ডুটা পিটপিট করে তাকিয়ে চিঁ চিঁ করে বলছে, মরি নি ডাক্তারবাবু। মেয়ে মুণ্ডুটাও ডাইনে বাঁয়ে একটু নড়ে উঠল।
ডিসেকশন রুমে বিস্তর মড়া ঘেঁটেছি, হরেক রকম বীভৎস লাশ দেখেছি, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর পিলে-চমকানো ব্যাপার কখনও দৃষ্টিগোচর হয় নি। আমি আঁতকে উঠে পড়ে যাচ্ছিলুম, বিঘোর বাবা আমাকে ধরে ফেলে বললেন, ওহে গড়গড়ি ডাক্তার, ভয় নেই, ভয় নেই, মুণ্ডু কাটা গেছে কিন্তু আমি এদের বাঁচিয়ে রেখেছি। মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শুনেছ? তার প্রভাবে এরা এখনও বেঁচে আছে।
সেই শীতে আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, এদের ধড় কোথায় গেল?
—ওই যে, ওই কোণটায় কম্বলের নিচে পাশাপাশি শুয়ে আছে।
বিঘোর বাবা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই ধড় দুটোও বাঁচিয়ে রেখেছি, দেখ না তোমার চোঙা লাগিয়ে।
স্টেথোস্কোপের দরকার হল না। বুকে হাত দিয়ে দেখলুম হার্ট আর লংস ঠিক চলছে, তবে একটু ঢিমে। বিঘোর বাবাকে বললুম, ধন্য আপনার সাধনা, বিলিতী বিজ্ঞানের মুখে আপনি জুতো মেরেছেন। কিন্তু এতই যদি পারেন তবে ধর আর মুণ্ডু আলাদা রেখেছেন কেন। জুড়ে দিলেই তো লেঠা চুকে যায়।
বিঘোর বাবা বললেন, তা আমার কাজ নয়। আমি মৃতসঞ্জীবনী জানি, কিন্তু খণ্ডযোজনী বিদ্যা আমার আয়ত্ত নয়। ও হল মুচী বা ডাক্তারের কাজ। মুচী আবার লাশ ছোঁবে না, তার মোটরও নেই যে এই অবেলায় এতদূরে আসবে, তাই তোমাকে ডেকেছি। তুমি ধড়ের সঙ্গে মুণ্ডু সেলাই করে দাও।
আমি নিবেদন করলুম, বাইরের চামড়া সেলাই করলেই তো গলার হাড় আর নলী জুড়বে না। সার্কুলেশন রেস্পিরেশন এবং স্পাইনাল কর্ডের সঙ্গে ব্রেনের যোগ কি করে হবে? সেরিব্রেশন অথাৎ মস্তিষ্কের ক্রিয়া চলবে কি করে?
—কেন চলবে না? দুই ভুরুর মধ্যে আজ্ঞাচক্র ঘুরছে, তাতেই পঞ্চেন্দ্রিয় আর মনের ক্রিয়া চলছে। কাটা মুণ্ডু কথা কয়েছে তা তো তুমি স্বকর্ণে শুনেছ। কোনও চিন্তা নেই, তুমি সেলাই করে ফেল।
আমি বললুম, সেলাইএর উপযুক্ত বাঁকা ছুঁচ আর ক্যাটগট তো আমার সঙ্গে নেই, আর সেপসিস অর্থাৎ পচ বন্ধ করব কি করে?
—তোমাকে একটা গুনছুঁচ আর সুতলি দড়ি দিচ্ছি। পচবার ভয় নেই, দেখছ না, কাটা জায়গায় গঙ্গামৃত্তিকা লেপন করে দিয়েছি। ওই কাদা সুদ্ধ সেলাই করে দাও।
বড়ই মুশকিলে পড়া গেল। আয়োজন কিছুই নেই, অ্যাসিস্টান্ট নেই, নার্স নেই, অপারেশন টেব্ল নেই, আলো পর্যন্ত নেই, অথচ বিঘোরানন্দ আমাকে এমন সার্জারি করতে বলছেন, যা কম্মিন্ কালে কোথাও হয়নি।—
ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, হয়েছিল সার—গজানন গণেশ আর অজানন দক্ষ।
—আরে তারা হলেন দেবতা। আচ্ছা বেণী, আজকাল বড় অপারেশনের আগে তোমরা নাকি হরেক রকম টেস্ট করাও?
—আজ্ঞে হাঁ। ব্লাড-প্রেশার, ব্লাড কাউন্ট, ব্লাড-সুগার, এক্স-রে ফোটো, কার্ডিওগ্রাম প্রভৃতি মামুলী রুটিন টেস্ট তো আছেই, তা ছাড়া নন-প্রোটিন নাইট্রোজেন, টোটাল হেভি হাইড্রোজেন, বডিফ্যাটের আয়োডিন-ভ্যালু, হাড়ের ইলাস্টিসিটি, দাঁতের রেডিও-অ্যাক্টিভিটি, চামড়ার স্পেক্ট্রোগ্রাম—এসবও দেখা দরকার। অধিকন্তু রোগী আর তার আত্মীয়দের ইন্টেলিজেন্স কোশন্ট টেস্ট করালে খুব ভাল হয়। শাঁসালো পেশেন্ট হলে অন্তত বিশজন স্পেশ্যালিস্টের রিপোর্ট নেওয়া চাই। আর গরিব পেশেন্টকে বলে দিই, উঁচু দরের চিকিৎসা তোমার সাধ্য নয় বাবু, দাতব্য হোমিওপ্যাথিক খাও গিয়ে, না হয় পাঁচ সিকের মাদুলি ধারণ কর।
যদু ডাক্তার বললেন, আমাদের আমলে অত সব ছিল না, জিব আর নাড়ী, থার্মোমিটার আর স্টেথোস্কোপ, এতেই যা করে। আর এই দুই পেশেন্টের তো চূড়ান্ত অপারেশন মুণ্ডচ্ছেদ আগেই হয়ে গেছে, এখন টেস্ট করা বৃথা। যাক, তার পর যা হয়েছিল শোন। আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে বিঘোরানন্দ আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, অত মাথা ঘামিও না ডাক্তার, শুধু সেলাই করে দাও, বাকীটুকু কুলকুণ্ডলিনী নিজেই করে নেবেন।
আমি বললুম, বাবাঠাকুর, ধরের সঙ্গে মুণ্ডু সেলাই করা সার্জনের কাজ নয়, থিয়েটারের বাবা মুস্তাফার কাজ। বেশ, আপনার আজ্ঞা পালন করব, কিন্তু এই দুজনের হিস্টরি তো বললেন না, এদের এমন দশা হল কি করে?
বিঘোরানন্দ এই ইতিহাস বললেন।—মেয়েটার নাম পঞ্চী, ওর বাপ হরি কামার বাঁশবেড়েতে থাকে। পঞ্চীর বিয়ে হয়েছে এই কাগমারি গ্রামের রমাকান্ত কামারের সঙ্গে। রমাকান্ত লোকটা অতি দুর্দান্ত, দেখতে যমদূতের মতন, বদরাগী আর মাতাল। সে জমিদার-বাড়িতে প্রতি বৎসর নবমী পূজোয় এক শ আটটা পাঁঠা, দশটা ভেড়া, আর গোটা দুই মোষ এনে এক কোপে কাটে। পঞ্চী তাকে বিয়ে করতে চায় নি, তার বাপ টাকার লোভে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। রমাকান্ত বজ্জাত হলেও আমাকে খুব ভক্তি করে, আমার অনেক ফরমাশও খাটে। সে পঞ্চীর ওপর অকথ্য অত্যাচার করত, আমি ধমক দিয়েও কিছু করতে পারি নি। এ রকম ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে তাই হল। এই যে পুরুষটার মুণ্ডু দেখছ, ওর নাম জটিরাম বৈরাগী—তোর দেশের লোক, নয় রে পঞ্চী?
পঞ্চীর মাথা ওপর নিচে একটু নড়ে উঠে সায় দিলে।
—এই জটি ছোকরা কীর্তন গায় ভাল, তার জন্য নানা জায়গা থেকে ওর ডাক আসত। জটিরাম মাঝে মাঝে এই গাঁয়ে এলে পঞ্চীর সঙ্গে দেখা করত, শেষটায় দুজনের প্রেম হল।
পঞ্চীর ভুরু আর ঠোঁট একটু কুঁচকে উঠল।
বিঘোরানন্দ বলতে লাগলেন—রমাকান্ত টের পেয়ে একদিন পঞ্চীকে বেদম মারলে, কিন্তু তাতে কোনও ফল হল না। তার পর গত কাল রাত একটার সময় আমি ঘুমিয়ে আছি এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। উঠে দরজা খুলে দেখি, রামদা হাতে রমাকান্ত। আমার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সর্বনাশ করেছি বাবাঠাকুর, এক কোপে দুটো সাবাড় করেছি, বাঁচান আমাকে।
ব্যাপারটা এই।—আগের দিন রমাকান্ত পঞ্চীকে বলেছিল, আমি ভদ্রেশ্বর যাচ্ছি, চৌধুরী বাবুদের লোহার গেট তৈরি করতে হবে, চার-পাঁচ দিন পরে ফিরব, তুই সাবধানে থাকিস। সব মিথ্যে কথা। রাত দুপুরে রমাকান্ত চুপি চুপি তার বাড়িতে এল এবং আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে দেখলে পঞ্চী আর জটিরাম পাশাপাশি শুয়ে ঘুমুচ্ছে। দেখেই রাম-দায়ের এক কোপে দুজনের মুণ্ড কেটে ফেললে। তার পর ভয়ে পেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে।
আমি তখনই রমাকান্তর সঙ্গে তার বাড়ি গেলুম। প্রথমেই মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে পঞ্চী আর জটিরামের সূক্ষ্মশরীর আটকে ফেললুম। তার পর রমাকান্তকে বললুম, তুই ধড় দুটো কাঁধে করে আশ্রমে নিয়ে চল, মুণ্ডু দুটো আমি নিয়ে যাচ্ছি। আশ্রমে এসে রমাকান্ত আমার উপদেশ মত ধড় এক জায়গায় আর মুণ্ডু আর এক জায়গায় শুইয়ে দিলে। খণ্ডযোজনের আগে পর্যন্ত এই রকম তফাৎ রাখাই তন্ত্রোক্ত পদ্ধতি।
হরিশ চাকলাদার প্রশ্ন করলেন, সূক্ষ্মশরীরেরও কি দু ভাগ হয়েছিল? মুণ্ডু আর ধড় দুটোই আলাদা হয়ে বেঁচে রইল কি করে?
যদু গড়গড়ি বললেন, তোমরা দেখছি কিছুই জান না। সূক্ষ্মশরীর ভাগ হয় না, নৈনং ছিদন্তি শস্ত্রাণি। তার অ্যানাটমি অন্য রকম। কতকটা অ্যামিবার মতন, কিন্তু ঢের বেশি ইলাস্টিক। ধড় আর মুণ্ডু তফাতে থাকলেও সূক্ষ্মশরীর চিটে গুড়ের মতন বেড়ে গিয়ে দুটোতেই ভর করতে পারে। তার পর বিঘোর বাবা যা বলছিলেন শোন।—
রমাকান্ত আবার আমার পায়ে পড়ে বললে, দোহাই বাবাঠাকুর, ফাঁসি যেতে পারব না, আমাকে বাঁচান। আমি বললুম, তুই এক্ষুণি তোর বাড়ি গিয়ে সব রক্ত ধুয়ে সাফ করে ফেলবি, তোর রাম-দা গঙ্গায় ফেলে দিবি, তার পর গায়েব হয়ে থাকবি। এক বৎসর পরে গাঁয়ে ফিরতে পারিস। রমাকান্ত বললে, কিন্তু লাশের গতি কি করবেন? পুলিশ টের পেলেই তদারক করতে আসবে, আপনাকেই আসামী বলে চালান দেবে। আমি বললুম, তোকে তা ভাবতে হবে না, যা বলছি তাই করবি। রমাকান্ত যে আজ্ঞে বলে চলে গেল। আমার সেই টেলিগ্রাম পেয়ে তুমি এসেছ। এখন আর দেরি নয়, রাত আটটায় অশ্লেষা পড়বে, তার আগেই সেলাই করে ফেল, নইলে জোড়া লাগবে না।
গুন-ছুঁচ আর সুতলি নিয়ে আমি সেলাই করতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলুম মুণ্ডু দুটো ফিসফিস করে আপসের মধ্যে কথা বলছে। ক্রমশ পঞ্চীর কণ্ঠস্বর চড়া হয়ে উঠল। বিঘোর বাবা ধমক দিয়ে বললেন, এই পঞ্চী, চেঁচাস নি। আরে গেল যা, এখনও ঘাড়ের ওপর মুণ্ড বসে নি, এর মধ্যেই গলাবাজি শুরু করেছে!
পঞ্চী ডাকল, অ বাবাঠাকুর, একবারটি শুনুন তো।
বিঘোর বাবা উবু হয়ে অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে পঞ্চী আর জটিরামের কথা শুনলেন। তার পর আমাকে বললেন, ওহে ডাক্তার, এরা বলছে যে জটির ধড়ে পঞ্চীর মুণ্ডু আর পঞ্চীর ধড়ে জটির মুণ্ডু লাগাতে হবে। আমিও ভেবে দেখলুম এই ব্যবস্থাই ভাল।
স্তম্ভিত হয়ে আমি বললুম, এ কি রকম কথা বাবাঠাকুর! মুণ্ডু বদল হতেই পারে না, ভিয়েনা কনভেনশনে তার কোনও স্যাংশন নেই। এ রকম অপারেশন মোটেই এথিক্যাল নয়, আমাদের প্রোফেশনাল কোডের একদম বাইরে।
বিঘোর বাবা বললেন, আরে রেখে দাও তোমার কোড। পঞ্চী যদি নিজের ধড় আর মুণ্ডু নিয়ে বেঁচে ওঠে তবে যে আবার রমাকান্তর কবলে পড়বে। মুণ্ডু বদল করলে এদের নব কলেবর হবে, কোনও গোলযোগের ভয় থাকবে না। আর একটা মস্ত লাভ এই হবে যে কখনও এদের ছাড়াছাড়ি হবে না। জটিরাম যদি আগে মরে তবে তার ধড় নিয়ে পঞ্চীর মুণ্ডু বেঁচে থাকবে। পঞ্চী যদি আগে মরে তবে তার ধড়টা জটির মুণ্ডু নিয়ে বেঁচে থাকবে। এই পঞ্চীটা অত্যন্ত চালাক, এর মাথা থেকেই এই বুদ্ধি বেরিয়েছে। জটিরাম হচ্ছে হাঁদারাম। কালই আমি ভৈরব মতে এদের বিয়ে দেব, আমার আশ্রমেই এরা বাস করবে।
আমি প্রশ্ন করলুম, ধড় আর মুণ্ডু বদল হলে কে পঞ্চী কে জটিরাম তা স্থির হবে কি করে?
বিঘোর বাবা বললেন, মাথা হল উত্তমাঙ্গ। মাথা অনুসারেই লোকের নাম হয়, ধড় যারই হক।
ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত জনান্তিকে বললেন, কিন্তু গণেশ আর দক্ষের বেলায় তা হয়নি।
যদু ডাক্তার বলতে লাগলেন, এর পর আর আপত্তি করা চলে না, অগত্যা খণ্ডযোজনের জন্য প্রস্তুত হলুম। অ্যানাস্থেটিক দরকার হল না, বিহোর বাবা মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে অসাড় করে দিলেন। কিন্তু ভোঁতা গুন-ছুঁচ আর খসখসে পাটের সুতলি দিয়ে চামড়া ফোঁড়া গেল না। বিঘোর বাবা বললেন, এই পিদিম থেকে রেড়ির তেল নিয়ে ছুঁচ আর সুতোয় বেশ করে মাখিয়ে নাও। তাই নিলুম। লুব্রিকেট করার পর কাজ সহজ হল, আধ ঘন্টার মধ্যে মুণ্ডুর সঙ্গে ধড় সেলাই করে ফেললুম।
তারপর বিঘোর বাবাকে বললুম, এখন এদের শরীরে কিছু তাজা রক্ত পুরে দেওয়া দরকার, অভাবে পাঁচ শ সিসি গ্লুকোজ-স্যালাইন। কিন্তু এই পাড়গাঁয়ে যোগাড় হবে কি করে? যদি নেহাতই বেঁচে থাকে তবে এর পর কিছুদিন লিভার এক্সট্রাক্ট, ব্লস পিল আর ভিগানরাজেন খাওয়াতে হবে, নইলে গায়ে জোর পাবে না।
বিঘোর বাবা বললেন, ওসব ছাই ভস্ম চলবে না বাপু। এখন এরা সমস্ত রাত ঘুমুবে। কাল সকালে জেগে উঠলে ঝোলা গুড় দিয়ে খানকতক রুটি পথ্য করবে। তার পর বেলা হলে পঞ্চী ভাত চড়িয়ে দেবে আর লঙ্কা-বাটা দিয়ে কাঁকড়া চচ্চড়ি রাঁধবে। তাতেই বলবান হবে। জটিরাম আবার গাঁজা খায়। নয় রে জটে?
জটিরাম দাঁত বার করে বললে, হাঁ।
বিঘোর বাবা বললেন, বেশ তো, কাল সকালে আমার প্রসাদী ছিলিমে দু-এক টান দিস। এখন খাওয়া চলবে না, গলার জোড় পোক্ত হতে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে। এখন খেলে সেলাই-এর ফাঁক দিয়ে সব ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে। দেখ ডাক্তার, তোমাকে ফী কিছু দেব না, আজ তুমি যা দেখলে তারই দাম লাখ টাকা।
আমি উত্তর দিলুম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই বাবা। আমার চক্ষু কর্ণ সার্থক হয়েছে, অহংকার চূর্ণ হয়েছে, গা দিয়ে ঘাম ছুটছে, আগাপস্তলা রোমাঞ্চিত হচ্ছে। আমি ধন্য হয়ে গেছি। এখন অনুমতি দিন, আমি বাড়ি ফিরে যাই, দু ডোজ ব্রোমাইড খেয়ে নার্ভ ঠাণ্ডা করে শুয়ে পড়ি। এই বলে প্রণাম করে সেই রাত্রেই কলকাতায় ফিরে এলুম।
ডাক্তার অশ্বিনী সেন বললেন, কিমাশ্চর্যমতঃপরম্!
ডাক্তার হরিশ চাকলাদার বললেন, ফ্ল্যাবারগাস্টীং মিরাক্ল।
ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, অতি খাসা। পরকীয়া প্রেমের এমন পারফেক্ট পরিণাম বৈষ্ণব সাহিত্যেও নেই, আর সিদ্বায়োসিসের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত বায়োলজির কেতাবেও পাওয়া যায় না। আচ্ছা সার, নায়ক-নায়িকার তো একটা হিল্লে লাগিয়ে দিলেন, কিন্তু রমাকান্তর কি হল?
ডাক্তার যদু গড়গড়ি বললেন, শুনেছি এক বছর পরে সে চুপি চুপি বিঘোর বাবার আশ্রমে এসেছিল, কিন্তু জটি আর পঞ্চীকে দেখে ভূত-পেত্নী মনে করে তখনই ভয়ে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে সে নিরুদ্দেশ।
—আহা, তার জন্য দুঃখ হয়, বেচারা খুন করেও বউকে শায়েস্তা করতে পারল না। নামটাই যে অপয়া, ডাইনে বাঁয়ে যে দিক থেকে পড়ুন পাবেন রমাকান্ত কামার। আমাদের সুবল বসুও তার দুমুখো নামের জন্য উন্নতি করতে পারছেন না। আচ্ছা তার পর আর কখনও আপনি পঞ্চী আর জটিরামকে দেখেছিলেন?
—দেখেছিলুম। দু বছর পরে বিঘোর বাবা চিঠি লিখলেন, মাঘ সংক্রান্তির দিন জটি-পঞ্চীর ছেলের অন্নপ্রাশন, তুমি অবশ্যই আসবে। বাবার যখন আদেশ তখন যেতেই হল।
—কি দেখলেন গিয়ে?
দেখলুম, বিঘোর বাবা ঠিক আগের মতন লাল চেলির জোড় পরে দাঁড়িয়ে হুকো টানছেন, পঞ্চী তার মস্কিউলার মন্দা হাতে একটা মস্ত কুড়ুল নিয়ে কাঠ চেলা করছে, জটিরাম রোয়াকে বসে একটা পিঁড়িতে আলপনা দিচ্ছে আর কোলের ছেলেকে মাই খাওয়াচ্ছে।