যতীনবাবুর বাগান – দীপান্বিতা রায়
যতীনবাবুর মনে কোনো শান্তি নেই। রিটায়ার করে নিরিবিলিতে থাকবেন বলে শহরগুলিতে একখানা বাড়ি কিনেছেন। ছিমছাম দোতলা বাড়ি। সামনে-পিছনে অনেকখানি বাগান। বাড়িতে আগের মালিকই নানারকম গাছপালা লাগিয়েছিলেন। যতীনবাবুর খুব বাগানের শখ। তাই আগের গাছতো কাটেননি বরং নিজেও নানারকম নতুন চারা লাগিয়েছেন। মোটা মানুষ। তাই বাগানের দেখাশোনা করার জন্য মালিও রাখা হয়েছে।
নিজেরা এমনিতে ঝাড়া হাত-পা। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা নমাসে-ছমাসে আসে। বাড়িতে লোক বলতে যতীনবাবু নিজে, তাঁর স্ত্রী আর বাপের আমলের চাকর নিবারণ। অবসর নেওয়ার পর বাগান করে, বই পড়ে জীবনটা বেশ খুশিতে কাটিয়ে দেবেন বলেই বাড়িটা কিনেছিলেন যতীনবাবু। কিন্তু এখন এই বাগানই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর অশান্তির কারণ।
পিছনের বাগানে নানারকম ফলের গাছ। আম, জাম, পেয়ারা, জামরুল, পেঁপে। গাছে প্রচুর ফল হয়। পাকে, কিন্তু তার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ যতীনবাবুর খুব একটা হয় না। এই তো কদিন ধরেই দেখছিলেন, গাছের পেঁপেটা কমলা রঙ ধরেছে। ভেবেছিলেন নিবারণকে বলবেন পেড়ে রাখতে। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া যাবে। গাছপাকা পেঁপের স্বাদই আলাদা। কিন্তু নিবারণকে আর বলার সুযোগই হল না। তার আগেই গাছ থেকে পেঁপে হাওয়া। রেগে আগুন হয়ে সারাবাড়ি দাপিয়ে বেড়ালেন যতীনবাবু। পেঁপে চোরকে ধরতে পারলে পুলিশে দিয়ে জেল খাটাবেন একথাও ঘোষণা করলেন। কিন্তু লাভ হল না কিছুই। চোরের সন্ধান মিলল না।
তবে সবসময়ই যে এমন চুপেচাপে চুরি হয় তা নয় মোটেই। ডাকাতিও হয়। সেদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ছাতে বেড়াছিলেন যতীনবাবু। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর শীতল হয়, মন প্রশান্ত থাকে। হঠাৎ দেখেন পেয়ারা গাছের মাথাটা নড়ছে। তখুনি ছুটে গিয়ে ছাদের পাঁচিল ধরে ঝুঁকে পড়তেই দেখা গেল, সাদা প্যান্ট-সবুজ জামা। দিব্যি গাছে চড়ে বসেছে। ব্যাস আর যায় কোথায়; অমনি এক বোম্বাই হাঁক ছাড়লেন যতীনবাবু, ”অ্যাই কে রে?” ”আমি পিন্টু”—নির্ভীক উত্তর। ”কী করছিস ওখানে? নাম শীগগির।” ”পেয়ারা পাড়ছি তো। টিফিনের পয়সা দিয়ে আইসক্রিম খাবো না!” মর্নিং স্কুল। মা টিফিনের জন্য যে পয়সা দিয়েছে তা দিয়ে আইসক্রিম খাওয়া হবে। তাই টিফিনে খাওয়ার জন্য যতীনবাবুর গাছ থেকে পাকা পেয়ারা পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
পিন্টুর কথার মর্মোদ্ধার করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লেগেছিল যতীনবাবুর। তারপরই রাগে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয় একটা কিছু ছুঁড়ে মারার চেষ্টায় হাত গিয়ে পড়ল হাঁড়িতে রাখা খোল পচা জলে। ছাতের কলে হাত ধুয়ে কোনোরকমে ছুটতে ছুটতে যতীনবাবু যখন নীচে নামলেন, পিন্টু তখন স্কুলে গিয়ে ক্লাসে বসে পড়েছে।
”এই পিন্টুর মা-বাবার কাছে নালিশ করব আমি। নিবারণ, এখনই যা ওর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়।” ”কার বাবাকে ডাকবো? পিন্টুকে তো চিনিই না। রাস্তা দিয়ে কত ছেলেপুলে যায়। তাদের বাড়িঘর জেনে বসে আছি নাকি আমি!” নিবারণের কথায় আগুনে যেন ঘি পড়ল। চিড়বিড় করে উঠে যতীনবাবু বললেন, ”তবে যা স্কুল থেকে ধরে নিয়ে আয়। মর্নিং স্কুল।” ”কোন স্কুল, কোন ক্লাস জানোতো? এপাড়ায় কিন্তু তিন-চারটে মর্নিং স্কুল আছে।” স্ত্রীর ঠান্ডা গলা শুনে যতীনবাবু বুঝে গেলেন পিন্টুর খোঁজ পাওয়া কঠিন। কিন্তু হেরে যেতে তিনি রাজি নন। তাই ঠিক করলেন নিজের ঘর নিজেই সামলাবেন।
ডাক পড়ল নিবারণের। ”গাছের সব পেয়ারা পেড়ে ফেল।” হুকুম দিলেন যতীনবাবু। ”তারপর অত পেয়ারা কী হবে?” গিন্নি জানতে চান। ”চালের মধ্যে রেখে দেবে। পেকে গেলে খাব।” ”অত পেয়ারা পাকতে হলে আগে বড়ো বড়ো দুখানা ড্রাম ভরে চাল কিনে এনো। মোটা চাল আনাই ভালো। পেয়ারার গন্ধ হলে সে চাল তো আর ভাত খাবার যুগ্যি থাকবে না।” ”তা ছাড়া ওষুধ-পথ্যিরও যোগাড় করতে হবে।” পোঁ ধরে নিবারণ, ”অত অত পেয়ারা খেয়ে বাবুকে যদি আবার ঘনঘন বাথরুম যেতে হয় তাহলে তার ব্যবস্থাও আগে থাকতি করি রাখা চাই।” ”ও। তার মানে তোমাদের আসল কথা হল গাছের ফল-পাকুর ওইসব ভূত-প্রেতদের ভোগেই লাগবে।” ”বালাইষাট। ভূত-প্রেত হতে যাবে কোন দুঃখে। খাবার জিনিস, ছেলেপুলেরা খেয়েছে, এতে অত রাগের কী আছে বাপু।” গিন্নির কথা শুনে রাগে গুমগুম করতে করতে ঘরে চলে যান যতীনবাবু।
গিন্নি আর নিবারণই যে আসলে ঘরশত্রু বিভীষণ, এমন সন্দেহ তাঁর অনেকদিন ধরেই হচ্ছিল। হাতে-নাতে দু-একবার প্রমাণও যে মেলেনি তাও নয়। এই তো সেবার গাছে একটা মস্ত মর্তমান কলার কাঁদি পড়ল। সময় থাকতে সেটাকে কাটিয়ে ঘরে তুলেও রেখেছিলেন। চমৎকার সোনালি রঙের কলা। মুখে দিলে যেন মাখনের মতো গলে যায়। এবেলা-ওবেলা খাচ্ছেন দিব্যি। ওমা! সেদিন বিকেলে বাজার থেকে ফেরার সময় দেখেন গেটের কাছে পাঁচ-সাতটা ফ্রক আর হাফপ্যান্ট মিলেমিশে দাঁড়িয়ে। গিন্নি তাদের কলা বিলোচ্ছেন। যতীনবাবু প্রায় বাঘের মতো গাঁক করে পড়ে হুংকার দিলেন, ”কী হচ্ছে এসব অ্যাঁ? ”ছেলেগুলো তো সঙ্গে সঙ্গে দে-দৌড়। গিন্নি কিন্তু নির্বিকার। বলে কী না, ”অনেকগুলো কলা পেকে উঠেছিল। তাই ভাবলাম ছেলেগুলোকে দিই। বিকেলে খেলাধুলো করে ক্ষিদে পায় তো।” ”না দেবে না। দিতে পারবে না। আমার হুকুম।” হুকুমটি জারি করে ঘরে ঢুকলেন যতীনবাবু। পিছন পিছন গিন্নি। আর ঢুকেই ডাক দিলেন, ”নিবারণ একবার এদিকে আয় তো বাবা। চিলেকোঠার ঘর থেকে বড়ো ঝুড়িটা পেড়ে আন।” ”কেন গিন্নিমা?” জানতে চাইল নিবারণ। ”ঝুড়িতে কলাগুলো ভালো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখ। তোর বাবু সকালে বাজার বসলে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বেচে আসবে। নাহলে দুদিন বাদে পচা কলার গন্ধে বাড়িতে টেঁকা যাবে না। হ্যাঁ গা, গাছে জামরুলও হয়েছে অনেক। খানিক দিয়ে দেব, ঝুড়িতে গুছিয়ে?” এরপর গিন্নিকে যদি যতীনবাবুর ঘরশত্রু বিভীষণ মনে হয় তাহলে নেহাৎ দোষ দেওয়া যায় না।
তবে ইদানীং যতীনবাবুর দুশ্চিন্তাটা খুব বেশি বেড়ে গেছে। সামনেই সরস্বতী পুজো। এদিকে এবার শীতে সারা বাগানে থরে থরে ফুল ফুটেছে। গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া কী নেই সেখানে। ছোটো ছোটো টব যেন আলো হয়ে আছে। এসব ফুল ঠাকুরের পুজোয় লাগে না। তাই বেশ খানিকটা নিশ্চিন্তই ছিলেন। কিন্তু চাঁদা নিতে এসে পাড়ার ছেলেরা যখন বলে বসল, ”মেসোমশাই কয়েকটা টব দেবেন, প্যান্ডেলে সাজাব?” তখন তো যতীনবাবুর চুল খাড়া। সেই মুহূর্তে তাদের দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলেন ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে ভয় ঢুকল। টবসুদ্ধ যদি চুরি করে নিয়ে যায়, তাহলে কী করে আটকাবেন? টবের গায়ে তো আর নাম লেখা নেই। ফুলের গায়েও নেই।
অনেক ভেবে-চিন্তে যতীনবাবু দেখলেন টব চুরি আটকানোর একমাত্র উপায় হল পাহারা দেওয়া। পুজোর অন্তত দুদিন আগে থেকে। কিন্তু পাহারাটি দেবে কে? নিবারণকে বিশ্বাস করা যায় না। সে তো চোরেদেরই দলে। তিনি নিজেও ভারি ঘুমকাতুরে, তার উপর তাঁর আবার বেজায় ভূতের ভয়। তাহলে কাকে বলবেন পাহারা দিতে? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যতীনবাবুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি সোজা চলে গেলেন স্টেশনের কাছে বিহারী পালোয়ানদের কুস্তির আখড়ায়। সবকথা শুনে আখড়ার মালিক হাঁক পাড়লেন, ”এই ভীমা ইধার আও।” এমনি এক বিরাট মুশকো পালোয়ান এসে হাজির। ইয়া তার ছাতি, ইয়া গোঁফ। মালিক বললে, ”ইয়ে ভীমাকে লিয়ে যান বাবু। সব বাচ্চা ডরকে মারে ভাগবে।” কথাটা মনে ধরল যতীনবাবুর। সত্যিই ভীমার পাশে পাড়ার ছোঁড়াগুলো যেন নেংটি ইঁদুর। দরদস্তুর করে ঠিক হল, সরস্বতী পুজোর আগের দু-রাত বাড়ি পাহারা দেবে ভীমা। প্রতিরাতের জন্য তাকে দিতে হবে 100 টাকা। সব ঠিকঠাক করে বাড়ি ফিরলেন যতীনবাবু। কিন্তু কথাটা কাউকে বললেন না, গিন্নিকেও না।
যথারীতি সরস্বতী পুজোর দুদিন আগে রাত আটটা নাগাদ, হাতে একটা মস্ত লাঠি নিয়ে ভীমা এসে হাজির। তাকে দেখে গিন্নি তো অবাক। যতীনবাবুই এগিয়ে এসে বললেন, ”বুঝলে এ হল গিয়ে ভীমা, মস্ত পালোয়ান। এখন দু-তিনদিন ও রাতে বাড়ি পাহারা দেবে। পাড়ার ছোঁড়াগুলো যাতে ফুলটুল চুরি করতে না পারে, তাই আর কী…।” গিন্নির মুখ দেখে ভালো-মন্দ কিছুই বোঝা গেল না। যতীনবাবু আরও একটু উৎসাহী হয়ে বললেন, ”আমিও একয়দিন নীচের ঘরেই শোবো বুঝলে। ছোঁড়াগুলো যদি আসে আর ভীমা ওদের তাড়াতাড়া করে, তাহলে ওকে সাহায্য করতে পারবো।” গম্ভীরভাবে পান মুখে দিয়ে গিন্নি এবার বললেন, ”দেখো বুড়ো বয়সে ছোটাছুটি করতে গিয়ে আবার হাত-পা ভেঙো না যেন।”
প্রথম রাতটা কাটল নির্বিঘ্নেই। ভীমা একটু পরে পরেই উঠে বাগানে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিয়েছে। মাঝে মাঝে হাঁকও পেড়েছে। ফুলচোরদের কাউকে আশেপাশে দেখা যায়নি। যতীনবাবুর আশা, …দ্বিতীয় রাতও নির্বিঘ্নে কাটবে। ভীমার চেহারা দেখে ছেলেপিলেরা কেউ বাড়ির কাছ ঘেঁষবে না।
শুক্লা পঞ্চমীর আগের রাত। আকাশে অল্প চাঁদের আলো। মাঘ মাসের শেষদিক হলেও এখনও ঠান্ডা আছে বেশ। ভীমা তাই মোটা একটা আলোয়ান জড়িয়ে যতীনবাবুর ঘরে ঢোকার সদর দরজার সামনে যে দুধারে সিঁড়ি আছে সেখানে বসেছে। ঠিক ওপারেই দোতলার ঝুলবারান্দা। রাত বাড়ছে। চারপাশ শুনশান। হালকা কুয়াশায় রাস্তার আলোগুলো ঝাপসা। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে একটু ঢুলুনি এসেছিল ভীমার। হঠাৎ মনে হল নাকে কীসে যেন সুরসুরি দিচ্ছে। তক্ষুণি চোখ খুলেই তো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। তার ঠিক সামনে শূন্যে ঝুলছে একটা নরকঙ্কাল। সাদা সাদা হাড়ের আঙুল দিয়ে ইশারা করে ডাকছে তাকে। কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই ”বাপ রে মর গয়া” বলে বিকট এক চিৎকার করে উঠে প্রাণপণে দরজা ধাক্কাতে লাগল ভীমা। ফুলচোর ধরা পড়েছে ভেবে ছুটে এসে দরজা খুললেন যতীনবাবু। অমনি ”ভূত ভূত-মর গয়া” বলে চেঁচিয়ে তাঁকে জাপটে ধরল ভীমা। ভূত পাছে ঘরে ঢুকে পড়ে, এই ভয়ে কোনোরকমে তাকে টেনে সড়িয়ে দরজাটা বন্ধ করলেন যতীনবাবু। কিন্তু আলো জ্বালালে যে ভূত পালায় সেকথা মাথায় এল না। তাই অন্ধকারেই দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে চেঁচাতে লাগলেন। যতক্ষণ না নিবারণ এসে সুইচ টিপল।
ভীমা আর কিছুতেই বাইরে যেতে রাজি হল না। বাড়িতে যে ভূত আছে সেকথা বাবু আগে বলেনি বলে মহা রাগমাগও করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত নিবারণবাবুর ঘরের মেঝেতে একটা সতরঞ্চি বিছিয়ে তার ওপর কম্বল পেতে দিল নিবারণ। সেই কম্বলে বসে সারারাত সজোরে সীতারাম জপ করতে লাগল ভীমা। খাটে শুয়ে বিড়বিড় করে রামরাম জপ করতে লাগলেন যতীনবাবুও।
সরস্বতী পুজোর বিকেল। গিন্নি গেছেন পাড়ার প্যান্ডেলে বাচ্চাদের বিচিত্রানুষ্ঠান শুনতে। আগের দিন রাতে বাগানের সব টব চুরি হয়ে গেছে। তবে তা নিয়ে যতীনবাবুর আর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। দোতলার ঝুলবারান্দায় মনমরা হয়ে বসে তিনি শুধু ভাবছেন, এই ভূতের বাড়িতে তো আর থাকা চলবে না। এত শখ করে কেনা বাড়িটা তাহলে বিক্রিই করে দিতে হবে। এমন সময় নজরে পড়ল বারান্দার রেলিংয়ে জড়িয়ে আছে খানিকটা কালো সুতো। কী রকম যেন সন্দেহ হল যতীনবাবুর। উঠে গিয়ে গিন্নির ঘরটা খুঁজতে লাগলেন। বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না। আলমারির পিছনটা হাতড়াতেই বেরিয়ে এল কালো চার্ট পেপারের ওপর সাদা পোস্টার কালারে আঁকা নরকঙ্কাল। পিছনে ঝাঁটার কাঠি লাগানো সরু সরু দুটো হাত, দুপাশে ল্যাকপ্যাক করে ঝুলছে।