যদি

যদি

ঠিক সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেল সবুজ৷ স্নান করে এসেছে, নিখুঁত চুল আঁচড়ানো, প্যান্ট-শার্ট, জুতো-মোজা পরা, কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগ৷ টিকিট আগে থেকেই কাটা আছে, সে প্ল্যাটফর্ম খুঁজতে লাগল৷ সবুজের বয়েস চোদ্দো বছর পাঁচ মাস, সে ক্লাস নাইনে পড়ে৷ সবুজ এই প্রথম একা-একা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে বাইরে যাচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, সে যাচ্ছে চাকরি করতে৷ চাকরিটা অবশ্য এক মাসের জন্য, তাতেও সে বেশ কয়েকশো টাকা মাইনে পাবে৷

ট্রেনে নিজের কামরা খুঁজে পেয়ে সবুজ দেখল অতীশ, বন্যা, আকাশ, জয়দীপ, রম্যাণি, তার আরও তিন-চারজন বন্ধুও এসে গেছে৷ নতুন নিয়ম হয়েছে, কলকাতার সব স্কুলের ক্লাস নাইনের ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের গরমের ছুটিতে এক মাসের জন্য চাকরি করতে যেতেই হবে৷

ট্রেন ছাড়ার পর ওরা সবাই মিলে অন্তাক্ষরী গানের খেলা খেলতে লাগল৷ তারপর কিছুক্ষণ গল্প৷ এক-একজন যাবে এক-এক জায়গায়, সবুজ স্টেশনের নামগুলির দিকে লক্ষ রাখছিল, মেমারি স্টেশন আসতেই সে বন্ধুদের কাছে বিদায় জানিয়ে নেমে পড়ল৷ এবার সে একেবারেই একা৷ মেমারি থেকে সাইকেল রিকশায় চেপে তাকে যেতে হবে আরও অনেকটা দূরে৷

হাতে ঠিকানা লেখা কাগজটা নিয়ে দামালপুর গ্রামের হাই স্কুলের সামনে রিকশা থেকে সবুজ নামল ঠিক পৌনে এগারোটার সময়৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন হেডমাস্টারমশাই, বেশ গম্ভীর চেহারা, নাকের নীচে মোটা গোঁফ আর চোখে কালো চশমা৷ তিনি বললেন, ‘‘এসো, তোমারই নাম সবুজ দাশগুপ্ত? একটু পরেই ঘণ্টা বাজবে, তুমি ক্লাস এইটে অঙ্ক পড়াবে৷’’

সবুজের বুকটা ঢিপঢিপ করছে, ভাগ্যিস সেই আওয়াজ অন্য কেউ শুনতে পায় না! গ্রামের নাম দামালপুর, এখানকার ছাত্ররা কেমন হবে কে জানে? তাকে মানবে তো? ক্লাস এইটে অঙ্ক পড়াতে অবশ্য তার ভয় নেই, কিছুদিন আগেই ক্লাস এইট থেকে ফার্স্ট হয়ে সে ক্লাস নাইনে উঠেছে৷ অঙ্ক তার সব জানা৷

ক্লাসের ছেলেরা অবশ্য সবুজকে দেখে খুব অবাক হল না৷ গত দু-তিন বছর ধরেই গ্রামের ইস্কুলে কয়েকজন করে খুদে মাস্টার আসছে শহর থেকে৷ এই মাস্টারটির নামও তারা জানে৷ মজা করার জন্য আগে থেকেই কে যেন ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে রেখেছে, ‘‘সবুজ, না অবুঝ?’’ ‘‘খুদে মাস্টার দাশগুপ্ত, চেয়ারে বসেই হল সুপ্ত!’’

সবুজ ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে হাসল৷ তারপর বলল, ‘‘তোমরা আমার নাম জানো দেখছি৷ ভালোই হয়েছে৷ আমাকে স্যার বলার দরকার নেই৷ যার ইচ্ছে, সবুজদা বলবে৷ শুধু নাম ধরেও ডাকতে পারো৷ অথবা ডাকনাম, টমটম, তাও বলতে পারো!’’

স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোর ধর্মমহাসভায় ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স বলে যেমন হাততালি পেয়েছিলেন, সবুজও প্রায় সেইরকমই হাততালি পেল সারা ক্লাস থেকে৷ সবাই বলতে লাগল, ‘‘টমটম, টমটম!’’ তারপর ছাত্রদের সঙ্গে তার ভাব জমতে দেরি হল না৷

সবুজের থাকার জায়গা ঠিক হয়েছে এক চাষির বাড়িতে৷ মাটির ঘর, তার ওপর খড়ের ছাউনি৷ বাসু মণ্ডলের চার ছেলে, এক মেয়ে, তার মধ্যে মেজো ছেলেটির নাম হিমালয়, সে সবুজেরই বয়েসি, ক্লাস নাইনে পড়ে৷ এদের বাড়িতে বেশি জায়গা নেই, তাই রাত্তিরে হিমালয়ের সঙ্গে একই তক্তপোশে শুতে হয় সবুজকে৷ দু’জনে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে৷ সবুজ অনেক বই পড়েছে, হিমালয় সেসব বইয়ের খোঁজও রাখে না, কিন্তু সে অনেক কিছু জানে৷ কত গাছের নাম জানত না সবুজ৷ সেগুলো হিমালয় তাকে চিনিয়ে দেয়৷ ওদের বাড়ির পাশেই একটা বেগুনের খেত, অনেক বেগুন পাতায় পোকা লেগেছে৷ পোকা লাগলে কী ওষুধ স্প্রে করতে হয়, কেমনভাবে করতে হয়, তাও জেনে গেল সবুজ৷ সে শহরের ছেলে, এতদিন জলকে ভয় পেত, হিমালয় ওকে সাঁতার শিখিয়ে দিল সাতদিনে!

সকালবেলা ওরা পান্তাভাত খায়৷ তার সঙ্গে গন্ধ লেবু আর কুচো চিংড়ির তরকারি৷ প্রথমদিন সবুজ আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ তার রোজ টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ খাওয়া অভ্যেস, পান্তাভাত সে জন্মে খায়নি৷ কিন্তু ওদের কথামতন মেখে-টেখে নিয়ে এক গেরাস মুখে তুলে দেখল, বেশ লাগে তো! দুপুরে গরম-গরম ভাত, যে-কোনও ডাল আর পুঁইশাকের তরকারি৷ এক-একদিন মাছ থাকে৷ সবুজের কোনও অসুবিধে হয় না৷ রাত্তিরে ভাতের সঙ্গে গরম দুধ৷

এক মাস ধরে সবুজ খাচ্ছে হিমালয়দের বাড়িতে৷ সেজন্য তার কোনও পয়সা লাগে না৷ পয়সা দিতে হবে কেন? পুজোর ছুটির সময় হিমালয় কলকাতায় গিয়ে সবুজদের বাড়িতে থাকবে এক মাস৷ পুজোর সময় গ্রামের স্কুলের ক্লাস নাইনের ছেলেরা এইসব খুদে মাস্টারদের বাড়িতে এক মাস কাটিয়ে আসবে, এইরকমই যে নিয়ম হয়ে গেছে এখন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *