যদি এমন হত

যদি এমন হত

যদি এমন হত।

কোনও দেশনায়ক আমার মতোই সাড়ে তিনশো টাকা ভাড়ার দেড় কামরার একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। পুব দিকের পুঁচকে জানালা দিয়ে সকালের প্রথম রোদ সোনালি পাখির মতো উড়ে এসেই উড়ে চলে যায়। সারাদিনের জন্যে একটা পালকও ফেলে রেখে যায় না। ছোট্ট সুটকেসের মতো রান্নাঘর আর বাথরুম। মাঝখানের প্যাসেজ প্রাইমারি সেকসানের মাপে। বেগ এলে সবেগে ধাবিত হলে দেয়ালে ঘষা লেগে শরীরের নুনছাল উঠে যাবে। প্রাচুর্যে, আনন্দে, স্বাস্থ্য ফুলে উঠলে ভয়ের কারণ। বাথরুমে অ্যাকোমোডেসান হবে না। দু-দেয়ালের মাঝে পশ্চাদ্দেশ আটকে যাবে, যেমন ডেকচির মধ্যে থালা আটকে যায় বেকায়দায়। জলের ব্যবস্থা ছোটো একটি হ্যাঁচকল। বার কয়েক হ্যাঁচোর-হ্যাঁচোর করলে এক চুমুক জল বেরোয়। যার ফলে ডান হাতটা আমাদের শালপ্রাংশু মহাভুজ, বাঁ হাত লিকলিকে। অথচ এ দেশের নিয়ম অনুসারে বামহস্তের স্বাস্থ্যই ভালো হওয়া উচিত ছিল। যাঁরা বাল্যে ঘুড়ি ওড়াতেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, টানটান বাতাসে ভস করে ঘুড়ি উবড়ে গেলে মনে আচমকা কেমন একটা শূন্যতা নেমে আসত! মাসের প্রথমে সামান্য উপার্জন থেকে সাড়ে তিনশো চলে গেলে ভেতরটা নিজের অজান্তেই যা: করে ওঠে। মনের দুটো পা আকাশের দিকে তাকিয়ে, খানাখন্দ পেরিয়ে ছুটতে থাকে, সাড়ে তিনশো টাকার চাঁদিয়াল ঘুড়ির পেছনে। দোতলার বারান্দায় বিষম চেহারার গৃহস্বামী অনুচ্চারিত ইশারায় বলতে থাকেন, ধরে ফেলেছি বৎস। ঘুড়ি এখন আমার হাতে। সেবার আশ্বিন মাসে মজ:ফরপুর থেকে শ্বশুর মহাশয় এলেন কন্যা-সন্দর্শনে। প্রথম ভোরেই বাথরুম-ব্যবহার-বিধি অবহেলা করার বিষম কোণে এমন বেখাপ্পা আটকে গেলেন, সামনের দোকানের ভুজাওয়ালা এসে শেষ পরামর্শ দিলে, দেয়াল উতারকে কত্তাকো নিকালনে পড়েগা। ভদ্রলোক আতঙ্কে চুপসে গেয়ে ঘণ্টাখানেক পরে নিজেই বেরিয়ে এসে বললেন, বাবাজীবন, এ যে দেখি কিন্ডারগার্টেন বাড়ি, প্রমাণ সাইজের মানুষ থাকে কি করে?

না, তা হয় না। দেশ নায়করা ঈশ্বরের ‘রিবন-টায়েড বেবি’।

যদি এমন হত, একটি উত্তর পুরুষের আগমন সংবাদে কোনও দেশনায়ক আমার মতোই মনে-মনে, এই-রে বলে, নি:শব্দে একটি হেঁচকি তুলতেন! মনের আকাশে সাঁঝের আঁধার দেখতেন, দেখতেন গোটা কতক দুশ্চিন্তার বাদুড় লাট খাচ্ছে। প্রথম চিন্তা, শিক্ষা। খাই না খাই মধ্যবিত্তের ছেলেকে লেখাপড়া তো শেখাতেই হবে। কিন্তু কোন বিদ্যালয়ে? জন্মের আগেই যেখানে লাইন পড়ে আছে। প্রবেশ পথ সেখানে অতি সঙ্কীর্ণ। মহামানবের সন্তান ছাড়া যেখানে প্রবেশপত্র মেলা ভাগ্যের খেলা। অর্থহীন মানবের পিতা হওয়া যে সমাজে অর্থহীন সেখানে সন্তানের আগমনে শঙ্খ-ঘণ্টা আর বাজে না, বাজে বেহালা কাঁদুনে সুরে। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকে, আমি হেরেছি, জোর করে আর একজনকে টেনে এনেছি, পরাজিতের মিছিলে। কৈশোরেই যার বার্ধক্য নামবে। পথ না পেয়ে বিপথে ছুটবে। শৈশবের অচেতন হাসি সচেতন হতাশায় জীবিতের খোলে মৃত্যুকে ভরে দেবে, যার আধুনিক নাম, ফ্রাসট্রেশান।

না, তা হয় না। দেশ নায়করা অন্য কোটির মানুষ। সিংহাসন টলে গেলেও মরা হাতি লাখ টাকা।

এমন যদি হত, কোনও দেশ নায়ক মেয়ের বিবাহের দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে ছেলের সন্ধানে ঘুরছেন। মেয়েটি ডানাকাটা পরী নয়। চলনসই দেখতে। শান্তশিষ্ট এবং ভদ্র। আপস্টার্ট নয়। আধুনিকতার দুরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধিতে ভুগছে না। গৃহকর্মে প্রকৃত সুনিপুণা, বিজ্ঞাপনের কথা নয়। ছেলে পছন্দ হয় তো, ছেলের মেয়ে পছন্দ হয় না। সব হয় তো, দেনাপাওনার ফয়সালা হয় না। ছুটির দিন নীল শাড়ি পরে, সামান্য সেজেগুজে, বাইরের ঘরে ভীরু পায়ে গুঁফো গুঁফো এক দল শিকারীর সামনে এসে বসে। শিকারীরা ধূর্ত চোখে শিকারটিকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখেন, চা জলখাবার ধ্বংস করেন। পাকা পাকা প্রশ্ন করেন। কিছু প্রশ্ন ইডিয়েটের মতো। তারপর উঠে চলে যান। সকলেরই মুখ বড় ডাক্তারের মতো। বোঝার উপায় নেই রুগি বাঁচবে কি মরবে? চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে বলা যাবে না। ডাক্তাররা যেমন বলেন আর কি! ছেঁড়া চটি পায়ে দেশনায়ক এসে দাঁড়িয়েছেন খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের কাউন্টারে, বিজ্ঞাপন কর্মীর পরামর্শ নিচ্ছেন, কি করলে খরচ আর একটু কমবে? কমা, পূর্ণচ্ছেদ সব উড়িয়ে মন্ড পাকিয়ে দিন। সু: মানে সুশ্রী, গৃ: ক: নি: মানে গৃহকর্মে নিপুণা। শি:, দ: রা: কুড়ি। শি: পা: চাই। নিন লিখুন, সুগৃকনি শি দরা কুড়ি শিপা চাই। এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত আর কি হবে? খুঁত-খুঁত করবেন না, হলে এইতেই হবে। চিঠি এখানে এসে কালেক্ট করে নিয়ে যাবেন। খরচ বাঁচবে। কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে দেশনায়ক অনেক ভেবে এক ভাঁড় চা খাবেন। চায়ে চুমুক দিতে-দিতে একটি সিনেমা পোস্টারের দিকে তার চোখ চলে যাবে। ছবিটির নাম হবে হয়ত এইরকম, প্রেম কি সৌগন্ধ। সুন্দর নায়ক আর নায়িকার মুখ বড় কাছাকাছি। স্বপ্নের মতো রঙে আঁকা। দেশনায়ক তাঁর জীবনের অতীতে চলে যাবেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গঙ্গার ধার, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, অতীত ফিরে আসতে থাকবে ধোঁয়ার মতো। চায়ের দাম মিটিয়ে তিনি গুটি-গুটি হাঁটতে থাকবেন ভাঙাচোরা শহরের উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে। স্বপ্নের মতো শহরও হারিয়ে গেছে। জীবনের সঙ্গে তাল রেখে বিবর্ণ, হতশ্রী হতে শুরু করেছে।

দেশনায়ক সন্ধ্যের মুখে ফিরে আসবেন। তাঁর কিন্ডারগার্টেন ফ্ল্যাটে। এসে দেখবেন, তাঁর পরাজিতা কন্যা একপাশে বসে রাতের রুটি বেলছে। ফর্সা রোগা রোগা দুটি হাত, ক্ষয়া ক্ষয়া দুগাছা চুড়ি, সেফটিপিন ঝুলছে। যে হাত এই পৃথিবীর সঙ্গে লড়াইয়ের পক্ষে বড়ই দুর্বল। কিছু দূরেই জীবননায়িকা। জীবনের যত ভালো-ভালো কথা বসন্তের উতলা বাতাসে শোনানো হয়েছিল সবই এখন স্বপ্নের পাখি। মরা আঁচের মতো চেহারা। চুলের ধারে-ধারে ছাই। সব আগুন চোখের মণিতে কেন্দ্রীভূত।

দেশনায়ক ঘরে এসে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পাবেন। অকাল বার্ধক্য নেমে এসেছে। কপালের মাঝখানে একটি শিরা উঠেছে, ক্রীতদাসের রাজটীকার মতো। পোস্টারের নায়ক পোস্টারেই রয়ে গেল, আয়নায় পরাজিত নায়ক। না, তা হয় না। সকলকে সচকিত করে, ওঁয়া-ওঁয়া শব্দ তুলে দেশনায়ক ছুটছেন দূরে বহু দূরে, এই মর্তলোকের বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *