3 of 3

যদি পুরুষ হতাম

‘পুরুষ হলে বেশ হতো। মরে গেলে বছর বছর আমার প্রয়াণ দিবস পালন হতো। এতকাল খেটেখুটে যে ৪৩টা বই লিখেছি তা না লিখলেও চলত। কিছু কবিতা লিখতাম রাজনীতি নিয়ে, কিছু দেশ নিয়ে, কিছু কবিতা ধনী আর পুঁজিবাদীদের গালাগালি করে, কিছু কবিতা প্রেম প্রীতি নিয়ে। একখানা গান লিখতাম। ব্যস। ব্যক্তি হিসেবে যেমনই হই না কেন, যত মিথ্যুকই হই না কেন, যত চরিত্রহীনই হই না কেন, স্ত্রীকে যত এক্সপ্লয়েটই করি না কেন, যত অত্যাচারই করি না কেন, কেউ এসব নিয়ে কথা বলত না। বরং ভালবাসত আমাকে, মাথায় তুলে রাখত। আমার নামে মেলা করত বছর বছর। স্রেফ আমি পুরুষ বলে। পুরুষ হলে যৎসামান্য ট্যালেন্ট থাকলেই সেলেব্রিটি হওয়া যায়। মেয়ে হলে পাহাড় সমান ট্যালেন্ট দেখাতে হয় জাস্ট একটু রিকগনিশন পাওয়ার জন্য’।

উপরের ওই কথাগুলোই কাল আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছি। আর তাতেই দেখছি কমেন্টসের ঘরে উপচে পড়ছে মানুষের রাগ। আমার ওপর রাগ। কেন বিনয় নেই আমার লেখায়! কেন এত হীনমন্য আমি! কেন মনে মনে এত হিংসে আমার! আমাকে গালি দিতে কখনো কারওর কোনো অসুবিধে হয়নি। আজও হচ্ছে না। আমিই বোধহয় জগতে একজন মানুষ, একজনই লেখক, যাকে গালি দিলে, যার সম্পর্কে অকথ্য ভাষায় মিথ্যে বললে, যার সঙ্গে চরম অন্যায় আর অশোভন আচরণ করলেও কেউ আপত্তি করে না, কেউ অসন্তুষ্ট হয় না। আসলে সত্যি কথা হলো, আমার নিন্দেমন্দ করলে জাতে ওঠা যায়। মানুষ জাতে উঠতেই চায়। জাতে ওঠার এত মসৃণ সিঁড়ি বুঝি দ্বিতীয়টি নেই। বুদ্ধিজীবী হতে গেলেও কিছুটা তসলিমা বিরোধী না হলে হয় না। এ তো আজ থেকে দেখছি না। পঁচিশ বছর হলো। নারীর আত্মবিশ্বাস কোনোকালেই কেউ পছন্দ করেনি। শত্রুর প্রতিও নারী মায়া দয়া দেখাক, অত্যাচারীকে ভালবাসুক, মানুষ চায়! রুখে ওঠা পুরুষকে মানায়, নারীকে নয়। চোখের জল ফেলা নারীকে মানায়, চোখের জল মুছে চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ানো আর যাকেই মানাক, নারীকে নয়। এ আমরা সকলেই মনে মনে জানি। আমার জানাটা মাঝে মাঝে প্রকাশ করে ফেলে বিপদ বাঁধাই।

আমি কি ভুল কিছু লিখেছি? যদি পুরুষ হতাম, আমাকে কি বাধ্য হতে হতো দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে? নব্বই দশকের শুরুতে দেশে তো আরও নাস্তিক লেখক ছিলেন, তাঁরা তো দিব্যি ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে লক্ষ লোকের মিছিল হয়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়নি, তাঁদের মাসের পর মাস আত্মগোপন করে থাকতে হয়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে সুইসাইড স্কোয়াডও গঠন হয়নি। আমি পুরুষ নই, অথচ আমি ধর্ম নিয়ে কথা বলেছি, আমি নারীর অধিকারকে মানবাধিকার বলে রায় দিয়েছি, আমার ধৃষ্টতা কারওর সহ্য হয়নি। সেই যে সহ্য হয়নি। আজও সহ্য হয় না। বাইশ বছর পার হল, আজও না।

যদি পুরুষ হতাম, আমাকে নিয়ে উৎসব হতো। হ্যাঁ, হতো। নারী নিয়ে একখানা মাত্র অনুবাদ জাতীয় বই লিখলেই হতো। নারী হয়ে নারীর যন্ত্রণা আর পরাধীনতা উপলব্ধি করে নারীর অধিকারের পক্ষে বইয়ের পর বই লিখলে যা হতো, তার চেয়ে বেশি হতো। পুরুষের প্রতিভার প্রচার ততটাই হয়, যতটা হয় নারীর রূপের প্রচার, অথবা তার বদ-চরিত্রের প্রচার। পুরুষ হওয়ার আনন্দ যে কী তা পুরুষ-লেখকদের দেখলেই বুঝি। তাঁদের চরিত্র নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। অতি বদ-পুরুষকেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ অভ্যস্ত। দুশ্চরিত্র পুরুষ দ্বারা এক্সপ্লয়েটেড হয়েছি আমি, তারপরও আমাকেই লোকে নিন্দে করেছে, দুশ্চরিত্র পুরুষকে বরং ভালবেসে আলিঙ্গন করেছে, শ্রদ্ধায় নত হয়েছে। এই দৃশ্যের আজো কোনও বদল হলো না।

আমার চরিত্র নিয়ে প্রচুর লোকের মাথাব্যথা। যাদের মাথাব্যথা, তারা আমার সম্পর্কে নানারকম অপপ্রচার বাজারে চালু রেখেছে। এসব অপপ্রচার দিয়ে তরুণ তরুণীদের মগজধোলাই করা খুবই সহজ। আমার বই পড়ে কারও চেতন যদি জেগে ওঠে, তবে যেন অপপ্রচার শুনে চেতনকে হটিয়ে দিতে পারে দ্রুত, এরকম একটি অশুভ চক্র বরাবরই বড় সক্রিয়। একের অধিক পুরুষ আমার জীবনে এসেছে, এ নিয়ে পুরুষের সমাজে নিন্দের ঝড় ওঠে। দুশ্চরিত্র পুরুষ থেকে বাঁচার জন্য কী কঠিন সংগ্রাম আমাকে করতে হয়েছে, কীভাবে একা একা জীবনভর একা থেকেছি— এসব নিয়ে কারও উৎসাহ উত্তেজনা নেই। কোনোদিন শুনিনি কোনও দুশ্চরিত্র পুরুষ-লেখক নিয়ে কোনও নিন্দে। পুরুষ সে ভালো লিখুক কী মন্দ লিখুক, তাকে বিচার করা হয় তার লেখার প্রতিভা দিয়ে। নারী সে ভালো লিখুক কী মন্দ লিখুক, তাকে বিচার করা হয় সে ক’টা পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করলো, তা দিয়ে। যেহেতু তসলিমা তার স্বামীকে ডিভোরস করেছে, তসলিমা খারাপ। আর যেহেতু তসলিমা দ্বিতীয় কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করেছে, তসলিমা খারাপ। এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন নারীর বিরুদ্ধে যাবতীয় বৈষম্যের প্রতিবাদ হয় সারা পৃথিবীতে, তখনও নারীবিদ্বেষী আচরণের সামান্যও হেলদোল দেখছি না বাংলাদেশে।

প্রশ্ন ওঠে, আরও তো নারী-লেখক আছে, তাদের তো ঘৃণা করা হয় না। ঘৃণা করা হয় না, তার পেছনে নানারকম কারণ নিশ্চয়ই আছে। ওই নারী-লেখকরা নিশ্চয়ই পুরুষ-লেখকদের বা পুরুষ-কর্তাদের আশীর্বাদ পান। ওই নারী-লেখকরা তসলিমার মতো খামোকা অপ্রিয় সত্য কথা লিখতে যান না, সেলেব্রিটিদের গোপন কথা ফাঁস করে দেন না। একের অধিক পুরুষ তাদের জীবনে নেইও। তসলিমা পলিগ্যামাস না হলেও তার সিরিয়াল মনোগামিটাও সহ্য হয় না। কত যে পুরুষের ইচ্ছে করে আমাকে বিবস্ত্র করে অপমান করতে, অপদস্থ করতে, আমাকে ধর্ষণ করতে। ফেসবুকের ইনবক্সে হাজারো মেসেজ পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে কিছু পড়ি। আমাকে নোংরা ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে অথবা আমাকে ধর্ষণ করলে মনের সাধ মিটত, তা লিখছে। ওদের প্রোফাইলে গিয়ে দেখি প্রায় সকলেরই দেওয়ালে প্রার্থনার আহ্বান জানানো। যদি পুরুষ হতাম, আমার ফেসবুক ইনবক্স এসব উপদ্রব থেকে অন্তত বাঁচত।

যুগ বদলেছে। মানুষ আগের চেয়ে আরও নৃশংস হয়েছে। আজকাল পুরুষ-ব্লগারও দিনে দুপুরে খুন হচ্ছে। ধর্মীয় রাজনীতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ আমরা স্বচোখে দেখছি। গোটা পৃথিবীটা মনে হচ্ছে হাজার বছর পেছনে চলে গেছে। গণধর্ষণও করা হচ্ছে, শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। নারীর বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতার, পুরুষতান্ত্রিকতার, নারীবিরোধী আইনের আর কুসংস্কারের, মানুষের নারীবিদ্বেষী আচার-আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই করছি আজ তিন যুগেরও বেশি। একসময় বলা হত আমি বাড়াবাড়ি করছি, নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার যা পাওয়ার তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে। হ্যাঁ, বলা হত। আমাকে বারবারই একঘরে করা হত। পুরুষবাদি পুরুষরাই শুধু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না, পুরুষবাদি নারীরাও করত। যা ঘটছে চারদিকে, তা দেখেও কি মনে হচ্ছে আমি কখনো কিছু বাড়িয়ে বলেছিলাম?

পুরুষকে চিরকালই আমি সহযাত্রী ভেবেছি। মুশকিল হলো, পুরুষ কখনও আমাকে সহযাত্রী ভাবেনি। ভেবেছে প্রতিপক্ষ, নয়তো অকিঞ্চিৎকর কিছু, নেহাত যৌনবস্তু ছাড়া কিছু নয়। এখনও মানুষের আগ্রহের সীমা নেই ঠিক ক’জনের সঙ্গে আমি শুয়েছি এ নিয়ে। কোনও পুরুষ-লেখক নিয়ে এই আগ্রহ কিন্তু একেবারেই জনসাধারণের মধ্যে নেই। যদি কখনও জানাজানি হয় পুরুষ-লেখকের দ্বিচারিতার কথা, তাতে বরং পুরুষ-লেখককেই হিরো হিসেবে দেখে সবাই। তার ক্যারিশমার বিস্তর প্রশংসা হয়।

যদি পুরুষ হতাম, জীবন অন্যরকম হতো। এভাবে নির্বাসনে কাটাতে হতো না বাকি জীবন। যদি পুরুষ হতাম, আমার সাহিত্য-কর্মের সাহিত্যমূল্য নিয়ে কারও সংশয় হতো না। যদি পুরুষ হতাম, প্রতিভার সঠিক অথবা অধিক মূল্য পেতাম, যদি পুরুষ হতাম, আমাকে লেখক হিসেবে দেখা হত, যৌনবস্তু হিসেবে নয়। যদি পুরুষ হতাম, আমার বই একের পর এক নিষিদ্ধ হতো না, নিষিদ্ধ হলেও বাকস্বাধীনতার পক্ষের লোকেরা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করত। পুরুষ হলে এভাবে যুগের পর যুগ আমার বই জাল হতে পারত না। অন্য কারও নোংরা বই আমার নামে ছাপা হত না। পুরুষ হওয়ার সুবিধে অনেক।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ জুন, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *