‘যত মত তত পথ’

‘যত মত তত পথ’

শ্রীরামকৃষ্ণ বড় সুন্দর একটা গল্প বলতেন। একজন ভক্ত ছিলেন, তিনি শিবের ভক্ত। শিবকে মানেন, আর কোন দেব-দেবীকে মানেন না। শিব তাঁকে বরাবরই বলেন, দেখ বাপু, এরকম কোরো না—অন্য দেব-দেবীকেও তোমার মানা উচিত। কিন্তু সেই ভক্ত কিছুতেই শিব ছাড়া অন্য কোন দেব-দেবীকে মানবেন না। তাঁর বিশেষ রাগ আবার বিষ্ণুর প্রতি। শিব বলছেন; দেখ, বিষ্ণুও তো আমি, তাঁকে তুমি মানবে না কেন? ভক্তের সেই এক গোঁ—তোমাকে জানি, আর কাউকে জানি না। একদিন তিনি পুজো করতে বসেছেন, দেখলেন যে তাঁর ইষ্টমূর্তির অর্ধেকটা শিব, বাকি অর্ধেকটা বিষ্ণুমূর্তি। তিনি তখন মূর্তির যে-দিকটা বিষ্ণু সেদিকে না তাকিয়ে শুধু শিবের দিকটায় তাকিয়ে পুজো করতে লাগলেন। সমস্যা হল ধূপধুনো নিয়ে। ধূপধুনো জ্বেলে দিয়েছেন, তার গন্ধ তো বিষ্ণুর নাকেও যাচ্ছে। কি করা যায়? একটু তুলো নিয়ে তিনি বিষ্ণুর নাকে গুঁজে দিলেন। এইভাবে তিনি পুজো করলেন। এদিকে লোকে জেনে গেল, ইনি বিষ্ণুকে মোটেই পছন্দ করেন না। তিনি রাস্তায় বেরোলেই সবসময় লোকে বিষ্ণুর নাম করে। তিনি চটে যান, লাঠি নিয়ে লোকদের তাড়া করেন, লোকে ততই বিষ্ণুর নাম করতে থাকে। তখন তিনি পাছে বিষ্ণুর নাম কানে যায় এই জন্য দুই কানে দুটো ঘণ্টা বেঁধে নিলেন। রাস্তায় যখন লোকে বিষ্ণুর নাম করে তখন হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা দুটো বাজে, ঘণ্টার শব্দে বিষ্ণুর নাম আর তাঁর কানে যায় না। তখন থেকে তাঁর নাম হয়ে গেল ঘণ্টাকর্ণ। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, গোঁড়ামি, একদেশদর্শিতা কতটা তীব্র হতে পারে তার একটা উদাহরণ দিচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণ এই গল্পের মধ্য দিয়ে।

শ্রীরামকৃষ্ণের একটা কথা আমরা ‘কথামৃত’তে বার বার পাই: মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) কোরো না।(১-১২-৯) অর্থাৎ সঙ্কীর্ণতা রেখো না। আমার মতটাই একমাত্র মত, আমার পথটাই ঠিক—এই মত না মানলে, এই পথ না নিলে তুমি নরকে যাবে—একথা কখনও বোলো না! যেযুগে শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন, এই অনুদারতা খুব ছিল। এখনও যে সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেছে বলতে পারি না। একবার একজন খ্রীষ্টান পাদরী আমাকে বলেছিলেন: If a Moslem goes to Heaven he goes by mistake. বলছেন; ওটা ওর জায়গা নয়—ভুল করে ঢুকে পড়েছে। এই অনুদার ভাবটা তখন খুবই প্রবল ছিল—আমাদের দেশে ছিল, অন্য দেশেও ছিল। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: না, তা নয়। আমার দেবতাই একমাত্র দেবতা, আমার পথই একমাত্র পথ, এরকম ভাবতে নেই। ধর্মজগতে শ্রীরামকৃষ্ণের এই একটা মহৎ বাণী: মতুয়ার বুদ্ধি কোরো না।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: অমৃত-সাগরে যাবার অনন্ত পথ। (১-১১-৪) ঈশ্বর অনন্ত, তাঁর কাছে যাবার পথও অনন্ত। যিনি নিজে অনন্ত, তাঁর সম্বন্ধে তুমি কি করে বলতে পার যে, তাঁকে এই একটি পথেই পাওয়া যায়? তাহলে তো ঐ একটা পথের কাছে তিনি বাঁধা পড়ে গেলেন। তিনি তো তাহলে আর অনন্ত রইলেন না, অসীম রইলেন না। তাহলে তো তাঁকে অনেক ছোট করে ফেললাম আমি। তাই বলছেন: অনন্ত পথ। (ঐ) শ্রীরামকৃষ্ণের সেই বিখ্যাত কথা: যত মত তত পথ। বাস্তবিক এমন কথা বলবার অধিকারী শুধু তিনিই ছিলেন। অন্যেরা যখন বলেন, সে শুধু কথার কথা। কিন্তু ঠাকুর বলছেন নিজে উপলব্ধি করবার পরে। কোনরকম সাধনা তো তিনি বাদ দেননি। শ্রীরামকৃষ্ণের সাধক-জীবনের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় যে, কত রকম মত ও পথ দিয়ে তিনি গেছেন। একেবারে ‘অ’ থেকে আরম্ভ করে সেই ‘চন্দ্রবিন্দু’ পর্যন্ত। আমরা তো জানি, তিনি মা-কালীকে ডেকে তাঁর দর্শন পেলেন প্রথম। সন্তানভাবে সাধনা করে মায়ের দেখা পেলেন। তারপরেও আবার দাস্যভাবে সাধনা করবার, রামকে ডাকবার কি দরকার ছিল তাঁর? হনুমানের মতো সেজে গাছে গাছে ঘুরে বেড়াতেন, আর মুখে উচ্চারণ করতেন ‘রঘুবীর রঘুবীর’। সেইভাবে তিনি রামের দেখা পেলেন। আবার ভৈরবী ব্রাহ্মণীর কাছে তন্ত্রসাধনা করতে গেলেন কেন? তন্ত্র আবার শুধু একটা-আধটা নয়, চৌষট্টিখানা তন্ত্রে যতরকম সাধন-পদ্ধতি আছে সব তিনি অনুষ্ঠান করেছিলেন, সবগুলো পদ্ধতিতে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। আবার দেখি, মধুরভাবে শ্রীকৃষ্ণকে ডাকছেন। ছ’ মাস রমণী সেজে আছেন। নিজেকে ভাবছেন রাধারানী, শ্রীমতী। সবসময় ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলছেন। আর আশ্চর্য! ভক্তিগ্রস্থে রাধারানী বা শ্রীচৈতন্যের মহাভাবের যে-সমস্ত লক্ষণ আছে সব তাঁর আচার-আচরণে ফুটে উঠছে, শরীরেও প্রকাশ পাচ্ছে। এই মধুরভাব লোকে একটা কদর্য জিনিস বলে মনে করত। ঠাকুর সেই পথ দিয়ে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেলেন। বৃন্দাবনলীলা যে মিথ্যা নয়, এটা তিনি প্রমাণ করলেন। আবার বাৎসল্যভাবে সাধন করছেন। জটাধারী নামে একজন রামাইত সাধু তাঁকে একটা রাম-মৃর্তি দিয়েছিলেন। বালক রামের মূর্তি—‘রামলালা’ মূর্তি। তাকে নিয়ে ঠাকুরের যে-সাধনা তা তো লোকে বিশ্বাস করবে না। ঠাকুর যেন স্নেহময়ী জননী আর রাম তাঁর সন্তান। ঠাকুর যেখানে যান, রামলালাও সেখানে যায়, ছেলে যেমন মায়ের সঙ্গে ঘুরঘুর করে। মাঝে মাঝে রামলালা দুষ্টুমি করে, ঠাকুর আবার তখন তাকে শাসন করেন। একদিন ঠাকুর গেছেন নদীতে স্নান করতে, রামলালাও নদীতে নেমে ঝাঁপাই শুরু করেছে, কিছুতেই উঠতে চায় না। ঠাকুর শেষে রেগে গিয়ে, মা যেমন ছেলের উপর রেগে যান কখনও কখনও, রামলালাকে জলে চেপে ধরেছেন। জলের মধ্যে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, রামলালার কষ্ট হচ্ছে—শেষে আবার ঠাকুরের কান্না, তাঁর প্রিয়তমকে এত কষ্ট দিয়েছেন বলে। কী বিচিত্র সাধনা—ভক্ত জননী আর ভগবান সন্তান! সেইভাবে সাধনা করে ঠাকুর সিদ্ধিলাভ করলেন। দেখলেন সর্বত্র তাঁর রামলালা, শুধু ঐ মূর্তিতে নয়, সর্বত্র—যা নাকি সাধনার শেষ কথা। আবার দেখছি অদ্বৈতমতে সাধন করছেন। তোতাপুরী তাঁর গুরু। চল্লিশ বছর ধরে সাধনা করে যিনি সিদ্ধ হয়েছেন। ধ্যান করতে বসে গোলমাল বাধল তাঁর ‘মা’কে নিয়ে। ‘মা’ মানে গর্ভধারিণী মা নন, মা ভবতারিণী। মন কিছুতেই নির্গুণ নিরাকারে যেতে চাচ্ছে না। মন সব ছাড়তে পারছে, কিন্তু মাকে ছাড়তে পারছে না। মা এসে বারবার সামনে দাঁড়াচ্ছেন। ঠাকুর নিজের সম্বন্ধে বলছেন; শেষে জ্ঞান-অসি দিয়ে মাকে দ্বিখণ্ডিত করলাম। সঙ্গে সঙ্গে মন হুহু করে নামরূপের রাজ্য ছাড়িয়ে চলে গেল, নির্বিকল্প সমাধি হল। তোতাপুরীর যে-অবস্থায় পৌঁছতে চল্লিশ বছর লেগেছিল, মাত্র তিন দিনে ঠাকুর তা উপলব্ধি করলেন। এ তো গেল হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন মতে সাধনা। আবার দেখছি ইসলাম ধর্মেও তিনি সাধনা করছেন, নিজেকে মুসলমান ভাবছেন। এত মা-কালীকে ভালবাসেন—মা ছাড়া কিছু বোঝেন না, কিন্তু যখন ইসলাম ধর্মে সাধন করছেন তখন তিনি পুরোপুরি ইসলামধর্মীদের মতো আচরণ করছেন, মুসলমানদের মতো কাপড় পরছেন, নমাজ পড়ছেন, ভুলেও একবার মায়ের মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন না। মুসলমানী খাবারও খেয়েছিলেন কিছু কিছু। এমন কি গোমাংসও খাবেন বলে ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মথুরবাবুর অনুরোধে খাওয়া হয়নি। তিন দিন তিনি ইসলামধর্মে সাধন করেছিলেন। ঐভাবে সাধন করেও তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। যীশুখ্রীষ্টেরও দর্শনলাভ করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের কাছেই যদু মল্লিকের বাগানবাড়ি। সেখানে ঠাকুর মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতেন। ঐ বাগানবাড়ির বৈঠকখানা ঘরের দেওয়ালে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি ছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে: শিশু যীশুকে মেরী কোলে করে বসে আছেন। ঠাকুর তন্ময় হয়ে সেটা দেখছেন। হঠাৎ ঐ ছবি থেকে একটা জ্যোতি এসে তাঁর শরীরে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যত হিন্দুভাব, হিন্দু সংস্কার কোথায় চলে গেল। মানসিক দিক থেকে পুরো খ্রীষ্টান হয়ে গেলেন তিনি। দেখতে পেলেন: গির্জায় যীশুখ্রীষ্টের উপাসনা হচ্ছে, খ্রীষ্টভক্তেরা যীশুখ্রীষ্টকে ডাকছেন। তিন দিন ঠাকুরের ঐরকম ভাব ছিল। তিন দিনের দিন ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীর কাছে বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ দেখলেন, বিদেশী পোশাক পরা এক দেবপুরুষ, গৌরবর্ণ, অপূর্ব রূপ, তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। যীশুখ্রীষ্ট এসে ঠাকুরকে আলিঙ্গন করলেন, ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। এর বহু পরে, যখন ঠাকুরের কাছে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী সারদানন্দ এঁরা সব আসতে শুরু করেছেন, তখন একদিন যীশুখ্রীষ্টের প্রসঙ্গ হচ্ছে। কথাপ্রসঙ্গে যুবকেরা বলেছেন: যীশুখ্রীষ্টের খুব লম্বা টিকাল নাক ছিল। ঠাকুর বলছেন: কিন্তু আমি তাঁকে যেমন দেখেছিলাম, তাতে দেখেছিলাম, তাঁর নাক একটু চাপা। ঠাকুরের মহাসমাধির পর এই সব যুবক ভক্তেরা খুঁজে পেয়েছিলেন: যীশুর চেহারা সম্বন্ধে কয়েকরকম বিবরণ আছে, তার মধ্যে একটি বিবরণে সত্যিই বলা আছে যে, যীশুর নাক একটু চাপা ছিল। সাধারণত ইহুদিদের নাক যেমন টিকাল হয়, তাঁর নাক সেরকম ছিল না।

বাস্তবিক, ঠাকুরের সমস্ত জীবনটা যেন একটা বিরাট গবেষণাগার। সারা জীবন সেখানে তিনি গবেষণা করেছেন। ঈশ্বরকে কত ভাবে পাওয়া যায়, কত পথে পাওয়া যায়, এই যেন তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল। সেই গবেষণালব্ধ ফল তিনি আমাদের দিচ্ছেন, বলছেন: অনন্ত পথ।

ঠাকুর বলছেন: —জ্ঞান,কর্ম,ভক্তি—যে পথ দিয়া যাও, আন্তরিক হলে ঈশ্বরকে পাবে। মোটামুটি যোগ তিন প্রকার; —জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, আর ভক্তিযোগ। (ঐ) এখানে রাজযোগের কথা ঠাকুর বলছেন না। তাই বলছেন যোগ মোটামুটি তিন প্রকার। জ্ঞানযোগ—জ্ঞানী, ব্রহ্মকে জানতে চায়। (ঐ) ব্রহ্মকে জানলে সব জানা হয়ে গেল। কারণ এই জগৎ ব্রহ্মেরই বিকাশ। যদি আমি ব্ৰহ্মকে জানি, তা হলে এই জগৎকে জানা হল, জগতের যত কিছু জিনিস তার স্বরূপটা জানা হল। আর, ব্রহ্মকে জানা মানে ব্ৰহ্ম হয়ে যাওয়া। ‘ব্ৰহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি।’ যেমন নদী গিয়ে সমুদ্রে পড়ল। আর সে নদী নয়, সে সমুদ্র হয়ে গেছে। একাত্ম হয়ে গেল, একাকার হল—‘তদাকারাকারিত’। জ্ঞানী… ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এই বিচার করে। সদসৎ বিচার করে। (ঐ) জ্ঞানী বলে ‘ব্ৰহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা’, ‘অয়ং প্রপঞ্চো মিথ্যৈব’। ব্রহ্মই সত্য, এই জগৎপ্রপঞ্চ—এ মিথ্যা। একমাত্র সত্য হচ্ছে ব্ৰহ্ম। ঠাকুর বলছেন: এ যেন পেঁয়াজের উপর থেকে একটার পর একটা খোসা আমরা ছাড়িয়ে ফেলছি—নেতি নেতি। শেষে গিয়ে দেখা যায়, তিনিই সত্য, আর সব মিথ্যা। আর ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’—আমি সেই ব্ৰহ্ম। বলছেন: বিচারের শেষ যেখানে, সেখানে সমাধি হয়, আর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। (ঐ) সমাধি অর্থাৎ নির্বিকল্প সমাধি। তখন জ্ঞান, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা এক হয়ে যায়। তখন কোন ‘দুই’ বোধ থাকে না, ‘এক’ বোধ—আমি ব্রহ্ম, আমিই সব হয়েছি। বস্তুত, সে যে কি অবস্থা তা কেউ বর্ণনা করতে পারে না!

জ্ঞানযোগ সম্বন্ধে ঠাকুর বলছেন, এযুগের পক্ষে এই পথ খুব কঠিন। কলিযুগে মানুষের অন্নগত প্রাণ, জীবনধারণের জন্য সবসময় চেষ্টা করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় ‘আমি ব্ৰহ্ম, জগৎসংসার মিথ্যা’ এ বলা যায় না। হাতে কাঁটা ফুটে দরদর করে রক্ত পড়ছে, খুব লাগছে! অথচ মুখে বলছি: কৈ, আমার তো কিছু হয়নি। ঠাকুর বলছেন: এ কখনও হয় না। আমাদের দেহবুদ্ধি সহজে যেতে চায় না, আর যতক্ষণ দেহবুদ্ধি আছে ততক্ষণ এই জ্ঞানপথে চলা শক্ত, চললে সেটা মিথ্যাচার হয়ে দাঁড়ায়। সর্বসাধারণের জন্য এই পথ নয়। এই পথে চলবার লোক খুব কম।

আর কর্মযোগ? কর্ম দ্বারা ঈশ্বরে মন রাখা।…সংসারী লোকেরা যদি অনাসক্ত হয়ে ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করে, তাঁতে ভক্তি রেখে, সংসারের কর্ম করে, সেও কর্মযোগ। (ঐ) অর্থাৎ ঈশ্বরে মন রেখে যাবতীয় কাজকর্ম করা। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙা, যাতে হাতে আঠা না লাগে। সংসার তাঁর, সব তাঁর জিনিস। আমি তাঁর প্রতিনিধি, তাঁর যন্ত্র—তিনি আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নিচ্ছেন। আমি সবার প্রতি সব কর্তব্য করে যাচ্ছি, কিন্তু ফল প্রত্যাশা করছি না। সংসার তাঁর, ফলও তাঁর। ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করে পূজা জপাদি কর্ম করার নামও কর্মযোগ। ঈশ্বরলাভই কর্মযোগের উদ্দেশ্য।(ঐ) ‘চিত্তস্য শুদ্ধয়ে কর্ম’।—চিত্তের শুদ্ধির জন্য কর্ম। ফলাকাঙক্ষা না রেখে কাজ করতে করতে চিত্তশুদ্ধি হয়। চিত্তশুদ্ধি হলে ঈশ্বর লাভ হয়।

কর্মযোগ সম্বন্ধে ঠাকুর বলছেন: কর্মযোগও খুব কঠিন। অনাসক্ত হয়ে, ফল কামনা না করে, কর্ম করা ভারী কঠিন। ঈশ্বর লাভ না করলে ঠিক অনাসক্ত হওয়া যায় না। তুমি হয় তো জান না, কিন্তু কোথা থেকে আসক্তি এসে পড়ে। (ঐ) তবে এটাও ঠিক যে, কাজ না করে আমরা বেঁচে থাকতে পারি না। যেটুকু কাজ আমার আছে, সেটুকু আমি অনাসক্ত হয়ে করব, তার ফল আমি ঈশ্বরে সমর্পণ করব। ঈশ্বরের কাছে তাই প্রার্থনা করতে হয় যে, যতদিন না তোমায় লাভ করতে পারি, ততদিন পর্যন্ত যেন কর্ম কমে যায়। যেটুকু কর্ম থাকবে, সেটুকু কর্ম যেন অনাসক্ত হয়ে করতে পারি, …আর যতদিন না তোমায় লাভ করতে পারি, ততদিন কোন নৃতন কর্ম জড়াতে মন না যায়। তবে যখন তুমি আদেশ করবে তখন তোমার কর্ম করবো, নচেৎ নয়। (ঐ)

আর ভক্তিযোগের কথা ঠাকুর বলছেন যে,ঈশ্বরের নাম গুণ কীর্তন এই সব করে তাঁতে মন রাখা। কলিযুগের পক্ষে ভক্তিযোগ সহজ পথ। (ঐ) ভাগবতে ভগবান বলছেন: ‘অহং ভক্তপরাধীনঃ’— আমি ভক্তের অধীন। ‘অস্বতন্ত্রঃ’—আমার কোন স্বাতন্ত্র নেই, স্বাধীনতা নেই ভক্তের কাছে। ভক্ত আমাকে বশ করে রাখে। তার ভালবাসার আকর্ষণে আমি বাঁধা পড়ে থাকি। আমাদের ভক্তি শাস্ত্রে প্রেমকে সেই জন্য বলা হয়েছে রজ্জু। সেই রজ্জু দিয়ে ভক্ত ভগবানকে বেঁধে রাখে। আর ভগবানও ভালবাসেন ঐভাবে বাঁধা পড়ে থাকতে। ভক্তির কাঙাল তিনি। যীশুখ্রীষ্ট বলছেন: ‘I stand at the door, and knock: if any man hear my voice, and open the door, I will come in to him, and will sup with him, and he with me.’ আমি ভক্তের বাড়িতে যাই, নিজে যেচে যাই। দরজায় গিয়ে টোকা দিই। কোন্‌ দরজা? হৃদয়-দুয়ার। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলছেন:

যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু,

দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।

আমি তো দরজা বন্ধ করেই রাখব, কিন্তু তাই বলে তুমি যেন ফিরে যেও না, দরজা ভেঙে তুমি ভিতরে এসো, আমার হৃদয়ে এসো। যীশুখ্রষ্ট বলছেন: ভক্তের দরজায় আমি গিয়ে টোকা দিই, টোকা দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসি না। অপেক্ষা করতে থাকি—যদি সে দরজা খোলে। আর যদি সে দরজা খুলে বলে, এস, ভিতরে এসো, তা হলে আমি ভিতরে ঢুকে তার সঙ্গে বসে আনন্দ করি, খাই-দাই আর ফূর্তি করি। ভক্ত ভগবানের সাথে একটা সম্পর্ক পাতায়—সেই সম্পর্কটাই তার কাছে বড় সত্য। সেই সম্পর্ক ধরে সে তাঁর দিকে এগিয়ে চলে। এই হচ্ছে ভক্তিপথ। ঠাকুর বলছেন: অন্যান্য পথের থেকে এই পথ সোজা, বিশেষ করে এই যুগে। ভক্তিযোগই যুগধর্ম। (ঐ)

আর আছে রাজযোগ। সাধারণত যোগ বলতেই রাজযোগ বোঝায়। যোগী পরমাত্মাকে সাক্ষাৎকার করতে চেষ্টা করে।⋯যোগী বিষয় থেকে মন কুড়িয়ে লয় ও পরমাত্মাতে মন স্থির করতে চেষ্টা করে। (১-২-৩) আমাদের মনটাকে তুলনা করা হয় জলাশয়ের সাথে, সবসময় তাতে নানারকম তরঙ্গ উঠছে, বৃত্তি উঠছে। সৎ বৃত্তি উঠছে, অসৎ বৃত্তি উঠছে। রাজযোগী চেষ্টা করেন যাতে এই সব বৃত্তি না ওঠে। পতঞ্জলি বলছেন: ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ’ —সমস্ত চিত্তবৃত্তি নিরোধ করাই হচ্ছে যোগ। যোগের উদ্দেশ্য—জীবাত্মা ও পরমাত্মার যোগ। (ঐ) ঠাকুর বলছেন: ঠিক দুপুরে যেমন ঘড়ির দুটো কাঁটা এক হয়ে যায়, রাজযোগ ঠিকমতো অভ্যাস করলে সেইরকম জীবাত্মা আর পরমাত্মা এক হয়ে যায়। রাজযোগ খুব কঠিন পথ। রাজযোগ অভ্যাসের সময় সম্পূর্ণভাবে পবিত্রতা রক্ষা করতে না পারলে বিপদের ভয় থাকে। এই পথও সর্বসাধারণের জন্য নয়।

ঠাকুর কোন পথকেই অস্বীকার করছেন না। তবে বলছেন;ভক্তিযোগই যুগধর্ম। (১-১১-৪) আর এক জায়গায় বলছেন: কলিযুগের পক্ষে নারদীয় ভক্তি। (১-১১-২) এযুগে সাধারণের পক্ষে ভক্তিপথই সবচেয়ে ভাল। আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন; তার এ মানে নয় যে, ভক্ত এক জায়গায় যাবে, জ্ঞানী বা কর্মী আর এক জায়গায় যাবে। (১-১১-৪) তারা সবাই একই লক্ষ্যে গিয়ে পৌছচ্ছে। বলছেন: জ্ঞানীরা যাঁকে ব্রহ্ম বলে, যোগীরা তাঁকেই আত্মা বলে, আর ভক্তেরা তাঁকেই ভগবান বলে। একই ব্রাহ্মণ। যখন পূজা করে, তার নাম পূজারী; যখন রাঁধে, তখন রাঁধুনি বামুন। (১-২-৩) এক বস্তু, নামের তফাৎ শুধু। যিনি ব্রহ্মজ্ঞান চান, তিনি যদি ভক্তিপথ ধরেও যান, তা হলেও সেই জ্ঞান লাভ করবেন। ভক্তবৎসল মনে করলেই ব্ৰহ্মজ্ঞান দিতে পারেন। (১১-১১-৪) একটা মস্ত বড় কথা ঠাকুর এখানে বলছেন; আমরা জানি, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে গেলে জ্ঞানপথে যেতে হবে। ঠাকুর বলছেন: না, সে যদি ভক্তিপথ ধরে এগোয় তা হলেও সে ব্রহ্মজ্ঞ হবে। জগতের মাকে পেলে, ভক্তিও পাবে, জ্ঞানও পাবে। জ্ঞানও পাবে, ভক্তি পাবে। (ঐ) ভক্তিপথ দিয়ে যে যাচ্ছে, সে জ্ঞানও পাবে আর জ্ঞানের পথ দিয়ে যে যাবে সে ভক্তিও পাবে।

আমরা জ্ঞান আর ভক্তিকে পরস্পর-বিরোধী মনে করি। কিন্তু দুয়ের মধ্যে বিবাদ নেই কোন। শঙ্করাচার্যকে আমরা বলি বেদান্তবাদী, জ্ঞানমার্গী। কিন্তু তাঁর মধ্যে ভক্তিও ছিল। কত দেব-দেবীর স্তোত্র তিনি রচনা করেছেন। অপূর্ব সব স্তোত্র। কত মন্দির স্থাপন করেছেন তিনি। কত তীর্থ দর্শন করেছেন, কত লুপ্ত তীর্থে প্রাণসঞ্চার করেছেন। ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখা গেছে তাঁর মধ্যে। কাজেই জ্ঞানমার্গ দিয়ে গেলেও আমরা সেই ভক্তিতেই গিয়ে পৌঁছব। তারপরে বলছেন: ভাবসমাধিতে রূপদর্শন, নির্বিকল্প সমাধিতে অখণ্ডসচ্চিদানন্দ দর্শন হয়, তখন অহং, নাম, রূপ থাকে না। (ঐ) ঠাকুরের তো দুই-ই হয়েছিল, তাই এত সহজে বলতে পারছেন। ভক্তিপথে গেলে যে-সমাধি হয়, দ্বৈতপথে সাধন করলে যে-সমাধি হয়—ভাবসমাধি বা সবিকল্প সমাধি—তা তাঁর হয়েছিল। আবার অদ্বৈতপথে যদি সাধন করি, জ্ঞানপথ দিয়ে যদি চলা যায়, তাহলে যে-সমাধি হয়—নির্বিকল্প সমাধি, তাও তাঁর হয়েছিল। জ্ঞানপথ দিয়ে গেলে অদ্বৈতোপলব্ধি হয়—এক ব্ৰহ্ম আছে, আর কিছু নেই। ‘ব্রহ্মময়ং জগৎ।’ ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।’— জীব জগৎ সব ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছু নেই। এই একত্ব-উপলব্ধি হয় জ্ঞানীর। ভক্ত, সে তো দ্বৈতবাদী, তার আবার একত্বদর্শন কিরকম? ভক্তেরও একটা অবস্থা হয় যাকে বলা হয় ‘সাযুজ্য’। ভগবানের চিন্তা করতে করতে ভক্ত অনেক সময় এতটা তন্ময় হয়ে যায় যে, তার পৃথক অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলে যায়। শুধু ভগবান আছেন—আর কিছু নেই, সে নিজেও নেই, এই অনুভূতি হয় তার। তখন নিজেকেই সে মনে করছে ভগবান। শ্রীমতী যেমন শ্রীকৃষ্ণের কথা ভাবছেন, ভাবতে ভাবতে এক সময় তাঁর মনে হচ্ছে তিনিই শ্রীকৃষ্ণ। এই হচ্ছে ‘সাযুজ্য’। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: কুমুরেপোকাই ভেবে ভেবে আরসোলা শেষে কুমুরেপোকাই হয়ে যায়। ভক্তও তাঁকে ভেবে ভেবে অহংশূন্য হয়ে যায়। আবার দেখে ‘তিনিই আমি’, ‘আমিই তিনি’।

আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের নিজের জীবনেই দেখতে পাই, ভবতারিণীকে ভোগ নিবেদন করতে গিয়ে তিনি নিজেই খাচ্ছেন, আবার খেতে খেতে নিজের উচ্ছিষ্ট মায়ের মুখে দিয়ে বলছেন: এবার তুই খা। কখনও হয়তো পুজোর ফুল আগে নিজের পায়ে দিচ্ছেন, তারপর সেটা আবার মায়ের পায়ে রাখছেন। ভক্ত ভগবানে কোন ভেদ নেই আর। ঠাকুরের ভক্ত ‘গোপালের মা’র জীবনেও দেখি এরকম অবস্থা। তাঁকে ‘গোপালের মা’ বলা হয় কারণ ‘বালগোপাল’ ছিলেন তাঁর ইষ্ট। বাৎসল্যভাবের সাধিকা ছিলেন তিনি— শিশু কৃষ্ণ যেন তাঁর সন্তান। তাই ‘গোপালের মা’। ইষ্টদর্শন হয়েছিল তাঁর, আর তাঁর এই উপলব্ধি হয়েছিল যে, শ্রীরামকৃষ্ণই তাঁর ‘গোপাল’। শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি ‘গোপাল’ বলে ডাকতেন। কত অদ্ভুত অদ্ভুত আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়েছে তাঁর জীবনে। লীলাপ্রসঙ্গে সেসব বর্ণনা আছে। গোপালের মা জীবনের শেষদিকে সকলের মধ্যেই তাঁর ‘গোপাল’কে দেখতেন, আর নিজেকেও তিনি ‘গোপাল’ বলে মনে করতেন। ‘আমি খাব’, ‘আমি শোব’—এসব না বলে বলতেন: ‘গোপাল খাবে’, ‘গোপাল শোবে’। এই হচ্ছে ‘সাযুজ্য’। ভক্তির উচ্চতম অবস্থায় ভক্ত ভগবানের সাথে এই ‘সাযুজ্য’ অনুভব করে। সব ভেদ মুছে গিয়ে ভক্ত আর ভগবান, সাধক এবং দেবতা একাত্ম হয়ে যায়। যেমন ‘ব্রাহ্মী-স্থিতি’ হলে জ্ঞানমার্গের সাধক ব্রহ্মের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন দেখেন এও ঠিক তাই।। বস্তুত, জ্ঞানমার্গের সাধক এবং ভক্তিমার্গের সাধকের চুড়ান্ত উপলব্ধির মধ্যে গুণগত কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্যটা হচ্ছে এইখানে যে, ভক্ত জ্ঞাতসারে ভগবানের সাথে এক হয়ে যেতে চায় না। জ্ঞানপথের সাধকের সঙ্গে এখানেই তার তফাৎ। জ্ঞানপথের সাধক প্রথম থেকেই ভাবতে, চেষ্টা করে যে, সে ব্ৰহ্ম। সেটাই তার সাধনা। হয়তো ভুল হয়ে যায় তার, দেহাত্মবুদ্ধি এসে যায়। কিন্তু সারাক্ষণ সে নিজেকে বোঝায়: না, তুমি দেহ-মন-বুদ্ধি এসব কিচ্ছু নও, তুমি স্বরূপত ব্রহ্ম। ব্রহ্মই একমাত্র সত্যবস্তু। আর সব কিছু মিথ্যে। তার সমস্ত সাধনার উদ্দেশ্য, এই উপলব্ধিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। ভক্তের কিন্তু তা নয়। ভক্ত বলে: আমি কি করে ভগবানের সঙ্গে এক হতে পারি? আমি এত ক্ষুদ্র, এত সামান্য; এত মলিনতা আমার মধ্যে—আমি বলব যে, আমি আর তিনি এক! আমিই ভগবান! তা কি বলতে পারি কখনও? না না, তিনি আর আমি এক নই। আমি তাঁর দাস, তাঁর সন্তান—তাঁর কৃপাপ্রার্থী। আমি তাঁর সাথে ‘এক’ হব না, ‘সাযুজ্য’ চাইব না, চাইব ‘সামীপ্য’—তাঁর ‘সমীপে’ যাব, খুব কাছাকাছি চলে যাব। খুব কাছে গিয়ে তাঁকে আস্বাদ করব। ‘চিনি হতে চাই না আমি, চিনি খেতে ভালবাসি’—এই বলে ভক্ত। কিন্তু ভগবানের চিন্তায় তার সমস্ত মনপ্রাণ এমন ভরপুর হয়ে থাকে যে, তার অজ্ঞাতসারেই তার মধ্যে ঐ ‘সাযুজ্য’ অবস্থা এসে যায়। সে নিজেও জানতে পারে না যে, কখন সে তার ইষ্টের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। কাজেই, ভক্তিপথেই হোক কিংবা জ্ঞানপথেই হোক—চরম উপলব্ধি যেটা হয় সেটা দু-পথেই এক। ঠাকুর তাই বলছেন: শুদ্ধজ্ঞান আর শুদ্ধাভক্তি এক। শুদ্ধজ্ঞান যেখানে শুদ্ধা ভক্তিও সেইখানে নিয়ে যায়। (১-৭-৫) জ্ঞানপথ দিয়ে যে সিদ্ধ হয়েছে সে দেখে ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’—আমিই ব্ৰহ্ম, ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’১০ —সবকিছুই ব্ৰহ্ম। আর ভক্ত, সেও দেখে ‘সর্বভূতময়ং হরিম্‌’১১—হরিই সর্বভূতে। স্বামীজী যেমন বলছেন: ‘ব্ৰহ্ম হ’তে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়।’ ভক্ত বলে: ‘হরিরেব জগৎ জগদেব হরিঃ। হরিতো জগতে নহি ভিন্নতনুঃ’১২—হরিই জগৎ, জগৎই হরি। হরি আর জগৎ আলাদা নয়। ‘যাঁহা-যাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে’।১৩—ভক্ত যা কিছু দেখছে, কৃষ্ণকেই দেখছে। কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু সে দেখতে পায় না। স্বামীজীর সেই বিখ্যাত কথা: ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?’ আমার যিনি ইষ্ট, আমার যিনি প্রিয়তম, তিনিই নানা রূপে, নানা নামে আমার সামনে বিরাজ করছেন। বন্ধুরূপে তিনি, শত্রুরূপেও তিনি। কাকে ঘৃণা করব? কাকে বর্জন করব? ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্‌’—জগতের সবাই আমার আত্মীয়। কারণ সবার মধ্যে আমার প্রিয়তমকে দেখছি। পওহারী বাবাকে সাপে কামড়েছে, পওহারী বাবা বলছেন: সাপ নয়, আমার প্রিয়তমের দূত। এই একত্ব দর্শন হয় ভক্তের।

ঠাকুর বলছেন: ভক্তিপথে গেলেও ব্রহ্মজ্ঞান হওয়া সম্ভব, তবে ভক্ত সাধারণত সেটা চায় না। বলছেন; ভক্ত ঈশ্বরের সাকার রূপ দেখতে চায় ও তাঁর সঙ্গে আলাপ ক’রতে চায়;—প্রায় ব্রহ্মজ্ঞান চায় না।,(১-১১-৪) ঠাকুরের কথা হল যে, ভক্ত চিনি খেতে চায়, চিনি হতে চায় না। বলছেন: কি জান? দেশ-কাল-পাত্র ভেদে ঈশ্বর নানা ধর্ম করেছেন। কিন্তু সব মতই পথ, মত কিছু ঈশ্বর নয়। তবে আন্তরিক ভক্তি করে একটা মত আশ্রয় ক’ল্‌লে তাঁর কাছে পৌঁছান যায়। (২-১৫-১) বলছেন: একটাতে দৃঢ় হও, হয় সাকারে নয় নিরাকারে।⋯⋯দৃঢ় হ’লে সাকারবাদীও ঈশ্বরলাভ ক’রবে, নিরাকারবাদীও ক’রবে। মিছরীর রুটি সিধে ক’রে খাও, আর আড় করে খাও, মিষ্টি লাগবে।(১-১২-২) তুমি সাকারবাদী কি নিরাকারবাদী? সাকারবাদী হলে তুমি কোন মূর্তি পছন্দ কর? তুমি শাক্ত না বৈষ্ণব? কি তুমি শৈব? তুমি অদ্বৈতবাদী, না বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী, না দ্বৈতবাদী? ঠাকুর বলছেন: এই নিয়ে বিতর্ক করার কোন দরকার নেই। আসল কথা হচ্ছে, তুমি একটাতে দৃঢ় হও। তোমার মতটাকে আঁকড়ে ধরে তুমি এগিয়ে যাও। যো সো করে ভগবান লাভ কর। পথ নিয়ে অনর্থক ঝগড়া কোরো না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই তুমি ভুল পথে যাচ্ছ, তাহলেও কোন ক্ষতি নেই। তিনিই তোমার ভুল শুধরে দেবেন। তিনি তো অন্তর্যামী—তিনি কি আর জানেন না যে, তুমি তাঁর কাছেই আসতে চাচ্ছ? তিনিই তোমাকে হাত ধরে ঠিক পথটা ধরিয়ে দেবেন। বলছেন: যদি কোন মত আশ্রয় ক’রে তাতে ভুল থাকে, আন্তরিক হ’লে তিনি সে ভুল শুধরিয়ে দেন। যদি কেউ আন্তরিক জগন্নাথ দর্শনে বেরোয়, আর ভুলে দক্ষিণদিকে না গিয়ে উত্তর দিকে যায়, তা’হলে অবশ্য পথে কেউ ব’লে দেয়, ওহে, ওদিকে যেও না—দক্ষিণদিকে যাও। সে ব্যক্তি কখনও না কখন জগন্নাথ দর্শন করবে।(২-১৫-১) কাজেই, পথ নিয়ে অনর্থক ঝগড়ার কোন প্রয়োজন নেই। যে যে-পথ দিয়েই যাক না কেন, পৌঁছবে একই জায়গায়। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: কালীবাড়িতে যাওয়ার কত পথ। কেউ নৌকায় যাচ্ছে, কেউ গাড়ি করে যাচ্ছে, কেউ বা পায়ে হেঁটে। কিন্তু পৌছচ্ছে তো সেই কালীবাড়িতেই। তেমনি, নানা পথ দিয়ে মানুষ যাচ্ছে, নানা নামে ঈশ্বরকে ডাকছে, নানান ভাবে ঈশ্বরকে ভাবছে—কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছচ্ছে তাঁরই কাছে। ইংরেজিতেও একটা কথা আছে: Religion is one, religions are many. —‘ধর্ম’ এক, কিন্তু ‘ধর্মমত’ বহু। সব ধর্মই ঈশ্বর-উপলব্ধির কথা বলে। সেই অর্থে সব ধর্মই এক। কিন্তু ঈশ্বর-উপলব্ধি কি করে হবে—সে সম্বন্ধে বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন পথ নির্দেশ করছে। সেইজন্য জগতে এতগুলি ধর্মমতের সৃষ্টি। পথ অনেক, গন্তব্যস্থল একটিই। ঠাকুর বলছেন: যত লোক দেখি, ধর্ম ধর্ম ক’রে—এ ওর সঙ্গে ঝগড়া ক’র্‌ছে ও ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে। হিন্দু, মুসলমান, ব্রহ্মজ্ঞানী, শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব; সব পরস্পর ঝগড়া। এ বুদ্ধি নাই যে, যাঁকে কৃষ্ণ বল্‌ছো, তাঁকেই শিব, তাঁকেই আদ্যাশক্তি বলা হয়; তাঁকেই যীশু, তাঁকেই আল্লা বলা হয়। এক রাম তাঁর হাজার নাম। বস্তু এক, নাম আলাদা।…⋯যাকে বেদে ‘সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম’ বলেছে, তন্ত্রে তাঁকেই ‘সচ্চিদানন্দ শিবঃ’ বলেছে, তাঁকেই আবার পুরাণে ‘সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণঃ’ বলেছে।(২-১৩-৩) উদাহরণ দিয়ে বলছেন: একই পুকুরে কয়েকটা ঘাট। এক ঘাটে হিন্দুরা কলসী করে জল নিচ্ছে, বলছে ‘জল’। আর এক ঘাটে মুসলমানরা চামড়ার ডোলে করে জল নিচ্ছে, বলছে ‘পানি’। আবার আর এক ঘাটে খ্রীষ্টানরা জল নিচ্ছে, বলছে ‘ওয়াটার’। একই জল বিভিন্ন নাম শুধু। কেউ যদি বলে—কৈ, এটা ‘জল’ নয় তো, ‘পানি’; কিংবা ‘পানি’ নয় তো, ‘ওয়াটার’—তাহলে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়।

ঠাকুর বলছেন: তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত ধর্মজগতের বাইরের মহলে ঘোরাফেরা করছ, ততক্ষণ তুমি এই বিবাদ করছ, তর্ক করছ। কিন্তু যদি তুমি ভিতরে একবার ঢোক, তাহলেই বুঝতে পারবে; সব মতই এক একটা পথ, সব মতেই তাঁকে পাওয়া যায়। যত মত তত পথ। জল যদি তুমি আস্বাদ করতে পার, তাহলেই বুঝবে যা ‘পানি’, তা-ই ‘ওয়াটার’, তা-ই ‘জল’। শ্যামপুকুরে পৌঁছিলে তেলীপাড়াও জানতে পারবে। (১-১২-৯) কলকাতায় যদি কেউ একবার এসে পড়তে পারে তা হ’লে গড়ের মাঠ, সুসাইটি (Asiatic Society’s Museum).সবই দেখতে পায়। (১-১১-৪) আসল কথা হচ্ছে কলকাতায় আসা, অর্থাৎ ঈশ্বরলাভ করা। একটা গল্প বলছেন ঠাকুর: একজন জঙ্গলে গিয়েছিল, সে গাছের উপর একটা সুন্দর প্রাণী দেখল। দেখে এসে সে বন্ধুকে বলল, ভাই, অমুক গাছে আমি একটা লাল রঙের প্রাণী দেখে এলাম। বন্ধু বলল, আমিও দেখেছি, তা সে লাল রঙের হতে যাবে কেন? সে হচ্ছে সবুজ। আর একজন সেখানে উপস্থিত ছিল, সে বলল: আমিও দেখেছি, তবে সবুজ তো নয়, হলদে। শেষে এই নিয়ে ঝগড়া। তখন তারা সেই গাছটার কাছে গেল, গিয়ে দেখল গাছটার নীচে একজন লোক বসে আছে। সেই লোকটিকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল: আমি সেই প্রাণীটাকে জানি। তোমরা যা বলছ, সবই সত্যি। সেটা কখনও লাল, কখনও নীল, আর কত সব রঙ হয় তার। আবার কখনও দেখি, কোন রঙই নেই। অর্থাৎ যিনি নিরাকার তিনিই সাকার। ‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্ৰহ্মণো রূপকল্পনা’১৪—সাধকদের কল্যাণার্থে ব্রহ্মের রূপকল্পনা। সাধকদের জন্য নানা রূপ তিনি গ্রহণ করেন। যে ব্যক্তি সদাসর্বদা ঈশ্বর চিন্তা করে, সেই জানতে পারে, তাঁর স্বরূপ কি। সে ব্যক্তিই জানে যে ঈশ্বর নানারূপে দেখা দেন। নানা ভাবে দেখা দেন।⋯ গাছতলায় যে থাকে সেই জানে যে, বহুরূপীর নানা রঙ, আবার কখন কখন কোন রঙই থাকে না। অন্য লোকে কেবল তর্ক ঝগড়া ক’রে কষ্ট পায়।(১-১৫-২) অর্থাৎ যো সো করে আমাকে ঈশ্বরলাভ করতে হবে। তা না করলেই এই ঝগড়া, বিবাদ—এগুলি থাকবে।

এই যে সাকার-নিরাকার নিয়ে কত দ্বন্দ্ব—ঠাকুর তার অদ্ভুত সমাধান করে দিয়েছেন। ঠাকুর বলছেন: ভক্তিহিমে জল বরফ হয়, আবার জ্ঞানসূর্যের তাপে বরফ গলে যায়। ভক্ত তার নিজের ভক্তির দ্বারা ভগবানকে সাকারে পরিণত করে। ভক্তের অনুরোধে ভগবান সাকার হন। ভক্ত ভগবানকে যে-মূর্তিতে দেখতে ভালবাসে, যে-ভাবে দেখতে ভালবাসে, ভগবান তার কাছে সেইভাবে প্রকাশিত হন। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে:১৫

যেই যেই-রূপে জানে, সেই তাহা কহে।

সকল সম্ভবে কৃষ্ণে, কিছু মিথ্যা নহে।।

কতরকম মূর্তি আমরা দেখতে পাই। সবই যে আবার সুন্দর মূর্তি তা নয়। এই যে গণেশমূর্তি অথবা কালীমূর্তি, সকলের কাছে এ হয়তো সুন্দর মনে হবে না। কিন্তু অনেক ভক্ত আছে যারা ভগবানকে ঐরূপে দেখতে ভালবাসে। একটা বিশেষ রূপে ভক্ত তাঁকে চিন্তা করছে। যাঁকে সে ভালবাসে, তাঁকে সাজাতে ইচ্ছে হয়, একটা বিশেষ রকমে তাঁকে সাজাতে ভাল লাগে। সেইরূপে, সেইরকম সেজে ঈশ্বর তার কাছে আসেন। নাড়ুগোপাল হয়ে আসছেন। ভক্ত সে, তাই তিনি প্রার্থী হয়ে এসেছেন তার কাছে। ভিক্ষা চাচ্ছেন হাত বাড়িয়ে। ভক্তের অধীন তিনি। তাই এসেছেন নাড়ুগোপাল হয়ে। অনেকের মতে এ হয়তো নিছক কল্পনা। যদি কল্পনাই হয়—এর পিছনে ধরে নিচ্ছি কোন বাস্তবতা নেই—কিন্তু কী অদ্ভুত কল্পনা! আমাদের এই বাংলাদেশেই অনেক অদ্ভুত রকমের সব মূর্তি আছে। হুগলী জেলায় বাঁশবেড়ে নামে একটি জায়গা আছে। সেখানে ‘হংসেশ্বরী’ দেবীর মূর্তি আছে। অদ্ভুত মূর্তি! এরকম মূর্তি আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। ভক্ত, তিনি দর্শন করেছেন এই মূর্তি। মা তাঁর কাছে কৃপা করে ঐ মূর্তিতে এসে ধরা দিয়েছেন। তাই তিনি ঐ মূর্তি গড়ে পুজো করেছেন। ‘সকল সম্ভবে কৃষ্ণে, কিছু মিথ্যা নহে।’ সব রূপই তো তাঁর রূপ, সব নামই তো তাঁর নাম। তাই সব মূর্তিই সত্য, যে-কোন মূর্তিতেই তাঁর পুজো হতে পারে। কারণ, পুজো করছি তাঁকে, মূর্তিকে নয়। ঈশ্বরলাভ যে করে তার কাছে এগুলি পরিষ্কার হয়ে যায়। ঠাকুর তাই বলছেন: সকলেই তাঁকে ডাকছে। দ্বেষাদেষীর দরকার নেই।⋯যার সাকারে বিশ্বাস, সে সাকারই চিন্তা করুক। যার নিরাকারে বিশ্বাস, সে নিরাকারই চিন্তা করুক। তবে এই বলা যে, মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) ভাল নয়; অর্থাৎ আমার ধর্ম ঠিক আর সকলের ভুল। আমার ধর্ম ঠিক; আর ওদের ধর্ম ঠিক কি ভুল, সত্য কি মিথ্যা, এ আমি বুঝতে পাচ্ছিনে—এ ভাব ভাল। কেন না ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার না করলে তার স্বরূপ বুঝা যায় না। ⋯আমাদের কর্তব্য, কিসে যো সো ক’রে জগন্নাথ দর্শন হয়।(২-১৫-১) অর্থাৎ কি করে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করা যায়, ঈশ্বরলাভ করা যায়। তা যদি আমি করতে পারি, অপরোক্ষানুভূতি হয় যদি আমার, তাহলেই দেখব যে, আমার আর তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না, ঝগড়া-বিবাদ নিরর্থক মনে হচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি যে, কোন ধর্মই মিথ্যা নয়, কোন পথ বা কোন মতই ভুল নয়।

স্বামীজী বলছেন:১৬ ‘Each soul is potentially divine. The goal is to manifest this Divinity within, by controlling nature, external and internal. Do this either by work, or worship, or psychic control, or philosophy—by one or more or all of these—and be free.’ আমরা সবাই স্বরূপত ব্ৰহ্ম। ধর্ম মানে হচ্ছে সেই অব্যক্ত ব্ৰহ্মকে ব্যক্ত করা। কিভাবে তা করা যেতে পারে? স্বামীজী বলছেন: নিষ্কাম কর্ম বা কর্মযোগের দ্বারা করা যেতে পারে, ভক্তিযোগের পথে হতে পারে, জ্ঞানযোগের পথে হতে পারে, রাজযোগের পথেও হতে পারে। কেউ কেউ আবার এই চারটে যোগের এক বা একাধিক বা সবগুলো অভ্যাস করে ঈশ্বরলাভ করতে পারে। স্বামীজী কোন পথকে বাদ দিচ্ছেন না, হেয় করছেন না। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি আর যোগের তিনি সমন্বয় করেছেন। আমরা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের যে প্রতীক ব্যবহার করি, তারও অর্থ এই চার যোগের সমন্বয়।* স্বামীজী বলছেন: ১৭পাখীর উড়তে গেলে তিনটে জিনিস চাই। দুটো ডানা আর লেজ। একটা ডানা হচ্ছে ভক্তি, আর একটা ডানা হচ্ছে জ্ঞান। আর যোগ হচ্ছে লেজ, সেটা ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু তিনটে জিনিসই দরকার হয় পাখীর ওড়ার জন্য। তেমনি, সাধকও পূর্ণাঙ্গ হয় না যদি এগুলির সমন্বয় না ঘটে তার জীবনে। স্বামীজী বলছেন: যে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি আর যোগের মধ্যে একটিকেও অবহেলা করবে বা হেয় মনে করবে, তার চরিত্র ‘রামকৃষ্ণ-মুষায়’ ঠিকমতো ‘দ্রুত’ হয়নি বুঝতে হবে, শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাদর্শ-অনুযায়ী সে নিজেকে তৈরী করেনি। সব ধর্মের সমন্বয়, সব মতের সমন্বয়, সব পথের সমন্বয়—এই হচ্ছে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের আদর্শ।

স্বামীজী বলছেন: ধর্মের কোন অঙ্গকে তুমি অবজ্ঞা করতে পার না। তোমার জন্য হয়তো তার প্রয়োজন নাও থাকতে পারে, কিন্তু অন্য কারও পক্ষে তা হয়তো খুবই উপযোগী। সেই পথ দিয়ে গিয়েও কত লোকে তাঁকে পাচ্ছে। কাজেই, সেই পথকে, সেই মতকেও তুমি শ্রদ্ধা জানাও। তোমার যা ভাব তাকে তুমি আঁকড়ে থাক—কিন্তু অন্যের ভাবকেও মর্যাদা দাও। এই বলতে যেও না যে, তোমার ভাব ভুল, আমার ভাবেই তোমাকে ঈশ্বরকে ডাকতে হবে। আমাদের দেশে কত সাধক কত বিচিত্র পথে ঈশ্বরকে ডেকে আসছেন। ‘কথামৃত’তে দেখি, একজন সাধকের কথা আছে যিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে চলতেন আর মেঘের মতো গর্জন করে গণেশের নাম করতেন। ‘গণেশগর্জী’ বলা হচ্ছে তাঁকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চলতেন কেন? এই কারণে যে, চারদিকে জগৎসংসার এ আমি দেখব না। আমার ইষ্টকে আমি চিন্তা করছি, গণেশকে চিন্তা করছি শুধু। কী অদ্ভুত একটা সাধন! মনে হতে পারে, উদ্ভট সাধন। কিন্তু এ-পথে গিয়েও তো মানুষ তাঁকে ডাকছে, আনন্দ পাচ্ছে। আবার ধরা যাক, সহজিয়া সাধনার কথা। কী দুর্দান্ত সাধনা! নারী সঙ্গে রেখে সাধনা। ভোগের যত রকম উপকরণ সব চারপাশে থাকবে—অথচ কোন আকর্ষণ বোধ থাকবে না। স্বামীজী এবং অন্যান্যরা, তাঁরা তখন যুবক, ঠাকুরের কাছে এই পথের নিন্দা করছেন। ঠাকুর বলছেন: না না, নিন্দা কোরো না। আমি দেখেছি এঁদের মধ্যেও সত্যিকারের সিদ্ধপুরুষ আছেন। এও একটা পথ। তবে এটাও বলছেন: পথটা নিরাপদ নয়, খুব মারাত্মক পথ। কিরকম জান? বাড়িতে ঢোকার দুটো পথ আছে—সদর দরজা আছে আবার মেথর ঢোকার দরজাও আছে। এ হচ্ছে ঐ মেথর ঢোকার পথ। কিন্তু পথ যাই-ই হোক, শেষ পর্যন্ত বাড়িতে তো সে পৌঁছচ্ছে। পথটা আসল নয়, কোথায় তুমি যাচ্ছ সেটাই আসল। পরবর্তীকালে দেখি, স্বামীজীও ঠিক এই ধরনের কথা বলছেন: আমরা ফল দিয়েই গাছটাকে বিচার করি। যদি পুতুল পুজো করে শ্রীরামকৃষ্ণের মতো একটা জীবন হতে পারে, তাহলে আমি বলব, সেই পুতুল-পুজোও নিশ্চয়ই সত্য। আমরা যদি দেখি, কোন সাধনপদ্ধতির ভিতর দিয়ে এক একজন দেবসদৃশ মানুষের আবির্ভাব হচ্ছে, তাহলে সেই সাধনপদ্ধতি অবশ্যই সত্য। সব ধর্মেই দেখি, সব পথেই দেখি, সিদ্ধপুরুষের জন্ম হয়েছে। তা থেকেই বোঝা যায়, সেই ধর্ম বা পথও সত্য।

এই সাকার বা নিরাকার উপাসনা—এ দুটোরই প্রয়োজন আছে। প্রথম অবস্থাতেই ঈশ্বরকে নিরাকারভাবে চিন্তা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। একটা আকার চাই। আমরা জানি, ব্রাহ্মরা নিরাকারভাবে উপাসনা করে থাকেন। তাঁরা বলেন, ঈশ্বর নিরাকার, কিন্তু সগুণ। কিন্তু অনেকের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, তাঁরা বলেন যে, একটা আকার এসে যায়, একটা মূর্তি এসে যায়। একজন আমাকে বলেছিলেন: ঈশ্বর সম্বন্ধে যখন বলি, ঈশ্বর পরম দয়ালু, খুব করুণা তাঁর—তখন আমার দাদুর মুখটা ভেসে ওঠে। সেইরকম সাদা দাড়ি, সবসময় মুখে একটা হাসি, আমি শত অপরাধ করলেও আমাকে তিনি ক্ষমা করতেন—সেই দাদুর মুখ ভেসে ওঠে। এক ভদ্রমহিলার কথা জানি। ব্রাহ্ম ছিলেন তিনি। সারা জীবন ঈশ্বরকে নিরাকারভাবে চিন্তা করে এসেছেন। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি তাঁর স্বামীকে বলছেন; কী তোমরা কেবল নিরাকার নিরাকার কর? আমার ইচ্ছে হয়, বেশ একটা ঠাকুরঘর থাকবে; আমার ঠাকুরকে, আমার ইষ্টকে আমি স্নান করাব, খাওয়াব, মনের মতো করে সাজাব। তাঁর স্বামী খুবই উদার ছিলেন বলতে হবে। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বেলুড় মঠে গেলেন। তখন যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, স্বামী বিরজানন্দ, তাঁর কাছে সব কথা বললেন। তারপর তাঁর স্ত্রীর দীক্ষা হল মঠে। কাজেই, ঈশ্বরকে নিরাকারভাবে চিন্তা করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। অন্তত, প্রথম অবস্থাতে খুবই কঠিন। তখন মনের একটা সাকার রূপ চাই, একটা অবলম্বন চাই। ঠাকুর বলছেন: সব্বাই কি অখণ্ড সচ্চিদানন্দকে ধরতে পারে?⋯রুচি ভেদ আর অধিকারী ভেদ আছে।⋯রুচিভেদ, কি রকম জানরুচিভেদ, কি রকম জান? কেউ মাছটা ঝোলে খায়, কেউ ভাজা খায়, কেউ মাছের অম্বল খায়, কেউ মাছের পোলাও খায়। (২-২৫-২) একেক জনের একেকটা ভাল লাগে। শিবমহিম্ন:স্তোত্রে আছে ১৮

রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং

নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।

—মানুষের বিভিন্ন রুচি, তাই বিভিন্ন পথ সে বেছে নিচ্ছে। কিন্তু সবাই একই জায়গায় পৌঁছচ্ছে, ঈশ্বরে পৌঁছচ্ছে। সব নদীই যেমন একই সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে, এও ঠিক তেমনি। নানা রকম রুচি, নানা রকম পথ, নানা রকম ভাষা, নানা রকম মত, কিন্তু গন্তব্যস্থল এক, সেই তিনি। আর অধিকারী ভেদ। আমি বলি আগে কলাগাছ বিঁধতে শেখ, তার পর শলতে, তার পর পাখী উড়ে যাচ্ছে, তাকে বেঁধ। (ঐ) অর্থাৎ ধাপে ধাপে তুমি এগোও। স্বামীজীর ভাষায়: from a lower truth to a higher truth. আমরা সবসময় সত্যকে খুঁজছি, ঈশ্বরকে খুঁজছি—কিন্তু ধাপে ধাপে এগোচ্ছি, নিম্নতর সত্য থেকে উচ্চতর সত্যের দিকে। এই যে সাকার-নিরাকার, সগুণ-নির্গুণ, দ্বৈত্ববাদ-বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদ—এগুলির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। এগুলি ক্রমবিকাশের একেকটা ধাপ। যতক্ষণ আমার দেহবুদ্ধি আছে, ততক্ষণ আমি ভাবব ঈশ্বরেরও একটা দেহ আছে, আকার আছে, রূপ আছে। যতক্ষণ আমার নিজেকে ব্যক্তি বলে বোধ হবে, ততক্ষণ আমার এই বোধও থাকবে যে, ঈশ্বরও একজন ব্যক্তি। এই নিয়ে বিরোধের কিছু নেই। একই ঈশ্বর, একই ব্ৰহ্ম—আমাদের মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে কখনও মনে হচ্ছে সাকার, কখনও মনে হচ্ছে নিরাকার, কখনও সগুণ, কখনও নির্গুণ, কখনও মনে হচ্ছে তিনি আর আমি আলাদা, আবার কখনও মনে হচ্ছে এক। হনুমান রামচন্দ্রকে বলছেন:১৯

দেহবুদ্ধ্যা তু দাসোহস্মি জীববুদ্ধ্যা ত্বদংশকঃ।

আত্মবুদ্ধ্যা ত্বমেবাহমিতি মে নিশ্চিতা মতিঃ।।

—যখন আমার দেহবুদ্ধি থাকে তখন দেখি তুমি প্রভু, আমি তোমার দাস (অর্থাৎ দ্বৈতবাদ তখন)। যখন নিজেকে ‘জীব’ বলে মনে হয় তখন দেখি, আমি তোমার অংশ (অর্থাৎ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ)। আর যখন আত্মোপলব্ধি হয়, নিজেকে আত্মা বলে জানি, তখন দেখি তুমিই আমি। আমাতে আর তোমাতে কোন ভেদ নেই তখন (তখন একেবারে অদ্বৈতবোধ)। দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদের সমন্বয় দেখতে পাচ্ছি হনুমানের এই কথার মধ্যে। ঠাকুরও ঠিক তা-ই বলছেন: শেষে এই বুঝেছি, তিনি পূর্ণ আমি তাঁর অংশ; তিনি প্রভু ‘আমি’ তাঁর দাস; আবার এক একবার ভাবি, তিনিই আমি আমিই তিনি! (২-১৭-৪)

স্বামীজী বলছেন: একজন মাটির নীচের খনি থেকে সূর্যকে দেখছে—সে সূর্যকে একরকম দেখবে। আর একজন হয়তো ভূপৃষ্ঠ থেকে সূর্যকে দেখছে, সে আর একরকম দেখবে; আর একজন হয়তো কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখছে—সে আর একরকম দেখবে। আর একজন হয়তো পাহাড়ের উপর থেকে দেখছে—তার কাছে সূর্যকে আর একরকম মনে হবে। অথচ এক সূর্যকেই দেখছে সবাই। এই হচ্ছে ‘lower truth’ থেকে ‘higher truth’-এ যাওয়া। ঈশ্বরকে সাকাররূপে চিন্তা করছি, একটা বিশেষ মূর্তিতে দেখছি, একটা বিশেষ ভাবে দেখছি। ক্রমশ আমার চিন্তার পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। দেখছি সব রূপই তাঁর রূপ, সব ভাবই তাঁর ভাব, সব নামই তাঁর নাম। দেখছি—কোন রূপ নেই, আকার নেই কোন—সেও তিনি। যতই আমি এগিয়ে চলেছি ঈশ্বরের দিকে ততই আমার চিন্তা আরও সংস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু সেই এক ঈশ্বরকেই আমি চিন্তা করছি সবসময়।

স্বামীজী এক জায়গায় খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে বলছেন: তোমরা সবার জন্য একই কোটের ব্যবস্থা করে রেখেছ। সেই এক কোট—ছোট, বড়, মেয়ে, পুরুষ—সবাইকে পরতে হবে। এ কি হয় কখনও? কিন্তু হিন্দুরা এ-ব্যাপারে খুব বৈজ্ঞানিক। হিন্দুধর্মে নানা রকম কোট আছে—যার গায়ে যেটা লাগে। নানা রকম পথ আছে হিন্দুধর্মে। হিন্দুরা বুঝেছে: মানুষের রুচি বিভিন্ন, মানসিক গঠনও বিভিন্ন। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন মতের ব্যবস্থা। কিন্তু সব মত, সব পথ দিয়ে মানুষ পৌঁছচ্ছে একই জায়গায়—ঈশ্বরে। স্বামীজী বলছেন:২০ ‘In all religions the superconscious state is identical.’—সব ধর্মের তুরীয় অবস্থা বা চরম অবস্থা এক। ‘Hindus, Christians, Mohammedans, Buddhists, and even those of no creed, all have the very same experience when they transcend the body.’ —হিন্দু, খ্রীষ্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ, এমনকি যারা কোন ধর্মমত মানে না, তাদের সবার ঠিক একই উপলব্ধি হয়, যখন তারা দেহবুদ্ধি অতিক্রম করে। স্বামীজী বলছেন: যেটা চরম সত্য বা ‘Absolute Truth’—সেটা সব সময়ই এক। কিন্তু আমাদের মন-বুদ্ধি সীমিত, তাতে গোটা সত্যটা কখনও ধরা পড়ে না, খণ্ডিতভাবে ধরা পড়ে। আমাদের কাছে ‘আপেক্ষিক’ বা ‘Relative Truth’-টা ধরা পড়ে—চরম সত্যটা ধরা পড়ে না। একেক জনের মানসিক গঠন বিভিন্ন, তাই ‘আপেক্ষিক সত্য’ একেক জনের কাছে একেক রকম। কিন্তু চরম সত্যের অনুভূতি যাঁদের হয়, তাঁরা সবাই একই রকম অনুভব করে থাকেন। ধর্মে ধর্মে আপাতদৃষ্টিতে যেসব বিরোধ দেখা যায়, তা এই আপেক্ষিক সত্যের বর্ণনার ব্যাপারে। চরম সত্য সম্বন্ধে সব ধর্মই একই কথা বলে। বলছেন স্বামীজী:২১ ‘This is like the different photographs of the same sun taken from various distances. Each of them seems to represent a different sun. The diverse relative truths have the same kind of relation with the absolute truth. Each religion is thus true, just because it is a mode of presentation of the absolute religion.’ ধর্মে ধর্মে আপাতদৃষ্টিতে যতই বিরোধ থাকুক না কেন, কোন ধর্মকে আমরা মিথ্যা বলতে পারি না— কারণ সব ধর্ম সেই এক চরম সত্যকেই নানাভাবে প্রকাশ করছে।

ঠাকুর বলছেন: হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, ঋষিদের কালের ব্রহ্মজ্ঞানী ও ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানী তোমরা—সকলেই এক বস্তুকে চাহিছো। (২-১৫-১) ‘ইদানীং কালের ব্রহ্মজ্ঞানী’—মানে ব্রাহ্মরা। তবে যার যা পেটে সয়, মা সেইরূপ ব্যবস্থা করেছেন। মা যদি বাড়িতে মাছ আনেন, আর পাঁচটি ছেলে থাকে, সকলকেই পোলাও কালিয়া করে দেন না। সকলের পেট সমান নয়। কারু জন্য মাছের ঝোলের ব্যবস্থা করেন। (ঐ) অর্থাৎ ঐ রুচিভেদ আর অধিকারী-ভেদের ব্যাপার। কিন্তু মা সকলকেই সমান ভালবাসেন। (ঐ) আমাদের সবার সামর্থ্য সমান নয়, আবার প্রকৃতিও সমান নয়। মানুষে মানুষে এই তফাত থাকবেই। আমরা জাগতিক ব্যাপারেও এই তফাতটা স্বীকার করে নিই। শিক্ষাক্ষেত্রে দেখি কেউ সায়েন্স পড়ছে, কেউ হিউম্যানিটিজ পড়ছে, কেউ কমার্স পড়ছে—যার যেটা ভাল লাগে, যার যেদিকে যোগ্যতা। বহু প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুরা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও এই বৈচিত্র্যটাকে স্বীকার করে নিয়েছে। কারণ, হিন্দুরা বুঝেছে, এ না করলে বাস্তবকে অস্বীকার করা হয়। এই যে এত মত এত পথ হিন্দুধর্মে—এর ফলেই হিন্দুধর্ম একটা সর্বজনীন ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা হিন্দুধর্মের খুব বড় একটা বৈশিষ্ট্য। স্বামীজী বলছেন:২২ অনেকের কাছে এটাই খুব দুশ্চিন্তার কারণ যে, পৃথিবীতে এতগুলো ধর্মমত। কিন্তু আমি এতে খুব খুশি। কারণ, এতে অনেক লোকের ঈশ্বরকে ডাকার সুবিধে হয়েছে। আমি আরও খুশি হতাম, যদি পৃথিবীতে যত লোক আছে, ঠিক ততগুলো ধর্মমত থাকত—প্রতিটি লোকের মানসিক গঠন অনুযায়ী যদি এক একটা আলাদা ধর্মমত থাকত।

অনেকে বলে হিন্দুধর্ম একটা জঙ্গলবিশেষ—trackless forest! এই জঙ্গলে গিয়ে একবার পড়লে আর পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না, পায়ে হাঁটার্‌ পথও নেই। একজন মিশনারী সাহেব স্বামীজীকে আক্রমণ করে অনেক বক্তৃতা করেছেন। তিনি হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে লিখছেন: হিন্দুধর্মটা কিরকম? ধরুন, আপনি সমুদ্র দিয়ে কোথাও যাচ্ছেন, সেইসময় ঝড় উঠছে, আবার মেঘও করেছে। আপনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন, তীরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। এই হচ্ছে হিন্দুধর্ম। একবার একজন খ্রীষ্টান ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন: হিন্দুধর্মটা যে কি তা হিন্দুরাই বলতে পারে না। আমি তাঁকে বলেছিলাম: সেটা হিন্দুধর্মের কোন দুর্বলতা নয়, একটা বিশেষ গুণ, বিশেষ শক্তির পরিচয়। হিন্দুধর্মটা এত ব্যাপক যে তাকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। হিন্দুধর্ম একটা সর্বগ্রাসী জিনিস। সর্বগ্রাসী এই অর্থে যে, এর মধ্যে সব আছে—এর মধ্যে ইসলামধর্ম আছে, খ্রীষ্টধর্মও আছে, সব ধর্মমত এর মধ্যে আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ‘trackless forest’। কিন্তু ঈশ্বরলাভই যদি কারও উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তিনি দেখবেন, না, জঙ্গল নয়। এখানে এমন একটি পথ আছে যেটা মনে হবে যেন শুধু তাঁরই জন্য তৈরী। এটাই হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য।

হিন্দুধর্ম বলে: তোমার পথ আমার থেকে আলাদা। কিন্তু মনে রেখো, তোমার পথও সত্য, আমার পথও সত্য। তোমার পথ তোমার কাছে যতটা সত্য, আমার পথ আমার কাছে ঠিক ততটাই সত্য। আমার পথকে তুমি অবজ্ঞা করতে পার না, তোমারটাকেও আমি অবহেলা করতে পারি না। কতভাবে ঠাকুর মানুষকে শিক্ষা দিচ্ছেন। বলছেন: বাড়িতে একসঙ্গে পুরুষমানুষরা সব খেতে বসেছে, আর সেই বাড়িরই এক বধূ পরিবেশন করছে। তার স্বামী খেতে বসেছে, ভাশুর বসেছে, শ্বশুর বসেছে, দেওর বসেছে, হয়তো আরও কেউ বসেছে। এই সবার মধ্যে স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা আলাদা। সে যখন পরিবেশন করছে তখন সকলকে সমানভাবে সেবা করছে, সকলের জন্য সমান ব্যবস্থা। কিন্তু সে একজনকে খাইয়ে সব থেকে বেশী আনন্দ পায়, সে তার স্বামী। অথচ বাইরে সে সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। ঠাকুর বলছেন: তোমার ভিতরে থাকুক এক মূর্তি, ভিতরে থাকুক এক ভাব—কিন্তু অন্যের ভাব অন্যের মত, তাকেও তুমি মর্যাদা দাও। স্বামীজী বলছেন: tolerance নয়—acceptance। হিন্দুধর্ম অন্য ধর্মকে শুধু ‘সহ্য’ই করে না—‘স্বীকার’ করে, ‘গ্রহণ’ করে। ও দুর্বল, অক্ষম, ওকেও কেন আমি সঙ্গে নেব না—এই ভাব নয়। হিন্দুধর্ম মনে করে: সব পথেই তাঁকে পাওয়া যায়, সব পথই সত্য। সেই হিসাবে সে সব পথকে স্বীকার করে। ঠাকুর বলছেন: যখন বাহিরে লোকের সঙ্গে মিশবে, তখন সকলকে ভালবাসবে, মিশে যেন এক হয়ে যাবে—বিদ্বেষ ভাব আর রাখবে না। ‘ও ব্যক্তি সাকার মানে, নিরাকার মানে না; ও নিরাকার মানে, সাকার মানে না; ও হিন্দু ও মুসলমান, ও খ্রীষ্টান’—এই বলে নাক সিট্‌কে ঘৃণা করো না। তিনি যাকে যেমন বুঝিয়েছেন। সকলের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি জানবে, জেনে তাদের সঙ্গে মিশবে, —যত দূর পার। আর ভালবাসবে। তার পর নিজের ঘরে গিয়ে শান্তি আনন্দভোগ করবে। ‘জ্ঞানদীপ জ্বেলে ঘরে ব্রহ্মময়ীর মুখ দেখো না।’ নিজের ঘরে স্ব-স্বরূপকে দেখতে পাবে। (১-১২-৯) কী সুন্দর একটা কথা বললেন ঠাকুর! উপমা দিয়ে বলছেন: রাখাল যখন গরু চরাতে যায়, গরু সব মাঠে গিয়ে এক হয়ে যায়। এক পালের গরু। যখন সন্ধ্যায় নিজের ঘরে যায়, আবার পৃথক হয়ে যায়। নিজের ঘরে ‘আপনাতে আপনি থাকে।’ (ঐ)

শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের পর আমরা দেখছি প্রায় সকলের মুখেই এক কথা যে, সব ধর্মই সত্য। সামান্য কিছু গোঁড়া লোকের কথা বাদ দিলে, অধিকাংশ মানুষই আজ স্বীকার করে নিচ্ছেন: সব ধর্মই সত্য। ঠাকুর এসে যেন ধর্মজগতে এক বিরাট বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন। সেই বিপ্লবের ঢেউ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। কিছুদিন আগে একজন জার্মান ভদ্রলোক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে এসেছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক তিনি। তাঁদের দেশে তাঁরা একটা ধর্মমহাসম্মেলন করবেন। আমাদের সেখানে যাওয়ার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানালেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, যে-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানের বয়স হচ্ছে সাতাত্তর বছর। আমেরিকাতে যে ধর্মমহাসম্মেলন হয়েছিল, তার কয়েক বছর পরেই তাঁদের প্রতিষ্ঠানের জন্ম। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সকল ধর্মের মূল সুরটি ভাল করে অনুধাবন করা। পরস্পরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, সংঘর্ষ নয়—পরস্পরের মধ্যে মিলনসেতু তৈরী করা যায় কিনা, সেটাই হচ্ছে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। তিনি জানালেন, জার্মান ভাষাতে বহু বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের কথা পাওয়া যায়। তাঁর কাছ থেকে আরও জানলাম, জার্মানীতে বা অন্যান্য দেশে অনেক ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠী আছে যারা এই ভারতের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে তাদের আগ্রহ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের চিন্তাধারা সম্পর্কে। তাঁকে যখন সংক্ষেপে বলছিলাম ঠাকুর-স্বামীজীর ভাবধারার কথা, তিনি তখন ভারী একটা মজার কথা বললেন: তুমি কি আমার বক্তৃতাগুলো আগে পড়েছ, তাই এসব বলছ? নাকি, তোমার এই কথাগুলোই আমি নিজের বক্তৃতায় বলেছি?

এ-প্রসঙ্গে স্বামীজীর একটা কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। তিনি বলতেন: যদি তুমি একটা মহৎ চিন্তা কোন জায়গায় বসে কর, হয়তো দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কোন গুহায় বসে করছ, আর সেই চিন্তাধারা বাইরে প্রকাশের কোন চেষ্টা নাও কর—তবু কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। তোমার মনে যে চিন্তা রূপ নিয়েছে, দেখবে তা অনেকের মনকে আন্দোলিত করছে। শাশ্বত সত্য যা, তা সকলের জন্য, সকল সময়ের জন্য। একজনের বা একটা জাতির বা একটা বিশেষ সময়ের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়। তবে এক একটা যুগে আমরা এক একটা চিন্তার প্রাধান্য দেখতে পাই। স্বামীজীর সেই ঐতিহাসিক চিকাগো বক্তৃতার মধ্যে দেখতে পাই তিনি বলছেন: দ্বন্দ্ব নয়, বিবাদ নয়, প্রতিযোগিতা নয়—সহযোগিতা, আদানপ্রদান। বলছেন: একটু আগে গির্জায় যে ঘণ্টাধ্বনি উঠল, সেই ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বিভেদ মুছে যাক, সমস্ত রেষারেষি মুছে যাক। সেই বাণী, সেই সমন্বয়ের বাণী, যা স্বামীজী সেদিন আমাদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন, যা তিনি পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে—সেই বাণীর তরঙ্গ আজও ভেসে বেড়াচ্ছে, সেই চিন্তার তরঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে ইতস্তত। ভেসে বেড়াচ্ছে যেন একটা আশ্রয়ের সন্ধানে। অনুকূল আশ্রয় পেলেই সেই চিন্তার তরঙ্গ এসে বাস্তব রূপ নেয়, একটা রেডিওসেটের মধ্যে যেমন ভাসমান শব্দতরঙ্গ এসে আশ্রয় নেয়। বাস্তবিক, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের যে চিন্তাধারা এ একটা নৈর্ব্যক্তিক জিনিস। এর জন্য সঙ্ঘের কোন প্রয়োজন নেই, এর জন্য কোন ব্যক্তির প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে যে সারবস্তু আছে নিজের শক্তিতেই তা ছড়িয়ে পড়বে, ব্যাপ্ত হবে, সকলের মনকে ধীরে ধীরে আন্দোলিত করবে। আমরা চাই বা না চাই, বুঝি বা না বুঝি এই কাণ্ড, এই প্রকাণ্ড কাণ্ড—এ চলতেই থাকবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ যে সমন্বয়ের কথা বলেছেন সে কি কোন ? আমরা তো কবে থেকেই শুনে আসছি ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’।২৩ একথা তো আমাদের শ্রুতিতেই রয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। শ্রীরামকৃষ্ণ সেটাকে তুলে ধরলেন আমাদের সামনে। তাঁর অলৌকিক সাধনার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটা আমাদের সামনে পরিস্ফুট করে তুললেন। স্বামীজী ঠাকুরকে প্রণাম জানিয়ে বলছেন: ‘স্থাপকায় চ ধর্মস্য’। ধর্মের সংস্থাপনা করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কোন বিশেষ ধর্ম নয়, যা নাকি সব ধর্মের সার কথা, প্রেম-পবিত্রতা-ঈশ্বরানুরাগ-বৈরাগ্য-ভক্তি-ভালবাসা, সমস্ত মানবজাতির যা ধর্ম, সেই ধর্ম তিনি স্থাপন করলেন। স্বামীজী আবার বলছেন: ‘সর্বধর্মস্বরূপিণে’। সকল ধর্মের স্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণ। সব ধর্মের সমন্বয় ঘটেছে তাঁর মধ্যে, সব ভাবের সমন্বয় ঘটেছে তাঁর মধ্যে। বৈষ্ণবরা যখন তাঁর কাছে যাচ্ছেন, তাঁরা দেখছেন শ্রীরামকৃষ্ণ বৈষ্ণবকুলতিলক। শাক্তরা যখন তাঁর কাছে যাচ্ছেন, তখন তিনি শাক্তচুড়ামণি। আবার অদ্বৈতবাদী গিয়ে দেখছেন, শ্রেষ্ঠ বেদান্তী শ্রীরামকৃষ্ণ। সব মত সব পথ গিয়ে এক জায়গায় মিশেছে। তাঁর সম্বন্ধে একজন বলছেন: Federation of Religions. আবার স্বামীজী বলছেন: Parliament of Religions. তাঁর মধ্যেই ঘটেছে ধর্মমহাসম্মেলন। রোমাঁ রোলাঁ বলছেন: The symphony of India. বহু বাদ্যযন্ত্র একসাথে বাজছে, কিন্তু সব মিলিয়ে শুধু একটা সুর শুনছি আমরা। ধর্মজগতে শ্রীরামকৃষ্ণ সেই ঐকতান। আবার রবীন্দ্রনাথ প্রণাম নিবেদন করছেন: ‘বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।’ বাস্তবিক, শ্রীরামকৃষ্ণ যেন দু-হাত বাড়িয়ে ছুটে চলেছেন—কাউকে বর্জন করবেন না, কোন চিন্তা, কোন মত, কোন পথকে তিনি বাদ দেবেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ এক বিরাট সর্বগ্রাসী আলিঙ্গন।

আকর-তালিকা

 । মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ৩/২/৯

 । ব্রহ্মজ্ঞানাবলীমালা, শঙ্করাচার্য, ২১

 । ব্রহ্মানুচিন্তন, শঙ্করাচার্য, ২৬

 । ঐ, ৫

 । বিবেকচূড়ামণি, ১১

 । ভাগবত, ৯/৪/৪৬

 । New Testament, Revelation of Saint John the divine, Chapter 3, Verse 20 (The Holy Bible, Authorized or King James Version, 1948)

 । পাতঞ্জল যোগসূত্র, ১/২

 । ব্ৰহ্মজ্ঞানাবলীমালা, ২১

১০। ছান্দোগ্যোপনিষদ্‌, ৩/১৪/১

১১। বিষ্ণুপুরাণ, ১/১৯/৯

১২। উদ্ধৃত: গুরুগীতা ও স্তোত্রমালা, ১৩৪৬, হরিদ্বার ভোলানন্দ সন্ন্যাসাশ্রম কর্তৃক প্রকাশিত। সঙ্কলন: রাজকুমার দে।

১৩। চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪র্থ পরিচ্ছেদ

১৪। কুলার্ণবতন্ত্র, ৬/৭৩

১৫। চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৫ম পরিচ্ছেদ

১৬। C.w., Vol. I, 1984, p. 257

১৭। C.w., Vol. III, 1964, p. 33

১৮। শিবমহিম্নঃস্তোত্র, ৭

১৯। Quoted from ‘Universal Prayers’ by Swami Yatiswarananda, 1977, Verse no. 306

২০। C.w., Vol. VII, 1964, p. 43.

২১। Reminiscences of Swami Vivekananda by His Eastern and Western Admirers, 1983, pp. 26-7

২২। বাণী ও রচনা, ৩য় খণ্ড, ১৯৮০, পৃঃ ১৭৮-৭৯

২৩। ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৬

* রামকৃষ্ণ সরে যে প্রতীকচিহ্ন মঠ-মিশনের প্রকাশিত সমস্ত পুস্তক-পুস্তিকা প্রভৃতিতে দেখা যায়, তার পরিকল্পনা করেছিলেন স্বামীজী স্বয়ং। স্বামীজী নিজে প্রতীকটির অর্থ এইভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন: ‘চিত্রস্থ তরঙ্গায়িত সলিলরাশি—কর্মের, কমলগুলি—ভক্তির এবং উদীয়মান সূর্যটি— জ্ঞানের প্রকাশক। চিত্রগত সৰ্পপরিবেষ্টনটি যোগ এবং জাগ্রত কুণ্ডলিনীশক্তির পরিচায়ক। আর চিত্ৰমধ্যস্থ হংসপ্রতিকৃতিটির অর্থ পরমাত্মা। অতএব কর্ম ভক্তি ও জ্ঞান—যোগের সহিত সম্মিলিত হইলেই পরমাত্মার সন্দর্শন লাভ হয়, চিত্রের ইহাই অর্থ।১(বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, ১৩৮৪, পৃঃ ১৯০; এ ছাড়াও মিস ম্যাকলাউডকে লেখা স্বামীজীর ২৪/৭/১৯০০ তারিখের চিঠি দ্রষ্টব্য, বাণী ও রচনা, ৮ম খণ্ড, ১৩৮৪, পৃঃ ১৪৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *